হানড্রেড রোমান্টিক নাইটস্ – গিয়ােভানি বােকাসিও (সপ্তম দিন)

›› অনুবাদ  ›› ১৮+  

গিয়ােভানি বােকাসিও-র ডেকামেরন টেলস এর বাংলা অনুবাদ।

ডেকামেরনের সপ্তম দিবস আরম্ভ হল। এ দিনের রাজা মনােনীত হয়েছে ডায়ােনিও। গল্প বলার বিষয় সে নির্বাচন করে দিয়েছে। অবৈধ প্রেম বা কোনাে অপকর্মের জন্য স্বামীর কাছে ধরা পড়ে গেলে স্ত্রী কি কৌশলে স্বামীকে ধোঁকা দিতে পারে সেই বিষয় অবলম্বন করে গল্প বলতে হবে।

একে এসে সব তারা অবলুপ্ত হয়ে গেছে, শুধু ভােরের শুকতারা তখনও আকাশে জ্বলজ্বল করছে। ভাের হতে আরম্ভ করেছে। পাখিরা গান শুরু করেছে, ভােরের বাতাসে গাছের পাতা তিরতির সুরে কাপছে। স্টুয়ার্ড উঠে পড়েছে। সে অন্য পরিচারক ও পরিচারিকাদের ডাকাডাকি করছে। আজ অধিবেশন বসবে সেই রম্য উপত্যকায়। সেখানেই খাওয়াদাওয়া হবে ও দ্বিপ্রহরে শয়ন ও নিদ্রার ব্যবস্থা করতে হবে। অনেক মালপত্র বয়ে নিয়ে যেতে হবে। রান্নাও সেখানেই হবে। ঘােড়া ও গাধার পিঠে মালপত্র চাপাতে হবে।

স্টুয়ার্ডের হাঁকডাকে যুবক-যুবতীদেরও ঘুম ভেঙে গেল। আজ ডায়ােনিও রাজা, তাই তাকেই সবার আগে শয্যা ত্যাগ করতে হল। সকলের কাজের তদারক শুরু করলাে ও ফাকে ফাকে বন্ধু ও বান্ধবীদের নাম ধরে ডাকাডাকি করতে লাগলাে, সবাই উঠে পড়াে। রােদ ওঠবার আগেই আমরা সেখানে পৌছতে চাই।

সকলে তাড়াতাড়ি শয্যাত্যাগ করে প্রস্তুত হয়ে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে যাত্রা আরম্ভ করলাে। লাল সূর্য তখন সবে পুব আকাশে উঁকি মারছে।

পথ চলতে চলতে ভােরের পাখির গান তাদের কী ভালােই লাগছিল। তারাও থাকতে পারলাে না, মৃদুস্বরে সমবেত কণ্ঠে ভৈরবী সুরে গান ধরলাে। ঝিরঝির করে বাতাস বইছে, যেন কেউ ভালবেসে তাদের সঙ্গে কোমলভাবে হাত বুলিয়ে আদর করছে। প্রত্যুষে উঠে বেড়ানাে যে এত আনন্দময় হতে পারে তা তারা আজই অনুভব করলাে।

গতকাল এসেছিল ওরা দ্বিপ্রহরে কিন্তু আজ এলাে ডােরে, উপত্যকার রূপই আলাদা। সে যে কী অপরূপ তা বর্ণনা করার ভাষা তারা খুঁজে পাচ্ছে না। তাদের আজ খুব ভালাে লাগছে। তারা আফশােস করতে লাগল আগেই তারা উপত্যকাটির সন্ধান পায়নি কেন।

নতুন পরিবেশে সবই নতুন। আজ ওদের সাজপােশাক তাে ভিন্ন বটেই এমনকি আজকের ভােজনের ব্যবস্থাও সম্পূর্ণ অন্যরকম, অনুষ্ঠানসূচিও নতুন।

যতক্ষণ প্রাতরাশ তৈরি হচ্ছিল ও টেবিল-চেয়ার সাজানাে হচ্ছিল সেই সময়টা ওরা সকলে মহানন্দে হাত ধরাধরি করে নেচে গেয়ে অতিবাহিত করলাে আর সেই সঙ্গে চোখ ভরে উপভােগ করতে লাগল অপরূপ প্রাকৃতিক শােভা। সবচেয়ে ভালাে লাগলাে গাছের পাতার ফাকে ফাকে কচি রােদেব জলে ছােট ছােট মাছের সন্তরণ লীলা।

একসময়ে প্রাতরাশ শেষ হল তারপর শুরু হল সঙ্গীত। সঙ্গীত, নৃত্য ও খেলা চললাে যে পর্যন্ত না দ্বিপ্রহরের ভােজন পরিবেশন করা হল।

ইতিমধ্যে পরিচাকরা গাছের ছায়ায় সকলের শয়নের ব্যবস্থা করেছিল। কেউ সুখনিদ্রা উপভােগ বলো, কেউ অপরের সঙ্গে গল্প করতে লাগলাে।

একসময়ে কিং ডায়ােনিও হাক দিল, উঠে পড়াে সবাই। গল্প বলার সময় হয়েছে। সকলে উঠে তৈরি হরে এসে সবুজ নরম ঘাসের ওপর বসলাে। ডায়ােনিও বললাে, এমিলিয়া আজ প্রথম গল্পটা তুমিই বলো।

 

প্রথম গল্প

জিয়ান্নি লােটারিঙ্গি রাত্রে শুনলাে বাইরের দরজায় কে বুঝি টোকা মারছে। সে তার বৌকে জাগিয়ে তুলে বলল, দেখ তাে দরজায় কে টোকা মারছে। বৌ উঠে দেখে এসে বলল, ওটা একটা ওয়েরউলফ, নেকড়েবেশী মানুষ। তারা উভয়ে প্রার্থনা আরম্ভ করলাে। দরজায় আওয়াজ থেমে গেল।

এমিলিয়া খুব পুলকিত। ডায়ােনিওকে ধন্যবাদ জানিয়ে সে বলল নতুন বিষয়ে প্রথম গল্পটা অন্য কাউকে বলতে না বলে আমাকেই বলতে বলল এজন্যে আমি নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করছি। বেশ, আমি তােমাদের মনােরঞ্জনের চেষ্টা করবাে। এমন একটা গল্প বলবাে যা থেকে আমরা কিছু শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি এবং ভবিষ্যতে সাবধানও হতে পারি, বিশেষ করে সেইসব নরনারীর হাত থেকে যারা নিজেদের নেকড়ে বাঘে রূপান্তরিত করতে পারে। জানি না ওরা কি করে নিজেদের হিংস্র পশুতে রূপান্তরিত করতে পারে কিন্তু তাদের দেখা তাে দূরের কথা নাম শুনলেই আমার বুক কেঁপে ওঠে। তবে যদি তােমরা কখনও এমন অদ্ভুত জীবের সম্মুখীন হও তাহলে কী করে নিষ্কৃতি পাবে তার ইঙ্গিত পাবে, তা বলে আমার গল্প শুনে তােমাদের ভয় পাবার কিছু নেই।

ফ্লোরেন্স শহরের স্যান প্যানক্রেজিও পাড়ায় জিয়ান্নি লােটারিঙ্গি নামে একজন ওস্তাদ তাতি বাস অতাে। লােকটি খুব সরল। নিজের কাজ সে খুব ভালাে বুঝতো; তার কাজের সকলে প্রশংসা করতাে কিন্তু বৈষয়িক বিষয়ে সে মােটেই চতুর ছিল না। কেউ তার প্রশংসা করলে নিজেকে কেউকেটা মনে করতো এবং অনেকে তার সারল্যের সুযােগ নিয়ে কাজ আদায় করে নিত।

হাতের সে দক্ষ শিল্পী ছিল, এ ছাড়া তার আর একটি গুণ ছিল। সে গান গাইতে পারতাে বিশেষ করে গির্জার পবিত্র প্রার্থনাসঙ্গীত। সমবেত কণ্ঠে যখন প্রার্থনা-গীত গাওয়া হতাে তখন সে নেতৃত্ব অতাে। গান ব্যতীত তাকে গির্জার অন্য কিছু কাজ করতে দেওয়া হতাে। শুধু বলার অপেক্ষা মাত্রই সানন্দে সে কাজ সম্পন্ন করতাে। তার একটু খােশামােদ করে যাজকরা তার কাছ থেকে কিছু সামগ্রী বিনামূল্যে আদায় করে নিত। যাজকদের সে মাঝে মাঝে ভােজে আপ্যায়িত করতাে।

যাজকরাও তাকে একেবারে বঞ্চিত করতাে না। তাকে কিছু ধর্মীয় পুস্তক ও প্রার্থনাসঙ্গীতের স্বরলিপি উপহার দিয়েছিল। জিয়ান্নি সেগুলি সযত্বে রক্ষা করতে এবং বন্ধুদের দেখিয়ে গর্ব অনুভব করতাে।

জিয়ান্নির বৌটি ছিল সুন্দরী, বুদ্ধিমতী ও চতুর। তার ছলাকলায় যে কোনাে পুরুষ সহজে বশ হতাে। সুন্দরী এই নারীর নাম ছিল মােন্না টেসা, মানুচ্চিও ডান্না চুচুলিয়ার কন্যা।

মােন্না তার স্বামীকে নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল না। তার মতে স্বামীটি হাবাগােবা, বােকা ও পৌরুষহীন। কখনও রাগ করতেও জানে না, ঝগড়াও করে না। এতএব ফেডরিগাে তাই নেরি পেগােলাও নামে সুদর্শন ও তাজা টগবগে এক যুবকের প্রেমে পড়লাে সুন্দরী মােন্না। ফেডরিগােও তার প্রেমে হাবুডুবু।

শহর থেকে অদূরে ক্যামেরাতা শহরতলীতে জিয়ান্নির একটা বাংলাে বাড়ি ছিল। সারা গ্রীষ্ম ঋতুটা মােন্না এই বাংলােয় বাস করতাে এবং তার এক পরিচারিকার সাহায্যে ফেডরিগােকে ডেকে পাঠিয়ে সানন্দে সময় অতিবাহিত করতাে। মাঝে মাঝে নিশিযাপন করতাে পরস্পরের বাহবন্ধনে।

জিয়ান্নিও মাঝে মাঝে দিনের কাজ সেরে সন্ধ্যায় ঐ বাংলােয় গিয়ে ওখানেই আহার করতাে, রাত্রে থাকতাে এবং সকালে শহরে ফিরে আসতাে।

ডেরিগাে মহানন্দে আছে। প্রায় রােজই মােন্নার কাছে আসে। সেদিনও সন্ধ্যায় আকাশে দু’একটা তারা দেখার সঙ্গে সঙ্গে এসে হাজির। সেদিন কিন্তু জিয়ামির আসার কথা নয়। দু’জনে একত্রে মহানন্দে সুরাপান ও ভােজন করলাে এবং এইটেই প্রথম রাত্রি যেদিন ফেডরিগাে তার বাড়িতে ফিরে গেল না। মােন্নাকে নিয়ে সারারাত্রি তারই শয্যায় শুয়ে রইলাে। সারারাত্রি তারা একবারও ঘুমােয় নি।

দুজনেরই একান্ত ইচ্ছে যে এইটেই যেন তাদের প্রথম ও শেষ রাত্রি না হয় অথচ প্রতিবার পরিচারিকাকে পাঠিয়ে ফেডরিগােকে ডেকে পাঠানো নানা অসুবিধা। লােকনিন্দারও ভয় আছে বিবাহিতা মহিলা পরিচারিকা বার বার কেন অবিবাহিত যুবকের বাড়ি যায়, তাই তারা একটা কৌশল অবলম্বন করলাে।

মােন্নার বাড়ি রাস্তার ধারে। একটা আঙুর ক্ষেত আছে।

আঙুর ক্ষেতে একটা লাঠির ডগায় একটা গাধার মাথার খুলি আটকানাে আছে। মােন্ন ফেডরিগােকে বলল, তুমি রােজ আমার বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে যাবে। গাধার খুলিটার দিকে ভালাে করে নজর করবে। যদি দেখ গাধার মুখ ফ্লোরেন্সের দিকে ফেরানাে আছে তাহলে বুঝবে জিয়ান্নি আজ আসবে না এতএব রাতে তুমি নিশ্চই আসবে। সেদিন আমরা নিরাপদ। যদি দেখাে আমার ঘরের দরজা বন্ধ তাহলে তিনবার টোকা মারবে, আমি দরজা খুলে তােমাকে ভেতরে ঢুকিয়ে নেব আর যদি কোনােদিন দেখ গাধার মুখ ফিজোল গ্রামের দিকে ঘােরানাে তাহলে খবরদার, আসবে না, জিয়ান্নি এসেছে। এইভাবে তারা মিলিত হতে থাকল। দিনে রাতে আনন্দসাগরে হাবুডুবু খায়।

একদিন অঘটন ঘটে গেল। সেদিন রাত্রে মােন্নার বাড়িতে ফেডরিগাে আসবে, রাতের আহার তার সঙ্গেই করবে এবং পরদিন সকালে বাড়ি ফিরবে তাই মােন্না আহারের বিশেষ আয়ােজন করলাে। ফেডরিগাে ভালবাসে তাই এক জোড়া খাসি মােরগ রােস্ট করলাে কিন্তু সন্ধ্যার বেশ কিছু পরে স্বয়ং জিয়ান্নি এসে হাজির। মােন্না তাে মনে মনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলাে। তার আসবার কোনাে সম্ভাবনা ছিল না কিন্তু অকস্মাৎ এসে হাজির। কি আর করা যাবে। মনে মনে গজগজ করলেও হাসিমুখে বলতে হল, এসেছাে? বেশ করেছে। আমারও মন বলছিল তুমি আজ আসবে।

এসেই পড়েছাে যখন তখন এস দু’জনে বসে খাই। মােন্না ঐ মােরগের রােস্ট ছাড়াও নোনা মাংস রান্না করেছিল। সে আর তার স্বামী নােনা মাংসই খেল, প্রেমিকের জন্যে মােরগ রােস্ট স্বামীকে মন ভরে দিতে পারলাে না।

জোড়া মােরগের রােস্ট, তাজা ডিমের তরকারি আর এক বােতল সেরা সুরা সাদা একটা টেবিলক্লথ দিয়ে বেশ করে প্যাক করে তার পরিচারিকাকে বললাে, বাগানে যে পিচগাছটা আছে তার গােড়ায় এগুলাে রেখে আয়। পিছনের দরজা দিয়ে যা। মােন্না তখন এতই বিচলিত যে পরিচারিকাকে বলতে ভুলে গেল যে ডেরিগাে না আসা পর্যন্ত তুই পিচগাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকবি। সে এলে খাবারগুলাে তার হাতে তুলে দিয়ে কবি যে কর্তা হঠাৎ এসে গেছে, তুমি আজ ফিরে যাও, এগুলাে তােমার জন্যেই রান্না করা হয়েছিল। বাড়িয়ে গিয়ে খেয়ো, আমার কর্তী খুশি হবে। আসল এই কথাগুলাে বলতেই মােন্না টেসা ভুলে গেল।

ওদিকে রাত্রি অনেকটা এগিয়ে গেছে। জিয়ান্নি আর মােন্না শুয়ে পড়েছে। তাদের পরিচারিকাও নিজের ঘরে শুয়ে এতক্ষণে নাসিকা গর্জন করছে।

এদিকে ফেডরিগাে এসেছে। মােন্নার ঘরের দরজা বন্ধ দেখে তিনবার টোকা মেরেছে। জিয়ান্নি প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিল কিন্তু দরজা তাদের খাট থেকে কাছেই তাই আওয়াজ শুনেই তার ঘুম ভেঙে গেল। মােনার চোখে তখনও ঘুম আসে নি। স্বামীকে ধােকা দেবার জন্যে মটকা মেরে পড়েছিল। স্ত্রীকে সন্দেহ করবার কোনাে কারণই ঘটে নি, জিয়ান্নি হয়ত ভেবেছিল কোনাে কারণে তার স্ত্রীর পরিচারিকা তাকে

ডাকছে।

ফেডরিকো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার তিনবার টোকা মারল। এবার জিয়ান্নি তার স্ত্রীকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল, টেসা শুনতে পাচ্ছ? দরজায় কে টোকা মারছে?

টেসা তাে আগেই শুনেছে কিন্তু আওয়াজ শােনার সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লে জিয়ান্নি যদি সন্দেহ করে এজন্যে সে ইচ্ছে করে ঘুমের ভান করছিল। এখন যেন ঘুম ভাঙল, হাই তুলতে বললাে, উ, কি হল? কি বলছাে?

বলছি কি দরজায় কে টোকা মারছে?

মােন্না যেন ভীষণ ভয় পেয়ে গেল, আঁ? বলাে কি? টোকা মারছে দরজায়? তাহলে তাে সেই নেকড়েরূপী মানুষটা এসেছে। পশুটা ক’দিন ধরে আমাকে জ্বালাতন করছে। আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছে। ভয়ে আমি চাদরের মধ্যে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকি।

জিয়ান্নি বলল, ভয়ের কি আছে? এইরকম পশু তাড়াবার প্রার্থনা আমি জানি, সেই প্রার্থনা করছি। তারপর পরম পিতা, পরম পুত্র ও হােলি ঘােস্টের নাম নিয়ে তােমার সারা বিছানায় আমি পৰিত্ৰ ক্রুস চিহ্ন এঁকে দিচ্ছি, কেউ তােমার ক্ষতি করতে পারবে না।

ঠিক আছে, যা পারাে করাে। অন্যদিন তাে আমি একা থাকি, ভয়ে খাট থেকে নামতে পারি না। আমি ঐ বদ মানুষটার দেহ থেকে নেকড়েটাকে তাড়াবার মন্ত্র শিখেছি। একদিন ফিজোল গ্রামে গিয়েছিলুম। সেখানে এক পুণ্যবতী মহিলার সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভের সুযােগ হয়েছিল। আমি তাকে আর বিপদের কথা বলাতে তিনি আমাকে মন্ত্রটা শিখিয়ে দিয়েছেন। আমি এখন বন্ধ দরজার এপাশ থেকে সেই মন্ত্র তিনবার বললে বদ মানুষটার দেহ থেকে নেকড়েটা পালাবে, আর কোনােদিন ফিরে আসবে না। জিয়ান্নি মণি তুমি খাটে বসে তােমার প্রার্থনা করাে আর ক্রুস চিহ্ন অংকিত করাে। আমি দরজার এপার থেকে মন্ত্র বলে শয়তানটাকে তাড়াই। তুমি ঘরে আছে আমার ভয় কি?

ফেডরিকো তখনও আশা ছাড়ে নি, দরজায় ওপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার খাওয়া হয়নি, ক্ষিধেও পেয়েছে।

মােনা টেসা কতই যেন ভয় পেয়েছে এইরকম ভাব করে সে দরজার কাছে গিয়ে তার স্বামীকে বলল, আমি মন্ত্রবলে তােমাকে যেই থুতু ফেলতে বলবাে তুমি অমনি সশব্দে গলা খাঁকারি দিয়ে থুথু ফেলবে, বুঝলে?

বুঝেছি।

মােন্না প্রায় দরজায় মুখ রেখে মন্ত্র পাঠ করতে লাগলাে। মন্ত্র না ছাই, সে তার প্রেমিকাকে তার বক্তব্য বলতে আরম্ভ করলাে, কাকের মতাে কালাে নেকড়ে-মানুষ, আমি জানি তুমি তােমার লােকটি খাড়া করে এসেছ আমাকে ভয় দেখাতে কিন্তু তুমি বাগানে পিচগাছের নিচে ফিরে যাও। গাছের গােড়ায় তােমার খাদ্য ও পানীয় পাবে। সেগুলি তােমার বাসায় নিয়ে গিয়ে সদ্ব্যবহার করাে। আজ আমার প্রিয় স্বামী জিয়ান্নি এসেছেন।

তারপর স্বামীকে ইঙ্গিত করলাে, থুথু ফেলতে। জিয়ান্নি বেশ গলা খাঁকারি দিয়ে সশব্দে থুথু ফেললাে।

মােন্নার কথা এবং জিয়ান্নির থুথু ফেলার শব্দ, সবই ফেডরিগাে শুনতে পেল। অতিকষ্টে সে হাসি দমন করে অদ্ভুত একটা শব্দ করে চলে গেল। জিয়ান্নি ও মােন্না তাদের শয্যায় ফিরে এলাে। মােন্নার নির্দেশ পেয়ে ফেডরিগাে পিচগাছের নিচে সাদা কাপড়ে বাঁধা খাবারের পুটুলিটা বাসায় নিয়ে গিয়ে মােরগের রােস্ট, ডিমের তরকারি তৃপ্তি করে পেট ভরে খেয়ে তারপর সুরা পান করলাে। ফেডরিগাে ও মােন্না পরে এই ঘটনা নিয়ে খুব হাসাহাসি করতাে।

গল্প শেষ করে এমিলিয়া বলল, কেউ কেউ বলে যে স্বামীর আগমন অনুমান করে মােন্না গাধার মুখ ফিজোল গ্রামের দিকেই ফিরিয়ে রেখেছিল যাতে ফেডরিগাে সে রাতে না আসে কিন্তু কোনাে এক কৃষিকর্মী গাধার মুখ ফ্লোরেন্সের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল ফলে ফেডরিগাে এসে হাজির হয়েছিল। তখন দরজার আড়ালে থেকে মােন্না নাকি বলেছিল, নেকড়ে-মানুষ আজ তুমি চলে যাও। গাধার মুখ যে ঘুরিয়ে দিয়েছে তার সর্বনাশ হােক। তুমি তাে দেখতে পারছ না, আমার সঙ্গে আমার স্বামী জিয়ান্নি রয়েছে। নিরাশ হয়ে ফেডরিগাে ফিরে যায়। সে রাত্রে বেচারার আহার জোটে নি, অনাহারে কাটাতে হয়েছিল এমনকি সে রাত্রে একটা শয্যাও জোটেনি।

আমার এক প্রতিবেশী বলেছিল যে মােন্না টেসার স্বামীর নাম ছিল পাের্টা স্যান পিয়েরাে তবে সে জনি ভাই নেলাে নামেও পরিচিত ছিল। তা নাম যাই হােক মূল গল্পটা তাে তােমরা শুনলে এবং আশা করি তােমাদের ভালাে লেগেছে। গল্পটা মনে রেখ, কে জানে ভাই কার কখন কাজে লাগে।

 

দ্বিতীয় গল্প

পেরোনেলা যখন তার প্রেমিককে নিয়ে মগ্ন ছিল সেইসময়ে সহসা তার স্বামী বাড়ি ফিরে হাসতেই চতুর পেরােনেলা তার প্রেমিককে পেতলের একটা জালার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। স্বামী বলল জালাটার সে খরিদ্দার ঠিক করেছে। স্ত্রী বলল ইতিমধ্যে সে জালাটা বেচে দিয়েছে এবং ক্রেতা জালার ভেতর ঢুকে পরীক্ষা করছে ভেতরে কোনাে ফুটোফাটা আছে কিনা। প্রেমিক এই কথা শুনেই জালার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে স্বামীকে বলল, ভেতরটা চেঁছে সাফ করে দিয়ে জালাটা আমার বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে।

সকলে একমত যে এমিলিয়ার গল্পটা ভারি মজার গল্প। উঃ বৌটার কি বুদ্ধি! চট করে এক নেকড়ে মানুষের কথা তার মাথায় এসে গেল। সেদিনের রাজা ফিলােস্ট্রাটো বলল এবার তুমি একটা ঐ রকম জমাট গল্প বলাে।

ফিলােস্ট্রাটো বললাে, ব্যাপারটা কেমন মজার, স্বামীরা পত্নীদের ধোঁকা দেয়, পত্নীরা তা বিশ্বাস করে এবং সেই পত্নীই আবার স্বামীকে যখন ধোঁকা দেয় তখন স্বামীও সেটা বিশ্বাস করে নেয়। তারপর দুজনেই নিজ নিজ ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছে এ নিয়ে হাসাহাসি করে, কেমন ধাক্কা দিয়েছি! এর দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে পুরুষ বা স্ত্রী বুদ্ধিতে কেউ কম নয়। স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে গভীর ভালবাসা থাকলে তাে আর কথা নেই, পরস্পরের যে কোনাে মিথ্যা দু’পক্ষই মেনে নেয়। তাহলে এবার গল্প আরম্ভ করা যাক।

বেশিদিনের কথা নয়। নেপলস শহরে এক দরিদ্র ব্যক্তির সঙ্গে পেরােনেলা নামে একটি সুন্দরী তরুণীর বিয়ে হয়। তরুণীর পরিবারও স্বামীর মতােই দরিদ্র ছিল। পেশায় স্বামী ছিল রাজমিস্ত্রি, মজুরি যথেষ্ট ছিল না। তাই বৌ চরকা কেটে সুতাে তুলে কিছু রােজগার করতাে। দু’জনের মিলিত আয়ে ওদের সংসার কোনােরকমে চলে যেতাে।

একদিন হল কি পেরােনেলা বেশ প্রাণবন্ত হাসিখুশি চতুর ও চটপটে এক যুবকের নজরে পড়ে গেল। সুন্দরী মেয়ের পক্ষে যুবকের নজরে পড়া কোনাে অঘটন নয়। এমন প্রায়ই ঘটে।

যুবকের নাম জিয়ানেলা স্ক্রিনারিও। একটা ছল করে জিয়ানেলা পেরােনেলার সঙ্গে আলাপ করলাে। প্রথমে দু’একদিন অন্তর যাওয়া আসা আরম্ভ করলাে তারপর প্রতিদিন দিনে দু’বার। পেরােনেলাও বেকের প্রেমে পড়ে গেল। তার স্বামীর যেসব গুণগুলি ছিল না সেগুলি এই যুবকের ছিল তাই এই

প্রেমের সঞ্চার।

এরপর থেকে তাে পেরােনেলার স্বামী সকালে যেই বাড়ির কাজে বেরিয়ে যেত আর জিয়ানেলাও তার প্রেমিকার আলয়ে হাজির হতাে। পেরােনেলারা থাকতাে অ্যাভেরিয়াে পাড়ায়। পাড়াটা নির্জন, বাড়িগুলাে ফাঁকা জায়গায় অবস্থিত। সকালে পাড়ায় এসে কোনাে গুপ্ত স্থান থেকে জিয়ানেলাে নজর রাখতাে। স্বামী যেই কাজের সন্ধানে বেরিয়ে যেতাে জিয়ানেলাও অমনি পেরােনেলার ঘরে এসে ঢুকতে। তারপর দুজনে বেশ মজায় দিন কাটাত।

একদিন ঘটনা অন্যরকম ঘটল। স্বামী তাে কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়লাে আর জিয়ানেলাও ঘরে এসে ঢুকলাে। স্বামী তাে সারাদিন বাড়ি ফেরে না, ফেরে সেই সন্ধ্যার মুখে কিন্তু সেদিন কোথাও কাজ যােগাড় করতে না পেরে সকালেই ফিরে এলাে।

সদর দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল তাই সে দরজা ঠেলে সরাসরি বাড়ির ভেতরে ঢুকতে পারলাে। মনে মনে ভাবলাে তার স্ত্রী কী সাধ্বী। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমি গরিব হতে পারি কিন্তু তিনি আমাকে শুধু একটি সুন্দরী স্ত্রীই দেন নি উপরন্তু নিস্পাপ একটি কন্যা দিয়েছেন। আমি বাড়ি থেকে বেরােলেই সে দরজা বন্ধ করে দেয় পাছে কোনাে দুষ্ট লােক বাড়িতে ঢুকে তাকে বিরক্ত করে এই ভয়ে। আহা, এমন নইলে আর পত্নী।

স্বামী দরজায় ধাক্কা দিল। ধাক্কা দেওয়ার ধরন দেখে তাে পেরােনেলা বুঝতে পেরেছে যে অসময়ে হলেও তার স্বামী ফিরে এসেছে। জিয়ানেলাকে বলল, স্বামী তাে এমন অসময়ে ফেরে না। ও নিশ্চই তােমাকে আমার বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দেখেছে। তুমি এক কাজ করাে, ঘরের ঐ কোণে পেতলের যে জালাটা রয়েছে তার ভেতর ঢুকে পড়। আমি দরজা খুলে ওকে জিজ্ঞাসা করি, কি ব্যাপার? তাড়াতাড়ি ফিরে এলাে কেন?

দরজা খুলে দিয়ে স্বামীর মুখ দেখে স্ত্রী বুঝতে পারলাে আজ কাজ জোটে নি। এবার স্ত্রীর পালা। সে হতাশ ভাব দেখিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, বেশ তুমি! সকলে পারে আর তুমি কাজ জাটাতে পারাে না? কিন্তু আজ আমরা খাবাে কি, ঘরে তাে কিছু নেই। একেই তাে যা জোটে তাতে সব দিন পেট ভরে খাওয়া হয় না। কালও যদি কাজ না জোটে? তাহলে কি উপােস করে থাকবাে? কার হাতে পড়েছি? হা ঈশ্বর! সকাল থেকে চরকা কাটতে কাটতে হাত আঙুল ব্যথায় টনটন করে। রাত্রে আলাে জ্বালাবার তেল জোটে না। বেশ আছি! তুমি তাে দিব্যি তােমার কনিকটি নিয়ে হাত দোলাতে দোলাতে বাড়ি ফিরে এলে। এখন তােমাকে আমি কী খেতে দেব? বলে পেরােনেলা চোখের জল মুছতে আরম্ভ করলাে।

চোখের জল মুছলেও চোখের জল থামছে না। বৌ বিলাপ করেই যাচ্ছে। বলছে আমার কপালটাই মন্দ নইলে আমার রূপ থাকতেও এমন একটা অপদার্থ মানুষের হাতে পড়েছি যে, আমাকে আরামে রাখা দূরের কথা পেট ভরে খেতে দিতেও পারে না। অথচ আমি ওর জন্যে ভেবে মরি। এই তাে দেখতে পাই পাড়ায় কত যুবতী বৌয়ের দু’টো তিনটে করে প্রেমিক আছে। তারা তাদের বরের নাকের ডগায় প্রেমিক নিয়ে নৃত্য করছে কিন্তু আমি এক হতভাগী সতী নারী ওসব কথা চিন্তা করতেই পারি না। অথচ পাড়ার কত ছােকরা আমার দিকে চেয়ে চোখ টেপে, কত কি প্রস্তাব করে, এমন কি টাকা ও অলংকার দেখায় কিন্তু আমি তেমন বাপমায়ের বেটি নই, নইলে আর কিছু না হােক আমাকে দু’বেলা পেট ভরে ভালাে ভালাে খাবার তাে খাওয়াত। হা আমার অদৃষ্ট!

স্বামী এবার স্ত্রীর গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে বলল, এবার চুপ করাে। এখন বাজার খারাপ, অনেকেই কাজ পাচ্ছে না, বিলাপ করে আমার প্রতি কটু মন্তব্য করলেই তাে কাজ বা খাবার জুটবে না। আজ আবার বিশেষ করে একটা ধর্মীয় উৎসব আছে তাই কোনাে বাড়িতেই মেরামতী কাজ হচ্ছে না। নতুন বাড়ির গাথনি তােলাও বন্ধ আছে, সেইজন্যেই আমাকে বাধ্য হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। তা যাই হাো আমি একটা ব্যবস্থা করে ফিরে এসেছি। আমরা এখন ইচ্ছে করলে কাজ না করে এক মাস বসে যেতে পারবাে। ঐ যে মােটা পেতলের জালাটা আমার ঠাকুর্দার আমল থেকে পড়ে রয়েছে, আমাদের কোনাে কাজে লাগছে না, আমি ওটার একজন খদ্দের ঠিক করে এনেছি, রুপাের পাচ-পাচটা ডুকাট দেবে। তাতে আমাদের মাসখানেক ভালােই চলবে।

পেরােনেলা ফোস করে উঠল। বলল, তুমি একটা অকম্মা। অমন বনেদী একটা জিনিস মাত্র পাঁচ ডুকাটে বেচবে ঠিক করলে? আর এদিকে আমি বাড়িতে বসে একটা লােক ডেকে সাত ডুকাট দাম ঠিক করেছি। লােকটা ভালাে। এক কথায় রাজি হল। এখন জালাটার ভেতর ঢুকে দেখছে ফুটোফাটা আছে কিনা।

একথা শুনে স্বামী খুব সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, এমন না হলে পতিব্রতা পত্নী, বেশ করেছে। তারপর দরজা দিয়ে বাইরে মুখ বাড়িয়ে তার খরিদ্দারকে বলল, ওহে হল না। আমার স্ত্রী এর মধ্যে সাত ডুকাটে খদ্দের ঠিক করে ফেলেছে। লােকটা বলল, আমি আর দাম বাড়াতে পারব না, বলে চলে গেল। পেরােনেলা বলল, যাই হােক তুমি যখন এসেই পড়েছ তখন লােকটার সঙ্গে কথা পাকা করে নাও।

জিয়ানেলা তাে জালার ভেতরে ঢুকে সবই শুনছিল। মনে মনে কৌতুক বােধ করলেও হাত পা গুটিয়ে গরমে আর থাকতে পারছিল না। এখন সে তড়াক করে জালার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে এমন ভাব দেখাল যে যেন জালার ভেতরটা দেখছিল। তাছাড়া স্বামী যে বাড়ি ফেরছে তাও যেন সে জানে না। সে হাঁক দিল, কোথায় গেলে গাে বৌ ঠাকরুন।

স্বামী এগিয়ে এসে বলল, হ্যা ও আছে তবে যা বলবার আমাকে বলো। জিয়ানেলা বলল, তুমি আবার কে হে, তােমার সঙ্গে তাে আমার কোনাে কথা হয়নি।

ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমি ওর স্বামী, যা বলবার আমাকে বললাে।

জিয়ানেলা তখন বলল, তাহলে তাে ভালােই হল। শােনাে ভাই তােমার মালটা ভালোই আছে তবে ভেতরটা অপরিষ্কার, ছেচে ছুলে সাফ করে দাও আর বাইরেটা ঘসেমেজে দিয়ে আমার বাড়ি পৌছে দেবে চলাে। আমি সঙ্গে সঙ্গে তােমাকে সাত-সাতখানা রুপাের ডুকাট নগদ মিটিয়ে দেব।

স্বামী তখন যন্ত্রপাতি এনে জালার ভেতর ঢুকে ভেতরটা ঘসতে লাগল। বাইরে কি হচ্ছে ? দেখতেই পাচ্ছে না।

এদিকে স্বামী সকালে হঠাৎ ফিরে আসায় প্রেমিক-প্রেমিকার রতিমিলন দূরের কথা চুম্বন আলিঙ্গনও হয়নি।

পেরােনেলা তখন জালার দিকে ঝুঁকে স্বামীকে নির্দেশ দিচ্ছিল আর এই সুযােগে জিয়ানেলা পিছন থেকে তার প্রেমিককে জড়িয়ে ধরে নিজের ইচ্ছামতাে পদ্ধতিতে কাম চরিতার্থ করলাে। তারপর সে দূরে সরে দাঁড়ালাে যেন ভিজে বেড়াল।

জালার ভেতর সাফ হয়ে গিয়েছিল। স্বামী ভেতর থেকে বেরিয়ে এলাে। পেরােনেলা একটা আলাে জ্বেলে এনে জিয়ানেলার হাতে দিয়ে বলল, ভেতরটা দেখে নাও ঠিক হয়েছে কিনা, আমরা লোেক ঠকাই না।

জিয়ানেলা মােটামুটি দেখে নিয়ে বললাে, হ্যা ঠিক আছে। এবার বাইরেটা একটু মেজে দাও। পেরােনেলা ও তার স্বামী দু’জনে মিলে জালার বাইরেটা মেজে ঝকঝকে করে দিল। স্বামী জালাটা মাথায় করে জিয়ানেলাের বাসায় পৌছে দিয়ে সাতটা চকচকে রুপাের ডুকাট নিয়ে হাসতে হাসতে ফিরে এসে বলল, এমন না হলে আমার বৌ।

 

তৃতীয় গল্প

যাজক রিনালডাে তার ধর্মপুত্রের মায়ের সঙ্গে সহবাস করে। ঐ মহিলার স্বামী জানতে পারল রিনালডাে ও তার পত্নী তাদের শয়নঘরে রয়েছে কিন্তু ঐ মহিলা তার স্বামীকে বােঝাল যে তাদের পুত্রটি ক্রিমির আক্রমণে মারা যাচ্ছিল কিন্তু ফ্রায়ার রিনালডাে হঠাৎ এসে পড়ায় ছেলে সুস্থ হয়েছে।

জিয়ানেলা ও পেরােনেলা কিভাবে পশুর মতাে তাদের কাম চরিতার্থ করলাে তার বর্ণনা শুনে মেয়েদের সারা মুখ লাল টকটকে হয়ে উঠলাে কিন্তু সহসা তারা হাসিতে ফেটে পড়লাে। এ ওর গায়ে ঢলে পড়লো। কিন্তু তারা এমন ভাব দেখাতে লাগলাে যেন তারা অন্য কারণে হাসছে।

ওদের হাসি থামছে না দেখে কিং বলল, অনেক হয়েছে এবার থামাে। এলিসা নাও আরম্ভ কবো, এবার তুমি গল্প বলাে।

এমিলিয়া বেশ গল্প বলেছে, এলিসা বললাে, পেরােনেলার মাথায় যেমন চট করে নেকড়েমানুষের

চিন্তা উদয় হল তেমনি আমার গল্পর নায়িকাও চট করে তার স্বামীকে কেমন ধাপ্পা দিল তা শুনলে তােমাদের খুব মজা লাগবে। যাক আর দেরি করে লাভ নেই, গল্প আরম্ভ করছি:

সিয়েনা শহরে বেশ সুদর্শন ও চকচকে, সম্রান্ত বংশের এক ছোকরা বাস করতাে। মেয়েদের নজর কেড়ে নেবার মতাে তার কিছু গুণ ছিল এবং ছোকরা সেসব গুণ কাজে লাগাতে কসর করতাে না। তার নাম রিনালডাে।

রিনালডাে। তার পাড়ার এক পরস্ত্রীর প্রেমে পড়ে গেল। পলকে প্রণয়, দেখা মাত্রই প্রেম। বৌটির স্বামী ধনী এবং বৌটি অতিশয় সুন্দরী ও মনােলােভা। রিনালডাে খালি চিন্তা করে একবার যদি বেটির সঙ্গে আলাপ করার সুযােগ পাই তাহলে ওকে ঠিক বশ করে আমি আমার কামনা-বাসনা সবই চরিতার্থ করবাে কিন্তু বৌটির সঙ্গে আলাপ করার সুযোেগই হয় না।

এমন সময় শুনলাে বৌটি গর্ভবতী অমনি চট করে তার মাথায় এক বুদ্ধি এলাে। আমি যদি সন্তানটির ধর্মপিতা হতে চাই। রিনালডাে সম্রান্ত বংশের ছেলে, দেখতেও সুদর্শন। স্বামীর আপত্তি হল না, বেশ তাই হবে, যদি ছেলে হয় তবে সে তােমার ধর্মপিতা, গডফাদার।

বৌটির নাম অ্যাগনেসা। সন্তানের ভাবী গডফাদার অতএব অ্যাগনেসার সঙ্গে রিনালােের একটু একটু করে পরিচয় হতে লাগল। অ্যাগনেসা চতুর মেয়ে তাছাড়া মেয়েরা চোখের ভাষা বুঝতে পারে।

অ্যাগনেসা বেশ বঝতে পারলাে লােকটার মতলব ভালাে নয় তবুও যখন সে ছেলের গডফাদার হবে তখন কি আর তার কাছে কুপ্রস্তাব করতে পারবে? রিনালডাে এমন চমৎকার ও মিষ্টি কথা বলতো যে অ্যাগনেসার শুনতে ভালােই লাগতাে। ভাবত যার মনে যাই থাকুক না কেন নিজেকে ঠিক রাখলেই হল। তাছাড়া সন্তান আসছে, তার মন এখন সন্তানের চিন্তাতেই মগ্ন।

কিছুদিন কেটে গেল। কে জানে কি মতলবে রিনালভাে একজন ফ্রায়ার বা গির্জার যাজক হল এবং যাজক হয়ে সে সব নিয়মকানুন নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতাে ফলে সে পল্লীতে সুনাম অর্জন করলাে। তার মস্ত গুণ কথা বলে মানুষকে বশ করা। সে তার কয়েকটা কুঅভ্যাস ত্যাগ করেছি। তবে যাজকদের যে পােশাক নির্ধারিত ছিল সে দামী কাপড় কিনে তৈরি করিয়ে নিত। গলায় সােনার চেনে সােনার ক্রস চকচক করতাে। সর্বদা ফিটফাট। সে সাধুদের সম্বন্ধে গাথা ও প্রার্থনা সঙ্গীতও রচনা রতাে এবং নিজেও গেয়ে শােনাত। সে তার নানা কাজকর্মের দ্বারা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলাে।

যে সময়ে অ্যাগনেসা ক্রমশ সন্তান প্রসবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল এবং সন্তান প্রসবের পর সদ্যোজাত শিশুকে নিয়ে অ্যাগনেসা ব্যস্ত ছিল সেই সময়টাতে রিনালডাে তার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ যতদূর পারে কমই করতাে।

কিন্তু এখন কথা হচ্ছে রিনালডাে সম্বন্ধে এত কথা বলার দরকারটা কি? দরকার আছে বই কি। আজকাল পবিত্র গির্জার নামে এইসব ভণ্ড যাজক বা পাদ্রীসাহেবর দল সমাজের ভীষণ ক্ষতি করছে। ধর্ম প্রচারের নামে যা ইচ্ছে বলে যাচ্ছে। এদের চরিত্র বলতে কিছু নেই, বলতে গেলে সকলেই নারীলােলুপ। সুযােগ পেলেই তারা যে কোনাে নারী তা সে পরস্ত্রী হলেও তার শয়নকক্ষে রাত্রি যাপন করে। তা ছাড়া এ অত্যন্ত বিলাসী। বাইরে পুরনাে, মােটা কাপড়ের বা ময়লা পােশাক পরে থাকে কিন্তু উত্তম কাপড়ের কয়েক প্রস্ত পােশাক থাকে যা তারা গির্জার বাইরে পরে। এদের ঘরের তাকে সাজানাে আছে নানারকম প্রসাধনী, আতর ইত্যাদি এবং মুখরােচক খাদ্যদ্রব্য। তবে অলক্ষ্যে থেকে ঈশ্বর এদের দেখছেন এবং একদিন এদের বিচার হবেই।

ওদিকে অ্যাগনেসার শিশু কয়েক মাস অতিক্রম করলাে, শিশুর মাও এখন অনেক সুস্থ। রিনালদো স্থির করলাে এবার সেই রূপসীর সঙ্গে যােগাযােগ করা যেতে পারে।

ধর্মপিতা হওয়ার সুযােগ নিয়ে রিনালডাে আবার অ্যাগনেসার বাড়ি যাওয়াআসা আরম্ভ করলাে। শিশুর প্রশংসা আরম্ভ করলাে, তাকে কোলে নিয়ে আদর করতে আরম্ভ করলাে এবং এরই মাঝে মাঝে অ্যাগনেসার প্রশংসা। যতরকম ভাবে সম্ভব শিশুর মায়ের রূপগুণের চোখ, চুল, নাক ও অন্যান্য অঙ্গের প্রশংসা করতে করতে তার মন জয় করতে আরম্ভ করলাে। অ্যাগনেসারও বিশ্বাস হল যে, তার তুলনায় রূপসী ও গুণবতী নারী এবং আদর্শ মা আর বুঝি দ্বিতীয় নেই।

রিনালডাে যখন বুঝলাে যে অ্যাগনেসা তার দিকে ঝুঁকেছে, মানুষ হিসেবে তাকে পছন্দ হয়েছে তখন সে বারবার বলতে লাগলাে, অ্যাগনেসা আমার ইচ্ছে করে তােমাকে আলিঙ্গন করি। তােমার সারা দেহে হাত বােলাই এবং তােমাকে আমার অঙ্কশায়িনী করি। তুমি রাজি আছো আশা করি।

কিন্তু রিনালডাে তুমি তাে এখন যাজক হয়েছ, তবে এসব কথা বলছ কেন? যাজকরা কি পর নারীর সঙ্গে প্রেম করে?

সুন্দরী তাহলে বলি। আমি আমার এই যাজকের পােশাক খুলে ফেলতেই আর পাঁচজন যুবকের মতােই আর একজন যুবক। তখন তােমার মনে হবে না যে, আমি যাজক। তবুও আর পাঁচজন যুবক অপেক্ষা আমার কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, কিছু দক্ষতাও আছে।

সুন্দরী ব্যঙ্গহাসি হেসে বললাে, হা ভগবান আমার ছেলের ধর্মপিতার মুখে আমি এ কি শুনছি? তুমি আমাকে এসব কথা কি করে বলছো ফ্রায়ার? আমার বাচ্চা তাে তােমার ধর্মপুত্র। এর মাঝে দেহ সম্ভোগের কথা আসে কি করে? এ তাে ভীষণ পাপ।

তাই নাকি অ্যাগনেসা? তাহলে বলবাে তুমি মূর্খ, বাইরের জগতের কোনাে খবরই রাখাে না। এতে আবার পাপ কি আছে? তাছাড়া নরনারী কত বেশি পাপ করে তারপর অনুতাপ করলে মহান ঈশ্বর তাদের ক্ষমা করেন। পুণ্যবান মানুষ কোথায়, সকলেই দিবারাত্র পাপ করেও মুক্তি পাচ্ছে। বেশ এবার আমাকে বলল তাে, এই যে তােমার এই সুন্দর শিশুটি যে বাপ্তাইজ হবার সময় আমি তােমার কালে নিয়ে বসেছিলুম সেই শিশুর সঙ্গে সম্পর্ক কার সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ? আমার সঙ্গে না তােমার স্বামীর সঙ্গে যার ঔরসে এর জন্ম?

অবশ্যই আমার স্বামীর সঙ্গে, সুন্দরী উত্তর দেয়। ঠিকই বলেছাে। তােমার স্বামী কি তােমাকে নিয়ে শয়ন করে না? নিশ্চই শয়ন করে।

হ্যা আমি অপেক্ষা তােমার স্বামী তােমার বেশি নিজের। তা বলে আমি কি তােমার ঘনিষ্ঠ হতে পারি না? পারি। রিনালডাে বলতে চাইছিল, অ্যাগনেসার স্বামী তার শিশুর পিতা এবং সেও একজন পিতা, ধর্মপিতা হলেও পিতা তাে!

বলা বাহুল্য অ্যাগনেসা সুন্দরী নারী হলেও তর্ক করতে জানে না, অত বিদ্যা তার নেই। সে যুক্তি তর্কর ধার ধারে না। সে এখন তার ছেলে ও নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। তার মতাে সামান্য নারীর পক্ষে এত স্তবস্তুতি শুনতে শুনতে মাথা ঠিক রাখাও সম্ভব নয়। তার মনে হল রিনালডাে যা বলেছে যথার্থই বলেছে এবং সে রিনালডাের চাতুর্যে প্রায় ভেঙে পড়েছে। তার মনে হল রিনালডো শুধু সুপুরুষ নয় সুন্দরও। সে বলল, তুমি যা বলছে তার বিরুদ্ধে আর কে কি বলবে?

অ্যাগনেসা ভুলে গেল যে রিনালডাে তার ছেলের ধর্মপিতা, ধর্ম শব্দটাও যুক্ত আছে। সে রিনালডোের বাহুবন্ধনে ধরা দিল। সব বাঁধ ভেঙে গেল। অ্যাগনেসা পুরােপুরিভাবে আত্মসমর্পণ করলো। যেহেতু রিনালডাের তার ছেলের গডফাদার এতএব অ্যাগনেসার বাড়িতে আসতে তার বাধা নেই। যখন ইচ্ছে আসে, যায়। কেউ সন্দেহ করে না।

একদিন রিনালডাে এসেছে, সঙ্গে একজন তারই মতাে যুবক ফ্রায়ার এসেছে। বাড়িতে তখন কেউ নেই। শুধু আছে অ্যাগনেসা ও তার ছেলে এবং উদ্ভিন্নযৌবনা এক কিশােরী পরিচারিকা।

ভালােই হল। ফাকা বাড়ি। রিনালডাের সঙ্গীকে বলল, যাও হে তুমি এই সুন্দরী মেয়েটিকে নিয়ে ছাদে চলে যাও। ছাদে একটা ঘর আছে। সেই ঘরে ওকে নিয়ে গিয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পাঠ দাও। কেউ তােমাদের বিরক্ত করবে না।

সঙ্গী ফ্রায়ার মেয়েটিকে নিয়ে চিলকোঠায় চলে গেল আর রিনালডাে অ্যাগনেসাকে নিয়ে তার শয়নঘরে প্রবেশ করলাে এবং একটি শোফায় দু’জনে পাশাপাশি বসে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলাে। দারুণ মজা, ভীষণ ফুর্তি।

এমন সময় বিনা মেঘে বজ্রপাত। অ্যাগনেসার স্বামী হঠাৎ এসে হাজির। পত্নীর বেডরুমের দরজা বন্ধ দেখে দরজায় ধাক্কা দিল ও পত্নীর নাম ধরে ডাকতে লাগলাে।

স্বামী ফিরে এসে তাকে ডাকছে টের পেয়ে অ্যাগনেসা ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে বলল, হা ভগবান, এখন কি হবে? ও যে হঠাৎ ফিরে এলাে। ও তাে এখনি ঘরে ঢুকলেই টের পাবে। আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে।

রিনালডাের অবস্থা তখন কাহিল, বিবস্ত্র। কথা বলতে বলতে রিনালডাে তার যাজকের পােশাকগুলি একে একে পরতে আরম্ভ করলাে।

কিন্তু অ্যাগনেসার মাথায় সহসা একটা মতলব এসে গেল। তুমি তাড়াতাড়ি পােশাক পরে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আদর করাে। স্বামীকে দরজা খুলে দিয়ে আমি তাকে যা বললাে সেই কথাগুলাে মন দিয়ে শুনবে। তারপর যা করবার আমি করবাে।

স্বামী ওদিকে দরজায় ধাক্কা দিয়ে পত্নীকে ডেকে অপেক্ষা করতে আরম্ভ করলাে আর তখনি অ্যাগনেসা স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলল, এই যে এক মুহূর্ত খুলছি। অ্যাগনেসা যখন দরজা খুললো ততক্ষণে রিনালডােও রেডি হয়ে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আদর করছে। দরজা খুলে দিয়ে অ্যাগনেস নিরীহ ও নির্দোষ বালিকার মতাে স্বামীর দিকে চাইলাে। তার দৃষ্টি যেন প্রশ্ন করছে, এর মধ্যে ফিরে এলে যে?

স্বামী ঘরে ঢুকতেই বললাে, জানাে কি হয়েছিল? খুব বিপদ গেল। ভগবান যদি ফ্রায়ার রিনালডােকে ঠিকসময়ে পাঠিয়ে না দিতেন তাহলে আমার বাচ্চা এতক্ষণ বেঁচে থাকত কিনা কে বলতে পারে। ঈশ্বর ওকে রক্ষা করেছেন।

স্বামীটি গােলা লােক। অতিমাত্রায় এবং স্বভাবতই ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করে, কেন কি হয়েছিল?

কি আর বলবাে। কিছুক্ষণ আগে ছেলের হাতে পায়ে খিচুনি আরম্ভ হলাে, মুখ দিয়ে লালা বেরােতে লাগলাে, তারপর চোখ উলটে গেল। ছেলে অজ্ঞান। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে, কাদতে কাদতে ভগবানকে ডাকতে আরম্ভ করলুম। কি করবাে কিছু বুঝতে পারছি না আর ঠিক সেই সময়েই ছেলের গডফাদার আমাদের কল্যাণকামী রিনালডাে এসে পড়লেন। আমার প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে ভগবানই বুঝি তাকে পাঠিয়ে দিলেন।

তারপর? রুদ্ধশ্বাসে স্বামী জিজ্ঞাসা করলাে।

তারপর ফাদার রিনালডাে ছেলেকে দেখে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, ভয় পেয়াে না। ও কিছু নয়, তােমার ছেলের পেট ক্রিমিতে ভর্তি। ক্রিমিগুলাে চাপ দিতে দিতে বাচ্চার হৃত্যন্ত্রের কাছে এসে চাপ দিচ্ছে তাই বেচারা বেসামাল হয়ে গেছে। আমি এখনি ঠিক করে দিচ্ছি। মন্ত্র পড়ে হাত বুলিয়ে সব কেঁচো মেরে দিচ্ছি।

ফাদার বললেন, ছেলের বাবাকেও তাে মন্ত্র পড়তে হবে ও একটা প্রার্থনা করতে হবে। তােমাকে খুঁজে আনতে আমি পরিচারিকাকে পাঠালাম কিন্তু পরিচারিকা তােমাকে খুঁজে পেল না। তখন ফাদারের সঙ্গে একজন সঙ্গী যাজক এসেছিলেন। পরিচারিকাকে দিয়ে ফাদার তাকে বাড়ির সর্বোচ্চ তলে পাঠিয়েছেন। আকাশের দিকে দু’হাত তুলে যাজক সেই বিশেষ প্রার্থনা করছেন ও মন্ত্রপাঠ করছেন। এদিকে ফাদার বললেন, দরজা বন্ধ করে দাও এসময়ে কেউ যেন আমাকে বিরক্ত না করে। ছেলে বিপন্মুক্ত কিন্তু এ সময়ে ফাদার না এলে কি হতাে বলাে তাে? ভাবতেই আমার হাত পা হিম হয়ে আসছে।

অ্যাগনেসার কথাগুলাে রিনালডাে শুনছে আর মনে মনে কৌতুক বােধ করছে। স্বামীর দিকে একবারও চেয়ে দেখে নি, ছেলেকে সুস্থ করে তুলতেই ব্যস্ত।

ছেলের বাবা বললাে, ওকে আমি একটু দেখি।

থামাে থামাে এখন কাছে যেও না। বিপদ কাটলেও এখনও মন্ত্রপাঠ শেষ হয়নি। প্রার্থনা শেষ করে অপর যাজক এখনও নেমে আসেন নি। একটু অপেক্ষা করাে। ওঁদের প্রার্থনা ও মন্ত্রপাঠ শেষ হলে বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে। আমিই তােমাকে ঠিক সময়ে বাচ্চার কাছে নিয়ে যাবাে। শান্ত হয়ে বােসাে, বিপদ কেটে গেছে। ইস আমি কি সাংঘাতিক ভয়ই না পেয়েছিলুম। কিছুক্ষণ পরে শঠ রিনালডাে ঘাড় না ফিরিয়ে বললাে, অ্যাগনেসা, ছেলের বাবার যেন গলা পাচ্ছি?

ছেলের বাবাই উত্তর দিল, হ্যা, আমিই কথা বলছি। এবার এসে, ছেলেকে দেখে যাও, রিনালডাে বললাে। ছেলের বাবা কাছে যেতে রিনালডাে বললাে, এই যে তােমার ক্ষুদে বিচ্ছু, আমি তাে ঘরে ঢুকে ওর অবস্থা দেখে প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিলুম। ভেবেছিলুম বাড়ি ফিরে তুমি বুঝি ওকে আর দেখতে পাবে না। কিন্তু অন্তরীক্ষে যিনি আছেন তার অসীম দয়া, ছেলে এখন নিরাপদ। শােনাে একটা কাজ করবে। তােমার ছেলের সমান আকারের মােমের একটা মূর্তি তৈরি করিয়ে সেই মূর্তি ঈশ্বরের নামে উৎসর্গ করে সেন্ট অ্যামব্রোজের পায়ের তলায় রেখে দেবে। তারই অসীম দয়ায় তুমি তােমার ছেলেকে ফিরে পেলে।

বাপ ছেলের কাছে এগিয়ে গেল। বাবাকে দেখেই চিনতে পেরে আহ্লাদে আটখানা। মুখে হাসি ফুট উঠল, যেন তার কিছুই হয়নি। সত্যিই তাে কিছুই হয়নি। বাপ আদর করে ছেলেকে নিজের কোলে তুলে নিল, তখন তার দুই চোখ বেয়ে ঝরঝর করে জল ঝরছে। ছেলেকে আদর করতে বুতে রিনালডােকে বার বার ধন্যবাদ দিতে লাগল।

ওদিকে রিনালডাের সঙ্গী ছাদের চিলেকোঠায় ঘরে সেই টসটসে কিশােরীকে প্রার্থনা ও সঙ্গীত শুনিয়ে নানা বিষয়ে পাঠ দিল। পরে মেয়েদের ব্যবহারের উপযােগী চমৎকার একটি পেটিকা উপহার দিয়ে বলল, একজন নান এটি তৈরি করে দিয়েছে।

অ্যাগনেসার স্বামী ফিরে এসে যখন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিল ও পত্নীর নাম ধরে ডাকছিল তখন ওরা সেই শব্দ শুনতে পেয়েছিল। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রিনালডাে এমন একটা জায়গায় দাঁড়াল যেন থেকে ওদের দেখা যায় ও কথা শােনা যায়। যখন দেখল যে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক তখন নেমে এসে শয়নকক্ষে প্রবেশ করে বলল, ফ্রায়ার রিনালডাে আপনি যে চারটে প্রার্থনার উল্লেখ করেছিলেন আমি সবকটা প্রার্থনাই ভগবানের চরণে নিবেদন করেছি।

বাঃ তুমি তাে দারুণ কাজ করেছ ভায়া। আমি তােমার কৃতিত্বের প্রশংসা করি অথচ দেখাে অ্যাগনেসার স্বামী আসবার পূর্বে মাত্র দু’টি প্রার্থনা সম্পন্ন করতে পেরেছি। আমাদের উভয়ের মিলিত চেষ্টায় আমরা সফল হয়েছি। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। শিশু এখন স্বাভাবিক।

চার এবং দুই সংখ্যা দুটির অর্থ কেবলমাত্র অ্যাগনেসাই বুঝতে পেরে মুখ টিপে হাসল।

এরপর অ্যাগনেসার স্বামী সেরা সুরা ও উত্তম মিষ্টান্ন আনতে বলল এবং কয়েকজন প্রতিবেশী ও আরও কয়েকজন যাজককে আমন্ত্রণ করে পানভােজন সম্পন্ন করলাে। ভােজনপর্ব শেষে অতিথিদের সঙ্গে বাড়ির সদর দরজা পর্যন্ত গিয়ে বিদায় জানিয়ে এলাে।

অ্যাগনেসার স্বামী রিনালডাের নির্দেশে মােমের মূর্তি গড়িয়ে সেন্ট অ্যামব্রোজের মূর্তির পদততলে স্থাপন করবার ব্যবস্থা করলাে।

 

চতুর্থ গল্প

একদিন রাত্রে টোফানাে তার বউকে বাড়ি থেকে বার করে দরজা বন্ধ করে দিল। বউ কত আবেদন করলাে টোফানাে তবুও দরজা খুললাে না। তখন বউ আত্মহত্যার ছল করে কুয়াের মধ্যে মস্ত বড় একটা পাথর ঝপাং করে ফেলে দিল এবং বাড়ির দরজার পাশে লুকিয়ে রইলাে। ব্যাপার কি দেখবার জন্যে টোফানাে যেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে আর অমনি বউ বাড়ির ভেতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চিৎকার করে স্বামীর নিন্দা আরম্ভ করলাে।

এলিসার গল্প শেষ হতেই রাজা লরেতাকে গল্প বলতে অনুরােধ করলাে। লরেতাও ইতস্তত না করে তার গল্প আরম্ভ করলাে :

প্রেমের কি শক্তি! বজ্রতুল্য তার বাঁধুনি। কত শিল্প ও সাহিত্য সৃষ্টি ও কত মহৎ কাজের মূলে আছে প্রেম। প্রেম যে কি তােমাদের আর বুঝিয়ে বলতে হবে না। একজন সাধারণ রমণী তার যে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আছে তা নয় কিন্তু সে যা কাণ্ড করলাে তার মূলে ছিল প্রেম। এবার গল্পটা শােনাে :

অ্যারেজো শহরে টোফানাে নামে সম্পদশালী এক ব্যক্তি বাস করতাে। মােনা গিতা নামে অসাধারণ সুন্দরী এক যুবতীকে সে বিয়ে করলাে। কিন্তু বউ তার সংসারে আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বউকে সন্দিগ্ধচিত্তে দেখতে লাগলাে। বউকে সে সন্দেহ করে, এ মেয়ে নরলােলুপ। টোফানাে বউকে সর্বদা চোখে চোখে রাখে।

মােন তার স্বামীকে বার বার জিজ্ঞাসা করে তাকে কেন সন্দেহ করা হয়। টোফানাে যুক্তিহীন ভাসা ভাসা জবাব দেয়। বউ উত্তরে সন্তুষ্ট হয় না। সে ভাবে স্বামী সন্দেহ যখন করেই তখন সে আর অপেক্ষা করবে কেন? সন্দেহজনক কাজই করবে এবং সুযােগ পেলেই স্বামীকে উপযুক্ত শিক্ষা দেবে।

মােনা লক্ষ্য করলাে পল্লীর একজন পছন্দসই চেহারার ছােকরা তার দিকে লালসাময় দৃষ্টিতে নজর দিচ্ছে। নােনা গােপনে তার সঙ্গে পরিচয় স্থাপন করলাে। অনেকদিন ধরে দূর থেকে ঠারেঠোবে ইশারায় প্রেম বিনিময় হল। তারপর কথা বলারও সুযােগ হল কিন্তু তারা তাদের ভালবাসার কথাগুলি কাজে রূপান্তরিত করতে পারছে না। কোনাে সুযোেগই হচ্ছে না, দরােয়ান সর্বদা হাজির।

মােনা আবিষ্কার করেছিল যে তার স্বামীর অন্যতম কুঅভ্যাস হল মদ্যপান। এবার থেকে মােনা তার স্বামীর এই নেশা সমর্থন করতে লাগলাে এবং আরও মদ্যপান করতে উৎসাহ দিতে আরম্ভ করলাে। বউয়ের উৎসাহ পেয়ে টোফানা ঘন ঘন মদ খেতে লাগলাে। মােনা নজর রাখতাে লােকটা কখন বেহেড মাতাল হবে। মাতাল হয়ে টোফানাে যখন টলতাে, দাঁড়াতে পারতাে না তখন মােনা তাকে ধরে খাটে গিয়ে গিয়ে নরম বালিশ বিছানায় বেশ আদর করে শুইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিত। টোফানাে ঘুমিয়ে পড়লেই মােনা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে তার প্রেমিকার সঙ্গে মিলিত হতাে।

মােনা মনে মনে বলতো কেমন জব্দ, যতাে পারাে আমাকে সন্দেহ করাে, আমি আমার রাস্তা চিনে গেছি। মােনা তার প্রেমিকের সঙ্গে নিয়মিত নিরাপদে ও দীর্ঘ সময় ধরে মিলিত হতাে। মােন তার প্রেমিকের বাড়ি যেত। ক্রমে তার সাহস বেড়ে গেল, প্রেমিককেই নিজের বাড়িতে আনতে আরম্ভ করলাে। প্রেমিক কাছেই থাকতাে। বেশ কিছুদিন মহানন্দে কাটল।।

টোফানো হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলাে তার বউ তাকে মদ খেতে উৎসাহিত করে। মদের গুণও ব্যাখ্যা করে কিন্তু নিজে তাে এক ঢােক মদও খায় না। তার খটকা লাগল, সন্দেহপ্রবণ মন তাই সন্দেহ করতে লাগলাে। তাহলে যে যখন মাতাল হয়ে ঘুমােয় তখন তার বউ তাে যা ইচ্ছে করতে পারে।

তার সন্দেহ ঠিক কিনা জানবার জন্যে সে একটা পুরাে দিন সুরা পান করলাে না। সুরা পান করছি ও মাতাল হচ্ছি এইরকম ভান করতে লাগলাে। সেদিন যেন একটু বেশি মাতাল হল। মােন তাে ভারি খুশি, মশাই আজ ঘুমে অচেতন হবেন।

রাত্রে মােনা যখন মনে করলাে এবার হয়েছে, মশাই আর চোখ খুলতে পারছে না, কথা তাে কখনই জড়িয়ে গেছে। স্বামীকে বলল, ঢের হয়েছে, এবার শােবে চলাে।

অন্যদিনের মতাে স্বামীকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে যখন মনে করলাে এবার অন্তত ঘণ্টা চারেকের জন্যে নিশ্চিন্ত তখন সে প্রেমিকের বাড়ির দিকে যাত্রা করলাে।

টোফানাে মটকা মেরে পড়ে আছে। কিছুক্ষণ পরে খেয়াল হল মোেনার কোনাে আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়িতে নেই নাকি? কোথায় গেল? বিছানা ছেড়ে উঠে সে সারা বাড়ি দেখল। না মােনা বাড়িতে নেই। সে তখন ঢােকবার সদর দরজা বন্ধ করে দিয়ে জানালার ধারে বসে রাস্তার দিকে চেয়ে রইল। মােনাকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না।

মােন তার অভিসার শেষ করে ফিরে এসে দেখল সর্বনাশ! দরজা বন্ধ, বাড়ির ভেতর ঢােকবার উপায় নেই, এখন কি হবে? তবুও যত জোরে পারে দরজা ঠেলতে লাগল কিন্তু সে দরজা খােলা তার মতাে দুর্বল নারীর পক্ষে সম্ভব নয়।

টোফানাে সব লক্ষ্য করছিল। সে তাকে উদ্দেশ করে বললাে, কুলটা বৌ তুই বৃথাই তাের শক্তি ক্ষয় করছিস। দরজা খােলা তাের কর্ম নয়, যেখানে ছিলি সেখানেই ফিরে যা আর যদি না ফিরে যাস তাহলে চিৎকার করে তােক জড়াে করে তাের কুকীর্তি প্রকাশ করে দেবাে। সকলে জানবে তুই কেমন সতী নারী।

মােনা বলল, আমি কোনাে কুকর্ম করি নি। আমার এক প্রতিবেশী বান্ধবী বাড়িতে একা আছে। ভয় পাচ্ছিল, ঘুমােতে পারছিল না, আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। সে এখন ঘুমিয়ে পড়েছে, আমি চলে এলুম। খােল না, দরজাটা খুলে দাও না, ঈশ্বরের নামে দিব্যি করে বলছি যা বললুম সত্যি বললুম। লক্ষ্মীটি দরজা খুলে দাও, তুমি কি জান না যে তুমি ছাড়া আমি আর কাউকে ভালবাসি না।

মােনার আবেদন নিবেদেনে টোফানাে কান দিল না। মােন এমনও বলল যে তাকে ঘরে ঢুকতে না দিলে বদনাম তার একার হবে না, টোফানােরও হবে। লােকে বলবে ভেড়ুয়া একটা, বৌকে শাসনে রাখতে পারে না কিন্তু তাতেও যখন কাজ হল না তখন মােনা শাসিয়ে বলল, তুমি যদি আমাকে ঘরে কতে না দাও তাহলে কিন্তু ভীষণ অনুতাপ করতে হবে। টোফাননা বললাে, তুমি আমার কিছুই করতে পারবে না।

যে মেয়ে স্বামীকে ধোঁকা দিয়ে পরপুরুষের সঙ্গে প্রেম করতে পারে সে মেয়ে একেবারে বােকা নয়। প্রেমই তাকে বুদ্ধি যােগায়। সে বললাে, পারি কি না পারি দেখােই না। আমি সরলা, অবলা নির্দোষ সতী নারী। আমার ঘাড়ে তুমি মিছেমিছি দোষ চাপাচ্ছ। কি করব জানাে, অপমান সহ্য করা অপেক্ষা আমি ঐ কুয়ােটাতে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করবাে। তারপর লােকজন আমার লাশ তুলবে, তখন তারা বিশ্বাস করবে মাতাল হয়ে তুমি আমাকে কুয়াের মধ্যে ফেলে দিয়েছ। তখন তােমাকে বাড়ি, ঘর সম্পত্তি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াতে হবে। কোথাও থিতু হয়ে থাকতে পারবে না। খেতে পাবে না আর যদি পালাতে না পারাে, ধরা পড়ে তাহলে বিচারে তােমার মুণ্ডচ্ছেদের আদেশ হবে।

মােনা যে কতদূর ছলনাময়ী তা টোফানাে বুঝতে পারে নি, সে ভাবছিল মােনা ধাপ্পা দিচ্ছে। সে মােনার কথার কোনাে উত্তর দিল না। তখন মােনা বলল, শােনাে তাহলে, আমি তােমার অত্যাচার সহ্য করতে রাজি নই। ভগবান তােমাকে ক্ষমা করুন, আমার কিছু জিনিসপত্তর কুয়াের পাড়ে পড়ে থাকবে, সেগুলাে তুলে রেখাে।।

রাত্রি ভীষণ অন্ধকার। এত অন্ধকার যে চোখের সামনে হাত দুটো তুলে ধরলেও দেখা যাচ্ছে না। এতএব মােনা কি করছে তা টোফানাে দেখতেই পাচ্ছে না। মােনা অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে কুয়াের ধারে গেল। সে জানত কুয়াের লাগােয়া কয়েকটা বড় বড় পাথর আছে। অন্ধকারে হাতড়ে একটা বড় পাথর দু’হাত দিয়ে দিয়ে তুলে নিল তারপর টোফানাে যাতে শুনতে পায় সেইভাবে চিৎকার করে বললাে, “ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করুন” বলে পাথরটা বেশ জোরে কুয়াের জলে ফেলে দিতেই ঝপাং করে আওয়াজ হল। সে আওয়াজ টোফানাের কানে গেল। সে বিশ্বাস করলাে তাহলে সত্যিই তার বউ কুয়ারর মধ্যে ঝাপিয়ে পড়েছে। ছুটে গেলে এখনও হয়ত তার প্রাণরক্ষা করা যায় এই মনে করে দড়ি প্রতি নিয়ে দরজা খুলে সে কুয়াের দিকে ছুটলাে।

ইতিমধ্যে মােনা কুয়াের ধার থেকে সরে এসে বাড়ির সদর দরজার পাশেই লুকিয়ে ছিল। তার স্বামী যেই নজ খুলে বেরিয়ে কুয়াের দিকে ছুটল আর তখন মােনা খােলা দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে দরজায় খিল এটে বন্ধ করে দিল। তারপর জানালায় এসে চিৎকার করে বলতে লাগল, এবার তুমি পেট ভরে কুয়াের জল যত পারাে খাও। পেটে জমা মদের ভাড়ার জল হয়ে যাক।

মেনার কণ্ঠস্বর শুনেই চমকে উঠল, বউ তাে তাকে কলে ফেলেছে। সে কুয়াের দিকে না গিয়ে বাড়ির দরজার সামনে ফিরে এসে দরজা খুলে দিতে বললাে।

এবার মােনা যতটা পারল গলা চড়িয়ে চিৎকার করে বলতে আরম্ভ করলাে, তঁা দরজা খুলবাে বৈকি, জী, বদমাশ, ছুঁচো এতদিন কিছু বলি নি। পাড়ার লােক শুনুক সােমত্ত বৌকে একা বাড়িতে ফেলে রেখে উনি রাত্তিরে যান ইয়ারবকসি নিয়ে মদ খেতে, ফুর্তি লুটতে।

টোফাননা তাে ফাঁদে পড়ে ভীষণ রেগে গেল। সেও সমানে তার বৌকে গাল দিতে আরম্ভ করলাে। তাদের গত শুনে পাড়ার লােকের ঘুম ভেঙে গেল। অনেকেই মজা দেখতে ও উপভােগ করতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে তারা প্রথমে মােনার কাছে জানতে চাইল কি হয়েছে। মােনা তাে চোখে জল এনে তারস্বরে চিৎকার করে লতে লাগল। এই শয়তানটার হাতে পড়ে আমার হাড়মাস কালি হয়ে গেল। রােজ রাত্তিরে এই সময়ে ঘাের মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরে আমার ওপর অত্যাচার চালায়। যাকে বলে হাড়বজ্জাত। আমি আর পারছি না,

আমার জীবনটা ঝাঝরা হয়ে গেল। তােমার সবাই নিজের চোখে দেখ, তারপর বলাে, আমি ওকে বাড়িতে ঢুকতে না দিয়ে ঠিক করেছি না ভুল করেছি।

টোফানাে বলল, ওর কথা শুনাে না, ও মাগী মিছে কথা বলছে, বলে ঘটেছিল তাই বলল। মােনা তখন বলল, মিথ্যেবাদী নচ্ছারটার কথা শোনোনা। নিজেকে সাধু বানাবার জন্যে কি সাংঘাতিক মিথ্যা কথাই না বলছে? হা ভগবান আমি কোথায় যাবাে।

টোকানাের কথা কেউ বিশ্বাস করলাে না। তারা তাকে ধমক লাগাতে আরম্ভ করলাে। এমন সােরগােল হল যে, মােনার বাপের বাড়ি পর্যন্ত খবর পৌছে গেল। তারা ছুটে এল। টোফানােকে ধরে বেদম মার দিল। তারপর মােনার জিনিসপত্তর নিয়ে তাকে সঙ্গে নিয়ে চললো। যাবার সময় টোফানােকে বার বার মনে করে দিয়ে গেল যে পরে যদি আমাদের মেয়ের ওপর অত্যাচার করবার চেষ্টা করাে তাে ভালাে হবে আজ তাে শুধু নমুনা দেখিয়ে গেলুম, সেদিন তােমার হাড় এক জায়গায় আর মাংস এক জায়গায় করবাে।

পরে শান্ত মাথায় টোফানাে বুঝল স্ত্রীকে সন্দেহ করে সে ভুলই করেছে। মানুষ কত আর সহ্য করবে। সত্যিই সে অন্যায় করেছে। সন্দেহ করলেও স্ত্রীকে সে ভালবাসত এবং এখন বুঝলাে যে তাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না তখন সে কয়েকজন লােককে সালিশী মেনে বলল, তােমরা ভাই মিটমাট করে দাও। আমি এই নাক কান নলছি, প্রতিজ্ঞা করে বলছি মােনাকে আর সন্দেহ করব না। মােন বুঝলাে তার স্বামী জব্দ হয়েছে, তাকে আর ঘাটাতে সাহস করবে না।

সব ভালাে যার শেষ ভালাে। স্বামী-স্ত্রীতে আবার মিলন হয়ে গেল।

 

পঞ্চম গল্প

আর এক সন্দেহবাতিক স্বামীর গল্প। তার স্ত্রী বলল সে ফাদারের কাছে পাপ স্বীকার করতে চায়। স্বামী ফাদারের ছদ্মবেশ ধারণ করলাে। স্ত্রী তার কাছে স্বীকার করলাে যে, সে একজন যাজককে ভালােবাসে। যাজক প্রতি রাত্রে তার কাছে আসে এবং উভয়ে একই শয্যায় নিশিযাপন করে। এদিকে স্বামী যখন প্রতি রাত্রে সদর দরজার দিকে কড়া নজর রাখে ওদিকে স্ত্রী তার প্রেমিককে বাড়ির ছাদ দিয়ে নিজের শয়নকক্ষে আনিয়ে ফুর্তি করে।

লরেতার গল্প শেষ হল। মেয়েরাও যে বুদ্ধি ধরে তাও কারও জানতে আর বাকি রইল না। মেয়ের পুরুষদের চোখ ঠেরে বলল, দেখলে তাে, ইচ্ছে করলে আমরাও তােমাদের জব্দ করতে পারি অতএব আমাদের ঘাঁটিয়াে না, বিশ্বাস করতে শেখাে। এবার রাজা ফিয়ামমেত্তাকে গল্প বলতে অনুরােধ করলাে।

ফিয়ামমেত্তা বলল, লরেতার গল্প শুনে আমরাও এক সন্দেহবাতিক স্বামীর নাজেহাল হওয়ার কাহিনী বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। স্ত্রীকে সন্দেহ করে স্বামীটি নিজেও প্রচুর কষ্ট সহ্য করেছিল! সন্দে করতাে বলেই স্ত্রী বেপরােয়া হয়ে উঠেছিল অথচ ধরা পড়লে স্ত্রীরাই শাস্তি পায় স্বামীদের কিছুই হয় না। আর এইসব সন্দেহবাতিক স্বামীরা স্ত্রীদের নির্যাতন করে। স্ত্রী শাস্তি চেয়েও যখন পায় না তখনই তাে সে পাপ করে। পাপ করার সুযােগ স্বামীই দিয়ে থাকে। তাহলে এবার গল্পটা শােনাে।

রিমিনি শহরে এক অত্যন্ত ধনী ব্যবসায়ী ও জমিদার বাস করতাে। অতীব রূপসী ও লাবন্য যুবতীকে বিয়ে করেছিল। এমন রূপসী পত্নীকে কে না ভালবাসবে তাই তার স্বামীও তাকে ভালবাসত এবং তার মনােরঞ্জনের জন্য যথাসাধ্য করতাে।

এই স্বামী ভাবল তার সুন্দরী স্ত্রীকে সে যেমন ভালবাসে তেমন অপর পুরুষ যারা তাকে কে তারা প্রেম নিবেদনের সুযােগ না পেলেও মনে মনে নিশ্চয়ঃকুনজর দেয়। এই বৃথা সন্দেহ তার মনে দানা বাঁধতে আরম্ভ করলাে এবং স্ত্রীর ওপর কড়া নজর রাখতে আরম্ভ করলাে এবং সেই নজর এতই কড়া হল যে ফঁাসির আসামীর ওপরও এত কড়া পাহারা দেওয়া হয় না।

বন্ধুবান্ধবদের সম্মিলনী, বিবাহ অনুষ্ঠান, রবিবারে প্রার্থনার জন্যে গির্জায় যেতে দেওয়া তাে দূরের কথা ঐ স্বামী তার স্ত্রীকে বাড়ির বাইরেই যেতে দিত না। জানালায় দাঁড়ালেই তাকে সরে যেতে বলতো। সে ধনী, তার অনেক ভৃত্য ছিল কিন্তু কাউকে বিশ্বাস করতাে না, নিজেই স্ত্রীকে পাহাড়া দিত। চার দেয়ালের মধ্যে আটক পড়ে স্ত্রী বেচারীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল। সে আর সহ্য করতে পারছে না।

এভাবে তাে চলে না, কিছু একটা করতে হয় কিন্তু কোনাে উপায় পাওয়া যাচ্ছে না। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে যে কোনাে সুদর্শন যুবককে দেখে হাসবে বা ইশারা করবে সে সুযোেগ একেবারেই নেই। কিন্তু সে জানতাে যে তার পাশের বাড়িতেই একটি শােভন ও সুদর্শন যুবক বাস করে কিন্তু তার সঙ্গে যােগাযােগ করাই তাে অসম্ভব।

আচ্ছা দেখা যাক। বাড়ির দেওয়ালে কোথাও একটা ফুটোফাটা আছে কিনা, যার ভেতর দিয়ে ও বাড়ির ঘর দেখা যায়। তাহলে যুবকের সঙ্গে অন্তত কথা তাে বলা যাবে। স্বামী যখন পাহারায় ব্যস্ত কে সেই সময়ে যুবকের সঙ্গে আলাপ করা যাবে। যুবক সেরকম হলে প্রেম নিবেদনও করা যাবে। আরও সুযােগ হলে দু’জনে হয়তাে মিলিত হওয়া যাবে। সে সুযােগ কি হবে, তার প্রতি ভাগ্য কি কখনও প্রসন্ন হবে। তাহলে স্বামীর ওপর প্রতিশােধ নেওয়া যেত এবং বুঝিয়ে দেওয়া যেত যে ইচ্ছে করলে আমরা তােমাদের ফাকি দিতে পারি।

তার স্বামী যখন তার অন্দরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে বাইরে কোথাও কাজে যেতাে বা সদরে নিজেই পাহারায় থাকতাে সেই সময় স্ত্রী দেওয়ালগুলি তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখতো।

অবশেষে তার চেষ্টা সফল হল। বাড়ির এক প্রান্তে একটা ঘরের দেওয়ালে একটা ফাটল দেখা গেল কিন্তু ফাটলটা এত সরু যে ওধারটা স্পষ্ট দেখা যাছে না। তবে যেটুকু দেখা গেল তাতে মনে হল ওধারের ঘরখানা একটা বেডরুম। যতদূর দেখা গেল তাতে মনে হল ঐ বেডরুমে যুবক একাই শোয়।

সুযােগ পেলেই ঐ পত্নী সেই ফাটা দেওয়ালে চোখ রাখে আর যুবক ঘরে থাকলে ফাটলে খোঁচা দিয়ে ওদিকে কুটোকাটা, ধুলাে বা কিছু গুঁড়াে ফেলে এবং একদিন সে সফল হয়। কোথা থেকে খড়কুটো পড়ছে যুবক তা অনুসন্ধান করতে আসে।

যুবক ফাটলের কাছে আসতেই যুবতী নিম্নস্বরে ফিসফিস করে বলে যুবককে তার ভালাে লাগে কিন্তু এই ফাটলের ভেতর দিয়ে ছাড়া তার আর কথা বলার সুযােগ নেই। যুবক মহিলার কণ্ঠস্বর চিনতে পারে এবং তার কথা শুনে পুলকিত হয়। যুবক তখন কয়েকদিন চেষ্টার ফলে ফাটলটি বড় করে এবং সেই ফাটলের মধ্য দিয়ে ওরা পরস্পরের হাত স্পর্শ করতে পারতাে, তাও অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ও খুব ভয়ে ভয়ে, কারণ এসব কাজ করতে হতাে মেয়েটির স্বামীর কড়া পাহারা এড়িয়ে।

এদিকে পবিত্র বড়দিন এগিয়ে এল। স্ত্রী তার স্বামীকে বলল যে, সে তার স্বামীর অনুমতি নিয়ে বড়দিনের সকালে প্রার্থনা করতে গির্জায় যেতে চায় এবং এই সুযােগে কোনাে যাজকের কাছে সে স্বীকারােক্তি করতে চায়। এগুলি যে কোনাে খ্রশ্চানের পবিত্র কর্ম।

সন্দেহপ্রবণ স্বামী জিজ্ঞাসা করলাে, তুমি কি পাপ করেছ যে যাজকের কাছে স্বীকারােক্তি করতে চাও।

স্ত্রী মুখ তুলে বলল, কি কথাই বললে, তুমি কি ভাবাে যে আমাকে কড়া পাহারায় রেখেছ বলে আমি কোনাে পাপ করতে পারি না, আমি এতই পুণ্যবতী ? তুমি ভালাে করেই জানাে যে আর পাঁচজন মানুষ যে পাপ করে তেমনি আমিও পাপ করি। তবে কি পাপ করি যদি জিজ্ঞাসা করাে তাে তা আমি তােমাকে বলবাে না কারণ তুমি গির্জার যাজক নও।

স্ত্রীর কথা শুনে স্বামীর সন্দেহ আরও গভীর হল। স্ত্রী কি পাপ করে তা তাকে জানতে হবে। স্বামী বলল, তাহলে তােমাকে আমাদের নিজস্ব চ্যাপেল বা ভজনালয়ে যেতে হবে, অন্য কোনাে গির্জয়া নয়। চ্যাপেলে যাবে সকালে এবং আমাদের নিজস্ব পারিবারিক যে যাজক আছেন তার কাছে অথবা আমাদের যাজক যদি অন্য কোনাে যাজক নিযুক্ত করেন শুধু তার কাছেই তুমি স্বীকারোক্তি করৰে, আর কারও কাছে নয়। স্বীকারােক্তি হয়ে গেলেই সােজা বাড়ি চলে আসবে।

স্ত্রী বেশ বুঝতে পারলাে তার স্বামী তাকে কোনাে ফাঁদে ফেলে কৌশলে তার স্বীকারোক্তি জেনে নেবে। সে আর কোনাে প্রশ্ন না বলে বলল, বেশ তাই হবে।

ক্রিসমাস দিবসে স্ত্রীটি খুব ভােরে ঘুম থেকে উঠে বেশ ভালাে করে সাজগােজ করলাে। তারপর তার স্বামী যে চ্যাপলে যেতে বলেছিল সেই চ্যাপেলেই গেল। এদিকে তার স্বামী কিন্তু তার আগেই সেই চ্যাপেলে গিয়ে হাজির হয়েছে। চ্যাপেলে যাবার জন্যে বেরােবার সময় স্বামীকে বাড়িতে দেখতে না পেয়ে স্ত্রীর কিছু সন্দেহ হল যে তার স্বামীর কোনাে মতলব আছে।

চ্যাপেলে পৌছে স্বামী চ্যাপেলকে তার মতলবের কথা বলে নিজে সে যাজকের পোশাক পরলাে। প্রায় সমস্ত মুখ ঢাকা একটা টুপি পরলাে যাতে তাকে চেনা না যায়। তারপর সে যাজকের নির্দিষ্ট আসনে গিয়ে বসলাে।

গির্জায় পৌছে স্ত্রী বলল সে চ্যাপলনের সঙ্গে কথা বলতে চায়। চ্যাপলেন আসতে সে বলল যে সে স্বীকারােক্তি করতে চায়। চ্যাপলেন বললেন যে, তিনি এখন অন্য কাজে ব্যস্ত আছেন তবে তিনি অন্য একজন যাজককে পাঠিয়ে দিচ্ছেন, তাঁর কাছে সে স্বীকারােক্তি করতে পারে। তারপর চাপলেন একটা আসনের সামনে তাকে অপেক্ষা করতে বলে চলে গেলেন। একটু পরেই তার হতভাগ্য স্বামী যাজকের ছদ্মবেশে তার সামনে সেই আসনে এসে বসলাে। বসল তাে গম্ভীর চালে, আলাে তেমন উজ্জ্বল ছিল না এবং যাজকের চোখ কান বলতে গেলে সারা মুখটাই ঢাকা ছিল তবুও শ্ৰীমান যাজকটি যে কে তা জানতে স্ত্রীর বিলম্ব হল না।

স্ত্রী মনে মনে বলল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আমি যা আশা করেছিলুম তাই ঘটতে চলেছে। স্ত্রীকে যে স্বামী সন্দেহ করে এখন সে নিজেই স্ত্রীর স্বীকারােক্তি শুনতে এসেছে। আমার কিছু যায় আসে না। আমি ওর মন ভরিয়ে দেব, যা শুনতে চায় তাই ভালাে করেই শুনিয়ে দেব। সে যেন তার স্বামীকে চিনতে পারে নি এইরকম ভাব দেখিয়ে পরম শ্রদ্ধাভরে যাজকের পদতলে বসলাে।

ছদ্মবেশী যাজক মুখের মধ্যে ছােট ছােট কয়েকটা পাথরের টুকরাে ভরে রেখেছিল যাতে তার কণ্ঠস্বর তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না করে। মনে মনে ভাবছে তার ছদ্মবেশ এতই নিখুঁত হয়েছে যে তার পত্নী তাকে কিছুতেই চিনতে পারবে না।

স্বীকারােক্তি আরম্ভ করে মহিলা বলল সে বিবাহিতা। ঘরে তার স্বামী আছে কিন্তু সে এক যাজকের প্রেমে পড়েছে যে প্রতি রাত্রে তার কাছে এসে তার পাশে শুয়ে নিদ্রা যায়।

এই কথা শুনেই সে সন্দেহপ্রবণ স্বামীর মনে হল কেউ বুঝি তার বুকে একটা ধারালো ছোড়া বসিয়ে দিল। যদিও তার ইচ্ছে হল যে, এইখানেই স্বীকারােক্তি শােনা বন্ধ করে দেয় কিন্তু এ বিষয়ে আরও শুনতে চায়। সে জিজ্ঞাসা করল, এ তুমি কি বলছাে? তােমার স্বামী কি তােমার পাশে শয়ন করেন না?

নিশ্চয় ফাদার, স্বামী আমার পাশেই থাকেন।

তাই যদি হয় তাহলে সেই যাজক কি করে তােমার পাশে শয়ন করে? ‘যাজক জিজ্ঞাসা করলে

স্ত্রী উত্তর দিল, ফাদার এটা আমার কাছে একটা রহস্য। যাজক যে কি করে এটা সম্ভব করে তা আমিও জানি না। বাড়ির সমস্ত দরজাই বেশ ভালাে করে বন্ধ করা থাকে। কিন্তু ঐ যাজক দরজা স্পর্শ করলেই দরজা খুলে যায়। সে আমাকে বলে যে আমার শয়নকক্ষের দরজা খােলবার আগেই সে একটি মন্ত্র উচ্চারণ করে আর আমার স্বামী গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয়ে পড়ে। স্বামীর নাসিকাগর্জন শুনে যাজক দরজা খুলে আমার শয়নকক্ষে প্রবেশ করে আমার পাশে শুয়ে পড়ে। একবারও সে ব্যর্থ হয় নি।

যাজক’ বলল, ম্যাডাম এই কাজ অত্যন্ত গর্হিত এবং এমন অবৈধ মেলামেশা অবিলম্বে বন্ধ করা কর্তব্য।

উত্তরে স্ত্রী বলল, কিন্তু ফাদার আমি যে নিজেকে সংযত করতে পারি না, আমি তাকে অত্যন্ত গভীর ভাবে ভালবাসি।

তাহলে এক্ষেত্রে আমি তােমার পাপামােচন করতে কোনাে পন্থা অবলম্বন করতে পারি না, যাজক বলল।

মহিলা বলল, আমি দুঃখিত ফাদার। কিন্তু আমি তাে আপনাকে মিথ্যা কথা বলতে আসি নি তবুও অনুরােধ করছি আপনি যা করতে বলবেন আমি তাই করবাে।

‘যাজক’ বললাে, সত্যিই আমি তােমার জন্যে দুঃখিত ম্যাডাম। তুমি যদি এমন অন্যায় করতেই থাক তাহলে তুমি তাে পাপে ডুবতেই থাকেব। তবুও আমি তােমার জন্যে কিছু করবাে। আমি তােমার জন্যে ঈশ্বরের কাছে বিশেষভাবে প্রার্থনা করবাে এবং পরে আমি এই চ্যাপেল থেকে একজন ব্রহ্মচারীকে পাঠাব। আমার প্রার্থনায় তুমি কি ফল পেয়েছ তা তুমি তাকে বলবে। যদি সুফল পাও তখন আমি অন্য উপদেশ দেব।

মহিলা যেন আঁতকে উঠল। বলল, সর্বনাশ ফাদার। আপনি দয়া করে কাউকে আমার বাড়িতে পাঠাবেন না। আমার স্বামী এতই সন্দেহপ্রবণ যে অচেনা কোনাে মানুষকে বাড়িতে দেখলেই কি যে করে বসবেন কে জানে?

সেজন্যে তুমি চিন্তা কোরাে না। আমি এমন সময়ে ও এমনভাবে ব্রহ্মচারীকে পাঠাবাে যে তােমার স্বামী কিছু জানতেই পারবেন না বা সন্দেহও করবেন না।

তা যদি করতে পারেন তাে ভালােই, আমার কিছু বলার নেই, মহিলা উত্তর দিল এবং যাজকের আশীর্বাণী শুনে তার পদতল থেকে উঠে চ্যাপেলের ভেতরে প্রবেশ করলাে যেখানে বড়দিনের বিশেষ প্রার্থনা হচ্ছিল।

ক্ষিপ্ত স্বামী রাগে ফুঁসতে ফুসতে অন্য ঘরে প্রবেশ করে যাজকের বেশ ছেড়ে রেখে বাড়ি ফিরে চিন্তা করতে লাগল কি করে সে তার স্ত্রীর প্রেমিক যাজক ও স্ত্রীকে একত্রে ধরবে ও যথােপযুক্ত শাস্তি দেবে।

চ্যাপেল থেকে বাড়ি ফিরে স্বামীর মুখ দেখেই স্ত্রী বুঝল যে বড়দিনের আনন্দ স্বামীর মাথায় উঠেছে কিন্তু স্বামী যা জানতে পেরেছে তা আভাসে ইঙ্গিতে জানাবার চেষ্টা করছে না। তবে দমন করবার জন্যে মনে মনে আপ্রাণ চেষ্টা করতে হচ্ছে।

প্রাতরাশ শেষ করে স্বামী স্থির করলাে আজ রাত্রে সে বাড়ির সদর দরজার পাশের ঘরে সারারাত জেগে পাহারা দেবে। দেখবে কি করে তার স্ত্রীর প্রেমিক যাজক বাড়িতে প্রবেশ করে।

স্ত্রীকে বলল, আজ রাত্রে আমার নিমন্ত্রণ আছে। সন্ধ্যার পর বেরবাে, সকালের আগে ফিরতে পারবাে না। তুমি সব দরজা বিশেষ করে তােমার শােবার ঘরের দরজা উত্তমরূপে বন্ধ করে শোবে।

স্ত্রী উত্তর দিল, বেশ, তােমার কথামতােই কাজ করবাে।

এরপর সুযােগ পেয়েই স্ত্রী দেওয়ালের সেই ফাটলের কাছে গেল এবং সাংকেতিক শব্দ করে তার প্রেমিক ফিলিপ্পোকে ডেকে সব কিছু বলল। সে সকালে কোথায় গিয়েছিল, কি করেছে এবং তার স্বামীই বা কি বলেছে সবই সে বলল। ফিলিপ্পো মনে মনে কৌতুক অনুভব করলাে।

তার প্রেমিকা তখন বলল, আমি নিশ্চিত যে আমার স্বামী আজ রাতে বাড়ি থেকে বেরােবেই না। সে পাশের ঘরে শুয়ে দরজার ওপর নজর রাখবে। তুমি রাতে ছাদ দিয়ে উঠে আমার ঘরে আসবে, সিঁড়ির দরজা আমি ভেজিয়ে রাখবে।

ফিলিপ্পো এই প্রস্তাব শুনে খুব আনন্দিত হয়ে বলল, আমি যথাসময়ে তােমার ঘরে হাজির হবে।

সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার ছল করে স্বামী ছােরা, তলােয়ার ইত্যাদি নিয়ে সদর দরজার পাশে একটা ঘরে লুকিয়ে রইলাে। অবশ্য সদর দরজা সে অতি উত্তমরূপে বন্ধ করতে ভুললাে না।

ওদিকে স্ত্রীও সিঁড়ির দরজা এবং নিজের শয়নঘরে দরজা ছাড়া সমস্ত দরজা বিশেষ করে সদর দরজার পরে অন্দরমহলে ঢোকার যে দরজাটা আছে সেটা তাে ভালাে করেই বন্ধ করলাে যাতে স্বামী বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। একসময়ে রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে নিজের শােবার ঘরে প্রেমিকের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাে।

যথাসময়ে প্রেমিক নিজের বাড়ির ছাদে উঠে প্রেমিকার বাড়ির ছাদে এসে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সােজা প্রেমিকার ঘরে হাজির। তারপর একই শয্যায় উভয়ে শুয়ে মহানন্দে সারারাত্রি কাটিয়ে ফিলিপ্পো নিজের ঘরে ফিরে গেল। মহিলাও সিঁড়ির দরজা বন্ধ করে দিল।

ওদিকে সন্দেহপ্রবণ স্বামী সারারাত অনাহারে থেকে ও শীতে ঠকঠক করে কেঁপে ঠায় জেগে পাহারা দিল। মানুষ দূরের কথা একটা নেংটি ইদুরও ঘরে ঢুকতে পারে নি। সকাল হল। আর সে বসে থাকতে পারল না, এত ক্লান্ত যে মেঝেতেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

অনেক বেলায় ঘুম থেকে উঠল। ভৃত্যরা সদর দরজা খুলে দিয়েছে। বন্ধুর বাড়ি থেকে যেন এইমাত্র ফিরছে এইরকম ভান করে বাড়িতে ঢুকে নিজের ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে প্রাতরাশ সারল। ক্ষিধেয় তাে পেট জুলছিল।

ক্ষুধা শান্ত হলে সে তার একজন ভৃত্যকে ব্রহ্মচারী সাজিয়ে স্ত্রীর কাছে পাঠাল। তাকে বলে দিল স্ত্রীকে শুধু জিজ্ঞাসা করতে “সেই লােকটা কি এসেছিল?”

ধূর্ত স্ত্রী তাে ‘ব্রহ্মচারীকে দেখেই চিনেছে। মনে মনে হাসল, তার চোখে ধূলাে দেওয়া এত সহজ নয়। স্ত্রী তাকে বললাে, তুমি ফিরে গিয়ে ফাদারকে বলল যে গে যাও যে সেই লােক আসে নি। সে আর যদি না আসে তাহলে তার কথা সে ভুলে যাবে যদিও মনে মনে দুঃখ পাবে।

স্বামীদেবতা নিরুৎসাহ হল না। সে আগের মতােই স্ত্রীকে দিনের বেলা কড়া নজরে রাখতে লাগল আর রাত্রে আগের মতােই সদর দরজার পাশের ঘরে পাহারা দিতে লাগল। এই চললাে দিনের পর দিন। একে তাে মানসিক যন্ত্রণা, সন্দেহবিষ মাথায় বাসা বেঁধেছে তার ওপর রাতে ঘুম নেই। উত্তেজনা। নিয়ে জেগে থাকতে হয়, লোকটা ঐ বুঝি এলাে, মানুষ আর কত সহ্য করতে পারে?

ওদিকে প্রতিদিন রাত্রে ফিলিপ্পো আসে এবং ওরা বেশ মজায় রাত কাটায়। স্বামী ঘুণাক্ষরেও টের পায় না। স্ত্রীর শয়নঘরে হঠাৎ যে ঢুকে পড়বে সে পথও তাে বন্ধ। নিজেই আদেশ দিয়েছে সব দরজা বন্ধ করে রাখতে। স্ত্রীর ঘরে ঢুকতে হলে অন্তত গােটা তিনেক দরজা পার হতে হবে।

স্বামী একদিন ফেটে পড়ল। বৌকে সামনে দাঁড় করিয়ে ধমক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাে, বড়দিনের দিন যাজকের কাছে তুমি কি স্বীকারােক্তি করেছ?

বৌ বলল, এ তাে ভারী অন্যায়। যাজকের কাছে আমি কি স্বীকারােক্তি করেছি তা কি কাউকে বলতে আছে? তাতে তারও পাপ হবে।

স্বামী ফুসে উঠল। আহা আমার পুণ্যবতী মহিলা রে। পাজী, বদমাস, নচ্ছার, আমি যেন কিছু জানি না। তুই সেদিন যাজকের কাছে যা বলেছিস আমি সব জানি। এখন শুধু আমাকে তাের প্রেমিক যাজকের নাম বল, তাকে আমি খুন করবাে। তা না বললে আমি এখনি তাের গলা কাটবো।

স্ত্রী বলল, তাহলে শােনো আমি কোনাে যাজকের প্রেমে পড়ি নি, মিথ্যা কথা।

কি বললি? সেদিন চ্যাপেলে যাজকের কাছে কি বলেছিলি ? কোনাে যাজকের প্রেমে পড়িস নি?

স্ত্রী বলল, হ্যা বলেছিলুম। কিন্তু স্বামী তুমি কি করে এসব কথা জানলে? নিশ্চয় আড়ি পেতে শুনছিলে যা ধর্মীয় আইনানুসারে অন্যায়।

ক্ষিপ্ত স্বামী বলল, ন্যায় অন্যায় আমি বুঝবাে, এই যাজক কে? শিগগির বল, বলে স্বামী ওর দিকে দু’পা এগিয়ে এলাে। স্ত্রী দু’পা পেছিয়ে গিয়ে হেসে বলল, আমার খুব আনন্দ হচ্ছে, কেমন জব্দ করেছি। আগে জানতুম তুমি বুদ্ধিমান কিন্তু যেদিন থেকে আমাকে সন্দেহ করতে আরম্ভ করলে, আমাকে আগলাতে আরম্ভ করলে সেদিন থেকে বুঝলুম তুমি একটি গাড়ল, মূর্খ। অথচ আমাকে সন্দেহ করবার তােমার কোনাে কারণ নেই। আমার বিরুদ্ধে তুমি কিছু পাও নি, আর আমার দিকে কেউ দৃষ্টি দেবারও সুযােগ পায় নি আর তুমি মূর্খ বলেই আমি সহজেই আমাকে নির্দোষ প্রমাণিত করতে পারবাে।

স্ত্রী বলতে লাগলাে, স্বামী তুমি কি মনে করো যে তােমার বুদ্ধি যেমন ক্ষীণ আমার দৃষ্টিশক্তি ততটাই ক্ষীণ! তুমি ভুল করেছ। বড়দিনের দিন তুমি যখন যাজকের ছদ্মবেশে আমার সামনে বসলে, মুখ প্রায় ঢাকা থাকলেও তােমার চলন ও বসার ভঙ্গি দেখেই তােমাকে আমি চিনতে পেরেছিলুম। তখন আমার মাথায় দুষ্টবুদ্ধি খেলল যে তােমাকে নিয়ে একটু মজা করা যাক অর্থাৎ তুমি যা শুনতে চাও আমি মিথ্যার জাল বুনে তােমাকে তাই শােনাই আর তুমি ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে মর এবং আমি সফলও হলুম। কিন্তু তুমি নিজেকে যে পরিমাণ চতুর ও বুদ্ধিমান ভাবাে সত্যই তাই যদি হতে তাহলে তােমাকে এই বিড়ম্বনা ভােগ করতে হতাে না। স্বীকারােক্তির সময় আমার মিথ্যা তুমি সহজেই ধরতে পারতে।

আমি তােমাকে মানে যাজকের কাছে স্বীকার করলুম যে আমি এক যাজকের প্রেমে পড়েছি কিন্তু আমি কি মিথ্যা বলেছি? তুমি কি যাজক সেজে আমার সামনে বসে ছিলে না? আমি বলেছি যে সে ইচ্ছে করলেই আমাদের বাড়ির যে কোনাে দরজা খুলতে পারে এবং আমার পাশে এসে শােয়। আমি কি মিথ্যা কথা বলেছি? তুমি কি ইচ্ছামতাে দরজা খুলে আমার পাশে এসে শোও নি? আমি কি তােমাকে কখনও বাধা দিয়েছি? আপত্তি করেছি। আমি আরও বলেছি সেই যাজক প্রতিরাতে আমার পাশে শুতাে। এবার তুমিই বলাে তুমি কি প্রতিরাত্রে আমার পাশে শুতে না? তারপর তুমি আমাদেরই একজন ভৃত্যকে ‘ব্রহ্মচারী’ সাজিয়ে পাঠালে, তাকেও আমি চিনতে পেরেছিলুম তবে তা আমি প্রকাশ না করে বলেছিলুম সে সেই যাজক’ আর আমার কাছেই আসছে না কারণ তখন থেকেই তুমি অন্যত্র রাত্রি যাপন করছ। এখন আমিও তাে তােমার বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোেগ আনতে পারি যে, তুমি এই কয়েকদিন তােমার কোনাে প্রেমিকাকে নিয়ে মহানন্দে নিশিযাপন করেছ? অবশ্য তা তুমি করােনি উপরন্তু হিংসায় অন্ধ হয়ে অশেষ যন্ত্রণা ভােগ করেছ।

আমার কথাগুলি শুনে তােমার এইসব মিথ্যা ও কাল্পনিক সন্দেহের অবসান হল কি? এখনও কি তুমি আমাকে কড়া পাহারায় রাখবে। অন্যান্য স্বামী-স্ত্রীর মতাে স্বাভাবিক জীবন যাপন করবে না? ওসব সন্দেহ তুমি এখন ছুঁড়ে ফেলে দাও। ইচ্ছে করলে আমি কেন যে কোন স্ত্রী তার স্বামীর চোখে ধুলে দিয়ে পরপুরুষের সঙ্গে প্রেম করতে পারে।

সন্দেহপ্রবণ স্বামী স্ত্রীর নির্ভীক উত্তর শুনে কিছুক্ষণ ধরে সমস্ত ব্যাপারটা মনে মনে পর্যালােচনা করলাে এবং বুঝতে পারলাে সে কি মূর্খামি না করেছে। এখন যদি কেউ তাকে গর্দভ বলে তাহলে সে প্রতিবাদ করতে পারবে না। সত্যিই তার স্ত্রী সাধ্বী এবং বুদ্ধিমতী। এখন সে সন্দেহমুক্ত হয়ে নিজেকে হালকা মনে করলাে। এবং স্ত্রীকে সহজভাবে গ্রহণ করলাে। ফলে হল কি? স্ত্রীর সেই প্রেমিক ফিলিপ্পো যে বেড়ালের মতাে লুকিয়ে ছাদ ডিঙিয়ে আসত, এখন থেকে সে উপযুক্ত সময়ে সব দরজা দিয়ে আসতে আরম্ভ করলাে।

 

ষষ্ঠ গল্প

ইসাবেলা যখন তার প্রেমিক লিওনেত্তোর বাহবন্ধনে আবদ্ধ সেইসময়ে তার আর এক প্রেমিক ল্যাম্বারতুচ্চিও এসে হাজির। বিপদের ওপর বিপদ। সহসা অনুপস্থিত স্বামী এসে পড়িল। ল্যাম্বারতুচ্চিওকে ইসাবেলা বলল তুমি ছােরা হাতে কাউকে তাড়া করে বেরিয়ে পড। লিওনেত্তোকে পরে তার স্বামী তার বাড়ি পৌছে দিল।

ফিয়ামমেত্তাকে সবাই বাহবা দিল। হিংসুটে মানুষের উপযুক্ত সাজাই হয়েছে। রাজা এবার প্যামপিনিয়াকে বলল, এবার তুমি এমন একটা মজার গল্প বলাে তাে।

প্যামপিনিয়া বলল, কথায় বলে মানুষ প্রেমে পড়লে বােকা হয়ে যায় কিন্তু তাই কি? আবার কি রকম চালক করে দেয় তারই একটা গল বলছি সবাই মন দিয়ে শােনাে। গল্পটা তােমাদের ভালােই লাগবে।

আমাদের এই সুন্দর শহরে যেখানে আমরা এতকাল পরমসুখে বাস করে এলুম, যেখানে আমরা কোনাে কিছুর অভাব বােধ করি নি, যেখানে সুন্দর পুরুষ ও সুন্দরী নারীর অভাব নেই, যে শহরকে আমরা সুখের স্বর্গ বলতে পারি সেই শহরে ভেনাসতুল্য এক সুন্দরী যুবতী ছিল যার বিয়ে হয়েছিল এক অভিজাত ও ধনী পরিবারের ধীর ও শান্ত এক যুবকের সঙ্গে। এই সুন্দরী যুবতীর নাম ইসাবেলা।

মানুষের যেমন প্রত্যহ একই আহার ভালাে লাগে না, মাঝে মাঝে মানুষ মুখ পালটাতে চায় তেমনি ইসাবেলােরও কোনাে কারণে সেই একই স্বামীকে আর রুচিকর মনে হল না। কি জানি কেন তার মনে হল দিনের পর দিন সেই একই খেলা, অন্য কারও সঙ্গে খেললে কেমন হয়?

অচিরে সে লিওনেত্তো নামে এক যুবকের প্রেমে পড়ল। যুবকটি সম্ভ্রান্ত বংশের হলেও এখন তাদের পড়তি অবস্থা। তার চেহারা ভালাে, বিনয়ী এবং নারীর মনােরঞ্জন করতে পারে। বলাই বাহুল্য যে লিওনেত্তো ও ইসাবেলাকে ভালবাসত। পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা হলে চূড়ান্ত পর্যায়ে মিলিত হতে দেরি হয় না।

ইসাবেলা ছিল অসাধারণ রূপবতী। অনেক পুরুষই মনে মনে তার সঙ্গ কামনা করতাে। ল্যাম্বারতুচ্চিও নামে একজন শক্তসমর্থ কিন্তু কর্কশ যুবক ইসাবেলাকে অংকশায়িনী করতে চাইল কিন্তু তার আচার-আচরণ, কথা বলার ধরন এবং তার নিম্নমানের রুচি ইসাবেলার মােটেই ভালাে লাগত না। লােকটার ধারণা ছিল যে গায়ের জোরে সবই জয় করা যায়।

ইসাবেলা যখন তাকে বার বার ফিরিয়ে দিতে লাগলাে তখন সে তাকে ভয় দেখাল যে, ইসাবেলা আত্মসমর্পণ না করলে তার ফলভােগ করতে হবে। ইসাবেলা খুব ভয় পেয়ে গেল। লােকটা পাজী ও বদমাশ, সবকিছু করতে পারে, তাকে খুনও করতে পারে। খুন না করলেও হয়ত নাক বা কান কেটে দেবে কিংবা ছুরি চালিয়ে মুখটা বিকৃত করে দেবে। তাই ভয়ে ইসাবেলা লােকটাকে তার সব দিতে বাধ্য হলাে। ফ্লোরেন্সে যখন গ্রীষ্মকাল তখন তাে আমরা, বিশেষ করে মেয়েরা আমাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যাই। ইসাবেলারও গ্রামে বেশ প্রশস্ত ও দোতলা একটা বাড়ি ছিল। চারদিকে বাগান ঘেরা।

গ্রামে গিয়ে ইসাবেলা দাসদাসী নিয়ে একাই থাকত। স্বামী সময় পেলে মাঝে মাঝে গ্রামে গিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে এক-আধ দিন কাটিয়ে আসত। একদিন সকালে স্বামী শহরে ফেরবার সময়ে স্ত্রীকে বলে গেল কয়েকদিন সে আসতে পারবে না। ইসাবেলা তাে আনন্দে নৃত্য করতে লাগল এবং সেইদিনই লিওনেত্তোকে খবর পাঠাল, আজই চলে এসাে, বেশ কয়েকটা দিন ফুর্তি করা যাবে। খবর পেয়েই সে পরম পুলকিত হয়ে প্রিয়তমার পাশে এসে হাজির।

ওদিকে ল্যাম্বারতুচ্চিও খবর পেয়েছে গ্রামের বাড়িতে ইসাবেলা এখন একা আছে। তাহলে এই তাে সুযােগ। সে তখনি তার ঘােড়া ছুটিয়ে ইসাবেলার গ্রামের বাড়িতে এসে হাজির। ইসাবেলার পরিচারিকা লােকটাকে দেখতে পেয়েছে। পরিচারিকা তাে জানে তার কর্তী এখন লিওনেত্তোর সঙ্গে শয়নঘরে। লােকটা যা পাজী লিওনেত্তোকে দেখতে পেলেই খুন করবে। ল্যাম্বারতুচ্চি ঘােড়া থেকে নামবার আগেই সে ছুটে গিয়ে ইসাবেলাকে খবর দিল। যা করবার এখনি করাে নইলে একটা খুনোখুনি হয়ে যাবে।

সবে ওরা দু’জন রসসাগরে ডুব দিচ্ছিল আর এই সময়ে এই বাধা? ইসাবেলা ভয় পেল। লিওনেত্তো ল্যাম্বারতুচ্চিওর চরিত্র জানতাে তাই সেও ভয় পেয়েছিল। খাটের পাশে পর্দা ফেলা একটা কোণ থাকে, মেয়েরা প্রয়ােজনে সেখানে পােশাক বদলায়। ইসাবেলা তাকে তাড়াতাড়ি পর্দার আড়ালে চালান করে দিয়ে বলল, এখানে লুকিয়ে থাক। ছােকরা লুকিয়ে পড়তেই ইসাবেলা নিজের পােশাক আর মাথা চুল একটু ঠিকঠাক করে নিয়ে দরজা খুলে সিঁড়ির মাথায় এসে দাঁড়াল।

ল্যাম্বারতুচ্চিও ততক্ষণে ঘােড়া থেকে নেমে যথাস্থানে ঘােড়া বেঁধে হাসতে হাসতে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে।

ইসাবেলা হাসিমুখে তাকে অভিনন্দন জানাল। সে তার প্রিয়পাত্রীকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করে বলল, খবর আমি পেয়েছি তােমার কর্তা বাড়ি নেই। তুমি নিশ্চই আমার কথা ভেবেছিলে। দেখাে মনের টান কেমন, এসে পড়লুম, চলাে। বলতে বলতে ইসাবেলাকে নিয়ে ল্যাম্বারতুচ্চিও শয়নঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর ইসাবেলাকে নিয়ে খাটে গিয়ে শুয়ে পড়ল।

দু’জনে খাটে শুয়ে ভাল করে প্রেমালাপ আরম্ভ করতে না করতেই সেই পরিচারিকা এসে দরজায় সজোরে ধাক্কা দিল, রাস্তায় কর্তামশাইকে আসতে দেখলুম, এতক্ষণে বােধহয় বাগানে এসে গেছেন।

সত্যিই বিপদ। একজনকে না হয় লুকিয়ে রেখেছে কিন্তু আর একজনকে কিছুতেই লুকান যাবে না। তার ঘােড়া যে নিচে রয়েছে!

ইসাবেল এমন কিছু আশংকা করে আগে ভেবে রেখেছিল অথবা হঠাৎ তার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। সে চট করে খাট থেকে নেমে ল্যাম্বারচুচ্চিওকে বললাে, শুনলে তাে আমার স্বামী হঠাৎ করে ফিরে এসেছে। এতক্ষণে বাগানে এসে বােধহয় আস্তাবলে ঘােড়া রেখে বাড়িতে ঢুকেছে। তুমি যদি আমাকে একটুও ভালবাস তাহলে এক কাজ কর।

আশাহত ল্যাম্বারতুচ্চিও রীতিমতাে বিরক্ত। উত্তেজিত হয়েছিল প্রিয়ার স্পর্শে, এখন সেই উত্তেজনা দমন করবার চেষ্টা করছে। মুখের ভাব স্বাভাবিক নয়। বলল, কি করতে হবে?

ইসাবেলা তার মাথায় চুল এলােমেলাে করে দিতে দিতে বলল, জামার একটা বােম খুলে দিয়ে ছােরাটা বার করে হাতে নাও, তারপর জোরে নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে “আর পালাবি কোথায় বদমাশ, আমার সঙ্গে চালাকি? আমাকে চিনিস না” বলতে বলতে জোরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাও। আমার স্বামী যদি কিছু জিজ্ঞাসা করে তাহলে তার দিকে চাইবে না, উত্তরও দেবে না। শুধু ঐরকম কথা বলতে বলতে নেমে যাবে। তারপর নিজের ঘােড়ায় উঠে জোরে ঘােড়া ছুটিয়ে চলে যাবে। পরে দেখা কোরাে। যাও যাও, শিগগির, স্বামী বােধহয় বাড়িতে ঢুকলাে।

ল্যাম্বারতুচ্চিওর যত রাগ সব পড়ল স্বামী বেচারার ওপর। রাগে তার মুখ লাল, মাথার চুল এলােমেলাে, বীভৎস দেখাচ্ছে, তার হাতে ছােরা। ইসাবেলার শেখানাে কথাগুলাে বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল আর সেই সময়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে ইসাবেলার স্বামী। সে তাে হকচকিয়ে গেল, কি ব্যাপার রে বাবা, বাড়িতে কিছু হল নাকি? ল্যাম্বারতুচ্চিওকে জিজ্ঞাসা করলাে, এই তুমি কে? কি হয়েছে?

ল্যাম্বারতুচ্চিও ওর দিকে ফিরে চাইল না। আমার সঙ্গে চালাকি? পালাবি কোথায়? তাের হাড় একদিকে মাংস একদিকে করবাে, বলতে বলতে ল্যাম্বারতুচ্চিও বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের ঘােড়ায় উঠে জোরে ঘােড়া ছুটিয়ে দিল।

ঘরে ঢুকে দেখল তার স্ত্রীর চোখে জল। খুব ভয় পেয়েছে, খাটে বাজু ধরে দাঁড়িয়ে কাপছে। ঘরে ঢুকে স্ত্রীকে এইরকম করুণ অবস্থায় দেখে স্বামী তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলাে, কি হয়েছে?

ব্যাপারটা কি? ল্যাম্বারতুচ্চিওকে দেখলুম যেন? ও কাকে তাড়া করে গেল?

স্বামীকে দেখে স্ত্রীর মনে যেন সাহস ফিরে এলাে। সে বলল, আমিই কি জানি? উঃ কি ভীষণ ভয় পেয়েছি। এখনও আমার বুক ঢিব ঢিব করছে। একটা ছােকরা প্রাণভয়ে ছুটতে ছুটতে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল, ভয়ে তার আপাদমস্তক কাপছে। আমাকে বলল, আমাকে বাঁচান, ছােরা হাতে একটা লােক আমাকে তাড়া করেছে ওকে আমি জীবনেও দেখি নি। আমাকে কেন তাড়া করলাে জানি না, ঐ বুঝি এসে পড়লাে।

ছােকরাকে দেখে আমার মায়া হল। আমি ওকে আমার ঘরে ঢুকিয়ে কোথাও লুকিয়ে পড়তে বলে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলুম। দেখি কি ল্যাম্বারতুচ্চিও ফুসতে ফুসতে কার উদ্দেশ্যে গাল দিতে দিতে হাতে ছােরা নিয়ে ওপরে উঠছে। ছােরা দেখেই তাে আমার হয়ে গেছে।

ল্যাম্বারতুচ্চিও আমাকে জিজ্ঞাসা করলাে, ছোঁড়াটা গেল কোথায়? এই বাড়িতেই যেন ঢুকল? আমি ওকে কেটে টুকরাে টুকরাে করব। ব্যাটা এই বাড়িতেই ঢুকেছে, বলে আমার ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল।

সাহস করে আমি বললুম, এই আমার ঘরে ঢুকো না, ওপরে কেউ ওঠে নি। ছোঁড়াটা বাড়িতে ঢুকে দরজা দিয়ে বেরিয়ে পালিয়েছে। আমার কথা শুনে ল্যাম্বারতুচ্চিও ফিরে গেল আর সেই সময়েই তুমি এসে পড়লে। আমি তাে ভয়ে ঠকঠক করে কাপছিলুম, বলে ইসাবেলা স্বামীকে জড়িয়ে ধরলাে।

তুমি ঠিক কাজ করেছে ইসাবেলা। আমাদের বাড়ির ভেতরে একটা খুনোখুনি হলে কি বিশ্রী কাণ্ডই না হতাে। ল্যাম্বারতুচ্চিও লােকটা পাজী। ও কোন্ সাহসে আমার বাড়ির ভেতর ঢুকল? সে ছােকরা কোথায়?

ইসাবেলা বলল, ছােকরাকে তাে আমার ঘরেই লুকোতে বললুম, কোথাও নিশ্চয় লুকিয়ে আছে। খাটের তলায় নয়ত কোনাে পর্দার আড়ালে।

ইসাবেলার স্বামী তখন সেই ছােকরাকে উদ্দেশ্য করে ডাকতে লাগল, ওহে ছােকরা তুমি কোথায়? বেরিয়ে এসাে, তােমার কোনাে ভয় নেই।

লিওনেত্তে তাে পর্দার আড়ালে বসে সবই শুনেছে আর মনে মনে ভাবছে কি চালাক মেয়ে রে বাবা। কিন্তু এখন তাে অভিনয় করতে হবে তাই সে যেন খুব ভয় পেয়েছে এইরকম ভাব দেখিয়ে পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে গৃহকর্তার সামনে ভিজে বেড়ালের মতাে দাড়াল।

কর্তা তাকে জিজ্ঞাসা করলাে, ল্যাম্বারতুচ্চিওকে তুমি কি করেছ? – ছােকরা বলল, আমার কথা বিশ্বাস করুন। আমি এই নাম প্রথম শুনেছি, আমি ওকে চিনি না। আমার মনে হয় লােকটা আমাকে চিনতে ভুল করেছে। আমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে নিজের কাজে যাচ্ছিলুম আর ও ঘােড়ায় চড়ে আসছিল। আমাকে দেখেই ছােরা বার করে বললাে, এবার পেয়েছি, পালাবি কোথায়? আমি তাে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলুম। রাস্তার ধারেই আপনার বাড়ির বাগানের পাঁচিল দেখতে পেয়ে ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লুম। দিদিমণি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন, উনি না থাকলে আজ আমার নির্ঘাৎ মৃত্যু হতাে।।

ঠিক আছে। বদমাশটা চলে গেছে। তােমার আর ভয় নেই। চলাে আমি তােমাকে তােমার বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।

যাবেন? তাহলে তাে খুব ভালাে হয়। আপনাদের কি বলে যে আমার কৃতজ্ঞতা জানাব তা আমি ভাবতেই পারছি না। আমার ভয় এখনও কাটে নি। লােকটা রাস্তায় কোথাও হয়তাে আমার জন্যে পড়িয়ে আছে।

আচ্ছা, এখন কিছু খেয়ে নাও। তােমার চোখমুখ তাে শুকিয়ে গেছে। ছােকরাকে খাইয়ে ইসাবেলার স্বামী তাকে আর একটা ঘােড়ায় চড়িয়ে ফ্লোরেন্স পর্যন্ত তাকে পৌছে দিয়ে এলাে।

কি যে ঘটল তার স্বামী কোনােদিনই জানতে পারল না। একেই কি বলে ছলনাময়ী।

 

সপ্তম গল্প

লােডােভিচো বিয়েত্রিচকে বলল সে তাকে গভীরভাবে ভালবাসে। বিয়েত্রিচ তার স্বামী ইগানােকে বলল তুমি আমার পােশাক পরে বাগানে যাও। স্বামীকে বাগানে পাঠিয়ে বিয়েত্রিচ লােডােভিচোকে নিয়ে বিছানায় শুলাে। পরে লােডােভিচো বাগানে গিয়ে বিয়েত্ৰিচবেশী ইগনােকে প্রহার করলাে।

প্যামপিনিয়র সরস গল্পটি সকলের খুব ভালাে লাগল এবং ইসাবেলার উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা করলাে। রাজা এবার ফিলােমেনাকে বলল, নাও এবার তুমি আরম্ভ করাে। ফিলােমেনা বলল, আমিও তােমাদের একটা দারুণ গল্প বলবাে। শােনাে তাহলে :

একদা প্যারিসে ফ্লোরেন্সের একজন ভদ্রলােক বাস করতাে। তার অর্থ ও মানসম্মান ছিল কিন্তু কোনাে কারণে দুর্দশায় পড়ে সে ব্যবসা করতে আরম্ভ করলাে। তার ভাগ্য খুলে গেল। ব্যবসা করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করলাে। বড় বাড়ি, বাগান ও ভূসম্পত্তি ক্রয় করলাে। এককথায় রীতিমতাে সম্পদশালী ও সমাজে একজন ধনী ব্যক্তিরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করলাে। লােকটির মনে কিন্তু একটা ক্ষোভ থেকে গেল। ধনী ব্যবসায়ীরূপে খ্যাতি লাভ করলেও সমাজে অভিজাত পরিবরের সন্তানতুল্য মান সে অর্জন করতে পারলাে না। সে সম্মান তাকে কেউ দেয় না।

তাদের একটি মাত্র পুত্রসন্তান ছিল, নাম লােডডাভিচো। ব্যবসায়ী ঠিক করলাে সে নিজে যা পায়নি তা তার ছেলে যাতে পায় সে সেই চেষ্টা করবে। এজন্যে সে ছেলেকে নিজের ব্যবসায়ে না এনে ফ্রান্সের এক রাজপরিবারে জিম্মা করে দিল যাতে ছেলে রাজকীয় আচরণ শিখতে পারে এবং পরে প্যারিসের অভিজাত সমাজে সে সহজে মেলামেশা করতে পারে। এইভাবে লােডডাভিচো বড় হল এবং কালক্রমে সে এক মার্জিত রুচিসম্পন্ন যুবকে পরিণত হল।

একদিন লােডােভিচো তার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। আলােচনার বিষয় ফ্রান্স, ইংলণ্ড এবং অন্য দেশের সুন্দরী। কোন্ দেশের মেয়ে কত সুন্দরী, তাদের চলনবলন, ঠাকঠকম, ছলাকলা, দৃস্টিভঙ্গি, হাসি কেমন এই সব নিয়ে আলােচনা হচ্ছিল।

দলের কয়েকজন নাইট ছিল যারা ক্রুসেড যুদ্ধের জন্যে পবিত্র ভূমিতে গিয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন বলল, সে অনেক দেশ ঘুরেছে কিন্তু ইটালির বােলােনা শহরের ইনাে ডি গ্যালজির পত্নী বিয়েত্রিচের তুল্য সুন্দরী সে আর দেখে নি। অপূর্ব, আশ্চর্য। নারী যে এত রূপবতী হয় তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তার যে কয়েকজন সঙ্গী মহিলাকে দেখেছে তারাও একমত। বিয়েত্রিচ পৃথিবীর সেরা সুন্দরী।

পরিণত যুবক হলেও লােডডাভিচো এখনও পর্যন্ত কারও প্রেমে পড়ে নি। এখন বন্ধুদের মুখে বিয়েত্রিচের রূপের প্রশংসা শুনে সেই রূপবতীকে দেখবার জন্যে সে অস্থির হয়ে উঠল। কবে সেই অতুলনীয়া রূপসীকে দেখবে এজন্যে সে ছটফট করতে লাগল। সে তার বাবাকে বলল যে, সে খ্রীশ্চানদের পবিত্র তীর্থভূমি জেরুজালেম ও প্যালেস্টাইন যেতে চায়। এতে আর আপত্তি কি? পিতা অনুমতি দিলেন।

লােডডাভিচো বাবাকে ধোঁকা দিল। জেরুজালেম যাবার তার মােটেই ইচ্ছে নেই। সে অ্যানিচিনাে নাম নিয়ে বােলােনা শহরে গিয়ে এক সরাইখানায় উঠল। ভাগ্যক্রমে পরদিনই আড়ম্বরপূর্ণ এক ভােজসভার সে সেই রূপবতী মহিলার দর্শন পেল। তার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। সে যা শুনেছিল বা অনুমান করেছিল, সেই যুবতী তার চেয়ে অনেক বেশি রূপসী, সত্যিই তুলনারহিত। তখনি সে মনে মনে স্থির করলাে বিয়েত্রিচের সঙ্গে পরিচয় ও প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন না করে সে বােলােনা ত্যাগ করবে না।

কি করে সে তার ইচ্ছা পূরণ করবে এ নিয়ে নানা পরিকল্পনা করতে লাগল ও সেগুলি বাতিল করতে করতে ঠিক করলাে যে বিয়েত্রিচের স্বামীর কাছে সে একটা চাকরি নেবে। বাড়িতে একবার ঢুকতে পারলে সুযােগ বুঝে সুন্দরীর সঙ্গে আলাপ করবে।

আসবার সময় সঙ্গে অনেকগুলি ঘােড়া ও কয়েকজন ভৃত্য এনেছিল। ঘােড়াগুলি সে বিক্রি করে দিল এবং ভৃত্যদের অর্থ দিয়ে তাদের বােলােনায় থাকবার ব্যবস্থা করে দিল। কিন্তু সতর্ক করে দিয়ে বলল ভৃত্যরা যেন তার পরিচয় কিছুতেই প্রকাশ না করে। তারপর সেই সরাইখানার মালিকের সঙ্গে পরামর্শ করলাে, তার একটা চাকরি চাই, কোনাে ধনী ব্যক্তির সেবকের চাকরি হলেই ভালাে হয়।

সরাইখানার মালিক বললাে, তাহলে তুমি এক কাজ করাে। তুমি এই শহরের এক বিশিষ্ট ও ধনী ব্যক্তি ইগানাের সঙ্গে দেখা করাে, তােমার এখনই চাকরি হয়ে যাবে। সুদর্শন ও চটপটে সেবকবৃন্দ তাকে ঘিরে থাকবে, এটা তার একটা বিলাস। আমার তাে মনে হচ্ছে তােমাকে দেখলেই তার পছন্দ হবে। ঠিক আছে, ইগানাের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, আমি তােমার কথা বলবাে।

সরাইওয়ালা কথা রেখেছিল এবং সেইদিনই ইগানাের সঙ্গে দেখা করে অ্যানিচিনাের কথা বলল। ইগানাে রাজি হয়ে ছােকরাকে পরদিনই পাঠিয়ে দিতে বলল।

অ্যানিচিনাের চাকরি হয়ে গেল এবং মন প্রাণ দিয়ে প্রভুর সেবা করতে লাগল। প্রভুর মুখের কথা খসতে না খসতেই বা ইঙ্গিত না করতেই অ্যানিচিননা তখনি সে কাজ করে দেয়। প্রভু দারুণ খুশি। তারপর অ্যানিচিনাে প্রায়ই তার আকাঙ্ক্ষিত প্রেমিকাকে দেখে উৎসাহ পাচ্ছে তাই কাজে অবহেলা করে। ইগনাের মন জয় করেছে, বিয়েত্রিচেরও মন জয় করতে পারবে নিশ্চই।

অল্পদিনের মধ্যে অ্যানিচিনাে ইগানাের অপরিহার্য হয়ে উঠল। অ্যানিচিনো ছাড়া ইগানাের চলে না। সমস্ত কাজের ভার দিয়ে ইগানাে নিশ্চিন্ত।

এবার অনেকদিন পরে ইগানো তার বাজপাখি নিয়ে শিকার করতে গেল। সঙ্গে অবশ্য লােকজন গেল। অ্যানিচিনােকে সঙ্গে নিল না, তাকে বাড়ি ও অন্যসব কাজকর্ম তদারকির ভার দিয়ে গেল। বিয়েত্রিচও বাড়িতে রইলাে, একা।

বেচারি সময় কাটাবে কি করে। অ্যানিচিনাে যে ইতিমধ্যেই তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে তা তার জানা ছিল না। বরঞ্চ ছােকরাকে তার ভালােই মনে হয়েছে। তাই তাকে ডেকে বলল, এসাে আমরা দাবা খেলে সময় কাটাই।

অ্যানিচিনাে ভারি খুশি। সে তাে রূপসীর সঙ্গলাভের চেষ্টা করছিল কিন্তু কোনাে ছুতো খুঁজে পাচ্ছিল না। অ্যানিচিনাে দাবা খেলা ভালােই জানত কিন্তু বিয়েত্রিচের মন জয় করবার জন্যে, তাকে উৎফুন্ন রাখবার জন্যে ইচ্ছে করে বাজে চাল দিয়ে খেলায় হেরে যাচ্ছিল। তাকে হারিয়ে বিয়েত্রিচে তাে হেসে কুটিপাটি। ছোকরাকে বিয়েত্রিচের পছন্দ হচ্ছে। কথাবার্তা ও ব্যবহারও ভালাে, সাধারণ ভৃত্যের মতাে নয়, অনেক কিছু জানে, চেহারাটিও খাসা।

বিয়েত্রিচের দু’-একজন পরিচারিকা খেলা দেখছিল কিন্তু কিছুক্ষণ পরে তারা চলে গেল। তাদের কিছু কাজ আছে। এখন ঘরে শুধু অ্যানিচিননা আর বিয়েত্রিচ, আর কেউ নেই।

অ্যানিচিনাে একটা ঘুটি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে সহসা একটা দীর্ঘনিশ্বাস মােচন করলাে। বিয়েত্রিক জিজ্ঞাসা করলাে, তােমার আবার কি হল অ্যানিচিনাে? বার বার হেরে গিয়ে মনে কষ্ট হচ্ছে বুঝি?

অ্যানিচিনাে বলল, মহিলার কাছে খেলায় হারা আমি নিজে গৌরব মনে করি। তা নয়, ব্যাপারটা অন্যত্র এবং কারণটা খুব গভীর।।

তাই বুঝি? তা অ্যানিচিনাে আমার ওপর তােমার যদি কিছু স্নেহ বা বিশ্বাস থাকে তাহলে আমাকে বলে তােমার মন হালকা করতে পারাে।

স্নেহ আর বিশ্বাস শব্দ দুটো শুনে অ্যানিচিনাে মনে সাহস পেল কিন্তু সে আর একবার দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। মেয়েদের মন তাে দারুণ কৌতুহলী। বিয়েত্রিচ বলল, আরে ব্যাপারটা কি বলােই না, শুধু ফোস ফোস করে নিশ্বাস ফেলছ কেন?

বলতে সাহস হচ্ছে না দেবী, সত্যি কথা বললে তুমি হয়ত রাগ করতে পারাে এবং অপরকে বলে দিতেও পারাে।

বিয়েত্রিচ বলল, আরে না না। তােমার যা ইচ্ছে বলতে পারাে, আমি মােটেই রাগ করবাে না আর কাউকে কিছু বলব না, কথা দিচ্ছি।

তখন অ্যানিচিনাে আগে নিজের আসল পরিচয় দিল এবং সুদূর প্যারিসে বসে বিয়েত্রিচের রূপ সম্বন্ধে যা শুনেছে তাও বলল। বলতে কি তাকে দেখবার জন্যেই সে প্যারিস থেকে বােলােনায় এসেছে। এবং দেখামাত্রই তার প্রেমে পড়েছে। আশ্চর্য কিছু নয় দেবী। তােমাকে দেখে যে কতজন প্রেমে পড়েছে তা তুমিও জানাে না। এবার আমার আন্তরিক নিবেদন তুমি কি আমার প্রতি দয়া করবে? আমার ইচ্ছা কি পূরণ হবে? আমি কি তােমাকে পাবাে? কাতরস্বরে বলতে লাগলাে অ্যানিচিননা, আর আমার ইচ্ছা। বদি পূরণ করতে না দাও তাহলে আমাকে তাড়িয়ে দিয়াে না, আমি এখান থেকে দূরে থেকেই তােমাকে ভালােবেসে যাব।

বিয়েত্রিচ অ্যানিচিনাের আন্তরিকতা অনুভব করে তার প্রতি প্রথমে সহানুভূতিশীল হল এবং বুঝতে পারল সে তাকে ভালবাসে। এমনভাবে কেউ তার কাছে প্রেম নিবেদন করেনি। একদৃষ্টে কিছুক্ষণ পূর্বকের দিকে বিয়েত্রিচ চেয়ে রইল, তারপর নিজেই দীর্ঘনিশ্বাস মােচন করলাে। সে অভিভূত। বলল, অ্যানিচিননা প্রিয়তম, নিরাশ হােয়াে না। হ্যা, আমি তােমাকে আমার হৃদয় উজাড় করা ভালবাসা দেবাে

কারণ অনেকে যদিও আমার কাছে প্রেম নিবেদন করছে কিন্তু আজ পর্যন্ত এমন আন্তরিকভাবে কেউ। প্রেম নিবেদন করে নি।

বিয়েত্রিচির কথা শুনে অ্যানিচিনাের মনে হল আকাশ বুঝি নীল, বাতাস তার দেহে স্নেহস্পর্শ বােলাচ্ছে, পাখির কাকলি আরও মধুর, টবের ঐ বাহারী ফুলগাছটা থেকেও যেন সুমধুর গন্ধ বেরােচ্ছে।

বিয়েত্রিচ বলল, অ্যানিচিনাে আজ রাতেই তােমার অভিলাষ পূর্ণ হবে। আমি রাতে আমার শয়ন ঘরের দরজা ভেজিয়ে রাখবাে। আস্তে দরজা ঠেলে মাঝরাতে তুমি আমার ঘরে ঢুকবে। তুমি তাে দেখে আমাদের পালংক বিশাল, পাঁচজন মানুষ অনায়াসে পাশাপাশি শুতে পারে। পালংকের কোন্ দিকে শুই তাও তাে তুমি জানাে। তুমি সেই দিকে আসবে। আমি যদি ঘুমিয়ে থাকি তাহলে আমাকে স্পর্শ করবে, আমি জেগে উঠে তােমার ও আমার কামনা পূর্ণ করবাে। আমি যে আমার কথা রাখবাে তার নিদর্শনস্বরূপ আমি তােমাকে এখনই চুম্বন করবাে, এই বলে বিয়েত্রিচ অ্যানিচিনােকে বুকে চেপে ধরে তার ওষ্ঠে গভীর চুম্বন করলাে। অ্যানিচিনােও প্রতিদানে চুম্বন করলাে। তারপর সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে প্রদত্ত কাজগুলি করতে লাগলাে আর অপেক্ষা করতে লাগল কখণ রাত্রি গভীর হবে।

সন্ধ্যা হতেই ইগানাে শিকার করে ফিরে এলাে। যথাসময়ে নৈশভােজন সেরে শুয়ে পড়ল। সারাদিন শিকারের জন্যে ছােটাছুটি করে পরিশ্রান্ত, অচিরে গভীর নিদ্রায় অচেতন। কিছু পরে বিয়েত্রিচিও শয়নঘরে প্রবেশ করলাে কিন্তু অন্য দিনের মতাে দরজা বন্ধ করে দিলেও খিল তুলে দিল , শুধু ভেজিয়ে রাখলাে।

তারপর রাতে যথা সময়ে অ্যানিচিনাে এলাে। তার প্রিয়তমার শয়নঘরের দরজা ভেজানােই ছিল। খুব আস্তে, যাতে আওয়াজ না হয় এইভাবে দরজা খুলে প্রেমিকপ্রবর ঘরে ঢুকে দরজায় খিল তুলে দিল।

তারপর বিয়েত্রিচ খাটের যেদিকে শােয় সেইদিকে গেল। ঘর অন্ধকার।

ইগানাে ঘুমােচ্ছে, তার নিশ্বাস পতনের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। অ্যানিচিনাের একটু সাহস বাড়লো। সে তার প্রেমিকার পাশে গিয়ে তার একটি হাত প্রেয়সীর বুকের ওপর রাখল। বিয়েত্রিচ ঘুমােয় নি, জেগে ছিল। সে তার প্রেমিকের হাতখানি নিজেই দুই কোমল হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলাে। অ্যানিচিনােকে একটু আদর করে তার একটা হাত বেশ জোরে ধরে রইলাে। বেশ বড় খাট। স্বামী একটু তফাতে শুয়েছিল। বিয়েত্রিচ অ্যানিচিনাের জামার হাতসমেত হাতটা সজোরে ধরে রেখে স্বামীর পাশে গিয়ে তাকে ঠেলা দিয়ে জাগিয়ে তুললাে।

স্বামীর ঘুম ভাঙল কিন্তু পুরাে নয়। তন্দ্রাজড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলাে, কি হল আবার? এখন…….।

বিয়েত্রিচ বললাে, তা নয়, তুমি ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরবে তারপর তাে ঘুমিয়েই পড়লে তাই তােমাকে বলার সুযােগ হয়নি। আচ্ছা আগে বলাে তাে তােমার যে এত সেবক আছে তার মধ্যে সবচেয়ে কাজের, সৎ এবং অনুগত কে?

ইগানাে বললাে, তুমি যখন উত্তরটাই জান যে আমি অ্যানিচিনাের নামই বলবাে তখন এত রাতে আমাকে জাগিয়ে প্রশ্ন কেন ? কারণ আছে, বিয়েত্রিচ বললাে।

ওদিকে অ্যানিচিনাে ভয় পেয়ে গেল। সে ভাবলাে, ইগানাের তাে ঘুম ভেঙেছে, এবার বিয়েত্রিচ তাকে নিশ্চই ধরিয়ে দেবে কিন্তু বিয়েত্রিচ তার হাত এমনভাবে ও জোরে ধরে আছে যে অ্যানিচিনাে হাত ছাড়াতে পারলাে না। ভয়ে তার বুক ঢিব ঢিব করতে লাগল। তারপর বিয়েত্রিচের যেসব কথা শুনতে লাগল তাতে ভাবল তার নিস্তার নেই।

বিয়েত্রিচ তার স্বামীকে বলল, আমিও তােমার সঙ্গে একমত ছিলুম, আমি তাকে খুব বিশ্বাসী মনে করতুম। কিন্তু কাল তুমি যখন বাজপাখি নিয়ে শিকার করতে গিয়েছিলে তখন ও সুযােগ পেয়ে আমার কাছে কুপ্রস্তাব করেছে। কিন্তু ঘরে তখন ও ছাড়া আর কেউ ছিল না, তাই আমি ওকে বললাম, তােমার ইচ্ছে পূর্ণ হবে। আমি মাঝরাত্রির একটু পরে বাগানে গিয়ে দেবদারু গাছের নিচে তােমার জন্যে অপেক্ষা করবো। তুমি একটা কাজ করাে না। আমার একটা স্কাট পরে নাও আর বড় ভেইল দিয়ে মাথা ঢেকে বাগানে যাও, দেখবে চোড়া নিশ্চয় আমার আশায় দাঁড়িয়ে আছে তারপর যা করবার তুমি করবে।

তাই নাকি? ব্যাটার এতাে সাহস ? তাহলে তােমাকে ভােগ করবার জন্যে ওর কাজকর্ম সবই ছল ? দাড়াও মজা দেখাচ্ছি, ওর আশ মিটিয়ে দিচ্ছি তােমার স্কাট আর ভেইল কোথায় ?

ঘাট থেকে নেমে সামনে আলনায় হাত দিলেই পাবে। ঘর অন্ধকার। অ্যানিচিননাকে ইগানাে দেখতে পায়নি। সে খাট থেকে নেমে হাতড়ে হাতড়ে তার বৌয়ের স্কাট আর ভেইল কোনােরকমে পরে দরজা বুলে বেরিয়ে বাগানে গিয়ে দেবদারু গাছের তলায় অপেক্ষা করতে লাগলাে। ইগানাে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরই বিয়েত্রিচ উঠে দরজা বন্ধ করে খিল তুলে দিল। অ্যানিচিনাে যেন দ্বিতীয় জীবন পেল। মনে মনে প্রেয়সীর প্রশংসা করতে লাগল। এতক্ষণ তাে তাকে শাপশাপান্ত করছিল, এখন মনে অন্য ভাব।

ঘাটে ফিরে এসে প্রেমিককে বলল, তােমার এইসব পােশাক খুলে ফেল। ভয় নেই, ইগানাে এখন আসবে না। তারপর ওরা দুম্বজনে একত্রিত হয়ে কি করে সময় কাটাল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এবার অ্যানিচিনাের যাবার সময় হয়েছে। বিয়েত্রিচ তাকে বলল, প্রিয়তম পােশাক পরে নাও, পরেছ,

বেশ এবার রুপাে বাঁধানাে বেতের এই মােটা ছড়িটা হাতে নাও। তারপর বাগানে গিয়ে দেখবে আমার স্বামী দাঁড়িয়ে আছে। তুমি ধরে নেবে যে আমি দাঁড়িয়ে আছি এবং আমাকে উদ্দেশ্য করে এমন সব কথা বলবে যেন কাল তুমি আমার সতীত্ব পরীক্ষা করেছিলে। আমাকে যা ইচ্ছে তাই বলে গালাগাল তাে দেৰেই উপরন্তু নারীকে চড়চাপড় দেবে ও এই লাঠি দিয়ে পিঠে বেশ কয়েক ঘা লাগিয়ে দেবে। একবার ভেবে দেখাে এরপর থেকে আমাদের কি আনন্দেই না দিনরাত কাটবে।

ইগানাে বাগানে গাছটার নিচে বেদিতে বসেছিল। অ্যানিচিনােকে আসতে দেখে সে উঠে দাঁড়িয়ে দু’হাত বাড়িয়ে তাকে যেন আলিঙ্গন করতে গেল এবং আলিঙ্গনের ছলে তাকে টিপে ধরবে ও প্রহার করবে কিন্তু অ্যানিচিনাে বেশি কাছে গেল না। সে মানুষটাকে দেখেই কুৎসিত ভাষায় তাকে গাল দিতে আরম্ভ করলাে, পাজী দুশ্চরিত্র মাগী, এই তাের ব্যবহার? তাের অমন ভালাে স্বামী তােকে বিশ্বাস করে আমার জিম্মায় রেখে গেল আর তুই কিনা আমাকে প্রেম নিবেদন করলি? বলেই অ্যানিচিনাে তেড়ে গিয়ে ইগানাের গালে কয়েকটা চড় লাগিয়ে দিয়ে তার পিঠে ও কোমরে বেশ কয়েক ঘা লাঠির ঘা বসিয়ে দিল। ইগানাে যন্ত্রণায় কাতর। প্রহারের ঘা থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্যে সে দ্রুত পলায়ন করলাে।

ঘরে ফিরে কাতরাতে কাতরাতে ঘটনার বিবরণ শােনাল। তােমাকে হাসিখুশি খােলামেলা দেখে বােধহয় ভেবেছিল এ নারী সহজলভ্যা তাই হয়ত তােমাকে পরীক্ষা করতে চেয়েছিল। যাক আমাদের ভুল ভাঙল। লােকটা সত্যিই বিশ্বাসী বিয়েত্রিচ বলল। আরে আমি তাে সেইজন্যে বাগানে যাই নি। আমারও ইচ্ছে ছিল ওকে পরীক্ষা করা তাই তাে তােমাকে পাঠালুম। ভাগ্যিস নিজে যাইনি নইলে আমাকে তাে মার খেতে হতাে।

ইগানাে বলল, এখন থেকে অ্যানিচিনােকে আমরা পরিবারের একজন মনে করবাে। বেতন বৃদ্ধি তাে করে দেবই উপরন্তু ওকে আরও দায়িত্ব দেব। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। ইগানাে আরও মনে মনে ভাবল তার বৌটিও পাহাড়ী ঝর্নার জলের মতাে পবিত্র।

এই ঘটনা নিয়ে পরে ওরা তিনজনে একসময়ে আলােচনা করে খুব হাসাহাসি করেছিল। এরপর থেকে অ্যানিচিনাে ও বিয়েত্রিচ আরও সহজে মিলিত হবার সুযােগ পেয়ে গেল।

 

অষ্টম গল্প

এক স্বামী তার পত্নীর চরিত্রে সন্দিহান হল। কারণ ছিল। পত্নী পায়ের বুড়াে আঙুলে একটা দড়ি বেঁধে জানালা দিয়ে বাইরে ঝুলিয়ে দিত। পত্নীর প্রেমিক দড়ি টেনে ঘরে ঢুকতাে। একরাত্রে স্বামী যখন প্রেমিককে তাড়া করলাে সেই সুযােগে পত্নী বিছানায় তার জায়গায় অন্য একটা মেয়েকে শুইয়ে রাখল। স্বামী ফিরে মেয়েটাকে নিজের পত্নী মনে করে খুব মারলাে ও তার মাথার চুল কেটে দিল। পরে তার শ্যালকদের ও শাশুড়ীকে ডেকে আনল কিন্তু ওরা এসে দেখল স্বামী বানিয়ে গল্প বলেছে। তখন স্বামীকে বেইজ্জত হতে হল।

সকলে ফিলামেনার গল্প মন দিয়ে শুনল। তারা বললাে শয়নঘরে বিয়েত্রিচ যখন অ্যানিচিনাের হাত চেপে ধরেছিল তখন বেচারার দুরবস্থা কল্পনা করে খুব মজা অনুভব করছিল।

এবার নেফাইলকে ডেকে রাজা বলল, এবার তােমার পালা।

নেফাইল একটু গুছিয়ে বসে হেসে বললাে, তােমরা তাে পরপর কয়েকটা দারুণ গল্প শুনলে, এরপর কি আমি জমাতে পারবাে? তবুও চেষ্টা করে দেখি, ঈশ্বর সহায়।

আমাদের এই সুন্দর শহরে আরিগুচ্চিও বারলিন গিয়েরি নাম এক সওদাগর বাস করতাে। সে রীতিমতাে ধনী ছিল কিন্তু বনেদী বংশের একটি মেয়েকে বিয়ে করে ভুল করলাে। দুই বংশের আচারব্যবহার রীতিনীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন তাই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে উঠল না। স্ত্রীর নাম মােনা সিসমােণ্ডা! এছাড়া ব্যবসায় সূত্রে সওদাগরকে প্রায়ই বাইরে যেতে হতাে। অধিকাংশ সময়েই মােনা বাড়িতে একা থাকতাে।

যুবতী বধু যার অঙ্গে ও মনে তরঙ্গ সে কি উপবাসী থাকতে পারে? যৌবনের তাে একটা চাহিদা আছে। সে রুবারেটো নামে এক যুবকের প্রেমে পড়ল। স্বামী বাড়ি থাকে না এতএব মিলিত হতে হতে তাদের সাহসও বেড়ে গেল ফলে মােনা কিছু অমনােযােগীও হল। যথােপযুক্ত সাবধানতা অবলম্বনে তার কিছু অবহেলা হল।

অসমীচীন কিছু ব্যাপার দেখে আরিগুচ্চিও মােনাকে সন্দেহ করতে আরম্ভ করলাে। সে স্থির করলাে ব্যবসা এখন মাথায় থাকুক, অসতী স্ত্রীর ব্যাপারে একটা ফয়সালা করতে হবে। আপাতত সে বাইরে যাবে না। বাড়িতেই থাকবে, স্ত্রীর প্রেমিককে ধরতে হবে। স্ত্রীকে সে কড়া নজরে রাখল। রাত্রে স্ত্রী না ঘুমানো পর্যন্ত সে জেগে থাকত। খুট করে কোথাও একটু আওয়াজ হলে উঠে দেখে আসতাে। বারটোকে আর কাছে না পেয়ে মােনা কষ্টভােগ করতে লাগলাে।।

এভাবে তাে থাকা যায় না। কিছু একটা করতে হবে। রাস্তায় মােনার পরিচারিকার সঙ্গে দেখা হলে বারেটো তার প্রেমিকার খোঁজ নেয় আর মােনাকে বলতে বলে কি করে দু’জনে দেখা হবে তার শীঘ্র ব্যবস্থা করতে।

মােনাও তাে তাই চায় কিন্তু কোনাে পথ তাে খুঁজে পাচ্ছে না। অবশেষে মােনার মাথায় একটা মতলব এলাে। তার শােবার ঘরটা রাস্তায় ধারে আর আরিগুচ্চিও একবার ঘুমিয়ে পড়লে তাকে জাগানাে শক্ত, মড়ার মতাে ঘুমােয়।।

মােনা ঠিক করলাে সে রুবারটোকে রাতে সদর দরজায় আসতে বলবে আর ও গিয়ে দরজা খুলে তাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে আসবে।

কিন্তু রুবারটো কখন এলাে মােন কি করে জানতে পারবে? এজন্যে মােনা বলল, সে তার পায়ের বুড়াে আঙুলের সঙ্গে একটা সরু দড়ি বেঁধে দড়িটা জানালা গলিয়ে, রাস্তায় ফেলে রাখবে। রুবারটো এসে সেই সরু দড়িটায় টান দেবে। ইতিমধ্যে তার স্বামী ঘুমিয়ে থাকলে সে দড়ি খুলে বিছানা থেকে উঠে নিচ নেমে দরজা খুলে দেবে। মােনা না ঘুমােলে স্বামী তাে আবার ঘুমােয় না তাই মােনা মটকা মেরে পড়ে থাকে। কিন্তু স্বামী যদি জেগে থাকে মােনা দড়িটায় টান দেবে তখন রুবারটো ফিরে যাবে। সে রাতে আর মিলন হবে না।

এই ব্যবস্থা বেশ কিছুদিন চলল। ওরা দু’জনে প্রায়ই মিলিত হয়, মাঝে মাঝে দু’একটা দিন বাদ যায়। কিন্তু একদিন ফাস হয়ে গেল।

মােনা ও তার স্বামী দু’জনেই শুয়েছে। মােনা এদিন সত্যিই আগে ঘুমিয়ে পড়েছে। আরিগুচিওর তখনও ঘুম আসে নি। সে খাটে পাশ ফিরতে তার পায়ে একটা দড়ি লাগল। বিছানায় কিসের দড়ি?

স্বামীর মন তাে সন্দেহপ্রবণ। সে উঠে বসলাে। হাতড়ে দেখল দড়িটা মােনার পায়ের বুড়ো আঙুলের সঙ্গে বাঁধা! শয়তানী। মনে হচ্ছে এটা কোনাে সংকেতের ব্যাপার। আর একটু হাতড়াতে দেখল দডিটা বেশ লম্বা, জানালা গলিয়ে রাস্তায় দড়ির অপর প্রান্ত ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে তাে তার অনুমান ঠিক।

আরিচ্চিও মােনার পায়ের বুড়াে আঙুল থেকে সাবধানে দড়িটা খুলে নিজের পায়ের বুড়াে আঙুলে বেঁধে অপেক্ষা করতে লাগল। মােনা জানতে পারলাে না।

রুবারটো যথাসময়ে এসে দড়িতে টান দিয়েছে। দড়িটা ভালাে করে বাঁধা ছিল না। গিটটা আলগা ছিল। দড়িটা খুলে আলগা হয়ে গেল। রুবারটো আর একবার টান দিতে দড়িটা তার হাতে চলে এলাে। কি ব্যাপার? তার কি রকম সন্দেহ হলাে। সে দরজার সামনে না এসে একটু তফাতে অপেক্ষা করতে লাগলাে।

আরিচ্চিও চট করে বিছানা থেকে উঠে তলােয়ার ও ছােরা সমেত বেল্ট কোমরে বেঁধে নিল। দেখতে হচ্ছে ব্যাপারটা কি? তাকে ঠকানাে? এবার দু’জনেই বুঝবে আরিগুচ্চিও সােজা মানুষ নয়। তার গায়ে বেশ জোর আছে, ষাড়ের মতো সে একরােখা। লােকটাকে সে উচিত শিক্ষা দেবে।

সদর দরজা খােলবার সময় যথেষ্ট আওয়াজ হল। মােনা দরজা খুললে একটুও আওয়াজ হয় না। রুবারটোও চতুর। আওয়াজ শুনেই সে বুঝলাে এ নিশ্চই মােনা নয় এবং তখনি আরিচ্চিওকে দেখতে পেয়েই সে দৌড় লাগাল। ছােকরাকে পালাতে দেখে আরিগুচ্চিও তাকে অনুসরণ করতে লাগল।

কিন্তু আরিচ্চিও যখন রুবারটোকে প্রায় ধরবাে ধরবাে করছে সেই সময়ে রুবারটো রুখে দাঁড়াল। তার সঙ্গেও তলােয়ার ছিল, তলােয়ার বার করলাে। আরিগুচ্চিও তার তলােয়ার বার করলাে। পরস্পরকে গালাগাল দিতে দিতে সানিকসিনিক করে তলােয়ার যুদ্ধ আরম্ভ হলাে।”

এদিকে মােনার ঘুম ভেঙে গেছে। উঠে দেখল দড়ি নেই, স্বামী নেই, দরজা খােলা। বাইরে যেন পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। তবেই তাে কাণ্ড হয়েছে। স্বামী ফিরে এলে কি কাণ্ড হবে তা অনুমান করে মােনা শংকিত হয়ে পড়ল। মােনা ভীষণ চালাক। সে তখনি তার পরিচারিকাকে ঘুম থেকে তুলে এনে তার বিছানায় শুইয়ে দিল।

পরিচারিকা তাে ভয় পেল। মােনা বললাে, মার খাবি সেই ভয় করছিস? আমি তােকে টাকা আর গয়না দিয়ে পুষিয়ে দেবাে কিন্তু খবরদার কথাটি বলবি না আর মুখটাও লুকিয়ে রাখবি। ভয় নেই, ঘর অন্ধকার তােকে ও চিনতে পারবে না। পরিচারিকাকে তার বিছানায় শুইয়ে মােন অন্য একটা ঘরে লুকিয়ে রইল।

ওদিকে আরিচ্চিও আর রুবারটো তলােয়ার চালাচ্ছে, চীৎকার করে এ ওকে গাল দিচ্ছে। পাড়ার লাকের ঘুম ভেঙে গেল। তারা ওদের পাল্টা গাল দিতে লাগল। আরিগুচ্চিও ভাবলাে কেউ যদি ঘর যেকে বেরিয়ে আসে তাহলে তাে তাকে চিনতে পারবে। তার মতাে একজন মানী লােক একটা বাজে ছোককরার সঙ্গে মারামারি করছে, তােক জানাজানি হলে তার পক্ষে অপমানজনক, এজন্যে সে রণে ভঙ্গ দিয়ে বাড়ি ফিরে তলােয়ারের বেল্ট খুলে স্ত্রীর উদ্দেশে কুৎসিত ভাষায় গাল দিতে দিতে শােবার ঘরে কে ‘বৌকে মারতে আরম্ভ করলাে। ভ্রষ্টা, নষ্টনারী ইত্যাদি বাছা বাছা বিশেষণও প্রয়ােগ করতে লাগল। আর সে কি মার, যে কোন মেয়ের পক্ষে সহ্য করা শক্ত। তার ওপর মানুষটা বলশালী।

পরিচারিকা ভীষণ কাদতে আরম্ভ করলাে। বিকৃত কণ্ঠে বলতে আরম্ভ করলাে, আর করবাে না, মাপ করাে, আর মেরাে না, বাবা গাে আর পারছি না। কান্নার জন্য মেয়েটির স্বর বিকৃত তার ওপর আরিচ্চিও রাগে তখন আত্মহারা। এবার সে মার থামিয়ে ‘দাঁড়া বেশ্যামাগী তােকে উচিত সাজা দিচ্ছি’ বলে কাচি এনে কচকচ করে তার মাথার লম্বা চুলগুলাে কেটে নিয়ে বলল, ‘তােকে গাল দিতে, মারতে নেকি চুলগুলাে হাতে ধরতেও আমার ঘেন্না করছে কিন্তু এ চুল আমি ফেলবাে না। এগুলাে নিয়ে আমি তাের বাপের বাড়ি চললুম। তাদের চুল দেখাবাে আর বলবাে তােমাদের গুণধর মেয়ের কাণ্ড দেখবে চলো। তাের ভায়েদের ডেকে আনছি। তারাও একচোট মার দেবে কিন্তু তােকে আমি আর আমার বাড়িতে আর রাখছি না, দুর দুর করে তাড়িয়ে দেব।

কথা শেষ করে আরিগুচ্চিও সদর দরজা বন্ধ করে দিয়ে হনহন্ করে তার শ্বশুরবাড়ির দিকে চলাে।

আরিচ্চিও বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মােনা সিসমােণ্ডা শােবার ঘরে এসে আলাে জুলল। পরিচারিকা তখনও ফুপিয়ে কাঁদছে। মােনা তাকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করলাে, চুম্বন করলাে, সান্ত্বনা দিল। তারপর আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে মলম ও তেল লাগিয়ে দিয়ে প্রচুর টাকা ও দু’একটা ছােট অলংকার দিল। এগুলি পেয়ে পরিচারিকা ব্যথাবেদনা ভুলে গেল। তার মুখে হাসি ফুটল। মোনা বলল, চুলের জন্যে দুঃখ করিস না। তাের চুলের মাথা, তাড়াতাড়ি চুল আবার বড় হবে। তারপর তাকে তার বিছানায় পাঠিয়ে দিয়ে বলল, এবার তুই ঘুমাে আমি একটু ওদিকটা দেখি।

মােনা শােবার ঘরে এসে বিছানা নতুন করে পাতল। বালিস ফুলিয়ে যথাস্থানে রাখল, চাদরটা টান টান করে পাতল। কেউ যেন বিছানায় এখনও শােয়নি, এইরকম মনে হবে। তারপর ঘরের বাইরে ঘেরা বারান্দার বড় আলাে জ্বেলে রাতের পােশাক ছেড়ে অন্য পােশাক পরলাে, চুল আঁচড়াল, যেন এখনও সে শুতে যায় নি। স্বামী বাড়ি ফিরলে পােশাক বদলে শুতে যাবে।

আর একটা ছােট আলাে জ্বেলে সেলাইয়ের পেটিকা নিয়ে বসলাে। ভায়েদের নিয়ে স্বামী ফিরে এলে সে কি বলবে তাই মনে মনে আওড়াতে লাগল। আরিচ্চিও তখনও শান্ত হয়নি। তার মাথায় তখন আগুন জ্বলছে। শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে বন্ধ দরজায় দমাদ্দম করে ঘা দিতে আরম্ভ করলাে, দরজা খােলাে, আমি আরিগুচ্চিও।

তিন ভাই আর তাদের মা আলাে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলাে, কি হয়েছে, এত জোরে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিলে কেন?

হয়েছে আমার মাথা আর মুণ্ডু। আপনার মেয়ে আর তােমাদের ছিনাল বােনের কীর্তি শােনন, বলে আরিচ্চিও মােনার আদ্যোপান্ত কাহিনীটি বলল।

সব শুনে মা কেঁদে ফেলল, বলল তিনি মেয়েকে মানুষ করেছে। এসব কুৎসা তার বিশ্বাস হয় না কিন্তু তিন ভাই ক্ষেপে লাল। তারা বলল, চলাে আমরা যাই, হারামজাদীকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে তুমি তাে চুল কেটে নিয়েছ, আমরা ওকে নেড়া করে দেব। ছেলেরা আরও কি করবে এমন আশংকা করে মাও ছেলেদের ও জামাইয়ের অনুসরণ করলেন। কে জানে জামাই নিজেই হয়ত দোষ করে বৌএর ঘাড়ে চাপাবার চেষ্টা করছে। মা এইরকম ভাবছেন।

আরিচ্চিওর বাড়ি পৌঁছে তিন ভাই তাে দাপিয়ে ভেতরে ঢুকল। তারপর ওপরে উঠে বােনকে শান্তভাবে বসে সেলাই করতে দেখে হকচকিয়ে গেল। বােনও যেন অগ্নিমূর্তিতে তিন ভাইকে দেখে অবাক হয়ে গেল। বলল, তােমরা এতরাত্রে হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে কোথা থেকে আসছে। চারজনে মিলে কোথাও নেশা করছিলে নাকি? মা তখনও এসে পৌছন নি।

এক ভাই বলল, নেশা? নেশা করবাে কেন? কিন্তু এসব কি শুনছি পাজী মেয়ে। আমাদের বােন হয়ে তুই আমাদের নাম ডােবালি, বাড়িতে তুই পরপুরুষ ঢােকাতে আরম্ভ করেছিস?

ভায়েদের মুখে এসব কথা শুনে মােনা ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাে। সে বলল, তােমরা এসব কি বলছো? নিশ্চই আমার স্বামী তােমাদের কানে এইসব কথা মিছেমিছি তুলেছে কারণ ও নিজেই এই কাজ করে কিনা।

আরিগুচ্চিও হতভম্ব। সে এসব কি দেখছে? একটু আগে সে মােনাকে বেদম মার দিয়ে গেল, যা চড় দিয়েছিল তাতে ওর গালে কালসিটে পড়ে যাবার কথা। ও তাে দিব্যি বসে রয়েছে। গালে কোনাে দাগ নেই। সে কি জেগে আছে না স্বপ্ন দেখছে?

মােনা বলতে লাগল, সন্ধ্যা না হতেই বাবু বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। তারপর ইয়ারবকসিদের সঙ্গে মদ গিলে নষ্ট দুষ্ট মেয়েমানুষদের বাড়ি যান। তারপর অনেক রাত্রে মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরেন। আমাকে রােজ ততক্ষণ জেগে বসে থাকতে হয় কারণ ওঁর সেবা করতে হবে। আজ বেশি রাত্রি হয়ে গেছে কিংবা নেশাটা বেশি হয়েছে কিংবা আজ মনের মতাে মেয়েমানুষ পান নি তাই যত রাগ সব পড়েছে আমার ওপর। আরিগুচ্চিও তুমি এসব কি বলেছ আমার নামে? আজ তাে তুমি সেই যে সন্ধ্যার সময় বাড়ি থেকে বেড়িয়েছ তারপর তাে আর বাড়িই ফের নি, তা তুমি আমাকে মারলে কখন?

আরিগুচ্চিও চেঁচিয়ে উঠল, এই কথা! আমি বাড়িতে ছিলুম কিনা এখনি দেখিয়ে দিচ্ছি। মাথার ওপর থেকে ভেইল সরিয়ে নে, তাের কাটা চুল তাে আমার হাতে।

মােনা কাদতে কাদতে এবার হেসে ফেলল। তারপর মাথা থেকে ভেইল নামিয়ে মাথার চুল খুলে দিল, পিঠে চুল ছড়িয়ে পড়ল। তার স্বামী চুপসে গেল। তার মুখ সাদা হয়ে গেল। সে যে কাটা চুল দেখিয়ে স্ত্রীর সমস্ত উক্তি মিথ্যা প্রমাণ করবে তাই তাে হল না। সে নিজেও বুঝতে পারছে না।

এবার মােনার ভায়েরা তার ওপর ঝাপিয়ে পড়ল। তাকে অকথ্য কুকথ্য ভাষায় গাল দিতে লাগল। বলল, কোন্ বেশ্যালয়ে গিয়ে কার মাথার চুল কেটে এনেছিস আর আমাদের বােনের ঘাড়ে সব দোষ পাচ্ছিস ইত্যাদি বলে তাকে রীতিমতাে প্রহার করলাে।

জামাইকে মারতে মা ছেলেদের নিষেধ করলেন। বললেন, মাথার ওপরে ভগবান আছেন, তিনিই আমার মেয়েকে রক্ষা করছেন।

যাবার আগে ভায়েরা বলে গেল, এবার অল্পর ওপর দিয়ে গেল, ফের যদি আমাদের বােনের নামে মিথ্যে নালিশ করাে তাহলে তােমার জিভ কেটে দেব, সাবধান।

আরিচ্চিও অপদস্থর একশেষ, মার খেয়ে চোরের মতাে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। এরপর থেকে সে তার স্ত্রীকে আর ঘাঁটায় নি। স্ত্রী তাে মনে মনে খুব হাসল কিন্তু পুরনাে স্বভাব ছাড়তে পারল না। এবার থেকে নির্ভয়ে তার প্রেমিকের সঙ্গে মিলিত হতে লাগল।

 

নবম গল্প

নাইকোস্ট্রেটাসের পত্নী লিডিয়া পাইরাসের প্রেমে পড়ল। পাইরাস বলল লিডিয়া যদি তিনটে কাজ করতে পারে তাহলে সে বুঝবে লিডিয়া তাকে ভালােবাসে। কাজ তিনটে তাে লিডিয়া করলােই উপরন্তু স্বামীর সমক্ষে পাইরাসের সঙ্গে দেহমিলন করলাে এবং স্বামীকে বিশ্বাস করালাে যে সে চোখে ভুল দেখছে।

নেফাইলের গল্প শুনে মেয়েদের হাসি আর থামে না। তারা কলকল করে হেসেই চলেছে। শেষে রাজা তাদের ধমক দিয়ে থামিয়ে প্যানফিলােকে গল্প বলতে বলল।

প্যানিফিললা বলল, প্রেমের জন্য শুধু পুরুষরাই দুঃসাহসিক কাজ বা অসাধ্য সাধন করতে পারে না, মেয়েরাও পারে। আমি এইরকম একটু চতুর ও দুঃসাহসী মেয়ের গল্প বলবাে। তবে তার ভাগ্যও তাকে সাহায্য করেছিল যদিও তােমরা কেউ হয়ত বলবে যে ক্ষেত্রটা মেয়ে নিজেই তৈরি করেছিল আর তুমি বলছো তার সহায় ছিল। যাই হােক এবার গল্প বলি, শােননা :

গ্রীসের প্রাচীন শহর আর্গস-এ নাটইকোস্ট্রেটাস নামে একজন ধনী ভূস্বামী বাস করতাে। বর্তমানে তার বয়স হয়েছে। তার নানানারকম শখ আহ্লাদ আছে। মানুষটি ধীর ও স্থির, ক্রোধ জয় করেছে। তার স্ত্রী যেমন সুন্দরী তেমনি সাহসী, চটুল ও তেমনি চতুর, তবে লিডিয়া স্বামী অপেক্ষা বয়েসে অনেক ছােট।

বলেছি লােকটির নানারকম শখ ছিল যার মধ্যে ছিল শিকার। এজন্যে সে কয়েকটা বাজপাখি, বেপাল ডালকুত্তা, আর কয়েকজন শিকারী পালন করতাে। নাইকোস্ট্রোটাসের এই শিকারী দলের তদারক করতাে পাইরাস নামে এক যুবক। সুদর্শন, দীর্ঘদেহী ও খুব চটপটে। যে কোনাে কাজ সে দ্রুত ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারতাে।।

বৃদ্ধের তরুণী পত্নী লিডিয়া এই পাইরাসের প্রেমে পড়ে গেল। দিনরাত সে পাইরাসের কথাই ভাবে, সুযোগ পেলে তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। পাইরাস কিন্তু লিডিয়াকে গ্রাহ্য করতাে না, তার দিকে মন দিত না, হাজার হলেও প্রভুপত্নী তাে! এজন্যে লিডিয়া মনে মনে ব্যথা অনুভব করতাে। কিন্তু পাইরাস তাে জানে না যে তার প্রতি লিডিয়ার দুর্বলতা আছে। সেটা তাকে জানাতে হবে। এজন্যে লতিয়া তার প্রিয় ও বিশ্বাসী পরিচারিকা লুসকাকে ডেকে বলল, তােকে আমার দূতীগিরি করতে হবে কিন্তু খুব গােপনে, কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও না জানতে পারে। লুসকা রে তোকে আর কি বলবাে, আমার এই উদ্বেলিত যৌবন বৃথা যাচ্ছে, বৃদ্ধ স্বামীকে শ্রদ্ধা করি কিন্তু তার সঙ্গে প্রেম করা যায় না। আর সেও আমাকে তৃপ্তি দিতে পারে না। আমি আর উপবাসী থাকতে পারছি না রে, শরীরে অসহ্য তাপ আর জ্বালা। পাইরাসকে আমার খুব পছন্দ, ও আমার মনােবাসনা পূর্ণ করতে পারবে। ওকে না পেলে আমার জীবনটাই বুঝি ব্যর্থ হয়ে যাবে রে, হয়ত মরেই যাবাে। তুই তার সঙ্গে দেখা করে আমার কথাগুলাে, আমার হৃদয়ের বেদনা তাকে বলে। কোথায় আমাদের মিলন হবে সেটাও তুই ঠিক করে আসবি। তুই তাে সব জানিস।

লুসকা দূতীগির করতে রাজি হয়ে একদিন সময় বুঝে পাইরাসের কাছে প্রভুপত্নী সিডিগার অভিলাষ জানাল। প্রভুপন্তী তার প্রেমে পড়তে পারে এ কথা পাইরাস বিশ্বাস করতেই চাইল না। সে লুসকাকে বলল, ম্যাডাম নিশ্চই ঠাট্টা করে বলেছেন আর তাও যদি না বলে থাকেন এবং সত্যিই আমার প্রতি দুর্বলতা থাকে তাহলেও আমি আমার প্রভুর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না। অতএব তুমি আমার কাছে ম্যাডামের বিষয়ে আর কিছু বলবে না।

পাইরাসকে লুসকা মূর্খ বলে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলাে। খবর শুনে লিডিয়া হতাশ হয়ে শুয়ে পড়ল।

দিন কয়েক পরে লিডিয়া লুসকাকে বলল, পাইরাসের কাছে তুই আবার যা। একটা ওক গাছ কুড়লের এক ঘায়ে ভেঙে পড়ে না বার বার আঘাত করতে হয়। ওকে জয় করতে না পারলে আমি শুকিয়ে মরে যাব তাছাড়া প্রস্তাব পাঠিয়েছিলুম ও তােকে ফিরিয়ে দিয়েছে। পরে যদি ভেবে থাকে আমি ওকে ভালবাসি তাহলে তাে ও আমাকে মনে মনে ঘৃণা করবে। ভাববে কি রকম মেয়ে যে প্রভুর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে বলে এবং নিজেও স্বামীর প্রতি বিশ্বাসঘাতিনী হয়! অতএব ওকে আমার চাই।

এদিন পাইরাসের মেজাজ ভালাে দেখে লুসকা নতুন করে তার কাছে লিডিয়ার কথা বলল এবং নানা প্রলােভন দেখাল। স্বামীকে বলে লিডিয়া পাইরাসের পদোন্নতি করাতে পারবে, অনেক সুযােগসুবিধার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে এবং লিডিয়া নিজেও পাইরাসকে প্রচুর উপঢৌকন দিতে পারবে।

ইতিমধ্যে পাইরাসও মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল লুসকা যদি দ্বিতীয়বার প্রস্তাব নিয়ে আসে তাহলে তাকে সে সরাসরি ফিরিয়ে দেবে না। তবে তাকে বুঝতে হবে যে ম্যাডাম তার আনুগত্য পরীক্ষা করছেন না প্রভুর সমক্ষে তাকে অপদস্থ করবেন, যদিও তেমন কোনাে কারণ ঘটে নি। তার মনে আরও একটা ভয় ঢুকেছিল, লিডিয়াকে প্রত্যাখ্যান করলে স্বামীর কাছে তার নামে মিথ্যা অভিযােগ করে তাকে চাকরি থেকে তাড়িয়ে দিতে পারেন। এই রকম চিন্তা করে সে বলল, কিছুদিন থেকে দেখছি মনিব আমার প্রতি বেশি প্রসন্ন হয়েছেন, অনেক নতুন কাজের দায়িত্ব দিচ্ছেন এসব হয়ত ম্যাডামের কথাতেই হচ্ছে, ম্যাডাম হয়তাে আমার জন্যে কিছু বলছেন। তবুও আমি বিশ্বাস করতে সাহস পাচ্ছি না যে এমন ধনী ও প্রভাবশালী একজন পত্নী আমার সঙ্গে প্রেম করতে চান। বিশ্বাস করবাে যদি ম্যাডাম তিনটি কাজ করতে পারেন।

লুসকা জিজ্ঞাসা করে, কি তােমার তিনটে কাজ?

পাইরাস বলল, প্রথম কাজ হল লিডিয়া নাইকোস্ট্রেটাসের সামনে তার প্রিয় বাজপাখিটা হত্যা করবে। দ্বিতীয় কাজ হল নাইকোস্ট্রেটাসের দাড়ির একগুচ্ছ কেশ আমাকে দেবে কিন্তু তৃতীয়টি একটু কঠিন, মনিবের চোয়ালের দিকের একটি মজবুত দাঁত তুলে আমাকে দিতে হবে।

লুসকার মনে হল তিনটি কাজই বেশ কঠিন তাই সে ফিরে গিয়ে লিডিয়াকে বলল, তুমি ওর আশা ছেড়ে দাও। আরও অনেক মানুষ পাবে, ওর চেয়ে ভালাে বই খারাপ নয়। ওর আস্পর্ধা তাে কম নয়, তােমাকে বলে কিনা তিনটে কাজ করতে পারলে তবে ও তােমাকে বিশ্বাস করবে।

কাজ তিনটের বিষয় লুসকা সবিস্তারে বললাে। লিডিয়া শুনে বলল, পাইরাসকেই আমার চাই আর এ তিনটে আজ আমার কাছে কিছুই নয়, আমি কয়েকদিনের মধ্যেই করে দেব। শুধু তাই নয় লুসকা, ওকে আরও বলবি যে আমি নাইকোস্ট্রেটাসের চোখের সামনে ওর সঙ্গে রমণ করবাে। নাইকোস্ট্রেটাস আমাকে বকলে আমি বলবাে তােমার দৃষ্টিভ্রম হয়েছে, তুমি ভুল দেখছ।

পাইরাস অপেক্ষা করতে লাগল লিডিয়া কি করে তা দেখবার জন্যে।

একদিন যখন নাইকোস্ট্রেটাস যথারীতি কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে ভােজে আপ্যায়িত করেছে এবং ভােজপর্ব শেষ হয়ে গেছে, পরিচারকরা টেবিল পরিষ্কার করছে, ঠিক সেই সময়ে জরির কাজ করা সবুজ রঙের ভেলভেটের ঝলমলে একটা গাউন পরে লিডিয়া সহসা সেই ঘরে গেল এবং তার স্বামীর সবচেয়ে প্রিয় বাজপাখির দাঁড়ের কাছে গিয়ে পাখির পা থেকে শেকল খুলে সেটিকে হাতে নিল। যেন কোথাও নিয়ে যেতে চায় কিন্তু সে তা না করে পাখিটার গলা বেশ জোরে চেপে ধরে ঘাড়টা মটকে দিয়ে পাখিটাকে মেরে ফেলল।

নাইকোস্ট্রেটাস চিৎকার করে উঠল, এ কি সর্বনাশ করলে লিডিয়া প্রিয় বাজটাকে মেরে ফেললে?

মারবতােই তাে। ওটা আমার সতীন। ওটার জন্যে তুমি আমাকেও ভুলে যেতে। আমারও তাে দেহ মন আছে, সেদিকে তুমি নজর দাওনি, কি মহাশয়রা আমি কি কিছু অন্যায় করেছি?

সকলেই লিডিয়ার কাজ সমর্থন করলাে এবং নাইকোস্ট্রেটাস যে রাগে ফুলছিল সেও লিডিয়ার কথা শুনে শান্ত হল। পরে এ নিয়ে সকলে হাসিঠাট্টা করতে লাগল।

পাইরাসও স্বয়ং এই কাণ্ড দেখেছিল। প্রথমে সে বুঝি নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারেনি কিন্তু যখন দেখল লিডিয়া তারই জন্যে এই অসাধ্য সাধন করেছে তখন থেকে সে লিডিয়াকে ভালবাসতে আরম্ভ করলাে।

এবার দ্বিতীয় দফা কিন্তু এ কাজটা তেমন শক্ত নয়। কয়েকদিন পরে দ্বিপ্রহরিক আহারের পরে নাইকোস্ট্রেটাস ও লিডিয়া নিজেদের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে। কোমল পালংকে পালকের উঁচু বালিশে নাইকোস্ট্রেটাস আধশােয়া অবস্থায় শুয়ে প্রিয়তমার সঙ্গে গল্প করছে। কখনও চোখ বুজছে কখনও চোখ খুলছে। ঘুম আসছে কিন্তু লিডিয়া মজার মজার চুটকি বলে জাগিয়ে দিচ্ছে। আর এই সুযােগে কখনও স্বামীর মাথার চুলে বা দাড়িতে কোমল ও সরু আঙুল দিয়ে বিলি কেটে দিচ্ছে। স্বামীর বেশ আরাম লাগছে, মনে মনে পত্নীর স্তুতিবাদ দিচ্ছে।

ইস তােমার দাড়িতে এই চুলগুলাে জটা পড়ে গেছে কেন? চিরুনি বােলাতে পার না? বলেই চুলগুলাে ধরে এমন হ্যাচকা টান দিল যে একসঙ্গে অনেকগুলাে চুল উঠে এলাে। স্বামী যন্ত্রণায় কাতর হয়ে প্রতিবাদ করলাে, আরাে কি করছাে, আমার কি লাগে না?

আহা হা লেগেছে বুঝি, মরে যাই রে, বলে লিডিয়া স্বামীর গালে গাল রাখল, একটু আদর করলাে, চুটকি রসিকতা করে ভুলিয়ে দিয়ে আবার দাড়িতে হাত বােলাতে বােলাতে আবার এক গুচ্ছ চুল ধরে টান।

উঃ এবার আমার সত্যি লেগেছে, তুমি তাে আচ্ছা মেয়েমানুষ?

লিডিয়া বলল, এই শেষ। এগুলাে পাকা চুল, এই দেখ, খুব লেগেছে বুঝি? বলে স্বামীর গালে একটি চুম্বন করলাে। স্বামী পত্নীর ওষ্ঠের স্পর্শ পেয়ে সব ভুলে গেল। দুই গুচ্ছ কেশ মিলে বেশ পুরু একটি গুচ্ছ হল। দাড়ির এই চুলগুলি লিডিয়া সযত্নে একটি কৌটোর মধ্যে রেখে দিল।

তিন নম্বর কাজটাই কঠিন। দু’টো কাজে কৃতকার্য হয়ে তার সাহস বেড়ে গেছে তাছাড়া তাকে জিততেই হবে, পাইরাসকে বুঝিয়ে দেবে সে সব কাজ পারে।

লিডিয়া শুধু রূপসী নয়, বুদ্ধিমতীও। একটা মতলব স্থির করলাে। বাড়িতে দুই পরিবারের দুটি বালক ছিল। বালক দুটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের। সেকালে উত্তম কথা বলতে ও সদাচরণ শিখতে অনেকে নিজেদের পরিবারের ছেলেমেয়েদের আরও উচ্চ বংশের অভিজাত পরিবারের জিম্মা করে দিত। এই বালক দুটি সেইভাবে নাইকোস্ট্রেটাসের বাড়িতে থাকতাে।

নাইকোটোক দিনের বেলায় ভােজনে বসেছে। ছেলে দুটিও লিডিয়ার সঙ্গে খাবার পরিবেশন করছে। একজন মাংসর টুকরাে কেটে ছােট করে দিচ্ছে আর একজন হয়ত সুরা ঢেলে দিচ্ছে গ্লাসে। লিডিয়া ছেলে দুটোকে বলল, দেখাে তােমাদের নিঃশ্বাসে ও মুখে দুর্গন্ধ হয়েছে। তােমরা কর্তাকে খাবার পরিবেশন করবার সময় মুখ ঘুরিয়ে পরিবেশন করবে।

বালক দুটি লিডিয়ার কথা বিশ্বাস করে মুখ ঘুরিয়ে আহার পরিবেশন করতে লাগলাে আর চতুর লিডিয়া স্বামীকে একান্তে ডেকে বললাে, লক্ষ্য করেছ কি ছেলে দুটো মুখ ফিরিয়ে পরিবেশন করছে। কেন জান? তােমার মুখে দুর্গন্ধ হয়েছে তাই ওরা তােমার মুখোমুখি হচ্ছে না। আমি এটা আমি লক্ষ্য করেছি। তােমার মতাে একজন নামী ও সম্মানীয় মানুষের মুখে দুর্গন্ধ অসহ্য। তােমার সামনে বলেনি কিন্তু কেউ কেউ এ নিয়ে বলাবলি করছে।

নাইকোস্ট্রেটাস সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে জিজ্ঞাসা করলাে, এরকম কেন হচ্ছে বলাে তাে? তাহলে আমার কি কোনাে দাঁত পচে গেছে?

তাই হবে নিশ্চয়। এধারে জানালার ধারে এসাে তাে, হাঁ করাে। ইস তােমার চোয়ালের একটা দাঁত তাে একেবারে পচে গেছে দেখছি, ঐ পচা দাঁত থেকেই দুর্গন্ধ বেরােচ্ছে। তােমাকে কত গণ্যমান্য ভদ্রলােক ও মহিলার সঙ্গে দেখা করতে হয়, কথা বলতে হয়। যত তাড়াতাড়ি পারাে এ আপদ দূর করাে।

তাহলে লিডিয়া তুমি আজই এখনি আমাদের দন্তচিকিৎসককে খবর পাঠাও।

লিডিয়া বলল, আরে না না দন্তচিকিৎসক কি করবে, সে অনেক ঝামেলা করবে। দাঁতটা তাে গেছেই, গােড়া আলগা হয়ে গেছে, ও আমিই তুলে দিতে পারব। তােমার ঐ দন্ত চিকিৎসকের চেয়ে বৌয়ের হাত অনেক নরম জেনাে। তুমি ততক্ষণে মুখটা ভালাে করে ধুয়ে নাও, যা করবার আমি করছি, তুমি কিছু ভেবাে না।

বৃদ্ধ স্বামীর তরুণী ভার্যার হাতের মুঠোয়, সে যা বলে বৃদ্ধপতি সব মেনে নেয়।

লিডিয়া এক গামলা জল, একখণ্ড নরম কাপড়, কয়েকটা শিশি ভর্তি ভেষজ আরক ইতাদি এবং দাঁত তােলার উপযােগী ছােট একটি সাঁড়াশি এনে ছােট একটা টেবিলে সাজিয়ে রাখলাে। লুসকা ছাড়া ঘর থেকে সবাইকে বার করে দিল, দরজা বন্ধ করে দিল। ইতিমধ্যে একটা পচা ক্ষয়া দাঁত যােগাড় করে লুকিয়ে রেখেছিল।

স্বামীকে বললাে, টেবিলে শুয়ে পড়ে। তারপর মুখের ভেতরে ও বাইরে কি একটা আরকের প্রলেপ দিল। মুখটা বেশ ঠাণ্ডা হয়ে গেল। লুসকাকে বলল কর্তার মাথার দিকে গিয়ে হাত দুটো চেপে ধরে থাকতে। তারপর স্বামীকে হাঁ করতে বলে সাঁড়াশিটা বাগিয়ে ধরে চোয়ালের একটা দাঁত চেপে ধরে জোরসে টান দিয়ে দাঁতটা তুলে ফেলল।

নাইকোস্ট্রেটাস তখন চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করছে। লিডিয়া তাকে শান্ত করে, মুখ পরিষ্কার করে কি সব ভেষজ লাগিয়ে দিয়ে সেই পচা দাঁতটা দেখিয়ে বলল, দেখেছ দাঁতটার কি অবস্থা হয়েছিল। তােমার মুখ থেকে আর দুর্গন্ধ বেরােবে না। চলাে ঘরে গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নাও। স্ত্রীর হাতের কোমল পরশ পেয়ে সে ব্যথা ভুলে ঘুমিয়ে পড়ল। লিডিয়া স্বামীর মুখের ভেতরে যে ওষুধ দিয়েছিল সেটা হয়ত ঘুম পাড়াবার ওষুধ।

এরপর লিডিয়া সেই দাড়ির অংশ ও দাঁতটি তার প্রেমিকের কাছে পাঠিয়ে দিল। তিনটে কাজই সম্পূর্ণ হয়েছে অতএব আর সে প্রেমিকের সঙ্গে মিলিত হবার জন্যে অপেক্ষা করতে পারছে না। কি করে মিলিত হবে? লিডিয়া মনে মনে একটা মতলব ভাঁজল।

লিডিয়া অসুস্থ হওয়ার ভান করে বিছানায় শুয়ে রইলাে, বিছানা ছেড়ে ওঠে না। একদিন

পাইরাসকে সঙ্গে নিয়ে নাইকোস্ট্রেটাস তার ঘরে এসেছে। তাদের দেখে লিডিয়া বললাে, এই ঘরে একঘেয়ে ভাবে শুয়ে থাকতে ভালাে লাগছে না, যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে। তােমরা আমাকে একটু বাগানে নিয়ে যেতে পারাে?

বেশ তাই চলাে, বলে নাইকোস্ত্রোস ধরলাে তার পায়ের দিকে আর ভারি বলে পাইরাস ধরল মাথার দিক। দুজনে ধরাধরি করে তাকে বাগানে নিয়ে গিয়ে সুন্দর একটি নাসপাতি গাছের তলায় কোমল ঘাসের ওপর শুইয়ে দিল। নাসপাতি গাছটা বেশ ঝাকড়া, ঘন সবুজ পাতায় ভর্তি আর প্রচুর ফল হয়েছে।

লিডিয়া কোমল সবুজ ঘাসের ওপর শুয়ে গাছের ফল দেখতে দেখতে বলল, আমার টাটকা নাসপাতি খেতে ইচ্ছে করছে, পাইরাস তুমি গাছে উঠে কয়েকটা ফল তুলে নিচে ফেলে দাও তাে।

পাইরাস চড়চড় করে গাছে উঠে গিয়ে কয়েকটা ফল নিচে ফেলে দিয়ে তার মনিবকে ও লিডিয়াকে উদ্দেশ করে বললাে, ছি ছি এ আমি কি দেখছি? খােলা আকাশের নিচে আপনারা দু’জনে মিথুনে লিপ্ত? কেন বাড়ির ভেতর তাে অনেক ভালাে শয়নকক্ষ আছে, সেখানে যান না।

লিডিয়া বলল, পাইরাস তােমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? তুমি এসব কি বলছাে? খােলা হওয়ায় এসে আমার বেশ ভালাে লাগছে আর তুমি কি যা-তা সব খারাপ কথা বলছাে?

নাইকোস্ট্রেটাস বলল, তুমি কি স্বপ্ন দেখছাে নাকি পাইরাস?

না প্রভু আমি স্বপ্ন দেখি নি, ঠিকই দেখছি এবং যা বলছি সত্যই বলছি, পাইরাস বলল।

লিডিয়া বলল, যত সব বাজে কথা। আমার শরীর ভালাে থাকলে আমি গাছে উঠে দেখতুম ও সত্যি বলছে না মিথ্যে বলছে। নাইকোস্ট্রেটাস বলল, পাইরাস তুমি গাছ থেকে নেমে এসাে তাে?

পাইরাস নেমে আসতে নাইকোস্ট্রেটাস তাকে বললাে, এই তাে লিডিয়া তেমনি শুয়ে রয়েছে আর আমি তাে এই পাশে বসে রয়েছি তবে তুমি আজেবাজে কি দেখছিলে?

প্রভু আপনি তাে আমার কথা বিশ্বাস করছেন না, আপনারা আমার মনিব আমি কেন মিথ্যা কথা বলবাে। আমি তাে অবাক, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলুম না যে আপনারা এমন কুৎসিত ব্যাপার করতে পারেন, পাইরাস বলল।

এই কথা শুনে লিডিয়া বলল, আমার শরীর সুস্থ থাকলে আমি নিজে গাছে উঠে দেখতুম কিন্তু আমি বােধহয় এমন অসভ্য দৃশ্য দেখতে পাবাে না কারণ তােমরা দু’জন পুরুষ নিচে থাকবে। তবুও আমার প্রতি এই অসভ্য আচরণের অভিযােগ আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। স্বামী তুমি চেষ্টা করে একবার গাছে উঠে দেখ তাে পাইরাস সত্যি কথা বলেছে কিনা নইলে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে।

বেশ বলেছ লিডিয়া, বয়স হয়েছে ঠিকই তবুও চেষ্টা করলে আমি এই গাছটায় উঠতে পারবাে।

নাইকোক্টেটাস অনেক কসরত করে নাসপাতি গাছে উঠতে লাগল, পিছনে কি হচ্ছে তার দেখবার সূযােগ নেই। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত আর সেই সুযােগে পাইরাস লিডিয়ার বুকের ওপর শুয়ে পড়েছে। ওপর ডালে উঠতে নাইকোস্ট্রেটাসের বেশ খানিকটা সময় লাগল। ওপরে উঠে ডালপালা সরিয়ে নিচের দিকে চেয়ে নাইকোস্ত্রোটাস রাগে চিৎকার করে উঠল, এই বেশ্যামাগী হচ্ছেটা কি? পাইরাস বিশ্বাসঘাতক, নেমকহারাম, তাের এই কীর্তি? বলে নাইকোস্ট্রেটাস গাছ থেকে নামতে আরম্ভ করলাে।

লিডিয়া বলল, বুড়াে হয়ে ভীমরতি হয়েছে, আমরা তাে চুপচাপ বসে আছি। পাইরাসও বলল, দেখলেন তাে প্রভু আমিও এই একই দৃশ্য দেখে মনে করেছিলুম আমার মাথা বুঝি খারাপ হয়ে গেছে।

নাইকোষ্ট্রেটাস নিচে নেমে দেখল ও গাছে ওঠবার সময় যেখানে ও যেভাবে লিডিয়া ও পাইরাসকে বসে থাকতে দেখেছিল ওরা ঠিক সেইভাবে বসে আছে। এ কি অবাক কাণ্ড!

লিডিয়া বললাে, দেখলে তাে আমরা তিনজনেই কেউ কিছু করি নি। আমার মনে হচ্ছে যত দোষ এই গাছটার, ওটা ডাইনি গাছ। ঐ গাছে উঠলে মানুষের দৃষ্টিবিভ্রম হয়। পাইরাস যাও তাে একটা কুড়ুল এনে গাছটা কেটে ফেল।

পাইরাস এই আদেশ শােনবার জন্যে তৈরি ছিল। সে তখনি একটা ধারালাে আর ভারি কুড়ুল এনে গাছটার গােড়ায় কয়েকটা কোপ মারতেই গাছটা হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল।

পাইরাস যে নাসপাতিগুলাে পেড়েছিল লিডিয়া তখনও সেগুলাে খায়নি, বলল, না বাবা এই ডাইনি গাছের ফল খেয়ে দরকার নেই, কি হবে।

ঘরে ফিরে নাইকোস্ট্রেটাস লিডিয়ার কাছে ক্ষমা চাইল আর পাইরাসকে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ, গাছটাই যত নষ্টের গােড়া।

এইভাবে লিডিয়া তার প্রেমিককে জয় করলাে। পাইরাসও লিডিয়াকে কোনােদিন বা রাত্রে নিরাশ করেনি।

 

দশম গল্প

সিয়েনার দুই যুবক একই যুবতীর প্রেমে পড়ল। ওদের মধ্যে একজন যুবক যুবতীর সন্তানের ধর্মপিতা। ধর্মপিতার ঐ যুবক মারা যায় কিন্তু পূর্বের প্রতিজ্ঞা অনুসারে সে তার বন্ধুকে দেখা দিয়ে মরণের ওপারের কিছু পরিচয় জ্ঞাপন করে।

লিডিয়া ও পাইরাসের মিলনে আনন্দ প্রকাশ করা অপেক্ষা শ্রেতারা অমন স্বাদু ফলবর্তী একটি গাছ বিনাশ হওয়ায় বেশি শােক প্রকাশ করতে লাগল। কিন্তু এবার গল্প বলার পালা স্বয়ং রাজা ডায়ােনিওর।

রাজা বলল, এ দিনের সব কয়েকটি গল্পই দারুণ জমেছিল। আমাকে আজকের শেষ গল্পটি বলতে হবে তবে একটু অন্যরকম হবে। এলসা এক ধর্মপিতার গল্প বলেছিল না ? আমিও এক ধর্মপিতা, তার বন্ধু এবং উভয়েরই একই প্রেয়সীর গল্প বলবাে তবে দুঃখের বিষয় যে গল্পটা ছােট হবে কারণ দিন শেষ হয়ে আসছে। তাহলে আরম্ভ করা যাক :

সিয়েনা জেলায় সালাইয়া বন্দরে দু’জন যুবক বাস করতাে। একজনের নাম টিঙ্গোচিও মিনি আর অপরজনের নাম মিউচিও ডি টুরা। দু’জনের গলায় গলায় ভাব। একসঙ্গে খেত, বসত, শুত, চলতাে, হাসত, কাঁদত।

ওরা দু’জনে গির্জায় যেত এবং পরলােক যে রমণীয় স্থান, সুখের নিলয়, আনন্দের ভূমি, এই তারা বার বার শুনেছে। এও শুনেছে পাপীদের সেখানে সাজা পেতে হয়। সাজা শেষ হলে তাদের পাপের গুরুত্ব অনুসারে সুখস্বর্গের বিভিন্ন স্থানে পাঠানাে হয়।

তখন এই দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধু প্রতিজ্ঞা করলাে যে, আগে যার মৃত্যু হবে সে অপর বন্ধুকে দেখা দিয়ে ওপারের খবর বলবে।

এই শপথ গ্রহণের পর টেলোচিও একটি শিশুর ধর্মপিতা হল। ধর্মপিতা হওয়া এমন কিছু একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা নয়। যে শিশুটির ধর্মপিতা হল তার বাবা ও মায়ের নাম যথাক্রমে আমব্রুয়ােজিয়ে অ্যানসেলমিনি এবং মােনা মিটা। ক্যাম্পােরেজ্জি পাড়ায় ওরা বাস করতাে।

শিশুর মা মােনার রূপের খ্যাতি ছিল। মােনা সহজে পুরুষের মন ভােলাতে পারত। তার ধর্মপুত্রের সুবাদে টেলােচিও প্রায়ই মােনা মিটার বাড়ি যেত এবং বলা বাহুল্য সঙ্গে তার অভিন্নহৃদয় বন্ধুও যেত কারণ তারা তাে একসঙ্গে চলাফেরা করতাে। টেঙ্গোচিও মােনা মিটার রূপের ও কাজকর্মের এবং শিশুটিরও সুযােগ পেলেই প্রশংসা করতাে, মাঝে মাঝে ঠাট্টা রসিকতাও করতাে এবং এইসব করতে করতেই সেই পরস্ত্রীর প্রেমে পল্ল। এক বন্ধু যদি একই যুবতীর প্রেমে পড়ে তাহলে বন্ধুও প্রেমে না। পড়ে থাকতে পারে না কিন্তু প্রেমে পড়ল ঐ একই যুবতীর ওপর।

টিঙ্গোচিও যে মােনর প্রেমে পড়েছে এ কথা কিন্তু সে বন্ধু মিউচিওর কাছে প্রকাশ করতে মনে মনে অপরাধ বােধ করতাে। হাজার হােক সে তাে তার ধর্মপুত্রের মা। বলতে লজ্জা বােধও করতাে।

মিউচিও তার এই প্রেমের কথা বন্ধুর কাছে প্রকাশ করে নি, নিজের মনে মনেই রেখেছিল। একে তাে সে তার একান্ত বন্ধু, তাছাড়া বন্ধু জানতে পারলে ঈর্ষান্বিত হতে পারে এবং যেহেতু সে ধর্মপিতা এই সুবাদে তার বিরুদ্ধে বাবা মায়ের কাছে তার নামে অভিযােগ করতে পারে, ফলে বন্ধু বিচ্ছেদ হয়ে যেতে পারে আর বন্ধু বিচ্ছেদ হয়ে গেলে সে আর মােনা মিটাকে দেখতেই পাবে না। তার চেয়ে যেমন চলছে তেমনিই চলুক, ইচ্ছামতাে প্রেয়সীকে দেখতে পাচ্ছি, কথা বলতে পাচ্ছি, হাসিঠাট্টা করছি, তাই বা মন্দ কি।

কিন্তু তাহলেও টিঙ্গোচিওর সুযােগ ও প্রভাব বেশি। মােনার কাছে সে যা চাইতাে মােন তাকে তাই দিত। পরস্পরে রসাপ্লুত হয়ে পরস্পরের রস গ্রহণ করতাে। মিউচিও সব জানতে পারতাে এবং দীর্ঘ নিশ্বাস মােচন করতাে। সে শুধু সুযােগের জন্যে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতাে। জানত তার কামনা একদিন পূর্ণ হবে।

মােনাদের বাড়ি ঘিরে একটা বাগান ছিল। বাগানটা আরও মনােরম করবার জন্যে টিঙ্গোচিও নিজে মাটি কোপাতে লাগল, নতুন গাছ বসাতে লাগল এবং অন্যান্য পরিচর্যা করতে লাগল। প্রচুর পরিশ্রমের ফলে সে অকালে মারা পড়ল।

টিঙ্গোচিও মারা যাবার পর তৃতীয় দিনের রাত্রে মিউচিও যখন ঘুমােচ্ছে তখন টিঙ্গোচিও তার শপথ রাখবার জন্যে মিউচিওকে দেখা দিল।

মিউচিও চমকে ঘুম থেকে উঠে জিজ্ঞাসা করলাে, ‘কে? কে তুমি? কারণ পরলােকে যাবার পর টিঙ্গেচিওর কণ্ঠস্বর এবং আকৃতিরও বিশেষ পরিবর্তন হয়েছে, তবুও চেনা যায়। ও প্রেত জবাব দিল, আমি টিঙ্গোচিও, আমরা শপথ নিয়েছিলুম যে আগে মারা যাবে সে অপরজনকে দেখা দেবে। তাই আমি তােমাকে দেখা দিতে ও ওপারের খবর দিতে এসেছি।

মিউচিও প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিল তারপর সামলে নিয়ে বলল, বন্ধু তুমি স্বাগতম। তুমি দেখা দিলে আমার খুব ভালাে লাগছে তা পরলােকে কোথায় কোথায় তােমার স্থান হয়েছে? পাপীদের মধ্যে না সৎ লােকেদের মধ্যে, নাকি অন্য কোথাও? নরকের আগুনে তােমাকে ফেলে দেয় নি তাে?

ঠিক তা নয়, তবে আমাকে কড়া শাস্তি পেতে হয়েছে, কারণ পৃথিবীতে কিছু পাপ তাে করেছি, যন্ত্রণাও দিয়েছে ওরা।

মিউচিও জিজ্ঞাসা করলাে, ওরা কি রকম শাস্তি দেয়? কোন পাপের জন্যে কি শাস্তি দেয়, এইসব বিবরণ জানতে চাইলাে। আরও বললাে শাস্তি মকুব বা লঘু করার জন্যে সে পৃথিবীতে তার জন্যে কিছু করতে পারে কিনা।

টিঙ্গোচিও বলল, তুমি আমার জন্য গির্জায় বিশেষ প্রার্থনা করতে পারাে, বিশপও আমার জন্যে প্রার্থনা করতে পারেন আর দরিদ্র ও ক্ষুধার্তদের ভিক্ষা বা সাহায্য দিলে আত্মার কল্যাণ হয়।

মিউচিও বলল সে এসবই করবে। টিঙ্গোচিও বলল, আর বেশিক্ষণ নয় আমার ফিরে যাবার সময় হয়ে আসছে। মিউচিও বলল, আমার একটা প্রশ্ন আছে। তুমি যে তােমার ধর্মপুত্রের মায়ের সঙ্গসুখ উপভােগ করেছিলে এজন্যে ওরা তােমাকে কি কিছু শাস্তি দিয়েছে?

টিঙ্গোচিও বলল, শােনো তাহলে , আমি তাে ওখানে পৌছনাের সঙ্গে সঙ্গে একজন আমাকে পাকড়াও করলাে, সে আমার সমস্ত ইতিহাস জানে। আমি যেসব অন্যায় কাজ করেছি সেসব তার জানা, তালিকা তৈরিই ছিল। তালিকা ধরে ধরে আমাকে নানারকম সাজা দেওয়া হল, ভাগ্যিস মরে গিয়েছিলুম তাই খুব বেশি লাগে নি, জীবিত থাকলে গতর চূর্ণ হয়ে যেত। সেখানে আরও অনেক প্রেতাত্মা আমার মতাে শাস্তি পাচ্ছে। তারপর টিঙ্গোচিও বলল, তুমি যে প্রশ্নটা করলে, মােনার সঙ্গে অবৈধ প্রেম সেটা কিন্তু তালিকায় ছিল না। ওটা তাে গুরুতর অপরাধ, আমি তাে ভয়ে কাঁপছি আর ভাবছি ঐ অপরাধটা বােধহয় অন্য তালিকায় আছে, আমাকে বােধহয় আগুনে ঝলসাবে নয়তাে সপাসপ চাবুক চলবে।

আমাকে ভয়ে কাঁপতে দেখে কয়েকজন পাপী জিজ্ঞাসা করলাে, তুমি অত ভয় পেয়েছ কেন? কাপছ কেন? আমাদের চেয়েও গুরুতর কোনাে খারাপ কাজ করেছ নাকি?

আমি বললুম, হ্যা ভাই আমি আমার ধর্মপুত্রের মায়ের সঙ্গে অবৈধ প্রেম করেছি, কিছু বাকি রাখে নি। কি শাস্তি দেবে তাই ভেবে কাপছি।

আমার পাপ শুনে ওরা সকলে হাে হাে করে হেসে উঠল। আমি তাে অবাক। জিজ্ঞাসা করলুম, হাসলে যে?

তুমি একটি আস্ত গােমূর্খ। ধর্মপুত্রের মায়ের সঙ্গে অবৈধ প্রেম করলে এখানে কোনাে শাস্তি পেতে হয় না। তাই তােমার তালিকায় এই পাপটি লেখা নেই। এ কথা শুনে আমার মনে হল আমি বুঝি আবার বেঁচে উঠলুম, যেখানে হৃদপিণ্ড ছিল সেখানটা বুঝি ধক ধড়াক করছে।

ভাের হয়ে আসছে। টিঙ্গোচিও আর থাকতে পারবে না। সে বলল, আমি আর থাকতে পারবাে না, বিদায় বন্ধু। সে যেমন হঠাৎ এসেছিল তেমনি হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল।

বন্ধুর কাছ থেকে শুনে মিউচিও যখন জানতে পারলাে যে ধর্মপুত্রের মায়ের সঙ্গে অবৈধ প্রণয়ে লিপ্ত হলে পরলােকে সে জন্যে কোনাে শাস্তি নির্ধারিত নেই তখন সে আফশােস করতে লাগলাে কারণ সে নিজেও কয়েকজনের সন্তানের ধর্মপিতা এবং তাদের মায়েরাও সুন্দরী। একটু চেষ্টা করলেই সেও তাে সেইসব মায়েদের আকর্ষণ করতে পারতাে। যা হয়ে গেছে তা গেছে তবে ব্যাপারটা যখন জানাই গেল তখন সে আর নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকবে না। যদি তার কোনাে ধর্মপুত্রের মা তার প্রতি প্রণয়াসক্ত হয় তাহলে সেই বা তাদের ডাকে সাড়া দেবে না কেন?

সূর্য তখন পশ্চিমকাশে হেলে পড়েছে, মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। রাজা ডায়ােনিওর রাজত্ব শেষ। সে তার মাথার লরেল অর্থাৎ মুকুট লরেতার মাথায় পরাতে পরাতে বলল, লরেতা তােমার মাথায় লরেল পরিয়ে দিলুম। এবার তুমি রানী, আমরা তােমার ইচ্ছানুসারে চলবাে।

লরেতা বলল, আমিও তােমাদের খুশি রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবাে। এখনও খানিকটা বেলা আছে, চলাে আমরা সবাই আমাদের সেই মনােরম উপত্যকাটিতে বেড়িয়ে আসি। সবাই সানন্দে রাজি হল।

নতুন রানী লরেতা স্টুয়ার্ডকে ডেকে বললাে তাদের বিকেলের ঠাণ্ডাভােগ ঠাণ্ডাই ও সেইখানে পরিবেশন করতাে। সেই উপত্যকায় পৌছে সকলে একটা সুন্দর জায়গা বেছে নিয়ে বসলাে। লরেতা বলল, কাল ডায়ােনিও বলছিল যে এবার আমাদের গল্পগুলির বিষয় হবে অবৈধ প্রেমের ব্যাপারে। স্বামীরা কি ভাবে স্ত্রীদের ধোঁকা দেয় কিন্তু তাতে মনে হয় গল্পগুলাে একঘেয়ে লাগতে পারে। তাই আমি বলি কি আমাদের কালকের গল্পগুলির বিষয়বস্তু হােক পুরুষ বা রমণী, স্বামী বা স্ত্রী, পরস্পরকে কিভাবে ঠকায় বা ধাপ্পা দেয়। মনে হয় এমন গল্প ভালােই জমবে, তােমরা কি বলাে।

সকলেই বলল, ভালােই হল, শুধু স্বামী-স্ত্রীকেই মাথা ঘামাতে হবে না। নানারকম গল্প বল ও শােনা যাবে।

বিকেলের খাওয়ার পালা শেষ করে ওরা বাড়ির দিকে রওনা হল কারণ সন্ধ্যা হতে আর দেরি নেই। বাড়ি ফিরে সন্ধ্যার আলাে আঁধারিতে সকলে বাগানে খালি পায়ে নরম ঘাসের ওপর পায়চারি করতে লাগলাে, এলােমেলাে টুকরাে গল্প। এমন সময়ে সকলের গলা ছাপিয়ে ডায়ােনিও আর কিয়ামমো দ্বৈতকণ্ঠে সুন্দর একটা গান আরম্ভ করলাে। বাকি সকলে চুপ করে কান পেতে সেই গান শুনতে লাগলাে।

সেদিন রাত্রে সবশেষ গানটি শুনিয়েছিল ফিলােমেনা। মনভােলানাে একটি প্রেমসঙ্গীত। ফিলােমনা গানটি গাইছিল দরদ দিয়ে, মধুর কন্ঠে। তার চোখ চিকচিক করছিল। সকলে অনুভব করলাে ফিলােমন বােধহয় কোনাে যুবকের প্রেমে পড়েছে।

আগামীকাল শুক্রবার। বিশেষ একটি ধর্মীয় পার্বণের কথা লরেতা মনে করিয়ে দিল। দিনটি বিশেষভাবে পালন করতে হবে, গত শুক্রবারও সেদিনের রানী নেফাইলের নির্দেশে পালন করা হয়েছিল।

একসময়ে শয়নকক্ষে যাবার সময় হলাে। ছেলেরা গেল বাড়ির একপ্রান্তে তাদের ঘরে আর মেয়েরা অপরপ্রান্তে তাদের ঘরে।

| | ডেকামেরনের সপ্তম দিবস শেষ হল।।

Leave a Reply