বাংলাদেশের বাউল সমাজ, সাহিত্য ও সংগীত – ডক্টর আনােয়ারুল করীম

›› বই এর অংশ / সংক্ষেপিত  

…..এরা কোনাে জাতিভেদ মানে না। মানুষ ভজনা তাদের উপাসনা বিধায় সকল জাতের বা বর্ণের মানুষকে তারা তাদের সাধনধর্মে স্থান দিয়ে থাকে। এরা অসাম্প্রদায়িক এবং মানবতাবাদী। এদের সাধনা দেহভিত্তিক, তাই গুপ্ত। এরা পরিব্রাজক। গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে ভিক্ষা করাই একসময়ে এদের পেশা ছিল। কালের বিবর্তনে এদের সাধনায় যেমন পরিবর্তন এসেছে তেমনি তাদের পেশায়ও। অবশ্য এদের মধ্যে যারা সংসার-ত্যাগী তারা আজও এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে ভ্রমণ করে ফেরে। আখড়ায় আখড়ায় ঘােরা তাদের জীবন। এদের সাধনা যুগল-সাধনা বলে তাদের সঙ্গী নারী। অতীতে এদের মধ্যে বিবাহের কোনাে প্রথা ছিল না। কন্ঠি বা মালা বদল করলেই সব হতাে। এখনও বিয়েশাদির তেমন প্রয়ােজন হয় না বাউলসাধকদের । যার সঙ্গে প্রয়ােজন, চলে গেলেই হলাে। কেউ তেমন আপত্তিও করে না। অবশ্য এই পদ্ধতি কেবল যারা পরিব্রাজক অর্থাৎ যারা আখড়ায় আখড়ায় ঘুরে বেড়ায় কিংবা এখানে-ওখানে গান গেয়ে ফেরে তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যারা গ্রামাঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস করে তারা স্ত্রী-পুত্র নিয়েই বসবাস করে।….

…..সাধারণ মানুষের কাছে যৌনজীবনের আবেদন অন্যদের থেকে একটু বেশি। এর অনেক কারণের একটি হলাে এই যৌনজীবনের চর্চা এবং চর্যার মধ্য দিয়ে সে নিজের জন্য আনন্দ এবং প্রেরণার পথ খুঁজে নেয়। তাই দেখা যায় তাঁর সাহিত্যে, গানে এই যৌনজীবনের নানা ভাবনার বিভিন্ন প্রয়ােগ। এই প্রক্রিয়াও আদিকাল থেকে প্রবহমান এবং এর ফলে তার চিন্তায়, তা বস্তুগত বা অধ্যাত্ম যাইই হােক না কেন, অনেকাংশে তা যৌনভিত্তিক স্কুল পর্যায়ের। আমাদের আলােচ্য বাউলসাধনা দেহকে তথা বস্তুগত জীবনকে কখনও অস্বীকার করেনি। দেহ এবং ইহকালের গুরুত্ব স্বীকার করেই আত্মার স্বরূপ বিশ্লেষণে এই সাধনা তৎপর থেকেছে। বিভিন্ন ধর্মের
নিধারণার পরিপূর্ণ সমন্বয়ের মাধ্যমে সত্য জানার প্রয়াস এই সাধনার উদ্দেশ্য। বাউলসাধনা তাই সমন্বয়েরও সাধনা। এই সাধনা সে কারণে অসাম্প্রদায়িকও বটে।…..

…..দীর্ঘদিন এ জাতীয় লােকদের সাথে মেলামেশা করে বুঝতে পেরেছি যে এই সাধনা কিছুসংখ্যক মানুষের হাতে পড়ে বিকৃত হয়েছে। সত্যিকার জ্ঞানলাভে বঞ্চিত হয়ে এরা মাকাল ফল নিয়েই তৃপ্ত হয়েছে। এই বিকৃত সাধকদের কার্যকলাপ অত্যন্ত শূণ্য এবং সমাজে তাঁরা দুষ্টক্ষতের ন্যায় বেড়ে উঠেছে। তারা তাদের মূল আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে। এই শ্রেণীর মানুষের মধ্যে অনেক কুলটা নারী, বিধবা, পথভ্রষ্ট, অসচ্চরিত্র প্রকৃতির লােক রয়েছে, যারা এই সাধনায় সামাজিক আশ্রয় পেয়েছে। এদের কার্যকলাপ অনেকাংশে বীভৎসতার নামান্তর। বিভিন্নস্থানে তাদের আখড়া রয়েছে। অনেক সেবাদাসী নিয়ে তারা থাকে। এদের দ্বারা নির্বিবাদে যৌনস্বেচ্ছাচার চলে লাগামহীন। এরা সংগীতাশ্রয়ীও বটে এবং অনেক তরুণ যুবক এদের এই জীবনের প্রতি তীব্র আসক্তি অনুভব করে এদের দলভুক্ত হয়ে আখড়ায় আখড়ায় ঘুরে বেড়ায়। এদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান নামধারী উভয়
প্রদায়ের লােক রয়েছে। যুবসমাজের মধ্যে অধিকাংশই কর্মবিমুখ। যুবতী বা তরুণীদের অধিকাংশই তালাকপ্রাপ্তা, কুলত্যাগী এবং বিধবা। মালা বদলের মাধ্যমে এরা একেকজন যুবকের সেবাসঙ্গিনী হিসেবে দলে থাকে। বর্তমানে এদের সংখ্যা নেহাত নগণ্য নয়। এদেরকে বাউল নামে চিহ্নিত করে অনেক পণ্ডিত এই সাধনার ধারাকে যথােপযুক্ত বিচার করতে সক্ষম হননি।…..

দরবেশ ফকির

বাংলাদেশে দরবেশ ফকির নামে একটি ধর্মীয় গােষ্ঠী দেখা যায়। এরা নিজেদেরকে সহজিয়া-সুফি ধর্মাবলম্বী বলে পরিচয় দিয়ে থাকে। তবে শ্রীচৈতন্যকে তারা অবতাররূপে গণ্য করে তার ভজনা করে থাকে। সনাতন গােস্বামী এই ধর্মীয় গােষ্ঠীর উদ্ভাবক বলে শােনা যায়। সমাজের নিম্নস্তরের হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লােক এই মতের অনুসারী। এরা জাতিভেদ মানে না।
কুষ্টিয়ার লালন ফকিরের আখড়ায় প্রায় প্রতিবছর বার্ষিক ওরশের সময় হিন্দু মুসলমান নামধারী এই দরবেশ ফকিরদের দেখা যায়। তবে এদের সঙ্গে সেবাদাসী নামে নার সংগী থাকে। এরা সন্তানহীন এবং সন্ন্যাস জীবনযাপন করে। এরা ভিক্ষাজীবী। এই দরবেশ ফকিরদের অনেক শাখা-প্রশাখা আছে। মুসলিম প্রভাবিত শাখাগুলির নাম নিম্নরূপ :

১. খলুলিয়া—এরা নৃত্যগীতাদিতে আসক্ত এবং নরনারীর অবাধ মেলামেশায়  বিশ্বাসী। এরা নৃত্যকালে পরস্পরকে চুম্বন ও আলিঙ্গন করাকে বৈধ বলে জ্ঞান করে।
২.হালিয়া—এরা হাতে তালি দেওয়া ও নৃত্য করাকে বৈধ জ্ঞান করে।
৩. আউলিয়াইয়া—এদের মতে বান্দা আউলিয়ার দরজায় উন্নীত হলে শরিয়ত সাধনার কষ্ট থেকে তারা মুক্ত হয়।
৪. শামরানিয়া—এদের মতে পীরের মুরিদ হলে পীরই তাদের মুক্তির উপায় করে দেবেন। এরা তানপুরা ইত্যাদিসহ আমােদপ্রমােদকে বৈধ মনে করে।
৫. হােব্বাবিয়া—এদের মতে বান্দা মােহাব্বতের দরজায় উন্নীত হলে তার
শরিয়তের বিধান পালনের আর প্রয়ােজন হয় না।
৬. হুরিয়া—এদের মত খলুলিয়া সম্প্রদায়ের অনুরূপ। পর-দার গমন এদের কাছে পাপের বিষয় নয়, এবং এই কাজকে তারা সাধনার অঙ্গ বলে মনে করে।
৭. এবাহিয়া—এরা শরিয়তের বিধান মানে না এবং তােয়াক্কা করে না। এরা পর-দার বা পরকীয়া প্রেমকে সাধনার অঙ্গ বিবেচনা করে। এরা চারিচন্দ্র (মল মূত্র রজঃ বীর্য) পরম পবিত্র জ্ঞানে ভক্ষণ করে।
৮. মােতাফাসেনিয়া—এদের মতে আল্লাহ্র ফকিরদের কোনাে কাজকর্ম করতে নেই। ভিক্ষাই এদের একমাত্র জীবিকা।
৯. মােতাজাহিলা—এরা শত তালিযুক্ত বিচিত্র পােশাক পরিধান করে এবং গানবাজনায় রত থাকে। এরা ভিক্ষাজীবী।

এসব বিকৃত সাধনা সম্বলিত লােকধর্মের প্রভাব আমাদের সমাজজীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ‘বাউল ধ্বংস ফৎওয়া’র লেখক মাওলানা রেয়াজউদ্দীন৪৬ তাঁর। গ্রন্থে এদের সম্বন্ধে বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। তিনি তাঁর গ্রন্থে জনৈক স্বামী দয়ানন্দের লেখা ‘সত্যার্থ প্রকাশ’-এ বর্ণিত হিন্দুমতাবলম্বী বিকৃত সাধকদেরও পরিচয় দিয়েছেন। দয়ানন্দ এই বিকৃত সাধকদের দামমার্গী, চুলিমার্গী, বীজমার্গী এবং অঘােরী নামে চিহ্নিত করেছেন।

দামমার্গীঃ এরা জমি কিংবা তখতির উপর ত্রিকোণ বা চতুষ্কোণ কিংবা গােলাকার প্রস্তুত করত তাহার উপর মদের ঘড়া রাখিয়া মন্ত্র পড়িয়া তাহার পূজা করে এবং একটি গুপ্ত স্থানে স্ত্রী-পুরুষ একত্রে একটি লােককে উলঙ্গ করতঃ তাহার স্ত্রীলিঙ্গকে পূজে, তারপর যে-কোনাে স্ত্রীলােক সেখানে প্রবেশ করিলে সে যদি আপন মা, ভগ্নী, বউ, কন্যাও হয় তাহাকে ধরিতে পারে।

চুলিমার্গীঃ একটি গুপ্ত স্থানে স্ত্রী পুরুষ এবং সকলে মিলিয়া মাংস ভােজন মদ্যপান করে এবং স্ত্রীলােককে উলঙ্গ করতঃ তাহার গুপ্তস্থানের পূজা করে এবং তাহার নাম দুর্গাদেবী বলিয়া রাখে। আবার সকল স্ত্রীলােক একটি পুরুষকে উলঙ্গ করিয়া তাহার লিঙ্গের পূজা করে।

বীজমার্গীঃ স্ত্রী সঙ্গমান্তে নির্গলিত বীর্য পানিতে মিশাইয়া ভক্ষণ করে। দয়ানন্দ উল্লেখ করেন যে, এই ধরনের বিকৃত সাধনাকে উল্লিখিত সম্প্রদায় ধর্ম জ্ঞান করে ।

বজ্রযান

বজ্রযানীরা মহাযানীদের মতাে বােধিচিত্ত অর্জনে বিশ্বাসী ছিল। তবে তাদের প্রক্রিয়া ছিল ভিন্ন। এরা হীনযানীদের শূন্যতত্ত্ব গ্রহণ করে এবং এই শূন্যতা সম্পর্কে পরমজ্ঞান লাভকে তারা নির্বাণ বলে বুঝেছে। শূন্যতার চরম স্তরকে তারা নিরাত্মা নামে অভিহিত করেছে। বজ্রযানীদের মতে সাধকের বােধিচিত্ত যখন নিরস্তিত্ব শূন্যতা বা নিরাত্মায় বিলীন হয়ে যায় তখন তাকে তারা মহাসুখ’ নামে চিহ্নিত করে। বজ্রযানীদের মধ্যে দেহবাদ প্রাধান্য পেয়েছিল। তাদের মতে, নর-নারীর দৈনিক মিলনের ফলে যে পরামানন্দ লাভ হয় তাইই মহাসুখ এবং এর মাধ্যমে উভয়ের মধ্যে যে একাত্মতা ঘটে তাকেই বজ্রযানীরা বােধিচিত্ত বলে উল্লেখ করেছে।
বজ্রযানে দেহমিলনের গুরুত্ব প্রদানের সঙ্গে ইন্দ্রিয় দমনের কথাও বলা হয়েছে। এখানে মৈথুনের মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন আনন্দ লাভই মুখ্য। এই মতে বলা হয় যে মৈথুনজাত আনন্দের মাধ্যমে বােধিচিত্ত জাগ্রত হবে এবং মন্ত্রশক্তি তাকে স্থিতি দেবে। বজ্রযানীরা মৈথুনের আনন্দ থেকে দেব-দেবীর জন্মের কথা বলেছে, যারা সাধনার সর্বশেষ স্তরে সাধককে ইন্দ্রিয় কামনাবাসনা বিবর্জিত একটি পরমজ্ঞান লাভে সহায়তা দান করে। বজ্রযান অত্যন্ত গুহ্য সাধনা এবং এই সাধনার ভাষাও খুব জটিল। গুরু ব্যতিরেকে এই সাধনার কথা অন্য কেউ বােঝাতে সক্ষম নয়। কেবল দীক্ষিতই এই সাধনার মর্ম উপলব্ধি করতে পারেন। বজ্রযানীরা গুরুকে সকলের উপর স্থান দিয়েছে, কারণ গুরুকৃপা ব্যতীত কেউ এই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে পারে না।

সহজযানী

সহজযানী সম্প্রদায় শাস্ত্রাচারসহ অন্যান্য কর্মকাণ্ড অস্বীকার করেছিল। এই সাধনাও দেহবাদী এবং মৈথুনজাত যুগলসাধনা হলেও সহজযানীরা সব আচারঅনুষ্ঠান, দেব-দেবী, মন্ত্র ইত্যাদি পরিত্যাগ করে কেবল দেহহিবুদ্ধ’ অর্থাৎ দেহের মধ্যেই বুদ্ধ বা পরম জ্ঞান-এই চেতনাকে ‘সার’ জেনেছিল। সহজযানীরা বস্তুবাদী ছিল এবং তাদের সাধনা দেহকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতাে। তাদের মতে সম্ভোগের মাধ্যমেই সত্যকে জানা সম্ভব। দেহমিলনের মাধ্যমে যে পরম প্রশান্তি আসে তাতেই ‘আরাধ্য’, যাকে তারা বুদ্ধ নামে অভিহিত করেছে, তিনি অবস্থান করেন। সহজযানীদের মতে দেহের স্বাভাবিক আবেদনকে অস্বীকার করা একধরনের বিকৃতি। তাদের মতে দেহের দাবি পূরণ হলেই আর কোনাে বাধা থাকবে না। এটাই দেহের মুক্তি। তবে দেহের মাধ্যমে পরম আনন্দ লাভ করতে হলে রতিনিরােধ অপরিহার্য এবং গুরুর কৃপায় তা সম্ভব। সহজযানীর শূন্যতাকে প্রকৃতি এবং করুণাকে পুরুষ হিসেবে জেনে নর-নারীর মিলনে যে মহাসুখ লাভ হয় তাকে ধ্রুবসত্য এবং বুদ্ধ বলে জেনেছে। এই অবস্থায় উপনীত হতে পারলে তার আর কোনােকিছুর প্রয়ােজন হয় না। তাই তারা এই অবস্থাকে ‘সহজ অবস্থা বলেছে। এই অবস্থায় উপনীত হতে কোনাে মন্ত্রের বা দেব-দেবীর প্রয়ােজন নেই। সব শাস্ত্রাচার বা আচার-অনুষ্ঠান তাই তার কাছে মূল্যহীন।….

প্রসংগত উল্লেখযােগ্য যে ধর্মের নামে যৌনাচার বাংলাদেশে অষ্টম শতক থেকেই প্রাধান্য লাভ করে আছে। বাৎস্যায়নের কামশাস্ত্রে এ সম্পর্কে উল্লেখ আছে। ধর্ম-কর্ম আচার-অনুষ্ঠানে চর্যাপদের সমকালীন বাংলাদেশে ব্রাহ্মণের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। এই নিরঙ্কুশ ক্ষমতার জন্য ব্রাহ্মণ্যশাসিত সমাজে নানা আনাচার ও নৈতিক অধঃপতনের সৃষ্টি হয়েছিল। বিত্তবানেরা নিজেদের উপভােগের জন্য সমাজের নিম্নশ্রেণী এবং নিম্নবর্ণ থেকে দাসী রাখতেন। ব্রাহ্মণসম্প্রদায়ের লােকেরাও এই যৌনাচারে গা ভাসিয়েছেন চর্যাপদে তার উল্লেখ আছে। “নগর বাহিরে ডােম্বি তােহারি কুড়িআ, ছাই ছােই যাইসি ব্রাহ্মণ নাড়ি আ।” অর্থাৎ নগরের বাইরে ডােম্বি তােমার কুঁড়ে ঘর, ব্রাহ্মণ নেড়াকে তুমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাও। (চর্যা ১০)
সমাজের উচ্চশ্রেণীভুক্ত রাজপুরুষ ও ব্রাহ্মণ্য সমাজ দারিদ্র্যপীড়িত লাঞ্ছিত নিম্নসমাজের রমণীদেরকে ভােগ করেছে। এই নিম্নসমাজের দরিদ্রতার একটি ছবি ফুটে উঠেছে চর্যাপদে :
টালত মাের ঘর নাহি পড়বেষী হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেসী বেঙ্গ সংসার বড় হিল জাজ
দুহিল দুধু কি বেল্টে যামা অ ॥ টিলায় আমার ঘর, প্রতিবেশী নেই, হাঁড়িতে ভাত নেই, নিত্যই ক্ষুধিত। আমার ব্যাঙের সংসার (অযাচিত ক্রমবর্ধমান অসংখ্য সন্তান) বেড়েই চলেছে। দোয়ানাে দুধ আবার বাটে ঢুকে যাচ্ছে (অর্থাৎ যে খাদ্য প্রস্তুত তাও নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছে)। সমগ্র চর্যাপদে এমন অনেক চিত্র রয়েছে যা একদিকে কামাচারিতার উদগ্র প্রকাশ অপরদিকে দারিদ্র্য, ক্ষুধা, শশাষণ, যন্ত্রণা ও মৃত্যুর হাহাকারে সােচ্চার। একদিকে কামাচারিতা ধর্মের অঙ্গ—অপরদিকে সন্তানের জন্মদান দরিদ্রতা ও অসচ্ছলতার কারণ। এরই ফলে হয়তাে কোনােদিন রতিনিরােধের কথা চিন্তা করেছে তকালীন সমাজ এবং ধর্মপতিরা। বীর্যস্থলনকে ‘পাপ’ বলে গণ্য করা হয়েছে। ধাতু সাধনা ধর্ম ও জীবনের সাথে একাত্ম হয়েছে। সহজিয়া সাধনায় এর প্রকাশ লক্ষ করা যায়। ফলে পরিবার হয়েছে ছােট। জন্মনিয়ন্ত্রণ সাধনার অঙ্গ হয়েছে।….

…..সুতরাং এ থেকে স্পষ্ট ধারণা করা যায় যে চৈতন্যদেব অদ্বৈতাচার্য এবং নিত্যানন্দ যে ধর্মপ্রচার করলেন তা মূলত এক এবং এই সাধনা যে শুধু দেহবাদী তাই-ই নয়—এ সাধনা পরকীয়া সাধনাও বটে। বিবৰ্ত্ত বিলাস’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে :
পরকীয়া রতি পরতত্ত্ব সুখ সার তাহার কারণ পঞ্চবাণের আচার ॥ আরােপ করহ সেই মর্ম পরকীয়া । গুহ্যে পরকীয়া তারা কামিনী লইয়া নায়ক নায়িকা দোঁহাকার মর্ম সেই।
নিত্য ধামে বিশুদ্ধ মানুষ যারে কই ॥৮৫ এই পরকীয়া সাধনায় কিশােরী সঙ্গী। কিশােরীর সঙ্গে যে রতিসাধন হয় বাউল তাকে ‘অখণ্ড’ সাধনা বলে থাকে। বিবৰ্ত্ত বিলাস’ গ্রন্থে কিশােরী সাধনা সম্পর্কে উল্লেখ আছে :
কিশােরীর কৃপা বিনে কেবা তাহা যজে তার কৃপা যারে সেই নব বিধি ভজে কৃষ্ণ হইতে শত শত গুণেতে কিশােরী অধিক বাড়ায়ে কি সে দেখহ নির্ধারিত ॥
এই মানুষ ধারার সাধনা নর-নারীর মিলনের মাধ্যমে পরিপূর্ণ রতিনিরােধ সাধনা। বাউল বিশ্বাস করে রতিনিরােধের মাধ্যমে যে মৈথুনক্রিয়া, তা দীর্ঘস্থায়ী হয় বলে প্রেম গভীর হয় এবং তখন উভয়েই পরম প্রশান্তি লাভ করে।
এই স্তরে যে-সাধনার কথা দুদু উল্লেখ করেছেন তা মানুষজন। বৈষ্ণব সহজিয়া একে রাগের ভজন বলে অভিহিত করে থাকে। হাওয়া-দমের সাহায্যে রতিনিরােধ করে যুগলমিলনের মাধ্যমে অধর মানুষ, মনের মানুষ বা সহজ মানুষের স্বরূপতত্ত্ব উপলব্ধি করা যায়। এই রতি মূলত বিন্দু বা বীর্য, যাকে বাউল গুরুধন বা গুরুবস্তু বলেছে—এই বিন্দু বা বীর্য সংরক্ষণ করার নামই বাউলসাধনা ।১৮ বাউলদের রতিনিরােধ সাধনা সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞানলাভের জন্য আমি বেশ কয়েকজন বাউলের সঙ্গে আলাপ করি। তাদের সঙ্গে যে আলােচনা হয় তা নিম্নরূপ :
বাউলসাধনা বায়ু বা হাওয়া ধরার সাধনা। “হাওয়া ধরাে অগ্নি স্থির করাে, মরিলেও বাঁচিতে পারাে”(লালন)। এই সাধনা দেহভিত্তিক যােগক্রিয়ামূলক রতিনিরােধ সাধনা। রতি বা বীর্য (বিন্দু) দেহের অমূল্য সম্পদ। নর-নারীর মিলনে রতিকে নিরােধকল্পে সাধক ‘দম বা হাওয়ার সাধনা করে। অর্থাৎ রতিক্রিয়ার সময় বায়ু নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিন্দু বা বীর্যের স্থৈর্য আনয়ন করা হয়। ফলে বীর্য স্খলন হয় না।

বাউলসাধনায় রতিনিরােধ ও জন্মনিয়ন্ত্রণ
বলেছি, বাউলসাধনা একটি দেহবাদী সাধনা। এর উৎসস্থল প্রজনন (Fertility) এই ধর্মের অঙ্গ বিবেচিত হলেও পরবর্তীকালে যৌনস্বেচ্ছাচার আর্থ-সামাজিক নিপীড়নের কারণ হলে রতিনিরােধ বা জন্মনিয়ন্ত্রণকে ধর্মীয় আচারের অঙ্গীভূত করা হয়। বৌদ্ধ আমলের পূর্বে হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের কালে ব্রাহ্মণদের হাতেই যৌনস্বেচ্ছাচার চরমে ওঠে। ব্রাহ্মণ কর্তৃক ব্যভিচার সংসর্গ-দোষ ছাড়া অন্য কোনাে নৈতিক অপরাধ বলে গণ্য হতাে না। এ সময়ে ধর্মের নামে যৌনাচার অষ্টম শতক থেকে বাংলাদেশে প্রাধান্য পেয়ে আসছে ।৫৪ শুধু ব্রাহ্মণদের হাতেই নয়, রাজসভাতেও যৌনাচার দারুণভাবেই উৎসাহ পেয়েছিল ।৫৫ ব্রাহ্মণদের মতে কোনাে রাজপুরুষ যৌনাপরাধ করলে তেমন কোনাে শাস্তি হয় না। এই যৌন-অনাচারের শিকার হয়ে পড়েছিল সমাজের নিম্নবর্ণের মানুষেরা। অবিচ্ছিন্ন অভাব-দারিদ্র্য এবং শােষণ, অত্যাচার, অবিচারে তাদের জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। এমন সময়ে যৌন-অনাচার ধর্মের অঙ্গ হওয়ায় এসব নিম্নবর্ণের মানুষ উচ্চবর্ণের দ্বারা নিপীড়িত হতাে। মন্দিরে যারা দেবদাসী ছিল তারা আসলে হয়ে পড়েছিল বারবনিতা। তারা উচ্চস্তরের লােকদের যৌন কামনা এবং বাসনা পূরণের সঙ্গিনী হয়ে পড়েছিল।

ধর্মের নামে যৌনাচার যে কীভাবে মানবজীবনকে কলুষিত করেছিল তার একটি বিবরণ পাওয়া যায় নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙ্গালীর ইতিহাস’ গ্রন্থে।৫৭ শারদীয় দুর্গাপূজার সময়ে দশমী তিথিতে শারদোৎসব’ নামে এই উৎসব সমাজে প্রচলিত ছিল। এই উৎসবের সময় গ্রামে নগরে নরনারী সামান্য গাছের পাতার পােশাক পরিধান করে গায়ে কাদা পাক ইত্যাদি মেখে নানারকম যৌন-অনাচারে লিপ্ত হতাে। এরকম না করা হলে দেবীদুর্গা তুষ্ট হবেন না এবং তার মুখ উৎফুল্ল হবে না এমন বিশ্বাস ছিল এবং এ সম্পর্কে ধর্মীয় গ্রন্থ বৃহদ্ধর্ম পুরাণে নির্দেশ ছিল। বসন্তকালে হােলি উৎসবেও এ ধরনের যৌনাচার যে সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছিল, তার বিবরণ রয়েছে জীমূতবাহনের ‘কাল বিবেক’ গ্রন্থে। সমাজে প্রচলিত এই
কুৎসিত যৌনাচারের অনেক চিত্র ধর্মীয় গ্রন্থেও পাওয়া যায়। প্রমথনাথ বসু মহাভারতের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন :
The following extracts from the Harivamsa describing a sea side picnic given by Krishna hardly require any comment : Having thus issued his order to the sea, he (Krishna) commenced to play with Arjuna while Satyabhama, incited by a wink of Krishna, began to throw water on Narada. Then Balarama, tottering with drink with great glee fell into the water, and beckoning the charming daughter of Revata by his side, took her by the hand. The sons of Krishna and the leading Bhaimas, who belonged to the party of Rama, joyous and bent on pleasure, unmindful of their dresses and ornaments, and excited by drink, followed him to the sea. The Bhaimas belonging to the party of Krishna headed by Nishatha and Ulmuka, arrayed in many coloured garments, and rich jewels and bedecked with garlands of Parijata flowers, with bodies painted with sandal wood paste and unguents, excited by wine and carrying aquatic musical instruments in their hands, began to sing songs appropriate for the occasion. By order of Krishna, hundreds of courtesans, led by the heavenly Apsarases played various pleasing tunes on water and other instruments. Krishna and Narada with all those who were on their side, began to pelt water on Bala and his Party; and they in their turn did the same on the party of Krishna. The wives of Bala and Krishna, excited by libations of arrack (a strong spitituous liquor) followed their example, and squirted water in great glee with syringes in their hands. Some of the Bhaima ladies, over-weighted by the load both of love and wine, with crimson eyes and masculine garbes, entertained
themselves before the other ladies, squirting water. সমাজজীবনে এ যৌন-আনাচার বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ তাঁদের রচিত চর্যাগীতিকায়ও বর্ণনা দিয়েছেন ।
এক সে শুণ্ডিনি দুই ঘরে সান্ধ অ চীঅণ বাকল অ বারুণী আন্ধ অ।
সহজে থির করি বারুণী বান্ধ। জেঁ অজরামর হােই দিঢ় কান্ধ ॥ দশমি দুআরত চিহ্ন দেখই আ। আইল গরাহক আপণে বসিয়া ॥ চউশঠী ঘড়িয়ে দেত পসারা। পইঠেল গরাহক নাহি নিরাসা ॥
এ ঘড়রী সরুই নাল
ভণন্তি বিরু আ থিল করি চাল ॥ অর্থ : এক শুড়িনী দুই ঘরে ঢােকে। সে চিকন বাকল দিয়ে বারুণী মদ বাঁধে। সহজ পথে স্থির হয়ে বারুণীতে প্রবেশ কর। দৃঢ় স্কন্ধ লাভ করে অজর অমর হও। দশমী দুয়ারে চিহ্ন দেখে গ্রাহক নিজেই সেই পথ বেয়ে উঁড়ির দোকানে আসে। চৌষট্টি ঘড়ায় মদ ঢালা হয়েছে। গ্রাহক ঘরে ঢুকল, তার আর সাড়াশব্দ নেই অর্থাৎ মদের নেশায় সে এমনিই বিভাের। সরু নাল দিয়ে একটা ঘড়ায় মদ ঢালা হচ্ছে, বিরূপা সাবধান করে দিচ্ছেন, সরু নাল দিয়ে চিত্ত স্থির করে মদ ঢালাে।

পদটিতে যৌনক্রিয়া সম্বলিত দেহভিত্তিক রতিনিরােধমূলক আচরণের ইঙ্গিত রয়েছে। এখানে ‘দশমী দুয়ার’ বলতে রতিনিরােধজনিত চিহ্ন, সরুনাল—পুরুষাঙ্গ; ‘চৌষট্টি ঘড়া’—দেহের চৌষট্টি প্রকার নাড়ি, মদ’ অর্থে রতিকর্ম বুঝানাে হয়েছে। রতিক্রিয়ায় উত্তেজিত না হয়ে ধীরে ধীরে চিত্ত শান্ত রেখে মৈথুনে লিপ্ত হবার জন্য বিরূপা তার শিষ্যকে নির্দেশ দিচ্ছেন। তাঁর নির্দেশ অনুসরণ করলে সে ‘সহজ লাভে অজর, অমর হতে পারে।
বলেছি, তৎকালীন ব্রাহ্মণ্যশাসিত সমাজে নানা কদাচার ও নৈতিক অধঃপতনের জন্ম হয়েছিল। কাম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য বিত্তবানদের ঘরে দাসী রাখা হতাে। অষ্টম শতকের পূর্ব থেকেই ব্রাহ্মণ্য আমলে যৌনাচার ধর্মে স্বীকৃতি পাবার পর থেকে রতিনিরােধ সাধনাও গুরুত্ব পেয়েছিল। সহজিয়া বৌদ্ধদের মতাে তৎকালীন অন্যান্য বৌদ্ধসমাজেও রতিনিরােধ সাধনা অনুসরিত হচ্ছিল।….

….এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, এই রতিনিরােধ কিংবা জন্মনিয়ন্ত্রণের সাধনায় সহজিয়া সাধনার মতাে বাউলেরা কখনও কোনাে ওষুধ বা গাছগাছড়ার আশ্রয় নেয়নি। দেহের বিভিন্ন নাড়ি ইত্যাদির মাধ্যমে তারা এই নিয়ন্ত্রণক্ষমতা অর্জন করেছে। তাদের এই পদ্ধতিকে আমরা বাউলপদ্ধতি হিসেবে চিহ্নিত করব। একে প্রাকৃতিক পদ্ধতিও বলা যেতে পারে। কারণ প্রকৃতিগতভাবে বাউলসাধক এই জ্ঞানলাভ করেছে। সাধন-ভজনের সংজ্ঞায় প্রকৃতির অপর অর্থ নারী।
বলেছি, দেহসাধনায় নারীই প্রধান। এই নারীকে বাউল ‘চেতন গুরু’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কারণ দেহসাধনায় এই নারীর হাতেই মূল চাবিকাঠি। নারীকে বাউলের সাধনসঙ্গিনী এবং সেবাদাসী হিসেবেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। প্রতিমাসে নারীর মাসিক হয় এবং তার পরপরই অর্থাৎ মাসিক শেষ হবার পর ডিম্বস্ফোটনের কাল। লােকমুখে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, প্রতি গাছে ফুল ফোটে কিন্তু প্রতি ফুলে ফল হয় না। তেমনি নারীদের ডিম্বাণুরূপী ফুল যে সবসময়ে ফল বা সন্তানসম্ভাবনা হবে এমন নয়। পুরুষের বীর্যকে সূর্য বা রতি এবং নারীর ডিম্বাণুকে শশী বা চন্দ্র নামে অভিহিত করা হয়। নারীর ঋতুমতী কাল বা মাসিক পরীক্ষা করে বাউলসাধক ডিম্বাণুর ক্ষমতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়। নারীর ঋতুমতী কালকে বাউলসাধনায় অমাবস্যা, যােগ, মহাযােগ, শুভযােগ ইত্যাদি নামেও চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।….

….এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, নারীদেহে যােনিপথে মাসিক শেষে তিনদিন জরায়ু মুখ থেকে একপ্রকার জলীয় পদার্থ, কখনও পরিষ্কার কখনও-বা ঘােলাটে, পিচ্ছিল শ্লেষ্মপাত হতে থাকে এবং সর্বশেষ দিনে ডিম্বস্ফোটন বা অ্যুলেশন হয়ে থাকে। এই ডিম্বের জীবনীশক্তি মাত্র ২৪ ঘণ্টা। কিন্তু যােনিপথে যে শ্লেষ্মজাতীয় পদার্থ বের হয় তার উর্বরতা ডিমের জীবনীশক্তির উপর নির্ভর করে। অর্থাৎ যােনিপথ শ্লেষ্মর কারণে ভিজা থাকলে সন্তান সম্ভাবনা অনেকটা নিশ্চিত। সাধারণত মাসিক শেষ হবার পর তিনদিন পর্যন্ত এই সম্ভাবনা থাকে। যােনিপথ শুষ্ক থাকলে এই সম্ভাবনা একেবারেই কম। অর্থাৎ এই সময় দৈহিক মিলন ঘটালে শুক্রকীট শীঘ মারা যায়। এই শুক্রকীটকে বাউলগানে মীন বা মাছের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।….

….এই ত্রিবেণীর (অর্থাৎ স্ত্রীজননাঙ্গ) ধারে মীনরূপী সঁই-এর আনাগােনা হয়। মাসিক শেষ হবার পর তিনদিন ধরে যখন স্ত্রীযােনিপথে শ্লেষ্মজাতীয় পদার্থ নির্গত হয় তখন স্ত্রীডিম্বকোষ থেকে ডিম ফেটে বেরিয়ে যােনিপথে আসে। এই সময় যােনিপথে শেষ্যজাতীয় পদার্থ থাকলে এবং তখন দৈহিক মিলন ঘটলে শুক্রকীট ডিম্বের সাথে মিশে গেলে স্ত্রী সন্তানসম্ভাবা হয়ে থাকে। যােনিপথ শুষ্ক থাকলে সন্তানসম্ভাবনা থাকে না। বাউলসাধনায় এই প্রক্রিয়াকে নানাভাবে গানে ব্যক্ত করা হয়েছে :
তিনদিনের তিন মর্ম জেনে রসিক সাধনে ধরে তা একই দিনে ॥
(লালন) বাউলসাধকের কাছে সাঁই-এর আবির্ভাব পূর্ণচন্দ্রের ন্যায়। এই পূর্ণচন্দ্রই তার সাধনার ধন। এই পূর্ণচন্দ্রের আবির্ভাবকাল নির্ণয়ই বাউলের সাধনা। এই চন্দ্র নির্ণয়ে সাধক কয়েকটি বিশেষ ধারা অনুসরণ করে। প্রথমত, মাসিক শেষ হবার পর থেকে তিনদিন সাধক স্ত্রীর যােনিপথে নির্গত ধারা পরীক্ষা করে থাকে। একটি পরিষ্কার সাদা কাপড়ে এই রস পরীক্ষা করা হয়। তবে শ্লেষ্মজনিত পদার্থ যা এ সময়ে স্ত্রীযােনিপথে নির্গত হয়ে থাকে তা কখনও ঘােলাটে, কখনও স্বচ্ছ এবং পিচ্ছিল হয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত, সাধক এই রসের স্বাদ নির্ণয় করে। এই স্বাদ তিন প্রকার : তিতাে বা পানসে, ঈষৎ নােন্তা এবং মিষ্টি। যে রসের ধারা মিষ্টি তা মধুতুল্য। এই রসের ধারা স্বচ্ছ বা পরিষ্কার এবং পিচ্ছিল এবং যা দেখতে অখণ্ড রূপ এবং যার দ্বাণ পদ্ম বা চন্দনতুল্য তাতে সুসন্তান বা ত্রুটিমুক্ত সন্তানসম্ভাবনা থাকে। এই ধারাকে বাউল সাই-এর আগমনের ধারা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

এই সময় স্ত্রী বিশেষভাবে কামনাপীড়িত হয় এবং মানসিকভাবে অস্থির থাকে। তার মধ্যে কখনও আবেগ এবং কখনও বিষাদ কাজ করে। শরীর থেকে সুগন্ধজাতীয় ঘ্রাণও বের হয়।
প্রসংগত উল্লেখযােগ্য, বাউলসাধনা এক অর্থে অখণ্ড সাধনা। অর্থাৎ যে নারী কুমারী এবং সন্তানবতী হয়নি তাকে নিয়ে বাউলদের মূল সাধনা। নারীর প্রথম ঋতুকালীন অবস্থা শেষ হবার পর যে রস নিঃসৃত হয় তাকে বাউলেরা ‘শাস্তু রস’ বলে গণ্য করে এবং তা পান করে থাকে। এই পানের যৌক্তিকতা সম্পর্কে তারা বলে যে, এই পানে তাদের বিন্দুর যেমন স্থৈর্য ঘটে, তেমনি তারা জরা ব্যাধি ইত্যাদির হাত থেকেও মুক্ত হয়। এর পরের সাধনা উল্টা সাধনা। অর্থাৎ পূর্ণচন্দ্রের আগমনে সাধক যখন নারীর সাথে মিলিত হয় তখন যােগ প্রক্রিয়ায় শ্বাস-প্রশ্বাসকে উর্ধ্বগতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এই প্রক্রিয়ায় সাধক কারুণ্য, তারুণ্য এবং লাবণ্য রস আস্বাদন করে। কারুণ্যরস সাধনার প্রথমাবস্থায় রতিকে উর্ধ্বে অর্থাৎ ইড়া নাড়ির মাধ্যমে মস্তিষ্কে চালনা শিক্ষা করতে হয়। এই সাধনায় সিদ্ধিলাভ হলে সাধক তারুণ্য প্রেমের তারুণ্যরূপ অমৃতধারা সিক্ত হয়। এই সাধনা এক অর্থে বিন্দুর অটল অবস্থার সাধনা।
দ্বিতীয় রস সাধনার নাম তারুণ্য। সাধক বিন্দুধারণে সমর্থ হলে প্রয়ােজন মতে বিন্দুকে ঊর্ধ্বে উত্তোলন এবং পিঙ্গলা নাড়ির সহায়তায় নিম্নে আনয়নের সাধনা করেন। স্নায়ুপথে নিম্নে আগমনের কালে, জোয়ারের জলের মতাে প্রবাহ পায় বলে এই রসধারাকে তারুণ্যরস বলা হয়।
তৃতীয় রসসাধনার নাম লাবণ্য। এই সাধনায় সাধক ইচ্ছামতাে ইড়া, পিঙ্গলা এবং সুষুম্নপথে বিন্দুকে পরিচালিত করতে সমর্থ হয়। এই অবস্থা সাধকের জন্য মহানন্দের অবস্থা। অনেক সময় প্রকৃতি সংগম না করেও সাধক এই অবস্থা লাভ করতে সক্ষম হন। এই রসসাধনায় শরীরমন পুলকিত থাকে বলে এই রসসাধনার নাম লাবণ্য নামে চিহ্নিত করা হয়। এই কারুণ্য, তারুণ্য এবং লাবণ্য রসসাধনার অপর নাম প্রবর্ত, সিদ্ধ, সাধক।….

…..

শ্বাস-নিয়ন্ত্রণ ও ৮ ইঞ্চি পদ্ধতি

বাউলসাধনা যুগলসাধনা। এ সাধনায় নারীই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কখন কোন সময় ডিম্বাশয় থেকে ডিম্ব নির্গত হয় এবং ডিম্ব নিঃসরণের সময় নারীর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা কেমন হয়—তা নারীর অজানা নয়। কিন্তু পাড়াগাঁয়ের কোনাে বিবাহিত মেয়ে এ বিষয়ে সচেতন না থাকার কারণে সাধারণত কোনাে সতর্কতা অবলম্বন করে না। কারণ স্বামীর ইচ্ছা তার কাছে বড়। স্বামী আনন্দ চায় তাকে আনন্দ দিতে হবে। তা না হলে তার কপাল মন্দ।
বাউলসাধনায় অংশগ্রহণকারী মহিলা বা সেবাদাসী এ বিষয়ে তার যা যা করণীয় সবকিছুই গুরু কর্তৃক নির্দেশিত হয়। মহিলাদের যে মাসিক বা ঋতুকাল হয় তা সকলের সমান নয়। কারাে ২৬, ২৮ কিংবা ৩২ দিনেও ঋতুকাল শুরু হয়। এই ঋতুকাল ৭, ৫, ৩ দিন পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। গুরুর নির্দেশ অনুসারে সাধক ও সাধিকা রতিনিরােধ কিংবা জন্মনিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়। ঋতুকাল শেষ হলে নারীর উর্বরকাল শুরু হয়। এই উর্বরকাল তিনদিন স্থায়ী থাকে। এই তিনদিনকে সাধক-সাধিকারা নারীযােনিপথে বা স্ত্রীযৌনাঙ্গে সাঁই-এর আবির্ভাবকাল বলে জ নে। এখানে সাঁই ডিম্বরূপী। এই সময়কালকে ডিম্বস্ফোটন ও তা নিঃসরণের কাল বলা হয়। সাধিকা পূর্বাহ্নে শারীরিক কোনাে পরিবর্তন এলে তা টের পেয়ে থাকে এবং সে মতে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ইতঃপূর্বে রতিনিরােধ এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্বন্ধে আলােচনায় তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে এবং ফারাজির বক্তব্যের সঙ্গে মিল থাকায় এখানে তার পুনরুল্লেখ করা হলাে না। | বাউলেরা জানে : “যা আছে ভাণ্ডে তা আছে ব্রহ্মাণ্ডে।” মানবদেহের কার্যক্রমের সঙ্গে বহির্জগৎ বা প্রকৃতিরও কার্যক্রম একই নিয়মে সংঘটিত হয়। বর্ষাকালে প্রকৃতি রজঃশীলা হয়। চন্দ্রের উদয়-অস্তকালের মতাে নারীর দেহেও চন্দ্রের উদয় ও অস্তকাল আছে। একে শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষ বলা হয়ে থাকে। ফারাজির মতে নর-নারীর মধ্যে কামভাব আছে এবং কাম না থাকলে প্রেম, ভালােবাসা এবং সৃষ্টি সম্ভব হতাে না। তিনি এই কামভাবকে ‘চন্দ্র’ নামে অভিহিত করে তার উদয় ও অস্তকালকে শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষ নামে অভিহিত করেন। নারীদেহে কামভাব বাম অঙ্গ দিয়ে ওঠে এবং ডান অঙ্গ দিয়ে নামে। পুরুষ দেহে ডান অঙ্গ দিয়ে ওঠে এবং বাম অঙ্গ দিয়ে নামে। তিনি মানবদেহকে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ হিসেবে ভাগ করে জানালেন যে দেহের মস্তক এই সাধনার ঊর্ধ্বদেশ এবং পশ্চিমদেহের নিম্নদেশে; স্ত্রী এবং জননাঙ্গ এমনিভাবে দেহের বামে উত্তর এবং ডানে দক্ষিণ। বাউলসাধনায় ঈশান কোণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঈশান কোণের অবস্থান উত্তর-পশ্চিম কোণে যেখানে হৃৎপিণ্ডের অবস্থান। প্রাণবায়ুর মাধ্যমে হৃৎপিণ্ড এবং দেহের অভ্যন্তরে হাজার হাজার নাড়ি সচল হয়। দেহের মূল নাড়ি তিনটি : ইড়া, সুষুম্না ও পিঙ্গলা। মেরুদণ্ডকে সুষুম্না নাড়ি বলা হয়। দেহে বহির্জগতের মতাে চন্দ্র-সূর্যের অবস্থান রয়েছে। পুরুষ সূর্যের প্রতীক। পুরুষের বীর্য যা আরতিতুল্য তাকে সাধকদের ভাষায় কখনও ‘চন্দ্র’ কখনও ‘সূর্য’ বলা হয়ে থাকে। বাউলসাধনায় কখনও কখনও পুরুষ এবং নারী উভয়কেই ‘চাদ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। যেমন : “চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে (লালন)।” বাউল সাধনায় ‘মণি’ এবং ডিম্ব উভয়ের অবস্থান মস্তকের শীর্ষদেশে। লালনের গানে আছে—
বলব কি সেই পড়শীর কথা তার হস্তপদ স্কন্ধ মাথা নাই রে ॥ সে ক্ষ্যাণেক থাকে শূন্যের উপর
ক্ষ্যাণেক থাকে নীরে ॥ রতিনিরােধে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ অবশ্যকর্তব্য। বাউলসাধক এ বিষয়ে অভ্যস্ত। এই নিয়ন্ত্রণ গুরুর নিকট থেকেই শিখতে হয়। যৌনমিলনের সময় কোন নাসারন্ধ্রে শ্বাস প্রবাহিত হয় সে-সম্বন্ধে বাউল সচেতন থাকে। সাধারণত পুরুষের ডান নাসারন্ধ্রে শ্বাস সহজভাবে প্রবাহিত হলে তা মিলনের যথার্থ সময়। এই সময় মেয়েদের বাম নাসারন্ধ্রে শ্বাস প্রবাহিত হতে হবে। যদি ডান নাক দিয়ে শ্বাস প্রবাহিত না হয়, তবে বিশেষ কৌশলে ডান নাকে শ্বাস প্রবাহিত করতে হবে। বীর্যপাতের সম্ভাবনা থাকলে উভয়ে নিজেদের শরীর অচঞ্চল রাখবে এবং শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ রাখবে। পুরুষ তার গুহ্যদ্বার সংকুচিত রাখবে। এর ফলে বীর্যপাত হবে না। এমনিভাবে দীর্ঘক্ষণ এই কৌশল ব্যবহার করা যাবে এবং বীর্যপাত হবে না। খােজা ফারাজি বলেন, অতঃপর ‘আজল’-এর নিয়মে তারা স্ত্রীজননাঙ্গের উপরিভাগে অর্থাৎ ৮ ইঞ্চি জননাঙ্গের ৪ ইঞ্চি উপরে নিরাপদ স্থানে বীর্যপাত ঘটায়। সাধকদের অনেকেই এই বীর্য পান করে থাকে।
বাউলদের মতে নারীযােনির গভীরতা গড়ে আট ইঞ্চি বা আট আঙুল। তাদের ধারণায় বীর্যপাত অত্যন্ত গভীরে না হলে আট ইঞ্চির উপরিভাগে চার ইঞ্চি পরিমিত স্থানে নিক্ষিপ্ত হলে সন্তানসম্ভাবনা কম থাকে। তবে বীর্যপাতের সঙ্গে সঙ্গে নারী উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে এবং কৃত্রিম উপায়ে জোরে হাঁচি দেয়। অতঃপর ঠাণ্ডাপানিতে সে স্থান ধৌত করে। ফলে বীর্য যােনি-অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে না। বাউলেরা রতিনিরােধে দৈহিক প্রক্রিয়ায় স্ত্রীর কামচেতনাকে নিবৃত্ত করে, দীর্ঘক্ষণ শৃঙ্গার বা কামক্রীড়ার মাধ্যমে তারা মিলিত হয় এবং এতে সহজে বীর্যপাত হয় না। একে স্থানীয়ভাবে সাপখেলানাে বলা হয়ে থাকে।

পশ্চিম বাংলার বাউল

পশ্চিম বাংলার বাউলদের মধ্যে আমি রতিনিরােধ সাধনার প্রচলন দেখেছি। মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান-বীরভূম ও নদীয়া জেলার মুসলমান নামধারী বাউলেরা সরাসরি বৈষ্ণব-সহজিয়াপন্থী বাউল। এরা তাদের সাধনায় সহজিয়া প্রদর্শিত দেহমিলনে অভ্যস্ত। এরা বাৎস্যয়নের কামশাস্ত্র ও অন্য দেশজ রতিশাস্ত্র অনুসারে দেহসাধনা করে থাকে। সম্প্রতি প্রকাশিত শক্তিনাথ ঝা বিরচিত ‘বস্তুবাদী বাউল’ গ্রন্থে মুসলিম বাউলদের দেহসাধনা ভিত্তিক সাধনপ্রণালীর যে বিবরণ দেওয়া হয়েছে তা পরিপূর্ণ কাম-সাধনা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ সাধনা অনেকাংশেই বিকৃত। এরা সুফি সাধনার পরিবর্তে সহজিয়া সাধনাকেই গুরুত্ব দিয়েছে। বিভিন্ন সহজিয়া পুঁথিতে দেহসাধনার যে কর্মকাণ্ড রয়েছে তাকেই তারা অনুসরণ করেছে। সম্প্রতি বিশ্বভারতীতে অবস্থানকালে জয়দেবের বাউল মেলা এবং কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে সতীমায়ের ধামে সাধুদের সাথে আলাপ করেছি। ইতঃপূর্বে বহু বাউলের সঙ্গেও আমার আলাপ হয়েছে এবং তাদের সাধনপ্রণালী সম্পর্কে অবগত হয়েছি। এরা সহজিয়াভিত্তিক সাধনপ্রণালীতে মুসলিম ধর্মীয়ভাব ভাষা ব্যবহার করেছে। শক্তিনাথ ঝ৮৩ তাঁর গ্রন্থে পশ্চিম বাংলার মুসলিম বাউলসাধকদের সাধনপ্রণালী উল্লেখ করেছেন। যেমন : “দেহমিলনের আগে সাধক-সাধিকা পরস্পরের দেহকে পূজা করবে। সাধক নারীদের পাঁচটি স্থান স্পর্শ করে সেখানে ‘সেজদা’ দেবে। প্রথম পায়ে প্রণাম। সেজদার মন্ত্র গুরু সত্য, মা সত্য, মার নামে জয় হােক। আমার মনের বাঞ্ছা পূর্ণ হােক। মা তুমি গতি তুমি রতি তুমি জীবের নিস্তারণ, আমার মনােবাঞ্ছা পূর্ণ কর খাদেম মােক্তারগণ সেজদা দিলাম এখানে, সেজদা যায় মা বরকতের চরণে এই সেজদা মূল, এই সেজদা কবুল কর আল্লা মহম্মদ রসুল। দ্বিতীয় সেজদা মক্কায় (জন্মস্থানে); মন্ত্র— খাতনে মা জিন্নাত জহুর হুশিয়ার দিনহীনকে দ্বীন দিয়ে কর মা উদ্ধার। ও মা বরকত দাউনদার। এই কাবাতে মারিফাতে আল্লাহহা আকবার ॥ আল্লাওলি মহম্মদ কলি মা বরকত দাউনদার এই কাবাতে মারিফাতে নিষ্ঠা করে সেজদা করি আল্লাহহা আকরব ॥
আল্লা বীজ মহম্মদ ডাল মাদার নাথ আমার বাঞ্ছা পূর্ণ কর দীননাথ। শক্তিনাথ ঝা তাঁর গ্রন্থে জনৈক গুরু আদম আলি বিশ্বাসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, “গুরু আদম আলি বিশ্বাস, তাঁর গ্রন্থে বাউল তত্ত্বকে সৃষ্টি ব্রেক’ শিক্ষা বলে, বস্তু রক্ষার প্রাথমিক সাধনা ব্যাখ্যা করেছেন। ১. মাতৃস্থান প্রণামপূর্বক দেহমিলন শুরু করবে ২. বাম নাকে বা উভয় নাকে নিশ্বাস বহন-কাল মিলনের পক্ষে প্রশস্ত ৩, মিলন শুরু করার আগে ঠাণ্ডাজল খাবে এবং অঙ্গসিক্ত করবে ৪, শৃঙ্গার করবে, মুখেও শৃঙ্গার করবে ৫. মিলনকালে নাভির নিচে যেন মন না যায় ৬. পরস্পরের
চোখের মণির দিকে অপলক দৃষ্টিতে থাকিয়ে থাকবে। নারী এবং পুরুষ পরস্পরের মধ্যে গুরুরূপকে আরােপ করে নিহার করতে থাকবে। এই গুরু বর্জোখ, কামনিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। মন সেখানে আবিষ্ট থাকে। ৭. শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে মিলিয়ে দেহমিলন চালিত হবে। ৮. স্থলন আসন্ন হলে ঠাণ্ডাজলে অঙ্গসিক্ত করবে। (অনেকে এ জল পান করে)।
নারী জিহ্বার মাঝে কামড় দিয়ে রাখলে বস্তু স্খলিত হয় না। স্বস্থানে ফিরে যায়। দেহমিলনে ডান নাকে নিশ্বাস গেলে হয় নিশ্বাস বদলে নিতে হবে অথবা মিলন বন্ধ করতে হবে। গুরু প্রদত্ত মন্ত্র মনে মনে জপ করতে হয় মিলনকালে। স্থলনের সম্ভাবনায় মিলন বন্ধ রেখে, ডান নাক বন্ধ করে বাম নাসায় মূলাধার থেকে টেনে নিশ্বাস তুলতে হবে উপরে, মুখ দিয়ে বা নাক দিয়ে ধীরে রেচক করতে হবে। “দুই আঙ্গুল হটিয়া গুহ্যদ্বার জড়ত্ব করিয়া নিচ হইতে দোমবায় উঠাইবে ও নাভিমূলের দক্ষিণদিকে বাঁকাইয়া দোমবায়ু উঠানাের অভ্যাস করিতে হয়।” আদম আলি এই পদ্ধতিকে ‘হপিং’ করা বলেছেন। অতঃপর সর্বশেষে ব্যবহৃত মন্ত্রের একাংশ : ‘আল্লাহ মহম্মদের দোহাই তােমাকে, টলিতে নাই থাক, থাক মন্ত্র নিজ ঠাই, আল্লা মহম্মদের দোহাই তােমাকে টলিতে নাই।”৮৫ | শক্তিনাথ ঝা তাঁর গ্রন্থে হঠযােগ সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, বাউল সাধকদের মধ্যে নদীয়া জেলার কানাইনগরের ইমান আলী লিঙ্গমুখে দুধ বা জল পান করতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি ইমানের গুরু জনাব পণ্ডিতের (হরিহরপাড়া, স্বরূপনগর, মুর্শিদাবাদ) গুপ্ত কচ্ছপসাধনার কথা উল্লেখ করেন। জনাব পণ্ডিতের মতে এই সাধনায় ক্রমাগত অভ্যাসে সাধক লিঙ্গকে শরীরের অভ্যন্তরে ঢােকাতে ও বের করতে সক্ষম হয়। এতে প্রয়ােজনে কামােত্তেজনা দমন করা সম্ভব।
দীর্ঘকাল লালন একাডেমির পরিচালক থাকাকালে এ ধরনের অনেক বাউলের সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। এদের মধ্যে একজন বালতিভর্তি পানি লিঙ্গনালে সম্পূর্ণ শশাধন করতে পারতেন। তবে এমন বাউল আর দেখা যায় না এদেশে। হিন্দুধর্মে যৌনাচার বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত। বিভিন্ন মন্দিরের গাত্রে এসবের পরিচয় নানা চিত্রপটে উৎকীর্ণ। কোণার্ক, ইলােরা, অজন্তা সর্বত্রে এসবের ছড়াছড়ি। বাংলাদেশ মুসলিমপ্রধান হওয়ায় দেহবাদ ও যৌনাচারমূলক সাধনা একেবারেই হ্রাস পেয়েছে। বাউলদের মধ্যে এখনও যতটুকু আছে, তা একেবারে গুপ্ত। এরই মধ্যে সুফিসাধনায় এসবের পরিচয় পাওয়া যায়। বাংলা ভাষায় রচিত সুফিদের নানা পুঁথিতে দেহভিত্তিক সাধনার বিবরণ আছে।