মিনি নয় মিডি গল্প-ছন্দে – সন্তোষ কুমার ঘোষ
তার নাম? জানি না। কোনো দিন জানতে পারব না। তার মুখ? হঠাৎ রাস্তায় যদি ফের দেখি, চিনতে পারব না। অথচ গোটা একটা রাত তার সঙ্গে এক দিন কাটিয়ে এলাম। এক ঘরে, এক বিছানায়। অন্যথা সবই ছিল। চটকানো মালার গন্ধ, টকটক; মৃদু উত্তেজনা। জ্বালানো ধূপের কাঠি পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে চোখের পাতাও ধূপে আর থেঁতলানো ফুল মিলে মড়া মড়া গন্ধ বিলিয়েছে।
মেয়েটির পুষ্টি-স্ফীতি, সবই যথাযথ, যার যেটা স্থানে ছিল। অন্তর্বাস কিছু নেই, আলগা শাড়ি অগোছালো। এ সময় অবশ্যই অন্ধকারে শুধু অনুমান। সেই অন্ধকার দেয়ালের সঙ্গে মিশে থেকে দেওয়ালেরই অং হয়ে গিয়ে, সেই মেয়েটা, ওর বুক, টের পাচ্ছি উঠছে পড়ছে, থমথমে অন্ধকার গলা। আমাকে বলেছে ‘এই আমাকে চাই না? ছোঁয়া টোয়া কোনও কিচ্ছু না?’ – ছুঁতে পারছি না।
কেন? কী হল?
— মাঝখানে কী যেন, কিছু একটা জায়গা জুড়ে আছে; বহুদিন আগে পড়া গল্পটারমতো। সেই স্বামী, সেই পত্নী, কিন্তু সদ্য মৃত দ্বিতীয় পক্ষের বধু, মধ্যবর্তিনী। দীর্ঘকাল পরে পাশাপাশি ফের তারা গুলো, কিন্তু সেই পুরুষ এবং নারী মৃত সেই বালিকাকে ডিঙোতে পারেনি।
তার সঙ্গে আজকের কোথায় মিল? ভাঙা গলা মেয়েটির।
— মিল আছে।
এই বলে চুপ করে গেছি। সন্ধ্যা থেকে ঘটনাটা এ পর্যন্ত অনুক্রমে সাজিয়ে গিয়েছি। ময়দান, স্ট্যাচুর ছায়া, চোখের ইসারা। অল্প অল্প আলোর আভাসে অকস্মাৎ মনে হয় পিষ্পাপ একটা মুখ, সেই যুবতীর নিষ্পাপতা সুচতুর প্রসাধনও হতে পারে প্রথমে বুঝিনি। এমন ভাব-সাব করল, ঠাউরে বসলাম, আনকোরা নতুন। শিকারে
বেরিয়ে পড়া মেয়েটার সেদিনই প্রথম। তারপর ট্যাক্সি তে
– এবার কোথায় যাব?
— জানা জায়গা নেই?
আমার ছিলনা। অন্য দিকে মুখ রেখে সে তখন বলে, ‘মার সঙ্গে থাকি । ঠিক আছে, সেখানেই চলো। যা হয় কিছু একটা বন্দোবস্ত হয়ে যাবে।
শিকল খুলল মেয়ে, পিদিম জ্বালাল । স্যাঁতসেঁতে ঘর কিন্তু এক কোণে ছোট তক্তপোষ। প্রথমে খুলল মালা, খোঁপায় জড়ানো। তারপর ক্রমে ক্রমে সব। তারও আগে হাত বাড়িয়ে অনায়াসে অসঙ্কোচে বলেছে সে : ‘কই, কী দেবে, এবং কত বের করে দাও।’
— তার আগে জানা দরকার তুমিই বা কী দেবে?
— সব
দশ টাকার দু’টো নোট ফস করে তুলে নিয়ে তৎক্ষণাৎ আলো নিবিয়েছে ক্ষিপ্র ফুঁয়ে। আমিও সমান ক্ষিপ্র, সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়িয়ে ওর ফিনফিনে জামার বোতাম ঢিলে করে যেই কাছে টেনে নেব –ওমনি চৌকাটে ছায়া, বর্ষীয়সী কোনও রমনীর। মূর্তিমতী ছন্দভঙ্গ। সেই সংলাপ সাদামাঠা গদ্য ছাড়া লেখা অসম্ভব।
– পোলাডারে একবার লবি ছায়া? বড় কানত্যাছে। অরে আর রাখতে পারতেছি না।
অনেক কাঁচের বাসন তাক থেকে পড়ে গেল ঝনঝন করে। ইঁদুরের মতো ফেটে পড়ল কিচকিচ স্নায়ুগুলো আর্তনাদে ।
তাড়াতাড়ি আঁচল জড়িয়ে সেই মেয়ে বারান্দায় গেল, ত্রস্ত পায়ে। তার চোখ বলেছে ‘চুপ চুপ।’ কিছুক্ষণ, শব্দ নেই, সব অন্ধকার সে কিন্তু ফিরেছে। ফিরতেই দেশলাই জ্বেলেছি। সেই আলোয় অতি স্পষ্ট ধরা পড়ে গেছে, বুকের কাপড় ওর ভিজে গেছে। চোখ নামিয়েছি। ফিস ফিস স্বরে বলল ‘ঘুম পাড়িয়ে এলাম। ওকে চুপ করাতে দুধ দিতে হল? কী করব। এই বার এসো। বিছানায় টানটান শুয়ে আন্দাজে মনে হল, আন্দাজেই সে হাত বাড়াল। তারপর? আগেই বলেছি। পারলাম না। না পিছোতে না এগোতে। সেই গল্প : মধ্যবর্তিনী। না; মৃত কোন বধূ নয়, জ্যান্ত বাচ্চা কোনও, আর তার ট্যাট্যা কান্না আমাদের মাঝখানে শুয়ে রইল, পোড়া ধূপ, দুধে ভেজা জামা আর থেঁতলানো ফুলের গন্ধে মিশে গিয়ে, আড়াল তৈরী করে। ভিজে বুকে হাত দিতেই আঙুল শিটিয়ে যায়, ফিরে আসে। সারা রাত, সারা রাত সে আড়াল ডিঙানো গেল না।
ভূমিকম্প – গৌতম ঘোষদস্তিদার
ফুলবাগান থেকে অটোতে উঠে দেখলাম, কোণের দিকে বসে আছে মেয়েটি। সবুজ তাঁতের শাড়ি, লাল স্লিভলেস ব্লাউজ আর শ্যাম্পু করা খোলা চুল মেয়েটিকে, গোধূলির আলোয় একটি ফুলের বাগানের মতো দেখাল। মাঝখানে কিছুটা শূন্যতা ফেলে রেখে সন্তর্পনে বসলাম তার পাশে। তার গা থেকে উঠে এল জুঁইফুলের গন্ধ। ড্রাইভারের লুকিং গ্লাসে দেখলাম, মেয়েটির ঠোঁটে এক আচ্ছন্ন বিষাদের ছায়া। তার নগ্ননির্জন দুটি হাত কোলের ওপর ছড়ানো।
-‘এক্সকিউজ মি! আপনি কোথায় যাবেন? মেয়েটি রাজহংসীর মতো গ্রীবা ঘোরালো। গিরিশ পার্ক। কেন? জিজ্ঞাসা করলাম।
‘ভালই হল। আমিও, আসলে, ঠিক চিনি না তো’ মেয়েটি কথা শেষ করল না, হাসল, বিষাদ । যথাযথ যাত্রী পেয়ে ড্রাইভার অটো ছাড়ল। আমি মেয়েটির দিকে সামান্য ঘেঁসে বসলাম। বসতেই হল। ‘নো প্রবলেম।
মেয়েটি বলল, রিলাক্সড।’
এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় প্রায়শই তার কোমরে লেগে যাচ্ছে আমার কড়ি, আমি যথাসম্ভব দুরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছি। হাওয়ায় তার সুগন্ধি খোলাচুল আমার চোখে-মুখে আছড়ে পড়ছে ঢেউয়ের মতো। ধস নামছে আমার ভিতরে। শহর মুছে গিয়ে আমার চোখের সামনে ফুটে উঠছে বিস্তীর্ণ তৃণভূমি, দিগন্ত, শ্যামলে শ্যামল, নীলিমায় নীল। গিরিশ পার্ক এসে গেল পলকে। নামলাম দু’জনেই। এবার রাস্তা পেরিয়ে দু’জন দুদিকে চলে যাব। আমার গলায় সামান্য বাষ্প জমল। মেয়েটি হঠাৎ আমার হাত চেপে ধরে বলল, ‘যাবেন ? আমি চিত্রার্পিত, ‘কোথায় ?” মেয়েটি অবিচল, ‘আমার ঘর আছে।’
আমি দেখলাম, ভূমিকম্পে ভেঙে পড়েছে সব ঘরবাড়ি।
পাপ – সুদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
কি হ’ল গো। এই ভর সন্ধ্যেতে শুয়ে গড়াচ্ছ যে বড় – বলতে বলতে রাত্রি।
ছাপা জামা গায় প্রমোদ ঢুকে পড়ে অন্ধগলির কুসুমের ঘরে। কুসুম তখন ডাগর চোখজোড়া ড্যাব ড্যাব করে মেলে আয়নার সামনে নিজেকে মেলে ধরে রূপচর্চায় ব্যস্ত। কৃষ্ণকালো গালে আপন মনে ঘষছে ফেয়ার এ্যাণ্ড লাভলী। ঠোঠে লাগানো সস্তার ঘন লাল লিপস্টিক। স্তনসন্ধিতে ঝুলিয়ে দিল মন হরনি লকেট। তারপর পাখির ডানার মত দু’বাহু ছড়িয়ে খোঁপায় গুঁজছে কাঁটা। নখের উপর রং বোলাতে বোলাতে তীর্যক দৃষ্টি হেনে প্রমোদের দিকে তাকাল। প্রমোদের বুকে ঢেঁকির পাড়। রক্তে পাগলা ঘন্টা। রোমকূপে ঘামের বুদবুদ। মন তাথৈ তাথৈ।
-অপূর্ব লাগছে তোকে কুসুম ।
-সত্যি বলছ, তুমি বললে বড্ড ভাল লাগে গো ।
– আজ তোকে গিলে খাবো।
তুমি কি রাক্ষস না রাহু
– এত সেজেছিস কেন রে কুসুম ? মালদারবাবু কড়কাবি না কি?
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে কুসুম। ভরাট বুক উপছে পড়ে। প্রমোদের চোখে বিদ্যুৎ ছোলকে ওঠে। মুখে তৃপ্তির হাসি। বুকে রাহুর দপদপানি। শেষে ফুলের থোকা খোঁপায় গুঁজে ঝম ঝম করে বেজে ওঠে কুসুম
— না গো রোজই তো নাগরদের মনোরঞ্জনের জন্য সাজি। সাজতে সাজতে ভিতরটা কালসিটে পড়ে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। এইডস্ বাসা বেঁধেছে শরীরে। তাই আজ নিজের জন্য সাজলাম। তুমি ফিরে যাও প্রমোদদা। আমি তো শরীর বিলোতে এয়েচি। রোগ বিলোতে আসিনি। এ আমি পারব না । আমার মহাপাপ হবে গো। প্রমোদ অন্ধগলি থেকে রাজপথে পড়তে পড়তে ভাবে, কুসুমও পাপ পূণ্য শিখল। সে যে শিখবে কবে।
সনাক্তকরণ – সিদ্ধার্থ সিংহ
অবিনাশ ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বউ গত হয়েছেন বেশ কয়েকবছর। দুই ছেলেমেয়েই হোস্টেলে থাকে। অফিসে বসে মাঝে মাঝেই ইন্টারনেটে নীল ছবি দেখেন। কোন সহকর্মী যেন সে কথা তুলে দিয়েছেন বড় সাহেবের কানে। বড় সাহেব তক্কে তক্কে ছিলেন। উনি বুঝতে পারেন নি। গতকাল একেবারে হাতে নাতে ধরা পড়ে গেছেন। ছিঃ ছিঃ…।
সেই থেকে মনটা একদম ভালো নেই। আজ অফিস পর্যন্ত যেতে পারেন নি। ঝুল বারান্দায় দাঁড়ালে মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। সামনেই এই হাউজিং কমপ্লেক্সের লন। সারি সারি কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া। বাচ্চাদের জন্য ঢেকি, দোলনা, স্লিপ। বিকেল হলে বাচ্চাদের মেলা বসে যায়। বাচ্চাগুলো কি মিষ্টি। কি সুন্দর ফুটফুটে। অবিনাশের মাঝে মধ্যেই মনে হয়, বাচ্চাগুলোর গাল টিপে আদর করে আসবেন।
দোতলার এই ঝুল বারান্দাথেকে উনি ঠিক চিনতে পারেন, কোন বাচ্চাটা জুঁইয়ের, কোনটা বৃষ্টির, কোনটা মেঘলার। বাচ্চাগুলোর মায়েদের উনি ভালো করে চেনেন। বউ মারা যেতে উনি ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু কদিন পরেই তিনি বুঝেছিলেন যার বউ আছে, তার একটাই, কিন্তু যার বউ নেই, তার হাজারটা ।
ওই বাচ্চাগুলোর বাবারা কি কিছু টের পায় না। ওই যে ওটা, ওটাও তো আমার, তাই না। সে রকমই তো বলেছিল শম্পা।