কৃষ্ণবেণী – সায়ন্তনী পূততুন্ড

›› উপন্যাসের অংশ বিশেষ  

…..অর্থাৎ এটাই আমাদের সংস্কৃতি। এটাই আমাদের গর্ব। তায়ি আরও বলেছে—“আমরা সবাই এ বিষয়ে গর্বিত। আমাদের এটাই জীবন। আমাদের চেয়ে পবিত্র কেউ নেই। যে কোনও পুজো পার্বণে আমাদের ছাড়া চলে না, দেখিসনি?”……

……আর তারপর সেই একই ইতিহাস! সেই একই প্রথা! সেই অভিশপ্ত ‘পপাটুকাটু’! ঠিকমতন জ্ঞান হওয়ার আগেই এক কালাে কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গের সঙ্গে গণবিবাহে সামিল হওয়া। তারপর চিরদিনের জন্য প্রভুদাসী’, তথা ‘দেবদাসী’ হয়ে নিজের আর পরিবারের অন্ন সংস্থান করা! সে নিজে একজন প্রভুদাসী।…….

…..এবার সে ধরা পড়তে চায় না। অথচ আর হাঁটতেও পারছে না। একেই নিয়মমতন সকাল থেকে রাত অবধি একাধিক ‘ধনীর সেবা করতে হয়েছে তাকে। কিন্তু তাদের দেওয়া টাকা নিয়ে পালাতে পারেনি। কারণ সমস্ত টাকাই তায়ির কাছে। তার শরীর ক্লান্ত।…..

…..কৃষ্ণবেণী এখানকার নাম করা সুন্দরী। তার ওপর যােলাে বছরের প্রস্ফুটিত যুবতী। ফলস্বরূপ তার ঘরে ধনী বা শ্ৰীমন্তের আসা-যাওয়ার অভাব ছিল না। এমনকি পঞ্চায়েতপ্রধানেরও নেকনজরে ছিল কৃষ্ণবেণী। মাঝেমধ্যেই দিন নেই, রাত নেই—এসে হাজির হতেন নাগবল্পীর ডেরায়। নাগবল্পী বহুবার বলেছে—এরকম মাঝে মধ্যে এলে কি পােষায় শ্রীমন্ত? তার চেয়ে মেয়েটাকে কিনে নিয়ে যাও না। নিজের দাসী করে রাখাে সারাজীবনের জন্য।

পঞ্চায়েতপ্রধান একতাড়া কড়কড়ে নােট ধরিয়ে দিয়েছিলেন নাগবল্পীর হাতে-‘বউ ঝামেলা করবে রে।

‘বউয়ের সঙ্গে রাখবে কেন?’ নাগবল্লীর চটপট উত্তর-‘অন্য কোনও কোঠিতে রাখবে।’

মুখিয়া মৃদু হেসেছিলেন—ভেবে দেখি।’ বলেই ব্যস্ত হয়ে উঠে। ছিলেন—“কই রে? আল্লি কৃষ্ণাভেণী? কৃষ্ণবেণী কোথায়? তাড়াতাড়ি আসতে বল্। আমার আবার একটু তাড়া আছে।
নােটগুলাে হস্তগত করে চটুল ভঙ্গিতে বলে নাগবল্পী—‘আসছে। গা ধুতে গিয়েছে।

তার ইঙ্গিতপূর্ণ কথার মর্মার্থ বুঝেছিলেন মুখিয়া। আয়েশ করে শুয়ে পড়েছিলেন বিছানায়। নাগবল্লী দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। এখন মুখিয়ার তাকে প্রয়ােজন নেই। তার প্রয়ােজন মেটাবে কৃষ্ণবেণী। তার অঙ্কশায়িনী হয়ে সুন্দর সঙ্গমের মাধ্যমে সেবা করবে। পরিতৃপ্ত করবে ‘ধনী’কে।
কিন্তু কে জানত কৃষ্ণবেণীর মনের মধ্যে তলে তলে আবার জন্ম নিচ্ছিল বিদ্রোহ! প্রভুদাসীর জীবনের ওপর বীতশ্রদ্ধ ছিল সে। প্রায়ই ‘ধনী’র সঙ্গে সঙ্গমের পর সে বলত—‘আমার নিজেকে কেমন যেন ‘ভেস্যে মনে হয় তায়ি! নিজেকে বেশ্যা ছাড়া কিছু ভাবতে পারি না আমি!

‘ওরকম বলিস না!’ নাগবল্পী ধমকে ওঠে—“আমরা প্রভুদাসী। ধনীরা আমাদের প্রভু। তার প্রয়ােজন মেটানাে, তার সেবা করাই আমাদের ধর্ম। মানুষের সেবা করা, তাদের তৃপ্তি দেওয়াই আমাদের কাজ। এর চেয়ে পবিত্র কাজ দুনিয়ায় আর নেই।
‘তবে আমরা টাকা নিই কেন? এমনিই সেবা করলেই তাে পারি।
এ কথার কোনও উত্তর দিতে পারেনি নাগবল্লী। সে নিজেও একজন প্রভুদাসী। তার মা, ঠাকুমাও প্রভুদাসী ছিলেন। যুগ যুগ ধরে, বংশানুক্রমিক ভাবে এই প্রথা চলে আসছে। মায়ের মুখে গল্প শুনেছে যে আগে প্রভুদাসীদের কাজটা অন্যরকম ছিল। প্রভুদাসীদের বাসস্থান ছিল মন্দির। সেখানে দেবতাদের সামনে ওদের নাচতে গাইতে হত। রীতিমত তালিম দিয়ে ভরতনাট্যম শেখানাে হত প্রভুদাসী, তথা দেবদাসীদের। তার ঠাকুমা কর্ণাটকী সঙ্গীত, ভরতনাট্যমে পারদর্শী ছিলেন। এখনও অবশ্য প্রথা অনুযায়ী নাচ শিখতে হয় প্রভুদাসীদের। নাগবল্পী ও কৃষ্ণবেণী দু’জনেই ভরতনাট্যমে তালিম পেয়েছে।

তখন দেবতাদের পাশাপাশি সন্তুষ্ট করতে হত পুরােহিতদেরও। পুরােহিতরা মন্দিরের দেবদাসীদের ভােগ করতে পারতেন। তাদের কথাই শেষ কথা ছিল। ওঁদের ছাড়া অন্য কোনও পুরুষের দিকে তাকানাে ছিল ক্ষমাহীন অপরাধ! অন্য পুরুষের প্রতি অনুরক্ত হওয়ার মূল্য ছিল মৃত্যু। নাগবল্পীর মা মন্দিরের মুখ্য পুরােহিতের ঔরসজাত সন্তান!

কিন্তু ইংরেজ আমলে মন্দিরগুলাের রমরমা আর রইল না। পুরােহিতদের ক্ষমতা হ্রাস পেল। প্রভুদাসী প্রথা বিপন্ন হয়ে পড়ল। তবু লােকসমাজে তাদের গুরুত্ব ছিল। দেবতার স্ত্রী হওয়ার দরুণ সে ‘অখণ্ড সৌভাগ্যবতী’। অর্থাৎ চির সধবা। তাই যে কোনও বিয়ে বা অন্য অনুষ্ঠান প্রভুদাসীদের পবিত্র উপস্থিতি ছাড়া হতই না।

এরপর দেবদাসী প্রথা উঠে গেল। সরকার থেকে নিয়ম করে প্রভুদাসী প্রথা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হল। কিন্তু নাগবল্পীর মায়ের মতাে অনেক দাসী প্রত্যন্ত গ্রামগুলােয় কলােনি করে থেকেই গেল। সারি সারি পরিচ্ছন্ন মাটির বাড়ি তৈরি করে কলােনি বানিয়ে তারা সেখানেই বসবাস করে। তবে নিয়মটা অনেক পরিবর্তিত হল। আগে প্রভুদাসী ছিল মন্দিরের সম্পত্তি। এখন হয়ে দাঁড়াল ‘ধনীদের সম্পত্তি। প্রভুদাসীদের উত্তরাধিকার তাদের কন্যা সন্তানের ওপর বর্তায়। তাই কখনই তারা পুত্র সন্তানের আকাঙ্ক্ষা করে না। পুত্র সন্তান তাদের চক্ষুশূল! কন্যা সন্তান হলেই তাদের জীবন সার্থক। কারণ ঐ শিশু কন্যাই এরপর সংসারের দায়িত্ব নেবে। যতদিন না মেয়ে একটু বড় হচ্ছে, তার পােট্টকাট্ট হচ্ছে, ততদিন সংসার, অন্ন সংস্থানের দায়িত্ব তার মায়ের। মেয়েদের ছয়-সাত বছরেই শিবলিঙ্গের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। পােট্টকাটুর পর থেকেই প্রভুদাসীদের রােজগারে নেমে পড়তে হয়। শিশুকন্যা যে মুহূর্তে জীবিকায় নেমে পড়ে, সেই মুহূর্তেই তার মায়ের ছুটি। এবার সে মেয়ের রোজগারে বাঁচবে।
প্রথমে শিশু প্রভুদাসীরা সারাদিন ভিক্ষা করে বেড়ায়। প্রভুদাসীকে ভিক্ষা দেওয়া অত্যন্ত পবিত্র কাজ। তাই কোনও মানুষই তাকে ফেরায় না। সেই ভিক্ষার অর্থ খানিকটা মন্দিরকে দিতে হয়। বাকিটায় প্রথমে ‘ইয়েল্লাম্মা’কে ভােগ চড়াতে হয়। তারপরে চলে প্রভুদাসীদের সংসার।
এরপর শিশুকন্যা যখন কিশােরী হয়ে ওঠে এবং রজঃদর্শন করে, তখনই প্রভুদাসীর আসল কাজ শুরু হয়। ধনীরা এসে পায়ের ধুলাে দেয় তার ঘরে। তার সঙ্গে সঙ্গম করে, এবং পরিতৃপ্তির সঙ্গে অর্থ দিয়ে যায়, যে ‘ধন’ দেবে, সে-ই ‘ধনী’। নাম-ধাম জানার দরকার নেই। বাচ্চা-বুড়াে, জাত-পাতের কোনও বালাই নেই। সবার জন্যই তার দ্বার অবারিত। ধনীকে তুষ্ট করাই প্রভুদাসীর কর্তব্য। তার নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দের কোনও জায়গা নেই। ধনী চাইলে একটা মােটা টাকা দিয়ে দাসীকে কিনে নিতে পারে। কখনও নির্দিষ্ট কিছু দিনের জন্য। কখনও বা চিরকালের জন্য। দাসীর মা সবসময় চেষ্টা করে যাতে তার। মেয়েকে কোনও ধনী চিরকালের জন্য কিনে নিয়ে যায়। তাতে যা অর্থ পাওয়া যায় তাতে তার মায়ের সারাজীবন নিশ্চিন্তে চলে যায়। মেয়েও একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয় পায়। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, বহু পুরুষের মনােরঞ্জন আর করতে হয় না তাকে। আর ঘরের অন্যান্য দাস-দাসীর মতাে কাজকর্মও করতে হয় না। তার একটাই কাজ। প্রভু অর্থাৎ ধনী যখনই তাকে ডাকবে, তখনই সেজেগুজে তার সামনে হাজির হওয়া। নিজের দেহ দিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করা।

নাগবল্পী নিজেও এই কাজ করে এসেছে। নাগবল্পীর মা তাকে বিক্রি করে দিয়েছিল এক বৃদ্ধ নারকেল ব্যবসায়ীর কাছে। বিরাট নারকেল বাগান ছিল তার। বুড়াের ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু শখ ছিল বিস্তর। আলাদা বাড়ি করে নাগবল্পীকে রেখেছিল। আদর-সােহাগের কিছু কমতি ছিল না। কিন্তু বুড়াে কখনও পরিপূর্ণ সঙ্গম করে উঠতে পারেনি। নাগবল্পীকে নগ্ন করে সে কোলে বসাত। তারপর যেমন ক্রেতা শাক সবজী পরখ করে দেখে, তেমনই ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখত তাকে। নাগবল্পী তখন কিশােরী। সদ্যফোটা কুঁড়ির মতাে স্নিগ্ধ ও সুন্দর। তার ওই লােলচর্ম বৃদ্ধকে ভালাে লাগত না। তার কামুক স্পর্শ অসহ্য ঠেকত। তবু সব নিশূপেই মেনে নিয়েছিল। কারণ মা বলত—‘বুড়াে হােক কি জোয়ান। সুন্দর হােক কি কুৎসিত। ধনী ধনীই! তাকে সন্তুষ্ট করা তােমার কাজ। তােমার একমাত্র ধর্ম। এজন্যই আমাদের সৃষ্টি হয়েছে। নয়তাে ‘ইয়েল্লাম্মা’র অভিশাপ লাগবে।
কয়েক বছর পর বুড়াে মরে গেল। নাগবল্লী ফিরে এল তার মায়ের কাছে। সেখানে থেকেই সে ধনীদের সেবা করত। ফলস্বরূপ কিছুদিনের মধ্যেই গর্ভবতী হয়ে পড়ল।….

….ভেঙ্কটেশু আন্নাও আলাদা হয়ে গিয়েছে। প্রভুদাসীদের নিয়মই এটা। ওরা পুত্রসন্তান রােজগেরে হওয়ার পর তাকে আলাদা করে দেয়। তারা ছেলেদের আর কোনও খবর রাখে না। ঘরে কোনও পুরুষমানুষ রাখতে চায় না। সব দিক দিয়েই ওদের সংসার মাতৃতান্ত্রিক। এমনকি, কোনও প্রভুদাসীর সন্তানের পিতৃপরিচয়ও থাকে না। মায়ের পরিচয়েই সে বড় হয়। কৃষ্ণবেণী অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছে—তায়ি সবার তাে ‘তাণ্ডে’ থাকে। আমার বাবা কে? আমার ‘তাণ্ডে’ কই?
তায়ি বলেছে—‘প্রভুদাসীদের কোনও বাবা থাকে না। তাদের স্বামী একজনই। “দিভারু। ঈশ্বরই আমাদের স্বামী। আর কোনও পুরুষের আমাদের ওপর কোনও অধিকার নেই।
তখন না বুঝলেও এখন বুঝেছে কৃষ্ণবেণী যে বাবার পরিচয় মা কখনই দিতে পারত না। কোনও প্রভুদাসীই পারে না। কারণ যে একদিনেই একাধিক পুরুষের সঙ্গে মিলিত হয়, সে জানবে কী করে যে কার বীজ তার অভ্যন্তরে আছে। একমাত্র যাদের বাঁধা ধনী’ আছে, তারাই হয়তাে বলতে পারবে। তবু প্রভুদাসীর সন্তানের ওপরে আর কারাের অধিকার নেই। বাবার নাম পায় না ওরা।
কৃষ্ণবেণীর মনে হল, যদি তার কন্যাসন্তানও এই একই প্রশ্ন করে তখন সেও কোনও উত্তর দিতে পারবে না। দিনের পর দিন বহু পুরুষের সঙ্গে মিলিত হয়েছে সে। সেসব ধনীদের মনে রাখেনি। কেউই রাখে না। তাদের কারােরই ঔরসজাত তার সন্তান। কিন্তু কার, তা কখনই বলতে। পারবে না কৃষ্ণবেণী।…..

…এই নিয়ে বিস্তর তর্কাতর্কিও হয়েছে। তার মধ্যেই পঞ্চায়েতপ্রধানের লােলুপ, জুলজুলে দৃষ্টি মাঝে মধ্যেই তার দেহের বিভিন্ন গলিখুঁজিতে ঘােরাফেরা করছিল। পুরুষের দৃষ্টি খুব ভালাে করেই চেনে নাগবল্পী। কামুক দৃষ্টি চিনতে ভুল হয় না।
চনক আন্না পাশের গ্রাম ‘অনন্তপুরের অন্যতম ‘শ্ৰীমন্ত। জমি-জায়গা-নারকেল বাগানের প্রাচুর্যে লক্ষ্মী তার ঘরে অচলা। একসময় চনক নাগবল্লীর ঘরে অনেকবার এসেছে। তখন কৃষ্ণবেণী নিতান্তই ছােট। প্রায় কোলের শিশু বলা যায়। তাকে মেঝেতে শুইয়ে রেখে, সেজেগুজে চনকের সঙ্গে বিছানায় যেত নাগবল্পী। হয়তাে চুড়ান্ত উত্তেজিত মুহূর্তে কৃষ্ণবেণী কোনও কারণে কেঁদে উঠত। মশা, পিপড়ে বা পােকার কামড়ে চিৎকার করেই কেঁদে যেত। ভীষণ বিরক্ত হত চনক। নাগবল্লীকে উঠে যেতে দিত না। জাপটে ধরে রাখত। নাগবল্লী বলত—‘ছেড়ে দাও ধনী। মেয়ে কাদছে।
‘কঁদুক। তােকে টাকা দিয়েছি। সে কি কান্না শােনার জন্য?
শাড়ি সামলাতে সামলাতে বলত নাগবল্লী—ওরকম বােলাে না। ও তাে পরে তােমাদের ভােগেই লাগবে।
কথার খেলাপ করেনি সে। কৃষ্ণবেণীর চোদ্দ বছর বয়সে নথ ভেঙেছিল এই চনকই। নথ ভাঙার উপঢৌকন হিসাবে অনেক টাকা, সােনার হার দিয়েছিল।….

….নাগবল্পী আর কথা না বাড়িয়ে ঘরে ঢুকে গেল। চনকের ‘আলিয়া’ তথা জামাইকে স্বাগত জানাতে হবে। শুধু তাই নয়, নিমন্ত্রিত প্রত্যেকটি মানুষকে স্বাগতম জানানাের দায়িত্ব তার। অখণ্ড সৌভাগ্যবতী হওয়ার দরুণ যে কোনও বিয়েতে প্রভুদাসীকেই গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আমন্ত্রিত সবাইকে স্বীকারিসালু’ করতে হয়। প্রভুদাসী ছাড়া এই গ্রাম তাে দূর, আশেপাশে আরও পাঁচ-ছ’টা গ্রামের বিয়ে অসম্ভব। শহরতলী থেকেও অনেকেই এই বিয়ের অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে প্রভুদাসীদের নিয়ে যায়। মণ্ডপ পূজার পর যে মুহূর্তে দরজায় প্রভুদাসীর পা পড়ল সেই মুহূর্তেই বিয়ের মণ্ডপ পূত-পবিত্র হয়ে উঠল।…..
…..মাথায় তেল ঘষতে ঘষতেই নিজেকে আয়নায় দেখছিল। দেখতে দেখতেই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। কী অনিন্দ্যসুন্দরী সে এখনও। এখনও তার ভরপুর যৌবন! কেউ বলবে যে সে এক ছেলে, আর এক মেয়ের মা! চোদ্দ বছর বয়সে সে প্রথম মা হয়েছিল। তারপর যােলাে বছরে দ্বিতীয়বার। এখন ওর বত্রিশ বছর বয়েস। অথচ এখনও পঁচিশ-ছাব্বিশের বলে অনায়াসে চালিয়ে দেওয়া যায়। উত্তুঙ্গ স্তন, সরু কোমরে একটুও মেদ নেই। প্রত্যেকটা বিভাজিকা, প্রত্যেকটি চড়াইউতরাই স্পষ্ট। এই রূপ উত্তরাধিকার-সুত্রে কৃষ্ণবেণী পেয়েছিল। কিন্তু মেয়েটা তার মর্ম বুঝল না।…..
….দপ করে আগুন জ্বলে উঠল নাগবল্লীর চোখে। এত কষ্ট স্বীকার করেছিল বলেই ‘ইয়েল্লাম্মা’র আশীর্বাদ আছে তার ওপর। আজও তার শুচিশুদ্ধ উপস্থিতিকে সাধারণ মানুষ শ্রদ্ধা করে। রাস্তাঘাটে, হাটে-বাজারে লােকে দু-হাত তুলে নমস্কার জানায়। পুজো-পার্বণে তাকে প্রয়ােজন হয় সবার। এই তাে, আজই চনকের মেয়ের বিয়েতে ‘বন্ধু’ আর ‘বধূবীনা’ তার চরণস্পর্শ করে আশীর্বাদ নেবে।
চনক যতই তাকে শয্যাসঙ্গিনী বানিয়ে রাখুক, আজ সেই শয্যাসঙ্গিনীর গুরুত্ব ও সম্মান জীবনসঙ্গিনীর থেকেও বেশি। এতদিন নাগবল্পী চনককে তুষ্ট করে এসেছে। আজ চনককেই তাকে সন্তুষ্ট করতে হবে। প্রভুদাসী যদি কোনও কারণে অসন্তুষ্ট হয় তবে সেই নববিবাহিতা দম্পতির ওপর ‘ইয়েল্লাম্মা’র অভিশাপ লাগে।….

…..কৃষ্ণবেণী মৃদু গলায় তখন বলছিল—“আমার তেরাে বছর বয়সে মা আমাকে প্রথম এক ধনীর সঙ্গে বসিয়েছিল। আমি তখনও বুঝতে পারিনি যে ঘটনাটা কী ঘটতে চলেছে। লােকটা বুড়াে। কিছু বােঝার আগেই সে আমাকে জাপটে ধরে শুইয়ে দিয়েছিল। আমার ওপর চড়াও হয়ে সে নিজের ‘পঞ্চে’ আর ‘অঙ্গি’ খুলে ফেলল! শল্য’টা ফেলে দিল মেঝেতে। কী কুৎসিত ছিল বুড়ােটা। সারা বুক কাঁচা-পাকা লােমে ভর্তি। পেট তাে নয়, যেন জালা! থলথলে ভুঁড়িটা ঝুলছে। মুখ থেকে যেন লালা ঝরছে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। প্রতি মুহূর্তে ভাবছিলাম এখনই তায়ি এসে আমাকে বাঁচাবে। লােকটা আমার নরম শরীরটাকে পিষছিল৷
চিরুথা ওর দিকে তাকায়। কৃষ্ণবেণী যেন তাকে কথাগুলাে বলছে না। নিজের মনে কথা বলে চলেছে। সে চুপ করে শুনছিল তার স্বগতােক্তি।
‘নোংরা লােকটা আমায় ব্যথা দিচ্ছিল। যখন ও আমার গােপনাঙ্গে প্রবেশ করল তখন আমারও নিজেকে ভীষণ নােংরা মনে হচ্ছিল। আমার প্রচণ্ড যন্ত্রণা করছিল। আমি ওর সামনে দু’হাত জোড় করে মুক্তি চাইছিলাম। তবু ও থামছিল না। প্রচণ্ড ঝাকুনি দিয়ে যাচ্ছিল। আমি কাঁদছিলাম। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিলাম। অসহায়ের মতাে ডাকছিলাম—‘তা—য়ি, তা—য়ি। কিন্তু তায়ি আসেনি। বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে কোথায় যেন চলে গিয়েছিল। বুড়ােটা কিছুক্ষণ পরে আমায় যখন ছেড়ে দিল তখন দেখলাম আমার জামায়, বিছানায় লেগে আছে চাপ চাপ রক্ত। আমার ওই জায়গাটা, তলপেট যেন যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছিল। লােকটা মুখ মুছতে মুছতে বাইরে চলে যাওয়ার একটু পরেই তায়ি এসে ঘরে ঢুকল। আমি তখনও ব্যথায় কাদছিলাম। কাঁদতে কাঁদতেই তায়িকে বললাম—‘লােকটা ভীষণ নােংরা। আভারু কোলাকু মনুষ্যা! তায়ি বলল—‘ধনীর সম্পর্কে অমন কথা বলতে নেই। এই দ্যাখ, তাের জন্য কত কী দিয়ে গিয়েছে। মা আমাকে এক বাণ্ডিল টাকা, শাড়ি
‘পুলি বেল্ট দিয়ে মারে? তােমায় মেরেছে?
‘আমায় মারতে যাবে কোন্ দুঃখে? আমি কি ওর বউ?’ চিরুথা ফিক করে হাসলও ওর বউকে মারে। লৈঙ্গিকা করার পরে। কৃষ্ণবেণী কৌতুহলী—“তুমি জানলে কী করে?
“সরল! সে ফিক ফিক করে হাসতে হাসতেই বলল-“আমি রাতে চুরি করতে গিয়েছিলাম। সবে কোনওমতে দোতলার জানলায় উঠেছি, দেখি পুলি আর ওর বউ-এর মধ্যে ‘লৈঙ্গিকা’ হচ্ছে। পুলিটা শুধু নড়াচড়াই করছে। ব্যাটা কাজের কাজ কিছুই করতে পারছে না। যখনই করতে যায়, তখনই শালা ভূঁড়িতে আটকে যায়। এই করেই বেশ খানিকক্ষণ চলল। পুলি ওর বউয়ের ওপর জলহস্তির মতাে লাফিয়ে ঝাপিয়ে একসা করছে, কিন্তু ভুড়ি আর এগােতেই দেয় না। আমি ভাবলাম ও যতক্ষণ লাফায় ততক্ষণ একটু ঘুমিয়েই নিই। কিন্তু তাও হল না।
‘কেন?
‘কিছুই করতে না পেরে পুলি শেষে রেগে গিয়ে বউটাকে বেল্ট দিয়ে পেটাতে শুরু করল। আমার আর সহ্য হল না। চুরি-টুরি ছেড়ে স্রেফ খালি হাতে চলে এলাম। চিরুথা সশব্দে হাসল….

…..তবু এর মধ্যেও কিছুটা আশার আলাে দেখা গিয়েছে। একেবারেই ক্ষীণ, তবু আলাের রশ্মি বটে। অনেকে আজকাল প্রভুদাসীদের কিনে নিয়ে এর আরও মােটা দামে বিক্রি করে দেয়। মেয়েগুলাে শহরে গিয়ে ও বেশ্যাপট্টিতে গিয়ে কাজ করে। ওদের তাতে কোনও অসুবিধে কারণ ওই একই কাজ, তথা প্রভুদের সন্তুষ্ট করতে সে ইতিমধ্যেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। শহরে গিয়েও ‘প্রভু’ ভেবেই পুরুষদের ভােগত মেটায়। স্থানের পরিবর্তন হলেও কাজের পরিবর্তন কিছু হয় না।….

….নাগবল্পী চুপ করে শুনছিল। পঞ্চায়েতপ্রধান ওকে ভালােবাসেন কিনা তা ওর জানা নেই। কিন্তু এই বিশেষ পুরুষটির প্রতি তার নিজের সামান্য দুর্বলতা আছে। নাগবল্পীর যখন তেরাে বছর বয়েস, তখন তার নথ উনিই ভেঙেছিলেন। তখন ওঁর বাবা ছিলেন পঞ্চায়েতপ্রধান। তখন উনি একুশ বছরের ঝকঝকে চকচকে যুবক। লম্বা, চওড়া কাঠামাের সুদর্শন মানুষটিকে প্রথম দর্শনেই ভালাে লেগে গিয়েছিল নাগবল্লীর। নাগবল্পীর নথ ভাঙার পরে অনেক জোয়ান-বুড়াে ধনী তাদের ঘরে এসেছে। কিন্তু এই মানুষটিকে ভুলতে পারেনি সে। অপেক্ষায় থাকত, কখন তিনি আসবেন। ….

….নাগবল্পী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর গঙ্গা দিয়ে কত জল বয়ে গিয়েছে। মা এর একবছর পর তাকে বিক্রি করে দিয়েছিল ওই নারকেল ব্যবসায়ীর কাছে। সেখানে বেশ কয়েক বছর ছিল নাগবল্পী। বুড়াের মরার পর যখন ফিরল, ততদিনে সেই যুবক ‘ধনী’ ‘পঞ্চায়েতপ্রধান হয়ে গিয়েছে। আগের মতাে নিয়মিত আসতে পারতেন না ঠিকই, তবে মাঝে মাঝে এসে উপস্থিত হতেন। নাগবল্লীর সঙ্গে বসতেন।
পরবর্তীকালে কৃষ্ণবেণীরও সেবা পেয়েছেন তিনি। কিন্তু নাগবল্পীর প্রতি তার একটা সস্নেহ প্রশ্রয় বরাবরই আছে।…

….তিনি নাগবল্পীর দিকে তাকিয়েই ছিলেন। এখনও কী আগুনের মতাে সুন্দরী নাগবল্পী। নারীরা বােধহয় একেকজন একেকরকম হয়। কৃষ্ণবেণীও অপূর্ব সুন্দরী। তার ওপর সদ্য ফোটা ফুলের মতাে কমনীয়, তাজা! তার সঙ্গসুখও উপভােগ করেছেন তিনি। কিন্তু নাগবল্লী! সে যেন অন্য আনস। আগুনের মতাে জ্বালায়। তার সঙ্গ বিষের মতাে। তিল তিল করে মরণের জ্বালা উপভােগ করায়। রক্তে রক্তে ঢেলে দেয় বিষের জ্বালা!….

…আজ তিনি মরতেই এসেছেন।
পঞ্চায়েতপ্রধান এক হাত দিয়ে সরিয়ে দিলেন নাগবল্লীর গাল ছুঁয়ে থাকা অলকগুচ্ছ। নাগবল্লীর ভেতরটা যেন কেমন করে উঠল। বহুদিন পুরুষের স্পর্শ পায়নি সে। অন্তরের বুভুক্ষু কামনা খর দহনজ্বালায় জ্বালিয়ে দিল। সে উন্মুখ হয়ে উঠল। অজান্তেই তার মুখ এগিয়ে গেল পঞ্চায়েতপ্রধানের মুখের দিকে। চোখ দুটো আবেশে বুজে এসেছে। পঞ্চায়েতপ্রধান তার চিবুক আলতাে করে ছুঁয়েছেন। তিনি দেখলেন চুম্বনপ্রত্যাশী এক নারীকে। আলতাে করে তিনি নিজের ঠোট ডুবিয়ে দিলেন নাগবল্লীর নরম ঠোটে!

নাগবল্লীর মধ্যে যেন ফণা তুলল সেই বিধ্বংসী কামনা। এতদিন সে নিজে কোনও পুরুষের সঙ্গে রমণ করেনি। সব ধনীরা কৃষ্ণবেণীর সঙ্গেই বসতে চাইত। এতদিন তাকে কেউ স্পর্শ করেনি। কেউ কামনা করেনি তাকে। আজ সুযােগ পেয়ে ক্ষুধার্ত, অভিজ্ঞ পূর্ণযৌবনা হয়ে উঠল আরও বেশি তীব্র। সে’সাপের মতােই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে পুরুষটিকে। টেনে নিয়েছে বুকের ওপর। পঞ্চায়েতপ্রধানের হাত তার হাতে। তাঁকে পাগলের মতাে চুমু খাচ্ছে নাগবল্লী। পঞ্চায়েতপ্রধান ক্রমশই ডুবে যাচ্ছেন। নাগবল্লীর বাহুপাশে নিজেকে সমর্পণ করে দিয়েছেন তিনি। তাকে জাপটে ধরে তার গলায়, ঘাড়ে ঠোট ঘষছেন। দু’হাতে তার আলুলায়িত চুল নিয়ে খেলা করছেন। আঃ! কী সুখ! নাগবল্পীর কবােষ্ণ, কমনীয় বুক তার সঙ্গে সেঁটে আছে। তিনি ওকে আদর করতে করতেই পিয়াজের খােসার মতাে ছাড়িয়ে নিচ্ছেন শাড়ি। তার উত্তুঙ্গু বুকে মুখ ডুবিয়ে চুমু খাচ্ছেন। কোথাও কোথাও আদরের প্রাবল্যে এঁকে গিয়েছে। ভােগচিহ্ন। নাগবল্লীর, হাতের কঙ্কণে তার বুক ছড়ে গেল। তিনি নাগবল্লীকে সবলে টেনে নিয়েছেন নিজের কোলে। দ্রুত হাতে ওর ব্লাউজ খুলছেন। নাঃ, আর সহ্য হচ্ছে না। আর একটুও দেরি সহ্য হবে না! ওকে পরিপূর্ণ করে পেতে চান তিনি। ঠিক আগের মতন করে। আবেগ থরথর কণ্ঠে বললেন—নাগবল্লী!
‘শ্রীমন্ত’
‘তুই আমায় ভালােবাসিস না তাই না?’
চকিতে নিজেকে ফিরে পেল নাগবল্লী। প্রভুদাসীদের আবার ভালবাসা কী? তারা ধনের বদলে সবার শয্যাসঙ্গিনী হয়। কোনও এক পুরুষের ভালােবাসায় নিজেদের জড়ায় না। তাছাড়া ভালােবাসা কী তা নাগবল্পী কখনও বােঝেনি। সে শুধু শরীর বােঝে। এইটুকু না যে টাকার বিনিময়ে ওকে সব ধনীর সঙ্গেই সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। আর সে সম্পর্ক শুধুমাত্র দৈহিক সুখেই সীমাবদ্ধ। তার বেশি কিছু নয়। ধনীকে সন্তুষ্ট করাই ওর কাজ। ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপন নয়। তাই পঞ্চায়েতপ্রধানের কথার কোনও উত্তর না দিয়ে সে রমণে মন দিল। নাগবল্পী জানে, পঞ্চায়েতপ্রধানের এই ভালােবাসা নিতান্তই সাময়িক। একটা তৃপ্তিদায়ক সঙ্গমের পর উনিও ভালােবাসার কথা ভুলে যাবেন। ওঁর কাছে কৃষ্ণবেণী আর নাগবল্লী একই। আগে কৃষ্ণবেণীর বাহুপাশে ধরা দিতেন। আজ সে নেই বলে নাগবল্লীর কাছে এসেছেন। এ মানুষটাই দিনের পর দিন কৃষ্ণবেণীর সঙ্গে বসেছে। তার সেবা নিয়েছে। তখন নাগবল্লীর কোনও ভূমিকা ছিল না। সে শুধু দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে চলে যেত। কই! তখন তাে ওঁর নাগবল্লীর কথা মনে পড়েনি? তখন এই হাতই কৃষ্ণবেণীকে ছুত! এই ঠোটই ওর শরীরে ঘুরে বেড়াত। এই দাঁতেরই ভােগচিহ্ন লেগে থাকত কৃষ্ণবেণীর শরীরে। তখন বুকের ভেতর একটা প্রদাহ হত নাগবল্লীর। একেই কি বলে ভালােবাসা! তখন মাঝে মধ্যে নিজের মেয়েকে প্রতিদ্বন্দী বলে মনে হত! পঞ্চায়েতপ্রধান যখনই এসে কৃষ্ণবেণীর খোঁজ করতেন, তখনই একটা অদ্ভুত ব্যথায় ভরে যেত তার মন। কিন্তু তখন তাে তিনি নাগবল্পীর অনুভূতির কথা ভাবেননি।
কেউই ভাবে না। তাজা পদ্মের মতাে সুন্দরী সামনে এসে দাঁড়ালে কে আর বাসি চামেলি ফুলের মালা হাতে জড়িয়ে রাখে ! কথাগুলো মনে পড়তেই নাগবল্পী বাস্তবের মাটিতে নেমে এল।
সম্ভোগের মধ্যে যে নেশা, যেটুকু আবেগ ছিল, তা কেটে
এতক্ষণের সম্ভোগের মধ্যে যে নেশা, যে আবেগটুকু ছিল তা কেটে গিয়েছে। এখন পঞ্চায়েতপ্রধানকে সন্তুষ্ট করা তার কর্তব্যমাত্র। কর্তব্যে কোনও ত্রুটি হবে না।

সঙ্গম শেষে পরিতৃপ্ত হয়ে উঠে বসলেন পঞ্চায়েতপ্রধান। নাগবল্পী লক্ষ্য করল, এতক্ষণ তার চোখে যে ঘাের লেগেছিল, তা অনেকটাই নির্বাপিত। সে মনে মনে হাসে। এমনটাই তাে হওয়ার ছিল। এমনটাই হয়।….