কিছু মনোদৌহিক কবিতা

›› কবিতা / কাব্য  

প্রবাসের শেষে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

(বন্দী জেগে আছো)

যমুনা, আমার হাত ধরো, স্বর্গে যাবো।
এসো, মুখে রাখো মুখ, চোখে চোখ, শরীরে শরীর
নবীনা পাতার মতো শুদ্ধরূপ, এসো
স্বর্গ খুব দুরে নয়, উত্তর সমুদ্র থেকে যে রকম বসন্ত প্রবাসে
উড়ে আসে কলস্বর, বাহু থেকে শীতের উত্তাপ
যে রকম অপর বুকের কাছে ঋণী হয়; যমুনা, আমার হাত ধরো,
স্বর্গে যাবো।

আমার প্রবাস আজ শেষ হলো, এরকম মধুর বিচ্ছেদ
মানুষ জানেনি আর। যমুনা আমার সঙ্গী-সহস্র রুমাল
স্বর্গের উদ্দেশ্যে ওড়ে; যমুনা তোমায় আমি নক্ষত্রের অতি প্রতিবেশী
করে রাখি, আসলে কি স্বাতী নক্ষত্রের সেই প্রবাদ মাখানো অশ্রূ তুমি নও?
তুমি নও ফেলে আসা লেবুর পাতার ঘ্রাণে জ্যোৎস্নাময় রাত?
তুমি নও ক্ষীণ ধূপ? তুমি কেউ নও
তুমিই বিস্মৃতি, তুমি শব্দময়ী, বর্ণ-নারী, স্তন ও জঙ্ঘায় নারী তুমি,
ভ্রমণে শয়নে তুমি সকল গ্রনে’র যুক্ত প্রণয় পিপাসা
চোখের বিশ্বাসে নারী, স্বেদে চুলে, নোখের ধুলোয়
প্রত্যেক অণুতে নারী, নারীর ভিতরে নারী, শূণ্যতায় সহাস্য সুন্দরী,
তুমিই গায়ত্রী ভাঙা মণীষার উপহাস, তুমি যৌবনের
প্রত্যেক কবির নীরা, দুনিয়ার সব দাপাদাপি ক্রুদ্ধ লোভ
ভুল ও ঘুমের মধ্যে তোমার মাধুরী ছুঁয়ে নদীর তরঙ্গ
পাপীকে চুম্বন করো তুমি, তাই দ্বার খোলে স্বর্গের প্রহরী।

তুমি এ রকম? তুমি কেউ নও
তুমি শুধু আমার যমুনা।

হাত ধরো, স্বরবৃত্ত পদক্ষেপে নাচ হোক, লজ্জিত জীবন
অন্তরীক্ষে বর্ণনাকে দৃশ্য করে, এসো হাত ধরো।
পৃথিবীতে বড় বেশী দুঃখ আমি পেয়ে গেছি, অবিশ্বাসে
আমি খুনী, আমি পাতাল শহরে জালিয়াৎ, আমি অরণ্যেব
পলাতক, মাংসের দোকানে ঋণী, উৎসব ভাঙার ছদ্মবেশী গুপ্তচর।
তবুও দ্বিধায় আমি ভুলি নি স্বর্গের পথ, যে রকম প্রাক্তন স্বদেশ।
তুমি তো জানো না কিছু, না প্রেম, না নিচু স্বর্গ, না জানাই ভালো
তুমিই কিশোরী নদী, বিস্মৃতির স্রোত, বিকালের পুরস্কার……
আয় খুকী, স্বর্গের বাগানে আজ ছুটোছুটি করি।।

 

প্রকৃতি-পুরুষ জোড় – আলী আফজাল খান

 

ঊষের তপ্ত পুরুষ প্যাঁচে ধরে রাইপ্রকৃতি
দুই তীরে ষড়রিপুর আনচান
দলাদলা, নিখাদ আনন্দে মন্থন

ক্ষীণতোয়া নহর পায় ঠোঁটের লাক্ষা রস
অতঃপর, ডেউয়া ফলের মতো কুচযুগল
স্তনের মোহন চূড়ার জামফলে জীবন্ত জিহ্বাটুকু শিরশির

অজস্র উথালে চিৎপুরুষ
বর্ণের দেহে বর্ণে যুক্তাক্ষরে ফলা
নবরূপে ফোটে ফুল

শাটার চিরে পটচিত্র উজল উজাড় ফল জ্বলজ্বল
আলোর সরু গাঙ মুখে মোহনিয়া নয়াচর চচ্চর
পা পা-হীন রাই অঙ্গে শ্যাম অঙ্গ পুরে

নাম আর ক্রিয়ার লাগালাগি
মন দেহরে দেয় দ্রুতি, কৃষিকাজে ফলন দেখাদেখি

পুরুষ-প্রকৃতি সম্পর্ক: পুরুষের পুরে প্রকৃতি বিকশিত হচ্ছে যেন অন্ধের স্কন্ধে খঞ্জ

 

প্রেম দিতে থাকো – শক্তি চট্টোপাধ্যায়

মালবিকা স্তন দাও, দুই স্তনে মাখামাখি করি।
যেভাবে পর্বতশীর্ষে টেনে আনি বুকের পাঁজরে
সেইভাবে নদী আনি গহ্বরে বুকের,
মালবিকা দেহ দাও আলিঙ্গন করি,
যেভাবে পর্বত-নদী করি আলিঙ্গন,
সেইভাবে, মালবিকা বৃদ্ধে সুখ দাও-
অজপা রেখো না তাকে, প্রেম দিতে থাকো।

 

স্তন – শামসের আনোয়ার

তোমার স্তনে হাত রাখলে মনে হয় যে একটা
ছোট্ট পাখি চেপে ধরেছি মুঠোর ভিতর;
জোরে চেপে ধরলেই মরে যাবে-
আঙুলের ডগা বুলিয়ে বুলিয়ে আমি তোমার
স্তনের পালকগুলো খাড়া করে তুলি।
স্তনের ঠোঁটের মুখে গুঁজে দিই মমতার ক্ষুদ এবং কুঁড়ো,
তখন খুশিতে ডাকতে শুরু করে তোমার স্তনদুটো-
ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়ায় আমার মুখ, কপাল, বুক
এবং ঘাড়ের ওপর।

 

প্রত্নমুখ – সুকান্ত মন্ডল

প্রকৃত রাতে শেষে তুমি ফিরে আসো জন্ম দাও, লালিত করো
দেহকোষ ভেঙে ভেঙে মাটির কাঠামোয়
আনো, তিলক ও ত্রিশূল, বান
জাগাও সুষমা
আনো, শঙ্খ, জ্যোতিষ্কবিন্দু ধুলোর কণিকা।
তবু দেখো প্রত্নমুখ পড়ে আছি যোনির আঁধারে…

 

কেন যাবে ? বাণী বসু

সঙ্গম থেকে উৎসে
জলঙ্গম পিছে ফেলে হিমশৈলে
কেন যাবে বলো ?

ঘন টানা ভুরু গ্রাম-অরণ্যে ভ্রুকুটি
গাঙ্গেয় ঢালে প্রবল পাটল উৎরাই। চ
ুম্বক স্রোত পেছনে টানবে নিয়তি।
অনুকূল স্রোতে সাঁৎরাই।
মিলে মিশে চলা সাগরে
সঙ্গত, চলো সঙ্গমে গিয়ে ডুব দাও।

যাবে যদি যেও, কিন্তু এমন মৌন।
বৃদ্ধা হাতড়ানো শৈলসুতার বক্ষে।
রঙ্গিলা নুড়ি চায় বটে আঁচলে,
রাকস্যাক ঝেড়ে পথের পাথর পথেতেই।

অভিযাত্রিক টি পাপুরে বেদীতে
নিয়ত গাঁথছ বৃথাই পেরোতে উড়ালে
সমূহ প্রপাত, হায় অসঙ্গ যাত্রী
সিত গ্লেসিয়ার জানো কি মানস-উজানে।

 

অরুণ মাজীর অশ্লীল কবিতা (An Indecent Poem)

নগেন মাস্টার
পুরুষাঙ্গ প্রদর্শন করে পথ হাঁটলে
তা আমার অশ্লীল লাগে না।
পেন্তীর মা
বুকের আঁচল খুলে,  দুলে দুলে পথ হাঁটলে
তা আমার অশ্লীল লাগে না।
অষ্টাদশী তিন্নি
প্রকাশ্য রাস্তায়
ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মতো কাউকে চুমু খেলে
তাও আমার অশ্লীল লাগে না।

“কিন্তু”
রুগ্ণ ক্ষুধার্ত
ন বছরের নান্টুকে কাগজ কুড়াতে দেখালে;
তা অশ্লীল লাগে আমার ।
বারো বছরের বটুকে যখন
হোটেলের মালিক বেধড়ক প্রহার করে;
তা অশ্লীল লাগে আমার।
উপাচার্য্য উপেন আচার্য্য যখন,
উদ্ভিন্ন যৌবনা “স্বার্থের” বুকে
“চরিত্র” নামের চিবুক ঘষতে থাকে;
তা অশ্লীল লাগে আমার।
তোমাদের বামুন আর মৌলবী যখন
মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে কুকুরের মতো লেলিয়ে দেয়
তা অশ্লীল লাগে আমার।

তোমাদের শ্লীলতার সংজ্ঞাকে
কাঁচকলা দেখিয়ে বলছি-
সানি লিওন যখন উন্মত্ত শীৎকারের সাথে
একাধিক পুরুষকে তৃপ্ত করে;
তা অশ্লীল লাগে না আমার।
কিন্তু তোমাদের রাজা মন্ত্রী যখন ধর্ষণকে
ছোট্ট ঘটনা বলে ব্যাখ্যা দেয়,
তোমাদের দেশ আর চৌদ্দ পুরুষকে
অশ্লীল ইতর লাগে আমার।

 

কাঠঠোকরা – সাইয়েদ জামিল

গাছের যৌনাঙ্গ থেকে ঠিকরে পড়া রোদ্দুরের মতো শাদা শাদা
অনুভূতির প্রচ্ছন্ন আভায় পৃথিবী লেপ্টে আছে।

সমস্ত অনুভূতিই তবে শুদ্ধ সঙ্গীত। আর খচ্চরের পায়ু পথ দিয়ে
যে ধ্বনি নির্গত হয় কখনও কখনও তাও কারও কারও মর্মে পশে যেতে
পারে ব’লে মনে হচ্ছে।

দ্যাখো, একটি নারী আকাশের দিকে নিতম্ব দিয়ে শিশ্ন গর্জনের মতো
ধেয়ে আসা সৌরঝড় প্রতিহত করছে।

এবং এইসব অশ্লীল ঘটনার মোকাবিলা করতে করতে পেরিয়ে যাচ্ছে
সূর্যের আয়ুষ্কাল। তবু একজন কাঠঠোকরা জীবনে কতো কিউবিক কাঠ
ঠোকরায় তা হিসেবের বাইরেই থেকে যাচ্ছে।

 

ঈ-শ! ঈ-শ! এ-ই, আ-হ্, এইখানে, প্রিয়! – হুমায়ুন আজাদ

‘ঈ-শ! ঈ-শ! এ-ই, আ-হ্, এইখানে, প্রিয়! এইখানে রাখো
জিভদেব! আ-হ্! ম’রে যাচ্ছি! চোষো, একটুকু ধীরে,
আ-হ্! ডান চাঁদে ঠোঁট রেখে চিরকাল থাকো,
পান করো, খাও, গেলো, শুষে নাও, ভেঙে, ফেড়ে, ছিঁড়ে।’
‘ঈ-শ! ঈ-শ! এ-ই, আ-হ্, এইখানে, প্রিয়!’

‘আমার মুঠোতে দাও রাজদন্ড! দাও! ধরি! বন্য দেবতা
এতো দৃঢ়! পেশল! শক্তিমান! উচ্চশির! দাও তারে মুখগহ্বরে!
কী প্রচন্ড! আ-হ্! কন্ঠের ভেতর শুনি পৌরাণিক অপরূপ কথা,
দম বন্ধ হয়ে আসে! ভেঙে পড়ছি আশ্বিনের ঝড়ে!’
‘ঈ-শ! ঈ-শ! এ-ই, আ-হ্, এইখানে, প্রিয়!’

‘ঈ-শ! ঈ-শ! এ-ই, আ-হ্, এইখানে, শিউলি বোঁটায়
রাখো ব্যাঘ্রজিভ, কমলোষ্ঠে, চোষো, ভাঙো! ঘন মধু ঝরে,
আহ্! মধু খাও, প্রিয়! ম’-রে যা-চ্ছি! ফোঁটায় ফোঁটায়
ঝ’-রে যাচ্ছি, ঢোকো, মধুময় চাকের ভেতরে।’

‘ঈ-শ! ঈ-শ! এ-ই, আ-হ্, এইখানে, প্রিয়!’
‘ঢো-কো! আরো! গভীর পাতালে! ই-শ! বিদ্ধ, খনন করো,
আহ্! কে ঢুকছে? পশুদেব? কবিতা? ধীরে ধীরে ধীরে,
এ-ই-বা-র দ্রু-ত, প্রিয়, ম’রে যা-চ্ছি, ঢোকো, দুই হাতে ধরো,
ভে-ঙে যা-চ্ছি, ম’-রে যাচ্ছি, গ’লে যাচ্ছি মৃত্যুর গভীরে!’
‘ঈ-শ! ঈ-শ! এ-ই, আ-হ্, এইখানে, প্রিয়!’

 

অশ্লীল – শরদিন্দু কর্মকার

দর্শনে কত ধৰ্ষণ হয় ……
তা চলছে অনাবিল।
তোর শরীরে হাত রাখলেই …
সেটা হয় অশ্লীল?
ঠোঁটের ওপর দাঁত বসিয়ে…..
অল্প রক্তক্ষরণ।
তোর বুকেতে মুখ লুকিয়ে…..
তোরই হৃদয় হরন।
শরীর জুড়ে বৃষ্টি নামে…..
তোর বুকের মাঝে ঢেউ ।
নাভির নিচে সন্ধ্যা নামে …..
সিদ কাটবে কেউ।
পায়ের ফাঁকে খিরকি এঁটে…
দিয়ে রাখিস খিল,
সেটাও কারো ভোগ দখলে ….
তবে কোথায় অশ্লীল ??

 

প্রেমিকার দুধ – মলয় রায়চৌধুরী

আমি কখনও কোনো প্রেমিকার স্তনে দাঁত বসাইনি
প্রথম প্রেমিকারও নয়, যার
বুকের দুঃখি পরাগরেণু আজও গালে লেগে আছে
মায়ের তো দুধই হতো না অতিফর্সা বুকে, তাই
ছোড়দি কোলে করে নিয়ে যেতো
পাড়ার বউদের কাছে ; কাহার কুর্মি ডোম দুসাধ চামার
এমনকি দুস্হ মুসলমাননির এঁদো ভাঙাচোরা ঘরে
মায়ের স্তনে কিংবা সেইসব বউদের মাইয়েতে দাঁত
বসালে নির্ঘাৎ পাছায় চপেটা খেতুম–
তবে আজ ঘনদুধ খাই, সবুজ রক্তাভ নীল
শাড়িপরা যুবতীর মাই থেকে
টিপে টিপে দুই বেলা দুধ বের করি
শেষ ওব্দি শাড়িও খুলে ফেলে যেটুকু দুধ বাঁচে
তাও বের করে নিই ঘুম থেকে উঠে আর ঘুমোতে যাবার আগে
দাঁতকে ঝকঝকে করে তোলে ওনাদের দুধ
সেই বয়ঃসন্ধির পর যখন ভস্ম থেকে ছাড়া পেয়ে
টুথ পেস্ট টিউবের মাই থেকে
প্রতিদিন টিপে টিপে দুধ বের করি

 

স্বর্গবরাত – শুভঙ্কর দাস

স্বর্গের দিকে হাত বাড়াই, পোড়া হাত।
আঁচলের তলায় লুকিয়ে রাখা সুস্বাদু পাকা ফলের মুগ্ধতায়
বিলিয়ে দিয়েছি বুকের ভেতর জেগে থাকা দিন আর
চোখের ভেতর জমে ওঠা রাত!

কোথাও একটা যোগসূত্র আছে স্থূল কামনার আর
সূক্ষ্ম জন্মের—মাঝখানে ভাতকাপড়ের লড়াই!
বেঁচে থাকার ক্ষুধা ওঠে শরীরে শরীরে—শরীর তো আগুন
আর কয়েকটা শুকনো চ্যালাকাঠ !

তার ভেতর প্রবাহিত অদৃশ্য সময়ের কঠিনকরাত।

আঁচল আছে হাওয়ায়, শরীর আছে মায়ায়, হৃদয়ে যতই
জমুক হিংসার বমি করা বারুদ!

নির্বাক নিঃসঙ্গ ভালোবাসা শুধু দরজা খুঁজে বেড়ায়
নরকের আবার পুরাতন বা নতুন আর কী!

সহসা দরজা খুলে গেলে হাতের কাছে স্বর্গ, আশ্চর্য বরাত!

স্বর্গে এসে দাঁড়াই। বরাভয় হাত।