শামসুর রাহমানের কিছু কবিতার অংশ

›› কবিতার / কাব্যের অংশ  

অভিশপ্ত নগরের ঠোঁট

অভিশপ্ত নগরের ঠোঁট, শিরদাঁড়া, বুক ছুঁয়ে
হাওয়া বয়, কোট নড়ে। তপ্ত দু’টি চায়ের পেয়ালা
গেইশা নারীর মতো, কাকাতুয়া-ঝুটি কাঁপে, কালো
টেবিলে চামচ কথা বলে পিরিচের সঙ্গে, দূরে
গণিকার আলো-নেভা আস্তানায় বিষণ্ন নাবিক
অতিশয় ব্যবহৃত স্তনে হাত রেখে ঘন ঘন
নাক ডাকে, কুকুরের ক্রন্দন, পাড়ায় চৌদিদারি
হাঁকডাক ঝিমধরা নৈঃশব্দ্যকে ভীষণ অসুস্থ ক’রে তোলে।

……………….

অসামান্য তিথি

………………..

কিন্তু তুমি ছায়া নও, নও তুমি অশরীরী কেউ,
তোমার বেদেনী-চোখ, ক্ষীণ কটি আর স্তনভার
নিয়ে তুমি আজো কী সজীব জ্বলজ্বলে উপস্থিতি।
যেখানেই থাকো, যতদূরে বিস্মৃতির ক্রূর ঢেউ
তোমাকে সরিয়ে নিতে পারে না কখনো; বারবার
ফিরে আসে আমাদের কী মদির অসামান্য তিথি।

আত্মজৈবনিক

…………….

সগৌরবে ঢাক-ঢোল বাজালো সে ধ্বংসের উৎসবে
যারা তারা কেউ পেলে শিরোপ, কেউবা পতনের
ঝাঁ-ঝাঁ স্মৃতি; বহু মাঠ গেলো ভরে নামহীন শবে।
পচা মাংস দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে বেশ্যার স্তনের
উষ্ণতার মনস্তাপ মাখে যে- লোকটা মগজেই
ঘোরে তার শবাধার, একগাছি দড়ি কিংবা ক্ষুর-
যা-কিছু হননপ্রিয়, যা-কিছু অত্যন্ত সহজেই
জীবনকে করে তোলে অর্থহীন জীর্ণ আস্তাকুঁড়।

……………..

আমার আঙুল কামড়ে ধরে

……………..

ভাল কথা নিজের বিষয়ে
একটা জরুরি তথ্য জানাতে ভুলে গিয়েছি
আমি এই শহরেরই একজন কবি
বইয়ের দোকানে আমার কিছু কাব্যগ্রন্থ কিনতে পাওয়া যায়
সমালোচকদের জহুরী নজর আছে
আমার ওপর
বলা যেতে পারে কবিতা সম্পর্কে নিজস্ব কিছু
ধারণাও আছে আমার
আমি চাই আমার প্রতিটি পংক্তিতে
তরুণ পাখির ডানার ঝলসানি আর স্পন্দন
তন্বী স্তনের নিটোল সুষমা
বুদ্ধিমান যুবকের দিলখোলা হাসি এবং
বয়েসী দুঃখী মুখের কুঞ্চন

……………..

আমার মৃত্যুর পরে

……………..

জানি না তুমি তক্ষুণি ছুটে আসবে কি না
আমার বাড়িতে, আমার লাশের উপর লুটিয়ে প’ড়ে
উদ্বেলিত নদী হয়ে উঠবে কি না। না কি শুধু আড়ালে
দাঁড়িয়ে উদাস দৃষ্টি ছড়িয়ে দেবে দূরের আকাশে!
হয়তো তখন আমার কিছু কবিতা
উড়ে আসবে তোমার দিকে আদর কুড়াতে,
যেমন আমি
ব্যাকুল হয়ে উঠতাম তোমার স্পর্শের জন্যে,
চুম্বনের প্রত্যাশায়। এক সময়
হয়তো সবার অগোচরে তুমি নেবে বিদায়।
আমার মৃত্যুর পরে কিছুকাল তোমার ভেতরে
চলতে থাকবে ভাঙচুর, মাঝে মধ্যে চোখ দুটো
হয়ে উঠবে শ্রাবণের ভরা নদী;
টেলিফোনে বেজে উঠলে
সারসের মতো, হঠাৎ তোমার হৃৎস্পন্দন যাবে বেড়ে।
না, তুমি আমার কণ্ঠস্বর শুনতে পাবে না আর।
কোনো কোনোদিন
যখন স্নানঘরে নিজের উন্মোচিত যুগল স্তনে চোখ
যাবে, তখন
হয়তো তোমার মনে পড়বে, আমি ওদের
নাম রেখেছিলাম জেদী, স্বর্গীয় ফল।

কিছুকাল মনে মনে শোক পালনের পর আস্তে-সুস্থে
সবকিছুই হয়ে আসবে স্বাভাবিক। স্বামীর সঙ্গে
মাঝে মাঝে রাত্রির তৃতীয় যামে রতিবিহারে জীবনের
তাপমুগ্ধ হবে তুমি,
(মৃত্যু বড় হিম, মৃত্যু বড় দুঃসহ শীতল, প্রিয়তমা)
পুত্রকন্যার প্রতি তোমার স্নেহ বাড়বে বৈ কমবে না
এক রত্তি,
আনন্দে মেতে উঠবে বান্ধবী-সম্মেলনে আগেকার
মতোই।
মাঝে-মাঝ কাউকে কাউকে পাঠাবে
নিজের তৈরি শুভেচ্ছা কেক কিংবা অন্য কোনা
উপহার।

……………..

আমৃত্যু আমার সঙ্গী কবিতার খাতা

……………..

আমি আর কবিতার খাতা।
কমল মজুমদার পাঠ করে চণ্ডালের হাঁড়ি, শ্মশানের
তন্বী সতী, তার বানভেজা স্তন আর
গোলাপ সুন্দরী আর শ্যাম নৌকার নিকট থেকে
কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।

……………..

একশ চার ডিগ্রী জ্বর

……………..

বলা নেই কওয়া নেই কোত্থেকে এক সুন্দরী
দাঁড়াল আমার সামনে
তার চুল লাল
চোখ লাল
স্তন লাল
লাল তার ঊরু আর নিতম্ব অগ্নিশিখা তার বগলের চুল
সেই লালচুল সুন্দরী আমার দুচোখে হৃদ্যতাবশত
সামনে ছুঁড়তে থাকে ত্রন্তার জ্বলন্ত রক্তজবা
দেখতে পেলাম সুন্দরীর শুধু একটিমাত্র স্তন এবং
তার সঙ্গী স্তনটি যে জায়গায় থাকার কথা সেখানে
জমাট হয়ে আছে বৃদ্ধার ফোকলা হাসি
অসহ্য উত্তাপের মধ্য থেকে
আমি বিকশিত হচ্ছি আগুন রঙের ফুলের মত
আমার মাথাটা এখন রবারের বেলুন
চিল বালিহাঁস আর ঈগলকে নিচে রেখে দিব্যি
উঠে যাচ্ছে ক্রমাগত উপরে উঠে যাচ্ছে
বেলুনের সুতাগুলো ছিঁড়ে যাওয়ার যোগাড়
এক ঝটকায় ঝরে গেছে আমার বয়স
যেমন খসে পড়ে পুরোনো দালানের চুনবালি

……………..

এবং প্রকৃত বিল্পবীর মতো

……………..

এলভিস প্রেসলির মৃত্যু রটে গেছে চরাচরে। চারখানায়
আড্ডা জমে, পপ সুরে মারফতী গান শুনে মাথা নাড়ে বিগত-যৌবন
ফেরিঅলা। অন্ধকারে তরুণ কবির চোখে পড়ে
অপ্সীরর স্তন,
হিজড়ের সুবজাভ গাল, নর্দমায় ভাসমান সুন্দরীর মৃতদেহ।
দ্যাখো দ্যাখো এ শহরে কী ঘর বানায় ওরা শূন্যের মাঝার।

……………..

কতকাল পরে

……………..

কী করে তোমার রূপ বর্ণনা করি?
তোমার দু’চোখ কী-যে সুন্দর, ভাবি।
স্তনের ডৌল স্বর্গেয় উদ্ভাস,
সোনালি চূড়ায় আমার কি আছে দাবি?

ক্রমে যাবে বেড়ে অন্যের প্রাণবীজ
হয়তো আচরে তোমার গর্ভাশয়ে।
বন্ধ্যা সময়ে তুমি বসন্ত-ফুল,
আমার জীবন চিহ্নিত শুধু ক্ষয়ে।
আমার বাগান মুমূর্ষ ইদানীং
কর্কশ সব ঘাতকের তাণ্ডবে;
সত্তায় বয়ে দুঃস্বপ্নের ছায়া

……………..

কালেভদ্রে একটুখানি

……………..

যখন তুমি ধূসর দূরে বসে থাকো,
হিস্পানী এক গিটার বাজে
করুণ সুরে মনের ভেতর,
যখন তোমার হৃৎকমলে চুপিসারে
ভ্রমর কালো ছায়া ফেলে,
পানিমগ্ন শিলার মতো
অবচেতন নড়ে ওঠে ঠারে ঠোরে,
আমার বুকে ধাক্কা লাগে, দদ্মবেশী
আদিবাসী বিস্ফোরিত আর্তনাদে।
যখন তোমার আঁটো স্তনে
জ্যোৎস্না কোমল শুয়ে থাকে,
রহস্যময় একলা গাছে নিভৃতে ফল
পাকতে থাকে।
যখন তোমার গালে জমে রাতের শিশির,
কবন্ধ পাঁচ অশ্বারোহী ছুটে বেড়ায় তেপান্তরে।

……………..

কালো মেয়ের জন্যে পঙ্‌ক্তিমালা

……………..

তুমি যখন প্রথম চোখ মেলেছিলে, কালো মেয়ে,
স্বল্পালোকিত কাঠের কেবিনে,
তখন তোমার মুখের দিকে ঝুঁকেছিল একটি কালো মুখ।
যে-স্তন তোমার শিরায় শিরায় বইয়ে দিয়েছিল
জীবনের ধারা, কালো সেই স্তন।
তোমার দোলনা দুলিয়েছিল যে-হাত
সে-হাত কালো,
তোমার জন্যে রুটি বানিয়েছিল যে-হাত,
সে-হাত কালো,
তোমার হাতে প্রথম কাঠের পুতুল
তুলে দিয়েছিল যে-হাত
বড় স্নেহার্দ্র, বড় কালো সে হাত।

 

কালো মেয়ে, তুমি দারিদ্র্যের গহ্বরে
হামাগুড়ি দিয়ে
মিথ্যার মতো শাদার উৎপীড়নে ধুঁকে ধুঁকে
লাঞ্ছনার অট্রহাসি শুনে বঞ্চনার শত খানাখন্দ
পেরিয়ে গায়ে উপহাসের কাদা মেখে,
পা ঝাড়া দিয়ে জ্যোৎস্নার চন্দনলিপ্ত হরিণীর মতো
এসে দাঁড়িয়েছো যৌবনের চূড়ায়। তোমার বরকে ওরা
ঘরচাড়া করেছে, ওর কালো মথমলের মতো কণ্ঠস্বর
ওরা স্তব্ধ করে দিয়েছে, তোমার কানে কোনোদিন আর গুঞ্জরিত
হবে না তার তারা-ঝলসিত গান। কিন্তু, কালো মেয়ে,
তরমুজের মতো তোমার উদরে
মাসের পর মাস বেড়ে উঠছে ওর সন্তান।

……………..

কোনো কোনো কবিতা

……………..

কোনো কোনো কবিতা রহস্যময় বাদুড়ের মতো ঝুলে থাকে
জ্যোৎস্না রাতে কোনো কোনো কবিতাকে মনে হয় একান্ত পথিক
ধুলোময় পায়ে দূর তীর্থে চলেছেন একা। কোনো কোনো
কবিতা প্রকৃত
বিপ্লবীর মতো তার প্রিয়তমা রমণীর স্তনচূড়া, নাভিমূল থেকে
নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বয়ম্ভর দুর্গম টানেলে সরে যায়।
কোনো কোনো কবিতা কী সুখে ঘর-গেরস্থালি করে,
কখনো কবিতা এক মুখ ব্যান্ডেজের ফাঁকে দুই ফোঁটা চোখ,
কোনো কোনো কবিতা কখনো উপদ্রুত এলাকায়
ত্রাণ সামগ্রীর মতো সেবাপরায়ণ।

ঘরের মাঝখানে

……………..

এই তো এখন ক’পা এগোলেই আমার দু’হাত
অনাবৃত তোমার শরীরে
হতে পারে চকিতে পিয়ানো বাদকের
সুরেলা চাঞ্চল্য। তুমি জেগে
উঠবে এই ভয়ে আমি দূরত্বকে কাঙ্ক্ষনীয় ভেবে নিথর দাঁড়িয়ে থাকি।
তোমার
নিদ্রিত
আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে কনক চাঁপার
বিচ্ছুরণ, শব্দহীন স্তোত্রপাঠ হয়,
চৈত্ররাত্রি গান গায় তোমার শরীরে। নক্ষত্রের
যমজ সুচারু তোড়া নিতম্ব তোমার নিশীথের কাফ্রি-ঠোঁট
অক্লান্ত লেহন করে, তোমার অলস এলানো
স্তনটিকে, ঈষৎ স্ফুরিত রক্তিমাভ
ঠোঁটে স্বপ্নভাষা স্মৃতি তৈরি করে, পদ্মের মতন
পেটে কতিপয় অলৌকিক আঙুলের খেলা, তুমি
যেন কোনো দূর-দ্বীপে সদ্যোজাত স্বপ্নের মতন শুয়ে আছ
একাকিনী সেই কবে থেকে।

……………..

ডালকুত্তা

……………..

ওরা কারা আসছে উল্টো দিক থেকে
কণ্ঠে বরাভয়ের গান
প্রায় বেরিয়ে-পড়া আমার চোখ
এখন জ্বলজ্বলে বাঁচার তীব্রতায়
আমার চোখে নিসর্গের চুল ওষ্ঠ স্তন নাভিমূল
আর নিতম্ব বেহেশতের বিকল্প

শব্দ

……………..

রাত্রির জঠরে দাঁড়ানো শেয়ালের চোখ থেকে,
বরজাশ্রয়ী পানপাতা থেকে, অনূঢ়ার স্তন থেকে, ঈগল
আর সাপের অমীমাংসিত বিবাদ থেকে, ভোরের
স্পর্শ-লাগা
ডিমের কুসুম থেকে, সন্ন্যসীর পিঙ্গল জটা, অমিততেজ
শহীদের বুকের গোলাপ ফুটো, মগরেবে হঠাৎ-দেখা
সিজদারত মানুষের চন্দ্রাকৃতি, সুরাইয়ের ছায়া,
পূর্বপুরুষদের অস্পষ্ট পদধ্বনি আর
বল্লমবিদ্ধ গলার আর্তনাদ থেকে টপকে পড়ে শব্দ।

……………..

সারা জীবনই গোধূলির-আকাশ

……………..

যেখানে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো, সেখানেই দখলি। আমার কান ঘেঁষে যাওয়া
পরিযায়ী পাখি এক লহমায় ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান। চুলে নক্ষত্রের নাচ,
জ্যামিতিক গাছ ধারণ করে কোজাগরী জ্যোৎস্না, গলে গলে পড়ে সাধুর্য।
কয়েক ঘণ্টা পরে উঠবে টকটকে সূর্য, শিরায় টগবগানি। এক খণ্ড বড়সড়
পোয়াতি জমি অচিরে করবে প্রসব। ধান, পাট, গম, যব, ভুট্রা, আলু, আদা,
সর্ষে-কোনো ফসলসম্ভার নেবে সূর্যের চুম্বন, হাওয়ার আলিঙ্গন? সে জমি
আমার লক্ষ্যবস্তু বহু প্রহরের, তাকে দেখি জ্যোতির্বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে। নিয়মিত
নিড়াই, আগাছাগুলো মৃত সৈনিক। পানি গড়ায়, স্ফীতি-মৃত্তিকা-যোনি; হঠাৎ
জমির ওপর ধর্ষিতা নারীর ছিন্নদেহ, উনিশ শ’ একাত্তরটি সূঁচ-বসানো স্তন,
বৃদ্ধের বুলেটে ঝাঁঝরা বুক, বন্দুকের বাঁটে শিশুর থ্যাঁতলানো মুখ, গেরিলার
উত্তোলিত বাহু আর ফাঁকে ফাঁকে শৌর্যের সূর্যমুখী।

……………..

Leave a Reply