মহাভারতের মহারণ্যে – প্রতিভা বসু

›› বই এর অংশ / সংক্ষেপিত  

প্রথম পর্ব

……..

তবে দ্বৈপায়ন কিন্তু মূলত একটি বিশেষ রাজত্বের বিশেষ বংশ নিয়েই উপাখ্যানটি রচনা করেছেন। সেই বংশের নাম ভরতবংশ। যে ভরতবংশের ইতিহাস তিনি আমাদের গোচরীভূত করেছেন, তার স্থাপয়িত্রী শকুন্তলা। শকুন্তলা আশ্রমনিবাসিনী ছিলেন। পুণ্যতোয়া মালিনী নদী বেষ্টিত, বহু বৃক্ষ সমাকীর্ণ আশ্রমটি ব্যতীত কিছুই তিনি দেখেননি। তিনি কণ্বমুনির পালিতা অতি সরলা এক কন্যা। রাজা দুমন্ত শিকারে এসে অতি রমণীয় একটি বনে উপস্থিত হলেন। অনেক পশু বধ করে একাই ঘুরতে ঘুরতে সেখানে এসে পড়েছিলেন। এই রমণীয় বনের মধ্যেই তিনি অতি মনোরম আশ্রমটি দেখতে পেলেন। আশ্রমটি দেখতে পেয়ে তিনি সেখানে প্রবিষ্ট হলেন এবং কুটিরটির নিকটে এসে উচ্চস্বরে ডেকে বললেন, ‘এখানে কে আছেন?’

লক্ষ্মীর মতো এক সুন্দরী কন্যা বেরিয়ে এসে রাজা দুষ্মন্তকে স্বাগত জানিয়ে অভ্যর্থনা করে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী প্রয়োজন বলুন, আমার পিতা কণ্বমুনি ফল আহরণ করতে গেছেন, একটু অপেক্ষা করলেই তিনি এসে যাবেন।‘ রাজা দুষ্মন্ত বললেন, ‘আপনি কণ্বমুনির দুহিতা?’ কিন্তু তিনি তো উর্ধ্বরেতা তপস্বী। শকুন্তলা তখন তাঁকে তার জন্মবৃত্তান্ত বললেন। তারপর বললেন, শরীরদাতা, প্রাণদাতা, অন্নদাতাঁকে শাস্ত্রমতে পিতা বলা হয়। মহারাজ। আমাকে কণ্বমুনির দুহিতা বলেই জানবেন। শকুন্তলা যখন কুটির থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন কোনো কথাবার্তা বলার পূর্বেই তাঁকে দেখে তৎক্ষণাৎ দুষ্মন্তের কামস্থহ প্রজ্বলিত হুতাশনের মতো লেলিহান হয়ে উঠেছিলো। তিনি বললেন, “তোমার লাবণ্যসলিলে আমি আকণ্ঠ মগ্ন। তোমার শরীরের উপর তোমার কর্তৃত্ব, তাই তুমি আত্মসমর্পণ না করলে তোমাকে পেতে পারছি না, তুমি প্রার্থনা পূরণ করো। তখন শকুন্তলার মতো একটি সরল মধুর অপাপবিদ্ধ আশ্রমকন্যার পক্ষে যা নিতান্তই অস্বাভাবিক, দেহ সমর্পণ করার পূর্বে তিনি কিন্তু সেই রকমই একটি প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন দুষ্মন্তকে দিয়ে। ঠিক সত্যবতীর মতো বললেন, “আপনার ঔরসে আমার গর্ভে যে পুত্র জন্মাবে, আপনি বিদ্যমানে সে যুবরাজ হবে এবং অবিদ্যমানে রাজা হবে।’

দুষ্মন্ত বললেন, ‘নিশ্চয়, নিশ্চয়।’ তারপর গন্ধর্ব মতে বিবাহ করে শকুন্তলার সমর্পিত দেহ নিয়ে সঙ্গমক্রিয়া সম্পন্ন করে চলে গেলেন। বলে গেলেন, ‘আমি তোমাকে যোগ্য সমাদরে নিয়ে যাবার জন্য চতুরঙ্গিণী সেনা পাঠাবো, রানীর সম্মানে তুমি রাজভবনে প্রবিষ্ট হবে।’ ব্যাস, সেই যে গেলেন আর কোনো খবর নেই।……..

১.২

শকুন্তলার আরো কয়েক প্রজন্ম পরে পুনরায় যে রমণী সেই বংশে বিবাহিত হয়ে এসে খ্যাতির আসনে উপবিষ্ট হলেন তিনি সত্যবতী।……

…….রাজা শান্তনু সত্যবতীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তার পাণিপ্রার্থী হয়েছিলেন। এবং তা তিনি হতেই পারেন। তবে অবশ্যই তিনি তাঁকে ধীবরপল্লীতে দেখেননি। ধীবরপল্লী কখনো রাজামহারাজাদের ভ্রমণস্থল হতে পারে না। এখানে রচয়িতা পুনরায় একটি রূপকথার আবরণ ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেছেন, একদা পরাশর মুনি নৌকা পার হবার সময়ে সত্যবতীর দেহের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি ধীবরকন্যার দেহ থেকে সঙ্গমের পূর্বে মৎস্যগন্ধ দূর করে নিয়েছিলেন। সত্যবতীর দেহ তখন সুগন্ধে পরিপুত হয়। এবং সেই সুগন্ধ চিরস্থায়ী হয়। সুগন্ধ এমন যে বহুদূর থেকেও বাতাসে ছড়িয়ে পড়তো।……..

……..বিচিত্রবীর্যের মৃত্যুর পরে তাঁর পত্মীদের গর্ভে যখন পুত্রোৎপাদনের প্রশ্ন তুললেন সত্যবতী, তখন তিনি ভীষ্মকেই প্রথম অনুরোধ করেছিলেন। সেটা লোক দেখানো। তিনি খুব ভালোভাবেই জানতেন, যে প্রতিজ্ঞা করে দেবব্রত ভীষ্ম হয়েছেন সে প্রতিজ্ঞা তিনি কখনোই লঙ্ঘন করবেন না।…….

……….

ভীষ্ম পুনরায় বলেছিলেন, ‘পরশুরাম যখন একুশবার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করেছিলেন, তখন ক্ষত্রিয় রমণীরা ব্রাহ্মণ সহযোগেই পুত্রবতী হয়ে পুনরায় ক্ষত্রিয়কুল বৃদ্ধি করেছিলেন, সে ভাবেও আপনি বংশরক্ষা করতে পারেন। ভীমের মনে হয়েছিলো বংশরক্ষার সেটাই একমাত্র শুদ্ধ উপায়। তাই সেই পরামর্শই তিনি তাঁকে দিয়েছিলেন। দেখা গেলো সে উপায়টা সত্যবতী গ্রহণ করলেন। অনতিবিলম্বেই তিনি তাঁর কুমারী জীবনের পুত্র কৃষ্ণদ্বৈপায়ণকে আহ্বান করলেন। বোঝা গেলো ছেলের সঙ্গে তিনি সংশ্রব বহির্ভূত ছিলেন না।

পুত্রও এসে গেলেন তৎক্ষণাৎ, এবং মাতৃআজ্ঞা পালনে রত হতে বিলম্ব করলেন না। সদ্য স্বামী বিয়োগে শোকার্ত বধু দুটি দ্বৈপায়নের বিকট মূর্তি দেখে ও বীভৎস গন্ধে একজন ভয়ে দুচোখ বুজে এবং অন্যজন ভয়ে পাণ্ডুর হয়ে মৃতের মতো পড়ে থেকে শ্বশ্রীমাতার নির্দেশ পালনে বাধ্য হলেন। স্বীয় পুত্রের দ্বারাই সত্যবতী স্বীয় পুত্রের বধু দুটির গর্ভোৎপাদন করালেন। এতোদিন কেন তিনি ইতস্তত করছিলেন সে কারণটা বোধগম্য হলো। এই উৎপাদন রুচিসম্মত নয়, শাস্ত্রসম্মত নয়, ধর্মসংগতও নয়। তদ্ব্যতীত, স্বামীর ইচ্ছেতে তার স্ত্রীর গর্ভে অন্যের ঔরসজাত সন্তানেরা ক্ষেত্ৰজ পুত্র হিশেবে তখনকার সমাজে স্থান পেলেও শাশুড়ির ইচ্ছেতে পুত্রবধূদের গর্ভে পুত্রোৎপাদনের নজির মহাভারতে অন্য কোথাও নেই। এবং কার দ্বারা উৎপাদন? যে তাদের কেউ নয়। যাঁর মাতা তাদের শ্বশ্রীমাতা হবার বহুপূর্বেই এই সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। দ্বৈপায়ন নিজে কালো, তার মাতা কালো, তার পিতা কালো, সুতরাং এই তিনজনের একজনও যে আর্য নন, সে বিষয়ে কোনো তর্ক নেই। উপরন্তু দ্বৈপায়ন তাঁর মাতার বৈধ-সন্তান নন।……….

১.৩

……….

ততোদিনে সত্যবতী বয়স্ক হয়েছেন, ভীষ্মের চালনায় ধৃতরাষ্ট্র মর্যাদার সঙ্গে রাজত্ব করছেন। পাণ্ডু ও ধৃতরাষ্ট্রের মধ্যে ধৃতরাষ্ট্রই জ্যেষ্ঠ। তিনি অন্ধ, সেজন্য প্রথমে পাণ্ডুই রাজ্যের ভার গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কিয়ৎকালের মধ্যেই নিজেকে নিস্ফল জ্ঞানে মনের দুঃখে রাজ্যের ভার ধৃতরাষ্ট্রের হস্তে সমর্পণ করে, তার দুই পত্নী কুন্তী ও মাদ্রীকে নিয়ে হিমালয়ের শৃঙ্গে শৃঙ্গে বিহার করতে চলে যান। বিদুর মাঝে মাঝে সেখানে যেতেন। খোঁজ খবর রাখতেন, পাণ্ডুও জানাতেন। বিদুর অবশ্য পাণ্ডুর জন্য যেতেন না। যেতেন কুন্তীর জন্য। কুন্তীর সঙ্গে তার একটা গোপন সম্পর্ক ছিলো। বিদুরের লোভ ছিলো অপরিমিত এবং স্পর্ধা ছিলো সমুদ্রসদৃশ। সবাই জানেন, সত্যবতীর কুমারীকালের কলঙ্ক, বিকটগন্ধ বিকটাকৃতি দ্বৈপায়নের সঙ্গে দ্বিতীয়বার শয্যাগ্রহণের অনিবার্য অনিচ্ছাতেই অম্বা ও অম্বালিকা নিজেরা উপস্থিত না হয়ে একজন সুন্দরী দাসীকে রানী সাজিয়ে ছল করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দ্বৈপায়নের সঙ্গে সংগত হতে।

দ্বৈপায়ন সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। বুঝতে পেরেও তিনি দাসীর সঙ্গে সংগত হওয়া থেকে নিবৃত্ত হননি। ক্রুদ্ধ হয়ে স্থানও ত্যাগ করেননি, অপমানিত হয়ে অভিশাপও দেননি। সেই সংগমের ফলই এই বিদুর। বিদুরকেও যে ভীষ্ম পাণ্ডু ও ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে একইভাবে মানুষ করে তুলেছিলেন, সেটাও নিশ্চয়ই সত্যবতীর অনুজ্ঞাক্রমে। কেননা, সত্যবতী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ভীষ্ম স্বতন্ত্রভাবে কিছুই করেন না, বা করতে পারেন না। সেটা হয়তো নিয়মও নয়। ভীষ্ম তার বিমাতার নির্দেশেই চলেন। নচেৎ বিদুর কী অধিকারে রাজপুত্রদের সঙ্গে একইভাবে বড়ো হয়ে উঠলেন?………

……….সেই সময়ে কুন্তীও গর্ভবতী ছিলেন। সেই পুত্রের নামই যুধিষ্ঠির যুধিষ্ঠিরের জন্ম তখনো হয়নি বলেই বিদুর দুৰ্যোধনকে হত্যা করবার জন্য এত অস্থির ছিলেন। মহাভারতে এ কথা স্পষ্ট করে বলা না হলেও একের পর এক ঘটনা আমাদের বিশ্বাস করতে বাধ্য করে যে এই পুত্র বিদুরের ঔরসেই কুন্তীর গর্ভজাত পুত্র। সেই পুত্র যদি এখনো না জন্মে থাকে, তাহলে জ্যেষ্ঠ হিশেবে তার সিংহাসন প্রাপ্তির আশা দুরাশা মাত্র। তদ্ব্যতীত, সেই পুত্র কেবলমাত্র জ্যেষ্ঠ হলেই তো হবে না, তাঁকে পাণ্ডুর ক্ষেত্ৰজ হিশাবে প্রমাণ করার দায়ও আছে। যে কারণে দ্বৈপায়নের পুত্র হয়েও তিনি রাজা হতে পারেননি, সেই একই কারণ তো তার পুত্রের উপরও বর্ষিত হবে। ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডু যেহেতু বিচিত্রবীর্যের পত্নীদের গর্ভজাত, সেজন্য তাঁরা প্রতিবন্ধী হয়েও রাজা হলেন, আর তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ পুত্র হয়েও কোনো দাবিদাওয়ার অধিকারী হলেন না। অথচ অজ্ঞান বয়স থেকে তাঁকে রাজপুত্রদের সঙ্গে একইভাবে ভীষ্ম মানুষ করে তুলেছেন। সবাই এক পিতার সন্তান হলেও বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্ৰজ নন বলেই দাসীপুত্রের পরিচয় তার মিটলো না। ঈর্ষার দংশন তাঁকে দগ্ধ করলো। দ্বৈপায়নের উৎপাদিত বিষবৃক্ষের অঙ্কুরটি তখন বৃক্ষ হয়ে উঠতে আর বেশি দেরি করলো না।………..

……….কুন্তী বললেন, জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির ধর্মের পুত্র, মধ্যম ভীম পবনপুত্র, কনিষ্ঠ অৰ্জুন ইন্দ্ৰপুত্র আর নকুল সহদেব অশ্বিনীকুমারের যমজ সন্তান। স্বামী ব্যতীত আরো তিনটি প্রার্থিত পুরুষের অঙ্কশায়িনী হয়ে কুন্তী এই তিনটির জন্ম দিয়েছেন এবং সূর্যের অঙ্কশায়িনী হয়ে কুমারী অবস্থায় জন্ম দিয়েছিলেন কর্ণকে। এই রহস্যজনক পাঁচটি জটবন্ধলধারী কিশোরকে নিয়ে কুন্তী যখন হস্তিনাপুরে এসে পৌঁছলেন, এবং নানাজনে নানা কথা বলতে শুরু করলো, কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেলো সেই সমালোচনার উপর যবনিকা নেমে এসেছে। ……….

………আসল উপাখ্যানটি এই। একদা বসুগণ পত্নীসহ বশিষ্ঠের তপোবনে বিহার করতে এসেছিলেন। বশিষ্ঠের কামধেনু নন্দিনীকে দেখে কোনো বসুর পত্নী তাঁকে নিয়ে যান। বশিষ্ঠ আশ্রমে ফিরে এসে দেখেন নন্দিনী নেই। তখন তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে শাপ দেন, যারা আমার ধেনুকে নিয়েছে তারা মর্ত্যে মনুষ্য যোনিতে জন্মগ্রহণ করবেন। বসুরা তখন ব্যাকুল হয়ে অনেক অনুনয় বিনয় করাতে বশিষ্ঠ প্রসন্ন হন, এবং বলেন, ‘ঠিক আছে, তোমরা এক বৎসর পরে শাপমুক্ত হবে, কিন্তু পত্নীর জেদে যে বসু নন্দিনীকে নিয়ে যায়, সে বসু নিজের কর্মফলে দীর্ঘকাল মনুষ্যলোকে বাস করবে।’……….

১.৪

……….কুন্তী কুমারী জীবনে যেমন কর্ণের জন্মদাত্রী হয়েছিলেন, যুধিষ্ঠিরের জন্মদাত্রীও ঠিক একইভাবে হয়েছিলেন। যুধিষ্ঠিরের পরে যে কুন্তী আরো দুটি সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন তাদের কোনো পিতৃপরিচয় অনুমান করা শক্ত, তবে এটা অনুমান করা যায় পাণ্ডু তার প্রথমা পত্নী অপেক্ষা মাদ্রীর সঙ্গেই বেশি সময় কাটাতেন। কুন্তীরও স্বামীকে সাহচর্য দেবার মতো সময় থাকতো না।……..

……….জানাবার প্রয়োজন না থাকলেই সেটা উহ্য। রাজা-মহারাজারা ইচ্ছেসুখ নারীসংগম করতে পারতেন। সমাজ সেটাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। অবশ্য সেই স্বীকৃতি নরজাতীয় সব মানুষের বেলাতেই অটুট, এখনো অটুট। তবে রাজাদের বেলায় সামান্য পার্থক্য এই যে পতি যার গর্ভেই সন্তান উৎপাদন করুন না কেন, মাতা হবেন তার বিবাহিতা পত্নী। অথাৎ পতি পরমগুরুর এই সব দুস্কৃতিকেও হতভাগ্য রমণীটিকে মান্য করতে হবে। সেই হিশেবেই গান্ধার তাদের মাতা। অনুমিত হয় গান্ধারী যখন পেটে টিউমার নিয়ে দু বছর অসুস্থ ছিলেন, ধৃতরাষ্ট্র তখনই বিভিন্ন রমণীসঙ্গ করে এতোগুলো মানবসন্তানকে পৃথিবীতে এনেছিলেন। আমরা গান্ধারকেই ধৃতরাষ্ট্রের একমাত্র মহিষী বলে জানি, কিন্তু মহাভারতের অনেক স্থলে উল্লেখ আছে ধৃতরাষ্ট্রের পত্নীগণের। তবে সেইসব পত্নীগণকে আমরা প্রত্যক্ষ করি না। দুৰ্যোধনও করেন না। পৈতৃক অধিকারে গান্ধারকেই মাতা হিশেবে গ্রহণ করলেও, পুত্রদের প্রতি কুন্তীর যে স্নেহ, যে মাতৃভাব, গান্ধারীর নিকট সেটা তিনি পাননি।………

……….এ গল্পটি অবশ্যই কল্পনাজগতের বিশেষ একটি অবদান সন্দেহ নেই। এমন একটা ঘটনা কখনো কি প্রকৃতি ঘটাতে পারে? সমস্ত ব্যাপারটার মূল ভাষ্যটিই হলো যুধিষ্ঠিরকে যে কোনো প্রকারে জ্যেষ্ঠ দেখানো। শুধু তাই নয়, তার জন্য যদি ষড়যন্ত্র করে পাণ্ডু এবং মাদ্রীকে হত্যা করতে হয়, সেটা গোপন করতেও দ্বৈপায়নের চিন্তার প্রয়োজন হয় না। সততারও প্রয়োজন হয় না। যদিও আমরা পাঠকরা জানি তিনি একজন মহৎ, নিষ্কাম, নিরপেক্ষ, ব্রহ্মচারী, যে ব্রহ্মচর্যের মস্তকে পদাঘাত করে যে কোনো নারীর শয্যায় শায়িত হতে তিনি এক মুহুর্ত চিন্তা করেন না। পাণ্ডু বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্ৰজ, কিন্তু বিদুর কোনোভাবেই কুরুবংশের সঙ্গে যুক্ত নন। একজন দাসীর পুত্র ব্যতীত তার অন্য কোনো পরিচয় নেই। কিন্তু যুধিষ্ঠির বিদুরের পুত্র। এই যুধিষ্ঠিরকে শান্তনুর সিংহাসনে বসাতে হলে পাণ্ডুর ক্ষেত্ৰজ হিশাবে পরিচিতি করাবার প্রয়োজন আছে। যে কারণে বিদুর রাজত্ব পাননি, যুধিষ্ঠির পাণ্ডুর ক্ষেত্ৰজ না হলে সেই একই কারণে রাজত্বের অধিকারী হতে পারবেন না। সেজন্যই পাণ্ডুর ইহলীলা সম্বরণ করার প্রয়োজন ছিলো। তা যদি তিনি স্বাভাবিক উপায়ে না করেন সে ব্যবস্থাও বিদুর করবেন। কিন্তু সাক্ষী-প্রমাণ লুপ্ত করবার জন্য মাদ্রীকেও পৃথিবী থেকে মুছে না দিলে চলবে কেন? পতিবিয়োগে কুন্তী কাঁদেননি। কাঁদলেন, যখন সর্বসমক্ষে মৃতদেহ দুটি ভৰ্ম্মে পরিণত হলো এবং তিনি নির্দোষ বলে পরিগণিত হলেন।………

১.৬

………..প্রত্যয় হয়, কুমারীকাল থেকেই কুন্তীর নৈতিক চরিত্র খুব শুদ্ধ ছিলো না। প্রাক-বিবাহ কালে তিনি যখন সূর্যের সঙ্গে সংগত হয়ে কর্ণের জন্ম দেন (এই সূর্য নিশ্চয়ই আকাশের সূর্য নয়, কুন্তীরই কোনো ভালোবাসার আর্য যুবক) তখন কুন্তী গোপনে নিভৃত কক্ষে তখাকথিত সূর্যকে অবশ্যই একদিন সময় ও সুযোগ মতো আহবান করে এনেছিলেন। নির্জন কক্ষে সূর্য তাঁকে আত্মদান করতে বলেন। কুন্তী ভয় পান। কুমারী অবস্থায় যদি সন্তানসম্ভবা হন তখন পিতামাতা ও সমাজকে কী কৈফিয়ৎ দেবেন? সূর্য নিবৃত্ত হন না। তার চরিত্র বিষয়েও কটাক্ষ করেন। অতঃপর কুন্তী তাঁর সঙ্গে সংগত হন এবং গর্ভধারণ করেন। গর্ভাবস্থায় সর্বদাই খুব সংবৃতভাবে থাকতেন, কেউ বুঝতে পারতো না। কেবল তার এক ধাত্রীর সম্যক জ্ঞান ছিলো। যথা সময়ে তিনি অত্যন্ত রূপবান একটি পুত্র লাভ করেন। কুন্তী সেই ধাত্রীর সঙ্গে মন্ত্রণা করে, মোম দিয়ে ঢাকা অতি বিস্তীর্ণ ও আচ্ছাদন সম্পন্ন একটি পেটিকার মধ্যে রক্ষিত করে সেই পুত্রকে অশ্বনদীতে নিক্ষেপ করেন। বিভিন্ন চেহারার অন্য পুত্রদেরও কুলের ঠিকানা অজ্ঞাত বলেই স্বর্গের দেবতাদের পিতা হিশেবে মর্ত্যে নামিয়ে আনতে হয়েছিলো। ধারণা হয়, যে দুটি সন্তানকে তিনি মাদ্রীর সন্তান বলে পরিচয় দিচ্ছেন, সে দুটিও তাঁর সেদিক থেকে তাঁকে স্বৈরিণী আখ্যা দিলেও মিথ্যে বলা হয় না। প্রকৃত পক্ষে, তিনি অনেক পুরুষের সঙ্গেই সংগত হয়ে তাঁর সম্ভোগস্পৃহা নিবৃত্ত করেছেন। অবশ্য কথিত আছে কুন্তীর সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে এক মুনি তাঁকে বর দিয়েছিলেন, কুন্তী ইচ্ছা করলেই যে দেবতাঁকে স্মরণ করবেন তিনি আসবেন। সম্ভবত কুন্তীর বহুগামিতা ঢাকতেই এ বরদানের গল্পটি তৈরি হয়েছিলো।………..

১.৯

………..

প্রথম লীলাটি হলো দ্ৰৌপদীর প্রকৃত স্বামী অৰ্জুন হলেও তাঁকে বিবাহ করতে হলো পাঁচজনকেই। স্বয়ংবর সভায় মাল্যদান মানেই বিবাহ পাণিপ্রার্থীদের মধ্যে পাত্রী যাঁকে মাল্যদান করবেন তিনিই হবেন তাঁর পতি। মাল্যদান করেই শকুন্তলা দুষ্মন্তকে বিবাহ করেছিলেন। মাল্যদান করেই কুন্তী পাণ্ডুর পত্নী হয়েছিলেন। বেচারা দ্রৌপদী! যাকে মাল্যদান করলেন, তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতাও যে একজন মস্ত দাবিদার হয়ে তাঁর শয্যায় এসে উপস্থিত হবেন, তা কি তিনি স্বপ্নেও ভেবেছিলেন কখনো! আর্যকুলের বিবাহে এই রীতি কখনই সম্ভব নয়।

দ্রৌপদীকে জয় করে, যেখানে পাণ্ডবরা আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন সেখানে উপস্থিত হয়ে আনন্দিত স্বরে বললেন, ‘মাতঃ, আদ্য এক রমণীয় পদার্থ ভিক্ষালব্ধ হইয়াছে।’

কুন্তী গৃহাভ্যন্তরে ছিলেন, বললেন, ‘সকলে সমবেত হয়ে ভোগ করো।‘…………

……….কিন্তু এক কন্যাকে পাঁচজন পুরুষ কী করে ভোগ করবেন, গণ্ডগোল বাধলো সেটা নিয়েই। দ্রৌপদীর পিতা হতবাক হলেন। তিনি বলেছিলেন ‘অদ্য শুভ দিবস, অতএব অর্জুন আভ্যুদয়িক ক্রিয়ান্তে দ্রৌপদীর পাণিগ্রহণ করুন।’……….

……….কিন্তু দ্রৌপদী? দ্রৌপদী কী করে রাজি হলেন? অত বড় একটা মহতী জনসভায় যিনি উচ্চকণ্ঠে বলে উঠতে পারলেন, ‘সূতপুত্রকে আমি বিবাহ করবো না’, যেখানে তাঁর পিতা ভ্রাতা দুজনেই পুনঃপুন ঘোষণা করেছেন এই স্বয়ংবর সভায় জাতমানকুল কিছু নেই, বীরত্বই প্রধান, যেখানে বিদ্যায় বুদ্ধিতে রূপে গুণে শ্রেষ্ঠ এক বীরকে তিনি পিতা ভ্রাতার প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘন করে, অসম্মান করে, ধুলোয় লুটিয়ে দিলেন, এবং অন্য এক বীরকে স্বামীরূপে নির্বাচিত করে মাল্যদান করলেন, সেখানে কী করে তিনি তাঁর স্বামীর জ্যেষ্ঠ-কনিষ্ঠের শয্যাসঙ্গিনী হতে রাজি হলেন? কী করে সেটা সম্ভব হলো? বিবাহের আসরে বসে পরপর পাঁচজন ভ্রাতাকেই স্বামীরূপে গ্রহণ করতে তাঁর মনে কি কোনো বেদনা জাগলো না? অসম্মান জাগলো না? লজ্জাবোধ এলো না? তাঁর বিবেকের কাছে কি তাঁর কোনো কৈফিয়ৎ নেই? মহাভারত বলে তিনি অতি তেজস্বিনী নারী, সেই তেজ তখন তাঁর কোথায় গেলো? তিনি কি জানেন না স্বয়ংবর সভায় কন্যা যাঁর কণ্ঠে মাল্যদান করেন শুধু তিনিই হন তাঁর পতি? কেন তিনি অন্য পুরুষ গ্রহণ করতে কোনো প্রতিবাদ জানালেন না? আর তাঁর নির্বাচিত পতিকে তিনি কবে পেলেন? যখন তাঁর প্রেম এক বছর ধরে তাঁর স্বামীর জ্যেষ্ঠভ্রাতা যুধিষ্ঠিরই ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছেন। তারপর ভীমের কাছে গেছে সেই দেহ নারীদেহ তো নয়, যেন খেলার বল। একের কাছ থেকে অপরের কাছে। তাঁর মধ্যে অর্জুনের বারো বছরের জন্য নির্বাসনও হয়ে গেলো।………

দ্বিতীয় পর্ব

এর পরবর্তী আখ্যানটি আরম্ভ করতে হচ্ছে অতি ক্ষমতাশীল রাজা দ্রুপদের অন্তঃপুর থেকে, যে অন্তঃপুরে তিনি যজ্ঞ থেকে উত্থিতা একমাত্র কন্যাকে পাঁচটি ভ্রাতার পাণিস্থ করেছেন এবং ভেবেছেন আমার তুল্য বলশালী রাজা আর কেউ থাকলো না এ জগতে। সেই সময়ে একটি পত্নী নিয়ে পাঁচটি ভ্রাতাও দ্রুপদের অন্তঃপুরে যথেষ্ট আহ্লাদের সঙ্গে দিনযাপন করছিলেন। তবে তাদের পত্নীর মন সেই আহ্লাদের সঙ্গে কতোটা যুক্ত ছিল সে কথা কেউ ভাবেননি। তাঁর নিজের প্রেমিক, যাঁকে সত্যিই তিনি নিজের নির্বাচিত স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, সেই অৰ্জুনকে তখনো পাননি তিনি, তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাই ভোগ করছিলেন কনিষ্ঠ ভ্রাতৃবধূকে। যার যার স্বার্থসিদ্ধির কারণে সকলেই তাঁকে বলিদানের পাঠা হিশেবে ব্যবহার করছিলেন। স্বয়ং ব্যাসদেবই যুধিষ্ঠিরের জন্য সমাজবিরোধী এই কর্মটি করতে নানান ছলে বলে কৌশলে দ্রুপদ রাজা আর তার পুত্রকে প্রাভাবিত করলেন। অর্জুনকে মাল্যদান করবেন বলেই, পিতা-ভ্রাতার প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘন করে দ্রৌপদী চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, ‘আমি সূতপুত্রকে বিবাহ করবো না।’ অৰ্জুন বিষয়ে দ্রৌপদীর মনে নিশ্চয়ই অনেক স্বপ্ন ছিলো, পিতা-ভ্রাতার ঘোষণা লঙ্ঘন করে বরণও করলেন তাঁকে, কিন্তু রাজনীতির যূপকাষ্ঠে সেইসব স্বপ্নের কোনো ঠাঁই নেই। যে পিতা-ভ্রাতা তাঁদের আদেশ লঙ্ঘন করে কর্ণকে অসম্মান করার জন্য বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না, যেহেতু তাদের নির্বাচিত জামাতা অজুর্নই ছিলেন, সেই পিতা-ভ্রাতাই ব্যাসদেবের পরামর্শে যে আজ্ঞা পালনে বাধ্য করলেন কন্যাকে, সেই বাধ্যতা রক্ষা করা আর মৃত্যু, দুই-ই হয়তো তখন সমতুল্য মনে হয়েছিলো দ্রৌপদীর। তাঁর শ্বশ্রূমাতা কুন্তী স্বেচ্ছায় পাঁচটি পুরুষের অঙ্কশায়িনী হয়েছিলেন। কিন্তু দ্রৌপদীর মতো একটি অনাহত শুদ্ধ চরিত্রের কন্যা পতি হিশাবে অৰ্জুনকে মাল্যদান করে তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার শয্যায় যেতে যে নিজেকে অতিমাত্রায় কলুষিত লাঞ্ছিত বঞ্চিত মনে করেননি তা কি হতে পারে? কুন্তী তাঁকে পদার্থ বললেও সত্যি তো তিনি পদার্থ নন। অর্জুন বস্তুতই আকর্ষণীয় পুরুষ। বীরত্বেও কর্ণ ব্যতীত আর কেউ তাঁর সমতুল্য আছেন কিনা সন্দেহ। সেই ইপ্সিত প্রেম ও বাসনা নিয়ে যখন তাঁর হৃদয় থরোথরো তখনই যেতে হলো অৰ্জুনের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যুধিষ্ঠিরের শয্যায়। স্বীয় উপভোগান্তে যুধিষ্ঠির সেই পদার্থ নামের দেহটা পাঠিয়ে দিলেন ভীমের শয্যায়। ইতিমধ্যে অর্জুনের নির্বাসনও হয়ে গেল বারো বছরের জন্য, যেহেতু, যুধিষ্ঠির যখন দ্রৌপদীর সঙ্গে ছিলেন তখন নিয়মবিরুদ্ধভাবে কোনো অনিবার্য কারণে অৰ্জুনকে সেই ঘরে ঢুকতে হয়েছিলো। কে জানে কতো নিঝুম রাতের অন্ধকারে চোখের জলে ভেসে গেছে দ্রৌপদীর হৃদয়ের সব স্বপ্ন।………

Leave a Reply