………ঈভ্ -এর মডেলের গল্প বলি এবার। কীভাবে এই ভাস্কর্যের অনুপ্রেরণা পেলেন উনি। ঈভ-এর মডেল মারী-রােজ ব্যুরে নয়, লীজা।
……অগুস্ত দেখে লােকটা এবার একা আসেনি। তার সঙ্গে একটি যুবতী। বছর চব্বিশপঁচিশ। স্বাস্থ্য ভালাে। অগুস্ত জানতে চায়, ও কে ? তােমার বউ
-না না মেৎত্র। বউ হবে কেন ? ও লীজা ; সম্পর্কে আমার বােন হয়। ও ব্রোম থেকে চলে এসেছে রুজি-রােজগারের ধান্দায়।
অগুস্ত জানালাে, পাপিনােকে মডেল করে কিছু বানানাের বাসনা তার আপাতত নেই। কিন্তু লীজা রাজি হলে তাকে মডেল করে সে কিছু গড়তে পারে। লীজা এতক্ষণে আলােচনায় অংশ নেয়, বলে, কত করে মজুরী দেবেন, বাবু ?
দৈনিক পাঁচ ফ্রা। যা সবাইকে দিই। -কী বানাবেন আমাকে নিয়ে ? -তা এখনই কেমন করে কবুল করি ? আর তা নিয়ে তােমার কেন মাথাব্যথা ?
আমি জানতে চাইছি, আমাকে কি ‘ইয়ে’ হতে হবে ? -হ্যা হবে। ইয়ে না হলে পয়সা দিয়ে মডেল পুষব কেন ?
লীজা মাথা ঝাঁকায়, তাহলে পাঁচ ফ্রাঁয় হবে না। কাপড় জামা খুলতে হলে দশ ফ্রাঁ দৈনিক চাই।
অগুস্ত বলে, তাহলে পথ দেখ বাছা। এখানে সুবিধা হবে না।
অনেক দরাদরির পর দৈনিক সাত ফ্রাঁতে লীজা রাজি হল। তাও শর্তসাপেক্ষে। প্রথম শর্ত, মজুরি তাকে দৈনিক মিটিয়ে দিতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত, সে যখন বিবস্ত্র অবস্থায় মডেল স্ট্যান্ডে উঠে দাঁড়াবে তখন স্টুডিওতে অন্য কোনও পুরুষমানুষকে ঢুকতে দেওয়া চলবে না।
অগুস্ত বলে, অচেনা-অজানা কেউ আসবে না, কিন্তু পাপিনােকে আমার দরকার হতে পারে। হয়তাে একই সঙ্গে তারও কোন মূর্তি গড়ব আমি।
প্রচণ্ড প্রতিবাদ করে লীজা, না না, সে কিছুতেই হবে না। ও আমার দাদা।
পাপিনােও হাঁ-হাঁ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে, এটা কী বলছেন মেৎত্র ? লীজা আমার ছােট বােন, সে যখন ইয়ে’ হয়ে স্টুডিওতে…ছি ছি ! তা হতেই পারে না।
অগত্যা তাই স্থির হল।
প্রথম দিন-সাতেক অগুস্ত মনস্থির করতে পারছিল না—সে কী গড়বে। বিবস্ত্রা অবস্থায় লীজাকে ক্রমাগত পদচারণা করতে হয়েছে, আর ও দূর থেকে স্কেচ করে গেছে। সামনে থেকে, পাশ থেকে, পিছন থেকে। লীজা বারবার জানতে চেয়েছে—কেন মূর্তি গড়ার কাজে হাত দিচ্ছে না ভাস্কর। অগুস্ত ধমকে দিয়েছে, তাতে তােমার কোন পাকাধানে মই দেওয়া হচ্ছে ? মজুরি তাে তুমি পাচ্ছই ।
তা পাচ্ছে। পাপিনাে ওকে পৌছে দিয়ে যায়। আবার দিনান্তে এসে বােনকে বাড়ি নিয়ে যায়, টাকা গুনে নিয়ে।
তারপর একদিন। অগুস্ত-এর আদেশে লীজা উঠে দাঁড়িয়েছে মডেল-স্ট্যান্ডে। অগুস্ত তার অভ্যস্ত ‘অন্ধের হস্তিদর্শনের ভঙ্গিমায় এগিয়ে আসে। এটা ওর এক বিচিত্র বৈশিষ্ট্য। ওর ধারণা—শুধু চোখে দেখে কোনও ত্রিমাত্রিক বস্তুর অন্তর্লীন স্বরূপ সে উপলব্ধি করতে পারে না। চোখে দেখার পর সে দু-হাতের দশটি আঙুলে চোখ বুজে মডেলের শরীরের তরঙ্গভঙ্গ উপলব্ধি করে। মডেলের দেহের উত্তাপ আঙুলে লেগে থাকতে থাকতে সে কাদামাটিকে রূপান্তরিত করে। আঙুল দিয়ে যখন সে দেখে তখন তার চোখ দুটি বন্ধ থাকে। সে ভাবেই সে সমঝে নিতে গেল লীজার দেহের কন্টুর—যৌবনতরঙ্গ। লীজা প্রথমটা আপত্তি করেছিল। পরে ধমক খেয়ে চুপ করল। নিমীলিত নেত্রে ভাস্কর স্থাপন করল তার দুহাত ওর মাথায়। নেমে এল কাঁধ বেয়ে বাহুমূলে, ক্রমে আঙুলের ডগায়। তারপর কণ্ঠদেশ থেকে স্তনাগ্রচূড়ায় । লীজা একটু উশখুশ করল, কিন্তু আপত্তি করল না আর। এবার বক্ষদেশ থেকে দশটি আঙুল নামতে নামতে এল ওর তলপেটে । এসেই থমকে গেল। শিউরে উঠল লীজা। এবং অগুস্ত । এক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, এ কী! এ কথা বলনি কেন ?
-কী কথা ? দৃষ্টি যা বােঝেনি এতদিন, শিল্পীর আঙুল তা বুঝে ফেলেছে।
বলে, ক মাস ? লীজা নিরুত্তর। লজ্জায় যেন মাটিতে মিশে যেতে চায়। —তুমি যে মা হতে চলেছ সেকথা বলনি কেন ? লীজা সহসা দুটি হাতে আবৃত করে তার স্তনদ্বয়।
-পেটে যেটা এসেছে তার বাপু কে ? পাপিনাে ?
লীজা শিউরে ওঠে। জবাব দিতে পারে না। মাথাটা আরও নেমে আসে। বাঁ-হাতটা তুলে যেন বলতে চাইল : ছি ছি। ও কথা বল না।
আর সেই খণ্ড মুহর্তেই শিল্পী খুঁজে পেল তার বিষয়বস্তু : ঈভ’। বললে, তুমি না বলেছিলে, ও তােমার দাদা ?
-কাজিন।
-তােমাকে এতদিন যে মজুরী দিয়েছি তা ফেরত দিতে হবে ! তােমাকে নিয়ে কী গড়ব আমি ?………
…….THE KIss (1888):চুম্বন-প্রথমেই উল্লেখ্য, এ ভাস্কর্য নরকের দ্বার’-এর অঙ্গীভূত। সম্ভবত পাওলাে ও সেকার অবৈধ প্রণয়-এর বিষয়বস্তু এবং তাই এর স্থান নরকের দ্বার-এ। অথচ এ মিথুনমূর্তিতে যে ভাবের ব্যঞ্জনা তাতে নরক নিঃশেষে মুছে গেছে। পরিবর্তে আমরা পেলাম একটি স্বর্গীয় মিথুন। ভুবনেশ্বর, পুরী, খাজুরাহাে, কোণার্কের মৈথুনরত মিথুনের সঙ্গে এর প্রভেদ যেটুকু শিল্প-শৈলীতে, রসের বিচারে নয়।
লক্ষণীয়, প্রকৃতি এখানে যেন অধিক পরিমাণে অগ্রসর, পুরুষ কিছুটা নিষ্ক্রিয় ; নায়িকার আশ্লেষ শয়না ভঙ্গিমায় যতটা ভাবাবেগ পুরুষের যেন ততটা নেই। আমরা, শক্তিভাবনায় জারিত দর্শকেরা, বলব : তাই তাে হবে। দেখছ না, প্রকৃতির বাম পদপল্লবটি পুরুষের দক্ষিণ চরণের উপর ন্যস্ত । বিপরীত রত্যাতুরার এই শক্তি ব্যঞ্জনাটি শিল্পী এক তির্যক ইঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলেছেন।……….
THE ETERNAL IDOL (1849) : শাশ্বত রাদিনী -Venus Coclestis ! অপার্থিব , ভেনাস : পূর্ববর্তী নারীমূর্তি দুটির এ যেন বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। এর মুখে এক স্বর্গীয় দ্যোতনা। অপাপবিদ্ধ নিকশিত হেম। সে বরদা, রাদিনী শক্তির মূর্ত প্রতীক। পুরুষ তাকে সৌন্দর্যের পাদপীঠে বসিয়ে পূজা করতে চায়। দেহজ কাম অপসৃত ; তাই পুরুষের হাত নারীকে বেষ্টন করেনি, তাই ওর মাথা স্তনাচুড়ার নিচে।
প্রকৃতির দক্ষিণ হস্ত ও মস্তক আলম্ব, ঋজু ভঙ্গিমায় যেন নিবাত নিষ্কম্প দীপশিখা। যদিও পুরুষের গুরুভারে কাঁধ থেকে জানু পুরুষমূর্তির বঙ্কিম ভঙ্গিমার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করেছে। অপরপক্ষে নায়ক কায়মনােবাক্যে পতনােন্মুখ ওক গাছের মতাে । সৌন্দর্য দেবীর পাদপীঠে আশ্রয় খুঁজছে। ভারতীয় নিরিখে নায়িকার দক্ষিণ হস্তে ভূমিস্পর্শমুদ্রা, বাম হস্ত : বৱদা! উর্ধাঙ্গে প্রকৃতি ঋজু, পুরুষের সাপাের্ট, নিম্নাঙ্গে সে পুরুষের সঙ্গে ঐকতানে একটি বঙ্কিম সরলরেখায় একা।……….
ডাফনি ও লাইসিনিয়
……..দুটি চরিত্রই স্ত্রীলােকের। নিচে বাধাদানকারী মূর্তিটি নিঃসন্দেহে নারীর-সনক্তিকরণের বক্ষ প্রত্যক্ষদ্বয় অবশ্য দু হাতে ঢাকা পড়েছে ; কিন্তু তার পেলব দেহাবয়ব একটি যুবতীর, বলা যায় প্রায়-কিশােরীর। অপূর্ব লাবণ্যময়ী, অসহায় সে। অপরপক্ষে উপরের ফিগারটির দেহসৌষ্ঠব পুরুষালি ; কিন্তু তার দক্ষিণস্তন সন্দেহাতীতভাবে বলে দেয় সে একজন ‘আমেজন’। পুরুষভাবাপন্ন বলিষ্ঠগঠনা নারী। কী বক্তব্য শিল্পীর ?
কলকাতা ও দিল্লি প্রদর্শনীতে এই এক্সিবিট-এর ক্রমিক সংখ্যা ছিল সত্তর। উভয় ক্যাটালগেই ব্যাখ্যা হিসাবে যা বলা হয়েছে তার আক্ষরিক অনুবাদ “—এ ভাস্কর্যে দেখা যাচ্ছে আলিঙ্গনবদ্ধ দুটি রমণীকে; এটি লাস-বিরচিত একটি প্রখ্যাত লােকগাথা অনুসরণ নির্মিত। সেই কাহিনীতে মূল চরিত্রের একজন ছিল পুরুষ। মিথুন ভাস্কর্যগুলি নির্মাণকালে মূর্তির যৌনাঙ্গ বিষয়ে রোদ্যা কী-পরিমাণ অন্যমনস্ক হয়ে পড়তেন এ ভাস্কর্য তারই একটি দলিল।”………তাঁর কোনও শিষ্যেরও নজরে পড়ল না ? তাহলে তার কোন শিষ্য নে কখনও বলল , ‘মেত্র ! আপনি ভুলে পুরুষের টরসােতে নারীস্তন গড়েছেন !………
……….আর তাই আমরা রােদ্যার শিল্পে দেখছি অরফিউস একটি ধর্মিতা রমণী—প্রায় কিশােরী বিনতিতে সে বাড়িয়ে দিয়েছে হাত প্রতিবর্তী প্রেরণায়। উপরের গ্রুেশীয় রমণী প্রায় পুরুষ “আমেজন। তার প্রকাশমান স্তন সত্ত্বেও সে মূর্তিতে একটা পুরুষজনােচিত কাঠিন্য !………..
ফুজিতামাের
বন্ধুবর ক্ষুব্ধকণ্ঠে বলেছিলেন, এমন ‘কিস্তৃত মিথুন আমি জীবনে দেখিনি—কী ভারতে, কী পাশ্চাত্যে! নারী নিচে, উপুড় হয়ে শুয়েছে, পুরুষ তার উপর চিৎ হয়ে। ‘অ্যাবসার্ড কম্পােজিশান’।
রোদ্যার কিছু বিতর্কিত ভাস্কর্য
…………মেলার নাম কুম্ভমেলা’ নয় ‘মহামােক্ষপরিষদ। গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর সঙ্গম যে বহু পূর্বযুগ থেকেই একটি স্বীকৃত তীর্থস্থান, এর বহু প্রমাণ আছে। ধরুন মহাভারত।
শরশয্যায় শেষশয়নে শায়িত ভীষ্মকে ঋষি পুলস্ত ভারতভূখণ্ডের যাবতীয় তীর্থের কথা বলছেন। তাতে ‘কুম্ভমেলা’র উল্লেখ নেই। বলা হয়েছে প্রয়াগের সঙ্গমস্থলে স্নান করলে কুলগৈব সমূদূরয়েৎ’সপরিবারে মুক্তিলাভ হয়।…….