ভীষ্মের দীর্ঘশ্বাস – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

›› সম্পুর্ণ গল্প  

তৃষার্ত রাজা এসে থামলেন এক স্বচ্ছ সরােবরের সামনে। নিজের সৈন্যব্যহিনী থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। কী যেন মেহ ভর করেছিল তাঁর ওপর, তিনি মানুষের কথা ভুলে গিয়ে অরণ্যের শােভায় মুগ্ধ হয়ে ক্রমশ একাকী চলে এসেছেন গভীর থেকে গহনে।

রাজা ঘােড়া থেকে নেমে সেই জলাশয়ের ধারে বসে অজলা ভরে পান করতে যাবেন, এমন সময় কয়েকটি নারী কণ্ঠ একসঙ্গে বলে উঠল, হে রাজন! এই জল ছুঁয়ো না। এই জল পান করো না। তুমি অন্য সরােববে যাও!

রাজা মুখ তুলে দেখছিলেন তিনটি যুবতী সেই সরোবরে হংসের মতো ভাসছে। হলুদ রেশমের মতো তাদের মুখ, পদ্ম পলাশ চক্ষু, উড়ন্ত পাখির মতাে ওষ্ঠাধর।

রাজা কয়েক মুহূর্ত অপলক ভাবে চেয়ে রইলেন।

রানী বিলাসে তিনি কাটিয়েছেন বহু বছর, দেশ-বিদেশের বহু নারী তার অঙ্কশায়িনী হয়েছে, কিন্তু তার মনে হল! এই যুবতীত্রয়ী প্রত্যেকেই যেন তিলোত্তমা।

একটি মেয়ে একটু এগিয়ে এসে মধুর হেসে বলল, রাজা, আমরা নিরালায় এখানে কেলি করছি, এখানে অবস্থান করা তোমার উচিত নয়। এই জল তােমার পেয় নয়, তুমি শিঘ্র অন্যত্র যাও!

রাজা বললেন। অয়ি, বরবর্ণনী, তোমাদের দেখে আমার তৃষ্ণা শতগুণ বৃদ্ধি পেল। চোখের সামনে স্বাদু পানীয় দেখলে কি কোনো তৃষ্ণার্ত দূরে চলে যেতে পারে? কেন আমাকে নিবারণ করছ? কেন আমাকে চলে যেতে বলছ?

সেই মেয়েটি বলল, রাজা, সব ফুলের ঘ্রাণ নিতে নেই, সব পানীয় পান করা যায় না, সব ফল ভক্ষণ করা ঠিক নয়। এই সারোবর তােমার জন্য নয়, তুমি অন্য কোথাও যাও!

রাজ এবারে হেসে বললেন, তােমরা আমার পরিচয় জান না। আমি রাজা কোনো প্রকার নিষেধ শুনানিই আমাদের বাসনা বেশি বলবান হয়। যে কোনাে নিষিদ্ধ বস্তুই আমরা জয় সাধ্য মনে করি। আমি অচিরেই তৃষ্ণা মেটাব এবং তৃষ্ণা মেটাব।

তিন নারী আবার একত্রে কলকণ্ঠে বলে উঠল, রাজ অমত করাে না, এমন করে না। নিবৃত্ত হও!

রাজা শুনলেন না। তিনি গন্ডুস জল পান করলেন। তারপর তার বস্ত্র খুলে রেখে নেমে পড়লেন সরোবরে। রাজ সন্তরণ-পটু। জলাশয়টিও তেমন বড় নয়। তা ভাবলেন, মেয়ে তিনটি পালাবার চেষ্টা করলেও তিনি অদ্ভুত একজনকে বাহুবন্ধনে আনতে পারবেন ঠিকই। এরা অপ্সরা হলেও নিষ্কৃতি নেই।

যুবতী তিনটি কিন্তু দূরে সরে গেল না। বক্ষ জলে দাঁড়িয়ে হাসতে লাগল। রাজা কাছে আসতেই তারা বলে উঠল, নিয়তি, নিয়তি! রাজা এদের মুখপাত্রীটির হাত ধরলেন। তারপর বললেন, কবিতা এবং বনিতা স্বয়পসত্ত হলেও সুখদা নয়। হে সুন্দরী, আমি বলপ্রয়োগ করতে যাই না। আমি তোমার রূপ প্রার্থনা করি, তুমি আমার হও।

মেয়েটি তবু হাসতে লাগল! রাজা মেয়েটিকে বক্ষে জড়িয়ে ধরে মুখ চুম্বন করতে গেলেন। কিন্তু পারলেন না। তাঁর বিচিত্র এক অনুভূতি হল। তাঁর শরীরে বিদ্যুৎ নেই, শিহরণ নেই। এমন এক দুর্লভ রূপীকে তিনি স্পর্শ করেছেন, তার কামনা যথোচিত জাগ্রত হচ্ছে না কেন?

মেয়েটা বলল, নিয়তি, নিয়তি! রাজা জিজ্ঞেস করলেন, কী বলছ, তুমি? কার নিয়তি। মেয়েঃ বল, তােমার! হায় ভূতপূর্ব রাজা তুমি আর ইহজীবনে কোনাে রমণী-মন সুখ পাবে না।

নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ!

রাজা আপন শরীরের দিকে তাকিয়ে আমূল চমকে উঠলেন। তিনি আর রাজা নেই। তিনি এক নারীতে পরিণত হয়েছেন। আর তিনটি নারীরই মতাে।

সেই তিন রমণীর মধ্যে একজন বলল, তােমাকে এখন কী বলব, রাজা না রানি! শুধু রমণীই বলি। ওহে রমণী, আমরা দিব্যাঙ্গন। পৃথিবীর কােনাে পুরুষ আমাদের স্পর্শ করতে পারে না, এটা একটি মায়াসরোবর। সাধারণ মানুষ এটা দেখতেও পায় না।  তোমার নিয়তি তোমাকে এখানে টেনে এনেছে।

পর মুহূর্তেই এর অদৃশ্য হয়ে গেল। ছিনিয়ে গেল সেই মায়াসরসী । সবটাই যেন স্বপ্ন।

কিন্তু ভূতপূর্ব রাজার শরীরটা স্বপ্ন নয়। তিনি রমণী হয়েই রইলেন। কিন্তু নগ্ন বলে তার ব্রীড়া এল! তিনি প্রথমে স্তনদ্বয় ঢাকলেন হাত দিয়ে। তারপর এক হাত বুকে রেখে, অন্য হাতে চাপ দিলেন নিম্ননাভি, তার ভঙ্গিটি হল চিরকালীন প্রথাসিদ্ধ নিরাবরণ নারীর মতােই।

রাজার অশ্ব আর রাজাকে দেখতে না পেয়ে ফিরে গেল!

রাজা আস্তে আস্তে তার রাজ্য, তাঁর মহিষাবৃন্দ, তার সন্তানাদির কথা ভুলতে লাগলেন! অরণ্যের মধ্যে একাকী অবস্থায় তাঁর ভয় করতে লাগল।

অসহায় ভাবে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে কিছুক্ষণ পরে তিনি এক নবীন যুবার সাক্ষাৎ পেলেন। যুবকটি ঋষি-কুমার, অঙ্গে গেরুয়া, মাথায় জট-বাধাঁ চুল।

যুবকটি এই নবউদ্ভন্নযৌবনা রমণীকে দেখে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর যেন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে জিজ্ঞেস করল, হে অচেনা, তুমি কে?

রাজার তখনও স্মরণে আছে যে তিনি পুরুষ ছিলেন, কিন্তু তার শরীরটি নারীর। তিনি বললেন, আমি কেউ না।

যুবকটি বলল, তােমাকে দেখে আমার মনে তপোবন-বিরুদ্ধ এক অনুভূতি জাগছে। তুমি কি স্বপ্ন না মায়া ? মতিভ্রম না তাবৎ জীবনের গুণফল?

নারীরূপিনী রাজা আবার বললেন, আমি কেউ না

তখন সেই মুনিকুমার এগিয়ে এসে তার অঙ্গ স্পর্শ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে রাজার জীবনে যেন এক অলৌকিক ব্যাপার হল। জীবনে তিনি বহু নারীকে স্পর্শ করেছেন, কিন্তু আজ তার শরীরে এই পুরুষের স্পর্শে যে তরঙ্গ খেলে গেল, তেমনটি তাে আগে কখানো হয় নি। তার তীব্র ইচ্ছা হল এই যুবা তাকে বক্ষে টেনে নিক। কিন্তু মুখে তা প্রকাশ না করে একটু দূরে সরে গেলেন।

তরুণ ঋষি আবার কাছে এসে তার বক্ষে হাত রাখতে যেতেই তিনি মুখ ফিরিয়ে বললেন, না!

তখন সেই কামার্ত যুবা মাটিতে হাটু গেড়ে বসে পড়ে বললেন, হে রূপসী-শ্রেষ্ঠা, তােমার নয়ন কাছে অহত। তােমার অধর সুধায় আমায় সঞ্জীবিত করো! আমার যাগ-যজ্ঞ সব জলাঞ্জলি যাক। আমি তােমাকে পেয়ে ধন্য হতে চাই।

আরও কিছুক্ষণ স্তব স্ততি শোনার পর নারী-রাজা সম্মত হলেন।

তারপর তিনি পেলেন তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দ। রমনে এত সুখ তা তিনি জানতেন না। আগে মনে করতেন রতি সুখ মানে জয়ের আনন্দ। এতকাল তিনি ওপরে থাকবেন, আজ নিচে। পিঠের তলায় যে মাটি কাপে, ওপরে আকাশও যে কাপে তা বােধহয় কোন পুরুষই জানে না। চরম উল্লাসে তিনি আঃ আঃ শব্দ করতে লাগলেন।

মুনি-কুমার তার ক্রীড়া সাঙ্গ করা মাত্রই রাণী-রাজার ইচ্ছে হয়, আবার হােক, আবার হােক। এই যুবা তাকে পীড়ন করুক, দংশন করুক, তাকে স্বর্গ সুখ দিক।

সেই যুবা-ঋষিকেই বিয়ে করে রমণী-রাজা বনের মধ্যে পর্ণকুটিরে ঘর-সংসার করতে লাগলেন।

বেশ কয়েক বছর পর সেই রাজার প্রাক্তন রাজ্যের মন্ত্রী ও পাত্র মিত্রের দলবল সেখানে এসে উপস্থিত হয়ে ঋষিপত্নীর সামনে সসম্মানে অভিবাদন করলেন।

মন্ত্রী বলেন, হে আত্মবিস্মৃত রাজা ভঙ্গম্বন, আমরা অতিকষ্টে আপনাকে খুঁজে পেয়েছি। ইন্দ্রের সঙ্গে আপনি একবার কলহ করেছিলেন, সেইজন্য ইন্দ্র আপনার মনে মােহ এনে দিয়ে আপনাকে নারীতে পরিণত করেছেন। আমরা যগ-যজ্ঞে ইন্দ্রকে তুষ্ট করেছি। ইন্দ্র আবার আপনাকে পূর্ব অবস্থা ফিরিয়ে দিতে রাজি হয়েছেন।

ঋষিপত্নীর সব কথা মনে পড়ে গেল। তিনি ফিক করে হাসলেন। মন্ত্রী হাত জোড় করে বললেন, রথ প্রস্তুত, আপনি চলুন।

ঋষিপত্নী বললেন, পাগল নাকি। কোনো রমণী কখনো পুরুষ হতে চায়? হে মন্ত্রী, পৃথিবীর কোনাে পুরুষ এতকাল ধরে যে গুপ্তকথা জানতে পারে নি, আমি তা জেনেছি। পূরুষেরা তাে চতুর্দিকে দাপিয়ে বেড়ায় কিন্তু প্রতি মুহূর্তে নারীদের কাছে এসে পরাভূত হয়। শরীরের যে কী আনন্দ তা পুরুষরা সঠিক ভাবে কোনদিন টেরই পেল না। আমি যেমন আছি. চমৎকার আছি এই আনন্দের তুলনায় রাজ্য তুচ্ছ। আমার আগের ছেলেদের সিংহাসন দিন। আমার এই পক্ষের সন্তানদের প্রতি স্নেহ বেশি। তাদের ছেড়ে কোথাও যেতে পারব না।

বহুকাল পর। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষে, ভীষ্ম যখন শয্যায় শুয়ে দক্ষিণায়নের প্রতীক্ষা করছিলেন, তখন যুধিষ্টির তাঁর কাছ থেকে অনেক জ্ঞানের কথা জেনে নিতে নিতে একবার প্রশ্ন করেছিলেন, আচ্ছা, পিতামহ নারী ও পুরুষের মধ্যে যৌনসুখ কে বেশি পায়?

ভীষ্ম বললেন, তােমাকে আমি ভঙ্গস্বন রাজার উপাখ্যান শোনাচ্ছি। কাহিনীটি শুরু করার আগে ভীষ্ম প্রথমে মৃদু হাস্য করলেন। মনে মনে ভাবলেন, তার এই ধার্মিক  নাতিটি সত্যিই বড় গো-বেচারা। কান্ডজ্ঞান বলে কিছুই নেই। এই প্রশ্ন কি কেউ কোনো মৃত্যুপথযাত্রী জিতেন্দি পুরুষকে করে?

তারপরই ভীষ্মের একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস পড়ল! যেন এক বাযুময় হাহাকার। জিতেন্দ্রিয়? সাধারণ মানুষের চারগুন লম্বা একটা জীবন কাটিয়ে গেলেন, তবু নারীর রহস্য কিছুই জানলেন না। ব্যর্থ, ব্যর্থ, সব ব্যর্থ।

সুত্রঃ স্বনির্বাচিত একশো গল্প

One thought on “ভীষ্মের দীর্ঘশ্বাস – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

Leave a Reply