স্বৈরিনী – গিয়ােভানি বােকাসিও

›› অনুবাদ  ›› সম্পুর্ণ গল্প  ›› ১৮+  

অনুবাদঃ অবনী সাহা
উৎসঃ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ আদি-রসের গল্প
সম্পাদনাঃ সুকান্ত সেনগুপ্ত

অবস্থা বিপাকে মানুষকে কত দুভোগই না পােহাতে হয়।

ফোরেন্সের কাউন্ট এক সময় ছিলেন যথেষ্ট ধনী। শরিকদের সঙ্গে মামলা-বিবাদে ক্রমে ক্রমে তাঁর অবস্থা পড়ে গেল। তখন স্ত্রী-পুত্র নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন ভাগ্য অন্বেষণে। নানা ঠাই ঘুরতে ঘুরতে প্যারিস। সেখানে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপ হওয়ায় কাউন্টের কপাল খুলে গেল। তার পার্টনার হয়ে নেমে পড়লেন আমদানীর কারবারে। বছর না ঘুরতেই কাউন্ট লাখপতি।

তবে তাঁর মনে সুখ নেই। কারণ একমাত্র সন্তান লােডোভিকো বড় খেয়ালি। লেখাপড়ায় মন নেই, বাপের ব্যবসার দিকেও নজর রাখে না। অগত্যা কি করা যায় ? ব্যবসায়ী বন্ধু পরামর্শ দিল, ওকে ছলছুতাে করে রাজবাড়ির কোন কাজে ঢুকিয়ে দাও। ওখানে থাকলে বুদ্ধি খুলবে, আদব কায়দা শিখবে, পাঁচটা গণ্যমান্য মানুষের সঙ্গেও আলাপ হবে।

যা ভাবা সেই কাজ। কাউন্ট তরুণ পুত্রকে রাজকুমারের সহচরদের দলে ভিড়িয়ে দিলেন। তােফা আনন্দে দিন কাটে। খাও দাও আড্ডা মারাে। একদিন নানাদেশের সুন্দরীর কথা উঠলাে। কোন দেশের মেয়ে কেমন সুন্দরী? প্রেমের খেলায় তারা কেমন খেলতে পারে? জোর তর্ক। ঠিক তখন সেই আড্ডায় যােগ দিল প্রাচ্য দেশ ঘুরে আসা কয়েকজন নাইট বা ধর্ম যােদ্ধা। কথায় কথায় তাদের মধ্যে একজন হঠাৎ লােডােভিকোর দিকে চেয়ে সাগ্রহে বললে—“যাই বলাে তােমরা, আমি ঢের ঢের রুপসী দেখেছি কিন্তু বােলগুনা শহরের তালুকদার ইগানাে ডে’ গালুজ্জির বউ মাদোনা বিয়েত্রিচের মত সুন্দরী মেয়ে এ পর্যন্ত আমার নজরে আসেনি। ঐ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে নাইটদের মধ্যে যারা তাকে দেখেছে তারা সবাই বললে সে রূপসী সত্যি অতুলনীয়।

ঐ কথায় নবযুবক লােডােভিকোর মনে কামনার আগুন জ্বলে উঠলাে। না জানি বিয়েত্রিচে কেমন রূপসী। একবার অন্ততঃ তাকে চোখের দেখাও দেখতে হবে। আর একবার চার চোখের মিলন হলে তাকে কিভাবে জয় করা যায় সে বিদ্যা লােডেভিকোর খানিকটা জানা আছে। ফরাসী রাজবাড়ি তাে গােপন প্রেমের লীলাক্ষেত্র !

কিন্তু কিভাবে বাবার কাছ থেকে বােলগুনাতে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যায় ? অনেক ভেবে লােডােভিকো গেল কাউন্টের কাছে। গিয়ে বলল, তীর্থ দর্শনের জন্যে তার মন বড় ব্যাকুল হয়েছে। তাই কিছুদিনের জন্যে সে স্বদেশে যেতে চায়। সেখানে সে বিভিন্ন ধর্মস্থান ঘুরে দেখবে। চার্চে ভর্তি হয়ে ধর্মশাস্ত্রও শিক্ষা করবে। কাউন্ট প্রথমটায় রাজি না হলেও অনেক ধরাধরির পর মত দিলেন।

লােডোভিকো যাত্রা করলাে বােলগনার পথে। কিন্তু আসল পরিচয়টা গােপন রাখা দরকার। তাই ধনী কাউন্টের ছেলে হল গরিব বেকার যুবক। তার নতুন নাম—আনিচিনো।

বােলগনায় পৌছানাের পরদিনই এক নৈশভােজ সভায় সেই রুপসীর দৈবাৎ দেখা পেয়ে গেল আনিচিনাে রুপী লােডােভিকো। তার কামনার আগুনে যেন ঘৃতাহুতি পড়লাে। যা শুনেছিল, আসলে তার থেকেও মাদকতাময় । ঐ বিয়েত্রিচেকে না পেলে লােডােভিকো বাঁচবে না। কিন্তু ঐ রুপসীর কাছে পৌছানাে যায় কিভাবে?

খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেল ইগানাে ডে গাজ্জির প্রাসাদ বাগিচায় বহু দাসদাসী কাজ করে। আর যেখানে সে আছে সেই সরাইখানার মালিকের সঙ্গে ইগানাের ভারী দোস্তি। তাকে জপিয়ে আনিচিনাে ইগানের অন্দর মহলে গৃহভৃত্যের একটা চাকরি জুটিয়ে নিল দু’চার দিনের মধ্যে।

ইগানাে নিজেও তরুণ ও সুপুরুষ; সে চায় ভৃত্যরাও খানিকটা তার মত হােক। তাহলে তাদের সঙ্গে নিয়ে ঘােরাফেরা করতে সঙ্কোচ হবে না। আনিচিনােকে দেখামাত্র তার পছন্দ হয়ে গেল। তাই এক কথায় পাকা হয়ে গেল তার চাকরি।

এখন কাজের ফাঁকে প্রায়ই মনিব গিন্নির সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। কিন্তু চতুর আনিচিনাে মনের কথা মুখে প্রকাশ করে না। বরং প্রাণপণে ইগনাের মন জুগিয়ে চলার চেষ্টা করে। দেখতে দেখতে সমস্ত ভৃত্যের মধ্যে আনিচিনাে হয়ে উঠলাে ইগানাের সব চেয়ে বিশ্বাসভাজন।

একদিন ইগানাে বেশ কয়েকজন ভৃত্যকে সঙ্গে নিয়ে গেছে শিকার করতে। বাজপাখি আর কুকুরের সাহায্যে শিকার করার নেশা ছিল তার প্রবল। বাড়িতে সেদিন আর কেউ নেই। শুধু আনিচিননা আর বিয়েত্রিচে। ইগানােই বিয়েত্রিচের ফাই ফরমাস খাটার জন্য সবচেয়ে দক্ষ ভৃত্য আনিচিনােকে রেখে গিয়েছিল। আর বলা বাহুল্য বিয়েত্রিচেও জানতাে না ভৃত্যরুপী ঐ যুবকের আসল মতলবটা কি! সে তাই সময় কাটানাের জন্যে আনিচিনােকে দাবার বাের্ড নিয়ে তার ঘরে আসতে বললো।

শুরু হল দাবা খেলা। চতুর আনিচিনাে ইচ্ছে করে এমন চাল দিতে লাগলাে যাতে বিয়েত্রিচে সহজে কিস্তি মাৎ করতে পারে! আর খেলায় জিততে পারলে কার না আনন্দ হয়।

একদান জেতার পর খুসিতে ডগমগ মনিব-গিন্নি যখন আবার দাবার গুটি সাজাচ্ছে তখন তার হঠাৎ নজর পড়লাে সামনে বসে থাকে আনিচিনাের মুখের দিকে। ভারী বিমর্ষ দেখাচ্ছে পরাজিত ভৃত্যটিকে। বিয়েত্রিচে তার পানে তাকানো মাত্র সাড়ম্বরে আনিচিনাে ফেলল এক দীর্ঘ নিশ্বাস !

—“কি ব্যাপার আনিচিনো, হেরে যাওয়ায় সত্যি কি তুমি খুব ব্যথা পেয়েছো? বিস্মিত বিয়েত্রিচে জানতে চাইলেন নরম গলায়।
—না, গিন্নিমা, তার থেকেও ঢের বেশি বেদনাদায়ক একটা কথা ভেবেই আমার এই দীর্ঘ নিশ্বাস। একান্ত নিরীহ ভঙ্গিতে জবাব দিল আনিচিনে।
-তাই নাকি? তা আমি তাে কোন ভাবে তােমার সেই দুঃখ দূর করতে পারি, আমাকে বলাে না কেন? সত্যি কথা বলতে কি, তােমার কাজকর্মে আমি খুসি”

-তােমাকে যথেষ্ট স্নেহও করি।••••••
স্নেহ? তার থেকে প্রেমের দুর আর কতটুকু? ভরসা পেয়ে আনিচিনে আরও লম্বা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো। বিয়েত্রিচের দরদ তাতে উথলে উঠলো -সে সব কথা খুলে বলতে আবার অনুরােধ জানালাে।

-মাই লেডি’ আনিচিনাে সুযোেগ বুঝে বলতে শুরু করলাে – ‘ভয় হচ্ছে আমার দীর্ঘ নিশ্বাসের কারণ জানতে পারলে আপনি হয়তাে দারুণ বিরক্ত হবেন, কিবা যা বলব তা শােনামাত্র মনিবকে জানিয়ে দেবেন।
-তােমাকে কথা দিচ্ছি—বিয়েত্রিচে আশ্বাস দিল—তুমি যা বলবে তাতে বিরক্ত হব না আর তােমার সম্মতি ছাড়া কাউকে বলবও না।
অতঃপর আনিচিনো সাবধানে শুরু করলাে

-“যখন আশ্বাস দিয়েছেন তখন খুলেই বলি মনের কথা, দয়া করে অপরাধ নেবেন না।
এই ভণিতার পর অশ্রু সজল চোখে আনিচিনাে একে একে খুলে বলল সব কিছু। জানালাে তার আসল পরিচয়, কত কষ্ট করে সেরা সুন্দরী বিয়েত্রিচেকে শুধু একবার চোখের দেখা দেখবার  জন্যে সে প্যারিস থেকে ছুটে এসেছে, তার রুপ কিভাবে তাকে পাগল করে তুলেছে, কেমন ভাবে চাকরের কাজে অতি কষ্টে এই প্রাসাদে দিন কাটাচ্ছে। সে কাহিনী বলতে বলতে তার গলা বজে এলাে।

সব কথা শোনার পর কি বিয়েত্রিচে দয়া করবে না? আনিচিনাের বুকের মধ্যে যে কামনার আগুন জলছে তা নেবাতে সাহায্য করবে না? নির্জন ঘর। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। সামনে নতজানু, আনিচিনো। তার কণ্ঠে অন্তর আকুল করা মিনতি। সুন্দরী, বিয়েত্রিচের মনটাও টলে উঠলাে। সুদুর প্যারিস থেকে ছুটে এসেছে ধনী পিতার একমাত্র সন্তান। প্রেমের জন্যে দাসখৎ লিখে দিতে চায় তার পায়ে। তার কান্না আর মিনতিতে কোন রুপসী স্থির থাকতে পারে? বিয়েত্রিচে মােহিনীচোখ তুলে চাইলো আনিচিনাের মুখের দিকে। না, তার আকুলতার মধ্যে ভান ছলনা নেই। সত্যি এ যুবক তার রুপে মাতােয়ারা। তাই তার পীন পয়োধর যুগল কাঁপিয়ে বেরিয়ে এল ছােট্ট এক দীর্ঘ নিশ্বাস। চোখ ভরা জল নিয়ে সে চাপা গলায় বললাে-লক্ষীসােনা আমার, ভেঙে পােড়ােনা, তােমাকে নিরাশ করবাে না ; তবে তােমার আগে অনেক প্রেমিক আমাকে নানা ভাবে প্রেম নিবেদন করেছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের কারও ডাকে আমার সতীত্ত খােয়াই নি ; মিষ্টি কথা, নানা প্রতিশ্রুতি বা উপহার কিছুই আমার মন টলাতে পারেনি। তারা কেউ ধনী ব্যবসায়ী, কেউ অভিজাত কাউন্ট, সবাই তারা সুপুরুষ। কিন্তু তােমার মিনতি মাখা কয়েকটা কথায় আজ আমার মত বদলে গেছে। বুঝতে পারছি তােমার প্রেমে খাদ নেই, তা খাঁটি সােনা। তাই প্রিয় আমার, আজ রাতেই মিলবে তােমার সুযোেগ, কথা দিচ্ছি এ দেহ-মন হবে তােমার। ঠিক মাঝরাতে যাতে তুমি আমার শােবার ঘরে ঢুকতে পারো তার জন্য আমি দরজার আগল খুলে রাখবাে। তুমি জানো বিছানার কোন পাশে আমি শুয়ে থাকি। নিঃশব্দে দরজা খুলে অন্ধকারে ঠিক সেই জায়গায় চলে আসবে। যদি ঘুমিয়ে পড়ি তবে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দেবে, তখন এতদিন ধরে যা চেয়ে এসেছো তা সব পাবে। আর আমি যা বলছি তার প্রমাণ হিসেবে এই মুহুর্তে একটা পুরষ্কার তােমাকে দেবাে’—কথা বলতে বলতে বিয়েত্রিচে উঠে দাঁড়ালাে আর উদভ্রান্ত আনিচিনােকে দুহাতে বুকে টেনে নিয়ে তার ঠোঁটে একে দিল এক আতপ্ত চুম্বন।

ঠিক তখনই জানালার বাইরে শােনা গেল তূর্য ধ্বনি; অর্থাৎ গৃহকর্তা শিকার সেরে স্ব-পারিষদ বাড়ি ফিরে আসছেন। তাই ঝটিতি প্রেয়সীর বাহুপাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করে আনিচিনাে ছুটল মনিবকে অভ্যর্থনা জানাতে। কিন্তু তার বুকে লেগে রইল বিয়েত্রিচের উষ্ণ আলিঙ্গনের সৌরভ ; আর মন ভরে রইল নিদাঘ রজনীর সুখ স্বপ্নে। কাজে আর মন বসে না, সারাক্ষণ খালি মনে হয় কখন আসবে মধ্যরাত্রি, মিলনের শুভক্ষণ !

আর এদিকে সারাদিন শিকার খেলা আর উদ্দাম পান ভােজনে ইগনােও ক্লান্ত। হাত-মুখ ধুয়ে, কোনমতে রাতের খাওয়া সেরে সে চলে গেল শয়নঘরে। তাকে অনুসরণ করলো বিয়েত্রিচে। ঘরে ঢুকে যথারীতি দরজা বন্ধ করলো, কিন্তু আগল টানলো না। পতিব্রতা স্ত্রীর মত দেওয়ালে টাঙানাে মশাল নিবিয়ে শুয়ে পড়লাে তন্দ্রাচ্ছন্ন স্বামীর বাঁ পাশে। ঘরজোড়া বিরাট পালঙ্কে একধারে ইগানাে, অন্য পাশে বিয়েত্রিচে। একজন নিশ্চিন্ত নিদ্রার কোলে, অন্যজন অপেক্ষা করে আছে এক অতিথির…।

আনিচিনাের চোখেও ঘুম নেই। চাকরদের মহল্লায় নিজের ঘরে উত্তেজনায় সে ছটফট করছে। অবশেষে পথিক গীর্জার পেটা ঘড়িতে ঢং ঢং করে বাজলাে রাত বারােটা। পা টিপে টিপে আনিচিনাে রওনা দিল তখনই। অবশেষে বিয়েত্রিচের শয়নগৃহ! দরজায় চাপ দিতেই সেটা খুলে গেল। যাক তার প্রিয়তমা কথা রেখেছে।

কিন্তু ঘরের মধ্যে গাঢ় অন্ধকার, কিছুই ঠাহর হয় না। তবে ঐ ঘরের কোথায় কি আছে তা ভৃত্য আনিচিনাের নখদর্পণে। তাই পা টিপে টিপে সে হাজির হলাে পালকের বা ধারে। তার আগে বন্ধ দরজার আগলটা টেনে দিতে ভুললাে না।

যথাস্থানেই শুয়েছিল বিয়েত্রিচে। আনিচিনাে আলতােভাবে হাত রাখলে তার বুকে। হাত রাখা মাত্র কিন্তু তার প্রভুপত্নী যে ব্যবহার করলে তাতে ঘাবড়ে গেল আনিচিনাে। বিয়েবিচে সবলে চেপে ধরলাে আনিচিনাের কব্জি।

সে বেচারা ছাড়ানাের শত চেষ্টা করেও ঐ লৌহ মুষ্টি ছাড়াতে পারলাে না। সর্বনাশ! এইবার নিশ্চয়ই হাঁক ডাক করে বিয়েত্রিচে তার স্বামীকে জাগিয়ে তুলবে। আনিচিনো তার প্রেমিকার ঐ ব্যবহারের কোনাে কুল কিনারা পেলাে না।

এদিকে একজন খাটের ওপর দুহাতে চেপে ধরে আছে কব্জি। আর অন্যজন মেঝেতে বসে চেষ্টা করছে কোনাে মতে নিজেকে মুক্ত করতে। বলতে কি আনিচিনাে ছিল হামাগুড়ি দেবার ভঙ্গিতে। আর বিয়েত্রিচে বিছানায় অর্থ শায়িতা। উভয়ের ধস্তাধস্তিতে ইগানাের ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম জড়ানাে চোখে সে জানতে চাইলাে-এত ছটফট করছ কেন প্রিয়তমা ? বিয়েত্রিচে তখনও আনিচিনাের হাত ছাড়েনি। সেই অবস্থাতেই সােহাগ ভরা গলায় সে বললাে-“ওগাে, আজ সন্ধ্যেবেলা তােমার ক্লান্ত চেহারাটা দেখে এমন মায়া লাগলাে যে কথাটা বলি বলি করেও শেষ পর্যন্ত বলতে পারিনি। অথচ না বলেও শান্তি নেই। কিছুতেই ঘুম আসছে না চোখে
-“কি এমন কথা?’-বিরক্তির সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাে ইগানো।
-কথা তেমন কিছু নয়। তবে জবাবটা আমার জানা দরকার। আচ্ছা বলত তােমার খানসামাদের মধ্যে কার কাজকর্মে তুমি সবচেয়ে সন্তুষ্ট? তােমার মতে কে সবচেয়ে প্রভুভক্ত ?
বিয়েত্রিচের এই প্রশ্নের জবাব দিতে একটুও দেরী করল না ইগানাে৷

-“ও এই ব্যাপার। জবাবটাতে তােমার জানাই আছে সােনা। অনেকবারই বলেছি তােমাকে। নতুন ভর্তি হওয়া আনিচিনােকেই আমি সবচেয়ে পছন্দ করি। তাই তাে তােমাকে রেখে যাই তার পাহারায়। কিন্তু মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে ঐ প্রশ্নটা করছ কেন…

ব্যঙ্গের হাসি হাসল মােহিনী বিয়েত্রিচে। তখন তার বজ্রমুষ্টিতে ধরা পড়া আনিচিনাে ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে। তার কব্জিতে আরও জোর চাপ দিয়ে বিয়েত্রিচে বললে—সেই আনিচিনাের কীর্তি-কাহিনী একটু শােনাতে চাই তােমাকে। তুমি শুনলে অবাক হবে। কাল সদলে তুমি শিকারে বেরিয়ে যাবার পর সেই ছােকরা এসেছিল আমার কাছে প্রেম নিবেদন করতে। সে ব্যাটা বলে কিনা আমাকে না পেলে সে নাকি বাঁচবে না। আমার যে কি ভয় করছিল তা তােমায় কি বলব। চালাকির সাহায্যে কোনাে মতে সেই পশুটার হাত থেকে নিজের ইজ্জত বাঁচাতে পেরেছি। তাকে কথা দিয়েছি আজ রাতে আমি তার সঙ্গে গােপনে মিলিত হব। রাত বারােটা বাজার পর একটা কালো শাল মুড়ি দিয়ে চুপি চুপি যাবে ফলবাগানে ! ওর জন্যে অপেক্ষা করবাে পাইনগাছটার নীচে। বুঝতেই পারছো ঐ সময় মিথ্যে প্রতিশ্রুতি না দিলে ঐ জন্তুটার হাত থেকে আমার দেহটা বাঁচাতে পারতাম না। কিন্তু আর নয়। ঐ অকৃতজ্ঞ ছােকরাকে উচিত শিক্ষা দেয়া দরকার। তাই বলি কি, আমার শালটা জড়িয়ে তুমি এখনই যাও ফলবাগানে। তারপর আনিচিনাে কাছে আসা মাত্র তাকে গ্রেপ্তার কোরাে হাতেনাতে। আমার স্কার্ট, ভেল, শাল, সবকিছু খুলে রেখেছি তোমার মাথার কাছে। ওগুলাে চটপট পরে নাও লক্ষীটি। তারপর নাও উচিত প্রতিশােধ…’।

বিয়েত্রিচের কথাগুলাে যেন চাবুকের কাজ করলো। ঘুম উঠলাে মাথায়। রাগে কাঁপতে কাপতে উঠে বসলাে ইগাননা।

পালঙ্ক থেকে সে নেমে পড়লাে তখনই। ডানধার দিয়ে নামায় আনিচিনাের সঙ্গে তার মােলাকাৎ হােল না। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সে পােষাক ও চাদরটা পেয়ে গেল। সেগুলাে দ্রুত পরে নিয়ে বিয়েত্রিচের কপালে একটা চুমু খেয়ে সে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

স্বামী বেরিয়ে যাওয়া মাত্র তড়াক করে উঠে বসলাে বিয়েত্রিচে। আনিচিনাের হাত ছেড়ে সে ছুটে গেল দরজার কাছে। সেটা বন্ধ করে আগলটা টেনে দিল আস্তে আস্তে।

এতক্ষণ যেন দম বন্ধ করে নাটক দেখছিল আনিচিননা। জীবনে এমন ভয় সে আর কখনাে পায়নি। এতক্ষণ মনে মনে কত না অভিশাপ দিয়েছে ঐ নিষ্ঠূর সুন্দরীকে। কিন্তু এইবার সে খানিকটা বুঝতে পারলাে স্বৈরিণী বিয়েত্রিচের মতিগতি। স্বামীকে ঘর থেকে তাড়ানাের চমৎকার ফন্দী এটেছে তার প্রিয়তম—এমন ফন্দী যার তারিফ না করে পারা যায় না!

এ যেন বহারম্ভে লঘু, ক্রিয়া। কিন্তু তবু এখানেই শেষ নয়—সবে শুরু!

বিছানার কাছে ফিরে বিয়েত্রিচে জড়িয়ে ধরলে হতভম্ব আনিচিনােকে। তারপর অঙ্গ থেকে খুলে ফেলল রাতের পােষাক। আনিচিনােও অনুসরণ করলাে তাকে। বিপরীত বিহারের খেলায় মেতে উঠলো দুজনে। পরম তৃপ্তি দায়ী ক্লান্তিতে যখন আনিচিনাে এলিয়ে পড়েছে তখন বিয়েত্রিচে তাকে তাড়াতাড়ি পােষাক পরে বিদায় নিতে বলল। অনিচ্ছা সত্তেও বিদায় নিতে হবে এবার। কারণ মালিক যে কোন মুহর্তে ফিরে আসতে পারেন। ঠিক তখনই বিয়েত্রিচে মধুর কণ্ঠে জানানাে-লক্ষীসােনা আমার, দেরাজের পেছনে একটা মােটা লাঠি রাখা আছে, ওটা নিয়ে এখনই বাগানে যাও। সেখানে ইগানােকে দেখা মাত্র ভান করবে যেন তার মানে আমার এই ব্যবহারে তুমি খুবই বিরক্ত হয়েছো। আমার সতীত্ব পরখ করার জন্যই তুমি ইচ্ছে করে ঐ কুপ্রস্তাব দিয়েছিলে। তুমি ভাবতেও পারনি ইগানাের মত দেবতুল্য স্বামী থাকতে কোনাে নারী বাড়ীর চাকরের জন্য এইভাবে গােপন অভিসার করবে। আচ্ছা রকম গালিগালাজ করতে করতে ইগনােকে এই লাঠি দিয়ে পিটাবে তারপর। এরপর সে প্রাণের দায়ে আত্মপরিচয় দিলে তখন না হয় তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিও।

বিয়েত্রিচের যে কতটা দুষ্ট বুদ্ধি তার আর এক তরফা পরিচয় পেয়ে আনিচিনাে অবাক হয়ে গেল। কথামত সে ছুটলাে বাগানের সেই পাইন গাছটার দিকে। সেখানে বিয়েত্রিচের পােষাক পরে অন্ধকারে অধীরভাবে অপেক্ষা করছিল ইগানো। আনিচিনােকে আসতে দেখে সে উঠে দাঁড়ালাে। আর আনিচিনাে তাকে কোন রকম কথা বলার সুযোেগ না দিয়েই ব্যঙ্গের সুরে বলে উঠলো—“তবে সত্যিই সতী লক্ষীর আসা হয়েছে। হারামজাদী মাগী, এই তাের পতি ভক্তি! তাের স্বামী এত বিস্বাস করে তােকে আর তুই কিনা তার প্রতিদানে তারই চাকরের কাছে ছুটে এসেছিস। নরকেও তাের ঠাঁই হবে না। তাের জন্যে আমি এনেছি এই লাঠি, এটা দিয়েই আমার সােহাগ জানাবাে।

ক্ষিপ্ত আনিচিনাের হাতে মােটা লাঠি দেখে ইগানাে প্রমাদ গুনলাে। সে তখনই ছুটে পালালাে সেখান থেকে। আনিচিনােও তাড়া করলো সঙ্গে সঙ্গে। চিৎকার করে বলতে থাকলো—’কাল সকালেই আমি সব কথা বলে দোবাে আমার মনিব ইগনােকে। তখন ঝাঁটা মেরে তিনি বিদায় করবেন তােকে। বলতে বলতে দুচার ঘা লাঠির বাড়িও বসিয়ে দিল কর্তার পিঠে। সেযাত্রা নিজের শয়নকক্ষে ঢুকে কোনাে মতে প্রাণ বাঁচালাে ইগানাে। ঢোকা মাত্র বিয়েত্রিচে আনিচিনাের কথা জিজ্ঞেস করলাে। ইগানাে হাঁফাতে হাঁফাতে বললে—“কি কুক্ষণেই যে তার সঙ্গে বাগানে দেখা হয়েছিল, তা ভগবানই জানেন। সে আমাকে তুমি বলেই ধরে নেয়। তারপর এই গােপন অভিসারের জন্যে যাচ্ছে তাই ভাবে গালি গালাজ করলাে। সে নাকি তােমার সতীত্ব পরীক্ষার জন্যে এমন একটা প্রস্তাব দিয়েছিল। সত্যি, আনিচিনাের অনুগত্য আর বুদ্ধি দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি। ভাবছি আমার মতন ভাগ্যবান আর কে আছে। ঘরে তােমার মত রপসী সতী লক্ষী স্ত্রী, আর আনিচিনাের মত প্রভুভক্ত ভৃত্য। এখন থেকে নিশ্চিন্তভাবে তার হাতে তােমাকে ছেড়ে দিয়ে আমি দুর দেশেও যেতে পারবাে। তুমি কি বলো ?
মােহিনী বিয়েত্রিচে পাশ ফিরে শুয়ে মুচকি হাসলাে। কোন জবাব দিল না।

Leave a Reply