ছত্রিশ কিস্তির এক নম্বর – তাপস রায়

›› সম্পুর্ণ গল্প  

আরও পারভারশন চাই, বুঝলেন। আই মিন মেক ইট মোর টেস্টি। গল্প হিসেবে ঠিক আছে। আপনার এত দিনের কলম চালাচালি—তাতে যে কোনও গল্প আপনি দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু আপনাকে ডেকেছি এজন্য এই বারোশো ছিয়ানব্বই সাল মার্কা প্রেম ভার্চুয়াল রিয়ালিটির পাঠক ছোঁবে না।
নামি পত্রিকার দামি সম্পাদক একনাগাড়ে কথাগুলি বলে থামলেন। রূপেশের মুখের দিকে একবারও তাকাননি তিনি। প্রায় ন’মাস ধরে কলেজ ছুটি নিয়ে ন্যাশনাল লাইব্রেরি, সাহিত্য পরিষদ করে রূপেশ এই লেখাটা নামিয়েছে। ফোকটেল, সমাজ, মবিটি, অর্থনীতি, মর্যালিটি, রাজনীতি, ধর্ম সব কিছু রেখে ইমারত গেঁথেছে। আর ফাঁকে ফাঁকে মিষ্টি-মেদুর প্রেমের সিমেন্ট। রূপেশের নিজের উপর কনফিডেন্স আছে, বন্ধুদের কাউকেই লেখাটা পড়ায়নি বা শোনায়নি। সোজা পি.সি. থেকে প্রিন্ট বের করে জমা দিয়ে গেছে কাগজের অফিসে। রূপেশের কালো হয়ে আসা মুখের দিকে চোখ পড়তেই সম্পাদক গলার স্বরের এলোকোয়েন্সি কমিয়ে দেন। বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে চা দিতে বলেন। জানেন তো, আমার জ্বালাটা জানেন তো! ওই বৈদ্যুতিন মাধ্যমের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কি চাট্টিখানি কথা! কাগজের কাটতি যাতে না কমে সেটাও দেখতে হবে হতভাগ্য সম্পাদককে! অথচ কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নিয়ে মার্কেটিংয়ের ছোকরাগুলো লেজ নাড়ছে… । কথা শেষ না করেই সম্পাদক বলেন, নিন চা খান। সম্পাদকও একটা লম্বা চুমুক দেন। একেবারে দার্জিলিং টি। রূপেশের নাকেও ধাক্কাটা লাগে। ঘরটা বেশ ম ম করছে। সম্পাদক আবার কথা বাজান, বুঝেছেন, এরকম ম ম করবে গল্পের ভেতর তবেই না সেল বাড়বে! ওই ধারাবাহিকই বিজ্ঞাপন বাড়াবে। আপনি একটু রিরাইট করুন। প্রথম থেকেই পাঠকের সামনে ইশারা রাখবেন, যৌনতার। এখন প্রেম আর সেক্স কোনও আলাদা বস্তু নয়, মানেন তো! ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, লেক, গঙ্গার ঘাট—এসব আউটডোর লোকেশন তুলে দিন। সিনেমা হলও নয়। একদম নিখাদ ইনডোর। সব ইনসিডেন্টই ইনডোরে হবে। বাড়ি, রিসর্ট, হোটেল—সে যেমন খুশি আপনি ব্যবহার করুন। নানামুখী আবর্ত রাখুন ক্ষতি নেই। কিন্তু প্রতি সংখ্যায় অন্তত একখানা যেন হার্ডকোর যায়। ভঙ্গি পালটান। ফোর-প্লের সময় বাড়িয়ে দিন।
রূপেশের মাথাটা দপদপ করছিল। হার্ট কি একসঙ্গে পাঁচ লিটার রক্ত মাথায় পাঠিয়ে দিয়েছে। উত্তেজনা কমাতে বলে, একটা সিগারেট খেতে পারি?
আরে নিশ্চয়ই! এই নিন। ড্রয়ার খুলে খুব দ্রুত সম্পাদক বিদেশি ব্র্যান্ডের দামি সিগারেট এগিয়ে দিয়ে নিজেও একটা ধরালেন। সিগারেটে টান দিয়ে রুপেশ তখন অন্য জগতে। সম্পাদক পোড়খাওয়া। চশমার কাচের আড়ালে রুপেশের ঘোলাটে চোখ অনড় দেখে তিনিও কথা থামালেন। রুপেশ তখন ছকে যাচ্ছে ছত্রিশটা ইনস্টলমেন্টের এই ধারাবাহিক। তার চরিত্রগুলির মধ্যে সতেরো-আঠারোজন অ্যাডাল্ট, দু-তিনজন কিশোরী। কুসুম, রবিনা, বাব্বি, শ্রীরাধা, অনুষ্কা দে-র ভালো চেহারা, অ্যাফ্লুয়েন্টও। আরও কয়েকটা মেয়ে আছে স্কুল, কলেজের ছুটকো ছাটকা। ওদেরকেও কাজে লাগাতে হবে। গ্রোয়িং দু-তিনটে মেয়ে সাত বা আট ক্লাসের আছে, দেখা যাক ওদের দিয়ে কী করা যায়।
বাড়ি ফিরে ব্যাজার মুখে রুপেশ কম্পিউটার টেবিলে বসে পড়ে। লেখাটার ভিতর ঢুকে সত্যি কষ্ট হচ্ছে। শুরু হয়েছিল খুব রোমান্টিকভাবে। ডিলিট করে দেবে। খুব মায়া লাগছে। ওই যে আত্মহত্যার ঘটনাটা। রুপেশ খুব দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। শুরুটা এরকম ছিল— চায়ে চুমুক দিতে দিতে আমাকে দেখছে। আমি না তাকিয়েও বুঝতে পারছি ওর দু-চোখ। দু-চোখ পেরিয়ে দু-চোখ, অনেকগুলো চোখ হয়ে আমাকে মাপছে। আজ অন্যরকম সেজেছে। সাদার ওপর সবুজ ফুলের চুড়িদার। সঙ্গে সবুজ ওড়না। সবুজের এক সহজাত আকর্ষণ আছে। মানুষ দীর্ঘকাল অরণ্যবাসী ছিল সভ্য হয়ে ওঠার আগে। ফলে বনের স্বভাব সবুজ মানুষের জিনে ঢুকে আছে বলেই এত আরাম! নাকি অন্য কিছু! চুল স্বভাব সোজা ডানদিক থেকে বাঁ-দিকে কাত করে ফেলা, একটা ঢেউ খেলে সোজা নেমেছে। মাঝে মাঝে শরীর শিরশির করে। গায়ে গা লাগিয়ে বসেনি। তা হাত পাঁচ-ছয় দূরে একটা কৌণিক অবস্থান ওর। তবুও। কী দেখছে অমন! ভাবি, ভাবি না। মাঝে মাঝে অবহেলা করি। অথচ কোথায় একটা টানটান বাজনা লক্ষ করছি। সমুদ্রে জলের ভেতর পায়ের নীচ থেকে বালি সরে যাবার মতো অবস্থা। এ অবস্থায় ছবি আঁকার একটা তুলির অভাব অনুভব হয়। রং তুলির অবস্থান নিয়ে আমার মাঝে মাঝেই মাথা ব্যথা হয়। মাথা ধরার কারণও সে। ধরো তার নাম জবা। তাকে কী রঙে আঁকব। লাল ?
সবুজ? লাল সবুজের মিশ্রণ ? ব্যাপারটা দর্শনের দিকে ঝুঁকে যেতেই তুলি নিজেই সাদা কালোর আশ্রয় নেয়। যেভাবে কলমের মুখ থেকে একটি লাইন লেখার পর অন্য লাইনটি কখনও নিজে নিজেই গড়িয়ে নামে। আমি ইচ্ছে করেই নামটা লুকোলাম। কেউই তো আর বুকের ধড়াস ধড়াস ব্যথার আরামটা অন্যকে দিতে চায় না। এদিক থেকে আমি একটু সেকেলে। একালের মতো ডাকাবুকো হতে পারছি না। বুক বাজিয়ে সিনেমার হিরোদের মতো ডেকে বলতে পারি না। এক অন্ধকার ছোটঘরে খুব গোপনে আমি লালন করি এই বোধ। মাঝে কুপি জ্বেলে, পা টিপে, চুপি তাকে দেখে আসি।
এরকম প্রচলিত অনুভূতি থেকে আজকাল কী একটা চুঁইয়ে নামছে। গা শিরশির। এই নামটা আমার অত্যধিক ছোটপর্দা দেখার কল্যাণে হতে পারে। এখন আমি অফিসে এসেই ওই দুটো চোখ, ওই দু-চোখ পেরিয়ে আরও চোখ, অনেক চোখ খুঁজি। চেয়ার নেড়েচেড়ে বসতে বসতে ওই চোখ একবার চোখাচোখি করলে তবেই স্বস্তি। এবং অনেক কথা বলার থাকে যা প্রতিদিন রাতে নিজে নিজে মহড়া করি। বলার। অথচ দিন চলে যায়, বলা হয় না।
লোডশেডিং-এর কোনও শব্দ আছে! না নেই। অথচ হল। বেশ মনোরম। গোটা অফিস জুড়ে নীরবতা। আমার বিস্ময় লাগে। সবাই ওই আবছা আলো আঁধারে কি নিজেকে দেখতে চায়! আমি একটা ঘোর গড়ে তুলি। আমার কালির কলমের কালি আঙুল থেকে সারা হাতে মুখে ছড়ায়। মন খারাপের রং লাগে। ওপাশে শব্দ নেই, নড়াচড়া নেই।
অন্ধকারে চোখ দেখা যায় না।
কি মেয়ে বলতে পারছ না, কথা ফুটছে না মুখে? এই আমার ঠোট নাও, জিভ নাও। ঠোঁট কাপছে কাঁপুক। দেখো, চোখ মেলো। পারছ না। আমার চোখ নাও, দৃষ্টি নাও। শুধু তো একটু ছোঁয়া। একটুকু ছোঁয়া লাগছে না! এই আমার হাত নাও, আঙুলগুলো নাও। ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’-এর মতো একটা কিছু বাজছে। একটা কিছু পাইনের পাতায়, চেরি ফুলগুলোর গোলাপি সাদা ফিসফিসানিতে। হায়দারি পার্কে সারাবছর বসন্ত, সারাবছর হাওয়ায় কী যেন কী খেলে যায়। এক সময় ভয় ঘেরে। হঠাৎ যদি অন্য স্বর খেলে ওঠে! সারাপথ দাবার ছক। কোথায় পা দেব, কোথায়! একটু ভেসে যাওয়ার জন্য এই আকুলতার কোনও মানে হয়? মানে নাই হোক। আচ্ছা, ওই মৃগী বর্ষার ঘন ঘাসে মুখ ডুবিয়ে। ওই খাঁচার ভেতর এক দঙ্গল মানুষের চোখের সামনে। ও কি স্বাভাবিক ? মাঝে মাঝে চোখ তুলে দেখে। ওই চোখে কোনও সংকেত আছে! সংকেত মহাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে। প্রতিটি মুহূর্ত সংকেতের। এই যে একটু পরেই এত ভালোলাগা ছেড়ে, এই মহল্লা ছেড়ে চলে যেতে হবে—তাতে কোনও দীর্ঘশ্বাস লেখা থাকবে! হেলাফেলা ! ভালো লাগার একটা ঘোর লেগে থাকে, অনেকেরই। অনেকের, না!
রুপেশ পড়তে পড়তে দেখছে মায়া বেড়ে যাচ্ছে। না, সম্পাদকের পছন্দ নয় যখন….। ডিলিট করে দেয় উপরের অংশ পর্যন্ত। এর মধ্যে বাড়ির কাজের মেয়ে গীতা কফি দিয়ে গেছে। বউ চাকরি করে রেলে। ফেয়ারলি প্লেসে। আসতে আসতে সন্ধ্যা সাতটা সাড়ে সাতটা। ঘণ্টা চারেক সময়, দুটো কিস্তি নামিয়ে দিতে হবে। লিখল – এবছর এত অসহ্য গরম যে খুব কষ্ট হচ্ছে। এখন বিকেল তিনটে। কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে সে, অনুষ্কা। টপটপ করে ঘাম ঝরছে। হাতের রুমাল ভিজে সপসপে হয়ে আছে। অনুষ্কা এক ঝটকায় ঘরে টেনে নেয়। পা দিয়ে দরজা বন্ধ করে। আর অমন ঘর্মাক্ত মুখেই আসঙ্গ চুম্বনে ভরিয়ে দেয়। অনুষ্কার মুখের ভেতর তখন এক সমুদ্র লবণ ঢেউ হয়ে উঠেছে। রক্ত লাফাচ্ছে পাহাড় পেরোনো উচ্চতায়। এই চকিত বিন্যাসে শ্রীমন্ত ঘাবড়ে আছে। কী করছ! কী করছ!
উহু কোনও কথা নয়। অনুষ্কা কান কামড়ে দেয়। কাম, কাম অন। বাঘ যেভাবে হরিণছানার ঘাড় কামড়ে বনের ভেতরে টেনে নিয়ে যেতে থাকে সেরকম ভাবে অনুষ্কা শ্রীমন্তকে এসি ঘরের দিকে নিয়ে যায়। শ্রীমন্ত কথা বলতে পারছে না। অনুষ্কার জিভ ওর মুখগহ্বরে…. । আরে ছাড়ো, একটু জল খাওয়াও, এই গরমে ধড়ে তো আর প্রাণ নেই। কোনওরকমে একটু সুযোগে শ্রীমন্ত বলে। ও সরি। অনুষ্কা কিছুটা সংবিৎ সহ খুব দ্রুত ফ্রিজ থেকে ফ্রুট জুস ঢেলে দেয় গ্লাসে। পানীয় পড়তে শুকিয়ে আসা গলা কথা পায়, কেমন আছ? মনে হচ্ছে জম্পেস। এই স্কার্টটা আয়ারল্যান্ডের না! বছরে একবার আসো আর এমন ডাকাতিনী ভাব তোমার সত্যি আনবিলিভেবল। শ্রীমন্ত কথা বলবে কী, অনুষ্কার ওই আক্রমণ চিন্তাও করতে পারেনি। ফলে মাথার ভেতরটা চটচটে আঠার মতো জড়িয়ে যায়। সোফায় ধপাস করে বসে পড়ে। আর অনুষ্কার সে কী হাসি! ধুস! নিজের উপর বিরক্তিতেই রুপেশ কম্পিউটার ছেড়ে উঠে পড়ে। বিড় বিড় করে, এটা লেখা হচ্ছে। কেন লিখছি এসব! সম্পাদক আমাকে দিয়ে যা খুশি তাই লিখিয়ে নিতে পারে! ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরায়। ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে। হালকা ঠান্ডা বাতাস। মাথার দপদপে শিরাগুলি একটু স্বস্তি পাচ্ছে। উত্তর দিকের ব্যালকনি। জলের ছাটও ওই দিক থেকে আসছে। একটু ভিজবে আজ। টবের হলুদ জবা, গোলাপ, কাগজ ফুলের গাছ সবাই যেন আনন্দ প্রকাশ করছে মাথা দুলিয়ে। তা ওরা নিজেরা এমন দহনের পর বৃষ্টি পেয়েছে বলে না রুপেশের সঙ্গে একসঙ্গে ভিজছে— কোনটা তা বলা যাচ্ছে না। সিটি কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক রুপেশ। ও ভাবছে জনপ্রিয় সাপ্তাহিকে এই ধারাবাহিক ওর ছাত্র-ছাত্রীরা তো পড়বেই। তাদের রিপারকেশন কেমন হবে। নিশ্চয়ই ওদের স্যারকে খুব খারাপ লোক, পার্ভার্টেড ভাববে। ভালো লাগছে না রুপেশের। এই ধারাবাহিক লেখার অফারটাও হারাতে চায় না। এটা ওর সাহিত্যিক কেরিয়ারের একটা বড় বাঁক হতে
পারে। শেষমেশ রুপেশ ভাবল, না প্রথম কিস্তিতে কিছুতেই বেড সিন করবে না। যা লিখে ফেলেছে তাই অনেক। সিগারেটে দুটো বড় বড় টান দিয়ে নিভে আশা টুকরোটা রাস্তায় ছুঁড়ে দিয়ে কম্পিউটারে বসে। শ্রীমন্ত অনুষ্কার নতুন কোনও আক্রমণ কোন দিক থেকে আসবে এটা ভাববার জন্য সময় বের করতে চায়। কী গো চা-ফা দেবে কি দেবে না? একটু খিদে-টিদেও আছে। অনুষ্কা শ্রীমন্তের চিন্তা-টিন্তা থেকে যে ঢের এগিয়ে তা বোঝা যায়। বলে, ‘রাবিশ! এখন চা-র সময় হল ! আর হাত পুড়িয়ে চা বানাতে পারব না। চুপটি করে বোসো, লিমকা দিয়ে ভদকা দিচ্ছি। খুব ভাল্লাগবে নাও।’ এসব বলে সোফায় বসে থাকা শ্রীমন্তের পিছন থেকে এসে ঝাঁকড়া চুল মুঠো করে ধরে মাথা পিছনে টেনে অনুষ্কা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা অদ্ভুত চুমু খাচ্ছিল। এমন সময় ডোরবেল। দরজা খুলতেই—‘ওমা তুমি মিঠু মাসি ! কেমন আছ গো?’ দরজার বাইরে থেকেই দুজনের সে কী জড়াজড়ি! বেশ খানিকক্ষণ ওরা ওভাবে। শ্রীমন্ত যে ওদের সামনে বসে আছে তা যেন ওদের কারও মনে নেই। অনুষ্কার বয়সি হবে ভদ্রমহিলা। পঁয়ত্রিশের উপর নয়। অবশ্য আজকাল মেয়েদের বয়স কিছুতেই বোঝা যায় না। ভদ্রমহিলা যথেষ্ট সুন্দরী। ওরা দুজনেই কলকল করছে।
—মিঠু মাসি, তা এই দুপুরে তুমি হঠাৎ! তোমার চাকরিটা গেছে বুঝি
—আরে না। গড়িয়াহাটে ডাক্তারের কাছে, ফার্টিলিটি চেম্বারে এসেছিলাম। ট্রিটমেন্ট চলছে। তাই দিন পনেরো ছুটি নিয়েছি। ডাক্তার ঘোষ এবারও তো খুব আশা দিলেন। প্রতিবারই দেন, আর কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নেন। জানিস তো মাঝে মাঝে খুব ফ্রাস্টেটেড লাগে। একটানা কথা বলেন মহিলা। হাসতে হাসতে বললেন, আজ চেম্বারে সন্তান আকুল মেয়েদের খুব ভিড়। রিসেপশনিস্ট বলল, সাড়ে পাঁচ-ছয় বেজে যাবে আমার টার্ন আসতে। তাই ধর তোকে দেখতেও ইচ্ছে করছিল, আর সময় কাটানোর জন্যও চলে এলাম। নিশ্চয়ই অখুশি হোসনি।।
-আরে বাবা, কী যে বলো। মা মারা যাওয়ার পর তোমাকে দেখলেই আমি মাকে হারানোর দুঃখ ভুলে যাই। তুমি যে কী বলো! আমার খুব ভালো লাগছে।
—আর তুই তেমনি রয়ে গেলি? ভদ্রমহিলা একবার শ্রীমন্তের দিকে তাকিয়ে নেয়। ওদেশে গিয়েও একটা স্টেডি বয়ফ্রেন্ড ম্যানেজ করতে পারলি না!
—না মিঠু মাসি ওরকম বোলো না। এই বেশ আছি। দেখো, দেখো আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখো, তোমার কি মনে হচ্ছে কোথাও খারাপ আছি? ফিগার দেখো, একদম মুটিয়ে যাইনি সব ঠিকঠাক রেখেছি।
—তুই কী বলছিস, আমার দিকে তাকিয়ে দেখ, কিচ্ছু কমেনি কোথাও, এখনও প্রচুর মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারি ছেলেদের। এইসব বলে দুজনে ফের জড়াজড়ি করে উচ্চকিত শ্রীমন্তরও মনে হল সত্যি সত্যি ভদ্রমহিলা অ্যাট্রাকটিভ। তেমন সাজেননি, কিন্তু বেশ প্রোজ্জ্বল লাগছে। ঠোঁটে খুব হালকা একটা লিপস্টিক দিয়েছেন, চুলটা উঁচু করা পেছনে একটা পনিটেল। খুব হাই হিল না হলেও হিল আছে। তাতে বেশ লম্বা লাগছে ওই স্লিম চেহারা। মনে হয় সাড়ে পাঁচ-এর কাছাকাছি উচ্চতা। সিফন পরেছে, লুক খু সিফন। ভদ্রমহিলা তার বুকের সৌন্দর্য সম্পর্কে সচেতন। লোকাট ব্লাউজে তার বক্ষ সৌন্দর্য গোলাপের ফুটে ওঠার মতো।
–ও মিঠু মাসি, কী খাবে বলো, কিছু একটা করে দিই। অনেকক্ষণ বেরিয়েছ খুব খিদে পেয়েছে, বলো।
আশ্চর্য! একটু আগেই অনুষ্কা চা করতেই চায়নি, এখন রান্নার আয়োজন করবে বলছে। শ্রীমন্তর খুব কৌতুক লাগে। ভেবেছে মুখের কথা বলতে হয় তাই বলা। কিন্তু না, অনুষ্কা কথা বলতে বলতে কিচেনে চলে গেছে ওই কিছু একটার জন্য। তারপর তড়িঘড়ি ফিরে এসে বলে, মাসি তোমরা একটু গল্প করো আমার এক্ষুনি হয়ে যাবে।
সপ্রতিভ মাসি বলে, ‘কার সঙ্গে কথা বলব?”
হেসে –ও হো, সত্যিই খুব খারাপ, তোমাদের আলাপ করে দিইনি আমি! সরি সরি। দুজনের কাছেই ক্ষমা চাইছি। মাসি ও হল শ্রীমন্ত, আমার একেবারে ছোটবেলার বন্ধু, মানে স্কুলজীবনের। আর এ আমার মাসি, মিঠু মাসি। এবার তোমরা নিজেদের পরিচয় নিজেরা করে নাও। বলে খিল খিল করতে করতে কিচেনে ঢুকে যায়।
মিঠু মাসি-র মধ্যে হয়তো কোনও হিস্টোনাইজিং ব্যক্তিত্ব আছে। শ্রীমন্ত এখন আকাশচারী। ও উড়ে যাচ্ছে। তেমন ডানার কসরত না করেও যেভাবে বড় বড় পাখিরা ভেসে থাকে আকাশে, সেভাবে মিঠুমাসিও ওর পাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। সাদা মেঘ মাঝে মাঝে উড়ে এসে ওদের দুজনের মাঝখানে ঢুকে পড়লে শ্রীমন্ত হাত ধরে থাকছে মিঠু মাসির, যেন ছাড়াছাড়ি না হয়ে যায়। উড়তে উড়তে একটা শান্ত নদীর উপরে এসে নিজেদের ছায়া দেখে শ্রীমন্তর খুব মজা হল। উপুড় হয়ে থাকায় ওদের ছায়া গজ-কচ্ছপের মতো লাগছে। মনে মনে ভাবল আজ রাতে শোবার সময় ভাইয়ের ছোট্ট মেয়েকে গজ-কচ্ছপের গল্প শোনাবে। রোজই নতুন নতুন গল্প শোনাতে হয়। মিঠু মাসি এবার বললেন, ‘একটু জল খাবেন?’ এই প্রশ্নটা ঠিকঠাকের কিছু বেশি হয়ে শ্রীমন্তকে জাগাল। আর
অপ্রতিভতার চূড়ান্ত অবস্থা। শ্রীমন্ত ওই মেঘের রাজ্যে মিঠু মাসিকে নিয়ে ভাসতে ভাসতে ধরা হাত এখনও ধরে রেখেছে। মিঠু মাসি অল্প হাসছেন। শ্রীমন্ত খুব লজ্জিত স্বরে বলে, ‘আমি বুঝতে পারিনি, আসলে জানেন…….
মিঠু মাসি ওকে লজ্জিত হতে না দিয়ে নিজেই ওর একটা হাত ধরে বলে ওঠেন, ‘না এটা এমন কিছু নয়, বেশি ভাববেন না।’ কী হাতের ছোঁয়া! ওই হাত কি মাখন দিয়ে তৈরি! আবার স্বপ্নে চলে যাবে নাকি শ্রীমন্ত। এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে পড়ে। ‘আসলে আমি একটা কাজের কথা ভুলে গিয়েছিলাম। ঠিক চারটায় আমার যাবার কথা।’ শ্রীমন্ত যেন পালাতে চাইছে। ততোধিক স্মার্ট মিঠু মাসি হাতব্যাগের ভেতর থেকে নিজের ভিজিটিং কার্ড তুলে দিয়ে বলেন, ‘দরকার হলে ফোন করবেন। আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। আর হ্যাঁ, চা-টা খেয়ে যান। না হলে অনুষ্কা, বুঝতেই তো পারছেন…।’ বলে ভদ্রমহিলা চোখে এমন একটা লাস্য ঝোলালেন শ্রীমস্তের কোনও রা নেই। এই বিমূঢ়তায় না থেকে পালানো ভালো। অন্তত অনুষ্কার চোখে যেন ধরা না পড়ে। শ্রীমন্ত হাত নেড়ে দরজার বাইরে গিয়ে একটা ফুল লেন্‌থ নিশ্বাস নেয়। এ পর্যন্ত লিখে রুপেশও একটা দম নিল। আর মাথার ভেতর ফুটে থাকা কাঁটাটা খচখচে জানান দিতে থাকে প্রতিটি কাটাকুটির সঙ্গে সঙ্গে। পুরোনো লেখায় এ পর্বে একটি পারিবারিক বিষাদ এখানে রাখা ছিল। রুপেশের উদ্দেশ্য ছিল শূন্যতা তৈরি করা ও ভরা। ডিকনস্ট্রাকশনে ওই যে দেরিদা বলেছেন যে কোনও ফাঁকা জায়গা পাবে না তোমাকে পুশ করে ফাঁকা জায়গাটা বানাতে হবে। যেভাবে বা যে ধারণায় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি আজ নতুন নতুন প্রোডাক্ট বিক্রি করে। প্রায় প্রত্যেকেই তো ডিটারজেন্ট ইউস করে তবুও দু-দিন অন্তর নতুন নতুন ডিটারজেন্টে বাজার ছেয়ে যায়—সেগুলি বিক্রিও হয়। আবার ব্র্যান্ড একই রেখে কখনও নুন যোগ করে, কখনও লবঙ্গ যোগ করে বিক্রির পরিমাণ বা নতুন ক্রেতা ধরার সুযোগ তৈরি করে কোম্পানি। আর এই প্রোডাক্ট পুশে এ সময়ের জনপ্রিয় মন্ত্র হল – ইডস সেক্স অ্যাজ ম্যাচ অ্যাজ ইউ ক্যান। বাধ্যতায় পুরোনো অংশটি মুছে ফেলার আগে রুপেশ একবার পড়ে নিতে চায়, নিজের সৃষ্টি। একটা মায়া, একটা বুক টনটনে ভাব থাকেই। এখানে ছিল শ্রীমন্তের বাবার মৃত্যুকালীন কিছু অনুভব। শাহ রোডের নার্সিং হোম থেকে সেজেগুজে বের হচ্ছেন অভ্রনাথ। নার্স ড্রেসিংয়ের আগে কাউকেই ঘরে ঢুকতে দেয়নি। কাকলি, শিলাদের জোর করে মৃত্যুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মানে সাড়ে পাঁচটা নাগাদ কাঁকুড়গাছির বড়ছেলের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ডেথ সার্টিফিকেট, নার্সিংহোমের পাওনা-গন্ডা মিটিয়ে এখন রাত সাড়ে আটটা, অভ্রনাথ বের হচ্ছেন। ক্লিন শেভড, নতুন কাপড় পরা, আতর লেগেছে গায়ে। তাঁর সঙ্গী তাঁর তিন ছেলে, আর রাতের কলকাতায় পথের ঝক্কি এড়াতে বড়ছেলের পুলিশ শ্যালক। গাড়ি সেজে উঠবার জন্য লেক মার্কেটে ফুলের দোকান ঘুরে গেল। দিন পঁচিশ আগে ঠিক এভাবে নয়, বাজারের ব্যাগ হাতে মেজ বউমা সুজাতার সঙ্গে এসেছিলেন এখানে। তখন তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি লেক মার্কেটের মোড়ের এইসব ফুলের দোকানে তাকে আসতে হবে। ইস্টার্ন বাইপাস হয়ে গাড়ি ফাঁকা রাস্তায় হু হু ছুটছে। আকাশে তারাদের চোখে চোখ রেখে অভ্রনাথের মন হু হু করে উঠল। স্ত্রী শিলা, মেয়ে কাকলি কীভাবে সামলাবে নিজেদের! খুব ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়ে অনেক প্রতিকূলতায়, ঝড়ঝঞ্ঝায় তিনি বড় হয়েছেন। ছেলেদের কথা মনে পড়ছে। সবাই সক্ষম, সবাই প্রতিষ্ঠিত। তবুও এই হঠাৎ ঝাপটা, ওরা কি পারবে? স্ত্রী শিলার জন্য তিনি বেশি আকুল হচ্ছেন। একরাতও গত বিয়াল্লিশ বছরে আলাদা থাকেননি। ছেলে-মেয়ে বা কোথাও আত্মীয় বাড়িতেও তারা জুটিতে গিয়েছেন।
তার চোখের কোণ থেকে জল গড়িয়ে পাশে ফুলের উপর পড়ল শীতের শিশিরের মতো। বেশ শীত শীত করছে। ফেব্রুয়ারির রাত। ফাঁকা গাড়িতে এই হাওয়ায়, এই হঠাৎ যাওয়ার ব্যাপারে তো কেউ প্রস্তুত ছিল না। গতকাল মানে সতেরো ফেব্রুয়ারি অভ্রনাথ জানলেন তাঁর ক্যানসার। তখন তাঁর নাকে নল, হাতের শিরায় নল। সবাই দেখতে এসেছে। তার মনেই হয়নি অথচ এত বড় অসুখ। বারবার সবাইকে বলেছেন পেট পরিষ্কার হয়ে গেলেই তিনি ভালো হয়ে যাবেন। গতকালই বড়ছেলে ঋজি তাঁর কানে কানে বলে দেয়। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে তিনি বলেছিলেন, ‘তোর মাকে কিন্তু জানাস না। সহ্য করতে পারবে না।’ —এই তোরা কিছু একটা গায়ে নে, অন্তত কান দুটো ঢাক। অভ্রনাথ শুয়ে থেকেই বললেন। বড় ও ছোটছেলে তাঁর দু-পা ধরে বসে আছে। মেজছেলে ড্রাইভারের পাশে কেবিনে। তার গায়ে হাওয়া লাগছে না। তবুও ঘাড় ঘুরিয়ে কী একটা বলতে গেলেন। সত্তরের বেশি স্পিডে ছোটা গাড়ি একটা ছোট গাড্ডায় পড়ে বিদঘুটে লাফ দিল, মাথা ঠুকে গেল। অভ্রনাথ চ্যাচালেন, ‘ড্রাইভার সামলে চালাও।’ ড্রাইভারের দোষ নেই। এত রাত হয়েছে, দত্তপুকুর গিয়ে আবার ফিরে আসা কলকাতায়। তারপর কেওড়াতলার লাইন। কখন ছাড়া পাবে, কে জানে। এই সবে উলটোডাঙার মোড়। গ্রামের দিকে রাস্তাও তার ততটা চেনা নয়। পুলিশ বাবু না বললে হয়তো আসতই না।
অভ্রনাথ চ্যাচাতেন, রাইট টার্ন সিগন্যালটা কিছুতেই দিচ্ছে না। অন্য সময় হলে ‘চোখে কম দেখিস!’ কিন্তু আজ মুখে কিছুই বললেন না। কীরকম একটা হতবাক গোছের হয়ে গেছেন। জলের ধারা নেমেছে।
আজ সকাল থেকে একটানা যা সব ঘটে চলেছে—প্রায় দম দেওয়া পুতুলের মতো সব চরিত্র একের পর এক। তাঁর মনে পড়ল, দাদা সৌম্যনাথ এসে বসেছিল সকালবেলায় মাথার কাছে। মাথায় হাত বুলিয়ে তিনি বলছিলেন—ভালো হয়ে যাবিরে অস্ত্র। অভ্রনাথের চোখের কোল বেয়ে রুপেশ আর মায়া না বাড়িয়ে এই গোটা পর্বটি সিলেক্ট করে ডিলিট করে দেয়। লিখতে শুরু করে—উত্তরবঙ্গে বৃষ্টি নেমেছে কয়েকদিন হল। সকাল শ্যামল হয়ে আছে। সারা রাতের ট্রেন জার্নির পর সকালবেলায় গ্রামের ভেতর দিয়ে সড়ক পথে যেতে যেতে খুব ভালো লাগছে শ্রীমন্তর। কতদিনের তৃষ্ণার পর মাটি আকণ্ঠ পান করে শান্ত, শ্লথ গ্রামের বধুটির মতো কীরকম আমুদে হয়ে আছে। একটা মিষ্টি গন্ধ উড়ছে বাতাসে। শ্রীমন্ত ড্রাইভারকে টেপের সুইচ অফ করতে বলল। প্রকৃতি যখন গাইছে তখন যন্ত্র অসহ্য। বোলেরোর মতো গাড়িগুলোর অ্যাকসেস এমন স্পিডোমিটারের কাঁটা আশির নীচে নামে না। ফাঁকা রাস্তা। প্রধানমন্ত্রীর গ্রাম-সড়ক যোজনার টাকায় গ্রামের ভেতর দিয়ে এত বড় বড় পাকা রাস্তা চলে গেছে তা কিছুদিন আগেও ভাবা যেত না। ঠাকুরগঞ্জ নব্বই কিলোমিটারের পথ। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে পৌঁছে যাবে। শুধু চোখ দিয়ে নয়, সমস্ত মন মেলে প্রকৃতিকে চেখে নিচ্ছে। একটা ওষুধ কোম্পানির রিজিওনাল ডিরেক্টর শ্রীমন্ত জরুরি পরিদর্শন ও মিটিং করতে এসেছে। গ্রামের পথে রাস্তায় মুরগি, ছাগল এমন পথ জুড়ে মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে ড্রাইভারের বিরক্তি লাগছে। দু-পাশে মাঠ। কোথাও নতুন ধান চাষের জন্য তৈরি। পাটও বিস্তর হয়েছে। আর গাছগুলো এত লম্বা লম্বা মনে হয় যেন পশ্চাৎপটের বাঁশঝাড়কে টেক্কা দিতে চলেছে। এই দীর্ঘকায় পাটের খেত দেখতে দেখতে শ্রীমন্তর মনে এই আষাঢ়ের আকাশে ছেলেবেলার মেঘ ভেসে উঠল। সেও ছিল এক আষাঢ়ের দুপুর। ক্লাস সেভেন কী এইটের গ্রামীণ ছেলে। গ্রামের ছেলেবেলায় ছেলে-মেয়ে ভেদ থাকে। ওর থেকে বছর তিন-চারেকের বড় ছবিদি। ছবিদি বলল, ‘ডাবু আজ লুকোচুরি খেলব।’
ডাবু মানে শ্রীমন্ত রাজি।
—কোথায় খেলবে ছবিদি? বোসেদের মন্দিরের দিকে যাবে ?
—না, ওই ঘন পাটখেত দেখছিস না, ওটা আমাদের জমি, ওখানে। আমি আগে ওই বাঁশঝোপের পেছন দিক থেকে গিয়ে ঢুকব। তুই পাঁচ মিনিট বাদে আমাকে খুঁজবি। আবার আমিও খুঁজব, পরে। কিন্তু পাটগাছে বেশি চাপাচাপি চলবে না। গাছ ভেঙে গেলে বাবা রাগ ডাবু মাথা নাড়ে। কিন্তু মনে মনে ভয় হয় এত ঘন, বিস্তীর্ণ পাটের খেতের ভেতর খুঁজে পাবে তো! আজ আবার ছবিদি সব্‌জে সব্‌জে একটা গেঞ্জির টপ পড়েছে। সঙ্গে কালো স্কার্ট। গাছের পাতার রঙে তো মিশে যাবে! ভাবতে ভাবতে বেশ কিছুটা সময় কেটে যায়। হয়তো পাঁচ মিনিট হয়েছে কী হয়নি। ডাবু আস্তে আস্তে আল ভেঙে পাটের খেতের ভেতর ঢোকে গাছের পাতা নড়ে না। কিন্তু কোথায়? বাঁ-দিকে যাবে না ডান দিকে—ভেবে পায় না। একটু একটু করে মাঝখানের দিকে এগোয়। দু-এক মিনিট কেটে যায়। দীর্ঘ গাছেদের মাথা ছুঁয়ে মেঘলা আকাশের আলো তেমন ঢুকতে পারছে না। একটা গা-ছমছমে অস্পষ্টতা। না এলেই যেন ভালো হত। তখনই পেছন থেকে ছবিদি জড়িয়ে ধরে। —কীরে ভয় পেয়েছিস মনে হয়! মুখ একেবারে চুন! একটু একটু ঘামছিস।
—না, এত বড় খেতের ভেতর কোথায় তুমি, ভাবছিলাম। আচ্ছা, এখানে একটু বস, জিরিয়ে নে। ছবিদি হাত ধরে টেনে বসিয়ে দেয় ডাবুকে। তারপর নিজের কোলে মাথা টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। এত কাছ থেকে ছবিদিকে ডাবু আগে দেখেনি। ছবিদির গায়ে অদ্ভুত একটা মিষ্টি গন্ধ। ডাবু বড় করে শ্বাস নেয়। ছবিদির কোলে মাথা রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে ডাবু। আকাশ থেকে পাটের লাবণ্যময় পাতা ছুঁয়ে অল্প আলো এসে পড়েছে ছবিদির মুখে।
সেই লাবণ্য মেখে ছবিদির মুখে তখন দু-এক বিন্দু স্বেদ-অভ্র। কেন, ডাবু জানে না। মাঝে মাঝে ডাবুর নাকে মুখে ঘষে যাচ্ছে গেঞ্জির টপের ভেতর থেকে ফুটে ওঠা দুটি বড় পেয়ারার মতো স্তন। ডাবু তখনও কোনও নিষিদ্ধতার স্বাদ জানেনি। কোনও রহস্যের আনন্দ শিহরন কী—তার জানা নেই।
ছবিদি হঠাৎ বলে ওঠে, ‘ডাবু দেখ তো আমার পিঠে কোনও পোকাটোকা ঢুকেছে কিনা। পিঠটা চিড়বিড় করছে। ডাবুকে তুলে পিঠ ঘুরিয়ে বসে ছবিদি। কীভাবে দেখবে ডাবু! ঘাড়ের নীচের ও কোমরের ওপরের বাদামি ত্বক চকচক করছে ছবিদির। গেঞ্জির টপের ভেতর আরও একটা বেল্টের মতো কী উঁচু হয়ে আছে। কোথায় দেখবে!
—কী হল দেখ। ছবিদি পিঠ মোচড় দিতে দিতে তাড়া লাগায় ।
—কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না ছবিদি ।
—আরে বোকা ছেলে জামার তলা দিয়ে হাত দিয়ে দেখবি তো, এমনি উপর উপর দেখা যাবে। বলে ফটাৎ করে দু-হাত উপরে তুলে টপটা খুলে ফেলে ছবিদি। আর তরুণ ত্বকের অমন চিকন সাদার ঝলকানিতে ডাবুর চোখ ধাক্কা খায়। থতমত খেতে খেতে বলে, ‘কই কিছু তো নেই। —কিছু নেই! তাহলে চিড়বিড় করছে কেন! তুই একটু হাত বুলিয়ে দেখ না ।
ডাবুর কাঁপা কাঁপা হাত পিঠ ছোঁয়ার আগেই পেছন দিকে হাত দিয়ে ছোট জামাটা খুলে ফেলতে ফেলতে বলে, ‘তাহলে এই ছোট জামাটার নীচেই হয়তো আছে। দেখ।’ মুহূর্তেই সামনে ঘুরে যায় ছবিদি। আর ডাবুর চোখের সামনে বোসদের মন্দিরতলার ডালিম গাছের লাল টকটকে দুটো ডালিম উদ্ধত ভঙ্গিমায়। ডাবু চোখ বোজে।
-আরে চোখ খোল, কী হল, লজ্জা পেলি। ধুর বোকা! এইরকম সবারই তো থাকে। ডাবুর হাত টেনে নিয়ে ছবিদি নিজের বুকের উপর রাখে। ডাবুর হাত যেন গরম মাখনের ভেতর ডুবে যেতে থাকে। মাথার ভেতর অজানা পাখিদের গান। আর যেন চোখ খুলতে পারবে না এরকম একটা বোধও ওই প্রস্ফুটিত কুসুমের স্পন্দন নিয়ে হাতের তালু বেয়ে সমস্ত শরীরে। ছবিদির গলা থেকে একটা ঘড়ঘড়ে আওয়াজ বেরোয়——কী হল চোখ খোল। তোদের স্কুলে এখনও বুঝি ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে জীবনবিজ্ঞান পড়ায়নি!’ ডাবু চোখ না মেলেই মাথা নাড়ে, ‘না। পড়াবে।’ ‘স্কুলের আগেই তোকে আমি শিখিয়ে দিই দেখ। এই যেখানে হাত দিয়ে আছিস, এটা স্তন। মেয়েরা বড় হতে থাকলে এটা সবারই হয়।
আস্তে আস্তে কানের ভেতর থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক সরে গেলে ডাবু চোখ মেলে ছবিদির নগ্ন ঊর্ধ্বাঙ্গের অপরূপতায় প্রোজ্জ্বল হতে থাকে। ডাঁশা পেয়ারার মাথায় যেরকম গোল চ্যুত ফুলের ছাপ থাকা মোহময় গর্ত সেরকম যত্নে বাঁধানো নাভি। তার পরে ইউক্যালিপটাসের সুঠাম কাণ্ডের মতো খানিকটা উপরে উঠে রক্তিম বলয় নিয়ে বুকের দু-দিকে ওই প্রস্ফুটমান বর্তুলতা। ছবিদির চোখ তখন ডাবুর ওই অপাঙ্গ নিরীক্ষণ উপভোগ করছে। আর ডাবু চোখের উপর এই অজানা সৌন্দর্যের বহমানতায় বিস্মিত ও নিস্পন্দ। ডাবুর তখন মনে হতে থাকল ছবিদি যেন কত বড় হয়ে গেছে। যেন তার শিক্ষক। ছবিদির কথা তার কানে ঢুকছে। মাথায় ঢুকছে না। ছবিদি কত কী করছে। বুঝতে পারছে না। একসময় বলে, ‘মেয়েদের নীচের দিকটা একদম অন্যরকম দেখবি?’ চট করে পাঁচ ফুটের একটি চিতল হরিণ দু-পায়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। স্কার্ট খোলে। স্কার্টের নীচের ইজের খোলে। আর পরিচ্ছদহীন ওই হেম মূর্তির সামনে বসে থাকা ডাবু দেখতে পায় একটা ধবল ডাহুকের দুটি পায়ের মতো নম্রতা উপরে যেখানে এসে স্থিত সেইখানে সামান্য দূর্বাঘাসের ভেতর থেকে উকি মেরে আছে আবেশে বিভোর হয়ে থাকা দীর্ঘ একটা চোখ। ছবিদি ডাবুর হাত টেনে এনে ওই চোখের উপর স্থাপন করে বলে, ‘এই হল যোনি।’ একসময় একটা কানাকুয়ো পাখি পাশের বাঁশবাগানের ভেতর অযথা তার কর্কশতা ধ্বনিত করায় ডাবুর বিভোরতা কেটে যায়, আর সচকিত ছবিদিও দ্রুত জামা প্যান্ট পরে ফেলে। ততক্ষণে অনেকটা সময় কেটে পড়ন্ত বিকেল। তারপর অনেকদিন, পাটের খেতে নয়, বোসেদের মন্দিরের পেছনে স্কুলের ছুটিতে ডাবু ছবিদির শরীর দেখেছে।
একটা বাচ্চা ছাগলকে বাঁচাতে ড্রাইভার ডানদিকে সাপ টার্ন নিতেই শ্রীমন্তর মাথা ঠুকে যায় সাইড ডোরে। শ্রীমন্ত চ্যাচায়, ‘ক্যা হুয়া !” রস্তার উপর বাজার বসতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে ঠাকুরগঞ্জ এসে গেল। শ্রীমন্ত কপাল ডলতে ডলতে প্রশ্ন করে, “ইহাঁ কা হোটেল আচ্ছা হ্যায় ক্যায়া ?” “হাঁ স্যার বড়িয়া।’ বলতে বলতে ডানদিকে লুপ লাইনের ঠাকুরগঞ্জ স্টেশন ছাড়িয়ে বাঁয়ে গাছগাছালির ভেতর উকিমারা একটা দোতলা বাড়ির প্রশস্ত উঠোনে ড্রাইভার গাড়ি ঢুকিয়ে দেয়।
রুপেশ ভেবেছিল প্রথম কিস্তি আজই শেষ করে দেবে। কিন্তু এসময় স্ত্রী নীতার ফোন আসে। রাতে মাংসটা রান্না করে রাখতে হবে। নীতা হোটেল থেকে রুটি নিয়ে আসবে। সাড়ে ছ’টা বেজে গেছে ফলে বাধ্য ছেলের মতো টেবিল থেকে উঠে পড়ে রুপেশ। ফ্রিজ থেকে প্লাস্টিকের বাটিতে রাখা কাচা মাংস বাইরে বের করে রাখে, বরফ গলাতে হবে?
পেঁয়াজ আদা, আলু ঝুরি থেকে নিয়ে বেসিনের জলে ভালো করে ধুয়ে নেয়। পেঁয়াজ কুচিকুচি করে কাটে কিছুটা। কয়েকটা পেঁয়াজ চার টুকরো করে রাখে। মিট মশলা দিয়ে রান্না করাটা একদম পছন্দ করে না। বাটনা বাটতে পারে না, কিন্তু রুপেশের পছন্দ শিলনোড়ায় আদা, শুকনো লঙ্কা, জিরে একসঙ্গে বেটে মশলা বানানো। কাজের মাসি এই ঝক্কিটা মাঝে মাঝে সামলায়। কিন্তু এখন এই সন্ধ্যাবেলায় তাকে কোথায় পাবে! পেঁয়াজ কাটা হয়ে যাবার পর কিছুটা টক দই, জিরে গুঁড়ো, সরষের তেল, আদাকুচি, লবণ দিয়ে রুপেশ মাংসটাকে ম্যারিনেট করে। মানে জম্পেশ করে রেখে কিছুক্ষণ রেখে দেওয়ার আয়োজন করে। রুপেশ ভাবে গল্পকেও এরকম মেখেটেখে কিছুক্ষণ মাথার ভেতর রেখে দিলে ভালো। ফলে এখন ও লাল চা বানাবে আর তা নিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়াবে আধঘণ্টা। ভেবেছিল গুনগুন করে একটা গান ধরবে। মন থেকে টেনশন রিলিজ করার জন্য সিগারেট ধরিয়ে এটা করে রুপেশ। কিন্তু ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াতেই একটা হালকা মিষ্টি হাওয়ায় সে চিন্তা ভেসে গেল। বদলে কয়েকদিন আগে পড়া জয় গোস্বামীর কয়েকটা লাইন ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এল— ‘এসো বর্ষা শ্যামা পাখিটির ডানা ধরে এসো, চন্দ্রচূড় / হতবাক হল, কালো কেশে / কত তারা মুরছি পড়িছে…’
আশ্চর্য, রুপেশ মোটেও কবিতা আওড়াতে চায়নি। তাহলে কে ওকে বলিয়ে নিল। মন এমনি অবাক অবাক কাণ্ড ঘটায়, যার তেমন কোনও মানে নেই। ভাবছিল, জয় গোস্বামীই বা কেন লিখতে গেল ‘শ্যামা পাখিটির ডানা ধরে এসো।’ রুপেশ সিগারেটের লাল আলোটির দিকে তাকিয়ে ভাবছিল জীবন থেকে নিয়ত উৎসারিত হচ্ছে সমাধানহীন প্রশ্ন, আত্মপরিক্রমায় আমি ভেঙে টুকরো হয়ে যাচ্ছে, অসংগতির আকর গোটা জীবন, প্রাণহীন, সজীবতাহীন—তাকে কীভাবে আগ্রহে আমন্ত্রণ করা যাবে! ওর শ্রীমন্ত চরিত্রটির কথা ভাবছিল। ভাবছিল মিঠু মাসি, অনুষ্কা—এরাই বা কেমন মেয়ে! হঠাৎ মাথায় খেলল, ওদের দুজনকে একসঙ্গে ডেটিংয়ে ডাকবে শ্রীমন্ত। সংশয় লাগছে, ইন্ডিয়ান কালচারে তা কি খুব একটা যাবে! আপাতত এই মাসি, বোনঝি—দুজনে মিলে সামার এন্ডিংয়ে শিলংয়ের পাইনউড হোটেলে রয়েছে। বোনঝি, মানে অনুষ্কা শ্রীমস্তকে জানিয়েছেও তা। মাথায় যখন এসেছে রুপেশ ভাবল বউ আসার আগেই আরও কিছুটা লিখে ফেলবে। সিগারেটের শেষ অংশটুকুতে একটা লম্বা টান মেরে পি.সি.-তে বসল।
—ফিকিরতং কুমনো ?
পুলিশবাজারে সেন্টার পয়েন্টের সামনে দাঁড়ানো এক স্বল্পকেশ যুবক স্মিত হেসে উত্তর দেয়, বিভা।’ মানে কেমন আছেন এর উত্তরে সে জানায় ‘ভালো’।
মিঠু মাসির দু-বছর শিলং-এ কাটানোর ভাষা শিক্ষার দৌড় অতটুকু। আর সত্যিই শিলং-এ ভালো আছি না বললে সাধারণভাবে অনৃত ভাষণ হয়ে যায়। প্রকৃতির এমন অকৃপণ আয়োজনের ভেতর থেকে শরীরে, মনে খারাপ থাকার কোনও উপায় নেই। বছরের অধিকাংশ সময় ধরে ট্রপিক্যাল ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ঠান্ডা এ জায়গাটা। মিঠু মাসি এখন গাইড। একটু একটু করে পায়ে হেঁটে ঘুরছে আর বকবক করে যাচ্ছে।
—দেখ দেখ এই যে রাস্তার দু-পাশে সাদা নাকছাবির মতো অজস্র ফুল ফুটে আছে ওগুলো কী ফুল বল তো?
-জানি না। কী করে জানব! আমি আগে কখনও এই ফুল দেখিনি। আমি এসেছি নাকি এখানে
—ওগুলো নাশপাতি ফুল। প্রতি দু-মাসে শিলং নতুন করে সাজে।
এখন সাদায় ছেয়ে আছে দেখছিস – কিছুদিন আগে এলে গ্রীষ্মে দেখতে পেতিস রডোডেনড্রন গুচ্ছ থেকে থোকা থোকা লাল এসে দৃশ্য সাপটে আছে।
-আবার বসন্তে চেরি ফুলের হালকা গোলাপি বিভায় বিদেশি আবহ। কখনও জ্যাকারান্ডা, মুসান্ডার চমক। ক্যামেলিয়া, ম্যাগনেলিয়া, ফরগেট মি নট—এইসব ফুল দেখে আমার তো প্রথমে ইউরোপ মনে হয়েছিল। যখন বিয়ের পর প্রথম আমি এখানে এসেছিলাম। শুধু ভালোলাগায় নয়, মিঠুমাসিকে এখন খুব স্মৃতিকাতর লাগছে। —চল, ওয়ার্ডসলেকে বোটিং করি। এই তো পাশেই। রাজভবনের একেবারে গায়ে লাগানো। এটা একটা ছোটখাট হ্রদের মতো। ভূমিকম্পে তৈরি। লেকের ভেতর এত নানারঙের বিচিত্র গাছপালা আছে তোর নিজে থেকেই খুব কাব্যিক লাগবে।
—শিলং নামটার মধ্যেই একটা টুং টাং বাজনা আছে, না! বেশ মিষ্টি লাগে। কে রেখেছিল গো মাসি?
—খাসিদের উপাস্য দেবতা উব্লেই শিলং-এর নামে এই জায়গার নাম শিলং। কাল শিলং পিক-এ যাব। ধর এখান থেকে দশ-এগারো কিলোমিটার হবে। এটাই এখানকার সবচেয়ে উঁচু জায়গা। যদ্দুর জানি উনিশশো পঁয়ষট্টি মিটার। পথে যেতে যেতে দেখতে পাবি নাম না জানা নানারকম ফার্ন। এখানে প্রচুর রডোডেনড্রন ফুলের গাছও আছে। আছে পাইন, ফার, আর বার্চ গাছ। মিলিটারি এরিয়া বলে নিরাপত্তার জন্য চেকপোস্ট আছে। শিলং পিক থেকে গোটা শিলং-এর প্যানোরামিক ভিউ দারুণ লাগবে তোর।
ছোট জায়গা হলেও সারাদিন পায়ে হেঁটে গল্প করতে করতে ঘুরে বেড়ানোয় অনুষ্কা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। হোটেলের ঘরে ঢুকেই ও বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। মিঠুমাসি বাথরুমে ঢুকে মিনিট দশেক কাটিয়ে অল্প গরম জলে গা ধুয়ে তরতাজা হয়ে বেরোতে কেমন দেবী দেবী লাগছে। দুয়া না হোক অন্তত লক্ষ্মী, সরস্বতী তো হবেই। হাতকাটা কোমর পর্যন্ত নামা ধবধবে সাদার একটা টপ জাতীয় কিছু, আর একটা গাঢ় নীল প্যান্টি। এমন লম্বা গাউন টাউন নিশ্চয়ই কিছু একটা চাপাবে। ধবধবে সাদা শাম্মলী বৃক্ষের ঊরু সহ সাড়ে পাঁচ ফুটের মেদহীন চেহারায় বুকও কুমোরটুলির প্রতিমায় শাড়ি পরানোর আগের মতো নিক্তিমাপা, উন্নত। দু-একটা অলকচূর্ণ চোখের উপর বেয়ে বুকের উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে অগোছালো। পিঠে একরাশ চুলের কালোয় ঘরের অল্প আলোয় এক মায়া প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। বব ডিলান বাজছে। মিঠু মাসি হোটেলের সেন্ট্রালি আয়োজিত স্টিরিয়োর নবটা একটু কমিয়ে দিল। অনুষ্কা ঘুমোচ্ছে, ঘুমোক। ততক্ষণে ক্রিম-ট্রিম লাগিয়ে একটু তৈরি হয়ে নেওয়া যাবে। ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই—ওরে বাবা! সাড়ে ন’টা বেজে গেছে! কখন ডিনার-টিনার হবে! —অনু ওঠ, রাত হয়ে যাচ্ছে। চোখে-মুখে জল দিয়ে ফ্রেশ হ। আমি ডিনারের জন্য বেল বাজাচ্ছি। অনুষ্কার মাথায় হাত দিতেই জেগে ওঠে সে। চিৎ হয়ে যায়।
খুব টায়ার্ড লাগছিল, যা হাঁটিয়েছ মাসি । বলতে বলতে চোখ বড় করে একটা শব্দ করে—উফ্!
—কী হল রে?
—এদিকে এসো না। অনুষ্কা হাত ধরে মাসিকে বিছানায় বসায়।
হাউ থ্রিলিং মিঠুমাসি! এই ফিগার, তুমি তো ছেলেপিলেদের মাথা জ্যাস্ত চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে! অনুষ্কা প্রশংসার চোখে মিঠুমাসিকে অপাঙ্গে দেখতে থাকে। পারফেক্ট বিউটি। মাসি তুমি ওই কীসব মিসেস তিলোত্তমা-টমায় যাও না কেন? প্রাইজ নির্ঘাত বাঁধা। তুমি কি ব্রেস্ট লিফট করেছ প্যাডেড ব্রা দিয়ে?
—ধুৎ, তা কেন করব। কিচ্ছু করিনি। প্লেন ব্রা। মাসি দ্রুত টপ, ব্রা খুলে উন্মুক্ত হয়ে সামনে দাঁড়ায়।
বিশ্বাস হয় না। মাসি ওর থেকে বয়সে বেশ কিছু বড়, বিবাহিতা। তবু কী করে ভাস্কর্যের মতো খোদিত হয়ে আছে ওই দেব-ফল দুটি! অজ্ঞাতেই হাত চলে যায়, স্পর্শ করে মাসির স্তন-চুড়ো। সংবিৎ পেতেই কিছুটা অপ্রস্তুতে হাত সরিয়ে নেয়, একটু ঈর্ষা জন্ম নেয়। ওর • নিজের অহংকার দুটি এত নয়। কিছুটা লজ্জা আনত, নিম্নমুখী। ‘তুমি কি ক্যালোরি কনট্রোল করো, না ব্যায়াম ? ”
—দুটোই। রোজ সকালে এক ঘণ্টা প্রাণায়াম, মানে যোগা করি। আর তোদের মতো বেহিসেবি মদ্যপান করি না। যেমন আজকে ইচ্ছে -ও সিয়োর।
করছে একটু ভদকা খাবার। খাব, কিন্তু কাল নয়। তুই নিবি?
! ভদকা আমার একটা প্রিয় আইটেম। তুমি অর্ডার-ফর্ডার দাও, আমি টয়লেট হয়ে আসছি। ডিনার শেষ করে মাসি ও বোনঝি ভদকার গ্লাস নিয়ে আড্ডায়
বসে। ‘আচ্ছা অনুষ্কা তোর বোর লাগে না এই একাকী জীবন? বিদেশে তো আরও নিঃসঙ্গ লাগার কথা। কী করে কাটাস? গোটা জীবন এরকম থাকতে পারবি। ওখানে ডেটিং-ফেটিং করিস নিশ্চয়ই, কিন্তু তাও একটাকে পার্টনার করতে পারলি না! ওদেশে, এদেশে তেমন কেউই নেই তোর। ওই ছেলেটা তো ভালো, হ্যান্ডসাম। কী যেন নাম, শ্রীমন্ত ওকে প্রপোজ কর।’
প্রায় বিষম খাবার মতো করে হেঁচকি ওঠে অনুষ্কার। মুখ থেকে, গ্লাস থেকে অনেকটা মদ চলকে পড়ে বিছানার একপাশ ভিজে যায়।
‘শ্রীমন্ত! আর লোক পেলে না। ও খুব ভালো বন্ধু আমার। তবে পার্টনার হবার মতো নয়। ওরকম হ্যান্ডসাম বাদামি ত্বকের ছেলেদের জন্য ওদেশে খুব ক্রেজ। বাট হি ইজ নট মাই কাপ অফ টি। ফ্রিজিড নয় বটে, তবে যৌন-যাপনে ততটা স্মার্ট নয়। একটু ইতর ভাষায় যাকে বলা যায়- ভ্যাদা ভাদা।’
—খুঁতখুঁতে স্বভাবটা তোর এখনও রয়ে গেল। কোনও জিনিস কি হান্ড্রেড পার্সেন্ট পারফেক্ট পাওয়া যায়। আর তাহলেও তাকে সাজিয়ে রাখতে হয়। ব্যবহার করা যায় না। গো, গেট ইট। অনুষ্কা একটা সিপ নেয়। স্মিত হাসে। সম্মতি-অসম্মতি তাতে কিছুই প্রকাশ পায় না। মাসি কথা বাজায়, ‘দেখবি, কেমন ওভার ফোনে ওকে সিডিউস করব! তোর ধারণা ভুল হয়ে যাবে। দে নাম্বারটা দে।” -শ্রীমন্ত বলছেন? আমি মিঠুমাসি । অনুষ্কার… অন্যদিকের কন্ঠ সপ্রতিভার ছাপ রেখে দ্রুত জানায়, ‘শুধু অনুষ্কার কেন, আমারও মিঠুমাসি।’ মোবাইলের রিসিভারের ভলিউম বাড়ানো আছে। পাশ থেকে অনুষ্কার শুনতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। –তো অনুষ্কা কোথায় ?
-অনুষ্কা ঘুমিয়ে পড়েছে। অনেক রাত হল, আমার ঘুম আসছে না। হোটেলের ব্যালকনিতে এসে বসেছি। কী করি, কী করি করে আপনাকে ফোন করে একটু গল্প করব ভাবলাম। —এই আপনি-টাপনি বললে কিন্তু গল্প হবে না। ও প্রান্তের গলায় বেশ ঝরঝরে ঋজুতা।
—তাহলে তুমি নয়, একেবারে তুই বলব, যেমন অনু মানে অনুষ্কাকে বলি। এতে দূরত্ব ঘুচে যায়।
—হ্যাঁ, বল মিঠুমাসি ।
— আরেব্বাস । ছেলে তো খুব স্মার্ট। মিঠুমাসি ফোনে অকৃত্রিম অল্প হাসে। ফোনে হাত চাপা দিয়ে অনুষ্কার দিকে চেয়ে চোখ মটকে বলে, কিন্তু বাছা ঘুঘু দেখেছ, ঘুঘুর ফাঁদ দেখনি। দেখাচ্ছি মজা। পুনরায় কথা চালায়— তোদের ওদিকে বৃষ্টি হচ্ছে শ্রীমন্ত ? কাল মৌসিমগ্রাম যাব বৃষ্টি দেখতে।
—হ্যাঁ, সকালে এখানে বৃষ্টি হয়েছে কয়েক পশলা। গরম ভাবটা নেই। আবহাওয়া বেশ প্লেজান্ট লাগছে।
—কখনও বৃষ্টিতে ভিজেছিস? কোনও বান্ধবীর সঙ্গে? আমার কিন্তু খুব ইচ্ছে করে ঝমঝম বৃষ্টির ভেতর কোনও যুবকের কোমরে হাত দিয়ে শান্ত গ্রামীণ কোনও পথ দিয়ে হেঁটে যেতে। একটা কথা বলব বিশ্বাস করবি ?
—হ্যাঁ, বল না। শ্রীমন্তের গলার স্বর কেমন শুকনো এবার ।
—এই যে আমরা কথা বলছি, মনে হচ্ছে তুই যেন আমার পাশে বসে ফিসফিস করছিস। তোর গায়ের উত্তাপ টের পাচ্ছি। তোর প্রতিটি শ্বাসের শব্দ আমার কাছে দৃশ্যমান। গতকালই আমরা দেখছিলাম শিলং শহরের বাইরে বনের ভেতর একটু নির্জনে বিশপ বিডন ফলস। তখন মনে হচ্ছিল তোকে নিয়ে ঝরনার জলের আড়ালে ওই স্নিগ্ধতায় কিছুক্ষণ যদি কাটাতে পারতাম। তোর আর আমার কোনও পোশাক নেই। অরণ্যের সবুজ ছুঁয়ে তোর সারা শরীর সবুজ। আমিও সূর্যের পড়ন্ত আলো মেখে পিচ ফলের মতো আরক্ত। হোটেলের ঘরে এসি চলছিল। তাও শ্রীমন্ত কুলকুল করে ঘেমে উঠল। ঢাকা দেওয়া কাচের গ্লাস থেকে ঢকঢক করে অনেকটা জল খেয়ে নিল। জিভ জড়িয়ে যাচ্ছে তবুও বলল –’ বানিয়ে বানিয়ে এত সুন্দর মিথ্যে বলছিস যে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে।’ —নারে। গতকাল আমাদের পাইনউডের পাঁচতলার ব্যালকনিতে খুব ভোরে অন্যমনস্ক দাঁড়িয়েছিলাম। পাহাড়ের দিকে তাকাতেই থ্রিল! ওই শুভ্র শৃঙ্গে সূর্যের প্রথম শ্রমপাত হচ্ছে। আমার গোটা শরীরে কম্পন। কীসের আশ্লেষ বুঝে না উঠতেই দু-পাশে দু-হাত ছড়িয়ে দিয়েছি। আমার ফিনফিনে রাতপোশাক থেকে ঠিকরে বেরিয়েছে শরীরী অহং। আমি চাইছিলাম ওই শৃঙ্গ আমাতে গ্রথিত হোক। সেই ভালোলাগাটুকু এখনও রয়েছে রে। তুই ওই শৃঙ্গ হবি। আমার সবটুকু তখন উজাড় করে দিতে চেয়েছিলাম। —এখনও কি চাইছিস? শ্রীমন্তর শুকনো গলায় তেষ্টার কাঁটা। মাথার ভেতর ঝিঁঝি পোকার ডাক। —চাইছি রে, খুব চাইছ। তুই হাত বাড়া। —বাড়াচ্ছি, কিন্তু ছুঁতে পারছি না কেন রে! পারছি না। যদি ঘোর কেটে যায়, যদি এই রিমিঝিমি বর্ষণ হারিয়ে যায়!
—তুই একটা কাপুরুষ। দাঁতে ছিঁড়ে টুকরো করতে পারিস না।
এই নিক্তি মাপা শরীর—সেকি ঠাকুর ঠাকুর করে তোলা থাকবে! গলায় হাস্কি স্বর তখন মিঠুমাসির। বল, তুই আমাকে নিবি।
তারপর গান ধরে- দাও হে হৃদয় ভরে দাও ।
তরঙ্গ ওঠে উথলিয়া সুধা সাগরে।
সত্যি সত্যি তখন শ্রীমন্তের মনে হচ্ছে পড়ে যাবে। মাথা ঘুরছে নাগরদোলার মতো। ব্রেন আর নিতে পারছে না। ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। সেলফোনের ভেতর দিয়ে তা শোনা যাচ্ছে। মিঠুমাসি এরপর মাস্টার স্ট্রোকটা দেয়? ‘এত শ্বাস, এত আকাঙ্ক্ষা পাঠাস নারে শ্রীমন্ত। জানি না তোকে ভালোবাসি কি না, কিন্তু তোতে বন্দি হয়ে গেছি, তাড়িত হয়ে আছি। এই আমার সমস্ত পোশাক খুলে রাখছি, এই টপ… খুলে রাখছি। আয়।’ –ঠন্ করে একটা শব্দ হয়। মনে হয় শ্রীমন্তর সেলফোন হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল। আর কথা নেই।