—আপনিই তো ওকে বলেছিলেন, ধ্যাড়ানির সময়ে করলে বিপদ নেই। বলেননি? এই চিঠিটা দেখুন, শুধু দেখুন, ছোঁবেন না। এটা আপনার হাতের লেখা তো?
ভাগ্যিস ধ্যাড়ানি শব্দটা ব্যবহার করেছে। মাসিক বা মেন্স বললে বিহারি কর্মচারীগুলো টের পেয়ে যেতো।
অরিন্দম অবশ্য টের পেয়েছে; মাথা নামিয়ে কলম হাতে ব্যস্ত থাকার অভিনয় করছে। পাগল হয়ে কয়েকমাস লুম্বিনী পার্কে ভর্তি ছিল। পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশি ট্যুরে গেলে তার বউকে চটকাবার জন্য লাঞ্চের সময়ে বাড়ি যাচ্ছি বলে কেটে পড়ত অরিন্দম। ওকেও ধ্যাড়ানির আইডিয়াটা দিয়েছিলুম, কিন্তু বউটা অতোটা এগোতে দেয়নি; বলেছিল, “শুধু ওপর-ওপর বোলাও”। ব্যাস পাগল হয়ে গেল। অফিসের নারী-নারকোটিক গ্যাঙ ওকে বলেছিল, “আরে অন্যের বউকে ছেড়ে আমাদের দলে এসো, ফি-হপ্তায় নতুন মাল।”
যায়নি। প্রেমে ফেঁসে হালুয়া টাইট।
চিঠিটা ছোঁ মেরে কেড়ে নেবার তালে ছিলুম, বুঝতে পেরে ভাঁজ করে বাঁ হাতে পাট করে রাখলো আলেয়া। বলল, “এটা আপনার মা-বাবাকে দেখাবো, ওনারা বিশ্বাস করবেন যে চিঠিটা আপনি আমাকে লিখেছেন, কেননা আপনার বিখ্যাত কবিতায় আমার নামও আছে। আপনার কবিতা ফটোকপি করে আপনার বন্ধু বিলি করেছিল অফিসে। সবাই পড়েছে।”
বাঞ্চোৎ নিশীথ! আমি কলকাতায় মামলা লড়ছি, রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করছি। রাতে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজছি আর ও ব্যাটা আমার কবিতাটা যোগাড় করে ফটোকপি করে বিলিয়েছে। অফিসেই ফটোকপির মেশিন রয়েছে, তাই যতো ইচ্ছে কপি করে বাঙালি কর্মচারীদের মধ্যে বিলি করেছে। আর আমি ফিরে কাজে যোগ দিতেই আমাকে দিয়ে প্রেমিকাকে প্রেমপত্র লিখিয়েছে। আলেয়ার চিঠিটা আট পাতার; একই সঙ্গে আত্মহত্যার হুমকি আর বিয়ে করার কাঁদো-কাঁদো প্রস্তাব।
নিজের নিঃশব্দ সংলাপ গিলে ফেলি: “ইডিয়টটা আমার চিঠিটা কপি করার বদলে অরিজিনালটায় সই করে পাঠিয়ে দিয়েছে; হিন্দি স্কুলে পড়ে দু’পাতা বাংলা লেখাও কপি করতে পারেনি। বলেছিলুম, কপি করে আমার চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলে দিও।”
—আপনি আমাকে বিয়ে করুন। সক্কোলে বিশ্বাস করবে এই প্রেমপত্রটা আপনিই আমাকে লিখেছেন। আপনার বাবা-মা পাত্রী খুঁজছেন তো? আমিই পাত্রী।
বলে কী মেয়েটা!
—আপনি নিশীথের চেয়ে হাজারগুণ ভালো পাত্র। নিজেদের বাড়ি আছে। মাইনেও অনেক পান। আমাদের পরিবারের মতন আপনিও ঘটি। শুনেছি সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বংশধর।
কন্ঠস্বরে ভারিক্কি অফিসারগিরি এনে বললুম, “দ্যাখো আলেয়া, এটা তোমার আর নিশীথের ব্যাপার, আমাকে অযথা টেনে আনছো এর মধ্যে। হাতের লেখা আমার, স্বীকার করছি, কিন্তু চিঠিটা নিশীথ লিখেছে তোমাকে, তোমার আটপাতা চিঠির উত্তরে। ও তো বলেইছে যে তোমাকে বিয়ে করবে। তোমাদের বাড়িতে যাবেন ওর বাবা-মা।”
নিশীথ ব্যাটা সত্যিই কালো। বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে কথা বলে। ভাড়া বাড়িতে থাকে।
—-না, আমি আপনাকেই বিয়ে করব। আপনার কবিতায় আমার নাম আছে। সেই আলেয়া কে তা আমার জানার দরকার নেই। আমি শিয়োর, আপনার বাবা-মা সেই আলেয়াকে চেনেন না, কিন্তু আমাকে চিনবেন। আমি আপনার অধস্তন কর্মচারী। ওনারা মেনে নেবেন যে আপনি আমাকে এক্সপ্লয়েট করেছেন।
ওফ, ভাগ্যিস সেক্সুয়ালি এক্সপ্লয়েট করেছেন বলেনি। সবকটা বিহারী কর্মচারী আমাদের কথাবার্তা টের পেতে চাইছে।
—আপনিই তো লিখেছেন, “অথচ আমি চেয়েছিলুম আলেয়ার নতুন জবার মতো যোনির সুস্থতা”। কী? লেখেননি? আপনার পুরো কবিতাটা আমার মুখস্হ। শুধু আমার কেন, অনেকেরই মুখস্হ। এখন আপনিই ঠিক করুন কী করবেন।
অরিন্দম উঠে বাইরে চলে গেল। ভালো হলো।
একটু পরে ফিরে এলো অরিন্দম; সঙ্গে নিশীথ।
আলেয়ার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো নিশীথ, “আরে কী করছ কি! মলয়দাকে ভড়কি দিচ্ছ কেন? তুমি তো জানো আমি ভালোভাবে বাংলা লিখতে পারি না।
মলয়দাকে দিয়ে তোমার চিঠির উত্তর লিখিয়েছিলুম।
আলেয়ার হাত থেকে চিঠিটা কেড়ে নিয়ে আমাকে দিয়ে নিশীথ বলল, “নাও, নাও, আবার কোন বিপদে পড়বে।”
চিঠিটা নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিলুম ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে।
আলেয়ার হাত ধরে ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল নিশীথ।
পেছন ফিরে আলেয়ার হাসি মনে আছে আজও।
নারীর হাসিও আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে।
একটা কবিতা লেখার কতোরকমের যে প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা কবিরা নিজেরাই জানে না!