লিফট চালানো খুবই সহজ ব্যাপার। চেষ্টা করলে অল্প সময়েই শিখে নেওয়া যায় । আমার সুন্দর য়্যুনিফর্মটা আমার খুবই পছন্দ এবং যে মহিলারা আমার লিফটে ওঠানামা করে, তাদের চাহনির ধরণ থেকে বুঝি, তাদেরও পছন্দ। তাছাড়া নতুন নামটা আমার পছন্দ হয়েছিল। কাজের ধরণটাও মজার মনে হয়েছিল। কিন্তু যদিও ব্যাপারটা ছেলেখেলা, সামান্য বিরতির সময় বাদ দিয়ে সকাল সাতটা থেকে রাত বারোটা অবধি কাজ করা খুবই ক্লান্তিকর। এমন একটা দিনের শেষ লোকে দেহমনে ক্লান্ত হয়ে কোনমতে বিছানায় উঠে শুয়ে পড়ে। একনাগাড়ে ষোল ঘণ্টা। মধ্যে সংক্ষিপ্ত বিরতির সময়। লিফটম্যানরা তখন পালা করে রান্নাঘর ও ডাইনিং হলের মাঝমাঝি একটা খাওয়ার ঘরে ঢোকে। জঘন্য খাবার। বাসি, পচা, পাতকুড়োনো হাবিজাবি রান্না। জেলে ছাড়া অন্য কোথাও এতো জঘন্য খাবার আমি খাইনি। কাজের সময় তো ছোট্ট বন্ধ ঘরের ভেতরে, যেখানে হাওয়া লিফট যাত্রিনীদের ব্যবহৃত সেন্টের গন্ধে ভারী, সেই বন্ধ আবহাওয়ায় কন্ট্রোল চালু রাখতে হবে, ইনডিকেটর দেখতে হবে, নিৰ্দেশমত থামতে হবে, লোক তুলতে হবে, তাদের জায়গামত নামিয়ে দিতে হবে এরই মধ্যে ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলাদের নির্বোধ অসহিষ্ণুতা দেখে আমার অবাক লাগতো । যখন লবিতে ওঁরা অনর্গল ঘণ্টি বাজাতেন, ওঁরা খেয়ালও করতেন না যে আমি চারতলা থেকে একলাফে একতলায় নামতে পারনিা, আমাকে প্রত্যেক তলায় থামতে হবে, যাঁরা নামতে চান তাঁদের অভিবাদন জানিয়ে হাসিমুখে যেতে দিতে হবে ।
আমি একটু বেশী হাসতাম, বলতাম, ‘মসিয়ঁ ও মাদাম, সাবধানে পা ফেলবেন। যদিও ওসব বলা নিতান্তই নিষ্প্রয়োজন ছিল। কারণ প্রথম দিনেই শুধু লিফট থামাতে একটু ঝাঁকি দিয়েছি। তারপর আর কোন ভুল হয়নি। প্রৌঢ় ও বৃদ্ধা মহিলাদের হাত ধরে সাহায্য করতাম। ভাবটা এমনই যেন লিফট থেকে বের হতে ওঁদের কষ্ট হচ্ছে। বিনিময়ে পেতাম ঘাবড়ে যাওয়া চাউনিতে ধন্যবাদের ইঙ্গিত, কখনো বা বিষণ্ণতা মেশানো এক ধরণের ছেনালি, বয়স্কা মহিলাদের যুবকেরা ভদ্রতা দেখালে ওঁরা যে রকম ভাব দেখান, সেই রকম আর কি। কেউ কেউ আবার খুশী হয়েছেন বলে মনে হতনা। তাঁদের হৃদয় শীতল ও শূন্য। শ্রেণীগত অহংকার ছাড়া আর কোন অনুভূতি নেই। যুবতীদেরও আমি সাহায্যে করতাম। তারা লজ্জায় লাল হয়ে উঠে ধন্যবাদ জানালে আমার দৈনন্দিন কাজের একঘেঁয়েমি কেটে যেতো। আসলে আমার এইসব ভদ্রতার লক্ষ্য ছিল এমন একজন যুবতী, যার জুয়েল-কেসটা কিছুদিন আগে আমি চুরি করেছি এবং যার জুয়েলারী চোরাই মালের দোকান বেচে সেই পয়সায় আমি কিনেছি আমার বোতাম লাগানো নতুন জুতোজোড়া, আমার ছাতা, আমার পোষাক যুবতীর জন্যে আমাকে বেশীদিন অপেক্ষা করতে হয়নি।
দ্বিতীয় দিনে বিকেল পাঁচটা নাগাদ। আর একটা লিফটের লিফটম্যান ওষ্টাশ-ও লিফট থামিয়েছে একতলায়, ঠিক তখনই মাথায় হ্যাট ও স্কার্ফপরা সেই যুবতী এল । আমার সহকর্মীর চেহারাটা একেবারেই সাধারণ। তাই বড় বড় চোখে আমাকে দেখলো যুবতী, হাসলো, কোন্ লিফটে উঠবে তাই নিয়ে একটু দ্বিধা দেখালো এবং ওষ্টাশ হাত নাড়ছে দেখে এবার ওর লিফটের পালা ভেবে ওর লিফটে চড়ার সময় আমার দিকে তাকালো, চোখ দুটো আবার বড় বড় হলো। পরে ওষ্টাশের কাছে জানা গেল, মহিলা বিবাহিতা।
ওঁর নাম মাদাম হুপফ্লেহ্।
পরের দিন একই সময় —অন্য দুটো লিফট ওপরে উঠে গেছে, নীচের তলায় লিফটের সামনে একা দাঁড়িয়ে আছি আমি। যুবতী এল। ওর পরনে লম্বাঝুল, পশুলোমের তৈরী, দামী ও সুন্দর জ্যাকেট এবং একই রং-এর পশুলোমের টুপি। আমাকে দেখে ও খুসী হয়ে মাথা নাড়লো। আমি অভিবাদন জানিয়ে এমন গলায় ‘মাদাম’ বললাম, যেন নাচের আসরে ওকে পার্টনার হতে বলছি! আমার সঙ্গে আলোজ্বলা বন্ধ ঝুলন্ত ঘরে ঢুকলো মাদাম। ইতিমধ্যে চারতলা থেকে ভেসে এল ঘন্টির শব্দ।
‘তুমি তো নতুন, নাম আর্মাদ, তাই না?”
‘আপনার সেবক, মাদাম। ‘
‘তোমার গলার স্বরটা ভারী সুন্দর।’
চারতলার ঘণ্টি বেজেই চলেছে। আমরা দোতলায় উঠেছি। আমি বিনীতভাবে মহিলার কনুই ধরে লিফট থেকে বের হতে সাহায্য করলাম, যদিও সত্যিই তার কোন দরকার ছিল না।
‘মাদাম, আপনার অনুমতি পেলে প্যাকেটগুলো আপনার ঘরে বয়ে নিয়ে যেতে পারি।’
লিফট ছেড়ে প্যাকেটগুলো বয়ে নিয়ে করিডর বেয়ে মহিলার পেছন পেছন বিশ কদম এগিয়ে বাঁ দিকের তেইশ নম্বর স্যুইটে ঢুকলাম আমি। আমাকে বেডরুমে ঢুকতে বলা হয়। সাজানোগোছানো বেডরুম — হার্ড-উডের মেঝেতে পারস্য-গালিচা, চেরীকাঠের ফার্নিচার, টয়লেট টেবিলে অনেক ঝকঝকে জিনিষ, সাটিনের চাদরে ঢাকা পেতলের তৈরী চওড়া খাট, সিল্কের পর্দা। কাঁচঢাকা টেবিলে প্যাকেটগুলো রাখলাম আমি। পশুলোমের তৈরী জ্যাকেট খুলে যুবতী বলে—
‘আমার ঝি এখানে নেই। ও ওপরতলার ঘরে থাকে। তুমি আমার কোট খুলতে সাহায্য করবে?’
‘আনন্দের সঙ্গে।’
আমি বললাম। রেশমের লাইনিং দেওয়া পশুলোমের কোটটা ওর কাঁধ থেকে খুলছি, যুবতী আমার দিকে তাকালো। ওর মাথার চুল পুরু, রং বাদামী, কিন্তু সামনে চুলের কোঁকড়ানো একটা বলয়ের রং সাদা। চোখ দুটো একবার বড় হল, আবার ছোট। যেন ও স্বপ্ন দেখছে। যেন ও জলে ভেসে যাচ্ছে। ও বললো-
‘সামান্য চাকর হয়ে তোমার এতো সাহস যে তুমি আমায় উলঙ্গ করছো ?” “মাদাম, আপনার বর্ণনামাফিক কাজটা সম্পূর্ণ করার সময় আমার থাকলে কতো ভালো হত, ঈশ্বর জানেন—’
‘আমার সঙ্গে কাটাবার মত সময় তোমার নেই ?”
‘এই মুহূর্তে নেই, মাদাম। আমার লিফট অপেক্ষা করছে। ওপরতলায় ও নীচেরতলায় অনেক লোক লিফটের জন্যে ঘন্টি বাজাচ্ছে। হয়তো নীচের তলায় ভীড় জমে গেছে। আর দেরী করলে আমার চাকরী যাবে।’
“কিন্তু আমার সঙ্গে কাটাবার মত সময় তোমার হবে?’
‘অন্তহীন সময়, মাদাম ।’
‘কখন সময় হবে?’
কথা বলতে বলতে মহিলার চোখ বড় হয়, চোখের তারায় সেই স্বপ্নদেখা ভেসে-
যাওয়া দৃষ্টি, নীলচে ধূসর স্যুট পরা রমনী শরীর আমার কাছে আসে।
‘রাত এগারোটায় আমার ডিউটি শেষ হবে।’
‘আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করবো, কথা দিলাম।’
ও কি করতে যাচ্ছে বুঝতে পারার আগেই আমার মাথাটা ওর হাতে বাঁধা পড়লো
এবং আমার ঠোটে ঠোট রেখে চুমু খেলো মহিলা ।
প্রতিশ্রুতি দেওয়ার ধরণটা একটু অস্বাভাবিক বলা যেতে পারে।
ওর জ্যাকেটটা রেখে যখন আমি ওর ঘর ছেড়ে এলাম, আমাকে নিশ্চয়ই খুব ফ্যাকাসে দেখাচ্ছিল। লিফটের খোলা দরজার সামনে তিনজন লোক অবাক হয়ে অপেক্ষা করছে। অপ্রত্যাশিত একটা কাজে ডাক আসায় দেরী হয়েছে বলে ক্ষমা চাইলাম, ওদের নীচে নামাবার আগে চারতলায় লিফট তুলতে হল বলে ক্ষমা চাইতে হল। কিন্তু চারতলায় যে ঘন্টি বাজিয়েছিল তাকে পেলাম না। নীচে লিফট নামাতে কাজে গাফিলতির জন্যে কথা শুনতে হল। বললাম, একজন মহিলার মাথা ঘুরছিল বলে তাঁকে ঘর অবধি পৌঁছে দিতে হয়েছে।
মাদাম হুপফ্লেহ্-র মাথা ঘুরবে? কি সাহস মহিলার । আমার চেয়ে বয়স বেশী বলে এবং সমাজের উঁচুতলার বাসিন্দা বলে আমার থেকে বেশী সাহস।
‘সামান্য চাকর হয়ে এতো সাহস….’
—কি সুন্দর কথাটা বললো, যেন কবিতার মত—
‘তুমি আমায় উলঙ্গ করছো?”
উত্তেজনা-জাগানো কথাগুলো সারা সন্ধ্যা আমার মনে জেগে রইলো দুঘন্টা ধরে। যতোক্ষণ না আবার ওর সঙ্গে দেখা হল। ‘চাকর’ কথাটা আমাকে একটু আঘাত দিল, ‘কিন্তু ‘উলঙ্গ করা’, যে কথাটা আমি ভাবিনি, আমার যে উদ্দেশ্য ছিল বলে মহিলা ভেবেছে, কথাটা ভেবেই আমার গর্ব হল। তাছাড়া প্রতিশ্রুতি দেওয়ার বহরটা যেরকম— সন্ধ্যে সাতটায় আমার লিফটে চড়ে ডিনার খেতে নামলো মহিলা । তখন লিফটে অন্য লোকও ছিল। মহিলার পরণে এখন সাদা রেশমের অদ্ভুদ সুন্দর পোষাক, লেস লাগানো জামার এমব্রয়ডারী, কোমরে কালো সার্টিনের বেল্ট এবং গলায় ঝকঝকে উজ্জ্বল দুধ-সাদা সাচ্চা মুক্তোর নেকলেস। (দুর্ভাগ্য, জুয়েল-কেসটা চুরি করার সময় মুক্তোর হারটা ওর মধ্যে পাইনি।) একটু আগে অতো জোরে চুমু খাওয়ার পর এখন আর আমার দিকে তাকাচ্ছেই না মহিলা। আমার একটু খারাপ লাগলো ! প্রতিশোধ হিসেবে আমি ওর বদলে এক বিচ্ছিরি চেহারার বুড়ীকে হাত ধরে লিফট থেকে বের হতে সাহায্য করি।
ও হাসে ও কখন নিজের ঘরে ফিরেছে আমি জানি না। এগারোটার সময় আমার ছুটি হল। বাথরুমে ঢুকে সাফসুরো হয়ে নিলাম, তারপর সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় নামলাম। করিডরের লাল কার্পেটে পায়ের শব্দ হয়না। ২৫ নম্বরে বসবার ঘরের দরজায় ঘা দিয়ে শব্দ না পেয়ে আমি ২৩ নম্বরের বাইরের দরজা খুলে ভেতরের দরজায় আলতো টোকা দিলাম। একটু যেন অবাক হয়ে ভেতর থেকেও বললো— ‘এসো’। অবাক হওয়ার ধরণটাকে পাত্তা না দিয়ে আমি ভেতরে ঢুকি। সিল্কের শেড দেওয়া ল্যাম্প থেকে স্নান লালচে আলো ছড়িয়ে পড়েছে। প্রকাণ্ড ঝকমকে পেতলের খাটে লাল সাটিনের চাদরের নীচে সুন্দরী, হাত দুটো মাথার পেছনে জড়ো করা, পরণে খাটো ঝুল লেস-লাগানো ক্যাম্বিজের নাইট গাউন। রাতে শোবার আগে চুল খুলে মাথার চারপাশে টায়রার মত বেঁধেছে রূপসী। আমি ভেতরে ঢুকতেই দরজা বন্ধ হয়। বিছানা থেকে একটা তার টেনে দরজার ছিটকিণি খোলা বন্ধ করা যায়। সোনালী চোখদুটো একটু বিস্ফারিত হয়। লহমার জন্যে। যেন একটু নার্ভাস হয়ে বলে মহিলা—
‘একি, হোটেলের কর্মচারী, সাধারণ লোক শোয়ার পর আমার বেডরুমে ঢুকছে ?” ‘আপনি তাই চেয়েছিলেন, মাদাম। আপনার ইচ্ছেমতো—’
আমি খাটের কাছে যাই ।
‘আমার ইচ্ছে? মানে কোন মহিলা যেমন লিফটম্যানকে অর্ডার দেন ? আসলে তুমি বলতে চাইছো আমার নির্লজ্জ প্রতীক্ষা, তপ্ত কামনা, নগ্ন বাসনার কথা। তুমি দেখতে সুন্দর, বয়সে যুবক, স্বভাবে উদ্ধত। আমার ইচ্ছে? বলতো, তোমার ইচ্ছে কি আমারই ইচ্ছের মতো?’
তারপর সে আমার হাত ধরে বিছানার ধারে বসায়। ব্যালান্স রাখার জন্যে আমাকে হাত বাড়িয়ে বিছানার মাথার দিকটা ধরতে হয় ।
ফলে আমি লিনেন ও লেসে হাল্কাভাবে ঢাকা নগ্ন শরীরের ওপর ঝুঁকে পড়ি ও বারবার আমার সামান্য জীবিকার কথা বলছে কেন, আমি বুঝিনা। আমি ঝুঁকে পড়ে ওর ঠোঁটে ঠোঁট মেশাই, ওর দিক থেকে সহযোগিতার অভাব হয় না। ও আমার হাত ধরে হাতটা ওঁর পোষাকের ভেতর বুকের ওপরে নিয়ে যায়। ওর স্তন, আমার হাত—চমৎকার মিশে যায়। ও আমার হাতটা মনিবন্ধের কাছ ধরে এমনভাবে নাড়ায় যে, আমার পৌরুষ জেগে ওঠে। আমার পুরুষাঙ্গের দিকে তাকিয়ে খুসী হয়ে ও বলে—
‘সুন্দর যুবক, যে শরীর তোমার কামনা জাগিয়েছে, তার থেকে তুমি সুন্দর।’ তারপর সে দুহাতে আমার জ্যাকেটের কলার খোলে, আমার জামার বোতাম খুলতে খুলতে বলে—
‘খুলে ফেলো। সব বাধা দূরে যাক। যেন আমি দেবতার শরীর দেখতে পারি। তোমাকে প্রথম দেখার পর থেকে নগ্ন দেবতার বাহু আমি দেখতে চেয়েছি। এই তো! দেবতার মত বুক, কাঁধ, হাত। এবার প্যান্টটা খোলো বীরের মতো। এবার আমার কাছে এসো—’
কোনো মহিলাকে এতো সুন্দর কথা বলতে আমি কখনো শুনিনি। ওর কথা কবিতার মত। এবং আমি যখন ওর সঙ্গে রতিক্রিয়ায় মেতেছি, তখনও ও কথা বলে ।
এটা ওর স্বভাব। সব কিছু কথায় প্রকাশ করা।
“ওঃ, প্রিয়তম, প্রেমের দেবতা, বাসনার সন্তান, যুবক শয়তান, নগ্ন বালক, কাজটা
তুমি কি সুন্দর করতে পারো! আনন্দে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমার হৃদয়
ভেঙে যাচ্ছে। তোমার ভালোবাসা আমায় মেরে ফেলছে।’ আমার কানে, আমার ঘাড়ে, আমার ঠোটে ওর কামনার দংশন, চরম পুলকের মুহুর্ত কাছে আসতে ও হঠাৎ চীৎকাব করে ওঠে—
‘আমাকে তুই বলো। আমাকে আপন করে নাও, আমাকে নীচে নামাও। আমাকে অপমান করো।’
আমি আমার সুখ পেয়েছি, আমার যথাসাধ্য সুখ দিয়েছি। কিন্তু চরম সুখের মুহূর্তে ‘নীচে নামানোর’ কথাবার্তা বা আমাকে ‘বোকা চাকর’ বলা আমার ঠিক পছন্দ হয় না। আমার শরীরে চুমু খেয়ে ও বলে—
‘আমাকে তুই বলো। আমাকে এখানে শুয়ে সামান্য একটা চাকরকে আমার শরীর দিয়েছি। কি সুন্দরভাবে আমি নীচে নেমেছি। আমার নাম ডায়ানে। তুমি আমায় ও নামে ডেকো না ।
তুমি স্পষ্ট করে বলো—’মিষ্টি বেশ্যা!’….
‘মিষ্টি ডায়ানে !
‘না, বেশ্যা বলো। আমি নীচে নেমেছি, সেটা কথায় শুনতে চাই।’
“না, ডায়ানে, ওসব খারাপ কথা আমি বলতে পারবো না। আমার ভালোবাসা
তোমায় নীচে নামিয়েছে বলছো বলে আমার খারাপ লাগছে।’
‘তোমার না, আমার ! তুচ্ছ একটা ছেলে তুমি, নির্বোধ, সুন্দর, তোমার জন্যে আমার ভালোবাসা আমায় নীচে নামিয়েছে। আমি লেখিকা, বুদ্ধিজীবি। আমার নাম ডায়ানে ফিলবার্ট। আমার স্বামীর নাম হুপফ্লেহ্। হাস্যস্কর নাম। আমি আমার কুমারী নামেই লিখি। উপন্যাস, মনস্তত্বভিত্তিক, কামনাবসনা নিয়ে….হ্যাঁ, ডার্লিং, ডায়ানে বুদ্ধিমতী। এবং কিভাবে তোমাকে বোঝাই যে বুদ্ধিমতী সব সময় কামনা করে নির্বোধের সঙ্গ। যে জীবন্ত, সুন্দর কিন্তু নির্বোধ তাকেই নির্বোধের মত ভালোবেসে আত্মনিগ্রহ এবং নিজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকটা। যে দেবতার মত সুন্দর কিন্তু বুদ্ধিহীন, তারই সামলে হাঁটু গেড়ে বসে নিজেকে নীচে নামানোর, নিজেকে অপমান করার এই আনতে এমনই নেশা…. ‘
কিন্তু দেখতে ভালো হওয়ার কথাটা বাদ দিলেও….ডীয়ার চাইল্ড, আমি ততোটা বোকা নই, অবশ্য আমি তোমার লেখা উপন্যাস বা কবিতা পড়িনি “কি বললে? ডীয়ার চাইল্ড!” ঝড়ের মতো আমায় আঁকড়ে ধরে চুমু খায় ডায়ানে।
‘কি সুন্দর! ‘মিষ্টি বেশ্যা’ বলার থেকেও ভালো। প্রেমের শিল্পী, তুমি যা কিছু করেছো তার থেকে তোমার এই কথাটা আমায় বেশী আনন্দ দিয়েছে। আমি, ডায়ানে ফিলবার্ট, লেখিকা, বুদ্ধিজীবি—আমার পাশে উলঙ্গ হয়ে শুয়ে ছোট্ট একটা গিফটবয় বলছে, ‘ডীয়ার চাইল্ড’। সুন্দর, আশ্চর্য সুন্দর। তুমি বলছো, তুমি বোকা নও । তাই কখনও হয়। যেখানে সৌন্দর্য্য সেখানেই বুদ্ধির অভাব। কারণ মানুষের মনের দ্বারা মহিমান্বিত হয়ে উঠবে বলেই সৌন্দর্য্যের সৃষ্টি। এসো, আমি তোমাকে দুচোখ ভরে দেখি। মসৃণ, পেশীবহুল বুক, স্লিম্ হাত দুটো, কি সুন্দর পাঁজরাগুলো, সরু কোমর, পা দুটো হারমিসের পায়ের মতো—’ ‘থামো, ডায়ানে। আমারই উচিত তোমার রূপের প্রশংসা করা— ‘ননসেন্স! পুরুষদের এই একটা ভুল ধারণা। আমাদের মানে মেয়েদের শরীরের
বাঁকগুলো তোমাদের চোখে ভালো লাগে বলে আমরা খুসী হই। কিন্তু দেবতার মত সুন্দর, সৃষ্টির সুন্দরতম মাষ্টারপীস, সৌন্দয্যের আদর্শ হল পুরুষের শরীর। তুমি, যুবক, হারমিসের মত পা। তুমি কি জানো হারমিস কে? ‘সত্যি কথা বলতে কি সুন্দর! ডায়ানে ফিলবার্ট এমন একজনকে শরীর দিয়েছে যে গ্রীক উপকথার চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত নয়! কতো নীচে নেমেছি আমি। হারমিস ছিল চোরেদের দেবতা।’ আমি লজ্জা পাই। আমার মুখ লাল হয়ে ওঠে। তবে কি ও বুঝতে পেরেছে—
“তুমি কি বিশ্বাস করবে যে আমি শুধু তোমাকে অর্থাৎ তুমি নামের একটা আইডিয়াকে, একটা সুন্দর জীবন্ত আইডিয়াকে ভালোবেসেছি।’ তুমি এটাকে ব্যভিচার বলতে পারো, যৌনবিকার বলতে পারো, অন্যায় বলতে পারো। কিন্তু আমি বয়স্ক, দাড়িওলা, বুকে-লোম- গুলা পুরুষ, যাদের গুরুত্ব আছে, • সেই সব পুরুষকে ভালোবাসিনা। আমার নিজের গুরুত্ব আছে। সুতরাং ওইসব পুরুষের সঙ্গে শোয়াই হবে যৌনবিকারের চিহ্ন। প্রথম থেকেই আমি তোমার মত কমবয়সী ছেলেদের পছন্দ করি। যখন আমার তেরো বছর বয়স ছিল তখন আমি চোদ্দ বা পনেরো বছরের ছেলেদের ভালোবাসতাম। তোমার বয়স কত?’
“কুড়ি।” ‘তোমাকে আরও ছোট দেখায়। আমার পক্ষে তোমার বয়স বড্ড বেশী।” ‘বড্ড বেশী ? ” ‘শোনো, আমার এই ইচ্ছের সঙ্গে যে ব্যাপারটা জড়িয়ে আছে, তা হ’ল, আমি মা হইনি, আমার ছেলে হয়নি। আমার ছেলে হলে মানে মসিয়ঁ হুপফ্লেহ্ যদি ছেলের বাবা হতো, ছেলেটা সুন্দর হত কিনা সন্দেহ। তোমার জন্যে আমার কামনা আমার সন্তান কামনার একটা পরিবর্তিত রূপ। যৌনবিকার? তুমি তো তাই বলবে? কিন্তু বমনীর স্তন তোমার তৃষ্ণা মিটিয়েছে, রমনীর গর্ভ তোমাকে আশ্রয় দিয়েছে। তুমি কি তোমার অবচেতনে মাতৃস্তনের কাছে মাতৃগর্ভের কাছে ফিরে যেতে চাওনা ? তুমি কি তোমার স্ত্রীর মধ্যে তোমার মাকেই খোঁজনা। যৌনবিকার। প্রেম মানেই যৌনবিকার, খুঁজে দেখো, গভীরে যাও, প্রেমের আর কোন রূপ নেই! বয়স্কা রমনীর পক্ষে অল্পবয়সী ছেলেদের পছন্দ করার ব্যাপারটা ট্রাজিক, বেদনাদায়ক। বাস্তবে সম্ভব নয়, অন্ততঃ বিয়ে করা। আমি ধনী ব্যবসায়ী মসিয়ঁ হুপয়েকে বিয়ে করেছি। ওঁর ধনদৌলতের আশ্রয়ে আমি নিশ্চিন্তে উপন্যাস লিখতে পারি। তুমি আমার সঙ্গে যা সব করলে, মসিয় হুপফ্লেহ ও সব পারেন না। অবশ্য থিয়েটারের একটা মেয়ের সঙ্গে ওসব করেন। ভালোমত পারেন কিনা, আমার সন্দেহ আছে। তবেও ব্যাপারে আমি উদাসীন। এই পৃথিবী মেয়ে, পুরুষ, বিবাহ, ব্যভিচার—এসব ব্যাপারে আমি উদাসীন। আমি থাকি আমার তথাকথিত যৌবনবিকারের জগতে। আমার এই ভালোবাসার সুখ, দুঃখ, অভিশাপ নিয়ে । এই দৃশ্য পৃথিবীতে অল্পবয়সী পুরুষের শরীরের মত সুন্দর আর কিছু নেই। তোমার সুন্দর শরীর আমার কামনা জাগায় ! আমি আমার বুদ্ধি ও বিবেক ভুলে তোমাকে চুমু খাই। তোমার সাদা দাঁতের ওপরে উদ্ধত ঠোট দুটো হাসে। আমি চুমু খাই। তোমার পুরুষ-বুকের বৃত্ত তারার মত। সেখানে ঠোঁট রাখি। তোমার বগলের কালো চামড়ার ওপরে সোনালী লোম। সেখানে চুমু খাই। এসব কি করে হয় । নীল চোখ, ব্লও চুল, তুমি কোথা থেকে পেলে চামড়ার এই ব্রোঞ্জ রং? এই নেশার শেষ নেই। আমি মরে যাবো কিন্তু আমার আত্মা তার পিপাসা নিয়ে চিরদিন তোমায় ভালোবাসবে। তুমিও বুড়ো হবে কিন্তু আমার মনে এই শাস্তি থাকবে, তোমার প্রথম যৌবনের এই রূপ, সৌন্দর্য্যের এই সংক্ষিপ্ত আনন্দ, এই সুন্দর চঞ্চলতা, এই চিরন্তন মুহূর্ত চিরদিন বেঁচে থাকবে।
‘তোমার কথাগুলো কি অদ্ভুত ?”
‘কেন ? যাকে ভালোবাস, তাকে কবিতার প্রশংসা করলে তোমার অবাক লাগে ?” আমি ছোট ছেলের মত মাথা নাড়ি। এতো প্রশংসা এতো আদর, এতো কবিতা— আমি উত্তেজিত হয়ে উঠি। যদিও প্রথম আলিঙ্গনে আমি আমার সবকিছু দিয়েছি, আমার পৌরুষ আবার জেগে ওঠে। আমরা আবার শরীরে শরীর মেশাই। কিন্তু তা বলে আমি যে হীন, নীচ, সামান্য এবং ডায়ানে যে নীচে নামছে, সে কথা ভোলেনা আমার প্রেমিকা।
আর্মাদ, আমাকে পিষে ফেলো। আমি তোমার দাসী। সামান্য একটা ঝিকে যেভাবে ব্যবহার করবে, সেইভাবে আমায় ব্যবহার করো। তাই আমার স্বর্গ।…আর্মাদ, আমাকে মারো, খুব মারো, বেল্ট খোলো, চাবুক মারো, রক্ত ঝড়াও….’
‘আমি সে রকম প্রেমিক নই, ডায়ানে—’
“কি লজ্জা! তুমি মহিলাকে সম্মান দেখাচ্ছো—’
‘শোনো, ডায়ানে, একটি কথা স্বীকার করছি। তুমি যা চাইছো, তার বদলে— কিছুটা ক্ষতিপূরণ হিসেবে। তোমার ব্যাগে একটা জুয়েল কেস ছিল। কাস্টমসে তুমি আর আমি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি তোমার ব্যস্ততার সুযোগে তোমার জুয়েলারী চুরি করেছি!
“তুমি চুরি করেছো ? তুমি চোর! কি আনন্দ, কি আনন্দ। আমি চোরের সঙ্গে শুয়ে আছি। শুধু সাধারণ একটা লিফটবয়ের সঙ্গে নয়, একটা চোরের সঙ্গে!’
“আমি জানতাম, তুমি খুশী হবে। কিন্তু তখন আমি একথা জানতাম না। জানতাম না যে আমরা একদিন পরস্পরকে ভালবাসবো। নাহলে আমি তোমার টোপাজ-বসানো জুয়েলারী ও হীরেগুলো চুরি করে তোমায় দুঃখ দিতাম না।’
‘দুঃখ ? আমার ঝি ওটা খুঁজেছিল বটে। আমি দু সেকেণ্ডের জন্যেও ওগুলোর কথা ভাবিনি। আমার স্বামী কাল আসছে। সে দারুণ বড়লোক। ওর কোম্পানী বাথরুমের টয়লেট তৈরী করে, সবারই দরকার হয় ওটা। হুপক্ষের টয়লেট, খুব চালু, সারা পৃথিবীতে রপ্তানী হয়। বিবেকের দংশন এড়াতে স্বামী আমাকে এইসব জুয়েলারী দেয়। তুমি যা চুরি করেছে, তার থেকে তিনগুণ সুন্দর জিনিস ও আমায় দেবে। ওগুলোর চেয়ে অনেক বেশী দামী সেই চোর যে চুরি করেছে। চোরের দেবতা হারমিস! আমাদ ?” “বলো”।
“ভালো একটা আইডিয়া মাথায় এসেছে। তুমি এই ঘরে আমার গয়না চুরি করবে। আমার আরও গয়না আছে। কাপবোর্ডের ডানদিকের ড্রয়ারে ব্যুরোর চাবি । আমার নাইটড্রেসের নীচে গয়না। টাকাও আছে। বেড়ালের মত চুপি চুপি পা ফেলে ইঁদুর ধরো। এইটুকু করবে না? তোমার ডায়ানের জন্যে ?”
‘ডীয়ার, কাজটা ঠিক ভদ্রলোকের মত হবে না। তোমার সঙ্গে এইসবের
‘বোকা! এই হবে আমাদের ভালোবাসার অপূর্ব সমাপ্তি!’
‘কাল যখন মসিয়ঁ হুপয়েহ আসবেন—’
‘আমার স্বামী? ওকি বলবে? আমি উদাসীন ভঙ্গীতে জানাবো, ওখানে আসার সময় রাস্তায় সব চুরি হয়ে গেছে। বড়লোকের বউরা অসাবধান হলে ওসব হয়। চোর তো সড়ে পড়েছে। স্বামীর ব্যাপারটা আমার ওপরই ছেড়ে দাও—’ “কিন্তু ডায়ানে, তোমার চোখের সামনে—’
‘বেশ, আলো নিভিয়ে দিচ্ছ। এখন আমি তোমায় দেখতে পাচ্ছি না। শুধু শুনতে পাবো চোরের আস্তে পা ফেলার শব্দ, চোরের নিঃশ্বাসের শব্দ, চোরের হাতে গয়নার ঝুনঝন আওয়াজ। যাও, ওঠো, আস্তে আস্তে, খুঁজে নাও, চুরি করো। এই আমার ইচ্ছে।’
এবং আমি ওর আদেশই মামলাম। সাবধানে উঠে আমি সব নিলাম। চুরির কাজটা খুবই সোজা হল। টেবিলের উপর ছোট্ট ডিশে এর আংটি এবং মুক্তোর নেকলেস। অন্ধকারেও কাপবোর্ডে ব্যুরোর চাবি খুঁজে পেতে কোন ঝামেলা হল না আমার। আমি প্রায় নিঃশব্দে ড্রয়ার খুললাম।
কয়েকটা নাইটড্রেসের নীচে—জুয়েলারী, পেনড্যান্ট, ব্রেসলেট, ব্রুচ, বেশ কিছু টাকা। সব নিয়ে আমি ওর বিছানার পাশে এলাম। যেন ভদ্রতার খাতিরে। যেন ওর জন্যেই এইসব এনেছি।
‘বোকা, তুমি কি করছো? এই তোমার ভালোবাসা ও তোমার চুরির লাভ। সব পকেটে পড়, পোষাকে ঢোকাও, পালিয়ে যাও! তাড়াতাড়ি পালাও, পালাও! আমি সব শুনেছি, চুরির সময় তোমার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনেছি। এইবার আমি পুলিশে ফোন করবো। কিম্বা না করাই ভালো। তোমার কি মনে হয় ঐ তুমি কতো দূরে? কাজ শেষ ? প্রেমিক ও চোরের শরীরে তখন লিফ্টবয়ের য়্যুনিফর্ম, তাই না? তুমি আমার বাটন-হুক চুরি করোনিতো ?
না, এইতো রয়েছে। বিদায়, আর্মাদ। বিদায়, বিদায়, চিরদিনের জন্যে বিদায় । তোমার ডায়ানেকে ভুলো না। তার স্মৃতিতেই তুমি বেঁচে থাকবে। অনেক বছর পরে, যখন তুমি-আমি দুজনেই কবরের আড়ালে, তখনও জেগে থাকবে স্মৃতি…. তোমার ঠোট আমায় চুমু খেয়েছিল, পৃথিবীর কেউ জানবে না… বিদায়, বিদায় প্রিয়তম….