অনুবাদঃ মনীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
উৎসঃ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ আদি-রসের গল্প
সম্পাদনাঃ সুকান্ত সেনগুপ্ত
ষোড়শ শতাব্দীতে স্যার ইমবার্ট-দ্য-বাসতারনে ছিলেন তুরেনের সবচেয়ে বড় জমিদার। তাঁর স্বভাবটা ছিল অন্য মানুষের থেকে স্বতন্ত্র। স্ত্রী জাতির ওপর তার কোন আস্থা ছিল না। তাঁর ভাষায় ওরা বড় বেশী মাত্রায় ইন্দ্রিয় পরায়ণ। হয়তাে তাঁর ধারণাটা ভুল নয়, কিন্তু এই ধারণা মনে বদ্ধমূল থাকায় বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত তাঁকে অবিবাহিতই থাকতে হ’ল। এতে বিশেষ লাভ হল না তাঁর উপরন্তু অনেক সময়ে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতে করতে ভদ্রলােক ক্রমেই অসামাজিক হয়ে পড়তে লাগলেন। জীবনের বেশীর ভাগ সময়টাই তাকে কাটাতে হল যুদ্ধক্ষেত্রে আর অবিবাহিত ব্যক্তিদের সাহায্যে। তার পােষাক পরুিচ্ছদে ছিল না জৌলুষ, হাতগুলাে ছিল অপরিচ্ছন্ন আর সব সময়ে বিরক্ত থাকার কারণে মুখেটা হয়ে উঠেছিল বাঁদরের মতাে। সত্যি কথা বলতে কি তৎকালীন খ্রীষ্টান জগতের সবচেয়ে কুৎসিত ব্যক্তি ছিলেন তিনি। তার অবয়বে এমনকি গােপন স্থানগুলােতেও নিন্দা করার মতাে কিছু ছিল না।
বিশ্বাস করুন আর নাই করুন স্বল্পবাক, এই বীর যােদ্ধা নিষ্কলক চরিত্রের রাজার প্রতি অনুগত প্রকৃত ধনী জমিদারটিকে বােধ হয় কোন দেবদতও উপেক্ষা করতে পারতাে না।
অনেকেই বলতেন, এই ব্যক্তিটির মানুষকে সৎ উপদেশ দেবার ক্ষমতা ছিল, তাই অনেকেই আসত তাঁর কাছে পরামর্শ নেবার জন্যে। ভগবানের লীলা সত্যিই বােঝা ভার। অশেষ গুণাবলী সম্পন্ন লােকটির পােষাক পরিচ্ছদ অপরিচ্ছন্ন থাকতো কেন তার কোন ব্যাখ্যাই দেওয়া সম্ভব নয়। তাঁর বয়স যখন সবে পঞ্চাশ তাঁকে দেখাতাে ষাট বছর বয়সের বৃদ্ধের মতাে। সেই বয়সে তিনি মনে করলেন বংশরক্ষার জন্য এবার তিনি বিয়ে করবেন। অতএব তার মনমতো কন্যার সন্ধানে উঠে পড়ে লাগলেন তিনি। সন্ধান পেলেন। দক্ষিণ দেশের খ্যাতনামা রােহন পরিবারের বার্থা নারী কন্যাটি সবদিক থেকেই মনে ধরল তার। ইমবার্ট তাকে দেখেছিলেন সব্যাজনের দুর্গে। মেয়েটির রুপ গুুণ এবং নিষ্কলুষ মুখভাব তাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। মেয়েটির পাণিগ্রহণ করার উদগ্র বাসনায় তিনি প্রায় পাগল হয়ে উঠলেন। তাঁর ধারণায় এত সুন্দর এবং উচ্চবংশোদ্ভত কোন মেয়ে কখনই খারাপ হতে পারে না। বিবাহ অনুষ্ঠিত হতে দেরী হল না কারণ স্যার রােহনের সাত সাতটি কন্যা, পার করতে পারলেই তিনি বাঁচেন। বিশেষ করে যুদ্ধবসানে তখন সকলেরই অবস্থা খারাপ। বাস্তারনে দেখলেন তিনি সত্যিই একটি কুমারী মেয়ে পেয়েছেন। তিনি নিশ্চিন্ত হলেন এই ভেবে যে কন্যাটি কড়া শাসনেই মানুষ হয়েছে, সুশিক্ষা পেয়েছে। আলিঙ্গণ করার প্রথম অধিকার পাওয়ার দুমাসের মধ্যেই বার্থার গর্ভে সন্তান এল। স্যার ইমবাটের আনন্দের আর সীমা রইল না। এই আইন সঙ্গত সন্তানই পরবর্তী কালে খ্যাতিমান ডিউক অফ বাস্তারনে হয়ে ছিলেন। তিনি ছিলেন বাবার মতােই সাহসী বীর যােদ্ধা, রাজানগত এবং একাদশ লুইয়েরপ্র সাদে প্রথমে মন্ত্রী ও পরে ইউরােপের বহুদেশে রাষ্ট্রদূতের পদে আসীন ছিলেন। তাঁর বাবা একাদশ লুই যখন সিংহাসনের অধিকারী-রাজ পৃত্র তখন থেকেই তাঁর অনুগত ছিলেন, ছেলেও তেমনি বাবার পত্থানসোরণ করেছিলেন। রাজার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্টতা ছিল বন্ধুর মতাে। বার্থা সম্পর্কে কারাে মনেই কোন সন্দেহ ছিল না, উপরন্তু সকলেরই ধারণা ছিল তিনি দেবীর মতােই পুজণীয়া। বার্থার সন্তানটি দুবছর বয়স পর্যন্ত মার কোলেই মানুষ হােল। এক মুহুর্তের জন্যেও বার্থা ছেড়ে থাকতে পারতাে না তাকে। ওর লাল ঠোট দুটো প্রায় সবসময়েই লেগে থাকতাে বার্থার স্তনে। ওর ছােট ছােট হাত পাগুলােও বার্থার মনে আনন্দের সৃষ্টি করতাে। তার কান্নাও বার্থার কানে বাজতাে সঙ্গীত হয়ে । চুমুতে চুমুতে অস্থির করে তুলতো বার্থা এই শিশুটিকে। মা মেরীও বােধ হয় আমাদের ত্রাণকর্তাকে এত ভালোবাসেন নি কখনও। বৃদ্ধ ইমবার্টও খুব খুসী হতেন বার্থার এই কাজে। স্বল্পবস্কা এই বউটির যৌন চাহিদা মেটাবার ক্ষমতা তার ছিল না। তাছাড়া তিনি তাঁর শক্তি সঞ্চয় করে রাখতে চেষ্টা করছিলেন আর একটি সন্তান লাভের আশায়। ছ বছর পরে সে বাধ্য হলেন ছেলেটিকে কর্মচারীদের হাতে তুলে দিতে যাতে তারা তাকে সুশিক্ষা দিয়ে মানুষ করে গড়ে তুলতে পারে। বার্থা ছেলেটিকে হাতছাড়া হতে দেখে কেদে ফেলেছিল, কিন্তু কিছুই করার ছিল না তার। ওর দুঃখ দেখে স্যার ইবার্ট ওকে আর একটি সন্তান উপহার দিতে চেস্টা করেছিলেন, কিন্তু সক্ষম হন নি। বার্থা নিজেও অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল সন্তান প্রসব যন্ত্রনা সহ্য করতে রাজী ছিল না সে।
স্যার ইমবার্ট যুবক ছিলেন না। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি বীর যোদ্ধা হলেও প্রেমের জন্য যে নৈপণ্যর প্রয়াজোন তা তাঁর ছিল না। বৃদ্ধ সৈনিক ইমবার্ট দ্য বস্তারণেব মদনের উদ্যানে প্রবেশ করেছিলেন বটে কিন্তু প্রেমের ব্যাপারে তিনি ছিলেন একেবারেই অজ্ঞ ও অনভিজ্ঞ। বার্থার বয়স মাত্র পনের। তার কুমারী মনের বিশ্বাস অনুসারে ধারনাই ছিল না মা হয়ার আনন্দ লাভের জনা মানুষকে এমন নোংরা যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। সেইজন্যে বিয়ের পরে শুধুমাত্র যন্ত্রণাই ভোগ করেছে, সে কোন আনন্দই পায়নি। সুতরাং সেই পুরানো নিপীড়নের পুনরাবৃত্তি আর চায়নি সে। তাই সে সুরু করল সন্ন্যাসিনীর জীনযাপন করতে! মানুষের সাহচর্য আর ভালো লাগত না তার, এবং সে বিশ্বাসও করতে পারতো না যে সৃষ্টিকৰ্ত্তা সৃজন কাজের প্রাথমিক পর্যায়ে এত আনন্দ সুখের ব্যবস্থা করেছেন, কারণ নিজের ক্ষেত্রে সে পেয়েছে শুধু কষ্ট আর যন্ত্রণা। কিন্তু নিজের সন্তানকে সে যথার্থই ভালোবাসতো যদিও তার জন্মের জন্য অনেক যন্ত্রণাই ভোগ করতে হয়েছিল বার্থাকে। প্রাচীন লোকেদের মুখ থেকে এরকম অসুখী বিবাহের অনেক কথাই শুনি আমরা।
মা হয়েও কার্যতঃ কুমারী বার্থার এখন বয়স হাে’ল একুশ, তাজা প্রস্ফুটিত ফুলের মতাে সুন্দর মেয়েটি তুরেনের এই দুর্গ আর দুর্গের মালিকের গর্বের বন্তু। বাস্তারণেও প্রাণবন্ত এই মেয়েটির পরামর্শ ছাড়া কোন কাজ করতেন না। এখন বার্থা লোচে সহরের কাছে তার স্বামীর দুর্গে বাস করে। গৃহকর্ম দেখাশােনা করা ছাড়া আর কোন কাজ নেই তার। একদিন রাজা লােচে সহরের কাছে দিন কয়েক কাটাতে এলেন। সেখানে নিমন্ত্রণ হােল লর্ড ও লেডী বাস্তারণের। রাজসভায় লেডী বাস্তরণের রুপে সবাই মগ্ধ। রাজা নিজে ভােজসভায় আপ্যায়ণ করলেন ওদের বিশেষ করে বার্থাকে। সভায় উপস্থিত যুবকেরা লােভের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল ওর মুখের দিকে, বৃদ্ধদের শরীর গরম হয়ে উঠল ওর যৌবনের উত্তাপে। ওদের যে কেউ বার্থার কোণ ইচ্ছা পূরণ করতে প্রাণ পর্যন্ত দিতে রাজী, ভগবান বা বাইবেলের উপদেশ অপেক্ষাও বেশী আলােচনার কারণ হয়ে দাঁড়াল বার্থা। অন্য মেয়েরা স্বভাবতঃই ক্রদ্ধ হােলাে। ওদের উম্মাও প্রকাশ পেতে থাকল নানা ভাবে। বার্থাকে তার নিজের দুর্গে ফেরত পাঠাবার চেষ্টাও চলতে থাকল মেয়েদের তরফ থেকে। ওদের মধ্যে একজনের স্বামী বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়ে উঠল বার্থার প্রতি। সেই মেয়েটি ঈর্ষায় জলে পড়ে মরতে থাকল আর সেই ঈর্যাই বার্থার জীবনে নিয়ে এল দুর্যোগ। অবশ্য বার্থা সুখের ও আস্বাদন পেল সেই দুর্যোগে। প্রেমের জগতে যে এত সুখ, সে অনুভব করল এখন, অনুভব করল দৈহিক মিলনের আনন্দ। এর আগে যা কখনও পায়নি সে। সেই দুষ্টা স্ত্রীলােকটির একটি অল্পবয়সী যুবক আত্মীয় ছিল, বার্থাকে দেখার পর সে তাকে পাবার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছিল। এমনকি সে ঐ দুষ্টা স্ত্রীলােকটিকে জানিয়ে রেখেছিল যে যদিমাত্র একমাসের জন্যেও বার্থাকে ভােগ করার সুখ লাভ করার সৌভাগ্য পায় তাহলে সে স্বেচ্ছায় তার প্রাণ বিসর্জন দিতে পারে। রমণীর ঐ ভাইটি ছিল মেয়েদের মতােই সুন্দর ও কোমল দেহবিশিষ্ট। তার দাড়ি গোঁফ কিছুই ছিল না, মুখের আদলটা ছিল এতই সুন্দর যে, যে কোন শহর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করা মাত্র সে তা পেতে পারতাে। আন্দাজ কুড়ি বছরের মতাে বয়স তার, গলার স্বরটাও মেয়েদের মতাে সুরেলা।
ভদ্রমহিলা ওকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, ‘ভাইটি এখন বাড়ী যাও; তুমি যাতে তােমার কাম্য স্বর্গসুখ লাভ করতে পারাে তার চেষ্টায় থাকব আমি। কিন্তু দেখাে, সে যেন আমি ব্যবস্থা করার আগে তােমার মুখ না দেখতে পায়, কিম্বা ওর প্রভু ঐ বাঁদরমুখাে লােকটাও না দেখে তােমাকে।
যুবকটি চলে যাবার পরই ভদ্রমহিলা বার্থার কাছে এসে নানা মিষ্টি কথা বলে ওর মন জয় করতে চেষ্টা কবলেন, তার একটাই বাসনা বার্থার সর্বনাশ করে, প্রতিহিংসা প্রবৃত্তি চরিতার্থ করা। বার্থার মনটা সরল, ভদ্রমহিলার চাতুয্যে মুগ্ধ হল সে। ভদ্রমহিলাও ওর সঙ্গে কথাবার্তা বলে বুঝলেন প্রকৃত প্রস্তাবে বার্থা কামলীলায় কুমারীর মতােই অনভিজ্ঞা। তার সারা মুখাবয়বে কামলীলার কোন চিহ্নই নেই। বিশ্বাসঘাতিকা ভদ্রমহিলা কয়েকটা প্রশ্ন করেও জানলেন যে সন্তানের জননী হলেও প্রকৃত প্রেম ও পরবর্ত্তী স্তরে সম্ভােগের খেলায় সে কোন দিনই সুখলাভ করতে পারেনি। নিজের দূর সম্পর্কের ভাই সম্পর্কে তিনি নিশ্চিন্ত হলেন। তারপর তিনি ধীরে ধীরে কথা পাড়লেন। লােচে সহরেই রােহান পরিবারে এক ভদ্রমহিলা বিষম বিপদে পড়েছেন। স্বামীর সঙ্গে বিশেষ বনিবনা হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে যদি বার্থা তার নিস্পাপ মন দিয়ে ওদের মত-পার্থক্য দূর করতে সক্ষম হয়। অন্ততঃ রাজী হয় তাহলে উনি তাকে বার্থার দুর্গে নিয়ে যাবেন। বার্থা বিরক্তি না করে রাজী হােল, কারণ মেয়েটির দুভাগ্যের কথা তার জানা ছিল আগে থেকেই, কিন্তু মেয়েটি যার নাম শুনল “সিলভিয়া” তার সক্ষে তার পুর্ব পরিচয় ছিল না। কারণ সে জানতাে সিলভিয়া বিদেশে থাকে।
এখানে বলে রাখা প্রয়ােজন রাজা সায়ার দ্য বাস্তারণকে কেন আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তাঁর সন্দেহ ছিল তাঁর পুত্র সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ডফিন বার্গাণ্ডিতে চলে গিয়েছে এবং বাস্তারণের মতাে বিবেচক মন্ত্রীর মন্ত্রণা যাতে সে পায় সে বিষয়ে সচেষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তারণে ছিলেন ডফিনের প্রতি একান্ত অনুগত, তাই ইতিমধ্যেই তিনি মনস্থির করে ফেলেছিলেন। তিনি বার্থাকে নিয়ে ফিরে গেলেন তাঁর নিজের দুর্গে। বার্থা সেই সময়ে বাস্তারণকে জানালেন যে তার একটি সঙ্গিনী জুটেছে। মেয়েটির সঙ্গে সে আলাপ-পরিচয় ও করিয়ে দিল স্বামীর। মেয়েটি কিন্তু আসলে সেই দুশ্চরিত্র যুবক। মেয়ের ছদ্মবেশে ঈর্ষাকাতর ভদ্রমহিলাটির সঙ্গে এসেছিল। সিলভিয়া দ্য রােহনের কথা শুনে ইমবার্ট প্রথমে একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু বার্থার কথা শোনার পর কোন আপত্তি করেননি তিনি। স্ত্রীর ওপর অগাধ বিশ্বাস ছিল তাঁর। বাগাণ্ডি যাত্রা করার আগে স্ত্রীকে অনেক আদর-টাদর করে যুদ্ধের পােষাক পরে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন। ছােট ছেলেটির মুখটা তার পরিচিত ছিল না তাই তিনি ওকে একটি শান্ত, নম্রস্বভাবের মেয়ে বলেই ধরে নিয়েছিলেন। ছেলেটিও যথাসম্ভব বাস্তরণেকে এড়িয়ে চলছিল পাছে বার্থার সঙ্গে প্রেম করার আগেই ধরা পড়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়। বাস্তারণে দুর্গ ত্যাগ করায় নিশ্চিন্ত হােল সে।
(২)
এই অবিবাহিত যুবকটির প্রকৃত নাম সায়ার যেহান দ্য সাফেৎ, সিউর দ্য মমারানেসির দুর সম্পর্কীয় ভাই। যেহানের মৃত্যুর পর তার বিষয়-সম্পত্তি ঐ ভদ্রমহিলার অধিকারে আসবে। তার বয়স মাত্র কুড়ি, কামানলে জলছে সে, তাই প্রথম দিনটা যে কি কষ্ট করেই না তাকে কাটাতে হােল তা সহজেই অনুমান করা যায়। বৃদ্ধ ইমবার্ট যখন ঘােড়া চালিয়ে জোর কদমে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তখন ওরা দুজন অলিন্দে দাঁড়িয়ে রুমাল নেড়ে তাকে বিদায় জানাচ্ছিল। দলের বাঁকে তিনি অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওরা নেমে নীচের বড় ঘরটায় এসে বসল।
বার্থাই প্রথমে ছদ্মবেশী সিলভিয়াকে সম্ভাষণ জানিয়ে বলল, “এবার আমরা কি করব বােন ? তোমার কি গানবাজনা ভালাে লাগে ? তাহলে এস আমরা একসঙ্গেই গানবাজনা করি। প্রথমে আমরা একটা মিষ্টি সুরের চারণ গান দিয়ে আরম্ভ করি কেমন ? তুমি অর্গানে এসে বসাে, আমি গান করি।’
যেহানের হাত ধরে সে বসিয়ে দিল অর্গানে। মেয়েদের ভঙ্গীতে সে সুরু করল অর্গান বাজাতে। প্রথম সুরটা উঠতেই বার্থা উল্লসিত হয়ে বলল, বােন, কি সুরই না বাজাও তুমি। ছেলেটি ওর দিকে মুখ ফেরাল, যাতে ওরা দুজনে গলা মিলিয়ে গাইতে পারে। তােমার চোখ দুটোও কি সুন্দর বার্থা আর বলল।
ছদ্মবেশী সিলভিয়া বলল, এই চোখ দুটোই তাে আমার সর্বনাশ ডেকে এনেছে। সমুদ্র পারের দেশের একজন লর্ড আমাকে প্রায়ই বলতেন, তার সুন্দর চোখের কথা, আর বারবার চুম খেতেন আমাকে। খুব ভালো লাগত আমার।
‘আচ্ছা বােন, ভালােবাসার সুর, কি চোখেতেই ?
‘বার্থা, প্রিয়তমা, চোখেতেই তাে মনের আগুন।
“যাক, এখন আমরা গান করি। ওরা গান সুরু করল, প্রেমের গান। যেহান সেই গানই চায়। তােমার গলায় কি আছে বােন, আমাকে যেন একেবারে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
‘কোথায়? সিলভিয়া বলল।
এইখানে। বার্থা ওর হাতটা বুকে ঠেকিয়ে উত্তর দিল।
‘এখন গান থাক, আমি বড্ড অভিভূত হয়ে পড়েছি। জানালার ধারে এস। আমরা একসঙ্গে বসে একটু সেলাই এর কাজ করি। সন্ধ্যের তাে দেরী আছে এখনও।
“আমি তাে জীবনে ছুচ ধরিনি হাতে, প্রিয়তমা। তালে তুমি সারাদিন কাটাতে কি করে ?
‘আমি প্রেমে ভেসে বেড়াতাম, তাতে দিনগুলােকে মনে হতো মরে মতো, মাসগুলো হয়ে উঠতাে দিন, আর বছর গুলাে মাস। ওই রকম চললে সারাটা জীবনই ভরে থাকতাে সুগন্ধ, মাধুর্য্য আর অপরিসীম আনন্দে।
কথাটা শেষ করেই যুবকটি এমন একটা বিষাদ মলিন ভাব মুখে ফুটিয়ে তুলল যে মনে হয় প্রেমিকের সাহচর্য না পেয়ে সে একেবারে ভেঙে পড়েছে।
‘আচ্ছা বােন, তােমার বিবাহিত জীবনে কি সে প্রেমের আস্বাদ পাওনা তুমি ।
সিলভিয়া উত্তর দিল, ‘মােটেই না। কারণ বিবাহিত জীবনে সবটাই কৰ্তব্য, কিন্তু প্রেমে মনের স্বাধীনতা আছে। প্রেমিকের চুমুর আস্বাদ স্বামীর কাছে পাওয়া যায় না।
‘আমাদের আলােচনার বিষয় বস্তুটা বদলে ফেলা যাক। তােমার গানের থেকেও এই আলােচনা আমাকে বেশী চঞ্চল করে তুলছে।
একটা চাকরকে ডেকে সে তার ছেলেকে নিয়ে আসতে বলল।
ছেলেটিকে দেখে সিলভিয়া বলল—“আরে এযে প্রেমের মুর্ত প্রতীক। আবেগভরা একটা চুমু একে দিল সে তার কপালে।
মায়ের ডাকে শিশটি কোলে উঠে বসল। আদরে আদরে তাকে অস্থির করে তুলল বার্থা।
সিলভিয়া বলল, ‘ওকি বােন, তুমি যে ওকে প্রেমিকের মতাে সম্ভাষণ করছ। ‘প্রেম তাহলে শিশু, কেমন ?
হ্যাঁ, বােন, তাই তাে অবিশ্বাসীরা তাকে শিশু রুপেই কল্পনা করে, আর সেই ছবিই আঁকে প্রেমের দেবতার।
এইরকম কথাবার্তা বলতে বলতে যাওয়ার সময় হয়ে এল।
‘আর একটা ছেলে চাও না তুমি’, সুযোেগ পেয়ে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে একটা আলতাে চুমু খেয়ে বলল সিলভিয়া।
‘ওঃ, সিলভিয়া আর একটার জন্যে আমি একশ বছর ধরে নরক যন্ত্রনা ভােগ করতে রাজী, যদি ভগবান দয়া করে আমাকে দেন তা। কিন্তু আমার স্বামী অনেক চেষ্টা, অনেক পরিশ্রম করেও তা করতে পারেন নি। আমাকেও কত কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে, কিন্তু আমার পেটের আয়তন একটু বাড়েনি তাতে। সত্যিই একটা সন্তান কিছুই নয়। দুর্গে যখনই আমি কোন শিশুর কান্না শুনি আমার বুকটা যেন ফেটে পড়ে। এই নিস্পাপ শিশুটির জন্যে আমি সব কিছুতেই ভয় পাই। কিন্তু কি করব সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা।
কথাগুলাে শেষ করে শিশুটিকে বুকে চেপে ধরল। একমাত্র মায়ের পক্ষেই সম্ভব শিশুকে এভাবে আকড়ে ধরা। একটু লক্ষ্য করে দেখলেই দেখা যাবে বিড়াল কিভাবে তার শিশুকে মুখে করে ধরে নিয়ে যায়, বাচ্চার গায়ে একটু আচড় পর্যন্ত না লাগিয়ে। যুবকটির একটু ভয় ছিল, বার্থার মন গলাতে পারবে কিনা। বার্থার কথায় সন্দেহের নিরসন হল।
রাতে প্রাচীন প্রথানুযায়ী বার্থা সিলভিয়াকে তার রাজশয্যায় সঙ্গিণী হতে অনুরােধ জানাল। সিলভিয়া আনন্দে অধীর হয়ে রাজী হল। এত সহজে যে সুযােগ আসতে পারে তা ছিল তার কল্পনার অতীত। রাত্রের অন্ধকার নেমে আসতে ওরা প্রবেশ করল সুসজ্জিত শয়ন কক্ষে। বার্থা পরিচারিকাদের সাহায্য নিয়ে পােষাকগুলাে খুলে ফেলল। সিলভিয়া রাজী হল না ওদের সাহায্য নিতে। শুধু বলল নিজেই পােষাক খােলার অভ্যাস আছে তার। বার্থা একটু অবাক হল তার কথা শুনে, কিন্তু আর কিছু না বলে একত্রে প্রার্থনা করার অনুরােধ জানিয়ে শোবার আয়ােজন করতে সুরু করল। যুবকটি কামানলে জলছিল বার্থার নগ্ন দেহ দেখে। একজন অভিজ্ঞ মেয়ে তার সঙ্গে আছে মনে করে বার্থা নৈমিত্তিক কাজগুলো করে যেতে লাগল। পা দুটো ধুয়ে নিল সে, একবারও ভাবল না যে কতখানি তুলছে সে পা দুটো, দেহের কতখানি প্রকট হল তাতে। তারপর সে উঠল বিছানায়, আরাম করে বসে সিলভিয়ার ঠোঁটে চুমু খেল নিবিড়ভাবে, দেখল যেন জলছে তার সারা অঙ্গ।
“তােমার কি কোন অসুখ করেছে সিলভিয়া ? গাটা বেশ গরম লাগছে। শােবার সময় আমার গাটা গরম হয়ে ওঠে, এই সময়ে আমার পুরােন প্রেমের খেলার কথাগুলাে মনে পড়ে কিনা! ওঃ কত নতুন নতুন খেলা আবিষ্কার করত আমার প্রিয়তম।
‘আমাকে সব কথা খুলে বল বােন। বড্ড শুনতে ইচ্ছা করছে।
‘তােমার আদেশ আমার শােনা উচিত কিনা, ভাবছি আমি।
‘কেন নয়, বল।
‘কথার থেকে কাজে আরও বেশী বােঝা যায় নাকি?
ছদ্মবেশী কুমারী বলল, “কিন্তু আমার ভয় হয় পাছে আমার প্রেমিক আমাকে যত আনন্দ দিতে পেরেছিল আমি ততটা পারব কিনা! আমি বড় জোর একটা মেয়ে দিতে পারি তােমাকে।
‘খুব ভাল হয় তাহলে, দেবদূতেরা তােমাকে আশীর্বাদ করবেন। এখন তাড়াতাড়ি সুরু কর। বার্থা বলল।
‘আমার প্রিয়তম এইভাবে আমাকে সুখ দিতেন। কথাটা বলেই যেহান বার্থাকে কোলে টেনে নিল। বাতির স্নান আলােয় পাতলা আচ্ছাদনে আরামদায়ক বিছানায় বার্থকে দেখাচ্ছিল একটা সুন্দর লিলি ফুলের মতাে।
‘আমাকে এইভাবে কোলে নিয়ে আমার থেকে অনেক মিষ্টি সুরে সে বলত, আঃ বার্থা তুমি আমার চিরকালের প্রিয়তমা, আমার হৃদয়ের রাণী। পৃথিবীতে তােমার মত প্রিয় কিছুই নেই! ভগবানের থেকেও আমি তােমাকে বেশী ভালােবাসি। তােমার কাছে সুখ পাবার জন্যে আমি হাজার বার মত্যুবরণ করতেও রাজী। তারপর সে আমাকে চুমু খেতাে, স্বামীরা যেভাবে খায় সেভাবে নয়, পায়রা যেভাবে খায় সেই ভাবে।
বার্থার ওষ্ঠাধব থেকে সবটুকু মধু চুষে নিয়ে সেটা দেখিয়ে দিল সে। বার্থাকে সে বুঝিয়ে দিল তার গােলাপী ছোট পাতলা জিভটা দিয়ে মুখে কোন কথা না বলেও হৃদয়ের ভাষা কিভাবে প্রকাশ পায়। তারপর চুম্বন বৃষ্টি শুরু হল মুখ থেকে ঘাড়ে বুকে আর সুগঠিত নরম পয়ােধরে।
বার্থা নিজের অজান্তেই প্রেমে গলে গিয়ে ‘আহা, কি মধুর! আমি ইমবার্টকে অবশ্যই এরকম করতে বলব।
‘তােমার কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে বােন ? তােমার বুড়াে স্বামীকে এসব কথা কিছুই বলবে না। তার হাত আমার মতাে নরম কি করে হবে ? ধােবার হাতের মতাে শক্ত ওর হাত, আর খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলাে তােমার বুকে লাগলে কি ভাল লাগবে ? এই বুকেতেই তাে রয়েছে তােমার প্রেম ভালবাসা আর আনন্দের অফুরন্ত উৎস। এটা তাজা ফুল, এইভাবে চুমু খেতে হয়। এখানে, নিপীড়ন করলে সুখ লাভ হয় না। এই রকমই ছিল আমার প্রিয়তম ইংরেজ প্রেমিকের প্রেম করার ভঙ্গী।
এইসব কথা বলতে বলতে সুদর্শন যুবকটি কামােত্তেজিতা বার্থাকে সম্ভােগ করতে সুরু করল। বার্থা আনন্দে উদ্বেল হয়ে জড়িয়ে ধরল যেহানকে ।
‘আঃ বােন, আমি দেবদুতের উপস্থিতি অনুভব করছি। কানে কিছু শুনতে পাচ্ছি না আমি, কিন্তু ওদের দেহের উজ্জ্বল আভায় আমার চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে, কিছু দেখতে পাচ্ছি না আমি।
সম্ভোগ সুখের আধিক্যে এলিয়ে পড়ল ওর দেহটা শেষ পর্যায়ে। দেহের প্রতিটি তন্ত্রী, শিরা উপশিরায়, বার্থা অনুভব করতে লাগল স্বর্গসুখ। তার বিশ্বাস জন্মাল সত্যিই সে উপনীত হয়েছে স্বগে। যেহানের বাহু ডােরে তখনও আবদ্ধ সে, বকিশক্তি হীন, শুধু একটা কথাই বেরল ওর মুখ থেকে,
‘অঃ, ইংল্যান্ডে বিয়ে হওয়ার কি সুখ?
যেহানের রেতঃপাত হয়ে গিয়েছে, সম্ভোগ সুখের আনন্দ ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসছে, সে উত্তর দিল, ‘প্রিয়তমা, ফ্রান্সেই তোমার বিয়ে হয়েছে, বিয়ে হয়েছে আমার সঙ্গে। আমি পুরুষ, তোমার জন্য আমি হাজার বার মরতেও রাজি।
বার্থা চমকে উঠে এমন চিৎকার করে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠল যে যেহান ভয় পেয়ে গেল। হাটু গেড়ে বসে বার্থা যেহানের হাত ধরে কাদতে কাঁদতে প্রার্থনা সরু করল। দু’চোখের কোল বেয়ে মুক্তোর মতাে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল তার। ‘আমার মৃত্যু হোক! দেবদুতের মত সুন্দর মুখের শয়তান, আমায় প্রতারণা করেছে । নিঃসন্দেহে একটি সুন্দর শিশুর মা হতে চলেছি আমি। হে মা মেরী, ক্ষমা করাে আমায়।
যেহান যখন দেখল তার বিরুদ্ধে কিছু বলা হচ্ছে সে উঠল, বার্থার সজল চোখের দৃষ্টিটা মুগ্ধ করল। বার্থা তাকে উঠতে দেখে লাফিয়ে উঠল। এক পা এগুলে আমাদের মধ্যে একজনকে মরতে হবে বললাম ।
আবছা আলােয় যেন দেখল একটা কিছু হাতে ধরে রয়েছে সে।
দৃশ্যটা এত হৃদয় বিদারক যে যেহান অভিভূত হয়ে পড়ল। “তোমার নয়, মত্যুটা আমারই বরণ করা উচিত, প্রিয়তমা। তােমার মতাে অসামান্যা রমণী পথিবীতে আর জন্মাবে না।
‘তুমি যদি সত্যিই আমাকে ভালােবাসতে তাহলে এভাবে আমার মৃত্যুর কারণ হতো না। কারণ স্বামীর কাছে তিরস্কৃত হবার আগেই আমাকে মরতে হবে।
‘তুমি মরবে ? সে বলল।
“অবশ্যই। সে উত্তর দিল।
‘দেখাে, যদি তীক্ষ তরবারি দিয়ে আমাকে হাজার বার বিদ্ধ করাে তাে তুমি তােমার স্বামীর ক্ষমা নিশ্চয়ই পাবে। তুমি তাকে বলবে তােমার সরলতার সুযােগ নিয়ে যে তােমাকে ঠকিয়েছে তাকে হত্যা করে তুমি তার শােধ নিয়েছ। আর আমিও এই আনন্দ নিয়ে মরতে পারব যে তােমার মতাে প্রেমিকার হাতে আমার মত্যু হয়েছে, যে আমার প্রেমকে উপেক্ষা করে আমার সঙ্গে বাস করতে রাজী নয়।’
চোখের জলে মেশা মিষ্টি কথাগুলাে শুনে বার্থা ছরিটা ফেলে দিল হাত থেকে। যেহান একলাফে কুড়িয়ে নিল সেটা, তারপর ক্ষিপ্রতার সঙ্গে নিজের বুকে বসিয়ে দিল সেটা।—বার্থা, ‘যে সখ আমি পেয়েছি একমাত্র মত্যু দিয়েই শোধ হবে আমার।
কথাটা বলেই সে পড়ে গেল। শক্ত হয়ে উঠল ওর দেহটা।
বার্থা ভয় পেয়ে চিৎকার করে পরিচারিকাকে ডাকল। একজন পরিচারিকা হেটে এল। মাদামের ঘরে একজন আহত ব্যক্তিকে দেখে ভয়ে অস্থির হয়ে উঠল সে। মাদাম তখন তার মাথাটা তুলে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, একি করলে তুমি প্রিয়তম ? ও বিশ্বাস করে নিয়েছিল যে যেন মারা গিয়েছে। তখন ওর মনে যে চিন্তাটা সবচেয়ে বেশী প্রভাব বিস্তার করেছিল তা হচ্ছে, যোহানের আকৃতিটা কি সুন্দর। এমন কি ইমবার্টও ওকে মেয়ে বলেই ধরে নিয়েছিল। দুঃখে তার সবকিছু গােলমাল হয়ে যাচ্ছিল। কাঁদতে কাদতে পরিচারিকার কাছে সবকিছু স্বীকার করে ফেলল সে। ওর কথাগুলাে শুনতে শুনতে হতভাগ্য প্রেমিকটি তার চোখ খুলতে চেষ্টা করল। | আপনি আর কাঁদবেন না, পরিচারিকাটি বলল, ‘আসুন আমরা মাথা ঠিক রেখে এই সুন্দর পুরুষটিকে বাঁচাতে চেষ্টা করি। আমি গিয়ে লা ফ্যালােকে ডেকে আনি। অনেক টোটকা ওষুধ- বিষুধ সে জানে আর এমনভাবে ক্ষত সারাতে পারে যে ক্ষতস্থানে কোন আঘাতের চিহ্ন পর্যন্ত থাকে না। এইরকম গােপন ব্যাপারে কোন চিকিৎসককে ডাকা ঠিক হবে না।
‘তাহলে দৌড়ে যাও! বার্থা বলল। আমি তােমাকে ভালােবাসব, আর আমাকে এই সাহায্য করার জন্যে তােমাকে মােটারকম পুরস্কার দেব।’
কোন কিছু করার আগে মাদাম ও তাঁর পরিচারিকার মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত হােল যে দুজনেই মুখ বুজে থাকবে এবং যেহানকে লুকিয়ে রাখা হবে যাতে কেউ কিছু জানতে না পারে। অতঃপর পরিচারিকাটি লা ফ্যালােকে ডেকে আনতে গেল। ‘বার্থা দুগের ফটকটা শান্ত্রীকে বলে খুলিয়ে দিল ওর জন্যে। বার্থা ঘরে ফিরে এসে দেখল তার প্রেমিক অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য আবার অচৈতন্য হয়ে পড়েছে। যেহান যে তার জন্যই মত্যু বরণ করতে গিয়েছে একথা ভেবে সে তার রক্ত একটু মুখে দিল, তারপর ওর ফ্যাকাসে ঠোট দুটোর একটা চুমু খেয়ে, চোখের জলে ক্ষত স্থানটা ধুয়ে ভালাে করে বেধে দিল। বার বার অনুরােধ জানালাে, “প্রিয়তম, বেচে ওঠো তুমি, তােমাকে আজীবন ভালােবাসব আমি। বৃদ্ধ ইমবাটের সঙ্গে যেহানের তুলনা করে সে মনকে প্রবােধ দিল, এই সুন্দর পুরুষটি তার জীবনে স্বর্গ সুখ এনে দিয়েছে, সম্ভােগের যে অপরিসীম আনন্দ ইতিপর্বে সে আস্বাদন করেনি তাই সে পেয়েছে যেহানের কাছে। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে সে বারবার চুমু খেল যেহানের মুখে। তার উষ্ণ চুম্বনের স্পর্শে যেহানের জ্ঞান ফিরে আসতে লাগল। তখন সে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, আমায় ক্ষমা করাে প্রিয়তমা। বার্থা তাকে যতক্ষণ না লা ফ্যালাে আসেন ততক্ষণ চুপ করে থাকতে বলল। দুজনে চুপচাপ সময় কাটাতে লাগল, চোখে চোখে ভালোবাসা দেখিয়ে।
লা ফ্যালো, কুজো, অনেক তন্ত্রমন্ত্র জানা আছে তার। আর ডাইনিদের স্বভাবজাত বিদ্যায় পারদর্শিনী। সত্যি কথা বলতে কি অনেক ঔষধ-বিষুধই জানা আছে তার এবং মেয়েদের ও অভিজাতদের অনেক রকম গােপন ব্যাধির চিকিৎসা সে করে থাকে। অনেক অর্থই উপার্জন করে সে, যদিও প্রতিষ্ঠাবান চিকিৎসকেরা প্রচার করেন যে লা ফ্যালাে গােপনে বিষ বিক্রি করে। কথাটা অবশ্য মিথ্যা নয়। লা ফ্যালাে এবং পরিচারিকাটি একই গাধায় চেপে ভাের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এসে পৌছল। ঘরে ঢুকে চশমাটা চোখে লাগিয়ে সে, ক্ষতস্থানটা পরীক্ষা করল, তারপর পঞ্জ দিয়ে ক্ষতটা পরিষ্কার করে ভালো করে বেধে ছিল। ক্ষতটা গভীর নয়, প্রাণে অবশ্যই বাঁচবে, কিন্তু গতরাতের পাপের জন্যে এর জীবনে ভয়ানক দুর্যোগ আসবে। লা ফ্যালাের এই ভবিষ্যদ্বানীতে বার্থা এবং পরিচারিকা দুজনেই ভয় পেয়ে গেল। কয়েকটা ঔষধ দিল সে, আর জানাল আগামী রাতে সে আবার আসবে। একপক্ষকাল ধরে প্রতিটি রাতেই আসতো সে। দুর্গবাসীরা শুনেছিল, সিলভিয়া দ্য রােহন মারাত্মক রকম অসুখে ভুগছেন, পেটে জল জমেছে তার এবং যেহেতু তিনি মাদামের সম্পকীয় বােন সেই কারণে এই চিকিৎসার ব্যবস্থা। সকলেই বিশ্বাস করে নিয়েছিল এই গল্প।
অনেকের ধারণা হয়েছিল অসুখটা সাংঘাতিক রকমের, বিপদের আশঙ্কা আছে। কিন্তু সেটা মােটেই সত্যি নয়। যেহান আরােগ্য লাভ করেছিল। যেহানের শক্তি যত বাড়ছিল বার্থা তত দূর্বল হয়ে পড়েছিল। যেহান যে স্বর্গের বার তার জন্যে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল সেই দিকেই সে এগিয়ে চলছিল দ্রুত গতিতে। এক কথায় যেহানের প্রতি তার প্রেম বাড়ছিল দিন দিন। কিন্তু এই সুখের মধ্যেও মাঝে মাঝে দুশ্চিন্তা হােত ফ্যালাের ভবিষ্যদ্বানীর কথা মনে পড়ায়। স্বামীকে খুব ভয় করতাে সে। বার্থা দিনের বেলা এড়িয়ে চলতাে যেহানকে। সেই সময়ে সে চিঠি লিখতে ইমবার্টকে। যেহান ভাবতাে বার্থা তাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে, তাই সেও কাঁদতাে। রাত্রে যখন বার্থা তার গালে চোখের জলের দাগ দেখতাে সেও অভিভূত হয়ে পড়তাে। নানা কথায় সে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করতাে যেহানকে। যেহানও তাকে সান্ত্বনা দিত এই বলে যে এইজগতে এবং মত্যুর পরেও সে একান্তভাবে তারই কৃতদাস হয়ে থাকবে। বার্থা তখন ঝাঁপিয়ে পড়ত ওর বুকে।
এইভাবে অনেকদিন ধরেই চলল ওদের প্রেমলীলা। মনে দ্বন্ধ সংশয় থাকা সত্ত্বেও সম্ভােগের আনন্দ ওরা উপভােগ করতে পরিপুর্ণ ভাবেই।
মসিয়ে ইমবার্ট দ্য বাস্তারণের ফেরার সময় এগিয়ে এল। আগের দিনই সিলভিয়া দুর্গ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হােল। অনেক কান্নাকাটি চুম্বন আদানপ্রদানের পর বাথা বিদায় দিল তাকে…
এদিকে ইমবার্ট ফিরে এসে দেখলেন বার্থার কোমরটা বেশী ভারী হয়েছে, আনন্দিত হলেন তিনি। আর বার্থা যখন একটি ফুটফুটে দেবদুতের মতাে ছেলেকে পৃথিবীতে নিয়ে এল তখন তিনি আনন্দে অধীর হয়ে স্থির করলেন, ছােটছেলেকেই তিনি মনে করবেন বড় ছেলে, আর বড় ছেলে থাকবে ছােট হয়ে। কারণ বড়টির তখন মুখের আদল হয়েছে তার নিজের অর্থাৎ বাঁদরের মতো।
পড়ে ভালো লাগলো। আপনাদেরকে ধন্যবাদ।