পেয়িং গেস্ট – হাসান চৌধুরী

›› সম্পুর্ণ গল্প  

মানুষের জীবনে ভালোবাসা আসে। কতবার আসে? মানুষ নাকি অসংখ্যবার প্রেমে পড়ে ।
নিতান্ত সাধারণ এক মানুষ আমি। আমার জীবনেও প্রেম এসেছিল এবং চলেও গেছে। যখন মানুষ একটু বয়স্ক হয় তখন নাকি বাস্তববাদী হয়। এই বয়সে প্রেমিক হতে পারে না। কিন্তু আমি হয়েছিলাম। সেই গল্পটি আপনাদের আজ বলব।
স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে আমার সংসার। স্ত্রী বিয়ের পর থেকেই অসুস্থ । তাই বিয়ে- পরবর্তী প্রেমটি তেমন হয়ে ওঠেনি। ঢাকায় আমার নিজের বাড়ি। তিন তলা বাড়ির দোতলা একটা ইউনিটে আমরা থাকতাম। বাকিগুলো ভাড়া দেওয়া ছিল। বড় ছেলে এইচএসসি পাস করে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে বিদেশ চলে গেলে আরো নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লাম। এ জন্য ঘরটিও খালি খালি লাগছিল। স্ত্রীর পরামর্শে ওই খালি ঘরে পেয়িং গেস্ট হিসেবে কাউকে ভাড়া দিতে চাইল স্ত্রী । প্রথমে অবশ্য আমি রাজি ছিলাম না। কিন্তু স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে রাজি হলাম। বেশ কয়েকজনকে বলে রাখলাম।
আমাদের পরিবারে পেয়িং গেস্ট হিসেবে এল সাথী। বরিশালের মেয়ে। একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। আগে মহিলা হস্টেলে ছিল। কিন্তু ওই মহিলা হস্টেলের মালিক তেমন ভালো ছিল না। তাই পেয়িং গেস্ট হিসেবে আমাদের পরিবারে এসেছিল ।
বয়স বিশ-বাইশ। আমার ছেলের বয়সী। সুন্দর চেহারা। মায়াভরা চোখ আমার স্ত্রী তাকে দারুণভাবে গ্রহণ করল ও সন্ধ্যার দিকে আমার স্ত্রীকে রান্নার কাজে সাহায্য করত। অবশ্য আমি ব্যবসার কাজে এবং সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার জন্য তাদের প্রতি মনোযোগ দিতে পারতাম না এভাবেই চলছিল সময় ।
সাথী আমাকে আংকেল বলে ডাকত আর আমার স্ত্রীকে ডাকত খালাম্মা বলে। আমার ক্লাস সিক্সে পড়া ছেলেটিকে পড়ত ও। আমি বাসায় ফিরলে আমার বেডরুমে বসতাম। টিভিরুমে ওর টিভি দেখত, গল্প করত অথবা রুমে পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকত।
এর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা গাঢ় হয় আমার স্ত্রীর অসুস্থতার ঘটনায়। আমার স্ত্রী হঠাৎ করে বেশি অসুস্থ হয়ে যায়। হসপিটালে ভর্তি হতে হয়। এই সময় হসপিটাল টু বাসা বেশ সময় দিত সাথী। আমিও সারা দিন হসপিটালে পড়ে থাকতাম। এভাবে সপ্তাহ খানেক পেরিয়ে গেল। স্ত্রীর অবস্থার উন্নতি হলে আমি একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বাসায় এলাম । হসপিটালে তখন ওর ছোট বোন সময় দিত ।
এক সন্ধ্যায় বাসায় বসে টিভি দেখছিলাম। সাথী এল। আমার পাশে বসে টিভি দেখছিল। সৌজন্যবশত তার কুশল জিজ্ঞাসা করলাম। অনেক আলাপ হলো। তার পরিবার, তার কথা, আমার কথা। সমসাময়িক বিষয়। অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করলাম। ওর গল্প করার ধরন, ওর আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধ করল। এভাবেই শুরু ।
প্রতিদিন ওর সঙ্গে গভীর রাত পর্যন্ত গল্প করতাম। আমার চল্লিশোর্ধ্ব জীবনে যেন কথা বলার মানুষ খুজে পেলাম। আমার নিঃসঙ্গতা যেন তাকে ছুয়ে গেল। ওর চোখেও যেন কেমন আহ্বান দেখতে পেলাম। নৈতিকতা-অনৈতিকতা নিয়ে অনেক ভাবলাম। আর কথা বলব না ভাবলাম। কিন্তু অদ্ভূত এক নেশার চাপে গল্প করতাম। হঠাৎ ঘটে গেল এক দুর্ঘটনা। কিংবা আমার অচেতন মন হয়তো এটাই চেয়েছিল।
দিন দশেক পরে সাথী আর আমি কথার নেশায় সময় পার করছিলাম। কখন যেন সাথী আমার কাধে মাথা রাখল। আমি ওর চুলে হাত বোলাচ্ছিলাম। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। অদ্ভুত এক আকর্ষণে আমি পরাজিত হলাম। গভীর রাতের নির্জনতা আমাদের এক করে দিল। সব শেষে আমি পরাজিত মানুষের মতো কাদলাম। সাথীও কাদল। কিন্তু এটাই শেষ নয়। কথার নেশা থেকে দেহের নেশাও পেয়ে বসল ।
হসপিটালে যাওয়ার সময় দুজন এক সাথে যেতাম। মেয়েরা সম্ভবত কোনো জিনিস অদ্ভুতভাবে আচ করতে পারে। তাই আমাদের গতিবিধি দেখেই হয়তো স্ত্রী নিজ গরজে হসপিটাল থেকে রিলিজ নিল । ডাক্তাররা চেষ্টা করেছিল আরো কয়েক কিন থেকে যাওয়ার জন্য। কিন্তু স্ত্রী কিছুতেই থাকবে না হয়তো সে বুঝে ছিল, তার সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হয়ে যে গেছে, সেটা কি বুঝে ছিল?
ও বাসায় ফেরার পর আমি আর সাথী আগের মতো কথা বলা ও প্রেম করতে পারতাম না। শেষে সাথীকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে বের হতাম ।
এক সময় ওকে একটি মোবাইল ফোন কিনে দিলাম। যাতে ওর খবর নিতে পারি। কিন্তু স্ত্রী কিছুতেই আমাকে বাসা থেকে বের হতে দিতে চাইত না। সাথী যখন বাসায় থাকত তখন বের হতে বলত। আমি এর কারণ বুঝতাম। এভাবে চলছিল গোপন প্ৰণয় ।
এক সময় সাথীর মধ্যেও দেখলাম পরিবর্তন। ওর চাহিদা বেড়ে গেল। প্রায়ই জামাকাপড় ও প্রসাধনী কিনে দেওয়ার বায়না করত। আমি তার ভালোবাসায় ব্যাকুল হয়ে সব দিয়ে যেতাম। বিনিময়ে মাঝেমধ্যে ছাদে কিংবা কোনো হোটেলে প্রেম চালিয়ে যেতাম। কিন্তু ওর আবেগ কেমন যেন কমে যাচ্ছিল।
একদিন রাতে স্ত্রী ঘুমিয়ে পড়লে ওর রুমের দিকে গেলাম। ওর রুম থেকে হাসির শব্দ পেলাম। দরজায় কান পেতে শুনলাম মোবাইলে কথা বলছে। প্রায় দুই ঘণ্টা দাড়িয়ে থাকলাম। তখনো কথা শেষ হয়নি। স্ত্রীর জেগে ওঠার ভয়ে রুমে ফিরে এলাম। সেদিন আর ঘুম এল না । সকালে দোকানে চলে এলাম। সাথীর ফোন পেলাম বারোটার দিকে।
কি ব্যাপার জান, ফোন করোনি কেন? অভিযোগ ওর।
আমি ব্যস্ততার ভান করে ফোন কেটে দিলাম । এক ঘণ্টার পর আবারও ফোন । কান্নাকাটি। অবশেষে আমি হার মানলাম। ওর সঙ্গে দেখা করলম। বিনিময়ে দিলাম ওর সেমিস্টার ফি।
পরের রাতেও একই ঘটনা। আমি না পারছিলাম কিছু বলতে, না পারছিলাম সইতে ।
এভাবে প্রতি রাতে মোবাইলে ওদের কথা চলত। এক সময় ওকে জিজ্ঞাসা করলাম। ও সহজে উত্তর দিল, বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে ।
একদিন স্ত্রীকে নিয়ে হসপিটালে চেকআপ করাতে গেলাম। খালি বাসায় শুধু সাথী ছিল। কিন্তু রিপোর্ট বাসায় ফেলে আসায় স্ত্রীকে রেখে আমি রাসায় এলাম। এসে দেখলাম সাথীর রুম বন্ধ । ভেতরে ফিশফাশ আওয়াজ। বুকটা আতকে উঠল। অসহ্য হয়ে দরজা নক করলাম । অনেকক্ষণ নক করার পর সাথী
বের হলো, পেছনে দেখলাম এক তরুণ।
ওকে চড় মারলাম। ছেলেটি চলে গেল । ওকে বেশ্যা বলে গাল দিলাম। ও খেপে গেল। বলল, আমি কি তোমার বউ?
তুমি আমাকে ভোগ করো। এর বেশি কি?
বললাম, মানে?
মানে আমার স্বাধীনতায় হাত দেবে না। নষ্টামি মানে কি স্বাধীনতা?
ও আমার বয়ফ্রেন্ড। আমি অবাক হলাম। অনেক কষ্টে বললাম, তাহলে আমি কি?
পেয়িং গেস্ট। ওর সহজ উত্তর। মানে?
মানে আমি তোমার বাসায় থাকি টাকার বিনিময়ে। আমার একটি ভালো বাসার দরকার ছিল। বাসার জন্য মাসে মাসে আমি পে করি। আমি একজন পেয়িং গেস্ট ।
আর তোমার দরকার ছিল ভালোবাসার। সেটা আমি দিয়েছি। বিনিময়ে তুমি আমাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে পে করেছ। তাই তুমিও আমার কাছে পেয়িং গেস্ট।
আমি সেদিনই স্ত্রীকে বললাম, মেয়েটি ভালো না। স্ত্রী দিগুণ উৎসাহে তার নিন্দা করল এবং তাকে রুম ছাড়ার জন্য বলে দিল।
ও নির্ধারিত তারিখের আগেই চলে গেল। আমি তার দিকে তাকিয়েও দেখলাম না।
ও তো বুঝল না, ভালোবাসা পে করে হয় না। সত্যিকারের ভালোবাসা দিয়েই যায়। স্ত্রী পণ্য নয়। আমি আর পেয়িং গেস্ট হিসেবে কাউকে এলাও করিনি। আমি এখন স্ত্রীকে ভালোবেসে তার ভালোবাসায় বন্দি থাকি ।

Please follow and like us: