প্রেম-রঙ্গ – শ্রী প্রেমদাস ভিখারী

›› দুস্প্রাপ্য বই  ›› সম্পুর্ণ বই  

প্রেম লহরীর প্রেমরঙ্গ দ্বিতীয় ভাগ।

ইহাতে প্রেমের নানা প্রসঙ্গ, নানা রঙ্গ, নানা বিকাশও সেই সঙ্গে সঙ্গে মানব মানবীর সন্মিলনার্থে প্রেম সম্বন্ধীয় নানা কাৰ্য্য বর্ণিত হইয়াছে। ইহাতে পাঠকগণ অনেক বিষয় নূতন দেখিবেন। যদিও বিষয়টা নূতন নহে,—এ ভারতবর্ষে প্রেমের চূড়ান্ত বর্ণনা হইয়া . গিয়াছে,—তথাপি এপর্যন্ত এরূপ প্রেমের কথা এরূপ ভাবে কখনও লিখিত হয় নাই। সংসারী মাত্রেই বিবাহিত,—কিন্তু অনেক সময়ে দম্পতিযুগল পরস্পর পরস্পরের সহিত কিরূপ ব্যবহার করিবেন, কখন কিরূপ আচরণ করিবেন এবং কিরূপ কার্য্য করিলেই বা প্রেমের উৎকর্ষ সাধন হয়, এ সকল অবগত না থাকায় বিবাহে সুথের পরিবর্তে গরণের উদয় হয়। প্রেম জন্মিলে প্রেমের কিরূপ ব্যবহার করিতে হয়, তাহা না জানিলে কখনই প্রেম স্থায়ী হয় না এবং প্রেমে সুখের উদয় না। এই পুস্তকে প্রেমের ব্যবহার কিরূপে করিতে হইবে, তাহাই যথাযথ লিখিত হইয়াছে। এই পুস্তক পাঠ করিয়া যদি বঙ্গগৃহে বিবাহ হইতে সুখের উদয় হয়, তবেই আমাদের সকল পরিশ্রম সাৰ্থক হইবে।

শ্রীনকুমার দত্ত
প্রকাশক

 

প্রথম পরিচ্ছেদ

প্রেমের আবির্ভাব

প্ৰেমলাভ কঠিন নহে। এ সংসারে কিছুই লাভ করা কাহারও পক্ষে কঠিন নহে; কিন্তু সকলই রাখা কঠিন। অর্থলাভ অনেকেই করে ও করিতে পারে, কিন্তু কয়জন অর্থ রাখিতে সক্ষম হয়? যৌবনের প্রারম্ভে প্রস্ফুটিত সুখপুষ্পের ন্যায় ধীরে ধাঁরে প্রেম, মানব হৃদয়ে প্রস্ফুটিত হইতে থাকে; তুমি ভাল বাসিতে চাহ আর নাই চাহ, তোমার মন, তোমার হৃদয়, তোমার অজ্ঞাতসারে অপরকে ভাল বাসিতে চাহে, হয়তো তোমার অজ্ঞাতসারে ভালবাসিয়া বইসে।
কিন্তু ভালবাসা রমণীর প্রতিই আক্কষ্ট হয়। পিতা মাতা, ভাই ভগিনী সকলকেই সকলেতো ভালবাসে, কিন্তু এ ভালবাসা ও যৌবনসুলভ ভালবাসায় একটু বিশেষ প্রভেদ আছে। ভক্তি স্নেহ ইত্যাদি ভালবাসার সহিত শরীরের বা পার্থিব বিষয়ের কোন সম্বন্ধ নাই। জননী কুরূপা হউন, আর সুরূপা হউন, ভাল হউন আর মন্দ হউন, সন্তানের ভালবাসা জননীর প্রতি আপনিই হয়; ইহা শিক্ষায় বৃদ্ধি পায় না; বা পৃথিবীর কোন বাহ্যিক ভাবে, বা প্রকৃতির কোন সৌন্দর্য্যে ইহার বৃদ্ধি এবং অসৌন্দর্য্য লক্ষ্য ঘটে না; কিন্তু প্রেমের স্বভাব সেরূপ নহে; প্ৰেম স্বভাবতঃ জন্মে না। প্রেমের আবির্ভাব বিনা কারণে হয় না।
হয় সৌন্দৰ্য হইতে, নয় কোন মানসিক গুণ হইতে, নয় কৃতজ্ঞতা হইতে, এইরূপ কোন না কোন কারণ বশতঃই প্রেম জন্মে। প্রেমের এই পার্থিব ভাব দেখানই উপন্যাসের উদ্দেশ্য, এবং এই জন্যই সাহিত্য জগতে উপন্যাসের সৃষ্টি। কেহ কাহারও উপকার করিলে স্বভাবতই তাহার দিকে মন আকৃষ্ট হয়, বিশেষতঃ কোমল-হৃদয়া রমণী জাতি কোন পুরুষ কর্তৃক উপকৃত হইলে, সহজে তাহাকে ভুলিতে পারে না। কেননা আপনা আপনিই তাহার প্রতি হৃদয় আকৃষ্ট হয়।
কিন্তু কৃতজ্ঞতার জন্য বা মানসিক গুণ দেখিয়া কয় জন লোকে কয়জনকে ভাল বাসে? কয়জনেরই বা দোষ গুণ দেখি- বার সুবিধা ঘটে? এই জন্য আমরা দেখি যৌবনে প্রেমের কারণই সৌন্দর্য্য। সৌন্দর্য্যে বিমুগ্ধ হইয়াই, সাধারণতঃ প্রেমের উৎপত্তি হয়। তাহাহইলে বলিতে হয়, সৌন্দর্য্যই প্রেমের আবির্ভাবের মুখ্যতম কারণ ৷
কিন্তু সৌন্দৰ্যতো একটা নির্দ্দিষ্ট বিষয় নহে। সৌন্দর্য্যের একটাতো নিয়ম নাই। তুমি যাহাকে সুন্দর বল, আমিতো তাহাকে সুন্দর বলি না। তুমি যাহাকে দেখিয়া বিমুগ্ধ হইয়াছ, আমার যে তাহাকে দেখিলে হৃদয়ে স্বণার উদ্রেক হয়! সুতরাং সৌন্দৰ্য যখন একটা নির্দিষ্ট বিষয় নহে, ভিন্ন ভিন্ন লোকের নিকট যখন সৌন্দর্য্য ভিন্ন ভিন্ন ভাব ধারণ করে, তখন সৌন্দর্যকে চিরস্থায়ী করা কঠিন নহে ৷
সৌন্দর্য মনের একটা ভাব মাত্র। মনের সেই ভাব কেন জন্মে ও কিরূপে জন্মে, বুঝিতে পারিলে প্রেম জন্মান কঠিন নহে এবং মনের সেই ভাবকে চিরস্থায়ী করিতে পারিলে, প্রেমকেও অনায়াসে চিরস্থায়ী করিতে পারা যায়।
মনের সেই ভাবটুকু কি? এ পর্যন্ত, কি বিজ্ঞানবিদ্, কি কবি, কেহই এভাবের স্বরূপ বর্ণনা করিতে সক্ষম হয়েন নাই। বিজ্ঞান বিদরা যাহা বলেন তাহা ”প্রেমতত্ত্বে” লিখিত হইয়াছে। এক্ষণে কৰি এ বিষয় সম্বন্ধে কি বলেন তাহাই আমরা দেখিব। কারণ কাব্যের সাহায্যে প্রেম না জন্মিলেও, কাব্যে প্রেমকে স্থায়ী করে।
মানবহৃদয়স্থ কল্পনা বৃত্তি, প্রেম উৎপাদনের একটী প্রধান উপকরণ। যাহা নয় তাহা ভাবিবার নামই কল্পনা। একজন প্রকৃত সুন্দরী নহে, কিন্তু তাহাকে সুন্দরী বিবেচনা করিয়া মুগ্ধ হওয়ার নামই কল্পনা। সুতরাং কল্পনা-বৃত্তির বৃদ্ধি সাধন করিলে প্রেমের স্থায়ীত্ব বিষয়ে আর কোন সন্দেহ থাকে না। হিন্দু গৃহে, স্বামী স্ত্রীর সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হইয়া প্রেম স্থাপন একরূপ সম্পূর্ণ অসম্ভৰ কার্য্য। ইংরেজ জাতির মধ্যে এইরূপেই প্রেম জন্মে। আমাদের সমাজে যখন সে প্রথা প্রচলিত নাই, তখন কি আমাদের গৃহে প্রেম নাই?
আমাদের সমাজে আমাদের মধ্যে যত ভালবাসা আছে,পৃথিবীর আর কোন জাতির মধ্যে তত নাই। তাহার কারণ, আমরা কল্পনাতৎপরজাতি, কারণ আমরা যাহা নয় তাহা ভাবিতে পারি, কারণ আমরা প্রেম ভোগ করিতে জানি, ও প্রেমের প্রকৃত তত্ত্ব বুঝিতে পারি। এক্ষণে ইংরাজি সভ্যতার স্রোতে পড়িয়া, ইংরেজের রীতি নীতি অনুকরণে প্রলুব্ধ হইয়৷ আমরা সকলই ভুলিয়া যাইতেছি; সঙ্গে সঙ্গে ভারতের চির প্রিয় প্রেম-রঙ্গ সকলও বিশ্বত হইতেছি।

মদন ও রতি

ভারতীয় কারো মদন ও রতি সৃষ্টির কি কোন অর্থ নাই? মদন ও রতি কবির কল্পনা মাত্র। ইহারা মানব হৃদয়ের দুইটী বৃত্তি ভিন্ন আর কিছুই নহে। মদন মানব হৃদয়ের লালসা প্রবৃত্তি, আর রতি ভোগ ইচ্ছা। কবি বলেন মদনই প্রেমের রাজা; প্রেমিক মাত্রেই মদন রাজার প্রজা। যৌবন সুলভ ভালবাসার প্রধান কারণই যে লালসাবৃত্তি, এ কথা কেহ অস্বীকার করিতে পারেন না।
অনেকে বলেন বটে, যে প্রেমের সহিত লালসার কোন সম্পর্ক নাই। লালসা,ইচ্ছা না করিয়াও অপরকে ভালবাসা যায়, কিন্তু আমার এ কথা স্বীকার। সুবিজ্ঞ আর্য ঋষিগণ এ কথা স্বীকার করিবেননা, কারণ তাঁহারা কখনও মদন ও রতির সৃষ্টি করি- তেন না এবং তাহাদিগকে দেবতার আসন প্রদান করিয়া যাইতেন না। অন্য ভালবাসার কথা আমরা বলিতেছি না। স্ত্রী পুরুষের ভালবাসা, যৌবন সুলভ প্রেম লালসা বৃত্তিকে পরিত্যাগ করিয়া জন্মিতে পারে না। জন্মিলেও দিন দিন, ক্রমে ক্রমে, ধীরে ধীরে লালসা প্রবৃত্তি উভয়ের মধ্যে জন্মিবে, সেই বৃত্তির চরিতার্থতা না ঘটিলে, ক্রমে ভালবাসারও লাঘব হইতে থাকিবে।
স্ত্রী পুরুষের মধ্যস্থ ভালবাসা চিরস্থায়ী করিতে ইচ্ছা করিলে, মদন ও রতির পূজা আবশ্যক। ষোড়শোপচারে এই দেবদেবীর পূজা না করিলে কখনই প্রেমস্থায়ী হয় না। একেতো প্রেম বড় চঞ্চল, প্রেম ত্রুটি বুঝে না। যেখানে ত্রুটী দেখিতে পায় তথা হইতে দেখিতে দেখিতে পলায়ন করে। ইহার উপর যেখানে মদন ও রতির আদর নাই, সেখানে প্রেম মুহূর্ত্তের জন্য রড়ে না। মদন ও রতি, অথবা কামনা প্রবৃত্তির এবং ভোগ ইচ্ছার যেখানে পূজা হয় না, সেখানে প্রেম মেঘাচ্ছাদিত কাদম্বিনীর ন্যায় নিস্প্রভ ও নিস্তেজ থাকে। প্রেমের বিকাশই মদন ও রতি। প্রেমাস্বাদ গ্রহণই মদন ও রতি পূজা। কবিগণ সৌন্দর্য্যে মদন ও রতিকে অতুলনীয় করিয়াছেন, ক্ষমতার অসীম দুন্দমণীয় বলিয়া গিয়াছেন, অন্যের কথা কি, দেবাদিদেব মহাদেবকেও মদন নিজ ফুলশর বিদ্ধ করিয়া পাশস্থ করিয়াছিলেন। মদন ও রতির দাস এসংসারে নহে কে? কাননের সন্ন্যাসীই হউন, আর রাজার রাজপুত্রই উন সকলেই কামন৷ প্রবৃত্তি ও ভোগ ইচ্ছার দাস।
স্ত্রী পুরুষের পরস্পর আকর্ষণ ও তাহাদের মধ্যে প্রেম নীচ প্রেন নহে; ইহাও ঈশ্বরের অভিপ্রেত গ্রেন। সঙ্কালের প্রতি জননীর ভালসাসা না থাকিলেও এ সংসারে সন্তান পালন হইত না, জননীর অবহেলায় শত সহস্র শিশু অকালে কালগ্রাসে পতিত হইত; হয়তো তাহা হইলে এতদিনে সংসার ধ্বংস প্রাপ্ত হইত। এই জন্যই জননীর প্রেম এসংসারে এত পবিত্র, এত উচ্চ, এত নিৰ্ম্মল বলিয়া বিবেচিত হয়, কিন্তু স্ত্রীপুরুষের ভাল- বাসাকে হেয় মনে করিরা ঘৃণা করা হয়। জননীর স্নেহ বিধাতার যে উদ্দেশে মানব হৃদয়ে সন্নিবিষ্ট, ঠিক সেই উদ্দেশে সেই সৰ্ব্বশক্তিমান বিধাতা মানব হৃদয়ে এই প্রেমের সৃষ্টি করিয়াছেন। জননীর স্নেহ না থাকিলে মানব জাতি মরিয়া যাইত, স্ত্রীপুরুষের প্রেম না থাকিলে সংসারে মানব জাতির সৃষ্টিই হইত না, মানব জাতির অস্তিত্ব স্থায়ী করিবার প্রেমের সৃষ্টি,সুতরাং মদন ও রতি পূজা যিনি নীচ ও হেয় কাৰ্য মনে করেন, তাঁহার মত অবোধ এ পৃথিবীতে কেহ নাই।
লালসা প্রবৃত্তি ও ভোগ ইচ্ছায় অনেক সময় প্রেমের অভাব দেখিতে পাওয়া যায়। অনেকে প্রেম না জন্মিলেও লালসা চরিতার্থে বিমুখ হয়েন না। উভয়ের মধ্যে বিন্দুমাত্র আকর্ষণ নাই, উভয়ের প্রতি উভয়ের বিন্দুমাত্র মমতা নাই, অথচ লালসা বৃত্তির চরিতার্থতার ত্রুটী নাই; এরূপ করিলে মদন ও রতির অপমান করা হয় মাত্র। যেখানে আকর্ষণ নাই,
মমতা নাই, প্রেম নাই, সেখানে মদন ও রতি নাই। তথায় লালসা বৃত্তি চরিতার্থে হৃদয়ের সুখ বিন্দু মাত্র লাভ় হয় না। ইন্দ্রিয় সুখও শতাংশের একাংশ উপভোগ হয় না। যেখানে প্রেম নাই, আকর্ষণ নাই, সেখানে লালসা বৃত্তির চরিতার্থতা মহাপাপ। যেখানে মদন ও রতি নাই সে খানে প্রেম ক্রীড়া লালসা বৃত্তির চরিতার্থতা ভিন্ন আর কিছুই নহে। মদন ও রতি পূজার ব্যবস্থা আছে। হিন্দুর অসংখ্য দেব দেবী ! বিশেষ এক একটী পূজার বিশেষ বিশেষ ফল আছে, সুতরাং সকলের পূজাপদ্ধতিও এক প্রকার নহে। শিবের পূজা একরূপ, বিষ্ণুর পূজা অন্যরূপ,—শিব পূজায় এক ফল, বিষ্ণু পূজায় অন্য ফল। ঠিক সেইরূপ মদন ও রতি পূজায় এক বিশেষ ফল লাভ হয় এবং সেই জন্যই মদন ও রতি পূজা পদ্ধতিও স্বতন্ত্র রূপ আছে।
লালসা প্রবৃত্তির নামই মদন, — সুতরাং লালসা প্রবৃত্তির উৎকর্ষ সাধন, দমন, ইত্যাদি কার্য্যের নামই মদনের পূজা | এ পূজার জন্য ফুল বিশ্ব পত্রের প্রয়োজন হয় না; নৈবিদ্য ও আবাক হয় না। এ হৃদয়ের পূজা, হৃদয়ের সহিত একতার সম্বন্ধ; হৃদয়ে কল্পনায় উৎকট সাধন করা, লালসা প্রবৃত্তিকে আয়ত্ত্বাধীন করিয়া তাহাকে মনোমত রূপ পরিচালিত করা ইত্যাদিই মদন পূজার উপকরণ। ইহার মন্ত্র প্রেম, নৈবিদ্য হৃদয়, বলিদান প্রাণ। সময় বসন্ত, গায়ক কোকিল, বাদ্যকর ভ্রমর, আসন নারীর যৌবন। কবি বলেন, মদন ও রতির বিলাস কানন, নন্দনকানন; স্বর্গের মধ্যে যে স্থান শ্রেষ্ঠ ও মনোরম সেই স্থানই যদি মদন ও রতির আবাসস্থল হয়, তবে মদন ও রতি পৃথিবীর কদর্য্য স্থানে কখনই বাস করিতে পারেন না। স্বর্গ অর্থে পূণ্য; মানব হৃদয়ে যেখানে পূণ্য নাই, যেখানে স্বর্গীয় ভাবের অভাব তথায় কখনই প্রেম-দেবতা মদন ও রতি থাকিতে পারেন না। কেবল পূণ্য থাকিলেই যে হইল এরূপ নহে, হৃদয় নন্দনকাননের ন্যায় সুন্দর ও মনোরম হওয়া প্রয়োজন। কেবল হৃদয় নহে, গৃহ, গৃহের চারিদিক, সংসারে যে স্থানে থাকিবে সেই স্থান টুকু ও নন্দন কাননের মত হৃদয়া- নন্দদায়ী মনোহর স্থান হওয়া কর্তব্য।
কদর্য্য অপরিষ্কৃত গৃহে, কোলাহল পূর্ণ বিবাদ বিসম্বাদের আবাস গৃহে,—অশান্তিপূর্ণ আলয়ে, কখনও মদন ও রতি থাকিতে পারেন না। সুতরাং সেরূপ গৃহের গৃহীর হৃদয়ে প্রেম ও জন্মে না, জন্মিলেও থাকে না। ভাল বাসিলেই কি হইল? ভালবাসা থাকিবে কিসে? চঞ্চল প্রকৃতি মদনকে গৃহে আবদ্ধ করিয়া রাখিবার উপায় কি? কি করিলে এবং কিভাবে তাঁহার পূজা করিলে তবে তিনি তুষ্ট হইয়া হৃদয়ে স্থায়ী হয়েন ! গৃহ ও মন নন্দনকাননের ন্যায় পবিত্র ও মনোরম করিলেই কি মদন দেবের তুষ্টিসাধন হইল। বসন্তের শোভা, পুষ্পের সৌরভ, মলয়ের সমীরণ, ভ্রমরের গুঞ্জন, কোকিলের কূজন, মদনদেবের প্রীতিকর দ্রব্য সন্দেহ নাই,—এই সকল পার্থিব মনোমুগ্ধকর দ্রব্য লালসা প্রবৃত্তির প্রবলতা সাধক হইবে, সন্দেহ নাই;—ইহাতে হৃদয়ে প্রেমের আবির্ভাব হইবে বটে, কিন্তু সেই প্রেম স্থায়ী হইবে কি? রতির বিহনে মদন রহে না। যেখানে রতি নাই, সেখানে মদনও নাই। যেখানে ভোগ ইচ্ছা ও ভোগ ইচ্ছার ভোগ- উপভোগ-নাই তথায় লালসা প্রবৃত্তি ক্রমে নিস্তেজ হয়, তথায় প্রেম এক মুহূর্ত্তও তিষ্ঠিতে পারে না। প্রেমের উপভোগ চাই,—রতির পূজা আবশ্যক, নতুবা মদন তোমার গৃহে ও তোমার হৃদয়ে মুহুর্তের জন্যও রহিবেন না। স্ত্রী পুরুষের প্রেমের উপভোগ প্রেমের ভিত্তিস্বরূপ। স্ত্রী ও পুরুষ হৃদয় সম্মিলিত করিয়া রাখিবার জন্য রতি যেন মায়াময়ী গ্রন্থি। তুমি যাহাকে ভাল বাসিলে, সতঃই তোমার মন তাহার সহিত বসবাসে, তাহার যৌবন ও নারীজীবন উপ- ভোগে ব্যাকুল হইবে। প্রতিবন্ধক না দেও, এ প্রবৃত্তি দিন দিন প্রথর হইবে। এই উপভোগ আশায়, তুমি দিন দিন আত্মজ্ঞান বিরহিত ইবে, হয়তো কি করিতে কি করিয়া বসিবে। যদি উপভোগ না ঘটে,—রা উপভোগে কেবল পাশর প্রবৃত্তির চরিতার্থতা সম্পাদন হয়, তাহা হইলে সে প্রেম, সে আকর্ষণ দুই দিনের জন্য। সে প্রেমে রতি পূজা হইল না। রতি তথায় উপস্থিত থাকিয়া দুইটা হৃদয় “এক” করিয়া রাখিবেন না। কিন্তু স্থির শান্তভাবে, পদ্ধতি অনুসারে, সকল আয়োজন সহ যদি রতির পূজা সম্পন্ন হয়,—যদি প্রকৃত স্বাভাবিক ভাবে ভোগ ইচ্ছা সম্পন্ন হয়, তাহা হইলে তাহাতে প্রেমের গভীরতা দিন দিন বৃদ্ধি হয় ৷
ইংরাজি প্রেমে রতি পূজা নাই। তথায় প্রেমের আবিভাবের সঙ্গে সঙ্গে পাশব প্রবৃত্তি চরিতার্থতার জন্ম ব্যাকু- লতা জন্মে। সকল বিষয়েই ব্যস্ততা, সকলই “তাড়া তাড়ি” সম্পন্ন; প্রেম তথায় স্তরে স্তরে উঠিতে পারে না, ধীরে ধীরে মনের মত হৃদয়ে আসন সংস্থাপন করিতে পারে না,— পাশৰ প্ৰবৃত্তি প্রবল হইয়া প্রেমকে দুই দিনে হৃদয় হইতে দূরীভূত করে; তাই আমরা ইংরাজ সমাজে এত বিবাহ ভঙ্গের মকদ্দমা দেখিতে পাই।
বোধন হইতে বিসর্জ্জন এক দিনে সম্পন্ন হয় না। সম্পন্ন করিলেও সে পূজাই নহে। সে পূজায় কোনই ফল লাভ দর্শে না। সেইরূপ মদন ও রতি পূজার সময় আছে, স্তর আছে, পৰ্য্যায় আছে। ইহারও বোধন, প্রথম দ্বিতীয় ইত্যাদি পর্যায়ক্রমে পূজা আছে। একেবারে প্রেম বা আকর্ষণ জন্মিলেই যদি ইন্দ্রিয় বৃত্তির চরিতার্থতা হয়, তবে ঐ প্রেম হৃদয়ে দৃঢ় আবদ্ধ হইতে না পারায়, ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তি প্রেমকে হৃদয় হইতে দূর করিয়া দেয়। সেরূপ হৃদয়ে রতি স্থান পান না। এসংসারে কেবল প্রেমই দুইটী হৃদয়কে এক করিতে পারে এবং এক রাখিতে পারে। ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তির আকর্ষণ দুইদিন স্থায়ী; যৌবন সুলভ শারীরিক তেজ দুই দিনের জন্য দুই জনকে আকৃষ্ট করিয়া রাখে—পরে আর থাকে না। তখন তাহাদের মধ্যে ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তিও বড় ক্লেশ কর
ও নিরানন্দময় ব্যাপার বলিয়া বোধ হয়। প্রেম ব্যতীত ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তিতে সুখ নাই, প্রেম ব্যতীত লালসায় মুখ হইতে পারে না, প্রথম দুই চারি দিন হইলেও, চিরকাল থাকে না।
তাই বলি, যদি প্রকৃত প্রেমিক হইতে চাই, যদি সংসারে প্রকৃত সুখের আস্বাদ উপভোগ করিতে চাই, তবে মানব হৃদয় মুগ্ধকারী প্রণয় দেবতা মর্দন ও রতির পূজা কর।

বসন্ত ও ফুলশর

ফুলশর কবির কল্পনা হইলেও সম্পূর্ণ কাল্পনিক বসস্ত ও ব্যাপার নহে। বসন্ত পার্থিব শোভা। পৃথিবীর সৌন্দর্য্যের নামই বসন্ত, বসন্তকালে কাননে কাননে ফুল ফুটে, গাছে গাছে পাখী পঞ্চমতানে সঙ্গীতে প্রাণ আকুল করে, ভ্রমরের গুঞ্জনে প্রাণ মাতাইয়া তুলে, যে দিকে চাহি সেই দিকেই অপরূপ সৌন্দর্য। সৌন্দর্য্যে কাহার না হৃদয় মুগ্ধ হয়? বাহ্য বস্তুর সহিত মানব হৃদয়ের বড়ই সম্বন্ধ। বাহ্য বস্তুকে বাদ দিয়া মানব হৃদয়, কিছুই করিতে পারে না। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না হইলে পূজা করিতে মন আইসে না। অপরিষ্কৃত কতকগুলি কদর্য্য স্থানে কখন ও দেব দেবীর পূজা হয় না। বাহ্যিক কার্য্য করিয়া এবং কতকগুলি বাহু বস্তুর সাহায্যে হৃদয়কে পূজার উপযুক্ত করিয়া লইতে হয়। ঠিক সেইরূপ প্রেম পূজা করিতে বাসনা করিলে, তাহার জন্য হৃদয়কে প্রস্তুত করিতে হয়। দয়াময় ভগবানের এমনি মহিমা, তিনি এ বিষয়ের জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় অনেক বিষয় সৃষ্টি করিয়া আমাদের সম্মুখে ধারণ করিয়াছেন! বসন্তের শোভায়, ফুলের সৌরভে, ভ্রমরের গুঞ্জনে, আমাদের হৃদয়ও যেন কেমন
কেমন আপনা আপনি প্রেম আপনা আপনি প্রস্ফুটিত হয়। লাভের জন্য ব্যাকুল হয়। অপরকে ভালবাসিতে ইচ্ছা যায়। প্রকৃতির শোভা যত বৃদ্ধি হয়, মন ততই প্রেমে পাগল হইতে থাকে। বসন্তে স্ত্রী পুরুষ সম্মিলনে যেন প্রকৃতি দেবী সযতনে চেষ্টা করেন। অন্য সময়ে তো এইরূপ হয় না। বসন্তে হৃদয়ে যত প্রেমের প্রখরতা জন্মে, বৎসরের অন্য কোন সময়ে তো তত জন্মে না? বসন্তের সহিত হৃদয়ের ও প্রেমের নিশ্চয়ই কোন বিশেষ সম্বন্ধ আছে।
যাহাই থাকুক,—বসন্তে প্রেম জন্মে ও প্রেম স্থায়ী হয় ইহা নিশ্চয়, যদি বসন্তকে স্থায়ী করিতে পারা যায় তাহা হইলে প্রেমও হৃদয়ে স্থায়ী হয়। যদি সৌন্দর্য; বাহ্যিক সৌন্দর্য্য ও প্রকৃতির শোভা প্রেম বৃদ্ধি করে এবং প্রেমের সূত্রপাত করে, তাহা হইলে ঐ সকল বা হ্যক সৌন্দর্য্য ও প্রকৃতির শোভা অধিকতর নয়নে দর্শন করিলে হৃদয়ে প্রেম কেন না জন্মিবে, এবং জন্মিলে কেন না চিরস্থায়ী হইবে !
বসন্তের কয়েকটী শোভার নামই ফুল শর। যাহাতে হৃদয়ে লালসা প্রবৃত্তির প্রতা করে, যাহা পঞ্চেন্দ্রিয়ের সহিত মিলিত হইয়া হৃদয়ে মুহূর্তের মধ্যে প্রেমের উৎপত্তি করে বা যাহা কর্ণে প্রবেশ করিয়া বা নয়নে দর্শন করিয়া মুহূর্ত মধ্যে স্ত্রী বা পুরুষ সংস্পর্শে হৃদয়কে ব্যাকুলিত করে, মদন ও রতির পঞ্চ শরই সেইগুলি।
ইহাও প্রাকৃতিক কয়টা সৌন্দর্য্য ভিন্ন আর কিছুই নহে। আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, প্রকৃতির সৌন্দর্য্য অনায়াসেই চিরস্থায়ী করিতে পারা যায়, কারণ সৌন্দর্য মাত্রেই নিজ নিজ মনে; সৌন্দর্য্য কল্পনাপ্রসূত বিষয় ভিন্ন, আর কিছুই নহে। নিজের মানসিক প্রকৃতির অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন রুচির লোকের নিকট সৌন্দৰ্য ভিন্ন ভিন্নরূপ।
সংসারে বসন্তেরও যেরূপ শোভা, বর্ষারও সেইরূপ শোভা। কবি বসস্তের যেরূপ মনোহর শোভা দেখিয়া আনন্দিত হয়েন, ঠিক সেইরূপ বর্ষারও মেঘের গর্জ্জনে বিদ্যুতের ঝলকে ও বৃষ্টির পতনে অপরূপ মনোহর সৌন্দর্য দর্শন করেন। সকলই মনসাপেক্ষ। প্রেম এতবড় কঠিন ব্রত, কারণ প্রেমের ন্যায় সুখের ধন এসংসারে আর কিছুই নাই।প্রেম উপার্জ্জন ও রক্ষা দুইই কঠিন, কারণ ইহাতে মনকে আয়ত্তাধীন করিতে হয়, মনকে সমিত করিয়া প্রেমে শিক্ষিত করিতে ভয়।
মানুষ বসন্তু ও ফুলশর চিরস্থায়ী করিতে পারি না বলিয়াই সংসারে প্রেম চঞ্চল, তাই সংসারে প্রেমে এত কষ্ট, এত যন্ত্রণা. এত বিপদ আপদ ! অনেকে বলিবেন কি করিলে তবে বসন্ত ও প্রেম চিরস্থায়ী হয়? তাহার উত্তরে আমরা বলি, – সাধনা আবশ্যক! হৃদয়কে প্রকৃতির সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হইতে শিক্ষা দেওয়া কঠিন কাৰ্য্য নহে। পৃথিবীতে যাহা কিছু দেখিবে, কি বসন্তের পুষ্প, কি শরতের চন্দ্র, কি বর্ষার বিদ্যুৎ সমস্তই একটু বিশেষ করিয়া দেখিও, তাহা হইলে সকল বিষয়েই অপরূপ সৌন্দর্য্য দেখিতে পাইবে। . সামান্ত কীট হইতে মনুষ্য পর্য্যন্ত, সামাঙ্গ গুল্ম হইতে বৃহৎ শামলী পর্যন্ত, সকল প্রাণীতে সকল পাদপে এক সৌন্দর্য্য বিদ্যমান। মানুষ ভাল করিয়া দেখে না বলিয়াই এই সকল সৌন্দর্য্য উপভোগ করিতে পারে না। বসন্তের ভ্রমর গুঞ্জনে যেরূপ হৃদয়ে প্রেমভাবের আবির্ভাব হয়, ঠিক সেই রূপ বর্ষায় বৃষ্টির শব্দেও হৃদয়ে প্রেম ভাবের উৎপত্তি হয়,—কেবল একটু দর্শন আবশ্যক। ইহা কেহ কথন কাহাকে শিখাইতে পারে না, আপনি শিক্ষিত; – সংসারে যে দ্রব্যটা দেখিবে তাহা প্রথম ভয়ঙ্কর বলিয়াই ৰোধ হউক বা নিতান্ত ঘৃণাজনক বলিয়াই বোধ হউক, প্রথমে দেখিয়াই মুখ ফিরাইও। উহাকে একটু বিশেষ করিয়া দেখ। দেখিবে ক্রমে ক্রমে ধীরে ধীরে তোমার মন হইতে ভয় ও ঘৃণা তিরোহিত হইবে। ধীরে ধীরে তুমি উহাতে সৌন্দর্য্য দেখিতে থাকিবে।
আরও দেখ, উহাতে আরও সৌন্দর্য্য দেখিতে পাইবে। এইরূপ বিশেষ করিয়া সকল বিষয় দেখিলে মানব সকল পদার্থের বসন্তের শোভা ও মদন এবং রতির দুর্দমনীয় ফুলপর দেখিতে পাইবে।

নারী ও যৌবন

পুরুষের মন সতঃই নারীর দিকে আকৃষ্ট হয়। ইহা একটা স্বাভাবিক হৃদয়ের বেগ; ইহা কাহাকেও শিখাইতে হয় না।; দুর্দান্ত সিংহ ও মেষশাবকের ন্যায়, শিষ্টভাবে সিংহিনীর পশ্চাৎ অনুগামী হয়। জগতের যে দিকে চাহিবে সেই দিকেই প্রেমের এই বিচিত্র লীলা জগৎ স্রষ্টার এই অগম্য মানব বুদ্ধির অতীত আকর্ষণী শক্তির ক্রীড়া। তবে পশুপক্ষী ও মানবে একটু বিশেষ প্রভেদ আছে, মানব প্রেমে স্ত্রীপুরুষ সম্মিল ইচ্ছা ব্যতিতও আর একটু উচ্চ, আর একটু মধুর, আর একটু পবিত্র ভাবের, আভাষ দেখিতে পাওয়া যায়। অনেকে সেই ভাব টুকুকে প্রধান মনে করেন, স্ত্রী পুরুষ সম্মিলন ইচ্ছাকে নীচ হৈয় বিৰ্চেনা করিয়া উহার দমন সাধনার্থে উপদেশ প্রদান করিয় থাকেন—কিন্তু ঈশ্বরপ্রেম ব্যতিত (অন্যপ্রেম মানব হৃদয়ের এ ইচ্ছাকে বাদ দিয়া কখনই জন্মিতে পারে না। ধৰ্ম্মশীল নীতিপ্রেমী যে প্রেমের নারী; সাপক্ষতাচরণ করেন, সে প্রেমের ভিত্তি পিতা মাতা, ভ্রাতা ভগিনীকে মনুষ্য ভাল বাসে, কার তাহাদের সহিত রক্তের সম্বন্ধ। পরকে কে কবে ভাল বাসে, বিনা কারণে পরকে পরে কখনও কি ভাল বাসে? কিন্তু যুবার প্রাণ যুবতীর প্রতি সততই আক্বষ্ট হয়, তাহার যৌবন সৌন্দর্য: যেন প্রথম হৃদয় আকৃষ্ট করিয়া পরকে ভালবাসিতে শিখায়।
যিনি রমণী জাতিকে বাদ দিয়া এসংসারে প্রেমের রাজ্য বিস্তৃত করিতে চাহেন তিনি ঘোর ভ্রান্ত। যদি এ পৃথিবীতে প্রেম সুখের হয়, তবে নারীই সে সুখের আকর,প্রেমের পূর্ণ উৎস—ধর্ম্মশীল নারীজাতির প্রতি ঘৃণা প্রদশর্ন করিয়া কেবল নিজের অনুদারতা প্রকাশ করেন, কারণ তিনি যতই বলুন না কেন, সংসারে নারীজাতি না থাকিলে সংসারে প্রেমের আবির্ভাবও ঘটিত না, নারীই প্রথম আক্বা করিয়া প্রথম পরকে স্বার্থ বলি দিয়া হৃদয় পরময় করিতে শিক্ষা দেয়। প্রেমের নারীই সকল।
রমণী মাত্রকেই দেখিলেই কি হৃদয় আকৃষ্ট হয় কই বালিকা ও বৃদ্ধা দেখিলে যে হৃদয় আকৃষ্ট হয় না। বালিকা বা বৃদ্ধ দেখিলে হৃদয় তো প্রেমে পূর্ণ হইতে চাহে না।
না,—নারীর যৌবনই প্রেম উৎপাদনের যন্ত্র। যে অতি কুরূপা সেও যৌবন শোভায় বিভাসিত হইলে পুরুষের মন ও আপু আকর্ষণ করে। তাহার হৃদয়ের দিকে পুরুষের হৃদয় ধীরে ধীরে সরিয়া যায়। চুম্বক যেরূপ লৌহের অজ্ঞাতসারেই লৌহকে আকর্ষণ করে, নারীর যৌবন ও ঠিক সেইরূপ পুরুষের অজ্ঞাত সারে পুরুষের হৃদয়কে আকৃষ্ট করে।
এই সম্মিলনেই পরমসুখ, – কিন্তু ঈশ্বর মানুষকে বুদ্ধি, বিবেক ও জ্ঞানবিশিষ্ট জীব করিয়াই তাহাদের সুখের সীমা সীমাবদ্ধ করিয়াছেন। মানুষের মধ্যে অনেকে বুদ্ধি, ৰিবেচনা ও জ্ঞান সত্বেও কি কাজ করিলে প্রকৃত সুখ লাভ হইবে বুঝিতে পারে না।
আপাতমনোরম সুখের প্রলোভনে প্রলুব্ধ হইয়া সৎপথ ত্যাগ করিয়া কুপথাবলম্বী হয়। প্রেম সম্বন্ধেও ঠিক সেই রূপ। প্রেমের পরিণামে সুখ ও দুঃখ দুই আছে, মানুষ বুঝিতে পারে না বলিয়াই অনেক সময়ে প্রেমের পরিণামে অসহনীয় যন্ত্রণা ভোগ করে।
প্রেমের উৎপত্তি নারীও নারীর যৌবন, অথবা এই উভয় মিশ্রিত একরূপ অপরূপ সৌন্দর্য্য। সুতরাং পার্থিব ভাব হইতে হইতে আধ্যাত্মিক ভাবাপন্ন হয়, ক্রমে “মেটিয়িরাল” (জড়) “ম্পিরিচুয়াল” (আধ্যাত্মিক) হইয়া দাঁড়ায়,। কিন্তু ইহা একটু যত্ন সাপেক্ষ। নারী ও নারীর যৌবন হইতেই প্রেমের বিকাশ বলিয়া অনেকের মন নানা কারণে নারী ও নারীর যৌবনেই সম্বদ্ধ থাকে, কিন্তু সে প্রেম আর কখন পৰিত্ৰভাৰ ধারণে সক্ষম হয় না, বরং ক্রমে দিন দিন অবনতির ভাব গ্রহণ করিয়া নীচ হইতে নীচতর হইতে থাকে। সে প্রেমের স্থায়ীত্ব নাই, বিস্তৃতি বা বৃদ্ধি নাই। সে প্রেম কখন এক স্থানে চিরকাল থাকিতে পারে না। যে যৌবন লাবণ্য দেখিয়া মন কোন নারীর প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিল, সেই যৌবন লাবণ্য একটু ক্ষীণপ্রভ হইলেই প্রেমও ক্রমে তিরোহিত হইতে আরম্ভ হয়, আবার অন্যত্র নিজের রুচি অনুযায়ী যৌবনশোভার অনুসন্ধানে ব্যগ্র হয়।
এরূপ প্রেমকে সাধারণতঃ প্রীতি বলে, কিন্তু প্রীতির প্রকৃতি উপভোগে সুখ নাই; বলিতে গেলে প্রীতিতে প্রেমের কোন পৰিত্র ভাব বা বিমল আনন্দ নাই। প্রীতি এক শারীরিক উত্তেজনা ভিন্ন আর কিছুই নয়, ইহাতে হৃদরের বা মনের কোনই সম্বন্ধ নাই ৷
প্রেমের জন্য নারী আবশুক সন্দেহ নাই, প্রেমের জন্ম নারীর যৌবন ও অপরূপ শোভার ও এ সংসারে প্রয়োজন, কিন্তু মনকে কেবল ইহাতেই মগ্ন করিয়া রাখা কৰ্ত্তব্য নহে।
আমরা নারী ও নারীর যৌবন হইতে কিরূপে প্রেমের উৎপত্তি হয়, কিরূপ স্তরে স্তরে ইহা ক্রমে পবিত্র হইতে পবিত্রতার ভাবাপন্ন হয়, অবশেষে কিরূপেই বা প্রেমে আর পার্থিব ভাৰ না থাকিয়া কেবল অনির্বচনীয় আধ্যাত্মিক ভাব বিরাজ করে, তাহা আমরা নিম্নে একে একে লিখিতেছি।

 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

পঞ্চশর

পরকে ভালবাসা চাই। কারণ ভালবাসাতেই মুখ। এ সংসারে যদি কোন সুখ থাকে, তবে পরকে ভালবাসিয়া এবং পরের নিকট হইতে ভালবাসা পাইয়াই সেই সুখ। কিন্তু এ সংসারে এ ভালবাসা পাইবার উপায় কি?
করুণাময় বিধাতা আপনার প্রিয় সৃষ্টি, মানবের প্রতি দয়া করিয়া, তাহারা যাহাতে প্রেমের অপরূপ সুখ উপভোগ করিতে পারে তাহার আয়োজন স্বয়ংই করিয়া দিয়াছেন। তিনি আমাদিগকে বুদ্ধি বিবেচনা জ্ঞান দিয়াছেন, সুতরাং তিনি আমাদের
হস্ত ধরিয়! সেই সুখধামে লইয়া যাইতে পারেন না। তিনি আমাদের হৃদয়ে এ মুখলাভের জন্য ইচ্ছা ও ব্যাকুলতা প্রদান করিতে পারেন, তিনি আমাদিগকে কেবল এই মুখ ধামে যাই বার পথ দেখাইয়া দিতে পারেন। তাহা তিনি করিয়াছেন।
কবির কল্পনা প্রসূত পঞ্চশর আর কিছুই নহে, তাঁহারই অপার করুণাময় সৃষ্টিকৌশল মাত্র। আমরা “প্রেমতত্ত্বে” দেখাইয়াছি, যে মানবের পঞ্চ ইন্দ্রিয়, দর্শন, শ্রবণ, ঘ্রাণ, স্পর্শ, স্বাদ—আমরা এই সকল ইন্দ্রিয়ের সহিত মানবের হৃদয়ের কি
সম্বন্ধ, এবং কিরূপে ইহারা মানব হৃদয়ে কার্য্য করে তাহা পূর্ব্বে বলিয়াছি। এক্ষণে প্রেম উৎপাদনের জন্য বাহ্যিক কোন কোন বিষয় কোন কোন ইন্দ্রিয়ের উপর কার্য্য করে তাহাই লিখিতেছি।
এবিষয়ে মানুষের কোন হাত নাই। আপনিই নিক্ষিপ্ত হয়, আপনা আপনিই মানব শরীরে বিদ্ধ হইয়া মানব হৃদয়ে প্রেমের আবির্ভাব করে। কখন কোন সময় কি ভাবে ইহারা পঞ্চেন্দ্রিয়ের উপর কার্য্য করে, তাহা কেহ বলিতে পারে না।
কবি ইহাদের নাম দিয়াছেন সন্দেহ নাই; কিন্তু সে নাম কবিরা কল্পনা প্রস্তুত মাত্র; সকল কবি একই নাম প্রদান করেন নাই; যাহার মনে যেটা ভাল লাগিয়াছে তিনি সেইটা দিয়াছেন। সুতরাং আমাদের কল্পনার আলোচনা করিয়া লাভ কি? যাহা প্রকৃত, যাহা সত্য সত্য পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের উপর কার্য করে তাহাদের নাম যাহাই হউক না মদন ও রতির পঞ্চশরই সেই গুলি।
সৌন্দর্য্যই দর্শনেন্দ্রিয়ের পর স্বরূপ। নিজের হৃদয়ের মত, মনের মত কাহাকে দেখিলে তাহাকে বড়ই সুন্দর বলিয়া বোধ হয়, দর্শনেন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়া সেই সৌন্দৰ্য গিয়া হৃদয়ে কাৰ্য্য করে। এইরূপে, যেরূপ স্বর শুনিতে আমার মন চাহে, ঠিক সেই রূপ স্বর শুনিতে পাইলে তাহা বড় মিষ্ট বলিয়া বোধ হয়, কর্ণের মধ্য দিয়া যেন সেই খর হৃদয়ে গিয়া প্রতিঘাত হয়। স্পর্শনেও ঠিক ঐরূপ ঘটে। কেন অপরের রূপ, স্বর ইত্যাদি আমার ভাল না লাগিয়া কেবল কোন বিশেষ ব্যক্তির রূপ স্বর আমার মন মুগ্ধ করে; কেন সকল সময়ে হৃদয়ের সাম্যাবস্থা থাকা সত্বেও কেবল কোন বিশেষ সময়ে বিশেষ কারণে মুহূর্ত মধ্যে হৃদয় মুগ্ধ হয়, ইহার উত্তর এ পর্যন্ত দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক দিতে সক্ষম হয়েন নাই, তবে কবির কল্পনার নিকট কিছুই আটকাইয়া থাকে না, তাই কৰি বলেন ঐ সময়ে ঐ স্থানে মদনদেব লাভ করেন।
আমরা এই মাত্র দেখিতে উপস্থিত থাকিয়া এর প্রয়োগে আনন্দ বলি,—ঐটুকুতেই বিধাতার হস্ত স্পষ্ট পাওয়া যাইতেছে আমরা প্রেম চাই এবং প্রেমালয়ের পথ অনুসন্ধান করি, কে আমাদিগকে প্রেম লাভের উপায় ও প্রেমালয়ে উপস্থিত হইবার পথ দেখাইয়া দিবে। আমরা তথা উপস্থিত হইয়া প্রেমের পরম সুখ লাভ করিতে পারি, বা না পারি সে জন্য তিনি দায়ী নহেন। তিনি আমাদের ইন্দ্রিয়ের উপর অজ্ঞেয় শর নিক্ষেপ করিয়া আমাদিগকে ভালবাসার পথ দেখাইয়া দেন, মানব জীবনে একদিন না একদিন সকলেরই এরূপ অবস্থা ঘটে। একদিন না একদিন সকলেরই প্রাণ আর এক জনকে ভালবাসিবার জন্য ব্যাকুলিত হয়।
বুঝিতে হইবে মানব জীবনের সেই দিন একটী ভয়ানক সমস্যার দিন, হয়তো সেই দিন হইতে জীবন ধীরে ধীরে সুখের নদী দিয়া আনন্দ ধামে ভাসিয়া যায়, আবার হয়তো সেই দিন হইতে জীবন আগুনে পুড়িতে পুড়িতে দুঃখের জ্বালা চির জীবন সহিতে থাকে। মনুষ্য মাত্রেরই সেই দিনটাকে বিশেষ লক্ষ্য করিয়া ভবিষ্যৎ জীবনের পথ দেখিয়া লওয়া কৰ্ত্তব্য।

বসন্তের শোভা

বীজ ভিন্ন গাছ হয় না, জল ভিন্নও গাছ বাঁচিয়া থাকিতে পারে না। মানুষ সহস্র উন্নত হইলেও বীজ নিৰ্ম্মাণে ও সেচনে কখন জল সক্ষম হইবে না। প্রেম সম্বন্ধেও ঠিক এইরূপ। মানুষ প্রেমের বীজ হৃদয়ে আপনাআপনি স্বজন করিতে পারে না, কিম্বা প্রেমকে দিন দিন বৃদ্ধি করিতে হইলে যে যে উপকরণ প্রয়োজন তাহাও নিজে গড়িতে সক্ষম নহে।
আমরা উপরে যাহা লিখিয়াছি, উহা প্রেমের বীজমাত্র, পঞ্চশর, বীজ রোপণের চিহ্ন ভিন্ন আর কিছুই নহে। উহা বিধাতার হয়ে অদ্ভুত কৌশলমাত্র, — কাহারও বুঝিবার ক্ষমতা নাই। কিন্তু তিনি মানব হৃদয়ে প্রেমের বীজ রোপণ করিয়াই ক্ষান্ত রহেন না; যাহাতে মানব হৃদয়ে প্রেম দিন দিন বৃদ্ধি হইয়া পূৰ্ণাবস্থা প্রাপ্ত হইতে পারে, যাহাতে প্রণয়কুসুম-হৃদরকাননে প্রস্ফুটিত হয়. তিনি তাহারও যথোপযুক্ত আরো- জন করিয়াছেন। বসন্তের শোভা ইহার একটী উপকরণ। কাননে কাননে প্রস্ফুটিত কুসুম, তাহার মন-প্রাণ-ব্যাকুলিত সৌরভ, আকাশের পূর্ণচন্দ্রের শোভা,— কৌমুদিবিভাসিত প্রকৃতির হাস্য বদন— এ সকল প্রণয়পোষণের প্রধান যন্ত্র।
ইহারা মানব হৃদয়ে সৌন্দর্য্য মুগ্ধতা ও সৌন্দর্য্য লালসা ধীরে ধীরে জন্মাইতে থাকে; সৌন্দৰ্য হইতেই প্রেম জন্মে, সুতরাং হৃদয়, চারি দিকে সৌন্দর্য্য দেখিয়া নিজ-হৃদয়-অঙ্কিত সর্ব্ব সৌন্দর্য্যভূষিতা সেই অপরূপ মূৰ্ত্তি দেখিতে আকুল হয়। এই ব্যাকুলতা হইতে সতঃই প্রাণ প্রেমপিপাসু হয়, সুতরাং হৃদয় মধ্যে দিন দিন প্রেমের পূর্ণ বিকাশ হইতে থাকে।

কোকিলের কুজন ও ভ্রমরের গুঞ্জন

দর্শন ও ঘ্রাণেজিয়ের কার্য্য বসন্তের শোভা ও পুষ্প-সৌরভে দৃষ্ট হয়। কেবল দুইটা ইন্দ্রিয় লইয়া তো প্রেম ব্যাপ্ত নহে। প্রেমকে পরিপুষ্ট করিতে হইলে সকল ইন্দ্রিয়েরই পরিচালনা ও সন্তোষ আবশ্যক, তাই কোকিলের কূজন ও ভ্রমরের গুঞ্জন প্রেম বৃদ্ধির একটা প্রধান উপকরণ। কেবল যে কোকিলের কূজন ও ভ্রমরের গুঞ্জনই হৃদয়ে প্রেম বৃদ্ধি করে, অন্য কোন শব্দ হইতে তাহা হয় না, এরূপ নহে। সুমধুর স্বর, মিষ্ট সঙ্গীত, মধুর নিনাদ, তাহা ভ্রমরের কুজনই হউক আর স্রোতস্বিনীর কুল কুল নিনাদই ইউক, বা গায়কের মধুর সঙ্গীত সুধাই হউক, ইহাতে প্ৰেম হৃদয়ে উত্তেজিত হইয়৷ বৃদ্ধি পায়। যাহাতে কর্ণকুহর পরিতৃপ্ত হয়, যাহাতে হৃদরের তন্ত্রি বাজিয়া উঠে, সে শব্দ, য শব্দই হউক না কেন তাহাতে প্রেমের উৎকর্ষতা সাধন করে। ঘোর প্রলয় কোলাহলের মধ্যে থাকিলে হৃদয়ে ভয়ের সঞ্চার হয়; প্রেম স্তম্ভিত হইয়া স্তিমিত হইয়া থাকে; বিকট চীৎকার, কঠোর নিনাদ, ঘোর রোলে প্রেম হৃদয় হইতে পলাইতে চাহে। ইহা স্বাভাবিক নিয়ম যে হৃদয়ে এক বৃত্তির প্রাদুর্ভাব ঘটিলে অন্য বৃত্তি আপনা আপনিই লোপ হইয়া যায়। বিকট ভয়াবহ দৃশ্যে বা শব্দে, হৃদয়ে ভয়ের প্রাদুর্ভাব হয় সুতরাং প্রেম নিস্তেজ লইয়া পড়ে।

মলয়ের সমীরন

আমরা দর্শন, ঘ্রাণ ও শ্রবণ, তিনটী ইন্দ্রিয়ের কথা বলি- য়াছি,—এক্ষণে স্পর্শের কথা বলিব। স্পর্শেও যে প্রেম বৃদ্ধি পায় তাহার জলন্ত দৃষ্টান্ত — মলয়ের সমীরণ। ঝটিকা কালে যখন প্রবলবেগে বায়ু বহিতে থাকে, আর সেই বায়ু শরীরে লাগিয়া শরীরকে উৎপীড়িত করিয়া তুলে, তখন কি হৃদয়ে ভাল বাসা তিষ্ঠিতে পারে? আর যখন সমীরণ মৃদু মৃদু বহিতে থাকে, যখন সুশীতল বায়ু অঙ্গে ধীরে ধীরে লাগে, তখন কেমন আপনা আপনিই শরীর উল্লাসিত হয়, — অঙ্গ রোমাঞ্চিত হয়, প্রাণ যেন কিসের জন্য আকুলিত হয়। যদি হৃদয়ে প্রেমের বীজ রোপিত হইয়া থাকে তবে ঐ বীজ অঙ্কুরিত হয়, আর যদি হৃদয়ে বীজ রোপিত না হইয়া থাকে, তবে ঐরূপ সময়েই প্রকৃতি দেবী নিজ অদ্ভুত কৌশলে মানব হৃদয়ে প্রেমের বীজ রোপণ করেন।
উপরে আমরা যে সকল প্রেম বৃদ্ধির উপকরণের নাম উল্লেখ করিলাম, ইহা ব্যতীতও নারী-যৌবনে কতকগুলি বিশেষ বিশেষ ভাব আছে, তাহারা প্রেম উদ্দীপক পক্ষে প্রধানতম সহায়। ইহারা না থাকিলে হয়তো স্ত্রীপুরুষ মধ্যস্থ প্রেম জগতে জন্মিতে পারিত না; জন্মিলেও স্থায়ী হইত না।

ঢল ঢল নয়ন

নয়ন আবার ঢল ঢল কি? নয়নই তো দেখিতে সুন্দর, তবে ইহার আবার অন্য ভাব কি হইতে পারে, তাহা তো সহজে বুঝিতে পারা যায় না। সুধু নয়নে যে সৌন্দর্য্য আছে “ঢল ঢল নয়নে” তাহপেক্ষা সহস্র গুণ অধিক সৌন্দর্য্য; কারণ “ঢল ঢল” অর্থে ভাব ব্যঞ্জক। হৃদয়ের ভাব, প্রাণের প্রেমভাব, যখন হৃদয়কে প্লাবিত করিয়া বহির্গত হয়, তখনই কেবল নয়ন “ঢল চল” করে। তখন প্রেম কথায় প্রকাশ করা যায় না, সে / প্রেম, সে অব্যক্ত অপরূপ প্রেম কেবল নয়নেই দেখিতে পাওয়া যায়।
ঢল ঢল নয়ন আরও সুন্দর এই জন্য ইহা প্রেমিক ভিন্ন আর কেহ দেখিতে পায় না। যে যাহাকে ভালবাসে সে কেবল তাহারই সন্মুখে ভালবাসা দেখাইতে চাহে। প্রণয়িনীর প্রেম তাহার অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রেমিকের সম্মুখে তাহার চক্ষে প্রতি- ফলিত হয়। তাই “ঢল ঢল নয়ম” এত প্রেম উদ্দীপক। তুমি আমাকে ভাল বাস জানিলে, তোমাকে কি, না ভাল বাসিয়া আর থাকা যায়? কেবল তাহাই নহে, “ঢল ঢল নয়নের” সহিত একটু কাতরতা, একটু বিষণ্ণতা, মিশ্রিত থাকে; কেবল তাহাই নহে, ইহার সহিত যেন একটী কি ভিক্ষা প্রতিভাসিত হয়,এরূপ চক্ষু দেখিলে কার প্রাণে না ভালবাসা উথলিয়া উঠে। যদি ভাল বাসা রাখিতে চাই, তবে “ঢল ঢল নয়নের মাধুৰ্য্য বুঝিয়া “ঢল ঢল নয়ন” লাভে সচেষ্ট হও।

রক্তিমাভ ওষ্ঠ

নয়ন হইতেও ওষ্ঠ অধিক প্রেম উদ্দীপক। নয়ন দেখিলে মুগ্ধ হইতে হয়, সন্তুপ্ত হইতে হয়, ব্যাকুলিত হইতে হয়; কিন্তু ওষ্ঠ দেখিলে আত্ম বিস্তৃত হইতে হয়। যে ওষ্ঠ হইতে একটা মাত্র শব্দ নির্গত হয় না, অথচ কথা ফুটিতে ফুটিতে ফুটে না।— যাহাতে হৃদয়ের প্রেম প্রতিবিম্বিত হয়, প্রেমের বিভা পড়িয় যাহা রক্তিমাভ ধারণ করে, তাহা নয়ন হইতেও অধিক মানৰ হৃদয় মুগ্ধ করে। হৃদয়ের প্রেম সে ওষ্ঠ দেখিয়া প্রলুব্ধ হয়, অধৈর্য্য হয়, ব্যাকুল হয়। সেই রক্তিমাভ অস্ফুট প্ৰেমভাৰ ব্যঞ্জক ওষ্ঠ চুম্বনে হৃদয় আকুল হয়। প্রেম পদার্থ লাভের ব্যাকুলতা হৃদয়ে যত বৃদ্ধি হয়, হৃদরে প্রেমও ততই প্রবল হইতে থাকে। দর্শনে দর্শনে এই ব্যাকুলতা ৰত বৃদ্ধিহয় প্রেমও ততই বৃদ্ধি হইতে থাকে।

গোলাপ বিনিন্দিত কপোল

ওষ্ঠ হইতেও গণ্ডে প্রেম উদ্দীপক শোভা অধিক কেন? গণ্ডে কি ভাব বিকাসিত হয়? ওষ্ঠে যেরূপ হৃদয়ের প্রেম ভাব প্রকাশিত হয়, গণ্ডে সেইরূপ লজ্জা প্রতিভাসিত হয়। প্রথম যুবক যুবতি মিলনে একরূপ অনির্বচনীয় সুখের লহরী হৃদয়ে উদ্বেলিত হইতে থাকে; কেমন লজ্জা আসিয়া উভয়ের সৰ্ব্বাঙ্গ,—বিশেষতঃ কপোল যুগল রক্তিমাভ করিয়া দেয়। তুমি কথা কও আর নাই কও, – তুমি নীরবে দাঁড়াইয়া থাক আর নাই থাক, তোমার নয়ন, তোমার ওষ্ঠ, তোমার গণ্ড তোমার হৃদয় প্রেম ব্যক্ত করিয়া দিবে।
অপরের হৃদয়ের ভাব অবগত হইবার ইহাপেক্ষা আর উৎকৃষ্ট উপায় নাই। যুবক যুবতী পরস্পর দর্শনে পরস্পরের মধ্যে যদি প্রেম ভাবের আবির্ভাব হয়, যদি উভয়ের প্রতি উভয়ের আকর্ষণ জন্মিয়া থাকে, তবে তাহা অবগত হইবার উপায়ই, নয়ন,গণ্ড, ও কপোল। পরের হৃদয়ের প্রেম জানিতে পারিলে নিজের হৃদয়ের প্রেমও বৃদ্ধি হয়। তুমি যাহাকে ভালবাস সে তোমাকে ভালবাসে জানিলে, তোমার প্রেম যত বৃদ্ধি হইবে তত আর কিছুতেই হইবে না। কেহ যেন ভাবিবেন না, “রক্তিমাভ ওষ্ঠ” ও “গোলাপ বিনিন্দিত কপোল” বলিলাম বলিয়া আমরা কেবল রূপসীদিগের কথাই বলিতেছি। রূপের কোন স্থিরতা নাই, কিন্তু অতি কৃষ্ণবর্ণা সাধারণতঃ—বিবেচিতা কুরূপার ওষ্ঠ প্রেমব্যঞ্জক হইলে রক্তিমাভ হয় এবং প্রেমের লজ্জা হৃদয়ে উদিত হইলে, কি কুরূপ, কি সুরূপ সকলেরই গণ্ডে প্রবল বেগে রক্ত স্রোত বহিতে থাকে। যথায় রক্তের আবির্ভাব তথায়ই গোলাপ প্রস্ফুটিত ৷

পীনোন্নত পয়োধর

এতক্ষণ এত গুলি বিষয় দিয়া প্রকৃতি সুন্দরী মানব হৃদয়ে প্রেমের ভিত্তি স্থাপন করিতে ছিলেন,—এত গুলি বিষয় দিয়া প্রকৃতি মানবের মনকে, প্রেম ধারণে প্রস্তুত করিতে ছিলেন। এতগুলি দ্রব্য দিয়া উভয়ের মধ্যে একটী “টান” করিয়া দিতে- ছিলেন। কিন্তু সে “টানের” পূর্ণ বিকাশ তবুও পাইতেছিল না। উভয়ে উভয়ের দিকে আকৃষ্ট হইয়াছে সত্য, কিন্তু উভয়েসম্মিলিত হইবার ইচ্ছা তখনও হয় নাই। তখন প্রকৃতি দেবী সেই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নারী দেহে নানা সৌন্দর্য্যের সৃষ্টি করিতে লাগিলেন। অবোধ হউক আর সুবোধ হউক, মূর্খ, হউক আর জ্ঞানীই হউক, সকলেই সে সৌন্দর্য্যে আকৃষ্ট হইবে, কারণ হৃদয় মনের সহিত, সে সৌন্দর্য্যের কোন সম্পর্ক নাই।
এই সৌন্দর্য্যে কাহারও আর মতভেদ নাই। কি কুরূপা, কি সুরূপা, সকলেই যৌবনে এ সৌন্দর্য্যে সৌন্দর্য্যবর্তী হয়। যে সৌন্দর্য্যের কথা আমরা বলিতেছি, তাহারই নাম এই পরিচ্ছেদের উপরে সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। পীনোন্নত পয়োধর দেখিলে সমস্ত পুরুষেরই মন স্ত্রীজাতির নিকট আকষ্ট হয়?
কেন, ইহাতে কি আছে? ইহাতে কোথা হইতে এ আকর্ষণী শক্তি আসিল? সস্তান যাহা হইতে দুগ্ধ গ্রহণ করিয়া জীবন ধারণ করিয়া বাঁচিয়া থাকে, তাহা দেখিয়া মানবের মনে লালসাবৃত্তির উদ্দীপন হয় কেন? কামনা শারীরিক বৃত্তি, যৌবন সুলভ বৃত্তি। কামনার দ্বারা নর, নারীর দিকে আকৃষ্ট হয়; তাহা হইতে সত্তানোৎপাদিত হইয়া সংসারে মানব জাতির অস্তিত্ব রক্ষা করিয়া থাকে। ইহা পাশব প্রবৃত্তি ভিন্ন আর কিছুই নহে। কুকুর কুকুরীর মধ্যে যে বৃত্তি প্রবল, ইহাও সেই বৃত্তি। তবে মানব হৃদয়ে ইহার একটু ভিন্ন ভাব আছে, ভিন্ন উদ্দেশ্য আছে ৷ মানবের এই পাশব প্রবৃত্তি হইতে ক্রমে প্রেমের সূত্রপাত পশু পক্ষীর মধ্যে প্রেমের কোন চিহ্নই নাই। লালসা বৃত্তি যখন প্রবল হয়, তখনই সিংহ সিংহীর নিকট, হরিণ হরিণীর নিকট, কুকুর কুকুরীর নিকট ধাবিত হয়; পরে তাহাদের মধ্যে আর কোনই সম্বন্ধ থাকে না। কেহ কাহারও দিকে ফিরিয়াও চাহে না। কিন্তু মানব জাতিতে এরূপ নহে, — মানবের উদ্দেশ্য প্রেম-পবিত্র, অনস্ত, প্রেম। অনেক সময়ে মানব জাতির দুর্ভাগ্য বশতঃ মানৰ হিতাহিত জ্ঞান বিরহিত হইয়া প্রেমের প্রথম স্তর, পাশৰ প্ৰবৃত্তি অতিক্রম করিয়া যাইতে পারে না। তাগরা তখন পণ্ড স্বভাবাপন্ন হইয়া পশুর অধম হইয়া পড়ে; আর যাহারা পাশৰ প্ৰবৃত্তিকে অতিক্রম করে, তাহারাই ক্রমে প্রেমের অপার আনন্দ উপভোগ করিতে পারে। এই জন্য অনেকে যেরূপ “পীনোন্নত পয়োধর” ইত্যাদিকে লজ্জাকর বিষয় মনে করেন, আমরা তাহা করি না। আমরা ইহাকে প্রেমের ভিত্তি মনে করি। ইহাতেই পুরুষ, স্ত্রীর দিকে প্রথম আকৃষ্ট হয়। কারণ ঐশ্বরিক নিয়মে মানব পাশৰ প্ৰবৃত্তির বলে, যৌবন চিহ্ন দেখিয়া ভোগ বিলাসের জন্ম ব্যাকুল হয়। পীনোন্নত পয়োধর নারীজাতির যৌবনের চিহ্ন। তাই পুরুষ পীনোন্নত পয়োধর দেখিলে, স্বতঃই তাহার প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাঁহাই কবিগণ ইহার এত সৌন্দর্য্য বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন।

করেনু সদৃশ নিতম্ব

কবিগণ ইহাও প্রেম উৎপাদনের প্রধান উপকরণ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। কেন? আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, স্ত্রী পুরুষের পাশব প্রবৃত্তি, ও সন্মিলন ইচ্ছা প্রেমের ভিত্তি স্বরূপ, —তাই নিতম্ব প্রেম উৎপাদক উপকরণ। কারণ নিতম্ব হইতে সন্মিলন ইচ্ছা বলবতী হয়। পীনোন্নত পয়োধর লালসা বৃত্তি প্রখর করে, সন্দেহ নাই, কিন্তু নিতম্বের ন্যায় নহে। পয়োধর দর্শনে অপৰিত্ৰ ভাব না আসিলেও আসিতে পারে, লালসা বৃত্তির উদ্দীপন না হইলেও হইতে পারে, কিন্তু নিতম্ব সম্বন্ধে তাহা নহে। ইহাতে সন্মিলন ইচ্ছা আসিবেই আসিবে; প্রাণ, স্ত্রী জাতির সহিত সন্মিলিত হইতে, একেবারে ব্যাকুল হইয়া পড়ে।

আলুলায়িত কেশ

বিধাতার অনন্ত ও আশ্চর্য্য কৌশল। তিনি আগুন জালিতেও পারেন, আবার নিবাইতেও পারেন। “ চল চল- নয়ন”—“পীনোন্নত পয়োধর” “করেন সদৃশ নিতম্ব যেরূপ মানব হৃদয়ে ধীরে ধীরে, লালসার আগুন জ্বালিয়া দেয়, যেমন ইহারা ধীরে ধীরে মনকে পাগল করিয়া তুলে,—তেমনিই সেই হৃদয়কে দমন করিয়া মনকে পাশব প্রবৃত্তি অতিক্রম করিবার যখন উন্মুক্ত জন্যও তিনি কৌশল করিয়া দিয়াছেন। যদি সেটুকু না করি- তেন, তবে মানব মাত্রই পশুভাবাপন্ন হইত,—মানবে ও পশুতে তাহা হইলে কোনই প্রভেদ থাকিত না। তিনি সুকৌশলে লালসা প্রবৃত্তি মানব হৃদয়ে ন্যস্ত করিয়া পুরুষকে স্ত্রীর দিকে আক্কষ্ট করিলেন, তাহাদের উভয়কে উভয়ের জন্য পাগল করিয়া তুলিলেন,—কিন্তু তাহাদিগকে চিরকাল প্রেমে আবদ্ধ করিয়া রাখিবার জন্য একটী উপায়ও করিয়া দিলেন। পীনোন্নত পয়োধর ও নিতম্ব দেখিয়া মানব মাতিয়া উঠিল,— অমনি তখনই তাহাদের সম্মুখে স্ত্রী জাতির সৌন্দর্য্য করিয়া দিলেন। আলুলায়িত কেশ নারীজীবনের শোভা; নারীর ইহাতে যেরূপ সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করে, জগতের সকল অল- স্কারেও সেরূপ হয় না। পুরুষ, স্ত্রীর অপরূপ সৌন্দর্য্য দেখিয়া মুগ্ধ হইল,সেই সৌন্দৰ্যই হৃদয় ভরিয়া দেখিবার জন্ম ব্যগ্র হইল। তাহার হৃদয়ের লালসা প্রবৃত্তি সমিত হইল। যাহার এরূপ সৌন্দর্য্য তাহাকে চিরকাল হৃদয়ে হৃদয়ে পূজা করিবার জন্য ইচ্ছা হইল, অমনি মানব মন পাশর প্রবৃত্তি অতিক্রম করিয়া প্রকৃত পবিত্র প্রেম পথের পথিক হইল। প্রেমের উৎকর্ষতা সাধন করিবার ইচ্ছা হইলে, প্রেমকে চিরস্থায়ী করিতে হইলে, উল্লিখিত সমস্ত বিষয়গুলির সংস্থান করা, নঙ্গ নারী মাত্রেরই কর্তব্য। নতুবা প্রেম লাভের আশা বৃথা। ইহাতে অর্থ লাগে না, পরিশ্রম লাগে না, কেবল হৃদ- য়ের প্রয়োজন ও শিক্ষার আবশ্বক।
আরও একটা কথা। এই সকল দ্রব্য কেবল সংস্থান করিলে হইবে না; যাহাতে ইহারা চিরস্থায়ী হয় তাহারও চেষ্টা করিতে হইবে নতুবা প্রেম দৃঢ়রূপে হৃদয়ে সম্বদ্ধ হইবার পূর্ব্বে যদি এই সকল দ্রব্যের অভাব হয়, তবে সেই অভাবের সঙ্গে সঙ্গে প্রেমেরও অন্তর্ধান ঘটে। এতদ্ব্যতীত প্রেমের উপভোগে যে সুখ তাহাও ইহাদের অভাবে নর নারীর মধ্যে ঘটে না। ইহাদের পক্ষে সংসারে সুখ, অর্দ্ধলাভ ও অর্দ্ধভোগ হয় মাত্র।

 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

দর্শন

না দেখিয়া প্রেম জন্মিয়াছে, ইহা কেবল কবির কল্পনা ক্ষেত্রেই দেখিতে পাওয়া যায়; সংসারে না দেখিয়া প্রেম জন্মি- য়াছে এরূপ দৃষ্টাস্ত দেখিতে পাওয়া যায় না। না দেখিয়া যে প্রেম জন্মে না, এরূপ নহে, কিন্তু প্রেমের সর্ব্বোচ্চ বিকাশই সে প্রেমের পরিণাম ফল। না দেখিয়া প্রেম জন্মে না, এ কথা বলিলে ঈশ্বরের প্রেমকেও অমান্য করিতে হয়; তাহা হইলে ঈশ্বরের প্রতি প্রেম জন্মে না, জন্মান অসম্ভব মনে করিতে হয়, সুতরাং আমাদের সকলকেই স্বীকার করিতে হইবে যে, ৰিনা দর্শনেও প্রেম জন্মে। কল্পনা শক্তির চরম উৎকর্ষ সাধন হইলেই এরূপ প্রেম জন্মে,—কিন্তু ইহা সকলের অদৃষ্টে ঘটে না, সহজের মধ্যে এক জনেরও হয় না। তাহাই আমরা এ প্রেমের কথা এখন ছাড়িয়া দিয়া যে প্রেম লইয়া সংসার চলিতেছে, তাহারই কথা বলিব।
এ সংসারে কত জনকে সে প্রেম দর্শন ব্যতিত জন্মে না। তো দেখি। কত শত সুন্দরী তো চোকের উপর দিয়া প্রস্ফু – টিত কুসুমের ন্যায় শোভা বিস্তার করেন, কিন্তু কই সকলকে তো ভাল বাসি না; সকলের প্রতি তো প্রেম জন্মে না ! যাহাকে ভাল বাসি, তাহাকে যেন কি “ক্ষণে” দেখি,—সে নিতান্ত কুরূপা হইলেও, আমার চক্ষে সে অপূৰ্ব্ব রূপসম্পন্ন অপ্সরী বলিয়া প্রতীয়মান হয়। তাহাতেই বলিতে হয় প্রেমের দর্শনই সকল !
একবার দেখিলে যে, তাহাকে বার বার দেখিতে ইচ্ছা যায়—যত দেখি ততই তো প্রাণ, আরও দেখিতে চায়। দেখিয়া দেখিয়া প্রাণের ব্যাকুলতা বৃদ্ধি হয়, প্রাণের সন্তোষ জন্মে না। যাহাকে ভাল বাসা উচিত নহে, নর নারী তাহাকে ভাল বাসিয়া শেষে অশেষ কষ্ট পায়। সমাজে মানুষকে কতকগুলি নিয়মের বশীভূত হইয়া চলিতে হয়, সকলের সহিত সকলের বিবাহ সম্ভব নহে এবং সংসারে বিবাহ স্ত্রীপুরুষ সন্মিলনের এক মাত্র উৎকৃষ্ট উপায়। যেখানে বিনা বিবাহে স্ত্রীপুরুষ সন্মিলন ঘটে, তথায় প্রকৃত ভাল ৰাসা থাকিলেও সমাজের নিয়মানুসারে অনেক কষ্ট উপভোগ করিতে হয়; সেখানে প্রেমের সুখের পরিবর্তে হৃদরে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি জ্বলিতে থাকে। সে প্রেম লাভ অপেক্ষাই একেবারে প্রেমশূন্য হইয়া থাকা ভাল।
এই জন্য সকলেরই সমাজের নিয়মানুসারে যাহাকে বিবাহ করিতে পারা যায়, কেবল তাহাকেই ভাল বাসা কৰ্ত্তব্য। কেহ কেহ বলেন, ভাল বাসা তো নিজের আয়ত্বাধীন কার্য্য নহে, সম্পূর্ণ আয়ত্ত্বাধীন কাৰ্য্য না হইলেও একেবারে মানব শক্তির অতীত বিষয়ও নহে। একটু বিবেচনা করিয়া দেখিলে সক- লেই দেখিতে পাইবেন, মানবের শক্তি অল্প নহে; মানব যে কি করিতে পারে, আর কি না করিতে পারে তাহা কেহ নিশ্চিত বলিতে পারেন না। সুতরাং মানব যে প্রেমকে আয়ত্বাধীন করিতে পারে না এ কথা আমরা বিশ্বাস করি না। কিন্তু মানবের সেই ক্ষমতার একটা সীমা আছে।
মানব বৃক্ষের শাখায় বসিয়া থাকিতে পারে, এবং ইচ্ছা করিলে তথা হইতে ভূমে লম্ফ দিতেও পারে, কিন্তু এক বার বৃক্ষশাখা ত্যাগ করিলে মানুষ আর ফিরিয়া বৃক্ষশাখায় যাইতে পারে না। ঠিক সেই রূপ প্রেম সম্বন্ধেও একটী সময় আছে; ঐ সময় অতীত হইলে মানুষ আর প্রেণকে কোন ক্রমেই আয়ত্ত্বাধীন করিতে পারে না।
সেই সময়টা প্রেমের প্রথম আবির্ভাব। আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, প্রেম দর্শনেই জন্মে। যেই বুঝিলে যে কোন বিশেষ লোককে দেখিতে তোমার বড় ইচ্ছা হয়, অমনি তোমার বুঝা উচিত যে, তোমার হৃদয়ে প্রেমের বীজ রোপিত হইয়াছে। যদি বুঝিলে যে তাহাকে ভাল বাসিয়া কোন ফল নাই, তাহাকে বিবাহ দ্বারা পাইবার কোন আশা নাই, তাহা হইলে তৎ- ক্ষণাৎ হৃদয় হইতে প্ৰেম বীজকে উঠাইয়া ফেলিয়া দেও, তখন উহাকে নষ্ট করা কষ্টকর হইবে না; কিন্তু বীজ হইতে এক বার গাছ জন্মিলে কাহার সাধ্য সে গাছকে তুলিয়া ফেলে। যদি দেখিতে ইচ্ছা হয়, আর দেখিও না। মন যাহাতে অন্য কার্য্যে বিশেষ লিপ্ত হইয়। পড়ে তাহার চেষ্টা কর, দেখিবে এক মাসের মধ্যে তোমার হৃদয় হইতে প্রেম-বীজ অন্তর্হিত হইয়াছে। আর যদি তাহাকে পাইবার আশা থাকে, তবে পুনঃ পুনঃ তাহাকে দর্শন কর, ইহাতে তোমার হৃদয়ের প্রেম দিন দিন বৃদ্ধি পাইবে, এবং যাহাকে তুমি ভাল বাসিলে তাহার ভাল বাসাও ক্রমে তোমার উপর ন্যস্ত হইবে।

কটাক্ষ

পরের হৃদয়ে ভালবাসা জন্মাইবার প্রধান যন্ত্র “কটাক্ষ” যাহাকে তুমি ভালবাস, তাহার হৃদয় যদি শূন্য থাকে, সে যদি অপর কাহাকে ভাল না বাসে, তবে তাহার ভালবাসা লাভ করা এ সংসারে নিতান্ত কঠিন কাৰ্য্য নহে। পরের হৃদয়ে প্রেম উদ্দীপন করিতে হইলে কটাক্ষই প্রধান উপকরণ। অনেকে ভাবিয়া থাকেন স্ত্রীলোকের কটাক্ষই কটাক্ষ, পুরুষের নয়নে কটাক্ষ নাই,—এটা সম্পূর্ণ ভুল। কটাক্ষ সকলেরই নয়নে সম্ভব, কারণ কটাক্ষ নয়নের একটী বিশেষ ভাব ভিন্ন আর কিছুই নহে। অনেকে কটাক্ষ কাহাকে বলে তাহা বুঝিতে পারেন না,—তাহাই কটাক্ষের অসীম ক্ষমতাও উপলব্ধি করিতে পারেন না। আবার অনেকে ভাবিয়া থাকেন অসভ্যতাপূর্ণ, কুৎসিত চক্ষের বিলাসময় ভাব প্রকাশের নামই কটাক্ষ। অনেক অসভ্য, স্ত্রীলোক দেখিলেই তাহাদের প্রতি কুৎসিত নয়ন ভঙ্গি করেন, সে নয়ন ভঙ্গির নাম কটাক্ষ নহে, আবার অনেক কুচরিত্রা স্ত্রীলোক পুরুষের মন হরণ করিবার জন্ম নানা হাবভাবময় নয়ন ভঙ্গি করে; আমাদের মতে তাহাও কটাক্ষ নহে। ইহাতে কেবল পাশব প্রবৃত্তি প্রকাশ হয় মাত্র; ইহাতে প্রেমের কোন সম্পর্ক নাই,—ইহা দ্বারা প্রেম উদ্দীপনের কোন সম্ভাবনা নাই। সচ্চরিত্রা স্ত্রীলোক হইলে এরূপ কটাক্ষে লজ্জিত ও বিরক্ত হইয়া সে দিকে আর কখনও চাহেন না, আর সচ্চরিত্র পুরুষ হইলেও এরূপ কটাক্ষময়ী স্ত্রীলোকের নিকট হইতে ভয়ে পলাইয়া খুন। কেবল পাপীর সন্তোষ, কিন্তু পাপের পরিণাম যে অসহনীয় দুঃখ তাহা সকলেই অবগত আছেন। প্রকৃত কটাক্ষে একটু বিশেষ মধুরতা আছে। ইহাতে লালসার নাম মাত্র থাকে না। যদি কটাক্ষের দ্বারা পরের ভালবাস। লাভে ইচ্ছুক হও, তবে হৃদয় হইতে লালসা বৃত্তিকে প্রেমকে উদ্দীপন করিবার একেবারে দূরীভূত কর,— হৃদয়ে কর,— তুমি যেন তাহার জন্য পাগল, তুমি যেন তাহার চেষ্ট।
রূপ ও গুণে মুগ্ধ,—তুমি যেন তাহার জন্য প্রাণ বিসর্জ্জনে কত সঙ্কল্প,—মনে এই সকল ভাবের আবির্ভাব করিয়া কাতরে, ব্যাকুলে, প্রেম ভরে, কেবল যাহাকে ভালবাস, তাহার দিকে চাহিয়া থাক,—তাহার চক্ষে তোমার চক্ষু মিলাইতে চেষ্টা কর,—দিবারাতি তাহারই দিকে চাহিয়া থাক,—তিনিই যেন তোমার হৃদয়ের নক্ষত্র। নয়নের এরূপ ভাবে কেহ কখন বিরক্ত হইতে পারে না, কারণ ইহাতে কুভাবের চিহ্ণ মাত্র নাই। স্ত্রীই হউন, আর পুরুষই হউন, কেহই এরূপ নয়ন দেখিয়া বিরক্ত হইতে পারিবেন না। যিনি নিতাস্ত ভালবাসেন না, তিনিও নয়নের এই কাতরতা দেখিয়া দুঃখিত হইবেন! কিন্তু প্ৰেমলাভ একদিনে ঘটে না,—চেষ্টা, ক্রমান্বয়ে চেষ্টা আৰ্যক। একদিনে না হয়, এক সপ্তাহে হইবে, এক সপ্তাহে না হয় এক মাসে হইবে, একমাসে না হয়, এক বৎসরে হইবে,— হতাশ হইতে নাই। প্রথম তোমার নয়নের ব্যাকুলতাপূর্ণ কটাক্ষ দেখিয়া তাঁহার দুঃখ হইবে,—একবার তোমার নয়নের সহিত তাহার নয়ন মিলিলে তোমার হৃদয়ের প্রেম তাহার হৃদয়ে প্রতিবিম্বিত হইবে।
নয়নের এইরূপ কটাক্ষে, আকর্ষণী শক্তি আছে, তিনি তোমার নয়নের দিকে চাহিবেন না ভাবিলে ক্রমে ক্রমে চাহিবেন, ক্রমে ক্রমে, ধীরে ধীরে তোমার দিকে তাহার হৃদয় আঙ্কষ্ট হইবে। কিন্তু সাবধান, যেন নয়নে লালসা ভাবের চিহ্ন মাত্র না আইসে,—ইহাতে মুহুৰ্ত্ত মধ্যে প্রেম উভয়ের হৃদয় হইতেই অন্তর্হিত হইবে।

নয়নে নয়নে কথোপকথন

প্রেমের স্বতন্ত্র ভাষা আছে। ইহাতে পার্থিব ভাষায় কঠোরতা নাই। ইহাতে শব্দের আবশ্যক ঘটে না; এ ভাষা, বিনা শব্দে, বিনা আড়ম্বরে ব্যক্ত হয়। অপরে বুঝে না; কেবল প্রণয়ী প্রণয়িণীই এ ভাষা বুঝিতে সক্ষম হয়। ইহাই নয়নে নয়নে কথোপকথন।
যাহাকে ভালবাসি ও যে আমাকে ভাল বাসে বা যাহার ভালবাসা লাভে সক্ষম হইলাম, তাহার সহিত আলাপ ও কথোপকথন করিবার সুবিধা প্রথমেই ঘটে না। কি হিন্দু সমাজ, কি ইয়োরোপীয় সভ্য সমাজ সর্ব্বত্রই দেখিতে পাওয়া যায়, প্রণয়ের প্রারম্ভে প্রণয়ী প্রণয়িণীর আলাপ পরিচয় ঘটে না। হিন্দু গৃহে নব বিবাহিত স্বামী বা নব বিবাহিতা স্ত্রD উভয়ে উভয়ের সহিত কথোপকথন করিতে পারেন না, আর নয়নে নয়নে কথোপকথন।
ইয়োরোপীয় সমাজে সকল সময়েই, প্রণয় জন্মিলেও আলাপ পরিচয় ঘটিবার সুবিধা হয় না। তবে কি প্রেম, যতদিন প্রণয়ী প্রণয়িণীর আলাপ পরিচয় ও কথোপকথন না হয়, তত দিন উভয়ের হৃদয়ে স্তিমিত হইয়া থাকে? তাহ! যদি হইত, তাহা হইলে প্রেম উৎসাহিত না হইয়া ক্রমে ক্রমে হৃদয়ে বিলীন হইত।
বিধাতার সর্ব্বদর্শী চক্ষে ইহা পূৰ্ব্বেই পতিত হইয়াছিল, তাই তিনি প্রেমের এক স্বতন্ত্র ভাষার সৃষ্টি করিয়াছেন, এ ভাষা কেহ শুনিতে পায় না, কেহ বুঝিতে পারে না,—কেবল প্রণয়ী প্রণয়িণীই বুঝেন। প্রণয়িণী এই অব্যক্ত ভাষায় কথোপকথন করিয়া উভয়ের হৃদয়ের প্রেম উভয়কে অবগত করান,~~উভয়ের প্রেম উভয়ের প্রেমে প্রতিভাসিত হইয়া ঘাতপ্রতিঘাতে দিন দিন প্রবল হইতে থাকে। কি নিজের হৃদয়ে, কি অপরের হৃদয়ে, প্রেমের বৃদ্ধিসাধন করিতে হইলে, সৰ্ব্বত্রই এই নয়নে নয়নে কথোপকথন একটা প্রধান উপায়৷
ইহা কেহ কাহাকেও শিখাইতে পারে না। শিখাইবার আবতক ও হয় না। যদি হৃদয়ে প্রকৃত প্রেম জন্মে তাহা হইলে নয়নে কথোপকথন আপনি আইসে, আপনি হয়। আর তাহা যদি না হয়,—তবে একটু কল্পনা শক্তির আবশুক। হৃদয়ে কল্পনাশক্তির উত্তেজনা করিতে পারিলে, মনে মনে প্রেম ভাবিয়া লইতে পারিলে, — এবং নয়নে সেই প্রেমকে প্রতিভাসিত করিতে পারিলে হৃদয়ের সমস্ত কথা নয়নে ব্যক্ত হইবে। যদি সেই কথার প্রতি উত্তর পাও, তবে তাহার প্রতি উত্তর নয়নে আপনিই আসিবে, – তাহার জন্য চেষ্টা পাইতে হইবে না, কিন্তু আমরা আবার বলি, কোন ক্রমে যেন প্রেমের এই অবস্থায় হৃদয়ে লালসাবৃত্তি আসিতে না পায়, আসিলেও ইহাকে যত্নে দমন করিতে হইবে। কারণ ইহাই প্রেম বীজ নষ্ট করিবার প্রধান কারণ। লালসার সময় আছে। লালসা হইতে প্রেম জন্মে সত্য, কিন্তু সেই লালসা হইতে প্রকৃত লালসার কাল পর্যন্ত প্রণয়ি প্রণয়িণী যত্নসহকারে লালণাবৃত্তিকে হৃদয়ে দমন করিবেন। নতুবা সহস্র চেষ্টায় ও প্রেম জন্মিবে না, এবং জন্মিলেও থাকিবে না।

 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

কথোপকথন

যোগ একই রূপ বিষয়। যোগের যেরূপ সহস্র বিপদ, পদে পদে যোগ ভ্রষ্ট হইবার ভয়,—যোগ সাধনার জন্য যেমন বিশেষ যত্ন ও পরিশ্রম প্রয়োজন, প্রেম সাধনায়ও ঠিক সেইরূপ বিশেষ আয়াস ও যত্ন আবশ্যক; ইহাতেও প্রতিপদে প্রেম নষ্ট হইবার সম্ভব। এ সংসারে আমরা প্রতিদিনই কি প্রেমের প্রখরতা ও প্রেমের বিলীনতা দেখিতেছি না? যে আজ যাহাকে ভালবাসিতেছে, সেই আবার পর দিন তাহাকে ঘৃণা করিতেছে; যে আজ যাহার জন্য উন্মত্ত, সেই আবার পর দিন তাহাকে হত্যা করিবার জন্য ব্যগ্র। প্রেম রক্ষা বড়ই কঠিন কাৰ্য। এই জন্য ইহার প্রতিষ্ঠর বিশেষ রূপে লক্ষ্য করিতে হয়, প্রতিস্তর বিশেষ সাবধান হইয়া চলিতে হয়, নতুবা গোলাপ বিনিন্দিত কপোল ৷
মুহূর্তের মধ্যে এত যত্নের ও এত আয়াসের প্রেম অস্তহিত হইয়া যায়।
এতদিন তো কেবল দর্শন; দূর হইতে প্রণয়ী প্রণয়িণী উভয়কে উভয়ে দেথিয়া মুগ্ধ হইতেছিলেন। এতদিন তো মানুষ যেমন দেবতাকে দূরে থাকিয়া ভক্তি করে, প্রণয়ী প্রণয়িনী উভয়ে সেইরূপ দূরে থাকিয়া প্রেম করিতেছিলেন, কিন্তু যেই পরিচয় হইল, অমনি উভয়ে কথোপকথন হইল। হয়তো কথোপকথনে অভক্তির উদয় ও ঘৃণার আবির্ভাব হইল, আবার হয়তো কথোপকথনের গুণে প্রেম শত গুণ বৃদ্ধি পাইল।
প্রথম কথোপকথন বড়ই কঠিন বিষয়, বড়ই দুরূহ সমস্যা। ইহা প্রেম নদী পার হইবার অতি অস্থায়ী সেতু, একটু অসাবধান হইলে পদস্খলন হইয়া একেবারে জলে নিমগ্ন হইবার সম্ভাবনা।
আমরা কি প্রতিদিনই দেখিতে পাই না যে, যাঁহাকে কত ভক্তি করি, যাঁহাকে চিরদিন কত ভালবাসিয়া আসিতেছি,—তাঁহার সহিত আলাপ হইলে, তাঁহার সহিত কথোপকথন হইলে ভক্তির লাঘব হয়, এমন কি হয়তো ঘোর রণার উদ্রেক হয়। যদি সংসারে এরূপ ব্যাপার প্রতিদিনই ঘটে, তবে কেন না প্রণয়ী প্রণয়িণীর মধ্যে ইহা ঘটল? একটী . নহে, আমরা এমন শত শত দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিতে পারি।
কি কথা প্রথম কহিব, কি কথা কহিলে যাহাকে ভাল ৰাসি তিনি সন্তুষ্ট হইবেন, কি কথা তাঁহার মনোমত হইবে; আবার কি কথায় তিনি বিরক্ত হইবেন, কি কথা তাঁহার অপ্রিয় হইবে, ইহা অবগত হওয়া কঠিন কাৰ্য্য সন্দেহ নাই; কিন্তু একটু বিবেচনা করিয়া, একটু ভাবিয়া চিন্তিয়া কথা কহিলে কথার ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা অল্পই থাকে।
অনেকে মনে করেন, যাঁহাকে ভালবাসি তাঁহার রূপ গুণের যথেষ্ট প্রশংসা তাঁহার সম্মুখে করিলে, তিনি বড়ই সন্তুষ্ট হয়েন; কেহবা মনে করেন খোষামোদ করিতে পারিলেই প্রিয়পাত্রের সন্তোষ জন্মে। যাঁহারা এরূপ মনে করেন তাঁহারা বড়ই ভ্রান্ত।
যে ভালবাসে সে প্রশংসার আশা করে না, যে ভালবাসে সে খোষামোদ চাহে না; সে ভালবাসার পরিবর্তে ভালবাসা চাহে; সে প্রকৃত হৃদয়ের ভালবাসা চাহে। কপটতাপূর্ণ বাহ্যিক ভালবাসা সে চাহে না। যদি কোন ক্রমে জানিতে পারে যে, সে যাহাকে ভালবাসে সে তাহাকে প্রকৃত ভালবাসে না, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ তাহার হৃদয়ের ভালবাসা হৃদয়ে অন্তর্হিত হইতে আরম্ভ হয়।
অধিক কথা কহিবার প্রয়োজন নাই। প্রশংসা করিতে হয়, খোষামোদ করিতে হয়, তোমার প্রেমপূর্ণ নয়ন তাহা করিবে, যদি কথা কহিতে হয়, তবে যে কথায় তোমার হৃদয়ের ভালবাসা ব্যক্ত হয়, যে কথায় তোমার কপটতা লক্ষ্য না হয়, সেই কথাই কহিবে। অথবা কোন কথাই কহিবার আবশ্যক নাই; তোমার কথা বা তাহার কথা, বলিবার প্রয়োজন হয়, না, যে যাহাকে ভালবাসে সে তাহার স্বর শুনিবার জন্যই ব্যাকুল হয়; তুমি প্রিয়জন সম্মুখে অন্য নানা কথা কহিও, তোমার কি তাহার কথা একেবারে বিস্তৃত হইয়া, ভিন্ন ভিন্ন দেশের কথা, যুদ্ধের কথা, গল্পের কথা এইরূপ নানা কথা কহিও, ইহাতে উভয় পক্ষের কাহারই বিরক্তি জন্মিবার সম্ভাবনা থাকিবে না, অথচ কথোপকথন বড়ই মধুর, বড়ই সুখের বলিয়া বোধ হইবে। আমরা জানি এমন অনেকে আছেন, যাঁহাদের অস্থি মজ্জার সহিত লালসা প্রবৃত্তি জড়িত; তাঁহারা কিছুতেই, আপনাদিগের কোন কাৰ্য্য হইতেই, লালসা প্রবৃত্তিকে বিভিন্ন করিতে পারেন না।
আবার অনেকে আছেন, তাঁহাদের বিশ্বাস যে, স্ত্রীলোকেরা লালসা ও কামনার কথাই শুনিতে ভাল বাসে; তাই তাঁহারা সভ্যতার মুখে আবরণ দিয়া প্রিয়জন সম্মুখে অশ্লীল অবক্তব্য কথা সকল বলিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হয়েন না।
অন্য অপকারের কথার প্রয়োজন নাই; প্রেম নষ্ট করিতে ইহাপেক্ষ| ক্ষমতাপন্ন শত্রু আর কেহ নাই। যদি কেহ তোমাকে প্রকৃত ভালবাসেন, তাহাহইলে তিনি তোমার মুখে এই সকল যখন শুনিবেন, তখনই তাঁহার মনে তোমার উপর ঘৃণার উদ্রেক
হইবে; তিনি আর তোমাকে ভালবাসিতে ইচ্ছা করিবেন না।
আর যদি তুমি যে রমণীকে প্রাণের সহিত ভালবাস তাহার মুখে কোন গর্হিত কথা শুন,তাহাহইলে তোমার ভালবাসাও মুহূর্ত্তের মধ্যে অন্তর্হিত হইবে।

আলাপ

কথোপকথনে প্রেম বৃদ্ধি হয়, যতই কথোপকথন করিবে ততই কথোপকথনে হৃদয় আকৃষ্ট হইবে, কিন্তু অনেক সময়ে লজ্জা, প্রতিবন্ধক হইয়া প্রণয়ী প্রণয়িণীর মুখ চাপিয়া ধরে; তাহারা প্রকৃত আলাপ করিতে সক্ষম হয় না।
দেখা হইল, পরিচয় হইল, কিন্তু উভয়ের প্রকৃত আলাপ হইল না, উভয়েরই ইচ্ছা উভয়ে বসিয়া আলাপ করেন, বহুক্ষণ ধরিয়া উভয়ে উভয়ের কথা শুনিয়া কর্ণকুহর পরিতৃপ্ত করেন, কিন্তু লজ্জার জন্য তাহা হয় না। এরূপে লজ্জাকে প্রশ্রয় দিলে প্রেমের উৎকর্ষতা লাভ ঘটে না। তাই আমরা বলি একটু চেষ্টা করিয়া এ লজ্জাকে দূর করা কর্তব্য।
অনেক সময়ে লজ্জার জন্য সুখের প্রেমে গরল উত্থিত হইয়াছে, কেবল হৃদয়ের কথা হৃদয়ে চাপিয়া রাখিরা অনেক সুখের পরিবারে দুঃখের শ্মশান হইয়া গিয়াছে। হিন্দুর গৃহই হউক বা অপর জাতির গৃহই হউক, সকলকেই যত্ন করিয়া প্রেম বৃদ্ধি
করিতে হয়। যেমন একটা বৃক্ষের বীজ রোপন করিয়া তাহার লালনপালন করিতে হয়, ঠিক সেইরূপ হৃদয়স্থ প্রেমবীজকে লালনপালন করিয়া ইহাকে বৃদ্ধি করিতে হয়। যিনি তাহা না করেন, এসংসারে তিনিই কষ্ট পান।
যখন আলাপে প্রেম বৃদ্ধিহয়, তখন যেমন করিয়াই হয় আলাপের উৎকর্ষতা সাধন করিবার চেষ্টা করা প্রেমিক মাত্রেরই কৰ্ত্তব্য।
অনেকে ভাবিবেন, কি আলাপ করিব? আমরা জানি অনেকে কি কথ। কহিবেন, ভাবিয়া স্থির করিতে না পারিয়া এবং নীরবে হারার স্নায় বসিয়া থাকিতে লজ্জিত হইয়া, হৃদয়ে কষ্ট পাইয়াও প্রিয়জনকে ত্যাগ করিয়া আইসেন। তাহাকে ত্যাগ করিয়া আসিতে প্রাণ চাহে না, ত্যাগ করিতে গেলে প্রাণে দারুণ আঘাত লাগে, অথচ না আসিলেও নহে, বসিয়া থাকিয়৷ কি কথা কহিব ! কথোপকথন পরিচ্ছেদে আমরা এ বিষয় সম্বন্ধে যাহা বলি- বার তাহা বলিয়াছি। কথোপকথন ও আলাপে প্রভেদ এই. কথোপকথন অল্প সময় ব্যাপী, আলাপ বহুক্ষণ ব্যাপী। পরের নিন্দা বা প্রশংসা, আপনাদিগের নিন্দা বা প্রশংসা, খোষামোদ ইত্যাদি একেবারে ত্যাগ করিয়া অল্প কৌতুকপূর্ণ নানা কথা কহিলে আলাপের বিষয়ের অভাৰ কাহারই ঘটিবে না।

মধুর সম্ভাষণ

সম্ভাষণ একটী কঠিন বিষয়; বিশেষতঃ যাহাকে ভাল- বাসি, অথচ যাহার সহিত সেরূপ ঘনিষ্টতা হয় নাই। তাহাকে কি বলিয়া সম্ভাষণ করিব? এবং সংসারে যদি কিছু মধুর ও নিষ্ট থাকে তবে সে সম্বোধন। সন্তান যখন জননীকে “মা মা” বলিয়া ডাকে তখন “মা” শব্দের ন্যায় মধুর শব্দ সংসারে আর কি আছে! স্বামী যখন স্ত্রীকে আদর করিয়া “প্রিয় – তনে” বলিয়া সম্বোধন করেন, তথন সে সম্বোধন অপেক্ষা অধিক মিষ্ট আর কি আছে? কথোপকথন করিতে হইলে. আলাপ করিতে হইলে, সম্ভা- ষণ করাও একরূপ ঐ সঙ্গে সঙ্গে আবশ্যক হইয়া পড়ে। কিন্তু যাহার উপর তোমার অধিকার জন্মে নাই তাহাকে “প্রিয়- তমে” ইত্যাদি সম্বোধন করা নিতান্ত অন্যায়; ইহাতে প্রেমের অপবিত্র ভাব আসিয়া থাকে; ইহাতে প্রেমের সহিত লালসা মিশ্রিত হয়। মিষ্ট সম্ভাষণ শুনিতে মধুর হইলেও ইহা প্রেম- ব্যঞ্জক নহে। প্রেন প্রকাশের অন্য সহস্ৰ উপায় আছে, কিছু বলিয়া সম্ভাষণ না করিলেও কোন ক্ষতি হয় না; তবে সম্ভাষণ করিবার নিতান্ত আবশ্যক হইলে নাম ধরিয়া ডাকাই সৰ্ব্বাপেক্ষা উত্তম উপায় । নামের ন্যায় মধুর সম্ভাষণ আর নাই। ইহা প্রেমিকের কর্ণে যত মধুর বলিয়া প্রতীতি হয়, তত আর কিছু- তেই হয় না; ইহা যত হৃদয়ের ভিতর প্রবিষ্ট হয়, তত আর প্রেম-রঙ্গ। কিছুতেই হয় না। ইহার কারণ এই—ইহা স্বাভাবিক, সরল ও কপটতাশূন্য সম্বোধন। তুমি সম্বোধনে যত বাড়াবাড়ি করিবে, তুমি যতই কেন মধুর মধুর শব্দ করিয়া প্রেমিককে সম্বোধন কর না, তাহাতে তাহার প্রাণে তত সস্তোষ জন্মিবে না, কারণ সেই সকল সম্বোধনের সরলতা এবং সত্বের উপর তাহার বিশ্বাস হইবে না। তাহার হৃদয়ের নিকট সন্দেহ আসিয়া ধীরে ধীরে বলিবে, – “বিশ্বাস করিস্ না, যে যত মুখে ভালবাসা দেখায়, সে তত হৃদয় হইতে ভালবাসা তাড়াইয়া দেয় ।”

প্রিয়জন সহবাস

আমরা প্রেমকে খণ্ড বিখণ্ড করিয়া প্রেমের প্রতি স্তর উন্মুক্ত করিয়া দেখাইতেছি। যেরূপে প্রেম মানব হৃদয়ে ধীরে ধীরে রাজ্য বিস্তার করে, যাহার একে একে দেখাইতেছি। লব্ধি যাহা ঘটে, আমরা তাহাই যখন প্রণয়ী প্রণয়িণীর উভয়ের পরস্পর ভালবাসা উপ- করিতে আর বিলম্ব রহিল না, যখন উভয়ে উভয়ের হৃদ- দের ভাব স্পষ্ট বুঝিতে পারিল, যখন উভয়ের মধ্যে আলাপ পরিচয় হইল, তখন কেহু ভাবিবেন না যেন যে, আর ভয় কি? এখন এ যাইবে না । ভালবাসা আর কিছুতেই যাইবে না, মরিলেও এ কথা প্রেমিক মাত্রেই ভাবিয়া থাকেন। একথা প্রণয়ী প্রণয়িণীকে এবং প্রণয়িণী প্রণয়ীকে শত সহস্র বার বলিয়া থাকে, অথচ আমরা ইহাও দেখি প্রণয়ী প্রণয়িণীর দৃঢ় ভাল- বাসার চিহ্নও সময়ে থাকে না। আমরা প্রেমের যত টুকু বর্ণনা প্রিজন সহবাস 89 করিয়াছি, ততটুকুতে প্রেম দৃঢ় একেবারেই হয় নাই। এ প্রেম সামান্য কারণেই তিরোহিত হইতে পারে। সুতরাং সকল সময়েই প্রেমকে সযতনে স্থায়ী করিতে হইবে। নিয়ম হয়। কিসে প্রেম স্থায়ী হয়? এ সংসারে সকল বিষয়েরই এই যে, বৃদ্ধি হইতে আরম্ভ হইলেই হ্রাস হইতে আরম্ভ প্রেম সম্বন্ধেও ঠিক এই নিয়ম, প্রেমের কোন নির্দ্দিষ্ট সীমা নাই। ভালবাসার মাত্রাপূর্ণ হইয়াছে, ইহা কেহ কখন বলিতে পারেন না; তাই দিন দিন প্রেমের বৃদ্ধি আরম্ভক, নতুবা প্রেম কখনই স্থায়ী হইতে পারে না। কিসে প্রেম বৃদ্ধি হয়? আলাপ পরিচয় হইলে তখন প্রেম কিসে বৃদ্ধি হয়? কিসে বৃদ্ধি হয়, তাহাই আমর। নিম্নে লিখিতেছি। যতই কেন ভাল বাসা প্রখর হউক না কেন, অদর্শনে ভালবাসার লাঘব হয়। এমন যে অপত্য স্নেহ তাহাও অ- শনে অন্তর্হিত হয়। পুত্রকে বহুদিবস না দেখিলে জননী তাহার কথা ভুলিরা যান। তখন যখন অপত্যস্নেহ অদর্শনে রহে না, অপরিপক্ক চঞ্চল প্রেম যে অদর্শনে কোনক্রমেই থাকিতে পারে না ইহা নিশ্চয়। এইজন্য প্রণয়ী প্রণয়িণীর একত্রে বস- বাস নিতান্ত প্রয়োজন। দুই জনেই দুই জনকে বড় ভালবাস, তোমাদের ভালবাসায় হৃদয় পূর্ণ হইয়াছে, অন্য কথা কি উভয়ে উভয়ের জন্তু পাগল, উভয়ে উভয়ের জন্য প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে পার, কিন্তু পাঁচ বৎসর কিম্বা দশবৎসর উভয়ে উভয়কে না দেখিয়া থাক দেখি, উভয়ে উভয়কে ত্যাগ করিয়া ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বাস কর দেখি; পাঁচ বৎসর পরে ভালবাসা সেরূপ প্রবল থাকিবে না, দশ বৎসর পরে হৃদয়ে ভালবাসা এক বারেই রহিবে না। 88 প্রেম-রঙ্গ। তাহাতেই বলি যদি ভালবাসা স্থায়ী করিতে চাই এবং ভাল- বাসাকে দিন দিন বৃদ্ধি করিতে চাই, তবে উভয়ে একত্রে বস- বাস কর, উভয়ে উভয়কে ত্যাগ করিয়া মুহূর্ত্তের জন্যও অন্যত্র যাইও না। কিন্তু বিবাহ না হইলে এরূপ বসবাস সম্ভব নহে, কিম্বা বিবাহের প্রথমাবস্থায় হিন্দুগৃহেও এরূপ বসবাস সম্ভব নহে। তাই প্রেমের প্রারম্ভে যথাসম্ভব প্রণয়ী প্রণয়িণীর একত্রে থাকা কর্তব্য। লজ্জার জন্য অনেকে এ কার্য্য করিতে পারেন না, আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, যিনি মিথ্যা লজ্জার বশীভূত হইয়া প্রেমের উৎকর্ষ সাধনে অবহেলা করিবেন, তাঁহাকে ভবিষ্যতে ইহার জন্য অনুতাপ করিতে হইবে।

সাদর বিদায়

প্রিয় জনের সহিত বসবাসে যেরূপ প্রেমের বৃদ্ধি হয়, বিদা- য়েও সেইরূপ প্রেমের প্রথরতা জন্মে। সকলেই দেখিয়াছেন, প্রবলবেগে জল যাইতে আরম্ভ করিলে উহাকে প্রতিবন্ধক দিলে উড়ার বেগ শত গুণ বৃদ্ধি হয়। প্রেম সম্বন্ধেও ঠিক এইরূপ। প্রেম বাধা পাইলে প্রবল হয়; যেখানে প্রেম যত প্রতিবন্ধক পায়, সেখানে প্রেমের ততই তেজ বৃদ্ধি হয়। এই জন্য বিদায় প্রেমের একটা আনুসঙ্গিক বিষয়। বিদায়ের পরেই বিচ্ছেদ, বিচ্ছেদে প্রেমের প্রতিবন্ধক, সুতরাং বিদায়ে প্রেম বৃদ্ধি পায়। প্রেমের প্রথম অবস্থায় বিদায় প্রয়োজন; মধ্যে মধ্যে বিদায় গ্রহণে প্রেমের উদ্দীপন হয়। কিন্তু বিদায়েরও ভিন্ন ভিন্ন বিশেষত্ব আছে। যে বিদায়ে বিষণ্ণতা আছে, তাহাতে হৃদয়ে বিপদের ছায়া পড়ে, প্রেমকে স্তম্ভিত করিয়া রাখে। যে বিদায়ে নৈরাজ্য আছে, তাহাতে হৃদরের তেজের অপলাপ করিয়া প্রেমকে দুর্ব্বল ও ক্ষীণ করিয়া ফেলে, এইজন্য বিদায় কালে এরূপ কোন কথাই বলা উচিত নহে, যাহাতে বিষণ্ণতা বা নৈরাশ্য আসিয়া হৃদয়কে আশ্রয় করিতে পারে। ইহাতে প্রেম অন্তর্হিত না হইলেও তদ্বারা বৃদ্ধির পথে প্রতিবন্ধক পড়িবে। আমরা জানি অনেকে আছেন, তাহারা প্রেম পরীক্ষা করিতে বড় ব্যাকুল। যাহাকে ভালবাসি সে আমাকে ভালবাসে কি না, এবং ভালবাসিলে কত ভালবাসে তাহা জানিতে চাহেন, কিন্তু কিরূপে ইহা জানিতে পারা যায়, তাহার প্রথা অবগত না থাকায় হিতে বিপরীত ঘটাইয়া থাকেন। ভালবাসা জানিতে গিয়া প্রিয়জনের হৃদয়ে বেদনা প্রদান করেন। হয়তো বিদায় কালে প্রিয়জন তাহার অদর্শনে কি ভাব করেন জানিবার জন্য বিষাদে নৈরাঙ্গের বেদনা লাগে কথা কহেন। তাহাতে মাত্র, তাহাতে প্রেম বৃদ্ধি পাইয়া নিস্তেজ পায় প্রিয়জনের হৃদয়ে না। বরং আঘাত হইয়া পড়ে। মধ্যে মধ্যেএরূপ আঘাত পাইলে প্রেম একবারে অন্তর্হিত হইতেও পারে ।

 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

স্পর্শ

আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি মানবের পাশব প্রবৃত্তিই প্রেমের বীজ, তৎপরে প্রেম উদ্দীপনের জন্য আমরা যাহা যাহা বলি- য়াছি, তাহাতে পাশব প্রবৃত্তিকে হৃদয় হইতে দূর করিতে ও লালসাকে হৃদয়ে সমিত রাখিতে বিশেষ অনুরোধ করিয়াছি। কিন্তু পূর্ব্বে উল্লিখিত বিষয় গুলির সাহায্যে যখন প্রেম হৃদয়ে দৃঢ়রূপে গ্রথিত হইয়াছে, তখন প্রেমকে চরম সীমায় আনিবার জন্য আবার লালসাকে একটু প্রশ্রয় দেওয়া নিতান্ত আবশ্যক হইয়া পড়ে। তখন সতঃই হৃদয়, লালসা শাস্তির জন্য আকুলিত হয়, তখন ইহাকে দমন করিতে গেলে কেবল যে মানসিক দুঃখের উৎপত্তি হয় এরূপ নহে, প্রেমও এক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়িয়া চঞ্চল হইরা পড়ে। লালসা, পাশব প্রবৃত্তি হইলেও মানব হৃদয়ে ইহা পূৰ্ণ পাশব প্রবৃত্তি নহে। ইচ্ছা করিলে মানব ইহাকে স্বর্গীয় ভাবাপন্ন করিতে সক্ষম হয়। পশু পক্ষী প্রেমের অভাবেই লালসা প্রবৃ ত্তিকে প্রশ্রয় দিয়া থাকে, মানবজাতির মধ্যে যাহারা প্রেমের অভাবে লালসাকে প্রশ্রয় দেয় তাহারা পশু হইতে অধম ব্যতীত উত্তম নহে। আমরা প্রেম শূন্য কামনার সম্পূর্ণ বিরোধী, ইহাকে মনুষ্য জাতির ঘোর কলঙ্কের কথা বিবেচনা করি। যাহারা এরূপ কার্য্য করেন তাহাদিগকে আমরা কুকুর শৃগালের তায় ঘৃণা করি।
যখন যুবক যুবতী উভয়ের হৃদয়েই প্রেম জন্মিল, তখন লালসা প্রবৃত্তিকে ধীরে ধীরে হৃদয়ে প্রবল হইতে দেওয়া কৰ্ত্তব্য, কারণ এরূপ না করিলে প্রেম হৃদয় হইতে অন্তর্হিত হইবার বিশেষ সম্ভাবনা। কিন্তু একেবারে সহসা লালসাবৃত্তিকে হৃদয়ে রাজ্য বিস্তার করিতে দেওয়া কৰ্ত্তব্য নহে; তাহাতে হৃদয়ে ভয়ের উদয় হইবার সম্ভাবনা, ভয় হইতে স্বণার উদ্রেক হয়। হৃদয়ে একবার ভয় ও ঘৃণা আসিলে, প্রেম আর তথায় থাকিতে পারে না। হিন্দুগৃহে এদৃশ্য কি দেখিতে পাওয়া যায় না? কত স্বামী যে সরলা স্ত্রীর সন্মুখে সহসা লালসার প্রথরতা দেখাইয়া, স্ত্রীকে ভীতা করিয়া তাহার হৃদয় হইতে প্রেমকে দূর করিয়া দিয়াছেন, তাহা বলা যায় না। লালসা, রাক্ষসীবৃত্তি, ইহার দমনেই সৌন্দর্য্য ও সুখ। কি প্রথায় ও কিরূপে ধীরে ধীরে লালসাকে হৃদয়ে স্থান দান করিতে হইবে, নিম্নে আমরা তাহাই লিখি- তেছি। লালসার প্রধান বৃত্তিই ভোগ ইচ্ছা। কোন ইচ্ছাকেই হৃদয়ে প্রবল হইতে দিতে নাই, বিশেষ ভোগ ইচ্ছা তো নিতান্ত বল- বতী ইচ্ছা। যখন বুঝিবে যে, উভয়ের হৃদয়ে প্রেম দৃঢ়রূপে সম্বন্ধ হইয়াছে, কেবল তখনই পরস্পর পরস্পরের অঙ্গ স্পর্শ করিতে অগ্রসর হইবে। নতুবা এ কাৰ্য্য কখনই করা কর্তব্য নহে, কারণ লালসাপ্রবৃত্তিকে একবার প্রশ্রয় দিলে উহাকে আর দমন করিয়া রাখিতে পারা যায় না। প্রথম স্পর্শ। ইহাতে লালসা ভাব অব্যক্তরূপে ন্যস্ত থাকি- লেও এরূপ স্পর্শে প্রেম বৃদ্ধি হইবে, শত গুণ বৃদ্ধি হইবে। প্রেমে প্রেমিকের সর্ব্ব শরীরে একরূপ বৈদ্যুতিক অগ্নি ছুটিতে থাকে। বিদ্যুৎযুক্ত দুই খানি মেঘ নিকটস্থ হইলে যেমন ঐ হুই মেঘে আপনা আপনিই বিদ্যুৎ ছুটিতে থাকে, ঠিক সেইরূপ প্রণয়ী প্রণয়িণী নিকটস্থ হইলে ইহাদের উভয়ের শরীরেও এক- রূপ অগ্নি ছুটিতে থাকে ৷ প্রণয়ী প্রণয়িণীর স্পর্শে এই অগ্নি যেন ঘাতপ্রতিঘাতে দ্বিগুণিত হয়। উভয়ের স্পর্শে উভয়ের মস্তিষ্কে যেন কি এক অগ্নি ছুটে,হৃদয়ের প্রত্যেক তন্ত্রী গুলি যেন একে একে বাজিয়া উঠে, উভয়েই প্রেমের আবেগে বিমুগ্ধ হইয়া যায়। তখন সে স্পর্শ যেন অনন্ত কাল স্থায়ী করিতে ইচ্ছা যায়, সে স্পর্শে যেন কত সুখ, কত আনন্দ !

হস্ত স্পর্শন

শরীরের ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গস্পর্শে,ভিন্ন ভিন্ন সুখ উপলব্ধি হয়; কোন অঙ্গ স্পর্শে হৃদয়ে প্রেম ভাব বৃদ্ধি হয়. কোন অঙ্গ স্পর্শে আবার লালসা প্রবৃত্তি প্রবল হয়। এই জন্য যে যে অঙ্গ স্পর্শে লালসা প্রবৃত্তি প্রবল হয়, তাহা প্রথম প্রথম স্পর্শ করা নিতান্ত গর্হিত কাৰ্য্য। এই জন্যই আমরা হস্ত স্পর্শই প্রথম উপযুক্ত স্পর্শ বিবেচনা করি। কেবল স্পর্শেই প্রেম বৃদ্ধি হয়; কিন্তু স্পর্শেও একটী ভাষা আছে। একথা লোক সহজে বুঝিতে পারিবে না, অনে- কেই হয় তো আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিবেন, “স্পর্শে আবার ভাষা কি!” কিন্তু আমরা জানি, স্পর্শও প্রেমের একটা জীৱন্ত ভাষা। না কথা কহিয়া, না চাহিয়া, একটা শব্দ মাত্র উচ্চারণ না করিয়া, প্রণয়ী প্রণয়িণী উভয়ে উভয়ের হস্ত ধারণ করিয়া নিজ নিজ প্রাণের সকল কথা কহিতে পারে, এবং এ সংসারে অনেক স্থলে কহিয়াও থাকে। আদর। হাতে হাত খানি লইলে বড় আনন্দ হয়; সে হাত আর এজীবনে ছাড়িতে ইচ্ছা হয় না। কিন্তু আমার হৃদয়ের প্রেম আমার প্রণয়িণী অবগত হইবেন কিরূপে? প্রেমভরে, আদরে অতি যত্নে হস্ত একটু পেষণ কর, অমনি তোমার হৃদয়ের সকল কথা ব্যক্ত হইয়া পড়িবে। আমরা একটা মাত্র দৃষ্টান্ত দিলাম, স্পর্শে সহস্র প্রকার মানসিক ভাব ব্যক্ত করা যায় এবং প্রেমিক শত সহস্ৰ ভাব স্পর্শ দ্বারা প্রকাশ করিয়াও থাকে। কেবল ইহাই নহে। কে কাহাকে ভালবাসে, কে কাহাকে কত ভালবাসে, তাহাও প্রেমিকের হস্ত ক্রীড়া দেখিয়া স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। যে যাহাকে ভালবাসে সে তাহার হাত লইয়া আদর করিতে ও খেলা করিতে ইচ্ছা করে। ইহাতে প্ৰেম দিন দিন বৃদ্ধি পাইয়া থাকে, সুতরাং প্রেমিকের পক্ষে ইহার প্রতি অযত্ন বা তাচ্ছিল্য করা কর্তব্য নহে।

আদর

প্রেমের প্রেমের গভীরতা প্রকাশক ভাবের নাম আদর। আদরই সকল। প্রেমে যদি কিছু থাকে, তবে সে আর কিছু নহে, সে প্রাণের ও হৃদয়ের আদর। সুতরাং আমাদের বলা বাহুল্য, আদরে প্রেম যত বৃদ্ধি হয়, তত আর কিছুতেই হয় না। আদর শত সহস্র প্রকার। এ সংসারে কত প্রকার আদর, আছে, তাহা প্রেমিকই কেবল জানে, অন্যে তাহা জানিবে কি? কথায় আদর, নয়নে আদর, স্পর্শে আদর, আদরের সহস্র বিকাশ, কোটি কোটি ভাব। প্রেম-রক্ষ। আদর কি কাহাকেও শিখাইতে হয়? যেমন গোলাপ ব্লক্ষ রোপিত হইলে উহাতে সময়ে গোলাপ আপনিই প্রস্ফুটিত হয়, তাহার সাহায্য করিবার জন্য কাহাকেও মায়াস পাইতে হয় না, তেমনিই প্রেম হৃদয়ে রোপিত হইলে প্রেমের ফুল আদর, হৃদয়ে বৃত্তে বৃত্তে প্রস্ফুটিত আপনিই হয়। কিন্তু আদরের আধিক্যের পক্ষপাতী আমরা নহি। কিছুরই ৰাড়াবাড়ি ভাল নহে। বিশেষতঃ প্রেমের প্রারম্ভে প্রেমের আধিক্য, প্রেম নষ্ট করিবার একটা প্রধান যন্ত্র। দুই একটা আদরের কথা, দুই একবার আদর পূর্ণ দৃষ্টি, মধ্যে মধ্যে প্রেম উদ্দীপনার উপায় সন্দেহ নাই। হাত ধরিয়া আদরেও কোন ক্ষতি হইবার সম্ভবনা নাই। কিন্তু প্রথম ইহাপেক্ষা অধিক আড়ম্বর পূর্ণ আদরে প্রেম বৃদ্ধি না করিয়া প্রেমের হ্রাস করিতে পারে। আদরের ন্যায় মধুর বিষয় এ সংসারে আর কি আছে? প্রাণের ভালবাসা প্রকাশ করিবার ইহাপেক্ষা আর উৎকৃষ্ট উপায় কি? পিতা মাতা, সন্তানকে ভালবাসা দেখাইবার জন্ম আদর করেন,—ভ্রাতা ভগিনীকে, বন্ধু বন্ধুকে, – যে যাহাকে ভালবাসে সে তাহাকেই আদর করে, – আদরের ন্যায় পবিত্র মধুর ও হৃদয়ানন্দ দায়ক কার্য্য এ সংসারে কিছুই নাই। কিন্তু আদরও শিখিতে হয়। মানুষের সকলই শিখিতে হয়, সুতরাং আদরও শিখিতে হয়। অসভ্য সাঁওতাল বা গারো কি, কখন রমণীজাতির উপযুক্ত আদরে,সক্ষম হয়? এই জন্যই আমরা দেখিতে পাই, সভ্য জাতীয় পুরুষের প্রেমে অসভ্য জাতীয় রমণী সহজেই পতিতা হয়; এই জন্যই অশিক্ষিতা,নিম্ন গৃহের রমণী,শিক্ষিত ভদ্র যুবকের প্রেমে অতি সহজে মুগ্ধা হয়। আদর। আদর একটা শিখিবার বিষয়—ইহা একটা বিদ্যা বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। এ বিদ্যার বলে বনের পশু পক্ষী পর্যন্তও মুগ্ধ হইয়া বশীভূত হয়। আদর শিখিতে হইলে চরিত্র হইতে সমস্ত কঠিনতাকে দূর করিতে হয়, নিজের চরিত্র যথাসম্ভব কোমল করিতে হয়, — হৃদয়ে সুপ্রবৃত্তি ও সুনীতি সকলকে যত্ন করিয়া আনিতে হয়। তৎপরে স্বর মিষ্ট, কথা মধুর ও প্রিয়, ভাবভঙ্গি কোমল ও শিষ্ট করিবার জন্য এসকল লাভ হইলে দেখিতে হয়, কোন্ কথা গুলি, কোন্ ভাব ভঙ্গি, কোন্ কোন্ কাৰ্য্য স্বভাবতই রমণীজাতির নিকট প্রিয় এবং কিসেই বা তাহারা স্বভাবতই সহজে মুগ্ধা হইয়া থাকে। ইহা অবগত হওয়া কি কঠিন? স্ত্রীলোকেরা কি ভালবাসে তাহা কোন পুরুষ না এসংসারে অবগত আছেন? যিনি নাই, তাঁহারও কি ইহা অবগত হইতে অধিক ক্লেশ পাইতে হয়?

স্ত্রীলোকদিগের প্রতি একটু বিশেষ দৃষ্টি রাখ, তাহারা কখন কি করে, কখন কি কার্য্য করিতে ভালবাসে, কখন কোন দ্রব্য পাইবার জন্য ইচ্ছা করে, ইহা অবগত হইবার জন্য চেষ্টা কর। অনায়াসেই স্ত্রীলোকের প্রিয় কার্য্য ও প্রিয় বিষয় সকল তুমি স্পষ্ট বুঝিতে ও জানিতে পারিবে।
যখন এই দুই কাৰ্য সম্পন্ন হইল; যখন নিজের হৃদয় কোমল ও মধুর হইল, যখন স্ত্রীহৃদয়ের প্রিয় কার্য্য ও প্রিয় দ্রব্য সকল কি অবগত হইলে, তখন স্ত্রীজাতিকে আদর করিয়া মুগ্ধ করা আর কঠিন নহে। এসংসারে মানব মাত্রেরই কোন না কোন বিষয়ে হৃদয়ে দুর্ব্বলতা আছে। ইংরেজ পণ্ডিতগণ এই দুর্ব্বলতা কে “মেন উইকনেস” বলেন। কোন বিষয়ে কাহার “উই- প্রেম-রঙ্গ। কনেস আছে জানিলে, তাহাকে মুগ্ধ করা ও তাহাকে দাসামু- দাস করা বিন্দুমাত্র কঠিন নহে। আমি আত্মপ্রশংসা বড় ভাল বাসি, আমার ইহাই “ উইকনেস”, যে আমাকে প্রশংসা করে, সুতরাং তাহারই উপর সন্তুষ্ট হই। কেহৰা মনে মনে নিজের রূপের বা বিশেষ কোন গুণের পক্ষপাতী, তাহার তাহাই “উই- কনেস ”। যে সেইটুকু বুঝিয়া কাৰ্য করে, সংসারে তাহারই উপর সে সন্তুষ্ট হয়। স্ত্রীলোকই হউক বা পুরুষই হউক ে পরের “ উইকনেস” বুঝিয়া কার্য্য করিতে পারে, পরে সে তাহার ক্রীত দাস হয়। পৃথিবীর সর্ব্বদেশেই পুরুষ স্ত্রীলোকের দাস। কি দরিদ্র কি ধনী, কি পণ্ডিত কি মূর্খ, কি সভ্য কি অসভ্য সকলেই কোন না কোন স্ত্রীলোকের অধীনতা স্বীকার করিয়াছেন। যে বীর পৃথিবী জয় করিয়া, দিগ্বিজয়ী হয়েন, তিনিও স্ত্রীলোকের নিকট মস্তক অবনত করিয়া রহেন। কেন? পুরুষ কি স্ত্রী জাতি অপেক্ষা কোন অংশে হীন? স্ত্রীলোক কি কোন মায়া জানে যে, মায়ার বলে পুরুষ মাত্রেই তাহাদের ক্রীত দাস হয়? মান্নাও নহে, বিশেষ কোন গুণও নহে, কেবল স্ত্রীলোক পরের উইকনেস ” বিশেষতঃ পুরুষের “উইকনেস” সহজে অবগত হইতে পারে, এই জন্যই তাহারা পুরুষের উপর এত কর্তৃত্ব করিতে সক্ষম হয়। এই “উইকনেস” অবগত হইবার জন্তু তাহাদের কি কোন বিশেষ ক্ষমতা আছে তাহা নহে।

পুরুষ সাংসারিক নানা কাজে ব্যস্ত হইয়া থাকে; পুরুষের পরের দিকে চাহিবার অবসর হয় না, সুতরাং পুরুষ পরের দুর্ব্বলতাও সহজে অবগত হইতে পারে না। স্ত্রীলোকদিগের পক্ষে এরূপ নহে। পুরুষকে পর্য্য- চিবুক ধারণ বেক্ষণ করাই তাহাদের একটা প্রধান কার্য্য, সুতরাং তাহারা সহজেই পরের দুর্ব্বলতা জানিতে পারে। পরকে সন্তুষ্ট করার নামই আদর। সাধারণ সন্তোষ নহে, যাহাতে হৃদয়ে বিমল আনন্দ উপভোগ হয় তাহারই নাম আদর। কাহার কিসে সন্তোষ হয় তাহা জানিতে না পারিলে,কেহ কখন ও আদর করিতে পারে না। যাহার যেখানে হৃদয়ের দুর্ব্বলতা, তাহার সেখানে আঘাত করিতে পারিলেই সে প্রকৃত সন্তুষ্ট ও আহ্লাদিত হয়। যদি আদর করিতে চাহ, আর আদর শিখিতে চাহ, তবে যাহাকে আদর করিবে তাহার হৃদয়ের দুর্ব্বলতা কোথায় ও কিসে তাহাই প্রথম অবগত হইবার জন্য চেষ্টাকর।

চিবুক ধারণ

আমরা পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি আদর সহস্র প্রকার আছে। ইহার মধ্যে কোনটী ভাল, কোনটী অপেক্ষাক্বত মন্দ, তাহা বলিতে ভিন্ন ভিন্ন লোকের নিকট ভিন্ন ভিন্ন আদর না। পারা যায় প্রিয়। কিন্তু সাধারণতঃ চিবুক ধারণ, সকল সময়ে সকলের পক্ষেই বড় প্রিয় জননী সন্তানের চিবুক ধারণ করিয়া আদর করেন, প্রণয়ী প্রণয়িণীর চিবুক ধারণ করিয়া আদর * করেন, কি সভ্য কি অসভ্য সকল দেশেই এ আদর দেখিতে পাওয়া যায়; ইহা কাহাকেও শিখিতে হয় না, সতঃই মনে এ আদর আইসে। চিবুক ধারণ আদরের মধ্যে একটী শ্রেষ্ঠ আদর তাহা সকলেই জানেন, কিন্তু চিবুক ধারণ আদর কেন? আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি নিজ হৃদয়ের ভাব প্রকাশক কার্য্যের নামই হস্ত ধারণেও আদর করা হয়, ঐ হস্ত ঈষৎ পেষণ করিলে আরও আদর করা হয়, যেহেতু ঐ পেষণের সঙ্গে সঙ্গে তোমার হৃদয়ের ভালবাসা প্রকাশ হয়।

ঠিক এই জন্যই চিবুক ধারণ এত আদর পূর্ণ কার্য্য। স্পর্শ ও পেষণ ভাবব্যঞ্জক কার্য্য। চিবুক ধারণে স্পর্শ ও গেষণ উভয়ই আছে, এতদ্ব্যতীত ইহাতে মুখ তুলিয়া প্রেমিক নিজ চক্ষের সহিত প্রেমিকের চক্ষু সম্মিলিত করেন। প্রেমিক সহজেই ও স্বভাবতই বড় লজ্জাশীল, প্রণয়ী প্রগয়িণী ইচ্ছা থাকিলেত উভয়ে উভয়ের চক্ষের দিকে বড় চাহিতে পারেন না। চিবুক ধরিয়া মুখখানি তুলিয়া আদর করিলে, উভয়ের চক্ষু স্বভাবতই উভয়ের সহিত সন্মিলিত হয়। তখন প্রেমিক নিজ হৃদয়ের সকল প্রেম, সকল ভালবাসা, সকল আদর যেন সেই চক্ষে ঢালিয়া দেন। তুমি আমাকে ভালবাস ইহা জানিলে প্রাণ যত সন্তোষ হয়, এসংসারে আর কিছুতেই তত হয় না। আর আমি যাহাকে ভালবাসি সে আমাকে বড় ভালবাসে, সে আমাকে প্রাণের অপেক্ষা ভালবাসে, হৃদয়ের সহিত ভালবাসে এ কথা জানিলে হৃদয়ে যে সুথের উপলব্ধি হয়, সে সুখ এ পৃথিবীর নহে। সে স্বর্গের সুখ, মানুষ প্রকৃত প্রেমিক হইলে কখনও কথনও সেই সুখ উপলব্ধি করিতে সক্ষম হয়। তাই হৃদয়ে প্রেম না থাকিলে বা হৃদয়ের প্রেম চক্ষে প্রতিভাসিত করিতে না পারিলে চিবুক ধরিয়া আদর, আদরই নহে। চিবুক ধরিলেই যে আদর করা হইল এরূপ নহে,— চিবুক ধরিলেই যে প্রেমিক হৃদয়ে বড় সন্তোষ লাভ করিল, এরূপ নহে;–চিবুক ধারণের সহিত চক্ষে চক্ষে সন্মিলন আবশ্যক, সেই সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ের ভালবাসা চক্ষে প্রতিভাসিত আলিঙ্গন করা প্রয়োজন।

তৎপরে চক্ষু দিয়া ভালবাসা চক্ষে ঢালিয়া দিয়া প্রেমিকের হৃদয়ে প্রেরণ আবশ্যক। তাই চিবুক ধারণে আদর করা হয়,—নতুবা ইহাতে কোমলতা ও প্রেমপূর্ণতা না থাকিলে, এরূপ আদরে প্রেম বৃদ্ধি না করিয়া প্রেমিকের হৃদয়ে ঘৃণার উদ্রেক করে। আমরা আরও একটা কথা বলিতে চাহি। আদরে লালসার প্রতিবিম্ব একটু থাকিৰে সত্য, কিন্তু আদরে যেন, কোন ক্রমে লালসার প্রথরতা প্রকাশ হইয়া না পড়ে;—ইহাতে প্রেম পথের নুতন পথিক ভীত হইয়া পথত্যাগ করিয়া পথভ্রষ্ট হইতে পারে। প্রেমে ধৈর্য্য যত্ন ও আয়াসই সকল। যাহার ইহা নাই, সে কখনই প্রেম যোগ সাধনায় সফল মনোরথ হইতে পারে না।

 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

আলিঙ্গন

এদিকে হৃদয়ে প্রেম যতই নিজ রাজ্য বিস্তৃত করিতে থাকে, লালসাও ততই নিজ ক্ষমতা প্রকাশে যত্নবান হইতে থাকে। দর্শন, আলাপ, স্পর্শ ও আদর প্রেমের ভিন্ন ভিন্ন স্তর মাত্র। — ইহাদের দেখিয়া প্রেমের কিরূপ গাঢ়তা জন্মিয়াছে, হৃদয়ে প্রেম কি অবস্থায় আছে, তাহা জানিতে পারা যায়। কেবল ভাল বাসিয়াই তো প্রাণের সন্তোষ জন্মে না; অনেকেই প্রেমকে পবিত্র বলেন, অনেক প্রেমিকই প্রেমকে পবিত্র ভাবিয়া প্রেমে পাশব প্রবৃত্তির সন্মিলন হইতে দিতে চাহেন না। প্রেমে পাশব প্রবৃত্তি আছে বলিলে, তাঁহারা ভ্রূ কুঞ্চিত করেন; তাঁহারা বলেন,তাঁহারা ভালবাসার জন্যই ভালবাসেন, —তাঁহাদের ভাল- বাসিয়াই সুখ,—তাঁহারা মুহূর্তের জন্যও প্রেম উপভোগ করিতে ব্রাগ্র নহেন। এরূপ ভালবাসা যে এ সংসারে নাই, এ কথা আমরা বলি না, কিন্তু প্রেমের প্রথমে যে ভালবাসা সম্পূর্ণ লালসা শূন্য হইতে পারে, এ কথা আমরা বিশ্বাস করি না। উপরে যে ভালবাসার কথা হইল, উহা ভালবাসার পূর্ণ বিকাশ, উহা ভালবাসার শেষ স্তর, প্রথমেই ওরূপ ভালবাসা হইতে পারে না এবং হয় না। ইহা কেবল কবির কল্পনাতেই দেখিতে পাওয়া যায়। প্রেমের প্রারম্ভে প্রেমে ও লালসায় যুদ্ধ হইতে থাকে ৷

প্রেম নিজ রাজ্য বিস্তারের জন্য প্রয়াস পায়, লালসাও নিজ ক্ষমতা প্রকাশ করিবার জন্য সাধ্য মত যত্ন করে। কখনও বা এই যুদ্ধে প্রেমের জয় হয়, কখনও বা লালসারই জয় হয়। মানব হৃদয়, শিক্ষার অভাবে পাপের দিকে সতঃই আক্বষ্ট,–অনেকে প্রেমের গভীর ও দূরে অবস্থিত সুখের প্রত্যাশার অপেক্ষা করিতে পারেন না। লালসার আপাত মনোরম সুখের প্রলোভনে প্রলুব্ধ হইয়া অনেকেই প্রেম পথ ভ্রষ্ট হইয়া লালসার সুখ সম্ভোগ : গের জন্য ব্যাকুল হয়েন। ক্রমে প্রেমের পবিত্রতা, হৃদয় হইতে দূর হইয়া প্রীতির পাশৰ প্রবৃত্তিই হৃদয়ে রাজ্য বিস্তার করে। কেবল ধৈর্য্যই হৃদয়কে দমনে রাখিতে পারে, কেবল ধৈর্য্যই হৃদয়ে লালসা প্রবৃত্তিকে দমনে রাখিয়া প্রেমকে সতেজ করিতে পারে । তাই বলিয়া লালসা প্রবৃত্তিকে একেবারে দমন করিতে আমরা বলি না। তাহাতে প্রেম বৃদ্ধি না হইয়া ক্ৰমে হ্রাস হইতে থাকে। এই জন্য প্রেম উপভোগ করিতে হইলে, প্রেমের স্তরে স্তরে উঠিত হয়। দর্শনের পরেই স্পর্শ, বা আলাপের পরেই আদর, কিম্বা দর্শনের পরেই আলিঙ্গন, চুম্বন, প্রেমকে নষ্ট করিয়া হৃদয়ে লালসা প্রবৃত্তিকে আনয়ন করে। সকলেই জানেন, লালসাময় প্রীতি ক্ষণ স্থায়ী,—প্রেমই কেবল অনস্ত কাল ব্যাপী ভাল বাসা। যখন আদর অভ্যস্থ হইল. —যখন আদর করিয়া ও হৃদয়ের পূর্ণ সন্তোষ জন্মে ন1; হৃদয় যেন কি চায়, কি চায়, আর কি যেন পায় না,—যেন হৃদয় হৃদয়ের সহিত সম্মিলিত হইতে ব্যাকুল,—যেন দর্শন, আলাপ, স্পর্শ ও আদর এক সঙ্গে এক সময়ে না হইলে হৃদয়ের আর সন্তোষ জন্মে না;—যখন এই ভাব,—যখন হৃদয়ে আর প্রেন ধরে না, – প্রেম উথলিয়া পড়ি- তেছে,—কেবল তখনই আলিঙ্গন কর্তব্য।
আলিঙ্গন লালসা প্রবৃত্তি চরিতার্থ করিবার জন্য হৃদয়ের ইচ্ছাব্যঞ্জক ভাব ভিন্ন আর কিছুই নহে। লালসাকে নিরন্ত না করিলে লালসা ক্রমে প্রবল হইতে থাকিবে,—যতই ইহাকে প্রতিবন্ধক দিবে, লালসা ততই প্রথর হইতে আরম্ভ হইবে, শেষে লালসার প্রবল তরঙ্গে প্রেম ভাসিয়া যাইবে।

এই জন্ত লালসাকে একেবারে দমন করিতে আমরা পরামর্শ দিই না; কেবল যাহাতে লালসা নিতান্ত প্রবল হইতে না পারে, সাধ্যমত চেষ্টা করিয়া তাহাই করিতে হইবে। এবং ইহাকে শাস্ত করিবার জন্য, মধ্যে মধ্যে ইহার আকুলতাকে শাস্ত করিতে হইবে। অল্পে অল্পে ইহার ইচ্ছাকে পূর্ণ করিলে, ইহার তেজ ক্রমে ক্রমে লাঘব হইয়া আসিবে। যখন প্রেম-রক্ষ। লালসা হৃদরকে উন্মত্ত করিয়া তুলে,—যখন হৃদয় আর প্রবোধ মানে না,—যখন হৃদয়, লালসা উপভোগের জন্য পাগল হয়, তখন লালসাকে দমন করিবার এক মাত্র ঔষধই আলিঙ্গন। লালনা শারীরিক উত্তেজনা, — লালসায় মস্তিষ্কে অগ্নি জ্বলিয়া উঠে, শরীরের প্রত্যেক শিরার শিরার বিদ্যুৎ ছুটিতে থাকে, যতক্ষণ না ঐ বৈদ্যুতিক তেজ অন্যত্র বিস্তৃত হইয়া পড়ে ততক্ষণ হৃদয়ে শাস্তি জন্মে না। শরীরের বিদ্যুতে ও মেঘের বিদ্যুতে কোন প্রভেদ নাই, মেঘের বিদ্যুতের ন্যায় শরীরের বিদ্যুৎ ও অপর শরীরে ব্যাপ্ত হইয়া পড়ে। যখন আমরা প্রেমের আবেগে ও লালসার তাড়নে প্রেমিককে হৃদয়ে টানিয়া লইয়া হৃদয়ে পেষিত করিয়াও সন্তোষ লাভ করি না, তখন আপনা আপনিই আমাদের শরীরস্থ তাড়িত প্রবাহ অন্য শরীরস্থ হইয়া পড়ে। আমাদের মস্তিষ্কের অগ্নি কথঞ্চিৎ নির্ব্বাপিত হয়, শরীরের বিদ্যুৎ নিস্তেজ হইয়া পড়ে। সুতরাং লালসারও শাস্তি জন্মে। যদি হৃদয়ে প্রকৃত প্রেম থাকে, তাহা হইলে লালসার শাস্তি হইবা মাত্র অমনি প্রেমের বাহু বিকাশ হয়,—লালসাকে নিস্তেজ পাইবা মাত্র প্রেম প্রবল হইয়া উঠে, তখন আর আলিঙ্গনে পাশব ভাৰ বিন্দু মাত্রও থাকে না।

কিন্তু কতক্ষণ ও কিরূপ ভাবে পাশৰ প্ৰবৃত্তি আলিঙ্গনে থাকে ও কিসেই বা দুরীভূত হয়, তাহা দেখা প্রথম প্রয়োজন। সুখ দুই প্রকার, এক হৃদয়ের, অঙ্ক শরীরের। হৃদয়ের সুখের সহিত শরীরের কোন সম্বন্ধ নাই। শরীরের সুখ জন্মি- লেই যে, হৃদয়ে সুখ উপলব্ধি হইবে ইহারও কোন অর্থ নাই – একটা স্কুল দেখিলে যে আনন্দ হয় সে আনন্দ সম্পূর্ণ হৃদরের আলিঙ্গন। কিন্তু ঐ ফুলটা ঘ্রাণ করিলে যে মুখ বোধ হয়, উহা সম্পূর্ণ শরীরের। প্রণয়িনীর সহিত কথা কহিলে যে আনন্দ হয়, সে আনন্দ সম্পূর্ণ হৃদয়ের, কিন্তু প্রণয়িণীকে স্পর্শ করিলে যে আনন্দ হয় উহা শরীরের। আমরা আরও একটু যাইব, প্রণয়িণীকে ভাল বাসিয়া যে সুখ, সে সুখ সম্পূর্ণ হৃদয়ের সুখ, তাহার সহিত শরী- রের কোন সম্বন্ধ নাই। কিন্তু প্রণয়িণীর সহিত সহবাসে ধে সুখ, সে সুখ সম্পূর্ণ শরীরের সুখ, তাহার সহিত হৃদয়ের কোন সম্পর্ক নাই। কিন্তু আলিঙ্গনে শারীরিক ও হৃদয়ের উভয় সুখই আছে, কারণ আলিঙ্গন লালসা ও প্রেমের মধ্যবর্তি রেখা বিশেষ। আলিঙ্গনে প্রেমও আছে, লালসাও আছে।

প্রেমও লালসাকে একত্র সন্মিলিত করিবার জন্যই যেন আলিঙ্গনের সৃষ্টি। আলিঙ্গনের প্রথম বিকাশে লালসার ভাগই অধিক থাকে, তখন লালসার প্রখরতায় প্রেম নিস্তেজ হইয়া হৃদয়ে সঙ্কুচিত হয়। যখন আমরা প্রণয়িণীকে হৃদয়ে টানিয়া লই, যখন দুই হস্তে তাহার শরীর বেষ্টন করিয়া হৃদয়ের উপর তাহাকে পেষণ করি, তখন আমাদের হৃদয়ে প্রণয়িণীর হৃদয়, আমাদের বাহুতে প্রণয়িণীর বাহু, তাহার অঙ্গে আমাদের অঙ্গ সম্পূর্ণ জড়িত হইয়া যায়, তখন আমাদের হৃদয়ে লালসাই প্রবল হয়। যতক্ষণ আমরা শরীর স্পর্শ ও পেষণ করিয়া সুখ বোধ করি, যতক্ষণ আমাদের হৃদয়ে পাশব প্রবৃত্তি রাজত্ব করে, ততক্ষণ আমরা আলিঙ্গনের প্রকৃত সুখ উপভোগ করিতে পারি না। আমাদের মস্তিষ্কে একরূপ অগ্নি প্রজ্জলিত হইয়া আমাদিগকে উন্মত্ত করিয়া ফেলে, তখন আর আমাদের প্রকৃত সুখ উপলব্ধি করি- ৰার কোনই ক্ষমতা থাকে না। যদি এইরূপ লালসাসাগরে প্রেম-রক্ষ। পতিত হইয়া আমরা হৃদয় দমনে অক্ষম হই, যদি আত্মবিস্তৃত হইয়া লালসা চরিতার্থের জন্য ব্যগ্র হই, তাহা হইলে হৃদয়ে প্রেমের পরিবর্তে লালসাই বৃদ্ধি পায়। হৃদয়ে হৃদয়ে। যাহাতে লালসা প্রবৃত্তি নিস্তেজ হইয়া হৃদয়ে প্রেমকে বৃদ্ধি হইতে দেয়,তাহারই নাম হৃদয়ে হৃদয়ে আলিঙ্গন। একটু বিবেচনা কাররা দেখিলে জানা যায় মানব শরীরে দুইটী স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র জীব আছে। একটা জড় জীব ( মেটিরিয়াল ) অপরটা আধ্যাত্মিক জীব (স্পিরিচুয়াল )। আমরা যে আলিঙ্গনের কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি উহা দুইটী জড় জীবের আলিঙ্গন। উহার সহিত হৃদয়ের কোন সম্বন্ধ নাই। কিন্তু ঠিক ঐ রূপ হৃদয়ে হৃদয়েও আলিঙ্গন সম্ভব। মানবের অভ্যন্তরে যে আধ্যাত্মিক জীব আছে, উহাদের উভয়েরও আলিঙ্গন অসম্ভব নহে। হৃদয়ে হৃদয়ে আলিঙ্গনে ইহা সম্পূর্ণ না হইলেও কতক হয়। এ আলিঙ্গনে প্রেমিক শরীর জড় ও আধ্যাত্মিক উভয় জীবের আলিঙ্গন সন্মিলিত। আলিঙ্গনের সুখ স্পর্শ হইতে সম্ভূত।
প্রেমিকশরীরে সন্মিলিত হইয়া বিমল আনন্দ উপভোগ করে; যুবক যুবতীর মধ্যে ভালবাসা না থাকিলেও আলিঙ্গনের সুখ -উপলব্ধি হয়, কিন্তু হৃদয়ে হৃদয়ে আলিঙ্গন প্রেম ব্যতীত হয় না। ইহাতে একটা হৃদয় আর একটী হৃদয়ের সহিত স্পর্শ হয়, একটা হৃদয় আর একটা হৃদয়কে আলিঙ্গন করে। যদি প্রকৃত ভালবাসা থাকে, তবে সেই ভালবাসাই অন্ত সকল বৃত্তিকে দমন করিয়া নিজের ক্ষমতা প্রকাশ করে।

হৃদয়ে হৃদয়ে

যেখানে প্রকৃত প্রেম আছে, সেখানে ইচ্ছা থাকিলেও প্রণয়ী প্রণয়িণী লালসাকে প্রবল হইতে দিতে পারেন না। প্রণয়ী, প্রণয়িণীর ক্লেশ জন্মিবার ভয়ে লালসাকে দমন করেন, আর প্রণয়িনীর লজ্জাই, তাঁহাকে লালসা রাক্ষসের হস্ত হইতে সর্ব্বদাই রক্ষা করিয়া থাকেন। এরূপ অবস্থায় হৃদয়ে প্রেমেরই উদ্দীপনা হয়। যখন প্রেমিকে প্রেমিকে আলিঙ্গন হয়, তখন স্বভাবতই উভয়ের হৃদয় উভয়ের হৃদয় দেখিবার জন্য ব্যগ্র হয়, তখন আপনই হুইটী হৃদয় এক হইয়া যায়। ইহা দেখা যায় না। যে প্রেমিক সেই কেবল ইহা বুঝিবে। হৃদয় হৃদয়ের সহিত কথা কয়। যখন উভয় প্রেমিকে বাহ্য জগৎ বিস্তৃত হইয়া উভয়ে উভয়কে হৃদয়ে আলিঙ্গন করে, তখন উভয়ের হৃদয়ে কথোপকথন হয়; সে কত মিষ্ট, সে কত মধুর, সে কত ভাব পূর্ণ কথা! সে কথা আমরা শুনিতে পাই না, জগতের আর কেহ শুনিতে পায় না ! কেবল প্রেমিকেই শুনিয়া থাকে। প্রেমিকেই বুঝিয়া থাকে। এ আলিঙ্গন প্রথা কি শিখিতে হয়? এ যে নরনারী আপনি শিখে, এ যে প্রেমিক হৃদয়ে আপনি আইসে। যাহার হৃদয়ে প্রকৃত ভালবাসা আছে, যে লালসা প্রবৃত্তিকে হৃদয়ে দমন করিতে পারে, সেই, হৃদয়ের প্রেম অপর হৃদয়ে ঢালিয়া দিতে পারে। যেমন জড় জগতে ঘটে, ঠিক তেমনি অন্তর্জগতেও ঘটিয়া থাকে ৷
প্রেম দান কর, অপর হৃদয়ে যত প্রেম প্রাপ্ত হইবে, ততই তাহাতে প্রেমের উদ্দীপন আরও হইতে হইবে। প্রণয়িণীকে হৃদয়ে আলিঙ্গন কর, — প্রথম যে লালসার প্রবল তরঙ্গ আসিয়া তোমার হৃদয়কে ভাসাইয়া লইয়া যাইবার চেষ্টা করিবে, উহাকে সবলে রোধ কর, উহারে হৃদয় হইতে দুর করিয়া দেও, প্রাণপণে লালসা ঝটিকাপাতিত প্রেমকে রক্ষা কর, তাহ। ইলেই তোমার হৃদয়, নিজ হৃদয়ের, ভাব প্রণয়িণী হৃদয়ে প্রতিবিম্বিত করিবার জন্ম ব্যাকুল হইবে, হৃদয়ে প্রেমের তরঙ্গ খেলিতে থাকিবে, আর সেই সময়ে প্রণয়িণীর হৃদয় যদি তোমার হৃদয়ের অতি সন্নিকটবর্ত্তী হয়, যদি উভয় হৃদয়ের স্পন্দন শব্দ উভয় হৃদয় শুনিতে পায়, তবে ঐ স্পন্দনের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি দেবীর অদ্ভুত কৌশলে প্রেমের কথা হৃদয় হইতে হৃদয়াত্তরে গমনাগমন করিবে। তখন হৃদয়ের কথা হৃদয়ে শুনিয়া, প্রেমিক হৃদয়ে প্রেমিক হৃদয় স্পর্শিত হইয়া, হৃদয়ে হৃদয়ে আলিঙ্গনে এক অনির্বচনীয় সুখ উপলব্ধি হইতে থাকিবে—সে সুখের নিকট লালসার সুখ কিছুই নহে। যদি হৃদয়ে হৃদয়ে আলিঙ্গনের সুখ উপভোগের ইচ্ছা থাকে, তবে আলিঙ্গন করিয়া কোন মতে হৃদয়ে লালসা প্ৰৰ্ব- ত্তিকে উত্তেজিত হইতে দিতে নাই, অথবা মুহূৰ্ত্ত মধ্যে প্রেমি- কদ্বয়ের প্রভেদ ও স্বতন্ত্র হওয়াও কৰ্ত্তব্য নহে। প্রথম আলি- জনেই হৃদয়ে হৃদয়ে আলিঙ্গন সম্ভব নহে, — ইহা সময়সাপেক্ষ। যখন হৃদয় হইতে লালসার প্রথম প্রবাহ তিরোহিত হয়, কেবল তথনই হৃদয় হৃদয়কে স্পর্শ করিতে সক্ষম হইয়া থাকে।

জীবনে জীবনে

হৃদয়ে হৃদয়ে আলিঙ্গনে একটু লালসা প্রবৃত্তি জড়িত থাকে, কিন্তু এ আলিঙ্গনেরও উৎকর্ষ সাধন হয়। চেষ্টায় ও যত্নে ক্রমে আলিঙ্গনে আর কখনই লালসা প্রবৃত্তি উত্তেজিত হয় না, এইরূপ আলিঙ্গনের নামই জীবনে জীবনে আলিঙ্গন। লালসা প্রবৃত্তি যে সম্ভব এ প্রাণে প্রাণে ৷ একেবারেই মিশ্রিত নাই, এরূপ আলিঙ্গনও কথা হয় তো অনেকে বিশ্বাস করিবেন না, এইজন্য তেছে। বিবাহের পর,—বিবাহের প্রথমাংশ ও নূতনত্ব কাটিয়া প্রথম এইটাই বুঝাইবার জন্ত আমাদিগকে চেষ্টা করিতে হই- গিয়াছে, যুবক যু’তীর যৌবন তেজ উপশমিত হইয়াছে, এরূপ সময়েও তো স্বামী স্ত্রীকে আলিঙ্গন করেন, কিন্তু সে আলিঙ্গনে তো লালসার উত্তেজনা হয় না। তাহাতে তো মস্তিষ্কে অগ্নি জ্বলে না, বা শিরায় বিদ্যুৎ ছুটে না। ইহাতেই স্পষ্ট বুঝা যায়, যে আলিঙ্গনও সম্পূর্ণরূপে লালসা শূন্য হইতে পারে। তখন সেই আলিঙ্গনকেই জীবনে জীবনে আলিঙ্গন বলে।

প্রাণে প্রাণে

প্রাণে প্রাণে আলিঙ্গন অর্থে, মানবের যে টুকু মানবত্ব সেই টুকুতে আলিঙ্গন। প্রাণ মানে এখানে জীবন নয়। মানবের যাহা মরিলেও মরে না, যাহার সহিত মানবের হৃদয় মন জড়িত, যেটুকু লইয়াই মানব,—সেই টুকুকেই আমরা এখানে প্রাণ বলিতেছি। প্রাণ বলিলে হয় তো অনেকের বুঝিত্বে গোল হইবে, কিন্তু আত্মা বলিলে বোধ হয়, সকলেই স্পষ্ট বুঝিতে পারিবেন। প্রাণে প্রাণে আলিঙ্গন বা আত্মায় আত্মায় আলি- জনও এ পৃথিবীতে সম্ভব। মানব পৃথিবীতে প্রধানতঃ জড়ভারাক্রান্ত,—প্রথম মানৰ মানবের শরীরই দেখে; শরীরের ভিতর যে পরমাত্মা আছে, আর ঐ পরমাত্মাই যে মানব শরীর চালাইতেছে, তাহা সহজে দেখিতে বা বুঝিতে পারে না, যতক্ষণ মানব জড়ের সমস্ত গুপ ৬৪ প্রেম-রঙ্গ। হইতে আপনাকে বিচ্যুত করিতে না পারে, ততক্ষণ তাহার আত্মান জন্মে না। এই জন্য তুমি আমি, যে সে, প্রাপে প্রাণে আলিঙ্গনের সুখ উপভোগ করিতে পারি না। শরীর দেখিতে পাই না, কেবল আত্মাকেই দেখি, যখন আমি আমিই আছি, আমার অন্ত আর কিছু নাই। যখন আমি চক্ষু বুজিয়াও দেখিতে পাই, নাসিকা বন্ধ করিয়াও ঘ্রাণ পাই, স্পর্শ না করিয়াও স্পর্শ সুখ অনুভব করিতে পারি, কেবল তথ- নই আমার আত্মজ্ঞান জন্মে। প্রেম সম্বন্ধেও ঠিক এইরূপ আত্মজ্ঞান জন্মে। প্রেমের মাত্রা পূর্ণ হইলে তখন প্রেমিক চক্ষু মুদিলেও প্রিয়জনকে দেখিতে পায়। তখন, হৃদয়ের এইরূপ ভাব হয়, তখন প্রণয়ী প্রণয়িণীর প্রকৃত আত্মায় আত্মায় প্রাণে প্রাণে আলিঙ্গন হয়। আমরা জড় সম্ভূত সুখকেই বড় সুখ মনে করি, প্রিয়জনের হস্ত স্পর্শ করিতে পারিলে বা প্রিয়জনকে আলিঙ্গন করিতে পারিলেই আমরা বড় আনন্দ বোধ করি; ইহাপেক্ষা যে আর অধিক আনন্দ ও সুখ হইতে পারে তাহা বুঝি না। যে, সে সুখ উপলব্ধি করিয়াছে, যে একবার জড়ের সুখ অতিক্রম করিয়া আধ্যাত্মিক (স্পিরিচুয়াল ) মুখের স্বাদ পাইয়াছে, সে কখন আর জড়ের সুখের জন্য ব্যাকুল হয় না। যে একবার হৃদয়কে স্পর্শ করিতে পারিয়াছে, হৃদয়কে আদর করিতে পারি- য়াছে, হৃদয়কে আলিঙ্গন করিতে সক্ষম হইয়াছে, সে আর হস্ত স্পর্শ বা অঙ্গ হৃদয়ে লইতে প্রলোভিত হয় না। জড়ের দ্বারা আধ্যাত্মিক বিষয়ের মিলন সম্ভব নহে, জড় জড়কে স্পর্শ বা আলিঙ্গন করিতে পারে। আধ্যাত্মিক বিষয়ই কেবল আত্মাকে বা প্রাণকে আলিঙ্গন ও স্পর্শ করিতে সক্ষম হয়। কিন্তু যতক্ষণ চুম্বন। জড়ভাৰ থাকে, ততক্ষণ কখনই আধ্যাত্মিক সুখভোগ হৃদয়ে ঘটে না । যদি প্রকৃত প্রাণে প্রাণে আলিঙ্গন করিতে চাই, যদি সেই আলিঙ্গনের বিমল আনন্দ উপভোগ করিবার জন্য ব্যাকুল হও, তবে লালসা বৃত্তিকে একেবারে হৃদয় হইতে দূর করিয়া দিয়া প্রেমের উৎকর্ষতা সাধন কর।

সপ্তম পরিচ্ছেদ

চুম্বন

দয়াময় বিধাতার মহিমা অপার। তিনি সর্ব্বদা আমাদের পার্শ্বে পার্শ্বে থাকিয়া সংসারে পাপের সহিত যুদ্ধে আমা দিগকে সাহায্য করিতেছেন, যেখানে আমাদের পরাস্ত হইবার সম্ভাবনা, সেখানে যাহাতে আমরা পরাস্ত না হই, তাহার উপার করিয়া দিতেছেন, যেখানে যখন আমাদের হৃদয়ে বলের অভাব হইতেছে, অমনি তখনই তথায় আমাদিগের হৃদয়ে বল দান করিতেছেন। তিনি দেখিলেন, উত্তপ্ত জড় জীব দুইটা একত্র সম্মিলিত হইলে,তাহাতে কামনা প্রবৃত্তি বৃদ্ধি পাইবে, যুবক যুবতী আলি- জনে বদ্ধ হইলে লালসার উন্মত্ত হইয়া আত্মজ্ঞান শূন্য হইবে, যখন কামনায় উত্তেজিত যুবক হৃদয়, যুবতী হৃদয়ে স্পর্শিত হইবে, – তখন লালসাকে দমন করা সাধারণ মনুষ্যের পক্ষে সম্পূর্ণ অসস্তব না হইলেও প্রায় অসম্ভব হইয়া পড়িবে, তখন সহস্রের মধ্যে একজনও হৃদয় দমনে প্রবল সক্ষম হইবে না, তখন কামনার তরঙ্গে পবিত্র প্রেম কোথায় পশুর অধম হইয়া পড়িবে ভাসিয়া যাইবে, তখন মানুষ মনুষ্যের এরূপ দুর্ব্বলতার সময় করুণাময় ভগবান তাগর সাহায্য না করিলে আর কে করিবে? : তাই তিনি এই অর্দ্ধ উন্মত্ততার সময়, এই মানব জীবনের কামনা প্রপীড়িত সময় লালসা প্রবৃত্তি যাহাতে সমিত হয়, তাহার উপায় উদ্ভাবিত করিয়া দিলেন।
ঝটিকায় উৎক্ষিপ্ত তরঙ্গ মালায় তৈল নিক্ষেপ করিলে, যেরূপ তৎক্ষণাৎ তরঙ্গমালা শাত্তমূর্তি ধারণ করে, যেমন উত্তপ্ত দুগ্ধ, কটাহ হইতে উৎক্ষিপ্ত হইয়া ভূপতিত হইবার উপক্রম করিলে জল দিলে শাত্তমূর্তি ধারণ করে, ঠিক সেইরূপ যখন মানব শরীরের শিরায় শিরায় কামনার তাড়নায় বিদ্যুত ছুটে, যখন মানব মানবী আত্মবিস্তৃত হইয়া পাশব প্রবৃত্তি চরিতার্থ করিবার জন্য পাগল হয়, ঠিক সেই সময় চুম্বন, ক্ষিপ্ত তরঙ্গমালা সদৃশ কামনাকে শাস্ত করে। চুম্বনে মুহুৰ্ত্তমধ্যে কামনাবৃত্তিকে একেবারে দমন করিতে না পারুক, অনেকাংশে ইহার তেজকে লাঘব করে। চুম্বনে লালসা সম্পূর্ণ মাত্রায় আছে, আবার চুম্বনে পৰিত্ৰ- তারও সম্পূর্ণ বিকাশ আছে। চুম্বনে প্রেমও যেরূপ প্রকাশ হয়, চুম্বনে প্রীতিও ঠিক সেইরূপ প্রকাশিত হয়।
মাতাও সন্তানকে চুম্বন করেন, সন্তানও মাতাকে চুম্বন করে, ইহাপেক্ষা পবিত্রতা এ সংসারে কামোন্মত্ত আর কিসে কোথায় আছে? আবার যুবক যুবতীকে চুম্বন করে, ইছাপেক্ষা লালসাই বা আর কোথায় কিসে আছে! চুম্বনের এই অদ্ভুত ও অপরূপ ভাবব্যঞ্জক ক্ষমতা আছে বলিয়াই চুম্বনের এই অত্যাশ্চৰ্য ক্ষমতা। লালসায় উম্মত্তপ্রায় যুবক, যুবতী উপভোগে; আত্ম- জ্ঞান শূন্য হইয়াছে, তখন সে এ সংসারের সকল কুকার্য্যই করিতে পারে, যদি তাহার লালসার শাস্তি না ঘটে, তবে সে সুম্পূর্ণ পাগল হইতেও পারে। তাহাকে কিছুতেই কেহ শাস্ত করিতে পারে না। তাহাকে প্রতিবন্ধক প্রদান কর, সে জ্ঞান শূন্য হইয়া যাহা ইচ্ছা করিয়া ফেলিবে, কিন্তু তাহাকে যুবতীর গোলাপ বিনিন্দিত কপোলে একটা চুম্বন করিতে অনুমতি কর, অমনি তাহার লালসা প্রবৃত্তি শান্ত হইবে, তাহার হৃদয়ে অমনি অন্য ভাবের উদয় হইবে, সে লালসাকে সমিত করিয়া অপেক্ষা করিতে শিখিবে, ধৈর্য্য ধারণে সক্ষম হইবে। আলিঙ্গনে যেরূপ লালসাকে উত্তেজিত করে, চুম্বনে ঠিক সেইরূপ প্রেমের উদ্দীপন করে।
লালসার সময়ে চুম্বনের অভি লাষ থাকে না, তখন হৃদয় আলোড়িত হইয়া, পাশবভাব হৃদয়ে দর্শন দেয়, নানারূপ পাশব কার্য্যে মন ব্যগ্র হয়, তখন কেবল পবিত্র প্রেমপূর্ণ চুম্বনে অভিলাষ থাকিবে কেন-? তখন দংশন,লেখন ইত্যাদি নীচ ও কুভাবের উদয় মনে হইয়া থাকে, তখন চুম্বনের ইচ্ছা একেবারেই থাকে না। চুম্বন করিলে চুম্বন করিতে ইচ্ছা যায়, ভালবাসিতে ইচ্ছা যায়, আদর করিতে ইচ্ছা যায়, প্রণয়িনীকে ক্লেশ দিতে, পদ দলিত করিতে, কিছুমাত্র স্পৃহা হয় না। চুম্বন করিলে হৃদয় লালসা প্রবৃত্তিকে স্থগিত রাখিয়া আদর করিতে, ভাল বাসিতে ভালবাসা দেখাইতে, চায়। পাশৰ প্রবৃত্তিতে মগ্ন হইলে তাহা তো হয় না। তাই লালসা প্রবৃত্তিকে সমিত করিবার জন্য চুম্বনই একমাত্র ঔষধ।
এত কাৰ্য্য থাকিতে চুম্বনেই একার্য সম্পন্ন হয় কেন? চুম্বন তো কোন কিছুই নহে ৷ একটু ভাবিয়! দেখিলে ইহার তো অর্থই দেখিতে পাওয়া যায় না, কোন ভাবেই লক্ষ্য হয় না। ওষ্ঠ স্পর্শও সেই সঙ্গে সঙ্গে একরূপ শব্দ, ইহাতে হৃদয়ে এত আনন্দ হয় কেন? ইহার এত অমানুষিক ক্ষমতাইব! কেন ? সহসা ইহার দেখিলে চুম্বন বালকের বালকত্ব বলিয়া বোধ হয়, বিষয় ভাবিলে হাসি পায়। অথচ চুম্বনের ম্যায় লালসা প্রবৃত্তিকে দমন রাখিবার ঔষধ আর কিছুই নাই, অথচ প্রেম প্রকাশক এরূপ সুকৌশলও এ সংসারে আর কিছুই নাই। চুম্বন একই কার্য্যের কত ভাব ! সন্তানের বাল্যকালীন ওষ্ঠের পিতামাতার নিকট কত মধুর, কত মিষ্ট, কত পবিত্র। পিতা মাতা শিশুর একটী চুম্বন লাভে জীবন সার্থক মনে করেন, আবার সন্তান সে পিতামার একটা চুম্বন লাভের জন্য কত ব্যাকুল হয়, পিতা মাতার একটা চুম্বন লাভের জন্য খেলা পরিত্যাগ করে, আহারীয় ছাড়িয়া আইসে,—কেন, সে ইহাতে কি মধুরতা পায়? আবার প্রেমিক, তাহার নিকট একটা চুম্বন তো জগতের সকল ঐশ্বর্য্য হইতে শ্রেষ্ঠ। প্রণয়ী, প্রণয়িণীর একটা চুম্বন পাইলে জগত সংসার ভূলিয়া যান, আর প্রণয়িনী প্রণয়ীর সাদর চুম্বনে সুখে আত্ম বিহ্বলা হইয়া চক্ষু মুদ্রিত করেন। চুম্বনে এ অত্যাশ্চর্য ঘটনা সকল কেন হয়, তাহা কেহ বর্ণনা করিতে বা ব্যাখ্যা করিতে সক্ষম নহেন। যিনি এই অত্যাশ্চর্য্য চুম্বনের স্রষ্টা তিনিই কেবল এ রহস্তের ভেদ করিতে পারেন। যিনি জগতের অন্য কোন জীব জন্তুকে আনন্দ প্রকা- শের কোন চিহ্ন না দিয়া, কেবল মনুষ্যকেই দিয়াছেন, তিনিই কেবল জানেন, চুম্বনে এত ভাব কেন প্রকাশ হয়। দুঃখ হইলে কান্না খায় কেন এবং সুখেই বা হাসি আইৱে কেন, বিধাতা ভিন্ন অন্য কেহই যেরূপ এ প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম নছেন, ঠিক সেই রূপ চুম্বনে এরূপ নানা ভাবের তরঙ্গ কেন খেলে, চুম্বনে লালস! প্রবৃত্তিকে কেন দমন রাখে, তাহা এ সংসারে তিনি ভিন্ন কেহ বলিতে পারেন না।

হস্ত

চুম্বনের জন্য অঙ্গের ভিন্ন ভিন্ন স্থান নির্দিষ্ট আছে বা মানুষ হৃদয়ের অব্যক্তব্য ভাবের দাস হইয়া আপনা আপনিই নির্দ্দিষ্ট করিয়া লইয়াছে। ইহারও কেহ কারণ নির্দেশ করিতে পারেন না,—তবে জিজ্ঞাসা করিলে সকলেই বলেন “এইরূপ করিলে এইরূপ হয়, কেন হয় জানি না।” আবার হয়তো অনেকেই জানেন না, অঙ্গের কোন অংশে চুম্বন করিলে, কি ভাবের উত্তেজনা হয়। আমরা প্রেমিকের চুম্বনের অন্যান্য চুম্বনের কথা প্রেমিকের হস্ত চুম্বন বলিবার চুম্বনের মধ্যে আমাদের দেশে তত কথাই কেবল এ পুস্তকে বলিব আমাদের আবশ্যক হইকে না। অতিদূরবর্তী চুম্বনই হস্ত চুম্বন চলিত নাই, কিন্তু ইয়োরোপে ইহার বিশেষ প্রচলন দেখিতে পাওয়া যায়। হস্ত চুম্বনে কাম- নার লেশমাত্র থাকিতে পারে না, কারণ ইহাতে হৃদয়ে ভক্তির উদ্রেক করে। যাহাকে মনে মনে ভয় করি, যাহাকে মনে মনে ভাল বাসিও ভক্তি করি, যাহাকে ভাল বাসার সঙ্গে সঙ্গে মা করি তাহার কেবল হস্ত চুম্বনে অভিলাষ হয়। যখন প্রণয়ী প্রেম-রক্ষ । প্রণয়িণীর হস্ত চুম্বন করেন, তখন তাঁহার হৃদয়ে প্রণয়িনীর প্রতি মান্য ভয় মিশ্রিত হইয়া ভালবাসা বিরাজ করে। আমি তাঁহাকে ভাল বাসি সত্য, মান্যও করি। কিন্তু তাহাকে সেই সঙ্গে সঙ্গে তাহার গুণের জন্য তাহাকে ভক্তিও করি। যদি হৃদয়ে কোন ক্রমে লালসা উত্তেজিত হয়, তাহা হইলেও হস্তচুম্বন করিলে সে লালসা বৃত্তি তৎক্ষণাৎ নিস্তেজ হইয়া যায়। কারণ যাহাকে ভয় ও ভক্তি করি, যাহাকে মান্য করি ও ভালবাসি তাহাকে ভোগ করিতে ইচ্ছা হয় না; ইচ্ছ। হইলেও সাহস হয় না।

কপাল

হন্ত চুম্বন অপেক্ষা কপাল চুম্বন অধিক প্রেম ভাবব্যঞ্জক। হস্ত চুম্বনে যেরূপ ভক্তি প্রকাশ হয় ও হৃদয়ে ভক্তির উদ্রেক করে কপাল চুম্বনে ঠিক সেইরূপ স্নেহপ্রকাশ করে এবং হৃদয়ে স্নেহের উদ্রেক করে। যাহাকে ভালবাসি ও স্নেহকরি যে আমা বই জানে না, যাহার আশ্রয় আমি, যাহাপেক্ষা আমি বড় ও যে আমাকে ভক্তি করে, কেবল তাহারই কপাল চুম্বন করিতে ইচ্ছা যায়। যখন প্রণয়ি প্রণয়িণীর কপাল চুম্বন করেন, তখন তাহার হৃদয়ে বিন্দু মাত্রও লালসা স্থান পায় না, তখন অনেকটা বাৎসল্যভাবের উদ্রেক হয়, তখন দুর্ব্বল ও আশ্রয় বিহীন- বড় মায়া হয়, তাহার যাহাতে কষ্ট হয় বা বলিয়া তাহার উপর কষ্ট হইবার সম্ভাবনা সেরূপ কার্য্য করিতে মুহূর্তের জন্যও ইচ্ছা হয় না। যদি নিতান্ত পাশবভাববশতঃ কোন ক্রমে হৃদয়ে পাশবভাবের উদ্রেক হয়, অমনি কপাল চুম্বন করিবে, দেখিবে মুহূর্ত্ত মধ্যে তোমার হৃদয়ে এক অত্যাশ্চধ্য পরিবর্তন ঘটিয়াছে, যাহাকে হৃদয়ে দলিত করিবার জন্য তোমার হৃদয় আকুল হইতেছিল। এক্ষণে তাহার উপর তোমার মায়া জন্মিয়াছে, স্নেহ জন্মিয়াছে, আর তাহাকে পদদলিত করিবার বাসনা তোমার একেবারেই নাই। হস্ত চুম্বন করিলে ভক্তি ও কপাল চুম্বন করিলে স্নেহ কেন জন্মে, তাহা কেহ বলিতে পারেন না। জন্মে, ইহাই দেখিতে পাওয়া যায় এবং সেই জন্য তদনুরূপ কার্য্য করাই নরনারী মাত্রেরই কর্তব্য। তবে আমরা ইহাও বলি যে স্নেহ ও ভক্তি সম্মিলিত না হইলেও প্রেম জন্মে না। প্রেম কোন ভালবাসা বিশেষ নহে,— কতকগুলি ভালবাসার সমষ্টির নামই প্রেম। প্রেমে ভক্তি আছে, স্নেহ আছে, সৌহৃদ্য আছে, নতুবা সে প্রেম, প্রেমই নহে। নিজের আস্তরিক বৃত্তি সকলের উৎকর্ষতা অন্ত হৃদয়ে দেখিলে তবেই তাহাকে ভক্তি করিতে ইচ্ছা যায়। যদি নিজের অপেক্ষা অন্য হৃদয়ে সৌন্দৰ্য অধিক না থাকে, তবে তাহাকে দেখিয়া আমি মুগ্ধ হইয়া তাহাকে ভালবাসিব কেন?
যাহাকে ভালবাসি তাহাকে নিশ্চয়ই ভক্তি করি, নতুবা কখনই ভালবাসা থাকিতে পারে না। স্ত্রীপুরুষের ভালবাসাও ভক্তি হইতে সমুৎপন্ন হয়, প্রেমের প্রথম স্তর ভক্তি, ইহা একটু ভাবিয়া দেখিলে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়। স্নেহ সম্বন্ধেও এইরূপ। যাহাকে নিঃসহায়া দেখি, যাহাকে দুর্ব্বল দেখি, যাহাকে আশ্রয় দিলে উপকার হইবে, যাহার অব- লখন পাইলে সে সুখী হইবে, মানুষ তাহাকেই স্নেহ করে, ঠিক এই জন্মই জননী সন্তানকে স্নেহ করেন, ঠিক এই জন্মই স্বামী স্ত্রীকে ভালবাসেন, প্রণয়ী প্রণয়িণীকে ভাল বাসেন। প্রেমের প্রেম-রঙ্গ। দ্বিতীয় স্তর স্নেহ। যখন ভক্তি স্নেভ ও সৌহৃদ্য সম্মিলিত হইয়া এক হইয়া যার তখনই তাহাকে প্রেম বলি। আমরা দেখিয়াছি হস্ত চুম্বনে হৃদয়ে ভক্তি ও কপাল চুম্বনে স্নেহের উদ্রেক হয়; সুতরাং প্রেমকে পেষণ করিয়া উৎকর্ষ সাধন করিতে হইলে হৃদয়ে ভক্তি ও স্নেহেরও উদ্দীপন করা কৰ্ত্তব্য; এই জন্যই হস্ত চুম্বন ও কপাল চুম্বন প্রেম বৃদ্ধির প্রধান উপায়। আবার আমরা ইহাও দেখিয়াছি, হস্ত চুম্বন ও কপাল চুম্বন হৃদয় হইতে লালসা একেবারে অন্তর্হিত করে, সুতরাং হৃদরে কামনা প্রবৃত্তিকে দমন করিতে হইলেও এই দুই প্রকার চুম্বন গ্রহণীয়। কিন্তু যখন প্রেম এতদূর বিস্তৃত হইয়াছে যে প্রেমিক প্রেমিকা উভয়কে উভয়ে আলিঙ্গন করেন, তখন আর হস্ত চুম্বনের সময়তো একেবারেই নাই; কপাল চুম্বনের কালও অতীত হইয়াছে বলা যাইতে পারে। তখন লালসাকে দমন করিবার জন্ম কপাল চুম্বন না হইলেও অন্য চুম্বনও প্রশস্ত উপায় সন্দেহ নাই। পরে ইহাই আমরা দেখাইতেছি।

গণ্ড

হস্ত চুম্বন যেরূপ ভক্তি প্রকাশক, কপাল চুম্বন যেরূপ স্নেহ প্রকাশক, গন্ড চুম্বন সেইরূপ প্রেম প্রকাশক, সুতরাং গণ্ড চুম্বনেও লালসা বৃত্তির একেবারে দমন না হউক, অনেক উপ- শন হয় তাহার কোনই সন্দেহ নাই। প্রেমিকের ইহাপেক্ষা উৎকৃষ্ট আদর আর কিছুই নাই; ইহাপেক্ষা প্রেম প্রকাশক কার্য্য এসংসারে আর কিছুই হইতে পারে না। তুমি হস্ত স্পর্শই কর, চিবুক ধরিয়া আদরই কর, আর প্রেমভরে আলিঙ্গনই কর কিছুতেই এত প্রেম প্রকাশ হয় না। হৃদয়ে প্রেম প্রকাশ করিতে হইলে গওচুম্বন করিলে যত প্রকাশ হয়, তেমন আর কিছুতেই হয় না; বিশেষতঃ গণ্ডের একটা অস্পষ্ট মিষ্ট ভাষা আছে, সে ভাষার ম্যায় ভাবব্যঞ্জক, মধুর ও সুন্দর ভাষা আর এ সংসারে নাই। এতদ্ব্যতীত গণ্ডের একটী গুপ্ত শোভা আছে, এ শোভা কেবল স্ত্রীলোকেরই আছে, অন্য কাহারও নাই, অন্য কাহারও থাকিতেও পারে না। প্রেম মিশ্রিত লজ্জার ন্যায় সৌন্দর্য, নারী জাতির আর কি আছে? মুখ ফুটে ফুটে, ফুটে না; বলি বলি, — বলি না, প্রকাশ করি করি, করি না, কে যেন মুখ চাপিয়া ধরে, কে যেন হৃদ- য়ের কথা বলিতে দেয় না। প্রঙ্ক টিতোন্মুখ গোলাপ কলির ন্যায় রমণী হৃদয়ে প্রেম ফুটে, ফুটে না। রমণী জাতির এই অপরূপ, হৃদয় আনন্দদায়ী সৌন্দর্য্য কেবল তাহাদের কপোল যুগলে প্রতি ভাষিত হয়। কপোল যুগল অতি ঈষৎ রক্তিমাভ হইয়া হৃদয়ের এই অবক্তব্যভাব ভাব প্রকাশ করে।

নারীজাতির কপোল যুগলেই লজ্জার ছায়া যেন ক্রীড়া করে। কিন্তু এ লজ্জা, এ প্রেম, এ শোভা নারীর কমনীয় বঙ্গনে অতি অস্পষ্ট ভাবে বিন্যস্ত থাকে, একটী সামান্য কার্য্যে মেঘান্তরিত চন্দ্রের ন্যায় এ সমস্ত শোভা প্রকাশিত হয় ৷ এই কাৰ্য্যটীই চুম্বন। নারীর কপোল যুগলে চুম্বন করিলে যে মনোহর রক্তিমাভ শোভা (ব্লস) প্রকাশ হয় … তাহাতে প্রেম ও লজ্জা গাথা। সেই রক্তিমাভ শোভা যেন মৃছ মধুর স্বরে বলে “ আমি তোমার ভাল বাসি কেবল বলিতে পারি না।” 98 প্রেম-রঙ্গ। উভয় পক্ষ হইতে চুম্বন না হইলেও আদর অসম্পূর্ণ থাকে না; ‘হৃদয়ের ভাব অবক্তব্য রহে না। গণ্ডের রক্তিমাভ শোভা রমণী, হৃদয় খুলিয়া প্রেমিক সম্মুখে ধারণ করে। ইহা সত্ত্বেও যদি প্রণয়িণী প্রণয়ীর গণ্ডে চুম্বনের পরিবর্তে চুম্বন প্রত্যাবর্তন করে, তাহা হইলে প্রেম দ্বিগুণিত হইয়া উঠে। যে কার্য্যে প্রেমের উদ্দীপনা হয়, যাহাতে হৃদয়ের প্রেমকে সহজে উদ্দীপিত করে, তাহাতে কোন ক্রমেই লালসা প্রকল হইতে পারে না। আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, প্রেম প্রবল হইলে হৃদয়ে লালসা স্থান পায় না, আর লালসা প্রবল হইলে প্রেম হৃদয়ে তিষ্ঠিতে পারে না। গণ্ড চুম্বনে আমরা দেখিলাম হৃদয়ে পবিত্র প্রেম ভাবের আবির্ভাব করে, ইহাতে হৃদয়ের প্রেম দ্বিগুণিত হয়, এরূপ অবস্থায় লালসা কখনই হৃদয়ে প্রবল হইতে পারে চেনা। আমরা জানি এ কথা সহজে কেহ বিশ্বাস করিবেন না, অনেকের বিশ্বাস চুম্বনে কামনা প্রবৃত্তিকে উৎসাহিত করা হয়। যাহাদের এরূপ ভ্রম বিশ্বাস হৃদয়ে আছে,তাঁহাদিগকে আমাদের কথার সত্যাসত্য পরীক্ষা করিয়া দেখিতে অনুরোধ করি। যখন হৃদয় কামনা প্রবৃত্তির প্রবল তাড়নায় মাতাইয়া তুলিবে, সেই সময়ে প্রেমভরে আদরে প্রণয়িণীর কপোল যুগল চুম্বন করিয়া দেখিবেন। দেখিবেন, তাহাতে কামনা আর অধিক প্রবল হইবে না। হৃদয়ে লালসার পরিবর্তে প্রেমের উদ্দীপন হইবে, লাক্ষা একেবারে হৃদয় হইতে না যাউক, পূর্ব্বাপেক্ষা নিস্তেজ হইবে, কখন সতেজ হইতে পারিবে না।

ওষ্ঠ

যাহাদের হৃদয়ে কামনা প্রবৃত্তি বড়ই প্রবল, যাহাদের হৃদয়ে সহস্র চেষ্টা করিলেও প্রেমকামনাকে পরাস্ত করিয়া হৃদয়ে প্রবল হইতে দিতে পারে না, তাহাদের পক্ষে কামনায় তৃপ্তি সাধনই কৰ্ত্তব্য। কারণ ইহা না করিলে কামনা প্রতিবন্ধক পাইয়া দিন দিন প্রবল হইতে আরম্ভ করিবে; দিন দিন হৃদয়ে নিজ রাজ্য বিস্তৃত করিবে, এমন কি সময়ে হয়তো হৃদয়ের প্রেমকে সম্পূর্ণ নষ্ট করিয়া ফেলিবে। এরূপ অবস্থায় কামনার পরিতৃপ্তি করিয়া তাহার উন্মত্ততার শাস্তি করাই যুক্তি সঙ্গত। কিন্তু যত দিন না হৃদয়ে প্রেমের দৃঢ়তা জন্মে, তত দিন লালসাকে তৃপ্তির জন্য সহবাস একান্ত গর্হিত; ইহাতে প্রেমকে সম্ভবমত হৃদয় হইতে দূর করিয়া লালসাই প্রবল হইবে। এই জন্য অন্য কোন উপায়ে কামনার তৃপ্তি সাধনের চেষ্টা করা কর্তব্য। করুণাময় বিধাতা আমাদের দুর্ব্বলতা দেখিয়া ইহারও সুন্দর উপায় স্থির করিয়া দিয়াছেন। চুম্বনে যেরূপ লালসাকে দমন করে, কামনা প্রবৃত্তিকে সমিত করিয়া হৃদয়ে প্রেম ভক্তি স্নেতের উদ্রেক করে, সেইরূপ আবার চুম্বন, লালসাকে তৃপ্ত করিতেও পারে।
ওষ্ঠ চুম্বন লালসা চরিতার্থের একমাত্র উপায়। ওষ্ঠ চুম্বনে লালসার আকুলতাকে তৃপ্তি দান করে, স্ত্রী পুরুষ সন্মিলনে শরীরে যে মুখামুভব হয় ও যে সুখের অতি অল্প মাত্র ছায়া হৃদয়ে প্রতি- বিম্বিত হয়, সে সুখ সম্পূর্ণ না হউক, প্রায় সম্পূর্ণই ওষ্ঠ চুম্বনে উপভোগ হয়। ইহাতে শারীরিক সুখ যেমন কিয়ৎ পরিমাণে হৃদয়ের সুখ অধিক পরিমাণে বোধ হয়।
পৃথিবীতে অনেক জীব আছে, যাহাদের সহবাস ক্রিয়া চুম্ব- নেই সম্পূর্ণ হয়। অনেক জীব আছে যাহাদের সহবাসে কোনই সুখ নাই, চুম্বনেই সুখ আবার এমন অনেক প্রাণীও আছে, যাহাদের সহবাসে দারুণ ক্লেশের উদ্রেক হয়, কিন্তু ঐ ক্লেশের লাঘব চুম্বনে কতক পরিমাণে হইয়া থাকে। অনেকে হয়তে1 আশ্চর্য্যান্বিত হইবেন, অন্যান্য প্রাণীর আবার চুম্বন কি? পণ্ড পক্ষী কি চুম্বনের স্বাদ জানে, তাহাদের মধ্যে কি চুম্বন প্রচলিত আছে। তুমি মানুষ, তোমরা ভিন্ন ভিন্ন কার্য্যের ভিন্ন ভিন্ন নাম দিতে পার, পশু পক্ষী তাহা পারে না। কিন্তু এটী তুমি নিশ্চয় জানিও যে তোমার লালসা, পাশব প্রবৃত্তি ভিন্ন আর কিছুই নহে, লালসা পশু পক্ষীর মধ্যেও যাহা আছে, তোমাতেও ঠিক তাহাই আছে। পশু পক্ষী হাত চুম্বন, কপাল চুম্বন গণ্ড চুম্বন করিতে জানে না সত্য, কারণ তাহার সহিত লালসার কোন সম্বন্ধ নাই, কিন্তু ওষ্ঠ চুম্বন ও মুখে মুখ দিতে তাহারাও যেরূপ জানে, তুমিও ঠিক সেইরূপ জান। একটু বিশেষ করিয়া। লক্ষ্য করিয়া দেখিলে, এ দৃশ্য সমস্ত পশু পক্ষীর মধ্যে দেখিতে পাওয়া যায়। কুক্কুর লালসা প্রপীড়িত হইলে কুক্কুরীর বদন দংশনেও মুখে মুখ দিবার জন্য প্রয়াস পাইয়া থাকে, কপোত কামনার বেগে কপোতীর মুখে মুখ দিয়া সুখানুভব করে। আর সকলেই জানেন, যদি না জানেন অন্ততঃ শুনিয়াছেন যে, ময়ূর ময়ূরীর সহবাস চুম্বনেই সম্পন্ন হয়। ময়ূর ময়ূরীর মুখে মুখ দিয়া সম্পূর্ণ সহবাস সুখ উপলব্ধি করে। যখন হৃদয় আর প্রবোধ মানে না, যখন হৃদয় আর সমিত হয় না, যখন হৃদয় সম্পূর্ণ দুর্দমনীয় হইয়া উঠিয়াছে, সে সময় কামনার শাস্তি সাধনই কৰ্ত্তব্য—কিন্তু একেবারে সহবাসে হৃদয় অনেক ক্ষতি হইতে পারে। সহবাসে ভয় ঘৃণা ইত্যাদি নানা বৃত্তি উত্তেজিত হয়, সহবাসে লজ্জায় মস্তকে পদাঘাত পড়ে, সহবাসে হৃদয়ের ধর্মভাব বিলুপ্ত হইয়া পাপ ভাবের উত্তেজনা হয়, সুতরাং প্রেমের প্রারম্ভে সহবাস কোন ক্রমেই কৰ্ত্তব্য নহে । এরূপ অবস্থার ওষ্ঠ চুম্বনই একমাত্র গ্রহণীয় উপায়, ইহাতে লালসার শাস্তি হইবে, সহবাসের সুখ উপভোগ হইবে, এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রেমের উদ্দীপনা ঘটিবে।

হৃদয়

যাহাদের হৃদয় নিতান্ত কামনাপরবশ নহে, যাহাদের চরিত্র দূষিত হয় নাই, তাহাদের ওষ্ঠ চুম্বন, লালসা প্রবৃত্তি দম- নের পক্ষে যথেষ্ট উপযুক্ত উপায়। কিন্তু ইহাতেও যাহাদের চিত্ত সমিত হয় না, ইহাতেও যাহাদের হৃদয়, প্রবোধ মানে না, সৰ্ব্বশক্তিমান বিধাতা তাহাদের জন্যও উপায় নির্দেশ করিয়া দিয়াছেন। ওষ্ঠ চুম্বন অপেক্ষা হৃদয় চুম্বন অধিক লালসা প্রবৃত্তিকে সন্তোষ দান করিয়া থাকে। যাহাদের ওষ্ঠচুম্বনে লালসা প্রবৃত্তির চরিতার্থতা সম্পাদন হয় না, তাহাদের হৃদয় চুম্বনে লালসার প্রবৃত্তির শাস্তি হইবেই হইবে। আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, যেরূপে হউক লালসার দমন- এবং দমন একেবারে অসম্ভব হইলে উহার শাস্তি নিতান্ত আব- …শুক, নতুবা হৃদয়ে প্রেম তিষ্ঠিতে পারে না। হৃদয় চুম্বন ইত্যাদি কাৰ্য্য সহবাস না হইলেও সহবাসের আনুসঙ্গিক ক্রিয়া মাত্র। সাধ্যমত ওষ্ঠ চুম্বন বা হৃদয় চুম্বন করাও কর্তব্য নহে, কারণ ইহাতেও একরূপ লালসাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, তবে আমরা এই পর্যস্ত বলি, যে নিতান্ত আত্মসংযমে অক্ষম, তাহার পক্ষে সহবাস অপেক্ষা ইহাই ভাল। হৃদয় চুম্বনে লালসার শাক্তি হয় কেন? হৃদয় চুম্বন অর্থে কেবল হৃদয় চুম্বনই বুঝিলে হইবে না। স্তনক্রীড়া, দংশন, জীহ্ব লেহন ইত্যাদি সহবাসের আনুসঙ্গিক সমস্ত কার্য্যের সমষ্টির নামই আমরা হৃদয় চুম্বন বলিতেছি। এ সকল কার্য্যে লালসা প্রবৃত্তির শাস্তি হয় সত্য; কিন্তু ইহার সহিত সহবাসের বিশেষ প্রভেদ নাই। তাহাই বলি প্রকৃত প্রেম এবং উভয় পক্ষে প্রকৃত প্রেম না জন্মিলে কখনই এ সকল কার্যে লিপ্ত হওয়া কৰ্ত্তব্য নহে। প্রেম না থাকিলে বা হৃদয়ে প্রেম দৃঢ় না হইলে, এ সকল কার্য্যে মনকে কামনায় উন্মত্ত করিয়া তুলে, হৃদয় ক্রমে পাপের দিকে আকৃষ্ট হয়, সমস্ত জীবন নীচতার দিকে যেন হেলিয়া পড়ে; আর প্রেম? লালসার প্রবল তরঙ্গের মুখে প্রেম এক মুহূর্ত্তও দাড়াইতে পারে না। যদি প্রেম পথের প্রকৃত পথিক হইতে চাহ, যদি প্রেমের প্রকৃত স্বাদ উপভোগ করিতে চাহ, যদি এ সংসারে স্বর্গ সুখ উপভোগ করিতে চাই, তবে কোন ক্রমেই হৃদয়ে লালम! প্রবৃত্তিকে প্রবল হইতে দিওনা।

 

অষ্টম পরিচ্ছেদ

প্রেম ক্রীড়া

কেন জানি না, এসংসারে প্রেম ক্রীড়া লজ্জায় বিষয় বলিয়া সৰ্ব্বত্র সর্ব্বদেশে বিদিত। কি সভ্য কি অসভ্য সকল জাতির মধ্যেই নর নারী প্রকা্যভাবে, প্রেম ক্রীড়ায় মত্ত হয় না, হইতে পারে না, হইতে লজ্জিত হয়। মানুষ হয়তো ভাবে এটী পাশব প্রবৃত্তি ভিন্ন আর কিছুই নাই— হয়তো তাহারা পশু পক্ষীর এ কার্য্য দেখিয়া লজ্জিত হইয়া আপনারাও মনে মনে বিশেষ লজ্জা বোধ করে, কিন্তু একটু ভাবিয়া দেখিলে, ইহাতে লজ্জার বিষয় কিছুই নাই,—বরং যে কার্য্য হইতে মানব জাতির উৎপত্তি সে কাৰ্য অতীব পবিত্র ও আশ্চর্য্য বলিয়া মনে করাই ন্যায় সঙ্গত। এতদ্ব্যতীত ইহাতে এক অপরূপ সৌন্দৰ্য আছে, সেরূপ সৌন্দর্য্যও পৃথিবীতে অনত্র অন্য কোন বিষয়ে সহজে দেখিতে পাওয়া যায় না।
সাধারণ লোকে যাহা দেখিতে, যাহার কথা কহিতে, যাহার বিষয় ভাবিতে লজ্জিত হয়, কবি তাহাতে কেন অপার সৌন্দর্য্য দর্শন করেন ! সাধারণ লোকে পাপে বেষ্টিত; সাধা- রণ লোকের মন পাপে জড়ীভূত, এই জন্য সাধারণ লোকে প্রেমক্রীড়াকে পাপ কার্য্য বিবেচনা করিয়া মনে মনে লজ্জিত হয়, প্রকাশ ভাবে এ লজ্জা প্রকাশ করিয়াও থাকে। সাধারণ লোকে এইরূপ লজ্জা বোধ করে সত্য, কিন্তু ক্রীড়ার অপরূপ সৌন্দর্য্য প্রেম-রঙ্গ। দেখিয়া জগতে সেই সৌন্দর্য্য প্রকাশের যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়া গিয়াছেন। আধুনিক কবি ভারতচন্দ্র প্রভৃতিও প্রেমক্রীড়া বর্ণনে বিন্দুমাত্র লজ্জা বোধ করেন। অনেকে বলিবেন ভারতীয় কবি চিরকালই আদিরস প্রিয় এবং আদিরস বর্ণনে ব্যাকুল, তাহাদের রুচির প্রতি দৃষ্টি বিন্দুমাত্র নাই। যদি তাহাই হয় তবে ইউরোপীয় কবি দিগের মধ্যে এ ইচ্ছা বল- কেন। সেক্সপিয়ারের তো কথাই নাই,—ধর্মভীরু ও বর্তী ধর্ম্ম পরায়ণ মিলটনও আদম ও হবার সন্মিলন বর্ণনে ভাষার সৌন্দর্য্যের ও কবিত্বের চূড়ান্ত বিকাশ দেখাইয়াছেন। আর ভারতের প্রচীন ইতিহাস যদি বিশ্বাস করিতে হয়, তাহা হইলে, আমাদের বলিতে হয় যে প্রেমক্রীড়া হইতেই জগতের কবিত্বের সৃষ্টি। বাল্মীকি ঋষি বিহগ বিহগিনীর সন্মিলন শোভা দেখিয়া বিমুগ্ধ হইয়াছিলেন, এমন সময়ে কোথা৷ হইতে আর একটা হিংস্রপক্ষী বিহাগিনীকে আহত করিল,—এই অপরূপ সৌন্দর্য্যের নষ্ট ও বিহগিনীর যন্ত্রনায় ঋষির হৃদয় বিচলিত হইল, তাঁহার বদন হইতে একটা শ্লোক স্বতই নির্গত হইল। কথিত আছে, ঐ শ্লোকটিই জগতের আদি কবিতা।
প্রেমক্রীড়ার ন্যায় পবিত্র কার্য্য, সৌন্দৰ্য্যময় কাৰ্য, মুখের কার্য্য এ সংসারে আর নাই; ইহাতে, লজ্জিত হইবার কোনই কারণ নাই,—ইহাতে পাপের চিহ্ন মাত্র নাই। কিন্তু ইহার হুইটী বিকাশ আছে, একটার নাম পাশব, অপরটীর নাম প্রেমিক। পাশব প্রেমক্রীড়ায় কেবল শরীরের সম্বন্ধ, ইহাতে হৃদয়ের কোন সম্পর্ক নাই; ইহার সুখ শারীরিক, — অতি অল্পক্ষণের জন্য শরীরের উপর স্থায়ী, ইহাকে মুখ না বলিয়া প্রেম ক্রীড়া ৷ মস্তিষ্কের আলোড়ন ও উষ্ণতা বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। কিন্তু প্রেমিকপ্রেমক্রীড়াই প্রকৃত মনুষ্যোচিত কার্য্য,- ইহাতে শারীরিক সুখ অপার আনন্দ জন্মে। ভোগ তো হয়ই–এতদ্ব্যতীত হৃদয়ে এ কথা বোধ হয় সকলেই বুঝিতে পারেন যে, শারীরিক সুখ সুখই নহে, প্রকৃত সুখ হৃদয়ে ও মনে। পাশব প্রেমক্রীড়ায় সে সুখলাভ কখনই ঘটে না,— এই জন্য প্রকৃত প্রেমিক, প্রেম সম্ভূত প্রেমক্রীড়াতেই প্রকৃত সুখ ও আনন্দ বোধ করেন।
অনেকেই বোধ হয় ইহা প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, যে উভয় পক্ষে সমান উৎসাহ ও অভিলাষ না আসিলে প্রেমক্রীড়ায় কোন সুখই জন্মে না। উভয় পক্ষের প্রকৃত লালসা ব্যাকু- লিত না থাকিলে কোন সুখই উপলব্ধি হয় না। পরীক্ষার দ্বারা জানা গিয়াছে, অনেক সময়ে স্ত্রীলোকদিগের প্রেম- ক্রীড়ায় শারীরিক বা মানসিক কোন সুখই জন্মে না। রাজপথস্থ বারবনিতাগণের অবস্থা ঠিক এইরূপ। সহবাসে- তাহাদের আর কোন সুখ নাই, আকর্ষণই নাই, আকুলতা নাই; এবং ইহাও অনেকের নিকট শুনা গিয়াছে যে স্ত্রী- যেরূপ সুখ উপলব্ধি হয়, বারবনিতা সহবাসে তাহার সহবাসে শতাংশের একাংশও হয় না।
এই সকল হইতে আমরা স্পষ্টই বুঝিলাম যে, পশুর সন্মি- লন ও মানব সন্মিলনে যথেষ্ট প্রভেদ আছে। কোন নির্দিষ্ট সময়ে পশু ও পক্ষীর হৃদয়ে লালসা প্রবৃত্তি আপনা আপনি জন্য বিধা- উদিত হয়,সেই সময়ে তাহারা সৃষ্টি রক্ষার তার অত্যাশ্চর্য কৌশলে পরস্পরের দিকে পরস্পরে আকৃষ্ট হয়; তাহাদের তাহাতেই পরম সুখলাভ হইয়া থাকে। কিন্তু প্রেম-রঙ্গ। মানবের পক্ষে এ নিয়ম খাটে না। প্রেম না থাকিলে মान- বের প্রেমক্রীড়ায় কোন সুখই জন্মে না, হৃদয়ে লালসার আকুলতা, একেবারেই থাকে না। বরং পুরুষের কিছু ন কিছু থাকিতে পারে, কিন্তু স্ত্রীলোকের তো একেবারেই থাকে না, এরূপ অবস্থায় প্রেমই সকল। কোন লালসা তৃপ্তির জন্য সহবাস কিছুই নহে, কারণ তাহাতে লালসার তৃপ্তি হয় না, অথচ হৃদয়ে কোন মুখ জন্মে না। লালসা তৃপ্তির জন্যই প্রেমের আবশ্যক, কারণ প্রেম শূন্য সহবাসে সুখও নাই এবং লালসার শাস্তিও নাই। আবার এদিকে প্রেম বৃদ্ধি করি- বার জন্যও লালসার তৃপ্তি সাধন প্রয়োজন, সহবাস আবশ্যক। প্রেমের অভাবে সহবাস কিছুই নহে, প্রেমের সহিত সহবাস সুখের বিষয়, প্রেমের সহিত সহবাসে প্রেম বৃদ্ধি করে, প্রেমকে স্থায়ি করে ।
সম্পূর্ণ প্রেমশূন্য সহবাসে কখনই প্রেম জন্মিতে পারে না, সেরূপ সহবাসে ইন্দ্রিয় সকল উত্তেজিত হইয়া মনকে পশুর সদৃশ করিয়া তুলে; আবার হৃদয়ে প্রেম দৃঢ় না হইলেও, সহবাসে মস্তিষ্ক আলোড়িত, শরীর কণ্টকিত হইয়া হৃদয়ে পাশব বৃত্তিকে প্রবল করে। প্রেম হৃদয়ে তিষ্ঠিতে পারে না, – কিন্তু হৃদয়ে যদি প্রেম দৃঢ় হইয়া থাকে তাহা হইলে সহবাসে পরম সুখ বোধ হয়। এ কথা পুনঃ পুনঃ বলার উদ্দেশ্য এই যে এ কথা অনেকে বিশ্বাস করে না। কি ভারতবর্ষে কি ইয়োরোপ খণ্ডে সর্ব্বত্রই ধর্মপরায়ণ ব্যক্তিগণ স্ত্রীসহবাস পরি ত্যাগ করিবার জন্য অনুরোধ করেন, ভারতে তো বহুসংখ্যক লোকের বিশ্বাস কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ না করিলে ধর্ম্মোপার্জ্জন হয় না,—কিন্তু জগতের অন্তান্ত প্রদেশের কথা ছাড়িয়া দিয়া প্ৰেম ক্রীড়া ৮৩ কেবল এই ভারতবর্ষেই আবার সহবাস যে ধর্ম্মোপার্জ্জন ও সেই সঙ্গে প্রেম উপার্জ্জনের প্রশস্ত পথ তাহাও ঋষিগণ বুঝিয় লোক সমাজে প্রচার করিয়া গিয়াছেন। আমরা যে কথা বুঝাইবার জন্য চেষ্টা করিতেছি, সর্ব্বজ্ঞ সর্ব্ববিদ্যায় সুপণ্ডিত ঋষিগণ তাহা জ্বলন্ত দৃষ্টাস্ত দিয়া বুঝাইয়া গিয়াছেন। রাধা- কৃষ্ণের প্রেমের কি কোন গূঢ় রহস্য ও উদ্দেশ্য নাই। সকলেই জানেন রাধাকৃষ্ণের প্রেমের ন্যায় প্রেমের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত জগতের অন্য কোন স্থানে নাই। যদি অবতার স্বীকার করিতে হয়, তাহা হইলে আমাদের সকলকেই বলিতে হইবে যে স্বয়ং ভগ- বান্ সংসারে স্ত্রীপুরুষের প্রেম কি, সেই প্রেমের সহিত লালসার সম্বন্ধই বা কি এবং সংসারে স্ত্রীপুরুষের প্রেম হইতেই কেবল ঈশ্বর প্রেম জন্মিতে পারে, তাহা দেখাইবার জ্য এ পৃথি- বীতে জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন। আর যদি অবতার না স্বীকার করিতে হয়, তাহা হইলেও বলিতে হয়যে, মহর্ষিগণ সংসারীর মুক্তি ও প্রেমভক্তি লাভের উপায় তাহাদিগকে বুঝাইয়া দিবার জন্য এই রাধাকৃষ্ণের প্রেম লীলা কল্পনা করিয়া গিয়াছেন। যদি ঈশ্বর প্রেম লাভে ইচ্ছুক হও, যদি নিরাকার ঈশ্বরকে ভাল ৰাসিতে চাই, তৰে প্রথম সাকার পদার্থে প্রেম আবদ্ধ কর। আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, সৌন্দর্য্য হইতেই প্রেমের উৎপত্তি, ইহার জ্বলন্ত দৃষ্টাস্ত রাধা ও কৃষ্ণ। উভয়ে উভয়কে ভাল বাসেন, কে কাহাকে কত ভাল বাসেন তাহার স্থিরতা নাই। কিন্তু ঋষিগণ অবগত ছিলেন যে, স্ত্রীপুরুষের প্রেমে লালসা প্রবৃত্তি একেবারে না থাকিলে সে প্রেম বৃদ্ধি হইতে পারে না, বহু কাল হৃদয়ে স্থায়ীও হয় না। তাহাই তাহারা রাধাকৃষ্ণের পবিত্র প্রেমের ভিতর লালসার প্রবল প্রবাহ দেখাইয়াছেন। 68 প্রেম-রঙ্গ। তাহাই ভক্তচূড়ামণি জয়দেবকবি রাধাকৃষ্ণের প্রেমে লালসা প্রবৃত্তির তরঙ্গ ও রাধাকৃষ্ণের সম্মিলন, – মান, অভিমান, অভিসার-এরূপ সুন্দর ভাবে চিত্রিত করিয়া গিয়াছেন। জয়দেৰ কি নিতান্ত কুস্বভাবাপন্ন লোক ছিলেন যে, ধাহাকে তিনি দেবতা বলিয়া পূজা করিতেন, তাঁহাকেই পাশৰ প্রবৃত্তি চরি তার্থে নিযুক্ত দেখিয়া একেবারে ভক্তিতে গলিয়া যাইতেন? এ তত্ত্ব লোকে বুঝে না বলিয়াই এ কথা মনে ভাবিয়া থাকে। সংসারে দুর্ভাগ্যবশতঃ সহবাস নিতান্ত পাপের কথা ও লজ্জার কথা বলিয়া বিদিত আছে বলিয়াই লোকে ইহাতে পবিত্রতা ও সৌন্দর্য্য দেখিতে পায় না ৷
কেবল যে স্ত্রীপুরুষের প্রেম হৃদয়ে বৃদ্ধি সাধনের জন্য, চিরস্থায়ী করিবার জন্য, সহবাস আব্যক এরূপ নহে। সংসা- রীর ঈশ্বর প্রেম লাভের ইহাই একমাত্র উপায়। প্রেমের সহিত সহবােেস ইহ কালে পরম সুখ লাভ হয়, এবং পর কালের জন্য স্বর্গের দ্বার উন্মুক্ত হয়।
কিন্তু আমরা আবার বলি প্রেমশূন্য সহবাস পশুর কার্য্য। ইহাতে কোনই সুখ নাই—বরং পাপ যথেষ্টই আছে। ইহাতে শরীরে অসংখ্য ব্যাধিকে ডাকিয়া আনা হয়, হৃদয়ে সকল প্রকার নীচতাকে নিমন্ত্রিত করা হয় এবং পাপকে আলিঙ্গন করিয়া হৃদয়ে লওয়া হয়। যাহাতে কোনই সুখ নাই,যাহাতে না শারীরিক সুখ, না মানসিক সুখ কিছুই নাই, যাহা হইতে ব্যাধির প্রবলতা ও প্রখরতা জন্মে সে কার্য্যে মানুষ এত উন্মত্ত হয় কেন? আমরা ধর্ম্মভাবাপন্ন ব্যক্তিদিগের ন্যায় লালসাকে সম্পূর্ণ দমন করিয়া অনুরোধ করি না। এরূপ দমন করাও যে পাপ ইহাও আমাদের বিশ্বান। আমার বলি, — ভাল দেখিতে শিখ—সেই ভাল বাসাকে হৃদয়ে দৃঢ়কর, পরে সেই ভাল- বাসার বৃদ্ধি সাধনের জন্য লালসার তৃপ্তি সাধন কর। ইহাতে যে সুখলাভ হইবে সে সুখের ন্যায় সুখ এ সংসারে আর নাই।

ভাব

পাশব প্রেম ক্রীড়া ও প্রেমিক প্রেম ক্রীড়ার ভাবে বিশেষ পার্থক্য আছে। উভয়ই তো প্রেম ক্রীড়া, উভয়কাৰ্যই তো একরূপ, কিন্তু একটু বিশেষ লক্ষ্য করিয়া দেখিলে ইহাদের সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন ভাব স্পষ্ট দেখিতে পাওয়া যায়। পাশব প্রেম ক্রীড়ায় হৃদয়ে উম্মত্ততা,—প্রেমিক প্রেম ক্রীড়ায় হৃদয়ে শান্তিপূর্ণ বিমল আনন্দ। পাশব প্রেমক্রীড়ার লালসায় লোক হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়, নির্দয় রাক্ষস হয়. সৰ্ব্বতোভাবে নরপশু হয়। পাশব প্রেম ক্রীড়ায় স্ত্রীই হুউক কিম্বা পুরুষই হউক, কেহ কাহারও সুখের দিকে লক্ষ্য, করে না,—উভয়েরই উভয়ের দিকে দৃষ্টি, অরে অস্তিত্ব পর্যন্ত স্মরণ থাকে না। এই জন্যই পাশব সহবাসে উভয়ের দংশনে রক্তাক্ত কলেবর হয়, উভয়ের নখাঘাতে শরীর ছিন্ন ভিন্ন হয়—মায়া মমতা একটুও থাকে না। ভবি- ষ্যতে বাঁচিৰে কি মরিবে দারুণ ব্যাধি জন্মিবে কি না, এ সকল কথা একেবারেই স্মরণ থাকে না দেখিলেই স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়, কোটীর পাশব প্রকৃতি এবং কোটীর বা তাহা নহে। আর প্রেমিক সহবাসে কত মায়া, কত মমতা,— তাহাতে উন্মত্ততার নাম মাত্র থাকে না, তাহাতে লালসার ব্যাকুলতা নাই,—তাহাতে অধীরতা নাই, — তাহাতে পাশৰ প্রবৃত্তির লেশ প্রেম-রঙ্গ। মাত্র নাই। প্রেমিক সহবাসে বিমল আনন্দ, অপূৰ্ব্ব শাস্তি ও হৃদয়ে দেব ভাব বিরাজ করে। উভয়ে উভয়ের প্রেমে উন্মত্ত,—উভয়ে উভয়ের অস্তিত্ব সুখ উপলব্ধি করিয়াই বিমুগ্ধ। পাশব সহবাসে অপরের অস্তিত্ব আছে কি না আছে, তাঁহার কোনই জ্ঞান থাকে না; প্রেমিক সহবাসে অপরের অস্তিত্ব আছে, এই জ্ঞানেই হৃদয়ে পরম সুখ বোধ হইতে থাকে।
অনেকেই সহবাসে এই দুই ভাবের প্রকৃতি বুঝিতে পারেন না। ইহা কেহ কাহাকে কথায় বুঝাইতে সক্ষম হয় না,— ইহা সকলকেই নিজে নিজে দেখিয়া বুঝিয়া লইতে হয়। আমরা জানি অনেকেই নিজ নিজ স্ত্রীর প্রেম বিষয়ে সন্দিগ্ধমনা,—অনেকে ভাবিয়া থাকেন, হয় তো স্ত্রী তাহাকে ভাল বাসে না। ইহা অবগত হওয়া কি একটা কঠিন কাৰ্য্য? প্রেম ক্রীড়ায় স্ত্রীর পাশব প্রবৃত্তি বা প্রেম প্রবৃত্তি প্রকাশ হয়, ইহা একটু লক্ষ্য করিয়া দেখিলে, তাহার হৃদয়ে প্রেম আছে কিনা, অবগত হওয়া অতি সহজ। এইরূপে স্ত্রীও অনায়াসে স্বামীর হৃদয়ের প্রেম স্পষ্ট অবগত হইতে পারেন। স্বামীর যদি প্রেম ক্রীড়ায় পাশৰ ভাব প্রকাশ পায়, তাহা হইলে আমরা স্পষ্টই বলিব, তাহার হৃদয়ে স্ত্রীর জন্য প্রেম নাই।
প্রেম ক্রীড়ায় এই দুই ভাব লক্ষ্য করিয়া মানুষ নিজ নিজ হৃদয়কেও সমিত করিতে পারে, অনেক সময়েই মানুষ নিজ হৃদয়ের প্রকৃত অবস্থা বুঝিতে না পারিয়াই ধীরে ধীরে পাপ পথে প্রলুব্ধ হয়। যদি বুঝি আমার হৃদয়ে প্রকৃত প্রেম নাই, তাহার পরিবর্তে লালসা আছে, তাহা হইলে আমার স্বভাবতঃই লালসাকে দূর করিয়া প্রেমকে হৃদয়ে আনিবার জন্য ইচ্ছা হইবে। অন্য উপায়ে হৃদয়ের অবস্থা অবগত হইতে অক্ষম হইলে, বিশেষতঃ বিবাহিত স্বামী, স্ত্রীর পক্ষে—প্রেম ক্রীড়াই হৃদয় বুঝিবার এক মাত্র উপায়। যদি দম্পতির প্রেম ক্রীড়ায় পাশব প্রকৃতি থাকে, তবে হৃদয়ের, অবস্থা, বুঝিবার আর বিলম্ব হয় না। তখন যাহাতে হৃদয়ের সে অবস্থা দূর হইয়া অন্য অবস্থা হয়, তাহা করিবার জন্য চেষ্টা একান্ত কৰ্ত্তব্য।

সৌন্দৰ্য্য

সৌন্দর্য্য দুই প্রকার। এক প্রকার যাহা সকলে দেখে, সকলে বাহা দেখিতে পায় এবং দেখিয়া হৃদয়ে অপার আনন্দ অনুভব করে, – যেমন বসন্তের শোভা, গাছের ফুল রমনীর রূপ। এসকল সৌন্দর্য্য সকলেই দেখিতে পায় এবং সকলেই দেখিয়া থাকে, কিন্তু এ সংসারে আর একরূপ সৌন্দৰ্য আছে, কেবল সৌন্দর্য্যের যাহা আর কেহ দেখিতে পায় না, বিশেষ লোকে দেখিতে পায়। কারণের অথবা সেই সহিত যাহারা সম্বন্ধবন্ধ, কেবল তাহারাই সে সৌন্দর্য্য দেখিতে পায় । এসকল সৌন্দৰ্য কোন পার্থিব সৌন্দৰ্য নহে, কিম্বা জড় জগতের কোন সৌন্দর্য্যও নহে, ইহা একরূপ কার্য্যের সৌন্দর্য্য বলিলেও বলা যায়। যে সেই কার্য্যটী করে সে, স্বয়ং তাহার সৌন্দর্য্য দেখিতে পায় এবং দেখিয়া তাহাতে বিমল আনন্দ অনুভব করে। আমরা দৃষ্টান্ত দিয়া বুঝাইতেছি। একটী দরিদ্র ভিক্ষুক পথে বসিয়া আছে, আর কেহই তথায় উপস্থিত নাই। ভিক্ষুকও অন্ধ, সে কিছুই দেখিতে পায় না। আমি তাহাকে কিঞ্চিৎ দান করিলাম, অমনি আমার হৃদয়ে কেমন প্রেম-রঙ্গ। এক অব্যক্ত বিমল আনন্দ জান্মল। দান কেন জন্মিল? সেই ‘কার্য্যটুকুতে একটা এমন সৌন্দৰ্য আছে যাহা বৰ্ণনা করিয়া বুঝান যায় না সত্য,—সে সৌন্দর্য্য অপরে বুঝিতে পারে না, দেখিতে পায় না সত্য, কিন্তু আমি দেখিলাম, নতুবা আমার মন মুগ্ধ হইবে কেন, আমি হৃদয়ে আনন্দ অনুভৰ করিব কেন?
প্রেম ক্রীড়ায়ও ঠিক এইরূপ সৌন্দৰ্য আছে। বাহ্যিক সৌন্দর্যের কথা ছাড়িয়া দিন, কারণ তাহাতে মত ভেদ আছে। কেহ কেহ বলেন স্ত্রী-পুরুষ সম্মিলন অতি কদৰ্য্য কাৰ্য্য, দেখিতে নিতান্ত জঘন্য, – আমরা তাহাদের সহিত এক মত হইতে পারি না।
এ সংসারে কোন কবি বা কোন চিত্রকর তাঁহাদের সহিত একমত হইতে পারিবেন না। পৃথিবীতে যত উৎকৃষ্ট ছবি,অঙ্কিত হইয়াছে, তাহার অনেক গুলিই উলঙ্গ স্ত্রী মূৰ্ত্তি, , এবং অনেক গুলি সম্পূর্ণ স্ত্রী-পুরুষ সন্মিলন না হইলেও প্রেমের ছবি সন্দেহ নাই। আর কবিতা—জগতের শ্রেষ্ঠ কবিতা প্রেম বর্ণনে পূৰ্ণ – – সে প্রেম কর্কশ প্রেম নহে, সে লালসা পূর্ণপ্রেম / প্রেম ক্রীড়ায় যে সৌন্দৰ্য আছে, তাহা C আর কোথায়ও নাই। এ সুতরাং সংসারে প্রেমক্রীড়া অতি গোপনে সম্পন্ন হইয়া থাকে, তাহার বাহ্যিক সৌন্দৰ্য থাকিলেও এক রূপ ন থাকার মধ্যে দাঁড়াইয়াছে। এই সম্বন্ধে আমরা অধিক কিছুই না বলিয়া, প্রেমক্রীড়ার আভ্যন্তরিক সৌন্দর্য্যের কথাই বলিব। ইহা কার্য্যের সৌন্দর্য্য। যে এ কার্য্য করে, সে এ সৌন্দর্য দেখিতে পায়, তবে এ সৌন্দর্য্য চর্ম্মচক্ষে দেখিবার সৌন্দর্য্য নহে, ইহা জড়জগতের সৌন্দর্য্য নহে। ইহা দেখিবার জন্ম স্থায়িত্ব। একটু কল্পনার প্রাবল্য প্রয়োজন : মনে মনে একটু ভাবিয়া লওয়া আবশ্যক। সুতরাং এ সৌন্দর্য্য যে কিরূপে এবং কান কোন গুণে ভূষিত, তাহা বর্ণনা করিয়া দেখান যায় না, কিম্বা চিত্র: করিয়াও বুঝান যায় না। হৃদয়ই কেবল এ সৌন্দর্য্য দেখিতে পায় এবং ইহার বিমল আনন্দ উপলব্ধি করিতে সক্ষম হয়। প্রেম ক্রীড়ায় প্রেমের পূর্ণ বিকাশ বলিয়াই এ সৌন্দৰ্য ৷ দুইটী প্রাণ এক হইয়া এক শরীরে পরিণত হয় বলিয়া, প্রেম ক্রীড়ায় এ সৌন্দর্য্য। এই জন্য পাশব প্রেম ক্রীড়ায় এ সৌন্দৰ্য নাই;—পাশব উন্মত্ততায় এ সৌন্দৰ্য উপলব্ধি হয় না। নরনারী তখন একেবারে মাতিয়া যায়,—এ সৌন্দর্য্য দেখিবার তাহাদের কোনই সুবিধা বা অবসর থাকে না। কিন্তু প্রেমিক,—প্রেম ক্রীড়ার বিমল আনন্দের মধ্যে, এ সৌন্দর্য্য প্রেমিকপ্রেমিকার চক্ষের উপর নৃত্য করিতে থাকে, তাহাদের হৃদয়, সৌন্দর্য্য দর্শনের যে সুখ তাহা সম্পূর্ণ প্রতিভাষিত হয়।

স্থায়িত্ব

সৌন্দর্য্যকে স্থায়ী করিতে পারিলে সে সুখ, সকল সময়েই সুখ উপলব্ধি হয়, প্রথম লালসার বৃত্তি শারীরিক সুখ, উপলব্ধি করিতে পারা যায়। প্রেমক্রীড়ায় অনেক প্রকার প্রেমের সহিত লালসার সম্মিলন জন্য শারীরিক ও মানসিক সুখ,—প্রেমের পূর্ণ বিকাশ জনিত হৃদয়ের সুখ,—প্রেমক্রীড়ায় সৌন্দৰ্য দর্শন সুখ,—এতগুলি মুখ একসঙ্গে এককার্য্যে প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায় না। সৃষ্টি রক্ষার জন্যই করুণাময় বিধাতা প্রেমক্রীড়ায় এত সুখের সম্মিলন করিয়াছেন। সুতরাং প্রেম ক্রীড়াকে স্থায়ী করিতে পারিলে এতগুলি সুখও স্থায়ী হয়। প্রেম-রঙ্গ। প্রবঞ্চক আমরা জানি অনেকেই ইহার জন্য ব্যাকুল, আমরা ইহাও ব্যবসা চালাইতেছে। কেহবা কত প্রকার ঔষধ বিক্রয় করিয়! অর্থ জানি, মানবহৃদয়ের এই ব্যাকুলতার উপর এক উপার্জ্জন করিতেছে,—কেহবা তুকতাক তন্ত্রে মন্ত্রে ইত্যাদিতে লোক ভুলাইয়া পরসা লইতেছে। ঔষধ বা তন্ত্রে মন্ত্রে শরীরের উপর কার্য্য হইলেও হইতে পারে, কিন্তু হৃদয়ের উপর কোন ক্রমেই ইহার৷ কার্য্য করিতে পারে না। প্রকৃত প্রেমক্রীড়া, — প্রেমিক প্রেম ক্রীড়াকে স্থায়ী করিতে হইলে, — হৃদয়ের সহিত সম্বন্ধ। হৃদয়ের কোন ঔষধ যদি থাকে, তবে সেই ঔষধ ব্যবহারেই প্রেমক্রীড়া স্থায়ী হয়, নতুবা আর কিছুতেই স্থায়ী হইতে পারে না। এখন দেখা যাউক প্রেমক্রীড়া কিরূপে স্থায়ী হইতে পারে।
প্রেমক্রীড়ার সহিত- শরীরের বিশেষ সম্বন্ধ আছে। শরীর হইতে তেজ নির্গত হইয়া যাইবার জন্য বিধাতা এক অদ্ভুত কৌশলের সৃষ্টি করিয়াছেন। যে কৌশলে মানবের সৃষ্টি হয়,— সেই কৌশলেই বিধাতা প্রেমক্রীড়ার শেষ নিরাকরণ করেন। পাশব প্রেম ক্রীড়ায় শরীরের তন্ত্রী মণ্ডলী অত্যধিক উত্তেজিত হয়, মস্তিষ্ক আলোড়িত হইয়া উঠে,—এরূপ অবস্থায় প্রেমক্রীড়া অধিকক্ষণ স্থায়ী হইলে শরীরের বিশেষ ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা। এমন কি প্রেমক্রীড়ার অত্যধিক উত্তেজনায় অনেকের মৃত্যু ও ঘটিয়াছে। এই সকল কারণেই বোধ হয়, বিধাতা যাহাতে দুই চারি মিনিটের মধ্যেই প্রেমক্রীড়া শেষ হয় তাহার ব্যবস্থা করিয়াছেন। আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, প্রকৃত প্রেমের প্রেম ক্রীড়ায় উন্মত্ততা জন্মে না। ইহাতে তন্ত্রী মণ্ডলী ও মস্তিষ্ক উত্তেজিত হইলেও অত্যধিক উত্তেজিত হয় না; যদি প্রেম স্থায়িত্ব। ৯১ হৃদয়ে গাঢ়তররূপে অবস্থান করে, তবে প্রেমক্রীড়ায় শরীরের সহিত সম্বন্ধ ক্রমে অল্প হইয়া আইসে, সুতরাং প্রেমক্রীড়া স্থায়ী হইলে শরীরের যে ক্ষতি হয়, তাহা আর হইতে পারে না। পাশব প্রেমক্রীড়া স্থায়ী করা অসম্ভব, করিলেও নিতান্ত মৃত্যু না ঘটিলেও নানারূপ ব্যাধি জন্মিবে, কিন্তু প্রকৃত প্রেমের প্রেমক্রীড়ায় শারীরিক ক্ষতি হইবে না, এবং হৃদয়ে প্রেম- ক্রীড়ার সমস্ত সুখ উপলব্ধি হইতে থাকিবে।
ভালবাসার ঘাত প্রতিঘাতেই সুখ। অন্যকে আমি ভাল- বাসি সে আমাকে ভাল বাসুক, আর নাই বাসুক, তাহা হই- লেও আমার হৃদয়ে পরম সুখ বোধ হইতে থাকে,—কিন্তু সেই ভালবাসায় যদি প্রিয় জনের ভালবাসা আঘাতিত হইয়া উহা হইতে প্রতিঘাতে ভালবাসার উদ্রেক হয়, তাহা হইলে যে সুখ, সে সুখের তুলনা এসংসারে নাই। প্রেমক্রীড়া অপেক্ষা ভাল- রানার ঘাত প্রতিঘাত, অন্য কিছুর দ্বারাই সম্ভব নহে। ভাল- বাসা প্রকাশের ইহাপেক্ষা শ্রেষ্ট উপায় আর নাই। নয়নের কটাক্ষদ্বারা, স্পর্শের দ্বারা, আলিঙ্গন বা চুম্বনের দ্বারা ভালবাসা প্রকাশ করা যায় সত্য, কিন্তু সে ভালবাসার পূর্ণতা আছে কি নাই, তাহা স্থির জানা যায় না। কিন্তু প্রেমক্রীড়ার সময় প্রণয়ি ও চুম্বন প্রণয়িনী সন্মিলিত হইয়া উভয়কে করে, তখন যেরূপ তেমন আর কিছুতেই হয় না ৷ উভয়ে আলিঙ্গন ভালবাসার ঘাত প্রতিঘাত জন্মে, ভালবাসায় বড় সুখ, সুখ একবার বোধ হইলে সেই সুখ সহজে ত্যাগ করিতে প্রাণ চাহেনা। মন প্রাণ স্বতঃই সেই ভালবাসার সহিত আকৃষ্ট হইয়া থাকিতে চাহে। অথচ ভাল- বাসায় শাস্তি ভিন্ন উত্তেজনা নাই, দুখ ভিন্ন উন্মত্ততা নাই। প্রেম-রঙ্গ। সুতরাং শরীর মনের কোন ক্ষতিই ইহা দ্বারা সম্ভবে না। যি প্রকৃত ভালবাসার সহিত প্রেমক্রীড়ায় মানব মত্ত হয়, তাহা হইলে তখন আর তাহার পাশব প্রবৃত্তি জনিত শারীরিক সুখের প্রতি একেবারেই দৃষ্টি থাকে না—তখন কেবল হৃদয়স্থ প্রেমেই মন মুগ্ধ হইয়া সম্বন্ধ, থাকে— সুতরাং সে প্রেমক্রীড়া যতক্ষণ ইচ্ছা স্থায়ী করা যায়। প্রেমক্রীড়ার স্থায়ীত্বের, প্রেম ভিন্ন অন্য কোন ঔষধ নাই, যিনি অন্য উপায়ে ইহা সাধনে প্রয়াস পান, তিনি নিজ হৃদয় ও শরীর উভয়ই নষ্ট করেন।

বৃদ্ধি

স্থায়িত্বের জন্য যেমন অনেকে ব্যগ্র, বৃদ্ধির জন্যও ঠিক সেইরূপ অনেকে ব্যগ্র। প্রেমক্রীড়ায় বৃদ্ধি কিসের? সময়ের না সুখের; যদি সময়ের হয়, তবে তাহাকে বৃদ্ধি না বলিয়া অনায়াসেই স্থায়িত্ব বলা যাইতে পারে, – আর বৃদ্ধিও স্থায়িত্ব যদি একই হয়, তবে এ সম্বন্ধে আমর। স্থায়িত্ব নামক পরিচ্ছেদে যাহা যাহা লিখিয়াছি তাহাই যথেষ্ট। আর যদি বৃদ্ধি অর্থে সুখের বৃদ্ধি বুঝিতে হয়, তবে তাহার বিষয়েও আমরা পূর্ব্বে যাহা যাহা বলিয়াছি তাহাই যথেষ্ট। পাশব প্রেমক্রীড়ায় কোন সুখই নাই, সুতরাং পাশব প্রবৃত্তির বৃদ্ধি সাধন বা শারীরিক সুখের বৃদ্ধির চেষ্টায় কোনই ফল নাই। সুখ কেবল প্রকৃত প্রেমিক প্রেমক্রীড়ায়, সে সুখ হৃদয়ের সুখ, প্রেমের সুখ ! উহার বৃদ্ধিসাধন করিতে হইলে প্রেমের বৃদ্ধিসাধন করাই তাহার এক মাত্র উপায়।

 

নবম পরিচ্ছেদ

শারীরিক ও বাহ্যিক প্রেমের বিকাশ

যদি শাস্ত্র বিজ্ঞানের কথা বিশ্বাস করিতে হয়, তাহা হইলে মানিতে হইবে যে, এ সংসারে, এ প্রকাণ্ড জগতে যাহা কিছু আমরা দেখিতে পাই, সমস্তই আধ্যাত্মিক জগত হইতে সৃষ্ট, – – অর্থাৎ নিরাকার কিছু হইতে সাকার সমস্ত সংঘটিত হইয়াছে। ইংরেজিতে ইহাকে বলে “স্পিরিট হইতে ম্যাটারের সৃষ্টি।” আবার যদি পদার্থ বিদ্যা (ফিজিকাল সায়েন্স ) মানিতে হয়, তাহা হইলে বিশ্বাস করিতে হয়, সমস্ত জড়ই ক্রমে আধ্যাত্মিক অবস্থা প্রাপ্ত হয়; অর্থাৎ সমস্ত ম্যাটারই ক্রমে স্পিরিট ভাৰা- ক্রান্ত হয়। প্রেম সম্বন্ধেও ঠিক এই দৃশ্য দেখিতে পাওয়া যায়। প্রেম সকল সময়েই জড় হইতে সৃষ্ট, অর্থাৎ শারীরিক ও বাহ্যিক কারণ বশতঃই প্ৰেম জন্মে। স্ত্রীলোকের প্রতি পুরুষের প্রেম বা পুরুষের প্রতি স্ত্রীলোকের প্রেম, শারীরিক ও বাহ্যিক কারণ হইতে যে জন্মে, তাহা সকলেই স্বচক্ষে প্রতিদিন দেখিতেছেন। ক্রমে এই প্রেমের বিকাশ হইতে থাকে; কিন্তু বিকাশের সাহায্যের জন্য শরীরই প্রধান উপকরণ। দর্শন হইতে এতক্ষণ আমরা ইহাই দেখাইয়াছি। প্রেম উদ্দীপিত হইয়া ক্রমে বৃদ্ধি পাইতে থাকে,অথবা বিশেষ গুণে বিমুগ্ধ হইয়া প্রেম হৃদয়ে জন্মে, পরে সেই প্রেমের বিকাশ হইতে থাকে। দর্শনের পর স্পর্শ, প্রেম-রক্ষ। পরে আলাপ, পরে আলিঙ্গন, তৎপরে চুম্বন, অবশেষে প্রেম- ক্রীড়া প্রেমের ক্রমশঃ বিকাশ হয়। এ সকলই শরীর লইয়া, এ সকল না থাকিলে কারের উপর প্রেম অর্থাৎ শরীর না থাকিলে, কেবল নিরা- জন্মান সম্পূর্ণ অসম্ভব না হইলেও সংসারীর পক্ষে সম্ভব নহে। একটু ভাবিয়া দেখিলেই স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে দর্শন, মিষ্ট আলাপ, আলিঙ্গন, চুম্বনও প্রেমক্রীড়া না থাকিলে কোন ক্রমেই প্রেমের বিকাশ হয় না।

শারীরিক প্রেমের শান্তি

শরীর প্রেম বিকাশের প্রধান উপকরণ হইলেও শরীরের প্রেম মানবের উদ্দেশ্য নহে। শারীরিক প্রেমের শান্তি ও প্রকৃত হৃদয়ের প্রেমের বিকাশই মানবজীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। ম্যাটার (জড় ) হইতে স্পিরিট ( ভৌতিক পদার্থ) প্রেমকে লইয়া যাওয়াই মানবের কর্তব্য, কারণ তাহাতেই মানবের প্রকৃত সুখ। শারীরিক প্রেমের প্রধান অংশ প্রধান অংশ প্রেম | আমরা লালসা, প্রকৃত প্রেমের লালসার পক্ষপাতী নহি, ধৰ্ম্ম- ভাবাপন্ন ব্যক্তিদিগের ন্যায় আমরা লালসাকে হৃদয় হইতে একেবারে দূর করিবার জন্য অনুরোধ করি, —কিন্তু তাহাদের তায় আমরা প্রারম্ভ হইতেই অক্ষম। আমাদের লালসার দমনে পরামর্শ প্রদানে বিশ্বাস লালসার পরিতৃপ্তি সাধনই লালসা দমনের একমাত্র উপায়। প্রথমে লালসার তৃপ্তিসাধন করিলেও সেই সঙ্গে সঙ্গে তাহাকে আয়ত্বাধীন রাখিলে, লালসা কখনই প্রবল হইতে পারে না এবং পরে প্রেম হৃদয়ে প্রবল হইলে শারীরিক প্রেমের শান্তি। লালসা ক্রমে নিস্তেজ হইয়া অবশেষে একেবারে হৃদয়ে লাল- সার শাস্তি হয়। সেই শাস্তিই মানবের প্রেমের চরম সীমা। অনেকে হয়ত বলিবেন শারীরিক প্রেম অপরাধ করিল কি? কিসের জন্য এত চেষ্টা করিয়া শারীরিক প্রেমের বিনাশ সাধন করিব? বিশেষ কারণ না থাকিলে শারীরিক প্রেমের বিনাশ সাধনের জন্য আমরা সকলকে এত অনুরোধ করিতাম না। শারীরিক প্রেম স্থায়ী নহে। যে বিষয় অবলম্বন করিয়া বিষয় যদি নষ্ট হইয়া যায়, তবে তাহা কিরূপে স্থায়ী থাকে, সেই হইতে পারে ? থাকে; যদি যে বৃক্ষ অবলম্বন করিয়া লতা জীবিতা সেই বৃক্ষই নষ্ট হয় তবে কিরূপে লতা বাচিয়া থাকিতে পারে? অট্িকার ভিত্তি যদি ভাঙ্গিয়া পড়ে, তাহা হইলে কাহার উপর ভর করিয়া অট্িকা দণ্ডায়মান থাকিবে? ভিত্তির অভাবে অটকা ও বৃক্ষের অভাবে লতা যেরূপ ধ্বংশ প্রাপ্ত হয় শরীরের অভাবে প্রেমও ঠিক সেই রূপ ধ্বংস হয়। শরীর চিরস্থায়ী নহে, আজ যে শরীর থাকে কাল সে শরীর থাকে না,—বাল্যকালে যে শরীর ছিল, যৌবনে সে শরীর আর নাই, আবার যৌবনে যে শরীর ছিল বার্দ্ধক্যে আর সে শরীর- নাই। প্রেম, শরীরের সৌন্দর্য্যের উপর নির্ভর করিয়াই থাকে, প্রেম, শরীর অবলম্বন করিয়া রহে। যৌবনের যে শরীর, ও শরীরের যে সকল সৌন্দৰ্য্য দেখিয়া মন মুগ্ধ হইয়া ভালবাসা জন্মিয়াছিল যৌবনের অন্তে বার্দ্ধক্যে তাহার তো আর কিছুই থাকে না।
প্রেম যদি কেবল শারীরিক প্রেমই হয়, তাহা হইলে সে প্রেম যৌবনসৌন্দর্য্যের তিরোধানের সঙ্গে সঙ্গে তিরোহিত হয়। বৃদ্ধাকে দেখিতে কি প্রাণ চাহে, বৃদ্ধার শরীর স্পর্শ করিলে, বৃদ্ধাকে আলিঙ্গন করিলে, বৃদ্ধাকে চুম্বন করিলে আর কি সে সুখ হয়, যুবতী বৃদ্ধা হইলে তাহাকে কি পূর্ব্বের ন্যায় আদর করিতে ইচ্ছা যায়? কেন? কারণ যুবতীর যৌবন সৌন্দর্য্য আর তাহাতে নাই। তাহা হইলে বলিতে হয়,ভাল বাসা হইতে, আদর করিতে, আলিঙ্গন করিতে, চুম্বন করিতে ইচ্ছা যায় না, যৌবনের হাব ভাব দেখিয়া তাহারই দ্বারা আকৃষ্ট হইয়া ভাল বাসিতে প্রাণ চায়। যদি যৌবনের জন্যই আকর্ষণ হয়, তবে, সে অকর্ষণের সহিত পশুর আকর্ষণের প্রভেদকি? এরূপ আকর্ষণ মানব জীবনের বিবেক যুক্ত, দয়া চরম উদ্দেশ্য হইতে পারে না, বুদ্ধি মায়া পূর্ণ, অসীম ক্ষমতাশালী জগতের শ্রেষ্ট সৃষ্টি মানব জাতির প্রেমের এ উদ্দেশ্য কখনই হইতে পারে না। হৃদয়ের প্রকৃত প্রেমই মানবজীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। সে প্রেমের সহিত জড় জগতের কোন সম্বন্ধ নাই। জড়ের (ম্যাটার)- সহিত সে প্রেম কিছু মাত্র সংশ্লিষ্ট নহে। – যে প্রেম,শরীরের সহিত বা জড়ের সহিত সংশ্লিষ্ট সে প্রেম, কোনক্রমেই স্থায়ী হইতে পারে না। শরীর থাকেনা এই শরীরের দিন দিন পরির্তন ঘটে; সেইরূপ জগতের সমস্ত জড় পদার্থের একেবারে ধ্বংস না হইলেও পরিবর্তন ঘটে, সুতরাং এরূপ পরিবর্তনশীল সে প্রেম অস্থায়ী দ্রব্যের সহিত চিরস্থায়ী হইতে পারে প্রেম থাকিলে, কখনই না। অথচ আমরা দেখিয়াছি, শরীর হইতেই প্রেমের উৎপত্তি, যৌবন হইতেই প্রেমের বৃদ্ধি এই জন্য শারীরিক প্রেমের বিনাশ সাধন করিয়া মানসিক প্রেমের উৎপত্তি করাই মানব জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। শারীরিক প্রেমের শাস্তি কিসে হয়? অনেকে প্রেমকে আয়ত্বাধীন করিতে পারেন না বলিয়াই এসংসারে এত দুঃখও শারীরিক প্রেমের শান্তি। ৯৭ কষ্ট, প্রেমে এত বিড়ম্বনা। এই জন্যই গৃহে গৃহে এত কলহ, ঘরে ঘরে প্রেমের অভাব, এই জন্যই বিলাতে এত চুক্তিভঙ্গের মোকদমা,—সকলেরই এক কথা প্রেম থাকে না, আজ যাহাকে খুৰ ভালবাসি, হুই দিন পরে তাহাকে আর ভাল ভাসিতে ইচ্ছা যায় ন।।
এই রূপে যৌবনের সঙ্গে সঙ্গে প্রেম তিরোহিত হয়। এই জন্যই শারীরিক প্রেমের শাস্তি একান্ত আবশ্যক, প্রেমকে শরীর হইতে মনে ও হৃদয়ে লইয়া যাইতে হইবে। একাৰ্য্য অসম্ভব বা কঠিন কাৰ্য্য নহে। সকলেই বোধ হয় দেখিয়াছেন যে, প্রথম কোন ব্যক্তির সহিত সাক্ষাৎ হইলে তাহার আকৃতিই দেখি, তাহার চেহারা কিরূপ, তাহার হস্ত পদ চক্ষু নাসিকা কিরূপ তাহাই দেখি, কিন্তু তাহার সহিত যত আলাপ হইতে থাকে, ততই আর তাহার শরীরের প্রতি আমার দৃষ্টি থাকে না ও যদি তাহার সহিত বন্ধুত্ব হয় তখন আর তাহার বাহ্যিক আকারের প্রতি একেবারেই দৃষ্টি থাকে না। যাহাকে একদিন অতি কুৎসিত মনে হইয়াছিল, কয় দিন পরে তাহার সহিত ঘনিষ্টতা জন্মিলে, আর তাঁহাকে কুৎসিত বলিয়া জ্ঞান থাকে না। ইহার কারণ এই, তখন আমরা কেহই, আর তাহার আকার প্রকার দেখি না। এই কারণেই সন্তান অতিকুৎসিত ইই- লেও পিতা,মাতা তাহা সস্তান আরও সুশ্রী রাসেই হৃদয়ে যায়, দেখিতে পান না, তাঁহাদের চক্ষে কুৎসিত বলিয়া বোধ হয়। শরীর হইতে প্রেম অনা কারণ শরীরটা কিছুই নহে। অনেক দার্শনিক গণ শরীরের অস্তিত্ব পর্যন্ত বিশ্বাস করেন না, তাঁহারা বলেন শরীর, মনের কল্পনা প্রস্তুত বিষয়, ইহা কোন পদার্থ নহে। প্রমাণ স্বরূপ তাহারা বলেন, মানবের তিনটী অবস্থা, জাগ্রত সুষুপ্তি ও স্বপ্ন। জাগ্রত অবস্থায় যে হস্তপদ বিশিষ্ট আমি বিদ্যমান আছি, স্বপ্নাবস্থায় সে হস্তপদ বিশিষ্ট আমি আর থাকি না।

তখনও আমার হস্ত পদ থাকে, কিন্তু সে হস্তপদ এ হস্ত পদ নহে। তখন হয়তো আমি সহস্র দিনের পথ নিমেষে যাই, যে রাজ্যে এ হস্তপদবিশিষ্ট জীবের গমন অসম্ভব তথায়ও যাইয়া বিচরণ করি, — তখন আর আমার এ হস্তপদবিশিষ্ট শরীর থাকে না, হস্তপদবিশিষ্ট অন্য শরীর থাকে, আবার স্বপ্নাত্তে জাগ্রত অবস্থায় স্বপ্নের হস্তপদবিশিষ্ট শরীর থাকে না। আবার সুষুপ্তি অবস্থায় এ দুইয়ের কিছুই থাকে না। আমি সুখে নিদ্রিত ছিলাম এই জ্ঞানটুকু ভিন্ন অন্য আর কোন জ্ঞান থাকে না, তখন আমার শরীর, হস্তপদ বা মন হৃদয় ইত্যাদি ছিল কিনা তাহার কোন জ্ঞান থাকে না, তবে আমি যে নিদ্রিত ছিলাম এ জ্ঞানটুকু থাকে। তাহা হইলে তিন অবস্থায়ই “আমি” আছি, হয়। তিন অবস্থায় আমার শরীর এক দিবসের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি তিন অবস্থা প্রাপ্ত শরীরের এইরূপ পরি বৰ্ত্তন ও বিপর্যয় ঘটে, তবে কিরূপে বলা যায় যে, শরীরের কোন অস্তিত্ব আছে। এই জন্যই একটু ঘনিষ্টতা হইলে তখন আর নর নারীর দৃষ্টি শরীরে সম্বদ্ধ থাকে না। যাহারা ইচ্ছা না বুঝিয়া প্রেমকে শরীরে আবদ্ধ রাখে, কেবল তাহারাই চিরকাল শরীরের হাব ভাবের জন্য পাগল হয়। প্রকৃতি দেবী আপনা আপনিই মানব হৃদয়কে জড়জগৎ হইতে ভৌতিক জগতে লইয়া যায়, প্রেমকে শরীর হইতে হৃদয়ে লইয়া যায়। এই স্বাভাবিক বেগের প্রতি- ৰন্ধক না ঘটিলে এ কাৰ্য্য আপনিই সম্পাদিত হয়, কিন্তু অনেকে যৌবন সৌন্দর্য্যে এতই মুগ্ধ ও আকৃষ্ট হয় যে, ইচ্ছা করিয়া স্বভাবের এই স্বাভাবিক গতির প্রতিরক্ষক দিয়া হৃদয় প্রেমের হইতে ইহাকে হৃদয়ে প্রেম গভীরতা দূর করিয়া দেয়। কেবল এইরূপ লোকেরই চিরস্থায়ী হইতে পারে না। পূর্বোল্লিখিত প্রথায় প্রেমের বৃদ্ধি সাধন কর, ক্রমে শারীরিক সৌন্দর্য্য উপভোগের ইচ্ছা ত্যাগ কর,—ক্রমে মনকে শরীর হইতে হৃদয়ে লইয়া যাও, –এ কাৰ্য্যে প্রকৃতি তোমাকে সাহায্য করিবেন, এ কাৰ্য ক্লেশই জন্মিবে না।

প্রেমের গভীরতা

সকলেই প্রেমের গভীরতা অবগত হইবার জন্য ব্যাকুল হয়েন। স্বামী স্ত্রীর হৃদয়ে, তাঁহার প্রতি কত ভালবাসা তাহা জানিবার জন্য ব্যগ্র, — স্ত্রী স্বামীর হৃদয়ে কত ভালবাসা অবগত হইবার জন্য ব্যাকুলা। প্রণয়ী প্রণয়িনীকে আদর করিয়া জিজ্ঞাসা করেন “তুমি আমায় কি ভালবাস? ” প্রেমের আছে, নতুবা নর নারী মাত্রেরই, মনে একথা একটা গভীরতা উদয় হইবে কেন ? ভালবাসা অল্প ও অধিক হয়, ইহা স্পষ্টই সকলে বুঝিতে পারেন। আবার অনেকে বলেন তো “যাহাকে ভালবাসি, তাহাকে ভালবাসি,—ভালবাসার আবার কম বেশী বন্ধু বান্ধবের মধ্যে সৌহৃদ্যের কম বেশী হইতে কি?” অবশ্য পারে, স্নেহও ভক্তির ও কম বেশী হইতে পারে, কিন্তু প্রেমের কম বেশী হয় না। যৌবন সুলভ ভালবাসার অন্নতাও নাই, আধিক্যও নাই। ইহা ঠিক অগ্নির ন্যায়, অগ্নি অল্প হইলেও যৈ উত্তাপ, প্রেম-রক্ষ। অধিক হইলেও সেই উত্তাপ; প্রেমের ও উত্তাপ সকল সময়ে সমান। এই জন্যই প্রেমের অল্পতা বা আধিক্য নাই বলিয়া, দার্শনিকগণ বলিয়া থাকেন যে প্রেমের গভীরতা আছে। গভীরতা কাহাকে বলে। সমুদ্রের গভীরতা আছে। তীরে দাঁড়াইয়। সমুদ্র দেখিলে তাহার গভীরতা আছে কিনা অবগত হইতে পারা যায় না। কেবল জলই দৃষ্টি গোচর হয়, তবে সমুদ্র গভীর হয় বলিয়া শুনা আছে, তাই মনে মনে বোধ হয় সমুদ্র গভীর। কিন্তু জলে প্লাবিত কোন প্রান্তর দেখিলে গভীরতার কেবলই জল দেখি, কোন ঐ হাত গভীর, তাহা জানিবার ভাবই জল দুই মনে হয় না। তথায় ও হাত গভীর কি পঞ্চাশ আমাদের কোন উপায় নাই। প্রেম সম্বন্ধেও ঠিক এইরূপ,—ঐ প্রেমের গভীরতা আছে কিনা, থাকিলেই বা ঐ গভীরতার পরিমাণ কি, তাহা অবগত হইবার উপায় নাই। প্রেমের তেজ সকল সময়ে সকল হৃদ- য়েই সমান, – আমরা সেই তেজই প্রথম দেখিতে পাই, — ভেজের কোন রূপ পরিমাণ উপলব্ধি হয় না। প্রেমের প্লাবিত প্রাত্তর গভীরতা লইয়াই প্রেমের স্থায়িত্ব,—যেমন জল সমুদ্রের ন্যায় দেখিতে হইলেও উহার রতা না থাকায় দুই দিন পরে সমস্ত জল মরিয়া গভী- যায়,—যেখানে কাল সমুদ্রের ভয়াবহ দৃশ্য বিদ্যমান ছিল, সেখানে আজ শুষ্ক প্রান্তর,—প্রেমের গভীরতা না থাকিলে ঠিক সেইরূপ হয়। যে হৃদয় আজ প্রেম পূর্ণ বলিয়া বোধ হইতেছে, যেখানে আজ প্রেমের প্রেমের নাম – প্রেমের গন্ধ তরঙ্গ মাত্র গভীরতা উদ্বেলিত হইতেছে, কাল সেখানে থাকিবে ন। । অবগত হইবার উপায় কি? জিজ্ঞাসা দ্বারা এ প্রশ্নের উত্তর হয় না, কারণ সংসারে অতি অল্প লোকেই নিজ নিজ হৃদয়ে প্রেমের গভীরতা উপলব্ধি করিতে পারে। নিজেই যদি না জানিলাম, তবে কিরূপে পরকে বুঝাইয়া বলিব?
সৰ্ব্বাগ্রে নিজ হৃদয়ে প্রেমের গভীরতা কিরূপ তাহা অবগত হইবার জন্য চেষ্টা করা কর্তব্য। ইহা অবগত হইবার জন্য একটা উপায় ভিন্ন অন্য উপায় আর নাই। লৌহ ইত্যাদির কাঠিন্য আমরা আঘাত করিয়া দেখি;—যদি আঘাতে ভাঙ্গিয়া যায় তবে বুঝি যে, সে লৌহ কঠিন নহে। প্রেমও ঠিক আঘাত করিয়া দেখিতে হয়, প্রেমের গভীরতা কতদূর। যদি আঘাতে প্রেম তিরোহিত না হয়, তবেই বুঝিতে হইবে প্রেমের গভীরতা আেেছ। প্রেমের আবার আঘাত কি? বিচ্ছেদ প্রেমের একটা গুরুতর আঘাত। বিচ্ছেদে যদি প্রেম তিরোহিত না হয়; দুই এক দিনের বিচ্ছেদ নহে, দুই এক মাসের বিচ্ছেদে যদি প্রেম হৃদয় হইতে দূর না হয়, তবেই বুঝিতে হইবে, সে প্রেমের গভীরতা আছে। অন্য কার্য্যে মনঃসংযোগ ও একটী বিশেষ আঘাত,—পাঠে, রচনায়, সঙ্গীতবাদ্যে, সাংসারিক কার্য্যে বা অন্য কোন বিষয়ে লিপ্ত হইলেও যদি প্রেম হৃদয়ে প্রবল থাকে, তবে সে প্রেমের গভীরতা আছে। অবিশ্বাস প্রেমের একটা দারুণ আঘাত। যাহাকে ভালবাসি তাহার উপর যদি অবি- শ্বাস জন্মে তাহা হইলে দেখিতে দেখিতে হৃদয়ে প্রেম নষ্ট হয়। এ আঘাতেও যদি প্রেম নষ্ট না হয় তবে প্রকৃতই প্রেমের গভীরতা আছে। অবিশ্বাস হইতেও বিদ্বেষ ( Jealousy ) প্রেমের একটী ভয়ানক আঘাত। এ আঘাতে প্রেম প্রায়ই ক্ষত বিক্ষত হইয়া যায়। কবি শ্রেষ্ঠ সেক্সপিয়ায় ওথেলোর প্রেম-রঙ্গ। চরিত্রে ইহার সুন্দর চিত্র অঙ্কিত করিয়াছেন। বিচ্ছেদে যদি প্রেম হৃদয় হইতে না যায়, তাহা হইলে সে প্রেমের অতলস্পর্শী গভীরতা, সে প্রেম আর কখনই নষ্ট হয় না। নর নারী মাত্রেই হৃদয়ের প্রেম পরীক্ষা করিয়া দেখা কর্তব্য। পূর্ব্ব হইতে, প্রেমের কত দূর গভীরতা অবগত হইতে পারিলে, যাহাতে প্রেমের গভীরতা বৃদ্ধি হয়, নর নারী মাত্রেই তাহার চেষ্টা করিতে পারে।

দাম্পত্য প্ৰণয়

স্ত্রী পুরুষের প্রেমের চরম সীমাই দাম্পত্য প্রণয়। স্ত্রী পুরুষের প্রেম দাম্পত্য প্রণয়ে পরিণত না হইলে সে প্রেম, পাশব প্রবৃত্তিতেই সম্বন্ধ থাকে; সে প্রেমের পবিত্রতা কখন জন্মে না। বিবাহিত স্ত্রী পুরুষের যে প্রেম, স্বামী স্ত্রীর যে ভাল বাসা তাহারই নাম দাম্পত্য প্রণয়। সংসারে দাম্পত্য প্রেম পবিত্র, ও সৰ্ব্বসুখ পূর্ণ। স্ত্রীপুরুষের ভালবাসা দাম্পত্যপ্রণয়ে পরিণত না হইলে, তাহাতে পাপের উৎপত্তি হইয়া থাকে, সমাজের শৃঙ্খল ছিন্ন হইয়া, সমাজে সহস্র প্রকার ক্লেশের উৎপত্তি করিয়া থাকে। বিবাহই সংসারীর হৃদয়ে উদ্দেশ্য থাকা কৰ্ত্তব্য, – বিবাহ ব্যতীত যাহারা লালসা প্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করিতে অগ্রবর্ত্তী . হয়েন, তাহারা কেবল যে সমাজের মহৎ অনিষ্টসাধন করেন এরূপ নহে,—নিজের শরীরেও ব্যাধি আনয়ন করিয়া চির- দুঃখে জীবন অতিবাহিত করেন। যে কারণেই হউক, সভ্য দাম্পত্য প্ৰণয়। ১০৩ সমাজ মাত্রেই বিবাহের প্রচলন আছে, এবং বিবাহ প্রথা কোন মনুষ্য বিশেষের চেষ্টায় সমাজে প্রচলিত হয় নাই, ইহা আপনা আপনিই সমাজে প্রচলিত হইয়াছে। কেবল অসভ্য দিগের মধ্যেই বিবাহের শিথিলতা দেখিতে পাওয়া যায় এবং এক্ষণে যে সকল ইয়োরোপিয় দেশ অতি সুসভ্য হইতেছে, তাহাদের মধ্য হইতেও বিবাহ প্রথা যেন ধীরে ধীরে উঠিয়া যাইতেছে। বিবাহের আবশ্যকতা কি? বিবাহের সহিত প্রেমের সম্বন্ধ কি? সমাজে শাস্তি রক্ষা ও সুনিয়ম স্থাপনই বিৰা- হের মূখ্যতম উদ্দেশ্য, যদি সমাজে বিবাহ প্রথা না থাকে, তবে বড়ই বিশৃঙ্খলতা ঘটে, পুত্র কন্যার শিক্ষা বিষয়ে, ভরণ পোষণ বিষয়ে, এমন কি তাহাদের প্রাণ রক্ষা বিষয়ে বিশেষ তাচ্ছিল্য ঘটিতে থাকে।
বিবাহ না থাকিলে স্ত্রীপুরুষ উভয়ের স্বাধীন ভাবে জীবিকা নির্ব্বাহ করিতে হয়,—ইহাতে সংসারে দুঃখের ভাগ বৃদ্ধি করে মাত্র। কার্য্য বিভাগই সভ্যতার চিহ্ন। ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন কার্য্য সম্পন্ন হয় বলিয়াই, সভ্য সমাজে এত সুবিধা ও এত সুখ। স্ত্রী যদি গৃহিণীপন!, সন্তান পালন ইত্যাদি করেন, তাঁহাকে যদি অর্থ-উপার্জ্জনের জন্য ব্যাকুলা হইতে না হয়, তাহা হইলে যেরূপ সুচারুভাবে গৃহিণীপনা ও সন্তান পালন হয়, তেমন কি আর তাঁহাকে অর্থ উপার্জ্জন করিতে হইলে হয়? বিবাহের আবশ্যকতা বিষয়ে মহা মহা পণ্ডিতগণ বহুতর যুক্তি দেখাইয়া গিয়াছেন, এপুস্তকে তাহার আলোচনা করিবার আবশ্যকতা নাই ৷ প্রেমের সহিত বিবাহের কি সম্বন্ধ, তাহাই এক্ষণে দেখা যাউক। আমরা বলিয়াছি বিবাহ না থাকিলে প্রেমের পবিত্ৰ ভাৰ ! ১০৪ প্রেম-রক্ষ। রাখিতে পারে না। আরও বলি, বিবাহ না থাকিলে প্ৰেম চিরকাল শরীরেই সম্বদ্ধ থাকে, কখন শরীর ত্যাগ করিয়া হৃদয়ে উপস্থিত হয় না। মানব হৃদয়ে বিশ্বাস যেরূপ কাৰ্য্য করে, তেমন আর কোন বৃত্তিই পারে না। বিশ্বাসে মানুষ মিথ্যাকেও সত্য ভাবে। যে ভূত বিশ্বাস করে সে, কখনও অন্ধকারে গৃহের বাহির হইতে পারে না। এমন কি বিশ্বাসের জন্য ভূতের ভয়ে অনেকে প্রাণত্যাগও করিয়াছে। বিবাহে বিশ্বাসই মূল। বিবাহে স্বামী স্ত্রী সন্মিলিত হইল, তাহাদের বিশ্বাস জন্মে যে, এ জীবনের জন্য এবং এ জীবনের পর পর – কালের জন্যও আমরা উভয়ে উভয়ের সহিত সম্বন্ধ।
আজীবন আমাদিগের উভয়কে একত্রে থাকিতে হইবে, আমরা উভয়ে উভয়ের জীবন, হৃদয় ও প্রাণ। এ বিশ্বাস আমার কখনও সহজে জন্মে না। আমি দেখি একথা সংসারে সকলেই বলে, –এ জগতের নরনারী মাত্রেরই এই বিশ্বাস, তবে আমার ইহাতে অবিশ্বাসের কারণ কি? এতদ্ব্যতীত বিবাহে কতকগুলি ধৰ্ম্ম- ভাব আছে,—উহাতে বিবাহকে ধর্ম্মের সহিত, ঈশ্বরের সহিত মিশ্রিত বলিয়া আমার মনে প্রতীতি জন্মে,—তথন আমার মনে ততই বিশ্বাস হয় যে আমি যাহার সহিত বিবাহিত হইলাম, তাহার হৃদয়ে আমার হৃদয়ে সন্মিলিত হইল। এই বিশ্বাসই প্রকৃত পক্ষে প্রেমকে শরীর হইতে হৃদয়ে লইয়া আইসে। যদি এ বিশ্বাস না থাকে, যদি সংসারে বিবাহ প্রথা প্রচলিত না থাকে তবে লোকের মনে হৃদয়ের সন্মিলনের কথা উদিত হইবে কেন? ভবিষ্যতের ভাবনা যদি না থাকে, তাহা হইলে মানুষ পশুভাবাপন্ন হয়;—তাহা হইলে পশুর সহিত মানবের আর কোন প্রভেদ থাকে না। তখন মানুষ কেবল বর্তমানের দাম্পত্য প্ৰণয়। বর্তমানে তো মানবের পক্ষে পাশব প্রবৃত্তির চরিতার্থতারই সুখ। যৌবনও শরীর সম্ভোগেই তো, মানব অধিক প্রলোভিত হয়,—কেবল ভবিষ্যতে শরীরের প্রেম হৃদয়ে স্থায়ী হইবে না বলিয়াই তো হৃদয়ের প্রেম উদ্দীপন করিবার চেষ্ট!। বিবাহ না থাকিলে লোকের মন একেবারেই এদিকে যাইবে না,—মানবের মন প্রেম লালসায় জড়িত হইয়া যৌবন সম্ভোগেই পাগল হয়। প্রকৃত দাম্পত্য প্রণয় কি? দুই প্রকারে দাম্পত্য প্রণয় জন্মিতে পারে। এক প্রেম হইতে,অপর বিশ্বাস হইতে।
বিলাতি সমাজে প্রেম হইতে দাম্পত্য প্রণয় জন্মে, আমাদের সমাজে বিশ্বাস হইতে দাম্পত্য প্রেম জন্মে। ইংরেজগণ প্রেম না জন্মিলে বিবাহ করেন না, বলা বাহুল্য সে প্রেম শারীরিক প্রেম, লালসাপূর্ণ প্রেম ৷ অনেকে এই প্রেম হইতে দাম্পত্য প্রণয় কিরূপে জন্মে, তাহা অবগত নাই বলিয়াই তাঁহাদের প্রেম অনেক সময়েই স্থায়ী হয় না,—কিন্তু আমাদের সমাজে বাল্য কালে বিবাহ হওয়ায় বিশ্বাস হইতে প্রেম জন্মিতে আরম্ভ করে, সুতরাং এ প্রেমে লালসার প্রবলতা হইবার সুবিধা হয় না,—প্রথমে স্নেহ মিশ্রিত একরূপ ভালবাসা, তৎপরে অতি অল্পকালের জন্য প্রীতি অর্থাৎ লালসাপূর্ণ ভালবাসা হৃদয়ে উদিত হইয়া, এই সমস্ত ভালবাসা দাম্পত্য প্রণয়ে পরিণত হয়। দাম্পত্য প্রণয়ে লালসার নামগন্ধ নাই। শরীরের সহিত ইহার কোন সম্বন্ধ নাই। দাম্পত্য প্রণয়ে স্বামী স্ত্রীর যে, কোন আকৃতি আছে তাহ৷ একেবারে ভুলিয়া যান, তাহার চক্ষে স্ত্রীর কুরূপ বা সুরূপ কিছুই উদিত হয় না। স্ত্রীও স্বামীর আক্বতি প্রেম-রঙ্গ। – ১০৬ দেখিতে পান না। উভয়ে আছেন, – আর কিছু নাই,, সেই উভয়ের থাকার মধ্যে যেন অনন্ত সুখ বিরাজিত, —ইহারই নাম দাম্পত্য প্রণয়। প্রেমে নানা বিষয়ের জ্ঞান থাকে, দাম্পত্যে কেবল নিজেদের অস্তিত্বের জ্ঞান ও সুখের জ্ঞান থাকে। তখন মানুষের অবস্থার তাহার কোন জ্ঞানই থাকে না,—কেবল সে বুঝিতে পারে যে, সে ছিল এবং সুখে ছিল,— দাম্পত্য প্রণয়েও স্বামী স্ত্রীর কেবল জ্ঞান থাকে যে, তাহারা আছেন, আর সুথে আছেন। তাহাদের অন্য আর কোন জ্ঞানই থাকেনা। ইহারই নাম প্রকৃত দাম্পত্য প্ৰণয়। এ দাম্পত্য প্রেম কিসে জন্মে ! বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রী উভয়ে যদি লালস! বৃত্তিকে যত্ন সহকারে হৃদয়ে দমন করেন, বা হৃদয় হইতে ইহাকে একেবারে দূর করিয়া দিতে সক্ষম হয়েন, যদি বিবাহের প্রকৃত মৰ্ম্ম বুঝিয়া বিশ্বাসকে হৃদয়ে স্থান দান করিতে পারেন, তাহা হইলে মানব হৃদয়ে যে ভালবাসা জন্মিবে, বা থাকিবে, তাহারই নাম দাম্পত্য প্রণয় |

 

দশম পরিচ্ছেদ

হৃদয়ে হৃদয়ে প্ৰেম

আমরা এক্ষণে এক নূতন রাজ্যে আসিয়াছি। জড়জগৎ ত্যাগ করিয়া আমরা ভৌতিক জগতে আসিয়া পড়িয়াছি। . সংসারে যে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, হস্তপদ বিশিষ্ট শরীর আছে, হৃদয়ের প্রেমের আবির্ভাব ৷ তাহা আমরা এক্ষণে ভুলিয়া গিয়াছি। এক্ষণে আর আমরা “ঢল ঢল নয়ন” “রক্তিমাভ ওষ্ঠ” “পীনোন্নত পয়োধর” ইত্যাদি যে রাজ্যে রাজত্ব করে সে রাজ্যে আর নাই। আর আমাদের মদনও রতি পূজার আবশ্যক নাই,—আর আমাদের বসন্তের শোভা, কোকিলের কূজন, ভ্রমরের গুঞ্জনের প্রয়োজন নাই। আমরা এক্ষণে শরীর ত্যাগ করিয়া হৃদয়ে আসিয়াছি। কিরূপে ক্রমে ক্রমে ধীরে ধীরে প্রেম শরীর হইতে হৃদয় রাজ্যের এক্ষণে অংশীভূত হয় তাহা আমরা বলিয়াছি। দাম্পত্য প্রণয় বর্ণনা করিতে গিয়া হৃদয়ে প্রেম কি তাহাও বলিয়াছি। ঐ প্রেমের কিরূপে উৎকর্ষ সাধন হয় তাহাই বলিব | শরীর হইতে প্রেম হৃদয়ে উঠিলেই যে, মানবের জীবনের কাৰ্য্য শেষ হইল,—প্রেমের চূড়ান্ত লাভ হইল, এ কথা যেন কেহ ভাবিবেন না। ইহাতে এই মাত্র হইল যে, প্রেম পাশব হইল। প্রবৃত্তির হস্ত হইতে মুক্তি লাভ করিয়া প্রকৃত পবিত্র ভাবাপন্ন প্রেম উন্নতির সোপানের একস্তর মাত্র উঠিল,—প্রেম সাগরে সন্মিলিত হইবার জন্য এখনও তাহাকে বহুদূরে যাইতে হইবে। যেমন শারীরিক প্রেমকে যত্নে বর্ধিত করিতে হয়, ঠিক সেইরূপ বা ততোধিক যত্নে হৃদয়ের প্রেমকেও উন্নত করিতে হয়। নতুবা প্রকৃত প্রেমের যে অনন্ত সুখ তাহা লাভ হয় না।

হৃদয়ের প্রেমের আবির্ভাব

শারীরিক প্রেম যেমন শরীরের কতকগুলি অঙ্গ অবলম্বন করিয়া থাকে, ঢল ঢল নয়ন, গোলাপবিনিন্দিত গণ্ড, পীনোন্নত পয়োধর ইত্যাদি যেমন শারীরিক প্রেমের উপাদান স্বরূপ, প্রেম সেইরূপ হৃদয়ের প্রেমেরও কতকগুলি উপাদান আছে। লতার ন্যায়,—লতা যেমন অন্য কাহাকে অবলম্বন না করিয়া কখন থাকিতে পারে না, কি শারীরিক প্রেম, কি মানসিক প্রেম উভয় প্রেমই কিছু না কিছু অবলম্বন করিয়া থাকে? তাহা হইলে হৃদয়ের প্রেম কাহাকে অবলম্বন করিয়। হৃদয়ে থাকে? . আমরা দেখিয়াছি অঙ্গের কতকগুলি বিশেষ সৌন্দর্য্য অব লম্বন করিয়াই শারীরিক প্রেম বিরাজ করে। হৃদয়ের প্রেমও ঠিক সেইরূপ কতকগুলি হৃদয়ের সৌন্দর্য্য অবলম্বন করিয়া থাকে। এই সকল সৌন্দর্য্যের নাম গুণ। শরীরের সৌন্দর্য্য যেরূপ দিন দিন হ্রাস হইয়া শেষ একেবারে নষ্ট হইয়া যায়, হৃদয়ের গুণ ঠিক তাহার বিপরাত ভাবাপন্ন হইয়া দিন দিন বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। সুতরাং যে প্রেম গুণ অবলম্বন করিয়া থাকে সে প্রেমের কখনই বিনাশ নাই, কারণ গুণের বিনাশ নাই। যখন আমি অপরকে তাহার গুণের জন্য ভালবাসি তখন, আর আমি দেখিনা, সে যুবতী কি বৃদ্ধা, সুরূপা কি কুরূপা, কারণ গুণ বৃদ্ধাতেও আছে কুরগাতেও থাকে। হৃদয়ের ভালবাসার অর্থাৎ গুণাবলম্বী ভালবাসার বিকাশ কিসে হয়? যেরূপে বাহ্যিক সৌন্দৰ্য হইতে শারীরিক প্রেম জন্মে, ঠিক সেই রূপেই হৃদয়ের প্রেম জন্মে। অপরের যৌবন হুলভ সৌন্দৰ্য্য দেখিয়াই তাহার প্রতি আমার ভালবাসা জন্মে। দর্শন হইতেই শারীরিক ভালবাসার আবির্ভাব, গুণ দেখিতে পাইলেই লোকে গুণে মুগ্ধ হয়, তাহা হইলেই তখন তাহার প্রতি ভালবাসা জন্মে 1 গুণ তো চক্ষে দেখা যায় না? এতে হইলে তাহার সহিত বসবাস আবশ্যক, — একদিন হৃদয়ের ভালবাসার প্রকৃতি। ছই দিনে অপরকে বুঝিতে পারা যায় না,—অপরের দোষ গুণ জানিতে পারা যায় না। এই জন্যই শারীরিক প্রেম অগ্রে না জন্মিলে হৃদয়ের প্রেম জন্মে না। বাহ্যিক প্রেম বশতঃ সন্মিলন, এক সঙ্গে বসবাস, তৎপরে বিবাহ—ইহাতে স্ত্রীপুরুষ উভয়ের কাহারই আয় কাহাকে বুঝিতে ও জানিতে বাকি থাকে না। তখন উভয়ে উভয়ের হৃদয়স্থ গুণ দেখিয়া মুগ্ধ হয়। তখন সেই সকল গুণের জন্য উভয়ে উভয়কে ভাল বাসিতে থাকে। দিন দিন হৃদয়ে যেমন গুণ বৃদ্ধি লাভ করিতে থাকে, এদিকে ভাল বাসাও ঠিক সেইরূপ বৃদ্ধি পাইতে থাকে ৷

হৃদয়ের ভালবাসার প্রকৃতি

উপরে আমরা যাহা বলিলাম, তাহাতে আমরা স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম যে; লালসার সম্পূর্ণ বিরাম, শরীরের অস্তিত্ব বিস্মরণ ও গুণ অবলম্বন করিয়া থাকাই হৃদয়ের প্রেমের প্রকৃতি। কোন্ ভালবাসার কিরূপ প্রকৃতি, তাহা অবগত হইতে না পারিলে, সে ভালবাসার উৎকর্ষ সাধন কোন ক্রমেই সহজ বা সম্ভব নহে। এই জন্য প্রথমেই ভাল বাসার প্রকৃতি অরগত হওয়া সকলেরই কর্তব্য। যখন বুঝিলাম গুণ অবলম্বন করিয়া থাকা হৃদয়ের প্রেমের প্রকৃতি তখন, সেই প্রেমের উৎকর্ষ সাধন জন্য গুণের উৎকর্ষ সাধন করিলেই সে প্রেমেরও উৎকর্ষ সাধন করা হইল। এখন আকৃষ্ট হয়। দেখা যাউক, কোন কোন গুণে প্রেম অন্যান্য গুণাপেক্ষা অধিক গুণ অর্থেই পূণ্য, পাপীর হৃদয়ে কোন গুণই থাকিতে পারে না। সুতরাং হৃদয়ের প্রেমের উৎকর্ষ সাধন করিতে L প্রেম-রক্ষ। হইলে পুণ্যোপার্জ্জন করিবার জন্য প্রথম আয়াস পাওয়া একাত্ত কর্ত্তা। পাপের প্রলোভন যে প্রতিনিবৃত্ত করিতে পারে না, – সে পুণ্যের পবিত্র পথে বিচরণ করিতে পারে না। তাহার অনন্ত- সুখময়-হৃদয়ের প্রেম লাভের প্রত্যাশা করা বিড়ম্বনামাত্র। পূণ্য লাভের উপায় ও হৃদয়স্থ গুণ সকলের উৎকর্ষ সাধন, দয়া, মায়া, সহানুভূতি, সদাশয়তা, মমতা ইত্যাদি মানসিক গুণ সকলের উৎকর্ষ সাধন করিলেই পূণ্যোপার্জ্জন হইল; এবং এই সকল গুণ অবলম্বন করিয়া, হৃদয়ের প্রেম হৃদয়ে বিরাজ করে, সুতরাং ইহার উৎকর্ষ সাধনেই হৃদয়ের প্রেম বৰ্দ্ধিত হইবে। অনেকে হয়তো ভাবিবেন, প্রেমের সহিত দয়ার সম্বন্ধ কি, . সহানুভূতির সম্বন্ধ কি, সদাশয়তার সম্বন্ধ কি? আমি সহানুভূতি প্রকাশ করি না করি, তাহাতে আমার ভালবাসার সম্পর্ক কি? নিষ্ঠুর হইলে কি সে ভাল বাসিতে পারে না, —নিষ্ঠুর লোকও তো অনেক সময়ে দেখিতে পাওয়া যায় স্ত্রীকে বড় ভালবাসে? যাহার হৃদয়ে সহানুভুতি নাই, সেও তে৷ অনেক সময়ে প্রেমে পাগল হয়। এসকল কথাই আমরা স্বীকার করি।

পাশ প্রবৃত্তি সম্মিলিত প্রেমের সহিত মনের কোন সম্বন্ধ নাই। নিষ্ঠুর রাক্ষ্যও পাশব প্রেমে পাগল হইতে পারে, দয়া মায়া শূক্ত ৰক্তিও যৌবন সুলভ প্রীতির মোহিনী মায়ায় মুগ্ধ হইয়! উম্মত্ত- প্রায় হয়। এসকলই শারীরিক প্রেম, এ তো হৃদয়ের প্রেম নয়। আমরা যে প্রেমের কথা বলিতেছি, সে প্রেম নিষ্ঠুরে, দয়া মায়া শূন্য ব্যক্তিতে কিছুতেই থাকিতে পারে না। ভক্তি এ প্রেম হৃদয়ে আকৃষ্ট করিয়া রাখে।
যে দয়াঙ্গু তাহার হৃদয় সহানুভূতির পূর্ণ, যাহার দয়া মায়া মমতা দেখিলে মুগ্ধ হইতে হয়, তাহাকে সত্যই ভক্তি করিতে মন চায়, আর দিয়ের ভালবাসার প্রকৃতি যাহার নিষ্ঠুরতায়, যাহার কঠোরতায় হৃদয়ে স্বণার উদ্রেক হয়, তাহাকে কি ভক্তি করিতে ইচ্ছা করে? যাহাকে ভক্তি করিতে ইচ্ছা করে না, তাহাকে কখনই কেহ ভালবাসিতে পারে না। প্রকৃত হৃদয়ের প্রেমের উন্নতি করিতে হইলে প্রথম মনকে কোমল, সম্পূর্ণ কঠোরতা শূন্য করিতে হইবে। তৎপরে যাহাতে মায়া দয়া সহানুভূতি ইত্যাদি বৃদ্ধি হয়, তাহার চেষ্টা করিতে হইবে। পরিচালনাই এ সকলের বৃদ্ধি সাধনের একমাত্র উপায়। এ সংসারে কি শারীরিক কি মানসিক সকল বৃত্তিরই পরিচালনা করিলে ক্রমে তাহারা পরিস্ফুট হইতে থাকে ৷ যাহারা অধিক হাত নাড়িয়া কাজ করে, তাহাদের হস্তের বল বৃদ্ধি হয়, যাহারা অধিক পদচারণ করে, তাহাদের পদের ক্ষমতা ও বল বৃদ্ধি হয়। এই জন্যই ব্যায়ামে সর্ব্বাঙ্গের এরূপ পুষ্টি সাধন ও বল সঞ্চার হয়। ব্যায়াম দ্বারা সর্ব্বাঙ্গ পরিচালিত হয় বলিয়াই ব্যায়ামে মনুষ্য শরীরে এত বল বৃদ্ধি ও সর্ব্বাঙ্গের পুষ্টি সাধন হইয়া থাকে। মানব মনের ও ব্যায়াম আছে। যে ঐ ব্যায়ামে তাচ্ছিল্য করে, তাহার মন ও হৃদয় ক্রমে দুর্ব্বল হইয়া পড়ে, তাহার হৃদয়কে দুর্ব্বল পাইয়া পাপ আসিয়া তাহার হৃদয়ে রাজ্য বিস্তার করে। সেরূপ হৃদয়ে, হৃদয়ের প্রেম কখনই থাকিতে পারে না। পরিচালনার নামই ব্যায়াম। দয়া মায়া সহানুভূতি প্রভৃতি হৃদয়ের সমস্ত বৃত্তি গুলির পরিচালনা কর, দেখিবে তাহারা দিন দিন সবল হইয়া উঠিবে। যাহাকে দয়া করা কর্তব্য, তাহাকে দয়া কর, যাহাকে সহানুভুতি করা কর্ত্তব্য তাহার প্রতি সহানু ভূতি কর,দেখিবে তোমার হৃদয়ের সমস্তবৃত্তি পরিপুষ্ট হইয়াছে। তোমার হৃদয়ে আর দয়া ধরেনা, – তোমার হৃদয় প্লাবিত ১১২ প্রেম-রঙ্গ। করিয়া সহানুভূতি চারি দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে।
তোমার হৃদয়ে এরূপ অবস্থা হইলে পথের লোক তোমাকে ভাল • বাসিবে, ভক্তি করিবে। যাহাকে পথের লোক ভক্তি করে ও ভালবাসে, তাহাকে স্ত্রী ভাল না বাসিয়া কি কখন ও থাকিতে পারে? পথের লোক যদি হৃদয়ে সৌন্দৰ্য কিছুমাত্র দেখিতে পায়, তাহা হইলে তোমার চিরসঙ্গিনী সহধর্ম্মিনী তোমার হৃদয়ে সম্পূর্ণ সৌন্দৰ্য্য দেখিতে পাইবে। যদি সেই অপরূপ সৌন্দর্য্যের কিছু মাত্র দেখিয়াই অপরে তোমাকে ভালবাসে, তাহা হইলে যে সেই সৌন্দর্য্যের সম্পূর্ণ বিকাশ দেখিতেছে সে কি তোমায় না ভালবাসিয়া কখনও থাকিতে পারে। যখন দম্পতি যুগলের ভালবাসা কেবল এইরূপ হৃদয়ের গুণ ও সৌন্দর্য্য অবলম্বন করিয়া থাকিবে, তখন সে ভালবাসার আর মৃত্যু নাই। তাহার মূল্য মানব হৃদয়ে আমূল পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছে। তখনই প্রকৃত প্রেমের স্থায়িত্ব জন্মিয়াছে। পাশব প্রেমে আর এ প্রেমে কি প্রভেদ নাই? প্রভেদ স্বৰ্গ মর্ত্যের, সে প্রভেদ যে দেখিয়াছে ও বুঝিয়াছে, সে ভিন্ন অন্যে তাহার বুঝিবে কি?

 

একাদশ পরিচ্ছেদ

প্রেমের মাধুর্য্য

এখন হইতে আমরা যে প্রেমের উল্লেখ করিব তাহাকে হৃদয়ের প্রেমই বুঝিতে হইবে। প্রেমের মাধুব্য এ প্রেমের মাধুর্য্য কি? যে দ্রব্য বা যে বিষয়ের মধুরতা আছে, লোকে সেই দ্রব্য বা সেই বিষয়টা পাইবার জন্য ব্যগ্র হয়, এবং পাইলেও উহা যত্নে রক্ষা করিবার জন্য চেষ্টা করে। প্রেমের মধুরতা কি? যে কখন অমৃত খায় নাই, তাহাকে কি কখন কেহ অমৃতের মিষ্টতা বুঝাইয়া দিতে পারে! যে কখন বিলাত দেখে নাই, তাহার কি শত সহস্র বিলাত বর্ণনা পাঠ করিলে বিলাতের কতক ভাব মনে উদিত হয়! প্রেমের মাধুর্য্য যে উপভোগ না করিয়াছে সে কখনও কি প্রেমের মধুরতা উপলব্ধি করিতে পারে! শত সহস্র প্রকারে বুঝাইলেও কি সে তাহা বুঝিতে পারে ! অনেকে বলিবেন তবে মধুরতা আছে যে, তাহা কিরূপে বুঝিব ! যিনি প্রকৃত প্রেম উপার্জ্জন করিয়া প্রেমের মাধুর্য্য উপলব্ধি করেন নাই, তাঁহাকে পরের কথা বিশ্বাস করিতে হইবে। রোগী, ঔষধে উপকার হইবে কি না, তাহা সে জানে না, তাহার সে কথা জানিবার কোন উপায়ও নাই। এরূপ স্থলে রোগীকে চিকিৎসকের কথায় বিশ্বাস করিয়াই ঔষধ সেবন করিতে হইতেছে। সেইরূপ যাহারা প্রেমে অজ্ঞ, তাহাদিগের পক্ষে প্রেমের মাধুর্য্য উপলব্ধি করা অসম্ভব। প্রেমে যে মাধুৰ্য্য আছে, একথা পরের কথা শুনিয়া তাহাদিগকে বিশ্বাস করিতে হইতেছে। অসম্ভব সত্বেও আমরা প্রেমের মাধুর্য্য পাঠকদিগকে কথ- ঞ্চিৎ বুঝাইতে চেষ্টা করিব। যাহা দেখিলে বা উপলব্ধি করিলে বা স্বাদ গ্রহণ করিলে হৃদয়ে একরূপ সুখের আগে স্পষ্ট দেখিতে পাওয়া যায়, তাহাকেই সেই দ্রব্যের, সেই বিষয়ের বা সেই কার্য্যের মধুরতা বলে। মধুরতায় মানব মন যত মুগ্ধ ও প্রলোভিত হয় তত আর কিছুতেই হয় না। প্রেমে যদি মধু- রতা না থাকিত, তাহা হইলে লোকে প্রেমের জন্য এত পাগল হইত ন! ৷ ভালবাসিয়াই মানবের মনে একটা সুখের উপলব্ধি হয়। হয় তো আমি যাহাকে ভালবাসি, সে আমাকে ভালবাসেন। অথবা হয় ত সে ভাব আর নাই, – ভালবাসার ঘাত প্রতিঘাত আর হইতেছে না, অথচ ভালবাসায় যেন কি এক সুখ অনুভব হয়,— সে ভালবাসিয়াই সুখ। এই সুখ টুকুই ভালবাসার মাধুর্য্য, প্রেমের মধুরতা। প্রেমের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এই মধুরতারও বিকাশ হয়। যতই প্রেম বৃদ্ধি হইতে থাকে, লোকে ততই আমরা পূর্ব্বে যে বলিয়াছি, বিচ্ছেদ, বিরহ, বিদ্বেষ ইত্যাদির অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্যেও ভালবাসার একটু সুখ কেমন আপনা কেবল ভালবাসিয়াই অনন্ত সুখ অনুভব করিয়া থাকে। আপনিই পরিস্ফুট হয়, সেই টুকুই প্রেমের মাধুৰ্য্য। সহস্র কষ্ট 4 দেও, প্রেমিক তবু কষ্ট পায় না, তাহার হৃদয়ে সুখের একটা ক্ষুদ্র প্রবাহিণী ধীর গতিতে সৰ্ব্বদাই বহিতে থাকে।

শোভা ও সৌন্দর্য্য

প্রেমের যে অপরূপ শোভা ও সৌন্দর্য্য আছে, তাহা বোধ হয় আর কাহাকেও বুঝাইতে হইবে না। জগতে প্রেম আছে ৰলিয়াই জগতের এই অপরূপ সৌন্দর্য্য। বাবুর মনো- রঞ্জনের জন্যই কোকিল পঞ্চমতানে সঙ্গীত গাইয়া বসন্তের শোভা পূর্ণ করে। ভ্রমরী না থাকিলে ভ্রমর গুণ গুণ করিয়া ফুলে ফুলে ঘুরিত না। যে দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিবে, জগতের 1. শোভা ও সৌন্দয্য। ১১৫ সেই দিকেই দেখিবে, কি কীট পতঙ্গ, কি বিহগ বিহুগিনী, কি পশু কুল, সকলেই যুগলে যুগলে সম্বন্ধ হইয়া বাস করে? ময়ূরী না থাকিলে ময়ূরের শোভা কোথার? মরাল সহ মক্কালিনী না থাকিলে কি সরোবরের শোভা হয় ! বাহ্য জগতেতো এইরূপ, – মানব সমাজেও ঠিক এই শোভ, এই সৌন্দর্য্য। নারী জাতি না থাকিলে সংসার তো শ্মশানে পরিণত হইত। নারী জাতি না থাকিলে সংসারে আর কিসের শোভা থাকিত? কেবল পুরুষ, — জগতের সৌন্দর্য্যরূপিণী স্ত্রী নাই! একথা ভাবিলেও যে সংসারকে মরুভূমি বলিয়া প্রতীতি হয়। কেবল নারী থাকিলেও জগতের কোন সৌন্দর্য্য হইত না। কপোত কপোতী, ময়ূর ময়ূরী, সিংহ সিংহিনী, হরিণ হরিণী সকলে যুগলে যুগলে ভ্রমণ করে বলিয়াই সে দৃশ্য এত সুন্দর। পুরুষের পার্শ্বে স্ত্রী বিরাজিত থাকিলে তবেই শোভা। শিবের ক্রোড়ে শিবানী উপবিষ্টা হইলে তবেই জগতের অপরূপ শোভা দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু স্ত্রীকে পুরুষের নিকট টানিয়া আনিয়া জগতের এ সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করে কে? প্রেম। এই যে চারিদিকে আমরা সৌন্দর্য্য দেখিতে পাই, এই যে চারি দিকস্থ অপরূপ সৌন্দর্য্য দেখিয়া আমরা বিমুগ্ধ হইয়া হৃদয়ে এত আনন্দ অনুভব করি, এ সমস্তেরই মূল, প্রেম। পার্থিব পদা- র্থের এ শোভা ও সৌন্দর্য্য নহে, ফল ফুলেরও এ সৌন্দৰ্য নহে। এ সৌন্দর্য্য প্রেমের, এ সৌন্দর্য্য ভালবাসার। যে অত্যাশ্চর্য আকর্ষণী শক্তির বলে হৃদয় সমস্ত জগতে সম্বন্ধ, সেই প্রেমেই এই অপরূপ শোভা।

গুণ

প্রেমের গুণ কি? গুণ কাহাকে বলি প্রথম তাহা বুঝিবার চেষ্টা করা কর্তব্য। যাহা হইতে প্রকাশ ভাবে বা অপ্রকাশ্য ভাবে কোন উপকার পাই বা অন্যে পায় তাহাকেই গুণ বলি। প্রেম হইতে তাহা হইলে আমরা কি উপকার লাভ করি? প্রেম হইড়ে যে উপকার মনুষ্য জাতি লাভ করে, সে উপকার তো এ সংসারে আর কেহই প্রদান করিতে পারে না। মানুষ মাত্রেই মুখের প্রয়াসী। যিনি যাহাই করুন না কেন, সকলেরই শেষ উদ্দেশ্য সুখ। ঐ যে রাজাধিরাজ বিলাসে বেষ্টিত হইয়া কত অর্থ জলের ন্যায় ব্যয় করিতেছেন, উহারও উদ্দেশ্য সুখ লাভ। আর ঐ যে কৃষক প্রান্তরে দুই প্রহরের রৌদ্রে ঘর্ম্মাক্ত কলেবরে খাটিতেছে, উহারও উদ্দেশ্য সুখ। সামান্য কাঁট হইতে মনুষ্য পর্য্যন্ত সকলেই এই সুখের অনুসন্ধানে ব্যগ্র,—কিন্তু জিজ্ঞাসা কর, কি রাজা কি কৃষক সকলেই বলিবে, এ সংসারে সুখ নাই, এ সংসারে কেহ দুখ পাইবে না। বিখ্যাত ইংরেজ পণ্ডিত জন্মন সাহেব রাসেলাস নামক উপন্যাসে রাসে- লাসকে দিয়া দেখাইয়াছেন যে রাজার পুত্র কোন রূপেই সুখ লাভ করিতে পারিলেন না। তিনি কত দেশ ভ্রমণ করিলেন, কতস্থানে কত অর্থ ব্যয় করিলেন, কিন্তু কোথায়ও সুখ পাই- লেন না। পাইবেন কেন? এ সংসারে সুথ উপার্জ্জনের এক মাত্র উপায় আছে; সুখের মন্দিরে উপস্থিত হইবার জন্য এ পৃথিবীতে একই পথ আছে; ঐ উপায়ের নাম প্রেম, ঐ পথের নাম ভালবাসা। সুতরাং প্রেমের গুণই সুখদান। যে প্রেম লাভ করিতে পারে এ সংসারে কেবল সেই প্রেমের গুণস্বরূপ সুখ লাভ করে।

বিভা

সূর্য্যের যেরূপ বিভা আছে, কিরণ আছে, প্রেমেরও ঠিক সেইরূপ বিভা আছে, কিরণ আছে। সূর্য্যের কিরণে মানুষ তিষ্ঠিতে পারে না, প্রেমের কিরণে পাপও এক মুহুর্তের জন্য থাকিতে পারে না। এই জন্যই শাস্ত্রকারগণ বলিয়া গিয়াছেন, সতীর দেহ কেহ স্পর্শ করিতে পারে না। এই বিভা বর্ণনের জন্যই সাবিত্রী সত্যবান উপাখ্যানের সৃষ্টি। প্রেমের এমনি বিভা, প্রেমের কিরণের এমনই তেজ যে, স্বয়ং যমরাজ পৰ্য্যস্তও সেই তেজ ভেদ করিয়া সাবিত্রীর ক্রোড় হইতে মৃত সত্যবানকে লইতে পারেন নাই। রোগ, শোক, তাপ, পাপের প্রলোভনও সংসারের মায়া, প্রেমের বিভায় ভীত হইয়া প্রেমিক প্রেমিকার নিকটস্থও হইতে পারে না। সংসারে আত্মরক্ষার জন্য প্রেমের ন্যায় অস্ত্র আর কিছুই নাই।

 

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

প্রেমের সুখ

নরনারী যে সুখ প্রেম হইতে উপভোগ করে, সে সুখের ন্যায় সুখ এজগতে আর নাই। সুখ অনেক প্রকার তাহা- দিগকে শারীরিক সুখ মানসিক সুখ ও হৃদয়ের সুখ এই তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়। শারীরিক সুখ, — স্ত্রী পুরুষ সন্মিলন, সৌগন্ধ গ্রহণ, উপাদেয় দ্রব্য ভক্ষণ ইত্যাদি, মানসিক সুখ সন্তোষ ও হৃদষের সুখ আনন্দ। উত্তমোত্তম আহা- রীয় ভোজনে শারীরিক সুখ, কোন কঠিন প্রশ্নের উত্তর করিতে পারিলে মানসিক সুখও কাহারও প্রতি দয়া করিলে হৃদয়ের সুখ। প্রেমের সুখে এই তিন সুখেরই সম্মিলন, সুতরাং প্রেমের সুখের ন্যায় সুখ আর এ সংসারে নাই। শরীরের ‘জন্য ও মনের জন্যই মানবের এ সংসারে দুঃখ; ভাল আহার হইল না, ভাল বেশভূষা হইল না, দরিদ্রতার অসহনীয় কষ্ট ও অভাব, এবং ব্যাধি প্রভৃতি এই সমস্তই, শরীর লইয়া দুঃখ। শরীর যদি না থাকে মানবের তাহা হইলে প্রায় কোন কষ্ট থাকে না। আবার কতকগুলি কষ্ট আছে যাহা মনের—ইহাকে শাস্ত্রকারগণ মায়া বলিয়া গিয়াছেন। স্ত্রী পুত্র বিয়োগের কষ্ট ইত্যাদি সমস্তই মানসিক কষ্ট; যদি মায়া না থাকে তবে কখনই এসকল কষ্টও থাকিতে পারে না। আমরা পূর্ব্বেই দেখাইয়াছি প্রেম ক্রমে শরীরও মনকে অতিক্রম করিয়া কেবল হৃদয়ে আসিয়া সম্বদ্ধ হইয়াছে, অর্থাৎ প্রেম সম্পূর্ণরূপে জড় ভৌতিক (ম্যাটার) জগৎ পরিত্যাগ করিয়া (স্পিরিট ) জগতে আইসে। শরীর যে জড় পদার্থ তাহা তো আমরা স্পষ্টই দেখিতে পাই; মনও যে জড় সম্বলিত প্রতিবন্ধক কাটাইয়া, প্রেম অন্য এক রাজ্যে উপস্থিত হয় বিষয় তাহাও আমরা “প্রেমতত্ত্বে” দেখাইয়াচি। এই দুই জড় বলিয়াই প্রেমের এত আদর, প্রেমে এত সুখ। দুঃখের আশ্রয় .ও. উপাদান স্বরূপ শরীর ও মনের আশ্রয় স্বরূপ প্রকৃত প্রেমের, কোন সম্বন্ধ নাই বলিয়াই প্রেমে কোন দুঃখ বা কষ্ট নাই। এটি অনেকে বলিবেন “ইহাতে৷ ৰাজে কথা হইল। এসংসারে সংসারে স্বর্গ সুখ। ১১৯ তো এ প্রেম দেখিতে পাই না; এসংসারে তো প্রেমে অনস্ত কষ্টই দেখা যায়।” ইহার উত্তরে আমরা বলিব, যেখানে • আমরা প্রেমে কষ্ট দেখিতে পাই, সেখানে প্রেম শরীর ও মনে বন্ধ আছে, সে প্রেম পাশব নহে। শারীরিক প্রেম, সে প্রেমের সহিত লালসা ও প্রবৃত্তি মিশ্রিত আছে। সে প্রেম প্রকৃত হৃদয়ের প্রেম যাহাকে আমরা হৃদয়ের প্রেম বলিয়াছি, তাহার সহিত শরীর ও মনের বিন্দুমাত্রও সম্বন্ধ নাই। আমরা সকলেই জানি জগতের সমস্ত দুঃখের উপাদান শরীর ও মন, যখন শরীর ও মনের সহিত প্রেমের কোন সম্বন্ধ নাই, তখন প্রেমে দুঃখ, কষ্ট থাকা অসম্ভব। প্রেমে দুঃখ নাই, কিন্তু কিরূপ সুখ আছে, তাহার আলো- চনা করাও আমাদের কর্তব্য। সুখ কাহাকে বলি, হৃদয় ও মনের সম্পূর্ণ শাস্তির নামই সুখ। নিদ্রিত হইলে আমাদের কোনই জ্ঞান থাকে না, সম্পূর্ণ সুষুপ্তি অবস্থায় যে, আমরা কি অবস্থায় থাকি তাহা আমরা বুঝিতে পারি না, তবে আমরা এই মাত্র বুঝি যে, আমরা সুখে ছিলাম। ইহাতেই স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, সম্পূর্ণ শাস্তির নামই সুখ। শরীরের যেরূপ সুযুাপ্ত হয়, মনের এবং হৃদয়েরও ঠিক সেইরূপ সুষুপ্তি হয়,—হৃদয়ের সেই সুষুপ্তির নামই সুখ আর সেই সুখ কেবল প্রেম সাধনার দ্বারাই প্রাপ্ত হওয়া সম্ভৰ।

সংসারে স্বর্গ সুখ

সংসার কার্য্য ক্ষেত্র, এ পৃথিবীতে কোন বস্তু বা কোন জীৰই বিনা কার্য্যে থাকিতে পারে না, সকলেই চলিতেছে; ঘুরিতেছে, কাজ করিতেছে;—এক মূহূর্ত্তের জন্যও কেহ স্থির থাকিতে পারে না। প্রকৃতির এই নিয়ম,—এ নিয়মের কেহই ব্যতিক্রম করিতে পারে না। কি শরীর, কি মন, কি হৃদয় সকলেই কার্য্যে তৎপর, সকলেই কাজ করিতেছে,–এই কার্যা এবং এই কার্য্য হইতে হৃদয় ও মনের শত সহস্র প্রকার আলো- ড়ন বিলোড়ন,—ইহা হইতেই সংসারের দুঃখের উৎপত্তি হয়। এই কার্য্য তৎপরতায় দুঃখের উৎপত্তি না হইলেও সংসারে মানব সুখবোধ করিতে পারে না। সুখলাভ হইলেও সে সুখ বোধ হয় না। যখন এই কাৰ্য্য হইতে মানব বিশ্রাম পায়, তখনই তাহার সুখবোধ হয়। শরীরের বিশ্রাম নিদ্রায়, মন ও হৃদয় কিসে বিশ্রাম লাভ করিতে পারে তাহাই দেখা যাউক। সংসারে সেই বিশ্রামই সুখ, আর সেই অবস্থাকেই সংসারে স্বর্গ- সুখ লাভ বলা যাইতে পারে। মনের কার্য্য চিন্তা ও ইচ্ছা, মন কিছু না ভাবিয়া বা না ইচ্ছা করিয়া কখনও থাকিতে পারে না। হৃদয়ের কার্য্য ভালবাসা, — হৃদয় কাহাকে ভাল না বাসিয়া থাকিতে পারে না।

যদি মন ও হৃদয়ের এতদ্ব্যতীত অন্য কাৰ্য্য না থাকে, তাহা হইলে এই দুই কার্য্যের শাস্তিসাধন করিতে পারিলেই মনের ও হৃদয়ের শাস্তিসাধন করা হইল; তাহা হইলে মন ও হৃদয় উভয়ই বিশ্ৰামলাভ করিল। যে হৃদয়ের ভালবাসার কথা আমরা বলিয়াছি, সেই ভাল- বাসার পূর্ণ বিকাশ হৃদয়ে হইলে ভালবাসার জন্য আর আকু- লতা থাকে না। হৃদয়ের কার্য্য তাহা হইলে শেষ হইয়া গিয় বিশ্রামের সময় আইসে। যদি হৃদয়ের ভালবাসার অভাব সম্পূর্ণ মিটিয়া গেল, তবে কি জন্তু আর হৃদয়, ভালবাসা, ভালবাসা করিবে? তাহা হইলে আর হৃদয়ের কোন কাৰ্য্যই থাকিল না। হৃদয় সুষুপ্তিলাভ করিল। আবার মন সম্বন্ধেও ঠিক এইরূপ। যদি হৃদয় প্রেমময় হইয়া যায়, তাহা হইলে এ জীবনের সকল ইচ্ছা পূর্ণ হইল, তাহা হইলে আর কোন ইচ্ছাই থাকে না, তাহা হইলে মনের ইচ্ছার ও সুষুপ্তিলাভ হয়, আর ভাবনা? কাহার ভাবনা ভাবিব? সকলেই দেখিয়াছেন, হৃদয়ে প্রেমের রাজ্য বিস্তৃত হইলে প্রণয়িণীর ভাবনা ভিন্ন মনে আর মা। যদি প্রণয়িণীর কোন ভাবনাই থাকে হৃদয়ে ভালবাসা জন্মিল, তবে আর কাহার ভাবনা ভাবিব। তাহা হইলে ভাবনারও শাস্তি হইল। প্রেমে হৃদয়ের ও মনের সম্পূর্ণ সুষুপ্তিলাভ ঘটে। এ সংসারে সুষুপ্তিতেই সুখ। আর মানব হৃদয়ও, মনের সেই সুযুপ্তির অবস্থা লাভ করিতে পারিলেই সংসারে স্বর্গ সুখ উপলব্ধি করে।

পরকালে অনন্ত সুখ

আমরা এক্ষণে যে বিষয়ের আলোচনা করিতে যাইতেছি, এ বিষয়টী কঠিন ও চিত্তাসাপেক্ষ বিষয়। সকলেরই বিশেষ অনুসন্ধান করিয়া পাঠ মানুষ প্রয়োজন। মাত্রেই পর কালের সুখের আশা করিয়া থাকে। পরকালের সুখের প্রত্যাশায়ই অনেক লোক কুকাজ হইতে বিরত থাকে। পাপের দণ্ড ও পুণ্যের পুরস্কার পাইতে হইবে, ইহাই অনেকের বিশ্বাস। এই পরকালের জন্যই মনুষ্য সমাজে ধর্ম্মের প্রচার ও আলোচনা। এই জন্তই ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন ধৰ্ম্ম প্রচলিত। পরকাল তো কেহ কখনও দেখে নাই। পরকাল আছে কি নাই, কিসে পরকালে সুখলাভ হইবে, এ সকল কথা কেই নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারেন না। কেহ বলেন, জীবনে কর্ম্মর ফল ফলে। যে যেমন কর্ম্ম করে সে তেমনই ফল পায় ৷ যে পুণ্যোপার্জ্জন করে সে, স্বর্গে গমন করে, আর যে পাপে মগ্ন থাকে সে নরকস্থ হয়। সুতরাং তাহারা সৎকর্ম্মাচ- রণের পরামর্শ দেন। আবার কেহ কেহ বলেন, ভক্তিতেই মুক্তিলাভ হয়,—অর্থাৎ ঈশ্বরকে ভালবাসিলে সেই ভালবাসার বলে মানবের আর জন্ম মৃত্যু হয় না। মানব ঈশ্বরে লয় পাইয়া যায়,—আবার কেহ কেহ বলেন যে, যোগসাধনার দ্বারা মানবাত্মাকে সম্পূর্ণতার অবস্থায় আনয়ন করিলে, পরমাত্মার সহিত তাহার সন্মিলন হইয়া মুক্তিলাভ হয়।

এইরূপ ভিন্ন ভিন্ন মত ভিন্ন ভিন্ন লোক সমাজের মধ্যে প্রচলিত,— কোনটী ঠিক কোনটী অঠিক, তাহা স্থির করা যায় না। কিন্তু একটী বিষয়ে সকলেই একমত। মন শরীর তাহা এই,—হৃদয় ইত্যাদি সমস্তের প্রকৃত ও সম্পূর্ণ সুষুপ্তির নামই সুখ, . আর সুখের পূর্ণ উৎস স্বয়ং ভগবান এবং তিনি পূর্ণ ব্রহ্ম, সর্ব্ব বিষয়ে সৰ্ব্বভাবে সম্পূর্ণতাময়। যদি এই কয়টী বিষয়ে কাহারও মতভেদ না থাকে, তবে আমরা বলি প্রেমই মুক্তি লাভের একমাত্র উপায়। অন্য প্রেম নহে,—স্ত্রী পুরুষের প্রেম, যে প্রেমের কথা আমরা এই পুস্তকে বলিতেছি, সেই প্রেমই মানবের মুক্তি লাভের এক মাত্র উপায়। এতদ্ব্যতীত আর অন্য উপায় নাই।আমরা জানি একথা শুনিয়া অনেকেই আশ্চৰ্য্যান্বিত হই- রেন, ধৰ্ম্মভাবাপন্ন ভগণ মনে মনে হাসিবেন,—কিন্তু পরকালে অনন্ত সুখ। আমরা সংঙ্খেপে আমাদের কথা প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিতেছি। আমরা বলিতেছি সুষুপ্তির নামই সুখ, আমরা ইহাও বলিতেছি স্বয়ং ভগবানই সেই সুষুপ্তির মূলাধার। আমরা আরও বলিতেছি ভগবানে সন্মিলন না হইলে আমাদের মুক্তি হয় না বা স্বর্গ লাভ ঘটে না। যদি ইহা হয়, তবে আমাদের বলিতে হইতেছে যে, ভগবানে সন্মিলিত হওয়াই আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। ভগবান পূর্ণব্রহ্ম,—তাহাতে অস- ম্পূর্ণতা নাই। কোন অসম্পূর্ণতাময় কখনও পরমব্রহ্ম ময় হইতে পারে না। জলের সহিত জল মিলিয়া যাইতে পারে বায়ুর সহিত বায়ুই মিলিয়া যায়। জলের সহিত বায়ু কখনই মিশিতে পারে না,—সেইরূপ অসম্পূর্ণ ব্রহ্মের সহিত পূর্ণ ব্রহ্ম কখনই একেবারে সন্মিলিত হইতে পারে না, কারণ ইহা সম্পূর্ণ অসম্ভব কাৰ্য্য। পূর্ণ ব্রহ্মের সহিত সন্মিলিত হইলে মানবকেও পূর্ণতা প্রাপ্ত হইতে হইবে। মানুষের পক্ষে এরূপ সম্পূর্ণতা প্রচণ্ড হওয়া সহজ কাৰ্য নহে, ইহা বোধ হয়, সকলেই বুঝিতে পারেন। কিন্তু ধর্ম্মের দ্বারা ও যোগের দ্বারা কি হয়, আর কি না হয়, সেকথা আমরা, বলিতেছি না। আমরা এই পর্যন্ত জানি যে, যাহা আছে তাহাই সম্ভবমত সম্পূর্ণতা লাভ করিতে পারে, যাহা একেবারেই নাই তাহা কিরূপে আবার সম্পূর্ণ হইবে। একটু দয়া যদি হৃদয়ে থাকে, প্রকাশই থাকুক বা অপ্রকাশই থাকুক, উৎকর্ষ সাধন হইয়া উহার সম্পূর্ণতা জন্মিতে পারে, কিন্তু “যাহার হৃদয়ে দয়া একেবারেই নাই, তাহার হৃদয়ে দয়া সম্পূর্ণতা পাইবে কিরূপে? এখন দেখা যাউক মানব- হৃদয়ে বিধাতার যাহা মাছে, তাহার সমস্ত আছে কি না।
কেহ বলিবেন আছে, কেহ বলিবেন নাই। কেহ বলিবেন মানবহৃদয়ে ঐশ্বরিক বৃত্তি সকল অপ্রকাশিত ভাবে বিরাজ করে,—পরিচালনা দ্বারা ইহাদের উৎকর্ষসাধন হইতে পারে, এবং ধর্ম্মাচরণে ও যোগাভ্যাসে ইহাদের সম্পূর্ণতা হয় ৷ আবার কেহ বলিবেন,—একথা সম্পূর্ণ ভুল, ঐশ্বরিক বৃত্তি সকল এমন আছে, যাহার বিষয় আমরা ভাবিতে পারি না, বা ধারণা করিতে পারি না। শেষের মত অধিক সম্ভবপর হইলেও আমরা তর্কের স্থলে পূর্ব্বের মত স্বীকার করিয়া লইলাম। আমরা স্বীকার করিলাম যে, মানব হৃদয়ে গুপ্ত- ভাবেই হউক আর প্রকাশ্যভাবেই হউক, ঐশ্বরিক বৃত্তি সকল আছে। এই জন্যই মানবের পক্ষে সম্পূর্ণতা লাভ করিয়া পূর্ণব্রহ্মের সহিত সন্মিলিত হইয়া মুক্তি লাভ সম্ভব। কিন্তু এক্ষণে জিজ্ঞাস্য, – এ সম্পূর্ণতা লাভ কিসে হয়? আমরা স্পষ্টই দেখিতে পাই, পুরুষ হৃদয়ে কতকগুলি বৃত্তি আছে, যাহা স্ত্রী জাতির হৃদয়ে নাই। আবার স্ত্রী হৃদয়ে এমন অনেক বৃত্তি আছে যাহা পুরুষ হৃদয়ে নাই। মানব হৃদয়ে সমস্ত ঐশ্বরিক ^ বৃত্তি থাকা সম্ভব,—কিন্তু হৃদয়ে বা কেবল স্ত্রী হৃদয়ে যে, সকল তাহা আমরা কেবল পুরুষ ঐশ্বরিক বৃত্তিই আছে, কখনই বলিতে পারি না, কারণ আমরা চক্ষের উপর দেখিতেছি স্ত্রী হৃদয়ে যাহা আছে, পুরুষ হৃদয়ে তাহা নাই। তাহা হইলে কেবল পুরুষ বা কেবল স্ত্রী সম্পূর্ণতা লাভ করিতে কখনই পারে না। . হয়তো অনেকে বলিবেন পুরুষ হৃদয়েও তদ্ব্যতীত আর কিছুই নাই। তাহাই আছে তবে যে আমরা স্ত্রী পুরুষের প্রভেদ দেখিতে পাই, সে কোন সামাজিক শিক্ষার দোষ্ণ পরকালে অনন্ত সুখ ৷  তাঁহারা বলিবেন স্ত্রীলোককে বাল্যকাল হইতে পুরু- যেয় ন্যায় শিক্ষা দেও, স্ত্রীলোক ও সৰ্ব্বতোভাবে পুরুষের ন্যায় হইবে।

তখন আর স্ত্রী পুরুষে শরীর গত, মন বা হৃদয় গত কোন প্রভেদই থাকিবে না এ কথাও আমরা স্বীকার করিয়া লইলাম। কিন্তু স্ত্রী জাতিতে একটু. স্ত্রীজাতির বিশেষত্ব আছে একথা বোধ হয়, কেহই অস্বীকার করিতে পারিবেন না। স্ত্রী পুরুষ নহে, এ কথা স্থির,—এবং স্ত্রীর “স্ত্রীত্ব” এবং পুরুষের “পুরুষত্ব” ইহা সকলকেই স্বীকার করিতে হইবে। তাহা যদি পুরুষে “স্ত্রীত্ব” নাই একথা সকলকেই বলিতে হইবে। হয়, তবে পুরুষ সম্পূর্ণতা লাভ করিবে কিরূপে? যত দিন না পুরুষে “স্ত্রীত্ব” জন্মে ততদিন তাহার কখনই সম্পূর্ণতা, জন্মে না। হর কিছুই নহেন,—গৌরিও কিছুই নহেন, হর- গৌরিই ত্রিসংসারের সৃষ্টি স্থিতি পালনকর্তা। নহেন প্রকৃতি প্রকৃতিও কিছুই নহেন। পুরুষ কিছুই পুরুষের সন্মিলনেই এ ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি। “স্ত্রীত্ব” “ও “পুরুষত্ব” এক না হইলে যে সম্পূর্ণতা জন্মে না, তাহা হিন্দু শাস্ত্রের প্রতি ছত্রে মানবের কারণ ছত্রে লিখিত। “স্ত্রীত্ব” ও “সম্পূর্ণতাই” যদি ৰুক্তি হয়, তবে “পুরুষত্বের” সন্মিলন প্রথম আবশ্যক, — তাহা না হইলে মানব অন্য কোন প্রকারেই সম্পূর্ণতা লাভ করিতে পারে না । পরকালের সুখ ও ভবিষ্যতের মুক্তির জন্য প্রথম স্ত্রীআত্মা ও পুরুষাত্মাকে এক করিতে হইবে, পরে ঐ দুই করিতে বৃত্তির উৎকর্ষ সাধন করিয়া পূর্ণতা লাভ মানবের চরম উদ্দেশ্য। স্ত্রী আত্মা উপায় কি? আমরা এই পুস্তকে ও আত্মাস্থ সমস্ত হইবে, ইহাই পুরুষাত্মায় এক হইবার স্পষ্টই দেখাইয়াছি,—প্রেমই এক মাত্র উপায় ।

প্রেম ভিন্ন স্ত্রীপুরুষ এক হইতে পারে না। কি প্রথায় প্রেম অবশেষে হৃদয়ে হৃদয়ে হইয়া দুইটী হৃদয়শো এক করিয়া ফেলে তাহাও আমরা দেখাইয়াছি। তাহ। হইে ধর্ম্মাচরণ ইত্যাদি আবশ্যক হইলেও প্রেম সৰ্ব্বাপেক্ষা অধিক প্রয়োজন ও আবশ্যক। প্রেমোপার্জ্জন ভিন্ন মুক্তির আর অন্য পথ নাই। নাই। আমরা প্রেমোপার্জ্জন ভিন্ন স্বর্গলাভের আর কোন উপায় ইহাও দেখাইয়াছি যে, প্রেম একেবারে কখনই হৃদয় অবলম্বন করিয়া জন্মিতে পারে না। শরীর অবলম্বন কবিগ ও কামনা প্রবৃত্তিকে ভর করিয়া প্রেম প্রথম জন্মে, তৎপত্ত স্তরে স্তরে উৎকর্ষতা লাভ করিয়া ক্রমে ক্রমে হৃদয়ে আইসে,- অবশেষে দুইটী হৃদয়কে একেবারে এক করিয়া ফেলে। ঈশ্ব- রের অসীম মহিমা ! তাঁহার অনন্ত করুণা! যে অত্যাশ্চৰ্য কামনা প্রবৃত্তি মানব হৃদয়ে ন্যস্ত করিয়া তিনি মানব জাতির অস্তিত্ব রক্ষা করিয়াছেন, আবার সেই লালসা প্রবৃত্তি হইতে মানব হৃদয়ে প্রেম জন্মাইয়া তাহাদের মুক্তির উপায় ও স্বর্গ লাভের পথ ‘করিয়া দিয়াছেন। মানবের যে ব্লত্তি হইলে জন্ম হইতেছে, আবার সেইবৃত্তি হইতেই মুক্তি হইতেছে ! পিতঃ, করুণাময় দেখিয়া মুগ্ধ হইয়া আশীর্ব্বাদ পতিতপাবন,তোমার সৃষ্টি কৌশ তোমাকে কোটী কোটী বার প্রণাম করি,– করুন, যেন প্রেম লাভ করিয়া এ সংসারে ক্বতা হইতে পারি।