এক বাটি আমানি খেয়ে লুৎফ্যা ভেবেছিল পেটের খান্ডব খানিক শান্ত হবে। মাটির ঠাণ্ডা মেঝেয় শুয়ে ভেবেছিল, পেটটাও বুঝি ঠাণ্ডা হয়ে প্রশান্তি আসবে। দুচোখে বেশ ঘুম নামবে। কাচালঙ্কা চটকে পেঁয়াজ দাতে কেটে দেখল তিনভাগ আমানিতে একভাগ ভাতও নেই। আধভাঙা একমুঠো ভাতের পচা রসে লঙ্কার জ্বলুনি আছে, নেশার মাদকতা নেই। আসলে একবার প্রস্রাব করতেই সব নেমে গেছে। এখন শুধু লঙ্কার ঝালের মতাে খিদে হু-হু করছে। পেট থেকে বুক অবদি ঠেলে উঠছে জ্বালা। কেবল বিষিয়ে উঠছে অনুভূতি।
নতুন পলির মতাে সদ্য আসা যৌবনের একটা নিজস্ব তাজা রং আছে। দেহে যখন সেই রঙের আভা দেখা যায়, তখনই যৌবনের শুরু। তখন মেয়েলি স্বাস্থ্যে একটা কেমন ভরাট হয়ে ওঠার লক্ষণ পরিস্ফুট হতে থাকে। এবং তখন সুস্থ যৌবন এই ভরাট হওয়ার তাড়নায় অন্তত পেট পুরে খাদ্যের দাবি জানায়। কিন্তু লুফার জীবনে এই এক বিষম অবস্থা। দেহের যৌবন শুধুমাত্র কখানা হাড়ের খাচা দিয়ে খাড়া থাকতে পারে না। ত্বকের পেলবতা অনেকখানিই মানুষের আপন হাতে তৈরি করা জিনিশ। যেমন তার ভাবীর স্বাস্থ্য, বিয়ের জল পড়তে না পড়তেই নিদারুণ লিকলিকে দেহে একটা আন্দোলন হয়ে গেল। ভালাে ভালাে খেয়েদেয়ে আয়েসে ঘুমিয়ে একটা পুষ্ট পালিশ লাগিয়ে একদম রানীর উপমা। | ভাবতে গিয়ে লুৎফার চোখে জল এসে পড়ে চৈত্রের এই টুটা ফুটা ধু-ধু দাহঝলসানোে দুপুরে। ঘুঘুর ডাকে এই পৃথিবীকে একলা মনে হয়, পৃথিবীর এত বড় দুঃখ আর বিষন্নতার গান কেউ গায় না। এই বিপন্ন সময়ে কেবলই বাপের বাড়ির কথা মনে পড়ে। কাত হয়ে শুয়ে থাকা লুৎফা কোমরের কাপড় আলগা করে উপুড় হয়ে যায়। মেঝের মাটিতে পেট চেপে ধরে। মনে মনে বলে—আমানি খেয়ে মানুষ বঁচে না বাপজি। চামড়ার খােলে সঁজাল জ্বলছে ভাইজান। আমারে বাচাও।
ঘরের চালের ওপর একটি নিম আর একটি কাঠালের ছায়া পড়ে আছে। ঘরের ভেতরে সেই ছায়া ঘরখানিকে মৃদু মােলায়েম অন্ধকারে জড়িয়ে রেখেছে। এই অন্ধকার বেশ ঠাণ্ডার আবেশ তােয়ের করে। সেই অন্ধকারে শুয়েছিল লুৎফা। বাইরে রােদের মধ্যে মাখামাখি দাপানাে উড়খুড় হাওয়া। সেদিকে চেয়ে দরজা দিয়ে দৃষ্টি প্রসারিত হয়ে উঠোনে ভেসে বেড়াচ্ছে। উঠোনে এসে দাড়াল পাশের বাড়ির লখাই। খাইয়ের বয়স এগারাে পেরিয়েছে গত অঘ্রানে। রােগাভােগা স্বাস্থ্য হলে কি হয়, মুখের আদলে পাকা দুষ্টুমির ছাপ। পরেছে পাছায় পটিমারা ইজের প্যান্ট। হাটুতে শুকনাে ঘা! পায়ে ধুলাের গুঁড়াে। এলােমেলাে চুল। প্যান্টের পকেটে খুদ ভাজা নিয়ে খেতে খেতে উঠোনে এসে দাড়াল। লখাই মানে লখিন্দর। আতুড় ঘরেই সাপে কেটেছিল সেই শিশুবেলায়, কিন্তু তিনদিন ওঝা খেউড় গেয়ে বাচিয়ে দিয়েছিল, সেই থেকে ওর নাম হল লখিন্দর। অপভ্রংশ হল লখাই।
এই বয়সে কোনাে কোনাে ছেলের পাকা বুদ্ধির কারণে অস্পষ্ট যৌন অনুভূতি তৈরি হয়। অস্পষ্ট আর নির্বোধ। খুবই হ্যাংলা সেই অনুভূতি। এই রকম নিঃসঙ্গ দুপুরে লখাই মাঝে মাঝেই আসে। দুপুরে লুৎফার রােজই খিদে পায়। মানুষের খিদে, যুবতীর পেট খালি থাকা প্রখর খিদে একটা গোয়ার পশু। ছেলেবেলা থেকেই মােটামুটি সচ্ছল গেরস্ত চাষীর মেয়ে লুৎফার একটি মায়াবী যৌবনের সাধ ছিল। কিন্তু এই পশুবৃত্তে আটক-পড়া যৌবন মায়াবী আলােয় ভরে উঠতে পারল না। একটা আফশােস বইকী!
মানুষের শুনলে খারাপ লাগবে, লুৎফার সত্যিই কোনাে সুখ নেই। কোমরের কাপড় আলগা হয়ে গেছে। গায়ে জামা নেই। বুকে কাপড় নেই। বুক আর পেট দিয়ে মাটির শেতল স্বাদ শুষে নিচ্ছে সে। অদ্ভুত এই পরিবেশে লখাই এসেছে। রােজই আসে।
খুব কাছে এসে বসে। বুকের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দ্যাখে। নাভির গর্তে, পিঠের খাদে, ঠোটের লালিম কিনারায়। এমন কি নগ্ন জানু স্তম্ভের ওপর। পায়ের ওপর কাপড় সরে যায় লুৎফার। পুরােপুরি নগ্নতা নয়। বিস্ত হলেও কায়দা করে খানিক ঢেকে চেপে রাখতে হয়।
ওইসব নগ্ন ঠাইগুলােয় চেয়ে দেখতে লখাইয়ের মধ্যে অপার কৌতুহল। কিন্তু নিজের কিছু নগ্নতার গােপন প্রত্যঙ্গে একলা চেয়ে থেকে লুৎফার কষ্ট হয়। এখন, এই মুহূর্তে আবার সে আপন স্বাস্থ্যের দিকে চেয়ে দেখে বুঝল, যৌবনের সূচনাতেই হয়তাে একটা আমসি ভাব চলে আসছে। আপন বুকের সৌন্দর্যে একটি গােলাপ ফুটে ওঠার কথা। পরিপূর্ণ বৃত্তবেষ্টিত গােলাপ। পৃথিবীর একটি সুখী বিস্ময় রচনা হবে এই বুকের ঢিহিতে। হল না।
লুৎফার হৃদয় থেকে হাহাকার দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। খালি পেট থেকে উঠছে সেই শব্দ। উঠোনে দাড়িয়ে লখাই চারদিক দেখে নিচ্ছে। কেউ নেই। এ বাড়ির মরদটা মাঠে জন খাটতে গেছে। বিকালে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে ফিরবে। পকেট থেকে একমুঠো খুদ তুলে মুখে ফেলল লখিন্দর। আরাে দু-পা এগিয়ে এল। চটি বারান্দায় এসে বসল।
লুৎফা ওকে পরিপূর্ণ দেখতে পাচ্ছে না। আস্তে আস্তে সরে আসবে লখাই। লখাই ওইভাবেই আসে। কুণ্ঠিত লজ্জায় নিঃশব্দে। প্রথম দিনটিও ওইভাবে এসে ঘুমন্ত লুৎফার মাথার কাছে বসে ছিল। শরীরে ঘুম পেলেও মেয়েদের যৌবন ঘুমােয় না, কুকুরের একটি চোখ হয়ে নিজেকে পাহারা দেয়। লােকে কুকুর এক চোখে ঘুমােয়, এক চোখে জাগে। তাই হঠাৎ সেদিন লুফার ঘুমন্ত চোখ জেগে উঠল। বুকে কাপড় গুছিয়ে টেনে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল লুৎফা। লখাই সঙ্গে সঙ্গে বলল—তােমার জন্য দুফলা আম এনেছি ভাবী, তুমি খেতে চেয়েছিলে। লস্করদের বাগানে চুরি করেছি। লুৎফা লখাইয়ের চোখের দিকে | চেয়ে থেকে বুকের কাছে মুঠিতে ধরা কাপড়ের গােছা খানিক শিথিল করে দিল। কেন যেন লখাইকে তার তেমন লজ্জা হল না। সেই থেকে লখাই আসতে লাগল। লখাই লুঙ্কাকে কত কিছু এনে দেয়। নিজের ভাগ থেকে ভাগ দেয়। পেয়ারা, পাকা বহড়া। হালুয়া। ফুটি। জাম। প্রায় সব কিছু। তার বদলে সে লুফার পিঠের খাদ, চকিত বুকের কুসুম, ঠোটের অভিনীত উশখুশ মােহ দেখতে পায়। এইটুকু প্রশ্রয় না দিলে লখাই আজও তাকে খুদ ভাজা দেবে না। কোনােদিন লস্করদের বাগানের আম চুরি করে আনবে না। লুৎফা ডাকল লখাই, এদিকে আয়।
লখাই চুপি চুপি উঠে এসে শুয়ে থাকা ভাবীর বুকের কাছেই প্রায় বসে পড়ল। লুৎফা উপুড় হয়ে হাত পাতল—দে। একমুঠো খুদ হাতের তালুতে রাখল লখাই। লুৎফা মুঠি বাধল। মুখে পুরল। আবার হাত পাতল—দে।
লখাই আশ্চর্য হল। পকেটে আবার হাত ঢুকিয়ে টেনে বার করল অল্প ভাজা রুটি করবার খুদ। মা বেশি দেয় নি। তবু সে ভাবীর জন্য মনে করে এনেছে। এই এক মঠো দেবার পর লখাই প্যান্টের পকেটটা বাইরে থেকে মুঠিতে চেপে দেখাল এবং নিজেও দেখল, বেশি নেই। আর নিও না। মুখে সে লজ্জায় কোনাে কথা বলল না। লুফা কাত হয়ে ফের উপুড় হল। লখাই সেদিকে চেয়ে পকেটে হাত ঢুকিয়ে শেষ খুদটুকু তুলে আনল। লুৎফা হাত পেতেছে—দে । অল্প মৃদু মাথা নাড়ল সলজ্জ লখাই। মুখে ‘না’ বলতে পারে না। দে বলছি!
ধমক দিচ্ছে যেন লুৎফা । কেমন একটু ভয় পেয়ে গেছে লখাই।—এভাবে কেড়ে নিচ্ছ কেন? আমি কি তােমায় নিজে থেকেই দিই না?—এই সব নিঃশব্দ কথার অনুনয় মিশ্রিত অভিমান অভিযােগ চোখে জ্বলে উঠল লখাইয়ের। লখাই কোনাে কথা বলতে পারল না। অবশিষ্ট সবই লুৎফার হাতে ফেলে দিল। তুমি বড় নিষ্ঠুর ভাবী! লখাই যেন কেঁদে ফেলবে এই নিঃশব্দ উচ্চারণে।
লুৎফা দ্রুত খেয়ে ফেলল মৃদু তেতাে খুদ। প্রায় লাফিয়ে উঠে কলসির কাছে গিয়ে জল গড়িয়ে এক বাটি আমানির জল খেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লখাইয়ের দিকে চেয়ে ক্ষীণরেখায় মিষ্টি হাসি হেসে ফেলল। লখাইয়ের মুখ থমথম করছে। চোখ নামিয়ে সে নখ খুঁটছে।
মুহূর্তের কেমন এক আবেগে লুৎফা ছুটে এসে লখাইয়ের মুখখানা হাতের পাতায় টেনে তুলে একটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের টানা উষ্ণ চুমু খেয়ে লখাইকে চমকে তুলতেই লখাই নিঃশব্দে চোখে জল ঝরিয়ে ফেলল।
—এই তুই কাদছিস? লুৎফা বিমূঢ় হয়ে হাসতে চেষ্টা করল। লখাই কিছু না বলে এবারও খানিক বসে থেকে হাতের চেটোর উলটো পিঠে চোখের জল মুছে উঠে দাড়াল। লুৎফা ওর একটা হাত চেপে ধরেছিল, লখাই এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে এক লাফ মেরে ছুটে লুৎত্যার উঠোন ছেড়ে চলে গেল। বাড়িতে এসে দেখল তখন জাতায় খুদ পিষছে। এত বেলা হল, এখনাে রুটি বানানাে হয় নি। লখাইয়ের পেটেও ব্রহ্মাণ্ডের খিদে দাউ দাউ করছে। | ঠাণ্ড মেঝেয় গড়াতে লাগল ক্ষুধার্ত লুৎফা। সমস্ত শরীরে মেঝের ঠাণ্ডা ধুলাে মাখল। পিঠের খাদের পাড়ে, নাভির গর্তের গােল কিনারায়, বাহুতে, দারিদ্রের শাপে সামান্য মাথা হেঁট, স্তনের গরিমায়, দুঃখিত গােলাপের এলানাে বৃত্তে। তারপর উঠে বসে পেছনের চুলের গােছা সামনে মুখের ওপর ঝুলিয়ে মুখের ওপর সেই চুল ফেলে দিয়ে নিজেকে ভয়ঙ্করী করে কেমনধারা হেসে উঠল। | লুৎফা হাতের ফাস তুলে ঝুঁটি বাধল, তারপর বেরিয়ে পড়ল পাড়ায়। এ বাড়ির উঠোন পেরিয়ে ও বাড়ির কাঠা (বাড়ির পেছনদিক) দিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল। চেঁকিতে এই দুপুরে হলুদ গুড়াে করছে দুটি বউ। জাফরমুদি বড়লােক। মেয়ের বিয়ের হলুদ গুড়াে করছে দুই সতীনে। উঠোন পেরিয়ে লুফার ছায়া চলে যেতেই একজন মন্তব্য করল—যাচ্ছে! মায়ের কাছে। বাসি পান্তা যা পায় এক পেট মেরে দিয়ে আসবে।
অন্যজন বলল কমর আলি খেতে দেয় না কেনে, অমন ধিঙি বউকে রােজ রােজ বাপের কাছে পাঠায়?
—গরিবের শতেক জ্বালা, বুঝলে না? খাটে খায়। কাম না পেলেই উপােস। —আজ তাে কমর আমাদের বরজে কামে গেল।
—কিন্তু গতকাল ঠাই বসে সাতভাই পাখির নেও দেখেছে। চুলােয় বেড়াল ঘুমিয়েছে। পেট তাে মানবে না বহিন!
কথাগুলাে বেড়ার এপাশ থেকে শুনতে পায় লুৎফা। ঠোট উলটে না-পরােয়া করতে গিয়ে একটা অভিমানের সঙ্কুচিত ভাব ম্লান হয়ে ওঠে। হনহনিয়ে চলতে শুরু করে। গায়ের ঝাকুনিতে মাথার কেশপাশ খুলে গিয়ে একপিঠ চুলের প্রপাত লাফিয়ে নেচে দুলতে থাকে।
ঘুঘু ডাকা এলানাে দুপুরে গেরস্ত ঘরে সবারই ঘুমের মাদকতা। কারাে তন্দ্রা, কারাে গাঢ় ঘুম। লুৎফা উঠোনে দাড়িয়ে হঠাৎ কেমন বােবা হয়ে চারদিকে চোখ ঘােরায়। সব কেমন নিশ্ৰুপ। কারাে কোনাে সাড়া পায় না। বাঁশের সাকো পেরিয়ে খাল পেরিয়ে আসা। ভেবেছিল, হয়তাে এসময় হেঁশেলে খাওয়া-দাওয়া চলবে। হেঁশেলের সামনে মেয়েকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে মা ডাকবেন, আয় লুৎফা, দুমুঠো মুখে দে। আয় ভিতরে আয়। আহা, মেয়ের আমার কচি মুখখান তাপেভাপে একেবারে ঝলসে | গেছে গাে। নে ঠাণ্ডা হ। মুখ-হাতে পানি দে।
লুৎফা তখন বলবে—ড়াও আসছি। বলে প্রথমে বড় ভাইয়ের মার্গো সাবান, পদ্মিনী ধুপবাতি | সুগন্ধিত ঘরখানায় ঢুকবে। খাটে আলুলায়িত ভাবীর তন্দ্রাসুপ্ত শরীরে হাত রেখে মৃদু সম্বােধন—ভাবী।
ভাবী চোখ খুলবে। অবাক এবং খুশি হওয়ার ভান করবে। লুৎফা তখন বলবে—তােমার সাবানডা দাও তাে। মাখব।
ভাবী তাক দেখিয়ে ইঙ্গিত করবে—ওই কেসটাতেই যত্ন করে রেখাে। ভুল করে কলতলায় ফেলে | এসাে না, কাকে খেয়ে ফেলবে। লুৎফা মাথা নেড়ে হ্যা বলবে নিঃশব্দে। তারপর ছাতবিহীন বাথরুমে টিনের দরজা ঠেলে লাগিয়ে নাদায় তােলা ঢের জলে সাবান মাখবে অনেকক্ষণ। পরে ঘরে ঢুকে লক্ষ্মীবিলাস রগড়ে চুলে এবং মাথার ত্বকে ঘসে ঘসে নেবে। একটু পাওডার ছোঁয়াবে মুখে। হেঁশেলে ঢুকে হাঁড়ি থেকে ইচ্ছেমতাে আপন হাতে ভাত বেড়ে নেবে। আজ বােধ হয় ডেশী মুরগির ঝােল হয়েছে। লাল টকটকে রং। মােলায়েম করে ভাত মেখে গরাস তুলবে মুখে। ভাবীর সন্ধ্যামণি রঙের শাড়িখানা পরবে, দেয়ালে তারই উজ্জ্বল ছায়া নড়াচড়া করবে। সেই শাড়ি পরে খেয়েদেয়ে সে শান্ত হয়ে ভাবীর পাশে শুয়ে খাটে ঘুমােবে। তার আগে কানের ঝুমকোটাও টেবিলে খুলে রাখা দেখতে পেয়ে কানের ফুটোয় গুজে নেবে। ভাবীর ঝুমকোটা বেশ যেন ছন্দিত মনে হয়। এইভাবে না পরলে নাক কানের ফুটো বুজে যাওয়ার ভয় আছে। কিন্তু সে ঘুমােবে। ঘুমন্ত মুখের শান্ত নিরুদ্বেগ সৌন্দর্য সে আপন মনে দেখতে পাবে। এবং এখন ভয়ে নাক কানের ফুটো পরীক্ষা করল নারকেল গাছের পাতলা ছায়ায় দাড়িয়ে। খাচা থেকে ডিম পেড়ে কালাে মুরগিটা বেরিয়ে উঠোনে নেমে চিৎকার করতে লাগল। গলা ফাটিয়ে। কেউ তবু জেগে উঠল না। নাক কানের ফুটো এখনাে বুজে যায় নি। দেয়ালে পােতা আয়নার ভাঙা কাচে মুখ দেখছে লুফা। বিধবার মতাে করুণ দেখায় যুবতীর ছবি। কান্না পায়। উঠোনে দাড়িয়ে সত্যিই এখন কান্না পাচ্ছে, চিরল স্রোত বইছে কুল কুল করে বুকের অন্ধকার উৎসে। কান্না। অদ্ভুত কান্নার আবেগ এসে লুৎফাকে মােচড় দেয়। কেউ জেগে উঠল না।
জাফরমুদির বউ দুটির কটু কষাটে সংলাপ মনে পড়ে গেল। লুফার অভিমান হয় না বুঝি! লজ্জা করে না যেন! লজ্জা অভিমান সব হয়। এখন ওই মুরগিটার ওপরই সব রাগ। উঠোনে পড়ে থাকা ইটের চাকলা ছুঁড়ে মারে। বিড়বিড় করে গাল দেয়। মাগীর গব্ব দ্যাখ! একখানা ডিম পেড়ে ভাবছে রাজাউজির মেরেছে। ইটের ভয় পেয়ে ফড়ফড় করে টেকি ঘরের চালের ওপর দিয়ে মাগী আবার সঙ্গী খুঁজতে বার হল। নােংরা! নােংরা! ধান খায়। গম খায়। খন্দ খায়। যত খুশি ঠোট নেড়ে নেড়ে নােংরা ঘাটে। ছি! ভাবে লুৎফা, চাষীঘরে মুরগি হয়ে জন্মেও সুখ!
লুৎফা আর দাড়িয়ে থাকে না। বাড়ি চলে আসে ছুটতে ছুটতে। আসার সময় জানালার শিক ধরে অল্প-খােলা পাল্লায় চোখ রেখে দেখেছিল ভাবী বই পড়ছে শুয়ে শুয়ে। বইয়ের মলাটে জিঘাংসার চিত্র। হাতে-ছােরা একটা লােমশ মানুষ।
লুৎফা ঘরে এসে এলিয়ে শােয়। ঘুম আসে না। নাড়ি ডাকছে। বিকাল বেলায় কমর আলি ফিরে। আসে। মাথার মাথালটা দাওয়ার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে রাখে। বরজে বাহকে কলসিতে করে কুম (জলাশয়) থেকে জল তুলে টেনে পায়ে কাদা মেখে ফিরেছে। গায়ে মাটির ঘাম মেশানাে সেঁদো গন্ধ। লুৎফা ধড়ফড়িয়ে এলােমেলাে কাপড় ঠিক করে গায়ে জড়াতে না জড়াতে দাওয়ায় আসে। গন্ধ নাকে লাগে। এই গন্ধটা তার চেনা। নির্ভুল। কাদামাখা হােক, তবু এই তার স্বামী। প্রায় খেত মজুর (দেড় বিঘা জমির মালিক)। বােকা। অশিক্ষিত। গরিব। ক্লান্ত আর অবসন্ন। বলিষ্ঠ আর দুঃখী। স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে বড় মায়া হয়। কমর আলি ডােল নামিয়ে পাতকোয়ার জল তােলে। লুফা গামছায় জড়ানাে দুটি বুকফাটা ফুটি দেখতে পায়। আশ্চর্য হয়। মুখটা ভার হয়ে যায়। কমর আলি জল তােলে। টিনের টোলভাঙা ঘটিতে পায়ে জল ঢালে। উঠোনের কাপড়কাচা তক্তায় দাড়িয়ে, ইটে পা ঘসে কাদা ছাড়ায়। গম্ভীর হয়ে লুঙির আঁচলায় মুখ মােছে। দাওয়ায় এসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসতেই লুত্যা শুধায়— চাল আন নি?
স্ত্রীর মুখের দিকে কমর আলি অসহায় হয়ে চেয়ে দেখে এক পলক। চোখ ফিরিয়ে নেয়। লুৎফা ফের শুধােয়—আন নি?
না। জাফর বড্ড হারামি। মুনিশ খাটিয়ে দরমাহা (মজুরি বা বেতন) লিয়ে কচলানি করা স্বভাব। কাল দিবে বুল্লে, কে জানে কালও কচলাবে কিনা। দুখানা ফুটি মাগনা হাতে ধরিয়ে কেতাত্ত করে বুললে, যা। কাল কামে আসিস। | একটু থেমে কমর আলি ঠোট আর দাত চেপে মন্তব্য করল—শালা! চাল আনতে না পারার অক্ষমতায় কমর আলি দিশেহারার মতাে চুপ। কিন্তু কোনাে মতেই তার এই অসহায়তার দুঃখ বােধ থেকে নিষ্কৃতি নেই। সন্ধ্যা হল। কুপি জ্বলল। ফুটি কেটে থালার একপাশে চিনি বসিয়ে স্বামীর সামনে এগিয়ে দিল লুৎফা। ফুটি খেয়ে ঢকঢক করে পানি খেল কমর। পেটের তিনঅংশ জলে পূর্ণ এবং এক অংশে সামান্য ফটি। মেঝেয় শুয়ে দিগন্তে বিষন্ন চাদ দেখতে লাগল। লুৎফা কিছুই খেল না। ফুটি কোনাে খাদ্য নয়। বালিতে পয়দা, শুখা ফল। জলখাবারও হয় না। মানুষ সম্মান করে কটুমকৈও খেতে দিতে পারে না।
কমর আলির ঘুম জড়িয়ে আসছিল। বুকের ওমের মধ্যে বউকে পেতে ইচ্ছে করছিল। মিয়াননা গলায় কাঙালের মতাে বউকে নাম ধরে ডাকে। বউ একবার কেবল অস্পষ্ট শব্দ করল গলায়। আবার ডাকল কমর। আবার ডাকল। আবার। লুৎফা উত্তর দিল না। সব দিক থেকে তার অভিমান। সব দিকেই যেন সহানুভূতিহীন জীবন। খানিক বাদে কী মনে করে স্বামীর পাশে শুয়ে পড়ে।
স্বামী আঙুলের ডগায় কামনার ভাষা ফোটায় স্পর্শের শিল্প দিয়ে। লুৎফার দেহ বােবা। নিঃসাড়। পেটে আমানিও বাষ্প হয়ে গেছে। নাড়িতে খিদের অঙ্গার ছুটছে। পাশ থেকে স্বামীর নাড়ির ডাক শুনতে পায়। কার নাড়ি ডাকছে, নিজের নাকি বউয়ের বুঝতে পারে না। তন্দ্রায় আচ্ছন্নতায় বউ ফুটি খেল কিনা খোজ জানে না কমর। বউ যে অভিমানে খাচ্ছে না, তা সে জানবে কেমন করে? বুকের নগ্নতায় মােলায়েম করে এক তারার স্পর্শ দিতে গিয়ে অশিক্ষিত মানুষটির মনে হয় টানটা জুৎসই হচ্ছে না। আঙলের সবটাই নখ হয়ে উঠছে। স্পর্শ হয়ে উঠছে আঘাত।লুৎফা বেহুশ হয়ে যাচ্ছে। গােপন প্রত্যঙ্গ ছুঁয়ে মনে হল, লুৎফা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হল লুফা একটি লাশ ছাড়া কিছু নয়। সেই লাশটিকে সে যেন কাটছে।