বিবর – সমরেশ বসু

›› উপন্যাসের অংশ বিশেষ  

১.

………ডবল ডেকার বাসের ভিড়ে বা চৌরঙ্গীর সিনেমার লরীতে, তুমি এক পলকে, একটি চোখে লাগা মেয়েকে, মনে মনে নগ্ন করে নিখুঁত করে দেখে নিতে পার, আর খাট বরাবর আয়নায়, তোমার কাছে, পাশে বা যে ভাবেই হোক, আর কেউ বলতে কি বোঝায় বা কী উদ্দেশ্য এবং কী ফন্দী ফিকির মনের ইচ্ছা হয়ে লুকিয়ে থাকে, তুমি তা জান না। ……..

…..আয়নার প্রতিবিম্বেই নীতার শাম্পু করা রুক্ষ চুলের গোছার দিকে তাকালাম। যে-চুলের গোছা, একটু আগেই আমি বিলি কেটে কেটে, ঘাড়ু থেকে তুলে, ওর মাথার ওপর দিয়ে লুটিয়ে দিয়েছি। নীতাও উপুড় হয়ে রয়ছে। আমিই উপুড় করে দিয়েছি। ঠিক যেখানে ছিল, সেখানেই ঔপুড় করে দিয়েছি। ও আমার বুক ঘেঁষে কোল ঘেঁষে ছিল, এখনো তাই আছে। মুখটা আমার থেকে উলটো দিকে ফেরানো। আয়নার দূরত্বটা এমন জায়গায়, ওর পাশ ফেরানো চোখ বোজা ফর্সা মুখখানি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওর সমস্ত দেহটাই দেখা যাচ্ছে। ওর মেদহীন সুগঠিত খোলা পিঠ, এত সুন্দর আর স্বাস্থ্যপূর্ণ, শিড়দাঁড়ার মাঝখানটা যেন দু পাশ থেকে ঢালু হয়ে নেয়ে এসে একটি তীক্ষ্ণ গভীর রেখায় আঁকা পড়েছে। নিটোল কোমল ফর্সা পিঠ জামা নেই। পিঠটা যেন ক্ৰমাগত ত্রিভুজের রেখায় কোমরের দিকে নেমে গেছে। তারপরে লাল নীল ছাপকা ছাপকা (রং-এর শাড়িটা রং-এর এটা কী ফ্যাশান, আমি জানি না।) আমিই কোমর থেকে ঢেকে দিয়েছি। দেওয়া উচিত, এরকম একটা চেতনার থেকে যে দিয়েছিলাম, তা আমি স্মরণ করতে পারছি না। হতে পারে, নিতান্ত চোখে দেখার অভ্যাসের দরুণই দিয়েছিলাম। শায়াটা তো লুটনোই রয়েছে খাটের এক পাশে, ব্লাউজ ব্রেসিয়ার যেখানে দলা পাকানো।

নীতা আমার বাঁ পাশে। ওর ডান হাতটা মাথার পাশ দিয়ে ওপর দিকে এলানো, বাঁ হাতটা ওর বুকের কাছ ঘেঁষে কনুই মুড়ে রয়েছে। বাঁ হাতটা ওরকম না থাকলে ওর চব্বিশ পুষ্ট যৌবন (যৌবন বলতে আমি ওর সুউচ্চ সুগঠিত বুকের কথাই বলছি, আর এরকম কথা মনে হলেই আমার সন্ধিক্ষণের বয়সে, বেলেঘাটার মাসতুতো দাদার কাছে শোনা সেই গানের কলিটা নির্ঘাৎ মনে পড়বে, ও মালিনী তোর বাগানে জোড়া ডালিমে… ইত্যাদি। …….

……ঘণ্টা দেড়কে আগেই, কিংবা ঘণ্টা দুয়েক হবে বোধ হয়, আমরা দুজনেই আয়নাটার ছায়ায় দুজনে দুজনকে দেখছিলাম, আর বলাবলি করছিলাম। দেখেছ?

যা অসভ্য!

নীতি সলজ্জ হেসে বলছিল, চোখ বুঝে থাকছিল, যাতে আয়নাটার দিকে কোনরকমে চােখ না পড়ো মনে হয়েছিল, লজ্জাটা আসলে কামনার উদ্বেল হয়ে কুঁকড়ে যাওয়ার একটা প্রবণতায় ও ওরকম করছিল। অথবা যথেষ্ট সম্প্রতিভ সাবলীল হওয়া সত্ত্বেও মেয়েদের ওসব ব্যাপারে একটু লজ্জা-টজ্জা বেশী থাকে, বা কে জানে, হয়তো অবলোকনের থেকে, অনুভবের নেশায় গভীরভাবে ডুবেতেই ওরা বেশী ভালবাসে। জানি না বাবা অত সব। মোটের ওপর নীতা সলজ্জভাবে আয়নাটার দিকে চোখ না দেবার চেষ্টা করছিল। চেষ্টা করছিল, কারণ, দেখছিলাম, ওর চোখ জোড়াকে যেন আয়নাটা সুখীর মত হাতছানি দিয়ে ডাকছিল, এই ৷ এই নীতা, দ্যাখ দ্যাখ। আর সেই ডাক শুনে ও চকিতে চকিতে এক একবার আয়নার দিকে তাকিয়ে ফেলছিল এবং হাত দুটোকে শরীরের নানান অংশে রাখতে চাইছিল। ও তো বেশ্যা নয় যে, একটা বিক্ষুব্ধ ঘৃণায়, প্রায় চেতনাহীন শরীরটাকে আলোকিত ঘরে হাট করে খুলে ফেলে রেখে দিয়েছে, যেখানে অবলোকন বা অনুভূতি, এসবের কোন মূল্য বা তাৎপর্যই নেই। ……..

………..নীতার খোলা পিঠের ওপর আমি নাকটা খুঁজে দিলাম। ঠাণ্ডা, আর একটা শক্ত মনে হচ্ছে। একটা হালকা মিষ্টি গন্ধই পাওয়া যাছে ওর গা থেকে। হয়তো বিকেলে, সেই দুধের মত শাদা, লিকুইড ক্রীম ও সারা গায়ে মেখেছিল। জানি না, আজ কে মাখিয়ে দিয়েছিল। আমাকে দু-একবার মাখতে দিয়েছে, পিঠেই অবিশ্যি, যদি আমার স্বাভাবিক প্রবণতা বা ঝোঁকটা অন্যদিকেই। থাকতো! অন্যদিকে! মাঝে মাঝে আমার মনটাও সত্যি ভাল কথা ভাবে। অথচ অন্য দিকটা যখন ভাবছি, তখন নীতার সামনের দিকটাই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ওর সামনের দিকটাও সুন্দর। ওর বুক, যদিও একটু টল-খেয়েছে, কী যেন বলে তাকে, ঈষৎ-ঈষৎ নম্র, তবু গড়নাটা বেশ সুন্দর, বড় আর সুগোল, হয়তো এই কারণেই তবু চোখে পড়ার মত, যাকে বলে উদ্ধত, তাই মনে হত। বুক জোড়ার ওপরে, কণ্ঠার কাছ পর্যন্ত একটা চওড়া ভাবের অন্যে, আর পেটে চর্বি বা মেদ, অর্থাৎ ভুড়ি না থাকায়, গোটা সামনের দিকটা, এক বথায় দারুন। পিক্‌চার যাকে বলে।……….
….. কিন্তু শরীর তো অনেক দেখেছি। বাড়িতে কখনো সখনো অসতর্ক মুহূর্তে নিজের বোনকে দেখেছি, অবিশ্যি ওর কথা ভেবেও লাভ নেই, তেইশ বছরের বয়সের মধ্যে ও অনেক প্রেম (পীরিত!) করল। নির্ভেজাল আনকোরা সন্ধিক্ষণের নবীনা দেহ যাকে বলে, তাও দেখেছি। যার সংসর্গ করিনি, কিংবা যার করেছি। অনেকেরই দেখেছি, তার মধ্যে বেশ্যাও আছে, যদিও ভদ্রলোকই বেশী, সতী-অসতীর ছাপ বলে তো কখনো কিছু বুঝতে পারিনি। অথচ কথাগুলো বরাবর চালু আছে।………..

Leave a Reply