সহস্র এক আরব্য রজনী – ৫ (তিন কালান্দার ফকিরের কিসসা)

›› আরব্য রজনী  ›› ১৮+  

প্রথম কালান্দার ফকিরের কিসসা

বড় লেড়কিটার নির্দেশে প্রথম কালান্দার তার কিসসাটা শুরু করতে গিয়ে বল—“আমি সবার আগে বলছি কেন আমার মুখ দাড়ি-গােফ শূন্য। আর আমার বাঁ চোখটা কেন কানা তা-ও আপনার কাছে ব্যক্ত করব। আমি এক বাদশাহের ছেলে ছিলাম অন্য আর এক দেশের বাদশাহ ছিলেন আমার চাচা। অতএব বুঝতেই পারছেন। আমি হেলাফেলার মত ছিলাম না। যাকগে, আমার আব্বাজী আর চাচাজীর মধ্যে খুবই মনের মিল ছিল। একটা ঘটনার দ্বারাই এর পরিচয় কিছুটা পেতে পারবেন। আমার জন্মের দিনই চাচাজীর এক লেড়কা জন্মাল।

আমরা দু ভাই কৈশাের অতিক্রম করে যৌবনে পা দিলাম। আমাদের পরিবারের নিয়ম অনুযায়ী কিছুদিন বাদে বাদে আমরা চাচাজীর কাছে গিয়ে কিছুদিন করে থেকে আসতাম। শেষবার সেখানে যখন গিয়েছিলাম তখন আমার ভাইজান আমাকে বলল,—তােমাকে একটা কথা বলতে চাই। আশা করি অবশ্যই অমত করবে না। কথা দাও, না বলবে না।

আমার পেটে তখন সরাব গলা পর্যন্ত। নেশায় বিভাের। আমি টলতে টলতে বল্লাম–খােদাতাল্লার নামে হলফ করে বলছি, তুমি যা বলবে আমি হাসিমুখে সে তা-ই করব। বল, কি তােমার কথা।

এক কাজ কর, তুমি একে নিয়ে গােরস্তানের চালাটায় গিয়ে বসাে। আমি একটু বাদেই যাচ্ছি। আমার হাতে এক যুবতীকে তুলে দিয়ে কথাটা ছুঁড়ে দিল।

আমি খােদাতাল্লার নামে কসম খেয়েছি। কথা রাখতেই হ’ল। যুবতীটার হাত ধরে গােরস্তানে হাজির হলাম। চালাঘরটায় বসে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ বাদেই সে-ও সেখানে এল। তার এক হাতে কিছু প্লাস্টার আর অন্য হাতে জলের পাত্র। এর বােগলে ছিল একটা কুড়াল। চালাঘরটার অদুরে অতিকায় একটা পাথরের চাঁই পড়েছিল। সে কুড়াল দিয়ে পাথরটাকে টুকরাে করতে গিয়ে তাতে একটা সুড়ঙ্গের দেখা পেল। তারপর নিচের কটা পাথর সরিয়ে ফেলতই সুদৃশ্য এক প্রাসাদ চোখে পড়ল। আমার ভাইজান যুবতীটাকে নিয়ে সে সুড়ঙ্গ পথে নেমে গেল।

যাবার আগে আমাকে বলে গেল, ‘ভাইজান, তুমি এ জায়গা ছেড়ে যাবার আগে পাথরের টুকরােগুলাে সুড়ঙ্গের মুখে দিয়ে প্লাস্টার দিয়ে লেপে দিয়ে যেয়াে। কেউ যেন বুঝতে না পারে এর তলায় কিছু আছে।’

আমি তার অনুরােধে পাথর চাপা দিয়ে সুড়ঙ্গের মুখ বন্ধ করলাম প্লাস্টার দিয়ে লেপে যেমন ছিল ঠিক তেমনটি করে রেখে চাচাজীর প্রাসাদে ফিরে এলাম।

প্রাসাদে ফিরে শুনি চাচাজী শিকারে বেরিয়েছেন। সারা রাত্রি শুয়ে-বসে অস্থিরভাবে কাটালাম। আমার চাচা বা চাচাতাে ভাইয়া কেউ-ই ফিরল না। বিশেষ করে চাচাতাে ভাইয়া না ফেরায় আমার মনটা বড় চঞ্চল হয়ে পড়ল। শেষ রাত্রের দিকে আবার গােরস্তানের সে পাথরটার কাছে গেলাম। তার খােজ করলাম। কোন হদসিই মিলল না। বিষগ্ন মনে প্রাসাদে ফিরলাম।

পর পর সাতটা দিন আমি নিদারুণ অস্থিরতার মধ্য দিয়ে কাটালাম। কিন্তু আমার চাচাতাে ভাইয়া তবু ফিরল না। শেষ পর্যন্ত হতাশা আর হাহাকার সম্বল করে আমি নিজের দেশে ফিরলাম।

আমাদের নিজের শহরে পা দিতেই আমাকে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনার মুখােমুখি হতে হ’ল। একদল সশস্ত্র লােক অতর্কিতে আমাকে ঘিরে ফেল। আমি দেশের বাদশাহের ছেলে শাহজাদা। আর যারা আমাকে বন্দী করেছে সবাই আমার আব্বাজীর অনুগত কর্মচারী। নিজের দেশে, নিজের আব্বাজীর সৈন্যরা আমাকে বন্দী করায় বিস্মিত হবারই তাে কথা।

আমার নিজের দুরবস্থার চেয়ে আব্বাজীর অমঙ্গল আশঙ্কায় আমার বুকের মধ্যে কলিজাটা উথালি পাথালি করতে লাগল। ভাবলাম তবে আব্বাজীর নির্ঘাৎ কিছু ঘটে গেছে। তিনি হয়ত ইহলােকে আর নেই।

আমার ধারণা অমূলক নয়। এক সহৃদয় সৈনিক আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে অনুচ্চ কণ্ঠে বলল—“তােমার আব্বাজী জানে বেঁচে নেই। উজির আর সেনাপতি চক্রান্ত করে তাকে নিকেষ করে দিয়েছে। উজির এখন মসনদে বসেছেন। তারই হুকুম তামিল করতে আমরা তােমার হাতে শেকল পরাতে বাধ্য হয়েছি।’ |

আমি আব্বাজীর শােকে চোখের পানি ফেলতে লাগলাম। তারা আমাকে শেকল পরিয়ে উজিরের সামনে হাজির করল। আমার ওপর উজিরের অনেক দিনের খার ছিল। উজির একদিন বাগানে পায়চারি করছিলেন। আমি পাখি শিকার করতে গিয়ে তীর ছুঁড়েছিলাম। তীরটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। উজিরের চোখে গিয়ে বিধল। ব্যস, একেবারে কানা। কিন্তু আমার বাবার ভয়ে আমার উপর কোন প্রতিশােধ নিতে পারলেন না।

শেকলবাঁধা অবস্থায় আমাকে উজিরের সামনে দাঁড় করানাে হ’ল।

উজির গর্জে উঠলেন—কোতল কর গর্দান নাও। খতম কর।

আমি সচকিত হয়ে বললাম-“আগে আমাকে বলুন, আমার কি অপরাধ। তারপর আমার গর্দান নেন আপত্তি করব না।

এবার শান্তস্বরে উজির আমাকে কাছে যেতে বলেন। আমি এগিয়ে গিয়ে তার মুখােমুখি দাঁড়ালাম। তিনি আচমকা নখের আঘাতে আমার বাঁ-চোখটা ঘায়েল করে দিলেন। গলগল করে খুন বেরিয়ে এল। এতেও সন্তুষ্ট হতে পারল না! ঘাতকদের হুকুম দিলেন, —“একে একটা কাঠের বাক্সে ভরে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাও। সেখানে টুকরাে টুকরাে করে কেটে মাঠের মধ্যে ফেলে রেখে দিয়ে আসবে। শেয়াল-কুকুর আর শকুন ছিড়ে ছিড়ে খাক একে। যা, নিয়ে যা। বাক্সবন্দী অবস্থায় আমাকে বধ্যভূমিতে নিয়ে এল।

আমাকে বাক্সটা থেকে টেনে হিচড়ে বের করল। চোখের যন্ত্রণায় আমি তখন ছটফট করছি। ভাবলাম, এরকম অসহ্য যন্ত্রণায় একদিন তাে উজিরও করেছিলেন। একটা মানুষের চোখ কানা করে দেওয়া যে কী মর্মান্তিক কাজ। তা তখন আমি বেশী করে উপলব্ধি করলাম। তাই তিনি আমার চোখ কানা করেও তৃপ্ত হলেন না, মৃত্যুদণ্ড দিয়ে পুরােপুরি প্রতিশােধ নিলেন। ঘাতক আমার আব্বাজীর খুবই বিশ্বস্ত। আব্বাজীর কাছ থেকে উপকৃতও হয়েছে বহুবার। তাই আমাকে ছেড়ে দিল। তবে বার বার সাবধান করে দিল, আমি যেন ভুলেও দেশের মাটিতে কোনদিন পা না দিই। দিলে তবে মৃত্যু অবধারিত।

আমাকে বাঁ চোখটা হারাতে হ’ল সত্য, কিন্তু জানটা রক্ষা হয়ে গেল। পাহাড়, জঙ্গল আর মরুভূমি ডিঙিয়ে বহুৎ খুব তখলিফ সহ্য করে ফিরে এলাম চাচাজীর প্রাসাদে। আমার দুর্ভাগ্য এবং আব্বাজীর মৃত্যু সংবাদে তিনি বাচ্চা লেড়কার মত হাউহাউ করে কাঁদলেন, চোখের পানি ঝরালেন। চাচাজীর মনে তখন লেড়কার শােক জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছে। কতজনকেই সে লেড়কার কথা পুছতাছ করেছেন তা গল্পগাঁথা নেই। কিন্তু কেউ তার হদিস দিতে পারে নি।

চাচার চোখের পনি আর দীর্ঘশ্বাস আমাকে কাতর করে তুলল। অনন্যোপায় হয়েই তার লেড়কার সে কাণ্ডকারখানার কথা বল্লাম। চাচাজী আমার মুখে সবশুনে ব্যস্ত পায়ে সে-গারস্তানে গেলেন। আমাকে এবং কিছু সৈন্য সামন্তও সঙ্গে নিলেন। অনেক চেষ্টার পর সে রহস্যজনক সুড়ঙ্গটার হদিস মিলল। অতিকায় পাথরের টাইটা সরিয়ে আমরা সুড়ঙ্গটার মধ্যে সিঁধিয়ে গেলাম। সুড়ঙ্গ-পথে সামান্য নামতেই আমরা ভয়ঙ্কর এক পরিস্থিতির মুখােমুখি হলাম। জমাট বাঁধা ধোঁয়া কুণ্ডলি পাকিয়ে ওপরে উঠতে লাগল। চাচাজী আমাকে অভয় দিতে গিয়ে বললেন কিছু ডর নেই।

খােদার নাম জপ কর সব ডর কেটে যাবে। ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হতে সুবিশাল এক ঘরে আমরা পৌছে গেলাম। এক পাশে একটা পালঙ্ক । আমার চাচাতাে ভাই আর

সে রহস্যময়ী নারী পরস্পরকে আলিঙ্গন করে গভীর নিদ্রায় মগ্ন। মশারী টাঙানাে ছিল। কাছে গিয়ে মশারীর একটা কোণ তুলতেই আমার সর্বাঙ্গে অভাবনীয় কম্পনের সৃষ্টি হ’ল। শরীরের সব কটা স্নায়ু যেন এক সঙ্গে ঝনঝনিয়ে উঠল। দেখলাম, আমার চাচতাে ভাই আর মেয়েটা উভয়েই ভষ্মীভূত।

আমার চাচাজী, উন্মাদের মত কেঁদে উঠলেন। কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলতে লাগলেন—“তাের উচিত শাস্তি হয়েছে রে হতচ্ছাড়া। খােদাতাল্লা তোর বিচার করবেন। তাের যােগ্য স্থান দোজাক। তুই দোজাকেই যা।’ কথা বলতে বলতে চাচাজী পা থেকে চঞ্চল খুলে উন্মাদের মত মৃত ও ভষ্মীভূত লেড়কাকে পিটাতে লাগলেন।

বেগম শাহরাজাদ কিসসার এটুকু বলার পর থামলেন। জানলার ফাকে ইতিমধ্যেই ভোরের আলাে একটু একটু করে ফুটতে শুরু করেছে।

দ্বাদশ রজনী

রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর শুরু হতে না হতেই বাদশাহ শারিয়ার অন্দরমহলে বেগমের কাছে এলেন। শেহেরাজাদ কিসসা শুরু করলেন- কালান্দার বাদশাহ হারুণ-অল-রসিদ, উজির জাফর, কুলি-যুবক প্রমুখের সামনে তার জীবনে করুণতম দিনগুলাের কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে বলল—আমার চাচা পায়ের চপ্পল খুলে আমার মৃত চাচাতাে ভাইয়ের মাথায় আঘাত করামাত্র মাথাটা গুঁড়াে গুঁড়াে হয়ে নকলার মত ছড়িয়ে পড়ল। আমি চাচীকে প্রবােধ দেবার চেষ্টা করলাম। চাচাজী চোখ মুছতে মুছতে বলেন—কার গুণাহর জন্য  লেড়কার এ রকম হাল হয়েছে, জান? আর তার পাশে নসিব বিরম্বিতা লেড়কীটাই বা কে জান? আমার লেড়কী। শৈশব থেকে সে বহিনের সঙ্গে অনাচার করছে। কী গুণাহ ভেবে দেখ। খােদা এ রকম গুণাহ কখনও মাফ করবেন, ভেবেছ? আমি তাকে বহুভাবে শাসন করেছি, মারধাের করেছি, ডরও কম দেখাইনি।

কিছুতেই কিছু হল না! পরকালে দোজাকেই হবে তার একমাত্র স্থান এরকম ডরও বহুবার দেখিয়েছি। কিন্তু পরিণতি ভষ্মে ঘি ঢালা।

চাচাজী আবার হাউমাউ করে কেঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, জলেন-বেটা, তুই আর আমি একই রকম অভাগা। তাের আব্বাজী গেছে আর আমার গেছে লেড়কা। আজ থেকে তুই-ই আমার বেটা। আজ থেকে তুই আমাকে আব্বাজী ডাকবি।

আমরা প্রাসাদে ফিরে এলাম।

দরবারে পা দিতেই শােনা গেল, সীমান্তে শত্রু সৈন্য জড়ো হয়েছে। চাচাজীর রাজ্য আক্রমণ করেছে। আমরা সাধামত যত শীঘ্র সৈন্য প্রস্তুত করে নিলাম। বৃথা চেষ্টা। ইতিমধ্যে, শত্রুসৈন্য বিপুল বিক্রমে নগরে ঢুকে পড়েছে। আকস্মিক প্রবল আক্রমণের সুখে আমাদের সৈন্যরা খড়কুটোর মত উড়ে গেল।

আমাদের বুঝতে দেরী হ’ল না, আক্রমণকারী আমার আব্বাজীর হত্যকরী। সে-উজির চাচাজীর রাজ্য আক্রমণ করেছে শুনে আমার মাথায় রক্ত চেপে গেল। অস্ত্র ধারণ করে লড়াইয়ে নামার জন্য বদ্ধপরিকর হলাম। কিন্তু মুখােমুখি লড়াইয়ে নামা মােটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কারণ, যুদ্ধক্ষেত্রে আমাকে দেখতে পেলেই তার প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য। আমি দাঁতে দাঁত চেপে আমাকে হত্যা করার চেষ্টায় মেতে উঠবে।

অতর্কিতে আমার মাথায় একটা ফন্দি খেলে গেল। ব্যস্ত হাতে খুর চালিয়ে আমার মুখের দাড়ি-গোঁফ চেঁছে ফেলাম। গায়ে একটা ছেড়া পশমের চাদর জড়িয়ে নিলাম। এবার ভিক্ষাপাত্র হাতে ভিক্ষা করতে করতে বেরিয়ে গেলাম নগর থেকে।

আমি অশেষ ক্লেশ সহ্য করে বাগদাদ নগরে হাজির হলাম। অনেকেরই মুখেই খলিফা হারুণ-অল-রসিদের কথা শুনেছি। আর তিনি আল্লাহর পয়গম্বর। এত বড় নগর বাগদাদ। রাস্তাঘাট কিছুই চিনি না। কোথায় গেলে সে মহাত্মার দেখা পাব ভাবছি। দ্বিতীয় কালান্দার-এর দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করে আবার বলপথের বাঁকে ওনার দেখা পেয়ে গেলাম।  এবার তৃতীয় কালান্দার কে দেখিয়ে বল—“আমরা দু’জনে যখন কথা বলছি তখনই ইনি সেখানে উপস্থিত হলেন। আমরা সবাই এখানে পরদেশী। তাই রাত্রিটুকু কাটাবার ইচ্ছায় আপনার বাড়ির কড়া নাড়তে বাধ্য হয়েছিলাম।’

আশা করি আপনারা আমার বাঁ-চোখ কানা হওয়া এবং দাড়িগোঁফহীন মুখের কাহিনী শুনে সত্য ঘটনা বুঝতে পারলেন।

প্রথম কালান্দার-এর কথায় প্রীত হয়ে বড় মেয়েটা তাকে মুক্তি দিলেন।

 

দ্বিতীয় কালান্দার ফকিরের কিসসা

প্রথম কালান্দার ফকির তার কিসসা শেষ করলে খলিফা হারুণঅল-রসিদ জাফর-এর কানের কাছে মুখ নিয়ে অনুচ্চ কণ্ঠে বললেন— কী মর্মান্তিক কাহিনী শােনালেন ফকির সাহেব! এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা সচরাচর ঘটে না।

প্রথম কালান্দার ফকির তাঁর জীবনকাহিনী শুনিয়ে মুক্তিলাভ করলে দ্বিতীয় কালান্দার ফকির এগিয়ে এসে তার জীবনকথা শুরু করলেন।

আপনারা যে আমার কানা চোখটা দেখছেন, আমি কিন্তু মােটেই কানা চোখ নিয়ে জন্মলাভ করিনি। আর আমার গায়ে যে ফকিরের আলখাল্লা দেখতে পাচ্ছেন তা-ও কিন্তু আমার গায়ে উঠেছে অবিশ্বাস্য ঘটনার মধ্য দিয়েই।

আমার আব্বাজীও বাদশাহ ছিলেন। আমি ছিলাম বাদশাহের পেয়ারের বেটা। আমার আব্বাজান বাদশাহ, অগাধ ঐশ্বর্যের মালিক হলেও যথেষ্ট বিদ্বান ও বিদ্যোৎসাহী ছিলেন। আমাকেও উচ্চশিক্ষাদান করতে ত্রুটি করেন নি। পৃথিবীর সেরা সেরা বইয়ের পাহাড় ছিল আমাদের প্রাসাদে। আমি ছিলাম বইয়ের পােকা।

দেখুন, নিজের গুণগান করা উচিত নয়। আমারও সেরকম ইচ্ছা নেই। তবে প্রসঙ্গক্রমে কিছুতাে বলতেই হবে।

আমার বিদ্যাবুদ্ধি আর অগাধ পাণ্ডিত্যের কথা কেবল আমাদের রাজ্যেই নয় প্রতিবেশী রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়ল। একবার সমরখন্দের এক বাদশাহ আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন। আমি আব্বাজীর অনুমতি নিয়ে বহুমূল্য উপটৌকনস তার রাজ্যের উদ্দেশে যাত্রা করলাম। বাদশাহের ভেট, জাহাজ বন্দর ছাড়ল। একমাস অতিক্রান্ত, তখন এক বন্দরে আমার জাহাজ নােঙর করল। আমার সঙ্গের উট আর ঘােড়াগুলােকে নামিয়ে দেওয়া হল। তাদের পিঠে উপহারগুলাে চাপিয়ে রওনা হলাম। মাত্র ঘণ্টাখানেকের পথ। হঠাৎ ডীষণ ঝড় উঠল। ঝড় থামলে চারদিকে তাকালাম। অজানা-অচেনা মরুভূমিতে আমরা এগিয়ে চলেছি । অতর্কিতে একদল সশস্ত্র মরু-ডাকাত আমাদের ঘিরে ফেলে। আমি বল্লাম, বাদশাহের জন্য উপটৌকন নিয়ে চলেছি। পাত্তা দিল না। তারা আচমকা তরবারির আঘাতে আমার এক ক্রীতদাসকে হত্যা করে বসল। তার খুন দেখে আমরা যে যেদিকে পারলাম দৌড়ে ভাগতে লাগলাম। কারাে কথা ভাবার অবকাশ নেই।

এক সময় ছবির মত সুন্দর এক নগরে হাজির হলাম। শহরের পথে এক দর্জির কারখানা চোখে পড়ল। ছেড়া কাপড়ে তাঞ্জি মারছে।

আমাকে দেখেই দর্জি মুচকি হাসল। বিদেশী অনুমান করেই হয়ত তার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। আমি পাল্টা হাসিতে তাকে তুষ্ট করলাম। গুটিগুটি তার দোকানে উঠে গেলাম। আমার পরিচয় নিল। তার মুখে বিষাদের ছায়া নেমে এল। বলল—-“তুমি হয়ত জান না যে, এ দেশের শাহেনশাহ তােমার বাবার সব চেয়ে বড় শত্রু। তােমাকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসার পিছনে রহস্য হচ্ছে তােমাকে খুনের মাধ্যমে প্রতিশােধ নেওয়া। খবরদার কাউকে তােমার পরিচয় দেবে না। তবে কিন্তু এখানে করো কাছে আশ্রয় পাওয়াই তােমার পক্ষে দুষ্কর হয়ে উঠবে।

দর্জি আমার সঙ্গে খুবই ভাল ব্যবহার করল। রাত্রে খানাপিনা করাল। পাটি পেতে শুতে দিল। তিনদিন দর্জির আশ্রয়ে রইলাম।

একদিন দর্জি কাজ করতে করতে বলল—’এমন কোন কাজ জান কি যা দিয়ে তুমি রুটির জোগাড় করতে পারবে?

—“কিন্তু কোন্ বিদ্যা যে এখানে আমার রুটি রােজগারের কাজে লাগতে পারে তা তাে জানি না ভাই। তবে আইন বিষয়ে আমার পাণ্ডিত্য রয়েছে। দর্শন আর সাহিত্যেও যথেষ্ট দখল রয়েছে। আর হিসাবশাস্ত্রে নিজেকে একজন বড় পণ্ডিত বলেই আমি মনে করি।

দর্জি ব্যাজার মুখে বলল—“ভাইজান এ সব বিদ্যা এখানে অচল। অর্থোপার্জনই এখানকার মানুষের একমাত্র লক্ষ্য।

আমি হতাশার স্বরে বলাম—‘কিন্তু এসব ছাড়া যে অন্য কোন কাজই আমি রপ্ত করতে পারিনি।’

মুহূর্তকাল গম্ভীর মুখে ভেবে বল্ল –“ঠিক আছে, ব্যাপারটা খােদাতাল্লার ওপরেই ছেড়ে দেওয়া যাক। তিনিই দোয়া করে যা হোক একটা বিহিত করে দেবেন।

দু’দিন বাদে দর্জি একটা কুড়াল এনে আমার হাতে দিয়ে বল্ল-‘ভাইজান, জঙ্গল থেকে কাঠ নিয়ে এসে নগরে বিক্রি করলে রুটির জোগাড় হয়ে যাবে। যাও, তাই কর।’

দর্জির পরামর্শ মত জঙ্গল থেকে কাঠ এনে নগরে বিক্রি করে পেটের জোগাড় করতে লাগলাম। আশ্রয় দর্জিই দিল। এক বছর কটে গেল।

এক সকালে গভীর জঙ্গলে ঢুকে একটা বিশাল মরাগাছ কাটতে লাগলাম। কয়েক কোপ দিতেই গাছের গােড়া থেকে কুড়ােলের সঙ্গে একটা তামার বালা উঠে এল। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়লাম। মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে উন্মাদের মতে মাটি কাটতে লাগলাম। কিছুটা মাটি কাটতেই আমার চোখের সামনে একটা কাঠের মাচা ভেসে উঠল। অবাক মানলাম। ব্যস্ত-হাতে মাচাটা সরিয়ে ফেলতেই আরও বেশী অবাক মানলাম। আচমকা আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল-‘হায় আল্লা?’ এক সুরম্য অট্টালিকা দেখে আমি আর মাথা ঠিক রাখতে পারলাম না। তর তর করে নিচে নেমে গেলাম। আরও অবাক মানলাম, যখন একটা বিশালায়তন ঘরের দরজায় পৌছলাম। নিজের চোখ দুটোর ওপরও যেন আস্থা হারিয়ে ফেললাম। দেখি এক অষ্টাদশী সুসজ্জিত একটা পালঙ্কের ওপর শুয়ে। অপরূপা। খুব-সুরৎ! রূপের আভায় চোখ দুটো ঝলসে দিচ্ছিল। মনে হল বেহেস্ত্রের পরীদের সৃষ্টি করার পর অবশিষ্ট সৌন্দর্যটুকু এ অপরূপার গায়ে সযত্নে লেপে দেওয়া হয়েছে।

আমার পায়ের আওয়াজ পেয়ে অপরূপা চোখ মেলে তাকাল। মিষ্টি-মধুর সুরেলা কণ্ঠে উচ্চারণ করল-“তুমি কি মানুষ নাকি কোন দৈত্য গাে?

আমি বিস্ময়ের ঘাের কাটিয়ে বল্লাম-“আমি মানুষ। সত্যিকারের মানুষ।

মেয়েটা সবিস্ময়ে বলল—‘মানুষ! কি করে এখানে এলে? বিশ বছর আমি মনুষ তাে দূরের কথা মানুষের ছবি পর্যন্ত দেখতে পাই নাই।

–সবই আল্লাহর মর্জি। তিনিই আমাকে তােমার এখানে নিয়ে এসেছেন। এতদিন ধরে নসীবের ফেরে যা কিছু তকলিফ সহ্য করেছি তােমাকে চোখের সামনে দেখে সব মন থেকে মুছে গেল।

রুপসী যুবতী ধৈর্য ধরে আমার দুঃখ-দুর্দশার কথা সব শুনল।

আমি থামলে সে এবার তার কিত্সা শােনাতে লাগল-শােন গো মনের মানুষ, ইফতিমাসের লেড়কী আমি। চাচাতাে ভাইয়ের সঙ্গে আমার শাদী হবে পাকাপাকি হয়ে গিয়েছিল। নসীব মন্দ। শাদীর দিনে আমাকে বাজমুস দৈত্যের লেড়কা জারসিজ চুরি করে নয়। বহু জায়গায় ঘুরে এখানে এনে বন্দী করে। আমার খানাপিনার কোন অভাবই সে রাখে নি। সারা রাত্রি আমার সঙ্গে থাকে আমাকে উপভােগ করে। সুবহ হলেই পরিতৃপ্ত মন নিয়ে কোথায় যেন উধাও হয়ে যায়। ব্যস, সন্ধ্যার আগে তার টিকির কালও পাওয়া যায় না। আবার কখনও দীর্ঘদিন সে এমুখাে হয় না। চারদিন আগে এসেছিল। আরও ছয়দিন পর আবার আসার কথা। এর পাশেই একটা ছােট্ট কুঠরি আছে। তার দেওয়ালে একটা লেখা রয়েছে দু ছত্র মন্ত্র। তার গায়ে হাত রেখে দৈত্যটাকে ডাকলেই মুহুর্তে এখানে হাজির হয়। ছয় দিনের মধ্যে পাঁচদিন তুমি নির্বিবাদে এখানে কাটাতে পার। নিশ্চিন্তে আমাকে সঙ্গদান করতে পার। সে ফিরে আসার আগে এখান থেকে কেটে পােড়। আমি রূপসী যুবতীর প্রস্তাবে সম্মত হলাম।

আমার মুখে থাকার কথা শুনে সে রীতিমত উল্লসিত হয়ে পড়ল! উচ্ছ্বাসে-আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমাকে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে তার বিছানায় বসাল। তার হাতের স্পর্শে আমার সর্বাঙ্গে কেমন যেন এক অনাস্বাদিত রােমাঞ্চ জাগল। বুকের মধ্যে কলিজাটা নাচন কোদন জুড়ে দিল। ভাবলাম রূপসী যুবতীর স্পর্শে যদি মন এমন পাগলপারা হয়ে ওঠে তবে সম্ভোগে না জানি তার পরিমাণ কত গুণ বৃদ্ধি পায়। অভাবনীয় উত্তেজনার সঞ্চার হ’ল যখন সে আমার সর্বাঙ্গে তেল মর্দন করে গােসল করাল। আমার সর্বঅঙ্গে, পুরুষাঙ্গে পরম যত্নে তেল মালিশ করে দিল।

আর আমিও তার যৌবন ভরা দেহে নিজ হাতে তেল মর্দন করে গােসল করিয়ে দিলাম। তার গলা, ঘাড়, স্তন, হাত, বাহু, বগল, পেট, নাভী, যোনি সর্ব অঙ্গে হাত দিয়ে স্পর্শ করলাম, কোথাও বাদ দিলামনা। তার চোখের তারার দুষ্টুমিভরা হাসি আমার কলিজাটাকে উথাল পাথাল করে দিতে লাগল। সে গােসল সেরে খাটে উঠে এল। অতর্কিতে নাবালিকাসুলভ এক কাজ করে বসল। এক ধাক্কা দিয়ে আমাকে আবার জলে ফেলে দিল। নিজেও ঝপ করে জলে পড়ল। ডুবসাঁতার দিয়ে আমার একটা পা চেপে ধরল। দীর্ঘ সময় ধরে চলল আমাদের জলকেলী। আমার বুকের উপর চেপে এল। কাধে হাত দুটো তুলে দিয়ে আমার বুকের সঙ্গে নিজেকে লেপ্টে নিল। থাকল অনেকক্ষণ। আমার মধ্যে তখন শিহরণের পর শিহরণ ঘটে চলেছে। অদ্ভুত, অনাস্বাদিত শিহরণ। মনে হল এ সুখ ছেড়ে বেহেস্তে যেতেও আমি রাজি নই। অনেকক্ষন ধরে আমাদের দলন, পেষন, চোষন চলল। এক সময় আমরা ক্লান্ত দেহে সায়র থেকে উঠে এলাম। যােড়যােপচারে মধ্যাহ্ন ভােজন সারলাম উভয়ে। জলকেলীর ধস্তাধস্তিতে শরীরে অবসাদ অনুভব করছিলাম। দিবানিদ্রার মাধ্যমে ক্লান্তি অপনােদন করে নিলাম। সন্ধ্যার কিছু পরে রূপসীর নরম হাতের স্পর্শে আমার নিদ্রা টুটে গেল। আমি চোখ মেলে তাকালাম। সে তার তুলতুলে নরম শরীরটাকে আমার ওপর ছেড়ে দিল। আমার শরীরটাকে নিয়ে শিশুর মত খেলায় মেতে উঠল। আমি হাত বাড়িয়ে ওকে আরও নিবিড় করে নিলাম প্রশস্ত বুকটার মধ্যে। সে চনমনিয়ে উঠল। আমার ঠোটের কাছে নিজের ঠোট দুটো নিয়ে এল। উষ্ণ অনুভূতি। শিহরণ। রােমাঞ্চ। আমার বুঝতে অসুবিধা হল না। সে দলিত, মথিত, পিষ্ট হওয়ার জন্য উন্মুখ। আমার যৌবনকে পুরােপুরি উপভােগ করার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে। রক্তে মাতন জেগেছে। তার পক্ষে নিজেকে সংযত রাখা তাে সম্ভবও নয়। আমিও ক্ষুধাতুর নেকড়ের মত চেপে ধরলাম তার যৌবনের জোয়ার লাগা আঠাশ বছরের তুলতুলে শরীরটাকে। তার ঐকান্তিক আগ্রহ আর আমার নিজেকে নিঃশেষে বিলিয়ে দেওয়ার আগ্রহ একাকার হয়ে গেল।

গােপন করব না, তার দেহসুধা পান করে আমি যে তৃপ্তি সেদিন পেয়েছিলাম আজও তা আমার মনে রােমাঞ্চ জাগিয়ে তােলে।

রূপসী যুবতী চাওয়া ও পাওয়ার মধ্য দিয়ে তার ক্লান্ত-অবসন্ন দেহটাকে আমার ওপর ছেড়ে দিয়ে হাঁফাতে লাগল। এক সময় -একটু দম নিয়ে বলল—“আমার মন চাইছে আমার কলজেটা ছিড়ে এনে তােমাকে দিয়ে দেই।

আমি বল্লাম—“তােমাকে শয়তান দৈত্যটার হাতে ছেড়ে দিয়ে আমি কিছুতেই এখান থেকে যেতে পারব না।’

সে আমার লােমশ বুকে হাত বােলাতে বােলাতে বল্ল–কেন? মিছে  অস্থির হচ্ছ নাগর আমার? দৈত্য তাে দশদিন বাদে বাদে এখানে আসে।

—“তা হোক গে। আমি ছাড়া অন্য কেউ তােমার দেহটাকে উপভােগ করুক তা আমি কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারব না।’ কথা বলতে বলতে আমি উন্মাদের মত ছুটে গেলাম পাশের ঘরের দেয়ালের লেখাটার কাছে। একটা কুড়াল দিয়ে সজোরে আঘাত করতে লাগলাম তার গায়ে।

বেগম শাহরাজাদ দেখলেন প্রাসাদের বাইরের প্রকৃতির গায়ে প্রভাতের আলাের ছােপ দেখা দিয়েছে। কিসসা বন্ধ করলেন।

ক্রয়ােদশ রজনী। বাদশাহ শারিয়ার বেগমের কাছে এলেন।

বেগম শাহরাজাদ বললেন—জাঁহাপনা, দ্বিতীয় কালান্দার তার জীবনের ঘটনা বলতে লাগল।

তারপর আমার জীবনে কি ঘটল শেষ পর্যন্ত ধৈর্য ধরে শুনুন। আমি দেয়ালের লেখাটার গায়ে কুড়াল দিয়ে আঘাত করা মাত্রই যুবতী আকুল হয়ে কাদতে শুরু করে দিল। কাদতে কাদতে বল—“আ্ল্লাতালার দোহাই, তুমি এখান থেকে চলে যাও। যত শীঘ্র পার পালাও। দৈত্য এসে পড়ল বলে। তােমাকে মেরে ফেলবে। আমাকেও ছেড়ে কথা কইবে না। জানে বাঁচতে চাও তাে পালাও।

আমি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যে-সিঁড়ি দিয়ে নেমেছিলাম তার দিকে দৌড়ােলাম। উদ্ভ্রান্তের মত সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলাম। প্রেম আর সম্ভোগের সাধ মন থেকে নিঃশেষে মুছে গেছে। ভয়ে কলিজা পর্যন্ত শুকিয়ে কাঠ। বিপদের ওপর বিপদ। এতদূর এসে হঠাৎ মনে পড়ল, কুড়াল আর জুতাে জোড়া তাে সে-রূপসীর ঘরে ফেলে এসেছি। লম্বা লম্বা পায়ে ফিরে গেলাম। নসীবের ফের আর কাকে বলে? ফিরে এসেই দৈত্যের ফাঁদে পড়ে গেলাম। দৈত্য বীর বিক্রমে, ফিরে আসতে লাগল। বাতাসকে অস্থির-চঞ্চল করে তুলল তার হাত-পায়ের আস্ফালনে আর সুতীব্র হুঙ্কারে। পাহাড়ের মত সুবিশাল দেহধারী দৈত্যটা ফোস ফোস করতে করতে এসে হাজির হ’ল। তার চেহারাটা এক লহমায় দেখামাত্র আমার বুকের ভেতরে কোন্ অদৃশ্য হাত যেন হরদম হাতুড়ি পিটতে লাগল। সত্যি যেমন বীভৎস তেমনি কদাকার তাকে দেখতে।

রূপসী-যুবতীটির সামনে এসে দাঁড়িয়ে সে গর্জে উঠল—এটাকে কি বলে? আমি আরও ভাবলাম কোন অঘটন ঘটেছে, নির্ঘাৎ কোন বিপদের সম্মুখীন হয়েছ তুমি।

রূপসী যুবতী ভয়েডরে পৌনে মরা হয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল—“কিছুই তাে হয় নি। নেশায় টলতে টলতে গিয়ে ওই লেখার গায়ে আছাড় খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম।

দৈত্যটা এত সহজে ভুলবার নয়। তা ছাড়া ঠিক তখনই আমার জুতাে জোড়া আর কুড়ালটা তাের চোখে পড়ে গেল। চরম আক্ৰেশে গর্জে উঠল—‘শয়তানী কোথাকার! আমাকে ধাপ্পা দেওয়ার চেষ্টা! এগুলাে কার ?

—“বিশ্বাস কর। এর আগে আমি এগুলাে দেখি নি। তুমি না দেখালে হয়ত আমার চোখেই পড়ত না। আমি তাে ভাবছি, তুমিই হয় তাে কোন সময় সঙ্গে করে এনেছিলে, খেয়াল নেই।’

—“চুপ কর শয়তানী। এখনও সময় আছে, বল কার এগুলাে? কথা বলতে বলতে রূপসী যুবতীটার ওপর ঝাপিয়ে পড়ল। প্রচণ্ড আক্রোশে তার গায়ের জামা কাপড় টেনে ছিড়তে ছিড়তে তাকে একেবারে উলঙ্গ করে ফেলল। এক ঝটকায় উপুড় করে শুইয়ে দিল। হাত-পা সব মাটির সঙ্গে গেঁথে দিল। তারপর নৃশংস অত্যাচারে মেতে উঠল ক্রোধােন্মত্ত দৈত্যটা। সে কী বীভৎস দৃশ্য!

আমি অত্যন্ত সন্তর্পণে পা টেনে টেনে সিঁড়ির কাছে এলাম। নিজের আচরণে অনুতাপ জ্বালায় দগ্ধ হতে লাগলাম। নিজের সামান্য দেহক্ষুধা নিবৃত্ত করতে গিয়ে তাকে বিপদের মুখে ছুঁড়ে দিলাম। এ গুণাহ আল্লাতাল্লা ক্ষমা করবেন কি না জানি না।

বিষন্ন মুখে দর্জির কাছে ফিরে এলাম। আমাকে দেখে যেন সে আনন্দে নাচতে লাগল। বল্ল —সবাই কাঠ নিয়ে ফিরে এল আর তােমার দেখা নেই। আমি সারারাত্রি নিঘুম অবস্থায় বসে কাটিয়েছি। ধরেই নিয়েছিলাম, জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে তুমি নির্ঘাৎ খুন হয়েছ। জানােয়ার তােমাকে ছিড়ে-খাবলে খেয়েছে। তােমাকে দেখে চোখে জল এল।

তার পাশে বসে আগাগোড়া সব ঘটনা সবিস্তারে বলতে লাগলাম। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে দর্জি উঠে গেলো। একটু পরে ফিরে এসে বললো এক পার্শি সাহেব! তোমার জুতো জোড়া আর কুঠারখানা নিয়ে এসেছে। তোমার সঙ্গে একবার দেখা করতে চায়।

দর্জির কথা শুনে আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। কী করি, কী বলি, কিছুই ভাবতে পারলাম না। মাথাটার মধ্যে বোঁ বোঁ করে ঘুরতে লাগলো। মনে হতে লাগলো, এখুনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবো।

দর্জি বললো, যাও না, দেখা করে এসো। তোমার উপকার করতেই তো এসেছেন। অতো ঘাবড়াবার কি আছে? জুতো জোড়া আর কুঠারটা নিয়ে উনি ঘুরেছেন অনেক। শহরের কাঠকুড়ানোওয়ালারা যে অঞ্চলে বাস করে সেখানে গিয়েছিলেন প্রথমে। তাদের একজন তোমার জুতো জোড়া চিনতে পেরে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে। যাও, দরজার সামনে গিয়ে ওঁর সঙ্গে কথা বলে। শুক্ৰিয়া জানিয়ে এসো।

ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছিলো আমার পা। কোনরকমে উঠে দরজার কাছে গিয়ে একটু ফাঁক করে দেখলাম, এক সুদৰ্শন পার্শি দাঁড়িয়ে আছে। তার এক হাতে জুতো অন্যহাতে কুঠার। চিনতে ভুল হলো না, আমারই! ভাবছি, দরজাটা খুলে ওর সামনে দাঁড়াবো কি দাঁড়াবো না। এমন সময় দরজার ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে খপ করে আমার একখানা হাত চেপে ধরলো। দেখলাম, সে-হাতের থাবাটা কোনও মানুষের না। দৈত্যের। একটা বিকট আওয়াজ তুলে সে আমাকে হ্যাঁচকাটানে বের করে ফেললো। তারপর এক লাফে উঠে গেলো মহাশূন্যে। তার হাতের মুঠোয় আমি ঝুলতে ঝুলতে চললাম। কোথা দিয়ে কিভাবে আবার সেই পাতালপুরীর প্রাসাদে আমাকে এনে ফেললো, বলতে পারবে না। অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। আমি যখন জ্ঞান ফিরে এলো, দেখি, আমার সামনে সেই সুন্দরী-বিবস্ত্রা রক্তাপুত দেহে গোঙাচ্ছে।

দৈত্যটা গর্জন জুড়ে দিল—“তাের পিরিতের নাগরকে নিয়ে এসেছি। দেখ তো চিনতে পারিস কিনা?’

—“আমি কাউকেই চিনি না। আমার কোন নাগরটাগর নেই।’

তারপর আমাকে এক লহমায় দেখে নিয়ে বল্ল—‘কই, একে তাে আমি দেখিও নি কোনদিন।’

‘চিনিস না ? দেখিস নি কোনদিন? মিথ্যা কথা বলার আর জায়গা পাস নি! তুই একে নিয়ে মজা লুটিস নি, বল শয়তানি? এই নে তরবারি। যদি তাের নাগর না-ই হয়ে থাকে তবে আমার সামনে একে কেটে দু টুকরাে করে ফেল।

মেয়েটা তরবারিটা নিয়ে আমার দিকে এক পা এগিয়ে এল। আমি চোখের মণিতে সকরুণ মিনতি জানালাম। তা দেখে সে কেমন যেন হকচকিয়ে গেল।-তােমার জন্যই আজ আমার কলিজাটা টুকরাে টুকরাে হচ্ছে।’ কথাটা বলতে বলতে হতের তরবারিটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। বুদ্ধির ঢেকি দৈত্যটা তার কথার মারপ্যাচ বুঝল না। সে এবার তরবারিটা কুড়িয়ে নিয়ে আমার হাতে দিয়ে বল—তােমার পয়ারি দোস্তের গর্দানটা নামিয়ে নিতে পারলে বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে। যাও, ওর গদানটা ধড় থেকে নামিয়ে দাও।’

আমি ভাবলাম, নিজের জানের বিনিময়ে তার গর্দানটা নামিয়ে দেয়া বিশ্বাসঘাতকতা করাটা মােটেই সঙ্গত নয়। এত অত্যাচার সহ্য করেছে তাে কেবল মহব্বতের খাতিরেই। কিন্তু করি-ই বা করি? চোখ দয়ে পানি গড়াতে লাগল। পারলাম না। তরবারিটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। এবার দৈত্যের দিকে ফিরে বল্লাম-“তুমি দৈত্য কুলের সম্রাট। তােমার কটাক্ষে দুনিয়া থরথরিয়ে কঁপে। তুমি তাে নিজের চোখেই দেখলে, আমি তার তিলমাত্রও ক্ষতি কোনদিন করিনি বলেই তাে সে আমার জান নিতে পারল না। আমিই বা বিনা অপরাধে তার গর্দান নিতে কি করে উৎসাহী হই, তুমিই বল ?

দৈত্যটা এবার বিশ্রী স্বরে গর্জে উঠে বল—‘বুঝেছি, তােমাদের মহব্বত খুবই গাঢ় গয়ে উঠেছে। কেউ-ই কাউকে ছাড়তে পারছ না।

নিষ্ঠুর দৈত্যটা বিকট চিৎকারে চারদিক কাপিয়ে তুলে আমার মেহবুবার ওপরে ঝাপিয়ে পড়ল। তীব্র আক্রোশে তার হাতপাগুলাে কেটে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। হাতের তরবারিটা আর একবার তার মাথার ওপর উঠে গেল। আমার মেহবুবা আর্তনাদ করে উঠল। আমি চোখ বন্ধ করলাম। যখন চোখ মেলে তাকালাম, দেখি তার দ্বিখণ্ডিত দেহটা জমাট বাঁধা খুনের মধ্যে গড়গড়ি খাচ্ছে।

হিংস্র দৈত্যটা হাতের খুন জড়ানাে তরবারিটা প্রচণ্ড বিদ্বেষে ছুঁড়ে ফেলে দিল। এবার আমার দিকে তাকিয়ে, হাড়িতে মুখ ঢুকিয়ে কথা বলছে এরকম গলায় বল—“শােন মানুষের বাচ্চা, আমাদের দৈত্য-সমাজের নিয়ম ব্যাভিচারিণীর একমাত্র শাস্তি জান নেওয়া। মৃত্যু। হতচ্ছড়ি লােচ্চার মাগীটাকে বিয়ের রাতে চুরি করে এখানে লুকিয়ে রেখেছিলাম। বিশ সাল সে আমাকে সঙ্গ দিল। আমি দিলাম দেহের সুখ। কিন্তু সে সুখ তার দিলটাকে ভরিয়ে দিতে পারল না। আমি বিশ বিশটা সাল ধরে যা পারি নি, একদিনেই তুমি তা পেরে গেলে। তার দিলটাকে ধরতে পারলে। আমি অবাক মানছি বটে। কিন্তু নিজের চোখে তাে কিছু দেখি নি। তােমাদের লােস্টামি তাে আর চোখের সামনে দেখতে পাই নি। কিন্তু আমার মন কইছে কি, আমার ধারণাই ঠিক বটে। কিন্তু শুধুমাত্র ধারণার বশে তােমার জান আমি নিতে চাই না। তবে তােমাকে একেবারে রেহাইও দেব না। আমার যাদুবলে তােমাকে একটা জানােয়ার বানিয়ে দেব। তুমি নিজেই বল, কোন্ জানােয়ার তুমি হতে চাও?’

নাই মামার চে কানা মামা ভাল। ভাবলাম, তবু জানটা তাে বাঁচবে। বাঘ, সিংহ, গাধা, খচ্চর—কোনটা হলে যে আমার সুবিধা হবে বুঝতে পারলাম না।

আমাকে ইততঃ করতে দেখে শয়তান দৈত্যটা শোঁ শোঁ শব্দে বাতাসে ভর দিয়ে ভেসে গেল। পাহাড় থেকে এক মুঠো ধূলাে নিয়ে ফিরে এল। বিড়বিড় করে কি যেন সব বলে সেগুলাে দিল আমার ওপর ছড়িয়ে! ব্যস, মুহূর্তে আমার বুকের তীব্র আলােড়ন শুরু হয়ে গেল। আমি মনুষ্যদেহ ছেড়ে বানরে পরিণত হয়ে গেলাম। ছােটখাটো দেহ, চারটে পা আর বড় বড় লােমে আমার সর্বাঙ্গ ছেয়ে গেল। নচ্ছার দৈত্যটা বিশ্রি সুরে হেসে অদৃশ্য হয়ে গেল।

হায় আমার নসীব! অগাধ বিদ্যা, বুদ্ধি আর জ্ঞান নিয়ে আমি বানর জীবন যাপন করতে লাগলাম। একেই বলে নসীবের ফের। মনের দুঃখে সমুদ্রের তীরে গাছের ডালে ডালে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম।

একদিন গাছের ডালে বসে লম্বা লম্বা আঙুলগুলাে দিয়ে গা চুলকাচ্ছি। এমন সময় একটা জাহাজকে তীরের কাছ দিয়ে যেতে দেখে তার মাস্তুলে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। এক সময় নেমে গেলাম ডেকের ওপর। আমাকে দেখেই জাহাজের নাবিক আর লস্কর সবাই লাঠি নিয়ে তেড়ে এল। একজন তরবারি উঁচিয়ে ধরল। আমি কৌশলে তার হাত থেকে সেটা ছিনিয়ে নিলাম। লােকগুলাে হঠাৎ ঘাবড়ে গেল। আমি গালে হাত দিয়ে কঁদতে লেগে গেলাম। তারা বুঝল, আমি আশ্রয়প্রার্থী।

জাহাজের ক্যাপ্টেন আমার মনের কথা বুঝলেন। আমি যে তাদের কোন ক্ষতি করতে চাইছি না, আশ্রয় ভিক্ষা করছি বুঝতে পারলেন। দোয়া করলেন। আমাকে ডেকে নিজের কেবিনে নিয়ে গেলেন। আমাকে তিনি যা যা বললেন, বুঝতে পারলাম সবই। কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে পারলাম না। কিচির মিচির শব্দ করে, ঘাড় কাৎ করে, ইঙ্গিতে সাধ্যমত তার কথার জবাব দিলাম।

ক্যাপ্টেনের অনুগ্রহে আৰ্তির ব্যক্তিগত নােকরের পদে নিযুক্ত হলাম। আমার কাজকর্মে কোন খুঁত রাখতাম না। ক্যাপ্টেন তাে মহাখুশি।

পঞ্চাশ দিন এক নাগাড়ে জাহাজ চালিয়ে এক বন্দরে জাহাজ নােঙর করলেন।

দেশের সুলতানের আমিররা এসে ক্যাপ্টেনকে কুর্নিশ করল। খাতির করল খুবই। তারা জানাল, দেশের উজির কিছুদিন হল! বেহেস্তে যাত্রা করেছেন। দু-চারদিন রােগভােগেই মারা গেছেন। নানা বিদ্যায় বিশারদ একজন উজিরের খোঁজ করেছেন সুলতান। তেমন কাউকেই পাচ্ছেন না। জাহাজে কোন সর্বগুণান্বিত ব্যক্তি থাকলে তিনি সুলতানের কাছে হাজির হতে পারেন।

কথা বলতে বলতে আমির – ওমরাহরা একটা জড়ানাে কাগজ খুলে সুলতানের ইচ্ছার কথা ক্যাপ্টেনকে দেখালেন। ব্যস, জাহাজের ক্যাপ্টেন থেকে শুরু করে প্রত্যেক কর্মী আমার নাম লিখে তাতে সানন্দে স্বাক্ষর দান করলেন।

সুলতানের আমির ওমরাহরা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমার যােগ্যতার পরিচয় দিয়ে আমি যাতে তাদের দ্বিধা দূর করতে পারি তার জন্য তাড়াতাড়ি দোয়াত কলম এনে আমার সামনে রাখলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন।

আমি সুন্দর হস্তাক্ষরে কিছু শায়ের লিখে ফেললাম। আমার পাণ্ডিত্যে তারা মুগ্ধ হ’ল। বিস্ময়বােধ করল যার পর নাই। আমাকে নিয়ে হাজির করল সুলতানের সামনে। সুলতান আমার পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হলেন। চকমকা পােশাক পরতে দিলেন। আমাকে উজির পদে বহাল করলেন। আর জাহাজের ক্যাপ্টেনকে প্রচুর মােহর ইনাম স্বরূপ পাঠিয়ে দিলেন। আমি ভূমিতে দু’হাত ছুঁইয়ে সুলতানকে সালাম জানালাম।

আমার জন্য সুন্দর একটা কুরশি বন্দোবস্ত করা হ’ল। দেওয়া হ’ল কাগজ-কলম। আমি শায়ের লিখে লিখে সুলতানের হাতে তুলে দিতে লাগলাম। সুলতান তাে পড়ে মহাখুশি। স্তম্ভিতও কম হন নি।

আমার অগাধ পাণ্ডিত্য ও জ্ঞানগম্যির কথা সুলতান তার আদের মেয়েকে না জানানাে পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। তাকে ডাকালেন। সে ঘরে ঢুকেই তাড়াতাড়ি ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। রাগে ফোস ফোস করতে করতে বলল -আব্বাজান, এক বিদেশীর সামনে আমাকে আচমকা হাজির করিয়ে তুমি ঠিক কাজ কর নি। তুমি যাকে বানর দেখছ, তিনি প্রকৃতপক্ষে বানর নন। এক বাদশাহের লেড়কা। ফার দেশের বাদশাহ। তার আব্বাজানের নাম বাদশাহ ইফতি মারাস। আফ্রিদি দৈত্য জারসিজ যাদুবলে একে বানরে পরিণত করেছে। এর জ্ঞান বুদ্ধির তুলনা একমাত্র সাগরের

সঙ্গেই চলতে পারে। নসীবের ফেরে আজ এ হেয় জীবন যাপন করছে, লােকের করুণার পাত্র হয়ে দিন গুজরান করছে।

সুলতান সব শুনে আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি ঘাড় কাং করে জানালাম, যা শুনেছেন সবই সত্যি। আমার বিড়ম্বিত জীবনের কিসসা শুনে সুলতান তাে একেবারে থ বনে গেলেন। তিনি এবার লেড়কিকে জিজ্ঞেস করলেন – বেটি এত সব কথা কি করে জানলে, বল তাে?

‘যাদুবলে। আমার শৈশবে আমাকে দেখভাল করার জন্য যে বুড়ি পরিচারিকাকে রেখে দিয়েছিলে তিনি যাদুবিদ্যা খুবই ভাল জানতেন। আমাকে তার বিদ্যার কিছু কিছু দান করেছিলেন। তারপর থেকে চর্চা চালিয়ে যাচ্ছি সবার অলক্ষ্যে। আব্বাজান, তুমি মন করলে, আমি এক লহমায় তােমার এ সুবিশাল মহলটাকে অদৃশ্য করে দিতে পারি। আবার তােমার নগরটাকে বানিয়ে দিতে পারি বিশাল এক মরুভূমি। এক গণ্ডুষ পানি কেবল দরকার। ব্যস, যা খুশি আমি করে ফেলতে পারি।’

-“ভারি তাজ্জব ব্যাপার দেখছি। তােমার যাদুবিদ্যার কথা বিন্দুবিসর্গও তাে আমি জানতাম না। তবে এক কাজ কর, যাদুবিদ্যা প্রয়ােগ করে তুমি এর আসল দেহ ফিরিয়ে দাও। আদমির দেহ দান কর। তার মত জ্ঞানী-গুণী তামাম দুনিয়ায় খুব বেশী আছে বলে মনে হয় না। আমি দরবারে তাকে পাকাপাকিভাবে উজির করে রাখতে চাচ্ছি।

সুলতানের লেড়কি রাজি হ’ল। আমার বুকটা খুশি-আনন্দে ভরপুর হয়ে গেল।

এমন সময় প্রাসাদের বাইরে, বাগিচায় পাখিদের ছুটোছুটি আর কিচির-মিচির শুরু হয়ে গেল। বেগম শাহরাজাদ তার কিসসা বন্ধ করলেন।

চতুর্দশ রজনী রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে বাদশাহ শারিয়ার বেগমের কাছে ফিরে এলেন।

বেগম শাহরাজাদ তাঁর কিস্সা শুরু করতে গিয়ে বললেন – শুনুন জাহাপনা, বড় মেয়েটার কাছে দ্বিতীয় কালান্দার নিজের জীবন কথার অবশিষ্ট অংশ বলতে গিয়ে বললেন-“শাহজাদী একটা ছুরি এনে তার ফলা দিয়ে মেঝেতে হিব্রুভাষায় কি যেন লিখল। এবার ছুরির ফলাটা দিয়েই তার চারদিক একটা বৃত্ত অঙ্কন করল। তারপর অবােধ্য ভাষায় অনুচ্চ কণ্ঠে কি সব বলতে লাগল। ব্যস, দেখতে দেখতে অন্ধকার ঘনিয়ে এল। ভয়ানক দুর্যোগ। সারা বাড়িটা দুলতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে অন্ধকার কেটে গিয়ে স্বাভাবিকতা ফিরে এল। সবার চোখের সামনে দেখা দিল ভয়াল আফ্রিদি দৈত্য। নাম তার জারসিজ। শাহাজাদী নির্বিকার, আর আমরা সবাই ভয়ে কাঠ হয়ে গেলাম।

আফ্রিদি জারসিজ কর্কশ স্বরে গর্জে উঠল -তােমার কাণ্ড আমাকে অবাক করেছে। যে – বিদ্যা আয়ত্ব করেছিলে তাকে তুমি ধরে রাখতে সক্ষম হলে না। আমাদের মধ্যে শর্ত হয়েছিল, কারাে কাজে আমরা প্রতিবন্ধকতা করব না, ক্ষমতাও জাহির করব না কারাে বিরুদ্ধে। তুমিই কথা রাখলে না। এর জন্য উচিত শিক্ষা তােমাকে পেতেই হবে, কথা বলতে বলতে আফ্রিদি দৈত্য জারসিজ এক অতিকায় হিংস্র সিংহের রূপ পরিগ্রহ করে দিল তীব্র গর্জন। সে কী গর্জন! আমার বুকের ভেতরে কলিজাটা তাে দাপাদাপি শুরু করে দিল।

কিন্তু না। শাহজাদী ক্ষিপ্রহাতে মাথার একগাছি চুল ছিড়ে মন্ত্র পড়তেই মস্ত এক তলোয়ার হয়ে গেলো। সেই শাণিত তলোয়ারের আলোর ঝালকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে গেলো আমাদের। সিংহের ধড় আর কাল্লা দু’খানা হয়ে গেলো শাহজাদীর এক সুখ। কোপে। কিন্তু কি আশ্চর্য, সিংহের মুণ্ডটা এক প্রকাণ্ড কাঁকড়াবিছে হয়ে শাহজাদীর পায়ের দিকে ছুটে এলো কামড়াতে। চোখের পলকে এক বিষধর সাপের আকার ধারণ করলো শাহজাদী। তখন লড়াই শুরু হলো কঁকড়াবিছে আর সাপে। সে কি প্রচণ্ড লড়াই। অনেকক্ষণ ধরে চললো। এক সময় দেখলাম, কঁকড়াবিছেটা হয়ে গেলো একটা শকুনী। আর তক্ষুণি সাপটািও ঈগলপাখীর রূপ ধরলো। শকুনি আর ঈগলের যুদ্ধও চললো ঘণ্টাখানেক। এরপর শকুনি হলো এক বন-বিড়াল, ঈগল হয়ে গেলো নেকড়ে বাঘ। বিড়াল আর নেকড়ের লড়াই-এ বিড়ালটা কাবু হয়েছে প্রায়, এমন সময় দেখলাম, একটা প্রকাণ্ড বড় ডালিম হয়ে লাফিয়ে গিয়ে বসলো দরবার প্রাঙ্গণের ফোয়ারাটার চারপাশের গোলাকৃতি চৌবাচ্চার ওপর। নেকড়েটাও কাঁপিয়ে পড়লো সঙ্গে সঙ্গে। ডালিমটা এক লাফে উঠে গেলো শূন্যে। কিন্তু প্রাসাদ কক্ষের ছাদেবাড়ি খেয়ে গিয়ে পড়লো একটা থামের গায়ে। আর প্রচণ্ড শব্দে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে ছড়িয়ে পড়লো নিচে মারবেলের মেজের ওপর। সারা ঘরাময় ছড়িয়ে গেলো ডালিমের দানা। নেকড়েটা তখন একটা মোরগ হয়ে সেই দানাগুলো খুঁটে খুঁটে খেয়ে ফেলতে লাগলো; এইভাবে একটা দানা বাদে সমস্তগুলোই খেয়ে নিলো। শেষ দানাটাও খাবে বলে ঠোঁটে করে তুলেছে এমন সময়, ভাগ্যের কি পরিহাস, ঠোঁট থেকে পিছলে পড়ে গেলো একখানা ফাটা মারবেলের ফাটলের মাঝখানে। ঠোঁটটা আর ঢোকাতে পারলো না মোরগ। তখন চিৎকার করে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। ঠোঁটটা নেড়ে চেড়ে কি যেন একটা বোঝাতে চাইলো। কিন্তু তার ইঙ্গিত অনুধাবন করতে পারলাম না আমরা। পরে বুঝেছিলাম, সে বোঝাতে চেয়েছিলো, তোমরা ঐ মারবেল-এর টুকরোটা তুলে দাও। আমি ঐ শেষ দানাটা খাবো। ওটা খেতে পারলেই আফ্রিদিকে পুরো হজম করে ফেলতে পারবো। কিন্তু ভবিতব্য কে খণ্ডাতে পারে। যা হবার তাই হবে। আমরা তার ভাষা বুঝলাম না। সে প্রচণ্ড শব্দে চিৎকার করতে লাগলো। তার চিৎকারে প্রাসাদটা দুলতে। থাকে। বুঝিবা এখুনি হুড়মুড় করে ধসে পড়বে আমাদের মাথায়।

মোরগটা ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে চলেছে মারবেলটার ওপর। এক সময় দেখা গেলো, মারবেলের ভাঙা একটা টুকরো তুলে ফেলে দিয়ে সেই শেষ দানাটা ঠোঁটে করে তুলে নিলো সে। কিন্তু কি ব্যাপার, বুঝতে পারলো না। ডালিমের দানাটা ছিটকে গিয়ে পড়লো চৌবাচ্চার জলে। আর সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেলো একটা মাছ। মোরগটা তার রূপ পালটে হলো পানকৌড়ি। চৌবাচ্চার জলে ডুব দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলে সে। প্রায় এক ঘণ্টা কেটে গেলো, পানকৌড়ি আর ওঠে না।

এক সময়ে প্রচণ্ড এক গোঙানীর শব্দে চমকে উঠলাম আমরা। দেখলাম, উথালি পাথাল করছে চৌবাচ্চার জল। এবার দেখলাম, আফ্রিদি তার আসল চেহারা নিয়ে উঠে আসছে। জল থেকে। তার শরীরটা এক জ্বলন্ত অঙ্গার। গানগনে আগুনের এক বিরাট চাই। সে কি ভয়াবহ দৃশ্য! তার নাক চোখ মুখ দিয়ে উদ্গিরণ হচ্ছিলো চিমনীর ধোঁয়া। তার পিছনে পিছনে শাহজাদীও উঠে। আসে। ঠিক আগের মতো এক রূপবতী যুবতী। কিন্তু তার দেহটাও লাল টকটকে। আগুনে দগ্ধ এক ধাতব মূর্তি।

ক্রমশ তারা দুজনেই আমাদের দিকে এগুতে থাকে। ভয়ে শিউড়ে উঠলাম। ঐ আগুনের প্রচণ্ড উত্তাপে ভষ্ম হয়ে যাবো আমরা। কি করবো কিছু ভাবতে পারছি না। পালাবার পথ নাই। ঠিক করলাম চৌবাচ্চার জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে এই আগুনের হাল্কা থেকে নিজেকে বাঁচাই। কিন্তু দেখলাম, আফ্রিদিটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। একমুহূর্ত। তারপর বিকট এক চিৎকার দিয়ে বাঁপিয়ে পড়লো-দরবার প্রাঙ্গণে-ঠিক আমাদের মাঝখানে। এক ঝলক আগুনের হোঙ্কা এসে লাগলো আমার চোখে মুখে। এমন সময় শাহজাদীর জুলন্ত দেহটা এসে জাপটে ধরলো আফ্রিদিকে। দুই অগ্নিপিণ্ডের সে উদ্দাম লড়াই। আগুনের উত্তাপ দ্বিগুণ হয়ে উঠলো। আফ্রিদির মুখ-নিঃসৃত একটা উষ্কার মতো আগুনের ফলা এসে ঘায়েল করে দিলো আমার এই বঁ। চোখটা। আর একটা হাল্কা এসে লাগলো সুলতানের থুতনীর কাছে। পুড়ে ঝলসে গেলো। নিচের ঠোঁটটা খসে ঝুলতে লাগলো। আর নিচের পাটির দাঁতগালো ঝুপ ঝুপ করে পড়ে গেলো মার্বেলের মেজের ওপর। আর একটা তির্যক আগুনের ফলা এসে বিধলো সেই হারেমের প্রধান খোজার বুকে। ব্যচারী। সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেলো সে।

এই সময়কালের মধ্যে আফ্রিদি আর শাহজাদীর যুযুৎসুর লড়াই চলছিলো। আফ্রিদি চেয়েছিলো আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সবাইকে জীবন্ত দগ্ধ করে ফেলতে। কিন্তু শাহজাদীর প্যাচে পড়ে আর এগুতে পারলো না সে। তাই আগুনের স্মৃলিঙ্গ নিক্ষেপ করে হত্যা করতে চেয়েছিলো সবাইকে। আমরা দুজনে অঙ্গহানির ওপর দিয়ে বেঁচে গেলাম। কিন্তু খোজাটা প্ৰাণ হারালো।

এমন সময় আর্তনাদ করে উঠলো আফ্রিদি। আল্লাহ, আমাকে তোমার কোলে টেনে নাও। তুমিই একমাত্র ভরসা। তুমি ছাড়া আমার অন্য কোন গতি নাই। জীবনে যতো পাপ করেছি—তার শাস্তি আমাকে পেতেই হবে। তোমার দেওয়া সব শাস্তি আমি মাথা পেতে নেবো, মালিক। তোমার পায়ের কাছে আমাকে একটু ঠাই দাও।

হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলো আফ্রিদির আর্তনাদ। পাহাড়ের মতো তার ঐ বিশাল জ্বলন্ত বপুটা লুটিয়ে পড়ে গেলো মার্বেলের মেজের উপর। আগুনের তেজ কমে আসতে লাগলো। একটু পরে একেবারে নিভে ছাই-এর পাঁজা হয়ে পড়ে রইলো তার দেহটা।

শাহজাদী এগিয়ে এলো আমাদের দিকে। বললো, শিগ্গির নিয়ে এসো এক গেলাস পানি।

জল এলো। সে বললো, আমার মুখের সামনে তুলে ধরো গেলাসটা। জলের গেলাসটা সামনে ধরতে বিড়বিড় করে কি সব দুর্বোধ্যমন্ত্র আওড়ালো খানিকটা। তারপর বললো পানিটা ছিটিয়ে দাও ঐ বাদরটার ওপর।

আমার গায়ে ছিটিয়ে দেওয়া হলো সেই মন্ত্রপুত জল। সেই সঙ্গে শাহজাদী পরিষ্কার আরবীতে বললো, সর্বশক্তিমান—একমাত্র পরমসত্য আল্লাহর দোয়ায় তুমি তোমার আগের চেহারায় ফিরে এসো।

তখনি, আমি আমার আসল রূপ ফিরে পেলাম। মানুষের রূপ। শুধু ফিরে পেলাম না। আমার বাঁ চোখটা—আগুনের হাল্কায় কানা করে দিয়েছিলো—।

আমার একটা চোখ নষ্ট হয়ে গেছে দেখে শাহজাদী দুঃখ করলো খুব। কি করবে বলো। আগুন যাকে স্পর্শ করবে তাকেই দহন করবে। এই তার ধর্ম। বাবার ঝলসানো পোড়া মুখটা দেখেও তার অন্তর মথিত হতে লাগলো।

তারপর শাহজাদী বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো। বিষাদ বিবশ কণ্ঠে বলতে লাগলো, আব্বজান, আমারও যাবার সময় হয়ে এলো, আল্লাহর দরবারে ডাক পড়েছে আমার। বিধিলিপি এড়ানো যায় না। না হলে, দৈত্যটা যখন ডালিমন্দানা হয়ে ঘরাময় ছড়িয়ে পড়লো আমি তার প্রতিটি দানাই পেটে পুরে নিয়ে ছিলাম—শুধু মাত্র একটি ছাড়া। ঐ দানাটা, আমার দুর্ভাগ্য, মার্বেলের ফাটলের মধ্যে আটকে গিয়েছিলো। ওটাকে যদি খেয়ে ফেলতে পারতাম।–তবে, সেই মুহূর্তে আফ্রিদির মৃত্যু ঘটতো। কিন্তু নিয়তি কে খণ্ডন করবে, বলো! না হলে সব দানা খেয়ে শেষ করলাম আর ঐ একটা দানাই বা ফসকে পড়ে যাবে কেন, মুখ থেকে। যাক, এ নিয়ে দুঃখ শোক করো না, আল্লাহর যা ইচ্ছা তাই হয়েছে, হবে।

একটু থেমে শাহজাদী আবার বলতে থাকে, আমার আর আফ্রিদির এই প্রচণ্ড লড়াইএ আগাগোড়াই আমি তাকে ঘায়েল করে গিয়েছি। আর প্রাণপণে আঘাত প্রতিরোধ করার চেষ্টামাত্র করে গেছে সে। পাল্টা আক্রমণ কোন সময়ই হানতে পারেনি। সে দিক থেকে এ লড়াই জয় আমার অবধারিত ছিলো। কিন্তু নিয়তি বড় নিষ্ঠুর-বড় নির্মম। জলে স্থলে অন্তরীক্ষে কোনও লড়াই—এই সে যখন সুবিধে করতে পারলো না তখন সে নিজেই বেছে নিলো শেষ মারণাস্ত্ব। অগ্নিকুণ্ডের দরজা খুলে ঝাপ দিলো সে। আমার হাতে মরতে তার পৌরুষ অহমিকায় বাধলো। কিন্তু আমার মাথায় তখন খুন চেপে গেছে। ওকে আত্মঘাতী হতে দেবো না আমি। নিজে হাতে খতম করবো, এই আমার জেদ। আর সে জন্যই কোন দিকে ভ্বক্ষেপ না করে আমিও সেই অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। টুটি চেপে তুলে নিয়ে এলাম ওপরে। নিজে হাতে খতম করবো তাকে—এই আমার তখন একমাত্র রোখি।

সবই নিয়তির পরিহাস, আব্বাজান। না হলে আফ্রিদি তো বিলকুল হেরে গিয়ে আত্মহত্যাই করতে গিয়েছিলো; আমি আবার কেন তার পিছে পিছে ধাওয়া করে সে আগুনে ঝাপ দিলাম। তার কোন দরকার ছিলো না। সে তো ঐ আগুনেই পুড়ে ছাই হয়ে যেত। কিন্তু এই রকমই ঘটতে হবে। এই আল্লাহর অভিপ্ৰায়। এ-ই বিধিলিপি! আল্লাহ তোমাকে রক্ষণ করুন। আমার ধ্যান জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ। তিনি ছাড়া আর কারও অস্তিত্ব আমি বিশ্বাস করি না। তাঁর সমকক্ষ দ্বিতীয় কেউ নেই। মহম্মদ আল্লার পয়গম্বর।

এই বলে মেজের ওপর লুটিয়ে পড়ে গেলো-শাহজাদী। আফ্রিদির দেহাবশেষের পাশে তার  নির্বাপিত দেহটাও পড়ে রইলো-একটা ছোট্ট ছাই-এর ডেলা হয়ে।

আমরা অনেক কাঁদলাম। এর চেয়ে আমার নিজের মৃত্যুই ভালো ছিলো। আমার মুক্তির জন্য তার আত্মাহুতি আমাকে দগ্ধ করতে লাগলো। কৃতজ্ঞতায় অন্তর ভরে গেলো।

লেড়কীর আকস্মিক মৃত্যুতে সুলতান কেঁদে আকুল হলেন। দু চোখের কোল বেয়ে হরদম পানি গড়াতে লাগল। নিজের কাজের জন্য বহুভাবে অনুশােচনা প্রকাশ করতে লাগলেন। কেন সে বানরকে মানুষের রুপে ফিরিয়ে দেওয়ার জনা আকুল হয়েছিলেন সে-কথাই বুক চাপড়ে বার বার বলতে লাগলেন।

সুলতানের দরবারে, প্রাসাদে আর প্রজাদের ঘরে ঘরে নেমে এল শােকের ছায়া। কারাে মনে সুখ নেই, নেই এতটুকু শান্তি।

সুলতানের এবার আমার ওপর নজর পড়ল। তিনি চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন – বাছা, তুমি আসাতেই আমার বুকের একটা পার খুলে গেল। যদিও আমার নসীবেরই ফের এটা, তবু তােমাকে বলছি, এ দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও তুমি বরং চলে যাও। আমার লেড়কী তো তার নিজের জান দিয়ে তোমাকে আফ্রিদি দৈত্য জারসিজ-এর হাত থেকে রেহাই দিয়ে, ফিরিয়ে দিয়েছে তােমার মনুষ্যরূপ। ব্যস, আর নয় তুমি আমার রাজ্য ছেড়ে অন্যত্র চলে যাও।’

দ্বিতীয় কালান্দার এবার বড় মেয়েটার দিকে ফিরে, চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল – বিশ্বাস করুন, আমার তখন নিজের ওপর খুব রাগ হল। আমার জন্য এমন তরতাজা প্রাণচাঞ্চলে ভরপুর একটা লেড়কী তাকালে জান দিল খােদাতাল্লার দরবারে এখন কি গুণাই না আমি করেছি! অনুশােচনার জালায় দগ্ধ হতে হতে আমি সুলতানের প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। এবার শুরু হল উদ্দেশ্যহীনভাবে পথ চলা। এভাবে এক সময় হাজির হলাম এ – বাগদাদ নগরে।

বাগদাদে নাকি কারাে কোনরকম দুঃখ নেই। দেশের ছােট -বড় প্রতিটা মানুষের জন্য এখানে যাবতীয় সুখের অঢেল ব্যবস্থা রয়েছে। এক সময় ফকিরের বেশে ক্লান্ত অবসন্ন দেহে বাগদাদের রাস্তা হাঁটতে হাঁটতে এখানে এলাম। দাড়ি – গোঁফ কামিয়ে ইতিমধ্যেই আমি বিলকুল কালান্দার ফকির বনে গিয়েছি। এখান থেকে অদূরবর্তী মােড়ের কাছে এসে আমারই মত আর এক কালান্দার ফকিরের সঙ্গে মােলাকাৎ হ’ল। তার দাডি – গোঁফ কামানাে, বাঁ চোখ কানা ! এবার তৃতীয় কালান্দার ফকিরকে দেখিয়ে বল্ল – একটু বাদে ইনি এসে আমাদের সঙ্গে মিললেন। তৃতীয় কালান্দার। তারও দাড়ি – গোঁফ কামান, আর বাঁ চোখ কানা।।

আমরা তিন কালান্দার মিলে পথ চলতে লাগলাম। এখানে এসে রাত্রের জন্য আশ্রয়ের খোঁজ করতে লাগলাম সামনে এ – বাড়িটা দেখতে পেয়ে কড়া নাড়লাম।

দ্বিতীয় কালান্দার ফকির বল্ল – আমার জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার কথা তাে শুনলেনই। আপনারা এবার যদি চান তৃতীয় কালান্দার কথার জীবনের ঘটনাবলী শুনতে পারেন।

 

তৃতীয় কালান্দার ফকিরের কিসসা

এবার তৃতীয় কালান্দার এগিয়ে এসে তার কাহিনী বলতে শুরু করে :

শুনুন মালকিন, মনে করবেন না, আমার কাহিনী ওদের দু’জনের চেয়ে আরও চমৎকার। তা নাও হতে পারে। তবে সত্যি ঘটনা-এটুকু বলতে পারি। কারণ এর সবই আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা।

ওদের দুজনের মতো আমারও বহু বিড়ম্বিত ভাগ্য। তবে ওদের দু’জনের মতো অতোটা না। আমার এই বঁ। চোখটা হারিয়েছি। একমাত্র আমার নিজের দোষে। এর জন্য অন্য কাউকে দোষ দিতে পারি না।

আমি এক বাদশাহ। আমার বাবাও ছিলেন বাদশাহ। আমার বাবা কাসিব যখন মারা গেলেন। আমি তখন সিংহাসনে বসি। আমার ন্যায়বিচারে প্রজারা খুব খুশি ছিলো আমার ওপর। ছোটবেলা থেকেই সমুদ্র যাত্রা আমার বড় প্রিয়। তার একটা কারণ বোধহয় আমার সলতানিয়তের প্রধান শহরটা ছিলো সমুদ্রোপকূলবর্তী। বহুদূরব্যাপী সমুদ্রের মধ্যেকার দ্বীপগুলো ছিলো আমার দখলে। দশখানা রণতরী সাজিয়ে মাসাধিককাল ধরে যাত্রা করতাম আমি। আমার অধিকৃত দ্বীপগুলো পরিদর্শনে যেতম। এই রকম একবার যাত্রাপথে দারুণ ঝড়ঝঞ্জার মুখোমুখি হতে হয়েছিলো আমাকে-সারাদিন সারারাত্রিব্যাপী। রাত্রি অবসান হলো। ঝড়ও থামালো। আবার হাসি ঝলমল দিন উপছে পড়লো। কিন্তু আমি দেখলাম, একটি ছোট্ট দ্বীপের চড়ায় এসে আটকে গেছে আমার জাহাজগুলো।

সমুদ্র তখন শান্ত অবোধ শিশুর মতোন। তার ঘন নীল জলে কাব্যের গন্ধ। কে বলবে গত রাত্রে সংহার মূর্তি ধারণ করেছিলো সে।

দিন দুই সেই দ্বীপে একটু জিরিয়ে নিলাম। তারপর পাল তুলে পাডি দিতে থাকলাম আবার। কুড়িদিন কেটে গেলো। তবু হারানো পথের নিশানা খুঁজে পেলাম না। তখন আমরা ভাসছি। এক অজানা সমুদ্রে। দিশাহারা পাখীর মতো। নীড়ের সন্ধান চাই।

কাপ্তেনকে জিজ্ঞেস করলাম, আর কত দূর? কোথায় এলাম আমরা?

উত্তর পেলাম, জানি না, বলতে পারবো না।

এ সমুদ্র পথ তার অচেনা। কখনও সে কোনও দিন আসেনি এই পথে। উপােয়ন্তর না দেখে একজন ডুবুরিকে নামিয়ে দিলাম জলে। কিছুক্ষণ বাদে সে ফিরে এলো। বললো, সমুদ্রের ওধারে বড় বড় মাছ দেখলাম অনেক। আরও দূরে দেখতে পেলাম একটা পাহাড়। তার খানিকটা অংশ সাদা আর খানিকটা কালো।

ডুবুরীর কথায় ডুকরে কেঁদে উঠলো কাপ্তেন—আর রক্ষা নাই। মৃত্যু অবধারিত। ডুবুরি যা দেখে এসেছে ওটা একটা মরণ-ফাঁদ-চুম্বক পাহাড়। পাহাড়টার গায়ে গাঁথা আছে হাজার হাজার চুম্বক লোহার বর্শা। আমাদের জাহাজ যতই তার কাছে যেতে থাকবে সেই চুম্বকের প্রচণ্ড আকর্ষণ হিড় হিডি করে টেনে নেবে। আর পাহাড়ের ধাক্কায় চুরমার হয়ে যাবে জাহাজগুলো। মৃত্যুর দিন ঘনিয়ে এসেছে আমাদের। এখন আল্লাহর নাম জপ করা ছাড়া আর কোন পথ নাই, জাঁহাপনা। আগামীকালই আমরা পাহাড়ের দুর্বর আকর্ষণে প্রাণ হারাবো। সবাইকেই মরতে হবে। কেউ বাঁচতে পারবে না। এ পর্যন্ত যত নাবিক পথ হারিয়ে এই পাহাড়ের আকর্ষণ-আওতায় গিয়ে পড়েছিলো তারা কেউই ফেরেনি। আমাদেরও আর ফেরা হবে না।

কাপ্তেনের দুগাল বেয়ে বয়ে চলেছে জলের ধারা। অসহায় শিশুর মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে সে। কঁদিতে কঁদিতেই আবার বলে, ঐ পাহাড়ের চূড়ায় একটা গম্বুজ আছে। দশটা পিতলের খুঁটির উপরে সেই গম্বুজ। আর গম্বুজের উপরে রয়েছে এক ঘোড়-সওয়ার। ব্রোঞ্চের তৈরি। এক হাতে ঢাল অন্য-হাতে তারোয়াল। দেহে বৰ্ম, মাথায় শিরস্ত্ৰাণ-রণসাজে সজ্জিত এক যোদ্ধা। সীসার ফলকে উৎকীর্ণ করা এক দৈববাণী-আঁটা আছে তার বুকে। শুনুন শাহজাদা, লোকে বলে, ঐ পাহাড়ের চুড়ায় যতদিন ঐ ঘোড়সওয়ার ঐ ভাবে অবস্থান করবে ততদিন কোন জাহাজের নিস্তার নাই। তার আকর্ষণ-আওতার মধ্যে পড়লেই প্রচণ্ড বেগে টেনে নিয়ে খান খান করে দেবে। এইভাবে কত যে জাহাজ টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, কত শত সহস্ব নাবিক প্ৰাণ হারিয়েছে তার ইয়ত্ত নাই। ঐ ঘোড়সওয়ারকে ওখান থেকে ফেলে দিতে না পারলে এমনি ধ্বংসের তাণ্ডব চলতেই থাকবে।

মৃত্যুর আশঙ্কায় কাপ্তেনের দেহে কঁপুনি ধরে যায়। আমরাও সকলে ভয়ে আঁতকে হিম হয়ে যাই। মোউৎ অনিবার্য। তার কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া ভিন্ন পথ নাই। হায় আল্লাহ, কী এমন পাপ করেছিলাম, যার জন্যে বিদেশ-বিভুঁই-এ এইভাবে বেঘোরে জানি কবুল করতে হচ্ছে।

পরদিন প্রত্যুষে কাপ্তেন জানালো, সেই কোষ্ঠী-কালো চুম্বক-পাহাড়ের কাছে এসে পড়েছি আমরা। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে জাহাজগুলো ভেঙে গুডিয়ে যাবে। আল্লাহর নাম নাও সবাই!

প্রচণ্ড শব্দে জাহাজগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। উত্তাল ঢেউ-এর প্রলয় নাচনের মধ্যে পড়ে কে যে কোথায় হারিয়ে গেলাম কিছুই ঠাওর করতে পারলাম না। কে মরলো, আর কে বেঁচে থেকেও মৃত্যুর সঙ্গে যুঝতে লাগলো তার কোনও হদিশই করতে পারলাম না।

সারাটা দিন অশান্ত ঢেউ-এর মুখে মুখে ওঠা-নমা করতে করতে নাম-না-জানা ঠিকানার উদ্দেশে ভেসে চলেছি-যারা বেঁচে আছি তখনও। সে কি দুর্যোগ, সে কি নিদারুণ ঝড়ঝঞঝা! এলোপাথাড়ী হাওয়ার দাপটে উত্তালতরঙ্গমালা ভেঙেচুরে প্রচণ্ড জলোচ্ছাস-এ পরিণত হতে লাগলো। আর কিছু মনে নাই। অজ্ঞান হয়ে গেছি।

রাখে কৃষ্ণ মারে কে? আল্লাই বঁচালেন সে যাত্রা। যখন জ্ঞান ফিরলো দেখি, সেই পাহাড়টার নিচে এক বালির চুড়ায় আটকে আছি আমি। জলোচ্ছাসের প্রচণ্ড আঘাতে মরিনি, হাঙর কুমীরেও খায়নি, আশ্চর্য! সবই আল্লাহর দোয়ায়।

উঠে দাঁড়ালাম। দেখলাম, সামনেই একটা পথ, সোজা উঠে গেছে পাহাড়ের মাথায়। খোদা ভরসা করে উপরে উঠতে লাগলাম।

এই সময় রাত্রি ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

পরদিন পঞ্চদশ রজনী

শাহরাজাদ গল্প শুরু করে :তৃতীয় কালান্দার তার জীবন কাহিনী বলে চলেছে। আর শুনছে সেই তিন বোন, কুলি আর সেই সাতজন সশস্ত্র নিগ্রো-প্রহরী।

আল্লাহর কি অপার মহিমা, আমি যখন সেই খাড়াই পথ বেয়ে পাহাড়ের মাথায় উঠে চলেছি তখন হঠাৎ হাওয়ার দিক পরিবর্তন হয়ে গেলো। এবং এই হাওয়ার আনুকূল্যে তরতর করে উঠে যেতে পারলাম ওপরে। বিপরীতমুখী হাওয়ার বেগ অগ্রাহ্য করে। এ-পথ বেয়ে এক পাও এগুনো সম্ভব নয় কোন মানুষের।

যাই হোক, উপরওয়ালার কৃপায় উপরে উঠে এসে সেই গম্বুজের নিচে এসে দাঁড়ালাম। আনন্দে আমার শরীর তখন কাঁপছে।

সারা দিনের শ্রান্তিতে অবশ্য অবসন্ন হয়ে এলো শরীর। গম্বুজের নিচে-যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম। সেখানেই—শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যেই শুনতে পেলাম, এক দূরাগত কণ্ঠের বাণী-শোনো কাসিবের পুত্র, ঘুম থেকে জেগে উঠে তোমার পায়ের ঠিক তলায় গর্ত খুঁড়ে দেখো, একখানা তীর আর ধনুক পাবে। এই তীরন্ধনুকটা দৈবশক্তিসম্পন্ন। তারপর ঐ ধনুকে তীরটা জুড়ে গম্বুজের মাথার ওপরে ঐ ঘোড়সওয়ারকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দাও। তাহলে ব্রোঞ্জের ঘোড়সওয়ারটা সমুদ্রে পড়ে নিমজ্জিত হয়ে যাবে। দুনিয়ার মানুষ পরম উপকৃত হবে চিরকালের মতো। সঙ্গে সঙ্গে তোমার হাত থেকেও খসে পড়ে যাবে ধনুকটা। যে গর্ত খুঁড়ে তুলেছিলে সেই গর্তেই ধনুকটা রেখে মাটি চাপা দিয়ে দিও। এর পর সামনে তাকালে দেখতে পাবে, সমুদ্রের জল ফুলে উঠছে। ফুলতে ফুলতে এক সময় দেখবে, তোমার পায়ের তলার পাহাড়ের চুড়া-সমান হয়ে গেছে। এই সময় দেখবে, একটা ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকা বেয়ে আসছে একটা লোক। তোমারই দিকে। কাছে এলে পরিষ্কার মনে হবে, সেই ঘোড়সওয়ার—অবিকল তার চেহারার সঙ্গে মিল আছে এই ডিঙ্গির লোকটার। আসলে কিন্তু তা ঠিক না। নৌকোটা আরও কাছে এলে দেখবে, মরার মাথার খুলিতে ভর্তি নৌকের পাটাতন। ভয় পেয়ো না। তোমাকে নিরাপদে সাগর পার করে দেবার জন্যেই সে আসবে। সেই রূপই নির্দেশ দেওয়া আছে তাকে। কিন্তু সাবধান, তার নৌকোয় উঠে। ভুলেও কখনও আল্লাহর নাম মুখে এনে না। নৌকোয় উঠলে সে একটানা দশ দিন সমুদ্র পাডি দিয়ে তোমার দেশের চেনা শান্ত নিরাপদ সমুদ্র এলাকায় পৌঁছে যাবে। সেখানে দেখবে সওদাগরের এক নৌকে। তারা তোমাকে তুলে নিয়ে তোমার গন্তব্যস্থানে পৌঁছে দেবে। কিন্তু আবারও বলছি, ভুলেও কখনও তাদের সামনে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করবে না।

ঘুম ভেঙে গেলো। খোয়াব কেটে গেলো। উঠে দাঁড়ালাম। পায়ের তলার মাটি খুঁড়ে পেলাম সেই ধনুক আর তীর। ধনুকে তীর জুড়ে ঘোড়সওয়ারকে লক্ষ্য করে ছুড়লাম। প্রচণ্ড এক শব্দে নিচে সমুদ্রের জলে পড়ে গেলো মূর্তিটা। আর তৎক্ষণাৎ দেখলাম, সমুদ্র এক ভীষণ রূপ ধারণ করছে। টগবগ করে ফুটতে লাগলো অনন্ত জলরাশি। ফুসতে ফুসতে ফুলতে ফুলতে ক্রমশ পাহাড়ের সমান উঁচু হয়ে গেলো। দেখলাম দূরে একখানা ছোট নৌক বেয়ে নিয়ে আসছে একটি লোক। হুবহু যেমনটি দেখেছিলাম স্বপ্নে, সেই রকম সব ঘটে যেতে লাগলো। নৌকোটা কাছে আসতে লোকটাকে দেখলাম, ঠিক ঐ ঘোড়সওয়ারের মতো। কিন্তু স্বপ্নে জেনেছিলাম, দেখতে এক রকম হলেও ওরা এক না। আমার হাত থেকে ধনুকটা খসে পড়ে গেছে মাটিতে। ঐ গর্তাটায় রেখে মাটি চাপা দিয়ে উঠে দাঁড়লাম। নৌকোটা ততক্ষণে আরও কাছে—একেবারে আমার সামনে এসে থেমে গেছে। দেখলাম, লোকটার এক হাতে অনেকগুলো মড়ার মাথার খুলি। আর কি আশ্চর্য, যদিও নৌকো বাইছে, লোকটা কিন্তু রক্তমাংসের মানুষ না। পিতলের তৈরি এক মানুষের মূর্তি। তার বুকে আঁটা এক সীসার ফলক। তাতে উৎকীর্ণ করে লেখা আছে এক দৈববাণী।

আমি কোন কথা না বলে নৌকোয় উঠে বসলাম। সেই পিতলের মানুষটা বেয়ে চললো নৌকোটা। এক-দুই-তিন। এইভাবে দশটা দিন কেটে গেলো। অবশেষে দেখলাম, আমাদের দেশের চেনাজােনা সমুদ্রে এসে পড়েছি। আনন্দে উল্লাসে আমি তখন আত্মহারা। আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললাম, আল্লাহ তোমার মহিমা অপাের। তোমার দোয়াতেই আমি আমার জীবন ফিরে পেয়েছি, আজ আমার নিজের দেশের মুখ দেখতে পেয়েছি। তুমি সর্বশক্তিমান একমাত্র ঈশ্বর। তোমাকে ছাড়া অন্য কোন অলৌকিক শক্তিতে আমার আস্থা নাই। তুমিই একমাত্র পথ।

আমার মুখের কথা মুখেই রয়ে গেলো। দেখলাম, সেই পিতলের মূর্তিটা বাঁ হাত দিয়ে তুলে সমুদ্রের জলে ছুঁড়ে দিলো আমাকে। তারপর নৌকোটা নিয়ে নিমেষে উধাও হয়ে গেলো কোথায়!

আমি খুব ভালো সাঁতারু। সমুদ্রের নীল জলে গা ভাসিয়ে দিলাম। এইভাবে সারাটা দিন কেটে গেলো। আমার হাত পা অবশ হয়ে আসতে লাগলো। ভয় হলো, এবার মৃত্যু অনিবাৰ্য। আল্লাহর নাম স্মরণ করতে লাগলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। এমন সময় মসজিদ চুড়ার মতো উচু উত্তাল ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে চললো আমাকে। সমুদ্র-কূলের দিকে। তারপর এক সময় অনুভব করলাম, আমাকে তীরে ছুঁড়ে দিয়ে ঢেউটাি আবার সমুদ্রে ফিরে গেছে। বুঝলাম এও তারই এক মহিমা।

সমুদ্র সৈকতে উঠে এসে জামাকাপড় খুলে শুকাতে দিয়ে বালির ওপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে উঠে শুকনো জামাকাপড়গুলো পরে সামনে চেয়ে দেখি, এক সবুজ শস্যক্ষেত্ব। আনন্দে নেচে উঠলো মন। এপাশ ওপাশ চক্কর দিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। যেদিকে তাকাই শুধু জল আর জল আর জল। সমুদ্রের মধ্যে ছোট্ট একটা দ্বীপে দাঁড়িয়ে আছি আমি।

একটা জায়গায় বসে পড়লাম। আমার অধম অদৃষ্টের কথা চিন্তা করতে লাগলাম। নিজেকে এক হতভাগা বলে মনে হতে লাগলো! একটা ভুলের জন্যে এতো কষ্ট সহ্য করতে হলো আমাকে। ঠিক করলাম, এবার থেকে দেখে শুনে সাবধানে চলতে হবে। অদৃষ্ট যখন সাধ দিচ্ছে না। তখন, যখন-তখন বিপদ-আপদ আসতে পারে।

এমন সময় নজরে এলো, একখানা জাহাজ এই দিকেই আসছে। না জানি, আবার কোন বিপদ হয়, এই ভেবে একটা গাছের উপর উঠে গিয়ে নিজেকে আড়াল করে নিলাম পাতায় ঢেকে। জাহাজটা এসে নোঙর করলো। জনা দশেক নফর নামলো। সবাইর হাতে একখানা করে মাটিকাটা কোদাল। ওরা ঐ শস্যক্ষেত্রের এক পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। কি যেন একটা খুঁজতে লাগলো। তারপর একটা জায়গায় মাটি কেটে গর্ত করতে থাকলো। আমি গাছের ডালে বসে দেখলাম, খানিকটা গর্ত করার পর একটা গুপ্ত দরজার সন্ধান পেলো তারা। দরজার পাল্লা খুলে ফেললো। এরপর আবার তারা ফিরে গেলো জাহাজে। নানারকম দামি দামি খাবার দাবার মাথায় নিয়ে জাহাজ থেকে নেমে এলো! গুপ্তদরজা দিয়ে নিচে নেমে গিয়ে সামানগুলো রেখে আবার ফিরে গেলো জাহাজে। আবার নিয়ে এলো সাজপোশাক ইত্যাদি। এইভাবে নানারকম জিনিসপত্তর নামিয়ে রেখে এলো মাটির নিচের সেই ঘরে। মোট কথা, একটা খানদানি পরিবারে যা যা দরকার তার সবকিছুই ছিলো তার মধ্যে। তারপর জাহাজ থেকে নেমে এলো জরাবার্ধক্যে জীর্ণ এক থুরথুরে বৃদ্ধ—একটা ফুটফুটে কিশোরের হাত ধরে। পিছনে পিছনে নফরগুলো। তাদের হতে মণিমুক্তা-খচিত সূক্ষ্মকারুকার্যকরা বাদশাহী শাল। ওরা সবাই সেই গুপ্ত দরজা দিয়ে নিচে নেমে গেলো। কিছুক্ষণ বাদে সেই ছোট্ট কিশোর বালকটি ছাড়া আর সবাই উঠে এসে জাহাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো।

জাহাজটা যখন অনেক দূরে চলে গেছে, গাছ থেকে নামলাম আমি। ঐ জায়গাটায় গিয়ে মাটিগুলো সরিয়ে গুপ্ত দরজাটা খুলে ফেললাম। পাথরের তৈরি সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলাম নিচে। এক সুরম্য অট্টালিকা।একটু এগোতেই চোখে পড়লো, দামি মখমলের পর্দা দেওয়া একটা দরজা। পর্দা সরিয়ে ভিতরে পা রাখতে সাহস হলো না। ঝকঝকে তকতকে আনকোরা বহু মূল্যবান পারস্য গালিচায় প্রকাণ্ড ঘরটার পুরো মেজেটা মোড়া। সুন্দর সুন্দর সোফা কোচ, টেবিল আলমারীতে চমৎকার সাজানো গোছানো ঘরটা। মাথার উপরে কারুকার্যখচিত ঝাড়বাতি। টেবিলের উপর সাজানো সুন্দর কাজ-করা এক ফলের বাঁপি আর মিঠাই মণ্ডার রেকবী। তার মাঝখানে প্রকাণ্ড এক ফুলদানী ওপাশে সোনার পালঙ্কে বসে সেই কিশোর বালক সোনার পাখায় হাওয়া খাচ্ছে। আমাকে দেখা মাত্র ভয়ে আঁৎকে উঠলে সে। আমি তাকে অভয় দিয়ে বললাম, কোন ভয় নেই, বন্ধু। আমিও মানুষ-এক বাদশাহর ছেলে। এবং নিজেও আমি বাদশাহ, আমি তোমার কোন ক্ষতি করতে আসিনি। বরং তোমাকে মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করতে এসেছি। ওরা তোমাকে এই পাতালপুরীতে রুদ্ধ করে হাওয়া হয়ে গেলো। এখান থেকে কোন ভাবেই তুমি বেরিয়ে বাঁচতে পারবে না। তাই আমি তোমাকে বাঁচাতে এলাম।

আমার কথা শুনে কিশোর একটু হাসলো! কি সুন্দর তার ঠোঁটের হাসি। যেন মুক্তো ঝরে। পড়লো। তার আয়ত চোখ, উন্নত নাসিক, প্রশস্ত ললাট দেখে মনে হয়, এক খানদানী বংশের ছেলে সে। ইশারায় তার পাশে গিয়ে বসতে ডাকলো আমাকে —শুনুন মালিক, ওরা আমাকে এখানে ছেড়ে পালিয়ে যায়নি। আমার মৃত্যুও তাদের আদৌ কাম্য নয়। বরং ঠিক তার উল্টো। মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যেই ওরা আমাকে লোকচক্ষুর অগোচর এই পাতালপুরীতে লুকিয়ে রেখে গেলো।

তুমি হয়তো আমার বাবার নাম শুনে থাকবে। তামাম দুনিয়ার মধ্যে সব চেয়ে সেরা জহুরী আমার বাবা। তার মতো ধনী লোক বোধহয় খুব কমই আছে। দুনিয়ার এমন কোন সুলতান বাদশাহ নাই যার কাছে আমার বাবা হীরে-জহরৎ বিক্রী করেনি। তার খ্যাতি নাম জগৎজোড়া। বাবার বৃদ্ধ বয়সের সন্তান আমি।

আমার জন্মের সময় এক সিদ্ধবাক গনৎকার বলেছিলো, এই শিশু তার পিতামাতার জীবদ্দশাতেই মারা যাবে। এর বয়স যখন পনেরো হবে সেই সময় বাদশাহ কাসিবের পুত্রের হাতে এর মৃত্যু ঘটবে।

গণৎকার আরও বিস্তারিত বিবরণ রেখে গেছেন। এক সময় বাদশাহ কাসিবের পুত্র সমুদ্র যাত্রায় জাহাজ ডুবি হয়ে এক কষ্টি-পাথর পাহাড়ে গিয়ে উঠবে। সেই পাহাড়ের চুড়ায় এক পিতলের ঘোড়সওয়ারকে সমুদ্রের জলে ফেলে দিয়ে চিরকালের মতো হাজার হাজার নাবিকের প্রাণ বাঁচাবে।

আমার বাবা এই পনেরো বছর ধরে আমাকে খুব সাবধানে চোখে চোখে রেখে মানুষ করেছে। কয়েক দিন হল খবর ছড়িয়ে পড়েছে কাসিবের পুত্র সেই পাহাড়ে উঠে পিতলের ঘোড়সওয়ারটাকে জলে ফেলে দিয়েছে। এই খবর শোনার পর থেকে আমার মা-বাবার চোখে ঘুম নাই। এই কাঁটা দিনের মধ্যে আমার বাবার শরীর বার্ধক্যে একেবারে ভেঙে পড়েছে। দেখলে চেনা যায় না, এমন। আমার মা কেঁদে অন্ধ হয়ে গেছে। নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।

গণৎকারের ভবিষ্যৎবাণী শোনার পর থেকেই বাবার চিন্তা, কি করে আমাকে কাসিবের পুত্রের হাত থেকে রক্ষা করবে। অনেক ভেবে চিন্তে শেষে এই নির্জন দ্বীপে মাটির তলায় এই প্রাসাদপুরী বানিয়ে রেখেছে সে। পনেরো বছর বয়সের সময় যাতে সে লোকচক্ষুর আড়ালে এখানে এনে আমাকে লুকিয়ে রাখতে পারে। কাসিবের পুত্র সেই পিতলের শীঘোড়সওয়ারকে জলে ফেলে দিয়েছে। তাই আজ আমাকে সে এখানে লুকিয়ে রেখে গেলো। গণৎকারের ভবিষ্যৎ বাণীতে বলা হয়েছিলো, ঘোড়সওয়ারকে জলে ফেলে দেবার চল্লিশ দিনের মধ্যে এই ঘটনা ঘটবে। তাই বাবা আমাকে চল্লিশ দিনের জন্য এখানে লুকিয়ে রেখে গেলো। বাবার এবং আমার নিজেরও বিশ্বাস, এই দূরধিগম্য পাতালপুরীর সন্ধান কিছুতেই পাবে না সে।

রাগে কাঁপতে লাগলো আমার শরীর। কী মিথ্যেবাদী, ভণ্ড এই সব গণৎকারগুলো। নিরীহ মানুষের মনে এরা আতঙ্ক জাগিয়ে তোলে। ওই ব্যাটাদেরই খুন করা দরকার। এমন সুন্দর ফুলের মতো এক কিশোর-নিষ্পাপ নির্মল—তাকে কিনা আমি হত্যা করবো। গাঁজাখুরি বানানো একটা গল্পো শুনিয়ে ভয় ধরিয়ে দিয়ে গেছে। এদের মনে। এই বালকের জীবন রক্ষার জন্যে, যদি প্রয়োজন হয়, আমার জীবনও তুচ্ছ করে দিতে পারি। শয়তান গণৎকারটাকে-পেলে একবার শুনিয়ে দিতাম। সে কথা। গলা চড়িয়ে বেশ জোরেই বললাম, শোনো বাছা, উপরে আল্লাহ আছেন। তোমার মতো একটা ফুলের কুড়িকে ছিড়ে ফেলবে কেউ, তা তিনি কিছুতেই হতে দেবেন না। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, সে যেই হোক, তোমাকে যে হত্যা করতে আসবে তাকে আমি হত্যা করবো আগে। আমাকে না মেরে তোমাকে ছুঁতে পারবে না কেউ। আমি তোমার পাহারায়, তোমার সঙ্গে বাস করবো। এই চল্লিশ দিন। দেখি, কে তোমাকে মারে। তারপর চল্লিশ দিন কেটে গেলে, তোমার বাবার অনুমতি নিয়ে তোমাকে সঙ্গে করে আমার দেশে যাবো আমি। তুমি হবে আমার প্রাণের বন্ধু। তোমাকেই আমি বসিয়ে যারো আমার সিংহাসনে।

জহুরীর ছেলে খুশী হলো খুব। বিনীতভাবে ধন্যবাদ জানালো আমাকে। আমার উপর তার গভীর আস্থা লক্ষ্য করে আনন্দ হলো মনে।

অনেক গল্প কাহিনী শোনালাম তাকে। সেও শোনালো। খুশিতে ভরে গেলো আমাদের মন। নানারকম খানাপিনা করলাম। এতো খাবার দাবারে ঘর ভর্তি যে, শখানেক লোক সারা বছর ধরে খেয়েও তা ফুরাতে পারবে না।

আমার ব্যবহারে মুগ্ধ হলো কিশোর। তাকে যে আমি গভীর ভালোবাসার চোখে দেখছি সে কথা বুঝতে বেশী দেরি হলো না তার।

সারা রাত বেশ নিশ্চিন্তে ঘুমুলো সে। আমিও। সকালে উঠে হাত মুখ ধুয়ে দুজনে নাস্তা করলাম। তারপর নানারকম মজার মজার কিসসা শুনালাম তাকে। খেলাধুলা করলাম অনেকক্ষণ ধরে। তারপর সুগন্ধী আন্তর দেওয়া জলের চৌবাচ্চায় অবগাহন করে গোসল করলাম আমরা। দুপুরের খানাপিনা সেরে একটু বিশ্রাম করে আবার শুরু হলো আমাদের গল্প, খেলা। রাত্ৰিবেলায় পরিপটি করে বিছানা পেতে দিলাম তাকে। দুজনে একসঙ্গে বসে মাংস রুটী, মাখন, ফল, দুধ, মধু, মিঠাইমণ্ডা দিয়ে রাতের আহার শেষ করে ঘুমিয়ে পড়লাম।

দিনের পর দিন এইভাবে খেলাধূলা, হাসি-হুল্লোড়ের মধ্যে দিয়ে কেটে যেতে লাগলো। তার মা-বাবার আদর্শন, তার মরণভীতি, সব ভুলিয়ে দিলাম আমার বন্ধু-সুলভ ব্যবহার দিয়ে, আমার আন্তরিকতা দিয়ে। এইভাবে কি করে যে চল্লিশটা দিন কেটে গেলো আমিও টের পাইনি, সেও বুঝতে পারেনি।

সেদিন সে ফিরে যাবে তার দেশে। তার বাবা আসবে তাকে নিয়ে যেতে। সকালে উঠেই এক হাঁডি গরম জল বসালাম। গরম জল-ঠাণ্ডা জলমিশিয়ে খুব আচ্ছা করে ঘসে মেজে স্নান করালাম তাকে নিজের হাতে। খুব ভালো করে দামি সাজপোশাকে সাজালাম। আতরের খুশবু ছড়িয়ে দিলাম। তার গায়ে।

পালঙ্কের ওপর শুয়ে শুয়ে সে ভাবছে, বাবা আসবে। সে চলে যাবে। আর আমি ভাবছি। এ ক’দিনের দোস্ত, আবার কোথায় হারিয়ে যাবে। মনটা বেশ খারাপ হয়ে যায়।

তন্ময় হয়ে কি ভাবছে দেখে আমি কথা বললাম, কিগো সাহেব, কি খাবে বলো?

ছেলেটা বললো, তরমুজ খাবো।

একটা বড়সড়ো পাকা তরমুজ নিয়ে এলাম। পালঙ্কের ওপাশের দেওয়ালে টাঙানো ছিলো একখানা ছুরি। তরমুজটা কাটবো বলে ছুরিটা নামিয়ে আনার জন্যে উঠে দাঁড়ালাম পালঙ্কের ওপর। কাঁটায় ঝোলানো ছুরিটা খুলে হাতে নিয়েছি। এমন সময় ঘটলো সেই কাণ্ডটা। ছেলেমানুষের খেয়াল, দুষ্টুমীতে ভরা মন। আমি যখন নাগালের খানিকটা ওপরে ঝুলানো সেই ছুরিটা হাতের মুঠোয় খুলে নেবার জন্য করসৎ করছি তখন তা দেখে হয়তো বা শিশু-সুলভ সারল্যে মজা অনুভব করেছিলো ছেলেটা। আমার উঁচু হয়ে যাওয়া পায়ের গোড়ালীতে সুড়সুডি দিলো। ঐ অবস্থায় আমার কি দশা হয় তাই দেখার মজায় পেয়ে বসেছিলো তাকে। অতর্কিতে তার কাতুকুতুর জন্যে আদৌ প্রস্তুত ছিলাম না আমি। চমকে উঠে পােটা সরিয়ে নিতে গিয়েই শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে হুমডি খেয়ে পড়ে গেলাম ছেলেটার ওপর। চিৎ হয়ে শুয়েছিলো সে। আমার হাতের শানিত ছোরা আমূল বিদ্ধ হয়ে গেলো তার বুকে। আর সঙ্গে সঙ্গেই তার মৃত্যু হয়ে গেলো আমারই হাতের উপর।

মালকিন, তখন আমার কি অবস্থা একবার কল্পনা করুন। আমি প্রায় উন্মাদ হয়ে গেছি। নিজের জামাকাপড় নিজেই ছিড়ে কুটিকুটি করতে লাগলাম। কেঁদে গড়াগডি দিচ্ছি, হাত-পা চূড়ছি, চোখের জলে বন্যা বয়ে চলেছে। হায় আল্লাহ একি হলো। একি করলাম আমি। কি এমন পাপ আমি করেছিলাম, যার জন্যে এই শোক অনুতাপে পুড়তে হলো আমাকে! না, একেই বলে নিয়তি!! একটা দিন পরে হলেও গণৎকারের ভবিষ্যৎবাণীই তো সত্যি হলো। আল্লাহ তুমি আমাকে শাস্তি দাও। আমি মাথা পেতে নেবো। এ জীবন আমি আর রাখতে চাই না। আমাকে মৃত্যু দাও। আমি মরতে চাই।

ছেলেটার বাবা বৃদ্ধ জহুরী আসবে সন্ধ্যাবেলা। কি করে তার সামনে দাঁড়াবো আমি। কি ভাষায় সান্তুনা দেব তাকে। না-না, আমি পারবো না। পুত্রশোকের সেই নিদারুণ দৃশ্য আমি নিজের চোখে কিছুতেই দেখতে পারবো না। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলাম। গুপ্ত দরজা বন্ধ করে মাটি চাপা দিয়ে গর্তটা বুজিয়ে দিলাম।

মুক্ত আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে ভাবলাম, এখন কি করা যায়। কোন জায়গায় লুকিয়ে থেকে সমস্ত ব্যাপারটা প্রত্যক্ষ করতে হবে। তা না হলে, ঐ নফরগুলো আমাকে দেখতে পেলেই খুন করে ফেলবে।

সেই গাছটায় উঠে গেলাম। একটা ডালে পাতার আড়াল করে বসে রইলাম। খণ্টাখানেক বাদে সেই জাহাজটা এসে ভিড়লো। নেমে এলো সেই দশজন নফর আর সেই বৃদ্ধ জহুরী। হন হন করে এগিয়ে এলো আমার গাছের নিচে। গুপ্ত দরজার জায়গাটায় চোখ পড়তে ভয়ে শিউরে উঠলো তারা। একি, গর্তের মাটি তো মনে হচ্ছে। সদ্য সরানো হয়েছিল। তবে? তবে কি বাছা আমার বেঁচে নাই। জহুরী চিৎকার করে ওঠে, তোমরা হাঁ করে দাঁড়িয়ে কি দেখছে? চটপট মাটি সরাও। দরজা খুলে নিচে যাও। নিয়ে এসো আমার জানের কলিজাকে।

নফরগুলো অনায়াসেই সদ্য বুজানো মাটিগুলো সরিয়ে ফেলে নিচে নেমে গেলো। গাছের উপরে বসে সব দেখতে লাগলাম আমি। ছেলের নাম ধরে তারস্বরে ডাকতে লাগলো বৃদ্ধ। কিন্তু কে উত্তর দেবে! সে তো বেঁচে নাই। আমার হাতের ছুরি তার বুকে বিদ্ধ হয়ে গেছে। সোনার পালঙ্কে ঘুমিয়ে আছে সে। সে-ঘুম আর কোনদিন ভাঙ্গবে না তার।

নফররা এসে বৃদ্ধিকে নিচে নিয়ে গেলো। সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে তার যে কি অবস্থা আমি গাছের ডালে বসেই তা অনুমান করতে পারলাম। একটু পরে নফরগুলো ধরাধরি করে বৃদ্ধর অচৈতন্য দেহটা উপরে নিয়ে এসে গাছের তলায় শুইয়ে দিলো। চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিতে দিতে জ্ঞান ফিরে এলো তার। ছোট শিশুর মতো চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো। সে দৃশ্য আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিলো, এখনি বুঝি নিচে পড়ে যাবো। এর পর নফরগুলো নিচে নেমে গিয়ে ছুরিবিদ্ধ কিশোরকে উপরে নিয়ে এলো। পাশেই একটা জায়গায় কবর খোঁড়া হলো। কবরের তলায় তার মৃতদেহটা শুইয়ে দিয়ে মাটি চাপা দিলো তারা। তারপর পাতালপুরীর সামানপত্তর সব জাহাজে তুলে নিয়ে চলে গেলো।

আমি গাছ থেকে নিচে নোমলাম। সেই ছোট্ট দ্বীপটার চারদিকে চক্কর দিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। চারদিকে অনন্ত জলরাশি। যতদূর চোখ যায়, তীরের সন্ধান নাই। অথচ তীরের সন্ধান চাই। কেঁদে কেঁদে দিন কাটে। গাছের ফল খাই, গাছের তলায় শুই। দেশে ফেরার আশা প্ৰায় ছেড়েই দিয়েছি। এমন সময় একদিন দেখলাম সমুদ্ব শুকিয়ে যাচ্ছে ক্বমশঃ অবাক কাণ্ড!! এমনও আবার হয় নাকি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দেখলাম, জল সরে গিয়ে বালির চড়া পড়ে গেছে। যত দূর চাই শুধু ধুধু করা বালি। হাঁটতে হাঁটতে দিন শেষ হয়ে এলো। দেখলাম, শক্ত মাটির আসল তীরে পৌঁছে গেছি আমি। কৃতজ্ঞতায় মাথা নত হয়ে এলো তার উদ্দেশে।

মাঠের পথ বেয়ে হেঁটে চলেছি। এমন সময় দেখলাম, দূরে এক লাল আগুনের শিখা। মনে আশা হলো, কাছেই কোনও লোকালয় আছে। হয়তো বা কেউ ভেড়া পোড়াচ্ছে! কিন্তু কাছে আসতে ভুল ভাঙ্গলো। অবাক হয়ে দেখলাম, এক বিরাট প্রাসাদ। আর গোটা প্রাসাদটাই পিতলের তৈরি। সূর্যাস্তের লাল আভা এসে পড়েছে পিতলের উপর। তাই মনে হচ্ছে, গানগনে আগুনের এক কুণ্ড জুলছে।

প্রাসাদের সামনে দাঁড়াতেই দশজন যুবক এসে দাঁড়ালো প্রাসাদের সিংহ দরজায়। তারা সবাই সুঠাম দেহী সুন্দর সুপুরুষ। কিন্তু সবারই বাঁচোখ কানা—ঠুলি পরা। তাদের পাশে এসে দাঁড়ালো এক অশীতিপর বৃদ্ধ। জরা বার্ধক্যে গায়ের চামড়া ঝুলে পড়েছে। কিন্তু দেখলে বোঝা যায়, যৌবনে এক রূপবান পুরুষ ছিলো সে। আটজন সঙ্গী নিয়ে এগিয়ে এলো বৃদ্ধ। শুধু দুজন দাঁড়িয়ে রইলো আগের জায়গায়। সবাই আমাকে স্বাগত জানালো। আমিও সালাম জানালাম। তারপর আমার ভাগ্য বিড়ম্বিত জীবনের এক নিষ্ঠুর কাহিনী সব খুলে বললাম তাদের কাছে। সে কাহিনী আপনারা সবাই এতক্ষণ শুনলেন, তাই আর পুনরুক্তি করবো না। এখানে। আমার দুঃখের কাহিনী শুনে তারাও খুব দুঃখিত হলো। সাদরে প্রাসাদের অন্দরে নিয়ে চললো। বিরাট প্রাসাদ। মহলের পর মহল পার হয়ে চলেছি। কিন্তু শেষ আর হয় না। প্রাসাদ কক্ষগুলো আগাগোড়া সাজানো গোছানো ঝকঝকে তকতকে। শেষে প্রকাণ্ড দরবার কক্ষে এসে আমরা থামলাম। এইটিই সব চেয়ে বড় কক্ষ। এবং প্রাসাদের ঠিক মাঝখানে। কি সুন্দর করে সাজানো। দেখলে প্ৰাণ জুড়িয়ে যায়। দশখানা বিরাট বিরাট পারস্যের মূল্যবান গালিচায় মোড়া দরবার কক্ষের চারপাশ। আর মাঝখানে সুন্দর সব কাজ করা আর একখানা আরও দামি গালিচা পাতা। বৃদ্ধ গিয়ে বসলো সেই গালিচায়। আর যুবকরা গিয়ে বসলো চারপাশের সোফায়। বৃদ্ধ করজোড়ে আমাকে বললো, মালিক, মেহেরবানী করে বসুন।

আমাকে একটা সব চেয়ে উচু আসন দেখিয়ে বসতে অনুরোধ জানালো সে। বললে, চুপ করে বসুন ওখানে। কোন কথা বলবেন না, আমরা আপনার জন্যে প্রার্থনা জানাবো তার কাছে।

কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে রইলো বৃদ্ধ। তারপর উঠে দাঁড়ালো। এদিক ওদিক পায়চারী করলো একটু। তারপর মাংস আর মদ এলো আমাদের জন্যে। অন্য দশজন এবং আমি মোট এগারোজন। একসঙ্গে বসেখানাপিনাসারলাম। বৃদ্ধ নিজে হাতে করে আমাদের এঁটোকাটা পরিষ্কার করলো। তারপর আবার তার নিজের জায়গায় গিয়ে বসলো। কিন্তু কোন কথা বললো না।

বেশ রুক্ষ মেজাজেই যুবকদের একজন বললো, প্রার্থনা জানাবার জন্যে আমাদের দরকারী সামানপত্তর না। এনেই বসে পড়লে কেন?

বৃদ্ধ কোন উত্তর দিলো না। উঠে অন্য ঘরে চলে গেলো! এক এক করে দশবারে সুদৃশ্য সাটিনের ঢাকনায় ঢাকা দশটা পাত্র এবং দশটা চিরাগ বাতি নিয়ে এসে ঐ যুবকদের প্রত্যেকের পাশে রাখলো। কিন্তু আমার জন্যে কিছুই আনলো না সে। যে যার সবাই পত্রগুলো হাতে তুলে নিয়ে মুখের ঢাকনা খুলে ফেলতেই দেখলাম, উনুনের ছাঁই, চিরাগের কালি আর কাজলে ভরা সেই পত্রগুলো। ওরা সবাই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো, আমাদের পাপের ফল।

ছাঁইগুলো নিজের নিজের মাথায় ছড়িয়ে দিলো, মুখে মাখলে চিরাগের কালি, আর ডান চোখে পরলো সেই কাজল।

ভোরবেলা আবার সবাই ধুয়ে মুছে সাফ করলো সেই ছাই, কালি আর কাজল। পাট করা পোশাক পরলো। একেবারে ফিটফাট সাহেব আগের মতো।

ওদের এইসব কাণ্ডকারখানা দেখে তো আমার আক্কেল গুড়ুম। ব্যাপার স্যাপার কিছুই বুঝতে পারছি না। কৌতূহল হলো। কিন্তু কোন কথা বলার উপায় নাই। আগেই বারণ করে দিয়েছে বৃদ্ধ—কোন কথা বলবে না, চুপ করে বসে থাকবে শুধু। কিন্তু এইরকম কৌতূহল কি চেপে রাখা যায়। পর পর তিন রাত্রি কেটে গেলো। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে লাগলো। আমি আর ধৈর্য রাখতে পারলাম না। ওদের কাছে জানতে চাইলাম, আচ্ছা মালিক, এ সব কী ব্যাপার? কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি জানি, এসব কথা জানতে চাওয়া বারণ আছে। কিন্তু এমন অদ্ভুত সব কাণ্ড—না জেনেই বা থাকি কি করে? আমার ভাগ্যে যা আছে হবে। তবু আমি আজ শুনবো। বলুন, কেন আপনাদের সবারই বা চোখটা কানা? আর প্রতি রাত্রে কেনই বা আপনারা মাথায় মাখেন। ছাই, মুখে মাখেন কালি, আর চোখে পরেন কাজল?

—এ কথা জিজ্ঞেস করছে কেন? তোমার যে সর্বনাশ হবে। কেন জানতে চাইছো এসব।

আমি তখন বেপরোয়া। বললাম, তা হোক, তবু বলুন, আমি শুনতে চাই।

–-কিন্তু সে কথা শুনলে তোমারও বাঁ চোখটা যাবে।

—তা যাক, তবু বলুন, আমি শুনবো। সারা জীবন ধরে একটা অদম্য কৌতূহল জীবিত রাখার চেয়ে আমার বাঁচোখটা কানা হওয়াও ভালো। কৌতূহল যদি কুরে কুরে খায় আমাকে, তবে কি হবে আমার চোখ দিয়ে। আপনারা বলুন। আমার ভাগ্যে যা ঘটে ঘটুক-আমি শুনবোই।

তখন সেই যুবকদের একজন বললো, আমরা প্রত্যেকে আমাদের নিজেদের দোষে বা চোখ হারিয়েছি। তুমিও হারাবে তোমার নিজের দোষে। এ জন্যে পরে আমাদের দায়ী করো না। তোমার বাঁচোখ কানা হবার পর কিন্তু এখানে তোমার ঠাই হবে না। কারণ, মাত্র দশজনেরই জায়গা আছে। এখানে, এগারোজনের জায়গা হবে না।

এমন সময়ে সেই বৃদ্ধ একটা জ্যান্ত ভেড়া নিয়ে ঢুকলো ঘরে। কোন কথা বললো না, একখানা ছুরি দিয়ে জবাই করে মারলো ভেড়াটাকে। ছাল-চামড়া ছাড়িয়ে আবার চলে গেলো।

যুবকদের একজন বললো, এই ভেড়ার চামড়ার মধ্যে তোমাকে ভরে, সেলাই করে এই প্রাসাদের ওপরে চুড়ায় রেখে আসা হবে। রুখ পাখী জানো? একটা আস্ত হাতীকে ঠোঁটে তুলে উড়ে যেতে পারে। সেই রুখ পাখী এসে তোমাকে তুলে নিয়ে যাবে। তার ধারণা, তুমি বুঝি বা সত্যিই একটা ভেড়া। তোমাকে ফলার বানিয়ে খাবে, এই তার ইচ্ছা। উড়তে উড়তে সে গিয়ে বসবে একটা বিরাট উচু পাহাড়ের মাথায়। মানুষের সাধ্য নাই, সেখানে ওঠে। তোমাকে সেলাই করে ভরার আগে একটু ছুরি দেবো সঙ্গে। তুমি সেই ছুরি দিয়ে সেলাই কেটে বেরিয়ে আসবে। ভয় নাই, রুখ পাখী কখনও মানুষ খায় না। তোমাকে দেখা মাত্র সে উড়ে পালিয়ে যাবে। তারপর তুমি চলতে থাকবে। চলতে চলতে একসময় দেখতে পাবে এক বিশাল প্রাসাদপুরী। এই প্রাসাদের প্রায় দশ গুণ বড় আর এর চেয়ে হাজার গুণ সুন্দর সাজানো গোছানো। ঝলমলে। বলতে গেলে সারা প্রাসাদটাই সোনার পাতে মোড়া। দেয়ালে দেয়ালে হীরে চুনী পান্না বসানো। দেখে তোমার তাক লেগে যাবে। এমনটা হয়তো তুমি রূপকথার গল্পেই পড়েছে। কিন্তু নিজের চোখে দেখোনি কখনও। এখানেই তোমার বাঁচোখ কানা হবে। আমরা সবাই যেভাবে বাঁচোখ হারিয়েছি, তুমিও ঠিক সেই ভাবেই হারাবে। প্রতি দিন রাত্রে আমরা তার কাছে এইভাবে প্রার্থনা জানিয়ে একটু আত্মতুষ্টি লাভ করি মাত্র। এই হলো মোটামুটি ব্যাপার। বিস্তারিত বিবরণ শোনাবার দরকার কী? আপনা থেকেই তো সব জানতে পারবে।

দেখলাম, তারা আমাকে ভেড়ার চামড়ার মধ্যে ভরবার তোড়জোড় করছে। আমার হাতে একটা ছুরি দিয়ে বললো, এটা তোমার সঙ্গে রাখে। সেলাই কেটে বেরুবার সময় দরকার হবে।

ছুরিটা নিলাম। ওরা আমাকে ভেড়ার চামড়ার খোলের মধ্যে পুরে সেলাই করলো। তারপর কাঁধে তুলে নিয়ে রেখে এলো প্রাসাদের চূড়ায়। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই দেখলাম ঈগলের মতো প্রকাণ্ড বড় একটা পাখী উড়ে এসে ছোঁ। মেরে আমাকে তুলে নিয়ে গেলো মহাশূন্যে। ভয়ে হাত-পা হিম হয়ে গেলো আমার; যদি তার ঠোঁট থেকে খসে পড়ে যাই? যদি আমার ভার সে বইতে না পারে? কিন্তু না, আমাকে নিয়ে গিয়ে নামলো মানুষের দুর্লঙ্ঘ্য আকাশ ছোয়া এক পৰ্ব্বত শিখরে। চটপট ছুরিটা দিয়ে সেলাই কেটে লাফিয়ে বেরিয়ে আসলাম। তারপর পাখীটাকে ভয় দেখাবার জন্যে বিকট এক আওয়ার্জ তুলে চিৎকার দিলাম। নিমেষে উড়ে পালিয়ে গেলো সে। এবার ভালো করে দেখলাম, কি বিশাল তার আকার, কি ভয়ঙ্কর তার রূপ। দশটা হাতী জোড়া দিলে যা হয়, সেইরকম তার বপু। আর কুড়িটা উটপাখী পিঠে পিঠে উঠে দাঁড়ালে যতটা উচু দেখাতে পারে, ততটা সে উঁচু।

আর তিল মাত্র না দাঁড়িয়ে চলতে লাগলাম। কৌতূহল এমনই বস্তু তার নিবৃত্তি না হওয়া পর্যন্ত সে হনন করে চলে। আমার আর ধৈর্য সয় না। দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকি। সেই প্রাসাদের সন্ধান চাই। দুপুর নাগাদ এসে পৌঁছলাম সেই প্রাসাদের সামনে। ঐ দশজন যুবক প্রাসাদের অনেক গুণকীর্তন শুনিয়েছিলো আমাকে। তা থেকে মোটামুটি একটা ছবি একে নিয়েছিলাম মনে মনে। কিন্তু চোখের সামনে যা প্রত্যক্ষ করলাম তা কল্পনাতীত। এমন সুরম্য প্রাসাদ আমি জীবনে দেখিনি কখনও! সিংহ দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। নিরানব্বইটা বিরাট বিরাট চন্দন কাঠের দরজা পেরিয়ে প্রাসাদের মাঝখানের প্রশস্ত কক্ষে এসে দাঁড়ালাম। যে দিকে তাকাই-হীরা চুনি পান্নার মেলা। দেওয়ালের গায়ে বসানো এই সব অমূল্য রত্নগুলো ঝকমক করছে। মনে হলো, দুনিয়ার সব মণিমাণিক্যই বুঝি এখানে এনে রাখা হয়েছে।

একটা ঘরে দেখলাম, বেহেস্তের পরীর মতো পরমাসুন্দরী চল্লিশটি যুবতী। আমার তেমন কোন ভাষা নাই—তাদের রূপের বর্ণনা দিতে পারি। এক কথায়, এমন নিখুঁত অনিন্দ্য সুন্দরী নারী সারা দুনিয়া টুড়েও একটা মিলবে না। আর কি আশ্চর্য, চল্লিশজনের প্রত্যেকেই একই রকম দেখতে। কারো সঙ্গে কারো এক ফোটা অমিল নাই। হুবহু সবাই এক ছাঁচে ঢালা পুতুলের মতো। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো তারা। মধুঝরা মিষ্টি গলায় স্বাগত জানালো। তুমি আমাদের আজ মেহমান। আমাদের কাছে মন প্রাণ খুলে দাও। আনন্দ করো। তুমি আমাদের ঘরের লোক আজ।

একটা উঁচু মঞ্চের উপরে নিয়ে গিয়ে বসালে আমাকে। আর ওরা বসলো নিচে-দামি কার্পেটের উপর। বললো, মালিক, আমরা তোমার দাসী। যা হুকুম করবে তাই করে। ধন্য হবো আমরা। তুমি আমাদের প্রভু। মাথার মণি। তোমার আগমনে আমরা আনন্দে আত্মহারা। তুমি আমাদের ভাগ্যবিধাতা। তোমার সুখেই আমাদের সুখ। তোমার আনন্দেই আমাদের আনন্দ। তোমার ইচ্ছাতেই আমাদের ইচ্ছা। আমরা সবাই একান্তভাবে তোমারই!

একজন তোয়ালে আর গরম জল নিয়ে এলো। আর একজন আমার পা ধুইয়ে দিলো। একজন খানিকটা সুগন্ধী আন্তর ঢেলে দিলো আমার গায়ে। আর একজন আমাকে পরিয়ে দিলো সিস্কের দামি পোশাক। সোনার তৈরি একটা বেল্ট দিয়ে এটে দিলো আমার পাতলুম। একজন এনে ধরলো এক পেয়ালা গুলাবী সরবৎ। কেউ আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে রইলো, কেউ মুচকি হেসে চোখের বান হানলো, কেউ ভ্ব নাচিয়ে ইশারা করলো। কেউ বা শায়েরী আওড়াতে লাগলো। কেউ ধরলো গান। কেউ বা ঠেলাঠেলি করে সামনে এসে দাঁড়ালো। কারো মুখে বাঃ, কী সুন্দর’। কেউ বা বলে, ‘কী মিষ্টি চেহারা রে’! তার জবাবে আর একজন বলে, ‘চেটেপুটে খেয়ে নে’। সবাই মিলে হো হো করে হেসে ওঠে। একজন গেয়ে ওঠে, তুমি যে রূপের আগুন জ্বলিয়ে দিলে মোর প্রাণে’—আর একজন হাত ধরে বলে, ‘তুমি হবে মোর প্রিয়তম, আমি হবো তব দাসী।’ একজন লাফিয়ে এসে পড়ে আমার কোলে। গলা জড়িয়ে ধরে বলে, নানা না, তুমি আর কারো না। রূপটা তোমার খাসা। তুমি আমার-শুধু আমার ভালোবাসা।’

আমার চারপাশে মৌচাকের মতো ঘিরে বসলো মেয়েগুলো; কেউ আমাকে ঠেলা মেরে আদর করে। কেউ চিমটি কাটে। কেউ সুড়সুডি দেয়। চুল ধরে টানে কেউ। কেউ বা কোমর ধরে। সবাই মিলে আব্দার করে, তোমার জীবনের কাহিনী শোনাও, মালিক। আমরা এখানে বনবাসের মতো দিন কটাই। কালেভদ্রে কোন পুরুষের সঙ্গ পাই। আজ তোমাকে পেয়েছি; অনেক দিন পরে। এবার আমরা খুশির জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেবো। তুমি আমাদের ভালোবাসা দেবে, আদর করবে, সুখের সাগরে ডুবিয়ে দেবে।

আমি আমার জীবনের কিছু কিছু ঘটনা সংক্ষেপে বললাম। সন্ধ্যা পর্যন্ত।

সূর্য গেলো অস্তাচলে। আঁধার নেমে এলো। মেয়েরা অসংখ্য মোটা মোটা মোমবাতি এনে জেলে দিলো। দিনের আলোর মতো ঝলমল করে উঠলো প্ৰাসাদ কক্ষ। চারপাশের দেয়ালের হীরা মণিমাণিক্যের ছটা এসে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।

ফরাসের উপর নতুন চাঁদর পাতালো। তারপর এক এক করে খানা নিয়ে এসে সাজাতে লাগলো তারা। মুরগীর মাংস, দামী সরাব। ফল। মিষ্টি। তারপর আরম্ভ হলো নাচ গান বাজনা। একদল বাজাতে থাকলো। একদল ধরলো নাচের তালের গান। আর একদল নাচতে লাগলো। মোহিনী রূপ ধরে। সে নাচে পুরুষের রক্ত নাচে। আগুন ধরে বুকে। আমি মদ আর মাংস খেতে খেতে দেখতে থাকলাম, তাদের এই অনিন্দ্যসুন্দর মনোরঞ্জন।

আমার খানাপিনা শেষ হলো। ওরাও গানবাজনা থামালো। একজন এগিয়ে এসে বললো, রাত হলো, এবার শোবে চলো, মালিক। আমাদের এই চল্লিশজনের মধ্যে যাকে খুশি তোমার বেছে নিয়ে যাও। আজকে রাতে সে হবে তোমার প্রিয়া-তোমার সাখী। সে তোমাকে সুখ দেবে, আনন্দ দেবে—ভালোবাসায় দেবে ভরিয়ে! তোমার যাকে পছন্দ বেছে নাও। আমাদের কারো মনে কোন হিংসা বা কোন ক্ষোভ থাকবে না। আমরা চল্লিশটি বোন পালা করে চল্লিশটি রাত কাটাবো তোমার সঙ্গে।

একথা শুনে আমার সব তালগোল পাকিয়ে গেলো। কাকে ছেড়ে কাকে নেবো? চোখ বুজে আন্দাজে খপ করে ধরলাম একজনকে। সবাই হো হো করে হেসে লুটিয়ে পড়লো। চোখ খুলে দেখি,  আমার বাহুপাশে আবদ্ধ এক ষোড়শী। আমার হাত ধরে নিয়ে গেলে সে তার শয্যায়। সারা রাত ধরে সে দুধের সায়রে ডুবিয়ে রাখলো। চল্লিশবার পান করালো তার অমৃত। আমিও তাকে খাওয়ালাম আমার মধু-চল্লিশবার। সেও খেলো লেহন করে করে-প্ৰাণ ভরে।

এইভাবে চল্লিশটা সুখের রাত্রি কাটালাম আমি। চল্লিশটি বোন এক এক করে চল্লিশটি রাত্রে আমার প্রিয়া আমার সাকী হয়ে দুধের সায়রে ডুবিয়ে তাদের অমৃত পান করালো আমাকে। আমিও তাদের প্রাণ ভরে খাওয়ালাম আমার মধু। প্রতিটি রাত্রি এক এক জন পরমা সুন্দরীর তুলতুলে শরীর নিয়ে আমি খেলা করলাম। তাদের স্তনগুলোকে দলিত মলিত করলাম, পান করলাম তাদের যোনির অমৃত সুধা। নারীর সবথেকে মূল্যবান সম্পদ সতীত্ব তা-ই স্বেচ্ছায়, হাসি আর আনন্দের মধ্য দিয়ে আমার কাছে নিবেদন করল। প্রতিটি রাত্রিবাসের পর আমার প্রিয়া আমার সাকী নিয়ে যেতো আমাকে হামামে। ঘসে মেজে সাফ করে স্নান করাতো আমাকে। নতুন পোশাক পরাতে আতর মাখাতো গায়ে।

এমনিভাবে চল্লিশটা দিনরাত্রি কেটে গেলো। মেয়েগুলো সবাই এলো আমার শয্যা পাশে। কেঁদে আকুল হলো। মাথার চুল ছিঁড়তে লাগলো! তাদের সেই আকুলিবিকুলি কান্নার মধ্যে একটা কথা শুনতে পেলাম।–তুমি ছিলে আমাদের চোখের মণি, আজ তোমাকে ছেড়ে দিতে হবে। এর আগে যারা এসেছিলো, তাদেরও একদিন বিদায় দিতে হয়েছে। তারা সকলেই আমাদের সুখ আনন্দ আর ভালোবাসা দিয়েছিলো। কিন্তু মালিক তোমার কাছ থেকে যা পেয়েছি তুলনা তার নাই। সিংহের মতো তোমার ঐ পৌরুষ আর কোন পুরুষের দেহে দেখিনি আমরা। আমাদের জীবনে যত পুরুষ এসেছে।–তুমিই সবার সেরা। তোমার দুরন্ত যৌবনের অসভ্য দুষ্টুমি পাগল করে দিয়েছে-মাতাল করে দিয়েছে আমাদের। আবার তোমারশান্ত সৌম্য ব্যবহারেও মুগ্ধ হয়ে গেছি আমরা। তবুও আজ তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে আমাদের। আমরা চল্লিশ বোন, জনমানব বর্জিত এই প্রাসাদপুরীতে সারাটা বছর নিঃসঙ্গ যৌবন যন্ত্রণায় দিন কটাই। খোদা মেহেরবান, বৎসরান্তে মাত্র চল্লিশ দিনের জন্য তিনি একজন পুরুষ পাঠিয়ে দেন। এখানে। সারা বছরে আমরা প্রত্যেকে একটিমাত্র রাতে পৌরুষের স্পর্শ পাই।

আমি জিজ্ঞেস করি, কিন্তু আমাকে ছাড়বেই বা কেন তোমরা? কেন বিদায় দেবে আমাকে?

একজন জবাব দেয়।—আমরা একই বাবার চল্লিশ বোন। কিন্তু আমাদের সকলের মা আলাদা। আমাদের বাবা এখানকার শাহেনশাহ। সারা বছর ধরে আমরা এই প্রাসাদে বাস করি। তারপর বছরের চল্লিশ দিন বাকী থাকতে আল্লাহ একজন পুরুষ পাঠিয়ে দেন আমাদের যৌবন রক্ষার জন্য। এই চল্লিশ দিন পরে বছরের শেষে আমরা বাবা-মাকে দেখতে চলে যাই। আজ দিন-বছরের প্রথম দিন। আজ আমাদের চলে যেতে হবে তোমাকে ছেড়ে। কিন্তু প্ৰিয়তম মন চায় না। তোমার গভীর প্রেমে মাজে গেছি আমরা ফি বছর একজন পুরুষ আসে। কিন্তু তোমার মতো এমন রূপ এমন উন্মত্ত যৌবন কারো দেখিনি। তাই তোমাকে ভালো লেগেছে খুব। তোমাকে ছেড়ে যেতে যে কি কষ্ট তা বোঝাবো কি করে? কিন্তু কী উপায় বলো, যেতেই যে হবে!

—কিন্তু সোনারা, আমি তো তোমাদের ছেড়ে এখান থেকে যাবো না কোথাও। বেশ তো, তোমরা যাও, তোমাদের মা বাবাকে দেখে এসো। আমি এখানে অপেক্ষা করবো।

মেয়েগুলো নেচে উঠলো।–সত্যি? সত্যি থাকবে তুমি? তা হলে এই নাও, চাবির গোছা। প্রত্যেকটি দরজার চাবি আছে এতে। তোমার নিজের ঘর মনে করে থাকবে এখানে। আজ থেকে এই প্রাসাদের মালিক তুমি। কিন্তু সাবধান, বাগিচার ওপাশে যে তামার দরজা আছে, ওটা কিন্তু ভুলেও খুলো না। তা হলেই সর্বনাশ হবে। যদি খোলো জীবনে আর তোমার সঙ্গে আমাদের মোলাকাৎ হবে না। কখনও।

এক এক করে সবাই চোখের জল ফেলতে ফেলতে আমার কাছে বিদায় নিলো। তাদের সেই করুণ বেদনার্ত চোখের চাহনি আজও আমি ভুলতে পারিনি, মালকিন।

তারা চলে গেলো। আমি এক পড়ে রইলাম সেই বিশাল শূন্য-প্রসাদ কক্ষে। হাতে আমার এক গোছা চাবি। ওরা দিয়ে গেছে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। ক’দিন কি অপরূপ হাসি আনন্দ গানে উচ্ছ্বাস উচ্ছলতায় কেটে গেলো বেশ! কিন্তু আজ সেই প্রাসাদপুরী শূন্যতার হাহাকারে ভরা। এমন নীরব নিস্তব্ধতা মৃত্যুকে মনে করিয়ে দেয়। চারদিক ঘুরে দেখতে লাগলাম। যেদিকে তাকাই কি অপরূপ কারুকর্ম। নিপুণ শিল্পীর নিখুঁত শিল্প নিদর্শন ছড়িয়ে আছে এর সর্বাঙ্গে। মেয়েগুলোকে নিয়ে মশগুল ছিলাম। এ ক’দিন, তাই এসব দেখার সময় হয়ে ওঠেনি। আজ চোখ সার্থক হলো। তাদের রূপের জৌলুষে চোখ আমার ধাঁধিয়ে ছিলো। তাই এই শিল্পরূপ আমার চোখে পড়েনি।

প্রথম চাবিটা দিয়ে প্রথম দরজাটা খুললাম। এক সুন্দর ফলের বাগান। এমন নানা জাতের ফলের গাছ একটা বাগানে আগে কখনও দেখিনি। আপেল, আঙ্গুর, কমললেবু, শশা, কলা, পেয়ারা আরও কত নাম নানা জানা মিষ্টি মধুর ফল। প্রাণভরে পেটপুরে খেলাম। এর পর দ্বিতীয় দরজা খুললাম।

ফুলের সৌরভো ভরে গেলো দেহমান। এমন ফুলের মেলা কেউ কি দেখেছে কখনও? আমি তো দেখিনি। হয়তো বা নবাব বাদশাহদের বাগিচায় থাকতে পারে। যুঁই, বেল, মালতী, রজনীগন্ধা, গোলাপ, হাসনুহানা, টগর, মল্লিকা, সূৰ্যমুখী, ক্রিসেন্মথিমাম, পারিজাত আরও অসংখ্য। সব নাম ক’জনেই বা জানে। এমন এক স্বপ্নের দেশে, এমন এক কল্পনার কল্পলোকে এসে প্ৰাণ আমার নেচে ওঠে।

আর একটা চাবি দিয়ে তৃতীয় দরজা খুললাম। নানা জাতের নানা রঙের হাজার হাজার পাখীর কলকাকলীতে মুখরিত হচ্ছে সারা বাগিচা। মনে হলো, দুনিয়ার সব রকম পাখীই বোধহয় জোগাড় করে রাখা হয়েছে। সেখানে। সারাদিন ধরে পাখীদের সঙ্গে খেলা করলাম। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি।

পরদিন চতুর্থ দরজা খুলতেই দেখি, বিশাল এক প্রাঙ্গণ। তারপর চারপাশে চল্লিশটা বড় বড় কক্ষ চন্দনকাঠের বিরাট বিরাট দরজা। দরজাগুলো সব খোলা। একটা ঘরে ঢুকেই আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। সারা ঘরের মেজেয় ঢালা আছে কয়েকশো মণি মুক্তা। এতো বড় বড় মুক্তো কখনও দেখিনি আমি। পায়রার ডিমের মতো প্রায়। মুক্তোর আলোর ছটায় সারা ঘরটায় পূৰ্ণচাঁদের হাট। পাশের ঘরে এলাম। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্তহীরা আর রুবীতে ঠাসা। তৃতীয় ঘরে থরে থরে সাজানো ছিলো চুনী, পান্না, তার পাশের ঘর সোনার তাল-এ ভরা। পরের ঘরটায় সোনার মোহরের পাহাড়। এতো মোহর এলো কোথা থেকে। যতই দেখতে থাকি অবাক হই। তার পাশের ঘর রূপোর বাটে ভর্তি। পরের ঘরে শুধু রূপের মুদ্রা।

পর পর ঘরগুলো সবই দেখলাম মহামূল্যবান ধনরত্ন মণিমাণিক্যে ঠাসা। দেখলাম আর অবাক বিস্ময়ে ভাবলাম, এতো সম্পদ আমার গোটা সালতানিয়ৎ-এ নাই।

আমার কোন কাজ নাই, প্রত্যেকদিন সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত একটার পর একটা চাবি দিয়ে দরজা খুলতে থাকি। বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে দিন কাটে। কী অপার ঐশ্বর্য, কী বিচিত্র সংগ্রহ। তারিফ না করে পারা যায় না।

এইভাবে উনচল্লিশ দিন পার হয়ে গেলো। একটি ছাড়া সবগুলো দরজাই খুলে দেখেছি। এবার মাত্র একটি চাবিই বাকী আছে। কিন্তু মেয়েগুলো আমাকে দিব্বি দিয়ে বারণ করে গেছে এই চাবিটা দিয়ে যেন আমি না খুলি সেই তামার দরজা। কিন্তু মন আমার ভীষণ কৌতূহলী। অজানাকে জানার ইচ্ছে আমার জন্মাবধি। না দেখাকে দেখার আগ্রহ আমার শিরায় শিরায়। কিন্তু মেয়েগুলোর সেই করুণ মিনতি, সেই জলভরা চোখ আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ওরা বলেছিলো, খুলো না, কোন কারণেই খুলো না সেই সৰ্ব্বনাশা তামার দরজা। আর যদি না শোনো আমাদের কথা, যদি খোল, চিরদিনের মতো তোমার সঙ্গে আমাদের আর মোলাকাৎ হবে না। তোমাকে আমরা হারাতে চাই না, সোনা। তুমি শুধু এই কথাটা আমাদের রেখো। খুলে না—খুলো না, কিছুতেই যেও না। ওই দরজার কাছে।

চাবিটা নিয়ে নাড়াচাড়া করি আর ভাবি। কী সুন্দর পরীর মতো মেয়েগুলো। কী রূপ আর কী উচ্ছল, উদ্দাম যৌবন। তাদের মধুর ব্যবহার, তাদের নোচ, তাদের গান, তাদের আদর যত্ন, তাদের দেহ আমাকে চল্লিশটা দিন স্বৰ্গসুখ দিয়েছিলো। প্রতিটি দিনের স্মৃতি প্রখর স্পষ্ট হয়ে রয়েছে প্রদীপশিখার মতো আমার হৃদয়ে। ভুলবো না, কখনও ভুলবো না। এই পরম পাওয়ার চল্লিশটা দিন-রজনী। আর ভুলতে পারবো না সেই মেয়েগুলোকে—যারা আমাকে ভরে দিয়েছিলো—হাসি আর গানে। যৌবনের পূর্ণ সুধাপাত্ব আকণ্ঠ পান করিয়েছিলো যে সব যৌবন মন্দেমত্তা পরম রমণীয় নারী, -কেমন করে ভুলবো তাদের? কিন্তু কৌতূহল এমনই এক বস্তু তার নিবৃত্তি না হলে সব তুচ্ছ মনে হয়। জানি আমার সর্বনাশ হবে, জানি এই স্বৰ্গসুখ, এই নারী সংসর্গ থেকে চিরকালের মতো বিদায় নিতে হবে। তবু কৌতূহল দমন করা গেলো না। তামার দরজাটা খুলে ফেললাম। শয়তান যখন পিছনে লাগে তার আর নিস্তার নাই।

দরজাটা খুললাম বটে-কিন্তু কিছুই দেখলাম না। একেবারে শূন্য ঘর। শুধু কেমন একটা গন্ধ ভেসে আসতে লাগলো। গন্ধটা ক্রমশ উগ্রতর হতে লাগলো। আমার শরীরটা কেমন বিমঝিম করতে থাকে। মাথাটা বো বো করে ঘুরে উঠলো। তারপর আর মনে নাই। অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম।

অনেকক্ষণ বাদে জ্ঞান ফিরে এলো। উঠে বসলাম। গন্ধটা বেশ হালকা হয়ে এসেছে। উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের ভিতরটা দেখার জন্য পা বাড়ালাম। ওপাশে আর একটা দরজা। আর একটা ঘর। প্রকাণ্ড বড়। জাফরানে রং করা দেওয়াল। মোমবাতির মিষ্টি আলোয় এক মায়াজাল সৃষ্টি করেছে। আতরের খুশবুতে ভরে গেছে। সারা ঘর। ঘরের চারপাশে চারটে সোনার তৈরি চিরাগবাতি জুলছিলো। সেই পোড়া তেলের অপূর্ব এক মিষ্টি গন্ধও ছড়িয়ে পড়েছিলো ঘরময়। ঘরের এক পাশে একটা কালো ঘোড়া চোখে পড়লো। জবরদস্ত তাগড়াই। তার কপালে একটা সাদা তারার ছাপ। পিছনের দিকের বা পা আর সামনের দিকের ডান পায়ে সাদা মোজা পরানো। তার পিঠের জীন সোনার তৈরি। নিপুণ স্বর্ণকারের সূক্ষ্ম কারুকর্ম করা। যবের আটা আর বার্লির জাবনা তার সামনে। আর একটা বারকোষে খানিকটা জল।

ঘোড়াটা দেখে আমার ভীষণ লোভ হয়। ছোট বেলা থেকেই দুর্ধর্ষ ঘোড়সওয়ার হিসাবে সারা দেশে নাম ছিলো আমার। বাঘা বাঘা জাঁদরেল–ঘোড়সওয়ারকে পাল্লায় হারিয়ে দিয়েছি একসময়।  পিঠে চড়ে ঘরের বাইরে বাগানের মাঝখানে নিয়ে এলাম ঘোড়াটাকে। আর নড়তে চায় না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। একেবারে বেয়াড়া বেহুদা জানোয়ার। সপাং সপাং করে ঘা কতক লাগাতেই চি-হি-হি করে লাফিয়ে উঠলো। আর কী আশ্চর্য, সঙ্গে সঙ্গে দু’খানা পোল্লাই পাখা ছড়িয়ে পড়লো, দু-পাশে এমনভাবে গোটানো ছিলো যে, চোখেই পড়েনি এতক্ষণ। এর পর অদ্ভুত ধরনের এক আওয়াজ তুলে শো শোঁ করে আকাশের দিকে যেতে লাগলো। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ঘর-বাডি মানুষজন সব ছোট হতে হতে আরও ছোট হয়ে আসতে লাগলো আমার চোখে। অনেক উপরে উঠে গেছি তখন। একেবারে মেঘের কাছাকাছি। এবার ঘোড়াটা বাজপাখীর মতো তীর বেগে ছুটে চললো শক্ত করে লাগামটা ধরে বসে রইলাম। ভয় আমি পাইনি। বরং এক অপূর্ব শিহরণ বোধ করছিলাম সারা দেহে!

আকাশ পথে দেশদেশান্তর পেরিয়ে উড়ে চললো সেই পক্ষীরাজ ঘোড়া। তারপর এক সময় দেখলাম সেই তাম্র-প্রাসাদের ছাদে গিয়ে নামলো সে। এক মুহুর্ত নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো তারপর প্রচণ্ড এক ঝাকুনি দিয়ে গাঝাড়া দিয়ে আমাকে ফেলে দিলো নিচে—ছাদের উপর। আমি সামলে ওঠার আগেই ছুটে এসে তার একখানা পাখার ঝাপটা মারলে আমার এই বঁ। চোখে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করে পড়ে গেলাম আমি। আর তক্ষুণি শো শোঁ করে মহাশূন্যে উঠে গিয়ে নিমেষে উধাও হয়ে গেলো। সে।

এক হাতে বা-চোখটা চেপে ধরে প্রাসাদের সিডি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। সেই দশজন বঁ-চোখ কানা যুবক বেরিয়ে এলো।

—অতো পইপই করে বারণ করেছিলাম সেদিন, কিন্তু আমাদের কথা গ্রাহ্য করলে না। এখন ঠেলা বুঝলে? তোমাকে আগেই বলেছিলাম দশজনের বেশী জায়গা নেই এখানে। আর দশজন আমরা হয়েই গেছি। তোমার জায়গা হবে না। এখন নিজের পথ নিজে দেখো। তবে তোমাকে একটা পথের নিশানা বলে দিতে পারি। সেই পথ ধরে যদি যাও তবে দিন কয়েক পরে বাগদাদ শহরে গিয়ে পৌঁছতে পারবে। সেখানকার খলিফা হারুন-অল-রাসিদ পরম দয়ালু। তার কাছে গেলে তোমার আশ্রয় মিলতে পারে, তার দান ধ্যানের খ্যাতি জগৎ-জোড়া। তিনিই তোমার ভাগ্যবিধাতা।

দাড়ি গোঁফ কমিয়ে এক কালান্দার ফকিরের বেশে পথে নেমে পড়লাম। কেউ চিনবে না, কেউ জানবে না। আমি বাদশাহ কাসিবের পুত্র। দিনের পর দিন হেঁটে হেঁটে আজ সন্ধ্যায়। এই বাগদাদ শহরে পৌঁছেছি। কোথায় যাবো, কোথায় পাবো একটা আস্তানা—আজকের রাতের মতো, সেই ভাবনা ভাবতে ভাবতে একটা রাস্তার চৌমাথায় এসে দাঁড়ালাম। সেখানে দেখি আমারই মতো আরও দুজন কালান্দার। তাদেরও দাড়ি গোঁফ কামানো। আমার মতো তাদের দুজনেরও বা চোখে ঠুলি পরা। কানা। ওরাও শহরে নবাগত। রাতের আশ্রয় খুঁজছে। তিনজনের একই সমস্যা। এক সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম আস্তানার সন্ধানে। রাতের মতো একটু আশ্রয় পেয়ে যাবো। এই আশায় তোমাদের দরজায় কড়া নাড়লাম।

এই হলো আমার হতভাগ্য জীবনের করুণ কাহিনী। এই হলো আমার বাঁ চোখ হারানো আর গোঁফদাড়ি কামানোর ইতিবৃত্ত।

সেই সুন্দরী তিন বোন তৃতীয় কালান্দারের কাহিনী শুনে মন্ত্রমুগ্ধ হতবাক। বড়বোন বললো, খুব খুশি হয়েছি তোমার কাহিনী শুনে। যাও এক্কেবারে ছুটি।

–কিন্তু মালকিন, এখানে আর যারা আছেন তাদের কাহিনী শুনবো না?

ছোটবোন তখন খলিফা জাফর আর মসরুর-এর দিকে চেয়ে বললো, এবার আপনাদের কাহিনী শোনান।

জাফর বললো, আমাদের যা কাহিনী তা তো দরজায় ঢোকার মুখেই তোমাকে বলেছি, মা এর বেশী বলার মতো কোনও ঘটনা আমাদের জীবনে নাই।

বড়বোন বললো, ঠিক আছে, সবাইকে আমি মুক্তি দিলাম। যে যেখানে যেতে চাও যেতে পারো।

লেড়কি তিনটির কাছ থেকে মুক্তি পেয়ে খলিফা হারুণ-অল-রসিদ প্রাসাদে ফিরলেন। নির্ঘুম অবস্থায় নিদারুণ অস্থিরতার মধ্যে তিনি রাত্রি কাটালেন।

Leave a Reply