চোখ – আবদুল মান্নান সৈয়দ

›› সম্পুর্ণ গল্প  

কে এই রমণী? -নর্তকী, বাররামা, বিদুষী। নগরীর সমস্ত পুরুষ অগ্নিলুব্ধ পতঙ্গের মতাে ধাবমান। রাজপুরুষেরা, বাগী, কবি, চিত্রকর, ভাস্কর ও দার্শনিকেরা। গৃহবধূ ও প্রণয়িনীরা হয়ে উঠেছে শঙ্কিত, এমনকি অন্য বাররামরাও।

গােধূলি সমাগত হতে-না-হতে চঞ্চলার গুহে পুরুষেরা সমবেত হতে থাকে। সকলেই তার প্রণয়প্রার্থী, সকলেই তার কুপাভিখারী। অরি চলার গ্রহণ গ্রামে হলেও নগরীতে যখন সে নীত হয়েছে তখন তাকে মনে হয় এক আশ্চর্য মৃণালে উদ্যত পঙ্কজের মতাে। তার মুখের মলে যেন বিলুপ্ত কোনাে প্রাচীন নগরীর কারুকার্য খচিত; তার কেশদাম যেন নিশীথের অন্ধকারের দ্বারা রচিত; পত্রিবর্ণ কনকাভ। দেহ দীঘল ও তন্বী; স্তন নিটোল, পরিপূর্ণ ও কোমল-কঠিন দুটি ফলের মতাে; শ্রোণী নিবিড়, পরিপূর্ণ ও কোমল-কঠিন দুটি ফুলের মতাে করাঙ্গুলি সদ্যজাত অগ্নিশিখ পর্বতের মতাে; পদাঙ্গুলি রক্তশিখ সদ্যজাত পল্লবের মতাে। চঞ্চলা এক শরীরিণী রমণী; কিন্তু শরীরসর্বস্থা নয়—তার হাস্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মেধার দ্যুতি; হয়তাে গম্ভীর নয় কিন্তু চারু তার বাচনভঙ্গি; কবিতা ও ভাস্কর্য, চিত্রকলা ও দর্শন-সমেত সব বিষয় সম্পর্কেই অাছে তার প্রাথমিক জ্ঞান ॥ সেজন্যে তার সঙ্গে আলাপের আবহ থাকে সাচ্ছল বাতাসের মতাে। আর সে, বারমা, জানে বাক্যের সঙ্গে কি করে মেশাতে হয় কটাক্ষ, হর্যের উদ্বেলতার সঙ্গে কি করে সংগত হয় নিতম্বের হিল্লোল। তার শরীর যেন একটি সংগীত; যেন একটি সােনালি পানপালের উথাপন; আর তার রক্তিকুশলতা বাদ্য-যত্নে মসু-সমতুল-তীব্র-অতিতীর এইমতো এ-মেলীলা সুদক্ষ করাঙ্গুলির। চঞ্চলা একটু স্বতন্ত্র। সাধারণ স্নানাগারে সে কখনাে যায় না, কেমন যেন তার রুচি হয় না সাধারণ্যে নগ্ন হতে। চঞ্চলার খ্যাতি ও পুরুমহলে প্রতিপত্তি ও আকর্ষণ হয়তাে এত বেশি এজন্য যে বাররমণী হলেও তাকে সাধারণ্যে নগ্ন দেখা যায় না। বছরে একবারই, নগরীর বাৎসরিক উৎসবে মন্দিরে প্রণতি সমাপন করে সে আমূল নগ্ন হয়ে সমুদ্রে স্নান করতে যায়। বৎসরে ঐ একবারই তাকে নগরবাসী নগ্ন দেখতে পায়। কিন্তু উৎসবের উন্মাদনায় সবাই এত ব্যস্ত থাকে তখন যে, নগ্নিকা চঞ্চলার দিকে আলাদা দৃষ্টিপাতের অবসর থাকে না কারাে। কেবল হাজার হাজার নরনারীর ভিতরে লুকিয়ে এক রাজপুরুষ পৃথিবীর তীব্রতম ক্ষুধা নিয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। রাজপুরুষ চঞ্চলার এক প্রত্যাখ্যাত প্রেমিক। গত তিন বছরে সে এই উৎসবের দিনটিতে চঞ্চলাকে দেখার জন্যে ভিড়ের ভিতরে লুকিয়ে তাকে। তারপর স্থালী হাতে অামূল নগ্ন চঞ্চলা যখন মরিঘরি থেকে বহিগতি হয়ে একটি দীপ্র ঘােটকীর মতো সমুদ্রের উদ্দেশে চলতে থাকে, তখন জনতার মধ্যে থেকে তাকে অনুসরণ করে এক রাজপুরুষ। তাকে সমুদ্র অবধি অনুসরণ করে রাজপুরুষ, নীল সিন্ধুজলে রূপসীর অবতরণ অবধি, এবং তারও পর তার স্নান সমাপন অবধি তার ক্ষুৎকার চক্ষুদ্বয় জ্বলন্ত জাগ্রত থাকে। এই রাজপুরু দীর্ঘাঙ্গ ও সুদর্শন। অথচ কত তুচ্ছ নাগরিক চঞ্চলার হৃদয় — শরীরে দখল পেয়েছে, কিন্তু এই রাজপুরুকে চঞ্চলা কি-এক অজ্ঞাত কারণে প্রত্যাখ্যানের পর প্রত্যাখ্যান করেছে। কতদিন চঞ্চলকে এক-পলক দেখার আশায় তার বাড়িতে গিয়ে বসে থেকেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কিন্তু আশ্চর্য, চঞ্চলা তাকে বলতে গেলে একরকম অপমানই করেছে। বেচারা রাজপুরুষ তাই তাকে নগ্নিকা দেখার আশায় সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে।

ব্যক্তিত্বসম্পন্না চঞ্চলার পূহে, এই নগরীর শ্রেষ্ঠ পুরুষদের সমাবেশ। রাজপুরুষ, কবি, বাগ্মী, ভাস্কর, চিত্রকর। বাররমণী সে, তার গৃহদ্বার সকলের জন্যে উক্ত, কিন্তু হৃদয়ার নয়। এই নগরীতেই এমন রূপসী আছে যে চঞ্চলার চেয়ে সুন্দরী, এমন রমণী আছে যে চঞ্চলার চেয়ে মেধাণিী, কিন্তু রূপ এবং মেধার এমন সময় কি আছে আর? নেই। চঞ্চলার আছে সেই ব্যক্তিত্বের ব্যবহার, যা নেই স্তননিতম্বসম্বা অন্য বারমণীদের। তাই তার উদার নিমন্ত্রণের মধ্যেও একটি নির্বাচন আছে। আর-যে নারীর ব্যক্তিত্ব আছে, নির্বাচন আছে, সে আহবান করে নিয়ে আসে দ্বন্দ্ব, বিরােধ, প্রতিদ্বন্দ্ব। অর্থাৎ ঘটনা, নিস্তাপ সমতল জীবনযাপন নয়—পতনে-উত্থানে দোলায়িত ঘটনা। এবং সেরকম একটি ঘটনাই সংঘটিত হলাে সেদিন।

সেদিন সূর্য অস্ত যেতে না-যেতে প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত হতে-না-হতে চঞ্চলার গৃহে উপস্থিত হয় কবি। কবি স্বভাবই ঈষৎ তীব্র অস্থির এ ধৈর্যহীন। যখন সে উপস্থিত হলাে, তখনও চঞ্চলার সান্ধ্যকালীন স্নান ও প্রসাধন সাঙ্গ হয়নি। কবি সানন্দে বসে বসে পা নাচায়। | সম্প্রসাধন সম্পন্ন করে ভিতর থেকে অনেকক্ষণ পরে গলা যখন বেরিয়ে এল হাস্যোজ্জ্বল মুখে, তখন সন্ধ্যা উীর্ণ, রীতিমতো রাত্রি নেমেছে। বলল—কি ব্যাপার, কবি আজ এত তড়িতাড়ি?

কবি সে কথার উত্তর না-দিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে—আরে, এ যে দেখছি কক্ষের ভিতরেই চন্দ্রোদয় । সত্যি চঞ্চলা, তুমি আজ অচঞ্চল দ্বিতীয় চন্দ্রের মতাে দীপ্যমান। আমি কিছু কবিতা রচনা করেছি, কিন্তু মনে হচ্ছে ঈশ্বর-রচিত সৃষ্টির কাছে সেসব তুচ্ছ।

হয়েছে, খুব হয়েছে। আঁখিজাদু হেনে বলল যুবতী।

কবি রীতিমতো নাটকী আবেদন সৃষ্টি করে-অহি আজ বৃহুনীতে না জানি সে কোন ভাগ্যবান পুরু এই রূপসরােবরে স্নান করবে?

-ওহ, খুব হিংসা হচ্ছে, না?—চুম্বলী একটি ফোয়ারার মতো কলহাস্য করে ওঠে। তারপর ফোয়ারা শমিত করে বলে—কেন, চন্দ্ররশ্মি এই কবির উপরে কি এসে পড়েনি কোনাে দিন?

তা পড়েছে। তা পড়েছে। কবির সপ্রতিভা একতিল ভ্রষ্ট হয় না। কিন্তু সেসব তাে মনে হয় কোন পূর্বজন্মের কথা। এত সুদূর অতীতে বিষয় বলে মনে হয়, যার অর্ধেক স্মৃতির ভিতরে প্রবিষ্ট বাকি অর্ধেক স্বপ্নের অংশ। আর তুমি, চঞ্চলা, তােমাকে মনে হয় সাধারণ নারী নও তুমি। তুমি দেবী, তুমি ভিনাস, এইমাত্র সমুদ্র থেকে উত্থিত হয়ে এলে, তোমার কেশরাশি এখনো সিক্ত, তোমার শরীর এখনাে নীল লবণাধুজলের স্মরণে শীতল, তােমার আননে এখনাে লিপ্ত হয়ে আছে দুএককণা সমুদ্রশী, দেবী তুমি, সমুদ্রউথিত ভিনাস তুমি কবির শ্রোত্র যখন এইভাবে অবিরলাক্সে নিড়ান্ত হচ্ছে, আর কানের দুল। বিলকিয়ে মাথা ঈষৎ কাৎ করে সহাস্যে আশ্চর্য এক ভঙ্গিতে এই স্তোত্রপাঠ শ্রবণ করছে চঞ্চলা, কেননা বাধা দেওয়া বৃথা, কেননা বাধা পেলে কবির খান আরাে উদ্বেলিত হয়ে উঠবে—ঠিক সেই সময় কক্ষের ভিতরে প্রবেশ করে ভাস্কর। দীর্ঘ, বলশালী, সুষম শরীর সে নিজেই এক ব্রোঞ্জ ও পাথরের গড়া ভাস্কর্যে তুল্য। | কক্ষমধ্যে প্রবেশ করেই সে কবিকণ্ঠ নিহত স্তব শুনতে পেল। হাস্যমুখে সে তাকে শায় দ্যায়—ঠিক বলেছ, কবি। প্রকৃত কবিদৃষ্টি আছে তােমার। আমি ক-দিন থেকে ভাবছিলাম চলাকে মডেল করে ছিনাসের একটি মুক্তি রচনা কৰা যায় কিনা। এখন নিশ্চিত হলাম । দ্বিধামুক্ত এখন কাজে নেমে যাব। কবির অনুমােদন পাওয়া গেছে অজ্ঞাতসারেই।

=বাহ। চমৎকার। ককনঝংকারে চঞ্চলা সৃনিত কণিত হয়ে উঠল—শুড়ির সাক্ষী মাতাল এসে গেছে।

ভাস্কর আরাম করে বসে একটি কেদারায়। কানেও নেয় না চলার কথা। বলে—আমি আগামীকাল থেকেই কাজ শুরু করতে চাই। কাল কি তােমার সময় হবে, চঞ্চল? অাসতে পারবে অামার আলয়ে?

—উহ! তর সইছে না আর কারাে! চঞ্চলা কটাক্ষ হানে। এই সময় চিত্রকর, গায়ক, বক, বায়ী প্রভুতির একটি দল এসে উপস্থিত হয়। এদের মধ্যে বাগ্মী বয়স্ক, তার একমাথা শ্বেতশুভ্র চুলশাদা। পতাকার মতাে উডীন, কিন্তু তার মুখাবয়ব তারুণ্যে প্রদীপ্ত। আর দীর্ঘ কৃশকায় নবযুবকটি গায়ক, এই আসরে সে-ই সবচেয়ে অল্পবয়স্ক,—চঞ্চলার পূহে আজই সে প্রথম এল। অন্যের চঞ্চলার পুরহিন প্রণয়ী ও উমেদার। এরা সব এক অসির থেকে একসঙ্গে এখানে চলে এসেছে।

সায়ণ বিনিময় পর সবাই উপবেশন করল। চঞ্চলা ভিতরে গেল একটুক্ষণের জন্য। চঞ্চলার উদ্দেশে তার স্তব ব্যাহত হওয়ায়, এবং একটু বেশি ভিড় হয়ে যাওয়ায়, কবি ভিতরে ভিতরে বেশ বু হয়ে পড়ে। বেচারা নবীন যুবা গায়কটি তার ব্যঙ্গ্যাণের লক্ষ্য হয়ে ওঠে।

চুলা ফিরে আসে একটু পরে। তার পিছু পিছু কয়েকজন দাস-দাসী প্রচুর সুখাদ্য ওঁ সুরা নিয়ে আসে।

তারপর ঢলে পান, ভােজন, হাস্যরসালাপ । চঞ্চলার কণ্ঠে গীত হয় মধুস্রাবী। একটি গান । এইসব যখন চলছে, তখন একজন দাস এসে সংবাদ দ্যায়, কে একজন বার্তাবাহক দেখা করতে চাচ্ছে।

—বার্তাটি নিয়ে এলে হয়। কেউ একজন বলল। দাস উত্তর প্যায়-না, তিনি নিজের হাতে পেলেন, বললেন। কবিই বলে—এখানে আসতে বলাে তাকে।

কিছুক্ষণ পরেই দাসের সঙ্গে বার্তাবাহকটি এসে উপস্থিত হয় উৎকণ্ঠিত সবার সম্মুখে। অভিবাদন করে সে একটি পত্র চুলার হাতে অর্পণ করে। পত্রটি পাঠ করতে করতে চঞ্চলার মুর্ণ প্রথমে রক্তিম পরে শালা হয়ে যায়। কবি দ্রুত সেটি নিজের হাতে গ্রহণ করে। তারপর বার্তাবাহকের দিকে ফিরে তাকালে সে অভিবাদন করে প্রস্থান করে। | পত্রটি পাঠ করে কবি পার হয়ে যায়। তারপর গম্ভীর অথচ উজিত কণ্ঠে কিন্তু যথাসম্ভব আত্মসংবরণ করে বলে এখানে যারা উপস্থিত আছেন, তারা সবাই ট্রলার ঘনিষ্ঠ। তাই এটি চঞ্চলার প্রতি একটি ব্যক্তিগত পত্র হলেও ‘আমরা সবাই এর অংশভাপী। সেজন্যেই আমি এর সারাৎসার আপনাদের জানাতে চাই। তারপর আমাদের যুকির্তব্য হির করতে হবে। পটি এসেছে আমাদের বিচারসভা থেকে। এতে বলা হয়েছে, চঞ্চলা এই নগরের পুরুষদের বিপথগামী করছে, তাদের চরিত্র নষ্ট করছে, এজন্যে নগরের গৃহবধূরা বােধ করছে বিপন্ন, এবং তার মহান বিচারকন্দের কাছে অভিযােগ পেশ করছে এর বিহিত করার জন্যে। নগরের বিচারসভা এই বিচারের ভার গ্রহণ করেছে। তদনুযায়ী চলাকে আগামীকাল বিচারসভায় উপস্থিত থাকতে হবে। প্রধান বিচারপতির স্বাক্ষরে এই পত্র প্রেরিত হয়েছে।

এই বিবরণ শুনে প্রত্যেকের মুখ ব্যথিত, ক্লিষ্ট ও ব্রাসিত হয়ে উঠল। বিচারসভার আহ্বানের অর্থ কি, সবাই জানে। নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ড, অথবা নির্বাসন, অথবা অনুরূপ কোনাে কঠিন শাস্তি। মুহুর্তে সমস্ত আনন্দ ও আলাে নির্বাপিত হয়ে সারা ঘরে নেমে এল হিম নীরবতা।

নীরবতা ভঙ্গ করে চঞ্চলাই প্রথম কথা বলল। বলল—এ কার কীর্তি আমি জানি।

—কার? একসঙ্গে টীংকার করে উঠল সকলে।

-এ সেই রাজপুরুষের কীর্তি যাকে আপনারা চেনেন, যিনি এখানে আসেন, কিন্তু দিনের পর দিন মাসের পর মাস বছরের পর বছর আমার প্রণয় প্রার্থনা করেও

তিনি ব্যর্থকাম হয়েছেন। তাই তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে এই কর্ম করেছেন। গৃহবধূরা জানেন তাদের অনেকের স্বামী আমার কাছে এসে থাকেন, কিন্তু আমিই তো নই একমাত্র নাররমণী, এই নগরে আলো শত সহস্র বারমণী আছে আর বিদূষী গুণী বাররমণীদের সান্নিধ্যে আসা পুরুষদের জন্যে যে অপরাধ নয় বরং একটি প্রচলিত নিয়ম তা তারা জানেন। সুতরাং, আসলে গৃহবধূরা দায়ী নন। এই ঘটনার জন্যে দায়ী সেই আমার প্রণয়-প্রত্যাখ্যাত রাজপুটি।ঞ্চলা থেমে থেমে কথা ক-টি উচ্চারণ করে।

ভাস্কর এইখানে বাক্য যোজনা করে। বলে—আমি তােমাকে একটি প্রশ্ন করি, চঞ্চলা। প্রতিদিন কেউ-না-কেউ তো তোমার সঙ্গ পছই, দীর্ঘদিন ধরে তোমার প্রণয়প্রার্থী এই রাজপুরুষটি তাহলে কি অপরাধ করল যে, তুমি তাকে একদিনের জন্যেও কৃপা করলে না? | রোষে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল চঞ্চলা—রাজপুরুষ সমাজজীবনে প্রতিষ্ঠিত, সন্দেহ নেই। কিন্তু একজন পুরুষের কাছে নারী কী আকাক্ষা করে? তার ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিই হচ্ছে পুরুষের সেই আকর্ষণ যাকে নারী অগ্রাহ্য করতে পারে না। রাজপুরুষকে আমার মনে হয়েছে দীনাতিদীন, ভিখারীর চেয়েও ভিখারী। অল্পতম পরিচয়েই আমি অনেক সময় অত্বিলান করেছি, কিন্তু কখনাে কোনাে ব্যক্তিত্বহীন ভিখারীর কাছে নয়।

-সে তােমার প্রেমে পড়ে ভিখারী—বলতে গেল ভাস্ক, জিন্ন তাকে থামিয়ে কবি বলল এখন সে-সব আলােচনা অপ্রয়ােজনীয়। এখন আমাদের একমাত্র আলােচ্য হওয়া উচিত কোনাে বস্ত্র আছে কিনা যার ভিতর থেকে বাঁচিয়ে আনা যায় চঞ্চলাকে। আপনারা তাে জানেন এই বিচারসভা কী ভয়ংকর বিচারককে কিঞ্চিৎ প্রভাবিত করা যায় কিনা সেই চিন্তাই হবে আমাদের।

ভাস্কর বলল—বাগী তো আছেন এখানেই, হয়তাে তিনি তার অসামান্য ভাষণের দ্বারা | আত্মপ্রসঙ্গ ওঠায় বাগী ঈষৎ হাস্য করে। ‘জান্ন হাসসা বিষর্ণ রুদ্ধশ্বাস পরিবেশ একটু হালকা হয়। তারপর বাগ্নী সহাস্যেই বলে—রাজপুরুষ সম্বন্ধে যে-সব অভিযোগ করলেন মহামান্যী চঞ্চলা তার সবগুলাে ‘আমাতেও বয়, বোধ হয় সেই দোষে আমিও হয়ে আছি ভিখারীর চেয়েও ভিখারী । উপরুন্তু আমার অপরাধ আরএকটু বেশি। আমার কেশ সমুদ্রের ফেনার মতাে শ্বেত। এবং সেজন্যেই ঢথলার মতাে অসামান্য নারীর কাছে আমি আসছি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর—এবং আছি উপবাসী।

বাগীর বাক্যধারা শুনে চঞ্চলাও এত কষ্টের ও চিন্তার মধ্যেও হেসে ফ্যালে।

কবি বলে—আজো আমার ভাগ্য কৃপণ। তা হােক, বাপী মহােদয়, কেবল রতিরণে নয়, প্রকাশ্য যুদ্ধেও জেতা চাই।

আসর আর জমে না। বাগী মহােদয় বাদে আর-সবাই বিগ্ন মুখে প্রস্থান করে। নবীন গায়ক এম্নিতেই কবি-কর্তৃক যথেষ্ট অপমানিত হয়েছিল। তারপর তার প্রথম অগমনের দিনই এরকম একটি অশুভ সংবাদ। মনে মনে সে আর দ্বিতীয়বার

এখানে আসবে না বলে প্রতিজ্ঞা করে। ভাস্কর ভাবছিল, চঞ্চলার একটি প্রতিমূর্তি রচনার যে-আকাঙ্ক্ষা ছিল তার, তা আর বুকি পূর্ণ হলাে না। কবি ভাবল, শেষ পর্যন্ত কি হয় দেখাই যাক। একটা কি অলোকৰ কিছু ঘটতে পারে না!

মৃত্যুদণ্ডই হতে যাচ্ছিল চঞ্চলার। একেবারে শেষ মুহূর্তে প্রায় অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছে বাশ্মীর বুদ্ধিতে। শেষ বিচারের দিন, যখন সমস্ত বিচারক সমাসীন, বাগ্মী হঠাৎ এগিয়ে এসে একটানে খুলে ফ্যালে চঞ্চলার পোশাক। আর মুহুর্তে উন্মোচিত হয়ে যায় অসামান্য এক শরীর=প্রাচীন নগরীর কারুকার্যখচিত এক মুখমণ্ডল, নিশীথের অন্ধকারে রচিত কেশদাম, দীঘল শুভম্বী শরীর, নিটোল পরিপূর্ণ কোমল কঠিন স্তন ও শ্রোণী। একমুহূর্ত নিস্তব্ধ থেকে সমস্ত বিচারক একবাক্যে রায় সেন; “না, অলৌকিক এই শরীরে কোনো পপি থাকতে পারে না।’

চঞ্চলার গৃহ আজ আবার উৎসাৰে উতল হয়ে উঠেছে। মুক্তির উৎসব। যেখানে তার অবধারিত মৃত্যু হতে যাচ্ছিল, সে যে জীবিত ফিরে এসেছে, এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কী হতে পারে! বাগীর অদ্ভুত প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে চঞ্চলা সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে। বসন নির্মোচনের পর চঞ্চলার অমূল নগ্ন শরীর দেখে বিচারকবৃন্দের বিস্ময়ের অবধি ছিল না। ঘটনার আকস্মিকতায়, অলৌকিক শরীরের মহিমা দেখে বিচারকবৃন্দ প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন, এরপরই যেন একটি রুদ্ধ প্রস্তর ঠেলে সরিয়ে উচ্ছ্বসিত বেরিয়ে এসেছিল প্রশংসায় প্রবল স্রোতধারা। বিচারকবৃন্দ বিমুগ্ধ বিস্ময়ে একবাক্যে বলেছেন, এ শরীরকে কোনাে পাপ স্পর্শ করতে পারে না, এ ঈশ্বরের আশীর্বাদ, এ দেবীর সাক্ষাৎ মর্তপ । যেঈশ্বর এই শরীর সৃষ্টি করেছেন, তার কাছেও কৃতজ্ঞ থাকতে হয়। এ এক নিসপ্রতিমা, স্বয়ং ঈশ্বরী। নগরের সর্বত্র—সমস্ত গৃহে, বিপণিতে, ময়দানে, পথচত্বরে, কুঞ্জে পানশালায়, বিনােদনকেন্দ্রগুলোতে আজ আলােচ্য কেবল একটি অলৌকিক নগ্ন নারীশরীর, একটি মানুষী, চঞ্চল। নগৰৱময় চঞ্চলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ বাতিল হওয়ার সংবাদ রত্র হয়েছে, আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রূপকথার মতাে। একটি ঘটনা। চঞ্চলা হয়ে উঠেছে রূপকথার কেশবতী কন্যা, চন্দ্রমালামানিকমালার মতাে এক স্বপ্নসব নায়িকা। চঞ্জলাকে যারা দ্যাখেনি, তাদের আগ্রহ অসীম স্পর্শ করেছে। চঞ্চলাকে যারা দেখেছে, তারা নিজেদের মনে করছে ভাগ্যবান। সমস্ত নগরবাসীর মধ্যে একটি পুলকের জানা ও সিরাপ প্রবাহিত হচ্ছে। এই সুযােগে চরিতার্থ হচ্ছে বাণীরও ভূমিকা। তার প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের প্রশংসায় লােকে পঞ্চমুখ।

স্বতন্ত্র একটি গাহস্থ্য উৎসবের মতাে অনুষ্ঠান উদযাপিত হচ্ছে অভা চঞ্চলার হে। চুলার নির্বাচিত অতিদ্বনিত ভক্তমণ্ডলীর মধ্যে। প্রথমে মনে হয়েছিল, চলা-ঘটিত এই সমস্যার পরে খানিকটা সতর্ক হবে না কি তারা? পরে মনে হয়েছে, ভয় কী? স্বয়ং বিচারকবৃন্দই শেষ পর্যন্ত রায় দিয়েছেন চঞ্চলার পক্ষে। সুতরাং নিবিয়ে আনন্দ উদ্যাপিত হােক।

চঞ্চলার গৃহে হলেও আজকের অনুষ্ঠানের আয়ােজক এই নগরের একজন বিখ্যাত বণিক—তিনি চঞ্চলার করুণীধন্য। আজই প্রাচ্য থেকে বিচিত্রবিধ বিরল ও মহার্ঘ জিনিশপত্র সমেত তার একটি জাহাঙ্ক এসে ভিড়েছে নগরপ্রান্ত সমুদ্রে। আনন্দিত তিনি এই উৎসবের আয়ােজন করেছেন। চলার ছােট্ট সুন্দর ভবনের প্রতিটি কক্ষ আজ বিচিত্রবর্ণ আলােকমালা ও পুষ্পসজ্জায় দীপ্যমান। কক্ষে কক্ষে সুরভি, সংগীত, সুরা, আলােক, পুষ্প ও আনন্দধানির তরঙ্গ প্রবাহিত হচ্ছে। গৃহস্বামিনীর এই আনন্দ উৎসবে দাসদাসীরাও শরিক হওয়ার জন্যে সজ্জিত হয়েছে চারু সাপােষাকে।

ভবনের বৃহৎ কক্ষে আজ সমবেত হয়েছে চঞ্চলায় অতি ঘনিরাে-বাগী, ভাস্কর, চিত্রকর, কবি, নাট্যকার, গায়ক, বদিক প্রমুখ। বাগ্মীর অভিনব কৌশল। প্রয়ােগের প্রশংসা হচ্ছে। তিনিও সবিস্তারে জানাচ্ছেন, কী অবস্থায় কীভাবে তিনি ঐ কৌশল প্রয়ােগ করেছিলেন, এবং বিচারকবৃন্দের দৃষ্টি ও প্রতিক্রিয়ার অনুশৃঙ্গ বিবরণ। চঞ্চলার কাছে পূর্বাহ্নে বাগ্মী তার কূট অভিপ্রায় ব্যক্ত করেননি, কেবল তাকে কোনাে অন্তর্বাস না-পরে আসতে বলেছিলেন—যাতে একটানে পােশাক খুলে ফেলে তাকে নগ্ন করে ফেলা যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় চঞ্চলাও হতচকিত হয়ে পড়েছিল, এবং তার লজ্জাকরুণ মুখ লুকিয়েছিল দুহাতের পাতার আড়ালে। হয়তো লজ্জাই তার শরীরের শুরুভার, ক্ষীণতা ও বঙ্কিমায় এমন লাবণ্য সঞ্চার করেছিল যাতে অভিভূত হয়েছিলেন বিচারকবৃন্দ। আজ এখানেও, চালার ভবনে তার রূপের সুতি চলছে। বাররমণীদের মধ্যে চঞ্চলা যে শ্রেষ্ঠা এবং তুলনাহীনা, তা কি প্রমাণিত হয়নি? বৃথাই গৃহবধূলের ঈর্ষা, বৃথাই অন্য অন্য বাররমণীদের সন্ধ হওয়া, প্রেমপ্রত্যাখ্যাত রাজপুরুষের ক্রোধও ব্যর্থ হলাে। একপর্যায়ে অভিযােগকারী রাজপুরুষকে নিয়ে ব্যঙ্গ-পি হাসি-মশকরার অজস্র বাণ বর্ষিত হয়।

বিজয়িনী চঞ্চলার জন্যে প্রত্যেকেই তার ব্যক্তিগত প্রীতির অর্থ নিয়ে এসেছে। বেচারা উরুণ গায়ক প্রতিজ্ঞা করেছিল যে চঞ্চলার “হে আর কখনাে আসবে না। কিন্তু এরকম আনন্দ-উৎসবের দিনে কি না এসে পারা যায়? সে একগুচ্ছ দুর্লভ জাতের গােলাপ নিয়ে এসেছে। চঞ্চলার জন্যে কবি আজই কোন ফাকে যেন রচনা করেছে একটি চন্দ্রকরােজ্জ্বল কবিতা। সমবেত হর্ষধ্বনির মধ্যে কবি তার কবিতাটি মন্দ্রকণ্ঠ পাঠ করে শােনায়। সকলের মন স্পর্শ করে, সকলের আনন্দ যেন কবিকণ্ঠে উচ্চারণ খুঁজে পেয়েছে। ভাস্কর ঘােষণা করে, সমস্ত কর্ম বাদ দিয়ে সে যতদিন লাগে চলার এই অসাধারণ শরীর-সম্পদের একটি অনুকল্প রচনা করবে। শরীরের মৃত্যু তাে একদিন হবেই, জরা ও বার্ধক্য তাে একদিন শরীরকে আক্রমণ করবেই, কিন্তু এই শরীরের একটি ছাচ চিরকালের মানুষের অনিন্দ বর্ধনের জন্যে রেখে যাওয়া চাই। তারপর সুললিত কণ্ঠে চঞ্চলা একটি সংগীত নিবেদন করে-সেই সংগীতের মর্ম শুধু আনন্দ, আনন্দ, আনন্দনিন্দিত আকাশ। আর যতক্ষণ গান চলতে থাকে, ততক্ষণে চিত্র চঞ্চলার একটি গীতরত ছবি ‘অংকন করে চলে, এবং পীত সমাপ্ত হলে সেটি সমর্পণ করে চঞ্চলাকে| চঞ্চলা সবাইকে দেখায় ছবিটি। সবিস্ময়ে সকলে দ্যাখে, চিত্রে অবিকল রূপায়িত হয়েছে সংগীতরত চঞ্চলার মুখশ্রী ও দেহভঙ্গিমা। ‘তারপর সকলের অনুরােধে, কবি যতক্ষণ না তাকে অনুরােধ করে ততক্ষণ অপেক্ষা করছিল, তরুণ গায়ক গান করে। তার কণ্ঠস্বর গম্ভীর ও সুশ্রাব্য। তারপর চঞ্চলা একটি নৃত্য পরিবেশন করে—এই নৃত্যের বিষয় খাচা থেকে ছাড়া পাওয়া একটি পাখির ফুরফুরে মুক্তি ও আনন্দ। বাগী তখন অসম্ভব সরস কয়েকটি গল্প পরিবেশন করে=সকলের হাসরােল রাত্রির সুনীল আকাশে রঙিন ফানুশের মতাে উড়ে যেতে থাকে। রাত্রি যত অধিক হতে থাকে নগরের কোলাহল যত নির্বাপিত হতে থাকে, ততই এই গৃহের আনন্দ যেন হতে থাকে বর্ধিত। সব শেষে, আজকের অনুষ্ঠানের মূল আয়ােজক বণিকশ্রেষ্ঠের প্রস্তাবে, এবং সকলের সানন্দ সমর্থনে, চঞ্চলা একটি সম্পূর্ণ বিবসন নৃত্য পরিবেশন করে। সকলের প্রস্তাব ও অনুরোধকেও ছাড়িয়ে যায় চঞ্চলার নিজস্ব বুদ্ধিমতী যােজনা—বিবসন হয়ে সে উপস্থিত হয় ঠিকই, কিন্তু সালংকারা। তার মস্তুকে, কর্ণে, কঠে, বাহুতে হস্তে, কটিতে, জঘনে, পায়ে অলংকাররাশি স্থির হয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপরই তার বাহুর বিক্ষেপ, ভাঘনের আন্দোলনে, পদক্ষেপের তালে যেন কক্ষের ভিতরে স্বর্গের হিল্লোল একের পর এক স্পন্দিত হয়ে যায়। চঞ্চলার শরীর হয়ে ওঠে একটি সংগীত, সেই নৃত্যে কমি যেন স্বয়ং প্রমূর্ত হয়ে পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের একটি ইন্দ্রধনু জ্বেলে দ্যায়।

নৃত্যলেমে দ্রুত ভিতরে অন্তর্হিত হয় চঞ্চলা। এবং অনেকক্ষণ ফেলে না। চঞ্চলার প্রস্থানের পরেও কিছুক্ষণ সবার কাটে নির্বাক এবং রুদ্ধশ্বাস। তারপরই আবার শুরু হয় বাক্যালাপ।

কবি কেবল কাব্যলােকেই অধিষ্ঠান করে না, দেখা যায় তার মাথা খেলে। অচিন্তনীয় সব দিকে দিকে। হঠাৎ সে বলে—আচ্ছা, আজ তাে সমস্ত নগর একটি আলােচনাতেই শুধু মুখরিত-চুম্বালরি। আমরা এখানে যারা সম্যকভাবে উপস্থিত তারা তাে বটেই, এমনকি মহান বিচারকবৃন্দ, এমনকি সাধারণ নগরবাসী পর্যন্ত সবাই চুলাতে মুখ, নিবেদিত, সর্বসমর্পিত। এখন বলুন তাে দেখি, এই নগরেই এমন কে আছে, যাকে এসব অনিন্দ ও উত্তেজনা কিছুমাত্র স্পর্শ করছে না? যিনি আজ বিচারসভাতে’ যাননি, আসেননি এখানেও, এবং, চঞ্চলার উপস্থিতি যাকে কিছুমাত্র চঞ্চল করে না, এমন কে আছেন?

জানা ছিল সকলেরই, কিন্তু প্রসঙ্গটা কেউ ভেবেই দ্যাখেনি, এখন প্রসঙ্গ তোলা মাত্র তার কথা মনে পড়ল। তাছাড়া কবির বাক্যের যেন একটি নিটোল ধাঁধার অপরূপ সুরাহা করছে এনি কলরােল করে বলে উঠল-দার্শনিক! দার্শনিক মহোদয়।

—ঠিক বলেছেন। কবিও সহর্ষে বলে।এখন বলুন এই যে অরসিক দার্শনিক, একি সেই প্রস্তরের তুল্য নয় যে হাজার বছর ঝর্নাজলে স্নাত হয়েও একফোঁটা রস পেল না?’

চিত্রকর বলল—তা তাে বটেই।

-বেশ। সােৎসাহে বলে কবি=এখন বলুন, এটা কি অমানবিক নয় যে। সমস্ত নগরবাসী চঞ্চলার রূপে নিমজ্জিত হলাে, অথচ একজন হলাে বঞ্চিত?

বুঝলাম, বুঝলাম স্কর অধৈর্য। এত ভনিতা না-করে পরিষ্কার করে। বলুন তাে, কী বলতে চাচ্ছেন আপনি?

ঠিক। ঠিক সেখানেই এসে আমি পৌছেছি, যেখানে সােজা আমার প্রস্তাবটি পেশ করা যাবে। আমার প্রস্তাব আর কিছু না, একটি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই বলছি, আজকের এই অবিস্মরণীয় রাত্রেই বেচারা দার্শনিককে জীবনের মধুভাণ্ডের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হােক। অর্থাৎ চঞ্চলা আজ রাত্রেই তাঁর নৈঃশব্দ্য, গাম্ভীর্য, কৌমার্য এবং একাকিত্ব ভঙ্গ করবে। | অসম্ভব। প্রতিবাদ করে উঠল বাগী।—দার্শনিক মহােদয়কে টলানাে যাবে

একটুও। তিনি নির্বাকপ্রায় এবং আত্বস্থই থেকে যাবেন। আপনারা কি লক্ষ্য করেননি, এই নগরে কারাে সঙ্গে মিল নেই তার? যদিও তিনি এই নগরের অধিবাসী, আমাদের কি মনে হয় না তিনি এই নগরের নন? | -নগরে না হােন, নাগরিকদের হতে দেয় কী। কবি পরিহাস করে বলেসেটাই পরীক্ষা হােক রাত্রে। চঞ্চলার বিজয় সম্পূর্ণ হােক।

আর সেই মুহুর্তেই সুকেশিনী চঞ্চল পুনঃপ্রবেশ করে। কলরব করে ওঠে সবাই। চঞ্চলা বিস্মিত চক্ষে ও কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে=আবার কি হলাে? এত কলরব। হর্ষ। আলােমালা। সুরা। সুরভি।

নগরী প্রায় নীরব হয়ে এসেছে। শুধু এই বাড়িটি থেকে উখিত হচ্ছে কোলাহল। বাইরে, ঈশ্বরের পৃথিবীতে তখন নেমে এসেছে নীল নিস্তব্ধতা ও শ্বেত শান্তি। বাইরে, ঈশ্বরের নীলিমায় মেঘের ভিতর দিয়ে একটি মসৃণ সােনার তরী মতাে চন্দ্র ভেসে চলেছে।

এখন অনেক রাত্রি। শান্ত হয়ে রয়েছে বেদনা। নগরীর কিনারায় সমুদ্র নিথর হয়ে এসেছে। গম্ভীর হয়ে রয়েছে জাহাজ ও কালপুরুষ। | দার্শনিক মহোদয় একটু অনাধরনের। তিনি কোনো গ্রন্থ রচনা করেননি। কোনো দার্শনিক বক্তৃতাও তিনি করেন না। জনসমাজে তাকে কেউ কোনােদিন দ্যাখেনি। কদাচিৎ তিনি গৃহের বাইরে পদার্পণ করেন। দু-একটি উচ্চারণ তিনি করেছেন, দু-একটি কথা তিনি বলেছেন কারাে কারাে সঙ্গে। তাতেই রাষ্ট্র হয়ে গেছে তিনি একজন দার্শনিক।

এখন বাইরে জ্যোৎস্নারাত্রি, বাইরে মীলিমা ও নিস্তব্ধতা। কিন্তু প্রকৃতি দার্শনিককে একতিল আকর্ষণ করে না। ঘরের ভিতরে একটি প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত । তিনি স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন একটি দোয়ায় । চোখ বুজে ধ্যান হয়ে আছেন। এরকমভাবেই তার অধিকাংশ সময় কাটে।

এমন সময় বহির্বারে দ্রুত শব্দ শুনে চকিত হয়ে উঠলেন তিনি। দাসদাসীরা ড্রিাগত। এত রাত্রে কষ্ট করে উঠবে তারা? ভেবে তিনি অগ্রসর হয়ে এসে দুয়ার অবারিত করে দিলেন। আর, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাকে প্রায় ঠেলে এক সুন্দরী কক্ষের ভিতরে চলে এল।

দার্শনিক একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—কে তুমি? কি হয়েছে?

সুন্দরীর আননে ও শরীরে তখনাে ত্রাসের চিহ্ন। বলল—আমি এ পথ দিয়ে একটি স্থানে গৃহে ফিরছিলাম। এমন সময় কয়েকজন দত্ত আমাকে আক্রমণ করে। তাই আমি এত যান থেকে অবতরণ করে পালিয়ে এসেছি আপনার অশ্রয়ে। আমার নাম চঞ্চলা। আপনি আমাকে বাঁচান। | দার্শনিক চঞ্চলার পোশাকের দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। আস্বচ্ছ পোশাকে ঢঙ্কলরি শরীর প্রায় দৃশ্যমান। এই পোশাকে এত রাত্রে কি কেউ বাইরে বেরোয়?পার্শনিক ভাবলেন। আর চঞ্চলা ভবিল, এই তো, এই তাে তিনি আমার শরীরের দিকে তাকিয়ে আছেন, আমার স্বচ্ছ বসন ভেদ করে আমার শরীর। ঐশ্বর্য প্রায় সম্পূর্ণই তার কাছে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে আরাে ঐশ্বর্যের। এই তাে, এই তাে আমার দখলে, প্রস্ফুটিত পুষ্পে ভ্রমরের মতো তার চোখ লগ্ন হয়ে আছে আমার। শরীরে । দার্শনিকের বাড়ির সম্মুখের রাস্তার ওপারে পানশালায় কবি-দার্শনিক চিত্রকর-বাশ্মী-বণিলে অপেক্ষমান । সুরাপান করতে করতে তারা জল্পনা-কল্পনা করছে, কোন পরিণাম অপেক্ষা করে আছে তার। বিজয়িনী চঞ্চলা হয়তো একটু পরেই তাদের জানাবে, নগরীতে আর একটি পুরুষও নেই যে নয় তার রূপে মুগ্ধ, লােভাতুর ও নিমজ্জিত। | স্বচ্ছ বসনটিও একটানে খুলে ফেলল চঞ্চলা। তারপর আমূল নগ্নিকা চঞ্চল নিজেকেও উন্মোচিত করল । সৌরভের মতাে ক্রিান্ত হলাে তার কণ্ঠস্বর—দার্শনিক মহােদয়, আপনি আমাকে চেনেন না। আমি চঞ্চলা—এই নগরের বাৱৱমণীদের শ্রেষ্ঠা। আমার কটাক্ষপাতে শিহরিত হয় না এমন পুরুষ নেই এই নগরে, আমি তাদের স্বপ্নকল্পনালােকের রানি । এমন জ্যোৎক্সা ও আনন্দময় রজনীতে আপনি কেন, একাকী, বিমর্ষ ও চিন্তামগ্ন?—বলতে বলতে দার্শনিককে লঘু আলিঙ্গন করল চঞ্চলা।

দার্শনিক একখণ্ড শীতল নিস্তাপ রক্তহীন পাথরের মতাে দাঁড়িয়ে রইলেন।

একটু পরে ছিটকে বেরিয়ে এল চলা। দলিত কুদ্ধ সাপিনীর মতাে চীৎকার করে উঠল—আপনি আমাকে অপমান করছেন, আমার সৌন্দর্যকে অপমান করছেন। এই নগরে এমন কোনাে পুরুষ নেই যে আমার আলিঙ্গনের প্রত্যুরে আপনার মতাে অনড় ও নিস্তাপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। আপনি কেন জীবনের আনন্দ থেকে বঞ্চিত রাখবেন নিজেকে? কেন শরীরের আনন্দ থেকে বঞ্চিত থাকবেন? আমি কি আপনার যােগ্যা নই? আপনি কেন আমাকে অপমান করবেন?

তখনাে দার্শনিকের দৃষ্টি চলার আমূল নগ্ন শরীরে নিপতিত। দার্শনিকের দৃষ্টি দেখে চঞ্চলার এই প্রথম নিজেকে মনে হলাে নগ্ন। কিন্তু দার্শনিক তাে তাকিয়ে আছেন শুধু, তার শরীর তাে সাড়া দিচ্ছে না, আর তার কণ্ঠে কেন বাক্যশূন্য?

চঞ্চলা আবার উষ্ণ আলিঙ্গন করল দার্শনিককে। কাতর কণ্ঠে অনুনয় করল-আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না, দার্শনিক। বন্ধুদের কাছে আমার সম্মান তাহলে ধুলােয় লুটোৰে । দয়া করুন আপনি, দয়া করে দয়া করুন। আমি নারী আমাকে গ্রহণ ধন্য করুন। করে আপনি কি পাষাণ? ধিক আপনার মনুষ্যজন্মে! ধিক আপনার জনে!’

দার্শনিক চঞ্চলার কঠিন আলিঙ্গন ছাড়িয়ে সরে দাঁড়ালেন। তার কঠোর কণ্ঠ যথাসাধ্য বিনীত করে বললেন—চঞ্চলা, তুমি অধীর হােয়াে না। নগরের সমস্ত পুরুষই তাে তােমার রূপমুগ্ধ, একানই না হয় থাকল ছার বাইত্রে?

-কেন, কেন তা হবে? আমার সৌন্দর্যের চেয়ে আপনার বিষন্নতা কি বেশি মূল্যবান? আমার কি কোনাে নিজস্ব সাধ-আহলাদ নেই? অমিকে কি আপনি অন্য সব অশিক্ষিতা রুচিহীনা বাররমণীদের তুল্য জ্ঞান করেন? আমাকে কি আপনি মনে করছেন সাধারণ রূপজীবিনী? জানেন, আমার প্রণয়প্রার্থীদের মধ্যে আছে এই শহরের শ্রেষ্ঠ গুণীরা—কবি, ভাস্কর, চিত্রকর, গায়ক, বাদক, বাগী প্রমুখ। শুধু আপনি আমাকে তুচ্ছ জ্ঞান করলেন। ছি-ছি বৃথাই অামার নারীজন্ম!—যেন হাহাকার করে উঠল চঞ্চলা।

-না। তােমার দোষ নেই। দোষ আমার! কিন্তু আমি কি করব, চঞ্চলা? আমি তােমার অসামান্য সুন্দর শরীরের ভিতরের কঙ্কাল যে দেখতে পাচ্ছি। আমি কি করব? আমি কি করব? আমি নিরুপায়।

দার্শনিকের কম্পিত কণ্ঠস্বর শুনে তাকাল চঞ্চলা। দেখল, দার্শনিকের চোখ অশ্রুসজল।

[১৯৮২]

Please follow and like us:

Leave a Reply