রঙিন মছলির কিসসা
আফ্রিদি দৈত্য হাউমাউ করে কেঁদে বল্ল-—“বিশ্বাস কর, তােমার কোন ক্ষতি তাে আমি করবই না বরং খােদার নামে হলফ করে বলছি তােমাকে আমি আমির বাদশাহ করে দেব। মেহেরবানি করে একটিবার অন্ততঃ আমাকে সুযােগ দিয়ে দেখ।
বুড়াে জেলের পক্ষে আর মনকে শক্ত রাখা সম্ভব হলনা। দৈত্যর চোখের পানি তার মনকে ভিজিয়ে দিল। ফলে জালার মুখটি আবার খুলে দিল।
ব্যস, মুহুর্তে ধোঁয়ায় চারদিক ভরে গেল। ধোঁয়ার কুণ্ডলি থেকে আবার জন্ম নিল অতিকায় দৈত্য আফ্রিদি। পূর্বের দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটল। ব্যাপার দেখে জেলের কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়ার। উপক্ৰম হ’ল। কাপা কাপা গলায় বলল- “তুমি খােদাতাল্লার নামে শপথ করেছ। বাদশাহ উনান-এর কিসসার কথা স্মরণ কর। তিনি তার উপকারীর জান নিতে চেয়েছিলেন বলে খােদাতাল্লা কিন্তু তাকে মাফ করেন নি তুমি আমার অনিষ্ট করতে উদ্যত হলে তােমাকেও অবশ্যই মার্জনা করবেন না, জেনে রাখ।
আফ্রিদি দৈত্য এবার মুখ খুলল—‘এসাে আমার পিছন পিছন।” কথাটি বলেই সে হাটা জুড়ল! জেলে তার কথায় ভরসা রাখতে পারে না। ভাবল, আবার কোন বদ মতলব করছে, কে জানে। অবশেষে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে এক সময় সে দৈত্যকে অনুসরণ করল। দৈত্য জেলেকে নিয়ে পাহাড়ের ওপর উঠে গেল। একটা সরােবরের ধারে গিয়ে দৈত্য থামল। জেলেও দাঁড়িয়ে পড়ল।
দৈত্য এবার গম্ভীর স্বরে উচ্চারণ করল—এ সরােবরে জাল ফেলল।
জেলে মুহূর্তকাল সরােবরে স্বচ্ছ জলের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল—-লাল, নীল, হলুদ আর সবুজ প্রভৃতি রঙের মছলির ঝাক জলে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে। জাল ফেলতেই বিভিন্ন রঙের চারটি মছলি জালে পড়ল।
আফ্রিদি দৈত্য বলল—জেলে ভাইয়া, মছলি চারটি নিয়ে সুলতানের দরবারে হাজির হও দেখবে, তিনি তোমাকে বহুৎ, বহুৎ মােহর বকশিস দেবেন। ব্যস, তুমি একেবারে আমির বনে যাবে।
দৈত্য এবার বলল–এবার আমি বিদায় নিচ্ছি। কাল আবার এখানে এসে জাল ফেলবে। আবার বিচিত্র রঙের মছলি জালে উঠবে। সেগুলো বিক্রি করেই তােমার পরিবারের ভরণ পােষণ দিব্যি চলে যাবে। মনে রেখাে, রােজ একবারের বেশী এখানে জাল ফেলাে না যেন।
আফ্রিদি দৈত্যের পরামর্শ অনুযায়ী জেলে চার রঙের মছলি চারটি নিয়ে সুলতানের দরবারে উপস্থিত হ’ল। মছলিগুলাে দেখে সুলতান তাে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ার জোগাড় করলেন।
কয়েকদিন আগেই রুমের বাদশাহ বকশিসস্বরূপ এক নিগ্রো পরিচারিকাকে পাঠিয়েছেন। সুলতান এঁকেই মছলি চারটে রান্নার দায়িত্ব দিলেন।
সুলতান উজিরকে ডেকে বললেন—‘জেলেকে সন্তুষ্ট করার ব্যবস্থা করুন। চার শ’ দিনার পুরস্কার স্বরূপ তাকে দিয়ে দিন।
জেলে চার চার শ’ দিনার নিয়ে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরল। বিবিকে বলল-ভাল ভাল খানা পাকাও। লেড়কা-লেড়কিদের পেট ভরে আজ খেতে দাও।
এদিকে নিগ্রো পরিচারিকা মাছ চারটে কুটে, বেছে আর ধুয়ে কড়াইয়ে ভাজতে শুরু করল। সবে মছলির এক পিঠ ভেজেছে। অন্য পিঠ ভাজার জন্য যেই মছলির টুকরােগুলােকে ওল্টাতে শুরু করল তখনই ঘটে গেল এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড। রান্নাঘরের একদিককার দেয়াল দু’ভাগ হয়ে গেল। তাদের ফাঁক দিয়ে এক রূপসী তন্বী যুবতী ধীর-পায়ে বেরিয়ে এল। বাস্তবিকই অপরুপা! তার রূপের জৌলুস চোখ ঝলসে দিতে চায় যেন। তার হাতে ফাপা একটি বাঁশের টুকরো। সে নাচতে নাচতে কড়াইটির কাছে গেল। বাঁশের টুকরােটির এক প্রান্ত মুখে লাগাল। অন্য প্রান্তটি কড়াইয়ের ওপর ধরে মিষ্টি মধুর স্বরে বল্ল মছলি ভাইয়া, মছলি ভাইয়া, আমার কথা শুনতে পাচ্ছ।’
কড়াইয়ে আধ-ভাজা মছলির টুকরােগুলাে লাফাতে লাফাতে জবাব দিল–‘শুনছি, শুনতে পাচ্ছি।’
রূপসী-যুবতী আর মছলিগুলাের কাণ্ডকারখানা দেখে পরিচারিকা নিগ্রো মেয়েটি তাে ভয়ে ভয়ে একেবারে পৌনে মরা হয়ে যাবাব জোগাড়।
রূপসী যুবতী এবার আরও অত্যাশ্চর্য এক কাণ্ড করল। হঠাৎ কড়াইটিকে ধরে চুলার ওপর উপুড় করে দিল। মছলিগুলাে সব জ্বলন্ত আগুনে পুড়ে গেল। তারপর সে লেড়কি অদৃশ্য হয়ে গেল। ফাক হওয়া দেয়ালটি আবার জোড়া লেগে গিয়ে পূর্বের অবস্থায় ফিরে এল।
পরিচারিকা নিগ্রো মেয়েটি যখন সংজ্ঞা ফিরে পেল তার অনেক আগেই মছলিগুলাে পুড়ে ভষ্মে পরিণত হয়েছে। সে আতঙ্কে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল—’আমার যে আজ গর্দান নেবে! কী সর্বনাশ হ’ল গাে! এ কী ঘটে গেল! আমাকে যে একেবারে খতম করে ফেলবে গাে?
নিগ্রো পরিচারিকাটির বুকফাটা আর্তনাদে বৃদ্ধ উজির ছুটে এসে দেখলেন, সব পুড়ে ছাই।
রাগে কাপতে কাপতে বললেন তােমার নসীবে যে আজ কী আছে খােদাই জানেন! এখন মছলি-পােড়া ছাই নিয়ে সুলতানের সামনে হাজির হও, তিনি তােমার জান নিয়ে ছাড়বেন।
ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে কঁদিতে সে উজিরকে মছলির ঘটনাটি আদ্যোপান্ত বলল।
নিগ্রো পরিচারিকার কিস্সা শুনে উজির ত্রুর হাসি হাসলেন। তার কথাটিকে আমলই দিলেন না। চোখ-মুখ বিকৃত করে বলেন—’যত সব বুজরুকি!
জেলের ডাক পড়ল আবার! উজির তাকে আরও চারটি মছলির ফরমাস দিলেন।
জেলে ওই সরােবর থেকে আরও চারটি মছলি ধরে সুলতানের প্রাসাদে দিয়ে গেল। পরিচারিকাটি মছলি কেটে, ধুয়ে হলদি মাখাল। তারপর কড়াইয়ের গরম তেলে দিল ছেড়ে। মছলিগুলাের একপিঠ ভাজা হলে পূর্ব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল।
ব্যাপার দেখে তাে উজির হতভম্ব। মূচ্ছা যাওয়ার উপক্রম হলেন। বেগম শাহরাজাদ কিসসাটির এ পর্যন্ত বলে থামলেন। ঘরের বাইরে ইতিমধ্যেই পাখীর কিচিরমিচির শুরু হয়ে গেছে।পূর্ব-আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে।
সপ্তম রাত্রি সমাগত। বাদশাহ শারিয়ার-এর নির্দেশে বেগম শাহরাজাদ আবার তার কিসসা শুরু করলেন -“হ্যা, প্রথম ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। সে রূপসী যুবতীটি যখন কড়াইটিকে উপুড় করে উনানের জ্বলন্ত আগুনে মছলির টুকরােগুলােকে ফেলে দিল উজির আর বিশ্বাস না করে পারলেন না।
উজির এবার ব্যাপারটিকে সুলতানের কানে তুলতে বাধ্য হলেন। সুলতান ঘটনার বিন্দু বিসর্গও বিশ্বাস করতে পারলেন না। গাঁজাখুরি কিস্সা বলে হেসেই উড়িয়ে দিলেন ব্যাপারটিকে।
উজিরের নির্দেশে জেলেটি আবার ওই সরােবর থেকে চারটি মছলি ধরে দরবারে পৌছে দিল। চারশ দিনার বকশিস নিয়ে সে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরল। সুলতান স্বয়ং রসুইখানায় হাজির হলেন। মছলির আজগুবি। কাণ্ডকারখানা নিজের চোখে দেখবেন।
নিগ্রো পরিচারিকাটি কড়াইয়ের তেলে মছলিগুলাে ছ্যাৎ করে ছেড়ে দিল। সেগুলাের একপিঠ ভাজা হয়ে গেলে এবার পূর্বঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল না। দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে রূপসী যুবতীর পরিবর্তে এবার হাজির হ’ল এক ইয়া তাগড়াই নিগ্রো যুবক। রীতিমত জানােয়ারের মত চেহারা। প্রথম দর্শনেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। বাঁশের চোঙের পরিবর্তে তার হাতে গাছের ছােট্ট একটি ডাল।
আগন্তুক নিগ্রো যুবকটি কর্কশ স্বরে বল্ল – মছলি ভাইয়া, মছলি ভাইয়া?
আধভাজা মছলিগুলােকড়াইয়ের ভেতরে নাচতে নাচতে বলতে লাগল – “কি? কি বলছ – বল, আমরা শুনছি।”
ভয়াল দর্শন নিগ্রো যুবকটি এবার কড়াইটিকে ধরে সপাং করে উপুড় করে দিল। মছলির টুকরােগুলাে জ্বলন্ত উনানের আগুনে পড়ে মুহুর্তে ছাই হয়ে গেল।
ব্যস, নিগ্রো যুবকটি যে পথে এসেছিল সে দেয়ালের ফাঁক দিয়েই কপূরের মত উবে গেল।
সুলতান বললেন – “উজির সাহেব, এর মধ্যে কোন্ গােপন রিহস্য রয়েছে তা আমাদের ভেদ করতেই হবে। আর রহস্যভেদ করতে হলে সে জেলেকেই সবার আগে ডাকা দরকার।
সুলতানের তলব পেয়ে বুড়াে জেলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল। সুলতান এবার আর তাকে মছলি এনে দেওয়ার ফরমাস দিলেন না। সে কোথেকে মছলি আনে সে তলাওটি দেখতে ইচ্ছুক বুড়াে জেলে সুলতানকে নিয়ে পাহাড়ের ওপরের সরােবরটির উদ্দেশে যাত্রা করল। সঙ্গে চললেন সৈন্যসামন্ত আর উজির – নাজির প্রভৃতি পারিষদরা।
সরােবরটির ধারে পৌছেই সবাই বিস্ময়াপন্ন হলেন। রঙ বেরঙের কত সব মছলি সাঁতার কেটে কেটে খেলা করছে।
সুলতান বলেন –এ সরােবার এবং মছলিগুলির রহস্যভেদ না করে আমি এ জায়গা ছেড়ে কিছুতেই যাব না।’
সুলতান এবার প্রবীণ ও বিচক্ষণ উজিরকে ডেকে বললেন, তার তাবুর চারদিকে প্রহরী নিযুক্ত করতে। আর তিনি একা রাত্রে পাহাড়ের ধারকাছ এবং সরােবরের চারদিক ঘুরে দেখবেন। সরােবর ও মাছের রহস্য উদ্ধার করার জন্য কঠিন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন তিনি। আর কেউ যেন তার উদ্দেশ্যের কথা জানতে না পারে।
রাত্রি গভীর হলে সুলতান ছদ্মবেশ ধারণ করে একা নির্জন পার্বত্য অঞ্চল ও সরােবর প্রদক্ষিণে বেরিয়ে পড়লেন। সারারাত্রি ধরে হাঁটাহাঁটি করার পর রাত্রির চতুর্থ প্রহরে কুচকুচে কালাে বড়সড় একটি বস্ত তার নজরে পড়ল। মনটি আনন্দে নেচে উঠল। ভাবলেন, রহস্যটি বুঝি এবার ভেদ করা সম্ভব হবে। কিন্তু গুটিগুটি পায়ে কাছে যেতেই তার ভুল ভেঙে গেল। দেখলেন, কুচকুচে কালাে পাথরে তৈরী একটি প্রাসাদ। তার সামনে একটি সিংহ দরজা। তার একটা পাল্লা বন্ধ, দ্বিতীয়টি পুরােপুরি খােলা। প্রথমে দরজার কড়া নাড়লেন। ভেতর থেকে কারাে কণ্ঠস্বরই ভেসে এল না। এবার গলা ছেড়ে ডাকাডাকি করলেন, কেউ সাড়া দিল না। এবার গলা ছেড়ে বলতে লাগলেন আমি তৃষ্ণার্ত পথিক। তৃষ্ণায় বড় কাতর হয়ে পড়েছি। ভেতরে কে আছ, একটু পানি দিয়ে আমার জান বাঁচাও ?
সুলতানের কণ্ঠস্বর শূন্য প্রাসাদে বার বার প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। কিন্তু তার ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকিতে কারও কণ্ঠস্বরই ভেতর থেকে ভেসে এল না।
ভীত সন্ত্রস্ত পায়ে, দুরু দুরু বুকে সুলতান প্রাসাদের একেবারে ভেতরে ঢুকে গেলেন। তার সামনেই পড়ল মনােরম এক ফোয়ারা। আর তার চারদিকে চারটে সােনার সিংহ। ফোয়ারার পানি এসে সিংহগুলাের গা ধুইয়ে দিচ্ছে। আর ? ফোয়ারার পানির সঙ্গে থেকে থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসছে পান্না, হীরে, চুনী আর মুক্তো। সে গুলাে চারদিকে স্তুপাকারে জমা হচ্ছে।
প্রাসাদের দেয়ালে রঙ বেরঙের নাম জানা-অজানা কত সব বিচিত্র আকৃতি ও রঙ বিশিষ্ট পাখি। সবাই বন্দী। ওড়ার সাধ থাকলেও সাধ্য নেই। সােনার জালে সবাই বন্দী।
ঘুরে ঘুরে সুলতান এক সময় খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ বিশ্রামের মধ্য দিয়ে ক্লান্তি অপনােদনের জন্য তিনি এক জায়গায় ধপাস করে বসে পড়লেন। ক্লান্তি আর সকালের হিমেল হাওয়ায় তার চোখ দুটো বার বার বুজে আসতে চাইল। দেওয়ালে হেলান দিয়ে তিনি তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। হঠাৎ সুললিত সঙ্গীত-ধ্বনি তার কানে এল। তন্দ্রা টুটে গেল। উৎকর্ণ হয়ে সঙ্গীত লহরী শুনে তার উৎসস্থল আবিষ্কারের চেষ্টায় নিজেকে নিযুক্ত করলেন। বড়ই করুণ, বড়ই মর্মান্তিক সে গানের মর্মার্থ। সুলতান উঠে পড়লেন। পায়ে পায়ে এগােতে লাগলেন সঙ্গীতধ্বনি লক্ষ্য করে। কয়েক পা এগােতেই বহুমূল্য একটি পর্দায় বাধা পেলেন। বেশ চওড়া একটি দরজায় সেটিকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সুলতান হাত বাড়িয়ে পর্দাটি সামান্য ফাক করতে তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল এক যুবকের মুখ। সে পালঙ্কে আধশােয়া অবস্থায় রয়েছে। অনন্য তার রূপ। হরিণের মত টানা টানা চোখ। আপেলের মত টকটকে তার গাল দুটো। উন্নত নাসিকা, মুক্তার মত ঝকঝকে তার দাঁত আর মাথায় মখমলের মত চকচকে একরাশ ঝাকড়া চুল। সত্যই এক সুন্দরকান্তি যুবকই বটে।
সুলতান ঘরে ঢুকে গেলেন। উচ্ছ্বসিত আবেগের সঙ্গে বলে উঠলেন–“আমার নসীরে কী জোর যে, তােমার দেখা পেয়ে গেলাম।
পালঙ্কের অর্ধশায়িত যুবকটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—“আমি গােড়াতেই মাফ চেয়ে নিচ্ছি। আমার দেহ নিঃসার। উঠে বসা তাে দূরের কথা এমন কি নড়াচড়ার ক্ষমতা পর্যন্ত আমার নেই।’
সুলতান মুখে আক্ষেপসূচক শব্দ উচ্চারণ করলেন। এবার। বললেন – “এই যে সরােবরটি যাতে বিচিত্র রঙ বিশিষ্ট মাছলি রয়েছে। তার কি কি তােমার জানা আছে? মানে মাছলির কথা বলছি, জান কি কিছু ? যদি তােমার জানা থাকে তবে আমার কাছে সে – কিত্সা ব্যক্ত কর। আর একটু আগে তােমাকে বিষাদের গান গাইতে শুনলাম। কেন-ই বা তুমি এরকম গান গাইছ? তােমার ব্যথা কোথায়? কেনই বা তােমার এ-দুঃখ, হতাশা আর অন্তহীন হাহাকার?
‘নসীব! নসীবের ফেরেই আজ আমার এ-দুর্গতি!’ কথা বলতে বলতে যুবকটি তার গায়ের বহুমুল্য শালটিকে শরীরের ওপর থেকে সরিয়ে দিল। ব্যস, সুলতানের চোখের সামনে ফুটে উঠল অতীব মর্মান্তিক এক দৃশ্য। যুবকটির দেহের নিম্নাংশ শ্বেতপাথরের তৈরী, আর কোমরের ওপরের অংশ রক্ত মাংসে গড়া।
যুবকটি চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল – “হুজুর বলছি তবে শুনুন, বিচিত্র প্রকৃতির রঙিন মাছ আর তার নসীবের কিসসা। আমার বাবা ছিলেন এক সুলতান। বিশাল অঞ্চলের অধিপতি। দেশের নাম বললাম না, আর বললেও আপনার পক্ষে তার হদিস পাওয়া একেবারেই অসাধ্য। তিনি সত্তর বছর জীবিত ছিলেন। তার মৃত্যুর পর মসনদে বসলাম আমি। চাচাতাে বহিনকে শাদী করে জীবনসঙ্গিনী করলাম। নিজের কলিজার চেয়েও সে আমাকে পেয়ার করত। হাসি-আনন্দের মধ্যে পাঁচটি বছর কাটল।
এক সকালে সে গােসল করতে গেল। যাবার সময় পাচককে ভাল ভাল খানা পাকাতে বলে গেল। আমি তখনও পালঙ্ক ছেড়ে উঠিনি। আমার শিয়রে এবং পায়ের কাছে বসে দুই ক্রীতদাসী বাতাস করছে। চোখে তখনও নিদ ভর করে রয়েছে।
হঠাৎ আমার কানে এল, ক্রীতদাসীরা নিজেদের মধ্যে ফিসফিসিয়ে বাতচিত করছে হুজুরের কী নসীবের ফের! এমন এক জেনানাকে তিনি বিবির আসনে বসিয়েছেন। রােজ রাতে একটি করে নতুন মরদানা চাই-ই চাই। তিনিই কিনা আমাদের বিবি! ভাবতেও শরম লাগে। আমাদের সাদাসিদা হুজুরের সাদা মনের সুযােগের পুরাে সৎব্যবহার করছেন হুজুরাণি। ‘হুজুরের সাধ্য কি তার শয়তানি ধরেন। রােজ রাত্রে তিনি হুজুরের সরাবের সঙ্গে সাদা কি যেন এক গুঁড়া মিশিয়ে দেন। ব্যস, একেবারে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকেন সারারাত্রি। তখন হুজুরাণি তার ফয়দা লুঠতে মেতে যান। ভােরে আবার হুজুরের নাকের কাছে কি যেন একটা দাওয়াইয়ের শিশি ধরেন। তাঁর নিদ টুটে যায়।
তাদের বাক্যালাপ শােনার পর আমার সর্বাঙ্গ কেমন যেন অসাড় হয়ে পড়তে থাকে। মাথাটা ঝিমঝিমিয়ে ওঠে। মুহূর্তে খড়িমাটির মত ফ্যাকাশে হয়ে যায় আমার মুখ।
কিছুক্ষণ বাদে আমার বেগম গােসল সেরে ঘরে ঢুকল। অন্যদিনের মত তার ঠাণ্ডা হাতটি আলতাে করে আমার কপালে ধরে ঘুম ভাঙিয়ে দিল। সােহাগিনী বিবি আমার!
রাত্রি হ’ল। আমার বেগম বহুমূল্য সরাবের বােতল আর পেয়ালা নিয়ে এল। অন্য রাত্রের মতই এক পেয়ালা সরাব ঢেলে হাসির ঝিলিকমাখা মুখে আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি তার অলক্ষ্যে সরাবটুকু পিকদানিতে ফেলে দিলাম। তারপর অন্যদিনের মতই পালঙ্কে গা – এলিয়ে দিলাম। ঘুমের ভান করে ঘাপটি মেরে পড়ে রইলাম। মন আমার তার গতিবিধির ওপর। এ কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই তাকে পালঙ্ক থেকে খুবই সন্তর্পণে নামতে দেখলাম। হুরিপরীর মত সেজে নিল ঝটপট। ব্যস, এবার দরজা খুলে খুবই সাবধানে পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আমি তড়াক করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। আমি গোপনে তার পিছু নিলাম। প্রাসাদ ছেড়ে, সিংহ দুয়ার অতিক্রম করে লম্বা লম্বা পায়ে সে চল্ল শহরের সীমান্তের দিকে। সে নিচুস্তরের মানুষরা যে অঞ্চলে বাস করে তাদেরই একটা ভাঙাচোরা বাড়িতে ঢুকে গেল।
আমি বাড়িটার পিছনের দিকে চলে গেলাম। দেয়ালের এক ছিদ্রে চোখ রেখে ভেতরের কীর্তিকলাপ দেখতে লাগলাম। ঘরের ভেতরে ছিল এক ইয়া গাট্টাগােট্টা এক জোয়ান মরদ। নিগ্রো ক্রীতদাস।
আমার কলিজা, আমার পেয়ারের বিবি ঘরে ঢুকে হাসিমাখা মুখে হতচ্ছাড়া কালোেমােষ নিগ্রোটিকে কুর্নিশ করল। সে যেন তার কেনা বাঁদী। নিগ্রোটা বাঁদরের মত দাঁত-মুখ খিচিয়ে তার ওপর তম্বি করতে লাগল। যেন নবাব – বাদশা তার বাদীকে ধমকাচ্ছে-“হতচ্ছাড়ি এত দেরী করলি কেন? পাড়ার সবাই হাড়িয়া খেয়ে যার যার মরদানিকে নিয়ে মজা লুঠছে! আর তুই কিনা রাত কাবার করে এলি?
—গােসা কোরাে না মেরে জান! তােমাকে তাে বলেছি চাচাতাে ভাইয়ের সঙ্গে আমার শাদী হয়ে গেছে। তার চোখে ধূলা দিয়ে তবে তাে আসব। হুজুর জানতে পারলে সে আমার জান খতম করে দেবে। নচ্ছারটাকে আমি জানোয়ারের মত ঘেন্যা করি। তবু তাকে হাতে রাখলে আমাদের দুজনেরই মঙ্গল। সুলতানকে না চাইতে পারি, কিন্তু তার সােনা – চাঁদি আর মােহর তাে মিঠা বটে।
‘মুখ বন্ধ কর হারামজাদি! আর বকবক করতে হবে না। তাের বাহানা শােনার মত আর ধৈর্য আমার নেই। অনেক ছলাকলাই তাে দেখিয়েছিস। এবার সত্যি করে বল তাে কোন পেয়ারের নাগরের গলায় এতক্ষণ লটকে ছিলি? তোর তুলতুলে নরম শরীরটা দিয়ে কার মন চাঙা করে এলি। খুব রসে মজে গিয়েছিস তাই না? আর কোনদিন যদি দেরী হয় তবে আর তাের নরম-গরম বুকে আমাকে জাপ্টে ধরে সাধ মেটাতে পারবি না, বলে রাখছি, বুঝেছিস? তুই বাজারের বারাে ভাতারকে নিয়ে পড়েছি এখন। একজনকে দিয়ে তাের তৃষ্ণা মিটবে কেন ?
পঙ্গু সুলতান এবার বলেন – ‘ শুনুন হুজুর, আমার নসীবের ফেরের কথা খুলে বলছি আপনাকে – শয়তান নিগ্রোটার ধাতানি খেয়ে আমার বেগম ওড়নায় মুখ ঢেকে ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। ব্যাপার দেখে আমার মাথায় খুন চেপে গেল। মন চাইছিল, ছুটে গিয়ে তার ধড় থেকে গদাটা এক কোপে নামিয়ে দিই।
যা-ই হােক, আমার বেগম ধুমসাে নিগ্রোটার হাতে – পায়ে ধরে কান্নাকাটি করার পর তার মনটা একটু ভিজল। হাত বাড়িয়ে তাকে কাছে টেনে নিল। নিজে হাতে তার গায়ের ওড়নাটা খুলে দরজায় ছুড়ে ফেলে দিল খুলে ফেল তার ঘাগরাটা। তারপর তার কামিজ, কোমরবন্ধ, কঁাচুলি যা কিছু তার গায়ে ছিল এক এক করে খুলে ছুঁড়ে। ছুঁড়ে ফেলতে লাগল। বলে বিশ্বাস হবে না আপনার, পরপুরুষের সামনে আমার বিবস্ত্র বিবিকে দেখে শরমে আমার মুখ লাল হয়ে গেল। কিন্তু আমার বিবি ? সে উলঙ্গ কালাপাহাড়টাকে বুকের ওপর জাপ্টে ধরে দিব্যি পড়ে রইল। তারপর নিগ্রোটার পুরুষাঙ্গটিকে মুখে নিয়ে পরম তৃপ্তিতে লেহন করতে লাগল। মনে হল সে জীবনে এত সুস্বাদু বস্তু আর খায়নি। এদিকে নিগ্রোটি আমার বিবির সুন্দর নরম তুলতুলে দেহটিকে ইচ্ছামতে দলন পেষন করা শুরু করল। বিবির স্তনগুলোকে দুহাতে ময়দা পেষার মতে পেষতে লাগল, যোনি গহবরে আঙুলি করে তারপর তার বিশাল লিঙটিকে সেখানে জোড়ে প্রবেশ করিয়ে জোড়ে জোড়ে ধাক্কাতে লাগল যে এখনি বিবির শরিরটাকে দুভাগ করে ফেলবে। কিন্তু কি বলল আর এতে আমার বিবি ব্যাথা নাপেয়ে বরং আনন্দই পাচ্ছে বোঝা গেল। যতভাবে পারে উলটে পালটে বিবির দেহটাকে ভোগ করল। আমার তখন হুশ হ’ল, আঁর শরম লাগবে কেন ? নিজের দেহের জ্বালা নেভাতেই তাে সে আমাকে ফাঁকি দিয়ে এখানে ছুটে এসেছে।
আমার গা ঘিন ঘিন করতে লাগল বিবির নির্লজ বিশ্বাসঘাতকতা দেখে। একটা পরপুরুষকে কোন নারী, বিশেষ করে আমার বিবি হাসিমুখে বুকের ওপর তুলে নিতে পারে এ যে আমার কাছে খােয়বেরও অতীত | আর ওই শয়তান কালাপাহাড়টা নিজের চওড়া বুকের তলায় আমার বিবিেিক ফেলে হরদম দলন-পেষণ চালাতে লাগল। আর আমার বিবি ? আবেশে জড়ানাে কামতৃষ্ণাতুর আধ – বােজা আঁখি দুটি মেলে প্রাণ ভরে সম্ভোগ – সুখ লুঠে নেবার জন্য উতলা হয়ে উঠল। চোখে – মুখে তার এক অনাস্বাদিত ‘স্বর্গীয় সুখ ভােগের লক্ষণ ক্রমে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে লাগল। উভয়ের নাসারন্ধ্র দিয়ে তপ্ত শ্বাসবায়ু নির্গমনের শব্দ অস্পষ্ট হলেও আমার কানে ভেসে এল।
না, আর পারলাম না, নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলাম না। মাথায় খুন চেপে গেল। শিরা – উপশিরায় খুনের গতি দ্রুততর হয়ে উঠল। আমার গায়ে তখন যেন হিংস্র বাঘের শক্তি ভর করল। আচমকা এক লাথি মেরে দরজাটা দিলাম ভেঙে। এক লাফে ঢুকে গেলাম ঘরের ভেতরে।
এক ঝটকায় কোমর থেকে তরবারিটা টেনে নিয়ে শয়তান নিগ্রোটার শিরে আঘাত করলাম। গলগল করে খুন বেরিয়ে এল। বিবস্ত্রা বেগমকে কোনরকমে পােশাকে ঢেকে ঘােড়ায় চাপিয়ে নিয়ে এলাম প্রাসাদে।
কিসসার এ পর্যন্ত বলে বেগম শাহরাজাদ থামলেন। পরের রাত্রে বাদশাহ শারিয়ার অন্দরমহলে এলেন। বেগম শাহরাজাদ কিসার অবশিষ্ট অংশ শুরু করতে গিয়ে বললেন – সুলতান ভেবেছিলেন, তাঁর বেগমের মেহবুব ষণ্ডামার্কা নিগ্রোটা বুঝি তরবারির আঘাতে দোজকের পথে পাড়ি জমিয়েছে। কিন্তু নিগ্রোর জান, এত সহজে তাে খতম হওয়ার নয়। গুরুতর আহত হ’ল বটে কিন্তু জান খতম হল না। টিকে গেল।
এদিকে আমার বিবি পরদিন সকালে কালাে কামিজ, কালাে ওড়না প্রভৃতি গায়ে চাপিয়ে নিল। আমাকে বলল, কাল তার মা মারা গেছে। তাই শােকবস্ত্র গায়ে চাপিয়েছে। এক বছর শােক পালন করবে; একটা শােক • ভবন বানিয়ে দিতে হবে। এক বছর ধরে সেখানে শােক পালনের মাধ্যমে মায়ের বেহেস্ত লাভের জন্য আল্লাতান্নার কাছে প্রার্থনা করবে।
আমি তার ইচ্ছায় বাধা দিলাম না। প্রাসাদের অদূরে ছােট্ট একটা বাড়ি তৈরী করালাম তার সে এক বছর শােক পালনের জন্য। ভােরে আর সন্ধ্যার আগে আমার বিবি শােক – ভবনে যেত। গলা ছেড়ে কেঁদে কেঁদে আল্লাতান্নার কাছে মায়ের শান্তির জন্য প্রার্থনা করত।
আমার বিবির আসল উদ্দেশ্য শােক পালন নয়, অন্য। সে তার পেয়ারের শয়তান নিগ্রোটাকে শােক ভবনে এনে গােপনে তার ক্ষতস্থানে ইলাজ চালাতে লাগল। দু-চারদিন পর আমার মনে খটকা লাগল। ব্যাপার কি? শােক পালন নাকি অন্য কোন উদ্দেশ্য সাধন সেখানে চলে ?
একদিন সন্তর্পণে আমি বিবির পিছু নিলাম। কয়েক হাত দূর থেকে মনে হল বেগম মায়ের জন্য কেঁদে আকুল হচ্ছে। কিন্তু কাছে যেতেই আমার ভুল ভেঙে গেল। বুঝলাম, কান্না নয়, বিষাদের সুরে পেয়ারের নিগ্রোটাকে গান শােনাচ্ছে। গানের মাধ্যমে প্রেম নিবেদনের প্রয়াস।
আমার বেগম আর ষণ্ডামার্কা শয়তান নিগ্রোটা যখন গানে গানে একেবারে মাতােয়ারা তখন আমি তরবারি হাতে তার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। গান শেষ হতেই আমি গর্জে উঠলাম—‘শয়তানি, এই বুঝি তাের মায়ের জন্য শান্তি প্রার্থনা কথা বলতে বলতে তরবারি দিয়ে সজোরে এক কোপ বসিয়ে দিলাম। কাজ হ’ল না। এক ঝটকায় সে কয়েক হাত দূরে সরে গেল। পর মুহূর্তেই হেড়ে গলায় শাপবাক্য উচ্চারিত হ’ল- আমার অলৌকিক শক্তি নিয়ােগ করে, তােমাকে অভিশাপ দিচ্ছি, তােমার কোমরের নিম্নাংশ শ্বেতপাথরে পরিণত হয়ে যাক!
ব্যস, আমার নসীবের খেল শুরু হয়ে গেল। আমার নিম্ন অঙ্গ স্বেত পাথরে পরিণত হয়ে গেল। আর দেহের উধ্বাংশ রয়ে গেল পুরুষের স্বাভাবিক দেহ।’ কথা বলতে বলতে অভাগা সুলতানের দুখির কোল বেয়ে পানির ধারা নেমে এল।
সুলতান চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন- ‘তােমার চাচাতাে বোন, তােমার বিবি এখন কোথায় জান কি?
অদৃষ্ট বিড়ম্বিত যুবকটা এবার চোখের মনি দুটো খােলা জানালার দিকে ঘুরিয়ে বলল— “ওই যে, ছােট্ট কুঠিবাড়িটা দেখা যাচ্ছে সেখানে শয়তান নিগ্রোটাকে নিয়ে মনের আশ মিটিয়ে জীবন যৌবন উপভােগ করছে।
-এখানে, তোমার কাছে মােটেও আসে না?
– ‘আসে। রােজ একবার করে গুলিখাওয়া বাঘিনীর মত গর্জাতে গর্জাতে এসে হাজির হয়। চরম আক্রোশে আমার পিঠে সপাং সপাং করে ঘা কতক চাবুক কষিয়ে দিয়ে নিত্যকর্ম সম্পন্ন করে।
‘শােন, আল্লাতাল্লা বলে যদি কেউ থাকেন তবে তার নামে কসম খেয়ে আমি বলছি, তাকে তার প্রাপ্য শান্তি আমি অবশ্যই দেব।’ দাতে দাঁত চেপে সুলতান বলেন।
সকাল হ’ল। সুলতান এবার শােক ভবনের দিকে পা বড়লেন। তরবারি হাতে নিয়ে ঢুকে পড়লেন ছােট্ট প্রাসাদটিতে। শয়তান নিগ্রোটা পালঙ্কের ওপরে অকাতরে ঘুমােচ্ছে। মুহূর্তমাত্র সময় নষ্ট না করে সুলতান হাতের তরবারিটা দিয়ে সজোরে এক কোপ বসিয়ে দিলেন। মুহূর্তে কালাে পাহাড়টা দু’টুকরাে হয়ে গেল। ফনকি দিয়ে তাজা খুন বেরিয়ে এল। এবার তাকে টানতে টানতে নয়ে গিয়ে এক পাহাড়ে ফেলে দিয়ে এলেন।
কাজ এখনও মেটেনি। এবার পিশাচিনী বেগমটাকে সাবাড় করতে হবে। তিনি আবডালে দাঁড়িয়ে রইলেন সুযােগের প্রতীক্ষায়। বেশ কিছুক্ষণ পর হতভাগ্য সুলতানের ঘরে চাবুক হাতে ঢুকলেন।
ব্যস্ত – পায়ে ঘরে ঢুকেই তার পিঠে সপাং সপাং করে চাবুক চালাতে লাগলেন। গর্জন করতে লাগলেন — “আমার মহব্বতে তুমি কাটারী চালিয়েছ। তােমাকে কোন ক্ষমা নয়।
প্রাসাদ থেকে ফিরে এবার হন্তদন্ত হয়ে বেগম শােক – ভবনে ঢুকলেন। তার পেয়ারের নিগ্রোটার অদর্শনে উন্মাদিনীর মত তিনি নালা ছেড়ে কাঁদতে লাগলেন।
এমন সময় বেগম এক অদৃশ্য কণ্ঠের বাণী শুনতে পেলেন – আমার আদেশ পালন কর নি কেন?’ তিনি ভাবলেন, নির্ঘাৎ খাদাতাল্লার বাণী। তাই কাঁদো কাঁদো স্বরে বলেন—’‘খােদ, তােমার কোন্ আদেশ আমি পালন করিনি, বল?”
– ‘তােমার স্বামীকে রােজ চাবুকের ঘা মার কেন? তুমি জান, চাবুকের আঘাত আমার পিঠে এসে পড়ে। পিঠ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। আমি নিষেধ করা সত্ত্বেও তুমি কান দাওনি?’
– ‘আমায় কসুর মার্জনা করুন খােদা। এখন আমার প্রতি কি হুকুম, বলুন?
– “যদি নিজের ভাল চাও তবে তােমার স্বামীকে শাপমুক্ত কর। তার স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে দাও।
– করছি। এখনি করছি খােদা। আমার কসুর নিও না। আমি এখনি গিয়ে সুলতানের স্বাভাবিক দেহ ফিরিয়ে দিচ্ছি।
বেগম উদ্ভ্রান্তের মত ছুটতে ছুটতে প্রাসাদে ফিরে এলেন। গন্ডুষ ভরে জল নিয়ে অস্ফুটস্বরে কি সব বলেন। মন্ত্র পড়া জলটুকু তার স্বামীর গায়ে ছিটিয়ে দিলেন। এবার তার স্বামীর দেহের শ্বেতপাথরের অংশটুকু ধীরে ধীরে স্বাভাবিকতা ফিরে পেল।
আবার অদৃশ্য অলৌকিক বাণী শােনা গেল— এবার তােমার কাজ হচ্ছে, সরােবরের মছলিগুলােকে তুমি বন্দী করে রেখেছ কেন? তাদের মুক্ত করে দিতে হবে।’
বেগম এবার ঊর্ধ্বশ্বাসে সরােবরের দিকে ছুটলেন। কিসসা বলার ফাকে বেগম শাহরাজাদ জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে বুঝলেন, সকাল হতে আর দেরী নেই।
দুনিয়াজাদ বল্ল- ‘বহিনজী, তােমার কিসসা আমাকে উতলা করে দেয়। তুমি এমন সুন্দর কিত্সা,
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে শাহরাজাদ ম্লান হেসে ললেন—যদি জানে বেঁচে থাকি তবে এর চেয়ে আরও কত সুন্দর কত্সা শােনাতে পারব যা শুনলে মনে হবে আবারও শুনি।
পরের রাত্রে যথা সময়ে বাদশাহ শারিয়ার অন্দর মহলে হাজির হলেন।
বেগম শাহরাজাদ কিসসা শুরু করলেন— সেই শয়তানী বেগম সরােবরের তীরে এসে গন্ডুষ ভরে পানি নিয়ে বিড় বিড় করে কি যেন সব বলেন। এবার হাতের পানিটুকু সবােবরে ছিটিয়ে দিলেন। ব্যস, মছলিগুলাে সব এক একজন মানুষের রূপ ধারণ করল। তারা সবাই সুলতানেরই সৈন্য। মনুষ্য দেহ ফিরে পেয়ে সবাই নিজ নিজ পরিবারের লােকজনের কাছে চলে গেল।
শয়তানী বেগম আবার প্রাসাদে ফিরে এলেন। করজোড়ে নিবেদন করলেন – খােদা, তােমার আদেশে মছলিগুলােকে মনুষ্যদেহ ফিরিয়ে দিয়েছি। তুমি এবার বল, আমার আর কি করণীয়?
অন্তরাল থেকে এবার বাণী ভেসে এল –“না, আর কিছু না। আর কিছুই করতে হবে না। মুহূর্তের মধ্যে সুলতান ছুটে এসে তার মুন্ডুটা ধড় থেকে নামিয়ে দিলেন। এবার বললেন – নিজের স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতার ফল খােদাতাল্লার আদেশেই দিলাম। দোজকে গিয়ে এবার বাকী গুনাহর জ্বালা ভােগ কর গে শয়তানী।
শয়তানী বেগমকে খুন করে সুলতান প্রাসাদে ফিরে এলেন। শাপমুক্ত সুলতানের কাছে সব বিবরণ ব্যক্ত করলেন।
সুলতান এবার বিদায় নিয়ে স্বদেশে ফিরে যাবার উদ্যোগ করলেন। শাপমুক্ত সুলতান তার সঙ্গ নিলেন। তার দেশে বেড়াতে যেতে চান।
শাপমুক্ত সুলতানকে সঙ্গে নিয়ে সুলতান স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন। ঘটনার আদ্যোপান্ত উজিরের কাছে ব্যক্ত করলেন। তার মুখে সব শুনে বৃদ্ধ উজিরের তাে শ্বাসরুদ্ধ হওয়ার উপক্রম।
সুলতান এবার জেলেকে ডেকে পাঠালেন। তার সংসারের খোঁজ খবর নিলেন। তার এক লেড়কিকে নিজে শাদী করে বিবির মর্যাদা দিলেন। আর এক লেড়কির সঙ্গে শাপমুক্ত সুলতানের শাদী দিলেন। এভাবে জেলে দেশের মধ্যে একজন আমীরে পরিণত হয়ে গেল।