রুবি কখন আসবে – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়

›› উপন্যাসের অংশ বিশেষ  

……….সারা দুপুরে, মাঝে একটু ঘুম মেরে নিয়ে, আমরা দু’বার সঙ্গম করলাম। দু’বারই করতে হয় আমাদের। কেন না, দ্বিতীয়বারের আগে রুবির কাঁপুনি আসে না। কোমর অসাড় হয় না। এটা বহুপরীক্ষিত। রুবির যৌনতার এটা একটা পরম কৌতূহলােদ্দীপক দিক, আমার কাছে। কৌতুকময়ও বলতে পারি। এক কথায় বলতে গেলে, পরম রমণীয়ই বলা উচিত, ‘রমণী’ শব্দটি যদি বাচ্যার্থে ধরি। অন্যত্র, সর্বত্র প্রেম। কিন্তু, ফ্ল্যাট-প্রবেশের পর দরজায় ছিটকিনি তােলার পরমুহূর্ত থেকে তার ভূমিকা যেত কী পাতিনাটকীয়ভাবে বদলে!……..

………..বিয়ের আগে আমি শিয়ালদহর কাছে নুর মহম্মদ লেনে একা থাকতাম। রােজ রাত ১১টা নাগাদ দৃশ্যটি অভিনীত হতে দেখা যেত। বন্ধুবান্ধবদের ভিড় জমে যেত সেই অনির্বচনীয় নাইট শােতে।… রাস্তার ওপারে আমাদের দোতলার ছাদ থেকে কিছুটা উঁচুতে চারতলার ফ্ল্যাটে একটি নবাগত মাড়ােয়ারি-পরিবার। নতুন বউ পাশের ঘরে সেই দশটা থেকে শ্বশুর-শাশুড়ি আর ননদদেওরদের সঙ্গে গল্প করছে তাে করছেই। আর তার বরের অন্ধকার সিলুয়েট, এ ঘরের জানালায় সিগারেটের পর সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, এই যে রতিবিমুখ বধূ যেনাকিরমণকক্ষের ছিটকিনি পর্যন্ত বন্ধ করত কত না আলস্যভরে— নীল আলাে জ্বালিয়ে দেওয়ার পরমুহূর্তে সে শাড়ি ও ব্লাউজ খুলে দড়িতে ঝুলিয়ে দিত সে কী ঝপাঝপ দ্রুততায়! তারপর শায়া ও ব্রেসিয়ার পরে জানালার নিচে ডুব মারত। বলাবাহুল্য, ও-দুটি সে স্বামীকে দিয়ে খােলানােই মনে করত শ্রেয়। (উল্লেখ থাকে যে, ব্যবসা ও রতিক্রিয়া উভয় ক্ষেত্রেই মাড়ােয়ারি সম্প্রদায় পুরু ও মােটা গদি ব্যবহার করে থাকে, যা পাতা হয় মেঝের ওপর।)

ফ্ল্যাটটি উঁচুতে বলে এ-ছাড়া কিন্তু দেখা যেত না কিছুই। দড়িতে টাঙানাে শাড়ি ও ব্লাউজের ওই উড়ন্ত দৃশ্য ছাড়া। আর এই দৃশ্য দেখতে প্রতি রাত্রে সাহিত্যযশপ্রার্থী বন্ধুদের ভিড় জমে যেত আমার ঘরে। শচীন, প্রবাল…এরা তাে আসতই।নাম করে লজ্জা দিতে চাইনা। আজকের পুজো সংখ্যার খেপ-মারা কবি-সাহিত্যিকরা অনেকেই এসেছে। কারণ একটাই। সারারাত শুধু পাখার হাওয়ায় শাড়িউড়বে আর ব্লাউজ উড়বে—বাকিটাভিস্যুয়ালাইজ করতে হবে যার-যত কল্পনাশক্তির জোরে— পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লিটারারি ওয়ার্কশপ ছাড়া একে আর কী বলব। অন্তত, কল্পনাশক্তির উদ্বোধনের দিক থেকে। অর্কপ্রভ তাে প্রবন্ধ লিখত। এই দৃশ্য লেংচে দেখতে দেখতেই একদিন তালগাছ হয়ে উঠল তার স্নায়ুসমূহ। এখন তাে রাবােসমান বিখ্যাত কবি। মােট কথা, জানালার কুঁজো থেকে পতিব্রতার জলপান করার আগে পর্যন্ত সবাই রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা করত। কেউ নড়ত না।…………

……….মেয়ের কথা শুনে বিস্মৃতির গহুর থেকে আজ তিরিশ বছর পরে খিলখিল হেসে উঠে এল স্মৃতি-বিস্মৃতির চেয়ে কিছু বেশি সেই নীল সাপ, যা উল্কি হয়ে আঁকা ছিল সাঁওতাল রমণীটির খােলা বুকে, যুগান্ত পেরিয়ে আমার মনে পড়ল— তার প্রখর স্তনবৃন্তের দিকে সাপটি বাড়িয়ে দিয়েছিল তার হাঁ-করা মুখ। বাড়ির ভিতর নিয়ে গিয়ে উঠোনে প্রায়ান্ধ আকাশের নিচে আমি তার বুক খুলেছিলাম। তার স্তনের-দিকে-সাপ দেখেই আমি প্রথম কেঁপে উঠি। তারপর হাত-পা দেখি। তারপর পিছােতে থাকি।………

………….‘আমার মডেল-ফডেল লাগে না। মন থেকে আঁকি। তুমি পিকাসাের কাছে যাও। ওর এ-সব দরকার হয়।

মেয়েটি ঠোট-টোট ফুলিয়ে বলল, গিয়েছিলাম তাে। পিকাসাে-মাতিসে তখন খুব রেষারেষি বন্ধুত্ব। মাতিসের খুব খাতির, নামডাক। পিকাসাে ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরছে। স্ক্যান্ডালের গন্ধ পেয়ে মাতিস আঁকা থামিয়ে জানতে চাইলেন, কী-রকম! কী-রকম!

‘দেখুন না! আমি জামাকাপড় পরে সিটিং দিচ্ছি। উনি আঁকছেন। আর মাঝে মাঝে মাথা নিচু করে, ক্যানভাস ছেড়ে এসে আমার বুকটা টিপে যাচ্ছেন। আমি মৃদু প্রতিবাদ করে বললাম, মসিয়াে। আপনি তাে আমার জামা কাপড়-পরা ছবি আঁকছেন। নিউড তাে আঁকছেন না। তাহলে এ-সবের দরকার হচ্ছে কেন? ‘তা, পাষণ্ডটা কী বলল? মাতিস উদগ্রীব।

ছবির মেয়ের বুকটা তুলি উল্টে দেখিয়ে বললেন, যদিও ছবির সঙ্গে আমার একটুও মিল নেই—

আঃ, কী বলল, বল না!

বললেন, জামার মধ্যে এই যে বুকের কাছটা ফোলা-ফোলা দেখাচ্ছে ছবিতে, তুমি কি মনে কর, এর মধ্যে কোনও মাংস নেই? আমি সেটাই দেখে নিচ্ছি যে কতটা মাংস এতে দিতে হবে।…………

………লেপ-তােশক পর্যন্ত বরফ—- কেদারনাথের সেই অসহ্য শীতে বিড়লা গেস্ট হাউসের দোতলার ঘরে শুধু জননেন্দ্রিয় ও ওষ্ঠদ্বয় ব্যবহার করে (ইগলুর মধ্যে এস্কিমােরা যেমন), এ হল আমাদের আনগ্ন সােহাগ, জড়াজড়ি, চুম্বন ও ধর্ষণ, প্রেম, পায়ুকাম ও ব্যভিচার তথা সর্বোপরি (মন্দিরে না গিয়ে) দেবভূমিতে পাপবিহুল সঙ্গমের মাধ্যমে আমাদের চরম রতিপ্রাপ্তির কাহিনী। শত শৃঙ্খলমুক্ত শরীর যা বলতে চায় তাকে তা বলতে দিলে আসে যে-সব অনুচ্চারণীয় অশ্লীল ভাষা—তাই ছিল এ আরাধনার মন্ত্র। বস্তুত, যৌনতায় এখানে মৃত্যুপ্রসঙ্গ ওতপ্রােতভাবে ছিলই এবং সেভাবে, যেভাবে ফাঁসিতে ঝােলাবার পর প্রতি শহিদের লিঙ্গ সুদৃঢ় ও প্রলম্বিত হয়।……..

……….একটা উদাহরণ দিই। সেই যখন লােকে আমাদের বলত থ্রি মাস্কেটিয়ার্স আর আলেকজান্দার দুমার খোঁজে আমরা গিয়েছিলাম তােপচাঁচিতে। একটা দেহাতি মেয়ে সারাদিনের চেষ্টায় (চেষ্টা আমার জোগাড়ও হল, নাম তার ফুলবাসিয়া। তার টেরিকাটা, বিড়িখাের ছােটভাইকে নিয়ে মেয়েটা সন্ধেবেলা বাংলােয় এল। সংগ্রহ আমার। সর্বসম্মতিক্রমে আমি গেলাম পাশের ঘরে। আমি দেখলাম, বিছানা নয়, মেয়েটি জুট কার্পেটের ওপর প্রস্তুত হয়ে শুয়ে। শাড়ি সরিয়ে স্তনে হাত দেওয়া মাত্র বুঝি, সেখানে খাজুরাহাে। সে এত জোরে নিঃশ্বাস ফেলে যে তার বুকের ওপর আমি কেঁপে উঠি এক নিবিড়, অভাবিত ভয়ে। শচীন ভদ্র, কিছু বলবে না। কিন্তু প্রবাল গুণ্ডা। এর শেষ দেখে গেলে, প্রবাল বেরনােমাত্র আমাকে পেটাতে শুরু করবে এতে কোনও সন্দেহ নেই। তাই ছায়াছবির বাকি অংশ খবরের পরে মেয়েটাকে এরকম বুঝিয়ে, আমি বাইরে গিয়ে প্রবালকে পাঠাই। কিছুক্ষণ পরে প্রবাল বেরিয়ে এল হাসতে হাসতে। শচীনও তৈরি ছিল। কিন্তু ওর চান্সই এল না। কেন না, কথা হয়েছিল একটা শটের।

কিন্তু এটা গল্প নয়। গল্প হল, ওর ভাই বনমালী যখন বখশিস নিতে এল, তখন। শচীন তার গালে একটা প্রকাণ্ড থাপ্পড় মেরে বলল, বাস্টার্ড। লজ্জা করে না তাের। বোেনকে বিক্রি করে বখশিস চাইতে এসেছিস?

শচীন রেগে গেলে রাগ করে, দুঃখ পেলে দুঃখিত হয়, সে যখন সঙ্গম করে শয্যাসঙ্গিনী বােঝে তার কাম জাগ্রত হয়েছে।………..

………না-না, মেঝেয় নয়। মেঝেয় নয়। রুবির পিছনে দাঁড়িয়ে ওর ভিজে বাহুসন্ধি থেকে সরু বালিকা-কোমর পেরিয়ে মেয়েমানুষের নিতম্ব পর্যন্ত হাত নামিয়ে আনতে আনতে আমি বলি, ‘আমি বিছানার কথা বলছিলাম। যা সরু, একজনকে তাে নিচে শুতেই হবে। আর সেটা আমি হলে আপত্তি নেই। ‘ধ্যাৎ!’রুবি বলল, এই না, ওখানে নয়।

রুবি কখনও ঘাড়ে চুমু খেতে দেয় না। সে তার ভিজে আধখােলা ঠোঁট আমার ঠোঁটের সামনে মেলে ধরে। (কিন্তু ঠোঁটে চুমুকে আমি অগ্রাধিকার দিই না। বিশেষত ভিজে থাকলে। ঠোঁট ছাড়া অন্যত্র চুম্বনেই আমি নিজেকে অনেক বেশি খুঁজে পাই।) | চুমু না খেয়ে, আমি বরং তার কাঁধে হাত রাখি। রুবি বুঝতে পারে। মাথা নিচু করে সে হাত রাখে কামিজের বােতামে। তারপর, তা না করে, জানালার শার্শি বন্ধ করে দিয়ে আসে। একমাত্র জানালায় পর্দা নেই।

অন্ধকারে রুবি বিবস্ত্র হচ্ছে। এ নতুন কিছু নয়। আলােয় সে জামাকাপড় খােলেনি কখনও। তার এ উন্মােচন-রীতি আমি সমর্থন করি।নগ্নতা আলাের জন্যে। কিন্তু নগ্নতরতার জন্য প্রয়ােজন অন্ধকার। তবে, আজ তার, নিঃসন্দেহে, একটু দেরি হচ্ছে। তা হােক। আমারও তাড়া নেই। আজ আমাদের শেষদিন। আজ শেষবার।

আমি উপুড় হয়ে শুয়েছিলাম। অধমাঙ্গ বিছানার কিনারে রেখে সে আমার মেরুদাঁড়ায় মুখ রাখে। যথারীতি তার গায়ে সুতােটি নেই। কোনও-কোনওদিন সে তার গােড়ালি থেকে শুধু রুপাের। নূপুরগুলাে খুলে আসে না। আমাকে দিয়ে খােলায়। আজ সে, বলা যেতে পারে, তার নূপুরঅবধি-নগ্ন।……..

………উঠে বসে আমি ভাল করে দেখলাম। সত্যিই, নােংরা লম্বাটে লালরঙের বিজবিজে প্যাচ খানিকটা তার ঘাড় জুড়ে। মাঝখানে দু-একটা সাদা ফুটকি। মৃতের পচা চামড়া যেন জীবিতের ত্বকে গ্র্যাফট করে দেওয়া হয়েছে। (গােখরাের বাচ্চা যেন, হাঁ করে স্তনবৃন্তের দিকে এগচ্ছে, ঘাটশিলার রেবেকা সােরেনের বুকের মাঝখানে উল্কির কথা আমার মনে পড়ে না।)………..

Leave a Reply