অভিনয় – জাকির হোসেন মনির

›› সম্পুর্ণ গল্প  

মেয়েটার নাম জবা। বয়স মাত্র বিশ। এই বয়সে যখন তার অনাগত জীবন স্বপ্নে বিভোর থাকার কথা ঠিক সেই সময় সে মেতে উঠেছিল প্রতারণার ছোবল দিতে।
সিলেট নগর থেকে পরিবারের সদস্য ও আত্মীস্বজনদের আমন্ত্রণে লন্ডন পৌঁছালাম। অল্প দিনেই সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে মিশে গেলাম। আমাদের প্রতিষ্ঠান শাহজালাল হোটেল প্রতিদিন বিকালে ইচ্ছা করেই হোটেলের ব্যবস্থাপকের চেম্বারে বসতাম। তখন ব্যবস্থাপক বাংলাদেশে ছুটিতে ছিলেন। নানান দেশের নানান রকম লোক আসত আমাদের প্রতিষ্ঠানে। অল্প দিনের মধ্যেই অনেক কাস্টমারের সঙ্গে আমার ভালো একটা সম্পর্ক তৈরি হলো । বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মেয়ে জবা। লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাসরত। রূপবতী, ভাগ্যবতী, গুণবতী বলতে যা বোঝায়, সবই তার মধ্যে ছিল ।
সে প্রতিদিন একবার হলেও আমাদের হোটেলে আসত। অল্প কয়েক দিনে তার সঙ্গে আমার ভালো একটা সম্পর্ক তৈরি হলো ।
প্রায়ই সে আমাকে তার বাসায় যাওয়ার জন্য দাওয়াত দিত। আমাদের বাসা থেকে তার বাসার দূরত্ব অনেক বেশি এবং হোটেলের লোকবল সংকট থাকায় তার দাওয়াত রাখতে পারতাম না ।
একদিন বিকালে আমাকে ফোন করে জবা জানাল, তার মা রোড এ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন । যদি সম্ভব হয় তার বাসায় যেতে । অনীহা থাকা সত্ত্বেও মৃত্যুর সংবাদ শুনে বিবেকের টানে ড্রাইভারকে সঙ্গে নিয়ে রওনা হলাম ।
ঘণ্টা খানেকের মধ্যে পৌছে গেলাম তার বাসায়। ড্রাইভারকে ড্রইংরুমে বসিয়ে ভেতরে ঢুকেই দেখলাম ভিন্ন দৃশ্য। জৰা আমার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছিল বিছানায় বসে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাকে জড়িয়ে ধরল। এক এক করে তার শরীরের সব আবরণ খুলে ফেলল। আমার মাথায় একটি পিস্তল ধরে বলল, তাড়াতাড়ি কাপড় খোলো। আর আমি যা বলব তা করতে হবে তোমাকে । আমার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন দিয়ে ফোন করে ড্রাইভারকে চলে যেতে বলল ৷ আমি বাধ্য হয়ে ড্রাইভারকে বললাম, লাশ এখনো হসপিটাল থেকে আসেনি। জানাজার পর আমি বাসায় ফিরব। তুমি চলে যাও। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে চলে গেল। অস্ত্রের মুখে জিম্মি হয়ে অনেকটা বাধ্য ছেলের মতো কাপড় খুললাম। তার কথামতো অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটাতে লাগলাম ।
হঠাৎ অন্য রুম থেকে দুজন পোশাকধারী ছদ্মবেশী পুলিশ এবং খাটের নিচ থেকে একজন বের হলো হাতে দুটি নামি ব্র্যান্ডের ক্যামেরা মোবাইল নিয়ে। সেই ক্যামেরা মোবাইলে আমাদের আপত্তিকর দৃশ্য প্ল্যান অনুযায়ী ধারণ কর । আমি তাদের কাছে আকুতি-মিনতি করে বললাম, তোমরা কি চাও? এমন কিছু কোরা না, যা আমার জন্য ক্ষতি হয়ে দাড়ায়।
ভুয়া পুলিশ, সাংবাদিকসহ মোহনীয় নারীর কোমনীয়তার রূপের সমন্বয়ে গড়া এই চক্রটির একজন বাংলাদেশি তরুণ ! সে বলল, দেশের বাড়িতে আমার একটি ভাই বেকার, ওকে ভিসা দিয়ে তোদের হোটেলে বিনা টাকায় আনতে পারলে তোর কিছুই হবে না। তা নাহলে মোবাইল ক্যামেরায় ধারণ করা গোপন দৃশ্যটি ইন্টারনেটসহ তোর পরিবারের কাছে পৌঁছে দেব। আমি একটি শিক্ষিত পরিবারের সন্তান। যদি লোকজন জানতে পারে তাহলে যেমন আমি ধ্বংস হব, তেমনি আমার প্রতিষ্ঠানেরও সুনাম ক্ষুণ্ন হবে। সব কিছু ভেবে তার ভাইকে ওয়ার্ক পারমিটের ভিসায় আনব বলে লিখিত মুচলেকা দিয়ে তাদের হাত থেকে রেহাই পেলাম । যুবকটির তাড়নায় অতিষ্ঠ হয়ে দুই মাসের মধ্যে তার ভাইকে আমাদের প্রতিষ্ঠানে আনলাম। পরে ওই ছেলেটির কাছ থেকে জানতে পারলাম, সে তার আপন ভাই নয়, প্রতিবেশী। দশ লক্ষ টাকা দিয়েছিল ভিসা বাবদ ।
কিছুদিন পর হঠাৎ সেই ছলনাময়ী নারী আমাদের হোটেলে এল। তার সঙ্গে সেদিন আবারও যেতে বলল। আমি রাজি হলাম না । মোবাইল ক্যামেরায় ধারণকৃত দৃশ্যগুলো আমার প্রতিষ্ঠানের সবাইকে জানিয়ে দেবে বলে হুমকি দিল। মান- “ইজ্জতের ভয়ে আবারও জেনেশুনে তার সঙ্গে রওনা হলাম অজানা উদ্দেশে । ঘণ্টা দেড়েক পর পৌছালাম তার এক নিকট আত্মীয়ের বাসায়। সবার কাছে আমাকে তার হবু স্বামী বলে পরিচয় দিল। খাওয়া-দাওয়ার পর আমাদের একটি রুমে থাকতে দেওয়া হলো। আবারও তার সঙ্গে যা হওয়ার তা হলো। ভাবলাম, পুরুষ হয়েও আমি নারী দ্বারা ধর্ষণের শিকার! তখন রাত তিনটা। জবা কোনো প্রশ্ন ছাড়াই এক বাক্যে বলতে লাগল, আমাকে পৃথিবীর সেরা ঘৃণিত মানুষ মনে হয়, তাই না? তাহলে শুনুন কেন আমি খারাপ হলাম ।
সমাজের অন্য দশজন কোমলমতি মেয়ের মতো আমিও ছিলাম একজন। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য নিজেকে নিয়োজিত রাখার ইচ্ছা ছিল শৈশব থেকে। ক্লাস এইটে পড়া অবস্থায় আমার বাবা মা চল্লিশোর্ধ্ব এক প্রবাসী লন্ডনির সঙ্গে বিয়ে দিলেন শত চেষ্টা করেও আমার বল্য বিয়ে আটকাতে পারলাম না।
বিয়ের এক সপ্তাহের মধ্যে স্বামী আমাকে নিয়ে লন্ডনে চলে এল। দাম্পত্য জীবনে তেমন সুখী না হলেও অর্থনৈতিকভাবে সয়ংসম্পুর্ন হওয়ায় সংসারের প্রতি মনোনিবেশ করলাম । লন্ডনে আসার মাস খানেকের ভেতরে আমার দাড়িওয়ালা ছদ্মবেশী স্বামীর আসল চেহারা উন্মোচিত হলো। হঠাৎ এক রাতে তার ইংরেজ তিন বন্ধুকে বাসায় নিয়ে এল। স্বামী নির্দেশ দিল তাদের খুশি করতে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিন ভিনদেশি পুরুষ আমার স্বামীর সামনে আমাকে পালাক্রমে ভোগ করল। সেই দৃশ্য আমার স্বামী মোবাইল ক্যামেরায় ধারণ করছিল। এভাবে নোংরা দৃশ্য মোবাইল ক্যামেরার কল্যাণে তার বন্ধুদের দেখিয়ে প্রলোভন দিয়ে আমার কাছে নিয়ে আসত। বিনিময়ে সে অনেক টাকা উপার্জন করত। নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ, বাইরের তেমন কিছু চিনতাম না। তাই পালাতে পারলাম না। ইংরেজি ভাষা না জানার কারণে মনের দুঃখ কোনো নরপশুকে বোঝাতে পারিনি।
প্রায় ছয় মাস পর এক বাংলাদেশি খদ্দের আমার কাছে এল। তাকে সব কিছু খুলে বললাম। সে কৌশলে সেই ভয়াবহ নরক থেকে আমাকে উদ্ধার করে তার বাসায় নিয়ে গেল । সেও আমাকে দিয়ে ব্যবসা শুরু করল। তবে আগের মতো নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। সে আমাকে দামি ব্র্যান্ডের মোবাইল ক্যামেরা কিনে দিল। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উঁচু পদের কর্মকর্তার মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করে আমাকে দেয়। আর আমি তাদের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে দেখা-সাক্ষাতের নামে নির্ধারিত ফ্ল্যাটে আপনার ঘটনার মতো নাটক সাজাই। উপার্জনের অর্ধেক টাকা আমি পাই, আর অর্ধেক সে। সেদিন আপনাকে জিম্মি করার কারিগর সেই বাংলাদেশি দালাল । লন্ডনে প্রায় চার বছর ধরে অবস্থান করে অনেক টাকা উপার্জন করেছি। কোথাও শান্তি পাইনি। কি মানসিক, কি শারীরিক। আপনাকে খদ্দের বানানোর জন্য ফাদ পেতেছিলাম, সফলও হলাম। তবে আপনার কাছে অন্য একটি অসাধ্য জিনিস পেলাম। যা আগে কেউ দিতে পারেনি। একজন ক্ষুধার্ত মানুষ অনেক আগ্রহ নিয়ে যখন খেতে বসল, তখন যদি অন্য কেউ খাবারগুলো সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায়, তখন কি রকম লাগবে আপনার কাছে? নিশ্চয়ই কষ্ট লাগবে? যে কষ্ট বলার ভাষা নেই। যা বোবার মত নীরবে সহ্য করতে হয়। আবার কখনো কখনো খুব খারাপ লাগে। না পারি সইতে, না পারি একবার বাধ্য হয়ে দেশে গেলাম। নিজ ইচ্ছায় সুন্দর একটি স্মার্ট ছেলেকে বিয়ে করলাম। সেও আমার কাছে হার মানল । চার সপ্তাহ পর চলে এলাম লন্ডনে। এখানকার একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে আমার অবস্থা ব্যাখ্যা করলাম। ডাক্তার আমাকে বোঝালেন । শতকরা পচাত্তর ও পঞ্চাশ শতাংশ নারী আপনার মতো সমস্যায় হাবুডুবু খায়। আবার এমনও পচিশ শতাংশ পুরুষ ও পঞ্চাশ শতাংশ নারী আছে, যারা সব সময় স্বয়ংসম্পূর্ণ। এত দিন এগুলো নিয়ে কল্পনা করতাম আর অবাক হতাম। কিন্তু সব কল্পনা হার মানল, তোমাকে আমার বেড পার্টনার পেয়ে। সত্যিই এই প্রথম তুমি আমার জীবনে পরিপূর্ণ তৃপ্তি দিয়েছ। আমি এত দিন তোমার মতোই একজনকে খুজছিলাম। তোমার যা কিছু প্রয়োজন আমি দেব। গত কয়েক দিন আগের ঘটনার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আমাকে ক্ষমা করে দিও। তখন সকাল সাতটার বেশি। তাড়াতাড়ি চলে এলাম বাসায়। সেও চলে গেল তার নিজ ঠিকানায়।
সেদিনের পর তার আমন্ত্রণে প্রায়ই নানা অজানা গন্তব্যে পাড়ি জমাতাম। প্রতিবারই সে আমাকে পেয়ে ভাবত আকাশের চাদ হাতে পেয়েছে। পেশাগত দায়িত্ব পালনের তাগিদে আর বেশি দিন লন্ডনে থাকা সম্ভব হলো না। তাকে না জানিয়ে চলে এলাম নিজ দেশের উদ্দেশে এয়ারপোর্টে। এয়ারপোর্টে পৌঁছেই চমকে উঠলাম, সে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। বিদায়ের সময় সে আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেদে বিদায় জানাল।

 

Please follow and like us: