ভেজা ভাস্কর্য – কঙ্কাবতী দত্ত

›› সম্পুর্ণ গল্প  

‘দু-দুটো ছাতা নিয়ে চললি কোথায় ?’
‘কলেজে বন্ধুদের মধ্যে কেউ না কেউ আমার পাশে পাশে হাঁটতে থাকে গল্প করতে করতে। তখন তাকেও নিজের ছাতার তলায় নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না যে! লেডিজ ফোল্ডিং ছাতাগুলো দুজনকে বৃষ্টির ছাঁট থেকে রেহাই দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয়। বর্ষার আচমকা ডট কম বৃষ্টিতে দুজনকেই আধাআধি ভিজে পথ চলতে হয়।’
“তাবলে দুখানা ছাতা বইবি?’
‘হ্যাঁ। নিজের ছাতাটা রুমনাদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য দুটো ছাতা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।’
‘বোকা কোথাকার! রুমনা তো ইচ্ছে করে ছাতা আনে না।’
‘সত্যি, কেন যে আনে না বুঝি না!’
‘না বোঝার কী আছে? সিক্তবসনা সুন্দরী হিসেবে নিজেকে প্রদর্শন করবে বলে…’ ‘মানে…’
“হিন্দি সিনেমায় নায়িকাকে বৃষ্টি ভিজতে দেখিসনি বুঝি গাছের তলায় ? সিক্তবসনা সুন্দরীর আবেদনই আলাদা ।
‘আগেকার দিনের মন্দাকিনী হোক বা স্মিতা পাতিলের মতো নায়িকারা দেখবি নেচে নেচে বৃষ্টিতে গান গাইছে। অনেক ছবিতেই এ দৃশ্য থাকে। কেন বলতো?’
‘কেন শুনি?’
‘মেয়েরা ভিজে গেলে তাদের শরীর নামক ভাস্কর্যে জামাকাপড় লেপটে আশ্চর্য কারুকাজ ফুটে ওঠে। এ দৃশ্যের আবেদন আছে। শুধু আধুনিক কালেই নয়, যুগ যুগ ধরে। এমনকী রথের মেলায় যে সব মাটির পুতুল বিক্রি হয়, সেগুলোর মধ্যেও
সিক্তবসনা সুন্দরীর ছায়া চোখে পড়ে। ভেজা কাপড়ে কলসি কাঁখে রাধার পথ চলার ইমেজে ছোট্টো পুতুল কত্তো যে দেখেছি। দারুণ প্রতিভাবান শিল্পীরা গ্রামে গ্রামে অলক্ষ্যে অন্তরালে এসব গড়েছেন। তাঁদের নামও কেউ জানে না। রথের মেলাটেলায় এইসব হাতের কাজ দু-চার পয়সায় বিক্রি করে তাদের দিন চলে। যুগে যুগে শিল্পী, ভাস্কর, চিত্রকর নারীকে ঘিরে রূপ দিয়েছেন কত না ইমেজে, কত না কল্পনায়। কোনারক থেকে সিস্টিন চ্যাপেল, রবি বর্মা থেকে রাফায়েল, রঁদা, মিকেলাঞ্জেলো কতো দৃষ্টিকোণ থেকে নারীদেহের রহস্যে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছেন। সিক্তবসনা নারীর ছবি এঁকেছেন হেমেন মজুমদার। এই চিত্রকরের নিজের স্ত্রীই ছিলেন তাঁর শ্রেষ্ঠ মডেল। পশ্চিমী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের আবহাওয়ার বৈশিষ্ট্য হল, আমাদের বারোমাস্যায় ছটি ঋতুর উপস্থিতি। ইউরোপ আমেরিকা যেখানে চারটি মাত্র ঋতুচক্রে বাঁধা, আমরা ছয়টি ঋতুরাজ্যের বাসিন্দা। আমাদের ঋতু ছটি, ওদের চারটি। বর্ষা বলে আলাদা কোনো দুরন্ত ঋতুর সঙ্গে ওরা পরিচিতই নয়। বর্ষার রিমঝিম বৃষ্টি ঘিরে বাঙালির অনুভূতি ও কল্পনা নানাভাবে পরিস্ফুট হয়। সিক্তবসনা সুন্দরী তার অন্যতম।
‘পথের পাঁচালী’তে দুর্গার বৃষ্টিভেজার দৃশ্য কালজয়ী হয়ে গেঁথে আছে জনমানসে। কোনোরকম গ্ল্যামার ওই দৃশ্যে মিশে ছিল না, ছিল না কোনো ধরনের যৌন আবেদন বা অনুষঙ্গের ছিটেফোঁটা– তবু বাংলার মাটিতে বৃষ্টির গোটা আমেজটা যেন ধরা আছে সিক্ত বসনে দুর্গার বৃষ্টি ভেজার ওই ইমেজে। আলোকচিত্রী নিমাই ঘোষ বলেছিলেন, ‘সিক্তা রমণী আমার ফটোগ্রাফির অন্যতম প্রিয় বিষয় । অনেক সময় কৃত্রিম উপায়ে জল স্প্রে করেও বৃষ্টির এফেক্ট তৈরি করি। বৃষ্টিতে ভিজে গেলে মেয়েদের মেক আপ, প্রসাধন ইত্যাদি ধুয়ে মুছে যায়। শাড়ি-জামার পাট নষ্ট হয়ে যায়। তবু তার মধ্যে অন্য ধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আবিষ্কার করি।’