তুমি কে হে বাপু
……মেছােনির পেটে আপনি জন্মালেও বাবা তাে আপনার ব্রাহ্মণ, দোর্দণ্ডপ্রতাপী ঋষি পরাশর আপনার বাবা। মা যা-ই হােন, পিতৃকুলের বিচারে আপনি নাকি ব্রাহ্মণ!’
‘তা কী করে হয়! ভারতবর্ষে পিতার চেয়ে মায়ের মর্যাদা বেশি। মাকেই স্বর্গপ্রাপ্তির আধার হিসেবে সম্বােধন করা হয়। মায়ের স্থান পিতার চেয়েও অনেক উঁচুতে।’ বলতে বলতে উদাস হয়ে গেলেন ব্যাসদেব। তখন মা মৎস্যগন্ধার কথা মনে পড়ে গেল তাঁর।
উপরিচরবসু নামের এক রাজার কামের ফসল তার মা। স্ত্রীকে প্রাসাদে রেখে মৃগয়ায় গিয়েছিলেন তিনি। অরণ্যমধ্যেই কামাসক্ত হন। তিনি সংযমী পুরুষ ছিলেন না। বীর্য স্খলিত হলাে তাঁর। তিনি যে বীর্যবান পুরুষ, স্ত্রীর কাছে তার তাে প্রমাণ দেওয়া দরকার! অতঃপর বাজপাখির পায়ে বীর্যধারক পত্র বেঁধে রাজধানীতে পাঠালেন। আকাশপথে আরেকটি বাজ পাখির আক্রমণে সেই বীর্য পতিত হলাে যমুনাজলে। ওই বীর্য ভক্ষণ করল বিশাল এক মৎস্যা। মাছের পেটেই বড় হতে থাকল শিশু। কালক্রমে জেলের জালে মাছটি ধরা পড়ল । পেট থেকে বের হলাে এক কন্যা আর এক পুত্র। সংবাদ পেয়ে রাজা উপরিচর পুত্রসন্তানটিকে প্রাসাদে নিয়ে গেলেন। কন্যাটি থেকে গেল জেলেটির ঘরে। কন্যাটির সারা গায়ে মাছের গন্ধ, তাই তার নাম হলাে মৎস্যগন্ধা। ধীবররাজের ঘরে বড় হতে লাগল কন্যাটি। কালাে কিন্তু অসাধারণ সুন্দরী মৎস্যগন্ধা। বিবাহযােগ্য হয়ে উঠল ধীরে ধীরে। কিন্তু এই মেয়েকে বিয়ে করবে কে? ওর শরীর থেকে যে বিদঘুটে মাছের গন্ধ বেরােয়! চিন্তিত হলেন দাশরাজা। বাড়ির পাশেই যমুনানদী, সেখানে লোেকপারাপারের ঘাট। কত মুনিঋষির যাতায়াত ওই খেয়াঘাট দিয়ে! খেয়া পারাপার করানাের জন্য সেই ঘাটেই পাঠালেন তিনি মৎস্যগন্ধাকে। তৃপ্ত হয়ে কোনাে ঋষি যদি আশীর্বাদ করেন, কন্যাটির শরীর থেকে মাছের গন্ধ দূর হতেই পারে।
অনেকদিন পর সেই আশীর্বাদের বিকেলটি এলাে। সন্ধ্যা হয় হয় সময়ে পরাশর মুনি এলেন খেয়া পার হতে। ওই বিকেলে তিনি একাই যাত্রী ছিলেন। কূল থেকে একটু দূরে গেলে মুনির নজর পড়ল মৎস্যগন্ধার সজীব দেহের ওপর। মৎস্যগন্ধা আপনমনে নৌকা বাইছে আর আনমনে তার দিকে তাকিয়ে আছেন পরাশর । শ্মশ্রুধারী শীর্ণদেহী মুনির মনে তীব্রভাবে রিরংসা জাগল। এবং যমুনার মধ্যিখানে অনেকটা জোর করে উপগত হলেন তিনি মৎস্যগন্ধার সঙ্গে। ওপারে উঠে যাবার সময় অবশ্য তিনি আশীর্বাদ করে গেলেন—আজ হতে তােমার শরীর থেকে মাছের গন্ধ উধাও হয়ে যাবে। পুষ্পগন্ধী হবে তুমি।
অনেকটা আপন মনে আবার বলতে শুরু করলেন ব্যাসদেব, ঋষি পরাশর ব্রাহ্মণ, মানি। কিন্তু মা তাে আমার জেলেনি! মাছের পেটে জন্মেছেন, জেলের ঘরে লালিতপালিত হয়েছেন। সেই মায়ের গর্ভে জন্মানাে আমি কী করে ব্রাহ্মণ হই? মায়ের পরিচয়েই তাে আমার পরিচয়! জেলেনির সন্তান বলে পরিচয় দিতে পেরে আমার গর্বের কি শেষ আছে?
অদ্বৈত মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “মুনিবর পরাশরের সঙ্গে আপনার আর সাক্ষাৎ হয়নি?’
“হয়েছে।’ উদাস গলা ব্যাসদেবের।
‘ক্ষণিক রমণেচ্ছায় উত্তেজিত হয়ে একজন পূতপবিত্র কুমারীকে যে তিনি রমণ করলেন, তার জন্য কি তাঁর মধ্যে কোনাে বিবেক যন্ত্রণা জাগেনি? জিজ্ঞেস করেননি আপনি? উত্তেজিত গলায় বললেন অদ্বৈত।…
কুন্তীর বস্ত্রহরণ
……‘বস্ত্রহরণে যদি দ্রৌপদী লজ্জা পায়, নারীকুল যদি অপমানিত অয়—তবে তার সকল দায় ওই যুধিষ্ঠিরের, ওই পুরুষজাতির উপর বর্তায় সমস্ত দায়। এই আমার শেষ কথা।’ শ্লেষ মেশানাে গলায় বলে উঠল কুন্তী।
অপ্রস্তুত হয়ে অজয় মণ্ডল সবার দিকে তাকিয়ে থাকল। তার কিছু বলতে ইচ্ছে করল না। কী বলবে অজয় মণ্ডল? এতজন সভাষদ, যেখানে ভীষ্ম-ধৃতরাষ্ট্রের মতন মানুষেরা উপস্থিত আছেন, উপস্থিত আছেন দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামী, তাঁদের সামনে দ্রৌপদীকে বিবস্ত্র করা হচ্ছে, একজন পুরুষও জ্বলে উঠলেন না! জনসমক্ষে একজন রাজবধূর এতবড় অপমানে কেউ প্রতিবাদ করলেন না! কেউ তাকিয়ে থাকলেন, কেউ-বা থাকলেন। অধােবদনে! ওই কুরুসভায় প্রকৃতপক্ষে নারীজাতির অপমান হয়নি, হয়েছে। তাে পুরুষজাতির! দ্রৌপদীর নগ্ন বক্ষ, উদোম শরীর দেখার ইচ্ছে কি তাহলে সকল সভাজনের মনে জেগেছিল? নইলে নির্বাক থাকলেন কেন সকলে? কুন্তী সত্যি বলেছে—দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সকল দায় পুরুষজাতির।……
……ফখরে কাছে গেলে কুন্তী দূরে সরে যেতে চাইল। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারল না। শহীদুল এসে জুটল ফখরে আলমের সঙ্গে। শহীদুল একটানে কুন্তীর শাড়ি খুলে ফেলল।
কুন্তীর পরনে শুধু পেটিকোট আর ব্লাউজ। কুন্তীর নিতম্বে হাত দিল শহীদুল।
এইসময় কোথেকে লাঠি হাতে দৌড়ে এলাে শান্তনু। ফখরে আলম এক বাড়িতে শুইয়ে দিল শান্তনুকে।
শহীদুল ততক্ষণে কুন্তীর পেটিকোটের ফিতে ধরে টান দিয়েছে। গিট খুলে গেছে। কুন্তীর পেটিকোট খুলে নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছে। কুন্তী চোখ বন্ধ করল। তার গলা চিরে বেরিয়ে এলাে, “ভগবান রে…।’ শ্মশানের পাশ দিয়ে বহমান ভৈরব নদে ঝাপিয়ে পড়ল কুন্তী।……
ব্যর্থ কাম
……এখন থেকে খাবেদাবে আর আমাকে দেখবে।
‘মানে!’
‘বুড়াে খােকা, বুঝছ না কী বলছি?’ বুকের আঁচলটা আলগা করে সুদেষ্ণা বলেছিলেন।
এতক্ষণে বুঝতে পেরেছিলেন বউয়ের কথার মানে। চেয়ার ছেড়ে সুদেষ্ণাকে পেছন থেকে জাপটে ধরেছিলেন।
সুদেষ্ণা গলায় রস ছড়িয়ে বলেছিলেন, ‘পেছনে কেন, সামনে জড়াও।’
সেদিন থেকে ধরণী-সুদেষ্ণার দাম্পত্যজীবনের চেহারাটাই পাল্টে গিয়েছিল। জড়াজড়ি, চুমােচুমি, ভালােবাসাবাসি।
পাল্টাবেও না কেন? সুদেষ্ণা তাে আর দেখতে মলয়া-স্বপ্ন-রত্নার মতাে নারী নন! আধুনিক কালের মানুষেরা খাসা বা বিন্দাস শব্দ যেজন্য ব্যবহার করে, সুদেষ্ণা ছিলেন সেরকমই। ছিলেন বলছি কেন, এই তিপ্পান্ন বছর বয়সেও তার দিক থেকে চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না। একবার তাকানাের পর ঘুরে আরেকবার তাকাতে ইচ্ছে করে। পাঁচ ফুট সাড়ে চারের সুদেষ্ণা। কালাে নন। আবার ফরসা বললে উপহাস বােঝাবে। কালাে আর গৌরবর্ণের মাঝামাঝি গায়ের রং। কোমর ছাড়ানাে চুল। এই তিপ্পান্নতেও একটা চুল পাকেনি। তবে আগে যেরকম ঝাঁকড়া ছিল, এখন সেরকম নেই। চুল একটু পাতলা হয়ে এসেছে এই যা। শরীরের গাঁথুনি ভালাে। স্তনযুগল এখনও ঈর্ষণীয়ভাবে পুরুষ্টু, উন্নত।
সুদেষ্ণার শরীর নিয়ে ধরণীবাবুর দিন কাটে, রাত কাটে। সুদেষ্ণাও ধরণীবাবুকে উসকান। একে তাে খালি ফ্ল্যাট, তার ওপর সুদেষ্ণার লােভনীয় শরীর! রসেবশে কাটতে থাকে ধরণীবাবুর জীবন।…..
…..সস্ত্রীক বনে চলে গেলেন পাণ্ডু। অরণ্যবাসের একদিন পাণ্ডু মৃগয়ায় গেলেন। বধ করলেন এক হরিণীকে। হরিণ মূর্তি ধারণ করলেন। কিমিন্দম মুনি হরিণরূপ ধারণ করে বনের হরিণীকে সংগম করছিলেন। মানুষীতে অরুচি ধরে গিয়েছিল বােধহয় ঋষি কিমিমের! তাই তাঁর হরিণীতে উপগত হওয়া। পাণ্ডু তাে আর মুনির বিচিত্র-বিদঘুটে রুচির কথা জানেন না! ক্ষত্রিয়ের ধর্ম মৃগয়া। সেই ধর্মই পালন করেছেন পাণ্ডু।
কিন্তু সংগমে ব্যর্থ মুনি পাণ্ডুকে অভিশাপ দিয়ে বসলেন, “হে পাণ্ডু, তুমি স্ত্রীতে উপগত হতে পারবে না আর কোনােদিন। তােমার বাসনা জাগবে স্ত্রীসংগমের কিন্তু ওই ইচ্ছের বশবর্তী হয়ে স্ত্রীসংগমে রত হলে তােমার মৃত্যু হবে। এই আমার অভিশাপ।’
‘ক্ষত্রিয়ের ধর্ম মৃগয়া, আপনি যে হরিণরূপ ধারণ করে মানবেতর প্রাণীতে কামের পরিতৃপ্তি ঘটাচ্ছেন, তা তাে আমার জানার কথা নয়! আপনি আপনার অভিশাপ ফিরিয়ে নিন মুনিবর।’ এরকম নানা যুক্তি দেখিয়ে ক্ষমা চাইলেন পাণ্ডু কিমিন্দম মুনির কাছে।
কিন্তু মুনির এককথা—আজ থেকে তুমি অভিশপ্ত পাণ্ডু। কোনাে নারীতে উপগত হয়েছ তাে মরেছ!
অরণ্যগৃহে ফিরে প্রিয়তমা স্ত্রী কুন্তীকেই শুধু অভিশাপের কথাটা বললেন। কুন্তী নিজে সাবধান হলেন, মাদ্রীকেও সাবধান করলেন।
পাণ্ডু স্ত্রীকে পাশে নিয়ে আদর করেন, উপগত হবার প্রস্তুতিপর্ব সমাপন করেন। কিন্তু স্ত্রীসংগমের চরম তৃপ্তি লাভ করতে পারেন না। কিমিমের অভিশাপের কথা তার মনে পড়ে যায়। ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যান তিনি। সংগমেচ্ছা নিমিষেই উধাও হয়ে যায় তাঁর মন থেকে। শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে। বিব্রতাপন্ন মন নিয়ে পাশ ফিরে শােন পাণ্ডু। স্ত্রীরা অস্বস্তিময় শরীর নিয়ে শয্যা থেকে উঠে যান।
সেদিন শ্যামাকালী মন্দিরের বক্ততা শেষে বাড়ি ফিরে ‘মহাভারত’ নিয়ে বসেন ধরণীবাবু। পুনরায় পড়তে থাকেন পাণ্ডু-কুন্তী-মাদ্রীর অংশটি। এই কাহিনি পড়তে পড়তে নিজের মধ্যে একধরনের অস্বস্তি অনুভব করতে থাকেন ধরণীপ্রসাদ চক্রবর্তী।
গত মাসছয়েক ধরে তিনিও যেন পাণ্ডুর মতন হয়ে গেছেন। তবে পাণ্ডু আর তাঁর মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। পাণ্ডুর মধ্যে উত্তেজনা আছে, কিন্তু স্ত্রীসংগমে অভিশপ্ত। ধরণীবাবুকে কেউ অভিশাপ দেয়নি, তারপরও ইদানীং তিনি সুদেষ্ণাসংগমে ব্যর্থ। সুদেষ্ণা পাশে শুয়ে থাকেন, শরীরের কাপড়চোপড় আলুথালু করে রাখেন। যে স্তনযুগলে তিনি বিয়ে-পরবর্তী দিন থেকে আসক্ত, সেই পুরুষ্ট স্তন দুটো এখন আর তাঁকে আকুল করে না। তাঁর সকল শারীরিক উত্তেজনা মরে গেছে যেন! আগে সময়ে অসময়ে সুদেষ্ণার শরীর নিয়ে খেলা করতেন ধরণীপ্রসাদ, এখন মােটেই ইচ্ছে করে না এসব করতে। ভেতরের সকল কাম সমাধিপ্রাপ্ত হয়ে গেছে যেন!
একদিন লজ্জা ত্যাগ করে সুদেষ্ণা জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে তােমার! আমার দিকে তাকাও না যে, আগের মতাে!’
‘পারি না।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর ধরণীবাবুর। ‘মানে! অবাক চোখে মৃদু কণ্ঠে বলেন সুদেষ্ণা।
‘এখনও তােমাকে আগের মতাে পেতে ভীষণ ইচ্ছে করে আমার। কিন্তু নেওয়ার যে শক্তি, তা আমার ফুরিয়ে গেছে! আমি পাণ্ডুর মতাে অভিশপ্ত নই, কিন্তু কী এক অলক্ষিত দৈব-অভিশাপে আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে রে সুদেষ্ণা!’ বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন ধরণীপ্রসাদ চক্রবর্তী।……
দূর দিগন্তে অন্ধকার
……বিশাল উদ্যান। কী নেই এই উদ্যানে? পারিজাত থেকে সকল ধরনের ফুল, নানা জাতের বৃক্ষ, ঝরনা, উদ্যানের মাঝখান দিয়ে বাঁকা-সােজা হাঁটাপথ, বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বৃক্ষছায়ায় মনােরম বাঁধানাে আসন, খােলা বাগানে অলসভাবে সময় কাটানাের নরম ঘাসবিছানাে স্থান- সবই আছে এই স্বর্গউদ্যানে। এই উদ্যানে খ্যাত-অখ্যাতরা বিকেলটা কাটান। ইন্দ্র, অর্জুন, একলব্য, কচ, উর্বশী, কর্ণ, কংস, কুন্তী, গঙ্গা, গান্ধারী, দময়ন্তী, দুর্যোধন, সীতা, মন্দোদরী, দ্রৌপদী, বিভীষণ, বালী, তারা, মনসা, মহাদেব, বাল্মীকি, ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র- এঁরা সবাই ওই স্বর্গ-উদ্যানে ঘুরে বেড়ান। কেউ লাঠিতে ভর দিয়ে টুক টুক করে হাঁটেন, কেউ-বা একস্থানে দাড়িয়ে ব্যায়ামের নানারকম কসরত করেন।
আজ উদ্যানটা জমে উঠেছে। নারদ বীণা বাজিয়ে পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন। চোখ খােলা তাঁর। যদি কারও সঙ্গে কারও ঝগড়াটা লাগিয়ে দেওয়া যায়! অন্যদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি করতে না পারলে তিনি যে সুখ পান না! কোনাে রূপসীকে মনে লাগে কিনা, খুঁজে ফিরছেন ইন্দ্র। মনসা সর্পহাতে মহাদেবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। স্বর্গে এসে নতুন একধরনের সর্পের সন্ধান পেয়েছেন তিনি। মহাদেবকে তা না দেখিয়ে যে স্বস্তি নেই মনসার! ধৃতরাষ্ট্র কুম্ভকর্ণের সঙ্গে মল্লযুদ্ধে মেতেছেন।
ওই, একটু ওদিকে বৃত্তাকার একটা জটলা দেখা যাচ্ছে। কাছে গিয়ে বােঝা গেল, নারীরা কানামাছি খেলছেন। চারদিকে সীতা, তারা, মন্দোদরী, রাধা, দময়ন্তী আর মাঝখানে চোখবাঁধা যুধিষ্ঠির। সীতার ওড়না দিয়ে যুধিষ্ঠিরের দু’চোখ বেঁধে দেওয়া হয়েছে। যুধিষ্ঠির দু’হাত প্রসারিত করে নারীদের কোনাে একজনকে ধরতে চাইছেন। কিন্তু নারীদের ছোঁয়া কি অত সহজ! তারা এই ধরা দেন তাে এই দূরে চলে যান! সীতাদের হাতে পড়ে যুধিষ্ঠিরের নাস্তানাবুদ হবার উপক্রম। কিন্তু যুধিষ্ঠিরকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি মােটেই বিরক্ত নন, বরং উল্লসিত, উদ্বেলিত। যে দ্রৌপদীনিষ্ঠ যুধিষ্ঠির, সেই যুধিষ্ঠির আজ পরনারী সংস্পর্শে আনন্দে আকুল। খেলার একপর্যায়ে যুধিষ্ঠির সীতাকে ধরে ফেলেন। ধরেই বুকের একেবারে গভীরে টেনে নেন।
ওই সময় পাশ দিয়ে রামচন্দ্র যাচ্ছিলেন। এই দৃশ্য দেখে তার ভেতরটা রি রি করে উঠল। তিনি উচ্চ কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘ছিঃ ছিঃ, ছিঃ!’
চট করে চোখের বাঁধন খুলে ফেললেন যুধিষ্ঠির। অবাক চোখে রামচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
তৎক্ষণাৎ রামের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন সীতা। তাঁর চোখেমুখে ঘৃণা আর ক্রোধের মেশামেশি। সীতা নিজেকে সংযত করতে চাইলেন। ভাবলেন, স্বর্গে তাে কারও মনে ক্রোধ বা ঘৃণার উদ্রেক হবার কথা নয়! তাহলে রামের জন্য তার মনে ক্রোধ-ঘৃণার ঝড় কেন? ভেবে কূল পান না সীতা!
রামকে উদ্দেশ করে জিজ্ঞেস করেন, এই ছিঃ ছিঃ কেন? কার জন্য?
‘এই ধিক্কার তােমার জন্য। পরপুরুষের সঙ্গে ঢলাঢলি করতে লজ্জা করছে না তােমার? রামের কণ্ঠস্বর উন্মায় ভরা।
হি হি করে হেসে উঠলেন সীতা। বললেন, ‘পরপুরুষ! এখানে পরপুরুষ দেখলে কোথায় তুমি! এখানে তাে সবাই আপনপুরুষ। সবাই সবার এখানে!’
‘মানে! অবাক চোখে বলেন রাম।
সীতা বলেন, ‘ওই দেখ, দ্রৌপদী কংসের গায়ে ঢলে পড়তে পড়তে হেসে কুটিকুটি। আর তােমার প্রিয়তম ভাই লক্ষ্মণকে দেখ, স্ত্রী উর্মিলাকে বাদ দিয়ে শূর্পণখাকে বুকে জড়িয়ে কোন দিকে যাচ্ছে! আরও দেখবে, দেখ ভীষ্মমাতা চিরযৌবনা গঙ্গা ব্যাধপুত্র একলব্যের সঙ্গে কী করছেন! ওঁদের দেখে তােমার বিশ্বাস হচ্ছে না এই বুৈকষ্ঠে কেউ কারও একার নন?……