ঋষ্যশৃঙ্গ ও শান্তা – (রামায়নী প্রেমকথা) – সুধাংশরঞ্জন ঘোষ

›› পৌরাণিক কাহিনী  ›› সম্পুর্ণ গল্প  

প্রচণ্ড মার্তণ্ডতাপে শুধু অঙ্গদেশ নয়, সমস্ত পৃথিবীটাই যেন জ্বলছে। গ্রীষ্ম অপগত হয়ে কখন বর্ষা এসেছে ; তবু রক্ত কুরুবক বা কদম্ব গাছে ফুল ফোটে না। নদীর জলে ঢেউ দেয় না। দক্ষিণের সুমেরু পর্বত হতে মলয় বাতাস বয়ে আসে না। বর্ষার মেঘহীন নীলাকাশ হতে জল বর্ষিত হয় না; সূর্য শুধু অগ্নিবৃষ্টি করে।

রাজপ্রাসাদের একটি শীতল কক্ষের গবাক্ষ থেকে রাজকুমারী শান্তা চারিদিকে চেয়ে চেয়ে দেখেন আর দুঃখে তার বুক ফেটে যায়। মাঝে মাঝে কাদতে ইচ্ছা করে শান্তার। মনে হয় তার অফুরন্ত অশ্রুর প্লাবন দিয়ে দগ্ধ পৃথিবীর সব জ্বালা জুড়িয়ে দেন। সারা রাত্রি মধ্যে একটুও ঘুম আসে না তার। শুক্লা তিথিতে চাদের আলােয় জ্বালা অনুভব করেন আর কৃষ্ণাতিথিতে মেঘহীন আকাশের অসংখ্য নক্ষত্র এক একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে বিধতে থাকে যেন তার বুকে। 

একদিন সকালে দাসীর কাছে অদ্ভুত একটা কথা শুনলেন শান্তা। শুনে বিস্মিত এবং বেদনার্ত দুইই হলেন। রাজ্যের সমস্ত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা এই ভয়ঙ্কর অনাবৃষ্টির জন্য রাজা লােমপাদকেই দোষ দিচ্ছেন। তারা বলছেন, রাজকন্যা ঋতুমতী হওয়া সত্ত্বেও রাজা অনুঢ়া রেখে দিয়েছেন তাকে। ঋতুমতী কন্যাকে অনুঢ়া রেখে দেওয়া প্রাণহত্যার মতােই মহাপাপ। রাজা কোনাে পাপ করলে রাজ্যের সমস্ত প্রজাদের উপর সে পাপ অর্শায়। তাই আজ রাজার পাপেই রাজ্যের এই ঘাের দুরবস্থা। 

বেদনায় অস্থির হলাে শান্তার হৃদয়। সখীদের সব বিদায় করে দিয়ে ভাবতে লাগলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, এক নিদারুণ প্রখরতায় তার বুকের ভিতরটা জ্বলছে। কিন্তু শুধু মন জ্বললেই হবে না, যে জ্বালায় সমস্ত দেশ জ্বলছে সেই জ্বালা সারা অঙ্গে মেখে নিঃশেষে দগ্ধ হয়ে যেতে চান তিনি। শান্তা ঠিক করে ফেললেন, আজই গভীর রাত্রিতে সকলের অলক্ষ্যে জ্বলন্ত আগুনে প্রাণ বিসর্জন দেবেন। 

সহসা শান্তা দেখলেন, রাজা লােমপাদ স্বয়ং মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন তার ঘরের বাইরে। শশব্যস্ত হয়ে উঠে গিয়ে পিতার চরণবন্দনা করলেন শান্তা। তারপর শান্তকণ্ঠে বললেন, আপনি যা বলবেন আমি তা জানি মহারাজ। আমি বুঝতে পেরেছি আমার জন্যই দেশের এই ঘাের দুরবস্থা। তাই আমি আর এই অভিশপ্ত জীবন রাখতে চাই না। 

কাছে সরে গিয়ে শান্তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে রাজা বললেন, না মা, আমি সম্পূর্ণ অন্য কথা বলতে এসেছি তােমায়। জ্যোতিষীরা বলছেন, এই ভয়ঙ্কর অনাবৃষ্টির হাত থেকে দেশকে বাঁচানাের একটি মাত্র উপায় আছে এবং সেই উপায়ের সার্থকতা নির্ভর করছে একমাত্র তােমার উপর। 

অপরিসীম বিস্ময়ে হতবাক হয়ে মুখ তুলে চাইলেন শান্তা। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, আমি আগেই বলেছি পিতা, আমার এই অভিশপ্ত জীবনে আমার কোনাে আগ্রহ নেই। আমায় কি করতে হবে বলুন। দেশকে বিপদ হতে উদ্ধার করবার জন্য আমি আমার এ জীবন যেকোনাে মুহূর্তে হাসিমুখে ত্যাগ করতে পারি। 

আশ্বস্ত হলেন রাজা লােমপাদ। তারপর খুশি হয়ে বললেন, তার প্রয়ােজন হবে না মা। তুমি হয়ত ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির নাম শুনে থাকবে। বিভাণ্ডক মুনির একমাত্র পুত্র মহাতেজা ঋষ্যশৃঙ্গ। নর্মদা নদীর তীরে তার পােবন। মুনির ঔরসে কোন্ এক হরিণীর গর্ভ হতে তার জন্ম হয় বলে তিনি রূপে গুণে ঋষিকুমারতুল্য হলেও মাথার দুই পাশে দুটি ক্ষুদ্র মৃগশৃঙ্গ আছে। রাজজ্যোতিষীরা ও ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা বলেছেন, সেই ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে এ রাজ্যে না আনলে অনাবৃষ্টি ঘুচবে না। আমি তাই মনস্থ করছি তাকে এখানে সসম্মানে এনে তােমার সঙ্গে তাঁকে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করব। 

শান্তাও অনেকখানি আশ্বস্ত হয়ে বললেন, এ তাে সুখের কথা মহারাজ। এর জন্য আপনি কুণ্ঠাবােধ করছেন কেন? আমি দেশের মঙ্গলের জন্য পশুশৃঙ্গযুক্ত ঋষিকুমার কেন স্বয়ং পশুকেও বিবাহ করতে পারি। আপনি কোনরূপ বিচলিত না হয়ে তাকে আসার ব্যবস্থা করুন।

হৃষ্টমনে ফিরে যাচ্ছিলেন রাজা লােমপাদ। তবু একবার ঘুরে এলেন। শান্তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, আমার শুধু একটা বিষয়ে কুণ্ঠা হচ্ছিল মা। তুমি বিবাহযােগ্য হয়েছ বলে আমি স্বয়ংবর সভার কথা ভাবছিলাম। কত রূপবান রাজপুত্র তােমার পাণিপ্রার্থী। কিন্তু তাদের সকলকে প্রত্যাখ্যান করে পশুশৃঙ্গযুক্ত একজন তপস্বীকে গ্রহণ করতে কী করে বলব তােমায় তাই ভাবছিলাম।

শান্তা একটুখানি হাসলেন। এক সকরুণ মূৰ্ছায় রক্তরাঙা সে হাসি। তার ঘনকৃষ্ণ বিশাল অক্ষিযুগলের দুই কোণে সেই হাসির দুটি ক্ষীণ রেখা কাপতে লাগল। তিনি মুখ তুলে বললেন, আপনি আমায় এতদিন ধরে যে শিক্ষা দিয়েছেন সে কি মানুষকে তার উপরের রূপ দেখে বিচার করবার শিক্ষা? 

আনন্দ ও লজ্জায় মুখ থেকে কথা বেরােল না লােমপাদের। তিনি বুঝলেন, শান্তা সাধারণ মেয়ে নয়। ধর্ম দর্শনশাস্ত্র পাঠ করে তার নীতিজ্ঞান হয়ে উঠেছে প্রখর। মাথা হেঁট করে রাজা সেখান থেকে রাজসভায় চলে গিয়ে পরামর্শ করতে লাগলেন মন্ত্রীদের সঙ্গে।

সেদিন রাত্রে বেশ সুনিদ্রা হলাে শান্তার। এক বড় রকমের দুশ্চিন্তার ভার হতে মুক্ত হলেন তিনি। অনেক দিন ধরে আকাশে মেঘ দেখেননি শান্তা। সবুজের চিহ্ন দেখতে পাননি মাটিতে। কিন্তু আর কিছুদিন পরেই শ্যামলবরণ মেঘে মেঘে ছেয়ে উঠবে ঐ জ্বলন্ত তাম্রবর্ণ আকাশখানা। শীতল বৃষ্টিধারা ঝরে পড়বে তাপদগ্ধ মাটির উপর। দিকে দিকে শুকিয়ে যাওয়া প্রাণ সজীব হয়ে উঠবে আবার। আনন্দে চোখে জল এলাে শান্তার।

স্বেচ্ছায় সব ভােগ সুখ ত্যাগ করলেন শান্তা। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, যতদিন না সেই পুণ্যাত্মা ঋষিকুমার এসে পৌছবেন এই রাজ্যে, নবজলধারায় সিক্ত না হয়ে উঠবে এ দেশের তৃষ্ণার্ত ভূমি ততদিন ব্রহ্মচর্য পালন করবেন।

কিন্তু কিভাবে আনা যায় তা নিয়ে মহা ভাবনায় পড়লেন রাজা লোমপাদ। অনেকে বলল, জন্মের পর হতে কোনাে নারী দেখেননি ঋষ্যশৃঙ্গ। স্ত্রী পুরুষে ভেদ জানেন না তিনি। সুতরাং কোনাে সুন্দরী নারী দেখে তার পক্ষে বিচলিত হওয়া স্বাভাবিক। 

বিভাণ্ডক মুনির অনুপস্থিতিতে আশ্রমে গিয়ে ঋষ্যশৃঙ্গকে প্রলুব্ধ করে আনবার জন্য রাজ্যের সুন্দরী বারবনিতারা মনােহর বেশভূষা পরে রওনা হলাে। 

শান্তা কিন্তু কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারলেন না এই ব্যবস্থায়। উদ্দেশ্য পূরণ করতে চান না তিনি। তার ইচ্ছা ছিল তিনি এক কঠোর ব্রতচারিণীর বেশে নিজে গিয়ে নিয়ে আসবেন সেই ঋষিকুমারকে। বৃদ্ধ বিভাণ্ডককে লুকিয়ে তার শেষ বয়সের সম্বল একমাত্র সন্তানকে চুরি করে নয়, গুণের দ্বারা পিতাকে মুগ্ধ ও বিনয়ের দ্বারা বশীভূত করে তার কাছ থেকে তার পুত্রকে ভিক্ষা করে আনতে চেয়েছিলেন তিনি। নারীদেহের লােভনীয়তা, রূপের জৌলুস ও অলংকারের আতিশয্য দিয়ে ঋষ্যশৃঙ্গের মনকে কৌশলে ভুলিয়ে আনতে চাননি তিনি। তিনি চেয়েছিলেন তার অখণ্ড অন্তরের অনন্ত প্রেমসাধনার দ্বারা ধীরে ধীরে তার হৃদয়কে জয় করে আনতে।

কিন্তু তিনি যা চেয়েছিলেন তা আর হলাে না। লজ্জায় তার মনের কথা বলতে পারেন নি কাউকে। তছাড়া মনের একটা গােপন আশা আর আনন্দ একেবারে বিনষ্ট হয়ে গেল শান্তার। কারণ তিনি ভেবেছিলেন, ঋষ্যশৃঙ্গই পৃথিবীতে একমাত্র পুরুষ যিনি জন্মের পর হতে কখন কোনাে নারীমুখ দেখেননি, কোনাে নারীদেহ স্পর্শ করেননি। এই ধরনের এক পরুষকে প্রথম পাবার সৌভাগ্য হবে তার। তিনিই হবেন ঋষ্যশৃঙ্গের জীবনে প্রথম নারী যাকে তিনি প্রথম দেখবেন ; প্রথমা স্পর্শ করবেন ; প্রথম ভালবাসবেন।

নবজাত শিশুর মতাে সরল পূতচিত্ত এক পুরুষ এসে তার শুচিশুদ্ধ দেহের আজন্ম-সঞ্চিত শক্তি আত্মার সমস্ত সম্পদ সুষমা দিয়ে তিলে তিলে পূর্ণ করে তুলবে তাঁকে। একথা ভাবতেই অনাস্বাদিতপূর্ব এক গর্ব ও গৌরব অনুভব করতেন শাস্তা।

এখন আর কোন উপায় নেই। অভিমানে তার চোখ অশ্রুভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। তার এই নিবিড় অব্যক্ত অভিমান, নিষ্ফল বেদনার কথা কাকে তিনি বলবেন। এখন আর বলেও কোনাে ফল হবে না।

পর পর তিনটি দিন কেটে গেল। দিনেতে আতপান্ন আর রাত্রিতে কিছু ফলমূল আহার করে স্বর্ণপর্যঙ্ক ছেড়ে ভূমিতলে শয়ন করতে লাগলেন শান্তা। 

সহসা একদিন গভীর দ্বিপ্রহরে অসংখ্য শঙ্খ বেজে উঠল একসঙ্গে। মুহুর্মুহু হুলুধ্বনিতে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল সমস্ত আকাশ বাতাস। এক বিরামহীন ব্যস্ততায় উন্মত্ত হয়ে উঠল সমগ্র রাজধানী। সেই আশ্চর্য ঋষিকুমার এসে গেছেন। একজন সখী এসে খবর দিল স্বয়ং রাজা লােমপাদ অমাত্যদের নিয়ে নগরপ্রান্তে এগিয়ে গেছেন তার চরণ বন্দনা করে তাকে নিয়ে আসতে।

চারিদিকে সবাই ছুটোছুটি করছে। প্রাসাদশীর্ষ ও গবাক্ষপথ হতে রাজঅন্তঃপুরবাসিনীরাও একদৃষ্টে পথপানে চেয়ে আছেন। একমাত্র শুধু শান্তার মধ্যেই কোনাে চঞ্চলতা নেই। 

শুয়ে ছিলেন। সখীর কথায় উঠে বসলেন শান্তা। তারপর স্থির অচঞ্চল দৃষ্টিতে দেওয়ালের উপর টাঙ্গান একটি মৃগশৃঙ্গের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন। রাজা নিজে একদিন এ মৃগটিকে বন হতে শিকার করে এনেছিলেন। ঐ শৃঙ্গযুক্ত একটি অদ্ভুত মানুষের অঙ্কশায়িনী হতে হবে তাকে। ভাবতেই ভয়ে শিউরে উঠলেন শান্তা। 

আরও হয়তাে অনেক কথাই ভাবতেন শান্তা। কিন্তু এক প্রবল মেঘগর্জনে সচকিত হয়ে উঠলেন সহসা। বাইরে চেয়ে দেখলেন, পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ জমেছেআকাশের প্রতিটি দিগন্তে। স্নিগ্ধ বাতাস বইতে শুরু করেছে। একটু পরেই বৃষ্টি আসবে। বহুআকাঙিক্ষত বহু প্রতীক্ষিত প্রাণসঞ্জীবনী বৃষ্টিধারা।

মুহূর্তে সমস্ত ভয় ভাবনা কোথায় উবে গেল শাস্তার। ভয় পরিণত হয়ে উঠল ভালবাসায়। ভাবনা হলাে প্রেমসাধনা। যাকে একটু আগে ভয় করছিলেন এখন তাকে ভালবাসতে ইচ্ছা হলাে সব চাইতে বেশি। বকুটিল মৃগশৃঙ্গকে মনে হলাে, পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর বস্তু। ধূসর মেঘপুঞ্জে, তাম্রবর্ণ পবর্তশিখরে, শ্যামল বৃক্ষশাখায় শুধু আশ্চর্য সুন্দর এক মৃগশৃঙ্গ দেখতে লাগলেন যেন তিনি।

তিনদিন রাজা লােমপাদের বিশেষ অতিথি রূপে রইলেন ঋষ্যশৃঙ্গ। তিন দিনই থেকে থেকে প্রবল বর্ষণ হলাে। চতুর্থ দিনে ঋষ্যশৃঙ্গের হাতে শান্তাকে সম্প্রদান করলেন রাজা। বিয়ের যৌতুক স্বরূপ রাজধানীর বাইরে কয়েকটি গ্রাম দান করলেন ঋষ্যশৃঙ্গকে।

বীভৎস কিছু একটা দেখবার ভয়ে শুভদৃষ্টির সময় চোখ খুলছিলেন না শান্তা। এদিকে শান্তার রূপে মুগ্ধ হয়ে তার পানে একদৃষ্টে তাকিয়েছিলেন ঋষ্যশৃঙ্গ। শ্যামবর্ণা শান্তা খুব একটা সুন্দরী নন, কিন্তু তার চোখ মুখ বড় সুন্দর। মৃগলােচনা শান্তার ভংঙ্গিমাটি বড় লীলায়িত। রুক্ষকঠোর ব্রতচারিণী আলুলায়িত-কেশা বিশালাক্ষী শান্তার এক আশ্চর্য রূপের রহস্যে সমস্ত মন প্রাণ যেন নিঃশেষে ডুবে গেল ঋষ্যশৃঙ্গের। এর আগে যে সব সুন্দরী নারী তিনি দেখেছেন অর্থাৎ যারা তাকে এখানে নিয়ে এসেছে, তারা বড় চঞ্চল আর চটুল। 

শান্তার মতাে তারা সৌম্য শান্ত এবং গম্ভীর নয়। তাদের রূপ বিস্ময় আর এক জারজ লালসা জাগিয়েছিল ঋষ্যশৃঙ্গের মনে। শান্তার রূপ এক গভীর প্রেমবােধ জাগাল তার অন্তরে। তারা মায়াবিনী, হাতছানি দিয়ে দূরে টেনে নিয়ে যায়। শান্তা প্রেম-প্রদায়িনী, প্রেমােপলব্ধির গভীরে নিয়ে গিয়ে মন প্রাণকে সংহত করে। সেই সব নারীদের দেখে ঘর ছেড়ে পথে বেরিয়ে পড়েছিলেন কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে ; আজ শান্তাকে দেখে আবার ঘর বাঁধতে ইচ্ছা হলাে তার। 

এদিকে ভয়ে ভয়ে চোখ খােলার সঙ্গে সঙ্গে শান্তাও মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি যা ভয় করছিলেন, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। তার মনে হলাে যে কোনাে রাজপুত্র হার মেনে যাবে ঋষ্যশৃঙ্গের রূপের কাছে। তপ্ত কাঞ্চনের মতাে গৌরকান্তি। এক অপরূপ জ্যোতিতে সমস্ত মুখমণ্ডল স্বতােভাসিত। ঘনকৃষ্ণ কেশপাশ চুড়ার আকারে মাথার উপর বাঁধা। কপালের দুপাশে অতিশয় ছােট আকারের মৃগশঙ্গতুল্য দুটি পদার্থ। তার জন্য মুখশােভা কিছুমাত্র ক্ষুন্ন হয় নি তার। 

ভুল ধারণার জন্য মনে মনে লজ্জিত হলেন শান্তা।
পরদিন কালরাত্রি বলে দুজনকেই পৃথক থাকতে হলাে। কোনাে কথা হলাে না। ফুলশয্যার দিন সকাল হতে ফুল নিয়ে সখীদের সঙ্গে খেলা করতে লাগলেন শান্তা। দুদিন আগে সারা দেশে কোথাও ফুল পাওয়া যাচ্ছিল না। আর আজ সখীরা কোথা হতে অজস্র ফুল নিয়ে এসে শান্তার ঘরখানিকে ভরে দিয়েছে। আজ চারিদিকে গাছে গাছে সবুজের সমারােহ আর ফুলের সুষমা। স্বামীর প্রতি এক গভীর প্রণয়াসক্তির সঙ্গে সঙ্গে এক নিবিড় শ্রদ্ধা অনুভব করছিলেন শান্তা।

সন্ধ্যা হতে নিজের ঘরে স্বামীর প্রতীক্ষায় একমনে বসেছিলেন শান্তা। ঋষ্যশৃঙ্গ ঘরে ঢুকতেই তার পায়ে মাথা রেখে ভক্তিভরে প্রণাম করলেন। 

ব্যস্ত হয়ে শান্তার চিবুকে হাত দিয়ে তাকে তুলে নিলেন ঋষ্যশৃঙ্গ। তপস্বিনীর বেশে শান্তাকে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলেন। তারপর আস্তে আস্তে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বললেন, তুমি আমায় প্রণাম করে লজ্জা দিও না। তােমার স্থান তাে আমার পায়ে নয়, তােমার স্থান বুকে। তুমি আমার শ্রীচরণের দাসী নও, তুমি আমার অন্তর-মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।

ব্রীড়াবনত মুখ না তুলেই অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে শান্তা বললেন, আপনি তাে শুধু আমার স্বামী নন, আপনি আমাদের সমগ্র দেশের স্বামী, এক মহাতেজা পুণ্যাত্মা পুরুষ যিনি এই বন্ধ্যা বিশুষ্ক দেশকে ফলে ফুলে ভরে দিয়েছেন, মৃত্যুর মাঝে এনেছে জীবনের প্রবাহ, শূন্যতার মাঝে পূর্ণতা।

এ কথার কোনাে উত্তর না দিয়েই ঋষ্যশৃঙ্গ বলেন, কিন্তু রাজকন্যা হয়েও তােমায় এমন ব্রতচারিণী দেখছি কেন আর্যা ? 

কারণ রাজঐশ্বর্যের দ্বারা কখনাে ঋষিকুমারের অন্তর জয় করা যায় না, তাকে তপস্যার দ্বারা তুষ্ট করতে হয়। সাধনার দ্বারা তাকে আপন করে নিতে হয়। কঠোর ব্রতচারণার দ্বারাই তাকে কাছে পাওয়া যায় এই ছিল আমার ধারণা। লজ্জায় মুখখানা তেমনি নামিয়ে রইলেন শান্তা।

শান্তার লজ্জাবনত মুখখানিকে তুলে ধরলেন ঋষ্যশৃঙ্গ। বললেন, আর তােমার সে সাধনার প্রয়ােজন নেই শান্তা। এবার আমি তােমায় সালঙ্কারা ও উত্তম বেশভূষায় ভূষিতা দেখতে চাই। 

মুহূর্তে সেই পুরনাে অভিমানটা পুঞ্জীভূত হয়ে উঠল শান্তার বুকের মধ্যে। তিনি আস্তে আস্তে ঋষ্যশৃঙ্গের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন। ভাবতে লাগলেন, তবে কি সেই বারবনিতাদের সংস্পর্শে এসে দেহমনের শুচিতা নষ্ট হয়ে গিয়েছে ঋষ্যশৃঙ্গের? নির্লোভ নিষ্কলুষ চিত্তে জেগেছে ঐশ্বর্যের লালসা?

ঠিক এই ভয়ই করছিলেন শান্তা। নিবিড় হতাশায় ও অভিমানে চোখে জল এলাে তার। ব্যর্থ হলে তার এতদিনের ব্রতসাধনা।

রাজদ্বারে ঘণ্টাধ্বনি হলাে। রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর অতিক্রান্ত। 

বিছানায় শুতে যাবার জন্য ঋষ্যশৃঙ্গ এসে অনুরােধ করলেন শান্তাকে। শান্তা কোনাে কথা বললেন না। বাইরে ঘন অন্ধকারের মধ্যে জ্বলতে থাকা মখমল পােকা দেখতে লাগলেন একমনে। 

শান্তার এই ভাবান্তরে কিছুটা বিস্মিত হলেন ঋষ্যশৃঙ্গ। কিন্তু তার কোনাে কারণ জানতে চাইলেন না। নীরবে গিয়ে একা শুয়ে পড়লেন।

কিছুক্ষণ পর মুখ ফিরিয়ে ঘরের ভিতরে একবার তাকালেন শান্তা। বৈদুর্যমণি-খচিত স্বর্ণপালঙ্কের উপর দুগ্ধফেননিভ শয্যা। তার উপর অসংখ্য ফুল ছড়ানাে। পাশে গন্ধতৈলপূর্ণ একটি স্বর্ণপ্রদীপ। বিছানার একপাশে অঘােরে ঘুমিয়ে পড়েছেন ঋষ্যশৃঙ্গ।। 

একবার শান্তা ভাবলেন, সমস্ত রাগ অভিমান ভুলে গিয়ে স্বামীর পাশে শুয়ে পড়বেন। নিবিড় নিঃসঙ্কোচ আত্মসমপর্ণে ঢলে পড়বেন ঋষিকুমারের বিস্তৃত বুকে। ভাবলেন, বারবনিতাদের প্রলােভনে হয়তাে কেবলমাত্র মনের উপরিপৃষ্ঠটাই কিছুটা বিচলিত হয়েছে ঋষ্যশৃঙ্গের ; কিন্তু চিত্তের শুচিতা বা অন্তরের মহত্ত্ব কিছুমাত্র ক্ষুন্ন হয়নি তার।

তবু মনকে বোেঝাতে পারলেন না শান্তা। সুন্দর ফুলশয্যাকে মনে হলাে কলুষিত কন্টক শয্যা।

জানালার ধারে সেই জায়গাটিতে এসে বসে পড়লেন। তন্দ্রা এসেছিল শেষ রাত্রিতে। সকালে ঘুম ভাঙলে দেখলেন, ঋষ্যশৃঙ্গ তার আগেই ঘুম থেকে উঠে চলে গেছে।

আজ সকাল থেকে আকাশ বেশ নির্মল। স্বর্ণোজ্জ্বল সূর্যকিরণেঝলমল করছে সারা পৃথিবী।

আজ ঋষ্যশৃঙ্গের কথামতাে নিজেকে উত্তম বেশভূষায় ভূষিত করলেন শান্তা। সারা অপরাহু ধরে পরিপাটি করে কেশবিন্যাস করলেন সখীদের সাহায্যে।

সারাদিন রাজদরবারেই থাকতে হলে ঋষ্যশৃঙ্গকে। অন্তঃপুর দিয়ে একবারও আসবার সময় পেলেন না। দুর গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে অজস্র লােক আসছে দলে দলে তাকে দর্শন ও প্রণাম করতে।

প্রদোষকাল উত্তীর্ণ হতেই শান্তা শয়নকক্ষে প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। রাজোদ্যানের পিয়াশাল বনে তখন অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে। ঝিল্লীস্বনিত অন্ধকার বনে জোনাকী জ্বলছে। মনে মনে ঠিক করলেন শান্তা, আজ সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে নিঃশেষে আত্মসমর্পণ করবেন ঋষ্যশৃঙ্গের কাছে।

ঋষ্যশৃঙ্গ এলেন ঠিক রাত্রি প্রথম প্রহর অতীত হলে। ঘরে ঢুকেই একবার শুধু শান্তার পানে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কি একবার দেখে নিলেন। তারপর বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন। আজ আর শান্তাকে কোনাে অনুরােধ করলেন না শুতে যাবার জন্য।

এদিকে ঋষ্যশৃঙ্গ ঘরে ঢােকার সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই অন্তর্দ্বন্দ্বটা জেগে উঠল শান্তার মধ্যে। একদিকে প্রবল আত্মাভিমান আর অন্যদিকে আত্মসমর্পণের এক প্রণয়াকুলিত ব্যাকুলতা। কি করবেন কিছু ভেবে পেলেন না শান্তা। পালঙ্কের দিকে একবার এগিয়ে গেলেন।

একবার ভাবলেন স্বামীর বুকের মধ্যে মাথাটা গুজে তিনিও অমনি করে ঘুমিয়ে পড়বেন। দেহের চেয়ে মন কি বড় নয়! ক্ষণিকের ভুলে দেহটা অশুচি হয়ে পড়লেও মনটা ঋষ্যশৃঙ্গের আজও সরল ও নিষ্কলুষ রয়ে গেছে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা পারলেন না শান্তা। আত্মসমর্পণের সমস্ত ব্যাকুলতাকে বিপর্যস্ত করে দিয়ে সেই আত্মাভিমানটাই জয়ী হলাে তার মধ্যে। ঘৃণায় ও বিতৃষ্ণায় মুখ ফিরিয়ে চলে এলেন। যে দেহ বারবনিতারা একবার স্পর্শ করেছে সে দেহকে তিনি কিছুতেই স্পর্শ করতে পারবেন ।

মুক্ত বাতায়নপথে আকাশের তারা দেখা যায়। রাত্রি তখন গভীর। মাথার উপর সপ্তর্ষিমণ্ডল দেখা যাচ্ছে। বাইরে তেমনি নিবিড় নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। এক দুঃসহ দ্বন্দ্বে অন্তরটা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যেতে লাগল শান্তার। তার এই মনের কথা কার কাছে বলবেন। ঋষ্যশৃঙ্গ যদি রাজার কাছে সব কথা বলে দেন তবে তিনি কোন মুখে দাঁড়াবেন রাজা লােমপাদের কাছে? কী কৈফিয়ৎ দেবেন তার পুরনাে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের?

সকলে ভাববে স্বামীকে পছন্দ হয়নি শান্তার। অথচ তাকে নির্বিবাদে মনে-প্রাণে গ্রহণ করবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সে। শান্তা বিশ্বাসঘাতিনী।

তার এই নিঃসঙ্গ বেদনা ও নিবিড় মান-অভিমানের কথা কাউকে জানাতে পারবেন না শান্তা। তার এই দুঃখ কেউ বুঝবেনা। তাই যে কথা কেউ জানল না, সেকথাকে দূর আকাশের প্রতিটি তারায় তারায় ছড়িয়ে দিতে চাইলেন শান্তা। যে দুঃখ তার কেউ বুঝল না, সে দুঃখকে অতলান্ত অন্ধকারের গভীরে তলিয়ে দিতে চাইলেন নিঃশেষে।

পরদিন ঋষ্যশৃঙ্গ রাজাকে বললেন, আমাকে যে গ্রাম আপনি দান করছেন, আমি তার প্রান্তে একটি মনােরম তপােবন রচনা করে সেখানে অধ্যয়ন ও তপস্যার মধ্য দিয়ে শান্ত সরল জীবন যাপন করতে চাই।

ব্যস্ত ও বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন রাজা লােমপাদ, কিন্তু কেন ঋষিবর, আপনার প্রতি আমাদের কর্তব্যে কি কোনাে ত্রুটি অনুভব করেছেন? 

একটুখানি মৃদু হেসে শাস্তকণ্ঠে ঋষ্যশৃঙ্গ বললেন, না মহারাজ, আপনি বিন্দুমাত্র ব্যস্ত বা বিচলিত হবেন না। আমি আজন্ম তপােবনেই মানুষ। তাই তলােবনের জন্য মন আমার ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। আপনাদের যত্নের কোনাে ত্রুটি নেই। তবু রাজপ্রাসাদের ভােগ ঐশ্বর্য আর আমার ভালাে লাগছে না।

রাজা লােমপাদ বুঝলেন, রাজপ্রাসাদের মধ্যে ঋষ্যশৃঙ্গকে আর রাখা যাবে না। তাই তিনি নিরস্ত হয়ে বললেন, তবে যদি একান্তই যেতে চান তাহলে শান্তাকেও আপনি সঙ্গে নিয়ে যান মুনিবর। শান্তা আমার একমাত্র সন্তান। তাকে ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে সত্যিই অতীব কষ্টকর হবে। তবু সে আপনার ধর্মপত্নী, সর্বত্র আপনার সহগামিনী হওয়াই তার কর্তব্য।

ধর্মপত্নী হলেও আমি তার স্বাধীন ইচ্ছার উপর হস্তক্ষেপ করতে চাই না মহারাজ। স্ত্রী হলেও তার একটা আত্মমর্যাদা আছে। স্বামীত্বের দাবী নিয়ে সে মর্যাদা আমি কোনােদিন ক্ষুন্ন করব না।

ঋষ্যশৃঙ্গের কণ্ঠে কোথায় যেন একটা চাপা বেদনার সুর ছিল। রাজা লােমপাদ তার কিছুই বুঝতে পারলেন না। তিনি ঋষ্যশৃঙ্গের যাবার আয়ােজন করতে লাগলেন।

তখনাে পর্যন্ত শান্তা কিন্তু কিছুই জানেন না। ঋষ্যশৃঙ্গ ঠিক করলেন, আজ রাত্রে শােবার সময় সব কথা বলবেন শান্তাকে। বলবেন, তিনি একাই যেতে চান।

আজ শয়নমন্দিরে একটু সকাল সকাল ঢুকলেন ঋষ্যশৃঙ্গ। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হবার একটু পরেই। দেবমন্দিরে সন্ধ্যারতি তখনাে শেষ হয়নি। গাঢ় হয়ে ওঠেনি তখনাে রাজোদ্যানের আরণ্যক অন্ধকার। আজ অস্বাভাবিক রকমের গম্ভীর দেখাচ্ছিল ঋষ্যশৃঙ্গের মুখখানা। আজ যেন কোনাে একটা শক্ত কথা বলবার জন্য অন্তরে বাইরে কঠিন হয়ে এসেছেন তিনি।

অন্যদিনকার মতাে আজও শান্তা ঠিক সেই বাতায়ন পাশেই বসেছিলেন। সামনের অন্ধকার আকাশের তারা কি দেখছিলেন তা ঠিক বােঝা গেল না।সেদিকে ভালভাবে না তাকিয়েই ঋষ্যশৃঙ্গ গভীরভাবে বললেন, আমায় বিদায় দাও শান্তা। আমি কালই প্রাসাদ ত্যাগ করে তপােবনে চলে যাচ্ছি। চমকে উঠলেন শান্তা। ঋষ্যশৃঙ্গের দিকে মুখ তুলে সভয়ে প্রশ্ন করলেন, কেন?

ঋষ্যশৃঙ্গ বললেন, আমরা ঋষি। যাগ-যজ্ঞ, জপ-তপের মধ্য দিয়ে সরল আশ্রম জীবন-যাপন করাই আমাদের পক্ষে বিধেয়। তাই ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের মধ্যে থেকে আর বৃথা কালক্ষেপ করতে চাই না।

শান্তা বললেন, তাহলে আমাকেও আপনার সঙ্গে নিয়ে চলুন। একা যাবার কথা ভাবছেন কেন?

ঋষ্যশৃঙ্গ বললেন, আজীবন তুমি রাজ ঐশ্বর্যের মধ্যে লালিত-পালিত। সহসা এ-জীবন ত্যাগ করে আমার সঙ্গে আশ্রম জীবন-যাপন করতে গেলে যে ক্লেশ হবে সে ক্লেশ তুমি সহ্য করতে পারবে না শান্তা।

শান্তা দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, শত ক্লেশ হলেও আমি তা হাসিমুখে সহ্য করব ঋষিপুত্র। ‘আমি আপনার ধর্মপত্নী। আপনার ধর্মকর্মে অংশ গ্রহণ করা আমার একান্ত কর্তব্য। 

আর কোন কথা বললেন না ঋষ্যশৃঙ্গ। আসল কথাটাই বলতে পারলেন না। বলতে পারলেন না, শান্তা কেন অভিনয় করছে তার সঙ্গে এমন ভাবে। অন্তর দিয়ে যাকে গ্রহণ করতে পারেনি, দেহ দিয়ে যাকে স্পর্শ করতে পারেনি, লৌকিক জগতে তার ধর্মপত্নী সেজে এ হীন অভিনয় করার অর্থ কি। 

যে প্রেমে সাযুজ্য নেই, প্রেমাস্পদের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে দিয়ে প্রেমের গভীরতর আস্বাদ পাবার কোনাে আকুলতা নেই, শুধু সামীপ্যের মধ্যে দিয়ে সে প্রেমকে কেমনভাবে উপভােগ করবেন শান্তা।

শান্তাও ঠিক খুলে বলতে পারলেন না ঋষ্যশৃঙ্গকে, তাদের বাইরের এই লৌকিক সম্পর্কটাকে কেন তিনি সত্যিকারের একাত্মতার রস দিয়ে সিক্ত করে নিতে পারছেন না।

তবু যাবার জন্য জেদ ধরলেন শান্তা।

তিন চার দিন পরই দুটি রথ ও বহু লােকজন ঋষ্যশৃঙ্গ ও শান্তাকে চম্পানগরীর বাইরে কৌশিকী নদীর ধারে একটি বনে রেখে এলাে। সেখানে মনােরম একটি পােবন নির্মাণ করা হয়েছে। অদূরেই গ্রাম।

ঋষ্যশৃঙ্গ ও শান্তা দুজনেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। দুজনেই ভাবলেন এতদিন বিরাট রাজপ্রাসাদের মাঝে ও বহু লােকজনের মধ্যে তারা দুজনে পরস্পরের কাছে আসতে পারছিলেন না। তাই তাদের প্রেম গভীর হয়ে ওঠবার সুযােগ পাচ্ছিল না। আজ এই ছােট্ট কুটিরের স্বল্প পরিসরের মধ্যে দুজনের অবিরাম ও নিবিড় সাহচর্যের মধ্যে তাদের প্রেম এক আশ্চর্য প্রগাঢ়তা লাভ করবে। যে কথা এতদিন কেউ কাউকে বলতে পারেননি, সে কথা আজ বলে হালকা হয়ে উঠবেন দুজনে।

তখন অপরাহু হয়ে এসেছে। চারিদিকের তমাল বনের ঘনশ্যামল ছায়া পড়েছে কৌশিকীর স্বচ্ছ সুন্দর জলে। নদীর জলে তৃপ্তির সঙ্গে স্নান সেরে এলেন ঋষ্যশৃঙ্গ। তারপর কিছু ফলমূল আহার করলেন।

এদিকে দাসদাসীদের সকলকে বিদায় দিয়ে শান্তা একাই মনের মতাে করে পর্ণকুটিরটিকে সাজিয়ে তুললেন। ঋষ্যশৃঙ্গ আশ্বস্ত হলেন। কিন্তু কোনাে কথা বললেন না।

শান্তা ভাবলেন, সমস্ত অভিমান ভুলে গিয়ে আজ নিঃশেষে আত্মসমর্পণ করবেন ঋষ্যশৃঙ্গের কাছে। যে অভিমান এতদিন বুকে পাথরের মতাে শক্ত হয়ে জমেছিল, শান্তার সহসা মনে হলাে তা এখন কৌশিকীনদীর জলের মতােই স্বচ্ছতরল ও সাবলীল হয়ে উঠেছে; শান্ত শ্যামল তমাল বনের হাওয়ার মতােই সে অভিমান হয়ে উঠেছে শান্ত লঘু এবং সরল।

নিজের হাতে মাটির একটি সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বাললেন শান্তা। এদিকে নিজের হাতে যজ্ঞাগ্নি জ্বাললেন ঋষ্যশৃঙ্গ। কুটিরের মধ্যে একটি সরল ও সুন্দর পল্লবশয্যা প্রস্তুত করলেন শান্তা। তারপর এক নিবিড় প্রতীক্ষায় বসে রইলেন ঋষ্যশৃঙ্গের জন্য। এতদিন ধার যাকে প্রত্যাখ্যান করে এসেছেন, আজ তাকেই গ্রহণের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে তার মন।

কিন্তু স্তব্ধ অন্ধকার বনভূমিকে আলােকিত করে রাত পর্যন্ত হােম করে যেতে লাগলেন ঋষ্যশৃঙ্গ। সংসারের সব কাজ সেরে সামনে স্থির হয়ে নীরবে বসে রইলেন শান্তা। বসে বসে বেদমন্ত্রের ধ্বনি শুনলেন। প্রজ্বলিত যজ্ঞাগ্নিতে কেমন করে আহুতি দেয় তা দেখলেন।

ঋষ্যশব্দের প্রথম ঋষিরূপ দেখলেন শান্তা। দেখে যেমন মুগ্ধ হলেন, তেমনি একটা কথা ভাবতে লাগলেন। প্রশ্ন জাগল মনে, কি ফল এই সব সাধন ভজন ও তপশ্চর্যার ? ঋষির অর্থ হলাে, যিনি সত্যকে দেখতে পান। তাই যদি হয়, কেন তবে ঋষি হয়েও সেই সব বারবিলাসিনীদের রূপে মােহগ্রস্ত হয়ে ছিলেন ঋষ্যশৃঙ্গ? কেন তবে নারীদেহের প্রথম স্পর্শে জারজ লালসার শিহরণে রােমাঞ্চিত হয়ে উঠেছিল তার সারা দেহ?

ঋষিরা যদি সত্যকে দেখতে পেতেন এবং ঋষ্যশৃঙ্গ যদি প্রকৃত ঋষি হতেন তাহলে সেই সব বারবনিতাদের একবার দেখে আবার দেখবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠতেন না তিনি। ঘূণায় মুখ ফিরিয়ে নিলেন শান্তা। তারপর বিছানার একপাশে শুয়ে কাদতে লাগলেন। কাদতে কাদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন কিছুই বুঝতে পারেননি।

সহসা একটা আলােড়নে ঘুম ভেঙে গেল শান্তার। রাত্রি তখন গভীর। চোখ মেলে চেয়ে দেখলেন শান্তা, ঋষ্যশৃঙ্গ তাকে সবল আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে মুখপানে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। ক্ষীণভাবে জ্বলতে থাকা মৃদু প্রদীপালােকে ঋষ্যশৃঙ্গের মুখপানে একবার চাইলেন শান্তা। নিশীথরাত্রির নক্ষত্রদলপিষ্ট নরম অন্ধকারের মতাে একবার ঈষৎ কেঁপে উঠল তার দেহটা। পরক্ষণেই সে দেহ হয়ে উঠল পাথরের মতাে নিথর এবং কঠিন।

ঋষ্যশৃঙ্গকে সজোরে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সােজা হয়ে উঠে বসলেন শান্তা। তারপর সব কিছু খুলে বলবার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠলেন মনে মনে। 

কিন্তু শান্তা কিছু বলবার আগেই দৃঢ় ও গম্ভীর কণ্ঠে ঋষ্যশৃঙ্গ বললেন, এবার আমি তােমার ছলনা বুঝতে পেরেছি। আসল কথা, আমি হরিণীর গর্ভজাত এবং আমার কপালে ক্ষুদ্র-দুটি শৃঙ্গ আছে বলে আমায় তােমার পছন্দ হয়নি। কিন্তু তুমি তাে আমার সব কিছু জেনেই আমার সঙ্গে তােমার বিয়েতে মত দিয়েছ। তােমার মনের এই আসল কথাটা কেন তুমি আগে জানাও নি? কেন তুমি এইভাবে আমার সঙ্গে তােমার বাবার সঙ্গে প্রতারণা করলে?

শান্তা কথার কোনাে উত্তর দিতে পারলেন না। শুধু নীরবে চোখের জল ফেলতে লাগলেন।

ঋষ্যশৃঙ্গ বললেন, তােমাকে ভালবেসে সুখী হতে চেয়েছিলাম আমি। ভেবেছিলাম তােমায় সহধর্মিণী করে সংসারে থেকে ধর্মসাধনায় সিদ্ধিলাভ করব। কিন্তু যে ভালবাসার খাতিরে আমার বৃদ্ধ পিতা ও পিতৃভূমি ত্যাগ করে তােমাকে গ্রহণ করলাম আমি, সে ভালবাসাকে আমার নির্মম অবজ্ঞায় প্রত্যাখ্যান করলে তুমি। 

সহসা দলিতা ফণিনীর মতাে গর্জন করে উঠলেন শাস্তা। কোনাে এক দমকা হাওয়ার প্রহারে জর্জরিত শান্ত মৃদুদীপালােকের মতাে এক অস্বাভাবিক প্রখরতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠলতার চোখ দুটো। সােজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মুখ তুলে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন, কে বলেছিল তােমায় বৃদ্ধ পিতা ও পিতৃভূমিকে ত্যাগ করে আসতে?কার রূপের মােহে ও কাকে ভালবেসে তুমি আশ্রম ত্যাগ করে এসেছ?

যে ঋপু পারবশ্য হতে মুক্ত হবার জন্য সাধনা করেন ঋষিরা সেই রিপুর বশে কয়েকটি নারীদেহের জারজ লালসাকে দমন করতে না পেরেই তুমি এখানে এসেছ। যে ঋষি মুহুর্তের জন্য ধ্যানস্থ হয়ে ত্রিকালের কথা জানতে পারেন, সেই ঋষি হয়েও তুমি সামান্য কয়েকটি ছলনাময়ী বারবনিতার মনের আসল কথাকে জানতে না পেরে তাদের পিছনে পাগলের মতাে ছুটে গিয়েছ।

কথাটার কোন উত্তর দিতে পারেন না ঋষ্যশৃঙ্গ। শুধু দুহাতে মুখ ঢেকে অব্যক্ত লজ্জার এক অস্ফুট যন্ত্রণায় শিউরে উঠলেন।

শান্তা বললেন, যে-কোনােকারণেই তুমি এসে থাক, তুমি আমাদের অশেষ উপকার করেছ। তােমার পাদস্পর্শে আমাদের অভিশপ্ত রাজ্যের তাপদগ্ধ মাটির বুকে নেমে এসেছে বহু আকাক্ষিত বৃষ্টির সুধা। বন্ধ্যা দেশ হয়ে উঠেছে সুজলা সুফলা। তােমার এই উপকারের জন্য কৃতজ্ঞতাবশতঃ বাবা আমায় সম্প্রদান করেছেন তােমাকে।এই উপকারের জন্য আমি তােমায় আমার দেহের সেবা, অন্তরের আনুগত্য, আমার পার্থিব সম্পদ, আমার যথাসর্ব তােমায় দান করতে পারব ; কিন্তু একটা জিনিস তােমায় আমি কোনােদিনই দিতে পারব না—সে আমার প্রেম। তুমি চাইলে তােমায় আমার প্রাণ দেব; কিন্তু আমার প্রেম কোনােদিন দিতে পারব না। প্রয়ােজন হলে এক মুহূর্তে আমার হৃৎপিণ্ড উপড়ে দেব; কিন্তু আমার হৃদয় কোনােদিন তােমায় দিতে পারব না।

কোনাে কথা না বলে নীরবে নিশ্ৰুপে ঘর থেকে অন্ধকারে বেরিয়ে পড়লেন ঋষ্যশৃঙ্গ। শান্তা একবার ভাবলেন, ঋষ্যশৃঙ্গ যত দোষই করে থাকুন, তাকে অবিলম্বে ফিরিয়ে আনা উচিত। এই ভীষণ অরণ্যে একা থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু পরক্ষণেই রাগেও অভিমানে কঠিন হয়ে উঠেলেন শান্তা।

তবু একবার কুটির হতে বেরিয়ে গেলেন শান্তা। কিন্তু চারিদিকের নিবিড় অন্ধকারের মধ্যে নিমিষে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন ঋষ্যশৃঙ্গ কিছুই দেখতে পেলেন না। শুধু কোনাে এক সাথীহারা মানুষের গভীর দীর্ঘশ্বাসের মতাে পাতা ঝরার খস খস শব্দ শুনতে পেলেন চারিদিকে। 

রাত্রি তখন দ্বিতীয় প্রহর উত্তীর্ণয়। রাত্রির ঠিক এই কালটিতে সমগ্র পৃথিবী যেন হতচেতন হয়ে স্তব্ধশীতল এক ক্লান্তির কোলে ঢলে পড়ে। সারারাত্রি ধরে চীৎকার করে করে ক্লান্ত হয়ে ঝিমিয়ে পড়েছে ঝিল্লীর দল। দূর আকাশে স্তিমিত হয়ে এসেছে নক্ষত্রের আলাে। মন্থর হয়ে উঠেছে শিশিরসিক্ত আরণ্যক হাওয়ার হিল্লোল।

এক ভয়ঙ্কর নিঃশব্দতায় জমাট বেঁধে ওঠা শ্বাসরুদ্ধতমাল বনের মতােই বুকের ভিতরটাকে ভারী বলে মনে হলাে শান্তার। হাওয়ায় শীতের আমেজ। তবু এক অস্বস্তিকর উষ্ণতা অনুভব করছিলেন শান্তা সারা দেহের প্রতিটি ধমনীতে।

তিন দিন তিন রাত্রি কঠোর ব্রতচারিণীর বেশে ঋষ্যশৃঙ্গের প্রতীক্ষায় কাটিয়ে দিলেন শান্তা।

এই তিনটি দিনের মধ্যে একবারও চন্দনে চৰ্চিত হলােনা তার অঙ্গ।নীল মুক্তাহারে শােভিত হলাে না গলদেশ। সুগন্ধি প্রসাধনে বদ্ধ করলেন না তার আলুলাযিত কেশপাশ। অলক্তরসে রঞ্জিত হলাে না তার পদযুগল।

অনাহারে অনিদ্রায় শুয়ে শুয়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগলেন শান্তা। আর মাঝে মাঝে অধীর আগ্রহে মুখ তুলে দ্বারদেশে কার প্রতীক্ষায় চাইতে লাগলেন। তার ধ্রুব বিশ্বাস, ঋষ্যশৃঙ্গ চিরদিনের মতাে তাকে ত্যাগ করে যাবেন না। নিশ্চয় ফিরে আসবেন। | নির্জন বনপ্রদেশের প্রতিটি পল্লবমর্ষরকে মানুষের পদশব্দ বলে ভুল হতে থাকে শান্তার। এক উৎকণ্ঠিত প্রতীক্ষায় সচকিত হয়ে ওঠে তার প্রাণ।

তিন দিন পর পথে বেরিয়ে পড়লেন শান্তা। লতাগুল্মে আচ্ছন্ন ও কণ্টকে আকীর্ণ সে পথ। পায়ে পায়ে বাধা ঠেকছিল শান্তার। তাছাড়া অনাহারে অতিশয় দুর্বল বােধ করছিলেন। কৌশিকী নদীর জল ও বনের ফল খাওয়াও ছেড়ে দিয়েছিলেন।

এমনি করে বহুদূর যাওয়ার পর আর একটি গভীর ও বিশাল বনে এসে পৌঁছলেন শান্তা। বেলা তখন তৃতীয় প্রহর অতিক্রান্ত। কম্পিত বনচ্ছায়ার ফাকে ফাকে শেষ শরতের পাণ্ডুর সূর্যরশ্মি ছড়িয়ে পড়েছে তৃণভূমির উপর। শীর্ণকায়া শান্তা অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে এক জায়গায় বসলেন। সহসা কোনাে অদৃশ্য মানুষের অনুচ্চ কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলেন শান্তা। চারিদিকে চেয়ে কিন্তু কোথাও কিছু দেখতে পেলেন না। কিছুক্ষণ পর আবার সেই কণ্ঠস্বর শুনে শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে যেতে লাগলেন।

হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন শান্তা। এক অভূতপূর্ব দৃশ্যে আনন্দে বেদনায় ও বিস্ময়ে রােমাঞ্চিত হয়ে উঠল তার সারা দেহ। দেখলেন একটি পিয়াশাল গাছের তলায় একটি শান্ত হরিণীকে নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে ঋষ্যশৃঙ্গ বসে রয়েছেন। আর অপূর্ণ কণ্ঠে মাঝে মাঝে আপনার মনে কি সব বলছেন।

কোনাে উত্তেজনা প্রকাশ করলেন না শান্তা। যেখানে ছিলেন সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

ঋষ্যশৃঙ্গ সেই হরিণীকে সম্বােধন করে বললেন, তুমিই আমার মা। মােহবশে পিতাকে ত্যাগ করেছি। তার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। তুমি যেন আমায় কখনাে ত্যাগ করাে না। আমি তােমার গর্ভজাত, তােমার মাতৃত্বের অভিজ্ঞানস্বরূপ আমার মাথায় দুটি শৃঙ্গ। পৃথিবীর সব মানুষ তাই আমায় মৃণা করে। আমার শক্তিকে লােকে ভয় করে, আমার সামর্থ্যকে শ্রদ্ধা করে; কিন্তু কেউ আমায় ভালবাসতে পারে না। 

শান্তার মাথাটা ঘুরছিল। গলা ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছিল তার। মিথ্যা বলছেন ঋষ্যশৃঙ্গ। এত বড় মিথ্যাটাকে কোনােমতেই সহ্য করতে পারবেন না তিনি। তিনি কিন্তু মুখে কিছুই বললেন না। অবরুদ্ধ অশ্রুকে অতিকষ্টে দমন করলেন। 

ঋষ্যশৃঙ্গ আবার বলতে লাগলেন—প্রেমকে পরমার্থ বলে জ্ঞান করে যাগ-যজ্ঞ ও সাধনপূজন ত্যাগ করে নূতন জীবন শুরু করতে চেয়েছিলাম। সে প্রেম আমায় ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। আজ আমি সব হারিয়ে একেবারে নিঃস্ব। আজ পার্থিব অপার্থিব কোনাে বস্তুর কোনাে অবলম্বনই আমার নেই। আজ তুমিই আমার একমাত্র আশ্রয়। 

হরিণীটি উঠে দাঁড়াতে ঋষ্যশৃঙ্গও উঠে দাঁড়ালেন বিচলিত হয়ে। বললেন, আজ আমি আলাে চাই না। সুখ সম্পদ, জ্ঞান সত্য, ধর্ম অর্থ, কাম মােক্ষ কোনাে কিছুই চাই না। আমি শুধু চাই মাতৃজঠরের সেই শান্ত শীতল অন্ধকার যা সমস্ত ভালাে মন্দ, সুখ দুঃখের ঊর্ধ্বে নির্বিশেষ চেতনার এক আবরণ দিয়ে মানুষের দেহ মনকে ঢেকে রাখে। তুমিই হচ্ছ আমার আদি এবং অকৃত্রিম মুক্তি, একমাত্র তুমিই হচ্ছ অদ্বৈত সত্য। 

শান্তার দিকে পিছনে ফিরে দাঁড়িয়েছিলেন ঋষ্যশৃঙ্গ। শান্তাকে তখনাে দেখতে না পেয়ে আচ্ছন্নের মতাে বলে চললেন, জগতে অদ্বৈত সত্য বলে কিছু নেই। সকল বস্তুর মধ্যেই আছে দ্বৈতের দ্বন্দ্ব।-সুখের সঙ্গে সঙ্গে আছে দুঃখ, মুক্তির পিছনে আছে বন্ধন, প্রেমের সঙ্গে আছে প্রত্যাখ্যান।

এবার আর থাকতে পারলেন না। কেঁদে উঠলেন শান্তা আর সঙ্গে সঙ্গে পিছন ফিরে আশ্চর্য হয়ে গেলেন ঋষ্যশৃঙ্গ, শান্তা তুমি! আর আমায় লজ্জা দিও না শান্তা, এবার আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি। আজ আমি সমস্ত জীবন মৃত্যুর উর্ধ্বলােকে এক চিরশান্তি ও চিরমুক্তির জন্য চলে যাচ্ছি।

শান্তা কোনাে কথা বলতে পারলেন না। ঋষ্যশৃঙ্গের পায়ের উপর গিয়ে লুটিয়ে পড়লেন কাদতে কাদতে। ধীরে ধীরে শান্তাকে তুলে নিয়ে ঋষ্যশৃঙ্গ বললেন, তুমি তাে কোনাে অন্যায় করনি শান্তা। বরং যে অন্যায় আমি করেছিলাম তুমি তা ধরিয়ে দিয়ে আমার অশেষ উপকারই করেছ। তুমি আমায় বিদায় দাও শান্তা। 

শীর্ণ দুটি হাতের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঋষ্যশৃঙ্গকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে শান্তা বললেন, আজ আমি তােমায় কিছুতেই ছাড়বনা। কে বলেছে আমি তােমায় ঘৃণা করি! পৃথিবীর সকলে তােমায় ঘৃণা করলেও আমি তােমায় ঘৃণা করতে পারব না। আমি তােমায় যা বলেছি ভালবাসি বলেই বলেছি।

ঋষ্যশৃঙ্গ নির্বাক হয়ে শান্তার মুখপানে চেয়ে রইলেন। শান্তা বললেন, আমার ভালবাসা রুদ্রের মূর্তিতে পরিশুদ্ধ করতে চেয়েছিল তােমার মনকে। আমার ভালবাসার উপরকার কঠোরতাটাকে দেখেই ভয়ে পালিয়ে এসেছ তুমি। ভিতরে তা কতখানি খাটি কতখানি কোমল তা ধৈর্য ধরে দেখনি।

তুমি আমায় ক্ষমা কর শান্তা। শান্তা বললেন, আমার প্রকৃত দুঃখটা কি তা না জেনে আমার উপর রাগ করেছ তুমি। বাবার কাছে তােমার কথা শুনে তােমায় না দেখেই পূর্বরাগ সঞ্জাত হয়েছিল আমার অন্তরে। আমার গােপন ইচ্ছা ছিল, আমি তপস্বিনীর বেশে নিজে গিয়ে উপযুক্ত মর্যদার সঙ্গে তােমায় নিয়ে আসব। সত্য কথা বলে তােমার পিতার কাছ থেকে তােমায় ভিক্ষা চেয়ে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম আমি, চুরি করে নয়। আমার কুমারী জীবনের প্রেম সাধনার বিনিময়ে তােমার ঋষিজীবনের সমস্ত শক্তি ও সাধনার সত্যকে আমি জয় করে আনতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, শুধু হাতে তােমার কাছ থেকে কিছু নেব না। অজস্র বৃষ্টিধারার সঞ্জীবনী সুধা দিয়ে তুমি আমাদের রাজ্যের মাটি ও মানুষকে বাঁচাবার আগে আমি আমার হৃদয়ের রক্তরস ও প্রেমের অমৃত দিয়ে তােমার পা দুখানিকে ধুয়ে দেব।

বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে উঠেছিলেন শান্তা। 

কিন্তু কোথা থেকে কি যেন হয়ে গেল। মনের ইচ্ছা মনেই রয়ে গেল। সামান্য কয়েকটি বারবনিতা তােমার মনকে মােহমুগ্ধ ও দেহকে কুলষিত করে তােমার পিতার কাছ থেকে চুরি করে নিয়ে এলাে তােমায়।

ঋষ্যশৃঙ্গ বললেন, একথা আগে বলনি কেন শান্তা ? আমি আমার দোষ স্বীকার করছি। আমি সেদিন সত্যই মােহগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। জন্ম থেকে নারী দেখিনি বলে স্ত্রী পুরুষের ভেদ জানতাম না। তাই জীবনে প্রথম কয়েকটি মােহিনী নারীমূর্তি দেখে স্বাভাবিকভাবেই মােহগ্রস্ত হয়ে পড়লাম আমি। ধ্যানস্থ হয়ে ভালমন্দ বুঝবার অবকাশ পাইনি।

শান্তা বললেন, এইজন্যই তােমার উপর আমার অভিমান। এইজন্য প্রতিজ্ঞা করেছিলাম বারবনিতার দ্বারা উচ্ছিষ্ট তােমার দেহ মনকে কখনই স্পর্শ করব না আমি। আমার এই হিমশীতল অভিমানের স্পর্শে আমার অন্তরের সমস্ত ভালবাসা হৃদয়ের সমস্ত কোমলতা পাথরের মতাে শক্ত হয়ে জমাট বেঁধে গিয়েছিল সেদিন। আমি তাই দিয়ে আঘাত করেছিলাম তােমায়। কিন্তু তুমি বুঝতে পারনি, সে আঘাত আমার প্রেমেরই আঘাত, আমার হৃদয়ের এক অভিনব অভিব্যক্তি।

একটুখানি মৃদু হাসলেন ঋষ্যশৃঙ্গ। শান্তাকে বুকের কাছে টেনে এনে বললেন, আজ আমি এক নুতন শিক্ষা লাভ করলাম শান্তা। জগতে কোনাে বস্তু বা ঘটনা মিথ্যা নয়। মিথ্যা হতাে যদি সেদিনের সেই বারবনিতাদের মােহ, তাহলে তােমার এই প্রেমের মহাসত্যকে আজ লাভ করতে পারতাম না শান্তা। তারা চঞ্চলা চটুলা নদী, তুমি হচ্ছ স্থির অচঞ্চল এক সমুদ্র। তারা আমায় প্রলুব্ধ করে ভুল পথে টেনে নিয়ে যায়নি। তারা আমায় তােমার কাছেই এনেছে। তাদের মােহের স্রোতে সেদিন গা ঢেলে দিয়েছিলাম বলেই আজ তােমার এই প্রেমের গভীরতাকে আস্বাদন করতে পারছি। নিজেকে ধন্য মনে করেছি আজ।

এক অপরিসীম আনন্দের আবেগে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে ঋষ্যশৃঙ্গের মুখপানে চাইলেন বিশালাক্ষী শান্তা। তারপর ধীরকণ্ঠে বললেন, তােমাকে পেয়ে আমিও ধন্য ঋষিপুত্র।

ঋষ্যশৃঙ্গ বললেন, আমরা ঋষি। জ্ঞানের মধ্যে দিয়ে সত্যের সন্ধান করাই আমাদের কাজ। কিন্তু আজ জানলাম, প্রেমের মধ্যেও আছে এক মহাসত্যের মহিমা। এ সত্য লাভ করতে না পারলে ব্যর্থ হয়ে যায় অন্য সব সত্যের সন্ধান। অপরিপূর্ণ রয়ে যায় জীবনের সকল সার্থকতা। | কথা বলতে বলতে তরল অন্ধকার নেমে এসেছে কখন পিয়াশাল বনে কেউই তা বুঝতে পারেননি। পাখিরা গাছে গাছে ফিরে এসে কলরব করতে শুরু করে দিয়েছে কখন কেউ তা এতক্ষণ শুনতে পাননি। ঋষ্যশৃঙ্গ একটি হাত ধরে শান্তাকে বললেন, চল আশ্রমে ফিরে যাই।

দুজনেই তখন ক্ষুধায় কাতর ও দুর্বল, পথশ্রমে ক্লান্ত। তবু দুজনে পরস্পরকে এলম্বন করে অন্ধকার বনপথের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলেন ধীরে পায়ে।

Leave a Reply