সর্বনাশের সামনে – ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়

›› সম্পুর্ণ গল্প  

টানা কাচের জানলা বন্ধ ছিল। কাবেরী খুলে দিল। সঙ্গে-সঙ্গে একঝলক হিমেল বাতাস শরীর কাঁপিয়ে দিল।সামনের দিকে স্তব্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে কাবেরী। দুচোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে তৃপ্তিতে। ‘অহাে, কী দৃশ্য হেরিলাম, জন্ম-জন্মান্তরেও ভুলিব না।’ –মনে মনে বিড়বিড় করছে। এ লাইনটা দেবেন্দ্রনাথের ‘হিমালয় ভ্রমণ’-এ ছিল?সবুজ, শুধু সবুজের মেলা। সবুজ লন। তারপর ঢল নেমে গেছে। সেখান থেকেই সবুজ-নীল পাহাড়ের ঢেউ। কাছে থেকে দূরে, আরও দূরে। রােদ-মেঘের ছায়া পড়ে রং পাল্টাচ্ছে। তারপর আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। মেঘ ঢেকে দিচ্ছে, ফাঁকে-ফাঁকে উঁকি মারছে সােনার মুকুট।
কতদিন পরে বেড়াতে আসা। কাবেরীর বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। পিছন থেকে আচমকা অরণ্য এসে জাপটে ধরেছে।’অ্যাই!’ ছিটকে ওঠে কাবেরী, ‘কী হচ্ছেটা কি?’ ‘উমম? কী হচ্ছে?’ ঘাড়ে মুখ ঘষতে ঘষতে বিড়বিড় করে অরণ্য। ‘ও:, ছাড়াে! এই তাে এলাম। দ্যাখাে, দ্যাখাে, কী অপূর্ব সিনারি।’ ‘আমি তাে তােমার সিনারি দেখব বলে এসেছি, ম্যাডাম।’ ‘অসভ্য! এরকম বিউটিফুল জায়গায়…তুমি কী বলাে তাে?’ ‘কিছুই নয়। একজন স্বাভাবিক মানুষ। ম্যাডাম, আমার তর সইছে না।’ ‘যাও, চান করে এসাে। তুমি বেরােলে আমি যাব। চান করে দুজনে ঘুরতে বেরােব।’ ‘পাগল! হানিমুনে এসে সিনারি দেখে সময় নষ্ট করব?’ ‘হানিমুন? কী বলছাে?’ ‘অবকোর্স। সেকেণ্ড হানিমুন।’
বলতে-বলতে অরণ্য সামনে বেড় দিয়ে কাবেরীর ঠোঁটে ঠোঁট গুঁজে দিয়েছে। আস্তেআস্তে টানছে…
খুটখুটখুট! দরজায় নক হচ্ছে।
‘যা: শ-শালা!’ একঝটকায় কাবেরীকে ছেড়ে দিল অরণ্য। মুখ-টুখ মুছে দরজা খুলে দিতে এগােল। চোখমুখ কুঁচকে গেছে।
কেয়ারটেকার বাহাদুর দাঁড়িয়ে। ‘বাহাদুর জিগ্যেস করছে, কী খাব।’

জানলার আলসেতে থুতনি রেখে কাবেরী বলল, ‘তুমি স্নানে যাও। আমি বলে দিচ্ছি।’
কটকট করে তাকাতে তাকাতে তােয়ালে নিয়ে অরণ্য বাথরুমে ঢুকল। দড়াম করে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ। কাবেরী ধীরেসুস্থে বাহাদুরকে লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে আবার এসে দাঁড়াল জানলায়। হিমালয় ওকে চুম্বকের মতাে টানছে।…
সুবীর এখন কী করছে? নিশ্চয়ই অফিসে। বাবাই স্কুলে, ওর ছুটি তিনটেয়। এভাবে যে চলে আসা যায় কোনদিন ভাবেনি। কী চমৎকার প্ল্যান করেছে অরণ্য। কোথাও ফাঁক নেই। যা ঘটছে বা ঘটতে চলেছে, তার জন্যে দায়ী সুবীর। হ্যাঁ, সম্পূর্ণ দায়ী। কাবেরী জীবনে এসব ভাবেনি।
অরণ্য সুবীরের কলিগ। একই কাগজে সুবীর আর্ট ডিরেক্টর, অরণ্য রিপাের্টার। বয়েসে বেশ ছােট। অরণ্য সুবীরের ছবির ভক্ত।
সুবীর অরণ্যকে ওদের বাড়ি নিয়ে এল। প্রথম দেখাতেই কাবেরীর ছেলেটাকে ভালাে লেগে গেল। স্মার্ট, হ্যান্ডস্যাম।
অরণ্য প্রথমেই ধাক্কা দিল। কাবেরীর দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হেসে বলেছে, ‘সুবীরদা, আপনি কী করে মেয়েদের এত সুন্দর পােট্রেট আঁকেন, এতদিনে বুঝলাম।’
সুবীর হেসেছে।
তারপর দিন-দিন অরণ্যর এ বাড়ি আসা বেড়েছে। প্রায়ই ওরা তিনজন রাতে গ্লাস নিয়ে বসেছে। সেসব রাতে অরণ্য বাড়ি ফেরেনি। ফোনে জানিয়ে দিয়েছে। | কোনও রাতে অরণ্য হুইস্কিজড়িত স্বরে বলেছে, ‘আচ্ছা সুবীরদা, একটা কথা বলাে তাে! এক বউ বা বরকে নিয়ে সারাটা জীবন টেনে যাওয়া, এর কোনও মানে আছে?’
‘নাহ!’ সুবীর জড়িত গলায় বলেছে, ‘কোনও মানে নেই। তবু থাকতে হয়। এটাই নিয়ম। সংসার টিকিয়ে রাখতে হয়। অরণ্য, তুমি এখনও বিয়ে করােনি। এসব নিয়ে এখন মাথা ঘামিও না। বিপদ, বুঝলে খুব বিপদ!’
‘কীসের বিপদ? বিয়ে করে ফেললে অন্য পুরুষ বা মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যাবে , কোথায় লেখা আছে? অল বােগাস ট্রাডিশন! উই আর অল পলিগ্যামাস, বাই ইনস্টিংকট।’
‘পাচ্ছ কোথায়? পেলে সম্পর্ক করাে না, কে বাধা দিচ্ছে? বাপু হে, আমাদের সােসাইটিতে এসব অত ইজি নয়।’
‘পাওয়ার কথা ছাড়াে!’ অরণ্য চোখের কোণ দিয়ে কাবেরীকে দেখে নিয়ে বলেছে, ‘যদি পাওয়া যায়, তােমার মেনে নিতে আপত্তি নেই তাে?’
সুবীরের নেশা হলেও তালে ঠিক। দেখে ফেলেছে অরণ্যর তাকানাে। খলখল হেসে বলেছে, ‘আপত্তি কিসের? নাে প্রবলেম! ধরাে, তােমার বৌদির যদি তােমায় মনে ধরে, তুমি যদি চাও, তাতে আমি না বলার কে? মিয়াবিবি রাজি, তাে কেয়া করেগা কাজি! আমি এসব ব্যাপারে লিবারাল।’
‘কী বলছাে আবােলতাবােল?’ কাবেরীরও অল্প নেশা ধরে এসেছে। ঝংকার দিয়ে উঠল, ‘মাতাল হয়ে গেছ একেবারে। নাও, ওঠো! শুয়ে পড়।’
বলতে গেলে, সেই সূচনা। ধিকিধিকি আগুন খুঁচিয়ে দেওয়া। কাবেরীর চেয়ে সুবীর প্রায় দশবছরের বড়। তার ওপর ছবি-ছবি করে ওর শরীরের খিদে কবেই মরে গেছে।
শেষ কবে ওকে আদর করেছে, কাবেরীর মনে পড়ে না।
অথচ, সাঁইতিরিশে দাঁড়িয়ে কাবেরী এখনও টানটান। খাঁজখোঁজ যথেষ্ট আকর্ষণীয়। কতদিন এমন হয়েছে, নার্সিসাস-এর মতাে নিরাবরণ হয়ে আয়নার সামনে নিজেকেই মেপেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে।
অরণ্য হানা দেওয়া বাড়িয়ে দিল।
তখনও সুবীর ফেরেনি। ফেরার কথাও নয়। মর্নিং ডিউটি করে ভরদুপুরে অরণ্য এসে হাজির। বাড়ি ফাঁকা।
‘চা খাওয়াও ম্যাডাম। তােমার হাতের চায়ের টেস্টই আলাদা।’ ‘চা খাবে কী? এখন তাে লাঞ্চ টাইম।’ ‘এভরিটাইম ইজ টি টাইম। না খাওয়ালে চললুম।’ চা এনে টেবিলে রাখছে, আচমকা কোমর জড়িয়ে ধরল। ‘অ্যাই, অ্যাই, কী হচ্ছেটা? চা পড়ে যাবে।’ ‘কিছু পড়বে না। তােমায় একটা চুমু খাব।’ ‘না—না। খবর্দার অরণ্য!’ ‘কী না-না? সুধীরদা গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছে, বেশি ভ্যানতারা করাে না তাে।’ ‘সুবীরদা বললেই হল? আমার ইচ্ছে-অনিচ্ছে নেই?’ ‘তােমার ইচ্ছে তাে আছেই। অরণ্য চোখ চিনতে ভুল করে না।’ বলতে-বলতে জোর করে ঠোঁটের মধ্যে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল। কাবেরীর তখন কী অবস্থা, ও যদি জানত! ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি ঠেলে বেরােচ্ছে।… ‘এই যে ম্যাডাম! রবীন্দ্রনাথ হয়ে গেলে যে! যাও, গিজারে জল গরম আছে।’
অরণ্য মাথা মুছতে-মুছতে বেরিয়ে এসেছে। কাবেরীর ঘাের কেটে গেল। উষ্ণ জল গায়ে ঢালতেই কী আরাম। সব শ্রান্তি উবে গেছে। বাথরুমের দরজায় হঠাৎ ঠকঠক। ‘কে?’ ‘আমি। আমি ছাড়া আছে কে?’
‘কী হয়েছে?’ ‘কিছুই হয়নি। একবার খােলাে না! তােমায় দেখব।’ ‘মানে?’ ‘মানে আবার কী! তােমায় বার্থ-ডে সুটে দেখব। একবার খােলাে।’ ‘মারব এক থাপ্পড়।’ ‘সে মারাে। যত খুশি মারাে। তবু খােলাে।’ “পাজি কোথাকার!’
বলল বটে, কিন্তু শরীরে কাঁপুনি ছিল।…বিয়ের পর প্রথম-প্রথম এমন হতাে। তাড়াতাড়ি শালােয়ার-কামিজ পরে বেরিয়ে এল কাবেরী।
‘চলাে, বেরােও।’ টিপ পড়তে-পড়তে কাবেরী বলল। “কোথায়?” ‘তুমি অদ্ভুত লােক তাে! তােমার সুবীরদাকে পৌঁছ সংবাদ দিতে হবে না?’ ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। বলবে, অরণ্য আমায় খুব ‘ইয়ে’ করছে।’
হাতের চিরুনি দিয়ে এক ঘা দিল কাবেরী। অরণ্য ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,—’সব তুলে রাখছি। আজই মিটিয়ে দেব।’
দুজনে পাশাপাশি হাঁটছে। বাতাস ভরতি অক্সিজেন। কোনও ক্লান্তি আসে না। পাহাড়ি উতরাই পথ, একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে খাদ। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে কাঠের বাড়ি। অনেক নিচে শহর।
কালিম্পং-এর এই তাশিডিং টুরিস্ট লজ মূল শহর থেকে অনেকটা ওপরে। প্রায় শেষ বিন্দুতে। এরপরেই আর্মি ক্যাম্প শুরু। খুবই নির্জন, নিরালা। ওদের পক্ষে আদর্শ। সমস্যা একটাই, মােবাইলে টাওয়ার আসে না। একটা ফোন করতে হলেও বেশ খানিকটা নেমে আসতে হয়।
সুতাে ছেড়ে দিয়েছিল সুধীরই। প্রথম-প্রথম অরণ্য বাড়িতে এলে ও সুবীরকে জানিয়ে দিত। সুবীর হাসত। বলত, ‘আসুক না! তােমার খারাপ লাগে না তাে? একা-একা থাক, সঙ্গ দিয়ে যায়।’
সঙ্গ! এসব জেগে ঘুমােনাে ছাড়া কী! নিজের চাহিদা নেই, বউকে আগুনের দিকে ঠেলে দাও।
অরণ্য একদিন সকাল দশটায় এসে হাজির। কাবেরী তখনও রাতপােশাকে। সুবীর ছেলেকে নিয়ে সবে বেরিয়েছে।
দরজা খুলে ও অবাক, ‘তুমি! সাত সকালে?’ ‘নাইট ডিউটি ছিল। চলে এলুম। তুমি বডড টানছিলে।’ ‘পাগল! চানটান করােনি, চলে এলে?
অরণ্য অদ্ভুত হেসে চলেছে, ‘আজ আমরা দুজনে একসঙ্গে চান করব যে! ঠিক রাধাকৃষ্ণের মতাে। তােমায় আমি সাবান মাখিয়ে দেব, তারপর জল ঢালব আস্তে-আস্তে।’
উ:! সেইমুহূর্তে ছিটকে সরে গেছিল কাবেরী। ছেলেটা সাংঘাতিক কথা জানে। কাজের মেয়ে মানদা এসে না পড়লে সেদিনই হয়তাে সবকিছু হয়ে যেত।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা বাজারের কাছে এসে পড়েছে। দোকানপাট, রেস্তোরা। ছােট-ছােট হলুদ বাের্ড ঝােলানাে, ফোন বুথ।
একটা খুপরিতে ঢুকে পড়ল কাবেরী। ফোনের বােতাম টিপল। ‘হ্যালাে।’ ‘হ্যালাে, মা?’ ‘হ্যাঁ বাবাই সােনা! স্কুলে যাওনি?’ ‘আজ তাে স্যাটারডে। ছুটি। দিদার কাছে গিয়ে সব ভুলে গেছ?’ ‘ও হাে। তাই তাে! তােমরা সব ভালাে আছ সােনা? বাবা?’ ‘হ্যাঁ মা। ফাইন। তােমার জন্যে একটু-একটু মন খারাপ করছে। দিদা কেমন আছে?’
‘এখন ভালাে। মন খারাপ কোরাে না বাবু, লক্ষী হয়ে থাকো। দু তিনদিন পরেই ফিরে যাচ্ছি। বাবাকে বােলাে।’
‘হ্যাঁ মা। তুমি আবার ফোন করবে তাে?’ ‘কাল সকালেই করব। রােজ করব। …ছাড়ি?” ‘হ্যাঁ, বাই।’
‘বাই।’
ফোন রেখে অব্দি হৃদপিণ্ড লাফাচ্ছে। বাবাইসােনার মায়ের জন্যে মন-কেমন করছে? ও যদি জানত, মা সত্যি এখন কোথায়! ‘কী গাে ম্যাডাম, মুখ হঠাৎ বাংলার পাঁচ হয়ে গেল কেন?’
কাবেরী অরণ্যর মুখের দিকে তাকাল। আস্তে-আস্তে বলল, ‘বাবাই ফোন ধরেছিল। ওর মন-খারাপ করছে।…চলাে অরণ্য, ফিরে যাই।’
অরণ্য একমুহূর্ত পলকহীন চোখে চেয়ে রইল। তারপর হাে-হাে করে হেসে উঠল!
‘তুমি পারােও বটে! ছেলের বয়েস পনেরাে হয়ে গেল, এখনও এত পুতুপুতু! জান, বিদেশে এই বয়েসের ছেলে গার্ল ফ্রেন্ডের সঙ্গে ডেটিং করে। থার্ডক্লাস ইন্ডিয়ান। সেন্টিমেন্ট! ফরগেট, ফরগেট অল। এখানে শুধু তুমি আর আমি। কলকাতায় ফেরার পর তােমার সংসার। আন্ডারস্ট্যান্ড?…চলাে, অনেক বেলা হয়েছে।’
কাবেরী ঘােরের মধ্যে ঘাড় নাড়ল। শিলিগুড়ি থেকে কালিম্পং পর্যন্ত আসা, ট্যুরিস্ট লজ বুকিং সব ব্যবস্থাই অরণ্য করেছে। নিখুঁত অ্যারেঞ্জমেন্ট।
কাবেরীর বাপের বাড়ি জলপাইগুড়ি শহরে। বহুদিন আসা হয়ে ওঠেনি। ফোনেই যােগাযােগ। পনেরাে দিন আগে বাবা জানালেন, মায়ের শরীর ভালাে নেই। মাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল। এদিকে ছেলের ফাস্ট টার্ম পরীক্ষা সামনে, সুবীরের পুজোসংখ্যার চাপ, সবাই মিলে বেরােবার উপায় নেই। অরণ্য শুনেই লাফিয়ে উঠেছে।
‘অ্যায়সা মওকা অওর কাঁহা মিলেগা…’ কাবেরী বড়-বড় চোখে চেয়ে ছিল। ‘বুঝলে না? সত্যি, মেয়েদের ঘটে বুদ্ধি এত কম! থােড়া সা দিমাক লাগাও ম্যাডাম।’ কাবেরী তবুও হাঁ। ‘শােন, ভালাে করে শােন। তুমি সুবীরদাকে বলবে ট্রেনের টিকিট কেটে দিতে। মাসিমাকে দেখতে যাবে। আমিও একই দিনের একই ট্রেনে টিকিট কাটছি। অফিস থেকে নর্থ বেঙ্গলের একটা অ্যাসাইনমেন্ট ম্যানেজ করছি। দুজনে টুক করে নেমে যাব এন জে পি। ওখান থেকে বাই কার স্ট্রেট কালিম্পং। দুরাত ওখানে মজা করে তুমি চলে যাবে। মার কাছে, আমি অফিসের কাজে। নাে রিস্ক। অ্যাগ্রিড?’
কাবেরীর বুকের মধ্যে হঠাৎ ঢাকের বাজনা বেজে উঠেছিল। মুক্তি! কতকাল পরে মুক্তির স্বাদ।
তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত সব ঠিকঠাক চলেছে। সুবীর এসেছিল স্ত্রীকে ট্রেনে তুলে দিতে। তিস্তাতাের্ষা হুইশল না দেওয়া পর্যন্ত অরণ্যর টিকি দেখা যায়নি। কাবেরীর বুক কাঁপছিল। ডানকুনি পেরােতেই মক্কেল হাজির। একই কোচে টিকিট। একটু দূরের বার্থ।
বাইরের লনে বাহাদুর দাঁড়িয়ে আছে। একগাল হেসে বলল, ‘মেমসাব, খানা রেডি। লাগা দে?’
‘হ্যাঁ।’ বিয়ের ঠিক পরে ওরা বেড়াতে গেছিল ভূটানে। সতেরাে বছর হয়ে গেল।
কাবেরীর স্পষ্ট মনে আছে, ভালােভাবে জানাজানি হতে-হতে কেটে গেল প্রায় তিনচারদিন। তারপরেও লজ্জা-সংকোচ! কাবেরী তখন মােটে কুড়ি। তার সঙ্গে সুবীরের ছবির নেশা। পাহাড়-অরণ্য নিসর্গ দেখে খেপে গেল। কাবেরীও ভীষণ ভালােবাসে প্রকৃতি, তবে ওর মতাে নয়। হানিমুনেও শান্তিনিকেতনি ঝােলা কাঁধে। যেখানে-সেখানে বসে পড়ছে। স্কেচবুক-পেন্সিল নিয়ে আঁকছে। সঙ্গে যে ফুটন্ত এক তরুণী আছে, হুশ নেই। কাবেরীর মাঝে-মাঝে বিরক্ত লেগেছে। প্রায় অপরিচিত স্বামী, মুখ ফুটে বলতে পারেনি।
সেদিক দিয়ে পাল্লায় মাপলে এবারের ‘সেকেন্ড হানিমুন’ কয়েকশাে মাইল এগিয়ে। কোনও তুলনাই হয়না। কাল সন্ধে পর্যন্ত একটু বাধাে-বাধাে ছিল। রাত নামলে সব বন্ধনমুক্ত। লজ্জাহীন। এখনও, এই প্রান্ত-যৌবনেও শরীর-মনে যে এত ইচ্ছে লুকিয়েছিল, বুঝতে পারেনি। একধাক্কায় বয়েস কমে গেছে দশবছর।
দুপুরে একশিফট আনন্দের পর ফুরফুরে মেজাজে ঘুম থেকে উঠেছে দুজনে। বাইরের লনে বিকেলের চা খাচ্ছে।
হঠাৎ কাবেরীর মনে পড়ে গেল। ‘শােন, একটা মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে।’ ‘কী?’ ‘আজ ফোন করা হয়নি। রবিবার। তােমার সুবীরদা বাড়ি থাকবে। বাবাই ফোন না পেয়ে যদি জলপাইগুড়ি ফোন করে?’
‘ও; ম্যাডাম! ফরগেট অল। তােমায় মানুষ করা গেল না। সর্বক্ষণ ভয়েই মরছ। ওরা ফোন করতে যাবে কেন? তুমি তাে কাল বলেই দিলে, তুমি করবে।’ ‘হ্যাঁ-না-মানে…করিনি তাে।’
‘করােনি আবার কি? আজ দিন চলে গেছে নাকি? এখন করবে। বি হ্যাপি, ননা। অ্যাংজাইটি। আই অ্যাসিওর য়ু, এভরিথিং ইস অলরাইট।… চলাে ।…’
কাবেরী পুটপুট বােতাম টিপল। বাজছে। বুকের মধ্যে ধকধক। কে ধরবে? সুবীর? ওর গলা কাঁপবে না তাে?
ফোন বেজে যাচ্ছে। কেউ ধরছে না তাে! বাড়ি নেই? কোথায় গেল? হ্যাঁ, ধরেছে। ‘হ্যালাে।’ ‘কেঅ্যা বলছ গ?’ ‘আমি কাবেরী। তুমি কে?” ‘ব-বউদি। আমি মানদা। তুমি কোথায় গ বউদি?’
কী হয়েছে? এসব জিগ্যেস করছে কেন? মানদার তাে এখন বাড়িতে থাকার কথা | নয়। ঠিকে লােক, বিকেলে আসে না। | তবু কাবেরী গলায় সব কর্তৃত্ব জড়াে করে বলল, ‘কে-কেন? আমি তাে এখানেই। তুমি একা বাড়িতে কেন?’
‘আমি তাে পাহারা দিইছি গ বউদি। তুমি কোথায় গ? দাদাবাবু তাে তখুন-তখনুই ফুন করল তােমার বাপের বাসায়। সিখানে ত তুমি যাও নাই গ।’
‘বাজে বােকো না! কী হয়েছে বলবে তাে?’
‘বউদি, খােকার পা ভেইঙে গেছে গ। বাথরুমে নাইতে গিছল। সাবানে হইড়কে পাইখানার প্যানে পা ঢুইকে গিছল। সে কী যন্তরনা ছিলেটার! খালি মা-মা করে চেল্লাছে, কাঁদছে…দাদাবাবু তাে পাগল-পাগল অবস্থা। তারপর গাড়ি নিয়ে ছুইটেছে নার্সিংহােমে…’
ভেঙে পড়ছে কাবেরী…তাসের ঘরের মতাে সব ভেঙে যাচ্ছে…। ‘ও-ওরা এখন কোথায় মানদা?’ ‘নার্সিংহােমেই আছে। দাদাবাবুর ছুটো ফোনে কথা করলি সব জানতি পারবে। রান্না পইড়ে আছে…আমি’
দড়াম করে ফোন নামিয়ে রেখেছে কাবেরী। আর শােনার, সহ্য করার ক্ষমতা নেই। অরণ্য কিছু বলতে গেছিল, কাবেরীর চোখমুখ দেখে চুপ করে গেছে। দুচোখ দিয়ে ফিনকি দিয়ে জল গড়াচ্ছে, শরীর বেতসপাতার মতাে কাঁপছে।
অতটা চড়াই পথ কিভাবে টানতে-টানতে নিজেকে নিয়ে এসেছে, জানে না। বাংলাের লনে পৌঁছে শরীর ছেড়ে দিল।
শরীরের সব জল কি আজ চোখ দিয়েই বেরিয়ে যাবে? বাবাইসােনা, ওর বাবাইসােনা!
পাশ থেকে অরণ্য কিছু বলতে যাচ্ছিল। অস্বাভাবিক জোরে চেঁচিয়ে উঠেছে কাবেরী, “চুপ করাে! আর একটাও কথা বললে
ওর চোখ জ্বলে উঠেছে বাঘিনীর মতাে। সীমাহীন ঘৃণা শরীরে মােচড় দিচ্ছে। সন্ধে নামছে। আলাের ফুলকি জ্বলে উঠছে কালিম্পং শহরে।
কাবেরী উঠে দাঁড়িয়েছে। হনহন করে ঢুকে গেল বাংলােয়। পিছন পিছন অরণ্য। অস্বাভাবিক দ্রুততায় ব্যাগে কাপড় গােছাচ্ছে। “এখনই আমি শিলিগুড়ি ফিরব। ব্যবস্থা করাে।’ ‘এত রাতে! সন্ধের পর পাহাড়ে—’ ‘কোনও কথা শুনতে চাই না। কাল সকালের মধ্যে আমায় কলকাতা ফিরতে হবে। সে। যেভাবেই হােক।’
অরণ্য চোরের মতাে দৌড়ে নিচে নেমে গেল।