মাঝখানের দরজা – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়

›› গল্পের অংশ বিশেষ  

রােজকার মতাে হল না, বাথরুম সেরে আলােটালাে নিবিয়ে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করতে অনুভা আজ প্রায় বারােটা বাজিয়ে দিল। মেয়ে শুয়ে পড়েছে ঢের আগে, তার মর্নিং স্কুল, এতক্ষণে নিশ্চিত কাদা। তবু ভালাে যে হুড়কো লাগিয়ে ছিটকিনি ভােলা ও বেডসুইচ অফ করার মধ্যে অনুভা আজ বেশি সময় নেয় নি। গত মাসদুয়েক ধরে রােজ যেমন, সারারাতের জন্যে অন্ধকার হয়ে গেল ঐ ঘর। মাঝখানের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ থাকবে সারারাত।

খুব পীড়াপীড়ি না করলে, অনুভা আজকাল আর এ-ঘরে আসে না। ঝাড়া পাঁচটি বছর কাঠখড় পুড়িয়ে উত্তর-কলকাতা-ভাবাবেগে-ভরা যে বিধুর সহপাঠিনীকে বিয়ে করেছিল ধ্রুব, কে জানত, মেয়ের বয়স বছর-চোদ্দ হবার আগেই সারারাত-নারী থেকে সে তাকে এমন নিঃশেষে বঞ্চিত করবে। দীননাথও তাে চিনত অনুভাকে, বলতে গেলে তারই বান্ধবী, বিয়ের বেলা শাহলা দত্ত-হারামজাদা কেমন ক্লিন বারাে বছরের মার্জিন রাখল। পড়তি-কুড়িতে বীথি এখন যা, বিয়ের সময় অনুভা তার চেয়ে বড় বই কিছু ছােট ছিল না।

অনুভা এবার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাবল-মার্চ করে ঘুমের বাড়ি যাবে। ঘুমের বাড়ি যমের বাড়ি? সে যাই হােক, ততক্ষণ এ-ঘরে একটি চেয়ার টানাটানিও বারণ। হাঁচি পেলে, ধ্রুব আস্তে হাঁচবে। মুনের না মর্নিং স্কুল ? অনুভকে উঠতে হবে না তার সঙ্গে? হ্যাপা কে পােয়াবে, ধ্রুব না অনুভা ? | এখন সারা ফ্ল্যাট অন্ধকার। শুধু ঝলমল করছে ধ্রুবর মাথা। আর বিলম্বের প্রয়ােজন কী। মশারি তুলে ধ্রুব বিছানা থেকে বেরয়। ধ্রুবদের ফ্রিজটি নতুন না, বেশ শব্দ হয়। দুই ঘরে পাখা চলছে ফুলফোর্সে, একটা সাইসাই শব্দ আছে তাদেরও। পদশব্দ যদি কিছু হয়, ঢাকার পক্ষে এটা যথেষ্ট। অবশ্য ঝােপ থেকে বেরনাে চিতার সঙ্গে তার এখন বিশেষ তফাৎ নেই। নােখটোক যা কিছু, সবই থাবার মধ্যে।

কিছু আগে অনুভাকে শুনিয়ে ধ্রুব যে ছিটকিনি লাগিয়েছিল, তা ছিল শব্দমাত্র, আসলে লাগায় নি। ভেজানাে দরজা সাবধানে খুললে শব্দ হবার কথা না, হলও না। চৌকাঠ ডিঙিয়ে করিডােরের বাঁ-দিকে ডাইনিং স্পেশের সামনে গিয়ে ধ্রুব দাঁড়ায়। টেবিলের পাশে যার-পরনেই নােংরা, যত্রতত্র গিট-বাঁধা, তেলচিটে, টাঙানাে মশারি একটি। মশারির বোঁটকা গন্ধে নাকের পাটা কুঁচকে দাঁড়িয়ে, অন্ধকারে, যে-ভাবে সারা শরীর সে স্ট্রেচ করে নেয় তাতে কটি চিতার জীবনসর্বস্ব ছিলই, বস্তুত, তা ছিল চিতাসুলভ। যেন, খরগােশের বিধিলিপির জন্যে সে এক ঝােপের সামনে স্বাধীকারপ্রমত্ত দাঁড়িয়ে। তার পরনে পপলিনের আন্ডারউয়্যার, উরু অবধি উলঙ্গ পা-দুটি ঘন লােমে ঢাকা। | বাইরে গুমােট। মশারিতে কিছু জ্যোৎস্না এসে লেগেছে বটে, কিন্তু চিটপিটে ময়লা এত পুরু যে ভিতরে প্রবেশ করতে পারে নি। উবু হয়ে বসে, মশারি তুলে, ধ্রুব তার দক্ষিণ থাবা মশারির মধ্যে পাঠায়। ফ্রক সরিয়ে বছর-ষােলাের দুটি স্তন সে পায়, যার মধ্যে একটি ধরে সে মৃদু আকর্ষণ করে। ডাকে, আয় । থাবার সর্বস্ব তাকে ডাকে। ডেকেই সে কিছু এ-ঘরে চলে আসে না। সে পা ফাক করে দাঁড়িয়ে থাকে।

ধ্রুব যাকে ডাকে, যােলাে বছরের সেই মেয়েটির নাম সিন্ধু। এবার সে বেরয়। ভারি পরিপাটি করে মেঝেয়-লগ্ন বিছানায় সে ফের মশারি গোঁজে। অনুভা যখন থাকে না, এসব ধ্রুব তাকে হাতে ধরে শিখিয়েছে। এর মধ্যে একদিন, কোনও-একদিনও কি ঘর খুলে বেরিয়ে পড়ে নি অনুভা? তা নয়। একদিন পড়েছিল। শেষরাতে বাথরুম যাবার ভারি অসচরাচর প্রয়ােজন হয়েছিল মেয়ের , দেখতে-শুনতে তা মুনও চোদ্দয় পড়েছে। বছর-দুই আগেও কত ছােট ছিল যখন ভােরের বাথরুম থেকে এসে, মা নয়, বাবাকে নাড়া দিয়ে বলেছিল (হেসে), বাপি, আমার হিসির সঙ্গে রক্ত বেরুচ্ছে!’ বজ্রাঘাত হােক ধ্রুবর মাথায় যদি এ-কথা সত্যি না হয়। মাত্র দু-বছরে ছােটবেলাটা কোথা দিয়ে যে নষ্ট করে ফেলল মেয়েটা, ভালাে করে একবারটি আদর করে নেবার আগেই।

সেই মেয়ে ও মা একসঙ্গে বেরুল, শেষরাতে, যখন সিন্ধু এ-ঘরে ধ্রুবর বুকে লীন, ওঃ ভাবা যায়! অনুভা অবশ্য একদম ধরতেই পারে নি যে ঝােপ তখন ফfকা। ধরবে কী করে, এ-সব মহালয়া-মহালয়ায় কাচা মশারির ময়লা এত পুরু আর এমন চিটপিটে যে দিনমানেই বােঝা যায় না ভিতরে কেউ আছে না নেই, তাে রাতে। আর, ছেড়া কঁাথাকুতির বিছানার সঙ্গে কি পরিপাটি করে গোঁজা মশারিটি! একটিও বেশি হৃৎস্পন্দন হতে না দিয়ে, ধ্রুব শুধু অপেক্ষা করেছিল। হার্ট তাে নয় ধ্রুবর, দেওয়ালি ঘড়ি যেন। গুনে ষাটটি দুলুনি পেণ্ডুলামের ষাটটি টিকটিক, তবে এক মিনিট। পাক্কা ষাট মিনিট, তবে ঢঙ।

বাথরুম বন্ধ হল। অনুভার ঘরে হুড়কো উঠল। ছিটকিনি উঠল। আলাে নিবল। তবে টানটান হাত থেকে লাগেজ নামিয়ে রাখল ধ্রুব। অর্থাৎ, বুক থেকে সিন্ধু।

প্রায় মাস তিনেক হতে চলল কাজে লেগেছে মেয়েটি। মাসদুই ধরে এই আসা-যাওয়া চলছে, মাঝে মাঝে। মােট কবারই বা। তবে এত চটজলদি, অনুভা সুইচ অফ করতে নাকরতে, এমনটা এই প্রথম। এর আগে মধ্যরাতে বা যখন রাতশেষ, ঘুম ভেঙে গেলে তবেই টেনে এনেছে ধ্রুব। আ-খাওয়া মড়ি যেন বাঘের, কাছে যেতেই হয়েছে, টেনে আনতেই হয়েছে। কিন্তু না, ঘুমের ওপর সে আর বিশ্বাস রাখে না। নতুবা, দেখতে দেখতে একটা হপ্তা কাবার হয়ে গেল, একদিনও কি ঘুম ভেঙে যেতে নেই? কই, ভাঙে নি তাে। অগত্যা, বাধ্য হয়ে, তাকে আজ এই চরম ব্যবস্থা নিতে হল।

আজ ধ্রুবর হাত ধরে এ-ঘরে পা-টিপে ঢুকে, মশারি তুলে, সিন্ধু সােজা বিছানায় উঠে যায়। সিঙ্গল বেড, তবে ধ্রুবর কিছু অসুবিধা হয় না। রােগা মেয়েটা কতটুকু বা জায়গা নেয়, আর, আসলে কটা মুহূর্ত বা সে পাশে থাকে। হয় সে থাকে ধ্রুবর বুকে, না-হয়তাে ধ্রুব তার। এবং কাজ ফুরনাে মাত্র যাঁহাকা মাটি তাহা পাঠিয়ে দেয় ধ্রুব। ডাইনিং স্পেশে গিয়ে সিন্ধু পূর্ববৎ শুয়ে পড়ে। আসল কথা, সঙ্কট মুহূর্ত তাে একটাই হয় আর সেই অদ্বিতীয় মুহূর্ত ব্যত্যয়ে এক-জীবনের ভুলচুক হয়ে যায়। ধ্রুব তাই, বরং তিলার্ধ আগেই, পাঠিয়ে দেয়।

সিন্ধু ধ্রুবর বিছানায় ঢুকে গেলে ধ্রুবর কাজ তবু কিছু বাকি থাকে। কনট্রাসেপটিভ সে আগে থেকে ছিড়ে খুলে রাখে। বাচ্চা মেয়ে, জেলি লাগে সামান্য, নিরােধক হিসেবেও এটা অধিকন্তু, সে মায় টিউবের কর্কটিও আগেভাগে খুলে রাখে। | বাকি থাকে শুধু ছিটকিনি তােলা। ধ্রুব এতক্ষণে সত্যি সত্যি ছিটকিনি তােলে। ভূমিকম্প না-হওয়া সত্ত্বেও যদি বেরয় অনুভা, সেদিন যেমন, ডাইনিং স্পেশের পাশে পরিপাটিভাবে গোঁজা মশারি ও ধ্রুবর বন্ধ দরজায় সে একবার করে, অকারণে, চোখ বােলাবেই। আঙুল দিয়ে ঠেলে পরখ করেও নিতে পারে, অসম্ভব কি। ধ্রুব তাই ছিটিকিনি দেয়। এবং শ্যা, একটিও কিচ শব্দ না করে। যখন অনুভা থাকে না, বা বেরয়, সেইসব সময়ে বহু অনুশলীন করে সে এটা আয়ত্ব করেছে। এই অসাধ্য সাধন, একটিও টু-শব্দ হতে না-দিয়ে উঁটি-ধরে এই। ছিটকিনি-তােলা। রাতে অনুভা এ-ঘরে একদম আসে না সে প্রায় মাস ছয়েক হতে চলল।

খুব ফিসফিস করে এখন মশারির মধ্যে কথা বলা চলে। কিন্তু তার প্রয়ােজন কী। মােট কবারই বা, কিন্তু সেই প্রথমবার থেকে আজও, বারেকের জন্যও, প্রয়ােজন হয় নি। উঠে যাবার আগে সিন্ধু ভােশকের নিচে হাঁটকে নির্দিষ্ট জায়গা থেকে একটি দশ টাকার নােটের পেটে অতিরিক্ত টাকাটি আছে কিনা বুঝে নেয়। নিয়ে, নিজের জায়গায় চলে যায়। সাধনালব্ধ কুশলতায় ধ্রুব দেয় ছিটকিনি তুলে। হেয়ারক্লিপ কি একটা সেফটিপিন যে পড়ে থাকবে, সেটি হবার যাে নেই। সব, মায় ইজেরটি পর্যন্ত, খুলে আসে সিন্ধু। এ-জন্যে, যখন মুন যায় স্কুলে এবং অনুভা বেরয় এবং ধ্রুব বাড়িতে কচিৎ হলেও এমনটা হতেই হয় বেশ কয়েকটি ক্লাস নিতে হয়েছে ধ্রুবকে। এই সব ক্লাসে, বাংলা অনার্সের মেয়েগুলােকে ‘সাে মােহ কান্তা দূর দিগন্তা’ বােঝানাের তুলনায়, প্রফেসরদের চেয়ে, ঢের বেশি বেগ পেয়েছে সে। তবু সিন্ধুর বিবর্ণ মাথার চুল একটা যদি কোনওদিন আটকে থাকে বালিশে, বলা কি যায়, তাতেও ঘাবড়াবার কিছু নেই। সকালবেলা বেশ দেখেশুনে বিছানা ঝাড়ার সুশিক্ষা ধ্রুব তাকে দিয়ে রেখেছে।

প্রথম কবার দশ পায়। মাসের হিসেবে অঙ্কটি খুব-একটা বেশি দাঁড়ালাে কই। কটা বা টাকা পেল সিন্ধু, যা নিচ্ছিদ্র ঘুম ধ্রুবর। প্রথম মাসেই তাে দিল একটা গােটা হপ্তা কাবার করে। একদিনও তাে জাগতে পারল না! সে-মাসের শেষ-সপ্তাহে ছিটকিনি তুলে ধ্রুব বিছানায় ঢুকতেই, সিন্ধু তাই, ঘাের কটাক্ষ করে, দুহাত তুলে, বােবাদের মতাে ঈষৎ ঝঙ্কার লাগিয়ে হাতে, ধ্রুবর মুখের সামনে দু’হাতের পাঞ্জা দু’বার মেলে ধরেছিল। জানালা দিয়ে সেদিনও কিছু জ্যোৎস্না এসে পড়েছিল। নীল নাইলনের ঝাঁ-চকচকে যা স্বচ্ছ মশারি ধ্রুবর, সে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল। দশ-প্লাস-পাঁচ সেই থেকে পনেরাে চলছে।

অনুভা এ-ঘরে আসে না, সে প্রায় মাস ছয়েক হতে চলল।

গত বছর সেটা এপ্রিল না মে মনে নেই, দার্জিলিঙ-এ তারা তখন, অনুভা তাকে বাথরুমে ডেকে নিয়ে যায় ও পায়খানার দরজা খুলে দেওয়াল ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকে। জীবনে যে-কটি কাজ দেখে ধ্রুবর বােবা মন মুখর হয়ে উঠেছে প্রশংসায়, তার মধ্যে একটি হল দার্জিলিঙে থাকতে তাদের জমাদারনি ফুলমনি ছেত্রীর ধােয়া প্যানের অকলঙ্ক সাদা :সেদিন তার ওপর পড়ে আছে পােয়াটাক, কমসেকম তিনছটাক তাে হবেই, ঘােরবর্ণে রক্তের একটি ডেলা। লাল যেন কালাে হয়ে যাচ্ছে এমন…ধ্রুব খুব-একটা অনুমানী লােক নয়, তবে অনুভার তখনও পীরিয়ড চলছে—সে দেখেই বুঝেছিল, এ-জিনিস মুখ থেকে আসে নি।

সুস্থ পীরিয়ডে ঠিক কতটা রক্ত পড়ে ধ্রুবর জানার কথা নয়। স্ত্রীর পীরিয়ডের হিসেব রাখা সে অন্য ব্যাপার, দীননাথ রাখে। তবু, তুহিন সাদার ওপর ঐ লাল রিরংসা—প্রতীক সৌন্দর্য যেন—সে দেখেই বুঝেছিল, এটা ঠিক স্বাভাবিক না, বা, এমনকি কিছুটা ভয়ের। সে ভয়ে ভয়ে অনুভার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। দ্যা হতভাগা, আমার কী অবস্থা করেছিস, শান্ত, কঠিন গলায় কেটে কেটে বলেছিল অনুভা। | কলকাতায় ফিরে প্রথমে ডি, সি করানাে হল। কাজ হল না। জুলাই-এর শেষাশেষি সেই অপারেশন করাতে হল। ইউটেরাস রিমুভড় হল তাে কী, এ’, দীননাথ বলেছিল, ও কিছু না। আমার ছােট শালীর তাে, এ, ঐ এক ব্যাপার। বাচ্চা মেয়ে! ভায়রার তাে,’ দীননাথ আশ্বাস দিয়েছিল, এ, ফকিং-টকিং দিব্বি চলছে।’

যদিও কার্যত দেখা গেল, একটি গভীর প্রশ্বাস নিয়ে তা মােচন করে আজ ভাবে ধ্রুব, তা না। দীননাথের কথা বিশ্বাস করে ধ্রুব ঠিক করে নি; ভুলই করেছিল। দীনুর বাঁজা বৌটা তাে পাছাটি লেজ হিসেবে নাড়াচাড়া করেই দশ বছর দিব্বি কাটিয়ে দিল অ্যাকোরিয়ামে, যে ডাকল তার সঙ্গে শুয়ে এল, এক স্বামী ছাড়া। শালা গান্ডু, বৌ-যন্ত্রের তুমি কী বুঝবে?

অনুভা আর ঠিক সেরে উঠতে পারল কই। সেপ্টেম্বরে মনে হল বুঝি সেরেছে, একদিন ট্রায়াল দিতে এ-ঘরে এল। নাঃ, উঃ, অসম্ভব। অক্টোবর…নভেম্বর… গত বছরটা মাঝে-মাঝেই চেষ্টা চলল। ডিসেম্বরের শেষাশেষি ও-ঘরে হুড়কো লাগাল অনুভা। জানুয়ারিতে ছিটকিনি। বছর ঘুরতে চলল। অনশনে এত দীর্ঘকাল বেঁচে থাকার কোনও রেকর্ড নেই, কোনও জন্তুর, মানুষ বলে এতদিন বেঁচে ছিল ধ্রুব।

মার্চে, বাগবাজারে অনুভার বাপের বাড়ির পাড়া থেকে এসে সিন্ধু কাজে লাগল। সপ্তাহ না ফুরােতেই একদিন শেষরাতে ধ্রুবর ঘুম ভেঙে গেল। সেই থেকে শুরু হল আসা-যাওয়া।

মােট কবারই বা, তবু দু-আড়াই মাসে যার আদৌ দরকার হয় নি, আজ তার প্রয়ােজন হল। একটা খালি ট্রাম লটর-পটর করে ফিরে যাচ্ছে গুমটিতে। সেই ফঁকা আওয়াজের সুযােগ নিয়ে এই প্রথম ফিসফিসিয়ে কথা বলল সিন্ধু।

মা ডাক্তারের কাছ নিয়ে গিয়েছিল, সে বলল।

ধ্রুব কিছু কথা বলছিল না, বলেও নি কোনওদিন : সিন্ধুর সঙ্গে কাজের কথা যা কবেই | শেষ হয়ে গেছে। তবু, সিন্ধু যা বলল, শুনে সে টের পেল, এতদিন সে সিন্ধুর সঙ্গে কত কথা বলেছে এবং আজই এই প্রথম চুপ করে আছে। সিন্ধুর পাতলা, পরিণতিকা কোমরের খাঁজে আটকে আছে তার হাত, উঠে এতক্ষণে তার অন্যত্র যাবার কথা, সে ভুলে গেছে তুলে নিতে।। | ডাক্তার! মা ? কিন্তু কেন? পেট-খারাপের জন্যে নয় তা বুঝেছে, তবে কেন?স চুপ করে রইল। | প্রেগন্যান্ট হবার বিন্দুমাত্র বা কোনওরূপ চান্স তাে নেই। যখন অনুভা বেরয় বা থাকে আর মনু-ও স্কুলে, আমি কি তােকে বোেঝাই নি কেন কনডােম, কেন জেলি আর কী করলে বাচ্ছা হয়, আর কী না-করলে বাচ্ছা হয় না? শরীর ককিয়ে উঠে বলেছে ‘ঢাল, ঢাল’ কিন্তু কোনওদিন কি তা হতে দিয়েছি? মাই-মাই, দ্যাটস নাে কাপ অফ মাইন, লেভি ! সরি।

এই তাে, আবার ভাষা খুঁজে পেয়েছে সে, আর ঐ তাে, একটা ট্রাক না এলেও নিদেনপক্ষে একটা গ্যারাজগামী বাস আসছে। আসুক, কাছাকাছি এলেই শুরু করে দেবে ধ্রুব এবং বাস বেরিয়ে যাবার আগেই যা বলার বলে দেবে ভেবে, সিন্ধুর কানে মুখ রেখে তবু, অভিপ্রেত ললাডেড ট্রাকটি গাঁ-গাঁ শব্দে বাড়ির সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাবার আগে, সে কী!’-এর বেশি কিছু সে বলতে পারল না। এবার ‘কেন, কী হয়েছিল’, জানতে চাইবে বলে সে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে। না, কিছু এলাে না। না-ট্রাম, না-বাস, না-ট্রাক, নিদেন একটা ট্যাক্সিনা-কিছু।

এখন বাড়ির বাইরে জ্যোৎস্না। ঘরে ঘাের অন্ধকার। সে তাই তার মুখ থেকে রক্তাভা অন্তর্হিত হতে দিল। সিন্ধুর অভিব্যক্তি দেখা যায় না।

হাতের ভাষায় সিন্ধুকে উঠে বসতে বলে ধ্রুব ছিটকিনি খুলে দাঁড়ায়। একটু কিচ-শব্দ হন। কি? এ নিয়ে পরে কথা বলব, বাস বা ট্রাক কি ট্রাম কোনওকিছুর পরােয়া না করে বিবর্ণ ফসা গলায় সে সিন্ধুকে জানাল। ছিটকিনি দিতে ভুলে গেল আজ। সিন্ধু টাকা নিয়েছে কি নেয় নি, এটা জানার আজ খুবই প্রয়ােজন ছিল। তার মনে এল না।

সে জানালায় দাঁড়াল। বৃষ্টি শুরু এবং শেষ হল কখন? একটি জলধােয়া ডাবলডেকার আলােটালাে জ্বালিয়ে গ্যারাজে গেল। তারপর রাস্তা ফাঁকা পড়ে রইল অনেকক্ষণ। সারারাত যেন আর একটাও গাড়ি যাবে না এমন চকচকে রাস্তা দিয়ে একটি সওয়ারিবিহীন কালাে মােষ অতি মন্থরভাবে হেঁটে যাচ্ছে, সে দেখল।

বােসপাড়ায় অনুভার দাদাবৌদির বিয়ের আজ রৌপ্যজয়ন্তী। নিউ মার্কেট থেকে পঁচিশগােলাপের তােড়া নিয়ে সন্ধেবেলা সেখানে যাবার কথা। এদিকে লােডশেডিং। তবে অফিসের জেনারেটর আছে। এয়ার কণ্ডিশান্ড ঘরে সাতটা পর্যন্ত ধ্রুব বসে। একা? হ্যা, একা। বাইরে। বেয়ারা রাম-আধার।

৭টা নাগাদ ধ্রুব তলদেশ দেখতে পেল। খাড়া ঝুলছে, পড়বে, এবং এককোপে মুণ্ডু ছিটকে যাবে। আর কিছু হবার নেই, ধড়ের দিকে মুণ্ডুর চেয়ে-থাকা, এ-ছাড়া। ৭টা নাগাদ সে বুঝতে পারল, কানা নয়, খোড়া নয়, প্রেমিক নয়; লম্পট নয়, জোচ্চোর, সাধু, ক্লামজি, সােবার, মনমরা, চালাক, স্টুপিড, লাজুক, লােভী, উদাসীন, স্মার্ট, এ-সব কিছুই নয়—হাজবন্ড নয়, বাবা নয়, কমার্শিয়াল ম্যানেজার নয়—সে সংক্ষেপে, ভীতু। ৭টা নাগাদ আধগজি গদির রিভলভিং চেয়ার বোঁ করে ঘুরিয়ে দেওয়ালের মুখােমুখি শূনে দু’হাত ছুড়ে সে নিজেই নিজেকে ‘ডেস্ট্রয়েড’ বলে ঘােষণা করতে শুনল।

এবং ৭টা নাগাদই সে সেই সাহস পেল যা পুরুষ মানুষের নয়, মেয়ে মানুষের নয়, এমন কি নপুংসকেরও না; যা ভীতুর। অফিস থেকে বেরিয়ে সে, ধ্রুবজ্যোতি মিত্র, একটি ট্যাক্সি নিল। “সিধা চলিয়ে’, ভারি গম্ভীর আর জমকালাে গলায় সে বলছে শুনল, জলদি। যেন সে নয়, বুলেটের কথা ভুলে গিয়ে, প্রান্তরের পর প্রান্তর ভরিয়ে ডােরাকাটা লাফে, আ-খাওয়া মড়ির দিকে ছুটে চলেছে স্বাধীকারপ্রমত্ত চিতা।…….

…………চারতলায় ল্যাচ-কী খুলে ধ্রুব ঘরে ঢুকল। সিন্ধু ?’ অন্ধকারে সে নিচু গলায় ডাকল। সাড়া নেই।

ডাইনিং স্পেশে আলাে জ্বলছে। কদিন ধরেই অনুভা বলছিল শাড়ি পরাবে, আজ পরিয়েছে। একটি শাদা নীল সিন্থেটিক শাড়ি পরে, টেবিলের পাশে, বিনা মশাড়িতে, এই ভরা সন্ধেবেলা সিন্ধু চিৎ হয়ে ঘুমিয়ে।

‘ও কী ভাবে শুয়ে আছিস, ধিঙ্গি মেয়ে কোথাকার’, অনুভাকে কতবার বলতে শুনেছে।

সে ঠিক হয়ে শাে।

তবু তার ভঙ্গিমা পাল্টায় নি। ঘুমিয়ে পড়লে, কিছু যদি মনে থাকে মেয়েটার।

স্যুট-টাই না খুলে সিন্ধুর পাশে বোঁটা-ছেড়া পাতার মতাে ধ্রুব খসে পড়ে। তাকে জাগাতে, এত বিপদগ্রস্ত, তবু, শাড়ি সরিয়ে স্তনে হাত না-রেখে সে পারে না। সিন্ধু, কানের কাছে মুখ এনে সে বলে, মানইজ্জত নয়। অনুভা নয়; মুন নয়, কেউ নয়, ওরে কিছু না। সে ফুঁপিয়ে ওঠে, ‘সাত বছর পাথর ভাঙতে আমি পারব না।’

এত বলে সিন্ধুর ঘুম না-ভাঙা পর্যন্ত সে পাশে পড়ে থাকবে বলে শুয়ে থাকে।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠে স্যুট-টাই পরা ধ্রুবকে পাশে শুয়ে থাকতে দেখে সিন্ধু এক অবাক-কাণ্ড করে। বালিকার গাম্ভীর্যে মুখ ঢলঢলে করে সে ইঙ্গিতে বলে, ‘ও-ঘরে।

অর্থাৎ আজ ও-ঘরে হবে। দিদিমণির বিছানায় । হাত ধরে তুলে সে ধ্রুবকে তাদের প্রাক্তন দাম্পত্যবিছানায় নিয়ে যায়। জয়পুরে-কেনা মহার্ঘ চাদরটি অনুভা তাকে দিয়ে আজই পাতিয়েছে। পাখার রেগুলেটার ডানদিকের চরমে ঠেলে দিয়ে লীলাভরে সে নীল আলাে জ্বালায়। জয়পুরি কারুকাজের ওপর অবলীলায় শুয়ে পড়ে।।

জামাকাপড় খুলে পাজামা পরতে পরতে যেন কিছুই হয় নি এমনভাবে ধ্রুব বলল, ‘া, কাল কী যেন বলছিলি? মাকে সব বলেছিস নাকি…’ মা-কে? কী-সব? ‘ঐ-যে ডাক্তার-ফাকতার।

আপনি আমাকে তাই ভাবলেন জামাইবাবু?’ বহু-ভৎসিত ভঙ্গিমায় চিৎ হয়ে শুয়ে সিন্ধু। ঠোট ফোলায়, ‘ছিঃ।।

কাল যে বলছিলি, ডাক্তার…’ ‘ও, ওটা। ওটা একটা ঠাট্টা করলুম! ফিক করে হেসে সে পা দোলায়, আমি শাড়ি পরেছি। ধ্রুবর সাড়া নেই দেখে অভিমানে সে এবার হরিণীর কালাে ঘনিয়ে আনে চোখে, মাকে বলব, আমি কি এত খারাপ মেয়ে। তার বুক ফুলে ফুলে ওঠে। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে সে আবার বলে, “ছিঃ।।

বলে অনুভার বালিশে মুখ গোঁজে।

মেঘ-ডাকাডাকি হচ্ছিল সকাল থেকেই। ঝােড়ো হাওয়ায় জানালার একটা পাল্লা হু করে খুলে গেল। চমকে উঠে সিন্ধু বন্ধ করতে যাচ্ছিল, ধ্রুব বাধা দিল। প্রয়ােজন কী। আকাশ ছাড়া, ওদিকে তাে কিছু নেই।

বাইরে এ-গ্রীষ্মের প্রথম বর্ষা নামল। যেন মাত্র এক বছর পরে নয়। যেন কত খরার পরে—আবার। জানালার শার্সি আবার মেঘমেদুর হয়ে উঠছে, সেখানে, আবার, ঘনঘন বিদ্যুৎ। বাইরের পাগল হাওয়া আর ঘরের ঝুলন্ত খৈতান ঘরের মধ্যে যে প্রতিমুখী বিক্রিয়া তৈরি করেছে, বােধহয় তাে সেইজন্যে, পােড়ামাটির কারুকার্যময় শেড-দেওয়া নীল বাটি এমন রীতি-গর্হিত দুলছে।

কট করে একটি শার্সি ফাটার শব্দে ধ্রুবর জীবন জুড়ে ঝনঝন করে সব কাচ ভেঙে পড়ল। যােলাে বছরের হাল্কা বালিকাকে বিছানা থেকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল বিয়াল্লিশ বছরের বালক। এবং আগে যা কখনাে করে নি, মনে হয় নি যে করা যায়, সে তার মুখ চুমায় চুমায় ভরিয়ে দিতে লাগল।

অনুভার পাউডার-রু দু-ফিট গােদরেজের সামনে সে তাকে দাঁড় করায়। অনুভার ভ্যানিটি থেকে চাবি বের করে ব্যগ্র কঁপা হাতে সে আলমারি হাট করে খুলে ফ্যালে। বাঁদিকে ওয়াড্রোবে ঝােলানাে তা অন্তত খানপনেরাে শাড়ি। পিছনের গােপন চেম্বার থেকে বের করে এনে সে অনুভার গয়নার বাক্স ভঁজ করা শাড়ির উঁাই-এর ওপর রাখে। রেখে বাক্সর ডালা খুলে ফ্যালে। এখন, ঝলমলে রত্নগুহার সামনে, মর্জিনার সঙ্গে, গাধার পিঠে আলিবাবার মতাে সে যেন। | পা ফাক করে দাঁড়িয়ে, উন্মুক্ত আলমারির দিকে ইঙ্গিত করে ধ্রুব সিন্ধুকে বলে, ‘বেছে নে। | শাড়ি না নিয়ে, দেখুন-দেখুন, জড়ােয়া-সেট তর্জনীর ঠেলায় সরিয়ে, কত সপ্রতিভভাবে ইমিটেশান-হীরের রােল্ড-গােল্ডের নাকছাবিটি তুলে নিয়ে নাকের পাটায় পরছে মেয়েটা। লাল ভেলেভেটের ডালা-সংলগ্ন আয়নায় ফুটে উঠেছে প্রতিবিম্ব। কী দুর্ধর্ষ মানিয়েছে ওর গর্বিত, সপ্রতিভ, ককেটিশ মুখে ? আ, পছন্দ আছে মেয়েটার।

কৃত্তিবাস, ১৯৮০

Leave a Reply