রােজ সকালে ও বিকালে সুমেরু পর্বতের সানুদেশে বেতসীবনের ফাক দিয়ে লাল আলাে ছড়িয়ে পড়ে যখন ঠিক তখনি একসঙ্গে অনেকগুলি নুপুরের ধ্বনি শােনা যায়। আর সঙ্গে সঙ্গে মন্দমন্থর পুষ্পগন্ধবিহুল বাতাসের নিস্তরঙ্গ বুকে সহসা তরঙ্গায়িত হয়ে ওঠে মদমত্ত হংসকাকলির মতাে এক ঝাক দুরন্ত হাসির কলরােল।
সকালে ওরা আসে ফুল তুলতে। ওরা বলে পুলস্ত্য মুনির আশ্রমে যত রকমের ফুল পাওয়া যায় এত রকমের এবং এত রং-বেরঙের ফুল আর কোথাও পাওয়া যায় না।
বিকালেও ওরা আসে ফুল তুলতে। কিন্তু সে ফুল পূজার জন্য নয়। সে ফুল তুলে নিয়ে গিয়ে ওরা নানারকমের ভূষণ তৈরি করে পরে।
বিকালে আসবার সময় ওরা সরােবরে বেশ কিছুক্ষণ ধরে জলকেলি করে স্নান সেরে আসে। তারপর ইচ্ছামত ফুল তুলে নিয়ে বাড়িতে গিয়ে ভূষণ তৈরি করে ও কেশবিন্যাস করার পর সেগুলিকে বিভিন্ন অঙ্গে পরে।
দেখতে দেখতে যখন সন্ধ্যা হয়ে আসে, তখন ওরা কালাগুরু ধূপবাসিত এক একখানি সূক্ষ্ম বসন পরে লাক্ষা ও প্রিয়পরাগে চর্চিত করে আপন আপন দেহ। তারপর সন্ধ্যার মৃদু প্রদীপালােকে এক একটি উজ্জ্বল মুকুরে আপন মুখশােভা প্রতিফলিত দেখে বিমােহিত হয়ে। ওঠে নিজেরাই। আপন দেহসৌরভে মত্ত হয়ে ওঠে আপনা আপনি।
ওরা সকলেই আশ্রম বালিকা। পাশাপাশি আশ্রমে থাকে। কিন্তু পুলস্ত্য মুনি ও তার আশ্রম সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশি কৌতুহল ওদের মধ্যে শুধু একজনের। শুধু একজনের তাগিদেই ওরা রােজ দুবার করে আসে পুলস্ত্য মুনির আশ্রমে। শুধু আসে না, বা ফুল তুলেই ক্ষান্ত হয় না—ওদের উচ্ছসিত কনক কাঞ্চীগুন ও আশিঞ্জিত নূপুর চরণক্ষেপের দ্বারা ধ্যানমগ্ন মুনির তপস্যাকার্যে বিঘ্ন ঘটায়।
দিনে দিনে বিরক্তি বােধ করেন মুনি। কিন্তু কোনাে বিরক্তি বা ক্রোধকে বাইরে প্রকাশ করা তার স্বভাব নয়। আশ্রম বালিকার এই অশােভন আচরণে যত বিরক্তিই তিনি অনুভব করুন কেন, এক সতিক্ত অথচ শান্ত অবহেলায় উপেক্ষা করে যেতে হয় সব কিছুকে।
পুলস্ত্য মুনি ও তার আশ্রম সম্বন্ধে সবচেয়ে যার বেশি কৌতুহল, অবশেষে তার সঙ্গে দেখা হলাে পুলস্ত্য মুনির। সে হচ্ছে মহর্ষি তৃণবিন্দুর কন্যা স্বয়ংবরা।
মহর্ষি তৃণবিন্দুকে চিনতেন পুলস্ত্য মুনি। কিন্তু তার কন্যাকে দেখেননি কখনো। তাই দেখে চিনতে পারেননি। চিনতে পারলেও সেদিন স্বয়ংবরাকে দেখে অসম্ভব রকমের বিস্মিত না হয়ে পারতেন না পুলস্ত্য মুনি। একথা ভেবে নিশ্চয়ই আশ্চর্যবােধ করতেন তিনি, মহর্ষি তৃণবিন্দু কত শান্ত প্রকৃতির মানুষ। অথচ এতখানি চপল ও চঞ্চল হয়ে উঠল স্বয়ংবরা কেমন করে।
সেদিন স্বয়ংবরা আশ্রমে এসেছিলেন সম্পূর্ণ একা। এসেছিলেন অসময়ে। বেলা তখন দ্বিপ্রহর। কিছুক্ষণের জন্য যােগ বিরতির পর কাষ্ঠ প্রস্তুত করছিলেন পুলস্ত্য মুনি।
এমন সময় ছায়াঘন বেতসীবনের ফাক দিয়ে ভেসে উঠল ইন্দুকান্তি এক উজ্জ্বল নারীমুখ। এক গভীর অথচ নীরব কৌতূহলে উজ্জ্বল সেই মুখখানি এক উচ্ছল ও লাস্যবিলােল হাসিতে মুখর হয়ে উঠল সহসা। চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকালেন পুলস্ত্য মুনি। কিন্তু কে তা চিনতে পারলেন না। শুধু দেখলেন হাস্যমুখর এক অনুঢ়া যুবতী।
মনে মনে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন পুলস্ত্য মুনি। কিন্তু বাইরে সে ক্রোধ প্রকাশ করতে পারলেন না। ধ্যানমৌন এক ঋষির আশ্রমে কি কারণে এক হাস্যমুখর চপলমতি যুবতীর এই অকারণ অনধিকার প্রবেশ কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না।
মনে মনে বিরক্ত হয়ে উঠলেও মুখে কিছুই বললেন না পুলস্ত্য মুনি। শুধু একবার স্বয়ংবরার প্রতি রােষগম্ভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পরক্ষণেই মুখ ফিরিয়ে আপন মনে কাজ করে যেতে লাগলেন।
স্বয়ংবরা নিজেও ঠিক জানেন না। প্রায়প্রৌঢ় তপােশান্ত পুলস্ত্য মুনির প্রতি তার যুবতী হৃদয়ের কেন এই অসংযত উদ্দাম কৌতূহল তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেননি আজও। তিনি বুঝে উঠতে পারেনি, সে কৌতুহল যখন জাগে, শত চেষ্টাতেও কেন সংযত বা দমন করতে পারেন না সে কৌতূহলকে।
সকাল হতে রাত্রি পর্যন্ত সব সময়ই পুলস্ত্য মুনির কথা মনে পড়ে স্বয়ংবরার। প্রতি পলে অনুপলে অনিবারণীয় কৌতূহলের উচ্ছলতা অনুভব করেন রক্তের মধ্যে।
শুধু স্বয়ংবরা নয়, তার সখীরাও বুঝতে পারে না, যে পুলস্ত্য মুনি ফুলের রূপ রস গন্ধ বর্ণ সম্বন্ধে চির উদাসীনতার আশ্রমে কেন এত বিচিত্র ফুল ফোটে। যে পুলস্ত্য মুনি প্রাণায়ামের মাধ্যমে বায়ুকে বহুক্ষণ বন্দী করে রাখেন দেহের অভ্যন্তরে, তার আশ্রমে বাতাস কেন খেলা করতে আসে বেতসীবনেব সঙ্গে। যিনি নারী-সৌন্দর্যকে তার সাধনার ঘাের পরিপন্থী বলে মনে করেন তার কাছে স্বয়ংবরার মতাে সুন্দরী নারী কেন ছুটে যায়।
বুঝতে না পারলেও এ নিয়ে কেউ বেশি মাথা ঘামায় না স্বয়ংবরার মতাে।
আর পাঁচজনে রহস্যকে রহস্য হিসাবেই সহজভাবে মেনে নেয়। স্বয়ংবরার মতাে সে বহস্যকে বিশ্লেষণ করবার জন্য ব্যগ্র হয়ে ওঠে না কেউ এমনভাবে।
সকালে উঠে হাতমুখ প্রক্ষালন করে সখীদের সঙ্গে ফুল তুলতে বেরােন স্বয়ংবরা। কিন্তু। অন্যান্য সখীরা যখন ফুল তুলতে থাকে একমনে স্বয়ংবরা তখন ভাবেন পুলস্ত্য মুনির কথা।
তার কেবলি মনে হয়, চারিদিকে এত ফুল, এত ফল, এত বর্ণ ও গন্ধের সমারােহ ; তবু কেন পুলস্ত্য মুনি একবারও চেয়ে দেখবেন না সেদিকে।
মধ্যাহ্নকালে মনে হয় স্থিরােজ্জ্বল তাম্রাভ সূর্যকিরণের পাশে কেমন লজ্জাবতী মেয়ের মতাে বেতসীবনের গাঢ় সবুজ ছায়া কাঁপছে এক সুমধুর চঞ্চলতায়। তবু তা একবার দেখবেন না পুলস্ত্য মুনি।
অপরাহে যখন অস্তগত সূর্যের গায়ে রক্তপদ্মের রং লাগে এবং সেই রঙের রক্তিম আভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠে আকাশের প্রান্তভাগগুলি তখন তার মনে হয়, কেন একবার উপরের দিকে মুখ তুলে তা চেয়ে দেখেন না পুলস্ত্য মুনি।
সন্ধ্যার প্রাক্কালে অঙ্গরাগ ও কেশবিন্যাসের পর লাক্ষারসরক্তিমায় ললাটপটকে উজ্জ্বল করে মৃদু প্রদীপালােকের সামনে বসে একটি অম্লান মুকুরের মধ্যে নিজের উচ্ছলিত দেহসৌন্দর্যকে যখন প্রতিফলিত দেখেন স্বয়ংবরা, তখন তার মনে হয়, একবার যদি সপ্রশংস ও বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে সে সৌন্দর্য চেয়ে দেখতেন পুলস্ত্য মুনি, তাহলে মনে বড় শান্তি পেতেন তিনি।
শুক্লপক্ষ রজনীতে সরসীজলসিক্ত ও কৈরবসারসৌরভে সুবাসিত মন্দ সমীরণকে আলিঙ্গন করে যখন চন্দ্রের স্বচ্ছশীতল ময়খমালা, নিবিড় প্রেমােলাসে চারিদিকে ঢলে পড়ে; তখন স্বয়ংবরার মনে হয়, কেন একবার সে দৃশ্য দেখে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে না পুলস্ত্য মুনির মন।
আবার অন্ধকার কৃষ্ণপক্ষে অজস্র নক্ষত্রালােকে তৃপ্ত না হয়ে সূর্যের বিরহে শিশিরাবর্ষিনী হয় যখন রজনী, তখন বাতাসের মধ্যে একবার কান পেতে সে রজনীর কোন দীর্ঘশ্বাস শুনতে চান না পুলস্ত্য মুনি।
পুলস্ত্য মুনির উপর অত্যন্ত রাগ হয় স্বয়ংবরার। মনে হয়, পুলস্ত্য মুনির হৃদয় বলে কোনাে জিনিস নেই। আর থাকলেও তা পাষাণ দিয়ে গড়া। যােগনিরত নিশ্চল দেহের অভ্যন্তরে প্রাণ হয়ত একটা আছে। কিন্তু অবিরাম তপস্যার প্রভাবে সে প্রাণ নিয়ত তপ্ত ও জ্বালাময়।
ছােট থেকেই স্বয়ংবরা বড় চঞ্চল প্রকৃতির এবং সুখবাদী। কোনাে আত্মনিগ্রহকে কখনাে পছন্দ করেন না তিনি। তিনি চান সব সময় সখীদের সঙ্গে হ প্রমােদেব মধ্য দিয়ে জীবনটাকে কাটিয়ে দিতে।
তাই পুলস্ত্য মুনিকে দেখলেই সর্বাঙ্গ জ্বলে যায় স্বয়ংববার।
আবার সখীদের সঙ্গে গিযেও মন ভবে না। একা একা যেতে ইচ্ছা করে।
মাঝে মাঝে অদ্ভুত ধরনের একটা অসংযত খেয়াল চাপে স্বয়ংববার মনে। ভাবেন একবার একা একা গিয়ে ধ্যানভঙ্গ করে দেবেন পুলস্ত্য মুনিব। চীৎকার কবে বিঘ্ন ঘটাবেন সমাধিতে। কলসপূর্ণ জল নিয়ে গিয়ে নিবিয়ে দেবেন তার যজ্ঞাগ্নি। শুধু একবাব নয় বারবাব গিয়ে এমনি কবে শেষ কবে দেবেন তার তপস্বীজীবনের।
তিনি হয়ত শুদ্ধ হয়ে শাপ দেবেন! তবু সে শাপকে ভয় কবেন না স্বয়ংবরা। কারণ মুনি যদি ক্রুদ্ধ হয়ে শাপ দেন তাহলে তার শুধু একার ক্ষতি হবে না, নিবও এত দিনে ৩পস্যালব্ধ সব ফল বিনষ্ট হবে।
একদিন মাত্র একা গিয়েছিলেন এর আগে। এবার থেকে প্রতিদিন একা একাই যাওযার স্থির করলেন।
তাই অন্যায্য সখীদের আর পুলস্ত্য মুনিব আশ্রমে যেতে নিষেধ করে দিলেন। বললেন, কেন পুলস্ত্য মুনিব আশ্রম ছাড়া আর কি কোথাও ফুল নেই ? তােমরা কি কোনাে দিন লক্ষ্য কর নি আমরা গেলে মুনি বিরক্তি বোধ করেন? জগতে কি আর কোনাে কুসুকানন নেই যে ক্রোধপরায়ণ মনুষ্যবিদ্বেষী কোনাে মুনিব রােষকটাক ও তীব্র বিবক্তিকে সহ্য কবে দিনের পর দিন ফুল ভিক্ষা করতে যেতে হবে তার কাছে? স্বয়ংবরার কথা শুনে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল সখীরা সকলে।
একবাক্যে তারা সকলে বলল, আমরা তো এতদিন সেখানে তােমার কথাতেই গিয়েছি সখী। এ ছাড়া সেখানে যাবার আমাদেব তাে অন্য কোনাে প্রয়ােজন ছিল না। পৃথিবীতে অনেক মুনি আছে। একা পুলস্ত্য মুনির সম্বন্ধে আমাদের কোনাে বিশেষ কৌতূহল নেই।
স্বয়ংববা বললেন, মুনি হয়তাে অনেক আছে। কিন্তু ভুলে যেও না, তিনি পিতামহ ব্রহ্মার পুত্র, আমার তাে মনে হয় এই জন্ম-গৌরবে তিনি গর্ব অনুভব করেন বলেই মানুষকে এতদূর অবহেলা করেন।
সখীদের নীরব থাকতে দেখে স্বয়ংবরা আরও বললেন, কিন্তু তা বােঝা উচিত তুচ্ছ মানুষ হলেও আমরাও বিধাতার সৃষ্টি। সকল সৃষ্টিরই সমান মর্যাদা আছে। স্রষ্টার সাধনায় কিভােব হয়ে সৃষ্টিকে এমনভাবে অবজ্ঞা ও অবহেলা করা উচিত নয়।
সখীরা একবাক্যে প্রতিবাদ করল স্বয়ংবরার কথায়। বলল, এ আমাদের অনধিকার সমালােচনা সখী। বৃথা ও অর্থহীন তােমার এ ক্ষোভ। সকল মানুষের মত ও পথ কখনাে সমান হতে পারে না। জীবনে তিনি সাধনার যে পথ বেছে নিয়েছেন তা আমাদের মনঃপূত না হতে পারে কিন্তু তাই বলে তাঁর অসাক্ষাতে তার সমালােচনা করবার কোনাে অধিকার নেই। যদি কিছু বলার থাকে তা তার সমক্ষেই বলা উচিত। লজ্জায় চুপ হয়ে গেলেন স্বয়ংবরা।
আজকাল সখীদের সাহচর্য এড়িয়ে চলেন স্বয়ংবরা। একমাত্র অপরাহ্নে একবার করে সরােবরে জলকেলি করতে যাওয়া ছাড়া সখীদের সঙ্গে আর মেশেন না।
কিন্তু ঈষৎ বায়ুতাড়িত বীচিবিক্ষুব্ধ সরােবরের বুকের মতই কেমন যেন অশান্ত আলােড়নে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে স্বয়ংবরার বুকের ভিতরটা। সরসীজলের এই পদ্মগন্ধী শীতলতা কোনােমতে শান্ত করতে পারে না তার সেই গােপন পরাজয়ের মর্মজ্বালাকে।
স্বয়ংবরার শুধু মনে হয় তিনি হেরে গেছেন তার সখীদের কাছে। হেরে গেছেন পুলস্ত্য মুনির কাছে।
সুযােগ খুঁজতে থাকেন স্বয়ংবরা। সুযােগ খুঁজতে থাকেন শুধু একটি নির্জন মুহূর্তের, যখন তিনি একা একা পুলস্ত্য মুনির আশ্রমে গিয়ে চরিতার্থ করতে পারবেন তার সেই অদ্ভুত অসঙ্গত কৌতুহলকে। লণ্ডভণ্ড করে দেবেন তার যজ্ঞভূমি। এক নির্মম অবহেলার দ্বারা স্বয়ংবরার মতাে রূপসী যুবতীর সৌন্দর্য-সম্পদকে অগ্রাহ্য ও অবজ্ঞা করার জন্য সমুচিত শাস্তি দেবেন পুলস্ত্য মুনিকে।
পুলস্ত্য মুনির কাছে কিন্তু কিছুই চান না স্বয়ংবরা। অন্য কিছুই নয়। হলেই বা তিনি অনাসক্ত সাধক, নাই বা হলেন তিনি রূপে মােহমুগ্ধ, শুধু একবার এক সহজ মমতাস্নিগ্ধ দৃষ্টিতে স্বয়ংবরাকে কিছুক্ষণ স্থিরভাবে চেয়ে দেখলে কী এমন ক্ষতি হতাে তার সাধনকার্যের!
অবশেষে একদিন সুযােগ মিলল স্বয়ংবরার। শান্তমন্থর কোনাে এক নিদাঘদুপুরে স্বয়ংবরা পেলেন তার বহুবাঞ্ছিত সেই অবকাশ। সেদিন কার্যব্যপদেশে স্থানান্তরে গিয়েছিলেন মহর্ষি তৃণবিন্দু।
সরস ও শীতল চন্দনে সারা দেহ চর্চিত করে পথে বেরিয়ে পড়লেন স্বয়ংবরা। পথের দুপাশে দেখলেন প্রখর নিদাঘতাপে অতিমৃদুল শিরীষ ও পাটলী কুসুম ম্লান হয়ে অকালে ঝরে পড়েছে বৃন্ত হতে। নিদাঘসূর্যের দুঃসহ রৌদ্রতাপে সন্তপ্ত হয়ে পড়েছে সমগ্র ধরিত্রী।
স্বয়ংবরা গিয়ে প্রথমে আশ্রমে প্রবেশ করলেন না। অতি সন্তর্পণে বেতসীবনের এধারে দাঁড়িয়ে গাছের ফাক দিয়ে দেখতে লাগলেন।
দেখলেন প্রচণ্ড সৌরীনলনিহিত আকাশতলে প্রজ্বলিত হােমাগ্নির সামনে অটল অচল হয়ে বসে রয়েছেন ধ্যানমগ্ন পুলস্ত্য মুনি। প্রাণবায়ুকে এমনভাবে ধারণ করে আছেন যে নিশ্বাস পর্যন্ত বার হচ্ছে না।
আশ্চর্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন স্বয়ংবরা।
এই জগতে ও জীবনের চারিদিকে গতি ও চঞ্চলতার স্রোত বয়ে চলেছে যখন অনুক্ষণ তখন এমনি করে একটি মানুষ সেই স্রোতের বহু ঊর্ধ্বে আত্মার পদ্মাসন পেতে সমস্ত প্রাণ মনকে সংহত করে স্তব্ধ হয়ে থাকবে এমনি করে—এ তিনি কিছুতেই হতে দেবেন না।
দৃঢ়সংকল্প হয়ে উঠলেন স্বয়ংবরা। কিছুক্ষণ পর উঠে জ্বলন্ত হােমানলে ঘৃতাহুতি দিতে লাগলেন পুলস্ত্য মুনি আর সঙ্গে সঙ্গে স্তব পাঠ করতে লাগলেন উদাত্তস্বরে।
সত্য সত্যই হাসি পায়নি। এ সময় হাসি পাবার কথা নয়। তবু খুব জোরে হেসে উঠলেন স্বয়ংবরা। তার সেই কর্কশ কৃত্রিম হাসির চটুল উচ্ছ্বাস পুলস্ত্য মুনির বেদমন্ত্রধবনিকে ছাপিয়ে উচ্চৈঃস্বরে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠতে লাগল নির্জন নিস্তব্ধ আশ্রম প্রদেশে।
প্রথমে হাসিটা কানে গেলেও কোনাে চেতনার সৃষ্টি করতে পাবেনি তার মধ্যে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর শুনতে পেয়েই চারিদিকে তাকিয়ে সন্ধান করতে লাগলেন সেই হাসির উৎসদেশ। বনের মধ্যে লুকিয়ে পড়লেন স্বয়ংবরা। তাঁকে দেখতে পেলেন না পুলস্ত্য মুনি।
কিছু দেখতে না পেয়ে কাজে আবার মন দিতে যাবেন পুলস্ত্য মুনি এমন সময় আবার তেমনি জোরে হেসে উঠলেন স্বয়ংবরা।
এবার কিছুটা ক্রুদ্ধ হলেন পুলস্ত্য মুনি। বজ্রগর্জনে হুংকার করে উঠলেন, কে তুমি?
স্বয়ংবরা কিন্তু একেবারেই ভীত হলেন না পুলস্ত্য মুনির এই অগ্নিমূর্তি দেখে। হাসতে হাসতে এগিয়ে গিয়ে বললেন, আমি হেসেছি। আমার হাস্য আপনার কাজের তাে কোনাে ক্ষতি করেনি।
ক্রোধস্ফুরিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন পুলস্ত্য মুনি, কে তুমি স্বাধিকার প্রমত্তা বালিকা ? হাসতে হাসতে স্বয়ংবরা বললেন, আমাকে বালিকা বলে আমার গুরুত্বকে লঘু করে দেবার চেষ্টা করেছেন আপনি। আপনি স্পষ্টতঃই দেখতে পারচ্ছেন, অনূঢ়া হলেও আমি যুবতী।
পুলস্ত্য মুনি আশ্চর্য হয়ে গেলেন স্বয়ংবরার ধৃষ্টতায়। বললেন, তুমি যেই হও, কী প্রয়ােজন তােমার এখানে ?
স্বয়ংবরা বললেন, মানুষ সব সময় প্রয়ােজনের বশে চলে না মুনিবর। অধিকাংশ সময়ই সে চলে তার আপন খুশিতে। আপনি যেমন আপনার খুশিমতাে এই জপতপের কাজ বেছে নিয়েছেন আমিও তেমনি জগতে শত কাজ থাকতে ইচ্ছামতাে ঘুরে বেড়ানাের কাজ বেছে নিয়েছি। হাতে কোনাে গৃহকর্ম না থাকলেই পাহাড়ে প্রান্তরে বা বনপ্রদেশে ইচ্ছামতাে ঘুরে বেড়াই আমি। এতেই আমার আনন্দ! একজনের মত পথ আর পাঁচজনের মনঃপূত হবে এমন কোনাে কথা নেই। আপনার কর্ম যেমন আমি পছন্দ করি না, আমার কর্ম তেমনি আপনি পছন্দ নাও করতে পারেন।
পুলস্ত্য মুনি বললেন, তাবলে অপরের কর্মে বিঘ্ন সৃষ্টির কোনাে অধিকার নেই তােমার।
তাচ্ছিল্যভরে হেসে স্বয়ংবরা বললেন, একজনের স্বেচ্ছাকৃত কর্ম অপরের কর্মে ব্যাঘাত ঘটাবে এ তাে খুবই স্বাভাবিক কথা মনিবর।
বিস্ময়বিস্ফারিত দৃষ্টিতে স্বয়ংবরার দিকে একবার মুখ তুলে চাইলেন পুলস্ত্য মুনি। কিন্তু ক্রোধে কণ্ঠ রােধ হয়ে আসায় কোনাে কথা বলতে পারলেন না। বলবার কোন প্রবৃত্তিও ছিল।
তার। সামান্য একজন চপলমতি তরুণীর সঙ্গে তর্ক করতে ঘৃণা বােধ করছিলেন তিনি।
স্বয়ংবরা বললেন, এতে বিস্মিত হবার কোনাে কারণ নেই মুনিবর। আপনার মােক্ষ বা পরমার্থ লাভের জন্য আপনি যে যজ্ঞাগ্নি জ্বেলেছেন, ভেবে দেখেছেন কি একবার এখানকার বাতাসের সহজ গতিপথকে রুদ্ধ করেছে সে অগ্নি। এই যজ্ঞাগ্নির নিরন্তর তাপে সন্ত্রস্ত ও সন্তপ্ত হতে হতে ক্রমশ বিশুদ্ধ ও বিশীর্ণ হয়ে পড়ছে এখানকার চারিদিকের বৃক্ষলতা। এমন কি এই অগ্নির লেলিহান শিখা প্রতিমুহূর্তে প্রাণ সংহার করছে কত অদৃশ্য জীবকণার।
মনে মনে কিছুটা দমে গেলেন পুলস্ত্য মুনি। বাইরে কিন্তু কিছুমাত্র প্রকাশ করলেন না মনের সে দুর্বলতাকে।
সহসা ক্রোধে গর্জন করে উঠলেন পুলস্ত্য মুনি, স্তব্ধ হও? তােমার বাগাড়ম্বরপূর্ণ যুক্তির জাল বৃথা বিস্তার করছ। তাতে তােমারই ক্ষতি হবে।
স্বয়ংবরা আর সেখানে না দাঁড়িয়ে যাবার জন্য পিছন ফিরে দাঁড়ালেন। যাবার সময় বললেন, এখানে আসবার আমার বিশেষ কোনাে কারণ বা আকর্ষণ নেই। তবে যদি কোনােদিন ঘুরতে ঘুরতে স্বাভাবিকভাবে চলে আসি তবে তাতে ক্ষতি কি আপনার? বাগে কঁপতে লাগলেন পুলস্ত্য মুনি। বললেন, দূর হয়ে যাও তুমি এই মুহূর্তে।
স্বয়ংবরা বললেন, আপনি শুধু কামকেই দমন করেছেন, কিন্তু ক্রোধকে দমন করতে পারেন নি। ক্রোধেব মতে প্রচণ্ড এক রিপুকে অন্তরে পুষে রেখে কেমন করে আপনি সাধনায় সিদ্ধলাভ করবেন মুনিবর?
আবার গর্জন করে উঠলেন পুলস্ত্য মুনি, কোনাে কথা শুনতে চাই না তােমার। তুমি এই মূহুর্তে এ স্থান ত্যাগ কর।
তখনি সে স্থান ত্যাগ করলেন স্বয়ংবরা। তবু শাস্তি পেলেন না মনে। পুলস্ত্য মুনির প্রতি একটা দুর্বার আকর্ষণ অনুভব করতে লাগলেন অন্তরে। পুলস্ত্য মুনিকে পরাজিত করতে গিয়ে তিনি নিজেই যেন পরাজিত হয়েছেন। তঁাব ধ্যান ভঙ্গ করতে গিয়ে তার নিজের মনের ভারসাম্যই যে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
তার জীবন থেকে পুলস্ত্য মুনির জীবনটা সম্পূর্ণ বিপরীত। কোনাে দিক থেকেই কোনাে সাদৃশ্য নেই। তবু তার প্রতি কেন এই দুর্বার আকর্ষণ তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলেন না তিনি।
স্বয়ংবরাব মনে হলাে, এই বৈপরীত্যই হয়তাে সকল আকাণের উৎস। তিনি বুঝতে পাবলেন, সব সময় রূপগত ও গুণগত সমধর্মিতাই কাবাে প্রতি আমাদের প্রীতির কারণ হয় না। বিপরীতধর্মিত হতেও অনেক সময় সে প্রীতি সঞ্জাত হয়।
তার মধ্যে যে সব গুণ নেই পুলস্ত্য মুনির মধ্যে সে সব গুণ আছে। তিনি নিজে বড় চঞ্চল; পুলস্ত্য মুনি শান্ত ও স্থিতধী। তিনি চঞ্চলা চটুলা নদী; পুলস্ত্য মুনি শান্ত নিস্তবঙ্গ সমুদ্র। সুত্ব পুলস্ত্য মুনির প্রতি তাঁর এই আকর্ষণ একদিক দিয়ে খুবই স্বাভাবিক।
কয়েকটি দিন কোনােরকমে কাটালেন স্বয়ংবরা। তারপর আর থাকতে পারলেন না। একদিন বেলা দ্বিপ্রহর না হতেই বেরিয়ে পড়লেন পথে।
দাবানলের প্রচণ্ড প্রদাহে ঝলসিয়ে গেছে চারিদিকের মাঠের শস্যাঙ্কুর ও দূর্বামঞ্জরী। শুষ্ক ও ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে বৃক্ষরাজির সুশ্যাম পর্ণরাশি। প্রবল তৃষ্ণায় আর্ত হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে মৃগদল। নৃত্য ভুলে গিয়ে কলাপকুল স্তব্ধ হয়ে বসে আছে বৃক্ষশাখায়।
আশ্রমে গিয়ে আজ কিন্তু হাসলেন না স্বয়ংবরা। শুধু স্তব্ধ বিস্ময়ে স্থির হয়ে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন পুলস্ত্য মুনির দিকে।
স্বয়ংবরাব উপর তাঁর দৃষ্টি পড়তেই পুলস্ত্য ক্রোধে আগুন হয়ে উঠলেন আগের মতাে। বললেন, আমার নিষেধ বাক্য লঙঘন করে আবার এসেছ তুমি? এতবড় স্পর্ধা কোথা হতে হলাে তােমার ?
শান্ত কণ্ঠে স্বয়ংবরা বললেন, আজ আমি তাে আপনার কোনাে ক্ষতি করিনি মুনিবর।
কোনােরূপ শব্দ না করে স্থির হয়ে বসে আছে।
পুলস্ত্য মুনি কিন্তু কোনাে কথাই শুনতে চান না স্বয়ংবরার। তিনি বললেন, আমার এই আশ্রমে কোনাে নারীর উপস্থিত সম্পূর্ণরূপে অবাঞ্ছিত। আজও আমি তােমায় অভিশাপ দিতে গিয়ে কোনােরকমে সংবরণ করে নিলাম নিজেকে। এখনি চলে যাও। ভবিষ্যতে আর কোনােদিন এস না।
আর কোনাে কথা না বলে গম্ভীর হয়ে সেখানে থেকে চলে এলেন স্বয়ংবরা। চলে এলেন। কিন্তু মনটা পড়ে বইল পুলস্ত্য মুনির আশ্রমে।
পরদিন দ্বিপ্রহরে মহর্ষি তৃণবিন্দ স্নান করতে গেলে আবাব যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন স্বয়ংবরা। ভাবলেন আজ তাকে দেখে হয়তাে আর কিছুই বলবেন না পুলস্ত্য মুনি। ঘৃণা করারও একটা সীমা আছে। ঘৃণা করার সমস্ত শক্তি হয়তাে তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। এবার তাকে নিশ্চয়ই সহজভাবে মেনে নেবেন।
প্রতিদিন একবার করে আশ্রমে গিয়ে শুধু বসে থাকবেন স্বয়ংবরা। প্রয়ােজন হলে দু একটা কাজে সাহায্য করবেন পুলস্ত্য মুনিকে। এমনি করে একে একে সমস্ত বৈপরীত্যের স্তর ভেঙে দুটি অসম আত্মা পরস্পরের কাছে এসে এক নিবিড় অথচ সুগভীব সামীপ্য লাভ করবে। পথে বেরিয়ে পড়লেন সংববা। নিদাঘেব বৌদ্রতপ্ত নির্জন পথ। সমস্ত বৈপরীত্যকে আপন সত্তার মধ্যে শােষণ করে মিশিয়ে নেবার মধ্যে এক জয়ের গৌরব আছে। স্বয়ংবরা আজ সেই গৌরব লাভ করতে চান। এর বেশি কিছু নয়। পুলস্ত্য মুনিব পােকঠিন আত্মাকে আপন আত্মার প্রণয়ঘন বসে মিশিয়ে এক কবে পবম আত্মীয় কবে তুলবেন তাকে।
আশ্রমে প্রবেশ কবে নীরবে নিঃশব্দে ধীরে পায়ে ধ্যানমগ্ন পুলস্ত্য মুনির পানে এগিয়ে গেলেন স্বয়ংবরা। আজ তার আশা হতে লাগল, তার অন্তরের এই অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন নিশ্চয়ই নেত্রপথে পতিত হবে পুলস্ত্য মুনির।
তাঁকে দেখে বিস্ময়ে হয়তাে অবাক হয়ে উঠবেন পুলস্ত্য মুনি। হয়তো সস্নেহ দৃষ্টির নীরব স্নিগ্ধতা দিয়ে অভিনন্দন জানাবেন তাকে। ধ্যানে মগ্ন মুনির মুখপানে একদৃষ্টে চেয়ে অনেক কথা তখন ভাবছিলেন স্বয়ংবরা।
সহসা একবার চোখ মেলে চাইলেন পুলস্ত্য মুনি। চোখ খােলার সঙ্গে সঙ্গে সামনে স্বয়ংবরাকে দেখেই একবার চমকে উঠলেন শুধু। কিন্তু কোনাে কথা বললেন না। তারপর আবার গভীর ধ্যানে নিমীলিত হয়ে পড়ল সে চোখ।
পুলস্ত্য মুনিব চোখে চোখ পড়তেই স্বয়ংবরা অনুভব কবলেন, সহসা অগ্নিগর্ভ এক বিদ্যুৎ তরঙ্গ প্রবাহিত হয়ে গেল যেন তার সারা অংগের অভ্যন্তরে। প্রতিটি শিরা ও স্নায়ু কেঁপে উঠল সে তরঙ্গে আঘাতে ও উত্তাপে।
এক তীব্র অস্বস্তি অনুভব করতে লাগলেন স্বয়ংবরা সমগ্র দেহে মনে। অথচ অস্বস্তিটা যে প্রকৃতপক্ষে কি এবং দেহ বা মনের ঠিক কোন্ অংশ হতে উৎসারিত হচ্ছে, তা তিনি বুঝতে পারলেন না। তবে আশ্রমে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। তাই সেখানে আর কালবিলম্ব না করে বাড়ি ফিরলেন।
পথে যেতে যেতে দেহটা কেমন যেন ভার ভার বােধ করলেন স্বয়ংবরা। মনে হতে লাগল, সর্পিল ক্রুরতায় কি একটা বস্তু যেন তার দেহের ভিতরের সমস্ত নাড়ীগুলােকে পাক দিয়ে জড়িয়ে ধরে গ্রাস করতে চাইছে তার সত্তার শুচিতাকে।
বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে গর্ভলক্ষণ দেখতে পেয়ে চীৎকার করে উঠলেন মহর্ষি তৃণবিন্দু।
বিস্ময়ে ও বেদনায় হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন স্বয়ংবরা। প্রস্তরবৎ কঠিন হয়ে উঠল যেন তার দেহটা। চোখ দিয়ে এক ফোঁটা অশ্রু জল পর্যন্ত বেরােল না এত দুঃখে।
প্রথমে বুঝতে পারেননি। পরে একে একে বুঝতে পারলেন, তার দেহের নিম্নভাগ, নাভিদেশ ও জঘনদ্বয় স্ফীত হয়ে উঠেছে অস্বাভাবিকভাবে। স্তনমণ্ডল দুগ্ধপূর্ণ হয়ে উঠেছে এবং সামান্যতম চাপ পাবার সঙ্গে সঙ্গে দুগ্ধক্ষরণ হচ্ছে তার থেকে। স্তনবৃন্ত দুটি হয়ে উঠেছে ঘন কৃষ্ণবর্ণ।
মহর্ষি তৃণবিন্দু চীৎকার করে বললেন, অনুঢ়া কন্যা হয়ে তুই গর্ভবতী হলি! এমন নিষ্কলঙ্ক কুলে কালি দিয়ে কী সর্বনাশ করলি হতভাগী! কি হয়েছে যথাযথ সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণনা কর। দেখি যদি কোনাে উপায় থাকে। মিথ্যা ভাষণের দ্বারা নিজদোষ গােপন করবার যদি কোনােরূপ চেষ্টা করিস তাহলে জীবন্ত দগ্ধ করব তােকে।
এবার চোখ দুটি অশ্রুক্তি হয়ে পড়ল স্বয়ংবরার। কাঁদতে কাঁদতে লজ্জাবিকম্পিত হয়ে যা হয়েছিল সব বললেন ; কিন্তু কিভাবে এই আশ্চর্য কার্য সংঘটিত হলাে তা নিজেই বুঝতে পারলেন না।
তৃণবিন্দু কিছুটা বুঝতে পারলেন। পেরে বললেন, এই মুহূর্তে পুলস্ত্য মুনির কাছে যাচ্ছি। দেখি যদি কোনাে উপায় হয়।
সবকিছু শুনে আশ্চর্য হয়ে গেলেন পুলস্ত্য মুনি। বিস্মিত হয়ে বললেন, সেই চপলমতি প্রগলভা বালিকা তােমার কন্যা! তার অন্যায় কর্মের জন্য উপযুক্ত প্রতিফল আমি তাকে দান করেছি। বারবার জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও সে তার পরিচয় দান করেনি।
মহর্ষি তৃণবিন্দু বললেন, কিন্তু কিভাবে এবং কেন এলাে এখানে?
পুলস্ত্য মুনি বললেন, প্রথম প্রথম দলবেঁধে সকাল সন্ধ্যায় ফুল আহরণে আসত। তারপর ও একা একা এসে আমার তপস্যাকার্যে বিঘ্ন ঘটাতে লাগল প্রায়ই। আমি বারবার সতর্ক করে দিলাম। তবু ও বৃথা তর্ক করতে লাগল আমার সঙ্গে।
মহর্ষি তৃণবিন্দু আশ্চর্য হয়ে গেলেন স্বয়ংবরার ধৃষ্টতায়।
পুলস্ত্য মুনি বললেন, এতদিন ক্রোধ সংবরণ করেছিলাম। অবশেষে ধৈর্যচ্যুতি ঘটল একদিন। আমি অভিশাপ দিলাম, যে নারী তপস্যাকালে আমার দৃষ্টিপথে পতিত হবে সঙ্গে সঙ্গে গর্ভসঞ্চার হবে তার মধ্যে বিনা পুরুষসঙ্গমে।
পুলস্ত্য মুনির পা দুটোকে জড়িয়ে ধরলেন মহর্ষি তৃণবিন্দু। কাতরকণ্ঠে অনুনয় করে বললেন, যা হবার হয়ে গেছে। এবার যা হয় একটা উপায় করুন। আমার কন্যার কৃতকর্মের জন্য যে প্রায়শ্চিত্ত আপনি বিধান করবেন আমি তাই অবনত মস্তকে পালন করব। আপনি শুধু ওকে মুক্তি দিন। ওর শুভাশুভ সম্বন্ধে কোনাে জ্ঞান নেই। পরিণাম না জেনেই দুর্মতিবশে এই হীন কাজ ও করে ফেলেছে। আপনি ওকে ক্ষমা করুন।
পুলস্ত্যমুনি বললেন, আর তাে কোনাে উপায় নেই। আমার মুখনিঃসৃত অভিশাপ খণ্ডন হবার নয়। মহর্ষি বললেন, ও অনুঢ়া, আপনি ওকে বিবাহ করুন। এ ছাড়া অন্য কোনাে পথ নেই। তা না হলে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়ে যাবে ওর সারা জীবন!
পুলস্ত্য মুনি বললেন, জীবনে আমি দার পরিগ্রহ করব না কখনো। সকল তপস্বী সাধনায় সিদ্ধি লাভের জন্য তপস্যা করেন। আমার তপস্যা কিন্তু কখনাে শেষ হবার নয়। আমি কোনাে সিদ্ধি চাই না। সাধনার খাতিরেই সাধনা করে যাই আমি। এই ফলাসক্তিহীন সাধনাই আমার লক্ষ্যে পৌছাবার জন্য সাধনাকে উপায়রূপে গ্রহণ করিনি আমি।
অবশেষে ব্যর্থ মনােরথ হয়ে ফিরে এলেন তৃণবিন্দু। আকুল হয়ে কেঁদে উঠলেন স্বয়ংবরা। তারপর শিশিরাবর্ষিনী রজনীর মতাে সমস্ত রাত নীরবে নিঃশব্দে কাঁদলেন। শীতদ্যুতি চন্দ্র তার স্নিগ্ধ আলাে দিয়ে তার তপ্ত বুককে শীতল করবার চেষ্টা করল। কুটির প্রাঙ্গণের শাল্মলী তরু দীর্ঘশ্বাস ফেলে সারারাত সান্ত্বনা দিতে লাগল তাকে। তার সকল দুঃখ ভুলিয়ে দেবার জন্য মধুর আলাপে কলতান করতে লাগল মালিনী নদী। তবু কিছুতেই কিছু হলাে না। এমনি করে তিন দিন তিন রাত্রি কেটে গেল। মহর্ষি তৃণবিন্দু স্পষ্ট বললেন, তুমি নিজে গিয়ে একবার দেখ পুলস্ত্য মুনির কাছে। অনূঢ়া গর্ভবতী কন্যাকে আমি আর এভাবে ঘরে রেখে দিতে পারি না। যে দোষ তুমি করেছ তার প্রায়শ্চিত্ত তােমাকেই করতে হবে।
স্বয়ংবরা বললেন, আপনি না বললেও আমি আজই বেরিয়ে যেতাম পিতা। পুলস্ত্য মুনি আমায় গ্রহণ না করলেও এখানে আর আমি ফিরব না।
আজ নববর্ষারম্ভ। দলিত কজ্জলরাশির মতো ঘাের কৃষ্ণবর্ণ মেঘে সমাচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে সমস্ত আকাশ। পথে যেতে যেতে তবু একবার মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলেন না স্বয়ংবরা।
পুলস্ত্য মুনির আশ্রমে গিয়ে কোনাে কথা বললেন না স্বয়ংবরা। শুধু একপ্রান্তে বসে পুলস্ত্য মুনির চিন্তায় সমস্ত প্রাণমনকে কেন্দ্রীভূত করে অনুক্ষণ ধ্যান করতে লাগলেন তার। তার অটল বিশ্বাস, একদিন না একদিন পুলস্ত্য মুনি তাকে গ্রহণ করবেন। গ্রহণ না করেন, অনাহারে অনিদ্রায় এমনি করে তারই চিন্তায় জীবন বিসর্জন দেবেন। এই হবে তার কৃতকর্মের শ্রেষ্ঠ প্রায়শ্চিত্ত।
তন্দ্রা এসেছিল অভিমানকুণ্ঠিতা স্বয়ংবরার। নিবিড় দেহক্লান্তিজনিত এমনি এক তরলিত তন্দ্রায় কতক্ষণ কেটে গেছে তা জানতে পারেননি। সহসা মনে হলাে কে যেন তাকে ডাকছে। বড় মধুর মনে হলাে সে কণ্ঠস্বর।
ভয়ে ভয়ে চোখ মেলে চাইলেন স্বয়ংবরা। আশা-নিরাশার এক জটিল দ্বন্দ্ব প্রতিফলিত তাঁর চোখে মুখে! চেয়ে দেখলেন, পুলস্ত্য মুনি তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। রুদ্র রােষের পরিবর্তে এক স্নিগ্ধ মমতা ফুটে উঠেছে তার চোখে মুখে।
কাজে ব্যস্ত থাকায় এতক্ষণ স্বয়ংবরাকে দেখতে পাননি পুলস্ত্য মুনি। এবার দেখলেন। দেখে বিস্ময়ে শিউরে উঠলেন। স্বয়ংবরাকে দেখে এখন চেনাই যায় না। এ কি বেশ হয়েছে তার। পরিধানে মলিন বসন। কংকালসার দেহ।
পূর্ণ নবযৌবনপ্রবাহের প্রগলভ উচ্ছ্বাসে একদিন যে স্বয়ংবরা ছিল উদ্দাম ও খরস্রোতা, আজ সে বেণীভূতপ্রতসলিলা কোনাে তটিনীর মতাে শুষ্ক ও শীর্ণকায় ; নিদাঘতাপিতা পাটলকুসুমের মতাে ম্লান হয়ে পড়েছে তার বরাঙ্গের বিকচ শােভা। অনাহারে উত্থানশক্তিরহিত।
সস্নেহকষ্ঠে পুলস্ত্য মুনি প্রশ্ন করলেন, ওঠ স্বয়ংবরা, কি হয়েছে তােমার? কি চাও তুমি?
তৃষ্ণায় কণ্ঠ এমনি শুষ্ক যে চেষ্টা করেও কোনাে কথা বলতে পারলেন না স্বয়ংবরা। শুধু কোনােরকমে একবার মাথাটা নেড়ে উত্তর দিলেন, না, কিছুই চান না তিনি।
ছুটে গিয়ে কুটির ভিতর হতে কিছু দুধ আর ফলের রস নিয়ে এলেন পুলস্ত মুনি। কিন্তু তা গ্রহণ করলেন না স্বয়ংবরা। নিবিড় অভিমানে অধরােষ্ঠ একবার কেঁপে উঠল তার। কোটরাগত চোখের ভিতর হতে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাে অশ্রুর দুটি ধারা।
কণ্ঠরস অভাবে যে স্বয়ংবরার বাক্যনিঃসৃত হচ্ছিল না কিছু আগে, তার চোখ হতে এখন অপ্রতিরােধ্য গতিতে বেরিয়ে আসতে লাগল অফুরন্ত অশ্রুর ধারা।
রুদ্রমূর্তিতে রােষকষায়িত লােচনে তাকে যদি ভৎসনা করতেন পুলস্ত্য মুনি, তাহলে হয়তাে এমন করে কাদতেন না স্বয়ংবরা। তাহলে সহজভাবে হয়তাে সব দানই তার গ্রহণ করতেন। কিন্তু তার মধ্যে সহসা আজ অপ্রত্যাশিত এই স্নেহমমতার অভিপ্রকাশ দেখে নিবিড় অভিমানে ফুলে ফুলে উঠতে লাগলেন স্বয়ংবরা।
তেমনি সস্নেহকণ্ঠে পুলস্ত্য মুনি বললেন, ওঠ স্বয়ংবরা, আমি সব শুনেছি। এত দুঃখ করবার কিছু নেই। আমার অভিশাপ মিথ্যা হবার নয়।
ধীরে ধীরে একবার মুখ তুলে চাইলেন স্বয়ংবরা।
পুলস্ত্য মুনি বললেন, তােমার গর্ভ হতে ভূমিষ্ঠ হবে এক ধর্মপ্রাণ পুত্রসন্তান। বেদধ্বনি শ্রবণকালে সে গর্ভস্থ হয় বলে তার নাম হবে বিশ্রবা।
বিষাদগম্ভীর ঘনকৃষ্ণ মেঘমালার মধ্যে বিদ্যুতার মতাে এক নিগূঢ় আনন্দানুভূতির স্পর্শে চমকে উঠলেন স্বয়ংবরা। পুত্রসন্তানের কথা শােনার সঙ্গে সঙ্গে বাঁচবার এক গভীর আগ্রহ জাগল তার মৃতপ্রায় প্রাণে।
তবু কোনাে কথা বললেন না। মাথা নিচু করে নীরবে বসে রইলেন স্বয়ংবরা। পুলস্ত্য মুনি বললেন, তুমি অনশনক্লিষ্ট ও অতিশয় দুর্বল। কিছু পানাহার করে সুস্থ হও।
স্বয়ংবরা অতিশয় ক্ষীণ ও অভিমানক্ষুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, আমি আর কিছুই চাই না। আমি বাঁচতে চাই না। আমি শুধু নীরবে শান্তিতে মরতে চাই।
পুলস্ত্য মুনি বললেন, তােমার ব্যক্তিগত জীবনে আগ্রহ না থাকতে পারে, কিন্তু তােমার গর্ভের মধ্যে যে জীবনের বীজ অঙ্কুবিত হয়ে উঠছে দিনে দিনে সে জীবনকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করবার তােমার কোনাে অধিকার নেই। ববং তা করলে তা হবে কাণহত্যার মতােই মহাপাপ। অবশেষে অনেক ভাবনা-চিন্তার পর অনশন ভঙ্গ করলেন স্বয়ংববা। বাঁচতে চাইলেন আবার কেবল সন্তানের মুখ চেয়ে।
তখন সন্ধ্য হয়ে এসেছে। অল্প অল্প বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। বর্ষণবিক্ষুদ্ধ ব্যথাভাবক্রান্ত সান্ধ্য আকাশের মতােই অন্তরটাকে ভাবী বলে মনে হলাে স্বয়ংবরার। পুলস্ত্য মুনি এখনাে তাকে গ্রহণ করেননি। কোনাে প্রতিশ্রুতিও দেননি। কোথায় যাবেন কি করবেন কিছুই খুঁজে পেলেন স্বয়ংবরা। যথারীতি স্তবপাঠ করে কুটিবের মধ্যে প্রদীপ জ্বাললেন পুলস্ত্য মুনি।
এতক্ষণে স্বয়ংবরার কথা মনে পড়ল তার। বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে ঝড় বইতে শুরু করেছে। অথচ আশ্রমপ্রান্তের একটি ঝঞাহত বৃক্ষতলে বসে আছেন স্বয়ংবরা।
পুলস্ত্য মুনি ভাবলেন আজ রাত্রির মতাে এই কুটিরের মধ্যেই আশ্রয় দিতে হবে স্বয়ংবরাকে। এই ভেবে স্বয়ংবরা যেখানে ছিলেন সেইদিকে এগিয়ে গেলেন পুলস্ত্য মুনি ব্যস্ত হয়ে।
কিন্তু গিয়ে আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, বৃক্ষতলায় কেউ নেই।
এক তীব্র ব্যথায় সমস্ত অন্তরটা মােচড় দিয়ে উঠল পুলস্ত্য মুনির। বুকের ভিতরটা হাহাকার করে উঠল।
স্বয়ংবরার নাম ধরে চীৎকার করে ডাক দিলেন পুলস্ত্য মুনি। নিষ্করুণ হাওয়ার প্রহারে জর্জরিত আশ্রমপ্রান্তের সেই বনপ্রদেশের বিক্ষুব্ধ চিত্তের অতলে নিঃশেষে তলিয়ে যেতে লাগল তার ব্যথাহত হৃদয়ের সমস্ত হাহাকার।
তিক্ত ও অবাঞ্ছিত হলেও এই কয়দিনের সম্পর্কে স্বয়ংবরার প্রতি কিছু মমতা সঞ্জাত হয়েছিল তার অন্তরে। ধূসর অনাসক্ত চিত্তে জেগেছিল এক মধুর মমতার বর্ণরাগ রেখা। সহসা নির্মম হাতে কে যেন মুছে দিল সে মমতার রেখা।
মমতার রং মুছে দিলেও রসঘন এক উদার করুণা জাগল পুলস্ত্য মুনির মনে। মনে হলাে, যে পাপ স্বয়ংবরা করেছে তার থেকে অনেক বেশি শক্তি তাকে দেওয়া হয়েছে। বাইরে যে ঝড় বইছে তার থেকে ঢের বেশি ভয়ঙ্কর ঝড় বইছে আজ তার অন্তরে। দুর্যোগঘন বর্ষা রাত্রির এই অন্ধকার হতে মসীলিপ্ত কলঙ্কের এক ঘােরতর অন্ধকার আজ তার মাথায়। প্রবল বৃষ্টিধারা অপেক্ষা প্রবলতর অশ্রুধারা তার চক্ষে।
অন্ধকার পথে যেতে যেতে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে স্তবপাঠের ভঙ্গিতে উদাত্ত কণ্ঠে পুলস্ত্য মুনি বলতে লাগলেন, হে মেঘ, যত পারাে আমার মাথার উপর বর্ষণ করাে। হে ঝড়, যত পারাে প্রহারে প্রহারে জর্জরিত কবাে আমার দেহকে! হে অন্ধকার, আমার সারা জীবনের সব আলাে তুমি কেড়ে নাও।
আমি যেমন স্বয়ংবরার প্রতি নির্মম হয়েছি তােমরাও তেমনি আমার প্রতি নির্মম হও। শুধু স্বয়ংবরাকে মুক্তি দাও; তাকে কষ্ট দিও না! আমারই জন্য আজ সে নিরাশ্রয গৃহহারা। আমারই অসঙ্গত শাস্তির বােঝা তার মাথার উপরে। আমারই অভিশপ্ত সন্তান তার গর্ভে।
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন পুলস্ত্য মুনি। আজ যেমন করে তােক খুঁজে বার করবেন স্বয়ংবরাকে। যদি না পান আশ্রমে আর ফিরবেন না।
এদিকে আশ্রমের সীমানা থেকে বেরিয়ে পড়লেও ঝডে জলে বেশিদূরে যেতে পারেননি স্বয়ংববা। নিকটস্থ একটি পর্বত গুহার মধ্যে রাত্রি যাপন করবার জন্য ক্লান্ত ও ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন।
এমন সময় বিদ্যুতের চকিত আলােকে স্বয়ংবরাকে দেখতে পেলেন পুলস্ত্য মুনি। আকুল হয়ে সেদিকে ছুটে গিয়ে অপরাধীর মতাে সকরুণ কণ্ঠে বললেন, তুমি আমায় ক্ষমা করাে স্বয়ংবরা। চলাে আমাব কুটিরে রাত্রিবাস করবে। এ অবস্থায় তােমায় ছেড়ে দিতে পারি না আমি। আমি তােমায় আসতে দিতাম না। সামগানে ব্যস্ত ছিলাম আমি যখন, সেই অবসরে চলে এসেছ তুমি।
পুলস্ত্য মুনির পায়ের কাছে নতজানু হয়ে বসে, তাকে ভক্তিভবে প্রণাম করলেন স্বয়ংবরা। তাবপব ক্ষীণকণ্ঠে বললেন, আপনি আমার উপর যথেষ্ট দয়া করেছেন। আজ আমি আপনার কাছ হতে কিছুই চাই না। পর্বতগুহায় রাত্রিযাপন করতে কোনাে অসুবিধা হবে না আমার।
পুলস্ত্য মুনি বললেন, কিন্তু আমি যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হযেছি স্বয়ংবরা, তােমাকে না নিয়ে আশ্রমে একা ফিরব না।
আর কোনাে প্রতিবাদ না করে পুলস্ত্য মুনির অনুসরণ করতে লাগলেন স্বয়ংবরা। কুটিরের মধ্যে প্রবেশ করে স্বয়ংবরা বললেন, আমি অনূঢ়া। আপনি ব্রহ্মচারী তপস্বী। এক কুটিরের মধ্যে কেমন করে রাত্রিযাপন করতে পারি আমরা।
স্মিত হাসি হেসে পুলস্ত্য মুনি বললেন, কোনাে ভােগের উপাদান কাছে থাকলেই চিত্ত যদি বিচলিত হয় তাহলে বৃথাই আমার ব্রহ্মচর্য সাধনা। তাহলে বৃথাই আমার এতদিনের সংযম শিক্ষা। সে বিষয়ে তােমার কোনাে চিন্তা নেই।
স্বয়ংবরা তখন বললেন, কিন্তু কোনাে প্রতিদান না দিয়ে আপনার এত দান একটার পর একটা কোন্ অধিকারে গ্রহণ করব আমি। আপনার সঙ্গে আমার কোনাে সম্পর্ক নেই। আপনি তাে আমায় এখনাে গ্রহণ করেননি ধর্মপত্নীরূপে! একটু থেমে স্বয়ংবরা বললেন, এই প্রস্তাব আমার পিতা এসে আপনার নিকট উত্থাপন করলে পরে আপনি তা সরােষে প্রত্যাখান করেন। নিরুক্ত নিরুচ্চার এই প্রস্তাব বুকে করে আমি নিজে উপবাচিকারূপে আপনার নিকট এলেও আমায় ভিখারিণী ভেবে কিছু করুণা ভিক্ষা দিয়ে কৌশলে বিতাড়িত করবার চেষ্টা করেন। এব পরও আপনার কাছ থেকে কি কোনাে দান নেওয়া সম্ভব মুনিবর ? বিস্ফারিত চোখের বিহ্বল দৃষ্টি তুলে পুলস্ত্য মুনির মুখপানে তাকিয়ে রইলেন স্বয়ংবরা।
পুলস্ত্য মুনির চোখে জল এলাে। মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে বললেন, বড় দুস্তর সাধনায় আত্মনিয়ােগ করেছি আমি স্বয়ংবরা। সকল তপস্বীর তপস্যার শেষ আছে। আমার তপস্যার কখনাে শেষ হবে না। সুদুর স্বর্গমণ্ডলে গিয়েও না। এক্ষেত্রে দার পরিগ্রহ করে তপস্যায় বিঘ্ন ঘটানাে আমার কখনই উচিত নয়।
স্বয়ংবরা কোনাে কথা বলেন না। পুলস্ত্য মুনি বললেন, তাছাড়া আর একটা কথা আছে।
শরাঘাতবিদ্ধ কোনাে বিহগীর মতাে শান্তকরুণ দৃষ্টি তুলে ক্ষুব্ধ কৌতূহলে একবার তাকালেন স্বয়ংবরা। বিপন্ন আশার এক আর্ত আভাস শেষবারের মতাে ফুটে উঠল সে দৃষ্টিতে।
পুলস্ত্য মুনি বললেন, আমি প্রৌঢ় তপস্বী ; তুমি তরুণী যুবতী। তােমার আমার মাঝে এক অনতিক্রম্য বয়সের ব্যবধান। এই ব্যবধানের শূন্য বুকে প্রণয়মধুর কোনাে সম্পর্কের সৌধ গড়ে তােলা সম্ভব নয় স্বয়ংবরা।
অবস্থার পাকচক্রে বাধ্য হয়ে আজ আমায় তুমি পতিত্বে বরণ করতে পার; কিন্তু তােমার সখারূপে স্বামীরূপে কোনােদিন মেনে নিতে পারবে না তুমি আমায়। তুমি আমায় শ্রদ্ধা করতে পার ; কিন্তু ভালবাসতে পার না। তুমি আমায় তােমার মাথার উপরে আসন পেতে বসাতে পার ; কিন্তু বুকে টেনে নিতে পার না।
কেমন করেই বা পারবে। স্বয়ংবরা তুমি ভুল বুঝছ। তুমি জান না, আমার দেহের মধ্যে প্রাণ আছে, আত্মা আছে; কিন্তু মন বলে কোনাে পদার্থ নেই। ওই যজ্ঞানলে সে মন আমার জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে নিঃশেষে। সেই ভস্মাবশিষ্ট মনে শ্মশানে সৃষ্টির ধ্বজা উড়িয়ে কেমন করে ঘর বাঁধবে তুমি স্বয়ংবরা!
সহসা অন্ধকারের মধ্যে আলাে খুঁজে পেলেন যেন স্বয়ংবরা। আশায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার মুখখানা।
স্বয়ংবরা বললেন, তা আমায় যে পারতেই হবে মুনিবর। এছাড়া আমার কোনাে গত্যন্তর নেই। আমরা এখনাে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ না হলেও মন আমার আপনাতেই সমর্পিত হয়েছে বহু আগে হতে। কুসুমরস শােষণকারী নিষ্ঠুর কীটের মতাে আপনার চিন্তা অনুক্ষণ আমার মনের সব সুষমাকে হরণ করে ফেলেছে। আপনাকে ছাড়া আর কাকে আমার এই উচ্ছিষ্ট মন দান করতে পারি মুনিবর?
পুলস্ত্য মুনি বিস্মিত হয়ে বললেন, একথা আগে আমায় জানাওনি কেন স্বয়ংবর?
স্বয়ংবরা বললেন, জানাতে গিয়ে পারি নি। মুখ ফুটে বলতে গিয়ে দ্বন্দ্বমধুর এক লজ্জার আঘাতে মূক হয়ে গেছি মুনিবর। এক নিষ্ঠুর আশঙ্কার কণ্টকে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছে আমার অন্তর।
কথাটা বলতে বলতে সত্যিই লজ্জা অনুভব করলেন স্বয়ংবরা। বলা শেষ করে মুখ নত করে বসে রইলেন নীরবে।
পুলস্ত্য মুনি কিছু আর বললেন না। কিছুক্ষণ দুজনেই স্তব্ধ হয়ে রইলেন।
অনেকক্ষণ ধরে অনেক চিন্তা করার পর পুলস্ত্য মনি বললেন, সন্ধ্যাপ্রদীপের এই শান্ত আলােকশিখাকে সাক্ষী করে আজ আমি তােমায় গ্রহণ করলাম স্বয়ংবরা।
স্বয়ংবরার একখানি হাত নিজের হাতের মধ্যে তুলে নিলেন পুলস্ত্য মুনি।
আনন্দে চোখে জল এলাে স্বয়ংবরার। জীবনে এত বিপুল আনন্দ কোনােদিন অনুভব করেননি এর আগে।
আনন্দাশ্রুর সমস্ত বেগ দমন করে শান্তকণ্ঠে স্বয়ংবরা বললেন, আমি আজ ভগবানের নামে শপথ করছি, জীবনে কোনদিন আপনার সাধনকার্যে কোনােরূপ বিঘ্ন সৃষ্টি করব না। বরং সাধ্যমত আপনাকে সাহায্য করে যাব সে সাধনায়।
কয়েকদিন অনিদ্রার পর আজ সারাটি রাত ধরে এক গভীর সুষুপ্তিস্বাদ উপভােগ করলেন স্বয়ংবরা। সকালে উঠে বেশ সুস্থ হয়ে উঠলেন।
পরদিন সকাল হতে জোর বৃষ্টি শুরু হলাে।
স্বয়ংবরা দেখলেন, মেঘগম্ভীর বিশাল মুখমণ্ডলে অশনির ঘাের দুন্দুভিনিনাদিত বিদ্যুতার বিসাল ইন্দ্রধনু ও সুতীক্ষ্ণ বর্ষণধারার নিশিত শায়ক হাতে বর্ষা রণসাজে এসেছে পৃথিবীতে। আর এদিকে নবজলসম্পাতে উৎফুল্ল পৃথিবী নীলাদি রত্নভূষিতা বরাঙ্গী সুন্দরীর মতাে দলিত বৈদুর্যমণিসন্নিভ নববদ্ভিন্ন শ্যামল তৃণাঙ্কুর ও পত্রাবলীতে সজ্জিত হয়ে স্নিগ্ধসজল প্রেমালাপে তাকে প্রীত করবার চেষ্টা করছে।
স্বয়ংবরার মনে হলাে জলেস্থলে পৃথিবী আজ গর্ভবতী রমণীর পীন স্ফীত স্তনমণ্ডলের ন্যায় এক রসঘন ঐশ্বর্যের প্রভাপুঞ্জে বিরাজিত।
যথাসময়ে একটি পুত্রসন্তান প্রসব করলেন স্বয়ংবরা। কিন্তু পাছে সন্তানস্নেহ সাধনাকে ব্যাহত করে কোনােপ্রকারে এই ভেবে সন্তানকে পুলস্ত্য মুনির কাছ থেকে দূরে রাখলেন তিনি।
আগেকার বেশ ছেড়ে তপস্বিনীর বেশ ধারণ করেছিলেন স্বয়ংবরা। তপস্বিনীর বেশে অতি সতর্কতার সঙ্গে শুধু সেবা করে যেতেন পুলস্ত্য মুনির।
তপস্বিনীর বেশ ধারণ করলেও কিছুদিনের মধ্যেই পুনরায় যৌবন ফিরে পেলেন স্বয়ংবরা। নিটোল ও পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যসম্ভার-সমৃদ্ধ রক্তাভ দেহাবয়ব হতে নিয়ত বিচ্ছুরিত হতে লাগল এক অনুপম লাবণ্যচ্ছটা।
কিন্তু যতদূর সম্ভব তা জানতে দিতেন না কাউকে। নিয়ত রুক্ষ ও অবিন্যস্ত রেখে দিতেন তার দীর্ঘ আলুলায়িত কেশপাশ। বাঞ্চল দ্বারা ঢেকে রাখতেন তার প্রতিটি অঙ্গের লাবণ্যোচ্ছ্বাস। কাঞ্চীদাম দ্বারা নির্মমভাবে পিষ্ট করে রেখে দিতেন তার উদ্ধত উত্তুঙ্গ পীরস্তন দুটিকে।
তবু প্রস্তরপ্রতিহত সাগরগামিনী নদীর মতাে দিনে দিনে স্ফীত হয়ে উঠতে লাগল তার সংযমশাসিত যৌবনসৌন্দর্যের উদ্দাম বেগ।
মাঝে মাঝে পুলস্ত্য মুনি স্বয়ংবরার পানে একদৃষ্টে তাকিয়ে কি যেন দেখতে থাকেন। দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ভাবেন ওর কোনাে দোষ নেই। যে নির্মম অবহেলা দ্বারা একদিন অবজ্ঞাত করেছিলেন স্বয়ংবরার দেহসৌন্দর্যকে, আজ অনুরূপ অবহেলার দ্বারা তার প্রতি প্রতিশােধ নিচ্ছে স্বয়ংবরা। বলবার কিছুই নেই। তাই ভয়ে কোনাে কথা বলতে পারেন না স্বয়ংবরাকে।
স্বয়ংবরা কিন্তু গৃহকর্ম ও সন্তান পালন নিয়ে সব সময় এমনি ব্যস্ত থাকেন যে কোনােদিকে একবার তাকাবার কোনাে অবকাশ পান না। অথবা হয়তাে সে অবকাশ চান না তিনি।
এমনি করে দেখতে দেখতে বর্ষার পর শরৎ, হেমন্ত ও শীত তিনটি ঋতু কেটে গেল। আশ্রম প্রাঙ্গণে দিনে দিনে কত মালতী মল্লিকা ও কুন্দকেতকী ফুটে ঝরে গেল, কত ঢেউ বয়ে গেল পম্পা নদীর জলে, কোনােদিন একবার তা চেয়ে দেখলেন না স্বয়ংবরা। অবশেষে এলাে বসন্ত। মনে মনে ভীত হয়ে উঠলেন পুলস্ত্য মুনি। এমন দুরন্ত বসন্ত আর কখনাে আসেনি তার আশ্রমে।
পুষ্পভারান প্রিয়ঙ্গুলতিকার মতাে ক্ষীণকটি সুন্দরী স্বয়ংবরাকে দেখে দিনে দিনে কামাবিষ্ট হয়ে পড়তে লাগলেন পুলস্ত্য মুনি। কিছু কিছু ত্রুটি ঘটতে লাগল তার তপস্যাকার্যে।
স্বয়ংবরা তা বুঝতে পেরে স্থির করলেন, কিছুকালের জন্য তিনি পিতৃগৃহে চলে যাবেন। তারপর একে একে পুলস্ত্য মুনির অশান্ত মনটা শান্ত ও সংযত হয়ে উঠলে আবার চলে। আসবেন।
সেদিন ছিল বসন্ত পূর্ণিমা। সন্ধ্যার কিছু আগে সারাদিনের গৃহকর্ম সেরে বিদায় চাইলেন স্বয়ংবরা পুলস্ত্য মুনির কাছে। স্থির করেছেন, আজই তিনি চলে যাবেন মহর্ষি তৃণবিন্দুর আশ্রমে।
কথাটা শােনার সঙ্গে সঙ্গে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন পুলস্ত্য মুনি। ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, আমায় না জানিয়ে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা তােমার উচিত হয়নি। শত হলেও তুমি আমার ধর্মপত্নী, আমার প্রতি তােমার একটা কর্তব্য আছে। শান্ত কণ্ঠে অনুযােগ করলেন স্বয়ংবরা, সে কর্তব্যে কি কোনােদিন অবহেলা করেছি আমি? | পুলস্ত্য মুনি বললেন, সে কথা আমি বলছি না। আমি বলছি, তুমি আগে বলােনি কেন একথা।
স্বয়ংবরা বললেন, আমি যাব না। আপনার অমতে কখনাে কোনাে কাজ আর করব না। আপনি আমায় ক্ষমা করুন।
শান্ত ও আশ্বস্ত হলেন পুলস্ত্য মুনি।
সন্ধ্যা হতেই চাদ উঠল নির্মল আকাশে। বৃক্ষশাখার ফাকে ফাকে সে চাদের আলাে ছড়িয়ে পড়ল কেতকী পরাগসুবাসিত বনভূমির উপর। মদ মলয়সমীরণকম্পিত ছায়াবগুণ্ঠিত সে আলােক দেখে মনে হতে লাগল যেন কোনাে লজ্জাবতী সুন্দরী রমণী কৃত্রিম ক্রোধভরে প্রিয়সঙ্গ ত্যাগের জন্য উন্মুখ ও চঞ্চলা হয়ে উঠেছে।
মত্ত মাতঙ্গের মতাে উন্মত্ত হয়ে উঠলেন পুলস্ত্য মুনি। উদ্ধত কামাবেগকে কোনোমতেই শান্ত বা সংযত করতে পারলেন না অন্তরে।
স্বয়ংবরার একটি হাত ধরে সঙ্গম প্রার্থনা করলেন তার কাছে। মুহূর্তে সজোরে হাতখানি ছাড়িয়ে নিয়ে কুটিরের মধ্যে গিয়ে দরজাটি অর্গলবদ্ধ করে দিলেন স্বয়ংবরা।
আর সেই রুদ্ধদ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ব্যাকুল প্রার্থনায় বারবার করাঘাত করতে লাগলেন পুলস্ত্য মুনি। বললেন, কথা শােন স্বয়ংবরা, অভিমান করাে না, যদি কোনাে দোষ করে থাকি ক্ষমা করাে। মাত্র একটি বারের জন্য দরজা খােল। আমার হৃদয় হতে স্বতােৎসারিত এই কামনাটিকে একটিবারের জন্য তৃপ্ত করতে দাও। জীবনে আর কোনােদিন কোনাে কিছুই চাইব তােমার কাছে। তবু একটিবারের জন্যও দরজা খুললেন না স্বয়ংবরা। শুধু কাদতে লাগলেন ফুলে ফুলে।
সহসা স্বয়ংবরার কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে চমক ভাঙল পুলস্ত্য মুনির। স্বয়ংবরা তাহলে সত্যিই ভালবাসে তাকে। তার মঙ্গলের জন্যই আজ এতখানি কঠোর হয়ে উঠেছে সে। তার ভালাের জন্যই এক তীব্র যন্ত্রণায় নিজেও জ্বলছে সে।
রাত্রি শেষ হতে দরজা খুলে বাইরে এলেন স্বয়ংবরা। এসে আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, যজ্ঞভূমিতে অসময়ে ধ্যানে বসেছেন পুলস্ত্য মুনি। তার দেহ সম্পূর্ণরূপে নিশ্চল। এমন কি শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়াও রুদ্ধ।
সেই যে ধ্যানসমাধিস্থ হলেন পুলস্ত্য মুনি, আর কোনদিন জাগলেন না। সম্বিৎ ফিরে এলাে না তার শত চেষ্টাতেও।
আছাড় খেয়ে ভূমির উপর লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলেন স্বয়ংবরা।
বালক বিশ্রবাকে নিয়ে সেই আশ্রমেই রয়ে গেলেন স্বয়ংবরা। প্রতিদিন রাত্রি গভীর হলে এবং সপ্তর্ষিমণ্ডল মাথার উপরে এলে নক্ষত্রখচিত দূর আকাশের পানে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বিশ্ববাকে কি দেখান স্বয়ংবরা। বলেন, ওই যে সপ্তর্ষিমণ্ডল দেখা যাচ্ছে, ওর পুরােভাগে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র বিরাজ করছেন। উনিই তােমার পিতা। উনি স্বর্গে গেছেন। কিন্তু ওঁর সাধনার আজও শেষ হয়নি। | সৌরলােকেরও অনেক উর্ধ্বে ওই সপ্তর্ষিলােক। ত্রিলােকের উপাস্য সূর্যদেব স্বয়ং সন্ত্রমভরে উর্ধ্বনেত্রে চেয়ে থাকেন এই সপ্তর্ষিদের পানে। কল্পান্ত সংকটে জগতের সবকিছুই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, কিন্তু স্বয়ং ধরিত্রীর মতে সপ্তর্ষিমণ্ডলও মহাবরাহের দশন আশ্রয় করে প্রলয় পয়ােধি জল হতে উঠে আসেন, বিনাশপ্রাপ্ত হন না কখনাে।
স্বয়ংবরা বিশ্রবাকে আরও বললেন, জন্মান্তরজাত তপস্যার সমস্ত ফল ওঁরা ভােগ করেন সত্য। কিন্তু তবু তপস্যার ওঁদের শেষ নেই। যাদের তপস্যা সকাম, ফলসিদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই নিবৃত্ত হন তারা সে তপস্যা হতে। কিন্তু সপ্তর্ষিরা তপস্যার জন্যই তপস্যা করে যান যুগ যুগ ধরে।