গিয়ােভানি বােকাসিও-র ডেকামেরন টেলস এর বাংলা অনুবাদ।
অখণ্ড সংস্করণটি ইউনিক বুকস্ ০ ঢাকা থেকে প্রকাশিত। সম্পুর্ণ বইটি আমাদের সাইটে পাঠকের অনলাইনে পাঠ করার জন্য দেয়া হবে। ডেকামেরন টেলস বইটি প্রায় ৬০০ পেজ হওয়ায় এক পোস্টে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তাই এখানে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হবে।
ইতালীয়ান সাহিত্য সম্রাট গিয়ােভানি বােকাসিও-র ডেকামেরনের গল্পগুলিতে কখনও কোমল প্রেম আবার। কখনও দুঃসাহসিক প্রেমের বর্ণনা পাওয়া যাবে। কখনও তিক্ত, কখনও মধুর যা অতীতে ঘটেছে বা আজও ঘটে। গল্পগুলি পড়ে যেমন পুলকানুভূতি হবে তেমনি কিছু শিক্ষালাভও হতে পারবে। প্রেমে কতদূর অগ্রসর হওয়া উচিত বা কখন সরে আসা প্রয়ােজন তারও নির্দেশ এই কাহিনীগুলি দেবে। যে সকল প্রেমিক-প্রেমিকা গল্পগুলি পড়ে আনন্দ অনুভব করবেন তারা যেন প্রেমের কাছেই ঋণ স্বীকার করেন।
বিশ্বজোড়া খ্যাতি নিয়ে যে বই মধ্যযুগে ঝড় তুলেছিল সেই আদিরসে সিক্ত রসালাে একশােটি কাহিনী যা বয়স্ক পাঠক মনােরঞ্জনে অদ্বিতীয় বলে সমাদৃত হয়ে এসেছে। তারই বাংলা রূপান্তর।
বিশ্বসাহিত্যে গিয়ােভানি বােকাসিও একটি স্মরণীয় নাম। তার লিখিত দশ দিনের শত গল্প ডেকামেরন টেলস যেমন উপভােগ্য তেমনি রসােত্তীর্ণ।
ইটালীয় তথা ইউরােপীয় সাহিত্যের জনক গিয়ােভানি বােকাসিও ডেকামেরন লিখে অমর হয়ে আছেন। বইখানি ডেকামেরন টেলস্ নামে প্রভৃত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। পরবর্তী যুগের অনেক সাহিত্যিক বােকাসিওর এই সকল কাহিনীকে ভিত্তি করে নিজস্ব ভাষা ও ভঙ্গিতে গল্প লিখে খ্যাতি অর্জন করেছেন কিন্তু মূল কাহিনীকারকে অতিক্রম করতে পারেননি। তাঁর রসসৃষ্টি অতুলনীয়।
বােকাসিও যদি ডেকামেরন নাও লিখতেন তা হলেও তিনি অমরত্ব লাভ করতেন কারণ তিনি উচ্চস্তরের আরও কয়েকখানি বই লিখেছেন। এই বইগুলিও তাকে ইউরােপীয় সাহিত্যে বিশিষ্ট স্থান দিয়েছে, যদিও এগুলিকে অনেক সমালােচক তার ডেকামেরনের সমতুল্য স্থান দেননি। সে তাে হতেই পারে। কোনাে লেখকের সমস্ত বই তার শ্রেষ্ঠ রচনার স্থান অধিকার করতে পারে না।
তার একটি উপন্যাস এলেজিয়া ডি ম্যাডােনা ফিয়ামেডা অনেক সমালােচকের মতে একখানি উৎকৃষ্ট সাইকোলজিক্যাল উপন্যাস। ইউরােপীয় সাহিত্যে ইতিপূর্বে মানবমনকে এমনভাবে বিশ্লেষণ করে আর কোনাে উপন্যাস লেখা হয়নি।
ইউরােপে রেনেসাঁ যুগে যে সাহিত্য গ্রামীণ-সাহিত্য নামে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিল, বােকাচিও তেমন একখানি বইও লিখেছেন, নাম কমেডিয়া ডেলে নিনফে ফিয়ােরেনটিন। তিনি আরও দুখানি বই লিখেছেন, ফিলােস্ট্রাটে এবং টেসিডা।
ইংরেজী সাহিত্যের জনক চসার এই বই দুখানি পড়ে ক্যান্টারবেরি টেলস লিখতে অনুপ্রাণিত হন এবং চসারের কাহিনীগুলিতেও অনেক ক্ষেত্রে বােকাচিও ধরা পড়েছেন।
বােকাচিও নিজেও পেত্রার্ক দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তার জীবনের শেষ কুড়ি বছরে যে সকল সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন সেগুলি পড়লে বােঝা যায় যে চতুর্দশ শতকে তার তুল্য মানবদরদী সাহিত্যিক আর কেউ ছিল না। তিনি তার মৃত্যুর পর শত বৎসর পর্যন্ত ইউরােপীয় সাহিত্যিকদের ওপর প্রভাব অব্যাহত রেখেছিলেন।
এই স্বনামধন্য বােকাচিওর জন্ম ১৩১৩ খ্রীস্টাব্দের গ্রীষ্মে, সম্ভবত ইটালির ফ্লোরেন্স শহরে, কারও মতে প্যারিসে। অনেকে বলে ফ্লোরেন্স না হলেও ফ্লোরেন্স সন্নিকটে কোনাে গ্রামে। ফ্রায়ার চিপােলাকে নিয়ে কৌতুককর গল্পটি ফ্লোরেন্স জেলার যে গ্রামের পটভূমিতে রচিত (ষষ্ঠ দিনের। দশম গল্প) অনেকে অনুমান করেন বােকাসিও এই গ্রামেই জন্মেছিলেন।
বােকাসিওর বাবার নাম বেবাক্কাচিও দ্য চেলিনাে দ্য চারতালডাে। ফ্লোরেন্স শহরে তিনি মহাজনী ব্যবসা করতেন, গ্রামে চাষবাসও ছিল। সেকালে তাে আর ব্যাঙ্ক ছিল না তাই যারা মহাজনী কারবার করতেন বা সদে টাকা খাটাতেন তারাই ব্যাঙ্কের কাজ করতেন এবং ব্যাঙ্কার নামে পরিচিত ছিলেন।
বােকাসিওর পিতার জেনি নামে একজন প্রেমিকা ছিলেন। বিশ্বাস যে বােকাচিও এই জেনির অবৈধ সন্তান ছিল কিন্তু পিতা বােক্কাচিও অবৈধ শিশুর সকল দায়িত্ব গ্রহণ করে তাকে প্রতিপালন করেছিলেন। শােনা যায় সেকালে ইউরােপের নাগরিকরা এক বা একাধিক প্রেমিকা পুষতেন বা প্রেমিকা পাল্টাতেন। তাদের ঔরসে প্রেমিকার গর্ভে সন্তান জন্মালে সেটা নাকি দূষণীয় বলে বিবেচিত হতাে না এবং সেইসব সন্তান সমাজে গহীত হতাে, অবহেলিত হতাে না।
গিওভানির বয়স যখন মাত্র দুই কি তিন তখন তার পিতা একটি মেয়েকে বিয়ে করলেন। সেই মেয়ে ধনী কন্যা ছিল, প্রচুর যৌতুক এনেছিল। এই বিবাহের ফলে একটি পুত্রসন্তান জন্মায়, গিওভানির আদর কিছু কমতে থাকে।দুই ভাই যখন কৈশাের অতিক্রম করলাে তখন এই দুই ভাইয়ের বনিবনার অভাব দেখা গেল। দুই ভাইয়ে ক্রমশ বিবাদ আরম্ভ হল।
পিতা বােকাচিও দেখলেন যে, দুই ভাই একই পরিবারে শান্তিতে বাস করতে পারবে না। তখন তিনি ব্যাঙ্কিং ব্যবসায়ে পারদর্শিতা অর্জনের জন্য গিওভান্নিকে নেপলস শহরে পাঠিয়ে দিলেন। নেপলসে ব্যাঙ্কিং ব্যবসায়ী মহলে তার প্রভাব ও প্রতিপত্তি ছিল। গিওভানি তখন যুবক। কিন্তু কিছুদিন পরে বুঝলেন যে ব্যবসায়ী ব্যাঙ্কার হতে মােটেই ইচ্ছা নেই। তার ইচ্ছে কবি হওয়া। কবিতা লিখত গিওভানি ।
যাজক করবার মানসে পূত্র গিওভানিকে পিতা বললেন ধর্মীয় আইনে পাঠ গ্রহণ করতে। ধর্ম সংক্রান্ত অনেক সমস্যা সমাধানের জন্যে তখন ধর্মীয় আইন জানা ব্যক্তির চাহিদা ছিল।
কিন্তু গিওভানির ব্যবসায়ী হতে যত না আগ্রহ ছিল, দেখা গেল তার চেয়ে অনেক কম আগ্রহ ধর্মীয় আইনবিদ হতে। আইন বইগুলি তার কাছে নীরস ও বিরক্তিকর মনে হল। হবেই তাে কারণ যুবক গিওভানি নেপলসের প্রমােদ-জীবনে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছিল, কয়েকটি তরুণীর সঙ্গে প্রেম প্রেম খেলাও আরম্ভ করেছিল। পিতাকে নিরাশ করে গিওভানি সাহিত্য রচনায় মন দিল। আমরা বলি তাতে ভালােই হয়েছিল, আমরা একজন সাহিত্যস্রষ্টাকে পেয়েছি যা তাকে অমরত্ব দান করেছে। ধনী ব্যবসায়ী বা ব্যাঙ্কার হতে পারলেও গিওভান্নি বােক্কাচিওকে কেউ আজ চিনত না।
নেপলসের আঁজু বংশের কিং রবার্ট বিদ্যোৎসাহী ছিলেন। নিজেও যথেষ্ট পড়াশােনা করতেন। তারই উৎসাহের ফলে নেপলসে সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটি জগৎ গড়ে উঠেছিল। গিওভানি এই জগতে ঢুকে পড়লেন। অনেক জ্ঞানী ও সংস্কৃতিবান ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। তাদের সঙ্গে সাহিত্য ভাবনার আদান-প্রদান চলতাে।
গিওভানি সাহিত্য রচনা করে চলেছে এবং ক্রমশ জ্ঞানী গুণী মহলে সে বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিক রূপে খ্যাতি লাভ করলাে। গিওভানি বােকাসিও অসাধারণ মানবদরদী রূপে পরিচিত লাভ করেছিলেন। নেপলসের কিং রবার্টের অপূর্ব সুন্দরী একটি অবৈধ কন্যা ছিল। কন্যার মা ছিলেন অভিজাত পরিবারভূক্ত। মেয়েটির নাম ছিল মারিয়া। গিওভানি এই মারিয়াকে ভালবেসে ফেলল। মারিয়ার কথায় পরে আসছি। নেপলসে গিওভানির জীবন সুখে ও পরামানন্দে কাটছিল। এই বছরগুলি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। সে হয়তাে নেপলসেই থেকে যেতাে কিন্তু আর্থিক অনটন ও রাজনীতিক কারণে ১৩৪১ খ্রীস্টাব্দে তাকে প্রিয় নেপলস ছেলে ফ্লোরেন্সে ফিরে যেতে হয়।
ডেকামেরন টেলসের ভূমিকায় গিওভানি লিখেছে যে ১৩৪৮ খ্রীস্টাব্দে ফ্লোরেন্সে যখন মহামারী রূপে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে তখন সে ফ্লোরেন্সেই বাস করছিল, ভীত হয়ে শহর ত্যাগ করেনি। তবে গিওভানি যে ঐ সময়ে সত্যিই ঐ শহরে বাস করছিল তা সত্যি না হতেও পারে।
সুপণ্ডিত ও কবি পেত্রার্ককে সে গুরু বলে মেনে নিয়েছিল। পেত্রার্ক তার জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল। গিওভানিকে পেত্রার্ক ল্যাটিন ভাষায় লিখিত পৌরাণিক কাহিনী সংকলন করতে বলেন কিন্তু কাহিনীগুলি গিওভানির আকর্ষণীয় মনে হয়নি। তবে মনে হয় এই সব কাহিনী সংকলনের সময় সে হয়তাে ডেকামেরন নামে একটি বই লিখতে অনুপ্রাণিত হয়েছিল।
ডেকামেরন ব্যতীত সে আরও কয়েকখানি উচ্চস্তরের বই লিখেছিল, যে-বইগুলি তাঁকে ইটালির সুধা সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল। সাহিত্যিক মহলে গিওভানি বিশিষ্ট স্থান তো অর্জন করেছিলই এমনকি রাজনীতিক ও কূটনীতিক মহলেও সে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিল। ফ্লোরেন্সের প্রতিনিধিত্ব করতে এবং কূটনীতিক দূতরূপে তাকে কয়েকবার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
এই দৌত্যকাজে তাকে তার প্রিয় শহর নেপলসেও দু’বার যেতে হয়েছিল কিন্তু কয়েক বছর আগে সে নেপলস ছেড়ে এসেছিল এ সে নেপলস নয়। সংস্কৃতির জগতে নেপলস তখন স্নান। নেপলসের এই পতন দেখে গিওভানি যথেষ্ট মনোবেদনা ভোগ করেছিল।
কিং রবার্টের জারজ কন্যা মারিয়ার নাম আগেই উল্লেখ করেছি। তার পুরো নাম ছিল মারিয়া দ্য অ্যাকুইননা। গিওভানি তাকে আদর করে ডাকতো ফিয়ামমেত্তা বলে। বস্তুত ফিয়ামমেত্তা নামে একজন সুন্দরী ডেকামেরন টেলসে অনেকগুলি পৃষ্ঠা অধিকার করে আছে।
মারিয়ার মা ছিল অভিজাত বংশের মেয়ে। অবৈধ হলেও কন্যা মারিয়া নিজেকে অভিজাত বলেই মনে করতাে। পিতাও অভিজাত ছিলেন। মারিয়া ছিল অপরূপ রূপলাবণ্যবতী, স্নিগ্ধ সুন্দরী।
গিওভানির বয়স তখন তেইশ। সুদর্শন, চোখা নাক, কালাে কুঞ্চিত কেশদাম ও কালাে চোখ এবং বলিষ্ঠ গঠন যুবতীদের আকৃষ্ট করতাে। তার মস্ত গুণ ছিল সে ছিল সদাহাস্যময় ও আমােদপ্রিয়। সুরসিক তাে ছিলই। মজার মজার গল্প বলে মহিলাদের মন কেড়ে নিতে পারতাে।
১৩৩৬ খ্রীস্টাব্দের মার্চ মাসের কোনাে এক শনিবার গাছে গাছে যখন অজস্র ফুলে ফুটেছিল, মৃদু মলয়ানীল বইছিল, শাখায় শাখায় নৃত্য করতে করতে পাখিরা গান গাইছিল সেইসময়ে কোনাে বান্ধবী মারফত এক গির্জায় উদ্যানে মারিয়ার সঙ্গে গিওভানির পরিচয় হল। মারিয়া তখন পর-স্ত্রী।
এতদিন পরে গিওভানি যেন মনের মতাে এক তরুণীর সান্নিধ্য লাভ করলাে। তরুণী সুরসিকা, শিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী, অতীব সুন্দরী এবং স্বাস্থ্য সম্পদে ভরপুর। তার যৌন আবদেন যুবক গিওভানির পক্ষে উপেক্ষা করা অসম্ভব। হলেই বা পর-স্ত্রী, না হলই-বা কুমারী? প্রস্ফুটিত তাজা সুগন্ধী কুসুমের একাধিকবার ঘ্রাণ নিলেও সে কুসুম ম্লান হয় না। কিং রবার্ট মারিয়াকে কনভেন্টে বন্দী রেখে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। কনভেন্টের প্রতি মারিয়ার একটু দুর্বলতা ছিল তাই বােধহয় মারিয়ার ইচ্ছা ছিল উত্তর-জীবনে সে নান’ হবে।
এ অবশ্য তার কুমারী জীবনের ইচ্ছা। এমন রূপসীটি নান হয়ে কঠোর ধর্মজীবন পালন করবে? এ কি হতে পারে? তাই সে সােড়শী হবার আগেই তাকে বিয়ের বাঁধনে বেঁধে ফেলা হল। বনেদী এক জমিদার পুত্রের সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়া হল।
সেই গির্জার উদ্যানে একদিন চারি চক্ষুর মিলন হল এবং বলা বাহুল্য পলকে প্রণয়। গিওভানি কোনােদিন কামান্ধহীন প্রেমে বিশ্বাস করেনি, দৈহিক মিলন ছাড়া প্রেম অসম্ভব এই ছিল তার বিশ্বাস, প্রেম মানেই সর্বোতভাবে আত্মসমর্পণ।
গিওভানি আবিষ্কার করলাে তরুণী লেখাপড়া জানে, গান গাইতে পারে, সুরসিকা, রুচিশীলা। মেয়েটি তার মনের মতাে কিন্তু গণ্ডদেশে চুম্বনের পর তরুণী আর অগ্রসর হতে চায় না। এমনকি গিওভানি তার বুকে হাত দিলে হাত সরিয়ে দেয়। রতি চরিতার্থ না হল তাে কিসের প্রেম? গিওভানি সুযােগ অপেক্ষা করতে থাকে।
গিওভানিকে একদিন মারিয়া বললাে তার স্বামী জমিদারি পরিদর্শন করতে ও শস্য বিক্রয় করতে গ্রামে যাবে। ফিরতে সাত দিন দেরি হতে পারে। এই তাে সুযােগ। গিওভানির আর্থিক অবস্থা তখন বেশ সচ্ছল। পকেটে তখন সােনার ফ্লোরিন সর্বদা ঝম ঝম করে। তখন অক্টোবর মাস। গিওভানি মারিয়ার পরিচারিকাদের ঘুষ দিয়ে তাদের হাত করলাে। মারিয়ার বেডরুমে তাকে লুকিয়ে রাখতে হবে। রসিক পরিচারিকারা বললাে, তারা যথাসময়ে নায়ককে মারিয়ার বেডরুমে মােটা পর্দার আড়ালে লুকিয়ে রাখবে। এটা কোনাে সমস্যা নয়।
রাত্রে মারিয়া যখন ডিনার খেতে ব্যস্ত সেই সুযােগে একজন পরিচারিকা গিওভানিকে পিছনের গুপ্ত দরজা দিয়ে তাকে লুকিয়ে মারিয়ার বেডরুমে পৌঁছে দিয়ে মােটা পর্দার আড়ালে লুকিয়ে রাখলাে।
গিওভানি কারপেটের ওপর চুপ করে বসে প্রেমিকার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল। সে যে কৌশল অবলম্বন করবে তাতে আজই সে নিশ্চয়ই কৃতকার্য হবে।
গিওভানিকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। ঘরে প্রথমে প্রবেশ করলাে একজন পরিচারিকা তারপর মারিয়া, তার প্রিয়তমা ফিয়ামমেত্তা। গিওভানির রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠল। ঘরের আলাে উজ্জ্বল নয়। ঘরের মাঝখানে মারিয়া দাড়িয়ে দর্পণে নিজেকে দেখতে লাগল। ইতিমধ্যে তার পরিচারিকা মারিয়ার দেহ থেকে একে একে সমস্ত বস্ত্রগুলি খুলে আলনায় গুছিয়ে রাখলাে।
মারিয়ার গায়ের রং যে ফেটে পড়ছে। ঘরের আলাে যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আহা! গিওভানি এ কি দেখছে! এতদূর সে আশা করে নি। দ্রুত নিশ্বাস পড়তে লাগল, বুকের স্পন্দন দ্রুত হল। নগ্ন নারী সে অনেক দেখেছে কিন্তু এত সুন্দর নগ্ন নারী সে আর দেখে নি। অনমিত স্তনভার, সুডৌল নিতম্ব, ক্ষীণকটি, পদদ্বয় ও হস্তদ্বয়ও তুলনাহীন। স্বর্ণচাপাও এই বিবসনা নারীমূর্তির কাছে হার মানবে।
পরিচারিকা এবার কোমল বস্ত্রখণ্ড দিয়ে সারা দেহ মুছিয়ে দিল। কোনাে অঙ্গ বাদ দিল না। গিওভানি তখন ভাবছিল ঐ হাত পরিচারিকার না হয়ে তার হল না কেন?
মারিয়া একটি টুলের ওপর বসলাে। পরিচারিকা তার সােনালি চুল খুলে রুপপা-বাঁধানাে চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে, ভিজে তােয়ালে দিয়ে তার পা দুটি মুছিয়ে বিদায় নিল। মারিয়া অঙ্গে আর বাস না দিয়ে প্রার্থনা করে বুকে ক্রূশ চিহ্ন এঁকে শুয়ে পড়ল।
গিওভানি সবই দেখল। উপযুক্ত সময়ের জন্য সে অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু অপেক্ষা করতে হবে? ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগে পরিচারিকা বাতিগুলি নিবিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।
মারিয়া পাশ ফিরে শুয়েছিল। পশ্চাৎ দিক ছিল গিওভানির দিকে। গিওভানি বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাে। মারিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা বুঝতে পারলাে না। সে আর অপেক্ষা করতে পারলাে না। পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে সে নিঃশব্দে মারিয়ার খাটে উঠে তার পাশে সামনের দিকে বসলাে।
মারিয়া তখনও ঘুমােয়নি তবে তার চোখে ঘুম এসে গিয়েছিল। গায়ে পর পর কয়েকটা তপ্ত নিঃশ্বাস পড়তে সে প্রথমে সােজা হয়ে শুলাে তার চোখ মেলে চেয়ে অন্ধকারে একজন অপরিচিত পুরুষকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করতে যাচ্ছিল। গিওভানি সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, প্রিয়তমা কিয়ামমেত্ত ভয় পেয়াে না, আমি তােমার গিওভানি। গিওভানি মুখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিল।
নগ্নতা আবৃত করবার মতাে কিছু না পেয়ে মারিয়া উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে বললাে, তুমি একবার ঘরের বাইরে যাও আমি কিছু পরে নিই।
সে প্রয়ােজন নেই প্রেয়সী, যেমন আছে তেমনই থাক, তুমি কি জান না বসনহীনা তােমাকে কত সুন্দর দেখায়, তার পিঠেও নিতম্বে মৃদু ভাবে হাত বােলাতে বােলাতে গিওভানি বলল।
এই সুখস্পর্শ হয়তাে মারিয়ার ভালােই লাগছিল। পুলকানুভূতি বােধ করছিল তাই বাধা দিল না। বললাে, কিন্তু গিওভানি তুমি কোন্ সাহসে স্বামীর অনুপস্থিতিতে পরস্ত্রীর ঘরে প্রবেশ করলে? তুমি চলে যাও, জানাজানি হলে বড়ই লজ্জার ব্যাপার হবে, কেলেঙ্কারির চূড়ান্ত হবে।
ফিরে যাবার জন্যে তাে আসি নি কিয়ামমেত্তা, আমি এসেছি একটি উদ্দেশ্য নিয়ে, কি সে উদ্দেশ্য তা তােমাকে বলতে হবে না, বলে গিওভানি মারিয়ার ঘাড়ে চুম্বন করতে লাগল। মারিয়া শিউরে উঠতে লাগল কিন্তু বাধা দিল না।
গিওভানির প্রস্তাব শুনে মারিয়া ঈষৎ পাশ ফিরে বললাে, গিওভানি তুমিও? আমি তােমার কাছ থেকে এমন প্রস্তাব আশা করিনি। তুমি কি জানাে না যে আমি পরের স্ত্রী এবং আমাকে উপভােগ করবার অধিকার একমাত্র তারই আছে।
প্রেয়সী, তুমি যা বললে তা কি আমি জানি না? জানি। তুমি বিবাহিতা এবং কুমারী নও তাও জানি। পরস্ত্রীকে যে উপভােগ করতে নেই এই নীতিতে আমি বিশ্বাস করি না কারণ মানুষের আদি রিপু যখন প্রবল হয় তখন সে কোনাে নীতি মানে না।
তােমার অবস্থা কি তােমার আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে গিওভানি?
অনেকক্ষণ আগেই, যখন তােমার পরিচারিকা তােমার দেহ থেকে তােমার শেষ বস্তুগুলি খুলে নিল তখন থেকে। প্রিয়তমা আমার কামনা পূর্ণ করি, এসাে আমরা…।
তা হয় না গিওভানি, তুমি শিক্ষিত ও ভদ্র, নিজেকে দমন করো। তােমার কামলালসা যদি প্রবল হয়ে থাকে তাহলে তা চরিতার্থ করবার জন্য তুমি তাে অন্য নারী পাবে।
তাহলে বলি শােনাে ফিয়ামমেত্তা, নারী অনেক আছে, তারা অনেক রতিরণে নিপুণ কিন্তু তারা কেউ কিয়ামমেত্তা নয়। সােনা, তুমি যদি রাজি না হও তাহলে এই দেখ, আমার হাতে এই শাণিত ছুরি, আমি এটি আমার বুকে আমূল প্রােথিত করবাে।
গিওভানির হাতে ছােরা দেখে মারিয়া লজ্জা ভুলে উঠে বসে গিওভানির হাত চেপে ধরে বললাে, না না গিওভানি, ও কাজ কোরাে না। আমার ঘরে তােমার মৃতদেহ আবিষ্কৃত হলে কেলেঙ্কারির চূড়ান্ত হবে। তুমি কি তােমার প্রেয়সীকে এমন লজ্জায় ফেলতে পারাে?
তাহলে রাজি হও কিয়ামমেত্তা, আমরা পরস্পরকে ভালােবাসি, আমাদের রতিমিলনে পাপ হবে না, এসাে কাছে এসাে।
গিওভানি ছােরা সরিয়ে রাখল। গিওভানির সাহস দেখে মারিয়া মনে মনে তার প্রশংসা করছিল এবং গিওভানির হস্তস্পর্শে সে কিছু পুলক অনুভব করছিল। যখন সে বুঝলাে যে অন্য কোনাে উপায় নেই তখন তার রাজি না হয়ে আর উপায় রইলাে না।
মারিয়ার সঙ্গে গিওভানি বােকাসিওর ঘনিষ্ঠতা এক বছরের বেশি স্থায়ী হয়নি, কারণ গিওভানি এক নারীতে বেশিদিন তৃপ্ত থাকতে পারতাে না। তবে এই এক বছরের মধ্যে আরও অনেকবার মিলিত হয়েছে।
এই এক বছর সম্পূর্ণ হবার পূর্বে গিওভানির পিতার ব্যবসায়ে দুর্দিন নেমে আসে, বলতে গেলে তিনি সর্বস্বান্ত হয়ে যান। গিওভানির অবস্থাও এত খারাপ হয়ে যায় যে, প্রেমিকাকে এক গুচ্ছ ফুল কিনে দেবার সামর্থ্যও তার ছিল না।
গিওভানি নেপলস ছেড়ে ফ্লোরেন্সে ফিরে যায় কিন্তু নারীর প্রতি তার আকর্ষণ কোনাে দিনই কমেনি। তার নামে নানা স্ক্যাণ্ডাল শােনা যেতাে, কোনােটি সত্য কোনােটি মিথ্যা। কোনাে এক কনভেন্ট থেকে সে এক যুবতীকে ফুসলিয়ে বার করে আনে। তার গর্ভে একটি সন্তানের জন্ম দিয়েছিল।
গিওভানি অবিবাহিত ছিল। একজন প্রেয়সীকে সে পাঁচটি সন্তান উপহার দিয়েছিল। প্রেয়সীটি ছিল তার পরিচারিকা ব্রুনা। গিওভানি সন্তানগুলিকে অবহেলা করেনি। অর্থ রােজগারের জন্যে গিওভানি তখন প্রচুর পরিশ্রম করতাে। দুঃখের বিষয় যে ফ্লোরেন্সে প্লেগ মহামারীতে তার পিতা, ব্রুনা ও পাঁচটি সন্তানও মারা যায়।
শেষ বয়সে গিওভানি তার গুরু ও বন্ধু পেত্রার্ক দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পবিত্র জীবন যাপন আরম্ভ করেছিলেন। নারীসঙ্গ তিনি পরিহার করতেন। তার সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় বই ডেকামেরন সম্বন্ধে তিনি বলতেন যে, বইটি লিখেছিলুম যৌবনে কিন্তু এখন বৃদ্ধ বয়সে এই বই লেখার জন্য লজ্জা পাই। বইখানি যেন অবিবাহিত তরুণী বা যুবতীরা না পড়ে।
জীবনের শেষ তেরাে বছর গিওভানি চারটালাডাতে কাটিয়েছিলেন। এই শহরেই ১৩৭৫ খ্রীষ্টাব্দে তার মৃত্যু হয়।
সুচনা
ডেকামেরনের গল্পগুলি আরম্ভ করার পূর্বে ভূমিকায় বােকাসিও লিখেছেন, এইবার ডেকামেরন নামে বইখানি আরম্ভ করা গেল, যে-বইখানি প্রিন্স গ্যালাহল্ট নামেও পরিচিত। এই বইয়ে একশ’টি গল্প আছে যেগুলি সাতজন মহিলা ও তিনজন যুবক দশ দিন ধরে বলেছে।
ডেকামেরনের গল্পগুলিতে কখনও কোমল প্রেম আবার কখনও দুঃসাহসিক প্রেমের বর্ণনা পাওয়া যাবে। কখনও তিক্ত, কখনও মধুর যা অতীতে ঘটেছে বা আজও ঘটে। গল্পগুলি পড়ে যেমন পুলকানুভূতি হবে তেমনি কিছু শিক্ষালাভও হতে পারবে। প্রেমে কতদূর অগ্রসর হওয়া উচিত বা কখন সরে আসা প্রয়ােজন তারও নির্দেশ এই কাহিনীগুলি দেবে। যে সকল প্রেমিক-প্রেমিকা পড়ে আনন্দ অনুভব করবেন তারা যেন প্রেমের কাছেই ঋণ স্বীকার করেন।
এরপর বােকাসিও সেই পরিস্থিতির বর্ণনা দিচ্ছেন যে পরিস্থিতি কয়েকজন যুবক-যুবতীকে একত্রে মিলিত করেছেল এবং পরস্পর আলাপ সূত্রে গল্প বলতে আরম্ভ করলো। এই যুবক-যুবতীদের মধ্যে প্যামপিনিয়ার নির্দেশ অনুসারে প্রত্যেকে রুচি অনুসারে বা যে বিষয়টি তার নিজের কাছে উপভােগ্য সেই বিষয়ে একটি করে গল্প বলেছিল অর্থাৎ প্যামপিনিয়া প্রত্যেককে যে-কোনাে কাহিনী বলার স্বাধীনতা দিয়েছিল।
তারপর বােকাসিও লিখেছেন ঈশ্বর পুত্রের জন্মের পর তেরােশত আটচল্লিশ বৎসর কেটে যাবার পর ইটালির সুন্দরতম শহর ফ্লোরেন্স এক মারাত্মক মহামারীর কবলে আর সেই সঙ্গে আরম্ভ হল এক বিভীষিকার পরিবেশ। সে যে কি করুণ এবং নিষ্ঠুর দৃশ্য, সে যে কি সাংঘাতিক নির্যাতন তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।
মারাত্মক সেই মহামারীর নাম প্লেগ যার সূত্রপাত পুব দেশে, যেখানে সে অগুন্তি নরনারী ও শিশুর জীবন অকালে নাশ করে এই শহরকে আক্রমণ করলাে। দিনে দিনে তার শক্তি বাড়তে লাগল। এ রােগের কোনাে চিকিৎসা নেই, বিনা চিকিৎসায় মানুষ তিলতিল করে মরতে লাগলাে।
এই সর্বনাশা রােগ প্রতিরােধের জন্য কত না চেষ্টা করা হতে লাগল কিন্তু সবই বৃথা। চিকিৎসকরা বিফল, অসহায়। এ রােগের ওষুধ তারা জানে না, কেন হয় তাও জানে না। প্রথমে রােগীর কুঁচকি বা বগল ফুলে ওঠে, ফুলতে ফুলতে তা একটা আপেলের আকার নেয়। সেই ফোলা অন্যত্রও দেখা দেয়। শরীরের অন্য স্থান ফোলার সঙ্গে সঙ্গে পােড়া দাগ দেখা দেয় এবং কিছু করার আগেই তার মৃত্যু হয়।
তিলতিল করে মানুষ মরতে লাগল। প্রথম দিকে কবর দেবার মানুষ পাওয়া যেত তারপর কবর খোড়ার মানুষেরও অভাব হল। তখন লম্বা গর্ত খুঁড়ে তার মধ্যে মৃতদেহ ফেলে মাটি চাপা দেওয়া হতে লাগল।
অবশেষে এমন মানুষেরও অভাব দেখা দিল। তখন পথে ঘাটে মৃতদেহ পড়ে থাকতাে। কুকুর, বিড়াল ও শকুন সেইসব মৃতদেহ ছিন্নভিন্ন করতে লাগল। সে এক বীভৎস দৃশ্য। যারা সুস্থ তারা অনেকেই শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে লাগল আর যারা অসহায়, শহর ত্যাগ করবার ক্ষমতা নেই তারা গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা করতে লাগলাে।
বােকাসিও বলেছেন এই মহামারী এমনই নৃশংস আকার ধারণ করেছিল যে, আমি যদি স্বচক্ষে না দেখতুম তাে বিশ্বাসই করতুম না। একদিন দেখলুম কয়েকটা শূকর একটা মৃতদেহকে ছিন্নভিন্ন করছে। সে যে কী বীভৎস দৃশ্য তা লেখা যায় না। কিন্তু মনকে দারুণভাবে আঘাত করে।
যারা বেঁচেছিল তারাও ক্রমশ স্বার্থপর হয়ে উঠলাে। কেউ কারও সাহায্যে এগিয়ে আসে না। কলহ করে, এমনকি পরস্পরকে আক্রমণ করে। মানবধর্মের কি চরম অবনতি। ভাবতে গা শিউরে ওঠে।
এমত অবস্থায় কোনাে এক মঙ্গলবারে পবিত্র সান্টা মেরিয়া নােভেলা গির্জার প্রাঙ্গণে সাতজন মহিলাকে দেখা গেল। কালাে পােশাকে দেহ আবৃত করে এরা গির্জায় প্রার্থনা করতে এসেছে। এরা পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত কিংবা কারও সঙ্গে আত্মীয়তা সূত্রে আবদ্ধ। যীশুর অসীম কৃপা যে, এরা এখনও ঐ মারাত্মক ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হয়নি।
এই সাতজন মহিলা সম্রান্ত বংশের, সুন্দরী , কমনীয়। বয়স কারও সাতাশের বেশি নয় বা আঠারাের কম নয়। প্রত্যেকে বুদ্ধিমতী ও কর্মঠ। সকলেই সুরসিকা, কারও মুখ বেশ আলগা, রুচিহীন কথা সহজে বলতে পারে, চঞ্চলা।
প্রথমে ভেবেছিলুম এই মহিলাদের নাম প্রকাশ করা উচিত হবে না কারণ যেসব কাহিনী তারা পরে বলেছিল তাদের মধ্যে কতকগুলি তাে বেশ অশ্লীল। নাম প্রকাশ হয়ে পড়লে তারা নিন্দনীয় হতে পারে কিন্তু দেখলুম নাম উল্লেখ না করলে কাহিনী বলতে অসুবিধে হবে তাই তাদের নাম বলে দেওয়াই ভালাে।
প্রথমে যার নাম বলল সে বয়ােজ্যেষ্ঠ। তার নাম প্যামপিনিয়া। দ্বিতীয় মেয়েটির নাম ফিয়ামমো, ফিলােমেনা হল তৃতীয় মহিলা, চতুর্থ যুবতীর নাম এমিলিয়া, পঞ্চম হল লরেতা, ষষ্ঠ নেফাইল এবং সপ্তম কন্যার নাম এলিসা।
গির্জায় প্রার্থনা ও অন্যান্য অনুষ্ঠান সেরে এরা গির্জার উদ্যানে একটি মনােরম স্থান বেছে নিয়ে গল্পসল্প আরম্ভ করলাে। প্যামপিনিয়াই কথা আরম্ভ করলাে। দীর্ঘ ভূমিকা শেষে সে বললাে ফ্লোরেলের অবস্থার দিন দিন অবনতি হচ্ছে, প্লেগ মহামারীতে মৃত্যুসংখ্যা রােজই বাড়ছে। মানুষ হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের বাঁচবার অধিকার আছে এবং যতদিন পর্যন্ত না মৃত্যু হয় ততদিন পর্যন্ত আমাদের নিজেদের বাঁচিয়ে রাখা কর্তব্য। তাই বলছিলুম কি আমরা যদি আর কিছুদিন এই শহরে থাকি তাহলে মৃত্যু আমাদের অবধারিত তাছাড়া এখানে আপাতত আমাদের করবারও কিছু নেই। রােজই শুনছি আমাদের পরিচিত কেউ না কেউ মারা যাচ্ছে, এজন্যে আমরা মানসিক কষ্টও ভােগ করছি।
প্যামপিনিয়া বলল, তাই আমি প্রস্তাব করছি যে আমরা এই শহর ছেড়ে চলে যাই। অনেকে তাে চলে গেছে, আমরাই-বা পড়ে থাকি কেন? বাইরে কোথাও গেলে আমরা আবার পাখির গান শুনতে পাবাে, গাছে গাছে ফুলের শােভা দেখব এবং যে কোনাে মুহূর্তে মৃত্যুভয় থেকে আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারবাে। বাইরের বাতাস এখন নির্মল, সেখানে আমরা ইচ্ছামত নির্ভয়ে বিচরণ করতে পারবাে। তাই নয় কি? তােমরা কি বলাে?
প্যামপিনিয়ার এই প্রস্তাব সকলে সমর্থন করে আনন্দ প্রকাশ করলাে। বলতে কি দীর্ঘদিন পরে তাদের মুখে হাসি দেখা দিল।
ফিলােমেনা বলল, প্যামপিনিয়ার প্রস্তাব নিঃসন্দেহে সমর্থনযােগ্য এবং আমরা সকলে শহর ছেড়ে যেতে রাজিও আছি কিন্তু কথাটা কি যে আমরা সকলেই মেয়ে, সাত সাতটা মেয়ে শহর থেকে দূরে কোথাও থাকা নিরাপদ নয়, তাছাড়া এমন কিছু কাজ আছে যা করা আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়। পুরুষের সাহায্য ছাড়া যেসব কাজ আমরা করতে পারি না। পুরুষের সাহায্য ছাড়া আমরা অসহায় অতএব আমরা একা যাবো অথবা সঙ্গে পুরুষ সঙ্গী নেবাে কিনা যাত্রার পূর্বে এটা ভাবা দরকার।
এলিসা বলল, ফিলােমেনা ঠিকই বলেছে। মেয়ে হিসেবে আমাদের যেমন অনেক গুণ আছে তেমনি ত্রুটিও কম নয়। পুরুষ হয়তাে মেয়েদের সাহায্য বিনা চলতে পারে কিন্তু আমরা তা পারি না। পুরুষরা আমাদের চালিত না করলে আমরা চলতে পারি না। আমাদের মনের জোরও কম। বিপদ থেকে পুরুষরাই আমাদের রক্ষা করে এবং এমন অনেক কাজ আছে যা পুরুষের সাহায্য ছাড়া আমরা করতেই পারবাে না। অথচ আমাদের এমন পুরুষসঙ্গী নিতে হবে যারা আমাদের সম্মান রক্ষা করবে, যাদের ওপর আমরা নির্ভয় করতে পারি এবং যারা আমাদের বাধ্য হবে।
মেয়েরা যখন কলকল করে অতি উৎসাহের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলােচনা করছে সেই সময়ে তিনটি যুবক গির্জার উদ্যানে প্রবেশ করলাে। তাদের দেখে মনে হয় না যে, শহরের মড়ক তাদের স্পর্শ করেছে বা। এই করুণ পরিস্থিতির জন্য তারা ব্যথিত। এটা বােধহয় ওরা ঝড় বৃষ্টি বন্যা ইত্যাদির মতাে সাময়িক একটা প্রকৃতিক ঘটনা বলে ধরে নিয়েছে। মানুষ হয়ে জন্মালে রােগ শােক জরা ও মৃত্যু আছেই অতএব ওসব ভেবে নিজের মনকে কষ্ট দিয়ে লাভ কি?
এই তিনজন যুবকের মধ্যে কারও বয়স পঁচিশ বছরের কম নয়। প্রথম জনের নাম প্যানফিলাে, দ্বিতীয় জনের নাম ফিলােস্ট্রাটো এবং তৃতীয় জনের নাম ডায়ােনিও।
সাতটি যুবতীর মতাে এরাও সম্রান্ত বংশের। সুদর্শন, মন ভােলা, রসজ্ঞান আছে এবং সর্বোপরি নারীসঙ্গ এদের ভালােই লাগে। হয়তাে দুর থেকে সাতটি যুবতীকে একত্রে দেখতে পেয়েই ওরা গির্জা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেছে।
যুবকদের দেখতে পেয়ে মৃদু হেসে প্যামপিনিয়া বলল, দেখেছ? ভাগ্য আমাদের প্রতি সুপ্রসন্ন। ঐ দেখে, ওরা তিনজনই বুদ্ধিমান সাহসী ও সুরসিক। ওরা আমাদের সঙ্গী হতে পারে। ওদের আমরা কাজে লাগাতে পারবাে, আমাদের চাহিদা ওরা পূরণ করতে পারবে।
ইতিমধ্যে একটি যুবক নেফাইলকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করছে। নেফাইল তা বুঝতে পেরেছে। বেচারীর বয়স কিছু কম, এখনও পেকে ওঠেনি, লজ্জায় তার সারা মুখ আর দুই কান টকটকে লাল হয়ে উঠেছে।
প্যামপিনিয়াকে সে বলল, প্যামপিনিয়া ওরা ভালাে ছেলে মানছি কিন্তু কারও মতলব তাে ভিন্ন হতে পারে, আমাদের সাবধান হওয়া উচিত।
প্যামপিনিয়া বলল, তুই ঠিকই বলেছিস নেফাইল। কিন্তু আমি যদি ঠিক থাকি তবে কে আমার কি করতে পারে? ঈশ্বর, ন্যায় এবং সত্য আমাদের রক্ষা করবে।
প্যাপিনিয়ার মত সমর্থন করে ফিলােমেনা বলল, প্যামপিনিয়া ঠিকই বলেছে। এখন দেখা যাক ওরা আমাদের সঙ্গে যাবে কিনা এবং আমদের সম্মান রক্ষা করবে কিনা।
এবার সকলে একমত হল। যুবকদের ডেকে ওদের সঙ্গে কথা বলে দেখা যাক ওরা কি বলে। মনে মনে সকলেই জানে যে সাতজন সুন্দরী যুবতীর কোনাে অনুরােধ ওরা উপেক্ষা করতে পারবে না।
তিনজন যুবকের মধ্যে একজনের সঙ্গে প্যামপিনিয়ার রক্তের সম্পর্ক ছিল। তাকেই লক্ষ্য করে প্যামপিনিয়া ওদের কাছে ডাকলাে। যুবতীদের এমন সাদর আহ্বান কোন্ যুবক উপেক্ষা করবে! হাসিমুখে সাড়া দিয়ে ওরাও হাসিমুখে এগিয়ে এলাে।
যুবকেরা কাছে আসতে প্যামপিনিয়া তাদের কাছে প্রস্তাবটি রেখে জিজ্ঞাসা করলাে ওরা ভায়ের মতাে ওদের দলে যােগ দিতে রাজি আছে কিনা।
যুবকেরা প্রথমে মনে করেছিল প্যামপিনিয়া বুঝি ঠাট্টা করছে। কিন্তু যখন বুঝতে পারলাে যে মহিলা ঠাট্টা করছে না তখন তারা সানন্দে রাজি হল এবং তখন যাত্রার উদ্যোগ পর্ব নিয়ে আলােচনা শুরু করে দিল। কার্যক্রম স্থির করতে বিলম্ব হল না। কোথায় যাওয়া হবে, কখন যাওয়া হবে, মহিলাদের ও পুরুষদের সঙ্গে কোন্ কোন্ সেবিকা ও সেবক যাবে, কে কি কাজ করবে সব ঠিক করে আহার্যসহ সমস্ত প্রয়ােজনীয় সামগ্রী আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হল।
পরদিন বুধবার ভােরে সাতজন মহিলা ও তিনজন যুবক এবং তাদের সেবিকা অর্থাৎ আয়া এবং সেবক অর্থাৎ ভৃত্যসহ সকলে যাত্রা করলাে।
যে বাড়িটি ওরা পছন্দ করেছিল সেই বাড়িটি ফ্লোরেন্স থেকে এবং বড় রাস্তা থেকে বেশি দূরে নয় তবে বাড়িটি বড় সুন্দর। অনুচ্চ একটি পাহাড়ের ওপর উদ্যান ঘেরা এবং পরিবেশ মনােরম। চারদিকে ফুলের বাগান এবং ফুলন্ত বড় বড় গাছ। মাঝে মাঝে লতাকুঞ্জ, বসবার জন্য শ্বেতপাথরের চেয়ার ও বেদি। শ্বেতপাথরের কয়েকটি মূর্তি উদ্যানের শােভা বৃদ্ধি করেছে। নানা বর্ণের পাখি গাছের ডালে ডালে নেচে বেড়াচ্ছে। ছুটি উপভােগ করতে হলে এবং বিশ্রাম নিতে হলে এমন বাড়িতেই বাস করা উচিত।
পানীয় জলের অভাব নেই। কয়েকটি কূপ আছে। প্রয়ােজনীয় সবরকম আসবাবও বাড়িটিতে আছে। সুরাও প্রচুর পরিমাণে মজুত করা হয়েছে। শহর থেকে বেশি দূর নয়। কয়েকটা দিন বেশ আরামেই কাটান যাবে।
বাড়িতে ঢুকে ওরা দেখল সমস্ত বাড়িটি পরিষ্কার করা হয়েছে, দরজা জানালায় পর্দা ঝুলহ, মেঝেতে ধূলিবিহীন কার্পেট, খাটে শয্যা প্রস্তুত, ফুলদানিতে ঘরে ঘরে ফুল।
বাগান ও বাড়ি দেখে ডায়ােনিও তাে উৎফুল্ল। মহিলাদের উদ্দেশ্য করে সে বলল, বাঃ বেশ চমৎকার। তােমাদের সুরুচির প্রশংসা না করে উপায় নেই। বাগান দেখে আমাদের চোখ জুড়িয়ে গেল। ঘর দেখে আমার মন ভরে উঠল। আমি তাে আমার সব দুশ্চিন্তা শহর থেকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সেখানেই রেখে এসেছি, তােমরা কি করেছ জানি না। তাহলে যে ক’টা দিন এখানে আমরা থাকবাে সে কটা দিন আমরা নেচে গেয়ে হেসে খেলে কাটাতে চাই অবশ্য আমরা শালীনতা বজায় রাখবাে। কি? তােমরা রাজি তাে? না হয় তাে বলল আমি অন্তত আমরা দুর্ভাবনার গহূরে আবার ফিরে যাই।
প্যামপিনিয়া বলল, আরে আরে অত ব্যস্ত কেন? আমরা সব সােকতাপ দুঃখ ব্যথা বেদনা ভােলবার জন্যই এখানে এসেছি। ফিরে যাবার কথা তুলছ কেন? তােমার প্রস্তাব অতি উত্তম, আমাদের সকলেরই সায় আছে এবং আমরা তাই করবাে। তবে আমার একটা প্রস্তাব আছে।
কি প্রস্তাব? কেউ জিজ্ঞাসা করলাে।
প্রস্তাবটা হল এই যে, আমাদের মধ্যে প্রতিদিন এক-একজনকে সেইদিনের নেতা বা নেত্রী স্থির করা হবে। নেতা বা নেত্রী সেইদিনের সব কাজ পরিচালনা করবে। কি কি রান্না হবে তা থেকে আরম্ভ করে দিনের কার্যক্রম স্থির করে দেবে। দিনের শেষে সেই নেতা বা নেত্রী পরদিনের নেতা বা নেত্রী মনােনীত করে দেবে। আমরা সকলে তার ইচ্ছানুসারেই চলবাে।
পামপিনিয়ার প্রস্তাবে সকলে রাজি হয়ে সমস্বরে সমর্থন, জানাল এবং প্রথমদিনের জন্যে তাকেই নেত্রী বা কুইন নির্বাচিত করা হল। ফিলােমেনা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে বাগানে গিয়ে লরেল পাতা তুলে এনে একটা মুকুট বানিয়ে প্যামপিনিয়ার মাথায় পরিয়ে দিল।
কুইন নির্বাচিত হয়ে প্যামপিনিয়া প্রথমে ওদের চারজন আয়া এবং যুবকদের তিনজন ভৃত্যকে ডেকে সকলকে চুপ করতে বলে বলল, দেখ আমরা যাতে বিশেষ কিছু নিয়ম মেনে সকলে এখানে আরামে থাকতে পারি সেজন্যে একটা কার্যক্রম ঠিক করে দিচ্ছি। প্রত্যেককে কিছু কিছু নির্দিষ্ট কাজের ভার দেব এবং সকলে সেই অনুসারে কাজ করলে আমরা সকলে আরামেই থাকতে পারবাে নচেৎ আমাদের ছন্নছাড়ার মতাে জীবন কাটাতে হবে যা আমরা চাই না। প্রথমেই আমি ডায়ােনিওর ভৃত্য পারমিনােকে আমার স্টুয়ার্ড নিযুক্ত করেছি। আমাদের এখানকার ঘর গেরস্থালীর সমস্ত তত্ত্বাবধান সে করবে। প্যানফিলাের ভৃত্য সিরিসকো দৈনন্দিন কেনাকাটা করবে ও হিসেব রাখবে এবং পারমিনাে তাকে যে কাজ করতে বলবে সেসব কাজও করবে। ফিলােস্ট্রাটোর ভৃত্য টিণ্ডাররা নিজের মনিব এবং বাকি দুজন পুরুষের সকল কাজ করবে। আমার নিজের আয়া মিসিয়া রান্নাঘরের ভার নেবে, তাকে সাহায্য করবে ফিলােমনার আয়া লিচিশ্চা। কি রান্না হবে পারমিনাে বলে দেবে। লরেতা এবং কিয়ামমেত্তার আয়া চিমেরা এবং স্ট্যাটিলিয়া সাতজন মহিলার সব কাজকর্ম করবে, ঘর-দোর আসবাব পরিষ্কার রাখবে। আশা করি সকলে নিজ নিজ কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করবে।
তারপর প্যামপিনিয়া হাসিমুখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বাগানটা বেশ বড়। সকালে আমরা বাগানের যেখানে ইচ্ছে বেড়াব কিন্তু ন’টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে সকলে আমরা এই জায়গাটাতে ফিরে এসে একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট খাব। জায়গাটা বেশ ছায়া ঘেরা। কত প্রজাপতি, যেন ফুল উড়ে বেড়াচ্ছে।
আপাতত ওদের কিছু করবার ছিল না তাই ওরা সকলে ভাগ হয়ে নিজের ইচ্ছেমতাে বাগানে ঘুরে বেড়াতে লাগল। কেউ বা একজায়গায় বসে গান গাইতে লাগল, কেউ-বা ফুল তুলে মালা গাঁথতে লাগল, আবার কেউ উদ্দেশ্যহীনভাবে বাগানে বেড়াতে লাগল।
কুইন যে সময় ওদের জন্যে মঞ্জুর করেছিল, সেইসময় শেষে ওরা ঘরে ফিরে দেখল দিনের আহার প্রস্তুত, পারমিনাে টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে। টেবিলে পাতা হয়েছে ধবধবে সাদা চাদর। টেবিলের ওপরে ঘরে অন্যত্র ফুলদানিতে ফুল। চমৎকার!
প্যামপিনিয়ার আদেশে সকলে হাত মুখ ধুয়ে পরিষ্কার করে চুল আঁচড়ে ডাইনিং হলে ঢুকল। কে কোন্ চেয়ারে বসবে তা পারমিনাে ঠিক করে রেখেছিল।
মুখরােচক নানারকম খাবার তৈরি হয়েছিল, সুরাও ছিল সকলের মনমতাে এবং পারমিনাের দক্ষ পরিচালনায় পরিবেশন ব্যবস্থায় কোনাে খুঁত ছিল না। ভােজ ও পানীয় সকলকে তৃপ্ত করলাে। হাসি ও গল্পের মধ্য দিয়ে আহারপর্ব সমাপ্ত হল।
ওরা সঙ্গে কয়েকরকম বাদ্যযন্ত্র এনেছিল। এবার কুইন বলল কিছু যন্ত্র ও কণ্ঠসঙ্গীত হােক। ডায়ােনিও বাঁশি আর কিয়ামমেত্তা ভায়ােলা বাজাতে লাগল। কেউ হাল্কা নাচ দেখাল, কেউ গান গাইল।
অনুষ্ঠান শেষ করে কুইন আদেশ দিল এবার বিশ্রাম। পুরুষরা তাদের নিজ নিজ ঘরে গেল, মেয়েরা তাদের। পােশাক বদলে সকলে কোমল শয্যায় শুয়ে পড়ল। ইটালির এই অঞ্চলে দুপুরে একটু ঘুমিয়ে নিলে বিকেলে বা সন্ধ্যায় শরীরে কোনাে জড়তা থাকে না।
বেলা তিনটের সময় কুইন আগে উঠে সকলকে ডেকে দিল, বলল দুপুরে বেশি ঘুম কিন্তু ভালাে নয়।
সকলে ঘুম থেকে উঠল, হাত মুখ ধুয়ে পােশাক পাল্টে বাইরে এলাে। সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়েছে, গাছের ছায়া গভীর হয়েছে, সবুজ ঘাস যেন আরও সবুজ ও আরও কোমল মনে হচ্ছে।
কুইন বলল, এসাে আমরা সবাই গাছের ছায়ায় ঘাসের এই সবুজ কারপেটে বসি। যদিও একটু গরম তবুও বাতাস তাে বইছে। আর দেখ চারদিক কেমন শান্ত, শােনা যাচ্ছে শুধু বাতাসে আন্দোলিত গাছের পাতার শব্দ আর মাঝে মাঝে পাখির ডাক। এখন কথা হচ্ছে দুপুরের এই সময়টা কি করে কাটানাে যায়। আমাদের সঙ্গে দাবা বা অন্য কিছু খেলা আছে কিন্তু খেলায় হারজিতের ফলে কেউ অত্যধিক উল্লসিত হতে পারে আবার কেউ-বা মনােবেদনা ভােগ করবে। যদি তােমরা সকলে রাজি হও তাে আমি একটা প্রস্তাব করি আর রাজি না হলে অপরের কোনাে প্রস্তাব থাকলে তাও বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে। তাই আমি বলি কি আজ প্রথম দিন থেকেই আমরা এক-একজন একটা করে গল্প বলি। বিকেল পর্যন্ত গল্প চলবে। গরম এমন কিছু বেশি নয়, ভালােই লাগবে। গল্প শেষ হলে তারপর অন্য কিছু করা যাবে। এবার বলাে” তােমরা কি করতে চাও।
প্যামপিনিয়ার প্রস্তাবে সকলে সানন্দে রাজি হলাে।
প্যামপিনিয়ার পাশেই বসেছিল প্যানফিলাে। প্যামপিনিয়াে তাকেই বলল, তাহলে তুমিই আরম্ভ করাে। প্যানফিলাে গল্প বলতে প্যানফিলাে যেন তৈরি হয়েই ছিল।
আমি সত্য ঘটনা অবলম্বনে পারিবারিক পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। যৌনতা সম্পর্কিত আরও বিষয় নিয়ে আলোচনা করব না লিখব।