মুখবন্ধ
‘মফিজন’-এর অনেক প্রতিকূল সমালােচনা হইয়াছে। অল্প-সংখ্যক শিল্প-রসিকের মত : এইটি একটি অনবদ্য শ্রেষ্ঠ রচনা, অধিক-সংখ্যক পাঠকের রায় : রচনাটি অশ্লীল। | তবে মফিজন’কে কেহ ভুলিতে পারেন নাই। কারণ, ইহার শক্তিকে অস্বীকার করা যায় না।
তবুও দুই জনের কথা বিশেষভাবে মনে পড়িতেছে। একজন সীলেটের প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক সত্যভূষণ চৌধুরী। তিনি মফিজন’ পড়া শেষ করিয়া সবিস্ময় বলিয়াছিলেন ‘ইহার কোন্ খানটা যে অশ্লীল আমি বুঝিতে পারিলাম না’!
অপর জন আমার কনিষ্ঠা সহােদরা-প্রতিম কবি সুফিয়া কামাল। তিনি লিখিয়াছিলেন : সকলে সমালােচনাই করিল, কিন্তু মফিজন’-এর বেদনাটা কেহ বুঝিল না!
আলামীন কাজির দেউরী সেকেন্ড লেইন চট্টগ্রাম।
মাহবুব-উল আলম। ২০শে ডিসেম্বর, ১৯৬৪
মক্তবে বহু মেয়ে পড়ে। ছবিরন ও মফিজন—ছবি ও মফি, দুই বােনও পড়ে। ছবি বড়, মফি ছােট। কিন্তু দেখিতে দুইজনই সমান। তবুও পার্থক্য অনেক। ছবির রং ময়লা, শরীর মাংসল। মফির রংয়ের খােলতাই খুব, অথচ কৃশাঙ্গী। কিন্তু, আসল পার্থক্য চোখে। ছবি গরুচোখা—প্রকাণ্ড গােলকে ভাষা মূক—কোন্ আদম যেন উহার প্রতিবাদ। স্তব্ধ করিয়া দেওয়ার জন্য উহাকে মােড়াইয়া রাখিয়া গিয়াছেন। আর মফির চোখ দিয়া বাহির হয় ঝলকে ঝলকে জ্যোতিঃ। ছবি তাকাইয়া থাকে বেশী, কথা বলে কম কথা আকার ধরিয়া যেন বাহির হওয়ার পথ পায় না—পেছনে যেন কোন মনন নাই। মফি তাকায় মুহূর্ত; কিন্তু কথা বলে অনেক। ডিম-ভরা কৈ’র মতাে; ভিতরে সব দানা বাঁধিয়া আছে। ছাড়িতে পারিলে বাঁচে। আর পার্থক্য দেখা দিতেছে গ্রীবায়। যতই বালিকা ছাড়াইতেছে, ছবির গ্রীবা বসিয়া যাইতেছে—মিস্ত্রীর কুঁদান গােলকের ন্যায় নিজের খাঁজে, আর মফির বাহির হইয়া যাইতেছে পদ্মের মৃণালের মতাে।
এ পার্থক্য লক্ষ্য করার মতাে চোখ মক্তবে ছিল না। কারণ, বুড়ি শিক্ষয়িত্রীর পড়ানের বাহিরে হুঁশ নাই। আর ত সব মেয়ের দল। তুমিও যেমন, আমিও তেমন। এক জোড়া চোখ লইয়া আসিল বুড়ির দৌহিত্র মামুদ—কয়েকদিনের জন্য নানীর বাড়িতে বেড়াইতে আসিয়াছে। সঙ্গে এক জোড়া কানও।
মামুদ দেখিতে লাজুক; কিন্তু অকুতােভয়। বয়স এগার। ছবি ও মফির চাইতে বছর দু’য়ের সেয়ানা দেখায়। সাহস আছে, কিন্তু বড়াই নাই। এই বয়সে পাড়ার বিদ্ঘুটে সব জায়গায় গিয়াছে, যেখানে দিন দুপুরে যাইতেও আর দশ ছেলে ভয় করে। গিয়াছে একা। গিয়া দেখিয়া আসিয়াছে। কাহাকেও জানায় নাই। পাছে কেহ জানিয়া ফেলে এই ভয়। জানিলে বড় লজ্জার কথা হইত না।
এক পাল মেয়ের মাঝে পড়িয়া মামুদের প্রথমটা বড় লজ্জা হইল। লজ্জায় যেন তাহার চোখ-কান বুজিয়া গেল। কিন্তু, মফি তাহাকে টানিয়া তুলিল। তাহাকে হাত ধরিয়া টানিল খেলিতে, তাহার গলার উপর বাহু বাঁধিয়া টানিল বেড়াইতে, আর নিজে গল্প বলিয়া তাহাকে বাধ্য করিল ‘সায় দিতে। দু’দিনে তাহারা নিজের জগত রচনা করিল পুকুরপাড়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায়। নিরালা জগত। যেখানে নদী আপন মনে ভাঙ্গে তট, বাঁধ দিবার কেহ নাই। অথবা তােক উলঙ্গ হইয়া নামে জলে, কেউ দেখিয়া ফেলিবে বলিয়া ভয় নাই। | মফি বক্তা, মামুদ শ্রোতা, মফি নদী, মামুদ তার ডুবুরী। মফির পেটভরা কথা বাহির হইতেই দানা বাঁধিয়া উঠে গল্প। পিতার এ-গুণটুকু সে পাইয়াছে। আর সব গল্পেরই নায়ক ভীষণ ডানপিটে, অকুতােভয়। মামুদের খুব ভালাে লাগে। শুধু ভালাে লাগা নয়, মফির প্রতি কৃতজ্ঞতায় তার মন ভরিয়া ওঠে। আর ইহারই আতিশয্যে এক একদিন মফির বা হাতখানিকে সে ধরিয়া রাখে নিজের দু’হাতের মধ্যে।
মফির অনেক গল্প এখনও বাকী। ইহারই মধ্যে মামুদের ডাক আসিল। স্কুল খুলিবে।
যাওয়ার দিন। নিরালা কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় মফির বা হাতখানি নিজের দুই হাতের মধ্যে লইয়া মামুদ বলিল—‘আসি’। যেন মামুদ এই প্রথম কথা বলিল। এবার মফির কথা গেল বন্ধ হইয়া। সে একদৃষ্টে মামুদের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। যেন এতদিনে সময় হইল সঙ্গীটির দিকে চাহিয়া দেখিবার।
চোখে চোখ রাখিয়া উভয়ে বুঝিতে পারিল—এই অবস্থা অসহ্য। ইহার সমাপ্তির জন্য কিছু একটা ঘটা চাই। তখন মফি করিল চোখ নত, আর মামুদ আগাইয়া গিয়া তার কপালে করিল চুম্বন। এবার হাসি-চোখে মফি করিল মামুদের ওষ্ঠে চুম্বন। “বিদায়”! একটু থামিয়া,—“দিদির সঙ্গে দেখা করে যাবে না?” মামুদ সহজ গলায় বলিল : “চল দেখা করি গে।” | গরু-চোখা মেয়েটি পথের ধারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল। মামুদ যদি দেখা না করিয়াই চলিয়া যায়, সে মামুদের শেষ যাওয়াটা দেখিবে। মামুদ ও মফি এক সঙ্গে আসিয়া পড়িল সেখানে।—“ও ভাই-দিদি, আমরা তােকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। মামুদ এসেছে তাের থেকে বিদায় নিতে।” | ছবি তাহার প্রকাণ্ড দৃষ্টি তুলিয়া ধরিল মামুদের মুখে। যেমনি প্রকাণ্ড, তেমনি অবিকম্প। কিন্তু, অতল কূপের ন্যায় গভীরও। মামুদ এ মেয়েটিকে বুঝিয়া উঠিতে পারে না। মফি হয়ত পারে। সে বলিল : “মামুদের জন্য মন কেমন করবে, না ভাই-দিদি।”
এবার প্রথমে হাসিল ছবি, পরে মফি মামুদ এক সঙ্গে। মামুদ ছবির ডান হাতখানি নিজের দু’হাতের মধ্যে তুলিয়া লইয়া বলিল : “এবার আসি। দোআ দিও—পরীক্ষায় যেন ভালাে পাশ করতে পারি।”
ছবি বলিল : আচ্ছা। শুধু একটি ‘আচ্ছা।’
নানীর বাড়ি হইতে ফিরিয়া মামুদ নিজের পুরাতন স্থানটি আর গ্রহণ করিতে পারিল না। সব কিছু মাপে ছােট পড়িয়া যাইতে লাগিল। পুরাতন জামা ছােট পড়িয়া গেল, পুরাতন সাথীরা ছােট পড়িয়া গেল, আর পুরাতন স্কুলও ছােট পড়িয়া গেল। কোথা হইতে যেন এক দিগ্বিজয়ী আসিয়াছে। পরীক্ষার পর পরীক্ষা সে পাস করিয়া চলিল সর্বোচ্চ হইয়া। মা-বাপের সঙ্গে বয়সের যে ব্যবধান ছিল, তাহা যেন দ্রুত কমিয়া যাইতে লাগিল। মা ভাবিলেন, এবার বৌ দেখা দরকার। আর ছবিরণের বাপ ছিলেন উপযুক্ত পাত্রের খোঁজে। তিনি মন স্থির করিয়া নজর দিলেন মামুদের উপর। টাকা যত লাগে।
ছবি ও মফির বাবা ওয়াজুদ্দীন শেখ—পাটের দালালী করিয়া পয়সাওয়ালা হইয়াছেন। পয়সাওয়ালা হইয়া চক-মিলান বাড়ি করিয়াছেন; বেশ-ভূষারও উন্নতি হইয়াছে। কিন্তু, ‘কিস্তী’ ‘টুপী’ ছাড়েন নাই। ছাড়িবার প্রয়ােজন বােধ করেন নাই। কারণ, পাটের দালাল হইলেও তাঁহার দেশজোড়া খ্যাতি পুঁথির পণ্ডিত বলিয়া। আর সেই সঙ্গে সর্বত্র পরিচয় হইয়া গিয়াছে ওয়াজুদ্দীন পণ্ডিতের ‘কিস্তী টুপী’রও।
পয়সাওয়ালা হইয়াছেন; কিন্তু বড়লােক হইতে এখনও বাকী। শরীফ লােকেরা তাঁহাকে দেখিলে কেমন যেন বুক ফুলায়,-ছাতি উঁচু করিয়া ধরে। তিনি আগাম সালাম দিতেছেন কিনা লক্ষ্য করে। আড়াল হইতে শুনাইয়া কেহ কেহ বলে : “ছােঃ, দালাল আবার একটা মানুষ! পয়সা ত চামারেরও থাকে। করুক দেখি একটা ভালাে ঘরে সম্বন্ধ। শরীফ হতেও লাগে তিন পুরুষ, শরীফি যেতেও লাগে তিন পুরুষ।”
এই দলের ছমির কাজীর কথাতেই নুনের ছিটা বেশি। ছমির কাজী—যার সাত সাতটি মেয়ে, সম্বল কিছুই নাই, ভুইফোড় ঘরে মেয়ে বেচিয়াই যাহার দিন গুজরান হয়। | ছােট্ট নিঃশ্বাসও পড়ে। পণ্ডিতের একটি ছেলে নাই। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই ভাবিয়াছিল, ছােট মেয়ে মফি মেয়ে না হইয়া বেটা ছেলে হইবে। যখন মেয়ে হইল—কিছুদিন কেহ কাহারও চোখে তাকায় নাই। পাছে হতাশা ধরিয়া ফেলে। ছেলে হইলে কী চমৎকার মানাইত মফিকে!
| ছেলে নাই। পণ করিলেন, জামাইকে দিয়া সে অভাব মিটাইতে হইবে । মামুদের বাপকে রাজী করিয়া ফেলিলেন। মামুদের বাপ নিজে শরীফ; কিন্তু সব শরীফ ঘরের সঙ্গেই তাঁর শত্রুতা। কারণ? শরীফরা হইলেন লেফাফা-দুরস্ত । আর মামুদের বাপ মীর তাজুদ্দীনের লেফাফাই নাই । চোখেও না, জিহ্বাতেও না। মুখের উপর এমন স্পষ্ট কথা এ তল্লাটে আর কেহ বলিতে পারে না।
তা ছাড়া, তাঁহার কতক হালচালও অশরীফি। নৌকায় দাঁড় টানিতে পারেন, হাল চষিতে জানেন, সুর করিয়া পুঁথি পড়া—ঘর ছাওয়া—সঁড়ের লড়াই—বলীর কুস্তি, সব কিছু পারেন। পারেন ত ভালােই; কিন্তু, ‘বাঙ্গাল’দের সাথে উঠ-বস করিয়া এসব করিলে তাহার শরীফত্ব বজায় থাকে কি করিয়া? তা ছাড়া কিছুটা পেট-রােগা হওয়াও শরীফির লক্ষণ। চল্লিশের পরে ভুড়ি নামিবে, আর কামারের হাপরের ন্যায় রাতদিন গ্যাস উহার ভিতর-বাহির করিবে। কিন্তু এ-ব্যাপারেও তিনি দল-ছাড়া। প্রকাণ্ড কাঁঠাল একাই সাবাড় করেন। পেট নামে না একটুও। কোথায় যে সেঁধিয়া যায়, আল্লাই জানেন।
মীর তাজুদ্দীন রাজী হইলেন। কিন্তু, বিবি সাহেবা চাহিলেন ছেলের মন বুঝিতে। মামুদ বড় মুখ-চোরা। বলিল : ‘আমি কি বলব, আব্বার যা ইচ্ছে। আড়ালে বলিল : তওবা, তওবা।’ বিবি সাহেবা খবর লইয়া জানিলেন, মেয়েটি তেমন সুশ্রী নহে; আর ছােটটির সম্বন্ধে পণ্ডিত কোনাে প্রস্তাবই এখন শুনিবেন না। তিনি বাঁকিয়া বসিলেন। এমন সময় পণ্ডিতের দূতী আসিল—বড় মেয়েকে যে সকল অলঙ্কার পণ্ডিত দিতেছেন সেগুলাে লইয়া। দেখিয়া তাঁহার চক্ষুস্থির। জড়ােয়া গহনায় মেয়েটিকে জড়াইয়া দিবে দেখা যায়। এবার তিনিও রাজী হইলেন। ঘরােয়া কথা হইয়া গেল।
শুনিয়া মফি গেল নিরালায় আর্শী হাতে। কপালে ও ওষ্ঠে রগড়াইয়া যেন তুলিতে লাগিল কিসের দাগ। যখন মনে হইল দাগ তােলা হইয়া গেল, তখন তাহার বাঁ-চোখে আসিল জল। কিন্তু ডান চোখ দিয়া আগুন বাহির হইয়া তাহাকে শুকাইয়া ফেলিল। আর সব সময়ে হইল ভয় : পাছে এক জোড়া গরু-চোখ তাহার দিকে চাহিয়া আছে।
বিবাহ হইয়া গেল। শ্বশুর বলিলেন : ‘বেশ বৌ।’ শাশুড়ী বলিলেন : ‘অলঙ্কারে মানাবে। মামুদ হঠাৎ কিছু বলিতে পারিল না।
বাসর রাতে সে ছবির নূতন পরিচয় পাইল। মফির কথা নামিয়া আসিত জিহ্বা বাহিয়া অবিরল ধারায়। ছবির জিহ্বা মূক। সে কথা বলে তার দেহ দিয়া। মাংসল সুগঠিত প্রশান্ত দেহ। একবার হাত লাগাইলে উহা যেন লাগিয়া যায়, উঠাইয়া নিতে ইচ্ছা হয় না আর। আর সারা দেহে কান লাগানাে; শুধু হাতের তালুতে লাগানাে ভাষা। যেখানে যত গােপন স্পর্শ কর—চির-জাগন্ত ধরিত্রীর ন্যায় সে তাহা শুনিতে পায়, অমনি তাহার হাত সক্রিয় হইয়া ‘রেকর্ড করে সাদর আহ্বান; আর উহা না মানিয়া উপায়ই নাই। তখন সমগ্র ছবিটি হইয়া ওঠে প্রকাণ্ড একটি হৃদৃপিও—তাজা ও তপ্ত সবচেয়ে নীরব, আবার সবচেয়ে গতি-মুখর।
প্রথম দৈহিক মিলনের পর মামুদের মনে হইল, এই পরিচয় সবেমাত্র শুরু হইল। কারণ? মামুদের অতটা রােমাঞ্চ হইল না, যতটা সে ধারণা করিয়াছিল তাহার কেতাবী বিদ্যা হইতে। কিন্তু, ছবির রােমাঞ্চ সে বুঝিতে পারিল। মনে হইল, তাহার সারা দেহের কানগুলির মধ্যে যেন একটা কানাকানির বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল। আর মিলনের শেষে তাহার দেহ গেল যেন শান্তিতে জুড়াইয়া; তাহার হাতের তালু সঞ্চারিত করিল পরিপূর্ণ বিশ্বাস ও নির্ভরতার ভাষা, তাহার চোখ বুঝাইল কৃতজ্ঞতা, আর জিহ্বা মুক্তি পাইল পরিপূর্ণ তৃপ্তির বাণীতে। অতল কূয়ার জল কানায় কানায় ভরিয়া আকাশ ও ধরণীকে চিত্রিত করিল উহার বুকে। শাশুড়ী খুশী হইয়া শ্বশুরকে বলিলেন : “ওগাে, আল্লা চাহে ত মামুদের বিয়ে ভালােই হ’ল। বিয়ের পানি গায়ে পড়তেই পণ্ডিতের বেটি কেমন ফিরে উঠেছে দেখেছ। রংও যেন ধুয়ে ফর্সা হয়ে উঠল।” মীর সাহেব হাসিয়া উত্তর করিলেন : “আমি বলিনি?”
আহ্লাদটা ছেলের নিকটও প্রকাশ করিলেন। মামুদ ভাবিয়া বলিল : “হবে মা তােমার আদর যত্নে। ওখানে তাে সবটুকু আদরই ছােট বােন পেয়ে এসেছে।”
বৌ লইয়া মামুদকে শ্বশুরবাড়ি যাইতে হইল। ছবির পরিবর্তন দেখিয়া সকলে খুশী হইল। সকলের বেশী খুশী হইল মফিজন। কিন্তু অনেক চেষ্টা করিয়াও তাহাকে মামুদের সামনে পাঠান গেল না। অথচ তাদের শােয়া খাওয়ার ব্যবস্থার ভার লইয়াছিল সে নিজে; আর এমন নিখুঁতভাবে চালাইল সব, পান হইতে চূণ খসিতে দিল না। শুধু তাহার নিজের বিছানার জৌলুস কমিয়া গেল। রাত্রে বিছানায় শুইয়া তাহার ঘুম হয় না। সে সন্তর্পণে হিসাব করে—কপালের এবং ওষ্ঠের সে দাগ নিঃশেষে মুছিয়া গেল কিনা। এক এক বার সন্দেহ হয়, বা চোখ ভিজিয়া ওঠে; তখন ডান চোখে আগুন ঢালিয়া উহাকে শুকাইয়া ফেলে ।
বৌ লইয়া মামুদ চলিয়া গেল। উহার পূর্বেই বুঝা গেল, ছবিরণের গর্ভ হইয়াছে।
মেয়ে-জামাই বিদায় দিয়া পণ্ডিত দেখিলেন : অনেক টাকা ব্যয় হইয়া গিয়াছে। কিন্তু মামুদকে জামাই করিতে পারিয়া আত্মপ্রসাদে চিত্ত ভরিয়া গেল। এবার সত্যিই বড়লােক হইয়াছেন। ছমীর কাজীর মুখ। বন্ধ হইয়া গেল আর কি! সামান্য অবস্থা হইতে তিনি এতদূর আসিয়াছেন। রশিদ বেপারীর ছেলে। তাঁহার পিতা হাটে হাটে কুঁড়া কেনা-বেচার ব্যবসা করিতেন। পূর্বাপর জীবনের ইতিহাস বইর খােলাপাতার মতাে চোখের সামনে ভাসিয়া উঠিল। হাঁ, ইহার কোথাও তিনি ভুল করেন নাই। যাহারা ভুল করিয়াছিল তাহারা কোথায় চলিয়া গিয়াছে—তলাইয়া। বুদ্ধি থাকিলে কি না হয়। তাঁহার নিজেকে মনে হইল সব চেয়ে সেরা বুদ্ধিমান।
আর ইহাই হইল তাহার কাল। ক্ষতিটা পােষাইয়া লইবার জন্য ঠিক করিলেন : একটা চাল চালিবেন। ব্যবসায়ে তিনি যে সকলকে ছাড়াইয়া যান নাই উহার মূলে দেখিতে পাইলেন তাঁহার দুর্বলতা; অনেককে তিনি তাঁহার অপেক্ষা বুদ্ধিমান বলিয়া মনে করিয়া আসিয়াছেন। তাহাদের সহিত পরামর্শ করিয়া জোট বাঁধিয়া ব্যবসা। করিয়াছেন। এবার সে ভুল ভাঙ্গিয়াছে। কাহারও সহিত পরামর্শ করিলেন না। যাহারা অযাচিত পরামর্শ দিল—তাহাদের মধ্যে ঘরের বিবি একজন। তাহাদের পরামর্শ তিনি অগ্রাহ্য করিলেন। কিন্তু, চাল যখন তিনি দিলেন উহাতে মস্ত ফাঁক দেখা দিল। সব পাট তাহার এক হাতে জমা হওয়ার পূর্বেই কলিকাতার একটা বড় আড়ত কারবার গুটাইয়া মজুত মাল সস্তা দরে বাজারে ছাড়িয়া দিল। উহা কিনিয়া এক হাত করা যেমন সাধ্যের বাহিরে, তেমনি দাম উঁচুতে ধরিয়া রাখাও তাঁহার পক্ষে সম্ভব হইল না। তাঁহার মাল লাট পড়িয়া গেল। মহাজনেরা দেনার দায়ে সেই মাল মায় গুদাম বেচাইয়া ফেলিল। তিনি ফতুর হইয়া গেলেন। ছমীর কাজি তুড়ি মারিয়া বেড়াইতে লাগিল : ‘পিপীলিকার পক্ষ ধরে মরিবার তরে!’
এমন সময় বস্তু সরকার হইল মফিজনের খাস্তগার। টাকা যত লাগে। টাকা দিয়া জাঙ্গাল বাঁধাইয়া দিতে হয়, তাহাও স্বীকার। বাস্ত বিক, অত টাকার মালিক সে। ছােট বেলায় পড়ার ভয়ে পালাইয়াছিল আকিয়াবে। সেখানে প্রথমে হইয়াছিল চায়ের দোকানের বয়’, পরে ডিঙ্গীর খালাসী। ডিঙ্গীর খালাসী কি করিয়া হইল বহরে বহরে ডিঙ্গীর মালিক, সে-কাহিনী আজও লােলাকের মুখে মুখে ফিরে। তখনই হইয়া গিয়াছিল দেশের সেরা ধনী। কিন্তু পালে তখনও হাওয়া লাগিতে বাকী। সে হাওয়া লাগিল যখন কোটিপতি এহুদী ইলিয়াস সাহেব আসিয়া আকিয়াবে মিলের পর মিল বসাইতে লাগিলেন, আর দু’দিন আলাপের পরই বক্তকে ডাকিয়া করিলেন তাঁহার মিলসমূহের ‘সরকার অর্থাৎ কর্মাধ্যক্ষ। ভাগ্য যেন উজান বহিয়া আসিয়াই অর্ধপথে তাহাকে বরণ করিয়া লইল। তারপর আসিল প্লাবন। | কিন্তু, নিত্য টাকা গােণার মাঝে বশুর সময় হয় নাই দেশে ফিরিবার এবং বিবাহ করার। অথচ তাহার সে সঙ্কল্প রহিয়াছে বরাবরই। যে ছেলেটি পড়ার ভয়ে দেশ ছাড়িয়া পলাইয়াছিল, সে দেশকে কিছুতেই ভুলিতে পারে নাই। যে-ওস্তাদের ভয়ে পলাইয়াছিল, তাহাকে সে রীতিমত মাসহারা দিয়া আসিতেছে। আর যাহার কামরায় খাইত বেদম-মার, সেই মক্তব-বাড়িকে করিয়া দিয়াছে পাকা মাদ্রাসা। কিন্তু, ইহার মধ্যে তাহার বয়স কিছু বেশী হইয়া গিয়াছে। আধ-ডজন ছেলের বাবা অনায়াসেই হইতে পারিত। মাথার চুলও দু’এক গাছি মাঝে মাঝে পাকিয়া গিয়াছে। বাড়িতে সব মরিয়া আছেন। বুড়ি মা-টি ভিটা আঁকড়াইয়া। এবার বহু বৎসর পরে সময় করিয়া বকশু আসিয়াছে বাড়ি, আর বহু মেয়ের বর্ণনা শুনিয়া সে মফিজনকে করিল পছন্দ। পণ্ডিতের তখন আধ-কোটা কৈ’র অবস্থা। মহাজনেরা পাখনা কাটিয়াছে, লেজা কাটিয়াছে, কানকো কাটিয়াছে, এবার দুই টুকরা করিয়া পেটের নাড়ি বাহির করিয়া ফেলিবে। তাহার অবস্থা বুঝিয়া মফিজনই আগাইয়া আসিয়া এ-প্রস্তাবে তাহার সম্মতি জানাইল। তাহার মা-ও পণ্ডিতের কোন কথা শুনিতে চাহিলেন না। বিপদের আভাস পাইয়া পাকা মাঝির ন্যায় তিনি বৈঠা নিজ হস্তে তুলিয়া লইলেন। দেখা গেল, সম্পদের দিনে যে চালাইয়া লইয়া আসিয়াছে সে আসলে দাঁড়ি, আর খাটের উপর বসিয়া দোক্তায় ঠোট রাঙাইয়া যে পান-চর্চা করিতেছিল সে-ই আসল মাঝি। মা ও মেয়েকে সংসার-তরণী বুঝাইয়া দিয়া পণ্ডিত হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিলেন। মন কিছু ঘুরিয়া আসিতে চায়। বকশু ইহারই মধ্যে প্রস্তাব দিয়াছে : তিনি যদি হজ্বে যাইতে চান তাহা হইলে প্রথম শ্রেণীতে।
বশুর সহিত মফিজনের বিবাহ হইয়া গেল। কিন্তু, বিবাহ-মজলিসেই আসিয়া পৌছিল ইলিয়াস সাহেবের জরুরী টেলিগ্রাম : সামনের বােটেই বকর ফিরা চাই, নতুবা রহমানেরা বড় বেগ দিতেছে। রহমান ইলিয়াস প্রতিষ্ঠানের ছােট সরকার। বক্তর স্বাভাবিক প্রতিদ্বন্দ্বী, হিসাবে মাথা খুব দড়। বস্তু পেছন ফিরিতেই হিসাবে অনেক ভুল ধরাইয়া দিল। ভাবিল, এবার বশুকে সরাইয়া দিয়া তাহাকে করিয়া লইবে বড় সরকার। কিন্তু, ইলিয়াসকে সে কোনদিনই বুঝিত না। বুঝিত বণ্ড। জহুরী জহর চেনে। ইলিয়াস ও বন্ড বােঝে ব্যবসা। এইখানেই দু’জনের পরিচয় নিবিড়। হিসাবের ভুল ত হওয়াই সম্ভব।
সে ত আর কেরাণী নহে! আর, রহমানকেও ত অডিটার রাখা হয় নাই! সে মনে করিয়াছে কি : হিসাব ঠিক থাকিলেই ব্যবসা আপনা হইতে ফাঁপিবে? সে মুখে কিছু বলিল না; ভিতরে বিরক্ত হইল রহমানের উপর, আর বশুকে করিল টেলিগ্রাম। বস্তু আর রহমানের রেষারেষি এ অঞ্চলে সুবিদিত। কারণ, উভয়ের বাড়িই এ অঞ্চলে। বন্ড গিয়াছিল ছেলে বয়সে পলাইয়া। রহমান গিয়াছিল নব-যৌবনে মাইনর পাস করিয়া। বকশু পলাইয়া গিয়া ঠেকিয়া শিখিয়াছিল অনেক। আর রহমান স্কুল ছাড়িয়া চেষ্টা করিতেছিল তাহার পড়া বিদ্যাকে কাজে লাগাইবার জন্য।
কি হইতে কি হয়। মজলিসের সকলে বিবেচনা করিয়া রায় দিল : বশুর যাওয়াই কর্তব্য। কিন্তু হায়! বিবাহের পর একটি মাত্র দিন হাতে পাওয়া যাইবে!
একটি মাত্র রাত্রি। তারও অর্ধেক কাটিয়া গেল যাওয়ার বাধাছাঁদায়। কিছুটা ক্লান্ত দেহে অবশেষে বর-কন্যা উভয়ে শয্যাগ্রহণ করিল। পুরুষ ও নারীর এক শয্যা। পুঁথি-সাহিত্যের অনেক কাহিনী মফির মুখস্থ। আর এক গাদা পুঁথি সঙ্গে আনিয়াছেও সে। পুঁথির কাহিনীর সঙ্গে তার আজিকার বর-শয্যা বেশ মিলিয়া যায়। কিন্তু, বরটি কোনাে রাজপুত্র নহে, দিগ্বিজয়ী পালােয়ানও নহে। ইলিয়াসকোম্পানীর সরকার মাত্র। হৌক সরকার, টাকা আছে বিস্তর। থাকিলই বা টাকা। এমন বলিবার ক্ষমতা নাই যে, নূতন বিবাহ হইল, আর দু’দিন থাকিয়া যাই। কপালের আর ওষ্ঠের দাগ যে একবার তুলিতে হইয়াছে উহা তাহার মনে আছে। নাই-বা দিল উহাতে আবার নূতন দাগ লাগিতে। কিন্তু, বন্ড ছাড়িবে কেন? তাহার দেহ অটুট। টাকা উপার্জনের ফাঁকে এই কথা সে কোনদিন ভুলে নাই যে, সে একদিন বিবাহ করিবে এবং আদর্শ স্বামী হইবে বউকে ভালবাসিয়া। আর, এই রাত্রির জন্য সে প্রতীক্ষা করিয়াছে বহু বৎসর—তার অর্ধেক জীবন। সে বাতি উজলাইয়া দেখিল মফির মুখ। মফি চোখ বুজিয়া পড়িয়া রহিল।
সে বােজা চোখের উপর নামাইয়া দিল চুম্বন, আর কানের কাছে নত হইয়া ডাকিল :
“ওগাে, শুনছাে?” মফি চোখ খুলিল : “কি?” “আমার মন টাঙ্গানাে থাকবে তােমার দিকে। মাকে দেখাে।” নত হইয়া চুম্বন করিল এবার ওষ্ঠে। “যত সকাল পারি ফিরবাে।” মফির মনে আসিল : “কিন্তু, কত সকাল?” মুখে শােনা-কথার ন্যায় বলিল : “যত সকাল পার, ফিরবে।” “তাই ফিরবাে; তুমি দেখে নিও।”
সঙ্গে সঙ্গে নিষ্কম্প বাহু দিয়া সে মফিকে তুলিয়া লইয়া বসাইল কোলে। আবার কানে কানে পাঠাইল অনুরােধ : “লক্ষ্মীটি, একটি চুমাে৷”।
মফির মনে ভাসিয়া উঠিল ঝকঝকে টাকার তােড়া—যাহার কয়েকটি তাহার পিতা বিবাহের আগে তাঁহার শূন্য লােহার সিন্ধুকে। তুলিয়া লইয়াছিলেন। সে কণ্ঠ-বেষ্টন করিয়া বস্তুর আনত ঠোটে চুম্বন আঁকিয়া দিল। | “এবার শুই।”
ব তাহাকে নামাইয়া দিল। বাতি নিভাইয়া দিল। কিন্তু, শুইল । করিল চরম প্রস্তাব। মফি চুপ করিয়া রহিল। আঁধারে বশু ভাবিল : হয়ত ইহাই নিয়ম, এই মৌনই সম্মতি।
বকশু ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। মফি শুইয়া জাগিয়া আছে। জীবনের প্রথম চুম্বনের ন্যায় এই ব্যাপারেও আর পুনরুক্তি ঘটিবে না। সে জানে, বশু দ্বিতীয় যাত্রায়ও অন্ততঃ বারটি বৎসর কাটাইয়া দিবে। কারণ, তাহার শ্রেণীর লােকের পক্ষে একটা জীবনের অপেক্ষাও কিছু নহে। আর, ততদিনে এই মফি মরিয়া ভূত হইয়া যাইবে। তাই এই একটি মাত্র অভিজ্ঞতাকে সে ঘুরাইয়া ফিরাইয়া নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিতেছিল। ইহার কোন খানটা মধুর, কোন্ খানটা সত্য। সর্বশেষ তাহার উভয় দিককার সিদ্ধান্ত আসিয়া মিলিল একই জায়গায়—যখন জরায়ুতে পুরুষের রেতঙ্খলন হয়। তাহারও হইয়াছে, সে স্পষ্ট অনুভব করিয়াছে। আল্লা করুন, তাহার যদি একটি সন্তান হয়। তাহাকে মানুষ করিতে সে জীবন কাটাইয়া দিবে।
বশু চলিয়া গেল। মফির ঋতু হইল। বুঝিল, সন্তান হইবে না। শাশুড়ী-বুড়িকে ইহার মধ্যে সে ষােল আনা পােষ মানাইয়া লইয়াছে। ভালাে খাবার, ভালাে বিছানা পাইলেই বুড়ি সন্তুষ্ট। ভালাে খাইয়া ভালাে বিছানায় পড়িয়া ঘুমায় আর ঘুমায়। রাত্রে ত ঘুমায়ই। দুপুরেও এমন ঘুম দেয় সে হাঁ করিয়া হাঁ’র মধ্যে মাছি ঢুকিয়া পড়িলেও ঘুম সহজে ভাঙ্গিতে চাহে না। তখন মফির প্রচুর সময়। পুঁথিগুলি খুলিয়া বসে। একা একা পড়িয়া সুখ পাওয়া যায় না।
দু’দিন পরে একটা ছেলে আসিল পড়া বুঝাইয়া লইতে। শাশুড়ী পরিচয় করাইয়া দিলেন। দক্ষিণ পাশে যে প্রকাণ্ড পুকুরটি, তার ওপারে বাড়ি। সম্পর্কে ভাগ্নে হয়। পরিচয় করাইয়া দিতে দিতে বুড়ি পড়িল ঘুমাইয়া। ইহারই মধ্যে মফি ছেলেটিকে দেখিয়া লইয়াছে—বড় এক জোড়া চোখ, বিস্ময়ে ভরা—যেন পথ ভুলিয়া আসিয়া পড়িয়াছে এ কোন্ মায়ার দেশে—যাহা দেখে উহাই মনে হয় আশ্চর্য। কিছু বাড়ন্ত শরীর, পা ও পাছায় চমৎকার পুরুষালী ঢং—যত শক্তি আছে জমা আছে যেন উরুসন্ধিতে। তবে নাকটা এখনও পাকিয়া ওঠে নাই। দেখিলেই কম বয়স ধরা পড়ে। মফি অনুমান করে, বয়স ন’য়ের বেশী নয়।
“খােকা, তােমার নাম কি?” “শানু। ভালাে নাম শা’ নওয়াজ।
“বেশ নামটি। (মফি পাটি বিছাইয়া সবেমাত্র পুঁথির বস্তানী খুলিয়া বসিয়াছিল, উহারই কিছু সরাইয়া শানুকে স্থান করিয়া দিল বসিতে] বস। কী বই পড়বে?”
“গণিত-শিক্ষা।” “গণিত ত আমি পারবাে না। কী অঙ্ক কষ?” “বিবিধ প্রশ্নমালা।” “বাপ রে, ও আমার কর্ম না।”
খােকা স্থূপীকৃত বইর পানে দৃষ্টি মেলিয়া ধরিয়া অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করিল : “আপনি কি পড়েন?”
“আমি পড়ি পুঁথি।”
“তবে আপনার কাছে পুঁথিই পড়বাে। মা বলে দিয়েছেন, আপনি বড় বিদ্বান, পদবন্দী চিঠি লিখতে পারেন।”
মফি এবার হাসিল। এ অঞ্চলের অনেকেই থাকে বিদেশে এবং থাকে দীর্ঘ দিন। বউরা চিঠি লিখে বিনাইয়া বিনাইয়া, কেউ কেউ বিনি সূতার মালার ন্যায় উহাকে করিয়া তােলে বিনি ছন্দের কবিতা। ইহারই মধ্যে খ্যাতি ছড়াইয়া পড়িয়াছে মফির।
খােকা ততক্ষণে তুলিয়া লইয়াছে উপরের পুঁথিখানি : “গরুর। দুঃখের কবিতা।” সারা গায়ে তার ধুয়া, “হায়রে গরুর দুঃখ রে।” খােকার নজরে পড়িয়াছে বারবারই একই কথা লিখিয়াছে, “হায়রে গরুর দুঃখ রে।” সে উহাই পড়িয়া দেখিতে লাগিল। বিস্মিত হইয়া বলিল : “আমাদের বইতে এক কথা বারবার লিখে না।”
“আমাদের পুঁথিতে লেখে।” “তােমরা মেয়েলােক, আমরা পুরুষ-না?” “হাঁ, তােমার মা-ও মেয়েলােক।”
থােকা কথাটা ভাবিয়া দেখিল। আরও কিছু ভাবিয়া জানাইল : “কাল মা মেরেছিল।”
“আমি কোনদিন মারবাে না। কাকেও মারিনি কোনদিন।” [খােকা মফির চোখের দিকে চাহিয়া তাহা বিশ্বাস করিল।।
“কিন্তু কেন মেরেছিলেন, কি করেছিলে তুমি?” “জল-কাদায় ছুটাছুটি করেছিলাম।”
“ও, এই জন্য?”
খােকা বুঝিতে পারিল মফিজনের মনের কথা : লঘু পাপে গুরু শাস্তি হইয়াছে। সে মফির উপর খুশী হইল। মা যে তারপর কত আদর করিয়াছিলেন, তাহা মফির নিকট চাপিয়া গেল। | বাড়ি ফিরিয়া মাকে সবই বলিল—শুধু শেষের দিকটা গেল সুকাইয়া। ছেলে পদবন্দী চিঠি লিখিতে পারিবে, মা সে সম্ভাবনাতেই হইলেন খুশী। অতঃপর খােকার জীবন গেল দ্বিধা-বিভক্ত হইয়া এক ভাগ হইল মা’র, এক ভাগ হইল মফির, আর একের আড়ালে রহিল অপর।
বকশুর চিঠি আসিল। মফি যাহা ভাবিয়াছিল, তাহাই। বেচারী বড় জড়াইয়া গিয়াছে। ইলিয়াস সাহেবের সঙ্গে ভাইদের লাগিয়াছে বিরােধ, আর তাহারই ভিতরে বাহিরে সব জায়গায় নিত্য সামাল’এর প্রয়ােজন হইতেছে। বন্ড চখীর ন্যায় ঘুরিয়া সব দিকে তদারক করিতেছে। রহমান গিয়া জুটিয়াছে সাহেবের ভাইয়ের সাথে। এক গাঁয়ের লােক। সুতরাং ইলিয়াস ছাড়িলেও বশু তাহাকে ক্ষমা করিতে পারিতেছে না।
বৎসর না ঘুরিতেই ছবিরণ আসিল পিত্রালয়ে প্রসবের জন্য। খবর পাইয়া গেল মফিজন দেখিতে—ছুটি লইয়া শাশুড়ী হইতে এবং খােকা হইতে। খােকা এখন স্কুলে পড়ে। মফিজন খরচটা চালায়। ছুটি পাইলেই মফিজনের নিকট আসিয়া বসে—বিশেষ করিয়া শনিবার ও রবিবার। কোনাে বেলা খাবার একটু ভালাে হইলেই তাহারও পাত্ পড়ে এবং ভালাে প্রায়ই হয়। আশ্চর্য! মফির যে খাবার পছন্দ খােকারও তাই পছন্দ। আর মফির যাহা অপছন্দ—খােকারও তাই অপছন্দ। শুধু রঙের বেলা তাহা খাটে নাই। মফির পছন্দ ধুতির শাড়ির কালাে পাড়, আর খােকার পছন্দ লাল পাড়। মফি বুঝাইয়াছে ফর্সা মেয়ের পরণে কালাে পাড়ই সুন্দর—ধারাল ঝঝকে ছুরি কিছুটা বাঁটের ভিতর থাকাই শােভন। আর খােকা বুঝিয়াছে : তা বটে; কিন্তু আরাে শােভন হয় যদি তাহা হয় নিষ্কাশিত এবং খুন-রাঙা। কিন্তু, এই অনৈক্যের মুহূর্তই তাহাদিগকে আনিয়া দিয়াছে নিকটে। খােকা ভাবিয়াছে—আদতে ইহারা মেয়েমানুষ; আর মফি ভাবিয়াছে— তােমার বাপু পুরুষালী ঢং। তাই খােকার নিকট হইতেও ছুটি লইতে হইল।
ছবিরণকে দেখিয়া মফি অবাক্ হইয়া গেল। সমস্ত দেহ যেন কানায় কানায় ভরিয়া রঙের ভারে স্বচ্ছ হইয়া গিয়াছে—আর উহার ভিতর দিয়া পেটের সন্তান দেখা যায়, শুধু বুঝিবার উপায় নাই কী সে সন্তান। আর মফিজনকে দেখিয়া সকলের মুখ আঁধার হইয়া গেল। চলিতে চলিতে সে যেন হঠাৎ থামিয়া পড়িয়াছে—পেছন দিকে না তাকাইলে আর তাহাকে দেখার যাে নাই। মাতা-পিতা নীরবে নিঃশ্বাস ফেলিলেন। বিবি সাহেবা পণ্ডিতের দৃষ্টি এড়াইয়া চলিতে লাগিলেন। আর পণ্ডিত ভাবিল : জীবনে এই দ্বিতীয় বার তিনি জবর ঠকা ঠকিলেন।
ছবিরণের একটি মেয়ে হইল। প্রসবের পর যত রাজ্যের ঘুম আসিয়া যেন চাপিয়া ধরিল ছবিরণকে। সে অঘােরে ঘুমাইতে লাগিল। পাশে বসিয়া আছে মফিজন। দেওয়ালের প্রকাণ্ড আর্শীতে দেখা যাইতেছে তিন জনকেই—ছবিরণ, তার মেয়ে আর মফিজনকে।
হঠাৎ মফিজন লাগিয়া গেল মেয়েটির শরীর মিলাইয়া দেখিতে কাহার মতাে হইয়াছে, মা’র মতাে না বাবার মতাে। সে দেখিয়া অবাক্ হইয়া গেল : মেয়েটি কাহারও মতাে হয় নাই, হইয়াছে হুবহু মফিজনের নিজের মতােই। মফিজন ইহার কারণ কিছুই বুঝিতে পারিল না। বহুক্ষণ ভাবিয়া একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিল। মফিজন যাহা দেখিল গােপনে, মেয়ের নানী, নানা আর দশজন সকলেই তাহা লক্ষ্য করিল প্রকাশ্যে! আর ইহা রটিয়া গেল যে, ছবিরণের একটি মেয়ে হইয়াছে। দেখিতে ঠিক খালার মতাে।
শুনিয়া খুশী হইল দাদা-দাদী। কিন্তু, ভয় পাইয়া গেল তার পিতা মামুদ। তার মনে হইল : ইহা মফিজনের বাড়াবাড়ি। সেই চুম্বনের শােধ লইবার জন্য তাহাকে মুশকিলে ফেলিতেই যেন মফিজন আসিল তার কন্যার রূপ ধরিয়া। এই ভয় তার কাটিল অনেক পরে, যখন দিনে দিনে দানা বাঁধিয়া মেয়ের দৃষ্টি হইল স্থির; আর দেখা গেল—উহার চাউনি ঠিক মামুদেরই চাউনির মতাে। বাহিরটা মফিজন হইলে কি হয়, ভিতরটা ঠিক মামুদই। পিতার দৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখিয়া সে যেন বুঝাইতে চাহিল : আমি তােমারই রক্তের রক্ত, তােমারই দেহ-মনের সৃষ্টি। তখন মামুদ তাকে বুকে তুলিয়া লইল। সহসা মফিজনের জীবনের বিয়ােগান্ত দিকটা তাহার চোখে ধরা পড়িয়া গেল। তখন নিজের স্বার্থপরতায় সে নিজেই হইল লজ্জিত। মেয়ের কপালে চুমাে খাইতে খাইতে সে স্থির করিল : ইহাকে গড়িয়া তুলিবে পরম যত্নে—নিজের জন্য ছাড়াও অন্ত তঃ মফিজনের জন্য তাহাকে এইটুকুন করিতে হইবে।
মেয়ের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কারের পর মফিজনের দুই দণ্ড ভালাে লাগে নাই পিত্রালয়। নিজের স্বল্পপরিসর ‘খােপাটির জন্য সে ব্যস্ত হইয়া পড়িল। হঠাৎ তাহার মনে হইল : ঠিকা-ঝির হাতে শাশুড়ীর ও খােকার খুব কষ্ট হইতেছে। হউক কাজ অল্প। তবুও, পরের মেয়েকে বিশ্বাস। কি? সকলের সহিত একরূপ লড়ালড়ি করিয়াই সে চলিয়া আসিল স্বামীর বাড়ি। যুক্তি দিয়া কেহ তাহাকে আঁটিতে পারিল না, রাগ করিয়াও না। শুধু পণ্ডিত বলিলেন : “ওকে বাধা দিয়াে না, যেতে চায় যা; ওর যাতে ভালাে লাগে।” আর পিতার এই সম্মতিই যেন হইল তাহার পক্ষে মস্ত বড় বাধা। সে উহাও ঠেলিয়া ফেলিল। একমাত্র । পিতা-পুত্রীই বুঝিতে পারিল এই সম্মতির পেছনে কতখানি আত্মধিক্কার, আর এই ঠেলিয়া ফেলার পেছনে কতখানি বেদনা রহিয়া গেল।
কিন্তু, তার নির্দিষ্ট খোেপটিতে ফিরিয়া আসিয়া সে দেখিল, খােপটি নির্দিষ্ট আছে বটে; কিন্তু তার আবহাওয়া গিয়াছে বলাইয়া। আর, ইহার কারণ ধরা পড়িল—খােকা, আর পরিবর্তনটা তার চোখে।
সে বহু পুঁথি ঘাটাঘাটি করিয়াছিল মফিজনের সঙ্গে। নির্বিচারে সব কথার অর্থ বুঝিতে চাহিত। মফি বুদ্ধি খাটাইয়া উত্তর দিত। খােকা জিজ্ঞাসা করিত : “শেকম মানে কি?”
“পেট।” “মেয়েদের পেট?” “হাঁ, এইখানে মেয়েদের পেট।”
(আবার] “এক বিন্দু মণি যদি টলিয়া পড়িল” (খােকা মণি’ শব্দ পায় নাই, পাইয়াছে ‘মুণি’, সুতরাং
“মণি মানে কি?” ‘এক রকমের পানি।” “পানি পেটে পড়বে কেন? মেয়েটির অসুখ হয়েছে?” “হাঁ, অসুখ হয়নি, এবার হবে।” [আবার] “চন্দনের মাঝে যেন ‘মৃগ পদ চিন্’ … এর অর্থ কি?”
“একটা ছবি—চন্দনের মাঝে যেন হরিণের ক্ষুরের দাগ দেখা যায়। যদি কখনও দেখ, বুঝবে।” | “চন্দনের জঙ্গলে গেলে দেখা যায়?”
কিন্তু, এবার পুঁথি পড়িতে বসিয়া থােকা সাবধানে বহু স্থান এড়াইয়া যাইতে লাগিল। মফি বুঝিতে পারিল না, কে তাহাকে এই বুদ্ধি জোগাইয়াছে। কিন্তু, এটা বেশ বুঝা যাইতেছে : এই পড়ায় খােকাকে আর ধরিয়া রাখা যাইবে না। সে প্রথম পাঠ শেষ করিয়াছে। এবার হয় তাহার হাতে দ্বিতীয় পাঠ তুলিয়া দিতে হইবে, নতুবা তাহাকে স্কুল হইতে বিদায় দিতে হইবে। | বিদায়? বিদায়ের কথা সে ভাবিতে পারে না। তাহা হইলে সংসারে তাহার অবলম্বন থাকিবে কি? আর খােকার প্রতিও কি ইহা সুবিচার হইবে? সে মন দিয়া লেখাপড়া করিতেছে, স্কুলে প্রথম হইয়া পুরস্কার পাইয়াছে, ইহারই মধ্যে এ গাঁয়ের লােক তাহাকে লইয়া গৌরববোেধ করে। আর সে জানে, যে পাঁকে শিকড় গাড়িয়া এ পদ্ম দল মেলিতেছে, সে পাক সে নিজে। উহাকে উপড়াইয়া নিজে অত নিষ্ঠুরও সে হইতে পারিবে না, অত ভীতুও সে নয়।
আর খােকার চোখ? ইদানীং খােকার চোখ যেন তাহার গায়ে বড় বিধে। বসন ভেদ করিয়াও তাহা যেন দেখিতে পায়। খােকাকে পাঠ বলিতে বলিতে কতদিন সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে, জাগিয়া দেখিয়াছে— হয় খােকা চলিয়া গিয়াছে, নতুবা তাহারি পাশে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে পুঁথি বুকে করিয়া। আর এখন? একদিন জাগিয়া দেখে—খােকা বসিয়া আছে তাহারি মুখে অবাক বিস্ময়ে চাহিয়া রহিয়া। যেন এই নতুন দেখিল সেই মুখ। যেই বুঝিতে পারিল, মফি জাগিয়াছে, অমনি খােকা শুইয়া পড়িল ঘুমের ভান করিয়া। ঢংই শুধু পুরুষালী নহে, একটা আস্ত হলাে হইয়া উঠিল এই খােকাটা—ধূর্তেরও একশেষ। | সেই হইতে খােকার পাশে শুইয়া তাহার ঘুম আসে না। তবুও শুইতে হয়। নতুবা সে আর করিবে কি? আর খােকার চোখের বিস্মিত দৃষ্টি—সেও একটা দেখিবার জিনিষ। এই দৃষ্টি দেখিবার জন্য সে কী না করিয়াছে? আজগুবী গল্প, অপূর্ব খাবার, আশ্চৰ্য্য পুতুল, অদ্ভুত খেলনা, আর কত-না লুকোচুরি, কিছুই বাকী রাখে নাই। আর খােকা যদি। তাহার দেহকেই সেরা বিস্ময়ের বস্তু মনে করে, তাহাতেই বা কি? সে। যে কোনাে মুহূর্তেই ইহার ইতি করিয়া দিতে পারে। চোখ খুলিলেই। হইল। খােকা তখন পাথর বনিয়া যাইবে।
ক্রমে মফির দেহই হইল খােকার দ্বিতীয় পাঠ। কিন্তু, সেই লুকোচুরির মধ্য দিয়া। পুঁথি লইয়া শুরু হয়। শীঘ্রই মফি ঘুমাইয়া পড়ে, অর্থাৎ চোখ বুজে। তখন খােকা পুঁথি বন্ধ করিয়া উন্মুখ হইয়া বসে। প্রথম প্রথম অতি সন্তর্পণে সে মফির নাকের ডগায় হাত দিয়া দেখিত, ঘুমের। শ্বাস বহিতেছে কিনা। কিন্তু, শীঘ্রই বুঝিতে পারিল এটা ঘুমের ভান মাত্র। বিস্ময় তাহার একার চোখে নহে, প্রতিপক্ষের চোখেও কৌতুহলের অন্ত নাই। কিন্তু, মফিকে সে যেমন ভয় করে, ভক্তিও করে তার চেয়ে বেশী। আসলে এ সংসারে মফি ভিন্ন তাহার আর কেহ নাই। মা আছেন বটে; কিন্তু তিনি তাহার মনের খবর কিছুই রাখেন। না। আর, মফি—না বলিতেই সব বুঝিতে পারে, অভাব হওয়ার পূর্বেই তাহার মােচনের ব্যবস্থা করিয়া রাখে।
মফির দেহ খােকার কাছে পরম বিস্ময়ের বস্তু—যেমন বাপ সকালে যে মহাগ্রন্থ পাঠ করিয়া সম্মানের সহিত তুলিয়া রাখেন সেটা শিশুর কাছে পরম বিস্ময়ের বস্তু। শিশু যেমন চুরি করিয়া একবার উহা খুলিয়া দেখিতে চায়, খােকাও তেমন মফির দেহকে উহার খােলস হইতে খুলিয়া উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিয়া লইতে চায়। | মফির অনাবৃত দেহ। খােকা তন্ন তন্ন করিয়া দেখে। মফি পড়িয়া থাকে একদিকে তাহার চেতনা এবং দেহের খােলসকে লইয়া। খােকা অবাক্ বিস্ময়ে দেখে—খােলসমুক্ত দেহের প্রতিটি স্তর, প্রতিটি সন্ধি, প্রতিটি রেখা, প্রতিটি ইঙ্গিত—অসীম অসীম সে সমুদ্র। খােকা দেখে। পাগলের মতাে—কোথাও হাত লাগাইয়া—যেন নিজের দুই মুঠা ভরিয়া সমুদ্রকে তুলিয়া লইতে চায়, আর কানের পথে নিজ বুকে ভরিয়া লইতে চায় তাহার গর্জন। কূলমুক্ত সমুদ্রের ন্যায় দেহ খুলিয়া গলিয়া পড়িতে চায় আপন ভারে। খােকা বিভিন্ন যােজনায় ন্যস্ত করিয়া উহাকে বাঁধে, খােলে আবার বাঁধে। আর কোনদিন দূরে বসিয়া শুধু দেখে আর দেখে ।
নিত্য বাঁধন-ছাড়া পাইয়া মফির দেহ গেল খুলিয়া। খােলস যেন পড়িল ছােট হইয়া। কেয়ার ফুলের ন্যায় তাহা গেল ফটিয়া, আর উহার ভিতর হইতে যেন বাহির হইয়া আসিল নূতন মফি—সুবাসিত, কোমল ও লাজুক। হউক শিশু মক্ষিকা। কেয়ার ফুলকে ফুটাইল সে।
মফির দেহ হইল খােকার চোখে রূপায়িত মনের ক্যানভাস। “চন্দনের মাঝে মৃগ-পদ-চিহ্ন” উপমার তাৎপর্য সে বুঝিতে পারিল। তাহার বুক গেল ভরিয়া, চোখ উঠিল দীপ্ত হইয়া। তখন একদিন পরীক্ষার শেষে সে মফির পদ-তালুতে করিল চুম্বন—ভক্তিতে ও কৃতজ্ঞতায়। যেমন করিয়া ভক্ত পড়ার শেষে প্রতিদিন তুলিয়া রাখার পূর্বে মহাগ্রন্থকে ঠেকায় মস্তকে ও কপালে।
বদের ব্যাপার সঙ্গীন হইয়া উঠিয়াছিল আকিয়াবে। ব্যবসা ছিল বশুর নখদর্পণে। কিন্তু, ব্যবসা যখন গড়াইয়া গিয়া পড়িল কোর্টে, তখন আইন-ব্যবসায়ী হইল তাহার অছি। এবার সুযােগ হইল রহমানের। ব্যবসার উপর রিসিভার বসাইয়া সে করিল বশুর শক্তি হরণ । পরে গুণ্ডা লাগাইয়া দিয়া সুযােগ-মতাে লাঠি-পেটা করিয়া তাহাকে পাঠাইল হাসপাতালে। হাসপাতাল ব্যবসায় করে জীবনমরণের। তাহারা রদ্দি মাল বলিয়া তাহাকে পাঠাইয়া দিল দেহাতীদের হাসপাতালে।
বশুর মৃত্যু-সংবাদ দেশে পৌঁছিতেই দেশ ‘হায় হায় করিয়া উঠিল। তাহার মা আহার-দ্রিা ছাড়িয়া লইল বিছানা, আর সেই বিছানায় শুকাইয়া মরিল–মফিজনের সেবা-যত্ন অনুরােধ-উপরােধকে অগ্রাহ্য করিয়া। সুতরাং—মফিজনের স্বামীর বাড়ির পাট উঠিয়া গেল। পণ্ডিত তাহাকে নিজ বাড়িতে লইয়া গেলেন এবং নিজের মনে প্রতিজ্ঞা করিলেন : “এবার আর ভুল করবাে না। ইদ্দৎ গেলেই এমন জামাই দেখে বিয়ে দেবাে—ছেলে পুলে হয়, ঘর-সংসার করে, আর দশজনের মতাে সুখী হতে পারে।” | এ ঘূর্ণীতে মফিজন চিন্তিত হইল—নিজের জন্য নহে, খােকার জন্য। খােকা স্কুলের শেষ পরীক্ষায় বিভাগীয় বৃত্তি পাইয়াছে, সে খবর পৌঁছাইয়াছিল। এখন বাপের বাড়িতে ‘নাল’ হইয়া বসিয়া সে খােকাকে ডাকিয়া পাঠাইল। খােকা আসিলে তাহাকে দেখিয়া মফিজন অবাক্ হইয়া গেল। কপাল স্বচ্ছ হইয়া যেন চকচক করিতেছে, মুখ ভরিয়াছে গোঁফ-দাড়ির রেখার কাজলে, আর ঊরুসন্ধি হইতে যেন ছিটকিয়া পড়িতেছে শক্তির কণিকা। পুরুষালী ঢং নহে, এবার রীতিমত পুরুষ।
তারপর মনে পড়িল—এই পুরুষটিকে খােলস ফাটিয়া বাহির হইয়া আসিতে সেও সাহায্য করিয়াছে নিজের খােলস-মুক্ত দেহের আকর্ষণ দিয়া। জিজ্ঞাসা করিল : “কি করছ এখন? টাকা-পয়সার টানাটানি নাই ত?” | খােকা বগল দাবিয়া আনিয়াছিল একখানি কবিতার খাতা, আর একখানা ছাপা মাসিক—উহাতে তাহার প্রথম কবিতা ছাপা হইয়াছে। দুইখানিই তাহার হাতে ছিল। মফি দেখিল উল্টাইয়া পাল্টাইয়া, কবিতাটি দেখিল পড়িয়া। | মফি ভাবিয়া দেখিল, খােকার সহিত তাহার আর দেখা না-ও হইতে পারে। কারণ, ওষ্ঠের দাগ এই দ্বিতীয় বার তাহাকে রগড়াইয়া তুলিতে হইয়াছে। খােকাকে একটু সাবধান করা হইবে ভালাে। সংসার শুধু কবিতা লেখার স্থান নহে। কিন্তু, ইহার পূর্বেই খােকা করিল প্রশ্ন : “আপনি এবার কি করবেন?” | মফি তাহার দিকে চাহিল—মহীয়সী রাণীর ন্যায়—তাহার ‘আপনি’ এমনি মহিমায় মণ্ডিত করিয়া দিল মফিকে।
“আমি? মনে হয়, বাবা আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবেন।”
শানু সম্ভাবনাটা ভাবিয়া দেখিল। পরে হঠাৎ বলিয়া উঠিল : “আমি নিজের জন্য ভাবি না। আমি অনেক অনেক কবিতা লেখব। সবই লেব আপনাকে মনে করে। আর যেদিন আমার কিছুর অভাব হয়, ঠিক আপনার কাছে গিয়ে হাজির হ’ব।”
“আর তােমাকে যদি আমার কাছে যেতে না দেয়, অথবা আমি যদি মরে যাই?”
শানুর মুখ পাংশু হইয়া গেল। মফি হাসিয়া বলিল : “তখন আমার মতাে আর একটি মেয়ের সন্ধান করে নিও। তাকে পাবে তুমি আমার বােনঝির মধ্যে—কার্তিকপুরের মামুদ সাহেবের মেয়ে। দেখতে ঠিক আমার মতাে। তুমি তােমার মনের মতাে করে গড়ে নিও—যেমন আমি তােমাকে গড়ে গেলাম আমার নিজের মনের মতাে করে।”
ইহার চারি মাসের মধ্যে মফির বিবাহ হইয়া গেল নাছিরপুরের গদীনশিন পীর সৈয়দ বােরহানুদ্দীনের সঙ্গে। লােকে এক কালে বলিত, ইহারা নাকি খাটি সৈয়দ নহেন। কিন্তু, এখন ইহাদের দ্বারে বান্ধা হাতী” অবস্থা। উহার চাপে সব বলাবলি স্তব্ধ হইল—প্রতিক্রিয়ায় অতিভক্তি ছেদা’ পর্যন্ত পৌছিয়াছে।। | পণ্ডিত সম্বন্ধ করিলেন হাতী দেখিয়াও নহে, ছেজদার জন্যও নহে! পীর সাহেব দেখিতে সুপুরুষ বলিয়া, আর, পীর সাহেব ‘গদী’ ছাড়িয়া কোথাও যাইবেন না। আর পীর সাহেব পয়গাম পাঠাইয়াছিলেন— প্রথমা স্ত্রী সম্প্রতি এন্তেকাল করিয়াছেন কয়েকটি ছেলেমেয়ে রাখিয়া, সুতরাং একটি বয়স্থা নিঃসন্তান অথচ লায়েক মেয়ের প্রয়ােজন বলিয়া।
পাল্কী যখন পীর-বাড়িতে প্রবেশ করিল—উহার দরজা হইতে অন্দর পর্যন্ত মফির যেন দম বন্ধ হইয়া আসিল। কোথাও একটু ফাঁকা নাই। বহু জিনিষ পড়িয়া আছে ইতস্ততঃ—উহাদের কোন ব্যবহার নাই। আর শিষ্য-শিষ্যা, অনুশিষ্য-অনুশিষ্যা, চাকর-চাকরানী, বাকর-বাকরানী, বহু। লােকের ঠাসাঠাসি। অথচ সকলেই যেন পােষ্টাফিসের চিঠি—কাহাকেও খােলস হইতে খুলিয়া পড়িয়া দেখা হয় নাই।
যাহা হউক, তাহার নিজের কামরাটি বেশ নিরালা—যদিও কিছু অতিরিক্ত সজ্জিত। এই বাহুল্য এই বাড়ির সব কিছুতেই—কথা-বার্তা, খাওয়া-দাওয়া, সাজ-সজ্জা সব কিছুতেই। খােলস ছাড়িয়া বাহিরে আসার যেন বিধি নাই—পীর সাহেবের চোগা-চাকান ও পাগড়ি ছাড়িয়া খােলা গায়ে, ভাতের বর্তন ও পানির গেলাস তাহাদের ঢাকনা ছাড়িয়া খােলা মুখে, শােয়ার বিছানা উহার মশারী ছাড়িয়া খােলা দেহে, আর ছােট্ট ‘হাঁ’ বা ‘না’ একটা ‘জি’র আড়ম্বর ছাড়িয়া ছােট্ট ‘হা’ বা ‘না’ রূপে।
কিন্তু তাহার এই ভুল ভাঙ্গিল রাত্রে। আর ভাঙ্গিল অত্যন্ত রূঢ় ভাবেই। রাত্রে আসিলেন পীর সাহেব। আসিবেন সে ধরিয়া রাখিয়াছিল। আসিবেন তাহারই কামরায়, আর আসিয়া প্রথমে জমাইবেন আলাপ। এই জন্য সে ঝাড়িয়া মুছিয়া আস্তরণ লাগাইয়া রাখিয়াছিল একখানা চেয়ার। আর, মনে মনে কল্পনা করিয়াছিল : নিজে বসিবে নিজের বিছানায়। নিজের জীবনে সে নূতন অধ্যায়ের সূচনা করিতে যাইতেছে এবং সে জন্য নিজেকে ভালভাবেই প্রস্তুত করিয়াছে সে। নিজের উপবাসী দেহকেও সে গােছল করাইয়া নূতন বাস পরাইয়া সুবাস মাখাইয়া কানে কানে তাহাকে বলিয়া রাখিয়াছে ‘রাজভােজে’র কথা।
কিন্তু পীর সাহেব আসিলেন সােজা তাহার বিছানায়। বাতি জ্বলিতেছিল। বাতির পানে চাহিয়া তিনি আদেশ করিলেন : “বিবি সাহেবা, পায়ে ধরিয়া ছালাম করুন।” মফি শুনিল-স্থির হইয়া । তাহার সদ্যস্নাত ত্বক নূতন বাস ও লেপিত সুবাসের তলায় থাকিয়া ‘রি রি’ করিয়া উঠিল। একটুখানি অপেক্ষা করিয়া পীর সাহেব নিভাইয়া দিলেন। বাতি। অতঃপর কাপড় উন্মােচনের খস খস শব্দ হইতে লাগিল। দৈত্যের মতাে দুইখানি হাত আগাইয়া আসিয়া তাহাকে ধরিয়া শােয়াইয়া ফেলিল, সবলে তাহার বসন খসাইয়া ফেলিল, তাহাকে অনুভব করিল—যেমন করিয়া বাঘ করে নখর দিয়া তাহার শিকারকে, এবং প্রচণ্ড উল্লাসে তাহাকে করিয়া ফেলিল খণ্ড খণ্ড।
ইহার পরও মফি রহিল স্থির, অবিকম্প, জাগ্রত। চোখে অঙ্গুলি ফুটানর ন্যায় তাহার যন্ত্রণা হইয়াছে প্রতি অঙ্গে। কিন্তু, নিজের যন্ত্রণার কথা সে ভাবিতেছিল না। ভাবিতেছিল : কেন মানুষ এমন হইবে? মফি বরাবরই সাহসী ও সহিষ্ণু। মৃত্যুর চর্বণের মধ্যে পড়িয়াও গুণিয়া গুণিয়া তাহার দাঁত দেখিবে এমন মেয়ে। আর যদি মৃত্যুর জন্যও তাহার সাধ্য থাকে কিছু করিবার—তাহাকে কম ভয়ঙ্কর করিবার—সে তাহাই করিয়া যাইবে। সেই শ্রেণীর লােক, যারা প্রতিষেধক পরীক্ষা করিবার জন্য নিজের অঙ্গে ব্যাধি-বীজ পরখ করিয়া লইতে দেয়—বিজ্ঞানের বলি।
মনের এই গঠন তাহাকে দিত দৃষ্টির স্বচ্ছতা। সেই দৃষ্টি চালাইয়া সে দেখিতে পাইল পীর-বাড়ির জীবন। যতক্ষণ থাকে আলাে—এই গীর খােলস পরিয়া বসিয়া থাকেন নিজের হুজরায়। তাঁহাকে কেন্দ্র করিয়া চলে পীর-বাড়ির খােলসের জীবন। ইহার নড়চড় অসম্ভব। এই জন্যই পীর সাহেবের দিনে অন্দরে আসার নিয়ম নাই। আর এমন নিখুঁতভাবে এই পীর করেন কেন্দ্রের কাজ—বাতির আলােতেও তিনি। পারেন না খুলিতে তাঁহার খােলস—এমনকি স্ত্রীর সম্মুখেও। স্ত্রীর কাছেও তিনি পীর ছাড়া আর কিছুই হইতে পারেন না। এই জন্যই প্রয়ােজন বাতি নিভাইয়া ফেলিবার। বাঘ ও ব্রাহ্মণের গল্প। শুধু ব্রাহ্মণকে পাঁকে ফেলিবার পূর্বে আমদানী করিতে হইবে আঁধার। কারণ, এইখানে যাহা ঘটে তাহা গল্প নহে—তাহা বাস্তব। এখানে একটি মাত্র দিন নহে। রাতের পর দিন—অনেকগুলি দিন। নসীপুরের পীর সাহেবের কথা শুনিয়াছিল—শেষকালে ডাকাতি মােকদ্দমায় পড়িয়া জেল হইয়াছে। এইবার বুঝিল তাহা কিরূপে সম্ভব। তবুও ভালাে—এই পীর পরের বাড়িতে ডাকাতি করেন না—করেন নিজ ঘরেই রাহাজানি।
দ্বিতীয় রাত্রিতে পীর সাহেব বলিবার পূর্বেই মফি করিল পায়ে ধরিয়া সালাম। পীর খুশী হইলেন। এবার মফি বলিল : “বাতিটা থাকুক। আমার চিরদিনের অভ্যাস–আলাে ছাড়া ঘুমােতে পারি না।”
ইহাই আসল উদ্দেশ্য। ইহা সত্যও। আর এই ভরসাও ছিল, একবার যদি চোখে দেখিয়া বুঝিতে পারে : কাদা রুধিরে আপুত করিয়া যে শিকারকে করা হইতেছে অর্ধ ভক্ষণ উহার প্রতিটি কণিকা দেবতার ভােগ, তাহা হইলে এই বৃদ্ধ ব্যাঘ্রেরও প্রকৃতির পরিবর্তন হইতে পারে। কিন্তু বৃথাই।
পীর সাহেব বলিলেন : “আপনার ও-অভ্যাস ছাড়তে হবে। আঁধার আল্লার হুকুমেই হয়েছে—জেকের আকারের সুবিধার জন্য।”
জেকের-আজকের বটে! আর এই ‘আপনি! কত মামুলী! শাহনওয়াজের শেষ কালের ‘আপনি মনে পড়িল। পাক হইতে উঠিয়া শেষকালে পদ্মে পরিণত হইয়াছে।
ভাের হওয়ার পূর্বে পীর সাহেব সটকিয়া পড়েন। মফি জাগিয়াই ছিল। বলিল : “আমাকে লইয়া চলুন না কোথাও। নানা দেশ দেখিয়ে ঘুরিয়ে আনবেন।” এই বুদ্ধিই তাহার মনে আসিয়াছে। নিজের জন্যও বটে। আর, ভাবিয়াছিল : এই উপায়েও যদি এ লােকটার জীবনে। কিঞ্চিৎ আলাে-বাতাস আমদানী করা যায়। কিন্তু, বৃথাই। পীর সাহেব মাথা নাড়িয়া বলিলেন : “এস্তাগফারুল্লাহ্, হুজরা ছেড়ে কোথাও যাবার। এজেন নাই।” | কিন্তু, মফি লক্ষ্য করিল : শিকারী যতই নিষ্ঠুর হউক, তহার দেহ শুরু করিয়াছে উহার আক্রমণে স্পন্দন করিতে। সে স্পন্দন শুধু মৃত্যুশিহরণ নয়, যেন কোনাে অব্যক্ত নূতন জীবনেরও আকুতি। কানে কানে মন্ত্র দিয়া শুধু খঙ্গাঘাতে হত্যা নয়—তৎপর কোনাে বিশুষ্ক রসনায় রসের সঞ্চারও। শাহনওয়াজ রচনা করিয়াছিল এই দেহ দিয়া লতাবিতান। কিন্তু, কোথায় ছিল চৈতালী হাওয়া? আজ কাল-বৈশাখীতে লণ্ড ভণ্ড হইয়া ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে সেই লতাবিতান। তবুও উহার বিশীর্ণ শাখায় ঠেলাঠেলি করিয়া মুঞ্জরিত হইতে চাহে অগণন ফুল। সুতরাং মফি সরিয়া পড়িল একদিকে তাহার মননকে লইয়া—মালী চলিল তাহার যন্ত্রপাতি লইয়া—এই ঝড়াে হাওয়া বিশুদ্ধ বাগানে যাহা করিবে করুক। তবুও মফির গর্ভ হইল। মাস হিসাব করিয়া পণ্ডিত তাহাকে আনিলেন নিজ-বাড়ি। সেখানে মফির হইল এক ছেলে।
মফি বসিয়াছিল ছেলে কোলে করিয়া। শাহ্ওয়াজ আসিয়াছিল দেখা করিতে। শাহনওয়াজের মনে হইল যেন পাত্রটি শুধু চেনা, কোথায় ছিদ্র হইয়া উহার সব রস চুয়াইয়া পড়িয়া গিয়াছে। বাঁ-চোখ ক্লান্তিতে ভরা। এই বাঁ-চোখে তাহার থাকিত স্নেহ-রস। দেখিলে মনে হইত চোখটি সব সময় ঘুমাইয়া আছে, আর ইহার দৃষ্টি যেন দিত অভয়। কিন্তু ডানচোখ তেমনই আছে—চির-জাগ্রত, সত্যের আগুন জ্বলিতেছে উহার আড়ালে—নিমেষেই দীপ্ত হইয়া উঠিবে। মনে পড়িল—একদিন মফির বাঁ পায়ের তালুতে সে চুম্বন করিয়াছিল। ইচ্ছা ছিল দুই তালুতেই চুম্বন করিবে। কিন্তু, ডান তালুতে চুম্বন করিতে সে সাহস করে নাই—এই চির-জাগ্রত প্রহরীর ভয়ে। কিন্তু, গােটা মফি যেন তাহা হইতে অনেক দূরে সরিয়া গিয়াছে। উভয়ে একই পৃথিবীর বুকে আছে, এই যথেষ্ট। নতুবা, এই ছেলেটি যেন কাটিয়া দিয়াছে তাহাদের যােগসূত্র।
মফি হঠাৎ চোখ তুলিল তাহার পানে। একদণ্ড স্থির থাকিয়া বলিল, “তােমাকে দেখার জন্য একটা লােক চাই। নাম হয়েছে, বই বেচে পয়সাও আছে। তবুও বাপু, আমরা সংসারী মানুষ, ছেলে পুলেকে সংসার ধরিয়ে দিতে না পারলে মনে সােয়াস্তি পাই না। মামুদ সাহেবের মেয়েটি সম্বন্ধে তােমার কি মত?”
শাহ্ওয়াজ বুঝিতে পারিল। এটা হইল খােলস। ভিতরের কথা হইল, “আমাকে দিয়ে তােমার চলবে না। এবার আমার জুনিয়ার অবয়বটিকে গ্রহণ কর।” তবুও মনে পড়িল, সে তাহার সব কিছু পাইয়াছে ঐ ছেলে-কোলে-করা মামুলী-মা রমণীটি হইতে। আজ উহার দেওয়ার মতাে কিছুই নাই বলিয়া সে অকৃতজ্ঞ হইবে না। ধীরে ধীরে বলিল : “আপনার যা মত, মাসী-মা।”
বাহিরে পণ্ডিতের হাসি-মুখর আওয়াজ পাওয়া গেল : “ভাই এসেছে, একটি টুকটুকে ভাই।” কাহাকে বলিতেছেন—“এবার আর ভুল করিনি।”
সমাপ্ত
‘মফিজন’ গল্পটি আমার খুব ভালাে লেগেছে। জীবনের নগ্ন বলিষ্ঠতা ও তার প্রকাশ আমার কাছে ভালাে লাগে; সেই জন্যে সাহিত্যে ধরা-বাঁধা রীতি-নীতি আমার কাছে শুধু নগণ্য নয়, তুচ্ছও। সাহিত্যের কেতাবী আলােচনায় গল্পে realism বা বাস্তবতার কথা আলােচিত হয় দেখেছি; কিন্তু সত্যিকার বাস্তব জীবনের গল্প পড়বার সুযোেগ কদাচিৎ ঘটে।
মফিজন সত্যিকার বাস্তব জীবনের গল্প। গল্পের নামে যে সব সস্তা মানসিক বিলাস আজকাল মাসিকের পৃষ্ঠায় দেখা যায়, আপনার গল্প তার সগােত্র নয়। আপনার ‘মােমেনের জবানবন্দী’র বলিষ্ঠতা ও স্বচ্ছতা। এই গল্পেও জীবন-রসে পুষ্ট হ’য়ে ফুটেছে।
সাহিত্যে অশ্লীলতার কথা এক সময় খুব শােনা যেত। কিন্তু জীবনের অভিব্যক্তি যদি ঘটে, সেই রচনা অশ্লীল কেন বিবেচিত হবে? জীবন কি অশ্লীল? রক্ত-মাংসের কল-কল্লোলের সঙ্গে যে রয়েছে জীবন ও জীবন-বিকাশের নিবিড় যােগ, তা কে অস্বীকার করতে পারে? D. H. Lawrence-এর একটি উক্তি এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়
“My great religion is a belief in the blood, the flesh, as being wiser than the intellect. We can go wrong in our minds. But what the blood feels, and believes, and syas, is always true.”
আপনার গল্পের দুই বালক বালিকা মফি ও মামুদ—“চোখে চোখ রাখিয়া উভয়ে বুঝিতে পারিল : এই অবস্থা অসহ্য। ইহার সমাপ্তির জন্য কিছু একটা ঘটা চাই। তখন মফি করিল চোখ নত, আর মামুদ। আগাইয়া গিয়া তার কপালে করিল চুম্বন। এবার হাসি-চোখে মফি করিল মামুদের ওষ্ঠে চুম্বন।”
ইহাকেই বলে wiser than the intellect-এর তাগিদ। এই wiser than the intellect-এর অভাবের জন্য হাতের কাছে অপূর্ব সম্পদ পেয়েও পীর বােরহানুদ্দীন হ’য়েছে বঞ্চিত। আর না পেয়েও খােকার জীবন হ’য়েছে বিকশিত, পুশ্চিত। পুশ্চ-কলির মতাে জীবনকুসুমের বিকাশ ও তার পাপড়ি কি ক’রে একটির পর একটি দল মেলে তারি রহস্যোঘাটন ঘটেছে অপূর্ব কৌশল ও নৈপুণ্যের সঙ্গে এই গল্পে। তার সঙ্গে মিশেছে আপনার সতেজ ও সজাগ চিত্তের জীবন-জিজ্ঞাসা ও পরিণত রস-চিত্তের সমন্বয়।
‘মফিজন’ জীবন-রসে এমন টলটলায়মান যে, জীবন যারা বােঝে, আমার ত বিশ্বাস, সে সব পাঠকের কাছে এই গল্প রীতিমত আকর্ষণ রূপে বিবেচিত হবে। তদুপরি, সব কয়টি চরিত্র হয়েছে সজীব, জীবন্ত ও বিশিষ্ট। ভাষায়, ভাবে ও চরিত্র-চিত্রণে যেখানে রূপ পরিগ্রহ করেছে। অকৃত্রিম মানবীয়তার নির্ভেজাল চেহারা, তার আকর্ষণ আমার কাছে সত্যই অপ্রতিরােধ্য। এমন আরাে গল্প যদি লিখতে পারেন, সেই হ’বে নতুন দিগ্বিজয়।
—আবুল ফজল
“ “মফিজন পড়ে তৃপ্ত হয়েছি। লেখাটি আকারে ছােট হলেও একখানি নিপুণ রেখাচিত্রের মতাে অল্পে সম্পূর্ণ। কোথাও অতিভাষণের চেষ্টা নেই, অপভাষণও নেই। সত্য তার অনাবৃত রূপ নিয়ে নিজের সৌন্দর্য্যের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে। কেবল নায়িকা নয়, পীর। সাহেব, পণ্ডিত সাহেবকেও স্পষ্ট চেনা যায়। এবং বেশ লাগে।
কারিগরি বা craftsmanship-এর দিক থেকে রচনাটি মহামূল্য। রসের দিক থেকে অত ঊর্ধ্বে যাবে না, কারণ আপনার দৃষ্টি যতটা তীক্ষ ততটা স্নিগ্ধ নয়। রসলােকে আপনি আরাে অগ্রসর হবেন এই প্রার্থনা ও এই আশা নিয়ে আমরা আপনাকে লক্ষ্য করব।”
—অন্নদাশঙ্কর রায়
৩.১.৪৯