দুই বাংলার বাউল আখড়া – সোমব্রত সরকার

›› গল্পের অংশ বিশেষ  

……বলে যাচ্ছেন মীরা মা–নবকুমার জাত বাউল। ও তো ওর সাধনসঙ্গিনী ছিল। এখন সাধন ভুলে গান ধরেছে। মেয়েরা নেচেকুঁদে গাইবে কেন? আখড়ায় গাইতে পারে। মেয়েদের কাজ হল সাধনভজন করা।

খুবই ঝাঝি দিয়ে কথা বলছেন মীরা মা। আমি চুপ। শুনে যাচ্ছি। কথা বলছি না। ভাবছি শুধু তাঁর বিশ্বাসের আসন টলাবে কে শুনি! কতজন সাধক বাউল আছেন এখন। যারা আছেন তাঁরা সাধনাতে কতটা বা আগ্রহী! গান, প্রচার, বিদেশ যাত্রার তদবির নিয়ে অনেকে ব্যস্ত। মেয়েরা এর ভেতর কতটা সাধুসঙ্গ পাচ্ছে। সাধুই নেই, সাধকই নেই তার আবার সঙ্গ। সঙ্গিনীর সঙ্গে সাধক জীবন তো এখন ব্যাভিচারে, অনাচারে হয়ে উঠেছে। পাশ্চাত্যের তথাকথিত live together

নবকুমার কৃষ্ণাকে ছেড়ে নতুন সঙ্গিনী জুটিয়ে নিয়েছেন। কৃষ্ণা সে সময় মেয়ে নিয়ে বেশ বিপাকে পড়েছিলেন। আমাকে তার দুঃখের কথা, সংগ্রাম জানিয়েছিলেন তিনি।…….

…..জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সাধনায় মেয়েদের স্থান কতটুকু?

রেগে উঠলেন মা।

কতটুকু মানে। মেয়ে না হলে সাধন হবে? মেয়েরা হল গিয়ে সরোবর। সাধক সেখানে স্নান সারেন। সিদ্ধ হন।

মেয়েদের তবে সিদ্ধতা আসে না? তাঁরা সাধন সঙ্গিনীই কেবল?

বেশ রেগে উঠলেন মা।

কে বলেছে আবোল তাবোল?

বললাম, না সাধনায় সাধকেরা তো উর্ধগামী করে দিতে পারেন বস্তুকে।

বলতে দিলেন না মা। বললেন, তা বস্তু উর্ধগামী করতে সাহায্য করে কে? মেয়েরা যদি শ্বাস, দমের কাজ না শেখে সে পারবে? কীভাবে উর্ধগামী হবে শুনি! যত আজেবাজে কথা।

জানি আমার দৃষ্টিভঙ্গি মনোপুত হচ্ছে না মা’র।

বললেন, মেয়েরা সমান তালে যোগ করে। রেচক, পূরক, কুম্ভক সব করে।…….

*****

রজঃপ্রবাহকে বাউল বলেন রজঃস্নান। এই স্নানের চারটি গালভরা নামও আছে। গরল, উন্মাদ, রোহিনী, বাণ। চার নামই স্পষ্ট করে রজঃযোগ চারদিন। প্রথমদিন গরল। মানে হল বিষ। সেই বিষকেই সাধক সুধা করে দেন। দ্বিতীয় দিন উন্মাদ। বাউল বলেন জোয়ার শুরু হল। একে তাঁরা অমাবস্যাও বলে থাকেন। ঘোর অমাবস্যার তৃতীয় দিন। রোহিণী। রোহিণী কিন্তু চাঁদ প্রতীকের সামঞ্জস্যতা রাখছে। চন্দ্ৰপত্নী হলেন রোহিণী। বাউলের চন্দ্রনাড়ি জাগছে আর চন্দ্রপত্নী তৃতীয় দিনে যোগ্য সঙ্গিনী হয়ে সাধককে সাহায্য করছেন। সাধক চতুর্থ দিনে বাণে সিদ্ধ হচ্ছেন। বাণ বলতে কিন্তু বাউল লিঙ্গকে চিহ্নিত করেন। এই বাণকে উৰ্দ্ধরেতা দেন সাধক। বীর্য নিম্নগতি পায় না। তবে এই চারটিকে রজঃস্নানের চারটি দিনের রজঃপাতের নাম হিসাবেই দেখেন তাঁরা। স্নাননাম যদিও অনেকে বলেন। এই বৈপরিত্য গুরু অভিহিতের ফল। গুরু যেমন বলে থাকেন সাধককে, সাধক বাউল সেভাবে, সে নামে চিহ্নিত অরে থাকেন। ‘চারিচন্দ্র’ বলতে অনেকে আবার মল, মূত্র, রজ, শুক্র না বলে বলেন আদি, নিজ, উন্মত্ত, গরল। আদি হল আমিসত্ত্বা। নিজ হল নিজের মল-মূত্র। উন্মত্ত হল সঙ্গিনীর রজ। গরল হল গিয়ে শুক্র। বীর্যকেই তাঁরা অমৃত করে নেন, মানে বীর্যকে উধ্বপ্রবাহ দিয়ে ‘অধর মানুষ’, ‘অটল মানুষ’ হয়ে যান। অধর, অটল হল সিদ্ধ স্তরের দশা। স্কুল, প্রবর্ত, সাধক পেরিয়ে সিদ্ধ স্তরে তিনি ব্যক্তির উচ্ছ্বাস ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সহজ হয়ে ভক্ত শিষ্যদের সামনে নিমগ্নতার আততিকে তুলে ধরেন। মত বিনিময় করেন।

সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র হল করনখে দশ, পদনখে দশ, দুই গলায় দুই, অধরে এক, জিভে এক, কপালে দেড়। অষ্টম চন্দ্র বা অষ্টম ইন্দুর কথাও বলে থাকেন বাউল। ‘অষ্টম চন্দ্র’ হল মুখ এক, স্তন দুই, হাত দুই, বুক এক, নাভি এক, যোনি এক।

প্রশ্ন হল সংখ্যা চিহ্নিত এই প্রত্যঙ্গগুলোতে কী কাজ হয়ে থাকে? দেহ যখন দেহাতীত হয়ে ওঠে; বস্তুঙ্খলন থেকে উর্ধ্বে বিরাজ করে দেহ, রজঃবীজের নিয়ন্ত্রণ চলে এসে দেহ সংবৃত নির্জন হয়ে পড়ে যুগল মিলনে তখন সাধক ও সঙ্গিনীর এই সব প্রত্যঙ্গ মারফৎ স্বকীয় মৃত্যু ঘটে। এখানে চুম্বনে আত্মবিস্মৃত মগ্নতা আসসে। সাধক ও সঙ্গিনী ভুলে যান নিজস্বতা। সঙ্গমরত মানবশরীর সঙ্গমের ঊর্ধ্বে উঠে উপমেয়কেই যেন খুঁজে পায়। উপমেয় হল বাউল মতে, কামের মধ্য থেকে কামকে হেঁটে বাদ দিয়ে নিষ্কামী হওয়া। আর কামকে বাদ দেবার সাধনা গুরুই শেখান। সেজন্যই তা হল রপ্ত এক কৌশল। যে কৌশলে ‘সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র’ ও ‘অষ্টম চন্দ্রের’ ব্যবহার অনিবার্য। এগুলো সবই সঙ্গমের। উপান্ত দশায় এসে গুরু নির্দেশিত সব পূর্ণচ্ছেদ। অমোঘ টানে বা আকর্ষণে প্রত্যঙ্গের ওসব স্থানে কখনও সংখ্যাচিহ্নিত চুম্বন, স্পর্শ ইত্যাদি কোনওভাবে সম্ভবপর নয়। এগুলোকে গুরুর সুমুদ্রিত স্বাক্ষর হিসাবেই শুধু দেখা ভালো। তবে ঊধ্বরেতা যথেষ্টই শরীর রপ্তের কাজ। কঠোর যোগসাধন না হলে তা হবে না। কী তন্ত্রে, কী বাউলে, দেহ সাধনায় সাধক সঙ্গমস্থ দশায় বীর্যকে উর্ধেরেতা দান করেন। তবে সন্ন্যাসী তো আর শরীর ছোঁন না, তাঁরা বলেন স্ত্রীসঙ্গে বিন্দুনাশ হয়। বিন্দুনাশ হলে আত্মক্ষয় ও সামর্থহীনতা আসে–’যদি সঙ্গং করোতেব বিন্দুস্তস্য বিনশ্যতি। আত্মক্ষয়ে বিন্দুহানাদসামর্থঞ্চ জায়তে।।‘ ‘পীত্বা মোহময়ীং প্রমোদমদিরামুন্মত্তীভূতং জগৎ’। ভর্তৃহরি এই কথা বলেছেন। বলেছেন মোহময়ী। প্রমোদরূপ মদিরা পান করে এই অনন্ত জগৎ উন্মত্ত হয়ে আছে। ‘ভগেন চৰ্ম্মকুণ্ডেন। দুর্গন্ধেন ব্রণেন চ। / খণ্ডিতং হি জগৎ সৰ্ব্বং সদেবাসুরমানুষ।।‘ এই আকর্ষণ থেকে। উদ্ধার পাবার পথ কী? অভ্যাস আর সংযম। সন্ন্যাসী তা রপ্ত করেন। তাঁরা ব্রহ্মবস্তু বলেন বীর্যকে। শরীরে তা আছে বলেই আনন্দ। যোগসাধনে বিন্দুধারণ না হলে উন্নতি সম্ভবপর। নয় কখনোই। ‘যোগিনস্তস্য সিদ্ধিঃ স্যাৎ সততং বিন্দুধারণাৎ।’ সতত বিন্দুধারণ করলে। যোগীগণের সিদ্ধি হয়। তাঁরা বলেন বীর্য সঞ্চিত হলে পরে মস্তিষ্কে প্রবল শক্তি সঞ্চয় হয়। এই শক্তির বলে একাগ্রতা সাধন হয়। সাধক অনেক উপরে উঠতে পারেন। সংসার ছাড়ার কথা বলেন সন্ন্যাসী। অর্থাৎ সংসারের ‘সং’ ছেড়ে ‘সার’কে গ্রহণ করতে বলেন তাঁরা। দুরাশার অন্ধকারে না ডুবে অসার রূপে ‘সং’ না সেজে ‘সার’ হয়ে সংসারে আশার সুধা ভরার কথা বলে থাকেন তাঁরা। সংসারে সার প্রসার করতে বলেন তাঁরা। অর্থাৎ শরীরের যোগ শরীরের উপাদানকে শরীরে রেখে শরীরকে পাশব-বাসনা থেকে মুক্ত রাখেন তাঁরা।

যুগল সাধনে ‘সার’ গ্রহণ হয় ঠিকই কিন্তু সংসারের ‘সং’ কিছু থাকে ঠিক। সে অন্যত্র আলোচিত বিষয়। বাউল তাঁর শরীর সংবেদিতার মন্ত্র বলে থাকেন গানে। যেমন লালন বলেছেন–’না জেনে করণ কারণ কথায় কথায় কি হবে/ কথায় যদি ফলে কৃষি তবে বীজ কেন রোপে? / গুড় বললে কি মুখ মিঠা হয়/ দিন না জানতে আঁধার কি যায়/ তেমনি জেনো হরি বলায় হরি কি পাবে।

বাউলের পৃথিবী এই পাওয়ার প্রতীকী উত্তরাধিকারকে সবসময় ধরে রাখে গানে। গান তাই বাউলের সাধন অনুভূতির ভাষা। গান তাঁর যথাযোগ্য আলোরই বৈরাগ্য। সেদিকেই আমরা মুখ ফেরাব।

পদকর্তা বলেছেন : ‘অমাবস্যায় পূর্ণিমা যোগে আজব-সম্ভব সম্ভোগ / জানলে খণ্ডে এ ভব রোগ / গতি হয় অখণ্ড দেশে।’

‘আজব-সম্ভব সম্ভোগ’ হল বাউলের কাম জয়ের সম্ভোগ। প্রেমে রূপান্তর হয় কাম তাঁদের ভাষায় ‘চন্দ্ৰসাধনা’ করলে। আর সিদ্ধিতে সাধকের স্থান হয় ‘অখণ্ড দেশে’। আর তার জন্যই সাধনভজন। গোপালের ‘চন্দ্ৰসাধন কর রে মন সময় থাকিতে’ গানটির কথা বলেছিলাম আমরা। গোপাল বলছেন সেখানে চারটি চন্দ্র মন আর পবন চার জা’গাতে চারের আসন / আর আতস খাক বাদে মিলন চলন চারেতে / লাল জরদ সিয়া সফেদ চারটি রঙেতে। / চার মঞ্জিলে খেলছে তারা রয়েছে চার হিকমতে। / চার কুতুব আর ষোল প্রহরী একশ আট চন্দ্র তাইতে ধরি / রয়েছে সব সারি সারি ধরাধরিতে।।/ অদ্য হয়ে সাড়ে চব্বিশ হয় জাহেরাতে / সাড়ে চারকে সাধলে পাবি সিদ্ধি হবে চার যুগেতে।।’

চন্দ্রের কথা কিছু আগেও বলেছি আমরা। বাউলের চন্দ্রে আছে শরীরের বর্জ্য পদার্থ, বাঁ নাকের শ্বাস, বিভিন্ন দেহাঙ্গ, এমন কী নখ পর্যন্ত। এগুলোর সাহায্যেই তাঁরা চান্দ্র ঘটনাতে সামিল হন। ‘চান্দ্র ঘটনা’ হল সঙ্গিনীর রজঃপ্রবাহ। এই রজঃপ্রবাহের মধ্যেই চলে সাধনা। সাধনার সঙ্গী চার চন্দ্র–দুই বর্জ্য আর দুই শরীরের রজ-বীর্য। ‘মন আর পবন’ অর্থাৎ কিনা যুগল মনের একাত্মতা এবং যুগল বায়ু বাঁ শ্বাসের গুরু শেখানো রপ্তকৌশল। চার জায়গাতে চলে চারের আসন। চারটি জায়গা চারটি দিক–পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ আর চারের সাধন আদি, নিজ, উন্মত্ত, গরল–যা কিনা দুই বর্জ্য ও রজ বীর্যেরই মতান্তর। চার রঙ–জরদ, সফেদ, সিয়া, লাল–তা হলে রজের চারদিনে পরিবর্তিত রূপ। স্রোতধারার চারদিনে চার রঙ ধারণ করে রজ। মতান্তরে স্রোতধারা বা রজঃপ্রবাহের তিন দিনে দিন রঙের হয় সঙ্গিনীর রজ–সফেদ, সিয়া, লাল। চার কুতুব চারদিক। ‘ষোল জন প্রহরী’ হল–ষড়রিপু আর দু’ভাগের পাঁচ পাঁচ করে দশেন্দ্রিয়। ‘একশ আট চন্দ্র’–অষ্টম পাশের আট আর ছয় চক্রের পদ্ম পাপড়ির একত্র যোগফল। সেজন্য বলা রয়েছে রয়েছে সব সারি সারি। আমাদের শরীরকে স্থূল শরীর হিসাবে দেখে থাকেন প্রথমে বাউল সাধক। এই স্থূল দেহ ত্যাগ হলে আসে জ্যোর্তিদেহ। তারপর মানসদেহ ও নিমিত্ত দেহের প্রতিষ্ঠান। বিজ্ঞানেও কিন্তু এই তিন স্তরের উল্লেখ আমরা পাই। Astral body (জ্যোর্তিদেহ), Mentral body (মানসদেহ), Casual body (নিমিত্ত দেহ)। ছয়টি যে চক্র বললাম তা মানব শরীরে বর্তমান। ইংরাজিতে মানবদেহ বলা হচ্ছে হিউম্যান বিং। Human এর Hue রঙ বা Colour Being হল আলো বা light. Human Being faces oftco IGT colour menifextation in light সুতরাং এভাবে দেখলে দেহ রঙপেন্সিলের একটা বাক্স। তার আধারে ছটি চক্র। মূলাধার (Root), স্বাধিষ্ঠান (Abdomen), মণিপুর (Solar Plexus), অনাহত (Heart), বিশুদ্ধ (Throat), আজ্ঞা (Third Eye)। যেটা বোঝাতে চাইছি এই সব প্রতীকী কল্পনাতেও কিন্তু বিজ্ঞান রয়েছে। গাঠনিক সেই অভিধাকে মেনেই চক্ৰ কল্পিত প্রতীকী নামকে ধরে রেখেছে।

বাউল বলেন কারণবারি, রস বা রজ। যা দেহেরই অন্তর্গত পদার্থ বাউলের যে যুগলমিলন তা ঘটে কিন্তু জ্যোর্তিদেহে। বাউল যাকে প্রবর্ত স্তর বলেন আর কী। এই স্তরে তিনি শেখেন শ্বাসাদির কাজ, আসন। সাধক স্তরে যুগল দেহ বাউল মতের ‘ভাবদেহ’ হবার জন্য পাঠ গ্রহণ করে। এই হল মানস দেহ। সিদ্ধিস্তর বাউলের নিমিত্ত দেহ। বিজ্ঞানে, প্রাণে এই তিনাবস্থার উল্লেখ আছে কিন্তু। বাউলের যে সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র সাধনা তা যুগল মিলনে সসীমকে আসলে অসীম করে দেওয়া। তার জন্যই সাধক দেহের প্রত্যেকটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মধ্যে দিয়ে অসীমের জন্য গোপন সংকেত রাখেন। সেই সংকেতের ইন্দ্রিয়গুলোর সাহায্য তিনি নেন। খোঁজাখুঁজি করেন লক্ষ্যস্থলটির জন্য। চতুর্দশ স্থল মঞ্জরীর কথা বলেন সাধক। বলেন শরীরের মধ্যে চোদ্দ কমল ফোটে কীভাবে ফোটে এই কমল? কপালে ভানু মঞ্জরী, চোখে রূপ মঞ্জরী, নাকে কস্তুরী মঞ্জরী, জিভে রস মঞ্জরী, কানে গুণ মঞ্জরী, গলায় ভূঙ্গ মঞ্জরী, দুই স্তনে রঙ্গ মঞ্জরী, নাভিতে লবঙ্গ মঞ্জরী, কোমরে কিঙ্কিণী। মঞ্জরী, লিঙ্গে রতি মঞ্জরী, উরুতে মোহন মঞ্জরী, পায়ে পদ্ম মঞ্জরী, হাতে বিলাস মঞ্জরী, হৃদয়ে প্রেম মঞ্জরী। সাধক বাউল সাড়ে চব্বিশ চন্দ্রে ও অষ্টম চন্দ্রে যে প্রত্যঙ্গগুলো স্পর্শ করেন সেখানে কিন্তু বৈষ্ণবীয় আধারের চোদ্দ মঞ্জরীই বর্তমান। সাধন-করনখে চুম্বন। করেন পুরুষ ও প্রকৃতি। অর্থাৎ কিনা তাঁরা বিলাস মঞ্জরীতে বিচরণ করেন তখন। যা কিছু চাওয়া-পাওয়া সব তাঁরা নষ্ট করে বসেন। পদনখে যখন চুম্বন চলে তখন থেকেই বর্ধিত শোভা উপরের দিকে উঠতে থাকে। পায়ে পদ্ম মঞ্জরী বর্তমান। শোভা খুলতে থাকে প্রতীকী এই পদ্মরূপে। গলাতে যখন চুম্বন চলে তখন যেন ভ্রমরের মতোই স্বর নিক্ষিপ্ত হয় (যাকে। কামশাস্ত্রে শীকার বলছে)। গলায় তাই ভৃঙ্গ মঞ্জরীর কল্পনা। অধরে বা ঠোটস্থ চুম্বনের অর্ধস্ফুট আওয়াজও ভৃঙ্গ মঞ্জরীতে আমরা রাখতে পারি। জিভের চুম্বনে লালা নির্গত হতে থাকে, মিশে যেতে থাকে তা এ-জিভে ও-জিভে। এখানে রস মঞ্জরীর অবস্থান। ললাটে চুম্বনকালে তেজ বা জ্যোতি নির্গত হতে থাকে। মনে রাখতে হবে ব্রহ্মরন্ধ্র কিন্তু সহস্রার চক্রতেই বিরাজমান। একে ভানু মঞ্জরী হিসাবে প্রতীককল্প দিচ্ছেন সহজিয়া বৈষ্ণব। অষ্টম চন্দ্রের মুখে যদি চুম্বন চলে তাহলেও সেটাকে ভৃঙ্গ মঞ্জরীরে রাখতে পারি আমরা। কেননা মুখ থেকেই মধুর বচন নির্গত হয়। স্তনের চুম্বনে আমোদ বা আনন্দ লাভ হয়। একে বলা হচ্ছে রঙ্গ মঞ্জরী। হাতের চুম্বনেও বিলাস মঞ্জরীকে ভাবতে পারি। বুকের চুম্বনে প্রেম মঞ্জরীকে। বুকের ভেতরই তো মন বা হৃদয়ের সিংহাসনকে রাখি আমরা। নাভি চুম্বনে ফুল। আধার দিলে তা অবশ্যই লবঙ্গ মঞ্জরী। যোনি চুম্বনকে উরুর মোহন মঞ্জরীর প্রতীক হিসাবে কল্পনা করে নিতে পারি।

এখন প্রশ্ন এই সাড়ে ২৪টি স্থান স্পর্শ বা চুম্বন করা হয় কেন পুরোপুরি সম্ভোগ বা মিলনের আগে? করা হয় এই কারণেই, বাউল কামে থেকে নিষ্কামী হবার কথা বলে থাকেন। তাঁরা সঙ্গিনীর এই সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র চুম্বন বা স্পর্শ করে কামকে ভোঁতা করে। দেন। কাম তখন প্রেমের দিকে ধাবিত হয়। এমন তাঁদের সাধনার বিশ্বাস। অষ্টম চন্দ্রও স্পর্শ বা চুম্বন এ কারণেই হয় বা হয়ে থাকে। তা এই কার্যকরণ সাধক কি সঙ্গিনীকে করেন কেবল? নাকি সঙ্গিনীও সাধকের সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র চুম্বন করে থাকেন? উত্তরে মতান্তরে আছে। তবে প্রবীন প্রাজ্ঞ বাউল শশাঙ্কশেখর দাস বৈরাগ্যের মতকে গুরুত্ব দিলে তা দাঁড়ায় সাধকই তা করেন। সঙ্গিনীকে সাধনার জন্য প্রস্তুত করে নেন সাধক।

নবকুমার আমাকে বলেছিলেন, সঙ্গিনীও সাধকের সাড়ে চব্বিশ চন্দ্রকে জাগায়।

বললাম, অনেকে বলেন সাধক তা একা করেন।

বললেন, কখনও না। দুই গণ্ডে দু’বার যে তা ওই দুজনেরই না কি?

আমি তাঁকে আর বললাম না, দুই গণ্ডকে যদি গলার দু’ধারের স্পর্শ বলি তাহলে কি খুব ভুল ধরব? একথা তাঁকে আর বলা হয়নি। তার আগেই গান ধরলেন তিনি–

যদি হয় মহাভাবুক জেলে,
ধর্ম মাছ ধরতে পারে
ভাবের দ্বারে গুরু-ভাব-ভক্তি জাল।

বুঝলাম, চন্দ্র সাধনে আমার কথা তাঁর পছন্দ হয়নি। তাই যাদুবিন্দুর পদ গেয়ে আমার ভেতর যাতে গুরু-ভাব-ভক্তি–এসব আসে তারই ইঙ্গিত দিতে চাইছেন। নবকুমার।

*****

………মন্ত্ৰার্থ, মন্ত্র চৈতন্য, যোনিমুদ্রা না জেনে শতকোটি জপ করলেও মন্ত্রে সিদ্ধিলাভ হয় না। কেননা শরীরস্থ চক্রে যোনিমুদ্রাতে দেবদেবীর প্রতীকী রূপের কল্পনা রেখেই সাধক ধ্যানজপ করেন তাই সেগুলো সম্পর্কে সঠিক অভিহিত না থাকলে মন্ত্রজপে শরীর শক্তির জাগৃতি আসতে পারে না কিছুতেই।………

…..গাইছিলেন বাউল:

চাঁদের বিবরণ জানে যে জন সুজন বলি তারে
চাঁদ অমাবস্যা হলে চলে যায় পাও-তলে দক্ষিণ কনিষ্ঠ আঙুল ভিতরে
চাঁদ প্রতিপদ হলে চলে যায় পাতালে দ্বিতীয়াতে মিলে পায়ের উপরে
থাকে তৃতীয়াতে পায়ের গোছোতে মিলে চতুর্থীতে হাঁটুর উপরে।।
পঞ্চমীতে তায় জানুর উপর রয় ষষ্ঠীতে কোমরেতে যায়
সপ্তমীতে স্থিতি নাভিতে বসতি অষ্টমীতে রয় বক্ষ মাঝারে
নবমী যোগেতে কণ্ঠ ‘পরে আসে দশমীতে ঠোঁটের উপরে
একাদশ যোগে থাকে নাসিকাতে মিলে দ্বাদশ চোখের ভিতরে
ত্রয়োদশী হলে যায় কপালে চতুর্দশীতে পূর্ণিমা যে
পূর্ণিমাতে রয় পূর্ণ মগজেতে আর্জান বলে ধন্য সাধুতে হরে।।

এই পদে দেহে চন্দ্র পরিক্রমার কথাই বলা হয়েছে। ‘সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র’ পরিক্রমা করেন সাধক সাধিকার শরীরে। সেই পরিক্রমারই বর্ণনা রয়েছে এই গানে। ‘চাঁদ অমাবস্যা হলে চলে যায় পাও-তলে দক্ষিণ কনিষ্ঠ আঙুল ভিতরে’। অমাবস্যা এখানে রজঃপ্রবৃত্তির কাল। যে কালে সাধক চন্দ্র পরিক্রমা শুরু করেন। সঙ্গিনীর পদনখে (পাও তলে দক্ষিণ কনিষ্ঠ আঙুলে ভিতরে), প্রতিপদে চাঁদ অবস্থান করে পাতালে। পাতাল’ এখানে অষ্টম চন্দ্রের যোনি। দ্বিতীয়াতে পায়ের উপরে। তৃতীয়াতে গেছে। চতুর্থীতে হাঁটু। চাঁদ এভাবে সঙ্গিনীর প্রত্যঙ্গ গুলোকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। চাঁদ হল চন্দ্র সাধক। যার চন্দ্ররূপী নাড়ি, চন্দ্র চক্র সব জেগে গেছে। সিদ্ধির পরিস্থিতি তৈরি হয়ে উঠেছে। পূর্ণিমার চাঁদ। সাধকের প্রেমময়তা। জ্ঞান ও বোধিচর্চার গুরুকেন্দ্রিক ভাব-উপলব্ধি। আর্জান শাহের আরেকটি পদে পাই–’আগে পড়গা ইস্কুলে প্রথম যে স্বরে অ-এর স্বর যেও না ভুলে। / অ-এতে অন্ধকার ছিল স্বর বেয়ে আলো করিল/ একা চন্দ্র টলে গেল পক্ষ গেল মিলে।’ ‘চন্দ্র টলা’ মানে গুরু নির্দেশিত সাধনার ভিতটুক নড়ে যাওয়া। ‘টলা’ মানে হল শুক্র বা বীর্য স্খলিত হয়ে যাওয়া সাধিকার যোনির ভেতর। বাউল ‘অটল মানুষ’ হওয়ার কথা সব সময়ে বলে থাকেন। ‘অটল মানুষ’ হল ঈশ্বরতুল্য মানুষ। মূর্তিময়তায় সাধারণত বাউলের বিশ্বাস নেই। ‘ঈশ্বরতুল্য মানুষ’ হল ‘বস্তুরক্ষার মানুষ’। শুক্র সঞ্চয়ের মানুষ। শুক্রের অধগতি না আসা হল ‘অটল মানুষের’ সাধনলব্ধ ফল। সাধক বাউল দেহমিলনে সাধক শরীরকে উধ্বগতি দিয়ে বস্তুরক্ষা করে থাকেন। বাউল সাধনাতেও বস্তু বিসর্জন একেবারে নিষিদ্ধ। বাউল বলে রজঃপ্রকাশের তিনটি দিনে সঙ্গিনীর শরীরে কোনওরূপ কাম থাকে না। তার জন্যই সাধনে শুক্র স্খলিত হয় না। ‘প্রেমজন্ম’ হয়। সন্তান জন্ম হয় না। এই জন্ম সিদ্ধ সাধকের জন্ম। বাউল বলেন কামগায়ত্রী থাকে সাড়ে চব্বিশ চন্দ্রে।………

……দেহসাধক বলেন শরীরে সপ্তপাতাল আছে। যোগক্রিয়ায় সেসব স্থানে অনায়াসে বিচরণ করা যায় দেহসাধক বলেন পায়ের অধোভাগ অতল, ঊর্ধ্বভাগ বিতল (‘পাদাধস্তুবতলং বিদ্যাং তদৃধ্বং বিতলং তথা )। জানু দুটোতে সুতল এবং সন্ধিস্থলে তল (জানুনোঃ সুতলঞ্জৈব তলং চ সন্ধিরষ্ক্রকে।’) গুদমধ্যে তলাতল, লিঙ্গমূলে রসাতল(তলাতলং গুদ মধ্যে লিঙ্গমূলে রসাতলম। ) পায়ের অগ্রভাগে ও কোমরের কটির সংযোগস্থলে পাতাল (‘পাতালং কটিসন্ধৌ চ পাদাদৌ লক্ষয়ে বুধঃ।।’)। সাধক যোগে এই সাত পাতালকে দর্শন করে থাকেন। যাকে বিজ্ঞান বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একেকটি স্তর বা উপাদান হিসাবে দেখছে। দেহসাধক এগুলোকে সব দেহ উপাদান হিসাবেও চিহ্নিত করেছেন। শরীরে সাতটি লোকের কথাও বলে থাকেন সাধক। নাভিদেশে ভূলোক আর হৃদয়ে ভূর্বলোকের অবস্থান। (‘ভূর্লোকো। নাভিদেশেতু ভুবলোকস্তথা হৃদি। ‘)। স্বর্লোক থাকে কণ্ঠদেশে, চোখে মহর্লোক। (‘স্বর্লোকঃ কণ্ঠদেশে তু মহর্লোকশ্চ চক্ষুষি।।’) চোখের উপরে দ্রুদ্বয়ে জনলোক বাউল সাধক এই সন্ধিস্থলকে আরশিনগর বলে থাকেন। আর ললাটে থাকে তপোলোক (‘জনলোকস্তদৃধ্বঞ্জ তপোলোকা ললাটকে।‘)। মস্তকে, সহস্রারে সত্যলোক। অনেকে একে মহাযোনিও বলে থাকেন (‘সত্যলোকো মহাযোনী ভূবনানি চতুর্দশ।‘) সহস্রারেই ব্রহ্মরন্ধ্রের অধিষ্ঠান। বিন্দুধারণ এখানেই সুসম্পন্ন হয়ে থাকে সাধকের। সপ্তলোক ও সপ্তপাতালের সমষ্টিকে দেহসাধক বলেন চতুর্দল ভুবন। বাউল সাধক আবার চোদ্দকে পাঁচ কর্মেন্দ্রিয়, পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও চতুর্ভুজের যোগফল হিসাবে দেখেন। সপ্তপর্বতের কথাও বলে থাকেন। দেহসাধক। দেহের ত্রিকোনে থাকে মেরুপৰ্বত। উর্ধকোণে মন্দর পর্বত (‘ত্রিকোণে চ হিতো মেরুরূৰ্ব্বকোণে চ মন্দরঃ। ) কৈলাস বিষ্ণুস্তদূর্পে চ সপ্তৈতে কুলপর্বতাঃ।।উধ্বভাগে বিন্ধ্য ও বিষ্ণুপর্বত। শাক্তানন্দ তরঙ্গিনী’তে এই ছটি পর্বত আছে। মৎস্যপুরাণ ও বিষ্ণুপুরাণে সাতটি পর্বতের উল্লেখ পাই। তবে নামে কিছুটা পরিবর্তন আছে। মহেন্দ্র, মলয়, সহ্য, শক্তিমান, ঋক ও পরিবার–এই হল সপ্তপর্বত। শরীরস্থ সাতটি দ্বীপের কথাও বলেন সাধক। অস্থিতে জম্বুদ্বীপ, মাংসে থাকে কুশদ্বীপ (‘অস্থিস্থানে মহেশানি! জম্বুদ্বীপো ব্যবস্থিত। মাংসেষু চ কুশদ্বীপঃ ক্রৌঞ্চদ্বীপঃ শিরাসু চ।’) শিরাতে ক্রৌঞ্চদ্বীপের অবস্থান। রক্তে থাকে শাকদ্বীপ (‘শাকদ্বীপঃ স্থিতো রক্তে প্রাণিনাং সর্বসিন্ধযু।‘)। তার উপরে সন্ধিদেশে থাকে শাল্মলি দ্বীপ (‘তদূর্ধ্বং শাল্মলিদ্বীপঃ ক্ষশ্চ লোমসঞ্চয়ে। ‘)। লোমপূর্ণ স্থানে থাকে প্লক্ষদ্বীপ। আর নাভিতে থাকে পুষ্কর দ্বীপ(‘নাভৌ চ পুষ্করদ্বীপঃ সাগ্ৰাস্তদনস্তরম্।।’)। সাতটি সাগরও থাকে দেহে। মূত্রে লবণসাগর আর শুক্রে ক্ষীরোদসাগর (লবণোদস্তথা মূত্রে শুক্রে ক্ষীরোদসাগরঃ। ‘) মজ্জায় থাকে দধিসাগর, তার উপরে চর্মে ঘৃত সাগর ( ‘মজ্জা দধিসমুদ্রশ্চ তদূর্ধ্বং ঘৃতসাগরঃ।।)। বসা বা চর্বি / মেদে থাকে জলসাগর আর কোমরে / কটিদেশে বা রক্তে থাকে ইক্ষুসাগর (‘বসাপঃ সাগরঃ প্রোক্ত ইক্ষু স্যাৎ কটিশোণিতম্।।‘)। শোণিতে থাকে সুরাসাগর (শোণিতেষু সুরাসিন্ধঃ কথিতাঃ সপ্তসাগরাঃ।।)। সাধক এই সাত সাগরের কথা বলে থাকেন। বাউল সাধক দেহে সাত রসের কথা বলে থাকেন। আবার সাতদিনের যে রজঃধারার নাম করেন তাও অনেকটা সাগরস্থ সাতনামের ধারেপাশে চলে আসে।…..

…….রাধাশ্যাম বলছেন দেহতত্ত্ব না জানলে বাউল সাধন কখনও কোনওভাবেই সার্থক আকার নিতে পারে না। কেননা মানবদেহতেই মূলতত্ত্বের বাস। দেহকে ঘিরে থাকে উপলব্ধ-সত্তা। বাউল বলেন আত্মা। আত্মা তাঁদের কাছে ভগবান স্বরূপ। বাউল তো কল্পিত মূর্তির ভগবানে বিশ্বাস রাখেন না সাধারণত বাউলের ভগবান আত্মা। এই প্রাণস্পন্দ যুগল দেহসাধনা থেকে উঠে আসা স্পন্দ। ‘ভগবান’ কথাটিই কিন্তু যথেষ্ট যুগল-দ্যোতক। ‘ভগ’ কথার অর্থরূপ গর্ত। ‘বাণ’ হল লিঙ্গ। বাউলও গুহ্যপ্রতীকে বাণকে লিঙ্গই বলেন। নতুন কোনো আলাদা অর্থের প্রতীকরূপ বাণকে তিনি দেখেন না। যা সচরাচর তারা করে থাকেন। তবে যেটা মনে হয় তাঁদের সব প্রতীককল্পেরই একটা সদর্থক ভাবনা থাকে। ভেবেচিন্তেই বাউল সমাজ প্রতীককল্পগুলোকে তৈরি করেছেন। এখানেও সদর্থক অর্থেই তাঁদের ভেতর ভাবনা কাজ করেছে। প্রতীককে তারা অনুভূতিদেশের আলো দিয়েছেন। দিয়েছেন রক্তশব্দ, সমুদ্রশব্দ সব। যার জন্য প্রতীক প্রাণবন্ত তরঙ্গ তুলছে বাউলেরই গানে। চন্দ্র তাঁদের এমনি এমনি কি বাঁ নাক আর সূর্য ডান নাক হয়ে উঠেছে? মোটেই না। ইড়া পিঙ্গলার তেজদীপ্তি নিয়েই তো তারা ডান-বামের শিরোপা ধরেছে। পূর্ণচন্দ্রকে বাউল প্রেম বলেন। প্রেমের ভেতরে তো চিরকালই নরম মাধুর্য এক জ্বলজ্বল করে, বাউল তাই পূর্ণচন্দ্রকে প্রেম প্রতীকে রেখেছেন। ক্ষীরকেও প্রেম নামেই অভিহিত করে থাকেন তারা। ক্ষীরের জমাট নরম মিষ্টতার সঙ্গে প্রেমের ভাষার উৎসার তো সঠিক অর্থেই যায়। নীর তাঁদের কাম বা রজ। আভিধানিক নীর তো জলসূচক। রজ উন্মোচিত আবরণ তাই সে নিয়েছে বাউল-প্রতীকে। তিন, ছয়, পাঁচ প্রতীকেও তো শরীরের কেন্দ্রগত সব মাংসময়তা আছে। দেহে সপ্তস্বর্গ, সপ্ত পাতালের কথা বলেছেন রাধাশ্যাম গানে। শরীরস্থ প্রলয়ঙ্কর শক্তি সব। সাধকগণ তাঁদের প্রতীকময়তার দেহেই জীবন্ত করে রেখেছে। দেহ ব্ৰহ্মাণ্ড। নিয়েই সহজিয়া তাই অন্তর্লোকের অনুসন্ধিৎসাকেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন গুরুর সংযুক্ত আধারে। দেহকে বাউল ‘পরম পুরুষ’ হিসাবে দেখেন। দেহ আত্মোপলব্ধির একেকটি স্তর। গুরু নির্দেশিত সেই স্তর ভেদ করে সাধক আধ্যাত্মিক উপলব্ধিতে উপণীত হন। আধ্যাত্মিক এই বিকাশ বাউল সাধকের আত্মিক বিকাশ। যুগল সাধনে শরীরস্থ অস্থি চর্মময় আধারে তারা মহারসের আনন্দধারা উপলব্ধ করে থাকেন। বাউল ক্রিয়ামূলক আচরণে চক্রস্থ নাড়িকে সতেজ করে, ষড়রিপুকে দমন করে পঞ্চভূতকে, সপ্তপাতাল আর। সপ্তস্বর্গকে বিকশিত করে সঙ্গিনীর শরীরে সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র ছুঁয়ে, অষ্টম ইন্দুকে প্রতিলব্ধ করে ‘অটল’ হয়ে ওঠেন।……..

…..–কালী তো রতিযোগের নারী ক্রিয়াশীল। তিন রতির এক রতি হল গিয়ে কালী। বিপরীত বিহার করছেন তিনি। শিব নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। যেন মরে রয়েছে। যুগল সাধনায় নিষ্ক্রিয় শিবকে, পুরুষকে তো শক্তি জাগায়। তাই পুরুষ ব্রহ্মলাভের জন্য শক্তিরূপা কালীর কামনাকে হরণ করে নেন। নিণা কালী অর্থাৎ কামনা সগুণা হয়। আর তা হলেই সাধক অটল অমর হয়ে যায়।…..

…..পাঁচ পিড়িতে বসে শিবশঙ্কর গাইছিলেন তিনটি ধারার সঙ্গম স্থল ত্রিবেণীর গান। নারীকে বাউল নদীর প্রতীক দিয়েছেন। যোনি বা জননাঙ্গ হল নারী দেহের নদী। তাঁর স্রোতপ্রবাহ রজঃপ্রবৃত্তির সমাচ্ছন্নতা। বাউল সাধনা রস-রতির মিলন। সাধনমার্গে এই মিলন আত্মার সঙ্গে আত্মার। রজের সঙ্গে বীর্যের নয়। দুই আত্মা বা সাধন শরীরের একত্র মিলনে জন্ম হয় পরমাত্মার। বাউল বলেন তাঁদের সিদ্ধদশার করনকারণ তিনদিনের। সঙ্গিনীর শরীরে রজ-উদয়ের সময়কে তারা অমাবস্যা হিসাবে চিহ্নিত করে থাকেন। ওই দিনে সঙ্গিনীর শরীরে তমগুণের বিকাশ ঘটে। তম হল তামসিক ভাব। অজ্ঞানতা। এই অজ্ঞানতা কামের বশীভূত দশা আসলে। সঙ্গিনীর এই কামের মত্ততাকে সাধক বাউল বলেন ‘জীবাচার’। জীবাচারের ঊর্ধ্বে উঠে যেতে চান তারা। তাই তারা বলেন প্রকৃতি বা সঙ্গিনীর অন্তর্নিহিত সত্তাই হল রজ। পুরুষের বীর্য বা বীজ। এর মিলনে তাঁরা বিশ্বাসী। তাই জন্যই তাঁদের দেহসাধনা। কেননা তাঁদের মিলন জীবাচারের কখনও নয়–জীবাচারের মিলনে রজবীজের মিলন ঘটে দেহের ভিতরে।

প্রাজ্ঞ বাউল শশাঙ্কশেখর একবার আমায় বলেছিলেন, পুরুষ পুরুষ তো নয়।

জিজ্ঞাসা করেছিলাম, পুরুষ তাহলে কে?

বললেন, পুরুষ বীর্য। আর রজ হল নারী। যোনি-লিঙ্গ তাকে নারী-পুরুষ হিসাবে দেখে ঠিকই। আসলে নারী-পুরুষ কেউই তারা নয়, সবাই একেকজন হিজড়া।

জিজ্ঞাসা করলাম, কী হিসাবে একথা বলছেন আপনি?

–দুই দেহেই বাবা রজ-বীর্য থাকে। তাহলে দাঁড়ায় কী না তাঁরা ছেলে, না মেয়ে। সাধনই বাবা হিজড়াকে নারী বা পুরুষের রূপে এনে দেয়।

–কীভাবে আনে?

–তোমার দেহের উর্ধ্বচক্রে বীহ আছে। নিম্নে রজ। স্রোতধারা যে বয় মৈথুনে, ঊধ্বচক্রের বীজ নীচে নামে। বীজ তখন রজ হয়। সাধক রজকে রজর সঙ্গে মিশায় না কখনও। আবারও উর্ধ্বে তুলে বীজ করে দেয়। এভাবে সাধক সিদ্ধ হয়। পুরুষ হয়। অটল হয়।…..

…..জীবাচারে আবদ্ধ যেহেতু মানুষ তাই তাঁরা কামকে উপভোগ করেন। আমাদের কামশাস্ত্র সেই কামোপভোগকে সুন্দর সব ধারাভাষ্যেই চালিত করেছে। আর তা করতে গিয়ে পুরুষ বিভাগ এসেছে—‘শশো বৃষোহশ্ব ইতি লিঙ্গতো নায়কবিশেষাঃ।’ পুরুষের লিঙ্গমাপ অনুসারে তাকে শশ, বৃষ ও অশ্ব–এই তিনভাগে ভাগ করা হয়। যেসব পুরুষের লিঙ্গের দৈর্ঘ্য ছোট তাদের শশকের রূপ দেওয়া হচ্ছে। মধ্যম লিঙ্গ ধারণের অধিকারী পুরুষ বৃষ। আর দৈর্ঘ্যের দিক থেকে বারো আঙুল পরিমাপক যে লিঙ্গ ধারণের অধিকারী পুরুষ তিনি অশ্ব শ্রেণির বাৎস্যায়ন এখানে বোধহয় যথেষ্ট বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন লিঙ্গ পরিমাপক স্যাংখ্যিক হিসাব আনতে। শশ = ছয়, বৃষ = নয়, অশ্ব = বারো। আদতে শেষ দুটো যথেষ্ট রকম বাড়াবাড়ির। পর্ণগ্রাফি এই মাপকে অবশ্য গ্রহণ করে মনোরঞ্জন করছে। আপাতত। নীল ছবিতে তাই এখন ঠাঁই হয়েছে বাৎস্যায়নের বৃষ ও অশ্ব পুরুষের। নারীর তিনটি ভাগ হল–‘নায়িকা পুনমৃগী বড়বা হস্তিনী চেতি।’ নায়িকাও আবার পশুদের সঙ্গে উপমা অনুসারে তিন ধরণের হয়ে থাকে–মৃগী, বড়বা বা ঘোটকী, হস্তিনী। পুরুষের। লিঙ্গের দৈর্ঘ্য অনুসারে ভেদ-সূচিত তিন প্রকারের পুরুষ আর নারীর এই পরিমাপকে যোনির সেই ছয়, আট, বারো আঙুল মাপকেই সামনে আনা হয়েছে। চওড়াতে তাকে স্যাংখ্যিক পরিমাপকের আধার দেওয়া হয়েছে। মিলনে সুখদায়ক অনুভূতির জন্যই কামশাস্ত্রের নির্দেশিকা সব। সেজন্যই শশ শ্রেণীর পুরুষের সঙ্গে মৃগী, বৃষর সঙ্গে বড়বা, অশ্বর সঙ্গে হস্তিনীর মিলন বেঁধে দেওয়া হয়েছে। নারীদের ক্ষেত্রেও শেষ দুই শ্রেণীর বিভাজনকে নীল ছবি পুরোপুরি গ্রহণ করেছে।

চৌষট্টি কলার উল্লেখ আছে কামশাস্ত্রে। মিলনের সময় আলিঙ্গনাদিকে চৌষট্টি প্রকার হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে—‘আলিঙ্গন-চুম্বন-নখচ্ছেদ্য-দর্শনচ্ছেদ্য-সম্বেশন সৌকৃত-পুরুষায়িতৌ-পরিষ্টকানাদ্মষ্টানমষ্টধা।’ আলিঙ্গন, চুম্বন, নখ দিয়ে আঘাত করা, দাঁত দিয়ে উত্তেজনা জাগানো, অঙ্গমর্দন করা, উত্তেজিত অবস্থাতে সাড়া দেওয়া, মিলন, চূড়ান্ত পর্বের পর স্থিতাবস্থা–এই আট প্রকার ভেদের প্রত্যেকটির আট ভাগের উপবিভাগ করে চৌষট্টি কলার কথা বলা হয়েছে। তবে একথারও উল্লেখ আছে যে, মিলনে সব সময়ই যে চৌষট্টিটি দশার সূত্রপাত ঘটবে এরকম কোনো কারণ নেই। বিশেষণ হিসাবে বলা হয়েছে সপ্তপর্ণ অর্থাৎ কিনা ছাতিম গাছের প্রত্যেক পল্লবেই যে সাতটি করে পাতা থাকবে বা পূজা সবসময় যে পঞ্চাপচারে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা যেমন নেই তেমনই মিলনে যে সব সময় এই চৌষট্টিকলার প্রয়োগ ঘটবে এরও কোনো মানে নেই। পদাবলি আমাদের কিন্তু চৌষট্টি নায়িকার সন্ধান দিয়েছে। আবার আমরা চৌষট্টি রসের কীর্তনের সম্বন্ধেও কিন্তু অবহিত আছি। বৈষ্ণবীয় আচরণে চৌষট্টি প্রকার সেবারও উল্লেখ পাই। বৌদ্ধ-সহজিয়াতেও চৌষট্টি পাপড়ির পদ্মের কথা উল্লেখ আছে। আমাদের শরীরস্থ যে সপ্তম পদ্মচক্র তাঁর দলকেও কিন্তু চৌষট্টিদল বিশিষ্ট হিসাবে দেখানো হয়েছে। বাউলও তাঁর গানে চৌষট্টির প্রতীককে সামনে এনেছেন। মানবদেহকে কোলকাতার সঙ্গে তুলনা করে পদকর্তা বলেছেন: ‘তাঁর বাইরে আলো ভিতরে আঁধার / মানবদেহ কলিকাতা অতি চমৎকার / চৌষট্টি গলির মাঝে ষোলোজন প্রহরী আছে / তিনশত ষাট নম্বরে হয় রাস্তা বাহাত্তর হাজার।’ চৌষট্টি গলি হল রক্তবাহী প্রধান ধমনী, তা সংখ্যারূপ। যেটা বলতে চাইছি তা হল: চৌষট্টির রূপক, প্রতীকী আবেগ-ইচ্ছা-অনুভূতি ব্যক্ত যে কুক্ষিগত আচরণ। তা অতি আবশ্যিক উপাচার। কখনও তা সুখদায়ক কামাচারের কখনও বা তা সাধিত অনুশাসনে আচ্ছন্ন দেহাচারের। আটটি ভাবের উল্লেখ আমরা পাই দেহসাধনায়–স্তম্ভ, স্বেদ, রোমাঞ্চ, স্বরভঙ্গ, বেপথু, বৈবর্ণ, মূৰ্ছা ও অশ্রু। অষ্টশক্তির কথাও বলে থাকেন সাধক। অণিমা, লঘিমা, ব্যাপ্তি, প্রকাম্য, মহিমা, ঈশিত্ব, বশিত্ব, কামবসায়িত। অষ্টপাশের কথাও বলে থাকেন সাধক বাউল–ঘৃণা, লজ্জা, শঙ্কা, ভয়, জিগীষা, জাতি, কুল, মান। এই অষ্টরূপকে কিন্তু আমরা কামশাস্ত্রেও দেখে থাকি। সেখানে ললাট, অলক, কপোল, নয়ন, বক্ষ, স্তন, ওষ্ঠ ও মুখের মধ্যে চুম্বনের উল্লেখ আছে। চৌষট্টিকলার একটি রূপ নখচ্ছেদ্য। তাকেও আবার আটটি স্থানে রাখা হয়েছে–বগল,স্তন, গলদেশ, পৃষ্ঠদেশ, জঘন, কটির একদেশ, কটির পুরোভাগ, নিতম্ব–এই আট স্থানে নায়কের নখক্ষত সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। বাউল কিন্তু অষ্টম ইন্দু বা অষ্টম চন্দ্ৰস্পর্শের কথা বলে থাকেন। তাহলে এই আটের ব্যবহার দু’ধারায় আছে। সুখদায়ক কামাচারেও রয়েছে আটের বহুরূপী প্রতিফলন। আবার সাধনাচারের আট চেতনাসম্পৃক্ত এক অধ্যায়। এই চেতনা কামকে প্রেমে সমুজ্জ্বল ও ঋদ্ধ করে নিয়ে আত্মাকে সংগৃহীত পরমাত্মার সঙ্গেই মিলিয়ে দেওয়া। বাউল সাধনে এ যেন এক শৌর্য প্রদর্শন। তন্ত্র তথা সমস্ত যুগল দেহসাধনার সম্মিলিত চেতনা, আশা, উদ্বেগ, প্রেরণা, প্রতিজ্ঞা, প্রার্থনা–এগুলো সবই দাউ দাউ আদর্শের গহন শিখা।

শিবশঙ্কর গানে ‘ত্রিবেণী সংহতি’কে তিন রতির উর্ধ্বাঙ্গই দিয়েছেন। তিন রতি, তিন নদীরূপী স্রোতধারা, বাউল প্রতীকের ‘রূপ সায়রের তিনধারা’। প্রথম দিনের মিলনে বাউল বলেন গুণের মানুষ উঠে আসবে। এই গুণ তমগুণ। দ্বিতীয় দিনে রসের মানুষ। তৃতীয় দিনে সহজ মানুষ। বাউল বলেছেন: ‘যখন নদী হয় উথলা তিনজন মেয়ের লীলাখেলা।’ কীভাবে হয় এই লীলাখেলা?

চৈতন্যচরিতামৃতে বাউলের তিন রতিকে তিন বাঞ্ছা হিসাবে দেখা হয়েছে। বলা হয়েছে: ‘তিন বাঞ্ছ পুণ্য করি রস আস্বাদন।।/ আলিঙ্গনে ভাব পুণ্য কান্তিতে চুম্বন। / সিঙ্গারে প্রেমরস বাঞ্ছিতপূরণ।।/ পিরিতি আনন্দময় চিন্ময় কেবল। / সেইভাবে বস হইয়া করে সম্বল।।/ নিজরূপে স্বয়ং রূপে এক রূপ হয়। / এক দেহ সে জানিহ নিশ্চয়/ নিজরূপে সঅং রূপ এক দেহ হয়। গোলোক বৃন্দাবন বলি অতএব কয়।’ বাউলের এই লীলাখেলাতে প্রথম চারচন্দ্র ভেদ করতে হয়। সঙ্গিনীর রজ গুরু যোগাড় করে রাখেন। তা সাধক বাউলকে পান করতে হয়। কেউ বলেন সঙ্গিনী নিজে তা পান করেন। আবার কেউ বলেন না, সঙ্গিনীর কাজ তা নয়। পান করে থাকেন কেবল সাধক বাউল, যথেষ্ট মতভেদ আছে এই ক্রিয়াকরণে। এই পান ক্রিয়াকে তাঁরা বলেন গ্রহণ। অর্থাৎ শরীরের জিনিস শরীরেতে ফিরিয়ে নেওয়া। এটাই তাঁদের ভেদ। চার চন্দ্রের একচন্দ্র ভেদ। তারপর মূত্র যতবার হবে তা নারকেল মালা বা পাত্রে ধরে আবার শরীরে ফিরিয়ে আনা। মল হাতের তালুতে ফেটে খাওয়া আর বাকিটা শরীরে মাখা। এই চারচন্দ্র ভেদকে বাউল ব্রহ্মচর্যদশা বলেন। এরপরই মিলন দশা আসে। তবে ব্রহ্মচর্যে কতদিন পর রসরতির মিলন হবে তা নিয়েও যথেষ্ট মত পার্থক্য আছে। কেউ এক মাস, ছ মাস, দশ বা বারো মাসের কালক্ষেপের কথা বলেন। তবে সেই অপেক্ষা-যোগ এখন এতখানি সময় পর্যন্ত মানা হয় কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কেননা বাউলকে তো এখন তাড়াতাড়ি সিদ্ধ স্তরে পৌঁছতে হবে। তবে না তাঁর পসার জমবে। ভক্তশিষ্য তৈরি হবে। খ্যাতি রটবে। যেটা মনে হয় চারচন্দ্র ভেদ একটা নিমিত্তকরণ। আসলে যে করণকার্য তা তো নাড়ির। ইড়া নাড়ির, পিঙ্গলা নাড়ির, সুষুম্না নাড়ির। শরীরের বাইরের বায়ুকে প্রথমে বাঁ নাক দিয়ে টেনে কিছুক্ষণ সেই বায়ু বাঁ নাকে রেখে তাকে আবার ডান নাকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। বায়ু যখন টেনে অভ্যন্তর পূরণ করা হয় তখন তা পূরক। এতে উদর জলপূর্ণ কলসির মতো বায়ু জমা থাকে তাই তা কুম্ভক আর যখন তা ডান নাক দিয়ে বের করে দেওয়া হয় তখন তা রেচক। এই যোগশিক্ষাই বাউল সাধককে ক্রিয়াকরণে আসলে সাহায্য করে। মিলনে এর সাহায্যেই বাউল মূলাধারের শুক্রকে ব্রহ্মরন্ধ্রে উঠিয়ে নিতে পারেন। তাই চারচন্দ্র ভেদ না হয় হল কিন্তু শ্বাসক্রিয়া ঠিকঠাক না হলে শুধু চারচন্দ্র ভেদ, ব্রহ্মচর্যের দীক্ষার কি মূল্য আছে? আসল হল শরীর গঠন। তা ভেদে হয় ঠিক কিন্তু সেই ভেদ বায়ুভেদ বায়ুকেই বশ করেন সাধক। তবে বাউল ‘দমের কাজ’ করার কথা সব সময়ই বলেন।

শিবশঙ্কর আমাকে বলেছিলেন, দম হল দমন রিপুকে, রতিকে দমন।…..

…..দেহ মিলনের সময় মদন, মাদন, শোষণ, স্তম্ভন, সম্মোহন–এই পঞ্চবাণের ক্রিয়ার কথা বলে থাকেন বাউল সাধক। লালনের গানে আমরা পাই—’পঞ্চবাণের ছিলা কেটে/ প্রেম যজ স্বরূপের হাটে। সিরাজসাঁই বলে রে, লালন, / বৈদিক বাণে করিস নে রণ, / বাণ হারায়ে পড়বি তখন রণ-খোলাতে হুবড়ি খেয়ে।।’

‘বৈদিক বাণ’ কী? দেহমিলনের সময় কামই কামের একান্ত পরিনাম। কামকে উপভোগ্য স্তরে নিয়ে যাবার জন্যই নরনারী নানা প্রত্যঙ্গে নানারূপ ক্রিয়াকরণে মেতে ওঠেন। কেননা কামকে তাঁরা চুড়ান্ত রূপে ভোগ করতে চান। তার জন্যই কামশাস্ত্রে যৌনমিলনের প্রস্তুতিস্বরূপ নানা আলিঙ্গন, চুম্বন, দেহে নখচিহ্নের স্মরণীক অধ্যায়, দন্তক্ষতের রূপকল্প, ভঙ্গি বা আসন, শীৎকার ধ্বনির নানা রূপের কৌশলক্রিয়ার কথা লেখা হয়েছে। যাতে কাম, সম্ভোগক্রিয়া একেবারে উত্তেজক অধ্যায়ে চলে আসে। নরনারী তৃপ্তি লাভ করেন। বাস্তবিক এই তৃপ্তি। রিপুর উত্তেজনা থেকেই এই আকর্ষণ, মিলন। যে মিলনে তৃপ্তির সাথে সন্তান জন্মেরো এক বিধিবদ্ধ অধ্যায় আছে। তাই বলা ভালো, এই কাম-প্রবর্তিত দেহ-মিলন এবং এতে সন্তান সৃষ্টিই হল বৈদিক বাণ। লালনের গানে এই বাণকৌশলের ইঙ্গিত রয়েছে। বাউল বলেন, বিশ্বাস রাখেন যে, এই পঞ্চবাণের যে ক্রিয়া তাতে রয়েছে কেবল চূড়ান্ত সম্ভোগক্রিয়ায় কামকে উপভোগ। এই কাম ভোগমূলক। লালনের পদে, গুরু সিরাজ সাঁই তাই লালনকে বলছেনেই পঞ্চবাণের ছিলা কেটে ফেলতে হবে। দেহকে কামক্রিয়ার ভেতর না রেখে দেহকে ব্যবহার করতে হবে স্বরূপতত্ত্বকে জানার জন্য। তার জন্যই বাউল সাধক দেহ থেকে কামকে তুলে ফেলে প্রেমে রূপান্তরিত করে ফেলেন। ঠিক যেমন দুধ থেকে সর তুলে মাখন বা ঘি বানানো হয়। কীভাবে বাউল সাধক এই পঞ্চবাণের ছিলা কেটে ফেলেন?

পঞ্চবাণের প্রথম যেটি মদন, বাউল বলেন সেটি কামরতির প্রথম সিঁড়ি। এই সিঁড়ি তিনি টপকে যান কীভাবে? অমাবস্যায় প্রথম মিলনে সঙ্গিনীর দেহের স্পর্শকাতর প্রত্যঙ্গগুলোকে তিনি স্পর্শ করে সঙ্গিনীর শরীরে কামের বাণকে আরো যেন শানিয়ে দেন। উত্তেজনা বৃদ্ধি করে দেন সঙ্গিনীর শরীরে। এই স্পর্শ করনখে, পদনখে, গলায়, অধরে, জিহ্বায়, ললাটে বাউল বলেন সাড়ে চব্বিশ চন্দ্ৰস্পর্শর কথা। করনখে দশ, পদনখে দশ, দুই গলায় দুই, অধরে এক, জিহ্বার এক, ললাটে দেড়। মূলত দৃষ্টিস্পর্শর কথা তাঁরা বলে থাকেন। কীভাবে হয়ে থাকে এই চক্ষুস্পর্শ। আমাদের শরীরস্থ সুষুম্না নাড়ি মূলাধার চক্র থেকে উৎপন্ন হয়ে নাভিমণ্ডলের যে ডিম্বাকৃতি নাড়িচক্র আছে, তার ঠিক মাঝখান দিয়ে উঠে গিয়ে সহস্রার চক্রের ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত চলে গিয়েছে। সুষুম্না নাড়ির বাঁ দিকে রয়েছে ইড়া নাড়ি। দক্ষিণ বা ডানদিকে রয়েছে পিঙ্গলা নাড়ি। এই দুই নাড়ি দু’দিক থেকে উঠে স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত ও বিশুদ্ধ চক্রকে ধনুকাকারে বেষ্টন করে আছে। ইড়া দক্ষিণ নাসাপুট পর্যন্ত এবং পিঙ্গলা বাম নাসাপুট পর্যন্ত গমন করেছে। মেরুদণ্ডের মধ্যে দিয়ে সুষুম্না নাড়ি ও মেরুদণ্ডের বাইরে দিয়ে পিঙ্গলা নাড়ি চলে গেছে। বাউল সাধক দক্ষিণের পিঙ্গলা নাড়িতে কিছু সময় নিঃশ্বাস প্রশ্বাস প্রবাহিত করে দক্ষিণ চোখে দৃষ্টিকে নিবদ্ধ করে রাখেন। মদন বাণের সময় ইড়া নাড়িতে(বাঁ নাকে) শ্বাসগ্রহণ করে মদন বাণের সময় পিঙ্গলাতে নিয়ে যান। মাদনের সময় ডান বা দক্ষিণ নাকে শ্বাসগ্রহণ করে সঙ্গিনীর শরীরে উত্তেজনা বৃদ্ধি করেন। দক্ষিণ বা ডান দিককে তাঁরা বলেন কামের অবস্থা। সেজন্য তাঁরা দক্ষিণকে পরিত্যাগ করেন। শোষণ বাণের সময় তাঁরা যোগাভ্যাসের ক্রিয়াকে চালিত করেন। লিঙ্গ নালে উত্থিত শুক্রকে তাঁরা ঠেকিয়ে রাখেন। স্তম্ভন বাণে যুগল শরীরেই একটা। স্থিরতা আসে। শ্বাসাদির কাজ কিন্তু কিছুটা বাউল সঙ্গিনীও করে থাকেন। বিশেষত কুম্ভক প্রক্রিয়া। স্তম্ভন বাণের সময়ই দেহের বিভিন্ন স্পর্শকাতর অংশ স্থির অচঞ্চল হয়ে পড়ে। সাধক তখন চরম দশায় উত্তীর্ণ হয়ে যান। সম্মোহনের সময় তাঁদের দেহস্মৃতি লুপ্ত হয়। বাহ্য দেহে বিপুল আনন্দের তরঙ্গ উত্থিত হয়ে পড়ে। এরপরই তাঁরা বলেন পরমাত্মার বিকাশ ঘটে। নাভিপদ্ম থেকে হৃদয়পদ্মে এই অনুভূতির জাগরণ ঘটে। এতে তাঁরা নানা। সুমধুর ধ্বনি শুনে থাকেন। পরিশেষে যখন চরম পরিণতি আসে তখন আজ্ঞাচক্রের দ্বিদলপদ্মে তাঁরা মনের মানুষকে উপলব্ধ করে থাকেন। এখন প্রশ্ন বাণক্রিয়া যদি শুধু চক্ষুস্পর্শেরই হবে তবে স্তম্ভন বাণের সময় দেহ স্থির অচঞ্চল হয়ে পড়ছে কেন? যেটা। মনে হয় চন্দ্ৰস্পর্শ। অষ্টমচন্দ্র স্পর্শ এগুলো কোনওটাই আসলে চক্ষুস্পর্শ নয়। প্রত্যঙ্গকে। প্রত্যক্ষ ছোঁয়া। মদনের সময়ই তা শুরু হয়। শ্বাসক্রিয়া দিয়ে সাধন সঙ্গিনীর অঙ্গ স্পর্শ করেন আর সঙ্গিনীও শ্বাসাদির চোখে সাধকের অঙ্গকে নিজ শরীরে একীভূত করে নেন। কামশাস্ত্র মিলন ক্রিয়ার সময় চার প্রকার আলিঙ্গনের কথা বলেছে। সঙ্গিনী সঙ্গীর দিকে আসতে থাকলে যদি তাকে আলিঙ্গন করা সম্ভব না হয়, অথচ সঙ্গিনীকে সঙ্গীর অনুরাগ জানানোর প্রবল ইচ্ছে তখন সঙ্গী অন্য কোনও কাজ করবার ছলে, বুদ্ধি করে সঙ্গিনীর পাশ দিয়ে যেতে যেতে তাঁর শরীরে নিজের শরীর স্পর্শ করবে। একে সৃষ্টক আলিঙ্গন(slight contact) বলে। সঙ্গী কোনও নির্জন স্তাহ্নে থাকলে তাকে সেই অবস্থায় দেখে সঙ্গিনী যদি কিছু নেবার ছলে সেখানে গিয়ে স্তন দিয়ে সঙ্গীকে আঘাত করে তখন সঙ্গী সঙ্গিনীকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে যদি নিজের শরীরে চেপে রাখে সেটা বিদ্ধক আলিঙ্গন (Breast Pressure Embrace)। অন্ধকার জায়গাতে সঙ্গিনীর শরীরের। সঙ্গে সঙ্গী যখন উধৃষ্টক আলিঙ্গন (Huffing Embrace)। আর সঙ্গিনী এবং সঙ্গী যখন উদৃষ্টক আলিঙ্গনে আবদ্ধত অবস্থার কথা ভেবে একা একাই নিজের দুহাত চেপে নিজেকে জড়িয়ে নেয় সেটা পীড়িত আলিঙ্গন (Pressive rubbing embrace)। কামশাস্ত্রে চুম্বনের সঙ্গে পাঁচটি ব্যাপারকে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে–চুম্বন, নখক্ষত, দক্ষত, প্রহণন ও শীক্কার। তবে কামশাস্ত্র কখনওই মিলনক্রিয়ার সময়, তিথি নির্দেশ করেনি। বাউল সাধনে মিলন সময় নির্ণীত। ইড়া নাড়িতে যখন পুরুষের শ্বাস বইতে থাকে। অর্থাৎ চন্দ্র বাঁ নাকে আর সঙ্গিনীর পিঙ্গলা নাড়িতে বাঁ নাকে শ্বাস চলে তখনই মিলনের প্রশস্ত সময় বলে থাকেন বাউল গুরু। এই সময়টা রাতে খাবার ঘন্টা দুই পরে আসে বলে বাউল বলে থাকেন। এটিকে সাধক অর্ধপ্রহর হিসাবে চিহ্নিত করে থাকেন। সময়কাল তাঁরা বলেন দেড় থেকে দুই ঘণ্টা স্থায়ী হয়। এই ক্রিয়ার আরম্ভের সময় প্রথম চলে আলাপন। পরস্পর স্পর্শ করে পরস্পরের প্রত্যঙ্গগুলিকে। তারপরই শুরু হয়ে যায় দমের খেলা। অনেক সাধক বলেন এই সময় কাম-বীজ জপ করতে হয়। আর সঙ্গিনীকে কাম গায়ত্রী।…..

…..মনোহর খ্যাপার গানটিতে ‘জলের দরজায় জলের চাবি খুলা’ বলতে ইঙ্গিত করা হয়েছে সঙ্গিনীর রজঃপ্রবাহের তিন দিনকেই। আর এই তিন দিনই সাধক বাউলকে ‘উল্টা স্রোতে নৌকা বাইতে হয়। বাউলরা বিশ্বাস করেন, মানেন শরীরের ভেতরই পরমেশ্বরের সিংহাসন পাতা। তাঁকে লাভ করাই সাধক জীবনের মোক্ষ। কীভাবে তা সম্ভব? গুরুর শেখানো দম ও শ্বাসের কাজে–হঠযোগে, কুম্ভকে, পূরকে, রেচকে বীর্যের নিম্নগতিকে তাঁরা রুদ্ধ করে দেন। ওপরে উঠিয়ে দিতে তাঁরা পারেন। বীর্য নারীর যোনিতে রমণের পর চিহ্নস্বরূপ লেগে থাকবে না। রীতিমত সেখানে যোনি পরীক্ষার নিয়ম। দুটো শব্দ বাউল ব্যবহার করেন। বিন্দুধারণ’ আর ‘বিন্দুপতন। তার মানে হল বীর্যের গতিবেগকে ওপরে উঠিয়ে নাওয়া হল বিন্দুধারণ। পতন হল বাউল বলেন–’যোনিতে পতন।‘ মানে রমণে বীর্যপাত হয়ে যাওয়া। এই মিলন হয় সঙ্গিনীর রজঃপ্রবাহের তিন তিনটে দিন। বাউল বলেন এই এর উৎকৃষ্ট সময়। এই তিন দিন তাঁরা কামকে এই প্রক্রিয়ায় শুদ্ধ স্তরে, তাঁদের মতে প্রেমে রূপান্তরিত করেন। মেয়েদের রজঃপ্রবাহের তিন তিনটে দিন বাউলের ভাষায় ‘মহাযোগের সময়’। ঠিকঠাক উত্তীর্ণতায় বাউল সিদ্ধ স্তরে। পৌঁছান। তাঁরা বলেন নারী শরীরের মধ্যে ষড়দল, চতুর্দল, শতদল পদ্ম আছে। সে সব জেনে বুঝে তারপর হবে ‘জেন্তে মরা’ ‘জেন্তে মরা’ হল কাম থেকে প্রেমে নিষ্কামী হওয়া।

আমাদের প্রশ্ন, নারী শরীরের মধ্যে যে ষড়দল, চতুর্দল, শতদল পদ্মের কথা বাউল বলেন তা শুধু নারী শরীর কেন পুরুষ তথা মানব শরীরেও বর্তমান। তবে বাউল সাধক শুধু নারী শরীরে থাকবার কথা বলছেন কেন? শরীরের নটা চক্রে এই সব পদ্মরূপের কল্পনা করা হয়েছে। কারণ হল পদ্ম কাদায়, পাঁকে জন্মায় কিন্তু নিজে সে পঙ্কিল হয় না। কাদার উপরে সুন্দর ফুল হিসাবে ফুটে থাকে। রামকৃষ্ণদেব আমাদের সংসারে পাঁকাল মাছের মতো থাকবার কথা বলেছেন। পাঁকাল মাছও পাঁকে জন্মায় অথচ গায়ে পাঁক থাকে না। এই কাদা বা পাঁক হল প্রতীকী অর্থে মায়া। এই মায়াকে ভেদ করে পদ্মফুল ফুটছে। পদু সূর্যের আলো পেলেই তার পাপড়ি খোলে। তেমনই আমাদের শরীরের পদ্মগুলো তাঁদের দল খোলে কুণ্ডলিনী শক্তি জেগে উঠলে। সূর্যের আলো থাকা সত্ত্বেও যদি পদ্মের উপর জল ছিটিয়ে দেওয়া হয় তবে দেখা যাবে পাপড়িগুলো সব মুড়ে যাচ্ছে। সাধক বলছেন মানুষকে হতে হবে এই জলের উপরে ফোটা পদ্মের মতো পদ্মের পাপড়ি যেমন গায়ে জল পড়লে গুটিয়ে যায় তেমনই ইন্দ্রিয়ের আচরণগুলোও বদ্ধ হয়ে যেতে পারে বিরূপ আচরণে। যার জন্যই যোগক্রিয়ায়, সংযমে তাকে জাগিয়ে রাখতে বলছেন সাধক। যোগীতন্ত্রগুলো আমাদের সেই পথেই নির্দেশিত করেছে বারবার। যোগীগুরু, তন্ত্রসাধকরা এই সব পদ্মে ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়েন। মানে শরীর ক্রিয়ায় শরীরকে জাগান। উপাসনা করেন। তন্ত্র সাধনাতেও সঙ্গিনী অনিবার্য। ভৈরবের ভৈরবী অবশ্যই দরকার। তবে তাঁরা রমণের পূর্বে যোনি পূজা, বুক, ললাট, কণ্ঠ, লিঙ্গ ইত্যাদি প্রত্যঙ্গর পূজা সারেন। বাউল তা করেন না। তবে তাঁদের মতও তান্ত্রিক ক্রিয়াকর্মেরও মত সেই কাম থেকে প্রেমে নিষ্কামী হওয়া। আমাদের প্রশ্ন, যে কোনো মিলনই, নারী-পুরুষের একত্র সম্ভোগই তো আনন্দের, উপভোগের শুধু লোকায়ত সাধনার মিলনে করণকৌশল যেটা তা হল যোনিতে বীর্যপাত ঠেকানো। বস্তুরক্ষা। বাউল নারীর শরীরে এই পদ্ম, ওই পদ্ম বলে সাধন সঙ্গিনীকে মনে হয় উচ্চাসনই দিতে চান। কিন্তু এটা তো ঠিক লালন ফকির, চণ্ডীদাস গোঁসাই, হাউড়ে গোঁসাই, পদ্মলোচন, দুদ্দু শাহ প্রভৃতি পদকর্তারা তাঁদের সব ক্রিয়াকরণের গানে নারীকে যে সম্মান প্রদান করেছেন সে সম্মান বাস্তবে নারীর বা সাধন। সঙ্গিনীর এখন নেই। তার কারণ অবশ্যই পুরুষের, সঙ্গীর, সাধকের ব্যভিচার। না হলে আমাদের লোকায়ত সাধন আধার কিন্তু নারীকে যোগ্য আসনই দিয়েছিল। কী তন্ত্র, কী বৈষ্ণব, কী বাউল সাধনে। বাউল, সঙ্গিনীটিকে ‘রাধারানি’, ‘মনের মানুষী’ ইত্যাদি বিশেষণের মালা পরান ঠিকই যেমন তন্ত্রে ভৈরব সঙ্গিনীকে, ভৈরবীকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেন। আসলে এই বিশেষণ, সম্বোধন, মান্যতা, যথাযোগ্য প্রাপ্য স্বীকৃতি সব ছিল এখনকার কারও রচনা নয়। বেশির ভাগটাই সাধক পদকর্তাদের।…..

…..শাস্ত্রে বলছে–’ন তপস্তপ ইত্যাহুর্ব্রহ্মচর্য্যঃ তপোত্তমম্। / উৰ্দ্ধরেতা ভবেদ্‌ যস্তু স দেবো ন তু মানুসঃ।।‘ ব্রহ্মচর্য অর্থাৎ বীর্যধারণই সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট তপস্যা। যে ব্যক্তি এই তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে উৰ্দ্ধরেতা হয়েছেন, তিনিই মানুষ নামের প্রকৃত দেবতা। বাউল যাকে ‘বিন্দুধারণ’ বলেছেন। যোগও তাই বলছে–’যোগিনস্তস্য সিদ্ধিঃ স্যাৎ সততং বিন্দুধারণাৎ। সব সময় বিন্দুধারণ করলে যোগীগনের সিদ্ধিলাভ হয়। বীর্য সঞ্চিত হলে মস্তিষ্কে প্রবল শক্তি সঞ্চিত হয়–এই মহতী শক্তির বলে একাগ্রতা সাধন সম্ভবপর হয়। সন্ন্যাসীর মূলমন্ত্র আসক্তিমোচন। তাই নারী আসক্তি তার থাকবে না একেবারে। সেখানের। দেহসাধনা একক ক্রিয়াকরণের। লোকায়ত দেহসাধনার মতো কখনও যুগলের নয়। লোকায়ত সাধকরা সম্ভোগ সুখ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন না কিন্তু কখনও। শুধু ‘বিন্দুধারণ’ পদ্ধতিটিকে রপ্ত করেছেন। নারী আসক্তি তাঁদের রয়েছেই। যুগল সাধনার সৃষ্টিকল্পে আমাদের তাই মনে হয় বেশ বুঝেশুনে পরিকল্পিতরূপে এই ক্রিয়াকরণকে ভাবা হয়েছে। তবে এর পেছনে কারণ আছে। চর্যাপদের সময়কেই যদি আমরা মান্য দেহসাধনার নিদর্শন রূপে সামনে এনে দেখি, তবে দেখব সিদ্ধাচার্যরা সবাই কিন্তু গৃহী। বাউলরাও গৃহী। তাঁদের গৃহ হয়তো আখড়া অভিধার। তান্ত্রিকদের বরং সেই অর্থে গৃহ নেই। তবে এদেরও তো এখন ডেরা আছে। বাউল দেহসাধনা আখড়ায় সম্পন্ন হয়। তান্ত্রিক শরীরসাধনা। অমাবস্যাতে হয়। শ্মশানে ভৈরবীচক্র বসে। সন্ন্যাসীরা যুগলতত্ত্বের ধারেপাশে যান না। ত্যাগই তাঁদের প্রধান কর্ম। তাঁদের মতে ত্যাগের সাধনা না করলে ব্ৰহ্মচিন্তা নিস্ফল। কামিনী কাঞ্চন তাই সেখানে একেবারে নিষেধ। বিন্দুধারণ’ সেখানে কেবল বীর্যকে শুক্রকে উধ্বগমনে নিয়ে গিয়ে অতল আনন্দ লাভ করা।……

….খ্যাপার এই গানের প্রথম শব্দ দুটোর প্রতীকী রহস্য ভেদ করে নিয়েছি আমরা। তা নারীর যোনিতে কীভাবে ফুটছে এই তিনরঙা ফুল? অনেক বাউলকে নারীর যোনিকে ‘গুপ্ত বৃন্দাবন’ও বলতে শুনেছি। বৃন্দাবনে যেমন রাধার রসধারা ঝরে, তেমনি নারীর যোনিতে রজঃপ্রবাহ ঘটে।

-তিন দিনের এই স্রোতধারা গো। তিন দিনে তিন রঙ ধরে। লাল হয় প্রথম দিন, দ্বিতীয়তে নীল, তৃতীয় দিনে সাদা রঙ তার।

অনেকে আবার চার রঙের কথাও বলেন। তিনদিন হল রজঃপ্রবাহের সূচনা দিন থেকে নিবৃত্তির দিন। প্রতিমাসেই এদিন, তিনদিন ঘুরে ফিরে আসে। এজন্য প্রচলিত এক কথাও আছে ‘মাসিক’। এ নিয়ে কমল দাসের একখানা গানও আছে–’মেয়ে গঙ্গা যমুনা সরস্বতী/ মাসে মাসে জোয়ার আসে ত্রিবেণী সংহতি। / যখন নদী হয় উথলা তিনজন মেয়ের লীলাখেলা/ একজন কালা একজন ধলা একজনা লালমতী।‘

দেহসাধক নারীর রজঃপ্রবাহের তিন দিনের ‘মহাযোগ’ এ শরীর যুগলের মিলনকে মনে করে থাকেন রাধাকৃষ্ণের যুগলতত্ত্ব। ত্রিগুণময়ী রাধা সম্বন্ধে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, যার বিবৃতি আমরা ‘কথামৃত’তে পাই ৩০শে অক্টোবর ১৮৮৫ তারিখে শ্যামপুকুর বাটির কথোপকথনে–’বৈষ্ণবশাস্ত্রে আছে কামরাধা, প্রেমরাধা, নিত্যরাধা। কামরাধা চন্দ্রাবলী। প্রেমরাধা বৃন্দাবনে লীলা করেছিলেন। নিত্যরাধা নন্দঘোষ দেখেছিলেন গোপাল কোলে। … নিত্যরাধার স্বরূপ–যেখানে নেতি নেতি বিচার বন্ধ হয়ে যায়। নিত্য রাধাকৃষ্ণ, আর লীলা রাধাকৃষ্ণ। যেমন সূর্য আর রশ্মি। নিত্য সূর্যের স্বরূপ, লীলা রশ্মির স্বরূপ।‘

ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব যেটা বলতে চেয়েছেন তা হল শ্রীরাধাতত্ত্ব তিনটি স্তরের। চন্দ্রাবলী হলেন আমাদের কামনা-বাসনা, মান-অভিমানের প্রতীকী রূপ। কামধারা তাঁরই প্রতিদ্বন্দ্বী। চন্দ্রাবলীকে কৃষ্ণের সখি না ধরে জ্যোৎস্নারূপও ধরে নিতে পারি। এই রূপ তেজস্ক্রিয়াকে পরিহার করছে। সূর্যের আলোর পরক্ষতা রয়েছে চাঁদের মধ্যে। চাঁদ সূর্যের আলোতে আলোকিত হয়েও কমনীয়তা বজায় রেখেছে। চাঁদ বাঁ চন্দ্রাবলী তাই প্রেমসংগ্রামের রূপ। সূর্যকে এখানে কাম হিসাবে ধরছি। কাম প্রেমে রূপান্তরিত হচ্ছে যেন। প্রেমরাধা কী? প্রেমরাধা হল নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রতীক। যার কোনো চাওয়া নেই, পাওয়া নেই, কেবল সমর্পণ আছে। চৈতন্য তো সেই ভাবরসেই কৃষ্ণের উপাসনা করেছিলেন।…..

…..খ্যাপার গানে রয়েছে ‘এক বঁকে তিন ফুল ফুটেছে, লাল, নীল, পীত জরদ সাদা / এক ফুলে সুরসিক বসে, আর এক ফুলে রয় রাধা।‘ ফুল যে রজঃস্রাব তা এতক্ষণে আমরা বুঝে গেছি। ‘এক ফুলে সুরসিক বসে আছেন–সাধক মিলনে ব্যাপৃত আছেন। আর এক ফুলে রাধা’ আছেন–পরমা প্রকৃতি, সঙ্গিনী, রাধাস্বরূপিনী সেই নারী দেহ, যে দেহের রূপ-উপমায় সাধক বলছেন–’আর মরি কি ফুলের লীলা’। এই লীলারূপে অংশ নিচ্ছেন তো স্বয়ং সাধক। যার জন্যই ‘ফুলের মাঝে নন্দলালা’। যিনি ‘ভাঁড় ভেঙে ননী’ খাচ্ছেন আর বাঁশি বাজিয়ে বলছেন–’রাধা রাধা’ বাঁশি হল গিয়ে নারী দেহ। ‘ভাঁড়’ ভাঙা হল যোনির ভেতর প্রবেশ। সাধনলিঙ্গ যোনির মধ্যে অবস্থান করছে। সাধক। ‘ভাঁড় ভেঙে ননী’ খাচ্ছেন। ননী’ হল কামকে প্রেমরূপে আস্বাদন করে নেওয়া। রাধা এখানে রামকৃষ্ণদেবের সেই ‘কামরাধা’ থেকে ‘প্রেমরাধা’তে পরিণত হচ্ছেন। খ্যাপা বলছেন–’সে ফুল আছে থির পবনে, রসিকে তার সন্ধান জানে, / বায়ু বরুণ নাই যেখানে, ফুলেই খায় ফলের মাথা।‘….

…..এ কোন কারিকর,গড়লে এ ঘর, একটা রূপের নিশান
নয় দরজা ষোলতালা, দ্বাদশে বাতি ঘোষণা।।
সপ্ত তালায়, সপ্ত সিন্ধু, ষড়দলে দীনবন্ধু,
শতদলে প্রাণগোবিন্দ, দ্বিদলে রূপ সাধনা।।
এক ধারায় নয় তিন ধারানন, তিনগুণে তার তিন সাধনা,
ওই নব রসে রসিক বসে, স্বরূপ নিয়ে করে রূপ ঘোষণা।।
আর কেউ বা শুনে, কেউ বা দেখে, কেউ করে ভাই প্রবঞ্চনা।
কেউ দেখে শুনে চুপটি করে, করে নিত্যলীলার রটনা।।
জরা মৃত্যুর নয় সে অধীন, প্রতি নব নব জানা,
কৈশরা কিশোরী রূপে, ক্ষ্যাপা করেরে রূপের সাধনা।।

কানাই বাউল কথকতার ঢঙ্গে এ গানের ব্যাখ্যা করছিলেন সে আসরে। সেই ব্যাখ্যার সঙ্গে নিজস্ব চিন্তাধারাকে মিলিয়ে এ গানকে বুঝবার চেষ্টা করব আমরা। ঘর এখানে দেহভাণ্ড। বাউল বলেছিলেন, দেহবাড়ি, নারীদেহবাড়ি। আমরা বলব প্রবোধের বেড়া। যা ভাঙতে চাইছেন সাধক। ঘরের নয় দরজা হল শরীরে নয়টি প্রত্যঙ্গ। বাউল সাধক একে ‘নবদ্বার’ও বলে থাকেন। এই প্রত্যঙ্গগুলো হল দুই কান, দুই চোখ, দুই নাক, মুখবিবর, পায়ু ও উপস্থ। উপস্থ বললে সঠিক পরিষ্কার হল না। বলি জননেন্দ্রিয়, লিঙ্গ। যোনি। ‘ষোলতালা’ হল মোলটি আধার। যে আধারে লয়যোগ সাধন হয়। একে যোগী যাজ্ঞবল্ক বলেছেন ‘ষোড়শাধারং’। ‘পাদাঙ্গুষ্ঠী চ গুলফৌ চ / পায়ুমূলং তথা পশ্চাৎ দেহমধ্যঞ্চ মেট্ৰকং।।/ নাভিশ্চ হৃদয়ং গার্গি কণ্ঠকূপস্তথৈব চ। / তালুমূলঞ্চ নাসায়া মূলং চাক্ষুশ্চ মণ্ডলে। / ভ্ৰবোৰ্মধ্যং ললাটঞ্চ মূর্ধা চ মুনিপুঙ্গবে।’ অর্থাৎ ডান পায়ের আঙুল (দক্ষিণ পদাঙ্গুষ্ঠ), গোড়ালি (পাদগুল), গোপনীয় বা অপ্রকাশ্য অংশ (গুহ্যদেশ), পুংজননেন্দ্রিয় বা শিশ্ন (লিঙ্গমূল), নাভির গর্ত বা কুণ্ড (নাভিমণ্ডল), মন (হৃদয়), কণ্ঠনালীর নিচস্থ গর্ত (কণ্ঠকূপ), জিভের অগ্রভাগ (জিহ্বাগ্র), দন্তপংক্তি বা দাঁতের পাটি (দন্তাধার), টাকরা (তালুমূল), নাক বা নাকের ফুটো (নাসাগ্রভাগ), দুই ভুরুর মধ্যবর্তী স্থান বা অংশভাগ (ভ্রমধ্য), চোখ বা চোখের অংশভাগ (নেত্ৰাধার), কপাল (ললাট), মাথা বা মস্তক (মূর্ধ্বা), শিরোমধ্যস্থ বা মাথার ভেতরে অধোমুখের সহস্রদল পদ্ম(সহস্রার)। এই ষোলটি স্থানের ক্রিয়াবিশেষ অনুষ্ঠানে লয়যোগ হয়, লয়যোগ হল আমাদের মনকে যে কোনো পদার্থের উপর একত্র করে একতানে বেঁধে ফেলা। ‘দ্বাদশ বাতি’ হল শরীরের। মধ্যে অবস্থিত অনাহতচক্র। এর বারোটি পাপড়ি থাকে। এই দ্বাদশ দল হল–ক, খ, গ, ঘ, ঙ, চ, ছ, জ, ঝ, ঞ, ট, ঠ। এগুলো সবই মাতৃকাবর্ণাত্মক। মায়ের ভাষা। আমাদের। বর্ণমালা। মাতৃকা হল শক্তিস্বরূপিণী। সেই আধারেও রাখতে পারি এই বারোটি পাপড়িকে। এর রঙ সিঁদুর বর্ণের। এর প্রত্যেক দলে একেকটি বৃত্তি রয়েছে আমাদের। এগুলো হল–আশা, চিন্তা, চেষ্টা, মমতা, দম্ভ, বিকলতা, বিবেক, অহংকার, লোলতা, কপটতা, বিতর্ক ও অনুতাপ। এই অনাহত চক্রে বা পদ্মের মধ্যে অরুণবর্ণের সূর্যমণ্ডল ও ধূম্রবর্ণের বায়ুমণ্ডল আছে। এই পদ্মে সাধক ধ্যানে বসলে অণিমাদি লাভ করেন। অনিমিত্ত ঘটনারাশি তাঁর চোখের সামনে ভাসে।

তাহলে আমরা বুঝতে পারছি এ গানে পদকর্তা নারীদেহের ভেতরকার সৌন্দর্যের জাগৃতি দিয়েছেন। তবে যেটা মনে হয় ‘ঘর’কে কানাই বাউল নারী দ্যোতকের রূপ দিলেও ভঙ্গির প্রতিচ্ছায়াতে এ গানের বর্ণিত ‘ঘর’ যুগল দেহের। যুগল সাধনার ব্রহ্মাণ্ড। খ্যাপা বলেছেন ‘সপ্ত তালায়, সপ্ত সিন্ধু’–’সপ্ততালার কথা আমরা এর আগেও খ্যাপার গান প্রসঙ্গে বলেছি। তবু প্রসঙ্গত এখানে আবারও বলি। আমাদের শরীরের বীর্য, রক্ত, মজ্জা, মেদ, মাংস, হাড়, চামড়া–এই সাতটি পদার্থকে ‘সপ্ততালা’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন সাধক। তারপরই বলেছেন ‘ষড়দলে দীনবন্ধু’–’ষড়দল’ হল ষড়রিপু। সেখানে ‘দীনবন্ধু’ রয়েছেন কীভাবে? যদি ভাবি ‘দীনবন্ধু’ সাধকেরই দীনতা খুব কি ভুল ভাবব আমরা? সেই দীনতা ‘ষড়দল’এ আটকে যাচ্ছে। ‘ষড়রিপু’কে পরিণামী মেজাজ দিতে চাইছেন তিনি। যার জন্যই ‘শতদলে প্রাণ গোবিন্দ’কে দেখতে পারছেন তিনি। ‘প্রাণগোবিন্দ’ হল সাধকের অপরিমেয়তা। তাঁরই দিব্যবানী শোনাতে চাইছেন তিনি পরবর্তী দু’লাইনে। ‘শতদল’ হল গিয়ে শরীরের গুরুচক্র। অষ্টম পদ্ম এটি। এই পদ্মের কর্ণিকাতে (বীজকোষে) ত্রিকোণমণ্ডল আছে। ত্রিকোণমণ্ডল তিনটি বর্ণ দ্বারা গঠিত। এই বর্ণগুলো হল–হল, ক্ষ। এই তিনটি শক্তিদ্যোতক। নটি চক্রেরই বিকাশ তো শক্তির অভিক্ষেপের জন্যই। যার জন্য একে শক্তিমণ্ডল বলে। অনেকে যোনিপীঠও বলে। যা প্রকৃতি দ্যোতক। নারীর জননাঙ্গ সৃষ্টির সন্নিবেশকেই প্রতীকী করে রাখে। সাধক বলেন তেজময় এই শক্তির মধ্যে কামকলা মূর্তি থাকে। সেই মূর্তিকেই তিনি দিব্য প্রেমের ইঙ্গিত দেন। গুরুপদ্ম বা চক্র শতদল পদ্মকে কেন বলা হচ্ছে? বলা হচ্ছে এই কারণেই, এই পদ্মেই। সাধক গুরুদেবের ধ্যানজপ করেন। এই ধ্যানে সাধক মনে করেন সর্বসিদ্ধি লাভ হয়। দিব্যজ্ঞান স্ফুটমান হয়। এই দিব্যতা লাভ করার উদ্দেশ্যেই সাধক ‘দ্বিদলে রূপ সাধনা’ করেন। দ্বিদল হল আজ্ঞাপদ্ম। দুটো দলের বর্ণ হ এবং ক্ষ। এই পদ্মের বীজকোষে যে ত্রিকোণমণ্ডল আছে তাতে তিনটি গুণ বর্তমান–সত্ত্ব, রজ, তম। সাধক বলেন ত্রিগুণান্বিত ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর। এই জন্যই খ্যাপা গানকে সেই দ্বিদ্বলের দ্যোতনা দিয়েছেন। তাঁকে একটু আগে আমরা ‘দিব্যবাণী’ হিসাবে চিহ্নিত করে নিয়েছি। এই দিব্যবাণী হল–’এক ধারায় নয় তিন ধারানন, তিনগুণে তার তিন সাধনা/ ওই নব রসে রসিক বসে, স্বরূপ নিয়ে করে রূপ ঘোষণা।‘ ‘নবরস’ নটা চক্রেরই দ্যোতক। বাউল একে ‘নববিধা ভক্তি’ বলেন। নববিধা ভক্তি হল অলংকার শাস্ত্রের নয়টি রস–শৃঙ্গার, হাস্য, বরুণ, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস, অদ্ভুত ও শান্ত। কানাই বাউল আমাকে বলেছিলেন, নবরসে শরীরের নটি দ্বার খোলে গো।

এই নটি দ্বার–শরীরের নটি ছিদ্র। দুই চোখ, দুটি কান, দুই নাক, মুখ, যোনি লিঙ্গ। তা যদি খোলে ‘ঘর’ কে কানাই বাউল কথিত ‘নারীদেহ’ হিসাবে কীভাবে মেনে নেব? যার জন্যই তাঁকে যুগল দেহের প্রেম সাধনার (কাম সাধনার? !) দীর্ঘসূত্রতা দিয়েছিলাম। তা কিন্তু গানের শেষ লাইনে একেবারেই স্পষ্ট–কৈরা কিশোরী রূপে, খ্যাপা করেরে রূপের সাধনা।…..

…..কাঁচা হাড়িতে রাখিতে নারিলি প্রেমজল (গো)
কাঁচাহাঁড়ি জলে দিলে তখনি যাইবে গলে
শেষে লাগবে গণ্ডগোল (গো)
রাখিতে নারিলি প্রেমজল।।
যদি হবি পাকা হাঁড়ি
চলে যাবি গুরুর বাড়ি,
প্রেমানলে দগ্ধ হবি।
রূপে করবে টলমল গো।
রাখিতে নারিলি প্রেমজল (গো)।।
সদানন্দ ভেবে আউল
এই কথা যে বুঝেছে সেইত বাউল,
ধান কুটিলে হবে চাউল
(ক্ষ্যাপা) তুষ কুটিলে কিবা ফল।
রাখিতে নারিলি প্রেমজল (গো)।।

এই গানে কথিত ‘কাঁচা হাঁড়ি’ হল আমাদেরই স্থূল দেহ। এই স্থূল দেহকে প্রবর্ত স্তরে নিয়ে যেতে হলেই গুরুর কাছে যেতে হয়। গুরু শিক্ষা দেন স্থূল স্তর থেকেই। স্থূলকে মোটা হিসাবে না দেখে অতীক্ষ্ণ বুদ্ধি বা অসূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার নামান্তর ধরলেই বোধহয়। ভালো। গুরু এই অতীক্ষ্ণ বুদ্ধি বা অসূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতাকেই প্রবর্তস্তরে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন। তাঁর জন্যই গানে গুরুর বাড়ি যেতে বলা হচ্ছে। ‘প্রেমজল’ নারীর বা সাধন সঙ্গিনীর রজঃস্রাব। সহজিয়া বলছেন ‘কাঁচাহাঁড়ি জলে দিলে তখনি যাইবে গলে/ শেষে লাগবে গণ্ডগোল (গো)।‘ এই ‘জল’ পুরুষ দ্যোতক বা পুরুষের কিংবা সাধকের বীর্যপাত। স্থূল দেহেই যদি বাউল সঙ্গিনীর সঙ্গে মিলিত হয়ে পরেন তাহলে তিনি বীর্যকে চূড়ান্ত মিলনের সময় উর্ধগতিতে উঠিয়ে নিতে পারবেন না। বীর্য ‘প্রেমজল’ এ মিশে যাবে। পথভ্রষ্ট হবেন সাধক। যাকে ‘গণ্ডগোল’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন সাধক খ্যাপা। তাঁর জন্যই গুরুর কাছে যাওয়া।…….

…..কৃষ্ণকে সাধক শরীর আমরা ধরেছি আগেই। গোপীরা সব নাড়ি। কৃষ্ণ শরীরস্থ আত্মা বা অনুভব। যোগের প্রসারিত অঞ্চল সব। দেহস্থ নাড়িগুলো গোপী সেজে কৃষ্ণকে সবসময়ই বিরক্ত করেন। সাধকের বিরক্তি এতে। নাড়ি অর্থাৎ কিনা গোপীরা সব যোগক্রিয়াতে সাড়া দিচ্ছে না ঠিকমতো। চক্ৰস্থ শক্তিগুলোকে দেহসাধক একীভূত করে নিতে পারছেন না কিছুতেই। তাই তাঁদের শিক্ষা দেবার জন্য, উপদ্রব কমাবার জন্য কৃষ্ণ তাঁদের পাশমুক্তি দিয়ে বসলেন। এই পাশমুক্তি হল আবরণ উন্মোচন। বাসনার বস্ত্রকে সাধনার শরীর থেকে টেনে খুলে ফেলা। নাড়িগুলো যদি গোপী হয়, তাহলে তো কৃষ্ণ তাঁদেরই কাপড় সব টেনে খুলে একেবারে ন্যাংটা করে দিচ্ছেন। আবার নাড়িগুলো যদি প্রতীকী আবরণের গোপী হয়, তাহলে তো কৃষ্ণ তাঁদের সঙ্গে লীলাও করবেন না কী! কীভাবে করবেন সাধক কৃষ্ণ এই লীলা?

গোপীদের বশ করে নেবেন তিনি। বস্ত্র যদি বাসনা হয় তাহলে বাসনা মুক্ত শরীরে সর্বদাই চলবে নাড়িগুলোর ছন্দগত ক্রিয়াকরণের সব লীলা। এঁদের মধ্যে তো রাধাও বর্তমান ভেবে নিয়েছিলাম আমরা। দাঁড়াল এই–সাধক কৃষ্ণ মহিমায় মহিমান্বিত। হয়ে এভাবেই গোপীরূপী সব নাড়ি আর রাধারূপী সুষুম্নার সঙ্গে বিশেষ লীলা করে থাকেন। সুষুম্না হল প্রধানা নাড়ি। তাঁর দুই পাশে ইড়া, পিঙ্গলা। রাধার অষ্টসখিকেও নাড়ির প্রতীকী অবয়ব দিয়েছি আমরা। ইড়া, পিঙ্গলাও তাহলে এই অষ্টসখিরই অন্তর্গত।…..

…..পঞ্চবাণের প্রথম যেটি মদন, বাউল বলেন সেটি কামরতির প্রথম সিঁড়ি। এই সিঁড়ি তিনি টপকে যান কীভাবে? অমাবস্যায় প্রথম মিলনে সঙ্গিনীর দেহের

স্পর্শকাতর প্রত্যঙ্গগুলোকে তিনি স্পর্শ করে সঙ্গিনীর শরীরের কামের বাণকে আরও শানিয়ে নেন। উত্তেজনা বৃদ্ধি করে দেন সঙ্গিনীর শরীরে। এই স্পর্শ হয় করনখে, পদনখে, গলায়, অধরে, জিহ্বায় আর ললাটে। বাউল বলেন সাড়ে চব্বিশ চন্দ্ৰস্পৰ্শর কথা। করনখে দশ, পদনখে দশ, দুই গলায় দুই, অধরে এক, জিহ্বায় এক, ললাটে দেড়। এই হল গিয়ে সাড়ে চব্বিশ চন্দ্ৰস্পৰ্শর প্রত্যঙ্গ-হদিস। মূলত দৃষ্টিস্পর্শর কথা তারা বলে থাকেন। কীভাবে হয়ে থাকে এই চক্ষুস্পর্শ। আমাদের শরীরস্থ সুষুম্ন নাড়ি মূলাধার চক্র থেকে উৎপন্ন হয়ে নাভিমণ্ডলের যে ডিম্বাকৃতি নাড়িচক্র আছে, তার ঠিক মাঝখান দিয়ে উঠে গিয়ে সহস্রার চক্রের ব্রহ্মরন্ধ পর্যন্ত চলে গিয়েছে। সুষুম্না নাড়ির বাঁ দিকে রয়েছে ইড়া নাড়ি। দক্ষিণ বা ডান দিকে রয়েছে পিঙ্গলা নাড়ি। এই দুই নাড়ি দু-দিক থেকে উঠে স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত ও বিশুদ্ধ চক্রকে ধনুকাকারে বেষ্টন করে আছে। ইড়া দক্ষিণ নাসাপুট পর্যন্ত এবং পিঙ্গলা বাম নাসাপুট পর্যন্ত গমন করেছে। মেরুদণ্ডের মধ্যে দিয়ে সুষম্না নাড়ি ও মেরুদণ্ডের বাইরে দিয়ে পিঙ্গলা নাড়ি চলে গেছে। বাউল সাধক দক্ষিণের পিঙ্গলা নাড়িতে কিছু সময় নিশ্বাস-প্রশ্বাস প্রবাহিত করে দক্ষিণ চোখে দৃষ্টিকে নিবদ্ধ করে রাখেন। মদনবাণের সময় ইড়া নাড়িতে (বাঁ নাকে) শাসগ্রহণ করে মাদনবাণের সময় পিঙ্গলাতে নিয়ে যান। মাদনের সময় ডান বা দক্ষিণ নাকে শাসগ্রহণ করে সঙ্গিনীর শরীরে উত্তেজনা বৃদ্ধি করেন। বাউলের কাছে ‘বাম’ ও ‘দক্ষিণ’ শব্দদুটি বিশেষ অর্থদ্যোতক। কারণ হল বাম দিকে চন্দ্র নাড়ি-বলা হয় একে ইড়ার সাম্যাবস্থা আর ডান দিকে বাউলের সূর্য নাড়ি-পিঙ্গলারই চাঞ্চল্যকর দশা। যোগশাস্ত্র এরকম ব্যক্ত করেছে। দক্ষিণ বা ডানের দিককে বাউল বলেন কামের অবস্থা। সেজন্য তারা দক্ষিণকে পরিত্যাগ করেন। তবে শুধু বাউল কেন, সহজিয়া বৈষ্ণবরাও যুগল সাধনে তাই-ই মানেন। এ বিষয়ে তো চণ্ডীদাসেরও নিষেধনামা আছে : দক্ষিণ দিগেতে কদাচ না যাবে। যাইলে প্রমাদ হবে। মদন-মাদন যে বাম ও দক্ষিণনেত্রে অবস্থিত চণ্ডীদাস তার কথাও উল্লেখ করেছেন পদে। লিখেছেন :’মদন বৈসে বাম নয়নে। মাদন বৈসে দক্ষিণ কোণে।‘ তৃতীয় বাণ শোষণ বাণ। শোষণ বাণের সময় বাউল যোগাভ্যাসের ক্রিয়াকে চালিত করেন। লিঙ্গনালে উত্থিত শুক্র বা বীর্যকে তারা ঠেকিয়ে রাখেন। স্তম্ভন বাণে যুগল শরীরেই একটা স্থিরতা আসে। শ্বসাদির কাজ কিন্তু কিছুটা বাউলসঙ্গিনীও করে থাকেন। বিশেষত কুম্ভক প্রক্রিয়া। স্তম্ভন বাণের সময়ই দেহের বিভিন্ন স্পর্শকাতর অংশ স্থির চঞ্চল হয়ে পড়ে। সাধক তখন চরম দশায় উত্তীর্ণ হয়ে যান। সম্মোহনের সময় তাদের দেহস্মৃতি লুপ্ত হয়। বাহ্য দেহে বিপুল আনন্দের তরঙ্গ উত্থিত হয়ে পড়ে। এরপরই তারা বলেন পরমাত্মার বিকাশ ঘটে। নাভিপদ্ম থেকে হৃদয়পদ্মে এই অনুভূতির জাগরণ ঘটে। এতে তারা নানা সুমধুর ধ্বনি শুনে থাকেন। পরিশেষে চরম পরিণতি আসে তখন আজ্ঞা চক্রের দ্বিদলপদ্মে তারা মনের মানুষকে উপলব্ধ করেন।

এখন প্রশ্ন বাণক্রিয়া যদি শুধু চক্ষুস্পর্শেরই হবে তবে স্তম্ভন বাণের সময় দেহ স্থির চঞ্চল হয়ে পড়ছে কেন? যেটা মনে হয় চন্দ্ৰস্পর্শ, অষ্টমচন্দ্ৰস্পৰ্শ এগুলো কোনোটাই আসলে চক্ষুস্পর্শ নয়, প্রত্যঙ্গকে প্রত্যক্ষ ছোঁয়া। মদনবাণের সময়ই তা শুরু হয়ে যায়। শ্বাসক্রিয়া দিয়ে সাধক সঙ্গিনীর অঙ্গ স্পর্শ করেন আর সঙ্গিনীও শাসাদির কাজে সাধকের অঙ্গকে নিজ শরীরে একীভূত করে নেন। কামশাস্ত্র মিলনক্রিয়ার সময় চারপ্রকার আলিঙ্গনের কথা বলেছে। সঙ্গিনী সঙ্গীর দিকে আসতে থাকলে যদি তাকে আলিঙ্গন করা সম্ভব না হয়, অথচ সঙ্গিনীকে সঙ্গীর অনুরাগ জানানোর প্রবল ইচ্ছে তখন সঙ্গী অন্য কোনো কাজ করবার ছলে, বুদ্ধি করে সঙ্গিনীর পাশ দিয়ে যেতে যেতে তার শরীরে নিজের শরীর স্পর্শ করবে। একে সৃষ্টক আলিঙ্গন (Slight Contact) বলে। সঙ্গী কোনো নির্জন স্থানে থাকলে তাকে সেই অবস্থায় দেখে সঙ্গিনী যদি কিছু নেওয়ার ছলে সেখানে গিয়ে স্তন দিয়ে সঙ্গীকে আঘাত করে তখন সঙ্গী সঙ্গিনীকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে যদি নিজের শরীরে চেপে রাখে সেটা বিদ্ধক আলিঙ্গন (Breast Pressure Embrace)। অন্ধকার জায়গাতে সঙ্গিনীর শরীরের সঙ্গে সঙ্গীর শরীরের যে মিলন চলে সেটা উদ্ধৃষ্টক আলিঙ্গন (Huffing Embrace)। আর সঙ্গিনী এবং সঙ্গী যখন উদ্ধৃষ্টক আলিঙ্গনে আবদ্ধ অবস্থার কথা ভেবে একা একাই নিজের দু-হাত চেপে নিজেকে জড়িয়ে নেয় সেটা পীড়িত আলিঙ্গন (Pressive Rubbing Embrace)। কামশাস্ত্রে চুম্বনের সঙ্গে পাঁচটি ব্যাপারকে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে—চুম্বক, নখক্ষত, দক্ষত, প্ৰহণন ও শীৎকার। তবে কামশাস্ত্র কখনও মিলনক্রিয়ার সময় তিথি নির্দেশ করেনি। বাউল সাধনে মিলনসময় নির্ণীত। ইড়া নাড়িতে বা নাকে যখন শ্বাস চলে তখনই মিলনের প্রশস্ত সময় বলে থাকেন বাউল গুরু। এই সময়টা রাতে খাবার ঘণ্টা দুই পরে আসে বলে বাউল বলে থাকেন। এটিকে সাধক অর্ধপ্রহর হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। সময়কাল তারা বলেন দেড় থেকে দুই ঘণ্টা স্থায়ী হয়। এই ক্রিয়ার আরম্ভের সময় প্রথম চলে আলাপন। পরস্পর স্পর্শ করে পরস্পরের প্রত্যঙ্গগুলোকে। তারপরই শুরু হয়ে যায় দমের খেলা। অনেক সাধক বলেন এইসময় কাম-বীজ জপ করতে হয়। আর সঙ্গিনীকে কাম-গায়ত্রী।…….

One thought on “দুই বাংলার বাউল আখড়া – সোমব্রত সরকার

  1. অনেক কিছু জানতে পারলাম অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

Leave a Reply