জোসুয়া ও ম্যাগডালিন (বাইবেলের প্রেম কাহিনী) – সুভাস সমাজদার

›› সম্পুর্ণ গল্প  

জেরুজালেম ।
স্বপ্নের জেরুজালেম! আর কতদূর আর কতদূর! তাইবেরিয়াসের বাজার ছাড়িয়ে রুক্ষ পাথুরে চড়াই উৎরাই ডিঙ্গিয়ে আস্তে আস্তে চলেছে উটের দীর্ঘ কাফিলা । দূরের মরুভুমি থেকে হুক করে আগুনের হলকার মত বাতাসের ঝাপটা এসে পড়ছে তাদের নাকে মুখে চোখে ।
চারিদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার ঝাঁপিয়ে নেমে আসছে। রাস্তার দুধারে কমলা আর জলপাইগাছের কাক দিয়ে চাদ উকি দিচ্ছে। কিন্তু এখনও আকাশ থেকে যেন আগুন চড়াচ্ছে। বাতাসে উত্তাপের রেশ। এই গরমের জন্মেই তারা দিনের বেলা পথ চলতে পারে না। ঝাপড়া গাছগাছালির ভেতর দিয়ে তার উৎসুক চোখদুটো ছড়িয়ে দিল মিরিয়ম —
না। কিছু দেখা যায় না। শুধু ঘন থকথকে অতিকায় এক একটা হৈত্যের মত দাড়িয়ে আছে গাছপালার জঙ্গলে আচ্ছন্ন পাহাড়। মনটা ভারী হয়ে ওঠে ম্যাগডালার মেয়ে মিরিয়মের। গ্যালিলির এই পাহাড়গুলো ছাড়িয়ে আরও কতদূর—কতদূর গেলে পাওয়া যাবে সেই শহর ন্যাজারেখ, কে জানে? রাজারেথের পর থেকে তারা দিনের আলোয় চলতে পারবে। আর দু’চোখ স্তরে দেখবে শুধু দেখবে প্রকৃতির অবারিত রূপ ।
ওরা চলে। উটের গলায় বাধা ঘন্টা বাজে ডিং ডং-ডিং-ঢং।
রাত ৰাড়ে । ঘুমে জড়িয়ে আসে মিরিয়মের চোখদুটো। তন্দ্রার ভেতরে কুয়াশায় ঢাকা অস্পষ্ট আর ঝাপসা কতগুলো ছবির মত ফুটে ওঠে কয়েকটি দৃক্ত : গ্যালিলির সমুদ্রের ধারে সেই ধূ-ধূ বালুচর, মাথার ওপরে বিপুলব্য আকাশ, নীচে সাগরের বিশাল জলরাশি। চারিদিকের সেই আদিম পৃথিবীর মতই নিঃসঙ্কোচ এবং নগ্ন হয়ে স্থান করছিল।
খান সেরে ধীর পায়ে সে উঠে এসেছিল। সকালের রোদ তর সোনার মত গলে গলে পড়ছিল তার সম্পূর্ণ নিরাবণ দেহে। সূর্যের লাল আলোর গোলকটা তার মাথার চারিধিকে দেবীমূর্তির জ্যোতিশিখার মত জলজল করছিল। আর তার মনে হয়েছিল, সমুদ্রের নীল জল, দিগন্তের সরুপ, আকাশের অঙ্কুরাণ আলো— এইসব — সব কিছু-ই যেন তিলে তিলে তিলোত্তমার মত গড়ে তুলেছে তার নগ্ন দেতের অপরূপ সৌন্দর্য সম্ভার। তার তন্বী দেহে ষোলবছরের উদ্দাম যৌবনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার নিজেরই অপলক দুটো চোখে মুগ্ধ তন্ময়তা নেমে এসেছিল। আর সমুদ্রের হু বাতাস যেন অস্ফুট মন্ত্রোচ্চারণের মত তার কানের কাছে বারে বারে বলছিল শুধু একটি —একটি কথা—তুমি সুন্দরী, ম্যাগডালার মিরিয়ম, তুমি ভীষণ সুন্দরী।
তার বুকের ভেতরে তীব্র খুশির কলধ্বনি বাজতে লাগল। সমুদ্রের কলোরাস, একটানা বাতাসের ঐক্যতান তার সুঠাম দুটো পারে ফুটিয়ে তুলেছিল নাচের ছন্দ। সে নাচছিল – বিজন সেই সমুদ্রতীরে উদার আকাশের নীচে সে বিভোর হয়ে নাচছিল। যেন কোন অপ্সরী তার অনাবরণ দেহের বিপুল ঐশ্বর্য দেগিয়ে বিমোহিত করতে চেষ্টা করছে ওই দূর আকাশে লুকিয়ে থাকা অদৃশ্য ঈশ্বরকে-
খুট-বালিয়াড়ির আড়ালে একটা সন্দেহজনক শব্দ শুনতে পেয়ে যখন তার পোশাকটা পরার জন্য ছুটছিল তখন সামনে এসে দাড়িয়েছিল একটা রাখাল ছেলে।
যা সরে যা—পালা, বলেই দুহাতে দেহের যৌবনচিহ্নগুলো ঢেকে হিংস্র বাঘিনীর মত চিৎকার করে উঠেছিল সে। কিন্তু ছেলেটি যায় নি। তার পাদুটো যেন বালিতে আটকে গিয়েছিল। কিন্তু সে আর তাকে তাড়িয়েও দেয় নি। ওর বিস্ফারিত দুটো চোখের বিস্মিত দৃষ্টি তার নগ্ন দেহের বিচিত্র সৌন্দর্যকে লোলুপ উল্লাসে যেন গ্রাস করছিল। সে কাঁপছিল। ধর ধর করে কাপছিল। যেন কম্প দিয়ে অর আসছে ওর ।
অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে কি দেখছে—ছেলেটা কেন কাপছে—কেন দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া সত্ত্বেও ও গেল না—এসব ভাবতে গিয়ে সেইদিন তার প্রথম মনে হয়েছিল তার রূপের আছে অপরিসীম শক্তি !
আর মনে হয়েছিল, তার এই স্বর্গীয় সৌন্দর্য গ্যালিলির সমুদ্রের ধারে জেলেদের গ্রাম ম্যাগডালার কোন নোংরা আর আঁশটে গন্ধেভরা ঘরের অক্ষ- কারে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাওয়ার জন্ম নয়। সেইদিনই সে ঠিক করেছিল, আর গ্রামে নয়, যেমন করেই হোক যেতে হবে—যেতে হবে—জেরুজালেমে — আরও কত কথা তার মনে হল—তার পাশের বাড়ির ছেলে উরি তার বাল্যবন্ধুও তাকে বলেছিল জেরুজালেমের কথা। উরি স্বপ্ন দেখে তাকে বিয়ে করে শহরে ঘর বাঁধবে। উরির গোলগাল বোকা-বোকা মুখখানা মনে পড়ে হাসি পায়। ঈশ্বরের ধান তার এই অনাধিব রূপ-যৌবন কোন একজনের জন্যে নয়—আলোঝলমল লোক গিসগিস মহানগরী জেরুজালেম — সেখানকার লোকের মুখে মুখে তার রূপের প্রশংসা রাশি রাশি টাকা সোনা হীরা জহরৎ আরও কত আলোকোজ্জ্বল ভবিষতের কত টুকরো টুকরো ছবিকে গভীর ঘুমের ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। তলিয়ে দিল একটু একটু করে
–হো–ই–ও–এ–উচু গলার হাকে ঘুম ভেঙে গেল মিরিয়মের । থমকে দাড়াল গোটা দলটা। পথের ধারে মাওকেটিয়ান পাহাড় থেকে নেমে এল মধ্যবয়সী একটা লোক। তার সঙ্গে কুড়ি-বাইশ বছরের একটা মেয়ে। তার হৃষ্টপুষ্ট দেহে যৌবন জেগে আছে প্রখর হরে।
তোমরা এই মেয়েটিকে জেরুজালেমে নিয়ে যেয়ে বিক্রি করে জিও বুঝলে। ও খুব ভাল নাচতে পারে—গাইতে পারে—
ও তোমার কে হয় ? দলের নেতা সিমন প্রশ্ন করল।
দেহাতী লোকটা বিরক্ত হয়ে বলল, কে আবার আমার তিন নম্বর বৌ।
ঘরের কাজকর্ম কিছু জানে না । ও আপদ বিদেয় হওয়াই ভাল—
সিমন আপত্তি করল না। মেয়েটিকে মিরিয়মের পাশে বসতে বলল। কাফিলা আবার চলতে শুরু করল।
তোমার নাম কি? মিরিয়ম আলাপ জমায়।
আমার নাম বাগা, বলেই মিরিয়মের মুখের দিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কি দেখে। আর খুব আস্তে আস্তে যেন নিজের মনেই বলে, ইস্ কী সুন্দর — কী সুন্দর তুমি—তার মুগ্ধ চোখদুটোর দৃষ্টি মিরিয়মের মাথা থেকে পা পর্যন্ত বুজিয়ে নিয়ে-ই আবার উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে—ইস তোমার পা-দুটোও কি নিটোল কী সুন্দর
কথায় কথায় ওদের ঘনিষ্ঠতা হতে দেরী হয় না। মিরিয়ম তার সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনে ফেলে—বাগা খাস জেরুজালেমের মেয়ে। ছোটবেলা থেকে নাচে গানে পটু। আফ্রোদিতির মন্দিরের নর্তকী। কিন্তু রক্তে জেগেছিল ঘরসংসারের বাসনা । তাই ওই দেহাতী পাহাড়ী লোকটার সঙ্গে পালিয়েছিল। কিন্তু বনের পাখির কী কখনও খাঁচার বন্ধন ভালো লাগে?
উটের পিঠে ছলে ছলে ওরা চলে । বাগা তার নিটোল দুটো হাত দিয়ে মিরিয়মকে জড়িয়ে ধরে। বাগার শরীরের উত্তাপে তার শীত শীত ভাবটা কেটে যায়। মিরিয়মের মুখে, ঠোঁটে, গলায়, বুকে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ফিসফিস করে বলে, বাগা মনে হয় কোন পুরুষমানুষের হাতের ছোয়া পড়ে নি তোমার বুকে-
মিরিয়ম কথা বলে না । তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, গ্যালিলির সমুদ্রের ধারে ধু ধু সেই বালুচরে নিজের নিরাবরণ দেহের ছবি। সেই রাখাল ছেলেটা। মধুর লোভে লোভে যেমন মৌমাছি আসে তেমনি করে আবার একদিন এসেছিল তার শক্ত কর্কশ হাত দিয়ে তার সুডৌল বুকটা স্পর্শ করতেই তাকে বাধা দিয়েছিল। কিন্তু বিচিত্র এক শিহরণে সে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছিল। তারপরে উরিও একদিন তার বুকে-
তুমি চলো না জেরুজালেমে মিরিয়ম, তোমাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে, বাগা তার কাছে গুন গুন করে, তোমার সারা গা সোনা দিয়ে মুড়ে দেবে। তোমাকে রোমীয়রা টাকার পাহাড়ে বসিয়ে রাখবে, বাগার কথাগুলোর ভেতরে আলোকোজ্জ্বল অনাগত ভবিষতের ছবি ফুটে ওঠে।
মিরিয়ম কিছু বলে না। তার মনে পড়ে, মা-র কথা। সে ভূমিষ্ঠ হওয়াব আগে নাকি মা স্বপ্ন দেখেছিল, তার মেয়ে হবে রাজরাণী, হবে বিপুল ঐশ্বর্যের মালিক।
এই স্বপ্নের কথা শুনে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল তার বাবা-ডেভিড । রোদে- ঝড়ে-জলে সমুদ্রে মাছ ধরে তার দিন কাটে। অত কষ্ট করেও সংসারে নুন আনতে তেল ফুরোয়। তার ওপরে আবার রোমীয়রা বাজপাখির মত থেকে থেকে ঝাঁপিয়ে এসে খাজনা আদায়ের নাম করে সর্বস্ব লুটেপুটে নিয়ে যায়। হয় টাকা, না হয় দাও সোনাদানা — নিদেন পক্ষে কিছু না পাবো ঝুড়ি ভরে মাঙ দাও । কিছু না পেলে-ই ঘরে আগুন দেবে। মেয়েদের ওপর অত্যাচার করবে !
অভাব অনটনের সঙ্গে দুহাতে লড়াই করতে করতে বাবার মনটা হয়ে গিয়েছিল রুক্ষ, কর্কশ। তাই মাকে না কি বলেছিল, ভাঙ্গা নড়বড়ে কুঁড়েঘরে খড়ের বিছানায় শুয়ে প্রসবের যন্ত্রণায় ছটফট করছো জেরা। আর রাজরাণী মেয়ের স্বপ্ন দেখছো—ভালো — ভালো—এই সময়ে এসব স্বপ্ন দেখলে তোমার কষ্ট কম হবে—
সেই নিশিরাতে দূর প্রবাসের পথে যেতে যেতে তার মনে পড়ল, বাবা, মা-র কথা, মনে পড়ল, তাদের হা-করা অভাবের সংসারের কথা। সেখানে দু-বেলা দুটো পেটভরে খেতে পায় না। ছেঁড়া জামায় তার উদ্বেল যৌবনকে আড়াল করতে পারে না। অথচ এমন রূপ তার। এতবড় মূলধন থাকতে শুকিয়ে মরবে কেন?
না। তার টাকা চাই—অনেক— অনেক টাকা — অনেক গয়না — অনেক অনেক ঐশ্বর্য। কতদূর—জেরুজালেম আর কতদূর। অসহ্য — অসহ্য একটা অস্থিরতায় চটফট করে তার বুকের ভেতরটা।
কী গো-সুন্দরী, তুমি চুপ করে কি এত ভাবছো বলো তো ? বাগার কথায় যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল মিরিয়ম।
তুমি জেরুজালেমে, কোথায় উঠবে ?
আমার এক পিসীমার বাড়িতে, নিজের চিন্তার ভেতরে ডুং দিয়ে আস্তে আস্তে বলল মিরিয়ম, শুনেছি পিসেমশায় না কি রোমীয়দের কোন বড় পুরোহিতের প্রাসাদে ঝাড়পোছের কাজ করে- হঠাৎ থেমে গেল সে। স্থির দৃষ্টিতে কয়েকমুহূত বাগার দিকে তাকিয়ে দেন অনেক অনেক দূর থেকে বলল, বাগা—আমি তোমার মত দেবদাসী হবো- নাচবো — প্রাণভরে শুধু নেচে যাবো, উত্তেজনায় হাফাতে লাগল মিরিয়ম। দূরে ঘন অন্ধকারে চোখদুটো ছড়িয়ে দিয়ে আবার বলতে শুরু করল, জানো বাগা— ঝড় জলের রাতে বাবা একদিন আর সমুদ্র থেকে ফিরে এল না। মা বুক চাপড়ে কাদছে, ছোট ছোট ভাইবোনগুলো কারছে। আমিও দুহাতে বুক চেপে ধরে কারতে কাদতে ছুটে গেলাম সমুদ্রের ধারে। তখনো ঝড়ে। বাতাসে সমুদ্র গজরাচ্ছে। আমার যে কি হলো বাগা—সেই গাঁ গাঁ বাতাস আর দাগরের বড় বড় ঢেউয়ের গোঁ গোঁ শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমি পাগলের মত নাচতে শুরু করলাম— নাচছি তো—নাচছি-ই, পা দুটোর ওপরে আমার যেন কোন বর্ণ নেই। ক্ষ্যাপা সমুদ্র, ক্ষ্যাপা বাতাস, মেঘে ঢাকা কালো আকাশ-সব যেন আমার কানে কানে ফিস ফিস করে বলছে—নাচো নাচো নেচে নেচে মনের ভার কমিয়ে নাও, হঠাৎ থেমে গেল মিরিয়ম। ক্লান্ত হয়ে বড় বড় নিশ্বাস ফেলতে লাগল। অবসন্ন হয়ে মাথাটা নীচু করে অস্ফুটস্বরে বলল, আমি নাচিয়ে হওয়ার জন্যই জন্মেছি—বাগা ।
পূবের আকাশে ভোরের রেখা জাগল। সে জুড়িয়া পাহাড়ের গায়ে ছবির মত থাকা জেরুজালেম শহর ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠল। কাফিলার পরিচালক সিমন হেঁকে বলল, পাষরা – এবার জেরুজালেম শহরে ঢুকছি-
মিরিয়মের বুকের ভেতরে কে যেন হাতুড়ি পিউতে লাগল। তাহলে সত্যিই সে তার স্বপ্নের জেরুগ্যানেমে আসতে পারল। সেই পুণ্যনগরীর অপরূপ শোভার দিকে তাকিয়ে তার কালো ডাগর দুটো চোখ মুগ্ধ হয়ে গেল। নগরের মাঝখানে ঘন সন্নিবদ্ধ জলপাই আর দীর্ঘ সাইপ্রাস ও উইলেগোছের মিষ্টি নীলাভ ছায়ায় ঢাকা একটা পাহাড়। পাহাড়ের ঢালুতে ঘন সবুজ গাছগাছালির ভেতরে শ্বেতপদ্মের মত সাদা পাখরের এক একটা সুদৃত সৌষ। প্রত্যেক অট্টালিকার সম্মুখের উত্থানে নানা রঙের ফুলের সমারোহ। কোথাও সাদ জুঁইফুলের গুচ্ছ বাতাসে মাথা দোলাচ্ছে, কোথাও ম্যাগনেটো গোলাপ কিম্বা খন বেগুনী রঙের রাশি রাশি করবী চারিদিক আলো করে ফুটে রয়েছে।— সবচেয়ে বিশাল যে প্রাসাদটা দেখছো, সিমন মিরিয়মকে তার পিসী নির্ভার বাড়িতে নিয়ে যেতে যেতে বলে— এটাই হলো — শয়তান জেরুজালেমের সেই রোমীয় শাসনকর্তা পণ্ডিয়ান দি পাইলেতের প্যালেস-একটু থেমে আবার বলে, আর এই যে মন্দিরটা দেখছো যার সোনার চুড়ো ঝকঝক করছে এটাই হলো ওই হিয়েনদের দেবতা জুপিটারের মন্দির।
ম্যাগডালার ধীবর পল্লীর মেয়ের বুকের ভেতরটা তীব্র যন্ত্রণায় যেন পুড়ে যাচ্ছে—যদি এখুনি যদি ওই প্রাসাদের ভেতরে ছুটে যেতে পারতো। ওই সোনার মন্দিরে আছে যে-দেবতা তার সামনে যেয়ে যদি যে উদ্দাম হয়ে নাচতে পারতো — অসম্ভব আর অবাস্তব কতগুলো বাসনা যেন সহজ সরল সেই গেঁয়ো- মেয়েটিকে কুরে কুরে খেয়ে ফেলতে লাগল।
কখন অভিজাত পল্লী ছাড়িয়ে এসেছে। কখন খিঞ্চি নোংরা গলির ভেতর দিয়ে সিমন তাকে নিয়ে গোয়ালাদের বস্তি ছাড়িয়ে, চামড়ার দুর্গন্ধে ভরা ঘোড়ার জিনের কারিগরদের মহল্লা পেরিয়ে পিদীমা, নির্ভার বাড়ির দিকে চলেছে—সেসব কোনদিকে অক্ষেপ নেই ম্যাগডালার সেই অপরূপ রূপসী মেয়ে ম্যাগড্যালিনের ( মিরিয়ম ) !
খট-খট-খট তাদের ম্যাগডালার সেই ভাঙ্গা নড়বড়ে কুঁড়ে ঘরটার মতই জীর্ণ একটা ঘরের সামনে গিয়ে খুব জোরে কড়া নাড়ল সিমন ।
ও মা !—তুই এসে গেছিস, উচ্ছ্বসিত হয়ে ছুটে বাইরে এল নিভা। কিন্তু মিরিয়মের দিকে তাকিয়েই শুষ্ক হয়ে গেল। অস্ফুটস্বরে বলল, ইস, ক হুন্দর হয়েছিস তুই—
তোমার বৌদি দেয়া বলে দিয়েছে, সিমন বলল, ভালো কোন স্বজাতির (ইহুদী) ছেলে-টেলে রেখে সাদী দিয়ে দিতে, বলেই জোব্বার ভেতর থেকে বের করে জেরার একটা চিঠিও দিল। সাদী তো দিতেই হবে সিমন ভাই, মিরিয়মকে বুকের ভেতরে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে বলল নিভা ওই আগুনের মত রূপ নিয়ে এসেছে এই শহরে, রোমীয় শকুনেরা ওকে ছিড়ে খাবে। নির্ভার চোখে আশঙ্কার ছায়া কাপে থর থর করে।
কিন্তু মিরিয়ম-
ম্যাগডালার মেয়ে ম্যাগড্যালিন, যে পাকে পদ্মফুলের মত সেই গ্যালিলির সমুদ্রের ধারে দরিদ্র ধীবর পল্লীতে জন্ম নিয়েও বাইবেলের রমণীদের ভেতরে সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয়, রূপরম্যা ও লাস্তময়ী তরুণী হয়ে বিপুল খ্যাতি অর্জন করবে, হয়ে উঠবে খ্রীষ্টধর্মের সেই রক্তক্ষয়ী ঘটনাটিল ইতিহাসের এক রোমাঞ্চকর নারিকা,—তার জীবনের গতি কি কখনো বিয়ে-ঘর-বর সন্তান— সেই গতানুগতিক পথে নিয়ন্ত্রিত হয়—না হতে পারে ?
পিসীমা নিভা মাঝবয়সী মহিলা। দীর্ঘকাল শহরে থেকেও তার চোখেমুখে শহুরে ছাপ পড়ে নি। আর পাঁচজন ইহুদীর মত কট্টর রোমীয়- বিদ্বেষী। সে চেয়েছিল, ভাইঝির বিয়ে দিতে। কিন্তু পিসেমশায় জানেশা ফ্যারিসীদের প্রধান পুরোহিত মারাকাসের প্রাসাদের তিন নম্বর পরিচারক, তার মনে হলো, যদি মিরিয়মকে একবার জুপিটারের মন্দিরের কি পণ্ডিয়াস পাইলেতের রাজপ্রাসাদের নর্তকী করে দিতে পারে, তাহলে নির্ঘাত বড়কর্তাদের নজরে পড়বে ওই অসামান্ত রূপলাবণ্য আর তার ভাগ্যটাও ফিরে যাবে
শোন—আমি মিরিয়মকে রাজপ্রাসাদের নৃত্যশিক্ষক ডিমিট্রিয়াসের কাছে— না—না—তুমি আমার ভাইঝিকে রোমানদের বেশ্বা করতে চাও, ক্ষিপ্ত আক্রোশে বাঘিনীর মত চীৎকার করে উঠল নিভা। হাতে হাত চেপে ধরে কেটে কেটে বলল, তুমি ওই বেতার দালাল শয়তান গ্রীকটার কাছে ওকে নেবে না বলছি—কয়েক মুহূর্ত পর শান্ত হয়ে বলল, আমাদের গ্রামের উরি—ওর ছোটবেলার বন্ধু। এই সেদিনও ওর খোঁজে এসেছিল। তার সঙ্গে এর—
না—পিসী, উরিকে সাদী করতে পারবো না — বিয়ে-টিয়ে আমাকে দিয়ে হবে না, তীব্র একটা উত্তেজনায় নিভাকে জড়িয়ে ধরে কাপা কাপা গলায় বলল, আমি রোমীয়দের বড় মন্দিরের নর্তকী হবো। পিসী আমার যে টাকা চাই—গয়না চাই—অনেক অনেক ঐশ্বর্য চাই পিসী।
মিরিয়মের সেই উত্তেজিত উদ্ভ্রান্ত মূর্তির দিকে তাকিয়ে নিডা ভয় পেয়ে গেল।
জামেশার মুখে হাসি ফুটে উঠল ।
মিরিয়মের অপূর্ব দেহসৌঃব রূপের জরুরী ডিমিট্রিয়াসের নজরে পড়তে দেরী হল না। মুগ্ধ-বিশ্বয়ে ম্যাগডালার সেই রূপসীর দিকে তাকিয়ে তার পিসেমশায় জামেশাকে বলল, এ মেয়ে তো রাজরাণী হবে গো—ওর পা দুটো দেখেছ ? আর কিছু বলল না। কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করল ।
মিরিয়মের সেই স্বর্ণলতার মত তনুদেহ আর মোমের মত মন্থন নিটোল দুটো পায়ে অসাধারণ নৃত্যপটিয়সীর ভবিষ্যৎ আভাস আছে।
সে তখুনি সিদ্ধান্ত করে ফেলল, ফ্যারিনীদের প্রধান পুরোহিত জায়াফাসের প্রাসাদে যে ধর্মোৎসব হবে সেইখানে রাজনর্তকীদের সঙ্গে উপস্থিত করবে প্রস্ফুটিত ফুলের মত নজীব এই হুযৌবনা অপ্সরীকে। চমকে উঠবে সায়াফান, চমকে উঠবে জেরুজালেমে রোমান সম্রাটের প্রতিনিধি পন্থিয়াস পাইলেত। কিন্তু তার আগে ওকে একটু তালিম দিয়ে নিতে হবে।
এইখানেই একদিন বাগা-কে দেখে উল্লসিত হয়ে উঠেছিল মিরিয়ম । ডিমিট্রিয়াসের গৃহে নর্তকীদের দেখাশোনা করে আর নাচের সঙ্গে ধান বাজার এক বুডো ইহুদী সাব্বা। ক্রীতদাস হয়ে থাকার সময় কে জানে কোন অপরাধে তার একটা চোখ ধারালো ছুরি দিয়ে উপড়ে দিয়েছিল রোমীয়রা ।
একদিন নাব্ব। নিবিয়নের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিল ম্যাগডালিন, তুমি রূপসী। রোমীয়দের অঢেল সম্পদ এসে তোমার পায়ের নীচে লুটিয়ে পড়বে। তোমার গরীব স্বজন পরিজনদের কিন্তু ভুলে যেও না মিরিয়ম না-না ভুলবো কেন সাব্বা-ভাই ।
অনেক পরে জেনেছিল বিদ্রোহী ইহুদীদের দলের সঙ্গে সাব্বার যোগাযোগ ছিল ।
আলোকোজ্জ্বল মহানগরী জেরুজালেম। তার চারিদিকে হুরক্ষিত প্রাচীরের ওপরে সতর্ক প্রহরার নিযুক্ত রয়েছে বর্ণাঢ্য পোশাকে হুসন্দিত শত-শত সশস্ত্র প্রহরী। দূরের শহর, জনপদ থেকে দলে দলে আসছে পুরোহিতরা। তাদের পরণে বকের পালকের মত সাদা ধবধবে পোষাক। তাদের পরেই মিছিল করে আসছে রোমীয় শাসনকর্তার প্রতিনিধিরা। তাদের গায়ে রক্তকরবীর মত টকটকে লাল ভেলভেটের পোষাক। কোমরে রকমক করছে সোনার বাট লাগানো দীর্ঘ তলোয়ার। তাদের অনুসরণ করে আসছে ক্রীতদাসদের দল। ওদের প্রত্যেকের মাথার রূপোর বড় বড় খালায় তাল তাল সোনা হীরা-জহরৎ, আর সুস্বাদু খাণ্ডসামগ্রী—দেশের মানুষের দণ্ডমুণ্ডের মালিক পুরোহিতদের উপঢৌকন ৷
এই রঙীন মিছিল চলেছে প্রধান পুরোহিত সায়াফাসের প্রাসাদে ধর্মোৎসবে। রাজপথের দুপাশে অলন্ত মশাল হাতে নিয়ে ছবির মত দাড়িয়ে রয়েছে কাজী ক্রীতদাসবা। ব্যক্তি বাঙ্গছে, বাজছে বিউগিল, বাজছে ঝার আর সানাই । বিচিত্র সেই ঐক্যতানের হুমধুর মূর্ছনায় চারদিক কেমন আচ্ছন্ন আর বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
দূরে আলোর দীপালি জ্বলছে শ্বেতপাথরের তৈরী সায়াফাসের সুরম্য প্রাসাদের ভিতবে বিশাল সভাকক্ষে কাঞ্চনময় মঞ্চে বসে আছেন জেরুজালেমের প্রধান শাসক পণ্ডিয়াস পাইলেতের প্রতিনিধি প্রধান সেনানায়ক কমোডাল । তার পাশেই পুরোহিতদের সর্বাধিনায়ক বুদ্ধ অ্যানন্স, তারপরেই সায়াফাস এবং অন্যান্ত মন্দিবের পুরোহিত বর্গ। সায়াফাস ইঙ্গিত করতেই ঝংকার লাগল বীণার তারে তারে। আর হুগন্ধী ফুলের বলয়ে সাজানো নৃত্যস্থলীতে যেন মরালীর মত ভেসে ভেসে এল ঘর-যৌবনবতী রাজনর্তকীরা।
কিন্তু একী! চমকে ওঠে কমোডাসের চোখের দৃষ্টি। সায়াফাসের রক্তাভ কুটিল চোখে একটা প্রশ্ন খনিয়ে আসে নৃত্যপটিয়সীদের রুক্ষ জড় সৌন্দর্যের মাঝখানে এ কোন রূপধঞ্চা নারী ! এর প্রতিমার মত সুডৌল মুখে কেমন শান্ত আর স্নিগ্ধ জ্যোত্মার মত কমনীয়তা !
প্রবল হয়ে ওঠে বীণার ঝংকার তীব্র উল্লাসে বেজে ওঠে জলতরঙ্গের মধুর হয়। নর্তকীরা তাদের যৌবনপুষ্ট দেহের লীলায়িত বিন্যাসে বিচিত্র মুজা রচনা করে নাচতে থাকে।
কিন্তু দূর থেকে ডিমিট্রিয়াস যন্ত্রণার জলে যায়। কিছু হচ্ছে না মিরিয়মের নাচ। ওর উদ্দাম পদক্ষেপে কেমন একটা বক্তৃতা ফুটে উঠেছে। এত করে তালিম দিয়েছে—
বন্ধ কর নাচ, হঠাৎ কমোডাস নিজের উরুতে একটা চাপড় মেরে চীৎকার করে বলল ডিমিট্রিয়াসকে, তোমার আর সব নর্তকীদের বিহার করে শুধু নতুন মেয়েটিকে নাচতে বলো-
সায়াফাসের ইঙ্গিতে মিরিয়মকে ভেতরে নিয়ে যেয়ে আর এক পোষাকে সাজিয়ে নিয়ে এল ডিমিট্রিয়াল। প্রায় নগ্নদেহের অধোভুবনে স্বচ্ছ আর হাতা কমলা রঙের একটা ঘাঘরা ।
আবার বেজে উঠল অর্কেস্ট্রা। যেই নিজের যৌবন সত্তারকে অবারিত করে দাড়ালো মিরিয়ম অমনি তার চেতনার ভেত্তরে মর্মরিত হয়ে উঠল সেই গ্যালিলির সমুদ্রের কলোপ্লাস, নিঃসীম বালুচর আর ঈশ্বরের কাছে নৈবন্ধের মত নিবেদিত নিজের অনাবরণ দেহের অপরিসীম সৌন্দর্য। সঙ্গে সঙ্গে তার প্রায়ুতে থাহুতে উত্তেজনার তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল। আর উদ্দাম গতিতে নাচতে লাগল মিমি।
উতরোল হয়ে উঠল বাজনা। মিরিয়ম নাচছে পাগলের মত। তার পা দুটোর ওপর কোন বশ নেই। তার রক্তে জেগেছে গ্যালিলির সমুদ্রের সেই আদিমতা। তীব্র বেগে নাচের তালে তালে তার রক্তিম চুলের ঢেউ আছড়ে পড়ছে উত্তর বুকের ওপরে। আবার পরমুহূর্তেই সেই ঢেউ সরে যাচ্ছে আর বিদ্যুতের রেখার মত ঝলসে উঠছে রঙীন কাচুলির আড়ালে দুটো বিচিত্র বিভ্রমের ছবি।
বাহবা বাহবা—পৈশাচিক উল্লাদে চীৎকার করে উঠল প্রধান পুরোহিত সায়াফাস। প্রায় স্বচ্ছ পোষাকের আড়ালে অগ্নি শিখার মত জ্বলন্ত সেই যৌবনের মূর্তি অভিজাত রোমীয় এবং ক্যারিমীদের আঙ্কুকে বিকল করে দিল। তারা কেউ হীরের আংটি, কেউ বহুমূল্য নীলাভ পাথর বসানো মুক্তোর অঙ্গুরী, নানারকমের জড়োয়া গয়না, রক্ত প্রবালের মালা ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতে লাগল মিরিয়মের দিকে।
কিন্তু বিচিত্র সেই নর্তকীর কোনদিকে খেয়াল নেই। কখনো স্বর্ণলতার মত দুটো বাহু তুলে, কখনো চক্রাকারে পাক খেয়ে খেয়ে সে উদ্ধার গতিতে নেচেই চলেছে।
এক সময় সেই উদ্দাম বেগ কমে এল। ঈশ্বরের কাছে ভক্ত যেমন আকুল হয়ে নিজেকে নিবেদন করে ঠিক তেমনি সায়াফানের পায়ের ওপরে লুটিয়ে পড়ল মিরিয়ম । স্তব্দ হয়ে গেল অর্কেষ্টা! কেমন একটা অভিভূত
আচ্ছন্নতার ভেতরে তলিয়ে বসে রইল দর্শকরা, হাততালি দিতে পর্যন্ত ভুলে গেল।
বাগা ছুটে এসে ম্যাগডালিনের প্রায় অনাবরণ দেহ-টি পরমযত্নে রক্তবর্ণের রেশমের চাদর দিয়ে ঢেকে দিল। আর রোমীয়নের উপহার রাশি রাশি অলঙ্কার আর মনিমুক্তা দ্রুত হাতে একটি থলিতে ভরে নিল। ধীরে ধীরে উঠে হাড়ালো মিরিয়ম। আলোকোজ্জ্বল সেই নৃত্যম্বলীতে তার বাজেন্দ্রাণীর মত শান্ত সমাহিত রূপের ঐশ্বর্য দেখে রোমীয় নোবেলদের অপলক চোখে মুগ্ধ তন্ময়তা থম থম করতে লাগল ।
এইবার কমোডাসের সামনে এসে দাড়ালে। সেই প্রদীপ্ত অগ্নিশিখা। মধু খাওয়া মৌমাছির মত কয়েক মুহূর্ত ঝিম ধরে রেখে হঠাৎ অবরক্ষ আবেগে উত্তেজনায় চীৎকার করে উঠল সেই রোমীয় সেনানায়ক কমোডাস, তুমি কে কে তুমি ?
জলতরঙ্গের মত মিষ্টি শব্দ ছড়িয়ে লিখিল করে হেসে উঠল মিরিয়ম । হাসির বেশ টেনে বলল, আমি ম্যাগডালার মেরী।
সুন্দরী—তুমি—তুমি অসাধারণ সুন্দরী, যেন সুখস্বপ্নের ঘোরে বিড বিড় করে বলল কমোডাস। বলেই তার গলায় পরিয়ে দিন মহার্ঘ সোনার মালা ।
এদিকে এস রূপদী, মধুঝরা কন্ঠে ডাকল সায়াকাস। তাঁর রক্তবর্ণ রেশমের মত নরম চুলে হাত বুলিয়ে তার কানে পরিয়ে দিল হতে একটি হীরের কর্ণপুর। মুহূর্ত্তে হীনমন্যতার ছায়ায় আচ্ছন্ন হযে গেল প্রবীন পুরোহিত অ্যানন্সের মন। সে দ্রুত নিজের হাতের সুবর্ণ কঙ্কন খুলে পরমষতে পরিয়ে ছিল মিরিয়মের বাহুতে ।
জেরুজালেমের শাসক এবং অভিজাত সমান্ত ব্যক্তিদের প্রীতির উপকারে সালস্করা হয়ে সম্রাজ্ঞীর মত দৃপ্তভঙ্গীতে এল মহিলাদের কাছে। তাদের চোখে জলজল করছে ঈর্ষা। অসাধারণ সেই রূপরাশির সামনে তারা নিজেদের অত্যন্ত অসহায় আর দীনাতিদীন মনে করল। মেয়েদের ম্লান বিষ মুখের দিকে তাকিয়ে হাসি ঝিকমিক করতে লাগল মিরিয়মের চোখে— গর্বের হাসি ।
আলো ঝলমল সেই দরবার কক্ষ থেকে বেরিয়ে মিরিয়ম আর বাগা এ অন্ধকারে আচ্ছন্ন উত্তানে। জমাট অন্ধকার থেকে হঠাৎ একটা ছায়ামূর্তির মত ছুটে এসে মিরিয়মকে বুকের ভেতরে জড়িয়ে ধরল নিভা। অস্ফুটস্বরে বলল— মেরী মেরী—তুই—রাজরাণী হতে পারবি—তোর মা-র স্বপ্ন— তীব্র আবেগে তার কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে এল।
সায়াফাসের বিশাল পুরম্য প্রাসাদ সংলগ্ন সেই প্রাচীন উত্থানে অন্ধকারে এক একটা অতিকায় প্রেতের মত গায়ে গা দিয়ে জড়াজড়ি করে দাড়িয়ে রয়েছে ইউক্যালিপটাস আর জলপাইগাছের সারি। দূরে গা গা বাতাসের আর্তনাদ আছড়ে পড়ছে সাইপ্রাসের ঝিরিঝিরি পাতায়।
সেই আদিম অন্ধকারে নিশদ পায়ে চলেছে তিনটি ছায়াদেহ। তিনটি রমণী—তাদের হাতে বহুমূল্য পশমের চাদরের পুটলী, তার ভেতরে জেরুজালেমের অভিজাতদের অর্থ—রাশি রাশি স্বর্ণালঙ্কার, তীরে, প্রবাল, পুষ্পরাগ, ইন্দ্রনীল ও মরকতমনি অপর্যাপ্ত ঐশ্বর্য অতএব-
যা হয়, হয়ে থাকে। তাই হল-
আগরগাছের ঝোপের ভেতর থেকে নেকড়ের মত অতর্কিতে তাদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল তিন দুরবৃত্ত। ওদিকে সেই রাত্রেই গুপ্তচর বিভাগের প্রধান কমোডাসের কানে কানে ফিসফিস করে বলল কত গুলো ভয়ঙ্কর কথা—
সে কী! কঠোর হয়ে উঠন রোমীয় সেনাপতির ভারী মাংসল মুখ- খানা। তার রক্তচোখে হু হু করে জলতে লাগল বন্ধ হিংসা। দাঁতে হাত চেপে ধরে বলল কমোডাস, তুমি কি বললে নাচের সময় যে বুভো কানা ইহুদীটা বাশী বাজাছিল-
হ্যা—এর নাম সাব্বা—বিদ্রোহী ইহুদীর দল অর্থাৎ জিয়ালটদের সঙ্গে ও গোপন যোগাযোগ আছে—
তুমি বলছো ম্যাগতালার সেই সুন্দরী নর্তকীর সঙ্গে সাব্বার খুব ভাবনার আছে, উত্তেজনায় কমোডাদের চোখদুটো দুখও আগুনের মত ঝকমক করতে লাগল। হঠাৎ অহিত বাঘের মত গর্জন করে বলল, হা করে দাঁড়িয়ে দেখছ কি—যেমন করে পারো, যেখান থেকে হয় যে অবস্থার থাক, নাচিয়ে মেয়েটিকে ধরে নিয়ে এস-এক রাত্রে সে গত উপহার পেয়েছে সেসব যদি জিয়ালটদের হাতে পড়ে ?
কমোডাল অস্থির পায়ে পায়চারী করতে শুরু করে। অসহ—অস‍ একটা যন্ত্রণায় জ্বলে যায় তার বুকের ভেতরটা। তার মনের ভেতরে জলজন করে উঠল তন্বী হুঠাম এক পরমা। নারী। তার চাপার কলির মত দীর্ঘ আঙ্গুলে সে নিজের হাতে রক্তপ্রবালের অঙ্গুরীয় পরিয়ে দিচ্ছে—
সেই রাত্রেই পুঞ্চনগরীর দিকে দিকে সেই অসাধারণ রূপসী নর্তকীর খোজে সশস্ত্র প্রহরী পাঠিয়ে দিল কমোডাস ।
সেই রাত্রে কেন যেন মিরিয়ম-কে নিয়ে নিজের বাড়িতে গেল না নিভা । পেনিম উপত্যকায় ঘোড়ার জীনের কারিগরদের নোংরা বস্তীতে তার পরিচিত এক বৃদ্ধাব কুঁড়ে ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল।
রাত্রি গভীর হলো
গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গেল বৃদ্ধা। খড়ের গাদার ভেতর থেকে দুইটি পুটলী বের করে নিয়ে এল বাগা। বারান্দার মেঝেতে একটি সুদৃশ্ন চাদর পেতে মিবিষম ছড়িয়ে দিল রাশি রাশি সুবর্ণমুদ্রা। সেই মুদ্রাগুলোর ওপরে সাজিয়ে রাখল রোমীয় নোবেলদের স্বর্ণালঙ্কার! ভারত পাশে সধরে রাখ মেয়েদের স্বর্ণাভবণ—ব্রেসলেট, নেকলেশ নানা বৈচিত্র্যময় ইয়ার-রিং।
শোন, পিসী, বিপুল সম্পদের অধিশ্বরী সম্রাজ্ঞীর মতই আদেশের সুরে বলল মিরিয়ম, পুরুষদের এই গয়নাগুলো তো আমার পক্ষে পরা সম্ভব নয়, একটু থেমে আববি বলল, তবে কমোডাস আর সায়াফাসের আংটি দুটো রাখবো, আর রাখবে। মেয়েদের গহনাগুলো আবার হঠাৎ থেমে গেল সে। তার ঘন কালো চোখদুটো কেমন দূর আর স্বপ্নাচ্ছন্ন হয়ে উঠল। আস্তে আস্তে বলল বাদবাকী সোনা রুপোর অলঙ্কার যা আছে—সব বিক্রি করবো, সেই টাকা দিয়ে আমি একটা মস্তবড় বাড়ি কিনবো তার চারিদিকে থাকবে বাগান—বাড়ি। বলছিল কী তুই নির্ভার চোখদুটো বিস্ময়ে ছটফট করে। নিতু নিভূ গলায় বলে, তুই কি মাংসাশী নরপশুগুলোর অত্যাচার সহ্য করে এই শহরে থাকতে পারবি মা—
পারবো — পিসী—পারবো। চারিদিকের প্রগাঢ় স্তব্ধতার ভেতরে যেন ঝন অন করে বেজে উঠল মিরিয়মের কন্ঠস্বর। কয়েক মুহূর্ত কি ভেবে যেন অনেক অনেক দূর থেকে বলল, আমি—আমি যদি একবার এখানে স্থায়ী হয়ে বসতে পারি, হঠাৎ থেমে গেল। চবির তেলের কুপির ছায়া কাপা আলোর তার চোখদুটো বিদ্যুতের মত ঝকমক করে উঠল। নিজের তরী হঠাম অবয়বের দিকে ইসারা করে বলল, সুগন্ধী জলপাই তেল আর গন্ধপুষ্পের নির্বাস মেখে মেখে এই দেহটাকে আরও রমণীয়— আরও আকর্ষণী করে তুলবো। সুডৌল বুকের দুটো উদ্ধৃত গ্রহের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল, পুরুষের ভোগবাসনা- স্থল এই দুটো-কে আবদ্ধ করবো রূপোর চুমকি বসানো পীতবর্ণ রেশমের কাঁচুলীতে। আর কানে দুলবে মুক্তোর ঝুমকো। গলায় শোভা পাবে সোনার নেকলেশ। মাথার কেশগুচ্ছের কোনটায় অলজ্বল করবে মরকত মণি, কোনটায় পুষ্পরাগ, কোনটায় রক্তপ্রবাল, বলতে বলতে তীব্র উত্তেজনার আবেগে যেন খেই হারিয়ে ফেলল মিরিয়ম। শুষ্ক হয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিে রইল উঠোনের অভাবের দিকে। সে যেন দেখতে পাচ্ছে, সেই জমাট অন্ধকারে তাঁর অতুলনীয় রূপ যার উদগ্র যৌবনের পসরা নিয়ে একটা রঙীন মরিচীকা যুক্তির মত অলজল করছে তার দীর্ঘ ক্ষীণ তছ। দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে সংযত করল সে। শান্ত কণ্ঠে বলল, দেখবে সারা জেরুজালেম আমার পায়ের নীচে লুটিয়ে পড়বে—একটু থেমে চারদিকের পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে যেন হঠাৎ সচেতন হয়ে বলল যাও –চাও—পিসী দাড়িয়ে দেখছ কি-এর পরে দিনের আলো—
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই নিডা অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
শহরের শেষ প্রান্তে স্বর্ণকার জোব্বার বাড়ি থেকে ফেরার সময় বাজারের ভেতর দিয়ে আসতেই নির্ভার কানে পড়ল—
আরে শুনেছো ম্যাগডালার সেই সুন্দরী নাচনেওয়ালী ছুড়িটার সঙ্গে নাকি জিয়ালটদের যোগাযোগ আছে বলে, এক বুড়ো ইহুদী মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাকিয়ে বলছে—শয়তান কমোডাদের সৈন্তরা সারা শহরে হবে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে
নর্তকীকে—
পিসীমার কাছে সব শুনে মিরিয়মের মুখে ভয়ের ছায়া পড়ল না। কমোডাসের উপহার সেই সোনার নেকলেশ পরে চলে এল রোমীয় সেনানায়কের প্রাসাদে ।
কাঞ্চনময় মঞ্চে বসে আছেন রোমীয় শাদক পন্থিয়ান পাইলেডের সহকারী কমোডাস। তার সামনে মৃদুলগতি মরালীর মত এসে দাড়ালো রূপবন্তা হু যৌবনা মিরিয়ম। কমোডাদের মনে হল, যেন সুদূর আর অপার্থিব এক রমণী
মূর্তি। সমরনায়কের রক্তবর্ণ চোখের কঠোর ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আস্তে আস্তে স্নিগ্ধ হয়ে এল। মৃদুকণ্ঠে বলল, কাল রাত্রে তুমি কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলে সুন্দরী।
বিগতরাত্রে গ্রীক নৃত্যশিক্ষক ডিমিট্রিয়াস, তার পিসেমশার জামেশা এবং বংশীবাদক সাব্বা তার উপহার সেই বহুমূল্য রকমারী অলঙ্কারের লোভে তাদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তারা পরস্পর যখন কথা কাটাকাটি থেকে রক্তারক্তি শুরু করেছে তখন সায়াফালের প্রাসাদের প্রহরীরা তাদের রক্ষা করেছিল। তারপরে আর সব ঘটনা একে একে বলল মিরিয়ম । আর বলতে বলতে তার চোখ ফেটে জল এসে পড়ল। ঘন কালো ভাগ দুটো চোখের কোনায় কোনায় অশ্রুবিন্দু দেখেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল কমোডাস। আর অস্তি দ্রুত মিরিয়মকে তার প্রশন্ত বিশাল জাহর ওপরে বসিয়ে নিয়ে বলল, তুমি বিচলিত হচ্ছো কেন সুন্দরী? একটু খেয়ে প্রখর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আবার বলল, আচ্ছা সাব্বা যে জিয়ালটদের দলের লোক আর তাদের সংস্কার জন্যই যে গহনা লুঠ করতে এসেছিল—এসব কি তুমি বুঝতে পেরেছিলে ?
রোমীয়দের অঢেল ঐশ্বর্য, সারা জেরুজ্যালেমের সম্পদ তোমার পায়ে লুটিয়ে পড়বে সুন্দরী, হঠাৎ গাব্বার কথাগুলো তার কানের কাছে বেজে উঠল। নিশ্চয়ই মাজার নিজের জন্য নয়, সে জানে সাল। লোভী নয়, তার দলের জন্মই সোনাদানা নিতে এসেছিল মনে হয়—এসব কথাই তার বোধরাজ্যের কুয়াশার ভেতরে ছটফট করতে লাগল। কিন্তু মনের ভাব গোপন করে মুখে মোহমাখা হাসি ফুটিয়ে বলল মিরিয়ম, মহামার কমোভান আমি সামান্য গেঁয়ো মেয়ে—তোমাদের এই শহরে রাজনীতির কি বুঝি বলো ?
তারপরেই কমোডাসের কণ্ঠলগ্না হয়ে আবার বলল, জেনে রেখ— আমি—অত্যন্ত রাজভক্ত। আমি জানি—একমাত্র তোমাকে— বেশ—বেশ—বলো সুন্দরী তোমার কি চাই?
আমার চাই তোমার মত এইরকম একটি বিরাট প্রাসাদ। তার সামনে থাকবে বাগান, যেন মধুর এক সুখস্বপ্নের ঘোরে বলতে লাগল মিরিয়ম, সেই বাগানে থাকবে নানা রঙের ফুল-
তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হবে মিরিয়ম –
বিজয়িনীর মত গর্বিত পদক্ষেপে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এল ম্যাগডালার ধীবর করা ম্যাগডালিন। মধুর এক প্রসন্নতার আবিষ্ট হয়ে গেল তার চেতনা। রাজরাণী হওয়ার স্বপ্নটা তাহলে সত্যে রূপায়িত হতে চলেছে। কিছু—কোথায় তার রাজা? দিব্যকান্তি। গৌরবর্ণ। দীর্ঘ তহু। স্বপ্নের মত নীলাভ দুটো চোখ। ভুবনমোহন রূপের জ্যোতি বিচ্ছুরিত করে কি তিনি আসছেন তাকে নিয়ে যেতে। কবে কবে আসবে সেই শুভলগ্ন ?
তার মনে হল— তার বুকের ভেতরে দাড়িয়ে যেন অনেক অনেকদূর থেকে তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে আশ্চর্য এক অগ্নিবর্ণ পুরুষ !
তিন মাস পর।
ধূপছায়ার মত সন্ধ্যা নামছে জেরুজালেমে। মাউন্ট অলিডে বিত্তশালী অভিজাত ব্যক্তিদের হুরম্য বাসগৃহের মাঝখানে ঝলমল করছে মিরিয়মের আলোকোজ্জ্বল বিশাল প্রাসাদ। প্রধান তোরণের সামনে সুখ পান্ধী আর গোধানের ভীড়। প্রতি বদনীতে যেমন রোমীয় সেনানায়ক কমোডাস কি প্রধান ঋত্বিক সায়াফান তেমনি এসেছে পণ্ডিত, দার্শনিক, কবি ইত্যাদি বুদ্ধিজীবিদের দল। দূরদূরান্ত থেকে এসেছে হুবেশ সুন্দর সুবর্ণ শ্রেষ্ঠীরা, এসেছে উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীরা এসেছে ঐশ্বর্যশালী বণিকেরা এসেছে দূরদেশের বহুদর্শী মুসাফিররা। প্রাসাদ সংলগ্ন ঘন সবুজ ঘাসে আচ্ছন্ন বিস্তীর্ণ উষ্ঠান জুড়ে বত্নখচিত রঙীন চন্দ্রাতপ লম্বিত হয়ে রয়েছে। তার নীচে ইতস্তত এক একটি মেহগিনির তক্তাপোষে রক্তবর্ণ জাজিম বিছানো হয়েছে। তার ওপরে বসে কোথাও দার্শনিকদের দল গ্রীক দর্শনের আলোচনায় মুখর হয়ে উঠেছে, আবার কোথাও বসেছে কবিতার আসর, কোথাও বা জুড়িয়া বা জেরুজালেমের রাজনীতি নিয়ে তর্কের ঝড় উঠেছে। কাজী ক্রীতদাসরা নিঃশব্দে অতিধিদের সামনে নামিয়ে রাখছে রৌপ্যনির্মিত রেকাবীতে সুস্বাদু আহার্য সম্ভার-সুমিষ্ট রসালো খেজুর, আর নানাবিধ মিষ্টান্ন ! হঠাৎ কোথায় থেকে বার ঝর করে ঝড়ে পড়ে সুগন্ধী গোলাপজলের বৃষ্টি। প্রাসাদের অধিশ্বরীর নির্দেশে প্রাজনের দুইদিকে অন্ধকার নেপথ্য থেকে পরিচারিকারা পিচকারী দিয়ে সুগন্ধী সেই জল ছিটিয়ে দেয়। নানা আলোচনার মুখর সেই বিশ্বস্তজনসমাবেশের অদূরে চিত্রকরের আঁকা ছবির মত হাড়িয়ে আছে এক সুবেশা রমণী। বাগা। তার হাতে স্ফটিক পারে টলমল করছে মদিরা। যখন কোন কবি তার চোখ দুটোকে স্বপ্নালু করে হয়তো স্বরচিত কবিতায় ইহুদীজাতির অতীত ঐতিহের জয়গান করতে করতে আবেগে বিহ্বল হয়ে পড়েছেন, কি কোন সমাপ্ত ক্যারিসী এবং রোমীয় পণ্ডিতের ভেতরে ঈশ্বর নিরাকার না সাকার নিয়ে তুমুল বাক- বিতণ্ডার ঝড় চরমে উঠেছে—ঠিক তখুনি বাগা ছুটে এসে তাদের মোনিৰ্মিত শুক্ত পাত্রে ঢেলে দিচ্ছে জর্ডনের পার্বত্য উপত্যকার হুমিই ব্রাক্ষাসারের উত্তেজক সুরা। মদিরার উগ্র ঝাঁকানো গছে তাদের আবেগ ও উত্তেজনা আরও ৰণ্ডিত হয়ে উঠছে—
সেই হুধীজন সমাবেশের অদূরে রত্নখচিত আসনে সম্রাজ্ঞীর মত বসে আছে ম্যাগডালিন। তার সুবর্ণলতার পদযুগলে শোভা পাচ্ছে স্বর্ণখচিত পাছকা। আর কমলা রঙের মহার্ঘ মসলিনের রাজকীয় বস্ত্রাবরণে আবৃত তার দীর্ঘ তছদেহ যেন অগ্নিশিখার মত জ্বলজ্বল করছে। তার সুডৌল মুখে ঝিকমিক করছে হাসি। তার রূপ আর যৌবনের গর্বের হাসি। ঈশ্বরতত্ত্ব, দর্শন, রাজনীতি, সাহিত্য নিয়ে এখানে যারা ভর্তযুদ্ধের ঝড় তুলেছে তাদের প্রত্যেকের ভেতরে লুকিয়ে আছে এক একটি নারীমাংসলোলুপ হিংস্র পশু। কিন্তু এদের কাউকে কখনো দেয় নি প্রশ্রয়। এমন কি কমোডাসেবও সম্ভোগবাসনাকে সে শান্ত সংযত করে দিয়েছে।
একদিন গভীর রাত্রে কামনাত্মোত মাতঙ্গের মত কমোডাস এসেছিল তাব শয়নকক্ষে। বাকুনিপুণ বহুদর্শী প্রেমিকের মত নায়িকার মনহরনের জন্য রঙ্গীন কথার ফুলফুরি না জ্বেলে সমরকুশলী সেনাপতি অব্যর্থ লক্ষ্যে নিপুণ
হাতে খুলে ফেলেছিল তার ঘাঘরা, খুলে ফেলেছিল অন্তর্বাস। না—সে বাধা দেয় নি। কিন্তু যে মুহূর্তে সেই নিরাবরণ দেহলতাটিকে মত্ত উল্লাসে বেষ্টন করে তার লেলিহান লালসাকে চরিতার্থ করতে উদ্দোগী হয়েছিল অমনি সে দূরে সরে গিয়েছিল আর শ্বেতপাথরে বাধানো উঁচু আসনে উঠে দাড়িয়ে বলেছিল, মহামার ‘কমোডাস’–তোমাদের মন্দিরে ডারনা কি অ্যাফ্রোদিতির মূর্তি দেখেও কি তোমার মনে কামনার আগুন জ্বলে ওঠে ? জেনে রেখ—প্রত্যেক নারীর ভেতরেই আছে মহাশক্তিরূপিণী দেবী—কাজ- বাতির আলোয় উজ্জ্বল প্রদীপ্ত তার সম্পূর্ণ নগ্নদেহের অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের দিকে ইঙ্গিত করে আবার অস্ফুট স্বরে বলেছিল, বিধাতার দান এই নারীদেহের রূপলাবণ্য শুধু ভোগ করার জয় উন্নত না হয়ে প্রহ্মা করতে শেষ কমোডাস তোমার মঙ্গল হবে –
সেনানায়ক পাথুরে মূর্তির মতো দাড়িয়ে গিয়েছিল আর কামনার আগুন নিভে গিয়ে চোখে ফুটে উঠেছিল বিস্ময়।
কি দেখছ কমোডাস — আবার বলেছিল, এই সেদিন ক্লিওপেট্রার ওপর অত্যাচারের জন্য মিশর তোমাদের হাতছাড়া হয় নি?
আর দাড়ায় নি কমোডাস। মাথা নীচু করে চলে গিয়েছিল আর কখনো নিশীত অভিসারে আসে নি।
ওই যে বসে আছেন বিচক্ষণ জননেতা ক্যারিসীদের প্রধান পুরোহিত, সেই ধার্মিক মহাশয়টিও এসেছিলেন। এসেছিলেন লোকলজ্জার ভয়ে ফকিরের ছদ্মবেশে। পিতার বয়সী প্রবীন মানুষটিকে দেখেই স্বণায় জ্বলে উঠে বলেছিল—
আপনি ফ্যারিসী হলেও ইহুদী। ইহুদীদের মন্দিরে সোনার পাপবরণ থাকে জানেন? আর আপনি প্রধান পুরোহিত হয়ে এসেছেন কুমারীর সতীত্বমাণ করে পুণ্য অর্জন করতে
কি এত ভাবছে। ম্যাগডালিন? কমোডাস রুক্ষ কণ্ঠে বলল, আমরা কি সারারাত পণ্ডিতদের কচকচি-ই শুনবো ? তোমার নাচ শুরু করবে কখন, সায়াফাস অধৈর্য হয়ে ওঠে। আপনারা তো জানেন, ভেতর থেকে সাড়া না পেলে আমি নাচতে পারি না, গভার চিন্তার ভেতরে মগ্ন থেকেই মিরিয়ম বলল ।
দূরে-বহুদূরে মুড়িয়া পাহাড়ের আড়ালে চাদ উঠল। পবিত্র নগরী জেরুজালেম চাদের আলো মেখে স্বপ্নে বিভোর হয়ে রইল। এইবার মিরিয়মের চেতনার ভেতরে মর্মরিত হয়ে উঠল নাচের ছন্দ। নিঃশৰ পায়ে চলে গেল তার প্রসাধন কক্ষে ফিরে এল যেন কোন সুদূর অজানা রূপকথার অপ্সরী হয়ে। বাগার মূলে নাচের বোল উঠল।
সিডনের শিল্পী ইলার (মাসখানেক আগে নিচা নিয়ে এসেছিল ) বাণীতে জাগল করুন সুরের দুর্ছনা। আরম্ভ হলো নাচ ।
প্রথমে পেলব ছটো বাককে খুব মৃদু গতিতে আন্দোলিত করে নাচতে শুরু করল মিরিয়ম।
স্বহঙ্গের ধ্বনিতে, ধানর হয়ে বিষাদের হর যেন ক্রমশ গভীর হয়ে উঠতে জাগল। সেই হুমধুর করুণ হয়, স্বপ্নের মত নীলাভ পোষাকের আড়ালে রূপসী নর্তকীর দীর্ঘ ক্ষীণত বিমোহিত দর্শকদের কেমন ব্যথাতুর আর স্বপ্নাচ্ছন্ন করে তুলল। সেই গভীর ব্যথার উজান ঠেলে আসা ঐকতানের তালে তাল মিরিয়মের দেহবল্লরী যেন উত্তাল বেদনার নদীর মত ভরায়িত হয়ে উঠতে লাগল । আর নৃত্যের প্রতিটি মুদ্রার ফুঠে উঠল যেন কোন অদৃপ্ত দেবতার কাছে আত্মনিবেদনের বিনম্র আকৃতি । মুগ্ধ ও অভিভূত স্বর্ণকরের মনে হলো—মনে হলো তারা যেন কোন হুদূর বিশ্বতকালের অবলুপ্ত অতীতের করুণ সঙ্গীত শুনছে। আর তারাও যেন অতীত বর্তমান ছড়িয়ে অনেক অনেক স্মৃতি-বিস্তৃতিকে পিছনে ফেলে, লোকলোকান্ত পেরিয়ে চলেছে অজানা জগতে।
আবার হঠাৎ ধাীর হরে স্বহঙ্গের ধ্বনিতে বেদনার সঙ্গীতের পরিবর্তে জেগে উঠল উচ্ছ্বাসের ঝঙ্কার মুহূর্তে পাল্টে গেল মিরিয়ম গভীর বিষাদের সেই নীল প্রতিমা যেন থিরবিজুরী রেখার মত কমক করে উঠল। টান দিয়ে খুলে ফেলল সেই স্বচ্ছ নীলাভ গাউনের আবরণ। যেন তীক্ষ্ণ তীব্র বিদ্যুতের সাদা আলোর রেখা ঝলসে উঠল নৃত্যস্থলীতে। দর্শকদের মনে হল—একী মানব ? মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না দিয়ে গড়া নর্তকীর তথী দেহের অপাখির জ্যোতিতে যেন অন্ধ হয়ে গেল তাদের দৃষ্টি ।
চোখদুটো বুজে উতরোল বাজনার তালে তালে উদ্দাম বেগে নাচছে মিরিয়ম। কখনো হামাগুড়ি দিয়ে বসে ঠিক নিবিড় অরন্যে হিংস্র একটা বাঘিনীর মত যেন তার শিকারের দিকে এগিয়ে আসছে অব্যর্থ লক্ষ্যে আবার পর মুহূর্তেই উঠে দাড়িয়ে চক্রাকারে পাক খেয়ে উন্মত্ত বেগে নেচে চলেছে তার। রক্তিম চুলের ঢেউ আছড়ে পড়ছে তার উত্তঙ্গ বুকের ওপরে। আবার চোখের পলকে যেই সেই ঢেউ সরে যাচ্ছে অমনি দর্শকদের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে-তার রঙীণ বক্ষোবাসের আড়ালে আন্দোলিত সেই দুইটি দুরন্ত গ্রহ। তার অপ্রতুল অস্বচ্ছ বেশবাদের আড়ালে অনাবৃত আশ্চর্য যৌবনশ্রী, অতি দ্রুত আন্দোলিত হুপুষ্ট নিতম্বের ছায়াময় মরীচিকা শিল্পী, কবি, দার্শনিক রোমীয় নোবেল আর ক্যারিসী ইহুদীদের স্নায়ুকে বিকল করে দিল, বিশৃঙ্খল হয়ে গেল তাদের চেতনা ।
বিচিত্র সেই নর্তকীর কিন্তু কোনদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। বর্ষাসমাগমে ঘন কালো মেঘের গর্জনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেন এক মত্ত ময়ূরী অন্ধ আবেগে বিভোর হয়ে নেচেই চলেছে। লুপ্ত হয়ে গিয়েছে বাইরের পৃথিবীর সমাজ সংসার। এক বৃদ্ধ ফ্যারিসীর মনে হলো, এই রমণী যেন তাকে সেই নোকান্তপারের অশরীরি যাত্মার সেই চিররহস্যময় জগতে নিয়ে চলেছে।
ম্যাগডালার এই মেয়েটির নাচ দেখলে, এক পুরোহিত বিড়বিড় করে যেন নিজের মনকেই শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, মনে হয় যেন দূরাগত কোন প্রার্থনা সঙ্গীত শুনছি—
ভারনার মন্দিরের দেবদাসী বলে মনে হয় ওকে। সম্রাপ্ত এক রোমী অঙ্ক উত্তরে বলল, দেবীর কাছে আকুল হয়ে যেন আবেদন জানাচ্ছে—কিন্তু
নৃত্যের ছন্দে হিল্লোলিত দেহবল্লরী প্রায় নগ্ন অবারিত সেই দেহের অনির্বচনীয় রূপ, তার খরচ্যুতি ভ্রমণ দর্শকদের চেতনাকে পীড়িত করে তুলছিল। অসাড় হয়ে আসছিল তাদের অনুভূতি। আর যেন মেরুদণ্ডের হাড়ে হাড়ে হু হু করে ধরে চলেছিল হিমশীতল জলের স্রোত। হয়তো তার অতিথিরা আর সহ্য করতে পারবে না বলেই—
থামল মিরিয়ম। দূরে-বহুদূরে কাজল কালো দিগন্তে যেখানে মুখ থুবড়ে জবুথবু হয়ে পড়ে আছে বেথলেহাম গ্রাম, সেইদিকে তাকিয়ে মাথা নুইয়ে প্রণাম জানিয়ে থেমে গেল। নিশিপাওয়া মানুষের মত কেমন আচ্ছন্ন হয়ে
আর দূরে-বহুদূরে কুয়াশায় ঢাকা ঝাপসা পাহাড়ের দিকে চোখদুটো ছড়িয়ে দিয়ে বসে রইল সে।
না। হাততালি নয়, উচ্ছ্বসিত বাহবার উল্লসিত ধ্বনি নয়, প্রশংসার একটিও কথা নয়—নিথর অন্ধতা নেমে আসে আসরে। ইতিহাসেও আছে No applause, no clap after the dance of Mary Magdalene, one of the tantalizing Women of the Bible। বাইবেলের অসাধারণ আকর্ষণীয় রূপরস্যা, এই রমণীর নৃত্যের পর দর্শকরা এত অভিভূত হয়ে যেত যে কখনো হাততালি কি উল্লসিত হর্ষধ্বনি করতে পারতো না।
নাও। ম্যাগডালা সুন্দরী।
—অভিভূত আচ্ছন্নতার ঘোর কাটিয়ে জেরুজালেমের শ্রেষ্ঠ নাগরিক কমোডাস নিতান্ত দীন একটি অনুগ্রহ প্রার্থীর মত সসঙ্কোচে এগিয়ে আসে।
তার হাতে স্ফটিক পাত্রে রঙীন সুগন্ধী মদিরা। বলে এইটুক খেয়ে নাও মেরী-আশ্চর্য।
সে যুগে নারীর প্রতি পুরুষের শ্রেষ্ঠ সম্মান প্রদর্শনের ইঙ্গিত বহন করতো তাকে হুয়া দিয়ে আপ্যায়নে। তা জেনেও সমবেত সবাইকে বিস্ময়ে শুরু করে দিয়ে প্রত্যাখান করল তাকে। উদাস চোখদুটো দূরে শেষ রাত্রির আকাশে অনুমাণ চাজের দিকে ভাসিয়ে দিয়ে যেমন নিজের স্বপ্নের ভেতরে মা হয়েছিল। তেমনিই বসে রইল।
পূবের আকাশে ভোরের রেখা জাগো কমিল পাহাড়ের আড়ালে মুঠো মুঠো আবির ছিটিয়ে দিয়ে পূর্ব উঠল। সমাপ্ত অভিজাত রোমীয় এবং ক্যারিসী অতিধিদের শেষ মিটার বা পালকি-টি প্রাথন শূন্য করে চলে গেল।
নিডা অতিধিদের উপহার স্বর্ণালঙ্কার আর অজস্র স্বর্ণমুদ্রা ভর্তি দুইটি ঝুড়ি নিয়ে নিঃশষ পদক্ষেপে প্রবেশ করল প্রাসাদের একটি প্রকোষ্ঠে।
মহাজ্ঞানী নৃপতি সোলমনের রত্নাগারের প্রহরী, সেই রক্তচক্ষু ড্রাগনের যতই সে-ও এই কক্ষটিকে নিশিরিন সতর্ক প্রহরী আগলে রাখে।
আলো বাতাসশৃর গবাক্ষহীন সেই জমাট অন্ধকারে আচ্ছন্ন ঘরে কিসের যেন অত্যুজ্বল দীপ্তি ঝকমক করছে। শ্বেতপাথরের মেঝেতে ছড়ানো রয়েছে অস্র অগণন স্বর্ণমুদ্রা আর সেই মুদ্রার পুরু আস্তরণের এক পাশে ধরেধরে সাজানো রয়েছে বহুমূল্য স্বর্ণালঙ্কার — মিরিয়মের বিলাসী বিত্তশালী অতিধিদের প্রীতির উপকার!
নিস্তব্ধ বিগ্রহর।
প্রাসাদের সেই রত্নাগারের সংলগ্ন একটি সুরম্য কক্ষে ব্রোঞ্চের ফ্রেম দিয়ে বাধানো একটি হুবৃহৎ মুকুরের সম্মুখে ঈষৎ উচ্চ রৌপ্যখচিত আসনে সম্রাজ্ঞীর মত সমাধীন হয়ে ছিল জেরুজালেমের নগরশোষনা হম্বরী মিরিয়ম। সে স্থিরদৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে তার প্রিয়সখী বাগার দ্রুত ও নিপুণ হাতে প্রসাধন সামগ্রীর প্রস্তুতিপর্ব। সেই কক্ষের মেহগিনি কাঠের থাকে রঙীন চিত্র-বিচিত্র এক একটা মৃৎপাত্রের কোনটায় আছে জুডিয়ার, কোনটায় মেসোপটেমিয়ার আবার কোনটায় হামাভাসের জলপাই তৈল বা অলিভ অয়েল। তার এক একটা নামিয়ে নীলবর্ণ রেশমবঙ্গে আবৃত আবরণ (ঢাকনা ) খুলে-ই মিশিয়ে দিচ্ছে কাই (হুধাদিত চন্দন) চূর্ণ এবং সুগন্ধীপুষ্পের নির্বাস। উগ্র সুগন্ধে সেই প্রসাধন কক্ষের বাতাস আমোদিত হয়ে উঠল। ক্ষুদ্রাকৃতি স্বর্ণখচিত পারে হুগন্ধী অলিভ অয়েল খানিকটা নিয়ে এল স্বাগত।
এই তো গাধার দুধে মান করে এলাম বাগা—এখন আবার কিন্তু তার কথা শেষ হওয়ার আগেই বাগা তার পেলব হাতের মসৃণ করতলে কোমল দুটো পায়ের করতলে এবং অগ্নিবর্ণ দেহগাত্রে সেই জলপাই তৈল পরমদতে মাখিয়ে দিতে শুরু করল। অস্ফুট কণ্ঠে বলল, তোমাকে সাজাতে বসলেই কি মনে হয় জানো ?
কি?
মনে হয়, যেন দেবী অ্যাক্রোধিতির সোনার অঙ্গে তেল মাখিয়ে বিকৃত করছি—
না, না ওলব বলিস না বাগা সভয়ে যেন আর্তনাদ করে উঠল মরিয়ম । হুবুহু সেই মূকুরে প্রতিবিম্বিত নিজের নিরাবরণ দেহের অপরিসীম সৌন্দর্যের দিকে চোখদুটে। নিরক্ষ রেখে বলল, আমি – মামি রক্তমাংসের মানুষ বাগা একটু থেমে কয়েকমুহূর্ত কি ভেবে হঠাৎ উচ্চভ্রান্তের মত বলল, দে-হে বাগা আমাকে আরও ভাল করে আরও যত্ন করে সাজিয়ে দে। হেনার রং দিয়ে রঞ্জিত করে দে আমার হাতের করতল, লাক্ষাদার দিয়ে আমার অপর্যাপ্ত লাল চুলগুলোকে আরও উজ্জ্বল আরও মসৃণ করে তোল ।
হঠাৎ থেমে গেল সে। তীব্র আবেগকে কিছুটা সংযত করে বাগার কানে কানে বলল কতগুলো কথা। আর বলতে বলতে তার প্রতিমার মত হুডৌল মুখখানা রাজা হয়ে উঠল।
তাই না কি ? খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল বাগা।
দূরে-বহুদূরে দিগন্ত রেখায় আঁকা বেথলেহামের দিকে চোখদুটো ছড়িয়ে কেমন স্বপ্নাচ্ছন্নের মত ছাড়া ছাড়া গলায় বলল, হ্যাঁ রে আমার মন বলছে- সোনার বরণ রাজপুত্র আসছে—খুব শীগগীরই আসছে আমাকে বরণ করতে ভো-ও-ও-ও-ও-
অসময়ে মিরিয়মের অট্টালিকার প্রধান তোরণের সম্মুখে শিঙ্গ। বেজে উঠল। সেই তীক্ষ্ণ দূরাগত শব্দ মধ্য দ্বিপ্রহরের নিস্তব্ধতাকে বিদীর্ণ করে বাতাসে কাপতে কাপতে মাউন্ট অলিভ ছাড়িয়ে চলে গেল গেছিমন উপত্যকার দিকে।
বঙ্কিম হয়ে উঠল মিরিয়মের অযুগল। অসময়ে কোন অতিথি এল। কিন্তু উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী, সন্ত্রাস্ত রোমীয় এবং পদস্থ পুরোহিতরা এই শব্দের সংকেত-ই তাদের উপস্থিতি ঘোষনা করে।
সায়াফাসের সহকারী এক পুরোহিত এসেছেন, মুবিয়া পরিচারক মিরিয়মকে অভিবাদন করে বলল, তিনি আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী।
তাকে এখানে নিয়ে এম নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল মিরিয়ম।
গর্বিত পদক্ষেপে এলেন নবীন পুরোহিত। পরনে তার মর্যাদার পরিচায়ক রক্তাভ গাঢ় বেগুণী রঙের ভেলভেটের দীর্ঘ জোঝা ।
চিনতে পারছো মিরিয়ম, উল্লসিত কণ্ঠে বলল উরি, সায়াফাস আমাকে জুপিটারের মন্দিরে পার্চমেন্টকীপার নিযুক্ত করেছেন, বলতে বলতে মিরিয়মের কাছে এসে মন হরে । বহুকালের পুরানো অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত বলল, মিরিয়ম গ্যালিলির সমুদ্রের বালুচরে দাঁড়িয়ে আমাকে চুমু খেয়েছিলে, সেই চুম্বন-ই তোমার আমার চিরকালের বন্ধন হয়ে রয়েছে-
কোন কথা বলল না মিরিয়ম।
কয়েক মুহূৰ্ত্ত পরে উরির সেই হাসি হাসি গোল মুখখানার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে যেন অনেক অনেক দূর থেকে বলল সেসব ছোটবেলার কথা উরি, একটু থেমে আবার অস্ফুটে বলল আমি এখন অনেক বদলে গিয়েছি।
তুমি কি আমাকে তোমার যোগ্য মনে করো না মিরিয়ম বলতে বলতেই তার স্বর্ণলতার মত দীর্ঘ তথী দেহটাকে ধেই জড়িয়ে ধরতে চাইল, অমনি দুরে সরে গেল মিরিয়ম ।
আমার সঙ্গে তোমার জীবনকে প্রভাতে চেষ্টা করো না উরি, সম্রাজ্ঞীর আদেশের মত শোনালো মিরিয়মের কণ্ঠস্বর |
কয়েক মুহূর্ত হতভম্ব হয়ে বানাসঙ্গিনীর দিকে তাকিয়ে মাথা নীচু করে চলে গেল উরি। অপমানে আর লজ্জায় তার বুকের ভেতরটা চিন চিন করে জলে যেতে লাগল।

জুডিয়ার বিভিন্ন শহরের রোমীয় নোবেল এবং ফ্যারিনীদের কাছ থেকে নীচের আমন্ত্রন আসে। তাদের প্রত্যেককে প্রত্যাখান করে মিরিয়ম। জানিয়ে দেয়, সে শুধু তার গৃহের অতিথিদের-ই নৃত্য প্রদর্শন করে থাকে কিন্তু একদিন ভেঙ্গে গেল তার নিয়ম। জেরুজালেমের পুরোহিতদের অগ্রনায়ক অনিলের কাছ থেকে এস সনির্বন্ধ অনুরোধ। তিনি আরও জানিে আসরে উপস্থিত থাকবে শুধু মহান্ত এবং উচ্চপদস্থ ইহুদী কর্মচারীরা। দর্শকদের ভেতরে শুধু নিয়মরক্ষার জরই উপস্থিত থাকবে একমাত্র রোমীয় কমোডাস।
তার স্বজাতীয়দের সামনে সে তার নৃত্যকলা প্রদর্শন করতে পারবে। তার বুকের কলধ্বনি বাজতে লাগল ।
নৃত্যস্বনীর স্বেতপাথরের মদন মেঝেতে এসে যখন ধীর পায়ে দাড়ালো, তখন ধার্মিক ইহুদীদের ধর্মবিশ্বাসের আলোয় উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তার মনে হল, জীবনে এই প্রথম এবং হয়তো শেষ নারীমাংসলোলুপ পুরুষ দর্শকদের সম্মুখে নয়, একটি শুদ্ধ ভক্তি ও অনন্ত বিশ্বাসের প্রতীকের সামনে সে নৃত্য করতে এসেছে। মুহূর্তে একটা মহৎ, উদার ও পবিত্র অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে গেল মিরিয়মের সমস্ত চেতনা আর তীব্র একটা আবেগে তার অন্তরটা যেন বিরাট আহিত্যবর্ণ এক অখণ্ড জ্যোতিময় সবার কাছে লুটিয়ে পড়তে চাইল। তার বুকের ভেতরে কান্নার সমূদ্র উত্তাল হয়ে উঠল। বানর হয়ে আর বাগার স্বদজের ধ্বনিতে জেগে উঠল গভীর বেদনার করুণ মূর্ছনা চোখদুটো বন্ধ করে পূজারিণীর মত বিনম্র ওদীতে নাচতে শুরু করল মিরিয়ম। দেখতে দেখতে গ্যালিলির সমুদ্রের কলরোল জেগে উঠল তার পদক্ষেপে। সেই সাগরের অন্তহীন জলরাশি, বিপুলব্যপ্ত নীল আকাশ, ধু ধু বালুচর সব মিলিয়ে সেই অনন্ত মহিমার কাছে নিবেদনের এক সকরুণ ব্যাকুলতা পরিস্ফুট হয়ে উঠল তার নৃত্যের মুদ্রায়। তার বুকের ভেতরে যেন বেদনা সমুদ্র উথাল-পাথাল হয়ে উঠল। আর পারল না মিরিয়ম-
ঝড়ো একটা বাতাসের মত তীর বেগে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল মঞ্চ থেকে। আর বাতাসে বিলীয়মান হয়ে গেল তার চাপা কান্নার শব্দ।
বিশ্বয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল দর্শকরা।
বন্ধ একটা উন্মাদিনীর মত মিরিয়ম ছুটে এল বাগানে। আর স্কুলে স্কুলে ছেয়ে থাকা একটা ডালিমগাছের নীচে বসে দুহাতে মুখ ঢেকে অঝোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
বাগা এল।
তীব্র ব্যথায় মুচড়ে উঠল তার বুকের ভেতরটা। পাগলের মত চুমুতে চুমুতে আচ্ছন্ন করে মিরিয়মের গণ্ডদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিল অশ্রুর চিহ্ন!
পরম আদরে তাকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে এল পালকিতে।
নিশীথ রাত্রির নিজন পথে যেতে যেতে কেমন ঝাপসা গলায় বলল মিরিয়ম,
জানিস বাগা, আজ নাচতে গিয়ে কী যে হয়ে গেল— আবার নিজের ভেতরে মগ্ন হয়ে গেল সে। আবার যেন নিজের-ই কোন গোপন কলঙ্কের কথা বলছে তেমনি চাপা গলায় ফিসফিস করে বলল, কী আশ্চর্য আর অদ্ভুত একটা অঙ্গভুতিতে আমার সারা শরীর কেমন অবশ হয়ে এল। মনে হল— থেমে গেল মিরিয়ম। নিঃশর পথে পালকির বাহক ছবিয়া ক্রীতদাসদের পায়ের শব্দ বাজতে লাগল ।
কি মনে হলো ?
মনে হলো, অনেক অনেক দূর থেকে কে যেন আমাকে কি বলছে। একটু থামল মিরিয়ম। আবার লিটারের কারুকার্য খচিত দেওয়ালের দিকে উদভ্রান্ত আর অপলক চোখে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল, কি বলছ বুঝলাম না। কিন্তু কী মিষ্টি—কী মধুর সেই কণ্ঠস্বর। কয়েক মুহূর্ত থেমে আবার কান্নায় ভাজা ভাজা গলায় বলল, এমন কণ্ঠস্বর- আমি জীবনে কখনো শুনি নি বাগা ওদিকে আলোকজ্জল নৃত্যস্থলীতে পড়ে রইল দর্শকদের প্রীতির উপহার- ধরে থরে সাজানো মহার্ঘ স্বর্ণাভরণ থেকে শুরু করে রক্তপ্রবাদের কণ্ঠহার, নীলপ্রপ্তর খচিত অঙ্গুরীয়। আরও কত কি।
আশ্চর্য। বিচিত্র সেই নর্তকী কিন্তু আর এল না। এল না তার অর্থ নিতে।
অ্যানন্স। ম্যাগডালার দরিদ্রধীবর করা—কিন্তু কেমন মহৎ আর শুদ্ধাত্মা হয়ে উঠেছে—
বৃদ্ধ এক ফ্যারিসী। মেরীর নাচ দেখলে মনে হয় যেন জীহোভাকে আকুল হয়ে প্রণতি জানাচ্ছে
কিন্তু সায়াফাসের কুটিল চোখে সন্দেহের ছায়া পড়ে। তার সহকারী উরির মনে হয়, মিরিয়মকে জড়িয়ে আছে কোন হুজের রহন্ত। মিরিয়মের অপরিসীম মূল্যবান উপহার-কে নিদারুণ অবহেলার অগ্রাহ কবে চলে যাওয়া, তুষারের মত সাদা ধবধবে পরিচ্ছদ আর সদাসর্বদা একটা আচ্ছন্ন তন্ময় ভাব সায়াফাসের মনের ভেতবে ফুটিয়ে তুলল অনেক-অনেক দিন আগে দেখা একটি দৃশ্য—
গ্যালিলির গ্রামে গ্রামে ধর্মপোদেশ দিয়ে দিয়ে ঘুরছে এক বিচিত্র ইহুদ তরুণ। কেমন স্বপ্নাচ্ছন্ন বড় বড় নীল চোখ। তারও পরনে শুভ্র মেঘের মত উত্তরীয়।
সে কি বলছে জানে না। কখনো শোনেনি তার কথা, কিন্তু দেখেছে, গরীব-দুঃখী মানুষ তার চারিদিকে ভীত করে মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছে তার কথা। আর— সরকার থেকে নিযুক্ত করা হয়েছে যে রাব্বিকে (ইহুদী শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত, গ্রামের মানুষকে ধর্মকথা শোনানোর জন্য নিযুক্ত বেতনভূক কর্মচারী) সে মাছি তাড়াচ্ছে। একখা ঠিক গ্যালিলি অঞ্চলে যতগুলো ভণ্ড, বাকসর্বস্ব সাধুসন্ত আছে তার ভেতরে এই তারিখের ছোকরা জোয়ার-ই ভক্ত বা অনুগামীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তার মনের অন্ধকারে হঠাৎ বিদাতৎমকের ঝিলিক দিয়ে উঠল একটি অশুভ চিন্তা—তাজারখের সেই স্বপ্নবিলাসী যুবকের সঙ্গে ম্যাগভালার এই ধীবররমণী, জেরুজালেমের মক্ষিরাণীর কোন গোপন যোগাযোগ নেই তো? ডিমিট্রিয়াসের প্রাসাদের সেই বংশীবাদক একচছ সাঝা জিয়ালটনের গুপ্তচর। শুনেছে সাব্বার সঙ্গেও এই নর্তকীর খুব ভাবসাব ছিল। সাব্বা, এই নর্তকী আর সেই গ্যালিলির নবীন সন্ন্যাসী তার অসংখ্য দরিদ্র ইহুদী আ‍গামী রোমীয় শাসনের বিরুদ্ধে ইহুদী জনসাধারণের মনে পুঞ্জীভূত আক্রোশ না আর ভাবতে পারছে না সে। অজস্র বিষধর সরীসৃপের মত সন্দেহ মনের অন্ধকারে কিলবিল করতে লাগল ।
শোন উরি, নিজের ভেতরে ডুব দিয়েই বলল, সারাকাস, তুমি আগামীকাল ভোরেই গ্যালিলিতে যাবে—জোয়ার গতিবিধি লক্ষ্য করবে আর প্রতিধিন আমাকে খবর পাঠাবে
খুশির আভাসে উজ্জল হয়ে উঠল উরির গোল মুখখানা। এত বড় একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব পেয়ে আত্মপ্রসাদে ভরে উঠল তার মন।

একেবারে বদলে গিয়েছে মিরিয়ম।
অ্যানদের প্রাসাদে সেই ঘটনার পর থেকে তার ভেতরে কোথায় যেন একটা বিরাট পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। নিশিদিন তন্ময় হয়ে কি ভাবে। আর রত্নাগারে যেয়ে কেন যেন শুরু হয়ে দাড়িয়ে থাকে। অপর্যাপ্ত সম্পদের দিকে তাকিয়ে তার মনে পড়ে যায়, দূরে-বহুদূরে সেই গ্যালিলির সমুদ্রের ধারে মাছের জাপটে গন্ধে ভরা কুঁড়েঘর, মা-ভাইবোনদের রোগা রোগা শুকনো মুখ। ম্যাগডালার ধীবর পল্লীর অনাহারে অর্ড’ হারে জীর্ণ মানুষগুলোর করুণ চেহারা— রোমীয়দের অঢেল সম্পদ তোমার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়বে। দেখ স্বজন পরিজনদের ভুলে যেও না মিরিয়ম, অনেক অনেকদূর থেকে যেন বাতাসের সওয়ার হবে ভেসে এল সাজার কথাগুলো হুহু করে উঠল তার বুকের ভেতরটা। মনে মনে বলে—কোথায় কোথায়— তুমি সাব – এস এস নিয়ে যাও। আমার এত আছে যে বারে বারে তুমি নিয়েও শেষ করতে পারবে না— খুব সন্তপর্ণে আর গোপনে নির্ভার চোখের আড়ালে প্রতিদিন কিছু সুবর্ণমুদ্র। আর স্বর্ণাভরণ এক একটা ঝুড়িতে ভর্তি করে গুপ্তকুঠুরীতে রেখে দে মিরিয়ম। আর রাশি রাশি মণি মুক্তা, হীরা জহরৎ বিক্রি করে মেসোপটেমিয়া থেকে নিয়ে আগে প্রাচ্যদেশীর অতি মহার্ঘ সুগন্ধী, গাঙ্গেয় জটামাংসী, দামাস্কাস থেকে নিয়ে আসে জলপাই তৈল্য। প্রতি রজনীতে বাগা সুগন্ধী পুষ্প নির্বাস আর কারিকা মিশ্রিত জলপাই তৈল্যের প্রলেপে প্রিয়সখীর দেহ-বল্লরী স্বর্ণের মত অত্যুজ্জ্বল দীপ্তি বিচ্ছুরিত করে তোলে ঘনপক্ষ অজোড়ায় আয়তছটে। চোখে কাজল পরিয়ে দেয়।
আর বেশী সময় পাবি না বাগা। নিজের মনের ভেতরে ডুব দিয়ে কেমন উৎসুক স্বপ্নাচ্ছন্ন চোখে দূরে তাকিয়ে প্রায় নিঃশষ গলায় সে আসছে রে—
আমি — আমি বুকের ভেতরে পায়ের ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি—
তুই কি করছিস বল তো মিরিয়ম, নিভা সতর্ক করে বলে যে ভাবে খোলামকুচির মত সোনার গয়নাগুলো বিক্রি করে প্রসাধনের জিনিস কিনছিল, -তোর ভাণ্ডার যে উজাড়-
বাক-বাক পিসী পরম আদরে নিতাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আর ওসবে কি হবে—তোমার মিরিয়ম যে শীগগীরই রাজরাণী হচ্ছে গো, বলতে বলতেই তার চোখ ফেটে জল এসে পড়ল। মুখে হাসির নিঃশব্দ স্বরণা। হাসিতে চোখের
জনে অন্ধ হয়ে এল তার দৃষ্টি—

জেরুজালেমের জনাকীর্ণ পথে চলেছে একটি রৌপ্যৎচিত সুদৃত পালতি । পালকির দ্বারপথে শোভা পাচ্ছে পীতবর্ণ রেশমের আবরণ। মাউন্ট অঙ্গিভ থেকে নেমে গোয়ালাদের বন্ডী ছাড়িয়ে, ঘোড়ার জীনের কারখানা পেরিয়ে যেই লিটার বাজারে এসে পড়ল অমনি চারদিক থেকে রব উঠল—
ওই যে রোমীয়দের সেই বেশ্যা টার পালকি যাচ্ছে—
ভেঙ্গে ওড়িয়ে দে লিটার
ছিঃ ছিঃ এর মুখ দেখলেও পাপ হয়— ইহুদীর মেয়ে ম্যাগডালা থেকে এসে ওই শয়তান কমোডাস আর সায়াফাসের রক্ষিতা হয়েছে— লিটারের ভেতরে অন্ধকারে দীপশিখার মত কেঁপে উঠল বিরিয়ম। সে বেতা। তার মুখ দেখলেও পাপ হয়—কেন কি পাপ করেছে সে ? ঠক্ ঠক্ করে লিটারের গায়ে বড় বড় পাথরের টুকরো পড়তে লাগল ।
এই খবরদার কেউ পালকিতে ঢিল মারবে না। রোমীয়দের বেশ্যা নয় ও, একটা ভারিক্কী বাজখাই গলার আওয়াজে ক্রুদ্ধ জনতা নিরন্ত হল। মিরিয়ম চিনতে পারল, সেই যার সঙ্গে প্রথম এই শহরে এসেছিল, সেই তাদের গ্রামের বহুদর্শী ব্যবসায়ী এবং ভ্রমণকারী সিমনের কন্ঠস্বর। মনে মনে গভীর কৃতজ্ঞতা জানালো সিমনকে।
মারমুখী ক্ষিপ্ত জনতাকে আসতে দেখেই মিরিয়মের হবিয়া বেহারারা লিটার ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। তাই বাধ্য হয়ে সিমন চাচার সঙ্গে বাড়ি ফিরছিল মিরিয়ম।
একটা পয়সা দেবেন রাণীমা, ঠিক বাজার ছাড়িয়ে চৌরাত্তার মোড়ে আসতেই এক বুড়ো অঙ্ক ভিখারীর সঙ্গী একটি বালক মিরিয়মের কাছে হাত পেতে দাড়ালো।
রাণীমা! কথাটা যেন মিরিয়মের চেতনার ভেতরে মধুর একটা আবেশ ছড়িয়ে দিল। স্বর্ণখচিত পেটিকা থেকে একটি সুবর্ণমুদ্রা বালকটির হাতে দিয়ে অক্ষের মুখের দিকে তাকাতেই শিউরে উঠল, মূখ থেকে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে গেল -সাব্বা ভাই না ?
চুপ। সাপের মত হিস হিস শব্দ করে উঠল লোকটা। আর ভালো চোখ দুটির ওপরে ব্যাণ্ডেজটা টেনে নামিয়ে দিয়ে ছেলেটির হাত ধরে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়ে চলে গেল।
সিমনের সঙ্গে নিরাপদে ভিলায় ফিরে এসেই মিরিয়ম সাব্বার চেহারার বিবরণ দিয়ে নিভাকে বলল, পিসী যাও তাকে এগুনি ডেকে নিয়ে আসবে- কিছুক্ষণ পরেই সাব্বা এল। রাজপ্রাসাদের মতই বিশাল অট্টালিকা আর ঘরে ঘরে রাজকীয় ঐশ্বর্যের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কেন আমাকে ডেকে আনলে—তুমি বেইমান – রোমীয় আর ফ্যারিসী শয়তানদের অঢেল সম্পদ পেরে তুমি তোমার গরীব ইহুদী ভাইবোনদের—
না-না সাব্বাভাই, তীব্র আবেগে ভেঙ্গে পড়ে বলল মিরিয়ম, আমি যে আমার ভাইবোনদের ভূলিনি তা তোমাকে দেখিয়ে দিচ্ছি, বলতে বলতে টেনে নিয়ে এল তার কোষাগারে। নিজের গোপন সঞ্চয় থেকে দুটি ঝুড়ি তার হাতে
দিল। ঝুড়ি খুলতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল সাব্বার। রাশি রাশি স্বর্ণমুদ্রা আর স্বর্ণান্তর
যাও যাও সাব্বাভাই, আমার গরীব দুঃখী ভাইবোনদের বিলিয়ে দাও। দাও জিয়ানটদের তাদের অনেক প্রয়োজন আছে, অনেক-অনেক দূর থেকে ছাড়া ছাড়া গলায় বলল, শুনেছি—রোমীয় আর ফ্যারিসীদের বিরুদ্ধে তারা— চুপ—মিরিয়ম চুপ দেওয়ালের কান আছে, চাপা গলায় ফিস ফিস করে বলল সাব্বা। মিরিয়মের রেশমের মত নরম লালচুলে ভরা মাথায় হাত দিয়ে সাব্বা বলল, জীহোভা তোমার মঙ্গল করবেন— তোমার যখন খুশি আসবে সাব্বাভাই বলল মিরিয়ম ।
আর একটিও কথা না বলে সাব্বা দুটো বাস্কেট নিয়ে ঝড়ের বেগে চলে গেল।
তারপর থেকে নির্জন দুপুরে প্রায়ই আসে সাব্বা। আর জুভিয়ার রাজ- নীতির নানা খবর বলে, রাজারখের জোহরাকে যিনি দীক্ষা দিয়েছিলেন সেই জন দি ব্যাপটিস্টকে বিনা কারণে রোমীয়রা ফাসি দিয়েছে, জনসাধারণের মনে চাপা অসন্তোষ । তারা (মিয়ানটর।) সশস্ত্র বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
মিরিয়মের সুবর্ণমুদ্রা দিয়ে তারা অস্ত্রশস্ত্র কিনছে ইত্যাদি ।
বলাবাহুল্য যখুনি আসে তখনি সাব্বা নিয়ে যায় বাস্কেট বোঝাই করে সর্ণমুদ্রা।
মিরিয়মের প্রাসাদে অতিথি হিসেবে পরিব্রাজক ও বণিক প্রায়ই আসে। সেখানেও কথায় কথায় গ্যালিলির সেই তরুণ ধর্মপ্রচারকের প্রসঙ্গ উঠে।
সিমন। গ্যালিলি আর শমরিয়ার গরীব দুঃখী মানুষগুলো দলে দলে জোহরার শিষ্যত্ব গ্রহণ করছে— কমোডাস আপনাদের ইহুদীদের পীরপয়গম্বর তো পথে-ঘাটে গড়াগড়ি খায় আমি জেনেছি — আপনাদের ওই জোসুয়া না কি ফোহয়া একটি শুন্যগর্ভ বাচাল
সায়াকান জোব্বার ভেতর থেকে উরির লেখা মেষচর্ম বা পার্চমেন্টে লেখা চিঠি বের করে—শুনুন, জুপিটারের মন্দিরের পুঁথির রক্ষণাবেক্ষণকারী বা পার্টমেন্টকিপার উরিকে পাঠিয়েছিলেন খবরা খবর করতে। উরি কি লিখেছে শুনুন—“লোকটিকে সন্দেহের কোন কারণ নেই। সে প্রচার করছে, মৃত্যুর পরপরবর্তী এক অবাস্তব জীবনের কথা। পরকাল পাপপুর এসব কথা বলছে বলেই গরীবহুতো মুখ্যু মানুষেরা ভীড় করে তার কথা শুনছে।
ও-হো-উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল কমোডাস। যে যুবতী কাফ্রী ক্রীতাদাসী পাশে দাঁড়িয়ে বড় পাখা দিয়ে বাতাস করছিল, তার জানুদেশে আঁচড়ে দিয়ে চীৎকার করে বলল, গ্যালিলির এই রাব্বিকে সরকার থেকে পুরস্কার দেওয়া উচিত দেখছি, একটু থেমে বলল, পরকাল আর পাপপুন্যের আফিং খাইয়ে সাধারণ মানুষদের বুঁদ করে রাখলে আমাদের কত সুবিধা- শুভ নিশীথরাত্রে অজস্র নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে মিরিয়মের মনে হয় রাজারথের জোসুয়া কি জানে—মৃত্যুর পর পরবর্তী জীবনের রহস্য কেমন দেখতে জোসুয়া? সে-ই কি তার স্বপ্নের সেই রাজপুত্র।
আবার একদিন রাজির তৃতীয় প্রহরে দূরে বেথলেহামের দিকে তাকিয়ে নাচ শেষ করল মিরিয়ম। বিনম্রভঙ্গীতে কে জানে, কার উদ্বেগ্নে প্রণতি জানিয়ে ধীর পায়ে এসে তার রত্নখচিত আসনে বসল । একদিন মানুষের মুক্তির ইঙ্গিত আসবে ওই বেথলেহাম থেকে, লিমন বলল । এসব কথা শাস্ত্রে লেখা নেই, এক ফ্যারিসী গজ গজ করে। আমি রোমান, আমরা জানি মাটিতে পা ঠুকে বলল কমোডাস, মানুষকে সুখ শান্তি ঐশ্বর্য এবং মুক্তি বা স্বাধীনতা দিতে পারে একমাত্র রণনিপুণ সশস্ত্র দৈনিক স্বাধীনতা যার মাত্মার মুক্তি এক কথা নয় লিমন বলল, মাননীয় কমোডাস, যাদের আত্মা শুদ্ধ এবং মুক্ত, তারাই সৎ লোক। তাদের মাত্মাতেই ভগবান থাকেন –
ঠিক বলেছেন সিমনচাচা, মিরিয়মের চোখদুটো দপ করে জ্বলে উঠল, আমি যখন নাচতে থাকি তখন আমি আমার চেতনার ভেতরে, আত্মার ভেতরে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করি-
কমোডাস কথা বলল না ।
ভারী মাংসল মুখে কুটিল হাসি উঠল। মিরিয়মের বহুমূল্য বর্ণাঢ্য পোষাক, রত্নখচিত কারু শোভায় মনোহার আসন, তার দুইদিকে স্বর্ণনির্মিত ধূপধারে গন্ধৰূপের সুবাসিত ধোধায় আমোদিত বাতাস তার পেলব হুডৌল হাতে পায়ে গলার স্বর্ণাভরণ সব সব কিছুর দিকে তার ধূর্ত চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ম্যাগডালা হুন্দরী তুমি যেতোমার ওই লোভনীয় দেহের লচক দেখিয়ে এত মডেল কামিয়েছো সেটাও যদি তোমার আত্মার ঈশ্বরের নির্দেশে হয় তাহলে বুঝতে তোমার ঈশ্বর বেশ পাতা বেনিয়া—বলেই তো তো করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল কমোডাস। হাসির দমকে তার কুঞ্চিত কেশগুচ্ছে নিবন্ধ রবি, রক্তপ্রবাল, হীরা, নীলবর্ণ প্রস্তুর ইত্যাদি আভরণ দোদুान হয়ে বিনিঠিনি বেজে যেতে লাগল ।
গুণার ধিকার জলতে লাগল সিমনের চোখে ।
গভীর অনুশোচনার পাথরের মত ভারি হয়ে উঠল মিরিয়মের মন।
কেন নাচি আর নাচের সময় আমার ভেতরটা যে কি ভাবে ওলোট পালট হয়ে যায় আর নৃত্যের ছন্দে ছন্দে প্রতিটি পদক্ষেপে আমি যে বিশাল, মহৎ আর জ্যোতিময় এক সত্ত্বার অস্তিত্ব অনুভব করি—সে-টা কেমন করে আপনাদের বোঝাবো। এসব কথা বলতে চেয়েছিল মিরিয়ম। কিন্তু পারল না। মনের অনেক অনেক নীচে গহন লোকের গূঢ় কথা তো বলে বোঝানো যায় না। তাই চুপ করে থাকল। আর তীক্ষ্ণ ও তীব্র যন্ত্রনায় তার প্রতিমার অনিন্দ্যসুন্দর মুখখানা এঁকে বেঁকে কুমড়ে কুমড়ে উঠতে লাগল।
সেদিন একটা কথাও বলল না সারাকাস। মিরিয়মের চোখে এক আসন্ন সর্বনাশের ইঙ্গিত দেখতে পেল।

মাসের পর মাস কেটে যায়।
গ্যালিলির পথে প্রান্তরে, দরিদ্র ধীবর পল্লীতে যেখানে যখন যায় তাজারণের জোসুয়া, তাকে ছায়ার মত অনুসরণ করে উরি। যেমন দেবদূতের মত দেখতে তেমনি সুন্দর আর মিষ্টি তার কথাবার্তা। কিন্তু বড় অদ্ভূত আর আশ্চর্য তার বাণী —
“যারা দীন, অর্থাৎ গরীব তারাই ধন। কারণ স্বর্গরাজ্যে তাদের” প্রতিটি করা, প্রতিটি শব্দ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভাবে, খোয়ে-কোথাও কোথাও রাজদ্রোহের গন্ধ আছে কিনা। ওপরের বাণী সম্বন্ধে তার মনে হয়, গরীব ও মূর্খ মানুষদের স্বর্গরাজ্যের লোভ দেখিয়ে নিজের দলে টানার ধান্ধা করছে—
কিন্তু স্বর্গের লোভেই হোক আর যে কোন কারণে-ই হোক, দরিদ্র, ব্রাত্য মানুষ কিন্তু দলে দলে এসে তার শিশুত্ব গ্রহণ করছে। দিনে দিনে বেড়েই চলেছে তার অনুগামীর সংখ্যা। এসব বৃত্তান্ত বিশদ করে লিখে শেষে মন্তব্য করে—এখন পর্যন্ত জোয়া রাজদ্রোহকর কিছু বলছে না— মেষচর্যের ওপরে বা পার্টমেন্টের ওপরে এই তথ্য লিখে বার্তাবাহক অর্থাৎ বাণারকে পাঠিয়ে দিল জেরুজালেমে।
কিন্তু যেদিন জোসুয়া জেলে, ছুতার, কামার, মুচি প্রভৃতি দরিদ্র ও ব্রাত্য মানুষদের ছেড়ে সরকারী খাজনা আদায়কারী অথবা ট্যাকস কালেক্টরদের জড়ো করে বাণী দিতে শুরু করল, অমনি উরির বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল— সর্বনাশ—নিশ্চয়ই রোমীয় সরকারের জন্য খাজনা আদায় করতে নিষেধ করছে সেইদিন-ই আর রাণার না পাঠিয়ে নিজেই ছুটল জেরুজ্যালেমে।
জেরুজালেম! যে কোন একটা পূত্রেই সেখানে যেতে মন চায়। সেই সুদূর বাল্যকাল থেকে যে মুখচ্ছবি তার বুকের ভেতরে ক্ষত সৃষ্টি করেছে— দেখবে তার কত পর্ব ? কেন তাকে অবহেলা করছে।
সায়াফাসকে সব বৃত্তান্ত বলেই রওনা হল মিরিয়মের বাড়ির দিকে। কেন—কেন সেদিন পুরোহিতদের সর্বাধিনায়ক অ্যানদের প্রাসাদে নৃত্য করতে করতে হঠাৎ উদগত অঙ্গ গোপন করতেই অন্ধকার বাগানে চলে গিয়েছিল। কিসের দুঃখ মিরিয়মের? রোমীয় আর ক্যারিসীদের অমন দামী উপহারগুলো পর্যন্ত নিতে এল না! নিশ্চয়ই ওই ভবঘুরে বুভোটা সিমন মাখাটা বিগড়ে দিচ্ছে। কে জানে, হয়তো এর কানে কানে মন্ত্র দিচ্ছে। তাজারখের অর্থোন্মাদ যুবকটির সেই প্রলাপ উদ্ধৃত করে তোমরা যারা হুধার্ত, তারা ধর, কারণ তোমার তৃপ্ত হবে-ই কিম্বা যারা এখন রোদন করছ,
তোমরা ধন্য, কারণ তোমরা হাস্য করিবে-কী আশ্চর্য, এখন যারা খিদের জালায় কান্নাকাটি করছে, তারা পেটভরে খেয়ে পরিতৃপ্তির হাসি হাসবে । খাবার-টা আসবে কোথা থেকে শুনি? একেবারে নির্জনা ধোঁকাবাজী।
সারা দেশের আকাশে বাতাসে বিষ ছড়াচ্ছে ওই পাগলটা। না, যেমন করে হোক ওই বন্ধ উন্মাদের প্রভাব থেকে সিমনের চক্রান্ত থেকে উদ্ধার করতে হবে তার মিরিয়মকে
যদি জোসুয়ার কোন কথায় দেশদ্রোহীতার আভাস প্রমাণ করতে পারে) —তাহলে তোমার অনেক উন্নতি হবে হয়তো আমার পদটাই একদিন পাবে সায়াফাদের কথাগুলো কানে বাজতে লাগল। সে জুরিয়ার ভাবী প্রধান পুরোহিত। আর মিরিয়ম কমোডাস সায়াফাসের স্নেহধতা অভিজাত নর্তকী। তাদের রাজকীয় শুচিস্নিগ্ধ পরিমণ্ডলের ভেতরে সিমন কি সাল্ব। কোন বাজে উটকো লোককে ঘেসতে হেবে না-একটা বলিষ্ঠ সঙ্কল্প তার মনের ভেতরে স্বত্ত্বের মত মাথা উঁচু করে দাড়ালো। ভেতরে খবর পাঠিয়ে মিরিয়মের প্রাসাদের সেই প্রাঙ্গণে অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে লাগল উরি ।
দুপুরের সাঁ সাঁ বাতাস তার কানের কাছে প্রেতিনীর কান্নার মত বেজে যেতে লাগল। রাজা প্রাসাদের মত সুদৃপ্ত বিশাল সেই গৃহ। তার মহার্ঘ আসবাবপত্রে হুসজ্জিত প্রতিটি প্রকোষ্ঠের দিকে তাকিযে তার মনে হল ধাপে ধাপে উঠতে উঠতে সায়াফাসের গদীতে বসতে পারলেই সে-ও এই রকম-ই সুরমা বাসগৃহ পাবে। তখন সে আর মিরিয়ম দুজনে মিলে তাদের স্বজাতি পরিজন এবং তাদের সন্তান-সন্ততিদের ম্যাগডালার সেই নড়বড়ে কুঁড়েঘরের অন্তকার থেকে, অভাব অনটনের কবর থেকে সুস্থ-সুধী জীবনের আলোয় নিয়ে আসবে—
বাতাসে ভেসে এল উগ্র সুগন্ধ।
মিরিয়ম এল। রক্তবর্ণ রেশমের গাউনে আবৃত দীর্ঘ তছ। রক্তাভ আলোর শিখার দিকে নজর পড়তেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠল উরি। আর মাথা নীচু করে অভিবাদন করল। যেন সারা ইস্রায়েলের অধিশ্বরী কোন সম্রাজ্ঞীকে প্রণতি জানাচ্ছে অতি দীন আর নগন্ত এক ধীবর।
তুমি তো খুব বেশি দিন জেরুজালেম ছেড়ে ছিলে না, কৌতূহলী চোখে উরির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল মিরিয়ম আমার কাছে তোমার আবার কি এমন জরুরী দরকার পড়ল।’
মিরিয়ম, দেহের সমস্ত রক্ত যেন উরির মুখে এসে জমা হলো। নিশ্বাস বন্ধ করে বলতে লাগল তুমি শুনেছ বোধ হয় সায়াফান নামাকে খুব পছন্দ করে দায়িত্বপূর্ণ সরকারী কাজে আমি দেশের বহু জায়গায় ঘুরছি আর শীগগীরই
আমার আরও উন্নতি হবে, আর সেই পরমধান। আশা করি ম্যাগডানার মেরীর অযোগ্য হবে না –
আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না উরি। সারাকাস এবং কমোডাসের জন্ম তোমার যেমন কাজ আছে, তেমনি আমারও আছে অনেক-অনেক কাজ— একটু থেমে দূরে-বহুদূরে ঝাপসা ভাড়া পাহাড়ের আড়ালে বেধলেহামের দিকে তাকিয়ে নিজের ভেতরে ডুব দিয়ে বলল, আমি তোমার মত নই উরি । তুমি মানসম্মান, পদমর্যাদা রোমীয় এবং ফ্যারিসী কর্তাদের কৃপাদৃষ্টি এসব নিয়ে বেশ মত্ত হয়ে থাকতে পারে। মামি আমি তা পারি না উরি। আমার পথ সম্পূর্ণ ভিন্ন—করুণ কথাগুলো ক্রমশঃ কঠিন হতে হতে শেষের দিকে অত্যন্ত কঠোর শোনালো উরির কানে।
মিরিয়মকে তার সিদ্ধান্ত থেকে এক চুল সরানো যাবে না জেনেও মরিয়া হয়ে বলল, ও তোমার একটা খবর ছিল-
কি ?
তোমার মা ডেরা তোমাকে শুভেচ্ছা আর আনবার জানিয়েছে, একটু হেনে মিরিয়মকে প্রসন্ন করার জন্যই বলল, আমি ম্যাগডালায় গিয়েছিলাম কি না, তোমার মা-র সঙ্গে দেখা হল-
মা—তাই না কি ! মিরিয়মের চোখদুটো আগ্রহে প্রদ্বীপের মত জ্বলে উঠল। উরির কাছে এসে খনি হয়ে বলল, মা কি তোমার সঙ্গে কথা বলেছে-
নিশ্চয়ই। চোখদুটো নামিয়ে বলল উরি, বলবেন আর কি সেই এক কথা মিরিয়ম যে কি করছে- কেন – তোমাকে বিয়ে করছে না।
কখনো না দপ করে জ্বলে উঠল মিরিয়ম চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, আমার মা তোমাকে একথা বলতেই পারে না—কেন মিছে কথা বলছে। উরি মিছে কথা । ধরা পড়ে যাওয়া বাচ্চা ছেলের মত অবস্থা হল উরির।
আশ্চর্য! আবার প্রত্যাখানেও ক্রোধে জলে উঠল না। হেসে বলল, আমি এখন যাই মিরিয়ম, আকাশের নক্ষত্রের মত হুদূর সেই বাল্যসখীর দিকে তাকিয়ে বন্ধু বিদায়ের হাসি হাসল। অক্ষ উত্তরে বলল, আমি আবার আসবে। -না এসে পারব না-
প্রাঙ্গনের শেষপ্রান্তে যখন চলে গিয়েছে উরি, হঠাৎ ছুটে এল মিরিয়ম। তুমি তো গ্যালিলিতে গিয়েছিলে- জোসুয়াকে দেখেছে:— কিশোরী মেয়ের মত কলকল করে বলল মিরিয়ম, কেমন দেখতে কি রকম করে কথা বলে-
সর্বনাশ-তার কথা মুখেও এনো না বিরিয়ম। পরম আদরে মিরিয়মের নরম হাতটা নিজের হাতের ভেতরে নিয়ে বলল, লোকটা স্রেফ স্বপ্নবিলাসী। অবাস্তব আর অসম্ভব কতগুলো কথা বলে, হঠাৎ থেমে যায় সে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে চাপা গলায় আবার বলে, জানো— সে-সব কথাবার্তার ভেতরে রোমীয় আর ক্যারিমীদের বিরুদ্ধে মন্দির ও রোহিত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আভাসও পাওয়া যাচ্ছে একটু থামল উরি। মিরিয়মের সেই রঙ- পদ্মের পাপড়ির মত ডান করতলটি আরও ঘন—মারও শক্ত করে ধরে বলল, শোনো মিরিয়ম, যে যাই বলুক যে খুব গৈীর-ই দেশের শত্রু, রোমীয়দের শত্রু বলে প্রমাণিত হবে, তার পথ অনুসরণ করে কি তার ভক্ত হয়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে এনো না-শেষের দিকের কথাগুলোর ভেতরে ব্যাকুল মিনতি ফুটে উঠল।
অন্তত জোসুয়ার হুত্রেই মিরিয়ম অনেক ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, আরও হবে। হতেই হবে মনে করে আনন্দে ডগোমগো হয়ে চলে গেল উরি। প্রাঙ্গনে ছাড়িয়ে রইল মিরিয়ম। তার মনে হলো উরি ভুল পথে চলেছে।
গ্যালিলির সেই নবীন সন্ন্যাসীকে সে কখনো দেখে নি, শোনে নি তার বাণী। তবু কেন যেন তার মনে হয় মনে হয় যারা তার কথা শুনছে তারা সংসারের শোক দুঃখ থেকে পরিত্রাণ পেতে চায়, সিমন চাচা যেমন বলে, আত্মার মুক্তি। হয়তো ঠিক তার নাচের সময় যেমন হয়— তেমনি হয়তো তাদের নিজেদের চেতনার ভেতরে সমস্ত সত্বার ভেতরে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করতে চায়—

ইতিমধ্যে সারা জেরুজালেম মুখর হয়ে উঠল মহামাত এক বিদেশী অতিথির আগমনের শুভসংবাদে- মিরো! মেসোপটেমিয়ার রাজকুমার মিতো আসছে ! রাজকুমারের এই পরিদর্শনের আড়ালে আছে এক প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক
উদ্দেশ্য-
সিরিয়া, ইস্রায়েল থেকে শুরু করে প্রায় সমগ্র আরব ও ভূমধ্যসাগরের সন্নিহিত দেশগুলোতে চলছে রোমীয় শাসন। ভাইগ্রীস আর ইউফ্রেতিস নদীর মধ্যবর্তী জনপদ মেসোপটেমিয়া দার কি করে তাদের জারী প্রভাবের ৰাইরে থাকবে ? মেসোপটেমিয়ার বৃদ্ধ নৃপতি বদর্শী। তার মনে হয়েছিল যে কোন দিন অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে রোমীয়রা আর নিরীহ প্রজাদের ঘর বাড়ি আলিয়ে দিয়ে চলে যাবে। বাধা দিলেই পুত্রপাত হবে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের।
তাই- আগেই পুত্রকে পাঠিয়েছে রোমীয়দের সঙ্গে মৈত্রীর সম্পর্ক স্থাপনের জ এই সৌহার্দ্য ভ্রমণে !
পবিত্র নগরী জেরুজালেমের দিকে দিকে বাতাসে রাষ্ট্র হয়ে গেল আর একটি বোমাঞ্চকর খবর – জেরুজালেমের রোমীয় প্রকিউরেটার বা প্রাদেশিক শাসনকর্তা পস্তিযাস পাইলেড, কম্যাণ্ডার কমোডাস এমন কি রোমের সম্রাট ভাইবে বিয়াসের জন্মও চারটে বড় বড় পেটিকা ভর্তি করে এনেছে রাশি রাশি সোনা ও রূপোর তাল— মেসোপটেমিয়ার নৃপতির উপঢৌকন। মেসোপটেমিয়া সয় কিশালী দেশ। প্রতাপ প্রতিপত্তি আছে রাজার। অতএব বোম থেকে পণ্ডিয়ান পাইলেতের কাছে গোপনে নির্দেশ আসে, বিদেশী অতিথির আদর আপ্যায়নেব যেন কোন ত্রুটি না হয়-
সাজ সাজ রব পড়ে গেল সারা শহরে। পণ্ডিয়াসের নির্দেশে রাজপুত্রের সন্মানে এক বিশাল বর্ণাঢ্য সভার আয়োজন হল। স্থান নির্দিষ্ট হল- জেরুজালেমের অদূরে অ্যাম্ফিথিয়েটার। শত শত ক্রীতদাস অ্যাম্ফিথিয়েটার দিন রাত ঝাড়পোছ করে পরিষ্কার ঝকঝকে করে তুলল। রোম থেকে এল কুস্তিগীর। দৌড়ের ঘোড়া এল মিশর থেকে। আর জর্ডন থেকে নিয়ে আ হল উগ্র যৌবনবতী নর্তকী।
ওদিকে গভীর রাতের অন্ধকারে মাউন্ট অলিভের জঙ্গলাকীর্ণ গুহায় জিয়ালটনের ডেরায় জ্বলে উঠল মশালের আলো। তাদের গোপন বৈঠকে ঠিক হল—রাজকুমারের অবস্থানের তৃতীয় দিনে মন্তব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে একজন খাবে শিবিরে। সেই উত্তেজক হুয়া খেয়ে মেসোপটেমিয়ার এবং রোমীয় সশস্র প্রহরীরা যেই অচেতন হয়ে পড়বে – অমনি — উত্তরের পাহাড় থেকে ছদ্মবেশী অন্ধ সাব্বার সঙ্গী সেই বালক শিষ দিয়ে সঙ্কেত দেবে—আর তারপরেই গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব পেয়ে জিয়ালটদের বিশিষ্ট কর্মী জ্যাকেরিয়ার একমাত্র সন্তান, সেই বারো বছরের ছেলেটির মুখখানা উজ্জল হয়ে উঠল।
রাজকুমার মিরো আসছে ।

মিরিয়মের প্রাসাদের সম্রান্ত অতিথিদের ভেতরেও গুঞ্জন ওঠে। তারা মেসোপটেমিয়ার প্রজাহুরঞ্জন নৃপত্তির বিস্তা ও সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ পার তার অপর্যাপ্ত সম্পদের আলোচনায় সরব হয়ে ওঠে-
শুনছো মিরিয়ম, মিরিয়মের কানে কানে বলে বাগা, কি বলছেন এরা ! এই রাজকুমার আমার মনে হয়, তোমার না যাকে স্বপ্ন দেখেছিলেন——ইনি সেই রাজপুত্র। ব্যথার ছায়া ফুটে ওঠে তার চোখে। ভার ভার গলায় বলে,
তুমি এইবার সত্যি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে— যা-কি যে বলিস বাগা না না আমিও শুনেছি। ইলা বলল, মিরোর শুধু যে প্রচুর ঐশ্বর্য আছে তা নয়—যেমন গভীর জ্ঞান বুদ্ধি তেমনি দেখতে নাকি একেবারে দেবদূতের মত। কালো কুচকুচে কোকড়ানো দাড়ি। আর তার প্রতিটি গুচ্ছে চলছে পদ্মরাগমণি একটু থেমে আবার নিজের মনের ভেতরে ডুব দিয়ে বলল, ইনি তোমার সেই রাজপুত্র না হয়েই পারে ন:- কোন কথা বলল না মিরিয়ম । দূর দেশের তরুণ রূপবান রাজপুত্র তাকে বিপুল সমারোহে বিয়ে করে নিয়ে যাবে—এমন একটা ঘটনা-তে সে আর সকলের মত খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে পারছে না কেন—কেন তার মন আলোড়িত হয়ে উঠছে না ! ধনে জনে সমৃদ্ধ একটি দেশের ভাবী সম্রাজ্ঞী অনাগত আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কোন কিছুই তার চেতনার ভেতরে এতটুকু সাড়া জাগাতে পারছে না। তার মনের অন্ধকারে গহনলোকে গাড়িয়ে কে যেন বলছে, রাজকীয় সমারোহ, অপর্যাপ্ত ঐশ্বর্য-এসব
পণ্ডিয়াস পাইলেডের রাণার এল। মিরিয়মকে রাজকুমারের সম্বন্ধনা সভায় নৃত্যের জন্ম আমন্ত্রণ জানালো। উল্লসিত হয়ে উঠল নিভা। বাগা আর ইলা দুই সখী হুগন্ধী প্রসাধনের প্রলেপে মিরিয়মের অপরিসীম রূপ- রাশিকে আরও অনির্বচনীয় করে তুলল। ইলা বলল, রাজকুমার দেখবে ঈশ্বর এই মাটির পৃথিবীর রমণীকে তাঁর রূপের ঐশ্বর্য যেমন উজাড় করে দিয়েছেন।
মিরো এল। সেদিন পবিত্র নগরীর আকাশে জমেছে ধরে ধরে কালো মেঘ। ইলা, আর বাগা পালকিতে করে মিরিয়মকে নিয়ে যাত্রা করল অ্যাম্ফিথিয়েটারের উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে একটি কথা বলল না মিরিয়ম। বিষণ্ণ আর গম্ভীর হয়ে, কে জানে, কিসের চিন্তার ভেতরে মগ্ন হয়ে রইল।
গাঁ গাঁ করে ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা আছড়ে পড়ল মিরিয়মের নাকে মুখে শির শির করে উঠল তার শরীরের ভেতরটা।
আলোকোজ্জ্বল অ্যাম্ফিথিয়েটারে সারা জেরুজালেম যেন ভেঙ্গে পড়েছে। হুসজ্জিত মঞ্চে সারি সারি বসে রয়েছেন সম্রান্ত মহামান্ত রোমীয় নোবেলরা। তাদের মাঝখানে সভা আলো করে বসে আছে সেই রাজকুমার মিরে।। ঠিক তাব দুই দিকে দুই প্রবল প্রতাপশালী রোমীয় রাজপুরুষ – পণ্ডিয়াস পাইলে আর কমোডাস। তার ঠিক দুই সারি পরে যথেষ্ট ব্যবধান বজায় রেখে এসেছে পুরোহিত প্রধান সায়াফাস, জুডিয়ার বিভিন্ন মন্দিরের আমন্ত্রিত পুরোহিতত্ত্বন্দ এবং বিশিষ্ট ফ্যারিসীরা। বেজে উঠল বিউগিল, উঠল ড্রাম। শুরু হল বর্ণাঢ্য সামরিক পোশাকে সুসজ্জিত তিনশত সৈনের কুচকাওয়াজ। তার পরেই পস্তিষ্কাসের নির্দেশে ধীর পায়ে মঞ্চে এল মিরিয়ম ! দুরু দুরু কেঁপে উঠল তার বুক। শহরের ধনী দরিত্র নির্বিশেষে এত বড় বিশাল জনসমাবেশে সে এই প্রথম নৃত্য প্রদর্শন করতে এসেছে। হঠাৎ দেখল রাজপুত্রের বড় বড় কালো দুটো চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন তার দেহে ইচের মত বিধছে। কেমন আচ্ছন্নের মত তার উদ্ধত বক্ষোলঙ্কারের নগ্ন সৌন্দর্যকে আড়াল করার জন্যই রক্তবর্ণ রেশমের কাচুলির ওপরে আংগিয়াটা একটু টেনে দিল। জেরুজালেমের নগরশোভনা রূপসী নর্তকী সেই প্রথম পুরুষের চুষ্টির সম্মুখে সঙ্কুচিত হয়ে গেল আর বিচিত্র এক লজ্জার শিহরণে কেমন অবণ হয়ে গেল তার চেতনা।
ইলাব বাইতে জাগন হুরের মূর্ছনা। বাগার স্বহঙ্গের ধ্বনিতে ফুটল নৃত্যের বোল।
নাচতে শুরু করল মিরিয়ম। কিন্তু কেমন যেন প্রাণহীন তার নাচ। গ্র নৃত্যশিক্ষক ডিমিটিয়াস যেমন শিখিয়েছিল তেমনি চোখ খুলে আর বাজনার তালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচতে চেষ্টা করল। কিছু এলোপাথাড়ি পড়তে লাগল পদক্ষেপ।
কি করছো — মিরিয়ম, চাপা গলায় ফিসফিস করে বলল বাগা, চোখ বন্ধ করে তোমার সেই মার্চ নাচে। তোমার সেই মার্চ—
চোখ দুটো বুজল মিরিয়ম। তীব্র হয়ে উঠল বানর হুর আর যুজের ধ্বনিতে জাগন উষামতা। মিরিয়মের দেহের শিরায় শিরায় যেন ভয়দায়িত হয়ে গেল বিদ্যুৎপ্রবাহ। বিপুল বেগে চক্রাকারে পাক খেয়ে খেয়ে নাচতে শুরু করল সে তার রক্তে যেন জেগে উঠল গ্যালিলির সমুদ্রের সেই দামিতা । সেই দিগন্তবিসারী বালুচর, সাগরের বিশাল জলরাশির ভেতরে ঈশ্বরের অপার মহিমার সেই পবিত্র আর মহৎ অনুভূতিতে আবিষ্ট হয়ে গেল বিচিত্র নর্তকীর মন। আর তার নিজের ওপরে কোন বশ রইল না। তার লীলায়িত পেণীপুঞ্জে মোমের মত মদন দুটো বাহুর বিক্ষেপে বিচিত্র এক একটা বিভ্রমের মুদ্রা একে নৃত্য করে চলল সে। দেখে মনে হল যেন একটি সুখ- স্বপ্নের ঘোরে আচ্ছন্নের মত হয়ে নাচছে সে। কিন্তু
তার ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নিবেদিত সেই বিচিত্র নৃত্যের স্বর্গীয় হুমা উপলব্ধি করতে পারল না মেসোপটেমিয়ার রাজকুমার। সে দেখল, স্ফটিকের মত স্বচ্ছ ‘শবনম’ (শিশির) মসলিনের ঘাঘরার আডালে নৃত্যের ছন্দে আন্দোলিত দুইটি হুপুষ্ট জঙ্ঘার ছায়াভাস দেখল বিশাল ও কঠিন শিলাডটের মত তার গুরুনিতম্বের হিল্লোল। তার রক্তের ভেতরে জ্বলে উঠল কামনার লেলিহান আগুন ।
প্রবল করতালি আর সমবেত দর্শকদের উচ্ছ্বসিত হর্ষধ্বনির ভেতরে যেই নাচ শেষ হল অমনি মিরো তার কাছে যেতে ইঙ্গিত করল নির্তকীকে। মিরিয়ম কেমন আচ্ছন্নের মত তার সামনে এল। মিরো তার মাথার চুলে নিজের হাতে লাগিয়ে দিল একটি রুবি বা পদ্মরাগমণি। আবার হাততালির ঝড়ে ভেঙ্গে পড়ল প্রেক্ষাগৃহ।

তারপর যা অনিবার্য তাই হল।
পণ্ডিয়ানের রাণার এসে জানালো- রাজকুমার মিরোর ডুরসানা মঞ্জিলে গিয়ে একান্ত করে তাকে-ই নাচ দেখাতে হবে । নিডার বুকের ভেতরটা ঘর শুর করে উঠল। এইবার—এইবার তার মিরিয়ম রাণী হবে। বিষণ্ণতা থমথম করতে লাগল বাগা আর ইলার মুখে । সেদিন সন্ধ্যা থেকেই টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। মিরিয়ম তিন সখীকে নিয়ে এল মোরিয়া পাহাড়ে রাজকুমারের শিবিরে। তোমার সঙ্গিণীদের বাইরে অপেক্ষা করতে বলো সুন্দরী, বলল মিরো। রত্নখচিত নেই ভুরসানা মঞ্জিলের নির্জন প্রকোষ্ঠে একটি জনমূর্তির ওরা তিনজন বাইরে চলে গেল।
মুহূর্ত মিরিয়মের সেই তুষারের মত গুজ দীর্ঘতহর অপরিসীম রূপহুধা যেন আকণ্ঠ পান করল। ফিস ফিস করে বলল, তুমি-তুমি আমার দেশে যাকে সুন্দবী-ভাল তাল সোনা, মণিমুক্তা, বলতে বলতেই মরুসস্তানের রক্তে জেগে উঠল আদিমতা। টান দিয়ে সরিয়ে দিল প্রায় স্বচ্ছ দোপাট্টার আবরণ। উন্মাদের মত ফর ফর করে ছিড়ে ফেলল ভেলভেটের আংগিয়া খুলে ফেলল কালী। আর সম্পূর্ণ নিরাবরণ দুইটি দৃচ কঠিন, পরিপুষ্ট বর্তুলাকার গুনের মাঝখানে শ্বেতশুভ্র মসৃণ উপত্যকায় মুখ চেপে ধরে পশুর মত উল্লাসে গর গর করতে লাগল। কিন্তু সমস্ত শক্তি দিয়ে বাধা দেওয়া সত্ত্বেও যখন মিয়ো তার বুক নদী হযে মিশে যেতে চাইল ঠিক তখুনি নিচে গেল হাজার বাড বাতির আলো | অ—উ—হঠাৎ ভীক্ষ্ণ যন্ত্রণার মর্মান্তিক আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ল বা নকুমার মিরো। অন্ধকার নেপথ্য থেকে একটা বর্ণা এসে বিঁধে গিয়েছে তার পিঠে। ফিনকি দিয়ে পড়া তাজা রক্তের দিকে তাকিয়ে সংজ্ঞা হারিয়ে ফোল মিরিয়ম। আব রক্তের নদীর ভেতরে পড়ে রইল রাজকুমারের প্রাণহীন দেহ।
মোরিয়া পাহাডের উত্তরের জঙ্গল থেকে তীক্ষ্ণ একটা শিষের শব্দ শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে কতগুলো ছায়ামূর্তি এসে মিবোধ সেই সোনার আর রূপোর ভালে ভরা বড় বড় বাক্স গুলো নিয়ে অন্ধকারে উধাও হয়ে গেল। আর
রাজকুমারের দেহরক্ষী এবং সশস্ত্র রোমীয় প্রহরীরা? সেই দিন-ই বিকেলে এক বৃদ্ধ ইহুদী হুরা বিক্রেতা চামড়ার থলিতে করে জুডিয়ার উৎকৃষ্ট হুগন্ধী নিয়াজী বিক্রি করতে এসেছিল। যার বিক্রিও করেছিল
অতি হুলতে। সেই হুরার ভেতরে কি ছিল, কে জানে—তাই খেয়ে প্রহরীরা নেশার ঘোরে অচেতন হয়ে পড়ে ছিল সেই দুর্ঘটনার রাত্রে।
পবিত্র নগরীর আকাশে আবির ছিটিয়ে পূর্ব উঠল।
মিরিয়ম চোখ মেনেই দেখল, সে তার প্রাসারের কক্ষে সেই পীতবর্ণ রেশমের বস্তাবরণে আবৃত নরম শয্যাতেই আছে। আর তার চারধিকে তিন রমণীর উৎকণ্ঠিত মূখ পিসী, জিয়ালটদের ওপরে প্রচণ্ড অত্যাচার করবে রোমীয়রা, আতঙ্কিত হয়ে উঠে বসল মিরিয়ন, বলল, তুমি আমার কোষাগার থেকে চারটি যার বোঝাই করে সোমাহানা গল্পনা নিয়ে এখুনি চলে যাও ওদের পরিবারদের দেবে—
চারজন ছবিয়াকে নিয়ে নিতা রওনা হবে, এমন সময়-
শোন—পিসী, তার কানে কানে ফিস ফিস করে বলল, দেখবে তো লক্ষ্য করে চৌরাত্তার মোড়ে সাব্বাকে ঘুরতে দেখা যায় কিনা-
নিডা যেই বেরিয়ে গেল, অমনি মিরিয়মের প্রাসাদের সম্মুখে কোন রাজপুরুষের উপস্থিতির আভাস জানিয়ে শিক্ষা বেজে উঠল। জুতো মসমসিয়ে এল কমোডাস। মিরিয়মের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, মিরিয়ম তুমি কাল রাত্রে মিরোর তাবুতে ছিলে—বলে –কে—খুন করেছে তাকে ?
কোন কথা বলল না মিরিয়ম। তার মনের অন্ধকারে সাব্ব। ভাইয়ের এবড়ো খেবড়ো মুখখানা আমল করে উঠল। তার স্বজাতি मা এবং অন্যান্য জিয়ালটরা রোমীয়দের বন্ধু ওই ধনী বিলাসী কামুক পশুটাকে খুন করেছে বলে গর্বে আর আনন্দে ভরে উঠল তার মন-
চুপ করে আছো কেন মিরিয়ম, তুমি জানো—রোমীয় সাম্রাজ্যের সম্মান প্রতিপত্তি সব-সব নষ্ট হতে চলেছে— উত্তেজনায় ভেঙ্গে পড়ল সেনানায়ক।
উঠে ছাড়ালো মিরিয়ম। কয়েক পা এগিয়ে এসে কমোডাসের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল—আমি — আমিই খুন করেছি মাননীয় কমোডাস
সারা জেরুসালের জুড়ে ইহুদীদের ওপর শুরু হল মর্মান্তিক অত্যাচার। হত্যা- কারীদের সন্ধানের নামে রোমীয় সৈন্তরা তাদের ঘরবাড়ি জানিয়ে দিতে লাগল ।
এসব কথা কানে এল মিরিয়মের। আর ভীর একটা অস্বস্তির পীড়নে যেতে লাগল তার মাথার ভেতরটা। ধূর্ত কমোডাস তার কথা বিশ্বাস করে নি। স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল সে তার স্বজাতিদের বাচাতে চেষ্টা করছে। হঠাৎ নিদারুণ একটা হীনমন্যতায় মার অনুশোচনায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল তার মন—স্তারই। শোনিত সম্পর্কের মানুষেরা প্রাণের মায়া করে রোমীয়দের বিরুদ্ধে লড়াইতে নেমেছে আর সে ওই রোমীয় এবং তোদের অনুগ্রহপুষ্ট ক্যারিসীদের সুখসহচরী হয়ে অপর্যাপ্ত ঐশ্বর্যের পাহাড়ে বসে গাছে—ভাল ভাল কাহার মত স্বণার ধিকার জমে উঠল মনে। আর অসহ একটা যন্ত্রণায় তার চোখ ফেটে জল এসে পড়ল।
“মাজ পূর্বাণ্ডের ভেতরে ধদি হত্যাকারীরা ধরা না পড়ে, গুণানগরীর পথে পথে জানিয়ে দেওয়া হল পৰিয়াৰ পাইপেডের রাজকীয় ঘোষণা” তাহলে জেরুজালেমের ইহুদীদের সব মন্দিরের যাবতীয় সম্পত্তি ক্রোক করা হবে পার বিশিষ্ট ও সম্রান্ত ফ্যারিসীদের ফাসী দেওয়া হবে—
পুরোহিতপ্রধান এবং ফ্যারিসী নেতা সারাকাদের মাথার আকাশ ভেঙ্গে ডন। কমোডাসও তাকে শাসিয়ে দিয়ে বলল, আপনি এবং পুরোহিতদের সর্বাধিনায়ক অ্যানন্সের ওপরে দেশের আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার ভার দিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত ছিলাম, একটু থেমে সায়াফাসের রেখা জটিল মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চাপা গলায় আবার বলল, বুঝতেই তো পারছেন, হত্যাকারীরা জিয়ালটনের দলের লোক এবং তারা আপনার স্বজাতি। অতএব ধনেপ্রাণে যদি ধ্বংস হতে না চান-
সারাকাসের মনের ভেতরে ভেসে উঠল, সাব্বার মুখখানা। নিশ্চয়ই মিরিয়ম জানে, জিয়ালটদের নেতা ওই কান। বুড়োটার গতিবিধি ।
রোমীয়দের পদলেহনকারী পুরোহিত প্রধানকে দেখেই ঘৃণায় মুখ বিকৃত হয়ে উঠল মিরিয়মের। গভীর বিষাদের একটা শিলাস্তূপের মত সে সামনে এসে দাড়াল। একটি কথা বলল না। বাগা আর ইলা টু শব্দ-টি পর্যন্ত করল না। ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে উরিকে ডেকে পাঠানো। মন্দিরের বিশজন স গ্রহবা তার সঙ্গে দিয়ে তার কানে কানে ফিস ফিস করে বলল কতগুলো কথা ! টেরির গোল মুখে হাসির আভা ফুটে উঠল। দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। হুত ছিহরের জনহীন পথে পথে কালান্তকের মত ঘুরতে লাগল সে।
না, কোথায় চৌরাত্তার মোড়ে তো কোন অন্ধ বৃদ্ধকে বালকের হাত ধরে বুবতে দেখা যাচ্ছে না। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ নজরে পড়ল গোয়ালাদের বস্তির সামনে খুব খুব করছে সেই ছেলেটি। সারাফাসের অহচর, যুবক পুরোহিতকে দেখেই পালাতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু নানা পোশাক পরা সৈন্তরা চারিত্বিক থেকে ছুটে এসে তাকে ধরে ফেলল।
মন্দিরের চত্তরের নীচে ভূগর্ভের অন্ধকার কারাগারে বন্দী করে রাখা হল বারো বছরের সেই ছেলেটিকে। জিয়ালটনের বিশিষ্ট কর্মী জ্যাকেরিয়ার একমাত্র সন্তান!
সায়াফাসের মুখে সাপের জিভের মত চিক চিক করে উঠল মূর্ত হাসি ! কান টানলেই মাথা আসবে !
বিকেলে-ই জ্যাকেরিয়া এসে সারাকাসের পায়ে উপুড় হয়ে পড়ল। বলল-
আমার ছেলে কিছু করে নি—ওকে ছেড়ে দিন-
নিশ্চয়ই দেব, কিন্তু —
সায়াফা বলল তার সর্ত !
বেজে উঠল বিউগিল, বেজে উঠল ড্রাম।
রোমীয় সৈন্তরা রাস্তায় বর্ণাঢ্য এক বিজয় মিছিল করে জানিয়ে দিল মিরোর হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর রাজফুরাবের শিবির থেকে অপহৃত দুই সিন্দুক বোঝাই ধনরত্নও পাওয়া গিয়েছে—
কমোডাদের কোষাগারে জমা দেওয়া হল সোনার ভাল ও সুবর্ণমুহার ভরা দুইটি সিন্দুক। কল্পনাও করতে পারল না কমোডাস—সেসব ইহুদীদের প্রধান মন্দিরের সঞ্চিত ঐশ্বর্য !
পশ্চিমের আকাশে পূর্ব অন্ত গেল। প্রকার রাস্তার ক্রুশের কাটার বিশ্ব করা হলো জ্যাকেরিয়াকে। অসহ বেদনা তিলে তিলে সহ কবে জিয়ানট তথা জেরুজ্যালেমের সাধারণ দরিদ্র ইহুদীদের অব্যাহতি দিয়ে গেল রোমীয়দের নৃশংস অত্যাচার থেকে।

গভীর শোকের মত রাত্রি নামল পবিত্র নগরীতে।
সাধারণ দুর্বৃত্তের মত ক্রুশবিদ্ধ করা হলেও জনসাধারণ জানে, জ্যাকেরিয়া জিয়ালট। সে বিপ্লবী। বীরের মত শহীদের মৃত্যু বরণ করেছে। বন্ধ হবে গেল দোকান-পাট। আলো ঝলমলে পুণ্যনগরী অভিশপ্ত অন্ধকারে খা খা করতে লাগল ।
নির্জন প্রকোষ্ঠে অস্থির পায়ে পায়চারী করছে মিরিয়ম। সাপের মত খল আর হিংস্র এই ফ্যারিসী ও রোমীয়দের পুতীভূত এই পাপের শহর থেকে যদি এই মুহূর্তে দূরে-বহুদূরে কোথাও চলে যেতে পারতো! তীব্র যন্ত্রণা-ই যেন কণা কণা জল হয়ে গড়িয়ে পড়ল তার দুই গাল বেয়ে ।
হঠাৎ নিষাকে থেকে তার হাতে এক ঝুড়ি হুবর্ণমুদ্রা দিয়ে কেমন উদ্ভ্রান্তের মত বলল, পিসী দাও জ্যাকেরিয়ার ছেলে-কে খুঁজে বের করে এটা ওর হাতে দেবে—
নিডা চলে গেল। ভারী পাথরের মত ব্যথার ভার যেন একটু হাতা মনে হল মিরিয়মের বাগা-কে বাইরে পাঠিয়েছিল। ফিরে এসে বলল, জিয়ালটরা শহর ছেড়ে চলে গিয়েছে—একটু থেমে বলল, শুনলাম, সাব্বা না কি সীমান্তের রোমীয় প্রহরীকে খুব দিয়ে ভূডিয়ার সীমানা ছাড়িয়ে চলে গিয়েছে গ্যামিলির দিকে-
গ্যালিলি! বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল মিরিয়মের।
সাব্বা ভাই—তোমার কথা রাখতে পারলাম না- নিঃশব্দ ভান্নায় ভেঙ্গে পরল সে। গ্লানির অপচ্ছায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল মন। দুঃস্বপ্নের ঘোরে যেন বিড় “ড় করে বলল, আমি এখনও রোমীয়দের বিলাসের সহচরী হয়ে-ই আছি— -যায় শুয়ে ফুলে ফুলে কাদতে লাগল সে। কেঁদে কেঁদে-ই বেদনার ভার লাঘব হতেই তন্দ্রা এল। তন্দ্রাচ্ছন্ন চেতনার ভেতরে যেন অস্পষ্ট কুয়াশার মত ফুটে উঠল, মেসোপটেমিয়ার রাজকুমারের ভারী মাংসল মুখখানা—কিন্তু সেই কামুক পশুর কুৎসিত মুখ, মা-ভাইবোনদের হাড় বের করা শুকনো সারি সারি মুখ মিলেমিশে একাকার হয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠল একটি প্রদীপ্ত মুখাবয়ব। এলোমেলো সোনালী চুল। বড় বড় দুটো নীল চোখে থিঙ্ক প্রশান্ত দৃষ্টি তার।—রাজপুত্র! মুক্তার মত দুফোটা অশ্রুর বিন্দু চিক চিক করতে লাগল তার গালে।
ঘুম ভেঙ্গে গেল ।
রাতের আকাশে অলছে রাশি রাশি ভারা। দূর অক্ষকার দিগন্তে বেথলেহামের দিকে চোখ দুটো ছড়িয়ে দিতেই তীব্র আবেগে কাপতে লাগল ঠোট দুটো ! যেন নিঃশদে আকুল প্রার্থনা জানিয়ে বলল, হে ঈশ্বর বলে দাও আমি এখন কি করবো—তার মনে হল এই মুহূর্তে যদি তার চেয়ে অনেক অনেক বড় আর বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের একটি মানুষকে কাছে পেত, তাহলে তার সঙ্গে কথা বলে শাস্তি পেতো—এসব ভাবতে ভাবতেই—
সিমন এল।
তাকে দেখে অঝোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল জেরুজালেমের নগরশোভনা রূপসী নর্তকী। কান্নায় পড়ানো অস্পষ্ট গলায় বলল, আমাকে আমাকে দেশে নিয়ে চলুন— সিমন চাচা—ওই রোমীয় আর ফ্যারিনীদের আনন্দের জ আমি আর নাচবো না—নাচতে পারবো না—একটু থেমে আবার নিজের মনেই অস্ফুটস্বরে বলল, ওরা এক একজন দেশের জন্য জাতির জন্ম প্রাণ দিচ্ছে- কোন কথা বলল না লিমন। কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মিরিয়মের দিকে।
আমার কি স্বাধীন ইচ্ছা বলে কিছু থাকতে পারে না সিমন চাst, জলভরা দুটো চোখের তীক্ষ্ণ তীরের মত দৃষ্টিতে লিমনকে বিদ্ধ করে কেমন উদ্ভ্রাপ্ত আর উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, সোনা দানা, গয়না— বিলাসীতা আর ঐশ্বর্যে আমার দরকার নেই— মামি — আমি ম্যাগডালার জেলে—ভেভিডের মেঝে – সিমন চাচা-
তার কান্না ধরো ধরো মূর্তির দিকে তাকিয়ে সিমনের চোখদুটো জলে ভরে এল। পরমঙ্গেছে তাকে বুকে টেনে নিয়ে বলল, আমি কাল গ্যালিলিতে যাচ্ছি-আর সে-কথা বলতেই—
আমি — আমি তোমার সঙ্গে দেশে ফিরে যাবো সিমন চাচা, কান্না-টাঙ্গা কোথায় উড়ে গিয়েছে। মত্ত উল্লাসে চঞ্চলা কিশোরীর মত ডগোমগো হয়ে ছুটে গেল নির্ভার কাছে। হাফাতে হাফাতে বলল, পিদী—আমি কাল-ই গ্যালিলিতে চলে যাচ্ছি, একটু থেমে আবার বলল, মা আমার মা-র জন্ম নিয়ে যাবো হুবর্ণমুদ্রা, সোনার অলঙ্কার—এমন করে মা-কে সাজিয়ে দেব—যা কখনো কেউ কল্পনাও করে নি-
গুটি গুটি এসে দাড়াল বাগা আর ইলা।
বিষণ্ণ। শোকরান তাদের মুখাবয়ব।

ডিং-ঢং-ভিং-ডং—
জুড়িয়ার পাহাড়ের চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সিমনের কাফিলা চলেছে গ্যালিলির দিকে। কাফিলার মাঝখানে একটা সুদৃশ্য পালকিতে যাচ্ছে মিরিয়ম। এমাউসে আসতেই ঝাঁপিয়ে নেমে এল সন্ধ্যার অন্ধকার। সিমনের নির্দেশে এখানে থামল কাফিলা। এমাউসে থেকে বেনিয়মের গিরিপথে বজ আর রাহাজানির ভয় খুব বেশি।
দূর অন্ধকার দিগন্তে জুডিয়ার পাহাড়ের আড়ালে জেরুজালেমের দিকে তাকিয়ে ছাড়া ছাড়া গলায় বলল মিরিয়ম, জানো-সিমন চাচা, ওই শহরে আমি ছিলাম রাণীর মত। রোমীয়রা আমার পারে উজাড করে দিত অঢেল সম্পদ, তবু কেন হুণী হুই নিহতে পারি নি
ঐশ্বর্য কখনো মানুষকে সুখী করতে পারে না মিরিয়ম, আস্তে আস্তে বলল সিমন। কয়েক মুহূর্ত অন্ধকার রাত্রির আকাশে রাশি রাশি তারার দিকে তাকিয়ে আবার খুব মৃত গলায় বলল, জানো মিরিয়ম, ওই যে রূপোর চুমকির মত অজস্র তারা দেখছো—ওগুলো কিন্তু প্রত্যেকে এক একটা নক্ষত্র; যেমন বিশাল তেমনি জ্যোতিময়, একটু থামল সিমন। কেমন প্রদীপ্ত হয়ে উঠল তার মুখখানা। আবার বলল, এই নক্ষত্রের আড়ালে আছেন মঙ্গলময় ঈশ্বর। তোমার চেতনার ভেতরে যদি সেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব—
ঠিক বলেছে সিমন চাচা, বিদ্যুতের মত ঝকমক করে উঠল তার চোখমুখ ।
নিজের মনের ভেতরে ডুব দিয়ে আবার বলল, আমার নাচের সময়টা যে কি হয়— আমি যেন আমার সমস্ত সত্বার ভেতরে এক বিরাট জ্যোতিময় পুরুষকে স্পষ্ট দেখতে পাই আর আশ্চর্য একটা হবে ভরে ওঠে মন- দিনের পর দিন কাটে। কাফিলা চলে। তারা ছাড়িয়ে যায় বেখসিয়াম, পার তবে যায় ক্যানা নদী। লিমন হেঁকে বলে, এইবার আমরা পৌঁছাবো ভাজারখে। হলে উঠল মিরিয়মের বুকের ভেতরটা। ভাভারণ-জোহরা কি এখন আছে? কোন দূরদূরান্তরেব নিভৃত হতে যে তার ধৌবনধস্ত জীবনের সকল কামনা বাসনাকে মিথ্যে কবে দিয়ে তার প্রতি মুহূর্তের চিন্তার আর স্বপ্নে
আহ্বান করছে সেই জোনুযার সঙ্গে দেখা হবে। নাজারখের বাজাবের ধারে বড় মাঠে সিমন তাঁবু খাটালো। উটগুলো এখানে দানাপানি খাবে ।
শহর থেকে ঘুরে এসে মিন বলল, জোহরা এখানে নেই গিয়েছেন গ্যালিলিতে। একটু থেমে আবার নিজের মনেই বলল, তাঁকে খাদের খুব বেকার — তিনি গ্যালিলিব সেই গরীব দুঃখী লোকদের কাছেই গিয়েছেন –
বিষণ্ণ হয়ে উঠল মিরিয়মের মুখখানা। রাজারথ থেকে যে গ্যালিলি অনেক-অনেক দূর। কখন—কতদিন পরে সে তার স্বপ্নের রাজপুত্রের দেখা পাবে।
কাফিলা এল গ্যালিলিব সীমান্ত শহর তাব্বাধে। শহরের ভেতরে যেতেই পথচারীরা চারজন কাফ্রী ক্রীতদাসের পালকি দেখে কৌতূহলী হয়ে দাড়িয়ে পঞ্চল। মিটারের খোলা দরজা দিয়ে দেই তাদের নজরে পড়ল মিরিয়মের সেই ঢেউ খেলানো লাল চুলের অপর্যাপ্ত
ঐশ্বর্য, অমনি ছুটে এল একবাশ কুৎসিত কথাব ঋভ- রোমীয়দের সেই বেস্তাটা এসেছে রে— ক্যারিসীদের রক্ষিতা-টা এখানে আবার কি মতলবে —
সিমনের নির্দেশে পালকির গতি দ্রুত হল। বিড় বিড় করে বলল কাফিলার অধিনায়ক, এখানকার লোক খুব বর্ষব—আমরা এখানে থামবো না।
কাফিলা চলতে থাকে।
পালকির দেওয়ালে মুখ চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কারে মিরিয়ম। পালকির পাশে পাশে হেঁটে যেতে যেতে সিমন বলল, নর্তকী হলে-ই পতিতা হয় না মেরী ।
চূর্যদের কথায় কেন তুমি কাছে৷ করেকমুহূর্ত কি চিন্তা করে আবার বলল আর বারবিলাসিনী হলেই বা কি আমাদের ভাজারখের জোসুয়া কি বলে জানো
—মানুষ কখনো পাপী হয়ে জন্মায় না- পরিস্থিতিতে পড়েই সে—
জোসুয়া-কে কখন—কখন দেখতে পাবো, সিমন চাচা — মিরিয়মের কান্নার জড়ানো কথাগুলো কেমন হাহাকারের মত শোনালো।
সিমন কোন কথা বলল না।
পবধিন-ই দূরে-বহুদূরে সকালের নির্মেঘ আকাশের গায়ে এক টুকরো কালো মেঘের মত গ্যালিলির পাহাড়ের চূড়োর দিকে তাকিয়ে সিমন হেঁকে বলল, এইবার আমরা আমাদের গ্যালিলির সীমানায় এসে পড়েছি— কিছুক্ষণ পর মিরিয়মেরও নজরে পড়ল গ্যালিলির অতিকায় পাহাড় পাহাড়ের গায়ে স্বাস্থ্য ঘন সবুজ গাছগাছালির সমারোহ। তার ভেতে আগুনের ফুলকির মত জলছে রাশি রাশি হলুদ। আর পূর্বদিকের দিগন্তরেখাঃ গ্যালিলির সমুদ্রের নীলিম আভাস। সেই বিপুল ব্যস্ত আকাশ আর সমুদ্রের নীলাভ বিস্তাৰ, সবুজ অরণ্যের দিকে মুগ্ধ আর অপলক চোখে তাকিয়ে রইল
মিরিয়ম। আর তার বুকের রক্তে কলধ্বনি বাজতে লাগল তীব্র একটা আবেগে তার বুকের ভেতরটা তোলপাড় করছে। গ্যালিলির কোথায় গেলে কখন দেখা পাবে জোসুয়ার ! কাফিলা পাহাড়ের ঢালু পথ ধরে নেমে এল ভাইবেরিয়াস শহরে। আর পারল না মিরিয়ম। নেমে পড়ল লিটার থেকে। এই শহরের ভেতর দিয়ে এঁকে বেঁকে একটা সরু রাস্তা চলে গিয়েছে ম্যাগডালায়। সেই রাস্তার ধারেই গ্যালিলির সমুদ্র। দুজন হবিয়াকে দিয়ে মিরিয়ম তার মার কাছে পাঠিয়ে দিল চারটি বাক্স। কিন্তু-
কোথায় জোসুয়া। রাস্তার দুপাশের প্রত্যেকটি বাড়ির দরজা বন্ধ। হরের মানুষগুলো গেল কোথায়। সিমন বিড় বিড় করে বলল, বোধ হা বন্দরের দিকে জেলেদের পাড়ায়-
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই মিরিয়ম ছুটল সেই দিকে। দূর থেৰে তাদের কানে এল অনেক মানুষের মৃদু গুঞ্জন। দ্রুত পায়ে সে হাটতে শু করল। দেখল, রাজা দিয়ে যেন জনস্রোত বয়ে চলেছে। তারা আসছে সোর থেকে, সিজনের সমুদ্রপোল থেকে এমন কি জেরুজালেম থেকেও তার কথা শুনতে তাকে একবার দেখতে ।
বালুচরে ধাড়িয়ে কথা বলছেন তিনি। তাঁকে ঘিরে ধরে দাড়িয়ে আছে বিশাল জনতা। তাকে দেখতে পেল না মিরিন। হাজার হাজার মানুষের কলরবে শুনতে পেল না তাঁর কথা। দেখল শুধু সমুদ্রের শীর্ণ বাতাসে উড়ছে তাঁর অসাধারণ শ্বেতশুভ্র বসনের প্রান্তভাগ। মিরিয়মের মনে হল যেন মেঘের বুক চিরে ঝিলিক দিয়ে উঠছে বিদ্যুতের উগ্র সাদা আলোর রেখা । তাঁর অশ্রুত বাণী, তাঁর শুভ্র বস্ত্রাবরণের প্রান্তদেশ, এত সন্নিকটে তাঁর উপস্থিতি তার মনের ভেতরে পরিস্ফুট করে তুলল তাঁর দিব্যমূর্তি। অগ্নিবর্ণ এক দীর্ঘতনু যুবা পুরুষ।
পরম আবেগে চোখদুটো বুজে এল মিরিয়মের। আর ধীরে ধীরে কেমন একটা অনাস্বাদিত পূর্ব সুখের অনুভবে তার চেতনা আবিষ্ট হয়ে এল-
প্রভু এইবার ফ্যারিসী সিমনের বাড়িতে যাবে রে-ভীতের ভেতর থেকে কে একজন বলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে জনতার স্রোত ছুটল শহরের শেষ প্রান্তে সিমনের বাড়ির দিকে।
সিমনের গৃহসংলগ্ন প্রাঙ্গন এত বড় নয় যে অত লোকের স্থান সংকুলান হবে। তাই ভেতবে যাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি আর ধোকাবাজি শুরু হয়ে গেল।
জনতার ভীড় ঠেলে যেই মিরিয়ম ভেতরে যেতে চেষ্টা করল অমনি কে একজন চিৎকার করে বলল, এই খবরদার, — এই বারবনিতা-টা যেন ভেতরে যেতে না পারে- ইহুদীর মেয়ে হয়ে টাকার লোভে হয়েছে বেশ্যা-ছি ছি। দেখো বাবা, রোমীয়দের ওই রূপসী বারবনিতা যেন আবার স্পর্শ করে প্রভুকে অশুচি না করে ফেলে—
কেউ কেউ আবার তাকে লক্ষ্য করে পাথরের টুকরো ছুড়তে লাগল।
পরিব্রাজক সিমন তার বলিষ্ঠ দুটো হাত দিয়ে তাকে আগলে নিয়ে এল জোসুয়ার সামনে ।
থর থর করে কেঁপে উঠল মিরিয়ম। তার বহু বিনিদ্র রাত্রির অহরহ তার চেতনার ভেতরে সমস্ত সবার ভেতরে নক্ষত্রের মত জলজল করে যার প্রদীপ্ত মূর্তি ভাজারথের সেই জোসুয়ার এত ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসেছে সে। কেমন অবশ হয়ে এল তার স্বায়ুগুলো। তার মনে হল, সে যেন একটা ভূবনজোড়া আলোর রাজ্যে এসে পড়েছে। সে তার অনিন্দ্যসুন্দর মুখের দিকে তাকাতে পারল না। কিন্তু তার হারের ভেতরে দেন সেতারের মধুর ঝঙ্কারের মত বাজতে লাগল জোসুয়ার কথাগুলো তোমরা ভুল করছো, বাইরে থেকে কোন কিছুই মানুষকে অপবিত্র করতে পারে না। যে মন থেকে
ব্যভিচার, লোভ, নরহত্যা ইত্যাদি কুচিন্তার জন্ম হয়, সেসব-ই মানুষকে অপবিত্র করে
আশ্চর্য—সেই মধুস্রাবী কণ্ঠস্বর! অনেক অনেক দিন আগে অ্যানন্সের প্রাসাদে নাচতে গিয়ে অধিকল এই মৃদু মধুর আর দূরাগত কণ্ঠস্বর-ই তো ধ্বনিত হয়েছিল ভাব হৃদয়ের ভেতরে। তার চেতনা কেমন একটা অভিভূত আচ্ছন্নতায় আবিষ্ট হয়ে গেল।
জনতার ভেতর থেকে ভীড় ঠেলে একজন জোসুয়ার জন্য মাটির বেকারীতে করে নিয়ে এল খাবার তার সঙ্গে সঙ্গে কেমন সম্মোহিতের মত মিরিয়মও এগিয়ে এল। তার হাতে একটি অতিক্ষুদ্র স্বর্ণ নির্মিত পারে মিশরের সুগন্ধী আতর। ভক্ত যেমন ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে ঈশ্বরকে প্রণতি জানায় তেমনি করে জোসুয়ার রক্তপণ্ডের পাপতির মত পাদুটো জড়িয়ে ধরে চুম্বন এঁকে দিল। তারপরেই পাত্র নিঃশেষে উজার করে তাঁর পায়ে ঢেলে দিল আতর। ছিঃ ছিঃ রোমীয়দের বেশ্যা-টা প্রভুকে অপবিত্র করে ফেলল— ম্যাগডালার জেলের মেয়ে টাকার লোভে জেরুজালেমে গিয়ে হয়েছে বেশ্যা। এখন ভড়ং দেখাতে এসেছে
তিন-চারজন লোক তাকে জোর করে সরিয়ে দিতে যেই এল অমনি জোসুয়া হাত তুলে থামতে ইঙ্গিত করে প্রশান্ত কণ্ঠে বললেন, ছিঃ ছিঃ তোমরা ওকে নয়,—ওর পাপকে ঘৃণা করো— মিরিয়ম তাঁর পায়ের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। চোখের জলে জোসুয়ার পা-দুটো ভিজে গেল। কয়েকমুহূর্ত পরেই আবার মিরিয়ম তার অপর্যাপ্ত আর কোমল রক্তিম রেশমের মত চুল দিয়ে জোসুয়ার পা-দুটো মুছিয়ে মাথা নীচু করে কান্না ধরো ধরো অস্পষ্ট গলায় বলল, প্রভু ওরা ঠিকই বলেছে— আমি নষ্ট মেয়ে মানুষ আমি আমি পাপী তার বাদবাকী কথাগুলো আকূল কান্নার ভেতরে তলিয়ে গেল—
বাছা, পাপী হয়ে কেউ জন্ম নেয় না, জোসুয়া তাকে সস্নেহে দুহাত ধরে দাড় করিয়ে দিয়ে ফ্যারিসী সিমনে উদ্দেশে বললেন—এই স্ত্রীলোকটিকে দেখছো—আমি তোমার বাড়িতে অতিথি হয়ে এলাম আর তুমি আমার পা ধোবার জলটুকু পর্যন্ত দিলে না। কিন্তু এই স্ত্রীলোকটি তার চোখের জলে আমার পা-দুটো ভিজিয়ে চুল দিয়ে মুছে দিয়েছে—তারপরেও আরও যা বলেছিলেন বাইবেলে আছে সে সব কথা :- তুমি (সিমন ফ্যারিসী ) আমাকে চুম্বন পর্যন্ত করলে না। কিন্তু দেখ মহিলাটি এখানে আসার পর থেকেই আমার পায়ে চুম্বন দিয়েই চলেছে। তুমি আমার মস্তক তৈল দিয়ে অভিষিক্ত
করলে না। অথচ দেখ সে আমার পায়ে সুগন্ধী আতর মাখিয়ে দিয়েছে। তাই তোমাকে বলছি, স্বীলোকটির অনেক পাপের ক্ষমা হয়েছে তার নিবিড় ভালবাসায়। তারপরেই মিরিয়মকে স্নিগ্ধ আর প্রশান্ত কণ্ঠে বললেন, তোমার বিশ্বাস তোমাকে পরিত্রাণ করেছে, একটু থেমে আবার বললেন, তোমার অনুতাপের কান্নার ভেতর দিয়েই তোমার পাপ ধুয়ে মুছে গিয়েছে—
পাপ থেকে মুক্তি পেয়েছে! মুক্তি! তীব্র আনন্দে উত্তেজনায় থরথর করে কেঁপে উঠল মিরিয়ম ! প্রদীপের মত উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার মুখখানা । আর মূহূর্তে বদলে গেল তার সেই শোকস্নান স্তিমিত মূর্তি। আর আশ্চর্য একটা দৃঢ়তার প্রলেপে ঋজু হয়ে উঠে দাড়ালো। সম্রাজ্ঞীর মত দৃপ্তভঙ্গীতে আর গর্বিত পদক্ষেপে ভীড় ঠেলে বাইরে এল। জনতার চোখে বিশ্বয় । সেখানে আক্রোশের কোন চিহ্ন নাই।
আহা—আমাদের ম্যাগডালার মেয়েটাকে জোসুয়া ক্ষমা করেছে রে ।
গভীর সহানুভূতির বসে কেমন ভিজে ভিজে মনে হয় তার কথাগুলো। বয়সের ভারে ঝুঁকে পড়া এক বুডো এগিয়ে এসে সস্নেহে তার মাথায় হাত রাখল । ম্যাগডালার রাব্বি – জোয়াং-না? কলকল করে উঠল মিরিয়ম। তার নীল শিরার নক্সা কাটা হাতটি টেনে ধরে যেই চুমু খেতে গেল অমনি হাতটা টেনে নিয়ে বলল, না না — মিরিয়ম – জোসুয়া তোমাকে আশীর্বাদ করেছে—তুমি তাঁর স্নেহধন্বা একটু থেমে আবার বলল, আমার হাত তোমার চুম্বনের যোগ্য নয়—
মা কেমন আছে—কোথায় আছে ?
ও মা জানিস না— জোরাতো জোসুয়ার-ই শিষ্য হয়েছে। গ্রামেই আছে—
– আমি গ্রামে যাচ্ছি। মার কাছে যাবো বলেই যেন হাওয়ার ওপর পা ফেলে মিরিয়ম এল সমুদ্রের ধারে। ধু ধু বালুচরে পায়ের ছাপ এঁকে এঁকে চলেছে ম্যাগডালার দিকে। সাগরের গাঁ গাঁ বাতাস যেন তার কানের কাছে মধুর কোন
রাগিনীর বেজে চলেছে। রং বদলে গিয়েছে তার পৃথিবীর। তার সমস্ত চেতনার ওপরে নেমে এসেছে বিহ্বল স্বপ্ন—তার রাজপুত্র কোন যাদুমন্ত্রে তার সমস্ত ক্লেদ পঙ্কিলতা নিঃশেষে মুছে দিয়ে এক অনির্বচনীয় হবে আর পরিতৃপ্তিতে পূর্ণ করে দিয়েছে তার মন। তন্দ্রাভিভূতের মত নিজের মনেই বলল, গ্রাম-গ্রামান্তরে যেয়ে জোসুয়ার বাণী প্রচার করতে হবে-

ম্যাগডালায় গিয়ে মা-র সঙ্গে দেখা করেই চলে এল মিরিয়ম। জোহুরা ভাইবেরিয়াস ছেড়ে চলে যাবে গ্রাম গ্রামান্তরে। নানা—তার জোসুয়াকে তার বহু বিনিদ্র রাত্রির স্বপ্ন তার সোনার বরণ রাজপুত্রকে সে একমূহূর্তের অনন্তও চোখের আড়াল করবে না—করতে পারবে না। তার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল আর তীর এক সুখের আবেগে তার চোখদুটো জলে ভরে এল ।
এদিকে গ্যালিলির রোমীয় শাসনকর্তা হেরড অ্যাটিপাসের প্রাসাদে তাহারদের সেই অসাধারণ জনপ্রিয় তরুণ সন্ন্যাসীর বিরুদ্ধে চক্রান্ত ঘনীভূত হয়। মেষ চর্মের বা পার্চমেন্টের লিপিতে উল্লি লেখে—মার বিলম্ব করা উচিত নয়। গেহুয়া আকাশে বাতাসে বিদ্রোহের আগুন ছড়াচ্ছে। সে বলছে—দেশের অধীশ্বর হবে দরিদ্র জনসাধারণ — বিশালী সন্ত্রান্তরা নয়। আরও বলছে, অন্তর শুষ্ক থাকলেই ঈশ্বরের দেখা পাওয়া যায়— মন্দিরে গিয়ে মূর্তি পূজা করা অর্থ হীন এ সব কথা বলে মন্দির এবং পুরোহিত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করছে। সে নিজে তো এসব রাজদ্রোহকর কথা বলছেই এবং তার আরও বারোজন শিশুকে গ্যালিলির বিভিন্ন গ্রামে তার মতামত প্রচারের জন্ম পাঠিয়েছে- সে স্বপ্ন বিলাসী নয়- রাজদ্রোহী-
এই চিঠি নিয়ে রানার ফুটল জেরুজালেমে

গ্যালিলিতে কাজ শেষ করে জোসুয়া চলে যায় ভূডিয়ার দিকে। তাঁর নির্দেশে মিরিয়ম গ্রামে গ্রামে ধর্মপ্রচার করে এক অপাধিব হবে আর পরিতৃপ্তিতে ভরে উঠেছে মিরিয়মের জীবন। তার রাজপুত্রের নবোদিত আদিত্যের মত ভাস্বর মূর্তি প্রতিমুহূর্তে তার চেতনার ভেতরে জলজল করে। তার কণ্ঠে নেই মুক্তার মালা, বাহুতে নেই কোন স্বর্ণাভরণ। সেসব কবে গরীব দুঃধীদের বিলিয়ে দিয়েছে।
তবুও—তবুও কী আশ্চর্য তার মনে হয়, সে যেন তার সেই জেরুজালেমের প্রাসাদে বিলাস বৈভব আর অপর্যাপ্ত ঐশ্বর্যের ভেতরেই বাস করছে। হামামের তীব্র হুগন্ধী গোলাপ জলের পরিবর্তে কখনো পথপ্রান্তের কোন গিরিনির্ঝরের হিমশীতল সলিলে, কখনো বা দূর কোন শহর জনপদের বাজারের কৃপের অপরিচ্ছন্ন জলে স্নান করে মিরিয়ম। শিশিরের মতন নরম মহুণ সেই প্রার স্বচ্ছ মসলিন নয়, তার পরণে হীন-হরিত্র ধীবর রমণীর মত কারে কাচা রুক্ষ করুণ বস্ত্র। নেই সুগন্ধ পুষ্প-নির্যাস মিশ্রিত জলপাই তৈল, নেই ভ্রাতর।
তবুও—তবুও রূপেশ্বরী মিরিয়মের যৌবনদাবণ্যমাধুরী যেন রিক্ততার সৌন্দর্যেই প্রদীপ্ত জ্যোতি বিকীর্ণ করে। গ্যালিলির পথে প্রান্তরে দূর নিভৃত পল্লীতে অধিবাস পরিভ্রমণবতা মিরিয়ম যেন এক সিও উপাসিকার মতই এই বিশ্ব-চরাচরের অধীশ্বর তার সেই আদিত্য বর্ণ জোয়ার-ই পদধ্বনি শুনতে পায় নিগৰিগল্পে। আর গভীর নিষ্ঠুণ রাত্রে ভাব যেন মনে হয় অন্ধকারে আচ্ছন্ন দূরের বনবনান্তরের গহণলোক থেকে তারই মধুমিতালী কন্ঠের বাণী এক দিবালোকের মর্মরধ্বনির যত জেগে উঠছে।
শুধু মিরিয়মকে নয়, শুধু গ্রামবৃদ্ধ জোয়াবকে নয়। কে জানে কোন মালে গ্যালিলির দীন দুঃখী ইহুদীদের একেবারে বদলে দিয়ে গেছে জোহুরা। ভাবা আর মূর্তি পূজা করে না, মন্দিরের দিকে ঘুরেও তাকায় না যেমন, তেমনি জমি নিয়ে কি বাড়িঘর বিষয় আসয় নিয়ে মারামারিও করে না। তাদের মন থেকে যেন কপূরের মত উবে গিয়েছে হিংসা-দ্বেষ-লোভ আর উর্ধা। পরস্পরের প্রতি নিবিড় প্রীতি আর সৌহার্দ্যের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তারা যেন এক অবারিত হবে পৃথিবীতে বাস করে। তাদেরই অনাথ শিশুদের পরিচর্যা করে দিন কাটে মিরিয়মের। আর দূর দিগন্ত যখন আসন্ন রাত্রির রঙে মলিন হয়ে আসে তখন মিরিয়ম তাদের বলে জোসুয়ার কথা বলে জানো— তিনি বলেন প্রত্যেক মানুষের ভেতরে ঈশ্বর আছেন। কেউ কারো চেয়ে ছোট নয়— বলতে বলতে-ই তীব্র আবেগে তার চোখ দুটো বুজে আসে। আর তার বুকের ভেতরে জোসুয়ার মধুনিঃসৃত কণ্ঠের বাণীগুলো যেন মন্ত্রের মত নিঃশষে গুঞ্জরিত হতে থাকে আচ্ছা মেরী, এই রকমই এক শান্ত ‘সন্ধ্যায় জোয়ার বলল, তোমার নাচের সুখ্যাতি তো আমরা কত শুনেছি। তুমি আমাদের তোমার নাচ দেখাও না ?
নাচ! অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল মিরিয়ম। কান্নায় ভালা ভালা গলায় বলল নানা—পারবো না রাব্বি— নর্তকী মিরিয়ম অনেক অনেক দিন আগে মরে গিয়েছে—বলেই একটা পাথুরে মূর্তির মত বসে রইল সে। এমন সময়ে হঠাৎ-
—দূরে পাহাড়ের পাড়াল থেকে রাখালের বাণীর সুর বেজে উঠল। সেদিকে তাকিয়ে সন্মোহিতের মত উঠে দাড়ালো মিরিয়ম। ক্রমশঃ কাছে এল সেই ক্ষণি দুরাগত শব্দ। আর নির্জন বনভূমিকে সচকিত করে দিয়ে সেই ধার হুরের মূর্ছনা তার পায়ে ফুটিয়ে তুলল নৃত্যের বোল। আকাশের রাশি রাশি তারার দিকে তাকিয়ে দান্তে মান্তে নাচতে শুরু করল মিরিয়ম।
সেই বাণীর সুর নিকটবর্তী হল তত্তই উদ্দাম হয়ে উঠল তার নৃত্যের গতি। জোয়াব এবং সেই গ্রামের দর্শকদের মনে হল, বিপুল ব্যপ্ত আকাশের অগণিত নক্ষত্রের ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চাদের আলো গায়ে মেখে কোন অপ্সরী যেন মত্ত আবেগে নৃত্য করে চলেছে। আর মিরিয়মের সত্ত্বার ভেতর থেকে উৎসারিত তার সেই নৃত্যের প্রতিটি মুদ্রার অপূর্ব ব্যঞ্জনা যেন হুমন্ত্রিত মন্ত্রশ্বরের মত তাদের নিয়ে চলেছে কোন উর্দ্ধলোকে মহৎ ও উদার একটি অনুভূতির রাজ্যে। ধীরে ধীরে সেই অপসরমান বানর হয় ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে চারিদিকের নিথর শুদ্ধতার ভেতরে বিলীন হয়ে গেল। ক্লান্ত আর অবসন্ন হয়ে বসল মিরিয়ম।
কে ওখানে? হেঁকে বলল জোয়াব।
রোমীয়দের গুপ্তচর নয় তো? অস্ফুটস্বরে বলল একজন।
আমি সিমন, বহুদর্শী পরিব্রাজক সিমন মিরিয়মের দিকে কেমন করুণ চোখে তাকিয়ে বলল, তুমি নগগীর জেরুজালেমে চলো মেরী- একটু থেমে আস্তে আস্তে ফিস ফিস করে জানালো অনেক খবর পতিয়াস পাইলেত, সায়াফাস এবং গ্যালিলির রোমীয় শাসনকর্তা হেবড অ্যান্টিপাস—কোন কর্তাব্যক্তিই জোসুয়াকে সুনজরে দেখছে না। তাকে রাজদ্রোহী প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে। এতক্ষণ হয়তো
উরি কোথায়? রুশ্বাসে প্রশ্ন করল মিরিয়ম ।
সে তো আমাদের এই গ্যালিলিতে থেকেই জোসুয়ার গতিবিধির খবর জানাতো সায়াফাসকে এখন জেরুজালেমে, একটু থেমে বলল, একমাত্র উরি-ই বাচাতে পারে জোসুয়াকে
কেউ পারবে না—পারবে না, রাত্রির আকাশের অগণিত নক্ষত্র পুঞ্জের দিকে তাকিয়ে ছাড়া ছাড়া গলায় বলল গ্রামবৃদ্ধ জোয়াব, জোসুয়াই একদিন বলেছিল পৃথিবীতে তার কাজ শেষ হয়েছে আরও জেনে রেখ, শুধু আমার নয় কোন মানুষের আত্মাই ইহলোকের নয়, যার যখন কাজ শেষ হ’বে তার আত্মা বিলীন হয়ে যাবে অনন্তলোকে
কি কি বলছে। গাঁওবুড়ো—তার জোহুরা থাকবে না, বুকফাটা আর্তনাৰ করে এই কথাটাই বলতে চেয়েছিল মিরিয়ম। কিন্তু বলল না বলতে পারল না। শুধু কেমন উষান্ত আর শুভ দৃষ্টিতে দূরে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বসে রইল। কয়েক মুহূর্ত পরেই দক্ষপক্ষ বিহঙ্গীর মত মর্মান্তিক যন্ত্রণায় অস্ফুট আর্তনাদ করে বলল—সিমন চাচা, আমাকে জেরুজালেমে নিয়ে চলুন—
গ্যালিলি থেকে জেরুজালের অনেক-অনেকদুর
মিরিয়মের মনে হল কাফিলার উটগুলো যেন পায়ে ভারী পাথর বেঁধে চলেছে বড় বেশি মন্থর গতিতে। থেকে থেকে ব্যাকুল হয়ে বলছে সে, আরও তাড়াতাড়ি চলুন সিমন চাচা-চারিদিকের অবিচ্ছিন্ন নির্জনতার ভেতরে তার কথাগুলো হাহাকারের মত শোনায় ।
জেরুজালেমে পৌঁছেই মিরিয়ম ঝড়ের বেগে এল মাউন্ট অলিডে তার সেই রাজকীয় প্রাসাদে। ঘরে ঘরে সুসজ্জিত মহার্ঘ আসবাবপত্র ঠিক যেমন ছিল তেমনি আছে । সেই কোষাগার—সেই প্রসাধন শুরু। ইলা, বাগা, নিভা দেখল, মিরিয়মের পরণে অতি দীন মলিন বস্ত্ৰ । নিভার চোখে জল এসে পড়ল। অস্ফুট একটা আর্তনাদ করে বলল- যার একদিন রাজরাণী হওয়ার কথা ছিল-
—দেখছিস কি বাগা-ইলা তোরা আমাকে সাজিয়ে দে—ব্যস্ত হয়ে ছটফট করে বলল মিরিয়ম।
এল প্রসাধন কক্ষে। বিস্মিত সঙ্গীনিদের বলল, তোদের মনের মত করে সাজিয়ে দিবি আর এখন কিছু জিজ্ঞাসা করবি না—
তারা সুগন্ধী পুষ্পনির্যাস মিশ্রিত জলপাই তৈলের প্রলেপে ধীরে ধীরে অবহেলার ক গাত্রচর্য মহণ ও পেলব তুলল। পরিয়ে
বহুদিনের অযত্নে দিল রূপোর বুটিদার রক্তবর্ণ রেশমের বস্ত্রাভরণ। সেই অপর্যাপ্ত রক্তিম কেশের গুচ্ছে গুচ্ছে শোভা পেতে লাগল পদ্মরাগ মণি। কণ্ঠে দিল রক্তপ্রবালের মালা। বাহুতে মণিখচিত স্বর্ণবলয়। অনেক-অনেকদিন পরে জেরুজালেমের নগরশোভনা রূপেশ্বরী মিরিয়ম সালঙ্করা হয়ে, কে জানে কোথায় চলেছে অভিসারে।
জুপিটারের মন্দিরের প্রাঙ্গণে এসে দাড়াল মিরিয়ম। সাবেকদিনের সেই সম্রাজ্ঞীর মতো সেখানকার ক্রীতদাস পরিচারকদের হুকুম করল— যাও তোমাদের প্রধান পুরোহিত উরিকে ডেকে বলবে ম্যাগডালার মিরিয়ম এসেছে—
তার নাম শুনেও সঙ্গে সঙ্গে এল না সে—যে কতদিন কতবার তার কাছে গিয়েছে অতি হীন এক প্রার্থীর মত। তার বুকের ভেতরটা ভারী—খুব ভারী হয়ে উঠল ।
নিস্তব্ধ বিগ্রহর। খররৌজে মন্দিরের শ্বেতপাথরে বাঁধানো প্রাণ থেকে তাপ উঠছে। দূর থেকে ভেসে আসছে একটা কুকুরের কান্নার বীভৎস দাওয়াত। অজানা একটা আশঙ্কায় তার বুকের ভেতরটা ঢিব ঢিব করে উঠল। তাহলে কি এতক্ষণে কি ব্যাপার তুমি? উরির চোখে বিশ্বয় ফুটে ওঠে।
উরি, তুমি আমার ছেলেবেলার বন্ধু, ভরাট আর মৃদু গলায় বলল মিরিয়ম। অনেক-অনেকদিন আগে গ্যালিলির সমুদ্রের বালুচরে আমাকে চুমু খেয়ে বলেছিলে, আর তারপরেও কতবার তুমি বলেছিলে, সেই চুম্বন তোমার-আমার চিরকালের বন্ধন, থামল সে। জলভরা দুটো চোখের করুণ দৃষ্টি তুলে ধরে বলল, সেদিন তোমার কথা আমি বুঝতে পারি নি উরি। আজ এদেছি-এসেছি তোমাকে বিয়ে করে তোমার সেই স্বপ্নকে সার্থক করতে—পরম আবেগে উরির হাতটা জড়িয়ে ধরে বলল, উরি-তোমাকে বিয়ে করলে বলো কথা দাও জোয়ার কোন ক্ষতি করবে না–
বড়ো দেরি করে ফেলেছো তুমি, রূঢ় কর্কশ গলায় বলল উরি, একদিন চুম্বনকে যে বন্ধন বলে মনে করেছিলাম—সেটা ভাবতেও লজ্জা হয়। আমার মনে তোমার কোন স্থান নেই। তুমি – তুমি অত্যন্ত নীচ-হীন — বেইমান -তুমি একটা বিদ্রোহীর অনুচর, একটু থেমে তীব্র উত্তেজনাকে সংযত করে বলল, তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে, যেমন আজ সকালে গিয়েছে তোমার জোসুয়া, একটু থেমে আবার ধাতে দাত চেপে ধরে বলল, দেশদ্রোহীদের যেমন তেমনি তিনজন চোরের সঙ্গে তাকেও ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে। ক্রুশের বড় বড় কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে আর দারুণ যন্ত্রণা পেয়ে বুঝে গিয়েছে দেশের বিরুদ্ধা চারণ করার- কি! তার জোসুয়া নেই। ধেন হলে উঠল জুপিটারের বিশাল মন্দিরটা।
যাথার ভেতরটা কেমন করে উঠল। আর মুহূর্তে অসংলগ্ন আর কেমন বিশৃঙ্খল হয়ে গেল তার চেতনা। ঝড়ের বেগে তার প্রাসাদের দিকে হাটতে শুরু করল। মনে হল যদি উরিকে বিয়ে করতো, তাহলে জোয়ার হয়তো এই করুণ পরিণতি হতো না। নিজের কৃতকর্মের অনুশোচনার পাচ্ছন্ন হয়ে যায় তার মন। আবার তার কানের কাছে দূরাগত মন্ত্রঘরের মত ধ্বনিত থাকে জোসুয়ার সেই বাণী—মানুষের আত্মা ইহলোকের নয়— পৃথিবীতে কাজ শেষ হলে—নশ্বর দেহ ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু আত্মা বিলীন হয়ে যায় অনন্তলোকে শুদ্ধ দ্বিপ্রহরের বিশাল ধূসর আকাশের দিকে তাকিয়ে তার মনে হল যেন স্বিকৃষিগন্ধে বাতাসের মর্মরে যেন ঝঙ্কত হচ্ছে তার মধুনিঃদী কন্ঠের সেই বিভিন্ন আর আশ্চর্য উপদেশ – আপন আপন শত্রুদের ভালবাসা যার তোমাদের হিংসা করে, তাদেরও উপকার করে। হঠাৎ কেন যেন বিদ্যুত-চমকের মতো তার মনে হল, জোসুয়ার এই প্রেম ও অহিংসার বাণী একদিন দেবে—
দূর ভবিষ্যতের অনাগতকালের মানুষকে দুঃখদুর্যোগের অন্ধকারে আলোর সন্ধান নানা তার জোসুয়ার মৃত্যু নেই—মৃত্যু হতে পারে না—না, সে না—এক ফোটা জল এল না তার চোখে। মহৎ একটা আবেগে উদীপ্ত হয়ে তার মন চলে গেল কোন উর্দ্ধলোকে। আশ্চর্য একটা প্রশান্তিতে আবিষ্ট হয়ে বাড়িতে এল। নিভাকে বলল, পিসী, ওরা জোসুয়াকে কোথায় কবর দিয়েছে খুঁজে বের করো—
ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পর দুইটি রজনী অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। এল তৃতীয় হিনের নির্ণথ রাত্রি। ঘন অন্ধকারে প্রেতিনীর মত নিঃশদ পায়ে এল তিনটি ছায়ামুর্তি। এল সেই গেহিনম উপত্যকার যেখানে এক বৃদ্ধার কুটিরে রাত্রিবাস করেছিল ঠিক তার বিপরীত দিকে দোলগোথায় আন্তোনিয়া দূর্গের কাছে। এই দুর্গের-ই প্রাচীরের বাইরে এক গিরিগুহার মুখে একখণ্ড পাথর চাপা দিয়ে নিতান্ত অবহেলায় সমাধিস্থ করেছে জোসুয়াকে।
ধীর পায়ে এগিয়ে গেল মিরিয়ম। তার হাতে স্বর্ণনির্মিত পাত্রে অগুরু নির্গস, আর একটিতে হাজ্বী জলপাই তৈল। আশ্চর্য একটা আত্মপ্রসাদে আবিষ্ট হয়ে গিয়েছে তার মন। গুহামুখের পাথর সরিয়ে দিলেই বিদ্যুতের মত ঝলসে উঠবে তার জোসুয়ার, তার স্বপ্নের রাজপুত্রের উজ্জ্বল তাদের মত সেই স্নিগ্ধ । অনন্তলোকে তার জয়যাত্রার আগে তাকে সাজিয়ে দেবে! কিছু ভারী পাথরটা সরাতেই সে শিউরে উঠল। শৃগর্ত গুহায় জমাট অস্বকার না খা করছে। কিন্তু তার মনে হল- মনে হল তার আদরের জোসুয়ার শ্বেতশুভ্র বসনে আবৃত্ত সেই অগ্নিবর্ণ দ্বীর্ঘতমু আরও দীর্ঘতর প্রসারিত হতে হতে দিগন্তবিসারী আকাশের সঙ্গে মিশে যেতে লাগল। আর তার অন্তরের ভেতরে সমস্ত সত্বার ভেত্তরে দূরাগত স্নিগ্ধ গভীর মগ্নস্বরের মত হয়ে বাজতে লাগল তার মধুস্রাবী কণ্ঠের সেই বাণী, তুমি দয়ালু হও—তবে তুমি ঈশ্বরের দয়া পাবে না—তার জোসুয়ার মৃত্যু নেই। জানো আমি দেখেছি— স্বচোক্ষে দেখেছি–সে সমস্ত বিশ্বচরাচরের মানুষের কম্যাণের জন্ম পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। শুনতে পাচ্ছো না সারা আকাশ বাতাস সিকৃগিত্ত আলোড়িত করে হুন্দুভি বাজছে—মানবপুত্রের জয়গানে মুখরিত হয়ে উঠেছে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে আর একপ্রান্ত বদ্ধ উন্মাদিনীর মত দুহাত তুলে এই কথাগুলোই বলতে চেয়েছিল দুধে প্রতীক্ষারত পরিব্রাজক লিমন, আর প্রধান শিক্ষ পিটার এবং অনার শিয়দের। কিন্তু বলতে পার না। আর নিজেকে সংযত রাখতেও পার গিরিগুহার সামনে পাথরে মুখ থুবড়ে পড়ে তীব্র কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল । সেই কান্নাভরা শোকার্ত মূর্তির দিকে তাকিয়ে সঙ্গীদের চোখে জল এসে পড়ল ।
সেই এতদিনে জেরার স্বপ্ন সার্থক হল— ম্যাগডালার মেয়ে ম্যাগডালিন স্বর্গরাজ্যের সম্রাজ্ঞী হয়ে থাকবে, অঙ্ক-টম্বরে সিমন বলল। গোহুয়ার সঙ্গে ওই হতভাগী মিরিয়ম ও চিরকাল মানুষের মনে বেঁচে থাকবে, বলল পিটার।
হ্যা। বেঁচে আছে। ম্যাগডালিনের অনুতাপবিদ্ধ জীবনের উত্তরণের বিচিত্র কাহিনী, ধীশুর প্রতি তার নিবিড অনুরাগের ইতিবৃত্ত যুগযুগান্তর ধরে স্বাশ্বত হয়ে আছে বাইবেলের পাতায়।

Please follow and like us: