সৃজন – অপরাজিতা সরকার

›› সম্পুর্ণ গল্প  

অফিসের নোটপ্যাডে সাইন করতে গিয়ে হঠাৎই তারিখটা দেখে চমকে উঠলাম। সারা শরীরে কেমন যেন হাল্কা এক শিহরন জেগে উঠল। মনে | পড়ে গেল কলেজ স্কোয়ারের সেই বৃষ্টিভেজা সন্ধেটার কথা, একজন যুবতীকে একজন যুবকের প্রেম নিবেদন…..
আলো অন্ধকারের আবডালে নিয়ে গিয়ে উত্তপ্ত ঠোঁটের স্পর্শে হাতের উপর হাত রেখে – তুই আমার হবি? শুধুই আমার? সেই আবদার, সেই স্পর্শ এখনও আমার ঠোঁটের কোনায় কোনায় লেগে আছে। সারাটাদিন অফিসের কর্মব্যস্ততার মধ্যেও পুরনো স্মৃতিগুলো কেমন যেন জাপটে ধরতে চাইছে।
কলেজের প্রথমদিন,ফর্ম ফিলাপের লাইনে প্রথম আলাপ, বন্ধুত্বের মিষ্টি সম্পর্ক, তারপরেই সেরা প্রেমিক প্রেমিকার তকমা কলেজস্ট্রীট জুড়ে সমস্ত বইয়ের পাতায় ছড়িয়ে পড়ল। ক্রমশ চেনা হতে লাগলো একে অপরের শরীরের গন্ধ, প্রায়শই মেতে উঠতাম মনুষ্যজীবন সৃষ্টির আদিমতম লীলাখেলায়। শরীরের উপর শরীর, হাতের উপর হাত ….
বাড়ি পৌঁছলাম, রান্না করতে ভালো লাগছে না। তাই ফ্রিজে যা খাবার আছে তা আমাদের তিনজনের হয়ে যাবে। বাথরুমে ঢুকে সম্পূর্ণ আলগা শরীরে শাওয়ারের প্রতিটি ফোটা উপভোগ করতে লাগলাম। ফিরে এলো যেন সেই একই স্পর্শ। বেড়িয়ে এসে ওর লেখা কবিতার বইটা নিয়ে জানলার কাছে দাঁড়ালাম। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আমায় এসে জড়িয়ে ধরল। স্মৃতির পাতায় ডুব দিতেই মন খুঁজে নিল সেই চরম তৃপ্তিদায়ক দিনটির কথা – কলেজ শেষ হওয়ার পাঁচ বছর পর, ওর বাড়িতে একদিন দুপুরে ঘটে গিয়েছিল দুটি শরীরের এক হয়ে যাওয়ার ঘটনা। অগ্ন্যুৎপাতের পর আগ্নেয়গিরি যেমন নিস্তব্ধ, শান্ত হয়ে যায়, তেমনই আমাদের শরীরও নিথর হয়ে পড়ে আছে। তবে সেদিন আমি বুঝেছিলাম মিলনের জ্বলন্ত লাভা তখন আমার শরীরে বইছে। আমি সেটা ওকে জানতে দেইনি। হঠাৎই দরজায় কড়াঘাতের আওয়াজ। যদিও পরিবারের সবাই আমাদের সম্পর্ক, আমাদের গতিবিধি সম্পর্কে জানতো তবুও ওই দিনের সেই মুহূর্তে আমরা কেউই চোখ তুলে তাকাতে পারলাম না। অগত্যা আমাদের চারহাত এক হওয়ার প্রস্তাব হল আর লুকিয়ে প্রেম করার দিনও ঘুচলো।
সত্যিই ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্য তাই আর ওকে চিন্তা দেব না। ভেবে কথাটা জানালাম না – ভাবলাম বিয়ের রাতেই সব বলবো।
এমন সময় নেভি থেকে তাঁর চিঠি এল, ছোটবেলা থেকে তাঁর স্বপ্ন সে নৌ সেনাতে যোগদান করবে। তাঁর মুখে আনন্দের জোয়ার দেখে আমি আর তাঁকে আটকালাম না। যাওয়ার দিন বলে গেল নীলিমা আমি তাড়াতাড়ি ঠিক তোমার কাছে ফিরে আসবো। আমি কাউকেই তোমাকে দেবো না। তুমি ভালো থেকো আর নিজের খেয়াল রেখো। চোখের কোনে জল জমলেও সেদিন সেই জলের ধারাকে বাইরে আসতে দেইনি। হাসি মুখে তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস এই বলে বিদায় জানালাম। বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে সমস্ত কিছু কেনাকাটা শুরু হয়ে গেল, আমি শুধু অপেক্ষার রাত্রি যাপন করতে লাগলাম। কেনাকাটা সমস্ত শেষ, বিয়ের তিন দিন আগে ও ফিরল ….
হঠাৎই বিদ্যুতের আলোয় দেখলাম রাস্তার ওপাশে, এ কী! আমি ঠিক দেখছি?!! হ্যাঁ, ঠিকই তো, ওই তো রাস্তার ওপাশে সৃজন দাঁড়িয়ে, আমার সৃজন… নিজেকে আটকাতে পারলাম না। এতদিন পর দেখা, ছুটে বেড়িয়ে যেতে লাগলাম।
বিয়ের দিন সবকিছু যেমন হওয়ার কথা ছিল তেমনই গায়ে হলুদ, নতুন বেনারসি সমস্ত কিছুই হল। শুধু শুভদৃষ্টির সময় অবাক হয়ে দেখলাম কোথায় সৃজন ? এতো সৃজন নয়!
এতো সমুদ্র, বাবার দেখা পাত্র। পাগলের মতো চোখের দৃষ্টি হাতড়ে বেরালো সৃজনকে, ও বুঝতে পেরে আমার কাছে এসে বললো, যা হচ্ছে তোর ভালোর জন্য হচ্ছে বাবু, আমি চেঁচিয়ে উঠলাম তুই এইরকম প্রতারনা আমার সাথে করতে পারিস না। ধীরে ধীরে সৃজন মণ্ডপ থেকে পা বাড়াচ্ছে বাইরের রাস্তার দিকে, আমিও বিয়ের পিড়ি থেকে উঠে রাস্তার দিকে বেরোতে উদ্যত হতেই সবাই জোর করে বসিয়ে দিল আমাকে, তবু কেউ ওকে কিছু বলল না, যেন কেউ কিছু বুঝতেই পারছে না। সে দিনের রাতে যাকে আমি চিনি না, জানি না, আগে কোনোদিন দেখিনি তাঁর হাতে আমার মাথার সিঁথির সিঁদুর লাল রঙে রেঙ্গে উঠল। আমি শুধু কাঁদতে লাগলাম আর বাকিরা সবাই নীরব পাষাণের মতো সেদিন আমার পরিণতি দাঁড়িয়ে দেখল।
ফুলশয্যার রাতে আমার শরীরের প্রতিটা তিলই সমুদ্রের চেনা হয়ে গেল। বাঁধা দিতে পারলাম না কারণ ওই সন্তান আমার চাই। আমার ভালোবাসার সেই বীজ আমি নষ্ট হতে দিতে পারবো না, ধীরে ধীরে আমার গোটা শরীর আঁকড়ে ধরল – তখনও সৃজন চুপ করেই রয়ে গেল।
নদীর তারপর সব জোয়ারের মতো ঢেউ উঠল, যেমন সমুদ্রের জলরাশি তীরের দিকে ধেয়ে আসে আমিও সিঁড়ি থেকে বাইরে বেড়িয়ে ছুটে ফুটপাতের দিকে যেতেই সব কেমন যেন অন্ধকার হয়ে গেল। জ্ঞান যখন ফিরলো, দেখলাম হসপিটালের বেড এ আমি শুয়ে আছি, আমার পাশে সমুদ্র আর আমার ছোট্ট সৃজন।
মনে পড়ে গেল পেছনে ফেলে আসা কথাগুলো – আমার বিয়েতে যে কারুর কিছু বলারও ছিল না, করারও ছিল না। সৃজন সেদিন ফিরেছিল, কিন্তু একটা কালো বাক্সের মধ্যে সাদা কাপড়ে জড়িয়ে দু চোখ বন্ধ করে ফিরেছিল। তাই বিয়ের রাতে কেউ ওকে দেখতে পায়নি শুধু আমি ছাড়া।
চোখের কোনে জল গড়িয়ে পড়তেই একটা ছোট্ট হাত আমার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল – আমার সোনা পুচকি মা, তুমি কষ্ট পেও না আমি তো আছি তোমার কাছে।
সত্যি তোর ভালোবাসা আজও আছে আমার কাছে সৃজন, শুধু চোখ মেলে তুই আর দেখলি না।