আজ সারাদিন পূর্ণিমা টি ভি-র সামনে বসা। সমানে চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে চলেছে। কিন্তু কোনও প্রোগ্রাম ভাল লাগছে না। মনের ভেতরে কিছু অভিমান বাষ্প হয়ে ঘরের আবহাওয়াকে থমথমে করে তুলেছে। আজ সকাল থেকেই মস্তিষ্কের ভিতরে রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে।
সকালে দিল্লি থেকে ফোন এসেছিল। পূর্ণিমার ছেলে শুভাশিসের। পূর্ণিমার ভালমন্দ খোঁজ নেওয়ার পর শুভাশিস মাকে জানিয়েছিল ও এখন পূর্ণিমাকে নিতে আসতে পারবে না। অফিস থেকে সহজে ছুটি মঞ্জুর হয় না। এইবার অনেক চেষ্টার পর ছুটি পাওয়া গেছে। তাই পুত্রবধূর দাবি, শুধুমুধু কলকাতায় না গিয়ে বিশেষ বিশেষ জায়গার বিশেষ দ্রষ্টব্য দেখতে ও বেড়াতে হবে। তাই বউয়ের আবদার রাখতে তারা কলকাতায় যেতে পারছে না।
পূর্ণিমা ভেবেছিলেন সঞ্চয় যা আছে এবং প্রভিডেন্ট ফান্ড গ্র্যাচুইটি মিলিয়ে যা পাবে, তাতে বাকি জীবনটা ছেলে-ছেলেবউয়ের সঙ্গে থেকে বেশ স্বচ্ছন্দেই কেটে যাবে। পূর্ণিমা তো আর ছেলে-ছেলেবউয়ের নির্ভরশীলতায় বাঁচাবে না বরং ওর খরচের টাকা ওদের সংসারে তুলে দিয়ে ওদের সঙ্গে বাকিটা জীবন, সবার ভালবাসায় কাটিয়ে দেবে। কিন্তু আজ সকালে শুভাশিসের ফোন পেয়ে পূর্ণিমা বুঝতে পেরেছে পুত্র-পুত্রবধূ চায় না পূর্ণিমা ওদের সঙ্গে থাকুক। ছেলের কথা শুনে মন কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না যে ওদের থেকে মনে মনে ক্রমশই দূরের হয়ে গেছে পূর্ণিমা।
জীবনের সন্ধ্যাকালে নেমে এই এক অস্তিত্বের লড়াই। একটা বড় নিশ্বাস পড়ল পূর্ণিমার। পুরনো দিনগুলো হঠাৎ করে এসে কেমন যেন উদাস করা এক অনুভবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল আজ সারাদিন। চৈত্রের হাওয়ার মতো স্মৃতির শুকনো পাতাগুলি শুধু বারান্দায় লুটোপুটি খাচ্ছে। শুভাশিস বলেছিল, অফিস থেকে আবার যখন ছুটি পাবে তখন সুযোগ করে পূর্ণিমাকে দেখে যাবে। কিন্তু সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কথা একবারও উল্লেখ করেনি। এ কথা ভেবে দু’চোখে বেদনা ছলছলিয়ে ওঠে। হয়তো এ এক মায়া তাই দীর্ঘ দশ বছর ধরে তাদের আসার পথটা ছায়াময় হয়ে আছে। ধীর পায়ে উঠে টি ভি বন্ধ করে আবার ধীর পায়ে চেয়ারে এসে বসে পূর্ণিমা। তারপর পায়ের উপর পা তুলল, উরুর কাছে শাড়ি প্লেন করল এক হাত দিয়ে। চিবুকটি উঁচু করে একপলক চিন্তা করে নিল অন্য কিছু কী? খুব সম্ভবত পূর্ণিমা নিজের মনকে গুছিয়ে নিয়ে স্থির হল;
“যায় যাক সম্পর্ক এগিয়ে
থাকব একা দলছুট হয়ে।”
মনকে চোখ ঠেরে বুঝিয়েছে পূর্ণিমা, পুত্র-পুত্রবধূর কাছ থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে যেটুকু ভালবাসা পাওয়া যায়, সেটাই প্রাপ্য বলে মেনে নেবে। সম্পর্ক থেকে যদি রক্ত ঝরে তা হলে সব সম্পর্ক পৌঁছাবে লাশকাটা ঘরে।
সকাল দুপুর বিকেল সন্ধ্যা কত উদাসী প্রহর পূর্ণিমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। রাত্রি এলে বুকে ওঠে ভাবনার ঢেউ, সমুদ্রের নোনা জলের মতো অশ্রুবিন্দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে আসে বালিশে। রাত্রি আর কাটে না। কোনও কোনওদিন বাড়ির দোতলা বারান্দায় বসেই অভিমান বুকে নিয়ে কেটে যায় রাতের সবক’টা প্রহর।
সকাল থেকেই আজ পূর্ণিমার মনে হচ্ছে কেউ আসবে, আপন কেউ। সকাল থেকেই হাতের থালা-বাসন পড়ছে মেঝেতে । এই ধরনের কুসংস্কার পূর্ণিমা খুব একটা মানতো না। কিন্তু ছেলের অপেক্ষাই মনকে যেন জোর করে মানতে বাধ্য করছে। শুভাশিস আসবে…. আজকে যদি সত্যি শুভাশিস আসে। এখন শুভাশিসের আসার হাল ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু রক্তের সম্পর্ক এত তাড়াতাড়ি ভোলা যায় ?
সারাদিনের ক্লান্তিটাকে সরিয়ে দিতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দার আরাম কেদারায় শরীরটাকে বিছিয়ে দেয়। খানিকক্ষণ চোখ দুটো বন্ধ রেখে সামনে ব্যালকনির বাইরে চোখ মেলতেই কলিং বেল বেজে ওঠে। সচেতন হয়ে ওঠে পূর্ণিমা। যে সারাক্ষণ মন জুড়ে আছে, তার কথা ভেবেই দরজা খুলতে যায়। দরজা খুলেই পূর্ণিমার দৃষ্টি স্থির। দুধসাদা পায়জামা পাঞ্জাবি পরা এক অচেনা ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে রয়েছেন দরজায়। মাথা নিচু করে কুট কুট করে নোখ কামড়াছেন।
– কে আপনি? কাকে চাই?
পেছন থেকে আওয়াজ আসে। ‘ও অক্ষয়।’ পূর্ণিমা সিঁড়ির দিকে চেয়ে চেয়ে দেখে, বেটেখাটো সুশ্রী নীলিমা দাঁড়িয়ে। হাঁপাচ্ছে। নীলিমাকে দেখে পূর্ণিমা একটু এগিয়ে যায়। তারপর বলে, ‘এস এস। পাশের বাড়িতে থেকেও কতদিন পরে এলে। এস ঘরে এস।’ অভ্যর্থনা পেতেই অচেনা ভদ্রলোকটি সবার আগে তাড়াতাড়ি বারান্দায় গিয়ে সোফার উপরে ধপ করে বসে পড়েন। পূর্ণিমা একটু বিব্রত হয়ে বলে ‘আপনি কে? এইভাবে ঘরে ঢুকে বসলেন। ভদ্রলোক কিছুই বলেন না। চুপ করে থাকেন। এতক্ষণে নীলিমা এগিয়ে এসেছে। ‘ও আমার দাদা অক্ষয় মজুমদার। কাল রাতেই এসেছে।’ পূর্ণিমা একটু অপ্রস্তুত হয়। তারপর মুখে শব্দ করে, ‘ও।’
হঠাৎ নীলিমা পূর্ণিমার হাতটা টেনে অন্য ঘরে নিয়ে আসে। পূর্ণিমা বিস্মিত! অবাক হয়ে চেয়ে থাকে নীলিমার মুখের দিকে। নীলিমার ফরসা মুখটা কেমন যেন লালচে লালচে চোখে ঠেকছে। নীলিমা কী বলতে চাইছে। এই রকম গুপ্ত করে। নীলিমা কান্নাকান্না সুরে বলল, ‘পূর্ণিমাদি তোমার কাছে আজ বড় আশা নিয়ে এসেছি।”
— কী আশা? পূর্ণিমা বিস্ময়ে ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করে। একটু চুপ করে থেকে নীলিমা জানায়, ‘যেই ভদ্রলোকটিকে বাইরে বারান্দায় বসিয়ে এসেছে সে বর্তমানে একটু অসুস্থ। অতীত ভুলে গেছেন। তাই তোমার কাছে একটা অনুমতি নিতে এসেছি।’ — অনুমতি কিসের অনুমতি ? নীলিমা কান্নার সুরেই বলে— “তুমি যদি আমার অক্ষয়দাকে কিছুদিনের জন্য আশ্রয় দাও তা হলে আমি চিরজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।’
আশ্রয়। তিনি অসুস্থ, তাঁর চিকিৎসার প্রয়োজন। আপনজনকে দরকার। আমার কাছে নিয়ে এসেছ কেন! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না নীলিমা তোমার কথা। তুমি তাঁর ছোটবোন। তোমারই তো তাঁর দায়িত্ব নেওয়া উচিত! – হ্যাঁ, . নিতে পারতাম। নীলিমা একটু চাপা কণ্ঠে বলে— পূর্ণিমাদি, আমরা মেয়েরা সারাজীবন স্বামীর উপর নির্ভর করে দিন কাটিয়ে আসি। নিজস্বতা বলতে কিছুই থাকে না।
দেওয়ালে পিঠ না ঠেকলে নিজের অস্তিত্বের জন্য মাথা তুলে দাঁড়াই না।
তুমি তো জান? আমার স্বামীর সঙ্গে তার শ্বশুরবাড়ির সম্পর্ক ভাল নয়। শ্বশুরবাড়ির লোকদের সে সহ্য করতে পারে না। গতকাল দাদার আকস্মিক আবির্ভাবে আমি খুব ব্যস্ত হয়ে উঠেছি। আমার স্বামী পনেরো দিন হল ম্যাড্রাসে গেছে। আজ রাত্রে ফিরছে। সে এসে যদি দাদাকে এখানে দেখে তা হলে ঝড় বয়ে যাবে। দাদাকে কিছুতেই থাকতে দেবে না। আর এই অসুস্থতা নিয়ে দাদা কোথায় যাবে। কী হবে? এত সব ভেবে তোমার কাছে নিয়ে এলাম। আমার স্বামী দিল্লি, বম্বে, ম্যাড্রাসে যাতায়াত করতেই থাকে। আমি এর মধ্যে কিছু একটা ব্যবস্থা করে দাদাকে নিয়ে যাব। ততদিন তোমার কাছে থাকলে আমি নিশ্চিন্ত থাকব। দাদা চোখের সামনে থাকবে অন্তত।
পূর্ণিমা চুপ করে বসে কী যেন ভাবছে। নিস্তেজ, নীরস, একা জীবনে নীলিমার অনেক অবদান আছে, একবার বৃষ্টিতে ভিজে জ্বরে পাঁচদিন একা পড়েছিল পূর্ণিমা। তখন এই নীলিমাই সেবাযত্ন করে সুস্থ করে তোলে। কোনওদিন এ উপকার ভুলতে পারবে না পূর্ণিমা। আজ এ ঋণ শোধ করার সুযোগ এসেছে। কিন্তু এত বড় ঝক্কি সে সামলাবে কী করে! কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না পূর্ণিমা। এখন কী করা উচিত ?
নীলিমা সানুনয়ে বলল— পূর্ণিমাদি, এই বোঝা টানতে তোমার যে কত কষ্ট হবে তা আমি খুব বুঝতে পারছি। কিন্তু তুমি যদি রাজি হয়ে যাও তা হলে আমি বড় নিশ্চিত হই। পূর্ণিমা বারান্দায় বসা ভদ্রলোকটির দিকে চেয়ে থাকে। ভদ্রলোকের মুখে বিষাদের কুয়াশা, চেহারা অবিন্যস্ত। পূর্ণিমা এই মুহূর্তে কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। একটু থেমে প্রশ্ন করে, অক্ষয়বাবুর এরকম অবস্থার কারণ কী? ওঁর ছেলেমেয়ে নেই? যারা এই অবস্থায় ওকে দেখাশুনো করতে পারে ? নীলিমার মনের গভীর থেকে অক্ষয়বাবুর অতীতের কথা আর্তনাদ করে ওঠে। অক্ষয়দা তাঁর স্ত্রী অভিলীনাকে খুব ভালবাসতেন। স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া, মেয়েলি সংসারের ছোট ছোট কাজগুলি করে দেওয়া— সেই সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর মন দেওয়া নেওয়া খেলাটাও চলত। অভিলীনার সঙ্গ সব সময়ই চাইত অক্ষয়দা। স্বামী-স্ত্রীর ঘনিষ্ঠতায় এক এক করে পাঁচটি সন্তানের জন্ম। খুব সহজভাবে জীবনটাকে উপভোগ করেছেন। কিন্তু অভিলীনা জীবনের সন্ধ্যাবেলায় এসে আকস্মিক হৃদরোগে মারা যায়। অক্ষয়দা হঠাৎ একা হয়ে পড়েন। জীবনের সায়াহ্নে পৌঁছে তাঁর একা জীবন যেন আর কাটে না। স্ত্রীর মৃত্যুর পর ছেলে, ছেলে-বউদের, নাতি-নাতনিকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের অবহেলায় তাঁর মনের ভারসাম্য হারিয়েছে। সুস্থ পরিবেশের মধ্যে তাঁকে ফিরিয়ে আনা যেত; যদি সবাই মিলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত। কিন্তু সন্তানরা তাকে মানসিক হাসপাতালে পাঠিয়ে তাদের। কর্তব্য পালন করেছে।
একটা চাপা নিশ্বাস পড়ে নীলিমার। গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠে অনেকদিনের চাপা কান্না। নীলিমার হাতটা চেপে ধরে পূর্ণিমা। নীলিমা রুদ্ধ কণ্ঠে বলে— গতকাল অক্ষয়দা মানসিক হাসপাতাল থেকে পালিয়ে আমার কাছে চলে আসেন। তাঁর সন্তানদের কিছু জানাইনি কারণ, তারা জানলে ধরে বেঁধে আবার হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবে। জীবনের শেষ দিনগুলি ওখানেই কাটাতে হবে তাঁকে। ওই অসহনীয় বন্দি জীবনে।
নীলিমার কথা শুনতে শুনতে চোখ জলে ভরে গেছে পূর্ণিমার। অক্ষয়বাবুর অতীতের কথা শুনে নিজের জীবনের দুঃখকে বড়ই ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে। সত্যি বৃদ্ধ বয়সে ওদের পাশে এসে দাঁড়াবার জন্য একজনও অপেক্ষা করে নেই। পূর্ণিমা একটু নিশ্বাস টেনে বলল— নীলিমা, তুমি নিশ্চিন্তে বাড়ি যাও। তোমার দাদার ভার আমি নিলাম। তিনি এখানেই থাকবেন যতদিন তাঁর কোনও সুব্যবস্থা না হয়।
নীলিমা চলে যাওয়ার পর পূর্ণিমা একটু দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বলে— আসুন অক্ষয়বাবু, আপনার ঘরটা দেখে নিন।
পূর্ণিমার আহ্বানে কোনও প্রতিক্রিয়া হয় না। অক্ষয়বাবু চুপ করে বসে থাকেন। পূর্ণিমা অক্ষয়বাবুর মুখের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে দেখল। পৃথিবীর থেকে আলাদা কোনও জগতে তিনি আছেন। পূর্ণিমা এবার একটু কাছে এসে অক্ষয়বাবুর হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল- আসুন অক্ষয়বাবু, ঘরে আসুন। হাতটা ধরাতে, পূর্ণিমার দিকে শূন্যদৃষ্টিতে চাইলেন অক্ষয়বাবু। আসুন… আসুন বলে পূর্ণিমা হাতটায় আলতো টান দিল। বিছানার সবুজ গোলাপের ছাপা সাদা চাদরের দিকে চেয়ে আছেন অক্ষয়বার। পূর্ণিমা বলল— এটা আপনার খাট। এখানে বসুন। আসুন…..
এগিয়ে আসুন! ! কী হল? আসুন! পূর্ণিমা লক্ষ করে, উনি যেন একটু বেশি মনযোগ দিয়ে দেখছেন খাটে পাতা সাদা চাদরের উপর সবুজ গোলাপের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণিমা এগিয়ে গিয়ে তাঁর হাত ধরে টেনে এনে খাটে বসিয়ে দেয়। তারপর বলে— আপনি বসুন, আমি আপনার জন্য কিছু আনছি পূর্ণিমা রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যায়, ফ্রিজ খুলে সন্দেশ বের করে একটি কাচের প্লেটে সাজাতে সাজাতে ভাবে, অক্ষয়বাবুর হাত যখনই পূর্ণিমা ধরেছে তখন তাঁর চোখের শূন্য অথচ নরম দৃষ্টি দিয়ে অবাক হয়ে পূর্ণিমাকে দেখে। কী দেখে! হয়তো সে বুঝতে চায় – পূর্ণিমা কী তার পরিবারের কেউ একজন! কী জানি, ঠিক বোঝা যায় না, কী ভাবে মানুষটা ? মিষ্টির প্লেট নিয়ে পূর্ণিমা এসে দাঁড়ায়। অক্ষয়বাবু দেওয়ালের দিকে চেয়ে আছেন। সেই দেওয়ালে পূর্ণিমার যৌবনকালে বিয়ের সাজের ফোটো ঝুলে রয়েছে। মাথায় ঘোমটা দেওয়া, সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর, কপালে বড় লাল টিপ। অক্ষয়বাবু চেয়ে আছেন। ছবির দিকে। পূর্ণিমা কাছে এসে হেসে বলল – কে বলুন তো? অক্ষয়বাবু চুপ করেই আছেন। পূর্ণিমা নিজেই আবার বলল— ‘ওটা আমি।’ কোনও কৌতূহল নেই তাঁর দৃষ্টিতে। পূর্ণিমা সন্দেশের প্লেট এগিয়ে দিয়ে বলল – ‘নিন, খান।
আজ সাতদিন হয়ে গেছে। নীলিমা মাঝে এসে দেখে গেছে তার অক্ষয়দাকে। তারা ক’দিনের জন্য মুম্বই যাচ্ছে। পূর্ণিমাকে জানিয়ে গেছে নীলিমা।
সংসারের বাজার-হাট পূর্ণিমাকেই করতে হয়। অক্ষয়বাবুকে ঘরে ফেলে রেখে যাওয়া যায় না। মাঝে একদিন তাকে সঙ্গে নিয়েই বাজার করতে গিয়েছিল। সেদিন পূর্ণিমা প্রচণ্ড অস্বস্তিতে পড়েছিল। প্রত্যেকটা লোক ওদের দিকেই চেয়েছিল। সারাক্ষণ অক্ষয়বাবু পূর্ণিমার আঁচল ধরে ধরে থেকেছেন। এত বয়স্ক একজন মানুষ আঁচল ধরে আছেন বলে সবার মুখে হাসি। অস্বস্তি হচ্ছিল। ঘরে থাকলে পূর্ণিমার পায়ে পায়ে সারাক্ষণ থাকেন। মুখে কথা নেই। শুধু ། পূর্ণিমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে অনুসরণ করেন। রান্নাঘরে পূর্ণিমা কাজ করতে থাকলে, মানুষটা মোড়া পেতে দুয়ারে বসে থাকেন। প্রথম প্রথম খুব অসুবিধা বোধ করত পূর্ণিমা, কিন্তু এখন বুঝতে পারেন যে অক্ষয়বাবু নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। যে-সন্তানদের নিজের খুব কাছাকাছি ভেবেছিলেন, তারা কেউ তাঁর কাছের মানুষ হতে পারেনি। স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে দেখতে চায়নি। দিনের পর দিন ঘুমের ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে রেখেছিল। আলোর জগৎ থেকে অন্ধকারের দিকে তাকে ঠেলে দিয়েছিল। সকাল গড়িয়ে দুপুর। পূর্ণিমা রান্না করছে। অক্ষয়বাবু অন্যদিনের মতোই রান্নাঘরের দুয়ারে মোড়ার উপরে বসে মাথা নিচু করে এক দৃষ্টিতে মেঝের দিকে চেয়ে আছেন। রাস্তার পাশেই দোতলা বাড়ি পূর্ণিমার। ব্যালকনিতে দাঁড়ালে রাস্তার ব্যস্ততা দেখা যায়। একটা রিকশা গেল বিকট ভেঁপু বাজিয়ে। ক্ষণিক নিস্তব্ধতা। হঠাৎ শুরু হল নেড়ি কুকুরদের পরিত্রাহী চিৎকার।
বাড়ির ঠিক নীচেই। ওদের ঝগড়া লেগেছে বোধহয় । আর তখনই তীব্র গতিতে রান্নাঘরে ঢুকে পূর্ণিমাকে জড়িয়ে ধরলেন অক্ষয়বাবু। পূর্ণিমার বুকে মুখ লুকোলেন। পূর্ণিমা চিৎকার করে উঠল— ‘কী করছেন অক্ষয়বাবু, আমাকে ছাড়ুন…. ছাড়ুন আমাকে।
অক্ষয়বাবুরপুরুষালি বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা। করে। ‘ছাড়ুন আমাকে … সরে যান। ‘ এক সময় ধাক্কা দিয়ে অক্ষয়বাবুকে নিজের শরীর থেকে আলাদা করে দেয় পূর্ণিমা। চিৎকার । একটা বদ্ধ পাগল। আপনি করে “আপনি অসভ্য, জানোয়ার প্রকৃতির মানুষ। আপনাকে দয়া-অনুকম্পা সহানুভূতি কখনও করা যায় না। বেরিয়ে যান। চলে যান। চরম উত্তেজনায় ওর বুক ফুলে ফুলে ওঠে।
ওর কঠিন কথা শুনে অক্ষয়বাবু কুঁকড়ে যান।
জোরে জোরে নিশ্বাস পড়তে থাকে তাঁর। ধীর পায়ে চলে আসেন নিজের ঘরে। গুটিশুটি হয়ে বিছানায় মুখগুঁজে শুয়ে পড়েন। হঠাৎ যেন ঘরের আবহাওয়া থমথমে হয়ে যায়। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে।
। পূর্ণিমা চুপ করে বসে আছে বেতের চেয়ারে। এখন ও শান্ত। এতক্ষণ নিজের মনে অনেক প্রশ্ন উত্তর কষাকষি করেছে। কেন হঠাৎ অক্ষয়বাবু এরকম করলেন ! কটু কথাগুলো বলার জন্য এখন ভীষণ খারাপ লাগছে। সারাদিন মানুষটাকে। চ খেতে দেয়নি, খাওয়ার কথা জিজ্ঞেসও করা হয়নি। পূর্ণিমা নিজেও খায়নি। রাস্তার কুকুরদের ঝগড়া শুনেই উনি এরকম করেছিলেন। । নিশ্চয়ই কুকুরের ব্যাপারে তাঁর কোনও তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এই কথাটা মনে পড়তেই পূর্ণিমা চেয়ার ছেড়ে অক্ষয়বাবুর রুমে গিয়ে দাঁড়ায়। ভেতর দিকে তাকিয়েই বুকটা কেঁপে উঠে। চিৎকার করে ওঠে, ‘অক্ষয়বাবু… ! কী হয়েছে আপনার?’ কাছে গিয়ে দেখে, অক্ষয়বাবুর মাথার এক পাশ থেকে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। পূর্ণিমা সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মাথাটা কোলে নিয়ে আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে ঝরঝর করে কাদতে থাকে। ‘আমায় ক্ষমা করে দিন অক্ষয়বাবু, আমায় ক্ষমা করে দিন। আজ আপনাকে যা কটু কথা বলেছি তা ফিরিয়ে নিলাম। আমায় ক্ষমা করে দিন। আপনি এত বড় আঘাত নিজেকে করলেন কেন? এতদিন আপনাকে স্নেহ আদর দিয়ে আজ ঘৃণা-তাচ্ছিল্য ভরা কটু কথা বলেছি, আমাকে ক্ষমা করে দিন।’ অক্ষয়বাবু চেতনালুপ্ত হয়ে পড়ে আছেন। পূর্ণিমার নিজেকে দিশেহারা মনে হয়। কী করবে এখন! ডাক্তার সঞ্জয় মিত্রকে ফোন করে পূর্ণিমা। মিনিট দশেকের মধ্যে ডাক্তার মিত্র চলে আসেন। অক্ষয়বাবুর মাথার ক্ষতটি ড্রেসিং করে দেন।
পূর্ণিমাকে প্রেসক্রিপশন বুঝিয়ে প্রশ্ন করেন— পেসেন্ট আপনার কে হয় মিসেস রয়?
– পূর্ণিমা শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলে উনি আমার আত্মার কাছের মানুষ। -মানে? ডাক্তার মিত্রের ভুরু কুঁচকে ওঠে।
— অর্থাৎ উনি আমার আত্মীয়। যে আত্মার অনেক কাছে থাকে, সেই তো আত্মীয়।
সারাসন্ধ্যা কেমন করে কেটে গেছে তা বুঝতে পারেনি পূর্ণিমা। রান্নাঘরে গিয়ে একটা প্লেটে খাবার বেড়ে অক্ষয়বাবুর কাছে আসে। অক্ষয়বাবু বিছানায় শুয়ে আছেন। ওঁর ক্লান্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে পূর্ণিমার বুক ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠল। সারাদিন মানুষটা না-খাওয়া।
একটু কষ্ট করে উঠে বসুন। খাবারটা খেয়ে নিন। বলল পূর্ণিমা। অক্ষয়বাবু সামান্য উঠে বসতে চাইলেন, মাথাটা ভার ভার লাগছে হয়তো। আবার চুপ করে শুয়ে পড়লেন। পূর্ণিমা ওঁর মাথার কাছে এসে বসল; মাথাটি কোলে তুলে নিল। আলতো করে হাত বুলিয়ে দিল। অক্ষয়বাবু চেয়ে আছেন পূর্ণিমার মুখের দিকে।
পূর্ণিমার মুখে স্নিগ্ধ হাসি।
— খেয়ে নিন অক্ষয়বাবু। পূর্ণিমা একটু একটু করে খাবার তুলে অক্ষয়বাবুর মুখে দিয়ে দিচ্ছে, অক্ষয়বাবু চোখ বন্ধ করে ছোটশিশুর মতো খেয়ে চলেছেন।
সেবা আর প্রেম কখন যে এক হয়ে গেল বুঝতে পারল না। খাওয়া শেষ হয়েছে অক্ষয়বাবুর। প্লেটটা তুলে রান্নাঘরের দিকে এগোতে গেল পূর্ণিমা, হঠাৎ শাড়িতে টান পড়ল। পিছন ফিরে দেখল, অক্ষয়বাবু আঁচল ধরে আছেন। তারপর আস্তে করে নিজের খাবার লেগে থাকা মুখটা মুছে, আঁচলটা ছেড়ে দিলেন। পূর্ণিমার ঠোটে একটা মমতা ভরা হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠল। পূর্ণিমা ফিরে কাছে এসে অক্ষয়বাবুর ব্যথালাগা ক্ষততে একটা আলতো করে চুমু খেল, তারপর বলল— এবার ঘুমন। আমি এখানেই আছি। অক্ষয়বাবু আস্তে আস্তে বালিশে মাথাটা এলিয়ে দিলেন। এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেন। পূর্ণিমা খাটের পাশে হেলান চেয়ারে গা এলিয়ে দিতেই সারাদিনের ক্লান্তি এসে চোখ জড়িয়ে ধরল।
পর পর তিনটে দিন কেটে গেছে। এখন অক্ষয়বাবু আগের তুলনায় স্বাভাবিক। তবে এখনও মাথার ক্ষতর ব্যথা সারেনি। শরীরও দুর্বল। তাই অক্ষয়বাবুকে ঠিকমতো চান করাতে পারেনি পূর্ণিমা। তিনদিন ধরে তোয়ালে দিয়ে গা মুছিয়ে পুরনো জামাকাপড় ছাড়িয়ে পরিষ্কার ধোয়া পোশাক পরিয়ে দিয়েছে। প্রথম প্রথম খুব অস্বস্তিতে জামাকাপড় ছাড়িয়েছে পূর্ণিমা। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে জামাকাপড় পরাত। কিন্তু এখন অনেকটাই সুস্থ। তাই অক্ষয়বাবু নিজেই চান করতে বাথরুমে যাচ্ছেন। পূর্ণিমা না শুধু বলেছে দরজাটা বন্ধ না করতে। যদি পড়ে যায় ! অক্ষয়বাবু দরজা খোলা রেখেই চান শুরু করেন। ঝরনার নীচে দাঁড়িয়ে কী যেন খোঁজেন। কাছে গিয়ে বলে, ‘কী খুঁজছেন সাবান?’ অক্ষয়বাবু চুপ। পূর্ণিমা নিজেই বাথরুমে পূর্ণিমা একটু ঢুকে সাবান নিয়ে তাঁর গায়ে আলতো আলতো করে লাগিয়ে দেয়। অক্ষয়বাবু চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন। পিঠ থেকে সাবান ঘষতে ঘষতে তলপেটের দিকে হাত যেতেই অক্ষয়বাবুর মুখেহাসি শুনতে পায় পূর্ণিমা। প্রথমে বুঝতে পারে না, আবার সাবান ঘষতেই ঝরনার খোলা জলের আওয়াজের সঙ্গে অক্ষয়বাবুর হাসির তরঙ্গ ওঠে।
এই প্রথমবার, এতদিনের মধ্যে অক্ষয়বাবুকে হাসতে দেখছে পূর্ণিমা। চোখ আর কান যেন পারে,বিশ্বাস করতে পারছে না। পূর্ণিমা বুঝতে , অক্ষয়বাবুর নাভিদেশে হাত বোলাতেই তাঁর শরীর শিহরিত হয়েছে। পূর্ণিমার র কানে অক্ষয়বাবুর হাসি ভারী মধুর শোনায়। তাই বেশি করে নাভিদেশে সাবান বোলায়। ঝরনার খোলা জলে, গুম হওয়া বাথরুমে দু’জনের হাসি সপ্তম সুরে বাজতে থাকে। হা-হা-হি-হি-হো-হো । ভাললাগা মন্দলাগা অনুভবগুলি ভাগ করার মতো কেউ ছিল না দু’জনের জীবনেই।
অনেকদিন পরে পূর্ণিমা খুব হেসেছে আজকে।
তাঁর জীবনে ৫১টি বর্ষার পায়ের ছাপ মুছে গিয়ে আজকে নতুন করে বর্ষা নামল ছোট্ট বাথরুমে। দেহমন মুহূর্তে এক ছলছল জলে ভিজে ওঠে। দু’জন-দু’জনকে জড়িয়ে ধরে নির্মল হাসিতে জল তরঙ্গ তোলে। এক মুঠো খুশি ছড়িয়ে যায় মুহূর্তে, হাওয়ায়। আজ পূর্ণিমার স্বামীর কথা নতুন করে মনে পড়ে যায়। তারপর আলতো করে অক্ষয়বাবুকে ছেড়ে দূরে সরে আসে। ভেজা শরীর নিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে চলে আসে। ঘরে ঢুকে প্রথমেই শাড়িটা খুলে ফেলে। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজেকে দেখতে থাকে। শরীরটা এখনও ছিপছিপে। সুন্দর সুডোল। কিন্তু সুন্দরী যুবতীর মতো অবয়ব আর নেই। পঁচিশ বছর আগে যখন পূর্ণ যৌবন নিয়ে এই আয়নার সামনে দাঁড়াত, তখন তার নিজের প্রতিফলিত ছবি ঝলমল করে উঠত। স্বামীর মৃত্যুর পর সুন্দর ও ভাললাগা জড়িয়ে নিজেকে আর কোনওদিন এমনভাবে আয়নাতে দেখেনি। শীতের হিমেল হাওয়াতে, বসন্তের দক্ষিণা বাতাসে নিজেকে বুঝতে চায়নি কখনও। কিন্তু যৌবনের দিন পেরিয়ে এসে জীবনের সন্ধ্যাকালে হঠাৎই অক্ষয়বাবুর ছোঁয়ায় উত্তর ৫১-র শরীরটা উষ্ণতায় কেঁপে উঠছিল। মনে একটা ঝড় উঠছিল। তার আভাস পেয়েই পূর্ণিমা তাঁর থেকে সরে এসেছে। হঠাৎ সে দরজার কাছে আওয়াজ শুনতে পায়। পূর্ণিমা চেয়ে দেখে অক্ষয়বাবু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। স্নানসিক্ত নির্মল শরীর। অক্ষয়বাবুকে দেখে তাড়াতাড়ি তোয়ালে দিয়ে নিজের বক্ষদেশ ঢেকে নেয়। কৌতুকভরে তাকায় লম্বা-চওড়া, মাথা ভরা কাচা-পাকা চুলের এক্কেবারে ছেলেমানুষটার দিকে। শিশুর মতোই হাবভাব। হঠাৎ একটা উত্তরের হাওয়া এসে অক্ষয়বাবুর ভেজা শরীরটা কাঁপিয়ে দেয়। ঠোঁট কাপতে থাকে অক্ষয়বাবুর। পূর্ণিমার মনে পড়ে শুভাশিসকে বড় করে তুলতে কতখানি মমতা ও উষ্ণ ভালবাসা খরচ করেছিল, তার কোনও হিসেব নেই। পরিবর্তে কিছুই পায়নি সে। সম্পর্কের ভিত নড়ে গেছে। পুত্র-পুত্রবধূর এক মুহূর্ত সময় নেই পূর্ণিমার জন্যে। অথচ একটা সময় ছিল, যখন পূর্ণিমা নিজের যৌবন, ভালবাসা নিংড়ে নিয়ে সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য সমর্পণ করে দিয়েছিল। স্বামীর মৃত্যুর পর অনেক প্রিয়তম মানুষ এসেছিল জীবনে, কিন্তু সন্তানের মুখ চেয়ে সব কিছু ভুলে গেছে। কর্তব্য করেছে। নিজের ভবিষ্যৎ তিলে তিলে নষ্ট করে দিয়েছে। এই দুর্লভ দানের মূল্য বা মর্যাদা শুভাশিস কিছুমাত্র বুঝল না। পূর্ণিমার ভূমিকা শেষ হয়ে গেছে শুভাশিসের জীবনে। তাই ওরা দ্রুত গড়িয়ে গিয়ে ওদের নিজের শ্রেণির মানুষের ভিড়ে মিশে গেছে। আর পূর্ণিমাকে দল ছুট করে, ছিন্ন করে, মাড়াই করা আখের মতো ফেলে দিয়েছে। পূর্ণিমা ছেলেকে ফোন করলে দুটো কথা বলে রিসিভার নামিয়ে রাখে।
পূর্ণিমা অপমানে অভিমানে দূরে সরে এসেছে ক্রমাগত। তাতে ছেলে-ছেলে-বউয়ের কোনও ক্ষোভ বা দুঃখ হয়নি। তারা বুঝিয়ে দিয়েছে পূর্ণিমাকে, ওরা তার কেউ নয় ।
অক্ষয়বাবুর কাপুনিটা বেড়ে গেছে। দাঁতে দাঁতে কিট কিট কিট শব্দ হচ্ছে। পূর্ণিমা এগিয়ে গিয়ে অক্ষয়বাবুর হাতটা ধরে এনে খাটের এক কোনায় বসায়। তোয়ালে দিয়ে অক্ষয়বাবুর ভেজা চুলগুলি মুছে দেয়। বেশিক্ষণ ভিজে থাকাতে অক্ষয়বাবুর শরীরটা থরথর করে কেঁপে চলেছে। পূর্ণিমা তাড়াতাড়ি ভেজা জামাকাপড় ছাড়িয়ে খাটে শুইয়ে গায়ে চাদর ঢেকে দেয়। তবুও অক্ষয়বাবুর কাঁপুনি কমে না। অনবরত কেঁপে চলেছেন। পূর্ণিমার মন কেবলই বলছে আর একটু বেশি উষ্ণতা পেলে অক্ষয়বাবু ঠিক হয়ে যাবেন।
কী করবে পূর্ণিমা? — যেখানে প্রিয়জনের আদরের প্রয়োজন, পূর্ণিমা জানে ওর বুকে জমে থাকা অনেক কান্না গলে গিয়ে
সেখানে আদরের আশায় সপসপে হয়ে আছে তাদের সময়।
নর্মদা ধারায় মিশে যাবে, অতীত নির্জন হবে। কিন্তু এই অবুঝ ছেলেমানুষটার সঙ্গে কেমন যেন একটা হৃদয়ের নৈকট্য অনুভব, তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ। যেখানে সাধারণ মানুষের অনুভব পৌঁছাবে না। পূর্ণিমা তাই বিবস্ত্র হয়ে অক্ষয়বাবুর চাদরের তলায় নিজেকে মেলে ধরে। নির্জনতার সুখটুকু পাওয়ার প্রত্যাশায় নয়, অবুঝ ও ছোট্ট শিশুমনের মানুষটিকে নিজের জীবনে ঠেকিয়ে রাখার আশায়। জীবনে বেঁচে থাকার লোভটাও তো কম নয় ! প্রয়োজন ছিল উষ্ণতার, ছিল বড় প্রয়োজন। দিনের শেষে সন্ধ্যা নেমে এল। টিম টিম করে জ্বলছে জীবন প্রদীপ। সন্ধ্যার পরেও জীবন বাঁচতে চায়। সন্ধেটা এলোমেলো করে দিল উষ্ণ ঝরা বাতাসে, পূর্ণিমা চোখ মেলে দিল আকাশে। ওর দৃষ্টিতে পাতা ঝরা দিন— সামনের দিকে নেই কোনও প্রত্যাশা জাগা সবুজের আমন্ত্রণ।