গাব আজ আনন্দের গান
মৃন্ময় দেহের পাত্রে পান করি তপ্ত তিক্ত প্রাণ
গাব আজ আনন্দের গান।
বিশ্বের অমৃতরস যে আনন্দে করিয়া মন্থন
লভিয়াছে নারী তার সুখােদ্বেল তপ্ত পূর্ণ স্তন,
লাবণ্যললিত তনু যৌবনপুস্পিত পূত অঙ্গের মন্দিরে
বুচিয়াছে যে আনন্দ কামনার সমুদ্রের তীরে
সংসার শিয়রে,
যে আনন্দ আন্দোলিত সুগনন্দিত প্রিয় চুম্বন-তৃষ্ণায়
বঙ্কিম গ্রীবার ভলে, অপাঙ্গে, জংঘায়,
লীলায়িত কটিতটে ললাটে ও কটু ভ্রুকুটিতে,
চম্পা-অঙ্গুলিতে,
পুরুষ-পীড়নতলে যে আনন্দে কম্প মূহমান
গাৰ সেই আনন্দের গান।
যে আনন্দে বুকে বাজে নব-নব দেবতার পদনৃত্যধ্বনি
যে আনন্দে হয় সে জননী।
যে আনন্দে সতেজ প্রফুল্ল নর দৃপ্ত, নির্ভীক, বর্বর,
ব্যাকুল বাহুর বন্ধে কুন্দকান্তি সুন্দরীরে করিছে জর্জর,
শক্তির উৎসব নিত্য যে আনন্দে স্নায়ুতে শিরায়
যে আনন্দ সম্ভোগ-স্পৃহায়,
যে আনন্দে বিন্দু বিন্দু রক্তপাতে গড়িছে সন্তান।
গাব সেই আনন্দের গান।
যে আনন্দে ঝটিকার নগ্ন অভিসার
সমুদ্রের কল্লোল-উদগার,
যে আনন্দে আকাশের মাতৃদেহ জর্জরিয়া প্রসবব্যথায়
অন্ধকার-গর্ত হতে তারা বাহিরায়,
যে আনন্দে জ্যোতির্মঞ্চে সূর্য-চন্দ্র-নীহারিকা নিত্য নৃত্যশীল
যে আনন্দে এ মত্ত নিখিল
ছুটে চলে খ্যাপা, দিশাহারা,
যে আনন্দে কদম্ব-জাগান ঘন ভাবণের ধারা।
আনে কি কাজল মেঘের সনে সজল সলীল নীল
অনাবিল
নয়নের মােহ,
আনে তৃণমরীর প্রাণ-সমারোহ,
যে আনন্দে ঋতুতে-ঋতুতে এত অজস্রের বর্ণ-বিলাসিতা
সে আনন্দে চির কবিতা।
যে আনন্দে পিঞ্জরের দ্বার টুটি মুক্তি পায় বন্দী বিহঙ্গম
শিবের তপস্যা ভাঙে যে আনন্দে মন্মথের মিলিলে সঙ্গম,
যে আনন্দে ভস্ম করে অগ্নি যত সম্ভারের স্তুপ
যে আনন্দে গন্ধ দেয় দগ্ধ মান ধুপ,
নিরানন্দ বন্দরের অন্ধকার ছাড়ি
যে আনন্দে দেয় দীর্ঘ পাড়ি
ছিন্নপাল ভগ্নহাল জীর্ণ তরী কাণ্ডারীবিহীন
শুধু জানে মৃত্যু সম্মুখীন–
যে আনন্দে সৈন্যদল জিঘাংসু লােলুপ মাতে শত্রুর হত্যায়
শােণিতের প্রস্রবণ প্রবাহিত যে আনন্দে কৃপাণ-কৃপায়,
মদিনার পাত্র ভরি যে আনন্দ স্বচ্ছ টলমল
সৌরভবিহ্বল,
দ্রাক্ষা আর রমণীর বক্ষ হতে যে মদিরা হয় নিষ্কর্ষণ
যে আনন্দে বৃদ্ধ পিতা করেছিল ভিক্ষা তার
সন্তানের প্রফুল্ল যৌবন,
যে আনন্দে পূর্ণ হয়ে অশ্রুজলে আপনারে করি যায় দান
গাব সেই আনন্দের গান।
যে আনন্দে পতঙ্গেরা পাখা মেলি আগুনেরে করে আলিঙ্গন
যে আনন্দে চঞ্চরীরা গুঞ্জরিয়া করে পুষ্পমঞ্জরীর
মদিরা-ভূরুন,
যে আনন্দে উপবাসী পতিতার শুক ওঠে করে লুব্ধ
ক্ষুধার্ত চুম্বন,
যে আনন্দে প্রেয়সীর নব অবগুণ্ঠনের লজ্জা-উনােচন,
যে আনন্দে পত্রে-পত্রে বাতাসের দীপ্ত করতাল
সে আনন্দে হইব মাতাল।
যে আনন্দে সমাসীরা দেহ হতে জীর্ণ বস্ত্র ফেলে দেয় টানি
ঝরে বহে বৈরাগ্যের একতারাখানি,
যে আনন্দে ভিখারিনী আপনারে নগ্ন করি দিয়াছিল চীর
যে আনলে মৃত্তিকার গলীন তৃণদল প্রকাশ-অস্থির
যে আনন্দে মানুষেরা নিজ-নিজ ভাব দিয়া গড়ে ভগবান
গাব সেই আনন্দের গান।
১৩৩৩
দখিনা
লাখো লণ্ঠন লুণ্ঠিত আজি—লুটের লাট্টু ঘােরে,
পরদা বেফাস, কপাটের খিল আলগা করেছে চোরে।
দুর্বল যত দূর্বার দল দুর্মদ দুর্বার
প্রথম মাতার দুই স্তন ভরি দুগ্ধের সঞ্চার।
ইটের ফাটলে ফুটিছে টগর, চিতায় চাপার বাটি
দামালের দাপে সবুজে ফাটিছে তামাম তামাটে মাটি।
লালসার রাঙা আঙারেতে ভাঙা বুকের আঙুর পিষে,
কণ্টকক্ষত কন্টিকারির ভাণ্ড ভরেছে বিষে।
মড়ার খুলিতে মদ্য ভরিছে মৃত্যু মহৌষধি
রক্তের মাঝে ফেন-ফণা তুলে ফুসিছে বাসনা-নদী।
তারকার লাগি অতসীর শাখা করিতেছে আঁকুপাকু
নব-বিধবার ঠোট কাটে গত রাতের চুমার চাকু।
১৩৩৩
আছ কি নিদ্রাগত
আজি রজনীতে জানালার ধারে ফুটেছে আমার হেনা,
ওর পানে চেয়ে মনে পড়ে সেই বলেছিলে-ভুলিবে না !
আছ কি নিদ্রাগত,
চোখের পাতায় ঘুম নেমেছে কি আমার স্নেহের মতাে?
সফেনা তটিনীর নীরে তুমি নবেন্দুরেখা,
দুখজাগানিয়া কোন বাশয়ী অস্ফুট গীতলেখা!
শেষবিস্তারপাণ্ডুর তব স্তনকোরকের জ্যোতি-
শিথিল শিথানে কারে মােহিয়াছে–খ্রীড়ায় বেপথুমতী!
গােপনমিলনসুখে
মৃণালমৃদুল দুটি বাহু দিয়ে জড়ায়েছে কারে বুকে!
পল্পবরগতা অধরে কার তরে এত মধু,
কার করে লীলাকমল তুমি গাে, কার তুমি লীলাবধু!
তনুতট উচ্ছল-
শিশিরণীতল কপােলে পড়েছে বিচুর্ণকুন্তল!
হেথায় আঁধার নেমেছে নিবিড় কাকপক্ষের মতাে,
মনে আনে কার কালাে দুটি আঁখি মমতায় সন্নত।
ফুটেছে ব্যথার হেনা-
কেন ঘুমাইলে আমার মতন কেন তারে চিনিলে না?
তুমি শুধু আস নাই
কেহ আসিয়াছে চকিত চপল বন-হরিণীর মতো,
গুণ্ঠনহীন দুখানি নয়ন কুণ্ঠায় অবনত !
দেহে যৌবনভার,
এনেছে অতল গাঢ় রহস্য কালাে অমাবস্যার!
মদিবেক্ষণ কেহ আনিয়াছে রাঙা মদিরার ফেনা,
কবরীকলাপে যুথিকামুকুল গুজেছে করবী হেনা।
ষ্ফুরিততড়িৎ কেহ আসিয়াছে দেহ-তট বন্ধু,
পয়েধরে আর অধরে এনেছে মধুরতা মৃত্যুর !
মমতামাখানাে চোখে।
মিলনহীনার মিনতি এনেছে কেহ বা সন্ধ্যালােকে!
কুটিভূষণ আনিয়াছে কেহ, চরণে চঞ্চলতা,
ফুরণ এনেছে লােচনকোণায়, বচনে অস্ফুটতা!
কেহ এসে বসি দূরে
সিথির সীমায় বাঁকা বিদ্যুৎ আঁকে রাঙা সিন্দুরে।
কেহ অকলুষা আকাশের উষা এসেছে নম্র গতি,
সুন্দরী কেহ সন্ধ্যাতারকা, কেহ বা অরুন্ধতী।
তবু ভাবি বসে তাই-
আমার আহ্বানে সকলে এসেছে, তুমি শুধু আস নাই
শাঙনের গাঙ্
শাঙনের গাঙ, ভাঙন ধরেছে—এমনি তােমার দেহ,
বুকের সােনার গাগরী ভরিয়া এনেছ কি অনুলেহ !
ময়ূরপঙ্খী তনু
ময়ূরের মত পেখম মেলেছে-দেখিয়া উতলা হনু।
প্রবালের ডিবা দুটি ঠোটে কি বা প্রবল কামনা মাখি
আমার নয়নে রেখেছিলে তব মদমুকুলিত আঁখি !
গিরিকণিকা কর্ণে দুলিত বক্ষে ললন্তিকা,
দেহদীপাধারে জ্বলিত লেলিহ যৌবন-জয়শিখা।
সব পুড়ে হল ছাই,
তােমার মাঝে যে বিধবা বিবাজে সে কথা তাে জানি নাই।
কই তব সেই মণিকঙ্কণ, কই মালাচন্দন,
উদয়-তারার শাড়ি কই সই, কই বেণী-বন্ধন?
আজি সখি গিয়ে দূরে
রজনী ভরিয়া তারার আলােয় খুজিছো কি বন্ধুরে?
বিস্মরণের তীর হতে তবু তােমারেই শুধু দেখি,
সন্ধ্যার ঐ সন্ধাভাষায় মােরে তুমি ডাকিলে কি ?
অন্তরঙ্গতার –
সুখসৌরভ আনিল কি বহে মৃত্যু-অন্ধকার।
প্রিয়া ও পৃথিবী
নিঃশ, নিঃশব্দপদে একদিন এসেছিলে কাছে।
ঈপ্সিত মৃত্যুর মত ; নয়নে যেটুকু হ্ন আছে,
অধরে যেটুকু ক্ষুধা-সব দিয়ে লইলাম মুছে
লােলুপ লাবণ্য তব ; দিনান্তের দুঃখ গেল ঘুচে,
উদিলাে সন্ধ্যার তারা দিধূর ললাটের টিপ।
কদপ্ৰসবসম জলে ওঠে কামনা-প্রদীপ
যুণ দেহে ; শ্মশানে অতসী হাসে, নিকষে কনক ;
মেঘলগ্ন ঘনবল্পী আকুল পুলকে নিষ্পলক।
কঙ্করে অঙ্কুর জাগে, মরুভূতে ফুটিলাে মালতী-
তুমি রতি মুর্তিমতী, আর আমি আনন্দ-আরতি।
দেহের ধুপতি হতে জ্বলে ওঠে বাসনার ধুনা
লেলিহরসনা, তবু কালাে চোখে কোমল করুণা।
শুভ্র ভালে খেলা করে তৃতীয়ার স্নান শিশু-শশী,
তোমার বরাঙ্গ যেন সন্ধ্যাস্নিগ্ধ, শ্যামল তুলসী।
ভুজের ভুজঙ্গতলে হে নতাঙ্গী, নির্ভয়, নির্ভয়ে
তােমার স্তনাগ্রচূড়া কঁপিলাে নিবিড় থরথরে।
স্ফুরৎপ্রবাল-ওষ্ঠে গৃঢ়ফণা চুম্বন উৎসুক,
এক পারে রক্তালােক, অন্য তটে হিংসুক কিংশুক।
স্লথ হলাে নীবিন্ধ, চূর্ণালক, শিথিল কিঙ্কিণী,
কলে মলিন হলাে পাও গও, কাটিলাে যামিনী।
দূরে বুঝি দেখা দিলো দিঘালার বুজত-বলয়,
বলিলাম কানে কানে : “মরণের মধুর সময়।
আজি তুমি পলাতকা, মুক্তপক্ষ পাখি উদাসীন,
ক্লান্ত, দুরনভচারী দিগন্তের সীমান্তে বিলীন।
বিদ্যুৎ ফুরায়ে গেছে, কখন বিদায় নিলাে মেঘ,
অবিচল শূন্যতার নভােব্যাপী নিস্তব্দ উদ্বেগ
আবরিয়া রহিয়াছে হৃদয়ের অনন্ত পরিধি,
চাহি না ঘৃণিত মৃত্যু, তব গুপ্ত, হীন প্রতিনিধি।
নীবিবন্ধু শিথিলিতে কটিতটে যদিও কিঙ্কিণী।
বাজে আজো, কজ্জলে মলিন গণ্ড, তবু, কলঙ্কিনি,
চাহি না অতীত মৃত্যু। নভস্তলে অনিবদ্ধনীবি
ঘুম যায় মাের পার্শ্বে বীরভােগ্যা প্রেয়সী পৃথিবী।
‘রে চাই; তাহারি সুধার তরে অসাধ্য-সাধনা,
বিস্মিত আকাশ ঘিরি সম্মিত, সুনীল অভ্যর্থনা,
অজস্র প্রশ্রয়। মৃত্তিকার উদ্বেলিত পয়ােধরে
সম্ভোগের সুরাস্রোত ওষ্ঠাধরে উচ্ছ্বসিয়া পড়ে,
শস্য ফলে, নদী বহে, উধ্বে জাগে উত্তঙ্গ পর্বত,
হাস্য করে মৌনমুখে উলঙ্গ, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।
আয়ুর সমুদ্র মাের দুই চক্ষে, মৃত্যু পদলীন,
তােমার বিশ্বতি দিয়া পৃথিবীরে করেছি রঙিন।
নক্ষত্র-আলােক হ’তে সমুদ্রের তরঙ্গ-অবধি
বহে চলে একখানি পরিপূর্ণ যৌবনের নদী-
তারি তলে করি স্নান, নাহি কুল, নাহি পরিমিতি,
তুমি নাই, আছে মুক্তি—পৃথ্বীব্যাপী প্রচুর বিশ্বতি।