যম-যমীর অবৈধ প্রণয় – অনিতা বসু

›› পৌরাণিক কাহিনী  ›› সম্পুর্ণ গল্প  

সূর্য ও সংজ্ঞার কন্যা যমী কামনা করেছিল তারই যমজ ভ্রাতা যমকে। কি সেই অবৈধ প্রেমের সংলাপ-ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১৪টি শ্লোকে যা বিধৃত হয়েছে ? কামতাড়িতা যমী কি সত্যিই প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল ?

শরৎকাল। বাতাসে তখনও ঠোঁট ফাটা টান ধরেনি। এখনও চারদিক বেশ ভেজা-ভেজা। নদী-নালা-খাল-বিল- পুকুরে জল কানায় কানায় ভর্তি। সই জলে নীল আকাশ আর সাদা মঘের ছায়া পড়েছে। সোনাঝরা রাদে ভরভরন্ত মাঠের শ্যামলিমার মাঝে মাঝে নিশান উড়িয়েছে গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা কাশফুল। তপোবনের এক প্রান্তে ঘন শাখাপ্রশাখা নিয়ে দাঁড়িয়ে একটি শিউলি গাছ। গাছের নীচে মাটি দেখা যায় না খসে পড়া রাশি রাশি শিউলি ফুল যেন সাদা চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। তার মাঝে বাসন্তী রঙের আঁকিবুকি নকশা।
অদূরে আমলকি বনে বাতাস সরসর করে বয়ে যায়। খসে পড়ে দু’একটি পাতা। নদীর জলে ঢেউ তোলে সেই বাতাস। ঢেউয়ের মাথায় মাথায় সূর্যের আলো ঝিকমিক করে। পাখির কুজনে, মিঠে কড়া রোদ্দুরে. শিউলির গন্ধে, মৃদু হিল্লোলিত বাতাসে তপোবনের পরিবেশ মনোরম, সুন্দর। যেন পৃথিবীর যাবতীয় শান্তি এখানেই বাসা বেঁধেছে। দূরে আচার্যের পর্ণকুটীর থেকে ভেসে আসছে সমবেত সামগানের সুললিত সুর। অধ্যয়ন শুরু হয়েছে।
আশ্রমের নিস্তরঙ্গ প্রশান্তি কিছুটা যেন বিক্ষিপ্ত হন। ঠিক তালভঙ্গ নয়, যেন এক সুর থেকে অন্য সূরে প্রবাহিত হল তপোবনের ছন্দোবদ্ধ জীবনচর্যা। প্রথমে ছুটতে ছুটতে ল একটি হরিণী।
আশ্রমমূগী। আশ্রমেই প্রতিপালিতা। গুরুপত্নীর প্রশ্রয় এবং স্নেহের টান এড়িয়ে সে আর জঙ্গলে ফিরে যায়নি। শুধু কি গুরুপত্নী? আশ্রমের প্রতিটি ছাত্র তাকে ভালবাসো। তবে সবথেকে ভালবাসে বোধহয় যমী। তাই আধিকারটাও তার সবার থেকে বেশি। চকিত পদক্ষেপে কাজলটানা চোখের কটাক্ষে হরিণী একবার পিছন ফিরে দেখে নেয় যমী কতদূরে। তারপর আবার লাগায় ছুট। শিউলিতলা পেরিয়ে অশোকতরু পেরিয়ে দীঘির পাশ দিয়ে ছুটতে ছুটতে সে ঢুকে পড়ে আমলকি বনে।
এদিকে বাতাসে ভেসে আসে নূপুরের রুনুঝুনু শব্দ। পিছু পিছু ছুটে আসছে যমী। শিউলিতলায় এসে সে দাঁড়ায়। গুরু নিতম্বের ভারে বেশি দৌড়তে পারে না। হাঁপায়। ঘনসন্নিবিষ্ট তার সুডৌল দুটি বুক হাপরের মতো ওঠানামা করে। বল্কলের বাঁধনে তারা যেন আর বাঁধা থাকতে চায় না। গাছের পাতায় উজ্জ্বল জলকণার মতো বিন্দু বিন্দু ঘাম তার সুউচ্চ কুচযুগ বেয়ে নামতে থাকে রোমাবৃত নাভিবিন্দুর দিকে। হরিণীর পিছু নিয়ে দৌড়তে গিয়ে কখন যে বল্কল সরে তার বাম বক্ষ সম্পূর্ণ অনাবৃত হয়েছে, যুবতী তা জানতেও পারেনি।
যখন নিঃশ্বাস ছেড়ে যমী তারস্বরে ডাকল, ‘চঞ্চলা, ফিরে আয়, বলছি। চঞ্চলা।’ গলার স্বরে যেন বেজে উঠল তানপুরার মূর্ছনা। আমলকি বন প্রতিধ্বনি তুলে সেই মূর্ছনা ফিরিয়ে দিল। কিন্তু চঞ্চলার দেখা মিলল না। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে যমী কিছুক্ষণ বনের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ ফেরাল অন্যদিকে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ আটকে গেল মাটিতে পাতা শুভ্র ফুলের আস্ত আস্তরণটির দিকে। যমীর আয়ত চোখে যেন আনন্দের বান ডাকল। হরিণীর কথা ভুলে গিয়ে এক দৌড়ে সে চলে গেল শিউলিফুল কুড়োতে। হঠাৎ উবু হয়ে বসতে গিয়ে বহু ব্যবহৃত জীর্ণ বল্কলের বসন ফেঁসে গিয়ে তার দক্ষিণ জঙ্ঘা যে অনাবৃত হয়ে পড়ল, সেদিকেও তার খেয়াল রইল না।
খেয়াল তার থাকার কথাও না। দেহে যে যৌবন এসেছে, অঙ্গে অঙ্গে লিখন পাঠিয়েছে মদন দেবতা, যমী সচেতনভাবে তা কখনই অনুভব করেনি। তার মা থাকলে হয়তো তাকে সচেতন করে দিতেন। কিন্তু জ্ঞান হবার পর থেকে সে তো তার মাকে দেখেনি। শুধু শুনেছে তার পিতার নাম সূর্য, মাতার নাম সংজ্ঞা।
সূর্যের দৃষ্টিপাতে সংজ্ঞা দুচোখ বুজিয়ে ফেলতেন। তাই ক্রুদ্ধ হয়ে সূর্য বলেছিলেন, আমাকে দেখলেই তুমি সর্বদা নেত্র সংযম কর, তাই তুমি প্রজা সংযমন যমকে প্রসব করবে। এই কথায় ভয় পেয়ে সংজ্ঞা চপল দৃষ্টিতে তাকালেন। সূর্য তা দেখে বললেন, এখন তুমি বিলোল দৃষ্টিতে তাকাচ্ছ। তাই তোমার একটি কন্যা হবে। ওই দৃষ্টির মতো সেও হবে চঞ্চলা। সংজ্ঞা নাকি শেষপর্যন্ত সূর্যের তেজ সহ্য করতে পারেননি। পালিয়ে গিয়েছিলেন পিতার আশ্রয়ে। তার আগে নিজের দেহকে ছায়ারূপে নির্মাণ করে তাকে বললেন, তুমি আমার ঘরে থাকো, পুত্রকন্যাকে আমারই সমান স্নেহে পালন করো। সূর্যকে আমার কথা বলবে না। বলবে, তুমিই সংজ্ঞা। ছায়া বলল, সূর্য আমার কেশাকর্ষণ বা আমাকে শাপ না দেওয়া পর্যন্ত সূর্যের স্ত্রী সংজ্ঞারূপেই তোমার ঘরে থাকব ।
এসব অবশ্য পূরাণের কথা। যমীর পুরাণ তখনও জানার কথা নয়। কারণ পৃরাণ তখনও সৃষ্টি হয়নি। তবে পৌরাণিক কাহিনীর জটিল আবরণ ভেদ করে এটুকুই শুধু অনুমান করা চলে যে, যম এবং যমী ছিল সহোদর ভ্রাতা ও ভগিনী। শুধু সহোদর নয়, যমজও। শৈশবে তারা মায়ের আদর, পিতার স্নেহ কিছুই পায়নি। বিমাতা ছায়া তাদের উপর অতচ্যার করত। অনাদরেই তারা বেড়ে উঠেছিল আদিম অরণ্যের দুটি বন্য বৃক্ষের মতো। পরবর্তীকালে ভাই-বোন দু’জনেই বিখ্যাত হয়েছিলেন। ভ্রাতা যম হয়েছিলেন ধর্মদৃষ্টিসম্পন্ন এবং শত্রুমিত্রে সমদর্শী। তিনি হয়েছিলেন প্রজাপালক, দক্ষিণের দিকপাল, নরকের অধীশ্বর দেবতা। আর যমী? কাব্যে উপেক্ষিতা, কামপীড়িতা এই নারীর আর্ত হাহাকার লিপিবদ্ধ রয়েছে শুধু ঋগ্বেদ সংহিতার দশম মণ্ডলের দশম সূক্তের গোনাগুনতি চোদ্দোটি শ্লোকের মধ্যে। পরে লৌকিক সাহিত্যে যমী স্থান পেয়েছেন উচ্ছল যমুনা নদীরূপে। কিন্তু সে ভিন্ন কাহিনী। আমরা এখন চোখ ফেরাই আশ্রমের যৌবনোচ্ছল নায়িকা যমীর দিকে।
যমী যথার্থই সুন্দরী। অসংকৃত বেশবাশ তাকে যেন আরও মোহময়ী করে তুলেছে। চাঁচর কেশদাম ভুজঙ্গের মতো বেণীবদ্ধ-যেন ছোবল মারতে উদ্যত। আয়ত দু’চোখের বিলোল কটাক্ষে যেন কামদেবতার পঞ্চশর। ঘনকৃষ্ণ দুই ভুরু যেন শরক্ষেপণের যোগ্য ধনুক।
শুভ্র গ্রীবার মসৃণতা যেন শঙ্খকেও হার মানায়। দুই ঘনসন্নিবিষ্ট পেলব পয়োধর যেন কঠোর পুরুষ হস্তের পীড়ন পাবার জন্যে উন্মুখ। নাভিদেশ, কষ্টিতট, জঙ্ঘা, উরু- সর্বত্রই যেন কোন অজানার হাতছানি। একমনে সে শিউলি ফুল কুড়িয়েই চলেছে। কোনও দিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। গুটি গুটি পায়ে কখন যে চঞ্চলা নাম্নী হরিণী তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে তাও সে জানে না। অবোধ হরিণী তার পালয়িজীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত সদ্য উদগত শিং দিয়ে মারল এক ঠেলা। চমকে যমী পড়ে গেল স্তূপীকৃত ফুলের উপরেই। ফেঁসে যাওয়া বল্কলের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তাও অপসারিত হল।
কৃষ্ণ রোমাবলী উন্মুক্ত হয়ে পড়ল এবং দুই উরুর ফাঁকে মুখ গুঁজে দিল স্নেহপ্রত্যাশী হরিণী। মূহুর্তে যেন বিদ্যুৎ শিখা বয়ে গেল যমীর শরীরে। মুখ দিয়ে বের হল তীব্র শীৎকার। রোমাঞ্চিত হল তনুমন। কোনও রকমে উঠে বসল যমী। দুই উরুর সংযোগস্থল থেকে হরিণীর মুখটি টেনে বের করে আস্তে আস্তে দুটি থাপ্পড় লাগাল তার দুই গালে। ‘ভারি দুষ্টু হয়েছিস, তুই, চঞ্চলা। ফের যদি এমন করিস।
মুখের কথা তার আর শেষ হল না। কারণ ইতিমধ্যে সে দেখতে পেয়েছে অধ্যয়ন সমাপন করে আচার্যের কুটীর থেকে বেরিয়ে আসছে ছাত্ররা। বল্কল এবং কৌপীন পরিহিত শীর্ণকায় আশ্রমিককুল। ব্রহ্মচর্যাশ্রমের কায়িক ও মানসিক পরিশ্রমে তারা ক্লান্ত। ভুলুণ্ঠিতা যমীর দিকে দুরূপাত না করে, তার দুই অনাবৃত শুভ্র স্তন এবং কাঞ্চনবর্ণ উরুযুগলের প্রতি কিছুমাত্র আকৃষ্ট না হয়ে তারা এখন গো-দোহনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে প্রান্তরের দিকে। সকলের শেষে যাচ্ছে যম-যমীর সহোদর যমজ ভ্রাতা।
যম। যমীর চোখে যেন বিভ্রম। সত্যিই কি যম! তার আবাল্যের সঙ্গী যম! তার সেই চিরচেনা যম! তা কি করে হয়। কেমন উন্নত দেহ! যৌবনের গরিমায় যেন দেহ ঈষত্ সবুজ বর্ণ। দুই মহাভুজ জানু পর্যন্ত লম্বমান। পেশীতে পেশীতে স্তব্ধ হয়ে আছে উদ্ধত যৌবন। রুকনের আবরণ মানতে চায়না স্পর্থিত দুই বিশাল স্কন্ধ। বুক যেন শালের পাটা। উদ্ভিন্ন নরম রোমাবলীতে আচ্ছন্দ গণ্ডদেশ, গ্রীবা, নাসিকা ও ওষ্ঠের মধ্যবর্তী অংশ। পুরুষ বোধহয় একেই বলে। দ্বিতীয়বার রোমাঞ্চিত হল যমীর সমগ্র সমগ্র তনুমন। কিন্তু চকিতে সংবরণ করল মনের উদগ্র কামনা। চঞ্চলার গালে সপাটে চপেটাঘাত করে যমী বলে উঠল, ‘দূর হ, হতচ্ছাড়ী।’
সকাল মধ্য‍ এবং অপরাহ্ন বিমনা হয়ে কাটাল যমী। আহারে অরুচি দেখে তার কুশল জিজ্ঞাসা করলেন গুরুপত্নী। তার বিষণ্ণ মুখ দেখে দুঃখের কারণ জানতে চাইলেন আচার্য। যমী এড়িয়ে গেল। লোকচক্ষুর সামনে থাকতেই যেন তার অনীহা। অবচেতন মনের গভীরে সংগোপনে লালিত কোন আদিম কামনা আজ প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের মতো তার সমগ্র সত্তাকে আচ্ছন্ন করেছে। ভিতরের সেই বিক্ষোভের প্রকাশ অন্য কারোর চোখে ধরা পড়ুক এটা সে চায় না। সে যে অসঙ্গত ইচ্ছাকে পোষন করা করছে. তার অভীষ্ট যে অন্যায় এটাও সে বুঝেছে। আসলে ন্যায়-অন্যায়ের একটা সূক্ষ্ম অথচ সুস্পষ্ট প্রাচীর যে সবার মনেই খাড়া রয়েছে। যমীর মন যে ন্যায়ের প্রাচীর লঙ্ঘন করে অন্যায়ের রাজত্বে বিচরণ করছে- একথা তো তার মনই ভাল জানে।
হ্যাঁ, যমী কামনা করছে তার সহোদর যমজ ভ্রাতা যমকে। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের দশম সূক্তে ভ্রাতা-ভগ্নীর কথোপকথনের মধ্যে ধৃত হয়েছে সেই আদিম কাম কামনার আবিল অভিব্যক্তি। আবিল, না কোন মানদণ্ডে অনাবিল ? সভ্যতার মাপা যায় আবিলতা? বাইবেলের প্রথম পুরুষ আদম এবং প্রথম নারী ইভের পুত্রকন্যার মধ্যে অবৈধ বিবাহ হয়নি? তারা তো সন্তান উৎপাদন পর্যন্ত করেছিল। বিচক্ষণ যম কিন্তু কামার্তা যমীকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। যমী বলেছিল: ‘এসো, এই নয়নলোডন প্রাকৃতিক পরিবেশে আমরা যৌন মিলনের অনির্বচনীয় আনন্দ অনুভব করি। ঈশ্বরের বাসনা তোমার ঔরসে আমার গর্ভে সর্বাঙ্গসুন্দর এক সন্তানের জন্ম হবে।’
যম উত্তর দিল : ‘আমি তোমার সঙ্গে ঐরূপ সম্পর্ক কামনা করি না। তুমি আমার সহোদরা ভগিনী। তাই আমার অগস্যা।’
যমী: ভাইবোনের যৌন মিলন মনুষ্য সমাজে গর্হিত ঠিকই। কিন্তু দেবসমাজে তা প্রচলিত। তাই আমি যা বলছি তাই-ই করো। তুমি পুত্রজন্মদাতা পতির ন্যায় আমার শরীরে প্রবেশ করো।’
যম: ‘এ কাজ পূর্বে আমরা কখনও করিনি। আমরা সত্যবাদী, কখনও মিথ্যা বলিনি। গন্ধর্ব (সূর্য) আমাদের জনক, আপ্যা ঘোষা (সংজ্ঞা) আমাদের জননী।
যমী: বিধাতার বিধানে একই জননীর গর্ভে আমরা একসঙ্গে স্ত্রী- পুরুষ রূপে বিরাজ করেছিলাম। বিধাতার অভিপ্রায় কে অন্যথা করবে? আমাদের এই সম্পর্কের কথা পৃথিবী ও স্বর্গের সকলেই জানেন।’


যম: ‘এই প্রথম দিন কে জানে ? কে বা দেখেছে? কে-ই বা প্রকাশ করছে? মির ও বরুণের আবাসভূত এ বিশ্বজগৎ অতি প্ৰকাণ্ড। ‘
যমী: ‘ঘমস্য মা যম্যং কাম আগস্ত সমানে যোনৌ সহশেয্যায়। জায়েব পতো তনুং রিরিচ্যাং বি চিদিহের রথোব চক্র।’
-‘তুমি যম, আমি থমী। তুমি আমার প্রতি অভিলাষমুক্ত হও। এসো, একস্থানে শয়ন করি। পত্নী যেমন পতির নিকট, তদ্রুপ আমি তোমার নিকট নিজ দেহ সমৰ্পণ করছি। রথধারণকারী চক্রদ্বয়ের ন্যায়, এসো, আমরা একই কাজে আত্মনিয়োগ করি।’
যম: চতুর্দিকে দেবতাদের গুপ্তচর। তাদের সর্বত্রই গতিবিধি। তারা কখনও চক্ষু নিঃমীলন করে না। হে ব্যথাদায়িনী। যাও। শীঘ্র অন্যের নিকট গমন কর।’
যমী: ‘স্বর্গ এবং পৃথিবীর সম্পর্ক তো নারী-পুরুষেরই সম্পর্ক। অতএব, হে যম, আমাকে সম্ভোগ করো।”
যম: ‘ভবিষ্যতে এমন যুগ হবে যখন ভ্রাতা ভগ্নীর সঙ্গে সহবাস করবে। হে সুন্দরী। এক্ষণে আমা ভিন্ন অন্য পুরুষকে পতিত্বে বরণ কর। তিনি যখন তোমাকে গ্রহণ করবেন তখন তাঁকে বাহুদ্বারা আলিঙ্গন করো।
যমী: সে কিসের ভ্রাতা, যদি সে থাকতেও ভগিনী অনাথা হয়? সে কিসের ভগিনী, যদি সেই ভগিনী সত্ত্বেও ভ্রাতার দুঃখ দূর না হয়? আমি আর পারছিনা। মিলন কামনায় আমার শরীর উত্তপ্ত। কামমতা বহে তদ্রপাখি তা মে তনুং সং গিপৃদ্ধি। ‘এসো, তোমার শরীরে আমার শরীর মিলিয়ে দাও। আমার এই কামতপ্ত তনু শীতল হোক।’
যম: ‘তোমার শরীরের সঙ্গে আমার শরীর মিলাতে ইচ্ছা নেই। ভগিনীকে যে রমন করে, তাকে পাপী বলে। আমি ভিন্ন অন্য পুরুষের সঙ্গে সুখসম্ভোগের চেষ্টা করে দেখো। হে সুন্দরী। তোমার ভ্রাতার এরূপ অভিলাষ নেই
যমী: ‘হায়! যম! তুমি দেখছি নিতান্তই দুর্বল পুরুষ! এ তোমার কি প্রকার মন, কি প্রকার অন্তঃকরণ, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। । রজ্জু যেমন ঘোটককে বেষ্টন করে, কিংবা লতা যেমন রক্ষকে আলিঙ্গন করে, সেরূপ অন্য নারী অনায়াসেই তোমাকে আলিঙ্গন করে। অথচ তুমি আমার প্রতি বিমুখ। ‘
যম: ‘হে যমী! তুমিও অন্য পুরুষকে আলিঙ্গন করো। যেরূপ লতা বৃক্ষকে, তদ্রুপ অন্য পুরুষই তোমাকে আলিঙ্গন করুক। তারই মন তুমি হরণ কর, সেও তোমার মন হরণ করুক। তারই সঙ্গে তুমি সহবাস করো। তাতেই মঙ্গল হবে।
ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের দশম সুক্তটি এভাবেই শেষ হয়েছে। মাত্র ১৪টি শ্লোকে কোন সে কবি নিরাভরণ ভঙ্গিতে লিপিবদ্ধ করে গেছেন এক অবৈধ ব্যর্থ প্রেমের অস্ফূট হাহাকার। কবে কোন আশ্রমের আমলকি বনের নিভৃত কোণে পরিপূর্ণ চন্দ্রালোকের আলো- আঁধারিতে হয়েছিল কথোপকথন তারও কোনও ইঙ্গিত মেলেনি। তবে মৈত্রায়নী সংহিতায় যম-যমীর একটি ছোট্ট ঘটনা রূপকের আকারে বিধৃত হয়েছে। সেখানে দেখি, যম মারা গেছেন। দেবতারা যমীকে বোঝাচ্ছেন। ওকে ভুলে যাও। যতবারই তাঁরা একথা বলেন, যমী ততবারই বলেন, ‘ও তো আজই এই দিবসেই মাত্র মারা গেল।’ তখন দেবতারা বললেন, *এভাবে ও কোনও দিনই যমকে ভুলতে পারবে না। আমাদের ‘রাত্রি’ সৃষ্টি করতে হবে।” সংহিতা অনুসারে তখন ছিল শুধুই দিন, রাত ছিল না না। দেবতারা তখন রাত্রি সৃষ্টি করলেন। পরের দিন যমী ভুলে গেল যমের মৃত্যুশোক। তাহলে শেষ পর্যন্ত কি যম-যমীর মিলন হয়েছিল? বেদ- পুরাণে তার কোনও ইঙ্গিত নেই। অনেকে বলেন, যম-যমী আসলে দিন-রাত্রির রূপক। হয়তো ভ্রাতা- ভগ্নীর অবৈধ প্রণয়কাহিনীকে ঢেকে দিতেই বেদ-পুরাণের কবিরা রূপকের আশ্রয় নিয়েছিলেন। কে জানে!