পরস্পর
মনে পড়ে গেল এক রূপকথা ঢের আগেকার,
কহিলাম, শোনো তবে —
শুনিতে লাগিল সবে,
শুনিল কুমার;
কহিলাম, দেখেছি সে চোখ বুজে আছে,
ঘুমানো সে এক মেয়ে — নিঃসাড় পুরীতে এক পাহাড়ের কাছে:
সেইখানে আর নাই কেহ —
এক ঘরে পালঙ্কের ‘পরে শুধু একখানা দেহ
পড়ে আছে — পৃথিবীর পথে পথে রূপ খুঁজে খুঁজে
তারপর — তারে আমি দেখেছি গো — সেও চোখ বুজে
পড়ে ছিল — মসৃণ হাড়ের মতো শাদা হাতদুটি
বুকের উপরে তার রয়েছিল উঠি!
আসিবে না গতি যেন কোনোদিন তাহার দু — পায়ে,
পাথরের মতো শাদা গায়ে
এর যেন কোনোদিন ছিল না হৃদয় —
কিংবা ছিল — আমার জন্য তা নয়!
আমি গিয়ে তাই তারে পারি নি জাগাতে,
পাষাণের মতো হাত পাষাণের হাতে
রয়েছে আড়ষ্ট হয়ে লেগে;
তবুও, হয়তো তবু উঠিবে সে জেগে
তুমি যদি হাত দুটি ধরো গিয়ে তার!
ফুরালাম রূপকথা, শুনিল কুমার।
তারপর, কহিল কুমার,
আমিও দেখেছি তারে — বসন্তসেনার
মতো সেইজন নয়, কিংবা হবে তাই —
ঘুমন্ত দেশের সেও বসন্তসেনাই!
মনে পড়ে,শোনো,মনে পড়ে
নবমী ঝরিয়া গেছে নদীর শিয়রে —
(পদ্ম — ভাগীরথী — মেঘনা — কোন্ নদী যে সে –
সে সব জানি কি আমি! — হয়তো বা তোমাদের দেশ
সেই নদী আজ আর নাই,
আমি তবু তার পারে আজও তো দাড়াই!)
সেদিন তারার আলো — আর নিবু-নিবু জোছনায়
পথ দেখে, যেইখানে নদী ভেসে যায়
কান দিয়ে তার শব্দ শুনে,
দাড়ায়েছিলাম গিয়ে মাঘরাতে, কিংবা ফাল্গুনে।
দেশ ছেড়ে শীত যায় চলে
সে সময়, প্রথম দখিনে এসে পড়িতেছে বলে
রাতারাতি ঘুম ফেঁসে যায়,
আমারও চোখের ঘুম খসেছিল হায় —
বসন্তের দেশে
জীবনের — যৌবনের! — আমি জেগে, ঘুমন্ত শুয়ে সে!
জমানো ফেনার মতো দেখা গেল তারে
নদীর কিনারে!
হাতির দাঁতের গড়া মূর্তির মতন
শুয়ে আছে — শুয়ে আছে — শাদা হাতে ধব্ধবে স্তন
রেখেছে সে ঢেকে!
বাকিটুকু — থাক্ — আহা, একজনে দেখে শুধু — দেখে না অনেকে
এই ছবি!
দিনের আলোয় তার মুছে যায় সবই! —
আজও তবু খুঁজি
কোথায় ঘুমন্ত তুমি চোখ আছ বুজি!
কুমারের শেষ হলে পরে —
আর — এক দেশের এক রূপকথা বলিল আর — একজন,
কহিল সে উত্তর — সাগরে
আর নাই কেউ! —
জোছনা আর সাগরের ঢেউ
উচুনিচু পাথরের পরে
হাতে হাত ধরে
সেইখানে; কখন জেগেছে তারা — তারপর ঘুমাল কখন!
ফেনার মতন তারা ঠান্ডা — শাদা
আর তারা ঢেউয়ের মতন
জড়ায়ে জড়ায়ে যায় সাগরের জলে!
ঢেউয়ের মতন তারা ঢলে।
সেই জলমেয়েদের স্তন
ঠান্ডা, শাদা, বরফের কুঁচির মতন!
তাহাদের মুখ চোখ ভিজে,
ফেনার শেমিজে
তাহাদের শরীর পিছল!
কাচের গুড়ির মতো শিশিরের জল
চাঁদের বুকের থেকে ঝরে
উত্তর সাগরে!
পায়ে — চলা পথ ছেড়ে ভাসে তারা সাগরের গায়ে —
কাঁকরের রক্ত কই তাহাদের পায়ে!
রূপার মতন চুল তাহাদের ঝিক্মিক্ করে
উত্তর সাগরে
বরফের কুঁচির মতন
সেই জলমেয়েদের স্তন
মুখ বুক ভিজে
ফেনার শেমিজে
শরীর পিছল!
কাচের গুড়ির মতো শিশিরের জল
চাদের বুকের থেকে ঝরে
উত্তর সাগরে!
উত্তর সাগরে!
সবাই থামিলে পরে মনে হল — এক দিন আমি যাব চলে
কল্পনার গল্প সব বলে;
তারপর, শীত — হেমন্তের শেষে বসন্তের দিন
আবার তো এসে যাবে;
এক কবি — তন্ময়, শৌখিন,
আবার তো জন্ম নেবে তোমাদের দেশে!
আমরা সাধিয়া গেছি যার কথা — পরীর মতন এক ঘুমোনো মেয়ে সে
হীরের ছুরির
মতো গায়ে
আরো ধার লবে সে শানায়ে!
সেইদিনও তার কাছে হয়তো রবে না আর কেউ —
মেঘের মতন চুল — তার সে চুলের ঢেউ
এমনি পড়িয়া রবে পাল্ঙ্েকর পর —
ধূপের ধোঁয়ার মতো ধলা সেই পুরীর ভিতর।
চার পাশে তার
রাজ — যুবরাজ — জেতা — যোদ্ধাদের হাড়
গড়েছে পাহাড়!
এ রূপকার এই রূপসীর ছবি
তুমি দেখিবে এসে,
তুমিও দেখিবে এসে কবি!
পাথরের হাতে তার রাখিবে তো হাত —
শরীরে ননীর ছবি ছুয়ে দেখো চোখা ছুরি — ধারালো হাতির দাঁত!
হাড়েরই কাঠামো শুধু — তার মাঝে কোনোদিন হৃদয় মমতা
ছিল কই! — তবু, সে কি জেগে যাবে? কবে সে কি কথা
তোমার রক্তের তাপ পেয়ে? —
আমার কথায় এই মেয়ে, এই মেয়ে!
কে যেন উঠিল ব’লে, তোমরা তো বলো রূপকথা —
তেপান্তরে গল্প সব, ওর কিছু আছে নিশ্চয়তা!
হয়তো অমনি হবে, দেখি নিকো তাহা;
কিন্তু, শোনো — স্বপ্ন নয় — আমাদেরই দেশে কবে, আহা! —
যেখানে মায়াবী নাই — জাদু নাই কোনো —
এ দেশের — গাল নয়, গল্প নয়, দু — একটা শাদা কথা শোনো!
সেও এক রোদে লাল দিন,
রোদে লাল — সবজির গানে গানে সহজ স্বাধীন
একদিন, সেই একদিন!
ঘুম ভেঙে গিয়েছিল চোখে,
ছেড়া করবীর মতো মেঘের আলোকে
চেয়ে দেখি রূপসী কে পড়ে আছে খাটের উপরে!
মায়াবীর ঘরে
ঘুমন্ত কন্যার কথা শুনেছি অনেক আমি, দেখিলাম তবু চেয়ে চেয়ে
এ ঘুমোনো মেয়ে
পৃথিবীর মানুষের দেশের মতন;
রূপ ঝরে যায় — তবু করে যারা সৌন্দর্যের মিছা আয়োজন —
যে যৌবন ছিড়ে ফেঁড়ে যায়,
যারা ভয় পায়
আয়নায় তার ছবি দেখে! —
শরীরের ঘুণ রাখে ঢেকে
ব্যর্থতা লুকায়ে রাখে বুকে,
দিন যায় যাহাদের অসাধে, অসুখে! —
দেখিতেছিলাম সেই সুন্দরীর মুখ,
চোখে ঠোঁটে অসুবিধা — ভিতরে অসুখ!
কে যেন নিতেছে তারে খেয়ে! —
এ ঘুমোনো মেয়ে
পৃথিবীর ফোপরার মতো করে এরে লয়ে শুষে
দেবতা গর্ন্ধব নাগ পশু মানুষ!..
সবাই উঠিল বলে — ঠিক — ঠিক — ঠিক!
আবার বলিল সেই সৌন্দর্য তান্ত্রিক,
আমায় বলেছে সে কী শোনো —
আর একজন এই —
পরী নয়, মানুষও সে হয় নি এখনও;
বলেছে সে, কাল সাঁঝরাতে
আবার তোমার সাথে
দেখা হবে? — আসিবে তো? — তুমি আসিবে তো!
দেখা যদি পেত!
নিকটে বসায়ে
কালো খোঁপা ফেলিত খসায়ে —
কী কথা বলিতে গিয়ে থেমে যেত শেষে
ফিক্ করে হেসে!
তবু আরো কথা
বলিতে আসিতে — তবু, সব প্রগল্ভতা
থেকে যেত!
খোঁপা বেঁধে, ফের খোঁপা ফেলিত খসায়ে —
সরে যেত, দেয়ালের গায়ে
রহিত দাঁড়ায়ে!
রাত ঢের — বাড়িবে আরো কি
এই রাত! — বেড়ে যায়, তবু, চোখোচোখি
হয় নাই দেখা
আমাদের দুজনার! দুইজন, একা! —
বারবার চোখ তবু কেন ওর ভরে আসে জলে!
কেন বা এমন করে বলে,
কাল সাঁঝরাতে
আমার তোমার সাথে
দেখা হবে? — আসিবে তো? তুমি আসিবে তো! —
আমি না কাঁদিতে কাঁদে.. দেখা যদি পেত!..
দেখা দিয়ে বলিলাম, কে গো তুমি? — বলিল সে তোমার বকুল,
মনে আছে? — এগুলো কী? বাসি চাঁপাফুল?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে আছে’, — ভালোবাসো?’ — হাসি পেল — হাসি!
ফুলগুলো বাসি নয়, আমি শুধু বাসি!’
আচলের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে ফেলে
নিবানো মাটির বাতি জ্বেলে
চলে এল কাছে —
জটার মতন খোঁপা অন্ধকারে খসিয়া গিয়াছে —
আজও এত চুল!
চেয়ে দেখি — দুটো হাত, ক — খানা আঙুল
একবার চুপে তুলে ধরি;
চোখদুটো চুন — চুন — মুখ খড়ি — খড়ি!
থুত্নিতে হাত দিয়ে তবু চেয়ে দেখি —
সব বাসি, সব বাসি — একবারে মেকি!
এ-সব কবিতা আমি যখন লিখেছি
এ-সব কবিতা আমি যখন লিখেছি বসে নিজ মনে একা;
চালতার পাতা থেকে টুপ — টুপ জ্যোৎস্নায় ঝরছে শিশির;
কুয়াশায় সি’র হয়ে ছিল স্নান ধানসিড়ি নদীটির তীরে;
বাদুড় আধাঁর ডানা মেলে হিম জ্যোৎস্নায় কাটিয়াছে রেখা
আকাঙ্খার; নিভু দীপ আগলায়ে মনোরমা দিয়ে গেছে দেখা
সঙ্গে তার কবেকার মৌমাছির…. কিশোরীর ভিড়
আমের বউল দিল শীতরাতে; — আনিল আতার হিম ক্ষীর;
মলিন আলোয় আমি তাহাদের দেখিলাম, — এ কবিতা লেখা
তাহাদের ম্লান মনে কবে, তাহাদের কড়ির মতন
ধূসর হাতের রূপ মনে করে; তাহাদের হৃদয়ের তরে।
সে কত শতাব্দী আগে তাহাদের করুণ শঙ্খের মতো স্তন
তাহাদের হলুদ শাড়ি — ক্ষীর দেহ — তাহাদের অপরূপ মন
চলে গেছে পৃথিবীর সব চেয়ে শান্ত হিম সান্ত্বনার ঘরে :
আমার বিষন্ন স্বপ্নে থেকে থেকে তাহাদের ঘুম ভেঙে পড়ে।
শঙ্খমালা
কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে
সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে,
বলিল , তোমারে চাই :
বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ
খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি – কুয়াশার পাখনায় –
সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে আলোক
জোনাকির দেহ হতে – খুঁজেছি তোমারে সেইখানে –
ধূসর পেঁচার মতো ডানা মেলে অঘ্রাণের অন্ধকারে
ধানসিঁড়ি বেয়ে – বেয়ে
সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে
তোমারে খুঁজেছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে।
দেখিলাম দেহ তার বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা;
সন্ধ্যার আঁধারে ভিজে শিরীষের ডালে সেই পাখি দেয় ধরা –
বাঁকা চাঁদ থাকে যার মাথার উপর,
শিঙের মতন বাঁকা নীল চাঁদ শোনে যার স্বর।
কড়ির মতন শাদা মুখ তার;
দুইথানা হাত তার হিম;
চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম
চিতা জ্বলে : দক্ষিণের শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়
সে আগুনে হায়।
চোখে তার
যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার!
স্তন তার
করুণ শঙ্খের মতো- দুধে আর্দ্র – কবেকার শঙ্খিনীমালার!
এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।
সৃষ্টির তীরে
বিকেলের থেকে আলো ক্রমেই নিস্তেজ হ’য়ে নিভে যায়- তবু
ঢের স্মরণীয় কাজ শেষ হ’য়ে গেছেঃ
হরিণ খেয়েছে তার আমিষাশী শিকারীর হৃদয়কে ছিঁড়ে;
সম্রাটের ইশারায় কঙ্কালের পাশাগুলো একবার সৈনিক হয়েছে;
স্বচ্ছল কঙ্কাল হ’য়ে গেছে তারপর;
বিলোচন গিয়েছিলো বিবাহ-ব্যাপারে;
প্রেমিকেরা সারাদিন কাটায়েছে গণিকার বারে
সভাকবি দিয়ে গেছে বাক্বিভূতিকে গালাগাল।
সমস্ত আচ্ছন্ন সুর একটি ওংকার তুলে বিস্মৃতির দিকে উড়ে যায়।
এ-বিকেল মানুষ না মাছিদের গুঞ্জরণময়!
যুগে-যুগে মানুষের অধ্যবসায়
অপরের সুযোগের মতো মনে হয়।
কুইসলিং বানানো কি নিজ নাম- হিটলার সাত কানাকড়ি
দিয়ে তাহা কিনে নিয়ে হ’য়ে গেল লালঃ
মানুষেরই হাতে তবু মানুষ হতেছে নাজেহাল;
পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি।
এ-কেমন পরিবেশে র’য়ে গেছি সবে-
বাক্পতি জন্ম নিয়েছিলো যেই কালে,
অথবা সামান্য লোক হেঁটে যেতে চেয়েছিলো স্বাভাবিক ভাবে পথ দিয়ে,
কী ক’রে তাহ’লে এ-রকম ফিচেল পাতালে
হৃদয়ের জন- পরিজন নিয়ে হারিয়ে গিয়েছে?
অথবা যে-সব লোক নিজের সুনাম ভালোবেসে
দুয়ার ও পরচুলা না এঁটে জানে না কোনো লীলা,
অথবা যে-সব নাম ভালো লেগে গিয়েছিলোঃ আপিলা চাপিলা
-রুটি খেতে গিয়ে তারা ব্রেডবাস্কেট খেলো শেষে।
এরা সব নিজেদের গণিকা, দালাল, রেস্ত, শত্রুর খোঁজে
সাত-পাঁচ ভেবে সনির্বন্ধতায় নেমে আসে;
যদি বলি, তারা সব তোমাদের চেয়ে ভালো আছে;
অসৎপাত্রের কাছে তবে তারা অন্ধ বিশ্বাসে
কথা বলেছিলো ব’লে দুই হাত সতর্কে গুটায়ে
হ’য়ে ওঠে কী যে উচাটন!
কুকুরের ক্যানারির কান্নার মতনঃ
তাজা ন্যাকড়ার ফালি সহসা ঢুকেছে নালি ঘায়ে।
ঘরের ভিতরে কেউ খোয়ারি ভাঙছে ব’লে কপাটের জং
নিরস্ত হয় না তার নিজের ক্ষয়ের ব্যবসায়ে,
আগাগোড়া গৃহকেই চৌচির করেছে বরং;
অরেঞ্জপিকোর ঘ্রাণ নরকের সরায়ের চায়ে
ক্রমেই অধিক ফিকে হ’য়ে আসে; নানারূপ জ্যামিতিক টানের ভিতরে
স্বর্গ মর্ত্য পাতালের কুয়াশায় মতন মিলনে
একটি গভীর ছায়া জেগে ওঠে মনে;
অথবা তা’ ছায়া নয়- জীব নয় সৃষ্টির দেয়ালের ‘পরে।
আপাদমস্তক আমি আর দিকে তাকায়ে রয়েছি;
গগ্যাঁ ছবির মতো- তবু গগ্যাঁ চেয়ে গুরু হাত থেকে
বেরিয়ে সে নাকচোখে ক্কচিৎ ফুটেছে টায়ে-টায়ে;
নিভে যায়- জ্বলে ওঠে, ছায়া, ছাই, দিব্যযোনি মনে হয় তাকে।
স্বাতিতারা শুকতারা সূর্যের ইস্কুল খুলে
সে-মানুষ নরক বা মর্ত্যে বহাল
হ’তে গিয়ে বৃষ মেষ বৃশ্চিক সিংহের প্রাতঃকাল
ভালোবেসে নিয়ে যায় কন্যা মীন মিথুনের কূলে।
সেদিন এ-ধরণীর
সেদিন এ ধরণীর
সবুজ দ্বীপের ছায়া-উতরোল তরঙ্গের ভিড়
মোর চোখে জেগে জেগে ধীরে ধীরে হল অপহত-
কুয়াশায় ঝ’রে পড়া আতসের মতো!
দিকে দিকে ডুবে গেল কোলাহল,-
সহসা উজার জলে ভাটা গেল ভাসি!
অতি দুর আকাশের মুখখানা আসি
বুকে মোর তুলে গেল যেন হাহাকার
সেই দিন মোর অভিসার
মৃত্তিকার শূন্য পেয়ালার ব্যথা একাকারে ভেঙে
বকের পাখার মতো শাদা লঘু মেঘে
ভেসেছিল আতুর, উদাসী!
বনের ছায়ার নিচে ভাসে কার ভিজে চোখ
কাঁদে কার বারোঁয়ার বাঁশি
সেদিন শুনি নি তাহা-
ক্ষুধাতুর দুটি আঁখি তুলে
অতি দূর তারকার কামনায় তরী মোর দিয়েছিনু খুলে!
আমার এ শিরা-উপশিরা
চকিতে ছিড়িয়া গেল ধরণীর নাড়ীর বন্ধন-
শুনেছিনু কান পেতে জননীর স্থবির ক্রন্দন,
মোর তরে পিছুডাক মাটি-মা, তোমার!
ডেকেছিল ভিজে ঘাস-হেমন্তের হিম মাস, জোনাকির ঝাড়!
আমারে ডাকিয়াছিল আলেয়ার লাল মাঠ-শ্মশানের খেয়াঘাট আসি!
কঙ্কালের রাশি,
দাউদাউ চিতা,-
কত পূর্বজাতকের পিতামহ-পিতা,
সর্বনাশ ব্যসন-বাসনা,
কত মৃত গোক্ষুরার ফণা,
কত তিথি, কত যে অতিথি,
কত শত যোনিচক্রস্মৃতি
করেছিল উতলা আমারে!
আধো আলো-আধেক আঁধারে
মোর সাথে মোর পিছে এল তারা ছুটে
মাটির বাটের চুমা শিহরি উঠিল মোর ঠোটে-রোমপুটে!
ধু ধু মাঠ-ধানক্ষেত-কাশফুল-বুনোহাস-বালুকার চর
বকের ছানার মতো যেন মোর বুকের উপর
এলোমেলো ডানা মেলে মোর সাথে চলিল নাচিয়া!
মাঝপথে থেমে গেল তারা সব,
শকুনের মতো শূন্যে পাখা বিথারিয়া
দূরে দূরে আরো দূরে-আরো দূরে চলিলাম উড়ে
নিঃসহায় মানুষের শিশু একা, অনন্তের শুক্ল অন্তঃপুরে
অসীমের আঁচলের তলে!
স্ফীত সমুদ্রের মতো আনন্দের আর্ত কোলাহলে
উঠিলাম উথলিয়া দুরন্ত সৈকতে,
দূর ছায়াপথে!
পৃথিবীর প্রেত চোখ বুঝি
সহসা উঠিল ভাসি তারক-দর্পণে মোর অপহৃত আননের
প্রতিবিম্ব খুঁজি
ভ্রূণ-ভ্রষ্ট সন্তানের তরে
মাটি-মা ছুটিয়া এল বুকফাটা মিনতির ভরে,-
সঙ্গে নিয়ে বোবা শিশু-বৃদ্ধ মৃত পিতা
সূতিকা-আলয় আর শ্মশানের চিতা।
মোর পাশে দাঁড়াল সে গর্ভিণীর ক্ষোভে,
মোর দুটি শিশু আঁখিতারকার লোভে
কাঁদিয়ো উঠিল তার পীনস্তন, জননীর প্রাণ।
জরায়ূর ডিম্বে তার জন্মিয়াছে সে ঈপ্সিত বাঞ্ছিত সন্তান
তার তরে কালে কালে পেতেছে সে শৈবালবিছানা, শালতমালের ছায়া।
এনেছে সে নব নব ঋতুরাগ-পউষনিশির মেঘে ফাল্গুনের ফাগুয়ার মায়া!
তার তারে বৈতরণীতীরে সে যে ঢালিয়াছে গঙ্গার গাগরী,
মৃত্যুর অঙ্গার মথি স্তন তার বারবার ভিজা রসে উঠিয়াছে ভরি।
উঠিয়াছে দূর্বাধানে শোভি,
মানবের তরে সে যে এনেছে মানবী!
মশলা-দরাজ এই মাটিটার ঝাঁঝ যে রে-
কেন তবে দু-দণ্ডের অশ্রু-অমানিশা
দূর আকাশের তরে বুকে তোর তুলে যায় নেশাখোর মক্ষিকার তৃষা!
নয়ন মুদিনু ধীরে- শেষ আলো নিভে গেল পলাতকা নীলিমার পারে,
সদ্য প্রসূতির মতো অন্ধকার বসুন্ধরা আবরি আমারে।
সমুদ্রচিল
……. ।।২।।
রঙিন বিস্তৃত রৌদ্রে প্রাণ তার করিছে বিলাস;
কোনদিন ধানক্ষেতে পৃথিবীর কৃষকের প্রাণ
এই রৌদ্র পায় নাই,- জলপাই পল্লবের ফল,
জ্যৈষ্ঠের দুপুরে মাছি যে উল্লাসে গেয়ে গেছে গান,
কুমারী কোমল ঘাড় নুয়ে চুপে যেই পক্ক রৌদ্রে বেণী করিছে বিন্যাস,
নীল হয়ে বিছায়েছে পৃথিবীর মধুকূপী ঘাস,
তরমুজ ক্ষেতে শুয়ে স্বপন দেখেছে চৈত্রমাস,
তার চেয়ে আরো দামী গাঢ় মদে প্রাণ তার করিছে বিলাস।।
পৃথিবীতে যেই রূপ কোনদিন দেখে নাই কেউঃ
সিংহলের হীরা রত্ন নারী লুটে নাবিকের দল
ভারত সমুদ্রে নেমে নক্ষত্রের রজনীতে
তারপর ভোরবেলা দেখেছিল স্ফটিকের মত যেই জল;
তরঙ্গের পর ঘন তরঙ্গের মধু আর দুধ,
মেঘের গোলাপী মুখ- রৌদ্রের বুদ্বুদ;
তবু তারা দেখে নাই পুরুভুজ-বিছানায় নূপুর বাজায়ে নীচে ঢেউ
বারুণির জানালায়ঃ সিন্ধুচিল- মক্ষিকারা ছাড়া তাহা কেউ জানে নাক কেউ।।
ধ্বনিত ঢেউয়ের অগ্নি বয়ঃসন্ধি-দিবসের স্তন হয়ে রক্তে নেমে আসে!
তরঙ্গের উষ্ণ নীল তরমুজ ক্ষেতে
আমারে খুঁজিয়া পায় মৃত্যু যেনঃ
বিস্তৃতির পথে যেতে-যেতে
সমস্ত পৃথিবী যেন মিশে যায় রৌদ্রের সাগরে;
সিন্ধুচিল আর তার বনিতা যেখানে খেলা করেঃ
মরণ আমারে যেন পায় সেই দারুচিনি হাওয়ার আশ্বাসে।।
অবসরের গান
…….চারিদিকে নুয়ে প’ড়ে ফলেছে ফসল,
তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা-ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল;
প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে-থেকে আসিতেছে ভেসে
পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে!
শরীর এলায়ে আসে এইখানে ফলন্ত ধানের মতো ক’রে,
যেই রোদ একবার এসে শুধু চ’লে যায় তাহার ঠোঁটের চুমো ধ’রে
আহ্লাদের অবসাদে ভ’রে আসে আমার শরীর,
চারিদিকে ছায়া—রোদ—খুদ—কুঁড়ো—কার্তিকের ভিড়;
চোখের সকল ক্ষুধা মিটে যায় এইখানে, এখানে হ’তেছে স্নিগ্ধ কান,
পাড়াগাঁর গায় আজ লেগে আছে রূপশালি-ধানভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ
আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই—নুয়ে আছে নদীর এ-পারে
বিয়োবার দেরি নাই—রূপ ঝ’রে পড়ে তার—
শীত এসে নষ্ট ক’রে দিয়ে যাবে তারে;
আজো তবু ফুরায়নি বৎসরের নতুন বয়স,
মাঠে-মাঠে ঝ’রে পড়ে কাঁচা রোদ—ভাঁড়ারের রস;……..
অন্ধকার
…..হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে
আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি, অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর
মতো মিশে থাকতে চেয়েছি।…..
মনোবীজ
……..‘শানিত নির্জন নদী’- বলিল সে- ‘তোমারি হৃদয়,
যদিও তা পৃথিবীর নাদী- ন্দী নয়ঃ
তোমারি চোখের স্বাদে ফুল আর পাতা
জাগে না কি? তোমারি পায়ের নিচে মাথা
রাখে না কি? বিশুস্ক- ধূসর-
ক্রমে-ক্রমে মৃত্তিকার কৃমিদের স্তর
যেন তারা; -অপ্সরা –উর্বশী
তোমার উৎকৃষ্ট মেঘে ছিলো না কি বসি?
ডাইনির মাংসের মতন
আজ তার জঙ্ঘা আর স্তন;
বাদুড়ের খাদ্যের মতন
একদিন হ’য়ে যাবে;
যে-সব মাছিরা কালো মাংস খায়- তারে ছিঁড়ে খাবে।’…….