অনুবাদঃ অপু চৌধুরী
আমি যা কিছু জানি, সবই এই বইয়ের মধ্যে সঞ্চিত—
সাক্ষীহীন লেখা, মাত্রাহীন প্রাসাদ, আকাশে ঝুলে থাকা এক নগরী।
সকালে, যখন আমি এই বই লেখা শুরু করতে উঠলাম, কাশলাম। গলার ভেতর থেকে কিছু বেরোচ্ছিল, আমাকে শ্বাসরুদ্ধ করছিল। যে সুতো আমাকে বেঁধে রেখেছিল তা ছিঁড়ে আমি সেটা টেনে বের করলাম। তারপর আবার বিছানায় শুয়ে বললাম: আমি এখনই আমার হৃদয় থুথু ফেলে বের করে দিলাম।
একটি বাদ্যযন্ত্র আছে—নাম কুয়েনা, তৈরি হয় মানুষের হাড় দিয়ে। এটি জন্মেছিল এক ভারতীয়ের প্রেমপূজার থেকে। তার প্রেমিকা মারা গেলে, সে তার হাড় দিয়ে বানাল এক বাঁশি। কুয়েনার সুর সাধারণ বাঁশির চেয়ে গভীরতর, বেশি তাড়া করা, বেশি মায়াময়।
যারা লেখে তারা এই প্রক্রিয়াকে জানে। যখন আমি হৃদয় উগরে ফেলছিলাম, আমি সেই কথাই ভাবছিলাম।
কেবল আমি অপেক্ষা করি না আমার প্রেমের মৃত্যুর জন্য।
পৃথিবীর প্রতি আমার প্রথম দর্শন ছিল—জলে ঢাকা। আমি সেই জাতির মানুষ—যারা সবকিছু সমুদ্রের পর্দার আড়ালে দেখে, আর আমার চোখের রংও জলের মতো।
গিরগিটির চোখে আমি দেখেছি পৃথিবীর পরিবর্তনশীল মুখ; এক নামহীন দৃষ্টিতে তাকিয়েছি নিজের অপূর্ণ সত্তার দিকে।
আমি মনে করি জলে আমার প্রথম জন্ম। চারপাশে গন্ধক মেশানো স্বচ্ছতা, আর আমার হাড় যেন রাবারের মতো নড়ছিল। হাড়হীন আঙুলের ওপর ভেসে দাঁড়িয়ে দূরের শব্দ শুনছি—যে শব্দ মানুষের কানে পৌঁছায় না, দেখছি মানুষের চোখের অতীত জিনিস। জন্মেছি আটলান্টিসের ঘণ্টাধ্বনির স্মৃতি নিয়ে।
সবসময় খুঁজে ফিরেছি হারানো সুর, হারানো রঙ—চিরকাল দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে, স্মৃতির ভারে ভেসে, ভেসে হাঁটছি। ডানা-সদৃশ পাখনা দিয়ে বাতাস কেটে যাচ্ছি, প্রাচীরহীন ঘরে সাঁতরাচ্ছি।
নিঃশব্দতার স্বর্গ থেকে নিক্ষিপ্ত আমি। এক দেহের গমনপথে দুলে ওঠা গির্জার মতো, যেন নিঃশব্দ সংগীত।
এই আটলান্টিসকে আবার পাওয়া যেত কেবল রাতে—স্বপ্নের পথে। ঘুম নামলেই নতুন শহরের দৃঢ়তা, নতুন বিশ্বের কঠিন কাঠামো ঢাকা পড়ত, ভারী দরজাগুলো খুলে যেত মসৃণ ঘণ্টার শব্দে, আর প্রবেশ করা যেত স্বপ্নের নীরবতায়। নীরবতায় সংঘটিত হত্যার আতঙ্ক আর উল্লাস, নিঃশব্দ ঘর্ষণ ও স্পর্শে। সবকিছুর ওপরে জলঢাকা কম্বল চাপা দিত কণ্ঠকে। কেবল এক দৈত্য ভুলে আমাকে টেনে তুলেছিল পৃষ্ঠে।
আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম আটলান্টিসের রঙে—সীমাহীন, সীমান্তহীন সব রঙে। মাছগুলো মখমলের তৈরি, অর্গানডির শরীর আর লেসের দাঁত; কখনো চাকচিক্যময় টাফেটা, কখনো পালক ও গোঁফে ঢাকা সিল্ক, চকচকে দেহ আর ক্রিস্টালের চোখ। শুকনো চামড়ার মাছ, কাঁচা আমলকির মতো চোখ; ডিমের সাদার মতো দৃষ্টি। ফুলগুলো হৃদয়ের মতো দুলছিল ডাঁটায়। কেউ নিজের ভার অনুভব করছিল না। সমুদ্রঘোড়া পালকের মতো নড়ছিল…
এ যেন হাই তোলার মতো। আমি ভালোবাসতাম সেই সহজতা, সেই অন্ধতা, সেই কোমল ভ্রমণ যেখানে জল বয়ে নিয়ে যেত, বাধা সরিয়ে দিত। জল ছিল আমাকে ধারণ করার জন্য এক বিশাল বক্ষ, সর্বদা ছিল বিশ্রামের ভরসা, আর সেই জলের ভেতর দিয়েই ছড়িয়ে যেত জীবন, প্রেম, শব্দ ও চিন্তা।
ঝড়ের স্তর থেকে বহু নিচে আমি ঘুমাতাম। রঙ ও সুরের ভেতর চলাফেরা করতাম, যেন এক সমুদ্র-হীরার ভেতরে। চিন্তার কোনো স্রোত ছিল না, কেবল প্রবাহের আদর আর বাসনার মিশ্রণ—স্পর্শ, গমন, প্রত্যাহার, ভ্রমণ—শান্তির অন্তহীন তলদেশে।
আমি মনে করতে পারি না সেখানে কখনো ঠান্ডা লেগেছে, গরমও নয়। কোনো যন্ত্রণা ছিল না। ঘুমের তাপমাত্রা—জ্বরহীন, শিহরনহীন। ক্ষুধার স্মৃতিও নেই। অদৃশ্য ছিদ্র দিয়ে খাদ্য প্রবেশ করত। আমি মনে করতে পারি না কখনো কেঁদেছি।
শুধু অনুভব করতাম গতি—অন্যের শরীরে প্রবেশের গতি—অন্যের দেহে শোষিত ও হারিয়ে যাওয়া, জলের ছন্দে দোল খাওয়া, ইন্দ্রিয়ের ধীর স্পন্দন, সিল্কের মতো গতি।
অজ্ঞাত প্রেম, সহজ গতি, জলের কোমল স্রোত আর বাসনার ভেতর ভেসে যাওয়া শ্বাস—অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার উল্লাসে ভেজা।
ভোরে জেগে উঠলাম—একটি শিলার ওপর নিক্ষিপ্ত, নিজের পালেই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে থাকা এক জাহাজের কঙ্কালের পাশে।
রাত্রি আমাকে ঘিরে ধরেছিল—একটি ছবি যেন ফ্রেম থেকে খসে পড়েছে। কোটের আস্তর ছিঁড়ে গেছে, যেন ঝিনুকের দুটি খোলা খোলস। দিন আর রাত আলগা হয়ে গেছে, আর আমি পড়ছিলাম তাদের মাঝখানে—জানতে পারছিলাম না আমি কোন স্তরে শুয়ে আছি, ভোরের শীতল ধূসর পাতায়, নাকি রাতের অন্ধকার স্তরে।
সাবিনার মুখ বাগানের অন্ধকারে ভাসছিল। তার চোখ থেকে উঠে আসা সমীর মরুভূমির বাতাসের মতো পাতাগুলোকে শুকিয়ে দিচ্ছিল, মাটি উলটে ফেলছিল; যা কিছু এতদিন সোজা চলত, সবকিছু ঘুরতে শুরু করেছিল তার মুখকে কেন্দ্র করে, তার মুখকে কেন্দ্র করে। তার দৃষ্টি ছিল প্রাচীন—ভারী, বিলাসী শতাব্দীগুলো যেন গভীর শোভাযাত্রায় ভেসে আসছিল সেই চাহনিতে। তার মুক্তোর মতো ত্বক থেকে সুগন্ধ ঘুরে উঠছিল ধূপের মতো। তার প্রতিটি ভঙ্গি রক্তের ছন্দকে দ্রুত করে তুলত, জাগিয়ে তুলত মরুভূমির হৃদয়ের স্পন্দনের মতো এক সঙ্গীত—তার পদক্ষেপের আওয়াজ, রক্তে খোদাই করা ছাপ।
একটি কণ্ঠ—যা শতাব্দী অতিক্রম করেছে। এত ভারী যে যা ছুঁত তাই ভেঙে ফেলত, এত ভারী যে আমি ভয় পেতাম এটি আমার ভেতরে অনন্ত প্রতিধ্বনি হয়ে বাজবে। একটি কণ্ঠ মরিচা ধরা অভিশাপের সুরে ভরা, আর ডেল্টা থেকে ভেসে আসা কর্কশ আর্তনাদের মতো—শেষ দমনে, চূড়ান্ত তৃপ্তির মুহূর্তে।
তার কালো কেপ ঝুলছিল কালো চুলের মতো কাঁধ থেকে—অর্ধেক ঢাকা, অর্ধেক ভেসে থাকা। তার পোশাকের জাল সবসময় এক মুহূর্ত আগে নড়ত, যেন তার ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গেই তা সচেতন হয়ে উঠত, আর সে স্থির হয়ে গেলেও নড়াচড়া করত, যেন সমুদ্রের ঢেউ ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। তার হাতার পতন ছিল নিঃশ্বাসের মতো, আর পোশাকের প্রান্ত নেচে বেড়াচ্ছিল তার পায়ের চারপাশে।
তার গলার স্টিলের হার বিদ্যুতের ঝলকের মতো ঝলসে উঠছিল—আর স্টিলের শব্দ ছিল তরবারির সংঘর্ষের মতো… Le pas d’acier… নিউইয়র্কের ইস্পাত-অস্থি, গ্রানাইটে পুঁতে রাখা, দাঁড়িয়ে থাকা। Le pas d’acier…—জিপসিদের স্টিল-তাঁতে বাঁধা গিটারের তারে বাজানো সুর, চেয়ারের ইস্পাতের বাহুতে তার শ্বাসে নিস্তেজ হয়ে যাওয়া শব্দ; ইস্পাতের পর্দা, শিলাবৃষ্টির মতো ঝরে পড়া; ইস্পাতের বার, ইস্পাতের বিস্ফোরণ। তার হার যেন গোটা বিশ্বের গলায় ঝুলে আছে, গলন-অযোগ্য। সে একে বহন করত যুদ্ধজয়ের ট্রফির মতো, যন্ত্রের গর্জন থেকে ছেঁড়া, তার নির্মম পদক্ষেপের অমানবিক ছন্দের সঙ্গে মিলিয়ে।
তার কথাগুলো ঝরে পড়ত পাতার মতো, তার মেজাজ ছিল রঙিন কাঁচের জানালার মতো, তার কণ্ঠে মরিচার দাগ, তার মুখে ধোঁয়া, আর তার নিশ্বাস আমার দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করত মানুষের নিশ্বাসে আয়না ঝাপসা হয়ে যাওয়ার মতো।
আলাপ—অর্ধেক আলাপ, অসমাপ্ত বাক্য, বিমূর্ততা, তুলোর মাথা লাগানো কাঠি দিয়ে বাজানো চীনা ঘণ্টার মতো, সাদা কমলার ফুল আঁকা চীনামাটির বাসনের মতো। নরমদেহী নারীদের ঘনিষ্ঠ, চাপা, অর্ধেক কথোপকথন। যে পুরুষদের সে আলিঙ্গন করেছে, যে নারীদের, তারা সবাই আমার স্মৃতির সুরে ভেসে বেড়াচ্ছিল। শব্দের ভেতর শব্দ, দৃশ্যের ভেতর দৃশ্য, নারীর ভেতর নারী—অদৃশ্য এক লিপি উন্মোচন করছিল এসিডের মতো। নারী থেকে নারী, চিরকালীন এক শোভাযাত্রা, আমার মনকে ভেঙে ফেলছিল টুকরো টুকরো করে, এমন সূক্ষ্ম সুরে যা কোনো অর্কেস্ট্রার ছড়ি কখনো একত্র করতে পারবে না।
তার মুখের দীপ্তিময় মুখোশ, মোমের মতো, স্থির, চোখ দুটি প্রহরীর মতো সতর্ক। সে দেখছিল আমার ভোগবিলাসী ভঙ্গি, আর আমি শুনছিলাম তার জিহ্বার সিসকারি। আমরা একে অপরের দিকে ফিরেছিলাম—আমাদের বেশ্যা-চোখ দিয়ে। সে ছিল বাইজান্টিয়ামের এক দেবী, পা ফাঁক করে নাচছে; আর আমি লিখছিলাম পরাগ আর মধু দিয়ে। নারীর নরম, গোপন আত্মসমর্পণ আমি পুরুষদের মস্তিষ্কে খোদাই করেছিলাম তামার অক্ষরে; তার প্রতিচ্ছবি আমি উল্কির মতো বসিয়ে দিয়েছিলাম তাদের চোখে। তারা ভেতরের উন্মাদনায় গ্রাস হয়েছিল, কিংবদন্তির অবিনশ্বর বিষে আক্রান্ত হয়েছিল। যদি প্রবাহ তাদের ভাসিয়ে নিয়ে না যেত, অথবা তারা নিজেদের ছাড়িয়ে নিত, তবে আমি তাদের স্মৃতিকে তাড়া করতাম সেই কাহিনীতে, যা তারা ভুলে যেতে চাইত। নারীর যে দ্রুত ও দুষ্ট প্রকৃতি ছিল, হয়তো তা ধ্বংস করা যেত, কিন্তু কে ধ্বংস করবে সেই ভ্রান্তি, যার ওপর প্রতিদিন রাতে আমি তাকে ঘুম পাড়াতাম? আমরা বাস করতাম বাইজান্টিয়ামে—আমি আর সাবিনা—যতক্ষণ না আমাদের কপালে থাকা রত্ন থেকে রক্ত ঝরেছে, আমাদের দেহ ক্লান্ত হয়েছে ভারী বস্ত্রের ওজনে, আমাদের নাসিকা জ্বলে উঠেছে ধূপের ধোঁয়ায়। আর যখন আমরা অন্য শতাব্দীতে পাড়ি দিলাম, তখন তারা আমাদের আবদ্ধ করল তামার ফ্রেমে। পুরুষরা তাকে চিনত সর্বদা—একই উজ্জ্বল মুখ, একই মরিচাধরা কণ্ঠ। আর আমি আর সে, আমরা চিনতাম একে অপরকে; আমি তার মুখকে, আর সে আমার কিংবদন্তিকে।
আমার নাড়ির চারপাশে সে পরিয়ে দিয়েছিল এক চওড়া স্টিলের কংকণ, আর আমার নাড়ি বেজেছিল তার ইচ্ছেমতো, মানবিক ছন্দ হারিয়ে ফেলেছিল—উন্মত্ত উল্লাসে কোনো অসভ্য ড্রামের মতো। বাঁশির বিলাপ, আমাদের সরু হাড়ের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া দ্বিগুণ হাওয়ার গান, আমাদের হাড় ভাঙার প্রতিধ্বনি যেন দূর থেকে ফিরে আসছিল—যখন আমাদের প্রেরিত পূজা রূপান্তরিত হয়েছিল কামনায়, রেশমি শয্যার ভেতর।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে এগোচ্ছিলাম। রাস্তায় বাতিস্তম্ভ থেকে আতশবাজি ছুটছিল; আমরা গিলে ফেলছিলাম ডামরার রাস্তা এক জঙ্গলের গর্জনে, গিলে ফেলছিলাম ঘুমন্ত বাড়িগুলো তাদের বন্ধ চোখ আর জারেনিয়ামের মতো পাপড়ির দোরগোড়াসহ; গিলে ফেলছিলাম বার্তা-কাঁপা টেলিগ্রাফের খুঁটি; গিলে ফেলছিলাম ভবঘুরে বিড়াল, গাছ, পাহাড়, ঝোপঝাড়; গিলে ফেলছিলাম চাবির ছিদ্রে সাবিনার গোলকধাঁধার হাসি। দরজা গোঙাচ্ছিল, খুলছিল। তার হাসি বন্ধ। এক বুলবুলি পাতা ঝরাচ্ছিল মধুমালতী থেকে। মধু-চুষে নেওয়া। বাঁশির মতো আঙুল। বাড়িটি তার সবুজ দরজা খুলে আমাদের গিলে ফেলল। শয্যা ভাসছিল।
রেকর্ডে আঁচড় লেগেছিল, সুর ভেঙে গিয়েছিল। টুকরোগুলো আমাদের পা কেটে দিচ্ছিল। ভোর হলো, আর সে হারিয়ে গেল। আমি আবার বসালাম বাড়িগুলো রাস্তার ধারে, টেলিগ্রাফের খুঁটিগুলো নদীর ধারে, আর লাফানো বিড়ালগুলোকে ফিরিয়ে দিলাম রাস্তায়। আমি আবার দাঁড় করালাম পাহাড়। রাস্তা আমার মুখ থেকে বেরোলো এক মখমলের ফিতার মতো—সর্পিল হয়ে শুয়ে থাকল। বাড়িগুলো তাদের চোখ খুলল। চাবির ছিদ্রের বাঁক হয়ে গেল বিদ্রূপাত্মক প্রশ্নবোধকের মতো। নারীর মুখ।
আমি বহন করছিলাম তার পূজ্য জিনিস, তার কাঠের পুতুল, তার ভাগ্য গণনার তাস—যার কোণ ক্ষয়ে গেছে ঢেউয়ের ধারে। শহরের জানালাগুলো বৃষ্টির আলোয় দাগধরা, খণ্ডিত, আর প্রতিটি মিথ্যা, প্রতিটি প্রতারণায় সে যে রক্ত আমার থেকে শুষে নিয়েছিল, সেই রক্তে ভিজে। তার গালের ত্বকের নিচে আমি ছাই দেখেছিলাম: আমরা বিশ্বাসঘাতকতায় মিশে যাওয়ার আগেই কি সে মারা যাবে? চোখ, হাত, ইন্দ্রিয়—যা কেবল নারীরই থাকে।
নারীর মধ্যে কোনো উপহাস নেই। একজন শুয়ে পড়ে শান্তিতে, যেন নিজের বুকে শুয়ে আছে।
সাবিনা আর পুরুষ ও নারীকে আলিঙ্গন করছিল না। তার অস্থিরতার জ্বরে পৃথিবী হারাচ্ছিল মানবিক আকৃতি। সে হারাচ্ছিল মানুষের সেই ক্ষমতা—দেহকে দেহের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে মেলানোর ক্ষমতা। সে সীমা টানছিল দিগন্তে, ডুবে যাচ্ছিল অক্ষহীন গ্রহে, হারাচ্ছিল নিজের মেরু, আর ঐশ্বরিক সংযুক্তি ও মিলনের জ্ঞান। সে ছড়িয়ে পড়ছিল রাত্রির মতো সমগ্র বিশ্বে, অথচ খুঁজে পাচ্ছিল না কোনো দেবতা, যার সঙ্গে শয্যা ভাগ করবে। অপর অর্ধাংশটি ছিল সূর্যের, আর সে ছিল সূর্য ও আলোর সঙ্গে যুদ্ধে। কোনো খোলা বইয়ের পাতায় আলো ফেলে রাখা বার সে সহ্য করত না, কোনো একক সুরে বাঁধা ধারণার সমবেত সংগীত সে মেনে নিত না; সে সূর্যের আবরণে ঢাকা পড়তে চাইত না, অথচ মহাবিশ্বের অর্ধেক তার দখলে। সে ফিরিয়ে দিচ্ছিল নিজের সাপসদৃশ পিঠ, একমাত্র সেই শক্তির প্রতি যা তার মহিমাকে আচ্ছাদিত করতে পারত, যা তাকে দান করত উর্বরতার আনন্দ।
এসো আমার সঙ্গে, সাবিনা, এসো আমার দ্বীপে। এসো আমার দ্বীপে—যেখানে ধীরে ধীরে দাউ দাউ করে জ্বলছে লাল মরিচের আগুন, মৌরিশ কাদামাটির কলসে ধরা দিচ্ছে সোনালি জল, খেজুরগাছ, বুনো বেড়ালদের লড়াই, ভোরে কাঁদছে এক গাধা, প্রবালপ্রাচীর ও সাগর-অ্যানেমোনে পায়ের ছাপ, শরীর ঢাকা লম্বা সাগরশৈবালে, অপেরা কমিকের বারান্দা থেকে ঝুলে থাকা মেলিজান্ডের চুল, নির্মম হীরক-সূর্যালোক, বেগুনি ছায়ার ভেতরে ভারী, অসাড় ঘণ্টাগুলো, ছাইরঙা শিলা আর জলপাইগাছ, লেবুগাছ যেখানে লেবুগুলো ঝুলছে বাগানবাড়ির উৎসবে লণ্ঠনের মতো, বাঁশের কঞ্চি চিরকাল কাঁপছে, নরম সুরের এসপাদ্রিল, রক্ত ছিটানো ডালিম, এক বাঁশির মতো মৌরিশ সুর, দীর্ঘ ও অনবরত—চাষিরা গাইছে, গালাগাল দিচ্ছে, গাইছে আবার অভিশাপ দিচ্ছে, বীজের সঙ্গে ঘামে ভিজিয়ে দিচ্ছে মাটি।
তোমার সৌন্দর্য আমাকে ডুবিয়ে দেয়, আমার অন্তর্গত কেন্দ্রকে ডুবিয়ে দেয়। যখন তোমার সৌন্দর্য আমাকে দগ্ধ করে, আমি গলে যাই এমনভাবে, যেভাবে কোনো পুরুষের সামনে আমি কখনো গলাইনি। সব পুরুষের থেকে আমি আলাদা ছিলাম, আলাদা ছিলাম নিজের কাছেও, অথচ তোমার ভেতরে আমি দেখি সেই অংশ—যা আসলে আমারই। আমি তোমাকে নিজের মধ্যে অনুভব করি; আমি অনুভব করি আমার নিজের কণ্ঠ ভারী হয়ে আসছে, যেন তোমাকে পান করছি, প্রতিটি সূক্ষ্ম সাদৃশ্যের সুতোগুলো আগুনে গলিয়ে এক হয়ে যাচ্ছে, আর আর কোনো ফাঁক খুঁজে পাওয়া যায় না।
তোমার মিথ্যা আসলে মিথ্যা নয়, সাবিনা। ওগুলো তোমার কল্পনার শক্তি দিয়ে ছুঁড়ে দেওয়া তীর। বিভ্রমকে খাওয়ানোর জন্য। বাস্তবতাকে ধ্বংস করার জন্য। আমি তোমাকে সাহায্য করব: আমি-ই তোমার জন্য মিথ্যা উদ্ভাবন করব, আর সেইসব মিথ্যা নিয়ে আমরা ভ্রমণ করব পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। কিন্তু আমাদের মিথ্যার আড়ালে আমি ফেলে যাচ্ছি অ্যারিয়াডনের সোনালি সুতো—কারণ মিথ্যা পেরিয়ে আবার উৎসে ফিরে যাওয়ার আনন্দই সর্বোচ্চ আনন্দ, বছরে এক রাত হলেও সমস্ত আবরণ ধুয়ে ফেলে উৎসে ফিরে গিয়ে ঘুমানোর আনন্দ।
সাবিনা, তুমি তোমার ছাপ রেখে গেছো পৃথিবীতে। আমি চলে গেছি এর ভেতর দিয়ে ভূতের মতো। কেউ কি খেয়াল করে গাছের ডালে বসা পেঁচাকে রাতে? অথবা সেই বাদুড়কে, যে জানলার কাচে ধাক্কা মারে যখন অন্যরা আলাপে ব্যস্ত? কেউ কি খেয়াল করে সেই চোখকে, যা জলের মতো প্রতিফলিত হয়, আর শুষে নেয় কাগজের মতো? সেই দয়ার আলোকে, যা নিঃশব্দে কাঁপে প্রদীপের শিখার মতো? সেই বোঝাপড়াকে, যার ওপর মানুষ নিজেদের শোয় ঘুমোবার আগে?
কেউ কি জানে আমি কে?
আমার কণ্ঠও এসেছিল অন্য জগত থেকে। আমি নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলাম আমার গোপন মাথা-ঘোরার মধ্যে। আমি ঝুলছিলাম পৃথিবীর ওপর, দেখছিলাম কোন পথে আমি হাঁটতে পারি—তবুও যাতে কাদায় বা ঘাসে পা না পড়ে। আমার পদক্ষেপ ছিল সচেতন পদক্ষেপ; শুধু কংকর ভাঙার খসখস শব্দও আমার গমন থামিয়ে দিতে পারত।
যখন তোমাকে দেখলাম, সাবিনা, আমি বেছে নিলাম আমার দেহ।
আমি তোমাকে আমাকে ধ্বংসের উর্বরতায় বয়ে নিয়ে যেতে দেব। আমি তখন বেছে নিলাম এক দেহ, এক মুখ, এক কণ্ঠ। আমি হয়ে গেলাম তুমি। আর তুমি হয়ে গেলে আমি। তোমার দেহের ঝড়ো পথকে স্তব্ধ করো, আর তুমি আমার মধ্যে অক্ষত অবস্থায় দেখতে পাবে তোমার নিজের ভয়, তোমার নিজের দয়া। তুমি দেখতে পাবে সেই প্রেম, যা তোমার পাওয়া উন্মাদ আবেগের বাইরে ছিল; আর আমি দেখতে পাব সেই আবেগ, যা প্রেম থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। তোমার ভূমিকাকে এক মুহূর্তের জন্য ছেড়ে দাও, বিশ্রাম নাও তোমার সত্যিকারের বাসনার কেন্দ্রে। কিছুক্ষণ থামাও তোমার সহিংস বিচ্যুতি। ত্যাগ করো তোমার দুর্দমনীয় উন্মত্ত চাপ।
আমি তা তুলে নেব।
থামাও তোমার কাঁপুনি, হাঁপানো, অভিশাপ; আর খুঁজে নাও আবার তোমার অন্তর্নিহিত কেন্দ্র, যা আমি। বিশ্রাম নাও বিকৃতি, বিকলতা, বিকৃত রূপ থেকে। এক ঘণ্টার জন্য তুমি হবে আমি; অর্থাৎ, তোমার নিজের আরেক অর্ধেক। যে অর্ধেক তুমি হারিয়েছো। যা তুমি পুড়িয়েছো, ভেঙেছো, ছিঁড়েছো—সবই এখনও আমার হাতে: আমি ভঙ্গুর জিনিসের রক্ষক, আর তোমার সেই অংশ আমি ধরে রেখেছি যা অবিনশ্বর।
এমনকি পৃথিবী আর সূর্যও একসঙ্গে তাদের দুই মুখ দেখাতে পারে না।
তাহলে এখন আমরা অবিচ্ছেদ্যভাবে বোনা। আমি একত্র করেছি সব খণ্ডাংশ। আমি তা ফিরিয়ে দিচ্ছি তোমাকে। তুমি বাতাসের সঙ্গে ছুটে গিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলে, গলিয়ে দিয়েছিলে। আমি তোমার পিছু নিয়েছিলাম, তোমার নিজের ছায়ার মতো, আর তুমি যা বপন করেছিলে আমি তা সংগ্রহ করেছি গভীর ভাণ্ডারে।
আমি তোমার আরেক মুখ।
আমাদের মুখ নরম চুলে সোল্ডার করা, সোল্ডার করা, যেন এক আত্মার দুটি প্রোফাইল। এমনকি যখন আমি নিঃশ্বাসের মতো এক ঘর পেরিয়ে যেতাম, আমি অন্যদের অস্থির করে তুলতাম, তারা জানত আমি পেরিয়েছি।
আমি ছিলাম তোমার নিশ্বাসের সাদা শিখা, তোমার সমীর বাতাস যা পৃথিবীকে শুকিয়ে দেয়। আমি ধার নিয়েছিলাম তোমার দৃশ্যমানতা, আর তোমার মাধ্যমেই আমি আমার ছাপ রেখে গিয়েছিলাম পৃথিবীতে। আমি আমার নিজের শিখাকে প্রশংসা করেছি তোমার মধ্যে।
এটাই সেই বই যা তুমি লিখেছো।
আর তুমি সেই নারী।
আমি।
কেবল আমাদের মুখ দুটোই উজ্জ্বল হতে হবে দ্বিগুণভাবে—দিন ও রাতের মতো—সবসময়ই আলাদা, সময় ও মহাকাশের বিবর্তনে বিভাজিত।
ধোঁয়া আমার মাথাকে ছাদে পাঠিয়ে দিল: সেখানে ঝুলছিল, নিচে তাকাচ্ছিল ব্যাঙের চোখ, খড়ের মতো চুল, মলিন চামড়ার মতো ঠোঁট, টাক মাথার আয়না, পশম-ঢাকা বাঁদরের হাত যার তালু হ্যামের মতো রঙিন। সঙ্গীত অতীতকে কবর থেকে চাবুক মেরে তুলল আর মমিরা আমার স্মৃতিকে প্রহার করল।
যদি সাবিনা এখন কেবল একটি স্মৃতি হতো; যদি আমি এখানে বসতাম আর সে আর কখনো না আসত! যদি আমি কেবল এক রাতের জন্য তাকে কল্পনা করতাম—কারণ মাদক সূক্ষ্ম ছেদন করেছিল, আমার দেহের স্তরগুলোকে সাজিয়েছিল পারস্যের রেশমি দোলনায়, প্রতিটি স্নায়ুকে তুলোয় মোড়ানো আর কল্পনার রেডিয়াম তীর নিক্ষেপ করেছিল মাংসের ভেতর…
আমি জমে যাচ্ছি, আর আমার মাথা ধোঁয়ার পাতলা পর্দা ভেদ করে নেমে যাচ্ছে। আমি আবার খুঁজছি সাবিনাকে—গভীর যন্ত্রণায়—মুখহীন জনতার ভেতর।
আমি আক্রান্ত ছবির একগুঁয়ে আক্রমণে, ভাঙা আয়নায় প্রতিফলনে। আমি এমন এক নারী—যার চোখ সিয়ামি বিড়ালের মতো, যে সবসময় হাসছে আমার সবচেয়ে গুরুতর কথার আড়ালে, আমার তীব্রতাকে ব্যঙ্গ করছে। আমি হাসি কারণ আমি শুনি অন্যজনকে, আর আমি বিশ্বাস করি অন্যজনকে। আমি এক পুতুল—অদক্ষ আঙুলে টানা—ছিঁড়ে যাওয়া, বেমানানভাবে বিকৃত; এক হাত মৃত, অন্য হাত আকাশে উচ্ছ্বাসে ভাসমান। আমি হাসি, কথোপকথনে যেখানে মানায় সেখানে নয়, বরং যেখানে মানায় আমার কথার আন্ডারকারেন্টে। আমি জানতে চাই ভেতরে কী চলছে, যেটা তিক্ত বিস্ফোরণে বিরামচিহ্নিত। দুই স্রোত মেলে না। আমি দেখি আমার ভেতরে দুই নারী—অদ্ভুতভাবে বাঁধা, যেন সার্কাসের যমজ। আমি দেখি তারা একে অপরকে ছিঁড়ে ফেলছে। আমি শুনতে পাই ছিঁড়ে যাওয়ার শব্দ—রাগ আর ভালোবাসা, আবেগ আর দয়া। যখন সেই বিচ্ছেদের কাজ হঠাৎ থেমে যায়—অথবা আমি আর শব্দটা অনুভব করি না—তখন নীরবতা হয়ে ওঠে আরও ভয়াবহ, কারণ চারপাশে থাকে কেবল উন্মাদনা, নিজের ভেতরে টানাপোড়েন, শেকড় একে অপরকে ছিঁড়ে ফেলছে আলাদা হয়ে বেড়ে ওঠার জন্য, ঐক্য গড়তে গিয়ে সৃষ্ট যন্ত্রণা।
শুধু একখণ্ড সঙ্গীতই প্রয়োজন এই বিচ্ছেদকে সাময়িক স্তব্ধ করতে; কিন্তু তখন আবার হাসি ফিরে আসে, আর আমি বুঝি আমরা দুজনই লাফ দিয়েছি সংহতির সীমার বাইরে।
ধূসরতা কোনো সাধারণ ধূসরতা নয়, বরং এক বিশাল সীসার ছাদ, যা ঢেকে রেখেছে পৃথিবীকে—এক হাঁড়ির ঢাকনার মতো। মানুষের নিশ্বাস যেন ধোপার ঘরের বাষ্প। সিগারেটের ধোঁয়া যেন ভেসুভিয়াস থেকে ঝরে পড়া ছাইয়ের বৃষ্টি। আলোয় গন্ধ সালফারের, আর প্রতিটি মুখ তাকিয়ে থাকে তার নিজের ত্রুটির বিশালতায়। ঘরের ক্ষুদ্রতা যেন লোহার খাঁচা, যেখানে বসাও যায় না, শোয়াও যায় না। আর বড় ঘরের প্রশস্ততা যেন মৃত্যুঘাতী বিপদ, সর্বদা মাথার ওপর ঝুলে আছে, আনন্দের মুহূর্তে ভেঙে পড়বে। হাসি আর কান্না আলাদা অভিজ্ঞতা নয়, বিরতিরও নয়: তারা একসাথে উথলে ওঠে—এ যেন পায়ের মাঝখানে তলোয়ার নিয়ে হাঁটা। বৃষ্টি ভেজায় না তোমার চুল, বরং মস্তিষ্কের কোষে ঝরে পড়ে একগুঁয়ে ফোঁটায়। তুষার জমাট বাঁধে না হাতে, বরং ইথারের মতো ফুসফুস ফুলিয়ে দেয় যতক্ষণ না তা ফেটে যায়। সব জাহাজ ডুবে যাচ্ছে তাদের অন্ত্রে আগুন নিয়ে, আর প্রতিটি বাড়ির সেলারিতে আগুন সিসকার দিচ্ছে। প্রিয়জনের সবচেয়ে শুভ্র দেহই ভাঙা কাঁচে কাটা পড়বে, চাকার নিচে পিষ্ট হবে। রাতের দীর্ঘ হাহাকারগুলো আসলে মৃত্যুর হাহাকার। রাত হল নির্যাতকের সহযোগী। দিন হল ভয়াবহ আবিষ্কারের আলো। যদি কোনো কুকুর ঘেউ ঘেউ করে, তবে সে-ই সেই মানুষ—যে ভালোবাসে বিশাল ক্ষত নিয়ে জানালা দিয়ে লাফিয়ে ঢুকতে। হাসি উন্মাদনার আগে আসে। আমি অপেক্ষা করছি সেই ভারী পতনের জন্য, অপেক্ষা করছি মুখে ফেনা ওঠার জন্য।
একটি ঘর, যার ছাদ আমাকে হুমকি দিচ্ছে কাঁচির মতো খোলা হয়ে। অ্যাটিকের জানালা শুয়ে আছে খাটের ওপর কংকর হয়ে। সব সংযোগ ছিঁড়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে আমি বিদায় নিচ্ছি প্রতিটি প্রিয় সত্তার কাছ থেকে—ধীরে, সাবধানে, সম্পূর্ণভাবে। আমি বলছি তাদের—আমি তাদের কাছে কী ঋণী, আর তারা আমার কাছে কী ঋণী। আমি সংগ্রহ করছি তাদের শেষ দৃষ্টি আর শেষ মিলনের মুহূর্ত। আমার ঘর ফাঁকা, সূর্যালোকে ঝলসে উঠছে, প্রতিফলনে জীবিত—তার স্থিরতায় জমছে ইঙ্গিত, গোপন প্রতিচ্ছবি—যা একদিন আমাকে পাগল করে তুলবে, যখন দাঁড়াবো শূন্য প্রাচীরের সামনে, অতিরিক্ত শোনা আর অতিরিক্ত দেখার যন্ত্রণায়। আমি বিদায় নিচ্ছি সবার কাছ থেকে। আমি মারা যাচ্ছি একটি ছোট, কাঁচির খিলান-আকৃত ঘরে, প্রেম আর সম্পদহীন, এমনকি হোটেলের বইয়েও নথিভুক্ত নই। একই সময়ে আমি জানি, যদি কয়েকদিন এই ঘরে থেকে যেতাম, তবে একটি সম্পূর্ণ নতুন জীবন শুরু হতে পারত—যেমন অস্ত্রোপচারের পর মানুষের দেহ আবার জোড়া লাগে। এই নতুন জীবনের ভয়—মৃত্যুর ভয় থেকেও গভীর—আমাকে উদ্দীপ্ত করে তোলে। আমি বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠি, দৌড়ে বেরিয়ে যাই সেই ঘর থেকে, যা আমার চারপাশে বেড়ে উঠছিল বিষাক্ত জালের মতো, আমার কল্পনাকে জব্দ করছিল, আমার স্মৃতিকে গিলে ফেলছিল—যাতে সাত মুহূর্তের মধ্যে আমি ভুলে যাই আমি কে এবং কাকে ভালোবেসেছিলাম।
ওটা ছিল ৩৫ নম্বর ঘর—যেখানে আমি হয়তো পরের দিন সকালে জেগে উঠতাম পাগল হয়ে, অথবা পতিতা হয়ে।
আকাঙ্ক্ষা—যা স্নায়ুগুলোকে টেনে রেখেছিল—ভেঙে গেল, আর প্রতিটি স্নায়ু আলাদাভাবে ভাঙতে লাগল, ক্রমাগত, যেন কেটে দিচ্ছে, আর রক্তের বদলে বইছে অ্যাসিড। আমি নিজের জীবনের ভেতরে পেঁচিয়ে যাচ্ছিলাম, খুঁজছিলাম মুক্তির কোনো রাস্তা—যাতে গলিত আর্তনাদকে বহন করা যায়, যন্ত্রণাকে গলিয়ে তোলা যায় এমন এক বিশাল শব্দপাত্রে, যেখান থেকে সবাই তুলে নিতে পারে, সবাই—যারা তাদের নিজের যন্ত্রণার ভাষা খুঁজছে। কী বিশাল কড়াই নাড়ছি আমি এখন; বিশাল মুখভরা অ্যাসিড আমি খাওয়াচ্ছি অন্যদের—শব্দগুলো এত তিক্ত যে তা জ্বালিয়ে দেয় সব তিক্ততাকে।
মাটির বাদামি আবরণ ভাঙো আর পুরো সমুদ্র উঠে আসবে; সাগর-অ্যানেমোন ভেসে উঠবে আমার শয্যার ওপর, মৃত জাহাজগুলো এসে ভিড়বে আমার বাগানে। তাড়িয়ে দাও সেই দানবদের, যারা রাতের বেলা ঘণ্টাধ্বনি তোলে আমার মাথার ওপর—যখন সমস্ত গণনা থেমে যাওয়া উচিত; তারা বাজায় কারণ তারা জানে আমার স্বপ্নে আমি চুরি করছি শতাব্দীগুলো। সেটাকে এক ঘণ্টা হিসেবেই গণনা করতে হবে আমার বিরুদ্ধে।
আমি শুনেছিলাম আরব থেকে আনা লুটের সুর, আর আমার স্তনে অনুভব করেছিলাম তরল আগুনের স্রোত, যা আলহাম্বরার কক্ষে বয়ে যাচ্ছিল আর আমাকে পুনরুজ্জীবিত করছিল সেই অতিরিক্ত স্বচ্ছ জলের থেকে।
অত্যন্ত স্বচ্ছ যন্ত্রণার বিভাজন—বিভক্ত প্রেম, বিভক্ত প্রেম…
আমি ছিলাম নীলা-জাহাজে, প্রবাল-সমুদ্র বেয়ে চলা। দাঁড়িয়ে ছিলাম জাহাজের প্রান্তে, গান গাইছিলাম। আমার গান ফুলিয়ে তুলল পাল, আর ছিঁড়ে ফেলল তা; যেখানে ছিঁড়ল, সেসব প্রান্ত পুড়ে গেল, আর আমার কণ্ঠ ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন করল মেঘকেও।
আমি দেখলাম এক নগরী—যেখানে প্রতিটি বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে এক একটি শিলার ওপর, কালো সাগরের মাঝে, সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছে বেগুনি সর্প, হিসহিস শব্দ তুলে দিচ্ছে সতর্কতা, শিলাকে চেটে যাচ্ছে, তাদের বাগানের দেওয়ালের ওপর থেকে ফুলে ওঠা চোখ মেলে তাকিয়ে আছে।
আমি দেখলাম কাঁচের তালগাছ আমার চোখের সামনে দুলছে; আমার দ্বীপের তালগাছগুলো তখন স্তব্ধ আর ধুলোয় ঢাকা, যন্ত্রণায় নিস্তেজ। সবুজ পাতা আমার কাছে শুকিয়ে গেল, আর সব গাছ হয়ে উঠল কাঁচের মতো নিস্তেজ—শুধু কাঁচের তালগাছটি তার মাথার চূড়ায় ছুঁড়ে দিল এক নতুন পাতা, তার শিখরে, তার চরমে।
সাদা বাড়ির হৃদয় থেকে বেরিয়ে এলো এক সাদা পথ, তার ধার ঘিরে ছিল কাঁটাময় ক্যাকটাস—দীর্ঘ আঙুল, পশমে ঢাকা, বাতাসে অচল, বয়সহীন। সেই বয়সহীন ক্যাকটাসের ওপরে বাঁশের কঞ্চিগুলো কাঁপছিল—ঘনভাবে, চিরকাল, বাতাসের দোলায়।
বাড়িটি ছিল এক ডিমের আকৃতির, তুলোয় মোড়া ভেতর, কোনো জানালা নেই; সেখানে মানুষ ঘুমাত নরম তুলার ভেতরে, আর শোনাত খোলস ভেদ করে রাস্তার অর্গানের সুর, আর আপেলওয়ালার হাঁক—যে খুঁজে পাচ্ছিল না ঘণ্টা।
চিত্রকল্প—যা দেহের ভেতর আত্মার বিলয় ঘটাচ্ছিল, যেমন মধু-অম্লের বিস্ফোরণে ঘটে যায় সুখী-বিধ্বংস। চিত্রকল্প রক্তকে সামনে-পেছনে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, আর মনের সতর্কতা—যা বিপজ্জনক উল্লাসকে আটকে রাখে—তা হয়ে গিয়েছিল বৃথা। বাস্তবতা ডুবে গিয়েছিল, আর কল্পনাগুলো প্রতিটি ঘণ্টায় শ্বাসরোধ করছিল দিনটিকে।
আজ কিছুই সত্য মনে হয় না, শুধু সেই সোনালি মাছের মৃত্যু ছাড়া—যে একসময়ে পুলে মিলিত হতো ঘণ্টায় নব্বই কিলোমিটার গতিতে। দাসী তাকে দিয়েছে খ্রিস্টীয় কবর। কেঁচোদের জন্য! কেঁচোদের জন্য!
আমি আবার ভেসে যাচ্ছি। সব তথ্য, সব শব্দ, সব ছবি, সব পূর্বলক্ষণ—সব আমাকে ঘিরে বইছে, একে অপরকে উপহাস করছে। স্বপ্ন! স্বপ্ন! স্বপ্ন আমার ভেতরে বাজছে এক বিশাল তামার ঘণ্টার মতো, যখন আমি তাকে বিশ্বাসঘাতকতা করতে চাই। এটি আমাকে ছুঁয়ে যায় বাদুড়ের ডানায়, যখন আমি মানবচোখ খুলে স্বপ্নহীনভাবে বাঁচতে চাই। যখন মানবিক যন্ত্রণা আমাকে প্রবলভাবে আঘাত করেছে, যখন ক্রোধ আমাকে ক্ষয় করেছে, আমি উঠি, আমি সর্বদা উঠি ক্রুশবিদ্ধতার পর, আর আমার ভয় হয় আমার এই উত্থানেই। বাস্তবতার ফাটল। ঐশ্বরিক বিদায়। আমি পড়ি। আমি পড়ি অন্ধকারে—যন্ত্রণার সঙ্গে সংঘর্ষের পর, আর যন্ত্রণার পর আসে ঐশ্বরিক বিদায়।
ওহ, আমার মাথার ওজন, মেঘে টেনে তোলা বিশাল ওজন—মহাশূন্যে দুলছে; শরীর যেন খড়ের এক আঁশটুকু; মেঘ টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমার চুল, যেন গাড়ির চাকার মধ্যে আটকে থাকা এক ওড়না; শরীর দুলছে, ঝুলছে, ধাক্কা খাচ্ছে লণ্ঠনের তারকাদের সঙ্গে, মেঘ আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সারা পৃথিবীর ওপর দিয়ে।
আমি থামতে পারি না, নামতেও পারি না।
আমি শুনি জলের উন্মোচন, আকাশের আর পর্দার উন্মোচন। শুনি পাতার শিহরণ, বাতাসের নিঃশ্বাস, জন্মহীনদের ক্রন্দন, হাওয়ার চাপ।
আমি শুনি নক্ষত্র ও গ্রহের নড়াচড়া, সামান্য মরিচাধরা খচখচ শব্দ যখন তারা অবস্থান বদলায়। শুনি রশ্মির মসৃণ চলাচল, শুনি বৃত্তের নিঃশ্বাস ঘুরছে।
আমি শুনি রহস্যের গমন, দানবের শ্বাস। শুধু উচ্চস্বর, অথবা নিম্নস্বর। বাস্তবতার সঙ্গে সংঘর্ষ ঝাপসা করে দেয় আমার দৃষ্টি এবং আমাকে ডুবিয়ে দেয় স্বপ্নে। আমি দূরত্বকে অনুভব করি এক ক্ষতের মতো। এটি নিজেকে মেলে ধরে আমার সামনে, যেমন মেলে কোনো গির্জার সিঁড়ির সামনে কার্পেট—বিয়ে বা অন্ত্যেষ্টির জন্য। এটি মেলে ধরে এক লাল কনের মতো, অন্যদের সঙ্গে আমার মধ্যে, কিন্তু আমি তাতে হাঁটতে পারি না—কারণ এর ভেতরে থাকে এক ধরনের অস্বস্তি, যেমন থাকে কোনো আনুষ্ঠানিকতার সময়ে। সেই আনুষ্ঠানিকতার কার্পেটে হাঁটা, সেই ঘরে প্রবেশ করা, যেখানে অনুষ্ঠান উদঘাটিত হচ্ছে, অথচ আমি সেখানে অপরিচিত। আমি না বিয়ে করি, না মৃত্যুতে অংশ নিই। আর ভিড়ের সঙ্গে, অন্যদের সঙ্গে আমার দূরত্ব আরও বাড়তে থাকে।
দূরত্ব। আমি কখনো হাঁটিনি সেই কার্পেটের ওপর দিয়ে কোনো অনুষ্ঠানে। কখনো যাইনি ভিড়ের পরিপূর্ণ জীবনে, মানুষের আসল সঙ্গীত ও গন্ধের ভেতরে। আমি কখনো উপস্থিত ছিলাম না বিয়েতে বা অন্ত্যেষ্টিতে। আমার জন্য সবকিছু ঘটত হয় ঘণ্টাঘরে—যেখানে আমি একা ছিলাম লৌহকণ্ঠের কানে-ফাটা ঘণ্টার শব্দে, নয়তো সেলারে—যেখানে আমি কুড়োচ্ছিলাম মোমবাতি আর ধূপ, ইঁদুরদের সঙ্গে।
আমি কোনো ঘটনার, কোনো স্থানের নিশ্চয়তা পাই না—শুধু পাই আমার নিঃসঙ্গতার। বলো আমাকে, নক্ষত্ররা আমার সম্পর্কে কী বলছে। শনি কি পেঁয়াজ-চোখে সবসময় কাঁদছে? বুধের গোড়ালিতে কি মুরগির পালক গজিয়েছে, আর মঙ্গল কি পরে আছে গ্যাসমাস্ক? যমজ রাশি—জেমিনি—তারা কি অবিরত বিবর্তিত হচ্ছে, যেন কাঁটার শিকে ঘোরানো মাংস, জেমিনি আ লা ব্রশে?
আমার দৃষ্টিতে একটি ফাটল আছে, আর উন্মাদনা সবসময় সেখান দিয়ে ঢুকে পড়ে। তুমি ঝুঁকে পড়ো আমার উন্মাদনার শয্যার পাশে, আর আমাকে দাঁড়াতে দাও—বাহন ছাড়া।
আমি এক উন্মাদ নারী—যার কাছে ঘরগুলো চোখ টিপে, আর খুলে দেয় তাদের উদর। তাৎপর্য আমাকে চেয়ে থাকে সর্বত্র, এক বিশাল ভূতুরে উপস্থিতির মতো। তাৎপর্য উঠে আসে ভেজা গলি থেকে, বিষণ্ন মুখ থেকে, অচেনা জানালার ভেতর থেকে ঝুঁকে পড়ে। আমি অবিরত পুনর্গঠন করি এক নকশা—যা চিরতরে হারিয়ে গেছে, অথচ আমি ভুলতে পারি না; আমি ধরে ফেলি অতীতের গন্ধ রাস্তার মোড়ে, আর আমি সচেতন হই সেই পুরুষদের সম্পর্কে—যারা জন্ম নেবে আগামীকাল। জানালার আড়ালে থাকে হয় শত্রু, নয় পূজারি। নিরপেক্ষতা বা উদাসীনতা নেই কখনো। সর্বদা উদ্দেশ্য আর পূর্বপরিকল্পনা। এমনকি পাথরেরও আমার কাছে থাকে ড্রুইডদের অভিব্যক্তি।
আমি হাঁটি নিজের আগেই, অনন্ত অলৌকিক প্রত্যাশায়।
আমি জড়িয়ে আছি আমার মিথ্যার জালে, আর চাই মুক্তি। আমি সত্য বলতে পারি না, কারণ আমি অনুভব করেছি পুরুষদের মাথা আমার গর্ভে। সত্য হবে মৃত্যুদায়ক, তাই আমি বেছে নিয়েছি রূপকথা। আমি মোড়ানো আছি মিথ্যায়, যা আমার আত্মায় পৌঁছায় না। যেন আমার বলা মিথ্যাগুলো কেবল পোশাক। রহস্যের আবরণ ভেঙে যেতে পারে, আবার রাতারাতি জন্ম নিতে পারে। কিন্তু মুহূর্তে আমি পা রাখি আমার মিথ্যার গুহায়, আমি ডুবে যাই অন্ধকারে। আমি দেখি একটি মুখ, যা তাকিয়ে থাকে আমার দিকে—যেমন তাকায় এক কানা মানুষের দৃষ্টি।
আমি মনে করি বৃহস্পতিতে হিমে জমে যাওয়া অ্যামোনিয়ার ঠান্ডা, আর সেই অ্যামোনিয়ার স্ফটিক থেকে জন্ম নিয়েছিল ফেরেশতারা। আমি মনে করি ইউরেনাসে অ্যামোনিয়া আর মিথেনের বলয় ঘিরে আছে। আমি মনে করি শনিতে দাউ দাউ করে জ্বলন্ত মিথেনের ঘূর্ণিঝড়। আমি মনে করি মঙ্গলে এক ধরনের উদ্ভিদ জন্মাত—পেরু আর প্যাটাগোনিয়ার তুষখ ঘাসের মতো, মাটির লালচে রঙ, মরিচাধরা আকরিকের মতো উদ্ভিদ, শ্যাওলা আর লাইকেন। লোহা মিশ্রিত লাল মাটি আর লাল বেলেপাথর। সেখানে আলো ছিল এক সঙ্গীত, আর সূর্যালোক ছিল এক অর্কেস্ট্রা।
প্রসারিত চোখ, অভিজাত বংশের মতো প্রোফাইল, জেদি মুখ। জাঁ, পুরো শরীরে পশমে ঢাকা, পশমের মতো চোখের পাতা, মাথা উঁচু করে, নাকে বাতাস লাগিয়ে, চোখ তারা জুড়ে হাঁটছে, রাজসিক ভঙ্গিতে হাঁটছে, আর টেনে নিয়ে যাচ্ছে তার পঙ্গু পা। তার চোখ মানুষের স্তরের ওপরে, কিন্তু তার পা লম্বা দেহের পেছনে টেনে চলছে নিষ্ক্রিয়ভাবে, যেন কোনো বন্দীর পায়ে বাঁধা বলের মতো।
বন্দী পৃথিবীতে, মরতে না-চাওয়া জীবনে।
তার পা টেনে নিয়ে চলছে শুধু পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য—একটি মৃত ভারী পা, যা সে বহন করছে যেন কোনো বন্দীর লোহার বল।
তার ফ্যাকাশে, স্নায়ুতাড়িত আঙুলগুলো নির্দয়ভাবে গিটারকে যন্ত্রণায় ফেলে, স্নায়বিক দ্বিধার ভেতর দিয়ে তার নিম্নস্বরে গান ফুটছিল; আর সেই গানের আড়ালে ছিল তার তৃষ্ণা, তার ক্ষুধা, তার ভয়। যখন সে তীব্রভাবে তার গিটারের তারগুলো টানছিল, একটি তার ছিঁড়ে গেল, আর তার চোখ আতঙ্কিত হলো, যেন তার সমগ্র মহাবিশ্ব ছিঁড়ে গেছে।
সে গান গাইল এবং হেসে উঠল: আমি আমার ভাইকে ভালোবাসি।
আমি আমার ভাইকে ভালোবাসি। আমি চাই ক্রুসেড আর শহিদী মৃত্যু। আমি মনে করি পৃথিবীটা অনেক ছোট।
পরাজয়ের নোনা অশ্রু স্ফটিক হয়ে জমে উঠল তার অস্থির চোখের কোণে।
কিন্তু আমি কখনো কাঁদি না।
সে একটি আয়না তুলে নিল এবং নিজেকে ভালোবাসায় ভরা দৃষ্টিতে দেখল।
নরসিস লানভিন আয়নায় নিজেকে দেখছে। চার অশ্বারোহী বোয়া দে বুলোনের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে। ট্র্যাজেডি কর্ড টায়ারে গড়িয়ে চলেছে।
পৃথিবীটা খুব ছোট। আমি ক্লান্ত হই গিটার বাজাতে, বুনতে, হাঁটতে, সন্তান জন্ম দিতে। পুরুষরা ক্ষুদ্র, আর আবেগগুলো স্বল্পস্থায়ী। আমি ক্রুদ্ধ হই সিঁড়ি দেখে, দরজা দেখে, দেয়াল দেখে, আমি ক্রুদ্ধ হই প্রতিদিনের জীবনের প্রতি, যা আমার উন্মত্ত পরমানন্দের ধারাবাহিকতায় বাধা সৃষ্টি করে।
কিন্তু আছে এক ধরনের শহিদীযন্ত্রণা—টানটান উত্তেজনার, জ্বরের, এমন এক জীবনের, যা বাঁচে আকাশের মতোই, পূর্ণ গতিতে আর পূর্ণ আলোকোজ্জ্বলতায়।
তুমি কখনো তারাদের ক্লান্ত হতে বা ম্লান হতে দেখোনি। তারা কখনো ঘুমোয় না।
সে বসে রইল হাতে ধরা আয়না নিয়ে, খুঁজছিল সেই চোখের পাতা, যা পড়ে গিয়েছিল তার চোখে।
“আমি এমন এক পুরুষকে বিয়ে করেছি,” জাঁ বলল, “যিনি কখনো আঁকা চোখের জল দেখেননি, আর আমার বিয়ের দিন আমি কেঁদেছিলাম। সে আমাকে দেখল, আর দেখল এক নারী বিশাল কালো অশ্রু ঝরাচ্ছে, খুবই কালো অশ্রু। আমার কালো অশ্রু ফেলে দিতে দেখে সে ভয় পেয়েছিল। ঘণ্টাধ্বনি যখন বাজল আমি মনে করলাম সেগুলো অতিরিক্ত জোরে বাজছে। সেগুলো আমাকে বধির করে দিল। আমি অনুভব করলাম আমি রক্তের অশ্রু ফেলব, আমার কান ব্যথা করতে লাগল। আমি কাশলাম কারণ শব্দ ছিল অসহনীয়, যেমন একবার আমি চার্ত্রের ঘণ্টার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। সে বলল ঘণ্টা একেবারেই জোরে বাজছে না, কিন্তু আমি শুনছিলাম সেগুলো আমার ভেতরে, এত কাছে যে আমি তার কণ্ঠও শুনতে পাচ্ছিলাম না, আর শব্দ যেন আমার মাংসে হাতুড়ি মারছে। আমি মনে করছিলাম আমার কান ফেটে যাবে। আমার শরীরের প্রতিটি কোষ ফেটে যাচ্ছিল, বিশাল এই শব্দ-ঝড়ে, যেখান থেকে পালানো অসম্ভব। আমি চিৎকার করছিলাম: ‘ঘণ্টাধ্বনি থামাও!’ কিন্তু আমি পালাতে পারছিলাম না কারণ শব্দ সর্বত্র, আমার চারপাশে আর ভেতরে, যেন আমার হৃদয় বিশাল লোহার ঢোলের মতো ধুকপুক করছে, ধমনীগুলো ঝনঝন করছে ঝংকারে, মাথা যেন গ্রানাইটে আছড়ে পড়ছে আর হাতুড়ি কপালের শিরায় বাজছে। একটানা বিস্ফোরণ, যার ধাক্কায় আমার স্নায়ু মোচড়াচ্ছিল, গুটিয়ে যাচ্ছিল, অবশেষে ছিঁড়ে যাচ্ছিল, মাংস সঙ্কুচিত হয়ে ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল, আর কান থেকে রক্ত ঝরছিল… আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না… সহ্য করতে পারছিলাম না আমার নিজের বিয়ে, সহ্য করতে পারছিলাম না পুরুষকে বিয়ে করা, কারণ, কারণ, কারণ…”
আমি আমার ভাইকে ভালোবাসি!
সে তার ভারী ভারতীয় বালা ঝাঁকাল, তার ওরিয়েন্ট নীল বোতলগুলোকে আদর করল, তারপর আবার শুয়ে পড়ল।
আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্লান্ত নারী। ঘুম থেকে উঠেই আমি ক্লান্ত হয়ে যাই। জীবন এমন এক প্রচেষ্টা দাবি করে, যা আমি করতে পারি না। অনুগ্রহ করে আমাকে সেই ভারী বইটা দাও। আমার মাথার ওপর সবসময় এরকম ভারী কিছু রাখতে হয়। আর আমার পা রাখতে হয় বালিশের নিচে, নাহলে মনে হয় আমি ভেসে যাচ্ছি, চলে যাচ্ছি এক অজানা গতিতে, আমার হালকাপনার কারণে। আমি জানি আমি মৃত। আমি যখনই কোনো বাক্য উচ্চারণ করি, আমার আন্তরিকতা মরে যায়, সেটি হয়ে ওঠে এক শীতল মিথ্যে, যা আমাকে জমাট করে দেয়। কিছু বলো না, কারণ আমি বুঝি তুমি আমাকে বুঝতে পারছ, আর আমি ভয়ে আছি সেই বোঝাপড়ার। আমি ভীষণ ভয় পাই যেন আমার মতো আরেকজনকে খুঁজে না পাই, অথচ একইসঙ্গে সেই খোঁজার আকাঙ্ক্ষাও আছে! আমি এত নিঃসঙ্গ, অথচ আমি আবার ভয়ে থাকি এই নিঃসঙ্গতা ভেঙে গেলে আমি আর আমার রাজ্যের শাসক হয়ে থাকব না। তোমার বোঝাপড়ার আতঙ্কে আমি উন্মোচিত হয়ে পড়ব, এবং তখন আমাকে আমার সাম্রাজ্য ভাগ করে নিতে হবে তোমার সঙ্গে।
কিন্তু জাঁ, উন্মাদের ভয়ই কেবল আমাদের নিঃসঙ্গতার সীমানা ভাঙবে, আমাদের নিঃসঙ্গতার পবিত্র ঘর ভেঙে দেবে। উন্মাদের ভয়ই আমাদের ঠেলে দেবে বাইরের জগতে, যেখানে আমরা খুঁজব কোনো উষ্ণ সংস্পর্শ। যে জগৎগুলো আমরা নিজেরাই গড়ে তুলেছি, নিজেরাই পোষণ করেছি, সেগুলো ভরে আছে ভূত আর দানবে।
আমি শুধু ভয়কেই চিনি, হ্যাঁ, এমন এক ভয় যা আমাকে শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলে, আমি হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকি বাতাসবঞ্চিত মানুষের মতো; অথবা হঠাৎ আমি কিছুই শুনতে পাই না, পৃথিবীর প্রতি বধির হয়ে যাই। আমি পা ঠুকি, কিছুই শুনতে পাই না। আমি চিৎকার করি, আমার চিৎকারের শব্দও কানে পৌঁছায় না। আবার কখনো যখন আমি শুয়ে থাকি, ভয় আমাকে আঁকড়ে ধরে—এক বিশাল নীরবতার ভয়, আর সেই নীরবতার বুক চিরে যেন কিছু বেরিয়ে আসবে, আমার কপালের দেয়ালে আঘাত করবে। সেই ভয় চেপে বসে, দম বন্ধ করে দেয়। আমি দেয়ালে, মেঝেতে ঠুকি, নীরবতাকে তাড়ানোর জন্য। আমি ঠুকি, আমি গান গাই, আমি সিটি বাজাই—অবিরত, যতক্ষণ না ভয় পালিয়ে যায়।
আমি যখন আয়নার সামনে বসি, আমি নিজের দিকে তাকিয়ে হাসি। আমি চুল আঁচড়াচ্ছি। এখানে এক জোড়া চোখ, দুটি লম্বা বেণি, দুটি পা। আমি এগুলোকে যেন পাশার দানার মতো দেখি বাক্সে রাখা। যদি আমি এগুলো ঝাঁকি দিই, এগুলো কি এখনো আমারই থাকবে? আমি বুঝতে পারি না কীভাবে এত বিচ্ছিন্ন অংশগুলো একত্র হয়ে আমি হয়ে ওঠে। আমি তো আসলে নেই। আমি দেহ নই। আমি যখন হাত মেলাই, মনে হয় মানুষটা এত দূরে যে অন্য ঘরে বসে আছে, আর আমার হাতও অন্য ঘরে রয়ে গেছে। আমি যখন নাক ঝাড়ি, ভয় হয় হয়তো সেটা রুমালে লেগেই থেকে যাবে।
তার কণ্ঠস্বর ছিল মিসলথ্রাশ পাখির মতো। মৃত্যুর ছায়া প্রতিটি শব্দের পেছনে ছুটে চলত, ফলে শব্দগুলো শেষ হওয়ার আগেই শুকিয়ে যেত।
যখন আমার ভাই রোদে বসে থাকত আর তার মুখের ছায়া চেয়ারটায় পড়ত, আমি সেই ছায়ায় চুমু খেতাম। আমি তার ছায়াকে চুমু দিতাম, কিন্তু সেই চুমু তাকে স্পর্শ করত না, বাতাসে হারিয়ে যেত, ছায়ার সঙ্গেই মিশে যেত। আমাদের ভালোবাসা যেন এক দীর্ঘ ছায়ার চুম্বনের মতো, যার কোনো বাস্তবতার আশা নেই।
সে আমাকে ইনসেস্টের ঘরে নিয়ে গেল। এটিই সেই ঘর যা রাশিচক্রের বারোটি ঘরের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। মিল্কি ওয়ের পথ ধরেও এখানে পৌঁছানো যেত না, না কোনো কাচের জাহাজের মাধ্যমে যার স্বচ্ছ তলার ভেতর দিয়ে হারিয়ে যাওয়া মহাদেশগুলোর রূপরেখা অনুসরণ করা যেত, না বাতাসের দিক নির্দেশক তীরচিহ্নগুলো অনুসরণ করে, না পাহাড়ের প্রতিধ্বনির কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে।
ঘরগুলো সিঁড়ি দিয়ে একে অপরের সাথে শিকলে বাঁধা ছিল—কোনো ঘরই অন্য কোনো ঘরের সমতলে ছিল না—এবং সব সিঁড়িই ছিল গভীর ক্ষয়ে যাওয়া। ঘরগুলোর মাঝে ছিল জানলা, ছোট ছোট গুপ্তচর-চোখের মতো জানলা, যাতে একজন অন্যজনের মুখ না দেখেই অন্ধকার থেকে ঘর থেকে ঘরে কথা বলতে পারে। ঘরগুলো ছিল অনেক সামুদ্রিক শেলের মধ্য থেকে আসা সমুদ্রের ছন্দময় ওঠা-নামার শব্দে ভরা। জানলাগুলো দিয়ে দেখা যেত একটি নিশ্চল সমুদ্র, যেখানে স্থির মাছদের আঁকা পটভূমির সাথে আঠা দিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল। ইনসেস্টের ঘরে সবকিছু স্থির করে দেওয়া হয়েছিল, কারণ তাদের চলাচলের এবং উষ্ণতার এত ভয় ছিল, এমন এক ভয় ছিল যে সব ভালোবাসা এবং সব জীবন নাগালের বাইরে চলে যাবে এবং হারিয়ে যাবে!
সবকিছু স্থির করে দেওয়া হয়েছিল, এবং সবকিছু পচছিল। সূর্যকে আকাশের ছাদে পেরেক দিয়ে গেঁথে দেওয়া হয়েছিল এবং চাঁদকে তার প্রাচ্যীয় কুলুঙ্গিতে গভীর ভাবে পিটিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
ইনসেস্টের ঘরে এমন একটি ঘর ছিল যা খুঁজে পাওয়া যেত না, একটি জানলাবিহীন ঘর, তাদের ভালোবাসার দুর্গ, একটি জানলাবিহীন ঘর যেখানে মন এবং রক্ত মাছের মতো কোনো অর্গাজম ও শিকড়বিহীন মিলনে একত্রিত হতো। চোখের চাহনির, বাক্যাংশের অবাধ মেলামেশা, যেন মহাকাশে ঝলকানি বিয়ের মতো। তাদের সাদৃশ্যের মধ্যে সংঘাত, যা ঝাউ এবং বালির গন্ধ ছড়াত, পচা শঙ্খ এবং মরণোন্মুখ সামুদ্রিক আগাছার গন্ধ ছড়াত, তাদের ভালোবাসা যেন স্কুইডের কালি, বিষের এক ভোজসভা।
ঘর থেকে ঘরে হোঁচট খেতে খেতে আমি পৌঁছালাম ছবির ঘরে, আর সেখানে বসে আছে লট, তার হাত রাখা কন্যার স্তনের উপর, আর পেছনে শহর জ্বলছে, ফেটে ভেঙে সমুদ্রে পড়ে যাচ্ছে। যেখানে সে বসেছিল কন্যাকে নিয়ে, সেইখানে প্রাচ্যের কার্পেট ছিল লাল আর শক্ত, কিন্তু যে আলোড়ন তাদের নাড়িয়ে দিচ্ছিল তা প্রকাশ পাচ্ছিল চারপাশের ভাঙা পাথরে, তাদের পায়ের নিচে হা করে ওঠা মাটিতে, মশালের মতো জ্বলে ওঠা গাছে, ধোঁয়া আর লাল আঁচে ধিকিধিকি জ্বলা আকাশে—সব কিছুই ফেটে পড়ছিল তাদের প্রেমের আনন্দ আর আতঙ্কে। পিতার হাত কন্যার স্তনে রাখার আনন্দ, সেই ভয়ের আনন্দ যা তাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। তার পোশাক শক্ত করে চাপা, যাতে তার স্তন ওঠানামা করছে, ফুলে উঠছে পিতার আঙুলের নিচে, আর শহর বিদ্যুতের আঘাতে ছিন্নভিন্ন, আগুনের দাঁতের নিচে চূর্ণবিচূর্ণ, বিরাট বিরাট ইমারত ভেঙে সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছে অশ্লীলতার বিভীষিকায়, আর অভিশপ্তদের চিরন্তন হিসহিস শব্দে মিলিয়ে যাচ্ছে। কোনো আতঙ্কের আর্তনাদ নেই লট বা তার কন্যার ঠোঁট থেকে, বরং সেই শহর জ্বলন্ত আগুনে কাঁপছে, এক অদম্য বাসনায়—পিতা ও কন্যা, ভাই ও বোন, মাতা ও পুত্রের।
আমি সত্য খুঁজে পেতে তাকালাম এক ঘড়ির দিকে। ঘণ্টাগুলো কেটে যাচ্ছিল হাতির দাঁতের দাবার ঘুঁটির মতো, পিয়ানোর নোটের মতো আঘাত হানছিল, আর মিনিটগুলো ছুটে চলছিল তারের ওপর সাজানো টিনের সৈনিকের মতো। ঘণ্টাগুলো ছিল উঁচু কৃষ্ণাঙ্গ নারীর মতো, তাদের পায়ের মাঝখানে গং, অবিরত বেজে চলেছে, তাই আমি গুনতে পারছিলাম না। আমি শুনতে পাচ্ছিলাম নিজের হৃদস্পন্দনের ঘণ্টাধ্বনি; শুনতে পাচ্ছিলাম স্বপ্নের পায়ের শব্দ, আর সময়ের তাল তাদের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছিল, যেন সত্যের মুখ লুকিয়ে গেছে।
আমি এসে পড়লাম এক অরণ্যে, যেখানে ছিল শিরচ্ছেদিত বৃক্ষ, বাঁশ দিয়ে খোদাই করা নারীমূর্তি, মাংস চিরে রাখা যেন দুঃখী দাসত্বের দাসীরা, ভাস্করের ছুরির আঘাতে মুখ বিভক্ত, দু’পাশ চিরকালের মতো আলাদা, চিরন্তন দ্বিমুখী, আর আমাকেই এদিক-ওদিক ঘুরতে হচ্ছিল সম্পূর্ণ নারীকে দেখতে। খণ্ডিত বহুভুজ আকার, এগারো দিক, এগারো কোণ, শিরাযুক্ত ভঙ্গুর কাঠে, শরীরের টুকরো, বাহুহীন ও মস্তকহীন দেহ। টি-গোলাপের ধড়, একিলিসের হাঁটু, ছোট ছোট গুটিকা আর বিকৃতি, পচা কাঠে মমির পা, শিরাযুক্ত শান্ত কাঠ খোদাই হয়ে মানবিক কসরতে। বন যেন কাঁদছে আর নত হচ্ছে পুরুষদের কাঁধের মতো, জীবন্ত গাছের ভেতরে মৃত প্রতিমা। এখন সেই অরণ্য ভরে উঠেছে বুদ্ধিদীপ্ত মুখে, চিন্তামগ্ন বিকৃতিতে। গাছ হয়ে উঠেছে পুরুষ ও নারী, দ্বিমুখী, পত্রপল্লবের শিহরণে নস্টালজিক। গাছ হেলছে, কাঠ চকচক করছে, আর অরণ্য কাঁপছে এমন তীব্র বিদ্রোহে যে তার আর্তনাদ আমি শুনতে পাচ্ছিলাম গভীর অরণ্যের চেতনার ভেতর। সে কাঁদছিল তার পাতার ক্ষতিতে আর রূপান্তরের ব্যর্থতায়।
আরও দূরে এক অরণ্য, সাদা প্লাস্টারের, সাদা প্লাস্টারের ডিমের। বড় বড় সাদা ডিম রূপার থালায়, জন্মের প্রতি এক শোকগাথা, প্রতিটি ডিম এক প্রতিশ্রুতি, প্রতিটি আধখানা গঠিত মানুষ বা নারী বা পশুর ভ্রূণ এখনো সুনির্দিষ্ট নয়। গর্ভ আর বীজ আর ডিম, ভেজা শুরুটিকে পূজা করা হচ্ছে তার পূর্ণ বিকাশের পরিবর্তে। ডিমগুলো এত সাদা, এত স্থির, ভেঙে না গিয়েও জন্ম দিচ্ছিল আশার; কিন্তু সেখানে পড়ে থাকা কাটা গাছ এক সবুজ জীবন্ত শাখা জন্ম দিল, যা ভাস্করকে উপহাস করে হেসে উঠল।
জ্যান সমস্ত দরজা খুলে দিল এবং সব ক’টি ঘরে খুঁজে বেড়াল। প্রতিটি ঘরে বিস্মিত অতিথিরা চমকে উঠে চোখ মেলল। সে তাদের বলল: “দয়া করে তোমরা জানালা থেকে কিছু ঝুলিয়ে দাও। একটা শাল কিংবা রঙিন রুমাল, অথবা একটা গালিচা। আমি বাগানে যাচ্ছি। আমি দেখতে চাই কতগুলো জানালা হিসেব করা যায়। তাতে হয়তো আমি সেই ঘর খুঁজে পাব যেখানে আমার ভাই আমার কাছ থেকে লুকিয়ে আছে। আমি আমার ভাইকে হারিয়েছি। আমি তোমাদের কাছে ভিক্ষা চাই, তোমরা সবাই আমাকে সাহায্য করো।” সে টেবিল থেকে শাল টেনে নিল, নামিয়ে নিল লাল পর্দা, একখানা প্রবাল রঙের বিছানার চাদর, একখানা চীনা প্যানেল, এবং নিজেই সেগুলো জানালা থেকে ঝুলিয়ে দিল।
তারপর সে ছুটে গেল মৃত গাছের বাগানে, লাভার পথের উপর দিয়ে, মিকা শিস্টের উপর দিয়ে, এবং তার পথের সব খনিজ পদার্থ জ্বলে উঠল—মস্কোভাইট যেন এক বধূর মতো, পাইরাইট, হাইড্রাস সিলিকা, সিনাবার, আজুরাইট যেন কল্যাণকর বৃহস্পতির কোনো টুকরো, ম্যালাকাইট, সব একসঙ্গে গুঁড়িয়ে, চেপে, গলে মিশে গেল—গলে যাওয়া রত্ন, গলে যাওয়া গ্রহ, বায়ু আর সূর্য আর সময় আর মহাশূন্যের দ্বারা রূপান্তরিত হয়ে খনিজের স্থিরতায়, মৃত্যুভয়ের আর জীবনের ভয়ের স্থিরতায়।
বীর্য শুকিয়ে গেল শিলা ও খনিজের নীরবতায়। আমরা যে কথা বলিনি, যে অশ্রু ঝরাইনি, যে অভিশাপ গিলে ফেলেছি, যে বাক্য সংক্ষিপ্ত করেছি, যে ভালোবাসা হত্যা করেছি—সবই রূপ নিল চৌম্বক লৌহ আকরে, ট্যুরমালিনে, পাইরাইট আগেটে; রক্ত জমাট বাঁধল সিনাবারে, রক্ত ক্যালসিনেটেড হলো, সীসায় রূপান্তরিত হলো গ্যালেনায়, অক্সিডাইজড হলো, অ্যালুমিনাইজড হলো, সালফেটেড হলো, ক্যালসিনেটেড হলো—মৃত উল্কাপিণ্ড আর নিঃশেষিত সূর্যের খনিজ দীপ্তি, মৃত গাছ আর মৃত বাসনার বনে।
অর্থোক্লেজের টিলার উপর দাঁড়িয়ে, তার হাতে টোপাজ আর আর্জেন্টাইটের দাগ নিয়ে, সে তাকাল ইনসেস্টের বাড়ির সম্মুখভাগের দিকে—ইনসেস্টের বাড়ির মরচে ধরা আকরিকের সম্মুখভাগের দিকে—আর সেখানে ছিল একটি জানালা, যার অন্ধকার ঝাপসা পর্দা শক্ত করে টানা, মরচে ধরা, আলোবিহীন, মৃত চোখের মতো, পুরনো আইভির লোমশ লম্বা বাহুতে শ্বাসরুদ্ধ।
সে চমকে উঠল চিৎকার না করার আকাঙ্ক্ষায়, এমন এক প্রচেষ্টা যে তাকে স্থির হয়ে দাঁড়াতে হলো; তার রক্ত লুকিয়ে রইল তার মুখের সোনালি ফ্যাকাশে আভায়।
সে তার আসন্ন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ল: আমি কাউকে ভালোবাসি না; আমি কাউকে ভালোবাসি না, এমনকি আমার ভাইকেও না। আমি কিছুই ভালোবাসি না, শুধু এই যন্ত্রণার অনুপস্থিতিকে ভালোবাসি, এই শীতল নিরপেক্ষ যন্ত্রণার অনুপস্থিতিকে।
অনেক বছর স্থির দাঁড়িয়ে রইল সে, সেই মুহূর্তের মধ্যে যখন সে তার ভাইকে হারিয়েছিল এবং সেই মুহূর্তের মধ্যে যখন সে তাকিয়েছিল ইনসেস্টের বাড়ির সম্মুখভাগের দিকে, অন্তহীন বৃত্তে স্বপ্নের কোণ ঘুরে ঘুরে চলল, তার যাত্রার শেষ কখনো না পেয়ে, সমস্ত বিস্ময়কে উপলব্ধি করল তার বেদনার শিলার বয়সের মধ্য দিয়ে, মৃত্যুর দ্বারা।
আর সে তার ভাইকে খুঁজে পেল, চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে ঘুমিয়ে।
জ্যান, আমি চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, যেখানে আমি বহুদিন বসে থাকতে পারতাম তোমার প্রতিকৃতিকে উপাসনা করে। আমি তোমার প্রতিকৃতির প্রেমে পড়েছিলাম, জ্যান, কারণ এটা কখনো বদলাবে না। আমি ভীষণ ভীত তোমাকে বুড়ো হয়ে যেতে দেখার চিন্তায়, জ্যান; আমি প্রেমে পড়েছিলাম এক অপরিবর্তিত তোমার, যাকে কখনো আমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া যাবে না। আমি চাইছিলাম তুমি যেন মরে যাও, যাতে কেউ তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে না পারে, আর আমি তোমার প্রতিকৃতিকে ভালোবাসতে পারি যেভাবে তুমি চিরকাল দেখাবে।
তারা নিজেদের এক অংশকে নমস্কার করল—শুধু তাদের সাদৃশ্যকে।
শুভ রাত্রি, আমার ভাই!
শুভ রাত্রি, জ্যান!
তার সঙ্গে হাঁটছিল প্রসারিত ছায়ারা, ভয়ের দাগে কলঙ্কিত। তারা তাদের চুক্তিকে বুকের উপর গহনার মতো বহন করছিল; তারা সেটাকে গর্বের সঙ্গে পরেছিল যেন তাদের নিজস্ব বংশচিহ্ন।
আমি আমার নিজের বইয়ের ভেতরে ঢুকেছিলাম শান্তি খোঁজার জন্য।
রাত ছিল। স্বপ্নের ভেতর আমি অসতর্ক এক নড়াচড়া করলাম; খুব হঠাৎ করে কোণ ঘুরে দাঁড়ালাম আর আঘাত পেলাম নিজের উন্মাদনার সাথে ধাক্কা খেয়ে। খুব বেশি দেখার প্রবণতা— চোখের পলকে এক ট্র্যাজেডি খুঁজে বের করা, পাশের ঘরে এক অপরাধ নির্মাণ করা, একই হোটেল বিছানায় আমার আগে যারা প্রেম করেছে সেইসব নারী-পুরুষদের উপস্থিতি অনুভব করা।
আমি বহন করি সাদা স্পঞ্জের মতো জ্ঞান, যা ঝুলে থাকে স্নায়ুর সুতোয়।
আমার বইয়ের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে আমি কেটে যাচ্ছি ধারালো কাঁচ আর ভাঙা বোতলের খণ্ডে, যেগুলোতে এখনও শুকায়নি বীর্যের আর সুগন্ধির গন্ধ।
আরও পৃষ্ঠা যোগ হচ্ছে বইতে, কিন্তু সেসব পৃষ্ঠা যেন বন্দির একঘেয়ে পায়চারি, নিজের বরাদ্দ করা জায়গার ভেতর ঘুরপাক খাওয়া। আমাকে কী বলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে?
শুধু সত্য, কিন্তু রূপকথার আড়ালে লুকোনো সত্য। আর এই রূপকথার আড়ালেই সমস্ত সত্য তাকিয়ে থাকে, যেন জাফরি দেওয়া মসজিদের জানালার পেছনে ঢাকা চোখ। পর্দার আড়ালে। যতক্ষণ না আমি প্রবেশ করি আমার মিথ্যার অন্ধকার গুহায়, আমি পড়ে যাই অন্ধকারে, আর দেখি এক মুখোশ, যা আমাকে তাকিয়ে দেখে কানা-চোখের মানুষের মতো। তবু আমি জড়িয়ে থাকি মিথ্যায়, যা আমার আত্মায় প্রবেশ করতে পারে না— যেন আমার বলা মিথ্যাগুলো শুধু পোশাক।
মিথ্যা সৃষ্টি করে নিঃসঙ্গতা
আমি বেরিয়ে এলাম আমার বই থেকে, এক পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষের ঘরে।
সে বসেছিল বহু কাচের বাক্সে আবদ্ধ জিনিসপত্রের মাঝে, যেন কোনো জাদুঘরে। তার কাছে ছিল রঙের বাক্স, কিন্তু কোনোদিন আঁকা হয়নি, হাজারো বই যেগুলোর পাতা এখনও কাটা হয়নি, ধুলোয় ঢাকা। তার স্প্যানিশ কেপ ঝুলে ছিল এক মানেকুইনের কাঁধে, গিটার শুয়ে ছিল ছেঁড়া তারের জটের মতো। সে বসেছিল ফাঁকা পাতার নোটবুকের সামনে, বলছিল: আমি আমার নিজের শব্দ গিলে ফেলি। আমি চিবোই আর চিবোই যতক্ষণ না সব নষ্ট হয়ে যায়। আমার প্রতিটি চিন্তা বা তাড়না চিবোতে চিবোতে শূন্যতায় পরিণত হয়। আমি চাই একসাথে সব চিন্তা ধরে ফেলতে, কিন্তু তারা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। যদি পারতাম, তবে আমি সবচেয়ে চঞ্চল এক মনকে ধরতাম, ছোট মাছেদের ঝাঁকের মতো। আমি প্রকাশ করতাম নিষ্পাপতা আর প্রতারণা, উদারতা আর হিসেবি মন, ভয়, কাপুরুষতা আর সাহস। আমি চাই পুরো সত্য বলতে, কিন্তু পারি না— কারণ আমাকে একসাথে চারটি পৃষ্ঠা লিখতে হবে, চারটি কলামের মতো পাশাপাশি, বর্তমান পাতার সঙ্গে আরও চারটি। আর তাই কিছুই লিখি না। আমাকে উল্টো লিখতে হবে, বারবার পেছনে ফিরতে হবে প্রতিধ্বনি আর আভাস ধরতে।
তার চামড়া ছিল স্বচ্ছ, সদ্যজাত শিশুর মতো, আর চোখ সবুজ, শ্যাওলার মতো। সে নত হল সাবিনা, জেন আর আমার দিকে: এই যে দেখো আধুনিক খ্রিস্ট, যে ক্রুশবিদ্ধ হচ্ছে নিজের স্নায়ুতন্ত্রের দ্বারা, আমাদের সব স্নায়বিক পাপের জন্য!
আধুনিক খ্রিস্ট ঘাম মুছছিল, ঘাম ঝরছিল তার মুখ বেয়ে, যেন সে লুকোনো যন্ত্রণার ভেতর বসে আছে। যন্ত্রণায় খোদাই করা মুখ। চোখ অতিরিক্ত খোলা, যেন আতঙ্কের দৃশ্য দেখে প্রসারিত। ভারী পাতার নিচে দুনিয়া-ক্লান্তি। এমনভাবে বসেছিল, যেন তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ভূতেরা। হাসি, যা অপমানের মতো। ঠোঁট কালো মাদকের ছোপে শুকিয়ে গেছে। শরীর টানটান তারের মতো।
আমি বললাম, লেখালেখিতে আমরা ভাই। আমাদের মাথা ঘোরা সমান গতির। আমরা পৌঁছেছি একই জায়গায়, একই সময়ে, যা অন্যদের চিন্তায় হয় না। স্নায়ুর ভাষা যা আমরা দু’জনেই ব্যবহার করি, তা আমাদের লেখায় ভাই করে তুলেছে।
আধুনিক খ্রিস্ট বলল: আমি জন্মেছি চামড়াহীন। আমি একবার স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি দাঁড়িয়ে আছি নগ্ন অবস্থায় এক বাগানে, আর আমার শরীর থেকে আস্তে আস্তে সব চামড়া ছুলে নেওয়া হলো, ফলের মতো। শরীরে এক ইঞ্চি চামড়াও বাকি নেই। সবকিছু তুলে নেওয়া হলো, তারপর আমাকে বলা হলো হাঁটো, বাঁচো, দৌড়াও। প্রথমে ধীরে হাঁটলাম, বাগানটা ছিল খুব নরম, আর আমি সেই কোমলতা এত গভীরভাবে অনুভব করলাম— চামড়ার উপরিভাগে নয়, পুরো শরীর জুড়ে। নরম বাতাস আর সুগন্ধি সূচের মতো ফুটো করে ঢুকে পড়ল প্রতিটি রক্তাক্ত ছিদ্র দিয়ে। প্রতিটি ছিদ্র খোলা আর শ্বাস নিচ্ছে সেই কোমলতা, সেই উষ্ণতা, সেই ঘ্রাণ। পুরো শরীর ভেদ করে প্রবেশ করছে, প্রতিটি ক্ষুদ্র কোষ আর ছিদ্র সক্রিয়, কাঁপছে আর উপভোগ করছে। আমি ব্যথায় চিৎকার করলাম। আমি দৌড়ালাম। দৌড়াতে দৌড়াতে বাতাস চাবুক মারল আমাকে, মানুষের কণ্ঠ চাবুকের মতো পড়ল আমার গায়ে। ছোঁয়া! তুমি কি জানো মানুষের ছোঁয়া মানে কী!
সে রুমাল দিয়ে মুখ মুছল।
কোণের চেয়ারে পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষ স্থির বসে ছিল।
তুমি সৌভাগ্যবান, সে বলল, তুমি সৌভাগ্যবান এত কিছু অনুভব করতে পারছ; আমি চাইতাম আমি-ও এভাবে অনুভব করতে পারতাম। অন্তত তুমি জীবিত আছ ব্যথার ভেতরে, অথচ আমি…
তারপর সে মুখ ঘুরিয়ে নিল। মুখ ফেরানোর আগ মুহূর্তে আমি দেখলাম তার কপালের শিরা ফুলে উঠছে, ফুলে উঠছে সেই ভেতরের প্রচেষ্টায়, যা তার জিহ্বা, শরীর, চিন্তা কোনোটাই মানতে চাইছিল না।
যদি অন্তত আমরা সবাই পালাতে পারতাম এই অজাচার-গৃহ থেকে, যেখানে আমরা কেবল নিজেদেরকেই ভালোবাসি অপরের মধ্যে, যদি অন্তত আমি তোমাদের সবাইকে নিজেদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারতাম, বলল আধুনিক খ্রিস্ট।
কিন্তু আমাদের কারোর পক্ষেই সহ্য করা সম্ভব হলো না সেই সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে যাওয়া, যা এই গৃহ থেকে বেরিয়ে নিয়ে যেত বাইরের পৃথিবীতে, যেখানে গাছে পাতারা ঝরে, পথের ধারে পানি বয়ে যায়, যেখানে ছিল দিনের আলো আর আনন্দ। আমরা বিশ্বাস করতে পারলাম না যে সুড়ঙ্গ খুলবে দিনের আলোয়; ভয় ছিল আবারও অন্ধকারে আটকে পড়ার; ভয় ছিল আমরা ফিরে যাব সেই জায়গায় যেখান থেকে এসেছি— অন্ধকার আর রাত থেকে। সুড়ঙ্গটি যতই হাঁটতাম ততই সরু হয়ে আসত, আমাদের চারপাশে আঁটসাঁট হয়ে আসত, আমাদের দমবন্ধ করত। ভারী আর সরু হয়ে গলা টিপে মারত হাঁটতে হাঁটতে।
তবুও আমরা জানতাম, এই অজাচার-গৃহের ওপারে ছিল দিনের আলো। অথচ আমাদের কারোর পক্ষেই তার দিকে হাঁটা সম্ভব হলো না।
এখন আমাদের চোখ ঘুরল সেই নৃত্যশিল্পীর দিকে, যে ঘরের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে নাচছিল— হাতবিহীন নারীর নৃত্য। সে নাচছিল যেন বধির, সুরের তালে পা ফেলতে পারছিল না। নাচছিল যেন কাস্তানেটের শব্দ তার কানে পৌঁছায় না। তার নাচ বিচ্ছিন্ন, সংগীত থেকে, আমাদের থেকে, ঘর থেকে, জীবন থেকে। কাস্তানেটের শব্দ ভেসে আসছিল ভূতের পদচিহ্নের মতো।
সে নাচছিল— হাসছিল, দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল, নিঃশ্বাস নিচ্ছিল সব নিজের জন্য। সে নাচছিল তার ভয়ের নাচ, প্রতিটি নাচের মাঝে থেমে যেত অদৃশ্য ধিক্কার শুনতে, বা প্রণাম করত সেই করতালিকে, যা আমরা দিইনি। সে শুনছিল এক সংগীত, যা আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম না; সে নড়ছিল সেই ভ্রমের টানে, যা আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম না।
আমার হাত কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, সে গান গাইল। আমাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল আঁকড়ে ধরার জন্য। আমি আঁকড়ে ধরেছিলাম যাদের ভালোবেসেছি সবাইকে; আঁকড়ে ধরেছিলাম জীবনের প্রতিটি সুন্দর মুহূর্ত; আমার হাত আঁকড়ে ধরেছিল প্রতিটি পূর্ণ ঘন্টা। আমার বাহু ছিল সবসময় টানটান, আলিঙ্গনের ক্ষুধায়। আমি চেয়েছিলাম আলিঙ্গন করতে, আলো, বাতাস, সূর্য, রাত, পুরো পৃথিবীকে। আমি চেয়েছিলাম স্নেহ দিতে, সান্ত্বনা দিতে, দোলাতে, ঘুম পাড়াতে, ঘিরে রাখতে, বেষ্টন করতে। আর আমি এত আঁকড়ে ধরলাম যে তারা ভেঙে গেল; আমার থেকে ছিঁড়ে গেল। সবকিছু তখন ফসকে গেল আমার হাত থেকে। আমাকে অভিশপ্ত করা হলো— কিছুই আঁকড়ে ধরতে পারব না।
কাঁপতে কাঁপতে সে দাঁড়াল, তার বাহুগুলো আবার সামনে প্রসারিত।
সে তার হাতের মুঠো শক্ত করে দেখল, তারপর ধীরে ধীরে খুলল, পুরোপুরি খুলে দিল— খ্রিস্টের মতো। সে খুলল এক আত্মসমর্পণ আর দানের ভঙ্গিতে; ছেড়ে দিল, ক্ষমা করল, বাহু আর হাত মেলে দিল, সবকিছুকে প্রবাহিত হতে দিল নিজের বাইরে।
আমি সহ্য করতে পারি না সবকিছুর চলে যাওয়া। সব প্রবাহ, সব গতি আমাকে দমিয়ে দেয় যন্ত্রণায়।
আর সে নাচল; নাচল সংগীতের সাথে আর পৃথিবীর বৃত্তাকার ছন্দে; সে ঘুরল পৃথিবীর সাথে, ডিস্কের মতো ঘুরতে ঘুরতে— সব মুখ সমানভাবে আলো আর অন্ধকারের দিকে ফিরিয়ে, নাচতে নাচতে দিনের আলোর দিকে।
এটি একটা আনঅফিসিয়াল অনুবাদ। শুধুমাত্র বইটি পাঠকদের পড়ার জন্য অনুবাদ করা হয়েছে, বানিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য নয়।
