গিয়ােভানি বােকাসিও-র ডেকামেরন টেলস এর বাংলা অনুবাদ।
অষ্টম দিবস আরম্ভ হল। নতুন রানী লরেতার নির্দেশে আজ প্রত্যেককে একটি করে মজার গল্প বলতে হবে। কি বিষয়ে ? পুরুষ ও রমণীরা পরস্পরকে কিভাবে ঠকায়।
অষ্টম দিনে ভাের হতেই সকলে শয্যাত্যাগ করে বাগানে বেরিয়ে এসে ভােরের বাতাস উপভােগ করতে করতে, পাখির গান শুনতে শুনতে, ফুলের শােভা দেখতে দেখতে, শিশির-ভেজা ঘাসের কারপেটের ওপর পদচারণা করতে লাগলাে। কেউ বুঝি মৃদুস্বরে গাইতে লাগলাে, ভােরের বাতাস ধীরে কোথা যাস, যাস বঁধুয়ার দেশে লুটিয়ে আনিস কস্তুরীবাস মাখানাে বধুয়ার কেশে।
এরপর সকলে ফিরে গিয়ে পরিষ্কার হয়ে পােশাক পালটে প্রাতরাশ সেরে আবার বাগানে ফিরে এসে ফোয়ারার ধারে ফুলভর্তি বড় একটা গাছের নিচে বসল। অষ্টম দিবসের প্রথম গল্পটা আরম্ভ করল নেফাইল।
প্রথম গল্প
গুয়াসপারুলাের কাছ থেকে জার্মান গুলফারডাে কিছু টাকা ধার করলাে। গুয়াসপারুলাে বাইরে যাচ্ছে তাই বলে গেল টাকাটা তার বৌকে ফেরত দিতে। বৌকে টাকা ফেরত দেবার সুযােগে শুলফারডাে তাকে উপভােগ করে। স্বামী ফিরে যখন স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করল, টাকা ফেরত দিয়েছে? গুলফারডাের সামনে স্ত্রীকে স্বীকার করতে হল, হা টাকা ফেরত পেয়েছে কিন্তু তার স্ত্রী প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হল।
নেফাইল বললাে, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে তিনি নতুন রানীর মুখ দিয়ে আজকের প্রথম গল্পটা আমাকে বলতে বলেছেন। লরেতাকেও ধন্যবাদ। আমিও তােমাদের নিরাশ করবাে না। একজন চতুর ও শঠ পুরুষ একটি পরস্ত্রীকে কিভাবে ঠকাল তারই গল্প। শােনাে
গুলফারন্সে নামে একজন অবস্থাপন্ন জার্মান মিলান শহরে বাস করতাে। সে অন্যান্য জার্মানের মতাে কাজে অবহেলা করতাে না, অনুগত বলে কর্মক্ষেত্রে তার সুনাম ছিল। সে কারও কাছে টাকা ধার নিলে চুক্তিমতাে ঠিক তারিখে সুদসমেত ফেরত দিত। এজন্যে ব্যবসায়ী বা মহাজনরা তাকে ঋণ দিত, কখনও ফিরিয়ে দিত না এবং সুদও কিছু ছাড় দিত।
ঐ মিলান শহরেই এক ধনী ব্যবসায়ী ছিল। তার নাম গুয়াসপারুলাে কাগাস্ট্রাচিয়ে। আমরা সংক্ষেপে গুয়াস বলবাে। গুয়াসের সঙ্গে গুলফারডাের খুব ভাব, ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব করার পিছনে গুলফারডাের একটা মতলব ছিল। গুয়াসের স্ত্রীর মতাে অমন সুন্দরী ও রসিকা মেয়ে ও তল্লাটে আর একটিও ছিল না। তার নাম আমব্রুয়ােজিয়া। বন্ধুর বৌ-এর সঙ্গে প্রেম করা কঠিন নয়, যেমন কঠিন নয় স্বামীর বন্ধুর সঙ্গে প্রেম করা। অতএব দু’জনেই প্রেম করতাে এবং দু’জনে এত সতর্ক ছিল যে অন্য মানুষ দূরের কথা, গুয়াসই কিছুই টের পায় নি, দু’জনকে সন্দেহও করতাে না। দু’জনের প্রেম চুম্বন ও আলিঙ্গন পর্যন্ত পৌঁছেছিল তার বেশি সুযােগ হয়নি।
গুলফারডাে একদিন বেশি কিছু দাবি করলাে, এমনকি পরিবর্তে প্রেয়সী যদি কিছু দাবি করে তা দিতেও সে প্রস্তুত। প্রেয়সী তাে প্রথমে নানা ছলা করে নিজের দর বাড়াতে লাগল। শেষ পর্যন্ত দুটি শর্তে রাজি হল। প্রথম শর্ত হল তাদের মিলনের কথা গুলফারডাে কাউকে বলবে না আর দ্বিতীয় শর্ত? প্রয়সী বলল, ডার্লিং তােমার অবস্থা তাে বেশ ভালাে, ভালাে রােজগার করাে। তা আমি কিছু জিনিস নিতে চাই সেজন্যে তুমি আমাকে দুশাে সােনার ফ্লোরিন দেবে তাহলে তুমি যা চাইবে আমার কাছ থেকে তাই পাবে এবং যখনই চাইবে তখনই।
আমব্রুয়োজিয়া যে এমন লােভী ও হালকা মেয়ে তা গুলফারডাের জানা ছিল না। এমন কোনাে পরিচয়ও পায়নি। গুলফারডােও কম চালাক নয়। মনে মনে বলল, দেখ তােমাকে কেমন জব্দ করি।
মুখে বলল, নিশ্চই নিশ্চই, তােমাকে সুখী করবার জন্যে আমার হৃদয়ের রানী আমি সব কিছু করতে পারি। তােমার ইচ্ছাই পূর্ণ হবে।
এরপর দু’জনে কথা বলে ঠিক করলাে, কবে কখন কোথায় দুটিতে একত্রিত হবে। গুলফারডাে অবশ্যই সঙ্গে স্বর্ণমুদ্রা আনবে এবং এসব কথা ঘুনাক্ষরেও সে কাউকে বলবে না শুধু একজনকে ছাড়া। সে হল তার এক অভিন্নহৃদয় বন্ধু। দুই বন্ধু পরস্পরের সমস্ত গুপ্ত খবরই জানে। আসল ব্যাপার অবশ্য অন্য, তা যথাসময়ে জানা যাবে। গুলফারডাে ভাবলাে এতদিন যাকে সে মহিলা বলে জানতাে এখন তাে দেখা যাচ্ছে সে বারাঙ্গনা ব্যতীত কিছু নয়, এ তাে দেহ বেচে অর্থ নিচ্ছে।
আমব্রুয়োজিয়া সম্মতি জানিয়ে বললাে, ভালােই হল, আমাদের উভয়ের ইচ্ছাই পূর্ণ হবে। ব্যবসায়ের জন্যে স্বামী গুয়াসকে কয়েকদিনের জন্যে জেনােয়া যেতে হবে। এই সুযােগে আমরা আমাদের নস্কামনা পূর্ণ করবাে।
এদিকে পরে উপযুক্ত সময় বুঝে গুলফারডাে তার বন্ধু গুয়াসের কাছে গিয়ে বলল, ভাই একটা ব্যাপারে আমার দুশাে সােনার ফ্লোরিন দরকার পড়েছে। টাকাটা লগ্নী করলে মােটা লাভ করতে পারবাে তবে তােমার টাকা আমি চার পাঁচ দিন বা যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি শােধ করে দেবাে। সুদও দেবাে।
গুলারডােকে গুয়াস উত্তমরূপে চেনে। সে কথার খেলাপ করে না। সে তখনি গুনে গুনে দুশাে ফ্লোরিন বন্ধুকে দিয়ে বললাে, সে জেনােয়া যাবার আগে যদি টাকা শােধ দিতে না পারাে তাহলে যেন তার বৌয়ের হাতে দিয়ে দেয়। গুলফারডাে টাকা থলেতে ভর্তি করতে করতে ঘাড় নেড়ে তার সম্মতি জানালাে।
কয়েকদিন পরে গুয়াস জেনােয়া চলে যেতেই তার বৌ তার প্রেমিক গুলফারডােকে ডেকে পাঠাল এবং সঙ্গে দুশাে ফ্লোরিন আনবার কথা মনে করিয়ে দিলাে।
গুলফারডো সঙ্গে শুধু ফ্লোরিনই আনলাে না সেই অভিন্নহৃদয় বন্ধুকেও নিয়ে এল। তারপর বন্ধুর সামনেই দুশাে ফ্লোরিনের থলিটি প্রেয়সীর হাতে তুলে দিয়ে বললাে, থলেতে দুশাে সােনার ফ্লোরিন আছে, বন্ধু গুয়াস ফিরে এলে তাকে দিয়াে।
মহিলা থলি উপুড় করে ফ্লোরিনগুলি বার করে একে একে গুনে আবার থলেতে ভরে বলল, ঠিক আছে। মহিলা ভাবলাে গুলফারডাে দেখাতে চেয়েছে যে টাকাটা সে যেন ধার নিয়েছিলাে এখন শােধ দিলাে তার দেহদানের জন্যে টাকা দিচ্ছে না। থলে বাধতে বাঁধতে মুচকি হাসলাে। কিন্তু তার অজানতে কি নাটক হয়ে গেল তা সে জানতে পারলাে না। গুলফারডাের অভিন্নহৃদয় বন্ধু না আর কিছু, গুলফারডাে একজন সাক্ষী রাখল এই আর কি।
থলেভর্তি স্বর্ণমুদ্রা মহিলা ঘরের ভেতরে সিন্দুকে তুলে রেখে এসে দেখলাে গুলফারডাের বন্ধু চলে গেছে। তখন সে মহানন্দে গুলফারডােকে নিজের শায়নঘরে ডেকে এনে উভয়ে মিলিত হল। সেদিন শেষ নয়, গুয়াস ফিরে না আসা পর্যন্ত উভয়ে প্রতিদিন কখনও একাধিকবার মিলিত হতাে।
তারপর যথাসময়ে গুয়াস জেনােয়া থেকে ফিরলাে। গুলফারডাে জানত কখন গুয়াস তার স্ত্রীর সঙ্গে বসে কথা বলে। সে ঠিক সেইসময়ে তার সেই বন্ধুকে নিয়ে তাদের বাড়িতে হাজির।
প্রথমে কুশল প্রশ্ন বিনিময় হল। তারপর গুলফারডাে বলল, বন্ধু গুয়াসপারুলো তুমি আমাকে ফ্লোরিন ধার দেওয়া জন্যে তােমাকে আবার ধন্যবাদ জানাচ্ছি কিন্তু ভাই ঐ অর্থ আমার কাজে লাগল না তাই পরদিনই তােমার কথামতাে তুমি যেমন দিয়েছিলে থলেভর্তি সেই দুশাে সােনার ফ্লোরিন আমি তােমার পত্নীর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে গেছি। সঙ্গে আমার এই বন্ধুও ছিল। তােমার খাতায় তাহলে আমার নামটা কেটে দিয়ো।
গুয়াস তার বৌয়ের দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলাে, কই তুমি তাে আমাকে বলো নি?
আরে অনেকদিন পরে তােমাকে পেয়ে আমি ও কথা ভুলেই গিয়েছিলুম। হ্যা গুলফারডাে ফেরত দিয়ে গেছে।
বললাে বটে এ কথা কিন্তু গুলফারডাের দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে মনে মনে বলল, কি সাংঘাতিক মানুষ! গুলফারডােও মনে মনে বলল, কেমন জব্দ নষ্ট নারী!
গুলফারডাে হাসতে হাসতে বাসায় ফিরল।
দ্বিতীয় গল্প
ভারলুঙ্গোর যাজক মােনা বেলকোলােরের শয়নকক্ষে তাকে নিয়ে নিশিযাপন করলাে কিন্তু ভারলুঙ্গোরের কাছে তখন অর্থ না থাকায়, সে তার অঙ্গাবরণটি বন্ধক রেখে গেল। আসবার সময় তার কাছ থেকে বেশ বড় শ্বেতপাথরের খলনুড়িটা চেয়ে আনলাে তারপর সেটা লােক মােফত মােনার কাছে ফেরত পাঠিয়ে বলল অঙ্গাবরণটা ফেরত পাঠিয়ে দাও। আমি এই লােকের হাতে নগদ অর্থ পাঠাবাে। মােনা বিশ্বাস করে অঙ্গাবরণ ফেরত দিয়ে ঠকলাে।
ইস্ গুলফারডােটা কি চালাক রে বাবা, অমন মানুষের পাল্লায় পড়লে তাে গেছি, কি ভাবে ঠকাৰে কে জানে, সকলে এইরকম মন্তব্য করতে করতে খুব হাসাহাসি করতে লাগলাে। কুইন বলল, এই তােমরা হাসি থামাও তাে। এবার প্যানফিলাে গল্প বলবে, দেখি সে আমায় কি বলে। প্যানফিলে বলল, আমাদের মধ্যে কোনাে কোনাে সম্প্রদায়ের এমন কিছু মানুষ আছে যারা আমাদের ঠকালেও আমরা তার প্রতিশােধ নিতে পারি না। আমি গির্জার যাজকদের কথা বলছি। তারা অনেকেই ভণ্ড। পরস্ত্রীর ওপর লােভ যেন বেশি আর যাজকদের পক্ষে মেয়েদের ধোকা দেওয়া অনেক সহজ। আমি একটা ছােট গল্প বলছি কিন্তু খবরদার ওদের বিশ্বাস কোরাে না। এবার গল্পটা শােননা। যাজকের শেষ উত্তরটা শুনে মজা পাবে।
তােমরা তাে ভারলুঙ্গোর নাম শুনেছ, ছােট একটা গ্রাম কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ, এখান থেকে বেশি দূরে নয়। সেই গ্রামের গির্জায় এক যাজক ছিল, হৃষ্টপুষ্ট। যাজক অপেক্ষা পালােয়ান হলেই ভালাে মানাত। মানুষের মন জয় করবার জন্যে শ্রুতিমধুর নানারকম বুলি আওড়াতে পারতাে। প্রতি রবিবার গ্রামের লােকেদের এলম গাছের তলায় জড়াে করে জমিয়ে গালগল্প করতাে। তারপর যখন কোনাে গ্রামবাসী তার যুবতী স্ত্রীকে বাড়িতে একা রেখে কোনাে কাজ উপলক্ষে অন্য গ্রামে যেত, তখন তাদের পাপস্থানের ছুতাে করে তাদের বাসায় হাজির হতাে। সঙ্গে উপহারস্বরূপ গির্জায় জ্বালানাে মােমবাতির শেষাংশ বা পূত বারি বা অন্য কিছু নিয়ে যেত। তাদের ধর্মকথা, নীতিবাক্য ইত্যাদি শােনাবার সময় রসিকতা করতাে। ব্যাপার সুবিধে নয় বুঝলে যুবতীকে আশীর্বাদ করে চলে আসতাে। | কয়েকটি বধূ কিন্তু তাকে পছন্দ করতাে, তাদের মধ্যে একজন হল মােনা বেলকোলাের। তার স্বামীর নাম বেন্তিভেনা ডেল মাজো, জমি ছিল, চাষবাদ করতাে। এই বধূটি যাজককে আকৃষ্ট করলাে। আটোসাটো অথচ পুরন্ত গড়ন, হাসিখুশি রসিকা বৌটিকে তার খুব মনে ধরলাে। বৌটিও যে তাকে অপছন্দ করতাে এমন নয়। বৌটির অনেক গুণও ছিল, অনেক রকম কাজও জানত। চরকা কাটতে পরত, পশম থেকে সরু মােটা সবরকম সুতাে তুলতে পারতাে। ঘর সংসার পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতাে। নিজেও সাজতাে, ঘরখানিও সাজিয়ে রাখতাে। তম্বুরা বাজাতে ও গান গাইতেও পারতাে। গ্রামে কোনাে সৈবে সারিবদ্ধ নাচে যােগ দিত। হাতে একটা রুমাল নিয়ে একাও নাচতাে, সঙ্গে গান গাইতাে, মনের কথা কইলে পরে বঁধু এসে বসবে ঘরে। তখন ছােকরারা হাততালি দিত। বলতে কি সে ছিল গ্রামের মক্ষিরানী।
যাজকমশাইয়ের এমন মেয়েকে মনে ধরবে না তাে কাকে মনে ধরবে? সুযােগ পেলেই মনাের সঙ্গে কথা বলতাে। রবিবারে মােনো গির্জায় গেলে বাগান থেকে ফুল তুলে তার হাতে দিত। আপাতত যাজক বুব সাবধানে মােনার সঙ্গে কথা বলতাে মােনার স্বামী বা গ্রামবাসী কেউ তাকে সন্দেহ না করে। কিছু হবার আগে কুমতলব ধরা পড়লে সবই তাে মাটি হয়ে যাবে।
মােনার সঙ্গে একটু একটু করে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টায় সে লােক মারফত তার বাড়িতেও উপহার পাঠাত। যেমন গির্জার প্রাঙ্গণে উৎকৃষ্ট রসুনের চাষ হতাে, ক্ষেত থেকে সদ্য তােলা কিছু রসুন হয়ত পাঠিয়ে দিল। সে নিজে মটরশুটির গাছ লাগিয়েছিল, সিম গাছও ছিল, তাও পাঠাত। কিন্তু এসব উপহার পাঠিয়েও যাজকমশাই তখনও মােনা বেলকোলােরের মন জয় করতে পারে নি কারণ পথে দেখা পেলে এবং মােনা থাকলে ফিসফিস করে দু’চারটে রসের কথা বলতাে। মােনা না শােনার ভান করে নাক তুলে নিতম্ব ঘুরিয়ে চলে যেত। ঠোটের কোণে হয়ত একটু হাসি। এই দেখেই যাজকমশাইকে বুঝে নিতে হতাে যে মােনা তাকে অন্তত উপেক্ষা করছে না, তাহলে বােধহয় ওষুধ ধরেছে। আসলে মােনা যাজকের কথাগুলাে শুনে বেশ কৌতুক অনুভব করতাে।
একদিন বিকেলের দিকে যাজকমশাই গ্রামের পথে এমনিই যখন পায়চারি করছেন এমন সময় দেখলেন মােনার স্বামী বেন্তিভেনা গাধার পিঠে অনেক মাল বােঝাই করে কোথায় চলেছে। তাকে দেখতে পেয়ে যাজক জিজ্ঞাসা করলাে, কোথায় চললে হে এত মালপত্তর নিয়ে?
সে উত্তরে বলল, শহরে কিছু জরুরী কাজ আছে। তার ওপর উকিলমশাইয়ের সঙ্গে কোনাে ব্যাপারে পরামর্শ করতে হবে।
যাজক বললাে, আশীর্বাদ করি সফল হয়ে ফিরে এসাে।
বেন্তিভেনা শহরের দিকে নিজের কাজে চলে গেল আর সুযােগ বুঝে যাজক মােনর বাড়ির দিকে চললাে। বাড়ির সামনে পৌঁছে বেশ জোরেই বলল, ঈশ্বর সকলের মঙ্গল করুন। কেউ বাড়ি আছে? যাজক তাে ভাল করে জানে মােনা রেবলকোলাের এখন বাড়িতে একাই আছে। মােনা ওপরের ঘরে ছিল। যাজকের গলা শুনে নিচে নেমে এলাে তারপর দরজা খুলে বলল, আসুন ফাদার, এত রােদে কোথায় বেরিয়েছিলেন?
রােদ কোথায়? বেশ তাে হাওয়া দিচ্ছে। দেখলুম বেন্তিভেনা শহরে গেল, বাড়িতে তুমি একা রয়েছ তাই তােমার যাতে সময় কাটে সেজন্যে একটু গল্পগুজব করতে এলুম আর কি।
মােনা যাজককে বসিয়ে একটা বাঁধাকপি নিয়ে কাটতে বসলাে।
একটু গলা ঝেড়ে যাজক বলল, মােনা তুমি কি আমার দিকে মুখ তুলে চাইবে না? আমাকে বার বার ফিরিয়ে দেবে?
মােনা হাসতে হাসতে বলল, আমি আবার কি করলুম?
ফাদার মুচকি হেসে বলল, কিছু কররানি বলেই তাে আমার নালিশ। অথচ আমি তােমাকে আমার বুকে জড়িয়ে ধরতে চাই, ঈশ্বরেরও ইচ্ছা তাই অথচ তুমি আমাকে পাত্তা দিচ্ছ না।
মােনা বলল, হা ঈশ্বর! এসব কথা কি আপনাদের মতাে যাজকের মুখে শােভা পায়?
কেন পাবে না? এতে দোষ কি? আমরাও আর পাঁচজন মানুষের মতাে এবং এসব কাজ আমরা ভালােই করতে পারি। এতে কোনােই দোষ নেই।
যাজক যে কি চায় তা তার চোখমুখের ভাবভঙ্গি দেখে যে কোনাে কিশােরীই বলে দিতে পারে, মােনা তাে পরিপূর্ণ যুবতী। সে বললাে, আপনারা গির্জার সকলেই সমান। তার ওপর আপনারা ভীষণ কৃপণ।
তাই নাকি? তা তুমি কি চাও? একজোড়া সুন্দর জুতাে, সিল্কের স্কার্ফ নাকি পশমের কোমরবন্ধনী?
ধন্যবাদ। ওসব আমার কিছু চাই না, আমার কাছে। তা আমাকে যদি তােমার মনে ধরে থাকে তাহলে আমাকে মাত্র পাঁচ পাউণ্ড ধার দাও কারণ আমার কালাে স্কার্ট আর বেল্টটা বন্ধক দিয়েছি। ওটা আমি পরে রবিবারে গির্জায় যাই, বিবাহবার্ষিকীর দিন পরি, পশম নিয়ে শহরে যাই। ওটা ছাড়িয়ে আনবাে কারণ শনিবারই আমাকে ফ্লোরেন্সে যেতে হবে।
কিন্তু মােনামণি আমার কাছে তাে এখন একটাও পাউণ্ড নেই। নইলে তাে এখনি দিয়ে দিতুম। তবে শনিবারের আগে আমি নিশ্চই দেব।
মােনা বিরক্ত হয়ে বললাে, তােমরা ঐরকমই বলো তারপরে সব ভুলে যাও। তুমি কি আমাকে বিলিউজা পেয়েছ? বেচারীকে তুমি ভীষণ ঠকিয়েছ। কাছে যদি টাকা না থাকে তাে গিয়ে নিয়ে এসাে।
সজোরে মাথা নাড়তে নাড়তে যাজক বলল, আরে না না, ওসব বাজে কথায় কান দিয়াে না তাে। তুমি মিছিমিছি দেরি করছো, আবার কেউ হয়ত এসে যাবে তখন আমাদের এই চমৎকার বিকেলটাই মাটি হয়ে যাবে। আমার মেজাজ এখন উচ্চগ্রামে, মিইয়ে না যায়। তুমি আবার বলছাে এখন গির্জায় গিয়ে টাকা আনতে।
পার তাে গিয়ে টাকা নিয়ে এসাে নইলে অন্য পথ দেখাে।
বেশ তাহলে এক কাজ করা যাক। আমি যে তােমাকে পরে টাকা দেব সেকথায় যদি বিশ্বাস না করে তাহলে আমি আমার এই ক্লোক বা অঙ্গাবরণটা তােমার কাছে জমা রেখে যাচ্ছি। এটা খুব দামী, এ দেশে পাওয়া যায় না, যাচাই করতে দেখতে পারাে, এর দাম কমসে কম সাত পাউণ্ড।
যাজক তার ক্লোক খুলে মােনর হাতে দিল। মােনা সেটা ভালাে করে দেখল। জিনিসটা ভালােই, সেটা সে ঘরে তুলে রাখল। তারপর বলল, এখানে নয়, বাড়ির পিছনে চলো। ওখানে আমার আলাদা একটা ঘর আছে, ওদিকে কেউ যায় না। বাইরে থেকে মনে হবে বাগানের জিনিসপত্র ও অন্য জিনিস রাখবার ঘর। আসলে তা নয়, ওটা আমার নিজস্ব ঘর।
সেই ঘরে দু’জনে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। সময় ভালােই কাটল। তারপর যাজক নিজের বাসায় ফিরে গেল কিন্তু আফশােস করতে লাগলাে, আহা ক্লোকটা রেখে আসতে হল?
যাজক যেমন চতুর তেমনি তার কুটবুদ্ধি। ক্লোকটা উদ্ধার করবার জন্যে মনে মনে একটা মতলব ভাজল। একটিও পয়সা খরচ না করে ক্লোকটা সে উদ্ধার করে মােনাকে মজা দেখিয়ে দেবে।
পরদিন কী একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছিল। এই উপলক্ষে সে মােনার বাড়িতে একটি ছেলেকে পাঠিয়ে মােনার শ্বেতপাথরের বড় খলনুড়িটা চেয়ে পাঠালাে। সে কিছু মশলা পেশাই করবে।
মােনা খলনুড়িটা ছেলেটির হাতে দিল। ছেলেটি সেটি নিয়ে যাজককে দিল। কিছুক্ষণ পরে যাজক বুঝল বেন্তিভেনা ও মােনা এখন প্রাতরাশের টেবিলে বসবে। এবার সেই ছেলে নয়, একজন যুবকের হাত দিয়ে শুধু খলটি দিয়ে যুবককে বলল, তুমি বেন্তিভেনার সামনে বলবে, তােমাদের খল ফেরত দিলুম, ফাদার বলেছেন তিনি কাল তার যে ক্লোকটা জমা রেখে গেছেন সেটা ফেরত দাও।
মােনা কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার স্বামী বিরক্ত হয়ে বললাে, এসব জমা রাখা কি আমি বুঝি না। তুমি ফাদারের ক্লোক ফেরত দিয়ে দাও। এসব ভালাে নয়, ফাদারের কোনাে জিনিস জমা তাে রাখবেই না এবং তিনি কিছু চাইলে সঙ্গে সঙ্গে তা দেবে নইলে তােমাকে আমার হাতে মার খেতে হবে।
মােনা কি আর করে, বিড়বিড় করে কি বলতে বলতে উঠে গেল। তারপর খাটের তলা থেকে কাঠের সিন্দুক বার করে তার ভেতর থেকে ক্লোকটি বার করে এনে লােকের হাতে দিয়ে বলল, ফাদারকে বােলাে মোনা বলেছে তার খলে সে ফাদারকে আর কোনােদিন কিছু পিশতে দেবে না।
লােকটি ক্লোকটি নিয়ে ফাদারকে ফেরত দিয়ে মােনার কথা বলতে দুষ্ট ফাদার হা হা করে হাসতে হাসতে বলল, তার খল তারই থাক কিন্তু নুড়ি তাে আমার কাছে। কিছু পিশতে হলে তাে তার নুড়ি চাইই চাই। একটা ছাড়া অপরটা দিয়ে কাজ হয় না।
মােনা তাে রাগে ফুসতে লাগল। হাড়বজ্জাত পাজী লােকটা তাকে এরকম করে ঠকাল। যাজকের সঙ্গে কোথাও দেখা হলে মােন তার সঙ্গে কথা বলতাে না, মুখ ঘুরিয়ে চলে যেত। দুষ্ট যাজকও তকে তক্কে থাকতাে, কি করে মােনাকে সে আবার জড়িয়ে ধরবে।
ক্ষেতে আঙুর পাকল, তােলবার সময় হল। যাজক তাজা আঙুরের রসের সঙ্গে চূর্ণ বাদাম আর কিসব মিশিয়ে উৎকৃষ্ট এক বােতল পানীয় তৈরি করে মােনাকে একা দেখে তার বাড়িতে হাজির হল এবং ক্ষমা চেয়ে ও বাকচাতুর্যে আবার তার মন জয় করে নিল। মােনাকে পাঁচ পাউণ্ড না দিয়ে তার তামুরাটা মেরামত করে দিল। মােনা আবার খুশি হল, মানুষটা তাে রীতিমতাে পুরুষ। নুড়ি তার আয়ত্তে, শুধু খল নিয়ে সে কি করবে? দিন বা রাত ভালােই কাটতে লাগলাে।
তৃতীয় গল্প
ক্যালানড্রিনাে ব্রুনাে এবং বুফালমাচো মুগােন নদীর ধারে গেল জাদু পাথরের সন্ধানে। ক্যালানড্রিনাে ভাবলাে জাদু পাথর সে পেয়ে গেছে। একটা নয় সে অনেক পাথর সংগ্রহ করে বাড়ি ফিরে ঘরের মেঝেতে ঢেলে দিতেই তার বৌ রেগে গেল, যত সব জঞ্জাল। বৌ-এর রাগে দেখে ক্যালানড্রিনাে তাকে প্রহার করলাে। তারপর ক্যালানড্রিনাে তার সঙ্গীদের বলল, আসল ব্যাপার কি ঘটেছে।
মেয়েরা সবাই প্যানফিলাের গল্প শুনে যাজকের নিন্দা করতে লাগলাে, আবার হাসতে লাগলাে। এলিসার দিকে মুখ ফিরিয়ে কুইন বলল, মনে হচ্ছে তােমার যেন গল্প বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না, যদি হয়
তাে বলাে।
তুমি অনুমতি দিলেই বলতে পারি, এলিসা বলল। অনুমতি তাে দিলুম, কুইন বলল।
এলিসা সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমার গল্পটা খাটি ও নির্ভেজাল সত্যি। শুনে তােমরা মজা পাবে তবে প্যানফিলাের গল্প শুনে যত হেসেছিলে অত হাসবে কিনা বলতে পারি না। তবে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবাে।
খুব বেশিদিনের কথা নয়, আমাদের এই শহরে নানা অদ্ভুত রীতি ও প্রথা প্রচলিত ছিল, যার কোনাে ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। সেই সময়ে শহরে একজন চিত্রশিল্পী বাস করত যার নাম ছিল ক্যালানড্রিননা। লােকটি সরল ও স্বাভাবিক ছিল। তাকে প্রায়ই আর দু’জন শিল্পীর সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেতাে। একজনের নাম ছিল ব্রুনাে, অপরজনের নাম বুফালমাচো। এরা দু’জন খুব আমুদে ছিল, মাথায় দুষ্টবুদ্ধি গিজগিজ করতাে। ওরা দু’জনে ক্যালানড্রিনােকে নিয়ে মজা করতাে।
এই সময়ে ফ্লোরেন্সে আরও একজন ওদের সমবয়সী বাস করতাে। লােকটি জীবনে সফলকাম তাে হয়েছিলই উপরন্তু সে ছিল চতুর, বাপটু, খােলামেলা ও হাসিখুশি। তার নাম ছিল ম্যাসাে ডেল সাজ্জিয়াে। সে কোনাে সূত্রে সরল ক্যালানড্রিনাের কথা শুনেছিল। ওর দুই বন্ধু ওকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাসা করে, ও না হয় আর একটু করলাে। ঠাট্টা তামাসা তাে করতেই চাই কি মাথায় এমন কিছু ঢুকিয়ে দিতে হবে যা ও বিশ্বাস করবে। অবশ্য মজা করার উদ্দেশ্য নিয়েই সবকিছু করা হবে।
একদিন ক্যালানড্রিনাের সঙ্গে ম্যাসাের স্যান গিওভানি গির্জায় দেখা হয়ে গেল। গির্জার দেওয়ালে যেসব মূর্তি খােদিত বা প্রােথিত আছে, শার্সির কাচে যেসব রঙিন ছবি আছে, সেগুলি ক্যালানড্রিনাে খুব মনােযােগ দিয়ে দেখছিল। ম্যাসাে ঠিক করলাে ওর মাথা ঘুলিয়ে দেবার এই হল উপযুক্ত সময়।
ম্যাসাের একজন সঙ্গী ছিল। তাকে বলল, চলাে ঐ পেন্টারের সঙ্গে একটু মজা করি। ছবি ও মূর্তি দেখে ক্যালানড্রিনাে একটা পাথরের বেঞ্চে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। ম্যাসাে ও তার সঙ্গী তার পাশে গিয়ে বসলাে। ক্যালানড্রিনােকে গ্রাহ্য না করে অথচ সে যাতে শুনতে পায় এমনভাবে ম্যাসাে তার বন্ধুকে বলতে লাগলাে, জানিস আমাদের শহরের কাছে একটা জায়গায় কত রকম পাথর পাওয়া যায়। দাদুর কাছে শুনেছি ওখানে একটা লোেক ছােট একটা গােল পাথর কুড়িয়ে পেয়েছিল। পাথরটা কোনাে ছােট জিনিসে ছোঁয়ালে অর্ধেক রুপাে আর অর্ধেক সােনা হয়ে যেত। পাথর পাওয়ার কিছুদিন পরে লােকটা পাগল হয়ে যায়। পাথরটা কোথায় কে জানে ফেলে দিয়েছিল। তারপর ওখানে নানা রঙিন পাথর। পাওয়া যায়। সেইসব পাথরের গা চেঁছে শিল্পীরা রং তুলে তেল মিশিয়ে ছবি আঁকার রং তৈরি করে।
ম্যাসাে যেন পাথর সম্বন্ধে একজন বিশেষজ্ঞ। ক্যালানড্রিনোে ওদের কথা শুনে কান পেতে শুনছিল। যখন বুঝলল ওরা কোনাে ব্যক্তিগত কথা বলছে না তখন সেও ওদের সঙ্গে কথা বলতে আরম্ভ করলাে। ম্যাসাে তাে খুব খুশি, এবার পেয়েছি।
ক্যালানড্রিনাে কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাে, আচ্ছা এসব পাথর কোথায় পাওয়া যায় ? ওসব পাথর পাওয়া যায় করননাচোপিয়া অঞ্চলে বাস্ক জেলায় নােম্যানসল্যাণ্ডে। অপূর্ব দেশ। এক জায়গায় পাহাড়ের গায়ে চিজের স্তুপ, কোথাও বা ম্যাকারােনির গম্বুজ, একটা সর নদী, না জল নয়, নদী দিয়ে বইছে অতি সুস্বাদু ভারন্যচিয়া মদ। গাছে গাছে কত রকম ফল। আর চিকেন কি সস্তা, কি সস্তা। ওখানের লােকেরা কি সুখেই যে আছে সে বলার নয়। আর পাথরের কথা তাে আগেই বলেছি।
এখান থেকে কত দূর?
তা একটু দূর আছে, বিকেলে বেরােলে রাত্রি কাবার হয়ে যাবে। সকালে সেখানে পৌঁছবে তারপর সেই নদী থেকে এক পাত্র সুরা তুলে পান করলে সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে।
কিন্তু অনেক দূর, একা যাবে কি করে? আমার একটা ঘােড়া বা গাধা নেই। তুমি ওখানে গেছ? ম্যাসসা বলল, হাজারবার গেছি আর শরীর সারিয়ে নতুন শক্তি সঞ্চয় করে ফিরেছি।
ক্যালানড্রিনাে জিজ্ঞাসা করলাে, পাথরের কথা কি যেন বলছিলে? আমি যদি যাই তাে পাথরের জন্যেই যাবাে। রং করাগুলাে তাে তুলে আনবাে, যদি অন্য কোনাে জাদু পাথর পেয়ে যাই তাে বেশ হয়।
হা হা কতরকম পাথর ওখানে পাওয়া যায়। তবে আমি তাে ওখানে শুধু খেতে আর সুরা পান করতে যাই তাই পাথরের দিকে তেমন নজর দিই নি। দেখেছি নানা আকারের ও নানা রঙের পাথর ছড়িয়ে আছে। কে যেন ওখানে বলছিল যে একরকম মিশকালাে পাথর আছে। সেই পাথরটা যতক্ষণ মুঠো করে ধরে থাকবে ততক্ষণ তুমি অদৃশ্য হয়ে যাবে, কেউ তােমাকে দেখতে পাবে না। ঐ পাথরের নাম হল হেলিওট্রোপ। তা পেন্টারভাই একদিন চলেই যাও না। ভাগ্যে একটা হেলিওট্রোপ তাে জুটে যেতে পারে। তাহলে তােমার আর পয়সার অভাব থাকবে না। পাথরটা টিপে ধরে কোনাে ধনী মহাজনের গদিতে ঢুকলে। ওদের গদিতে অনেক খুচরাে মুদ্রা থাকে। তােমাকে তাে কেউ দেখতে পাচ্ছে না আর তুমি যা ছোঁবে তাও কেউ দেখতে পাবে না। তুমি যা পাবে থলে ভর্তি করে তুলে আনবে।
ম্যাসাের যা মুখে এলাে তাই বলে ধাপ্পা দিতে লাগলাে। ক্যালানড্রিনাে ম্যাসাের প্রতিটি কথা বিশ্বাস করলাে এবং তথ্যগুলি মুখস্থ করে রাখলাে। তারপর কাজের অছিলা করে উঠে পড়লাে। গির্জার বাইরে এসে সে স্থির করল মুগনােন নদীর ধারে পাথরের সন্ধানে ঐ জায়গায় যাবে কিন্তু তার আগে তার প্রাণের দুই বন্ধু ব্রুনাে এবং বুফালমাচোর সঙ্গে একবার পরামর্শ করা অবশ্যই দরকার।
সে বন্ধুদের খোঁজ করতে লাগলাে কিন্তু কোথাও তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। কোথায় গেল? কোথায় যেতে পারে? সহসা তার মনে পড়ল তার দুই বন্ধু তাে নতুন একটা কনভেন্ট বাড়ির দেওয়ালে ছবি আঁকছে। তার মাথায় ঢুকেছে পাথর, সেই চিন্তাই করছে সারাক্ষণ, বন্ধুরা যে ওখানে কাজ করছে তা তাে সে ভুলেই গিয়েছিল।
ক্যালানড্রিনাে ছুটতে ছুটতে যখন সেই কনভেন্টে পৌঁছল তখন দুই বন্ধুর ছুটি হয়েছে, ওরা হাত ধুচ্ছিল। ক্যালানড্রিনােকে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসতে দেখে জিজ্ঞাসা করলাে, কি ব্যাপার? ছুটে আসছাে কেন?
বন্ধুদের দেখে মুখে হাসি ফুটলাে। দম নিয়ে বলল, দারুণ খবর। তারপর ম্যাসাের কাছে যা শুনেছিল বন্ধুদের একে একে সব বলল। বন্ধুরা তাে মনে মনে হাসতে লাগলাে। এমন ভাব দেখাল যেন ম্যাসাে যা বলেছে সব সত্যি এবং তারা দু’জনেই ভীষণ আগ্রহী।
তারা কি করে ধনী হবে সে কথাও ক্যালানড্রিনাে বন্ধুদের বলল। শেষে বলল, চলাে তাহলে এখনি বেরিয়ে পড়া যাক।
ব্রুনাে বলল, থাম থাম অত ব্যস্ত হােয়াে না। বেশি দূরে নয় জায়গাটা, ঘন্টাখানেকের মধ্যে আমরা পৌছে যাবাে কিন্তু রােদের তাপে পাথর সব গরম হয়ে নিজের রং হারায়। কোটা নীল, কোটা লাল, বেগুনি কি কালাে তার তফাৎ বােঝা যায় না, সবই কালাে মনে হয়। আরও একটা কথা। ছুটির দিন ছাড়া কাজের দিনে ওখানে অনেক লােক যায়। আমরা সেখানে পাথর খুঁজতে আরম্ভ করলে তারাও ব্যাপারটা জানতে পারলে কি আর চুপ করে বসে থাকবে? তারাও পাথর খুঁজবে, আমার উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে। তার চেয়ে রবিবার ভাের হবার আগেই আমরা বেরিয়ে পড়ব, রােদ ওঠবার আগেই আমরা
ওখানে পৌঁছে যাবাে, তখন রং চিনে পাথর বেছে বার করতে অসুবিধে হবে না।
ক্যালানড্রিনাে খুঁত খুঁত করতে থাকলেও বন্ধুদের যুক্তি মেনে নিল। বুফালমাচোরও তাই মত। সেও তখন রাজি হলাে। তাদের সতর্ক করে দিল এই গুপ্ত খবর যেন তারা কাউকে না বলে। জিভ কেটে ওরা বলল, আরে ছি ছি, সে কি কথা? আমরা কাউকে কিছু বলবাে না। এদিকে দুই বন্ধু গ্রামের সকলকে এবং গ্রামের বাইরে শুল্ক বিভাগের যে প্রহরী থাকে, তাকেও বলে দিল রবিবার মধ্যাহ্ন পর্যন্ত ক্যালানড্রিনােকে রাস্তায় দেখতে পেলে তাকে ওরা দেখেও যেন না দেখে। এমন ভাব দেখাবে যেন গ্যালানড্রিনােইর অস্তিত্বই নেই। সে যেন অদৃশ্য।
রবিবার রাত্রি থাকতে থাকতেই ক্যালানড্রিনে উঠে পড়ল। চামড়ার একটা থলে নিল সঙ্গে, আর নিল প্রাতরাশের জন্যে কিছু খাবার। তারপর গিয়ে বন্ধুদের তুলল। বন্ধুরা তৈরি হয়ে নিতেই ওরা মুগনােন নদীর দিকে যাত্রা করলাে তখন পুব আকাশে সবে আলাে দেখা দিয়েছে। ক্যালানড্রিনাের উৎসাহ সবচেয়ে বেশি তাই সে সবার আগে চলেছে।
নদীর ধারে পৌছে দেখল নদীর ধারে সত্যিই নানা রঙের পাথর পড়ে রয়েছে তবে ম্যাসে কিছু বাড়িয়ে বলেছিল। ক্যালানড্রিনাে ছােট, গােল ও কালাে পাথর দেখলেই থলেতে ভর্তি করছে। ফলে যখন ভর্তি হয়ে গেল তখন জামার ভেতর পাথর ভরতে লাগল যতক্ষণ পর্যন্ত না ঢােকাবার আর জায়গা খালি রইল। কিন্তু বিশেস সেই জাদু পাথরটি পাওয়া গেল কিনা তা তাে বােঝা যাচ্ছে না।
ক্রনাে আর বুফালমাচো পাথর কুড়ােচ্ছে কিন্তু তারা থলেতে না ভরে একজায়গা জড়াে করে রাখছে। ক্যালানড্রিনাে বুঝলাে ওরা এখনও জাদু পাথর পায়নি, পেলে নিশ্চয় অদৃশ্য হয়ে যেতাে সেও এখনও পায় নি। পেলে তাে অদৃশ্য হতাে এবং বন্ধুরা সে কথা বলতাে।
কিছুক্ষণ পরে ক্রনাে আর বুফালমাচো ফিসফিস করে পরামর্শ করলাে, এবার মজা আরম্ভ করা যাক। | ক্যালানড্রিনাে তখন দুই বন্ধুর কাছ থেকে মাত্র কয়েক গজ দুরে চামড়ার থলের মুখ বাঁধছিল। ব্রুনাে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, আরে ক্যালানড্রিনাে কোথায় গেল? আমাদের না বলে চলে গেল নাকি? | ক্যালানড্রিনাের যে কী আনন্দ হল তা বলার নয়। সে ভাবল পাথর তাহলে পেয়ে গেছে আর পাথরটা সম্ভবত থলের মধ্যে নেই, আছে তার জামার ভেতরে। তবুও সে থলের পাথরগুলাে ফেলবে না, সেগুলাে বাড়ি নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখবে। জাদুপাথর যখন পেয়েই গেছে তখন আর এখানে অপেক্ষা করে লাভ কি? জাদু পাথর পেয়েছি ভেবে, সে যত না উল্লসিত হল তার চেয়ে সে নিজেকে শক্তিশালী মনে করল বন্ধুদের প্রতি সে তার কর্তব্য ভুলে গেল, সে বন্ধুদের ফেলে পাথর ভর্তি চামড়ার ভারি থলেটা পিঠ তুলে নিয়ে নিঃশব্দে বাড়ির পথে পা বাড়াল।
দুই বন্ধু তখনও ক্যালানড্রিনাের নাম ধরে ডাকছে, তাকে খুঁজছে আর মুচকি হাসছে। ক্যালানড্রিনাে যখন বেশ খানিকটা দূরে চলে গেছে তখন দুই বন্ধু বলল, আমরাই বা আর মিথ্যা কেন থাকি। আমরাও বাড়ি যাই। ওরাও বাড়ির পথ ধরলাে।
ওরা দেখতে পাচ্ছে ক্যালানড্রিনাে আগে চলেছে। ও যাতে শুনতে পায় এমন জোরে ক্রনাে বলল, বুফালমাচো দেখেছিস ক্যালানড্রিনাে কেমন বিশ্বাসঘাতক? জাদু পাথর পেয়েছিস তাে আমাদের বললি
কেন? আমরা কেড়ে নিতুম ? তারপর দেখ ওর সঙ্গে খাবার ছিল, আমাদের দিয়ে গেল না, ক্ষিধেয় পেট চুইছুই করছে। বুফালমাচোর পকেটে বাড়িতে তৈরি বিস্কুট আর চিজ ছিল, দুম্বজনে তাই ভাগাভাগি
যেতে যেতে ব্রুনাে রাস্তা থেকে নুড়ি পাথর ছুঁড়তে লাগলাে তার লক্ষ্য কিন্তু ক্যালাড্রিনাে তবুও এমনভাবে ছুঁড়ছে যেন ওর গায়ে না লেগে পাশ দিয়ে চলে যায় তবুও দুটো পাথর ক্যালানড্রিনােকে আঘাত করলাে, একটা বাঁ পায়ের গােড়ালিতে আর একটা মাথায় গােড়ালিটা একটু কেটে গেল আর মাথায় বেশ বড় একটা সুপুরি হয়ে গেল। ভীষণ লেগেছিল কিন্তু সে মুখ বুজে যন্ত্রণা সহ্য করলাে। বন্ধুদের সে গাল দিতে দিতে চললাে।
ক বিভাগের কড়া প্রহরীও যখন তাকে থামতে বলল না তখন সে বুঝল সে সত্যিই অদৃশ্য নচেৎ ঐ প্রহরী তার থলে না দেখে তাকে কিছুতেই ছাড়তাে না। বন্ধুদের গাল দিতে ভুলে গেল কিন্তু জানতাে না যে বন্ধুরা ঐ প্রহরীকে আগে টিপে দিয়েছিল। তারপর সে গ্রামে ঢুকলাে। তখন রাস্তায় বেশি লােক ছিল। সকলে বাড়িতে বা ক্ষেতে নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত তবুও যে কয়েকজন ছিল তারা কেউ যেন তাকে দেখতেই পেল না। ক্যালানড্রিনাের আত্মবিশ্বাস আরও প্রবল হল, এবার তাকে পায় কে? তাকে গ্রামের লােক কি করে দেখতে পাবে? সে তাে অদৃশ্য।
ভাবতে ভাবতে বাড়ি ঢুকলাে। বৌ মেননা টেসাকে অবাক করে দেবে, সে কথা বলবে অথচ বৌ তাকে দেখতে পাবে না। বৌ তখন ছিল ওপরে। ক্যালানড্রিনাে বাড়ি ঢুকে পাথর বােঝাই চামড়ার থলেটা একটা ঘরের মেঝেতে ঝপ করে ফেলে শার্টের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে পাথরগুলাে বার করে একে একে ঠকঠক করে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলতে লাগল।
মােনা টেসা আওয়াজ পেয়ে ওপর থেকে নিচে নেমে এসে ওকে দেখতে পেয়েই যেন জ্বলে উঠল, বাবুর এতক্ষণে জলখাবার খেতে আসবার সময় হলাে, বলি রাত থাকতে উঠে কোন কামিনীর বাড়ি গিয়েছিলে?
ক্যালানড্রিনাের গায়ে কে যেন ঝপ করে এক বালতি বরফ শীতল জল ঢেলে দিল। একি আশ্চর্য কাণ্ড, সে এতটা পথ অদৃশ্য হয়ে হেঁটে এলাে, কেউ তাকে দেখতে পেল না আর তার বৌ তাকে দেখতে পেল? একেই তা ভারি বােঝা বইতে বইতে অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছে, স্ত্রীর এই সম্ভাষণ এবং আকস্মিকভাবে আশাভঙ্গ। কেন এমন হল? ওর বৌ নিশ্চই এখন অশুচি, তাই জাদু পাথরের জাদু ওকে দেখামাত্র কেটে গেছে। তখন তার রাগ গিয়ে পড়ল তার বৌয়ের ওপর।
বৌকে একবারও জিজ্ঞাসা করলাে না সে অশুচি কিনা। রাগে উন্মত্ত হয়ে ছুটে গিয়ে বৌয়ের চল ধরে মাটিতে পেড়ে ফেলল, সর্বনাশী তুই আমাকে দেখলি কেন? আমার এত পরিশ্রম বিফল হল, আমার আশা চূর্ণবিচূর্ণ হল’ বলতে বলতে মােনাকে বেদম প্রহার করতে লাগল। বেচারী যন্ত্রণায় কাতর হয়ে বলতে লাগল ‘ওগাে আমাকে ছেড়ে দাও। পায়ে পড়ি, মাপ করাে, মারছ কেন? আমি কি করলুম? কিন্তু তার কোনাে কথাতেই কান না দিয়ে ক্যালানড্রিনাে মােনাকে মেরেই চললাে। কিল চড়চাপড় লাথি সমানে চলছে। তার সমস্ত রাগ এখন পড়েছে মােনার ওপর।
এদিকে তার দুই বন্ধুও এসে পড়েছে। মোেনার কান্না ও চিৎকার শুনতে পেয়ে বাড়িতে ঢুকে ক্যালানড্রিনাের অগ্নিমূর্তি দেখেই বুঝল আশাভঙ্গ হওয়ায় সে ক্ষেপে গিয়ে আর কিছু করতে না পেরে বৌয়ের ওপর বীরত্ব ফলাচ্ছে। ওদের দেখে ক্যালানড্রিনাে মার থামিয়ে একটা টুলে বসে হাঁপাতে লাগলাে। মােনার চুল ছড়িয়ে পড়েছে। পােশাক ছিড়ে গেছে, চড়ের আঘাতে দুই গাল লাল টকটক করছে, ঠোট ফুলে গেছে ও কেটে গিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। বেচারী ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।
তারা বললাে, ব্যাপার কি ক্যালানড্রিনাে? মােনা টেসাকে মারছিলে নাকি? আর এত পাথরই বা কি হবে? দেওয়াল গাথবে নাকি?
ক্যালানড্রিনাে ক্লান্তি অপেক্ষা হতাশায় একেবারে ভেঙে পড়েছে, কোনাে উত্তরই দিতে পারল না। বফালমাচো একটু অপেক্ষা করে বলল, তুমি কিন্তু মােটেই লােক ভালাে নও ক্যালানড্রিননা, তােমার প্রতি আমাদের বিশ্বাস ভেঙে গেছে। আমাদের নিয়ে তুমি গেলে জাদু পাথর সংগ্রহ করতে। জানি না তুমি সে পাথর পেয়েছ কিনা কিন্তু আমাদের না জানিয়ে চলে এলে। তােমার সঙ্গে খাবার ছিল, ভালাে করেই জানাে আমরা কিছু না খেয়েই তােমাকে সঙ্গদানের জন্যে ভােরবেলায় বেরিয়েছিলুম। এখনও পর্যন্ত আমাদের পেটে কিছু পড়ে নি। আমরা ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর তারপর এখানে এসে দেখছি মেয়েমানুষের ওপর বীরত্ব ফলাচ্ছ। ছিঃ।
ক্যালানড্রিনাে বলল, রাগ কোরাে না। জাদু পাথর আমি পেয়েছিলুম কারণ তােমাদের কাছেই আমি দাঁড়িয়েছিলুম তােমরা আমাকে দেখতে পাচ্ছিলে না। তােমাদের সঙ্গে একটু মজা করবার জন্যে আগে চলে এসেছি তবে অভীষ্ট জাদু পাথরটি হাতে পেয়ে আমারও মাথার ঠিক ছিল না। এরপর যা ঘটেছে, যা শুনেছে, সব ক্যালানড্রিনাে বলল। এমনকি গােড়ালিতে কাটা দাগ ও মাথার ফোলা দেখাল। তারপর বলল, কিন্তু বাড়ি ফেরার পর এই শয়তানীটা যেই আমাকে দেখল অমনি জাদু পাথরের গুণ কেটে গেল। সর্বনাশীটা নিশ্চই অশুচি হয়েছেনইলে এমন হবে কেন? আজ আমি সবচেয়ে ভাগ্যবান ও ধনী মানুষ হতে পারতাম, কিন্তু ওর জন্যে আমি স্বর্গ থেকে নরকে পড়লুম। আমার ইচ্ছে হচ্ছে ওর গলা কেটে দিই, বলে উঠে মােনাকে আবার মারতে গেল। মােনা ভয় পেয়ে কেঁদে উঠে বলল, আমি অশুচি হইনি।
দুই বন্ধু তাদের তৃতীয় বন্ধুকে ধরে বসিয়ে বলল, বন্ধু তাহলে শােনাে! তােমার এই অবস্থার জন্য মােনা টেসা মােটেই দায়ী নয়। ভগবানই তােমাকে বিফল করেছেন। তিনি তােমার প্রতি বিরূপ হয়েছেন। তুমি তােমার দুই বন্ধুকে ঠকাবার মলবে ছিলে। তুমি আমাদের অভুক্ত রেখে আমাদের কিছু না বলে চলে এলে তাই ভগবান তােমাকে উচিত শিক্ষা দিয়েছেন।
ম্যাসাে যে মজা করবার জন্যে তাকে ধাপ্পা দিয়েছিল এবং ওরাও ষড়যন্ত্র করেছিল একথা ব্রুনাে ও বুফালমাচো তাকে বলল না। তারপর স্বামী ও স্ত্রী দু’জনকে শান্ত করে ওরা ফিরে গেল।
চতুর্থ গল্প
ফিজোল গ্রামের গির্জার রেকটর এক বিধবার প্রেমে পড়লাে কিন্তু বিধবা কোনাে সাড়া দিল না। একদিন রাত্রে সেই বিধবা মনে করে বিধবার পরিচারিকার সঙ্গে যখন শয়ন করে আছে তখন বিধবার ভায়েরা গির্জার বিশপকে ডেকে এনে রেকটরকে ধরিয়ে দিল।
এলিসার গল্প বলার ধরনের সকলে প্রশংসা করলাে, গল্পটাও বেশ মজার, এলিসাও খুশি। কুইন এবার বলল এলিসার পর এমিলিয়া, তুমিই গল্পটা বলল।
এমিলিয়া একটা গল্প ভেবে রেখেছিল। ঠিক করে রেখেছিল তার পালা পড়লে এই গল্পটাই বলবে। সে বলল, এতগুলাে গল্প তােমার শুনলে। সেগুলাে থেকে তােমাদের নিশ্চই ধারণা জন্মেছে যে, আমাদের গির্জার বিভিন্ন স্তরের যাজকদের নৈতিক চরিত্রের মান কত নিচে নেমে গেছে। তাদের একমাত্র কাজ যেভাবে হােক যুবতীদের ধর্ম নষ্ট করা, তাদের উপভােগ করা যেন তাদের একমাত্র কাম্য। আমি একজন রেকটরের কাহিনী বলছি, সেএক সুন্দরী বিধবাকে ভােগ করার জন্যে কি-না করেছিল, তবুও সে বিধবাকে কাবু করতে পারে নি।
ফিজোল গ্রামটা একটা পাহাড়ের মাথায়। আমরা এখন যেখানে রয়েছি সেখান থেকে দেখা যায়। এই গ্রাম খুব প্রাচীন, তখন এটি শহর ছিল। গ্রামটি এখন ধ্বংসের মুখে। অধিবাসীরা অনেকেই গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে গেছে, তবুও কিছু লােক আছে।
গ্রামে এখনও একটি বড় গির্জা আছে। গির্জার একজন বিশপ বরাবরই আছেন তবে সংস্কারের অভাবে গির্জাটি এখন জীর্ণদশা।
কয়েক বছর আগে ঐ গ্রামে মােনা পিকার্ডা নামে সম্ভ্রান্ত বংশের এবং দৃঢ়চেতা এক সুন্দরী ও বিধবা বতী বাস করতাে। ঐ গ্রামে তার কিছু ভূসম্পত্তি ছিল। অবস্থা মােটামুটি স্বচ্ছল ছিল। তার সঙ্গে তার ই ভাইও থাকতাে। ছেলে দুটির সৎ আচরণ ও ব্যবহারের জন্যে গ্রামের সকলে তাদের পছন্দ করতাে।
মহিলার বাড়ির কাছে বড় গির্জাটি ছাড়া আর একটি ছােট গির্জা ছিল। প্রার্থনা করবার জন্য মহিলা ঐ গির্জায় নিয়মিত যেত। গির্জার রেকটর মহিলার রূপ ও যৌবন দেখে তাকে পাবার জন্যে ব্যাকুল হল। রেকটর তার কর্তব্য ভুলে গেল, মহিলাই তার ধ্যান। মনে মনে তার গর্বও ছিল যে, সে যে কোন যুবতীকে বশ করতে পারে। তার কথা বলার ধরন ও আচরণ মােটেই ভালাে ছিল না, রূঢ়ভাষী ছিল এবং মানুষকে ভয় দেখিয়ে কাজ আদায় করতাে। এজন্য গ্রামবাসীরা তাকে পছন্দ করতাে না। যদিও তার চরিত্র সম্বন্ধে সকলে সন্দিহান ছিল কিন্তু হাতেনাতে কেউ তাকে ধরতে পারে নি। সে ভীষণ ধূর্ত ছিল। যথেষ্ট বয়স হলেও নিজেকে সংযত করতে পারে নি। শিশু যেমন খেলনার জন্যে বায়না করে, রেকটরও তেমনি কোনাে যুবতীকে পাবার জন্যে বায়না ধরতাে।
সুন্দরী মােনা পিকার্ডো রেকটরের দূরভিসন্ধি বুঝতে পেরে তাকে অপছন্দ তাে করতােই, ঘৃণাও করত। মােন তাকে এড়িয়ে চলতাে তবুও সে সুযােগ পেলেই প্রেম নিবেদন করতাে। মােনা একদিন তাকে বললাে, আপনি যে আমাকে ভালবাসেন তা জেনে আমার ভালাে লাগছে তবে আশা করবাে যে আপনার সে ভালবাসা মালিন্যবিহীন, নিস্পাপ এবং ক্লেদমুক্ত। আপনি যাজকীয় এবং আত্মিক পিতা, আপনি এই গির্জার রেকটর, আপনার বয়সও অনেক হয়েছে এবং আশা করবাে আপনি আপনার এলাকার সকল নরনারীকে পুত্র ও কন্যাবৎ স্নেহ করবেন, আপনার চরিত্রে কেউ যেন সন্দেহ না করে, হৃদয়কে নির্মল রাখবেন। আমিও আর কিশােরী নই, পরিণত যুবতী এবং বিধবা। আমি কিশােরীর মতাে চঞ্চলা নই, অনেক সংযত। এবং বিধবা বলেই আমাকে অনেক কঠোর হতে হয়েছে। অতএব আপনি আমাকে যেভাবে ভালবাসতে চান এবং এক পূতিগন্ধময় পথে নিয়ে যেতে চান আমি তাতে মাের্টেই রাজি নই।
মােনার কথা শুনে রেকটর মনে মনে বলল, সব মেয়েই প্রথম দিকে অমন কথা বলে অতএব সে নিরুৎসাহ হল না। তার প্রেম নিবেদনে সামান্যতম কোমলতা ছিল না, যে কোন নারীকে ভােগ করার তার যেন অধিকার আছে।
মােনা তাকে যতদূর সম্ভব এড়িয়ে চলতাে, তবুও রেকটর তাকে দেখতে পেলেই তার পথ অবরােধ করে দাঁড়াতাে। মােনা কোনাে উত্তর না দিয়ে চলে গেলে চিঠি পাঠাতাে, কোনাে দূতী মারফত বার্তা ও প্রস্তাব পাঠাতাে। এক কথায় মােনাকে সে বিরক্ত করে মারতে লাগলাে এবং মােনাও যত বেশি বিরক্ত হয় লােকটার ওপর তার রাগ ও ঘৃণা তত বেশি বেড়ে যায়। রেকটরের ব্যবহার ক্রমে অসহ্য হয়ে উঠল।
মােনা পিকার্ড এবার স্থির করলাে রেকটর বাছাধনকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে। মনস্থির করে মােনা সেদিন গির্জায় গেল। সে সংকল্প করেছে রেকটর বাবাজীকে নাজেহাল করে ছাড়বে।
গির্জায় মােনাকে দেখতে পেয়েই কাজ ছেড়ে রেকটর তার সামনে এসে এক গাল হেসে দাঁড়াল, বলল, আমাকে আর কত দিন ঘােরাবে? অনেক মেয়েই তাে দেখলুম কেউ আমাকে এত বেগ দেয় নি। মােনা আজ হাসলাে। হাসি দেখে রেকটর উৎসাহিত হল। মােনা বলল, আমি শুনেছি যে কোনাে দুর্গ অবরােধ করে ক্রমাগত আঘাত হানতে থাকলে দুর্ভেদ্য দুর্গও আত্মসমর্পণ করে। আমিও তােমার নিষ্ঠা ও মিষ্টি কথায় মুগ্ধ হয়েছি এবং আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না। বুঝতে পারছি তুমি আমাকে খুবই পছন্দ করাে, আমি এখন তােমার।
হা ভবগান এ কি শুনছি, তিনি মঙ্গলময়। সত্যিই আমি অবাক হচ্ছিলুম তুমি এতদিন আমাকে কি করে প্রতিহত করলে ? যাই হােক শেষ পর্যন্ত যখন তােমার সুমতি হয়েছে তখন আর দেরি কেন? বলাে কোথায় কখন আমরা মিলিত হবে ?
মােনা বলল, আমার তাে স্বামী নেই তাই আমার অনেক সুবিধে, কাউকে কৈফিয়ত দিতে হবে না। তবে কোথায় আমরা মিলিত হবে তা এখনি বলতে পারছি না।
রেকটর অধৈর্য হয়ে বলল, কেন ? তােমার বাড়িতে।
মােনা বললাে, একটা অসুবিধে আছে। জান তাে আমার ছােট দুই ভাই আমার সঙ্গে থাকে। তারা এমনি বেশ ভালাে তবে দিন রাত ওদের অনেক বন্ধু আসে, হৈ হট্টগােল করে, থাকেও অনেক রাত পর্যন্ত। আমার বাড়িতে মিলিত হতে হলে অন্ধকার ঘরে কথাটি না বলে বােবা ও অন্ধর মতাে আমাদের থাকতে হবে কারণ আমার শােবার ঘরের পাশেই ওদের ঘর। অবশ্য তারা আমার ঘরে ঢােকে না তবু বলা যায় না তাে।
এটা যেন কোনাে সমস্যাই নয়, এইভাবে মােনার কথা উড়িয়ে দিয়ে রেকটর বলল, বেশ তাে দুএকটা রাত না হয় মরা অন্ধ ও বােবা হয়েই মিলিত হবাে তারপর আমি একটা নিরাপদ আস্তানা খুঁজে নেবাে।
বেশ তাই হবে। কিন্তু খবরদার আমার কথা তুমি কাউকে কিছুতেই বলবে না, কঠোরভাবে গােপন রাখবে। এ সে বিষয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাক প্রিয়তমা। কেউ কিছু শুনবে না, জানবেও না। তাহলে বলাে আজ রাতেই কি দেখা হবে?
বেশ তাই হবে। বলে মােনা তাকে বলে দিল ক’টার সময় তার বাড়ির কোন্ দরজা দিয়ে কিভাবে অন্ধকারে সে তার শয়নঘরে প্রবেশ করবে। মােনা আগেই বিছানায় শুয়ে তার জন্যে অপেক্ষা করবে। এ মােনা পিকার্ডার একজন পরিচারিকা ছিল। খুবই অনুগত ও বিশ্বাসী কিন্তু যৌবনে তার ভাটা পড়েছে, দেখতেও ভালাে নয়। চ্যাপ্টা নাক, পুরু, ঠোট, উঁচু দাঁত তবে গায়ে কিছু মাংস আহে। এককথায় মােটেই সুদর্শনা নয়। তার নামটাও অদ্ভুত, চিউটা। লােকে তাকে ভেংচি কেটে বলতে চিউটাজা।
গির্জা থেকে বাড়ি ফিরে টিউটাকে ডেকে এনে মােনা বলল, চিউটা আজ রাত্রে তুই যদি আমার জন্যে একটা কাজ করিস্ তাে তােকে আমি একটা লেসের শেমিজ দেব।
লেসের শেমিজ শুনেই তার চোখ চকচক করে উঠলাে। সে বলল, লেসের শেমিজ দিলে আমি তােমার জন্যে আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে যাবাে।
উত্তম কথা। এবার তাহলে শােন তােকে কি করতে হবে। আজ রাত্রে তােকে একটা পুরুষের সঙ্গে আমার বিছানায় শুতে হবে কিন্তু খবরদার একটিও কথা বলতে পারবে না। বলেছ কি মরেছ, পাশের ঘরেই আমার ভায়েরা থাকে। তারা তােমার গলা চেনে। তােমার গলার আওয়াজ পেলে আমার ঘরে ঢুকে আমার বিছানায় অন্য পুরুষের সঙ্গে তােমায় শুয়ে থাকতে দেখলে তােমাকে মেরে হাড়গােড় ভেঙ্গে দেবে, অতএব সাবধান। তাহলে কাল সকালেই আমি তােকে শেমিজটা দেবাে।
এক গাল হেসে চিউটা বলল, এ আর শক্ত কি, দরকার হলে তােমার জন্যে আমি দু’জন মানুষের সঙ্গে শুতে পারি।
মােনা তার ভায়েদের আগে বলে রেখেছিল যে, পাজী রেকটরকে আজ রাতে সে ফাঁদে ফেলবে। ওরা দুই ভাই যেন নিজেদের ঘরে যত ইচ্ছে জোরে কথা বলতে পারে, গান গাইতে পারে, হট্টগােল করতে পারে। চিউটা যদিও বা ভুলে দু’একটা কথা বলে ফেলে তাহলে গােলমালে রেকটর তা ধরতে পারবে না। চিউটাকে তাে আগেই বলে রেখেছিল তাকে কি করতে হবে। চিউটা চালাক মেয়ে, সে তার দিদিমণির মতলব বুঝতে পেরেছিল।
ওদিকে রেকটরের আর তর সইছে না। রাত্রি বেশি এগিয়ে যেতে না যেতেই অন্ধকারে দরজা হাতড়ে নিঃশব্দে সে মােনার শয়ন ঘরে ঢুকে খাটে শুয়ে হাত নেড়ে দেখলাে ‘লেডি’ কথা রেখেছে। সে তখনি চিউটাকে মােনা ভেবে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করতে লাগল। চিউটাও নীরবে প্রত্যুত্তর দিয়ে চলল।
মােনা ও টের পেয়েছে যে ইদুর কলে পড়েছে। মােন তার দুই ভাইকে বলল, এইবার গিয়ে বিশপকে ডেকে নিয়ে আয়।
দুই ভাই তখনি বেরিয়ে পড়লাে। ওদিকে প্রায় জানালাহীন বাসায় বিশপের গরম লাগছিল, তাই ভাবল মােনর বাড়ি যাওয়া যাক, ও বেশ ঠাণ্ডা সরবত তৈরি করে। সরবত পান করতে করতে ওর দুই ভাইয়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে বাসায় ফেরা যাবে। এই ভেবে বিশপ রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিল। পথে দুই ভায়ের সঙ্গে বিশপের দেখা হয়ে গেল।
তারা বিশপকে ডাকতে যাচ্ছিল শুনে তিনি খুব আনন্দিত হলেন। নিজের ইচ্ছার কথা বললেন। ভালােই হল। ওরা বিশপকে বাড়িতে এনে বারান্দায় বসিয়ে কয়েকটা আলাে জ্বেলে শীতল সুরা পরিবেশন করলাে। ভায়েরাও যােগ দিল।
খানিকটা সময় বেশ আনন্দে কাটলাে। পানীয় শেষ হলে ভায়েরা বলল, আপনি যখন দয়া করে আমাদের বাড়িতে এসেছেন তখন আপনাকে আমরা একটা ব্যাপার দেখাতে খুবই আগ্রহী। যদি অনুগ্রহ করে আমাদের সঙ্গে একবার এদিকে একটা ঘরে আসেন। ইতিমধ্যে দুই ভায়ের কয়েকজন বন্ধুও এসেছিল। ওরা আলাে দেখিয়ে বিশপকে দিদির শয়নঘরের দিকে নিয়ে চললাে।
ঘরের দরজা খুলে ওরা ঘরে ঢুকলাে। আলােয় দেখল রেকটর তার হাত ও পা দিয়ে চিউটাকে বেশ করে জড়িয়ে ধরে অশালীন অবস্থায় শুয়ে রয়েছে। রেকটর এতগুলি মানুষের সামনে ধরা পড়ে গিয়ে লজ্জায় মুখ লুকোবার বৃথা চেষ্টা করতে লাগলাে কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে। লুকোবার কিছু বাকি নেই।
বিশপ তাে তার রেকটরকে কঠোর ভাষায় ভৎসনা করে তাকে সঙ্গে করে গির্জায় নিয়ে গেলেন। যাতে না পালিয়ে যায় এজন্যে সমবেত সকলে তাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে গেল। যে পাপ সে করেছে, গির্জার আইনানুসারে তাকে এখন কঠোর দণ্ড ভােগ করতে হবে।
সব শুনে বিশপ মােনার শুদ্ধ মন ও চরিত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। লজ্জা ও অপমানে ক্ষুব্ধ রেকটরকে উনপঞ্চাশ দিন কঠোর দণ্ড ভােগ করতে হয়েছিল। দণ্ড যখন শেষ হল তখন তার দেহে শক্তি নেই, মনও ভেঙে গেছে। ভালাে করে চলতেও পারে না।
চলতে পারলেও যাবে কোথায়? রাস্তায় ছেলেরা তাকে দেখতে পেলেই সমস্বরে বলতাে, দ্যাখ দ্যাখ এই লােকটা চিউটাজাকে নিয়ে…। কথা শেষ করতাে না, বিশ্রীভাবে ইঙ্গিত করতে। রেকটরের রাস্তায়, বেরােন বন্ধ হয়ে গেল। সে পাগল হবার উপক্রম।
মােনা পিকার্ড এইভাবে রেকটরকে জব্দ করেছিল। চিউটা অবশ্যই শেমিজ ও আরও কিছু উপহার পেয়েছিল।
পঞ্চম গল্প
ফ্লোরেন্সের বিচারালয়ে মার্চ থেকে আগত একজন বিচারক যখন তার আসনে বসে ছিলেন তখন তিনজন যুবক তার পাৎলুন খুলে নিল।
এমিলিয়ার কাহিনী শুনে সকলে সেই সুন্দরী বিধবার দৃঢ় চরিত্রের প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠলাে কিন্তু কুইন তাদের আলােচনায় বাধা দিয়ে ফিলােস্ট্রাটোকে গল্প বলতে বলল।
ফিলােস্ট্রাটো বলল, এলিসা তার গল্পে একজন ম্যাসসা ডেল স্যাজ্জিওর নাম করেছিল। ম্যালাে বন্ধুর ছেলে, ক্যালানড্রিনােকে কি রকম ধাপ্পা দিয়েছিল তা তাে তােমরা শুনেছ। এবার শােননা, আদালতে সে একজন বিচারকের পাৎলুন খুলে নিয়ে তাকে কি রকম বেইজ্জত করেছিল। তবে ময়েরা তােমরা আমাকে ক্ষমা কোরাে কারণ এই গল্পটা বলতে বলতে আমার মুখ থেকে দু’একটা খারাপ কথা বেরিয়ে যেতে পারে।
একটি মেয়ে বলল, ঢের হয়েছে আর ন্যাকামাে করতে হবে না। তােমরা নিজেদের মধ্যে যে ভাষায় কথা বলাে তা আমাদের শােনা আছে তবে সীমা ছাড়িয়ে যেয়াে না। এবার গল্পটা চটপট। আরম্ভ করাে। ফিলােস্ট্রাটো গল্প আরম্ভ করলাে।
তােমরা তাে জান আমাদের শহরের অধিকাংশ বিচারক আসে মার্চ পরগনা থেকে কিন্তু তাদের চেহারা আর পােশাক দেখেছাে? যেন ভবঘুরে, ভিখিরি। যেন খেতে পায় না, জীর্ণ, শীর্ণ, গাল তােবড়ানাে চেহারা। পােশাকও ছেড়া, সেলাই করা। নতুন পােশাক কি কিনতে পারে না? পয়সা নেই? তা নয়, প্রত্যেকে কৃপণের জাসু। এদিকে লােভী। মনে হয় ক্ষেতে চাষ করছিল বা মােট বইছিল এমন সব মানুষদের ধরে এনে আদালতের চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মার্চ থেকে আগত এইরকম একজন বিচারকের বেইজ্জতের গল্প বলবাে। তাকে দেখে মনে হবে যেন স্যাকরা, তামার হাঁড়ি মেরামত করে। তার নাম নিকোলাে ডা স্যান লেপিডিয়াে। আদালতে ফৌজদারি মামলার বিচার করে।
তােমরা বােধহয় দেখেছে যে, আদালতে এমন অনেক লােক যায় যাদের কোনাে কাজ নেই। এরা আশা করে কিছু মজা দেখতে পাবে এইজন্যেই যায়। অযথা ভিড় করে, হাসাহাসি করে, বিচারককে প্রশ্নও করে, গােলমালও করে।
ম্যাসাে ডেল স্যাজ্জিও একদিন বিচারক নিকোলার আদালতে গেছে তার এক বন্ধুর খোঁজে কিন্তু বিচারককে দেখে বন্ধুর কথা ভুলে গেল। চেহারা দেখে মনে মনে বলল একি বিচারক নাকি? মনে তাে হচ্ছে লােকটা বুদ্ধিহীন। পথচলতি কোনাে ভবঘুরে আদালতে ঢুকে চেয়ার বালি দেখে বসে পড়ে নি তাে? একজনকে প্রশ্ন করে জানতে পারল তা নয়। ইনি বিচারক নিকোলােডা স্যান কেপিডিয়াে।
ম্যাসাে বিচারককে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাে। বিচারককে দেখে কোথায় মনে শ্রদ্ধা জাগবে তা নয় উলটে তার মনে এল ঘৃণা। মাথার টুপিটা তাে ভীষণ ময়লা, বেশ দেখা যাচ্ছে তেল আর ধুলাে জমেছে, গায়ের কোট ঢিলে। দু’তিন জায়গায় তাপ্পি মারা, বােধহয় ওর নিজের কোট নয়। তার ওপর বিচারকের একটা গাউন কাধে ফেলা আছে, সামনেটা খােলা।
বিচারকের পালুনের অবস্থা দেখে সে হেসে ফেললাে। পালুনটা পায়ের দিকে ঢিলে কিন্তু কোমর থেকে উরু পর্যন্ত সেঁটে বসেছে। তা বসুক কিন্তু একি? সামনে একটাও বােম নেই। তাও না হয় হল কিন্তু অনেকটাই বেশ ছেড়া। লজ্জা নিবারণের স্থানটাই উন্মুক্ত, সবই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ঊরুর ভেতর দিকেও দু’দিকেই অনেকটা ছেড়া। বিচারক মশাই কি ওটা পরবার সময় দেখেন নি? নাকি আদালতে এসে বসবার সময় ফেটে গেছে? কে জানে? তবে এঁকে নিয়ে একটা মজা করা যাক।
ম্যাসাে আদালত থেকে বেরিয়ে তারই মতাে ধুরন্ধর দুই স্যাঙাতকে ধরে আনলাে। একজনের নাম বিবি আর অপরজনের নাম ম্যাতিউজো। তাদের বললাে, এই আদালতে চল, শুধু মজা দেখবি না মজা করতেও হবে। এমন জিনিস তােরা দেখিস নি।
দু’জনেই হৈ হৈ করে উঠল, চল চল দেখি।
দুই বন্ধুকে নিয়ে ম্যাসাে আদালতে এসে বিচারকের বেহাল অবস্থা দেখালাে। তারা তাে হেসেই অস্থির। বিচারক মশায়ের বসবার জন্যে একটা উঁচু প্ল্যাটফরম তৈরি করা হয়েছে, কাঠের তক্তা পাশাপাশি সাজিয়ে। প্ল্যাটফরমের নিচে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা আছে, সেখানে একটা মানুষ। দিব্যি ঢুকে যেতে পারে। বিচারক যেখানে পা রেখেছেন তার সামনে খানিকটা ফাক আছে। মাপমতাে কাঠ পাওয়া যায়নি বলে হয়ত ফাকটা রয়ে গেছে। রয়ে গেছে তাে রয়েই গেছে। বিচারকের যদি এরকম চেহারা ও সাজপােশাক হয় তাহলে তার বসার ব্যবস্থা যে অনুরূপ হবে সে কথা বলাই বাহুল্য।
ম্যাসাের মাথায় দুষ্টবুদ্ধি গজালাে, সে বলল, আমরা তাে ইচ্ছে করলে বিচারকমশাইয়ের পালুনটা অনায়াসে খুলে নিতে পারি। ওই পাৎলুন পরে থাকাও যা না পরে থাকাও তাই।
কি করে পাৎলুনটা খুলে নেবে সে বিষয়ে পরামর্শ করে সেদিন ফিরে গেল। পরদিন আদালত বসার সঙ্গে সঙ্গে তিন মূর্তিমানও এসে হাজির। ওদের মধ্যে ম্যাতিউজো মাথায় খাটো আর রােগা ছিল। আদালতে বেশ ভিড়। সকলে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। ওরই এক ফাঁকে সকলের চোখ এড়িয়ে সে বিচারকের প্ল্যাটফরমের নিচে নেমে গুঁড়ি মেরে বসে উপযুক্ত সময়ের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।
ওদিকে ম্যাসাে আর রিবি বিচারকের দু’পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে দুজনেই তার গাউন ও ঢিলে কোট একসঙ্গে ধরে দাঁড়াল। রিবির দিকে আঙুল দেখিয়ে ম্যাসাে বলল, হুজুর এই চোরটা আমার বুট চুরি করেছে। ওকে ছাড়বেন না, সাজা দিন।
সঙ্গে সঙ্গে রিবি চেঁচিয়ে উঠল, আমি চোর? হুজুর ওর কথা মােটেই বিশ্বাস করবেন না। ও ব্যাটা আমার চামড়ার ব্যাগ চুরি করে সাধু সাজছে।
ম্যালাে বলল, না হুজুর, আমি কাল নিজে চোখে দেখেছি ও বুটজোড়াটা মুচিকে দিয়ে মেরামত করাচ্ছে। আমার তিন তিনজন সাক্ষী আছে। এজন্যে কি আপনাকে লিখে আর্জি পেশ করতে হবে? এ তাে সামান্য ব্যাপার। ওকে ফাটকে পুরে দিন।।
রিবি বলল, না হুজুর, ঐ বুটজোড়া আমাদের বাড়িতে অনেক বছর ধরে আছে, আমার চামড়ার ব্যাগ চুরির অপরাধে আপনি ওকেই ফাটকে পুরুন।
দু’জনে মিলে বিচারককে টানাটানি করে অন্যমনস্ক করে দিচ্ছে আর সেই ফাকে ম্যাতিউজো ফাক দিয়ে হাত তুলে বিচারককে কোমরে হাত দিয়ে পালুন খানিকটা নামিয়ে দিল তারপর পায়ের দিকে পালুনের প্রান্ত ধরে টান দিতেই পালুন নেমে এলাে এবং সেটি নিয়ে ম্যাতিউজে। আদালত থেকে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দুই আসামী ম্যাসাে ও রিবিও হাওয়া। পকেটমাররা এই কায়দায় পকেট মারে। পা মাড়িয়ে দিয়ে বা ধাক্কা দিয়ে অন্যমনস্ক করে দিয়ে পকেট হালকা করে দেয়।
একজন লােক বলল ওরা তাে আদালত থেকে বেরিয়ে গেল। একজন ঘুসি তুলে বলছিল আমি সিনেটে আপিল করবাে, আর একজন বলেছিল আমি সিনেটে যাবে না। এইখানেই ব্যাটাকে ধরে নিয়ে আসবাে।
বিচারক মশাই তখন কোট দিয়ে লজ্জা ঢাকতে ঢাকতে বলছেন, ব্যাটাদের ধরতে পারলে না?
একি তাজ্জব কাণ্ড, তােমাদের সামনে আমার পালুন খুলে নিয়ে পালালাে।
কে তাদের পাত্তা করবে? কি দরকার? ফ্লোরােন্সের কর্তারা যদি এমন গােলা মানুষকে বিচারক করে আনে তাহলে তার এমন অবস্থাই হবে। সস্তায় কি আর বুদ্ধিমান বিচারক পাওয়া যায়?
একজন যখন বিচারককে বুঝিয়ে দিল তিন ধড়িবাজ ছােকরা কি করে তাকে অন্যমনস্ক করে তার অজান্তে পাৎলুন খুলে নিয়ে পালাল তা শুনে তিনি তাে ভির্মি গেলেন। বেইজ্জত বিচারক এ নিয়ে আর কারও সঙ্গে আলােচনা করেন নি, অপমানটা হজম করতেই হল।
ষষ্ঠ গল্প
ব্রুনো আর বুফালমাচো দু‘জনে মিলে ক্যালানড্রিনাের একটা শূকর চুরি করবে। শূকরটা খুঁজে দেবার ছল করে ওরা ক্যালানড্রিনােকে একটা পরীক্ষা নিতে বলে। তাকে আদার মিষ্টি খেতে বলে। পর পর দুটো মিষ্টি খেতে বলে। কুকুরের বিষ্ঠার ওপর আলাে পাতার রস, আদার রস ও কিছু মিষ্টি দ্রব্য মিশিয়ে গােল দুটি মিষ্টি তৈরি করে ওকে খাইয়ে প্রমাণ করে যে ক্যালানড্রিনাে নিজেই চোর। তার বৌকে বলে দেবার ভয় দেখিয়ে ওর কাছ থেকে টাকা আদায় করে।
ফিলােস্ট্রাটোর গল্প শুনে মেয়েরা তাে হেসেই খুন, এমন দুষ্ট বুদ্ধি ছােকরাদের মাথাতেও আসে! হাসি থামতে কুইন এবার ফিলােমেনাকে বললাে, বেশ জমিয়ে একটা গল্প বল তাে।
ফিলােমেনা বলল, ফিলােস্ট্রাটো যেমন ম্যাসাের দুষ্ট বুদ্ধির গল্প বলল, আমিও তেমনি সেই ব্রুন আর বুফালমাচোর এক কীর্তির গল্প বলবাে। ওরাও ম্যাসাের চেয়ে কম যায় না। শুনে দেখাে গল্পটা তােমাদের ভালােই লাগবে।
আগেকার গল্পে তােমরা ক্যালানড্রিনাে, বুফালমাচো আর ব্রুনাের নাম শুনেছ অতএব নতুন করে তাদের আর পরিচয় দিতে হবে না। ফ্লোরেন্স থেকে অনতিদূরে ক্যালানড্রিনাের ক্ষেতখামার ছিল। এটা সে পেয়েছিল তার স্ত্রীর তরফ থেকে যৌতুকস্বরূপ। শর্ত অনুসারে তাকে প্রতি বৎসর একটি করে হৃষ্টপুষ্ট শূকর দেওয়া হতাে এজন্য প্রতি বৎসর ডিসেম্বর মাসে সে তার স্ত্রীকে নিয়ে খামারবাড়িতে যেত ও কিছুদিন বাস করতাে। এই সময় শূকরটিকে বধ করে তার মাংস নুন দিয়ে জারিয়ে রাখত।
একবছর তার স্ত্রী অসুস্থতার জন্যে খামারবাড়িতে যেতে পারল না অতত্রব শূকরের যাবতীয় ব্যবস্থা করতে ক্যালানড্রিনাে খামারবাড়িতে একাই গেল। কথাটা ব্রুনাে আর বুফালমাচোর কানে গেল। তাদের বন্ধু এবার একাই গেছে সঙ্গে তার বৌ যায় নি। ওরা দু’জনে ঠিক করলো ওরাও ঐ গ্রামে যাবে এবং সেখানে তাদের যে যাজক বন্ধু আছে তার আতিথ্য গ্রহণ করা যাবে। আসল উদ্দেশ্য ক্যালানড্রিনােকে নিয়ে একটু মজা করা।
দুই বন্ধু যেদিন গ্রামে পৌঁছল সকালে শূকরটা বধ করে ছাল ছাড়িয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় রেখেছে। এবার টুকরাে করে কেটে নুন দিয়ে জারাবে।
দুই ধুরন্ধর বন্ধু ক্যালানড্রিনাে তাদের ও সঙ্গে যাজককে দেখে খুব খুশি। আরে তােমরাও এসেছ, ভালই হল, কটা দিন বেশ আনন্দেই কাটান যাবে, কি বললা? আমার সঙ্গে এসে একটু এখানে দেবে যাও, আমি কি রকম করিৎকর্মা হয়ে উঠেছি।
দুই বন্ধু ও যাজককে সঙ্গে নিয়ে ক্যালানড্রিনাে ছাল ছাড়ান শূকরটি দেখাল। চর্বিভর্তি মাংসল শূকরটি দেখে দুই বন্ধুর চোখ চকচক করে উঠলাে। ক্যালানড্রিনাে বললাে এবার এটিকে খণ্ড খণ্ড করে কেটে লবণাক্ত করা হবে এবং তারপর সে মাংসগুলি ফ্লোরেন্সে তার স্ত্রীর কাছে নিয়ে যাবে। ১ এ কথা শুনে ব্রুনাে বললাে, তােমার মাথা খারাপ হয়েছে। ওটা এখনি বেচে দাও আর সেই পয়সায় আমরা বেশ ফুর্তি করতে পারবাে। বৌকে বলবে, একা ছিলাম তাে, নজর রাখতে পারি নি, কোন্ ফাকে শূকরটা কে চুরি করে পালিয়েছে। কত চেষ্টা করলুম, চোর ধরতে পারলুম না।
আরে সর্বনাশ! আমার বৌ আমার কথা কিছুতেই বিশ্বাস করবে না। লাথি মেরে আমাকে বাড়ি থেকে বার করে দেবে। অতএব শূকর নিয়ে আর উচ্চবাচ্য কোরাে না।
দুই বন্ধু তাকে অনেক বােঝাল, অনেক যুক্তি দেখাল কিন্তু ক্যালানড্রিনাে সে সবে কর্ণপাত করলাে না। বলল, ও নিয়ে তােমরা আর মাথা ঘামিও না। যা বলছে তা হবে না। তার চেয়ে আজ রাত্রে তােমরা আমার বাড়িতে এসাে, একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করা যাবে। ক্যালানড্রিনাে যেভাবে ওদের নিমন্ত্রণ করলাে সেটা ওদের মনঃপূত হল না। ওরা নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলাে না। ওরা যাজককে নিয়ে ফিরে গেল।
ক্যালানড্রিনাের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে এসে বুফালমাচোকে ব্রুনাে বললাে, আরে এক কাজ করলে তাে হয়, আমরাই তাে শূকরটা আজ রাত্রে চুরি করতে পারি?
বুফালমাচো জিজ্ঞাসা করলাে, কি করে চুরি করবে? ব্রুনাে বলল, সে আমি ভেবে রেখেছি। যদি ক্যালানড্রিনাে আজও কোথাও চলে না যায়।
বুফালমাচো বললাে, বেশ তাহলে চুরি করাই যাক, আর কেনই বা করবে না? চুরি করে মাংসগুলাে বেচে দিয়ে সেই পয়সায় আমরা দু’জন, আমাদের যাজক বন্ধু আর দু’চারজনকে জুটিয়ে তােফা ভােজ দেওয়া যাবে।
যাজকও সমর্থন করলাে। সেকালে যাজকরাও চুরি করতে উৎসাহ দিতাে।
ব্রুনাে বলল, ক্যালানড্রিনােটা পরের পয়সায় মদ খেতে খুব ওস্তাদ। আজ সন্ধ্যার পর আমার তিনজন ব্যাটাকে পানশালায় নিয়ে যাব। বলবাে, চলাে হে আজ আমাদের যাজক বন্ধু আমাদের সুরা পান করাবেন। মদ খেতে খেতে ব্যাটার যখন বেশ নেশা হবে তখন যাজকভায়া বলবে আমার আর পয়সা নেই তখন দেখিস ক্যালানড্রিনাে নিজেই পকেট থেকে পয়সা বার করে মদ খাবে। আমরাও ওকে খুব উৎসাহ দেব যে পর্যন্ত না ও রীতিমতাে মাতাল হয়ে যায়। তারপর বাকি কাজটা হাসিল করতে আমাদের একটুও বেগ পেতে হবে না।
ব্রুনাের কথামতাে ক্যালানড্রিনােকে পানশালায় নিয়ে গিয়ে মদ গেলাননা আরম্ভ হল। যখন দেখা গেল ক্যালানড্রিনাের নেশা ধরেছে, কথা জড়িয়ে আসছে সেই সময়ে যাজক বলল, চল হে ঘরে ফেরা যাক। আমার পুঁজি খতম।
ক্যালানড্রিনাে জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, সে কি? এরই মধ্যে যাবে কোথায়? এই তাে সবে মৌতাত আরম্ভ হয়েছে, তােমার পুঁজি নেই তাে কি হয়েছে? আমার তাে আছে, অ্যাই কে আছে, গেলাস ভর্তি করে দাও।
ক্যালানড্রিনাে এরপর আরও অনেক মদ গিললাে। যখন আর পারবে না বুঝলাে তখন উঠে পড়লাে। টলতে টলতে ঘরে ফিরলাে এবং বিছানায় ধপাস করে পড়ে ঘুম। রাত্রে কিছু খেলাে না। কোথা থেকে খাবে? প্রতিদিনের মতাে আজ শােবার ঘরে বাড়ির দরজাগুলাে বন্ধ করার কথা তার আর মনে রইল না, দরজাগুলাে হাট করে খােলাই রইল। | দুই বন্ধু আর যাজক বাসায় ফিরে রাতের খাওয়া সারলাে। তারপর ঢেকুর তুলে বলল, এবার তাহলে কাজে নামা যাক। যদি তালা ভাঙতে হয় সেজন্যে দু’একটা যন্ত্রপাতি নিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়ল। ক্যালানড্রিনাের বাড়ি এসে দেখলাে ও অঘােরে ঘুমােচ্ছ। সব দরজা খােলা এমনকি যে ঘরে শূকরের মাংস রয়েছে সে ঘরটাও। রাস্তা পরিষ্কার। তারপর যা হল তা বলার প্রয়ােজন নেই। বাসায় ফিরে ওরা শুয়ে পড়লাে। খুব সহজেই কাম ফতে হল।
পরদিন সকালে ক্যালানড্রিন আবিষ্কার করলাে শূকর চুরি হয়ে গেছে। প্রতিবেশীদের জিজ্ঞাসা করলাে। তারা কিছু জানে না। তখন নিজেই হাত পা ছুঁড়ে চেঁচামেচি আরম্ভ করে দিল।
ওদিকে দুই বন্ধু ঘুম থেকে উঠেছে। কিছুক্ষণ পরে ওরা ক্যালানড্রিনাের বাসায় দেখতে এলাে তাদের বন্ধুটি কি করছে? কে জানে এখনও হয়ত ঘুমােচ্ছে কাল যা মদ গিলেছে। কিন্তু এসে দেখল সে চেঁচামেচি আরম্ভ করে দিয়েছে। বন্ধুদের দেখেই সে দুঃসংবাদ দিল, শূকর চুরি হয়ে গেছে। বন্ধুরা বিশ্বাস করতে চায় না যে মাল চুরি হয়েছে। সে যত বলে সত্যিই চুরি হয়েছে বন্ধুরা ততই অবিশ্বাস করে।
ক্যালানড্রিনাে হতাশ হয়ে বলে তার অন্য কোনাে জিনিস চুরি গেলে সে গ্রাহ্যই করতাে না তার ভয় তার বৌকে। শূকর নিয়ে বাড়ি ফিরতে না পারলে তার বৌ যে কাণ্ড করবে তা সে ভাবতেই ভয় পাচ্ছে। এ বুফালমাচো বলল, চুরি যদি কেউ করে থাকে সে কাছাকাছি থাকে। সে কাল শূকর বধ করতে দেখেছে এবং কোথায় থাকে তা সে জানে। সে চোর হিন্দুস্তান থেকে আসতে পারে না, পাড়ার কোনাে লােক চুরি করেছে। কিন্তু সেই চোরকে কি করে ধরা যায় ? খুব গম্ভীর হয়ে সে বলল, বন্ধুর মাল চুরি যাওয়াতে সে যেন খুব চিন্তিত ও দুঃখিত। কিন্তু চোর তাে ধরতে হবে, চোরাই মালও উদ্ধার করতে হবে, কি করা যায়, তােমাদের কি পরামর্শ ? সে জিজ্ঞাসা করলাে। মনের এ পরামর্শ যে কি তা তাে তারা আগেই গােপনে ঠিক করে রেখেছিল।
ব্রুনাে বলল, একটা কাজ করা যাক, তাকে চোর নিশ্চয় ধরা পড়বে। আমি একটা তুক জানি। তুক মানে আমি আদা দিয়ে একরকম ছােট লাড়ু তৈরি করতে জানি। খেতে বেশ সুস্বাদু। আমরা পাড়ার লােকদের লাড়ু ও সেই সঙ্গে ভারনাচাই সুরা খাওয়াবার নেমতন্ন করি। আমরাও থাকবাে। আমরা চারজন ও সকলে সেই লাড়ু পর পর দুটো করে খাবাে। কিন্তু যে চোর তার মুখে সেই লাড়ু তেঁতাে লাগবে, সে খেতেই পারবে না। উগরে ফেলে দেবে। দেখাই যাক না ? বুফালমাচো সায় দিয়ে বলল, নিশ্চই, ক্যালানড্রিনাে তুমি কি বলাে?
ক্যালানড্রিনাে বলল তার আপত্তি নেই। শূকর উদ্ধার না হলে সে তার বৌয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই পারবে না।
ব্রুনাে বলল, লাড়ু তৈরি করতে আর ভারনাচাই সুরা কিনতে তাে খরচ আছে। দায় যখন তােমার, ক্যালানড্রিনাে তখন খরচ তাে তােমাকেই দিতে হবে।
ক্যালানড্রিনাে খরচ দিতেই ব্রুনাে টাকা নিয়ে তখনি ঘােড়ায় চেপে ফ্লোরেন্সে চলে গেল। ওর এক বন্ধু ছিলাে সে মিষ্টি পাক করে। ব্রুনো তাকে দিয়ে আদা ও মিষ্টি মিশিয়ে অনেক লাড়ু তৈরি করলাে কিন্তু দুটো লাড়ু পৃথকভাবে তৈরি করলাে, যা দেখতে অন্য লাড্ডগুলোর মতোই কিন্তু ভেতরে আছে কুকুরের বিষ্ঠা ও অ্যালাে গাছের পাতার তেঁতাে রস। এ লাড়ু মানুষ তাে দূরের কথা কাকও খাবে না, কোনাে পশুও নয়।
লাডুডু আর ভারনাচাই সুরা নিয়ে ব্রুনাে গ্রামে ফিরে এলো। পরদিন সকালে পাড়ার লােকদের নিমন্ত্রণ জানানাে হল তবে কেন এই নিমন্ত্রণ জানানাে হল। তারাও জিজ্ঞাসা করলাে না। আগে তাে লাড়ু ও ভারনাচাই খাওয়া যাক তারপর জিজ্ঞাসা করা যাবে এখন। কতদিন ভারনাচাই ভাগ্যে জোটে নি!
গির্জার সামনে গাছতলায় একটা জায়গা বেছে নেওয়া হল। সেখানে সকলে সমবেত হবার পর ভূমিকা করে ব্রুনাে বলল, ক্যালানড্রিনাে বছরে একবার করে গ্রামে আসে তাই সকলে মিলে একটু আড্ডা দেওয়ার জন্যে এই ব্যবস্থা করেছে। তবুও একটা উদ্দেশ্য আছে, উদ্দেশ্যটা আগে বলে দেওয়া ভালাে নইলে পরে তােমরা আমাদের দোষ দিতে পারাে। এখন হয়েছে কি আমাদের এই বন্ধু ক্যালানড্রিনাের একটি শূকর চুরি গেছে। শূকরটা যে পাড়ার কেউ চুরি করেনি সেটা প্রমাণ করবার জন্যে এই ছােট ভােজটি দেওয়া হচ্ছে। আমি প্রত্যেককে একটি একটি করে দুটি লাড়ু দেব কিন্তু আমাদের মধ্যে নিশ্চই কেউ চোর নয়, অনায়াসেই লাড়ু খেতে পারবে কিন্তু যে চোর একটাও লাডু তার গলা দিয়ে নামবে না।
ইতিমধ্যে সকলে এক টোক করে ভারনাচাই পান করে গলা ভিজিয়ে নিয়েছে। ব্রুনাে এবার প্রত্যেকের হাতে একটা করে লাড়ু দিল। ক্যালানড্রিনােই দিল। তার লাড়ু দুটি অন্য লাড্ডগুলির মতােই দেখতে হলেও সে দুটি চিহ্নিত করা ছিল।
সকলে লাড়ু খেয়ে ফেলল কিন্তু ক্যালানড্রিনাে লাড়ু মুখে দু-চার বার কামড়ে থু থু করে ফেলে দিল। ব্রুনাে ও তার বন্ধুরা হৈ হৈ করে উঠল। একি ? ক্যালানড্রিনাে কি হল ? লাডুটা খেতে পারছ না ? ব্রুনাে তার হাতে অপর লাটা দিয়ে বলল, এটা খেয়ে দেখাে তাে ? ক্যালানড্রিনাে সেটাও খেতে পারলাে না, উগরে ফেলে দিয়ে মুখ বিকৃত করতে লাগল।
বুফালমাচো তখন সকলকে সুরা পরিবেশন করছিল। সে ব্রুনাের পাশে এসে দাঁড়াল। ক্যালানড্রিনাে তখন মুখ থেকে লাড়ুর অংশ থুথু করে বার করছে। তার দুরবস্থা দেখে সকলে পরস্পরের মধ্যে প্রশ্ন রতে লাগলাে তাহলে কি ক্যালানড্রিনাে নিজের শূকর নিজেই চুরি করেছে ? তা কি করে হবে! পাড়ার লােকেরা লাড়ু ও ভারনাচাই পান করে নিজের নিজের ঘরে ফিরে গেল।
এবার ক্যালানড্রিনােকে একা পেয়ে দুই বন্ধু ওকে চেপে ধরলাে। বলল, গােড়াতেই আমাদের সন্দেহ হয়েছিল যে তুমি যেরকম লােভী আর মদ্যপ, এ তােমারই কাজ।
ক্যালানড্রিনাে বলল, তােমরা যা সন্দেহ করছে তা হতে পারতাে যদি না আমার ঘরে একটি দজ্জাল বৌ থাকতাে। তাহলে শূকর বেচে যে পয়সা পেতুম তাতে তােমাদের মদ খাওয়াতুম। কিন্তু তােমরা আমাকে বৃথা সন্দেহ করছে।
ওরা বলল, মিথ্যা বলে আর লাভ নেই। তুমিই চুরি করেছ কারণ এখন পাড়ার যারা এসেছিল তাদের মধ্যে একজন বলে গেল তুমি নাকি রােজ একজন মেয়েকে তােমার ঘরে আনতে। তারই আবদার মেটাতে শূকরটা তুমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছ। আমরা তাে তোমাকে চিনি। মুগনােন নদীর ধার থেকে তুমি আমাদের খেতে না দিয়ে জাদু পাথরটি নিয়ে একা পালিয়ে এসেছিলে। ক্যালানড্রিনাে যতই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবার চেষ্টা করে ওরা ততই চেপে ধরে। ক্যালানড্রিনাে হতাশ। তার আর একটা ভয়। বাড়ি ফেরার পর তার বৌ তাকে হয়ত বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে। তার চেয়ে চুপ করে যাওয়া ভালাে।
ওরা দু’জন বলল, ক্যালানড্রিনাে তােমার জন্যে আমাদের খুব খাটাখাটনি করতে হয়েছে। তুমি তােমার যে একপাল হাঁস মুরগি আছে তা থেকে দুটো মােরগ দাও। আর ঝামেলা না বাড়িয়ে সে দু’জনকে দুটো মােরগ দিল। ওরাও খুশি হয়ে প্রফুল্ল মনে বাসায় ফিরল।
কাটা শূকর ওরা নুন দিয়ে বেশ করে জারিয়ে শহরে নিয়ে গিয়ে ভালাে দামে বেচে দিল। ক্যালানড্রিনাে মাথা চুলকোতে চুলকোতে ফ্লোরেন্সে ফিরে গেল।
সপ্তম গল্প
এক বিদ্বান যুবক এক সুন্দরী যুবতী বিধবার প্রেমে পড়লাে। বিধবা অন্য এক যুবকের প্রণয়ী। বিদ্বান যুবককে যুবতী দারুণ এক শীতে তুষারপাতের সময় সারা রাত্রি দাঁড় করিয়ে রাখলাে। পরে সুযােগ পেয়ে ঐ বিদ্বান যুবক সুন্দরী বিধবাকে নগ্ন অবস্থায় জুলাই মাসে তপ্ত রৌদ্রে এক উচ্চ গম্বুজে সূর্যোদয়ের আগে থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাছি ও পােকার দংশন ও রৌদ্রতাপ সহ্য করতে বাধ্য করেছিল।
বেচারা ক্যালানড্রিনাের নাজেহাল অবস্থা যেমন হাসির খােরাক জোটাল, তেমনি তাকে দুটো মােরগ গুনাগার দিতে হল। এজন্যে সমবেদনাও প্রকাশ করলাে সকলে। যাই হােক গল্পটা অন্য গল্পগুলির মতাে সকলে উপভােগ করলাে। কুইন এবার প্যামপিনিয়াকে গল্প বলতে অনুরােধ করলাে।
প্যামপিনিয়া বলল, তােমরা ভাই জানাে যে, একটা কথা আছে ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়। যাকে তুমি ঠকাবে সে যদি চতুর হয় তাহলে ঠিক প্রতিশােধ নেবে। আমরা এরকম কয়েকটা গল্প উপভােগ করেছি। একটি মেয়ে একটি ছেলেকে দারুণ সাজা দিয়েছিল কিন্তু নিজেই ফাদে পা দিয়ে প্রাণটাই হারাতে বসেছিল। গল্পটা হাসির না হলেও এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবাে সকলে।
কয়েক বছর আগে ফ্লোরেন্স শহর এলেনা নামে এক যুবতী বিধবা বাস করত। সাত বংশের ললনা কিন্তু রূপসী বলে তার গর্ব ছিল। তাকে দেখলে অবশ্য মানতে হবে তার যৌবনসম্পদ ছিল নিখুঁত। কোনাে যুবক তাকে দেখলে তার প্রেমে পড়তে বাধ্য।
স্বামী মারা যাবার পর ইচ্ছে করলে সে বিয়ে করতে পারতাে কিন্তু সে আর বিয়ে না করে একটি যুবকের প্রতি প্রণয়াসক্ত হয়ে তাকে নিয়ে প্রতি রাত্রি তার বাহুবন্ধনে মহানন্দে কাটাতে লাগলাে। একাজে পরিচারিকা তার সহায় ছিল।
সেই সময়ে অভিজাত বংশের এক যুবক ফ্লোরেন্স থেকে প্যারিসে গিয়ে উত্তমরূপে বিদ্যা ও জ্ঞান অর্জন করে ঘরে ফিরে এলাে। তার নাম রাইনিরি। ঘরে ফিরেও সে পড়াশােনা নিয়েই থাকতাে, জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে সচেষ্ট ছিল। বিদ্বান ও পণ্ডিত মানুষরূপে শহরে সে খ্যাত অর্জন করেছিল।
একঘেয়েমি থেকে সকলেই ছুটি চায়। একদিন এক ভােজসভায় সে আমন্ত্রিত হল। যাবাে না বা না করেও শেষ পর্যন্ত বই বন্ধ করে সে ভােজসভায় গেল। ভােজসভায় রূপসী এলেনাও এসেছিল। বিধবাদের মতাে এলেনা কালাে ড্রেস পরে এসেছিল ফলে তাকে আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। সে অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল এবং সেও লক্ষ্য করছিল কারা তাকে বার বার দেখছে। সহসা রাইনিরির ওপর দৃষ্টি পড়ল। দেখল যুবক তার দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
রাইনিরি সাধারণত যুবতীদের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করে না কিন্তু এলেনার এত সুন্দর মুখশ্রী সে অগ্রাহ্য করতে পারল না। প্রথম নজরেই সে এলেনার প্রেমে পড়ে গেল। এলেনা তার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল কিন্তু পরে যখনি তার দিকে চেয়েছিল তখনি দেখেছিল যুবক তার দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। পানভােজনও ভুলে গেছে।
সুন্দরীকে নিয়ে রাইনিরি মনে মনে কত কল্পনা করতে লাগলাে। ভগবান দয়া করে যে-যুবককে ঐ নারীরত্নকে বিবসনা অবস্থায় আলিঙ্গন করবার সুযােগ দেবেন সে যুবক নিশ্চয়ই স্বর্গসুখ লাভ করবে। তার কি এমন সৌভাগ্য হবে! দীর্ঘশ্বাস মােচন করে সে ভাবলাে চুলােয় যাক বইপত্তর এই সুন্দরী ললনাকে লাভ করতেই হবে।
আর ওদিকে এলেনা ভাবছে সুযােগ পেলে এ ছোঁড়ার নাকে দড়ি দিয়ে ঘােরাববা, ওকে চোখের জলে নাকের জলে করে ছাড়বাে।
রাইনিরি একদিন এলেনার বাড়ি খুঁজে বার করলাে এবং আবিষ্কার করল যে, দাসদাসী নিয়ে সুন্দরী বাড়িতে একাই থাকে, দ্বিতীয় কোনাে অভিভাবক নেই। রাইনিরি সেইদিন থেকে সকালে বিকালে এলেনার বাড়ির সামনে দিয়ে হাঁটাহাঁটি আরম্ভ করলাে, আলাপ করবার যদি কোনাে সুযােগ পায়। এলেনা কিন্তু তার ঘরের জানালার পর্দার ফাক দিয়ে দেখে রাইনিরি তার বাড়ির দিকে চেয়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। ছোঁড়া তাহলে জালে আটকেছে।
রাইনিরি একদিন সুযােগ পেয়ে পরিচারিকাকে জানালাে যে, সে তার কী এলেনা ম্যাডামের প্রেমে পড়েছে একথা যদি সে তার স্ত্রীকে বলে এবং একদিন সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে সে কৃতজ্ঞ থাকবে। পরিচারিকা হাসিমুখে বললাে সে নিশ্চয় একথা তার দিদিমণিকে বলবে এবং তিনি যে উত্তর দেবেন সে কথা তাকে জানাবে।
এলেনা তাে পরিচারিকার মুখে সব শুনে হেসেই অস্থির। ছোঁড়া বঁড়শি গিলেছে তাহলে ওর মরণের আর দেরি নেই। শুনেছি ছােড়া নাকি এক ক্ষুদে পণ্ডিত। তা পণ্ডিতরা ত বােকা হয়, বিশেষ করে প্রেমের ব্যাপারে, তা ওকে নিয়ে একটু খেলা যাবে কি বলল! বেশ এবার যখন তাের সঙ্গে ছোঁড়ার দেখা হবে তখন বলিস কি দাদা তুমি যতাে না আমার দিদিমণিকে ভালােবাস, দিদিমণি তার চেয়ে অনেক বেশি তােমাকে ভালােবাসে, তােমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।
পরে পরিচারিকার মুখে এসব কথা শুনে রাইনিরি মনে মনে আনন্দে নৃত্য করতে লাগল। সে পরিচারিকা মারফত এলেনাকে প্রেমপত্র ও উপহার পাঠাতে আরম্ভ করলাে, সেই সঙ্গে দেখা করার আকুল আবেদন।
এলেনা একদিন তার প্রণয়ী যুবককে রাইনিরির কথা বললাে। যুবক তাে হিংসায় জ্বলে উঠল। এলেনা বললাে তােমার তাে ছোঁড়াকে হিংসে করার কোনাে কারণ নেই। দেখ না আমি ওকে কি নাজেহাল করি, তখন তােমার বিশ্বাস হবে যে তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই।
চিঠি আর উপহার পাঠিয়ে এলেনাকে রাইনিরি যেমন বিরক্ত করছিল তেমনি বিরক্ত করছিল পরিচারিকাকেও।
পরিচারিকা একদিন সুখবর বহন করে আনলাে। সে বললাে ক্রিসমাসের দিন দিদিমণি তার সঙ্গে দেখা করবে। শুধু দেখা করা নয় সারা রাত্রি তার সঙ্গে কাটাবে। ঐ দিন সন্ধ্যার সময় রাইনিরি যেন বাড়ির পিছন দিকের দরজায় অপেক্ষা করে।
রাইনিরি বুঝি হাতে চাদ পেলাে। ক্রিসমাসের দিন দুপুর থেকে তুষারপাত আরম্ভ হল। শীতও বাড়তে লাগলাে। রাইনিরি সন্ধ্যায় এলেনার বাড়ির পিছনদিকের দরজার কাছে দাঁড়াল। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, পরিচারিকা দরজা খুলে তাকে ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দিল। ভিতরে প্রশস্ত উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ, কোথাও কোনাে আচ্ছাদন নেই। রাইনিরি ফুর্তির চোট হাড়কাঁপানাে শীতের উপযােগী পােশাক পরে আসে নি। ভেবেছিল কি দরকার। প্রেমিকার উষ্ণ ঘরে উষ্ণ আলিঙ্গনে সে অচিরে আবদ্ধ হবে, মিছিমিছি ভারি বড় কোট ইত্যাদি বইবার দরকার কি?
পরিচারিকা ওকে অপেক্ষা করতে বলে একটা দরজা খুলে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। দরজাটা সে ভেতর দিকে বন্ধ করে দিয়ে গেল। উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে রাইনিরি একা অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু পরিচারিকা গেল তাে গেলই, তার তাে কোনাে সাড়াশব্দই নেই এমনকি বাড়ির থেকেও কোনােরকম আওয়াজ শােনা যাচ্ছে না।
ওদিকে এলেনা সামনের দরজা দিয়ে তার প্রেমিককে আগেই বাড়িতে ঢুকিয়েছে। একসময়ে দু’জনে রাতের আহারও সেরে নিল। ওদিকে রাইনিরি শীতে ঠকঠক করে কাপছে আর আশা করছে ওই বুঝি ডাক পড়ল কিন্তু কোথায় কি?
ঠিক তখন এলেনা পর্দা ফেলা শার্সির ফাঁক দিয়ে রাইনিরিকে দেখিয়ে তার প্রেমিককে বলল, এই দেখ আমি ঐ মূখটাকে কত ভালবাসি। রাইনিরির দুর্দশা দেখে প্রেমিক খুশি। তার বিশ্বাস আরও দৃঢ় হল, এলেনা শুধু তাকেই ভালবাসে।
ওদিকে তুষারপাত বন্ধ হলেও শীত ক্রমশ বাড়ছে। রাইনিরিকে কিছু বলবার জন্যে এলেনা তার পরিচারিকাকে নিচে পাঠিয়ে সে তার প্রেমিককে শয়নঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল, শুনবে এসাে, আমি ছোঁড়াটার কাছে কি খবর পাঠিয়েছি। প্রেমিককে শয়নঘরে নিয়ে গিয়ে ছােট্ট একটা জানালা খুলে বলল, দেখ আর শােননা।
পরিচারিকা নিচে নেমে জানালা খুলে রাইনিরিকে কাছে ডেকে বলল, রাইনিরি এদিকে এক বিপদ হয়েছে, দিদিমণি তাে ভারি অপ্রস্তুতে পড়ে গেছেন। আরে আর বলবাে কি তার হতচ্ছাড়া একটা ভাই হঠাৎ কোথা থেকে এসে হাজির হয়েছে। তবে তুমি নিরাশ হয়াে না, সে বােধহয় একটু পরেই চলে যাবে আর আমি তখনি তােমাকে ভেতরে নিয়ে যাব।
পরিচারিকা সত্যি কথাই বলছে মনে করে রাইনিরি বলল, ঠিক আছে, তুমি প্রিয়তমাকে আমার জন্যে ব্যস্ত হতে নিষেধ কোরাে, সুবিধে হলেই যেন আমাকে ডাকেন তবে যেন বেশি দেরি না করেন। উত্তর শুনেই পরিচারিকা জানালা বন্ধ করে দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়ল।
এলেনা তার প্রেমিককে বলল, বিশ্বাস হচ্ছে তাে? আমি ঘোড়াকে ভালবাসলে কি এই দারুণ শীতে ওকে বাইরে ফেলে রাখতুম। ও যে পালাবে তারও উপায় নেই, দরজা বন্ধ। শীতে জমে মরে যেতেও পারে। দু’জনে হাসাহাসি করতে করতে খাটে গিয়ে শুয়ে পড়ল। উষ্ণ বিছানায় তপ্ত আলিঙ্গনে ওরা মেতে উঠল।
রাত্রি তখন প্রায় শেষ হয়ে আসছে। আবার তুষারপাত আরম্ভ হয়েছে। এলেনা তার প্রেমিককে বলল, চলাে একবার নিচে গিয়ে দেখে আসি ছোঁড়া শীতে জমে গেল কিনা। ওরা নিচে নেমে জানালা খুলল। প্রেমিক এলেনার পিছনে দাঁড়িয়ে রইল। ওরা দেখল শরীর সচল ও গরম রাখবার জন্যে রাইনিরি কখনও লাফাচ্ছে বা হাত ছুঁড়ছে। দু’জনে অতিকষ্টে হাসি দমন করলাে। এলেনা জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ডাকল, রাইনিরি ডার্লিং কোথায় গেলে? কাদো কাদো স্বরে বলল, এই যে তুমি, আমার কান্না পাচ্ছে, হতভাগা ভাইটা বলল, আমাকে খেতে দে, খেয়েই চলে যাব। খাওয়া শেষ হলে বলল, নাঃ যাব না। বাইরে ভীষণ শীত আর তুষারপাত হচ্ছে। রাত্রিটা থাকি, ভাের হলেই ডেকে দিস। ভাের হতে আর তাে দেরি নেই, ও গেলেই, বুঝলে?
বুঝলুম, কিন্তু লেডি দরজাটা একবার দয়া করে খােললা, আমি শীতে জমে গেলুম, হাত-পা অবশ। হয়ে যাচ্ছে, ওপরে যাব না, দরজার পাশেই একটু বসে থাকব।
কাতরভাবে অনুনয় করলাে রাইনিরি। সে কথা বলছে আর দাঁতে দাঁত লেগে খটখট আওয়াজ হচ্ছে। বেচারার অবস্থা শােচনীয়।
এলেনা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, শীত করছে? এমনকি শীত? তুমি তাে অনেকদিন প্যারিসে ছিলে, সেখানে তাে আরও অনেক বেশি শীত। তারপর তুমি চিঠিতি আমাকে লিখতে আমার জন্যে প্রেমাপ্তিতে তােমার সারা দেহ জ্বলছে, সেই দেহ এখন একটু শীতল হােক। আমি এখন যাই, ও এখনি উঠে পড়ে আমাকে খুঁজতে হয়ত নিচে নেমে আসবে, তখন তােমাকে দেখতে পেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে, লক্ষ্মীটি।
ঈশ্বরের দোহাই এলেনা, প্রিয়তমা আমাকে এই নিচেই একটু আশ্রয় দাও। তারপর তুমি যতক্ষণ বলবে আমি অপেক্ষা করবাে, আমি বােধহয় মরেই যাব। রাইনিরি কাপতে কাপতে বলল।
মাই গড! এই দরজাটা এত ভারি যে খুলতেই পারবাে না আর বাইরে থেকে তুমি যদি ঠেলা দাও তাহলে এমন বিশ্রী আওয়াজ হবে যে বাড়ির সব লােক জেগে উঠবে। আমি একটু পরেই তােমাকে ডেকে নেব, ছলনাময়ী এলেনা বলল।
তাই যাও, কি আর করা যাবে কিন্তু ঘরের আগুনটা জ্বালিয়ে রেখ, হাত-পা যেন সেঁকতে পারি।
রাইনিরির শেষ কথাগুলাে শােনবার জন্যে এলেনা আর দাঁড়িয়ে থাকে নি। সে তার প্রণয়ীকে বলল, নিজের কানে সব শুনলে তাে। ঘোড়াকে কেমন জব্দ করলুম। এরপরও কি তুমি আমাকে সন্দেহ করবে?
কিন্তু এলেনা তুমি যত তাড়াতাড়ি পার ওকে বার করে দাও। কারণ ও যদি তােমার বাড়িতে মরে যায় তাহলে কেলেংকারির শেষ থাকবে না।
আরও কিছুক্ষণ কাটল। দরজা খােলার নাম নেই। রাইনিরি হতাশ। এবার সে বুঝতে পারল তার সঙ্গে ছলনা করে তাকে বােকা বানানাে হয়েছে। কিন্তু এখনি চলে যাবার উপায় নেই, কারণ বাইরে বেরােবার দরজাটাও বন্ধ। সে সাধ্যমতাে জোরে হাত পা ছুঁড়তে ছাড়তে বা ওঠবােস করতে করতে চিন্তা করতে লাগল সে কি করে এর প্রতিশােধ নেবে। এমন হৃদয়হীন নিষ্ঠুর নারীকে উচিত শিক্ষা দিতেই হবে কিন্তু সে সুযােগ কি পাবে? পেতেই হবে, তাকেও ছলনার আশ্রয় নিতে হবে।
দরজা খােলার আওয়াজ হল কিন্তু মানুষের ঘুম ভাঙার মতাে আওয়াজ মােটই নয়। পরিচারিকা পুরু কম্বলে বেশ করে গা ঢেকে বলতে আরম্ভ করলাে, দিদিমণির ভাইটা আচ্ছা লােক বটে। বলছে দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে যাবে। এখন কফি করে নিয়ে যেতে বলল। তুমি বাপু নিরাশ হোয়ো না, সূযােগ হলে আমিই তােমাকে খবর দেব। আহা আমার দিদিমণি তােমার জন্যে কত দুঃখ করছিল, চলাে বাইরের দরজাটা খুলে দিই।
রাইনিরি বলল, আহা রে, তােমার দিদিমণিকে আমার জন্যে দুঃখ করতে বারণ কোরাে। সে তাে নিচে নেমে এসে আমাকে সব বুঝিয়ে বলে গেছে। তবে শীতের রাত তাে, খােলা আকাশের নিচে আমার সামান্য একটু কষ্ট হল। ও কিছু নয়, আমার জন্যে তােমার দিদিমণি যেন দুঃখ না পায়। পরের বারে আমার ভাগ্য নিশ্চই সুপ্রসন্ন হবে।
রাইনিরি বাড়ি ফিরে তার ভিজে পােশাক ছেড়ে লেপ কম্বল দিয়ে শুয়ে পড়ল। এতই ক্লান্ত যে, সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। যখন ঘুম ভাঙল তখন সে তার হাত পা দেহ কিছুই নাড়তে পারছে সারা দেহ অসাড় হয়ে গেছে। শিরায় শিরায় রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে গেছে।
চিকিৎসককে খবর দেওয়া হল। তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন কিন্তু সুস্থ হয়ে উঠতে বেশ কয়েকদিন সময় লাগল। বিছানায় যতদিন শুয়ে ছিল ততদিন এলেনার প্রতি তার ঘৃণা পুঞ্জীভূত হচ্ছিল।
সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে সে আবার এলেনার বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়া-আসা আরম্ভ করলাে কিন্তু মনের ভেতের যে আগুন জ্বলছিল তা প্রকাশ করলাে না। তার মুখ দেখে মনে হবে ইতিমধ্যে কিছুই যেন ঘট নি। এলেনার প্রতি তার প্রেম যেন অটুট আছে। পরিচারিকার সঙ্গে দেখা হলে এলেনাকে শুভেচ্ছা পাঠায়।
বেশ কিছুদিন কেটে গেল। রাইনিরি মহিলাকে আর চিঠি লেখে নি, উপহারও পাঠায় নি যদিও সে এমন। ভাব দেখিয়ে যাচ্ছে যে, ক্রিসমাসের রাত্রে কিছুই যেন ঘটে নি।
এদিকে হল কি এলেনার সেই প্রেমিক অন্য এক সুন্দরীর প্রেমে পড়ে এলেনার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে লি। এলেনা শুধু ব্যথিত নয়, মুষড়ে পড়ল। তার মনে হল এই প্রেমিক বিনা জীবন বৃথা। রাত্রে ঘুম হয় না, ক্ষিধে হয় না, মাঝে মাঝে অশ্রুধারায় বুক ভিজে যায়।
তার এই দুর্দশা দেখে তার সেই পরিচারিকারও খুব কষ্ট হল। সে তার দিদিমণিকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে, বলে কাঁদবার কি আছে? তােমার রূপ আছে, যৌবন আছে, কত ধনবান ও সুন্দর যুবক তােমার পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়তে চায়, একজনকে বেছে নাও। কিন্তু এলেনা এ প্রস্তাবে রাজি নয়, সে তার ঐ প্রেমিকটিকেই ফিরে পেতে চায়।
এমন সময় ঐ পরিচারিকার খেয়াল হল রাইনিরি তাে প্যারিসে অনেক বিদ্যা শিখে এসেছে। জাদুবিদ্যা, মত, তুকতাক কি শিখে আসে নি? ওকে একবার জিজ্ঞাসা করা যাক না? এমন কোনাে বিদ্যা ওর জানা থাকলে তার প্রভাবে দিদিমণির প্রণয়ীকে ফিরিয়ে আনতে পারবে হয়তাে।
দিদিমণির কাছে এই প্রস্তাব পেশ করতে দিদিমণি রাজি হল এবং বলল, রাইনিরি যদি তার প্রেমিককে ফিরিয়ে এনে দিতে পারে তাহলে রাইনিরি যা চাইবে সে তাই দেবে, তুই ওকে বলে দেখ। এলেনার যত রূপ ছিল তত বুদ্ধি ছিল না। রাইনিরির যদি এমন কোনাে বিদ্যা জানা থাকতাে তাহলে সে তাে সেই বিদ্যা প্রয়ােগ করে এলেনাকে তার দাসী করে রাখতে।
রাইনিরি যখন এলেনার বাড়ির সামনে দিয়ে ভ্রমণে যাচ্ছিল, সেই সময়ে পরিচারিকা তাকে ধরে দিদিমণির কাহিনী বলে জিজ্ঞাসা করলাে প্যারিস থেকে সে কোনাে জাদুবিদ্যা বা বশীকরণ মন্ত্র শিখে এসেছে কিনা।
পরিচারিকার মুখে সব শুনে রাইনিরি অত্যন্ত পুলকিত। এই তাে প্রতিশােধ নেবার সুযােগ এসে গেছে। সেই শীতের রাত্রির কষ্ট অপেক্ষা বঞ্চনা ও অপমান রাইনিরিকে দন্ধ করছিল। এবার সে মেয়েকে উপযুক্ত শিক্ষা দেবে। কিন্তু ভাবে তা প্রকাশ করলাে না।
রাইনিরি এলেনার জন্য সমবেদনা প্রকাশ করে বলল, আহা রে এলেনা বিরহ যন্ত্রণায় কাতর হয়েছে আমি তাে জানতুম না, তাহলে আমি নিজেই দেখা করে একটা প্রতিকার করতুম। যা আমি প্যারিস
থেকে জাদুবিদ্যা, নারীপুরুষ বশ করবার বিদ্যা উত্তমরূপে শিখে এসেছি। এলেনার প্রেমিক যদি হিন্দুস্তানেও চলে গিয়ে থাকে তাহলে আমার মন্ত্র প্রয়ােগের ফলে সে এলেনার কাছে ফিরে এসে পায়ে ধরে তার ক্ষমা চাইবে। তুমি তােমার দিদিমণিকে বােলাে, প্রেটো গেটের কাছে সান্টা লুসিয়া গির্জাৰ বাগানে কাল বিকেলে যেন আসে, কি করতে হবে আমি সব ভালাে করে বলে দেব।
পরিচারিকা বলল, রাইনিরি তুমি যদি দিদিমণির বুকে তার প্রেমিককে ফিরিয়ে দিতে পার, তাহলে দিদিমণি বলেছে, তুমি যা চাইবে সে তােমাকে তাই দেবে।
জিভ কেটে রাইনিরি বলল, ছি ছি, এইসব মন্ত্রতন্ত্র জাদুবিদ্যা প্রয়ােগ করে বিনিময়ে কিছু নিলে দল পাওয়া যায় না। মনে মনে বলল, এলেনা তুমি তা তাে দেবেই। বিধবা হয়েও নিজেকে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত কারণ তুমি বারাঙ্গনা ছাড়া তাে আর কিছু নও।
পরদিন বিকালে গির্জার উদ্যানে একটি বেঞ্চে রাইনিরি ও এলেনা পাশাপাশি বসলাে। এলেনা তার হৃদয় উজাড় করে দুঃখের কাহিনী বলে ছলছল নয়নে অনুরােধ করলাে রাইনিরি তুমি তাকে ফিরিয়ে এনে দাও। কিন্তু সেই শীতের রাত্রের কথা একবারও উল্লেখ করলাে না। রাইনিরি মনে মনে বলল, বারবধূ তুমি পথে এসাে, তােমাকে আমি এবার হাতে পেয়েছি। সেদিন আমাকে প্রায় মেরে ফেলেছিলে, আমিও এমন সাজা তােমাকে দেব যে তুমিও মরে না গেলেও প্রায় মরেই যাবে।
রাইনিরি বলল, ম্যাডাম উপায় তাে আছে কিন্তু তুমি কি তা পারবে?
পারবাে, রাইনিরি পারব। আমি সব পিরবাে। তুমি শুধু বলাে আমাকে কি করতে হবে। আকুলভাবে এলেনা আবেদন করলাে।
রাইনিরি বলল, তাহলে শোেননা। ভালাে করে শােননা। আমি একটা চকচকে টিনের পাতে তােমার প্রেমিকের একটা প্রতীক মূর্তি এঁকে দেব আর তাতে প্রাচীন হিব্রুভাষায় কিছু মন্ত্র লিখে দেব। উলটো পিঠে ইটালিয় ভাষায় একটা মন্ত্র লেখা থাকবে। আগামীকাল গভীর রাতে আকাশে যখন চাঁদ উঠবে তখন তুমি কোনাে নির্জন স্থানে যাবে এবং সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে ঐ টিনের পাত হাতে নিয়ে নদীতে সাতবার ডুব দেবে। তারপর কাছাকাছি কোনাে উঁচু বাড়ির ছাদে উঠে উত্তর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ইটালি ভাষায় লেখা মন্ত্রটা সাতবার পাঠ করবে। অল্প পরে পরীর মতাে সুন্দরী দুটি কিশােরী এসে তােমাকে জিজ্ঞাসা করবে তুমি কি চাও। তুমি সব বলবে। তখন তারা তােমাকে আশীর্বাদ করে বাড়ি ফিরে যেতে বলবে। পরদিন রাতে তােমার প্রেমিক ফিরে আসবে। পারবে কি? কিন্তু ম্যাডাম আমার এমন কোনাে স্থান জানা নেই যেখানে নদীর কাছেই উঁচু কোনাে বাড়ি আছে। কিন্তু এমন স্থান রাইনিবির জানা ছিল এবং এলেনা যে সেইখানেই যাবে তাও রাইনিরি জানতে কিন্তু এলেনাকে বলে নি।
এলেনা বলল, শহরের বাইরে আরনাে নদীর ধারে তার একটা খামার আছে। সেখানে তার একটা বাড়িও আছে। কাছেই একটা উচু বাড়ি আছে। মাথায় একটা গম্বুজ ছিল কিন্তু গম্বুজটা এখন নেই তবে বেশ বড় ছাদ আছে। সবশেষ তলা থেকে ছাদে ওঠবার জন্যে একটা মই লাগানাে আছে। যেসব ছেলেরা ভেড়া চরায় তারা মাঝে মাঝে ছাদে উঠে হারানাে ভেড়া খােজে। আমার কোনাে অসুবিধে হবে না। এখন তাে জুলাই মাস, বেশ গরম। নদীতে স্নান করতে ভালােই লাগবে, আর কিছু না পরে থাকলেও শীত করবে না।
তাহলে তাে ভালােই হল। আমি তাহলে বাড়ি ফিরে টিনের পাতে যা লেখবার বা আঁকবার সেসব করে রাখবাে। কাল সকালে তােমার পরিচারিকাকে তােমার বাড়ির গেটে অপেক্ষা করতে বােলল। আমি ওটা ওর হাতে দিয়ে দেব।
এলেনা উল্লসিত। সে কল্পনা করতে লাগলাে তার প্রেমিক ফিরে এসেছে, সে তাকে জড়িয়ে ধরেছে। এরপর এলেনা রাইনিরিকে বলল, তুমি যা বললে আমি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।
পরদিন সকালে রাইনিরি টিনের একটি পাত পরিচারিকার হাতে দিল। তাতে সে কাল্পনিক একটা মও লিখে দিয়েছিল, যেটা এলেনা সাতবার পড়বে।
এলেনার খাবার ও গম্বুজ বাড়ি রাইনিরি উত্তমরূপে চিনত। ঐ খামারের কাছেই তার বন্ধুরও একটা খামার ছিল। সেখানে একটা ছােট বাড়িও ছিল। বন্ধুর কাছ থেকে রাইনিরি বাড়ির চাবি চেয়ে নিল। বলল, কোনাে কারণে সে ঐ বাড়িতে রাত্রিবাস করতে চায়। রাতের খাওয়া সেরে একজন ভৃত্য সঙ্গে নিয়ে রাইনিরি বন্ধুর সেই খামারবাড়িতে গেল।
গভীর রাতে আকাশে ভাঙা চাদ উঠতেই রাইনিরি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে সরু পথের ধারে কতকগুলাে উইলাে গাছের জটলার মধ্যে লুকিয়ে রইলাে। এই পথ দিয়ে এলেনাকে নাইতে যেতে হবে ও ফিরে এসে গম্বুজবাড়িতে উঠতে হবে।
ফিকে জ্যোৎস্না, মােটামুটি পথ দেখা যাচ্ছে কিন্তু রাইনিরি যেখানে লুকিয়ে আছে সেখানটা অন্ধকার, তাকে দেখা যাবে না। এলেনা বাড়ি থেকে বেরিয়ে নদীর দিকে চললাে, তার হাতে সেই টিনের পাত। পরিচারিকা তখন ঘুমােচ্ছে।
নদীর ধারে গিয়ে এলেনা একে একে তার সমস্ত পােশাক খুলে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে টিনের পাত বুকে চেপে ধরে নদীর জলে নামল। জ্যোৎস্নার আলােয় নদীর জল রূপালি, চিকচিক করছে। এলেনা সাতটা ডুব দিয়ে উঠে এলাে যেন এক ঝাক সাদা রজনীগন্ধা। একটু দাঁড়াল, চুল ও গায়ের জল ঝরে পড়ল। একটা ঝােপে যেখানে জামাকাপড় লুকিয়ে রেখেছিল দেখল ঠিক আছে।
এখন সে গম্বুজবাড়ির দিকে চললাে। যখন সে উইলাে গাছের কাছে এলাে তখন তার অতুলনীয় নগ্নরূপ দেখে রাইনিরির ইচ্ছা হল এলেনাকে জড়িয়ে ধরে কিন্তু অতি কষ্টে নিজেকে সংযত করলাে কারণ তাহলে তাে সব বানচাল হয়ে যাবে, প্রতিশােধ নেওয়া হবে না। এলেনাকে গম্বুজবাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে দেখল।
কিছুক্ষণ পরে রাইনিরিও গম্বুজবাড়িতে ঢুকলাে। এলেনা তখন মই বেয়ে ওপরের ছাদে উঠে উত্তর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে মন্ত্রপাঠ করছে। রাইনিরি দ্বিতীয় ছাদে মইটি নামিয়ে রেখে বন্ধুর বাড়িতে ফিরে এসে ভাের পর্যন্ত ঘুমিয়ে নিল। ভাের হতেই সে আবার গম্বুজবাড়িতে ফিরে গেল।
এলেনার সাতবার মন্ত্রপাঠ শেষ হল। মনে তার খুব আনন্দ এখনি পরীর মতাে সুন্দরী মেয়ে দুটি এসে তাকে প্রশ্ন করবে, তার মনস্কামনা পূর্ণ হবে। সে চুপ করে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। বেশ করে স্নান করে এসেছে, ঝিরঝির করে বাতাস বইছে, বেশ ঠাণ্ডা আমেজ। এলেনার চোখ জড়িয়ে এলাে। ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম যখন ভাঙল তখন পুব আকাশ বেশ ফর্সা হয়ে গেছে। ক্রমশ চারদিক বেশ পরিষ্কার হয়ে গেল। এলেনার ঘুম ভেঙে গেল পাখির ডাকে। সে ধড়মড় করে উঠে বসলাে। সকাল হয়ে গেল। কই সুন্দরী মেয়ে দুটি তাে এলাে না! রাইনিরি নিশ্চই তাকে ঠকিয়েছে। রাগে তার মুখ লাল হয়ে গেল।
মেষপালক ছেলেরা এখনও ভেড়া নিয়ে মাঠে আসে নি, এইসময় বাড়ি ফিরে যাওয়া যাক। নইলে তাকে নগ্ন অবস্থায় কেউ দেখে ফেললে লজ্জা ঢাকবার কোনাে উপায় থাকবে না। কিন্তু নামতে গিয়ে দেখল মই নেই। তার মনে হল পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেছে। সে প্রায় অজ্ঞান হয়ে শুয়ে পড়ল।
কিছু পরেই জ্ঞান ফিরে আসতে তার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে পড়ল। তার মনে পড়ল, ক্রিসমাসের রাত্রে সে রাইনিরিকে কী সাংঘাতিক সাজা দিয়েছিল এবং শীতের সে রাত্রি অনেক দীর্ঘ ছিল। বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারলাে রাইনিরি প্রতিশােধ নিল। তাকে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে সে চলে গেছে। সে সম্পূর্ণ নগ্ন, সাহায্যের জন্য কোনাে মানুষকে ডাকতে পারবে না। একমাত্র ভরসা তার পরিচারিকা যদি তাকে খুঁজতে খুঁজতে এদিকে আসে, কিন্তু পরিচারিকাকে তাে সে কিছুই বলে নি। ব্যাপারটা গােপন রেখেছিল।
সে আফশােস করতে লাগল। তার এই অবস্থার কথা জানতে পারলে তার ভায়েরা, আত্মীয়রা ও বন্ধুবান্ধব তাকে কী পরিমাণ বিদ্রুপই না করবে?
রাইনিরি তখন দেওয়াল ঘেঁসে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে তাই এলেনা তাকে দেখতে পায় নি। সূর্য অনেকটা উঠে পড়েছে, চারিদিকে রােদ ঝলমল করছে। দূরে চাষীরা ক্ষেতে কাজ করছে, ছেলেরা মেষ চরাচ্ছে। এলেনা বসে পড়ল যাতে তাকে কেউ দেখতে না পায়। ভাবতে লাগল রাইনিরি কি একবারও ফিরে আসবে না? এলেও তার সামনেই বা কি করে নিজের নগ্নরূপ দেখাবে? সে নীরবে চোখের জল ফেলতে লাগল। কেউ কি তাকে উদ্ধার করবে? নাকি বেলা বাড়ার সঙ্গে যখন রােদের তাপ বাড়বে ও ক্রমশ অসহ্য হবে তখন সেই রৌদ্রতাপে সে কি ঝলসে যাবে? তার ওপর যদি পােকা, মাছি আর বােলতা তাকে দংশন করে ?
সে উঠে দাঁড়িয়ে চারদিক একবার পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাে। যে ছেলেগুলাে মেষ চরাচ্ছে তাদের খ কেউ যদি মেষ খুঁজতে কাছে আসে বা বাড়িতে ঢুকে পড়ে তাহলে প্রাণ বাঁচতে পারে। প্রাণ আগে লজ্জা আগে?
ওপরে আওয়াজ শুনে রাইনিরি দেওয়াল থেকে ছাদের মাঝখানে সরে এসে এলেনাকে দেখতে পেয়ে “গুড মর্নিং ম্যাডাম বলে সম্বােধন করলাে।
এলেনা লজ্জা নিবারণ করবার জন্য ঝপ করে উপুড় হয়ে ছাদে শুয়ে গলা বাড়িয়ে বলল, রাইনিরি আর কেন? প্রতিশােধ তাে নিয়েছ, আমি চূড়ান্তভাবে অপমানিত ও ক্ষুব্ধ। এলেনার চোখে জল এসে গেল, কাদতে কাঁদতে বলল, জোড় হাত করে বলছি, দয়া করে আমাকে ছেড়ে দাও। তুমি বিদ্বান, বুদ্ধিমান এবং একজন ভদ্র ব্যক্তি। একজন নারীকে এমন অসহায় অবস্থায় ফেলে রাখা কি উচিত? আমি এখন বুঝতে পারছি সেদিন আমি তােমার সঙ্গে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করেছি, তােমার সঙ্গে বঞ্চনা করেছি। ভগবানের দোহাই আমাকে ছেড়ে দাও, তােমাকে আমি আমার সর্বস্ব দেব। বলতে বলতে এলেনা ফুপিয়ে কেঁদে উঠল।
এলেনা তুমি তাহলে এখন উপলব্ধি করতে পারছে যে, সে রাত্রে তুমি আমাকে কত কষ্ট দিয়েছ ও অপমানিত করেছ। আমার ওপর বােধহয় ঈশ্বরের দয়া আছে তাই আমি প্রাণে বেঁচে গেছি। তুমি যে আমাকে কী পরিমাণ কষ্ট দিয়েছ তা বুঝতে হলে তােমাকে আরও কিছু সময় ছাদে থাকতে হবে। রােদের জ্বালা আরও স্পর্শ করতে হবে। তােমাদের কোমল ত্বক রােদ সহ্য করতে পারে না জানি কিন্তু উপায় নেই। তুমি আমায় সর্বস্ব দিলে কি হবে? তােমার মতাে শয়তানীর প্রতি আমার কোনাে লােভ নেই। তােমাকে যদি আমি এখন মুক্ত করি তাহলে তুমি প্রথম সুযােগেই আমার ওপর শােধ তােলবার চেষ্টা করবে। আরও কিছুক্ষণ থাক, কতক্ষণ জানি না, রৌদ্রতাপ কেমন ভালাে লাগে দেখ, তারপর আমি কেসময়ে মই লাগিয়ে দিয়ে যাব। তারপর তুমি ছাদ থেকে নেমে যেখানে ইচ্ছা যেয়াে।
সেকি? আমি কি এইরকম উলঙ্গ হয়ে যাবাে নাকি?
তা আমি কি জানি? তুমি কি আমাকে দরজা খুলে আশ্রয় দিয়েছিলে? মনে নেই? তােমার সঙ্গে একজন বারবণিতার তফাৎ নেই। আমি এখন চললুম।
যেয়াে না, শােননা রাইনিরি! যাবার সময় আমার খামারবাড়িতে আমার পরিচারিকাকে বলে যাও। নদীর ধারে ঝােপে আমার কাপড়চোপড় আছে, সেগুলাে নিয়ে যেন আসে। আমার জন্যে কি তােমার একটুও কষ্ট হচ্ছে না, তুমি এত নিষ্ঠুর? | হ্যা আমি তাই। আমি দেখতে চাই একদিনের রােদের তাপে তােমার ঐ রূপ কি পরিমাণ কুরূপ হবে। মুখখানা পুড়ে কালাে হয়ে যাবে। সারা অঙ্গ ঝলসে যাবে, ফোসকা পড়বে। পােকা দংশন করবে, রক্ত ঝড়ে পড়বে, তৃষ্ণার গলা শুকিয়ে যাবে, কথা বলতে পারবে না।
আর বােলাে না রাইনিরি, শুধু একটি প্রার্থনা আমাকে দয়া করাে। এলেনা ডুকরে কেঁদে উঠল।
এলেনা তুমি শুধু রূপসর্বস্ব এবং মূখ। আমি যদি যাদুবিদ্যা ও তন্ত্রমন্ত্র জানতুম তাহলে তা প্রয়ােগ করে তােমাকে কবে বশ করতুম। এটুকু তােমার মাথায় এলাে না। আমি এখন যাচ্ছি, তােমার জামাকাপড় ঠিক কোথায় আছে বলাে। এলেনা ভাবল রাইনিরির বুঝি দয়া হয়েছে। নদীর ধারে কোনখানে কোন ঝােপে তার জামাকাপড় আছে তা চোখ মুছতে মুছতে বলে দিল।
রাইনিরি তার বন্ধুর বাসায় ফিরে তার ভৃত্যকে গম্বুজবাড়িতে পাহারা দিতে পাঠিয়ে দিল। তাকে বলে দিল কাউকে যেন বাড়িতে কিছুতেই ঢুকতে না দেয়। তারপর নিজে স্নান করে খাওয়াদাওয়া সেরে দিবানিদ্রা ভােগ করতে লাগল। গতরাত্রি প্রায় জেগেই কাটাতে হয়েছে।
এলেনা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাে, কিন্তু কেউ এলাে না। এদিকে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রােদের তাপ বাড়ছে, ছাদ গরম হচ্ছে, আর একটু পরে পা রাখা যাবে না। যারা ক্ষেতে কাজ করছিল তারা খাওয়াদাওয়া সারতে ঘরে ফিরে গেছে। দু’-তিনটে মেষপালক ছােকরাকে দূরে দেখা যাচ্ছে। যন্ত্রণায় কাতর হয়ে এবং প্রাণের দায়ে লজ্জা বিসর্জন দিয়ে এলেনা উঠে দাঁড়িয়ে ওদের ডাকাডাকি আরম্ভ করলাে। গলা তখনই শুকিয়ে গেছে, জোরে চিৎকার করতে পারলাে না, ওর ক্ষীণকণ্ঠ কেউ শুনতে পেল না। নদীটা ওর চোখে পড়ল। পারলে এখনি ছুটে গিয়ে নদীর শীতল জলে গা ডুবিয়ে বসে থাকতাে। কোনাে উপায় নেই। রােদে পুড়ে, তৃষ্ণার কাতর হয়ে মরতে হবে। পােকার দল তার গায়ে বসতে আরম্ভ করেছে। হা ভগবান! রাইনিরিকে অপদস্থ করে প্রেমিককে সন্তুষ্ট করবার মূখতা তার কেন হল? আর সেই প্রেমিকও তাে তাকে ছেড়ে চলে গেল। তার জন্যই আজ জীবন সংশয়। যদিও বা সে এখান থেকে মুক্তি পায় তাহলে কি রৌদ্রতাপে দগ্ধ হবার পর তার রূপ ফিরে পাবে। কতদিন যন্ত্রণা ভােগ করতে হবে কে জানে।
সূর্য যখন মধ্যগগনে উঠল তখন তাপ অসহ্য। ছাদ এত গরম হয়েছে পা রাখা যাচ্ছে না। এলেনার মনে হল তাকে কেউ উনুনের ওপর তপ্ত কটাহে ফেলে ভাজা ভাজা করছে। তারপর বিষাক্ত কীটের দংশনের যন্ত্রণা। ছাদ এত তেতে গেল যে, তার দেহের অনেক অংশে ফোসকা পড়ে গেল। গলা শুকিয়ে গেছে। চোখের জল জিভ দিয়ে চাটবার চেষ্টা করলাে কিন্তু তাতে কিছুই হল না। ছাদের ওপরেই মৃতবৎ পড়ে রইল। গলা দিয়ে অদ্ভুত আর একঘেয়ে এক কাতরধ্বনি।
সন্ধ্যা আগত। রাইনিরি ভাবলাে যথেষ্ট হয়েছে, এবার এলেনার খবর নেওয়া যাক। সে আগে সেই ঝোপের ধারে গিয়ে এলেনার ড্রেস উদ্ধার করে তার ভৃত্যের হাতে দিল। তারপর খামারবাড়ির বাসায় এসে পরিচারিকাকে ডাকল। জিজ্ঞাসা করলাে, তােমার দিদিমণি কোথায়? কোনাে খবর জানাে?
-না রাইনিরি, অনেক চেষ্টা করেও অনেক খুঁজে এখনও পর্যন্ত দিদির কোনাে খবর আমি পাই নি। বাড়িতেও ফিরে যান নি। কাল রাত্রে তাে আমরা একসঙ্গে শুয়েছিলুম, সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখছি তিনি নেই কিন্তু মনে হচ্ছে আপনি তার খবর জানেন। | জানি তাে। তােমার মনে আছে ক্রিসমাসের প্রচণ্ড শীতের রাত্রে তুমি আর তােমার দিদিমণি। আমাকে কি ভীষণ কষ্ট দিয়েছিলে? আমার অসহায় অবস্থা দেখে তােমরা আর তােমার দিদির নাগর আড়ালে হাসাহাসি করেছিলে? মনে আছে তাে? মনে তাে থাকবেই। আমি আজ তার চরম প্রতিশােধ নিয়েছি। তুমিও পালাতে পারবে না, তােমাকেও এমন সাজা দেব যে জীবনে ভুলবে না। আর কিছু না পারি তােমার নাক ও কান আমি কেটে দেব।
রাইনিরি তার ভৃত্যকে ইশারা করতে সে পােশাকের বাণ্ডিলটা পরিচারিকাকে দিল। পরিচারিকা তাে পোশাক দেখেই চিনতে পেরে ভয় পেয়ে গেল। দিদিমণিকে উলঙ্গ করে কোথায় ফেলে এলে? তাকে কি করেছ নাকি? এমন অত্যাচার করেছ যে মরেই গেছে? পরিচারিকা কেঁদে ফেলল। রাইনিরি বলল, ঐ গম্বুজবাড়ির ছাদে গিয়ে দেখ তােমার বেশ্যা দিদি পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে। এখনও বেঁচে আছে কিনা জানি না, বলে রাইনিরি চলে গেল।
রাইনিরি যখন চলে গেল ঠিক সেই সময়ে একটা ছােকরা ভেড়া খুঁজতে খুঁজতে গম্বুজবাড়িতে এসে ওপরে উঠল। ছাদে উঠে শুনতে পেল ওপরের ছাদে কে যেন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। এলেনার গলা ছােকরা নিত কারণ সে তার খামারবাড়ির এক প্রান্তে ঘর বেঁধে থাকতাে।
এলেনা তাকে বলল, আমি ম্যাডােনা এলেনা। তুই ছুটে আমার বাসায় গিয়ে পরিচারিকাকে কোন ডেস নিয়ে এখনি আসতে বল। তুই ওপরে উঠিস না…।
কথাগুলাে বলতে তার খুবই কষ্ট হচ্ছিল। ম্যাডােনার কোনাে বিপদ হয়েছে অনুমান করে ছােকরা মাড়ােনা কি বিপদে পড়েছে একবার দেখে নেওয়া দরকার। সে মইটা যখন তুলতে যাচ্ছে ঠিক তখনি পরিচারিকা হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এলাে।
পরিচারিকাকে দেখে ছােকরা বলল, তােমার কী ঠাকুরানি ছাদে রয়েছে, আমি নামাতে যাচ্ছিলুম।
পরিচারিকা বলল, তুই উঠিস না। আগে তুই মই লাগিয়ে দে, আমি ওঁকে ড্রেস পরিয়ে দিই। দেখি কি অবস্থায় আছে? বেঁচে আছে এই আমার ভাগ্য। পরিচারিকার গলায় আওয়াজ পেয়ে এলেনা জিজ্ঞাসা করলাে, আমার ড্রেস এনেছিস? এনেছি, আমি ড্রেস নিয়ে ওপরে যাচ্ছি, পরিচারিকা বলল। মই বেয়ে ছাদে উঠে দিদিমণির অবস্থা দেখে পরিচারিকা কেঁদে ফেলল। যাই হােক ড্রেস তাে পরানাে হল কিন্তু এলেনা কোনাে রকমে উঠে বসেছে, দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। কি করে নামবে? তখন ঐ ছােকরা। ছাদে উঠে এলেনাকে কাঁধে তুলে মই বেয়ে নিচে নেমে গম্বুজবাড়ির বাইরে এনে নরম ঘাসের ওপর শুইয়ে দিল। ওদিকে পরিচারিকা তাড়াহুড়াে করে মই বেয়ে নামতে গিয়ে এমনভাবে পড়ল যে তার উরুর হাড় ভেঙে গেল। যন্ত্রণায় সে কঁদতে লাগল।
এলেনার জিভ ফুলে গেছে। ভালাে করে কথা বলতে পারছিল না। কোনােরকমে বলল, জল, গলা শুকিয়ে গেছে।
ছােকরা বলল, আমি দেখে আসি আপনার পরিচারিকার কি হল, ও ভীষণ কাঁদছে। পরিচারিকার অবস্থা দেখে ছােকরা তাকেও কাঁধে তুলে এনে তার কত্রীর পাশে ঘাসের ওপর শুইয়ে দিল। তারপর সে তার নিজের বাড়িতে গিয়ে তার দুই ভাই, মা, বােন ও বৌকে ডেকে আনল। অন্ধকার হবার আগেই সে আগে এলেনাকে কাঁধে তুলে তার ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর পরিচারিকাকে তক্তার ওপর শুইয়ে ভায়েদের সহায়তায় তাকেও ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল।
ইতিমধ্যে ছােকরার মা বােন এলেনাকে একটু একটু করে ঠাণ্ডা জল খাইয়ে তার তৃষ্ণা নিবারণ করে পরে লেবুর সরবত খাইয়ে তাকে কিছু সুস্থ করলাে।
পরদিন দু’জনকে ফ্লোরেন্সের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হল। এলেনার ভায়েরা ও আত্মীয়রা খবর পেয়ে তাকে দেখতে এলাে। সে মিথ্যা কথা বলল, এটা নাকি কোনাে প্রেতাত্মার কাজ। সে তার খামারবাড়ি তদারক করতে গিয়েছিল। রাত্রে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙতে দেখে সে গম্বুজের ছাদে একা পড়ে আছে।
চিকিৎসক এলাে। তার দেহে বিশেষভাবে তৈরি তেল মাখানাে হল। এক পরত ত্বক উঠে গেল। ক্ষতস্থানগুলিতে মলম লাগিয়ে দেওয়া হল। পরিচারিকারও হাড় জুড়ে দেওয়া হল। দু’জনেরই সুস্থ হয়ে উঠতে বেশ কিছুদিন সময় লাগল।
এলেনা তার প্রেমিকাকে ফিরিয়ে আনার আর কোনাে চেষ্টা করেনি। তার উচিত শিক্ষা হয়েছে। সে আর কাউকে ঠকাবার চেষ্টা করেনি, কারও সঙ্গে ছলনাও করেনি। আর কারও প্রেমে পড়বার চিন্তাও করেনি।
রাইনিরি স্থির করেছিল পরিচারিকাকেও সাজা দেবে কিন্তু যখন শুনল তার উরুভঙ্গ হয়েছে তখন মনে মনে বলল, সাজা তাে পেয়েই গেছে, আরও সাজা দেবার দরকার কি?
গল্প শেষ করে প্যামপিনিয়া সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল, দেখলে তাে ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়। অতএব সাবধান, কারও সঙ্গে ছলনা না করাই ভালাে।
অষ্টম গল্প
দুই বন্ধুর গল্প। এক বন্ধু অপর বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে রমণে লিপ্ত হল। বন্ধু জানতে পারলাে। তখন সে ঐ বন্ধুর স্ত্রীকে দিয়ে স্বামীকে কাঠের সিন্ধুকে বন্ধ রাখলাে। তারপর নিজে ঐ বন্ধুপত্নীকে রমণ করলাে। সিন্দুকে বন্দী বন্ধু সবই টের পেল।
সকলে গল্প শুনে এলেনার প্রতি সমবেদনা প্রকাশ না করলেও মন্তব্য করলাে রাইনিরি যখন রীতিমতাে শিক্ষিত ও ভদ্র, তখন প্রতিশােধ নেবার জন্যে এতটা নিষ্ঠুর না হলেও পারতাে। কুইন ফিয়ামমেত্তাকে গল্প বলতে লাগল।
ফিয়ামমেত্তা বলল, তােমরা তাে একটা নিষ্ঠুর বঞ্চনা ও কঠোর প্রতিশােধের গল্প শুনলে। এবার আমিও প্রতিশােধ নেওয়ারই একটা গল্প বলছি শােনাে, খুব মজা লাগবে। দুই বন্ধু কি করে পরস্পরের দাঁত তুলে নিল অথচ কেউ কষ্ট পেল না বরঞ্চ তাদের বন্ধুত্ব আরও ঘনিষ্ঠ হল। তাহলে গল্প আরম্ভ করি :
সিয়েনা শহরে বনেদী বংশের দুই বন্ধু বাস করতাে। দু’জনেই সুদর্শন, অর্থবান ও আচার আচরণে ভদ্র। দুজনে গলায় গলায় ভাব। প্রথম বন্ধুর নাম স্পিনেলােচিও ট্যাভেনা আর দ্বিতীয় বন্ধুর নাম জেলা ডাই মাইননা। ওরা পাশাপাশি দুই বাড়িতে বাস করতাে। ওরা দু’জনে একসঙ্গে ঘােরাফেরা করতে, দেখে মনে হতাে ওরা যেন দুই সহােদর ভাই। দুই বন্ধুই দুটি সুন্দরী যুবতীকে বিয়ে করে পরমানন্দে দিন ও রাত্রি অতিবাহিত করছিল।
স্পিনেলােচিও তার বন্ধু জেপার বাড়িতে অনেকটা সময় কাটাতাে। তার কাজের জন্যে জেপাকে এক একদিন দিনের বা রাত্রের বেশির ভাগ সময় বাইরে কাটাতে হতাে। জেপার বাড়িতে এই অনেকটা সময় থাকার ফলে পিনেলােচিওর বৌয়ের সঙ্গে তার খুব ভাব হয়ে গেল এবং অচিরে তারা প্রেমিক-প্রেমিকা হল। তবে তারা ধরা পড়ে গিয়েছিল শেষ পর্যন্ত।
তর কি একদিন জেপা বাড়ি থেকে বেরােতে গিয়েও বেরলাে না। কিন্তু তার স্ত্রী জানতে পারল না তারণ জেপা বাড়ির অন্য এক অংশে একটা ঘরে বসে কিছু হিসেবনিকেশের কাজ করছিল।
স্পিনেলােচিও জেপার বাড়িতে এসে তাকে দেখতে পেল না আর জেপার বৌও বলল যে স্বামী। বেরিয়ে গেছে। জেলা কিন্তু তার ঘরে বসে স্পিনেলােচিওকে দেখতে পেয়েছিল।
স্পিনেলােচিও এই সুসংবাদ শুনে তখনি জেপার বৌকে জড়িয়ে ধরে চুম্বনে চুম্বনে অস্থির করে তললাে। ওর কি গল্প করে তা গােপনে শােনবার জন্যে ঘর ছেড়ে পা টিপে টিপে এক জায়গায় এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে ওদের দেখতে লাগল। সে দেখল তার বৌ তাকে যেমনভাবে চুম্বন করে এখন ঠিক সেইভাবে তার বন্ধু স্পিনেলােচিওকে চুম্বন করছে। তারপর দেখল ওরা জড়াজড়ি করে চুম্বন করতে করতে শয়নঘরে গিয়ে ঢুকে খাটে শুয়ে পড়ল। তার বৌ বন্ধুকে বুকের ওপর তুলে নিল। জেপা আড়ালে থেকে সবই দেখল।
পরস্ত্রীকে রীতিমতাে উপভােগ করে স্পিনেলােচিও তার বাড়িতে ফিরে গেল। জেপ চতুর ও বুদ্ধিমান। সে স্থির করলাে এর প্রতিশােধ নেবে কিন্তু কোনােরকম সােরগােল করবে না।
জেপা তার স্ত্রীর ঘরে ঢুকলাে। তার চুল এলােমেলাে হয়ে গিয়েছিল, সে তখন তার চুল আঁচড়াচ্ছিল। জেপা জিজ্ঞাসা করলাে, কি গাে সুন্দরী চুল আঁচড়াচ্ছ? তার আগে যা করছিলে তাও দেখেছি, যদিও তা আমি না দেখলেই ভালাে ছিল।
জেপা বৌকে বকাবকি করলাে। বৌ তখন কেঁদে ফেলেছে, ভয়ে। এড়াবার উপায় নেই কারণ জেপা সবই দেখেছে। সে ক্ষমা ভিক্ষা করলাে।
জেপা বলল, আমি তােমাকে ক্ষমা করতে পারি কিন্তু আমি যা বলবাে তােমাকে তাই করতে হবে। আমি কাল সকালে স্পিনেলােচিওকে নিয়ে বেড়ােব। তুমি স্পিনেলােচিওকে শিখিয়ে দেবে সে যেন কোনাে ছুতাে করে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সােজা তােমার কাছে চলে আসে। আমিও কিছুক্ষণ পরে ফিরব। আমাকে ফিরতে দেখেই তুমি স্পিনেলােচিওকে এই কাঠের সিন্দুকটার ভেতরে লুকিয়ে থাকতে বলবে। তারপর তােমাকে কি করতে হবে আমি পরে বলবাে। তােমার ভয় পাওয়ার কোনাে কারণ নেই। আমি আমার অভিন্নহৃদয় বন্ধু স্পিনেলােচিওর কোনাে ক্ষতি করবাে না, তােমাকে আমি কথা দিচ্ছি।
জেপার বৌ তার স্বামীর কথায় রাজি হল এবং বলল সে তার কথানুসারে সব কিছু করবে। পরে পিনেলােচিও যখন তার বাড়িতে এলাে জেপার বৌ তাকে বলে রাখল তার স্বামী যা বলতে বলেছিল কিন্তু সে যে ধরা পড়ে গেছে সেকথা অবশ্যই গােপন রাখলাে।
পরদিন সকালে স্পিনেলােচিওকে নিয়ে জেপা বেরলাে। কিছুক্ষণ পরে জেপার বৌয়ের পরামর্শমতাে পিনেলােচিও বললাে, এক বন্ধুর বাড়িতে আমার ব্রেকফাস্টের নিমন্ত্রণ আছে, আমি ভাই চললুম।
জেপা বলল, ঠিক আছে তুমি যাও তােমাকে আটকাব না তবে তুমি আমার সঙ্গে থাকলে ভালাে হতাে।
জেপার কাছ বিদায় নিয়ে স্পিনেলােচিও যত তারাতারি এসে তার বৌকে জড়িয়ে ধরলাে কিন্তু তারা পরস্পরের সুখ বেশিক্ষণ উপভােগ করতে পারলাে না কারণ জেলা ফিরে এলাে।
স্বামী ফিরে আসার আওয়াজ পেয়েই জেপার বৌ যেন খুব ভয় পেয়ে গেল। সে স্পিনেলােচিওকে বলল, তুমি এই সিন্দুকটার ভেতরে ঢুকে পড়। ওটা বেশ বড়, খালিও আছে, তােমার অসুবিধে হবে না। সুযােগ পেলেই তােমাকে আমি বার করে দেব।
জেলা ওপরে উঠে এসে তার স্ত্রী ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলাে, ব্রেকফাস্ট রেডি তাে? স্পিনেলােচিওর বুঝি তার কোনাে বন্ধুর বাড়িতে ব্রেকফাস্টের নিমন্ত্রণ আছে, সে চলে গেল। তুমি একটা কাজ করাে। ওর বৌ বাড়িতে একা আছে, ওকে ডাক, আমরা একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট করবাে।
স্পিনেলােচিওর বৌ যখন শুনল তার স্বামী ব্রেকফাস্ট খেতে বাড়ি আসবে না, তখন সে আসতে রাজি হল কিন্তু মনে একটু অভিমান রয়ে গেল। তার স্বামী যে আজ তার সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করবে না সেকথা তাকে বলে গেল না কিন্তু পাশের বাড়ির লােকেদের বলে গেল! এটা কিরকম হল। তার মনে ক্ষোভ রয়ে গেল।
স্পিনেলােচিওর বৌ তাদের বাড়িতে আসতেই জেপা যেন উল্লাসে ফেটে পড়ল। যতদূর পারল তার অনেক প্রশংসা করে সাদরে আহ্বান জানিয়ে তার হাত ধরে তাকে সােজা তার শয়নঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে খিল তুলে দিল। তার আগে নিজের বৌকে রান্নাঘরে যাবার জন্য ফিসফিস করে বলে দিয়েছে।
দরজায় খিল দিতে দেখে স্পিনেলােচিওর বৌ সভয়ে জিজ্ঞাসা করলাে, ওকি জেপা দরজা বন্ধ করে দিলে কেন? তােমার বুঝি কোনাে কুমতলব আছে তাই ছল করে আমাকে ডেকে আনলে। তুমি তাে স্পিনেলােচিওকে নিজের ভায়ের মতাে ভালবাস, তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করবে?
জেপা যুবতী সুন্দরীর কোমর জড়িয়ে ধরে তাকে নিয়ে সেই সিন্দুকের কাছে গিয়ে দাঁড়াল যাতে বন্দী স্পিনেলােচিও তাদের সব কথা শুনতে পায়।
জেপা বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। বন্ধুপত্নীকে বাগে পেয়ে, তার সঙ্গে প্রেম করা মানে বন্ধুর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা। আমিও সেকথা মানি। তােমার স্বামী স্পিনেলােচিওকে আমি আমার নিজের ভাই মনে করি ও সেই রকম ভালবাসি কিন্তু গতকাল আমি নিজের চোখে দেখলুম তােমার স্বামী তােমার সঙ্গে যেভাবে সহবাস করে ঠিক সেইভাবে আমার স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করছে। যেহেতু আমি আমার বন্ধুকে ভালবাসি এবং শারীরিক আঘাত ঘটিয়ে প্রতিশােধ নিতে চাই না, তাই আমি ঠিক করেছি তােমার সঙ্গে সহবাস করে আমি এর শােধ তুলবাে। তবে তুমি যদি রাজি না হও তাহলে বন্ধুবিচ্ছেদ হবেই এবং আমি তােমাদের জীবন বিষময় করে তুলবাে।
স্পিনেলােচিওর বৌ জেপাকে কয়েকটি প্রশ্ন করে নিশ্চিন্ত হল যে জেপা সত্যি কথাই বলছে। তখন সে বলল, কিন্তু একটা কথা আছে জেপা, তােমরা দুজনে যেমন বন্ধু তেমনি আমি ও তােমার বৌ আমরা দু’জনে সখি। কথা হল যে তুমি আমার সঙ্গে সহবাস করলে তােমার বৌ যদি রাগ করে তাহলে? আমি কিছু মনে করবাে না কিন্তু তােমার বৌ আমার ওপর চড়াও হয় যদি?
জেপা বলল, সেটা আমি অবশ্যই দেখব তবে আমি আমার বৌকে চিনি। সে যে কাজ করেছে আমিও সেই কাজ করলে সে কিছু মনে করবে না। তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারে। আর শােনাে আজই আমি তােমাকে একটি রত্ন উপহার দেব।
কথা শেষ করে জেলা স্পিনেলােচিওর বৌকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করতে লাগল। সে বাধা দিল না।
সে নিজেই সেই সিন্দুকের ওপর শুয়ে জেপাকে বুকের ওপর তুলে নিল।
সিন্দুক-বন্দী স্পিনেলােচিও সবই শুনল। তার বন্ধুর কথা যেমন শুনল তার বৌয়ের কথা শুনে মানসিক যন্ত্রণা ভােগ করতে লাগল। আফশােসও করতে লাগল। ভাবতে লাগল সে কেন বন্ধুর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে এমন কুকর্ম করলাে। তার ইচ্ছে হল সে এখনি তার বৌকে প্রহার করে কিন্তু উপায় নেই, তারই বুকের ওপর দুজনে তাে জড়াজড়ি করে শুয়ে রমণে মগ্ন। অবশ্য জেপাকে সে ভয় করে। একটু পরে উপলব্ধি করলাে, দোষ তাে তার নিজের। এমন কুকর্ম না করলে এমন ঘটনা ঘটতাে
জেপা ঠিকই করেছে। বন্ধুভাবেই সে প্রতিশােধ নিয়েছে। নাঃ এবার থেকে ওরা দুই বন্ধু আরও ঘনিষ্ঠ হবে।
পরিপূর্ণভাবে তৃপ্ত হয়ে জেপা সিন্দুক থেকে উঠল। মেয়ে কিন্তু রত্নর কথা ভােলে নি। বলল, কৈ রত্ন কৈ, দাও?
দরজা খুলে জেপা তার বৌকে ঘরে ঢাকল। বৌ ঘরে এসে স্বামীকে বলল, আমার বলার কিছু নেই। তুমি পাল্টা প্রতিশােধ নিয়েছ। আমি যদি পরপুরুষকে দেহদান করতে পারি তবে তুমিই বা পরস্ত্রীকে উপভােগ করবে না কেন? যাক শােধবোেধ হয়ে গেল, বলে সে হাসতে লাগল।
জেপা তার বৌকে বলল, সিন্দুকের ডালা তুমিই বন্ধ করেছিলে তুমিই খােলো।
সিন্দুকের ডালা খুলতেই স্পিনেলােচিওর বৌ তার স্বামীকে দেখে অবাক হল। জেপা বলল, আমার বৌয়ের কীর্তি আমি নিজের চোখে দেখেছি কিন্তু স্পিনেলােচিও নিজের চোখে না দেখলেও রীতিমতাে অনুভব করেছে, কি বললা?
জেপা মুখ ফিরিয়ে স্পিনেলােচিওর বউকে বলল, এই তােমার রত্ন, ওকে সিন্দুক থেকে বেরােতে সাহায্য করাে।
স্পিনেলােচিও সিন্দুক থেকে বেরিয়ে এসে বলল, জেপা তােমার বৌ ঠিক কথাটাই বলেছে। শােধবােধ হয়ে গেল অতএব এবার থেকে আমরা চারজনই আরও ঘনিষ্ঠ হবো। আমাদের মধ্যে গােপন কিছুই রইলাে না এবং আমাদের দুই পরিবারের সব জিনিসই আমরা নিজের মনে করি তেমনি আমাদের দু’জনের স্ত্রীকেও আমরা, আর পরস্ত্রী মনে করবাে না।
এরপর ওরা চারজনে একত্রে বসে ব্রেকফাস্ট সমাধা করলাে। সেদিন থেকে দুই স্বামীরই লাভ হল। দুই বৌ পেল দুই স্বামী।
নবম গল্প
ব্রুনাে আর বুফালমাচো এত ফুর্তিবাজ হল কি করে? ব্যাপারটা জানবার জন্যে সিমােন নামে একজন বৈদ্য আগ্রহী হল। দুই বন্ধু একদিন রাত্রে বৈদ্যকে এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে নােংরা জল কাদা ভর্তি একটা খানায় ফেলে দিল।
ফিয়ামমেত্তার গল্প শুনে তার বান্ধবীরা খুব হাসাহাসি করলাে। বলল তাের পেটে এতও আছে? দারুণ গল্প, বেশ জমিয়ে বলেছিস কিন্তু। কুইন বলল,এই সব হাসি বন্ধ করাে। পরের গল্পের জন্যে একটু হাসি রেখে দাও। এবার ডায়ােনিও গল্প বলবে এবং হাসির গল্প নিশ্চই।
ডায়ােনিও বলল, তাহলে গল্পটা তােমরা উপভােগ করলে। ভালােই হয়েছে। স্পিনেলােচিও এবং জেপার বৌ দু’জনেই বােধহয় নিজেদের খুব চালাক ভেবেছিল। অন্যজনের স্বামী বা বৌ টের পাবে না কিন্তু জেপাও কম চতুর ও বুদ্ধিমান নয়, সে সাপও মারলাে লাঠি ভাঙল না। তা আমাদের পুরনাে দুই বন্ধু ব্রুনাে আর বুফালমাচোর দুষ্টুমির কথা বলে শেষ করা যায় না। ওর দু’জনে একজন নিরীহ গােবেচারা বৈদ্যকে কেমন ধোকা দিল তারই গল্প শােনাে।
আমাদের এখানে যত বিচারক, আইনজীবী বা বৈদ্য আসে তারা প্রায় সকলেই বলােনা থেকে আসে। তাদের রঙিন শাড়ি ও জড়ি বসানাে পােশাকের ঘটা আর জেল্লা খুব কিন্তু তাদের পােশাকের যত বাহার, বুদ্ধির তত বাহার নেই। তাই ওরা ব্রুনােবা বুফালমাচোর মতাে ধড়িবাজদের পাল্লায় পড়লে জব্দ হয়। সিমােন ডা ভিলা ছিল এমনই একজন বৈদ্য। তার যত না বিদ্যা, জাহির করবার চেষ্টা করতাে তার চেয়ে বেশি।
টকটকে লাল একটা রােব গায়ে আর মাথায় কানঢাকা জমকালাে একটা টুপি পরে সে একদিন ফ্লোরেন্সে হাজির হল। তারপর বৈদ্যের পেশা চালাবার উদ্দেশ্যে ভিয়া ডেল কোচোমেরাে রাস্তায় একটা বাসা ভাড়া করে বেশ জাঁকিয়ে বসলাে। বাসার সামনে সাজিয়ে-গুজিয়ে দোকানও খুলল।
দোকানের সামনের রাস্তা দিয়ে কত লােক যাওয়া আসা করে। কাউকে দেখে তার কৌতূহল হলে তখনি সে তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নিত। শহরে নতুন এসেছে অতএব মানুষজনের পরিচয় জেনে নেওয়া অন্যায় কিছু নয়। তাছাড়া সিমােন মনে করতাে ঐ লােক যদি কোনােদিন তার রােগী হয়ে আসে তার পরিচয় জানা থাকলে চিকিৎসা করার সুবিধা হবে।
অনেক লােকের মধ্যে দুই পেন্টার বন্ধু ব্রুনাে আর বুফালমাচো সিমােনের কৌতুহল বিশেষভাবে উদ্রেক করলাে। এই দু’জন যুবক বেশ মজায় আছে, কোনাে ভাবনাচিন্তা নেই। সর্বদা হাসিখুশি, ফুর্তিবাজ, কাল কি হবে সে বিষয়ে চিন্তা নেই অথচ পকেটে একটাও মুদ্রা নেই। | সিমােন তাই ভাবে এদের কোনাে স্থায়ী বা নিয়মিত আয় নেই ওরা চালায় কি করে ? ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে রহস্যটা জেনে নিলে হয়। দু’জনের সঙ্গেই বন্ধুত্ব করলে ভালাে হয় নইলে একজনের সঙ্গে হলেও চলবে।
সিমােনার সঙ্গে একদিন ব্রুনাের আলাপ হল। ব্রুনাে তার সঙ্গে আলাপ করার আগে তাকে বাইরে দেখে বা শুনে বুঝেছিল যে বৈদ্য মানুষটির মাথায় কিছু নেই, গােলা।
বৈদ্যমশাই ব্রুনােকে ব্রেকফাস্টে নিমন্ত্রণ করলাে। আহার করতে করতে বলল, তােমাদের দুই বন্ধুকে দেখে তাে মনে হয় তােমাদের কোনাে আয় নেই এবং তােমরা বেকার। তা তােমরা এত ফুর্তিতে আছ কি করে?
ব্রুনাে এমনভাবে হাে হাে করে হেসে উঠল যে বৈদ্যমশাই তাে অপ্রস্তুত। এটা আবার একটা প্রশ্ন নাকি? হাসি থামিয়ে ব্রুনাে বলল, শােনন তাহলে, আমাদের রহস্য আমরা কাউকে বলি না তবেতুমি আমার বন্ধু তাই তােমাকে বলছি। আমরা দু’জনে পেন্টার, ছবি আঁকি। যা আয় হয় তাতে আমাদের পেট ভরে না তবুও রােজই ভালােমন্দ খাই। না আমরা চুরি বা কর্জ করি না, আমরা স্রেফ স্রোতে গা ভাসিয়ে দিই। তাতেই আমাদের দিব্যি চলে যাচ্ছে। বেশ মজায় আছি।
গােলা বৈদ্য তাে ব্রুনাের কথা বুঝল না। স্রোতে গা ভাসিয়ে দিব্যি চলে যাচ্ছে সেটা কি করে হয়। বলল, না ভাই তােমার কথা বুঝলুম না, একটু খুলে বলাে। তােমা রহস্য আমি কাউকে বলবাে না।
ব্রুনাে বলল আরে সর্বনাশ। আমাদের রহস্য ফাঁস হয়ে গেলে আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। না ভাই ঐ অনুরােধটি করাে না। তবে তুমি যদিন মন্টিসােনা ক্রসের নামে শপথ করাে তাহলে আমি ভেবে দেখতে পারি।
একথা শুনেই সিমােন বৈদ্য তৎক্ষণাৎ শপথ করলাে। ব্রুনাে বলল, এবার আমি তােমাকে রহস্যটা বলতে পারি। তাহলে মন দিয়ে শােনাে। অনেকদিন আগে আমাদের এই শহরে মাইকেল স্কট নামে স্কটল্যাণ্ড থেকে একজন অদ্ভুত মানুষ এসেছিল। তার একটু দুর্লভ গুণ ছিল। সে ভূতদের সঙ্গে কথা বলতাে, ভূত নামাতে পারতাে, এমনকি ভূতদের দিয়ে অনেক কাজ করিয়ে নিতে পারতাে। সে ছিল ভূতের রােজার রােজা, রাজা রােজা। ভূতের দল তার কাছে জব্দ।
ব্রুনাে গুলতাপ্পি দিয়ে চললাে আর গােলা বৈদ্য চোখ বড় বড় করে সেইসব উদ্ভট গল্প গিলতে লাগল।
মাইকেল স্কট ধনী ও অভিজাত মহলে খুব জনপ্রিয় হল কারণ মাইকেল ঐসব অলস ও আরামপ্রিয় ধনীদের ইচ্ছা ভূতেদের সাহায্যে পূরণ করতাে। ফ্লোরেন্সে কিছুদিন কাটিয়ে মাইকেল এবার অন্য শহরে যাবে কিন্তু ঐসব ধনী সন্তানেরা তাকে ছাড়তে চায় না। যখন ওরা বুঝলাে মাইকেল যাবেই যাবে, তখন ওরা বলল তাহলে তুমি তােমার দু’জন চেলাকে রেখে যাও, ওদের সব ভার আমরা নেব। তাই হােক। মাইকেল দুজন চেলা রেখে চলে গেল।
ব্রুনাে বলতে লাগল, গুরু চলে যাবার পর চেলা দু’জন একটা ক্লাব মতাে করলাে। সেই ক্লাবে ধনী নির্ধন সকলের অবাধ গতি। কতরকম মুখরােচক খাদ্যের স্থূপজমা হতাে, ফলের পাহাড় আর সুরার ফোয়ারা। যারা গরিব তারা ক্লাবে ঢাকার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ছেড়া পােশাক কোথায় অন্তর্হিত হতাে, তার জায়গায় ভেলভেট আর জরির পােশাক। সে এক এলাহী কাণ্ড। নাচগান ফুর্তি। কত দেশের রানী আসতাে।
আমি আর বুফালমাচো ঐ ক্লাবে ভিড়ে গেলুম। বুফালমাচোর সঙ্গে ফ্রান্সের রানী আর আমার সঙ্গে ইংলণ্ডের রানীর পীড়িত হল। রানীরা আমাদের স্বর্ণমুদ্রাও দিত। ও সে যে কী আনন্দ আর ফুর্তির হুল্লোড় আমি তােমাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না সিমােন। দুই চেলা ভূতেদের খাটিয়ে মারতাে। ভূতেরাই সব ব্যবস্থা করে দিত। তারাই সব আনতাে, রানীদের তারাই ধরে আনতাে আবার ফিরিয়ে দিয়ে আসতাে। যাইহোেক তুমি সবই শুনলে তাে কিন্তু খবরদার যা বললুম তুমি তা কাউকে কিছুতেই বলবে না। মােদ্দা কথা হল যে আমাদের চারিদিকে কত সুযােগ হাতছানি দিয়ে ডাকছে, সেগুলাে ধরতে জানা চাই। তাই আমরা বলি স্রোতে ভেসে যাই, ভাসতে ভাসতে মনােমতাে বস্তুটি পেলেই ধরে ফেলি, এই হল আমাদের রহস্য। খবরদার কাউকে বলবে না।
ব্রুনাে তাকে যতই সতর্ক করে সিমােনের আগ্রহ ততই বেড়ে যায়। সে ব্রুনােকে চেপে ধরে, বলে আমাকে তােমাদের ক্লাবে ভর্তি করে নাও। ক্লাবটার সবই তাে বাজে, ফাকাও, কিছুই নেই। ওদের দুই বন্ধুর হাতে যখন পয়সা থাকে না তখন দু’জনে কোনাে শাসালাে ব্যক্তি বা বন্ধুর ঘাড় ভেঙে যায়। যেমন ক্যালানড্রিনাের শূকর চুরি করে খেয়েছিল।
ব্রুনাে ভাবে সিমােন তাকে শুধু তাকে খােশামােদ করছে না, ভালােমন্দ খাওয়াচ্ছেও। আরও দু’চারদিন খেয়ে নেওয়া যাক তারপর একটা কিছু করা যাবে। খাওয়ার বিনিময়ে ব্রুনাে বৈদ্যর বসবার ঘরে বা বারান্দার দেওয়ালে কয়েকটা ছবি এঁকে দেয়।
ব্রুনাে প্রতিদিনই সিমােনকে নানা আকর্ষণীয় কাহিনী বলে আর সিমােনাের কৌতূহল আর আগ্রহ ততই বেড়ে যায়। সে শুধু ব্রুনাের পায়ে ধরতে বাকি রেখেছে। ব্রুনাে বলে, ধৈর্য ধরাে বন্ধু, ঠিক সময়েই তােমাকে নিয়ে যাব। উপযুক্ত সময়ে তােমাকে না নিয়ে যেতে পারলে চেলা দু’জন খেপে যাবে। তখন সবদিক সামলান যাবেনা, চাই কি চেলারা আমা তােক্লাবে আর ঢুকতেই দেবেনা।ওরা আমার আর বুফালমাচোর জন্যে।
অসাধ্য সাধন করে। এই তাে পরশু আমি বললুম আলটারিসির খানের গুমেড্রোকে আমার কাছে এনে দাও।
গুমেট্রো আবার কী ? তেজী ঘােড়া বুঝি?
দুর বােকা, গুমেট্রো হল যাকে আমরা বলি সম্রাজ্ঞী। তা সেএনে দিল মাত্র এক ঘন্টার জন্যে,কারণ ওদিকে ঠিক এক ঘন্টা পরে খান সিংহ শিকার করে ফিরে আসবে। তা ওরা আমার ইচ্ছাপূরণ করলাে।
এই ভাবে ব্রুনাে যত গাঁজাখুরি গল্প বলে সিমমানেরও তত আগ্রহ বাড়ে। ব্রুনাে যাতে তাড়াতাড়ি তাদের ক্লাবে নিয়ে যায় সেজন্য সিমােন তাকে আরও বেশি খােশামােদ করে, আরও ভালাে খাদ্য ও পানীয় খাওয়ায়।
আরও দু’চার দিন কাটল। ব্রুনাে বুঝলাে আর দেরি করা ঠিক হবে না। লেবু বেশি চটকালে তেঁতাে হয়ে যায়। শেষে সব হয়তাে ভেস্তে যাবে। তাই একদিন বলল, সিমােন ভায়া তােমার ভাগ্য বােধহয় সুপ্রসন্ন হতে চলেছে। আমাদের ক্লাবে একটা কমিটি আছে। কমিটির মাথায় একজন ক্যাপটেন থাকে আর কয়েকজন কমিটির মেম্বার থাকে। আমাদের নতুন কমিটি হয়েছে। তুমি তাে আমার বন্ধু বুফালমাচোর নাম শুনেছ, দেখেছও বােধহয়। বুফালমাচো এবার কমিটির নতুন ক্যাপটেন হয়েছে আর আমিও কমিটির একজন মেম্বার হয়েছি। যদিও ক্লাবে কেউ কোনাে বন্ধুকে নিয়ে যেতে চায় তাহলে ক্যাপটেনের অনুমতি লাগে। এবার অনুমতি পাওয়া সহজ হবে কিন্তু তুমি আমার বন্ধুকে একদিন নিমন্ত্রণ করাে। আমি তােমার কথা বলে রেখেছি। তবে একটা কথা আছে। তােমাকে খুব সাহসী হতে হবে।
সিমােন বলল, আরে তুমি আমাকে জানােনা। আমি বলােনার নামী বংশের ছেলে।যেমন দারুণতলােয়ার চালাতে পারি তেমনি মেয়ে বশ করতে পারি। ও তুমি ভেবাে না।
বুফালমাচোকে একদিন নিমন্ত্রণ করা হল। সেদিন আস্ত একটা শূকরশাবক রান্না করা হল। ভালাে সুরাও আনা হল। ভােজ খুব জমল। এমন উত্তম ভােজ দুই বন্ধুর কপালে অনেকদিন জোটে নি।
ব্রুনাে তাে কি চাল মারে। বুফালমাচো তার চেয়ে এক কাঠি বাড়া। কল্পনায় সে দারুণ এক রঙিন ছবি সিমমানের সামনে তুলে ধরলাে।সামনের উৎসবে কত বিশিষ্টনরনারী আসবে, যেমন লর্ডনটহােন ব্যারন অফ হেল। ডাচেস অফ নােম্যানসল্যাণ্ড এমনকি ক্লিওপেট্রাও আসতে পারে। তােমার সঙ্গে কুইন আর সেসপুলের আলাপ করিয়ে দেব। আজ আমরা যাচ্ছি, সব ব্যবস্থা করে কাল সকালে এসে তােমাকে খবর দিয়ে যাব।
তাহলে তােমরা দু’জন আমার সঙ্গে ব্রেকফাস্ট কোরাে। সে আর বলতে, আর শােনাে একশ ফ্লোরিন চাঁদা দিতে হবে। সেটাও কাল সকালে ঠিক করে রেখ।
সিমােন তাে মহা উল্লসিত! সে সেইদিনই উত্তম পােশাক ও উত্তম টুপি বার করে রাখল। ওরা শুধু একশ ফ্লোরিন বলেছিল রূপাের কি সােনার বলে নি। সিমােন একটা থলিতে সােনার ফ্লোরিন রাখল। পরদিন ব্রেকফাস্টের জন্য বেশ মােটা দেখে মােরগ কিনে আনল।
পরদিন সকালে যথা সময়ে দুই জোচ্চোর বন্ধু এসে বেশ তৃপ্তি করে ব্রেকফাস্ট করলাে। সােনার ফ্লোরিন ভর্তি থলেটি বুফালমাচো কোমরে গুঁজে বলল, সিমােন এবার মন দিয়ে শােনন, তােমাকে কি করতে হবে।
বলল আমি শুনছি।
আজ সন্ধ্যার পর যখন অন্ধকার হবে তখন তুমি সান্টা মেরিয়া নােভেলার কবরখানায় যাবে। ভাললা পােশাক পরে যাবে,না পরলেও ক্ষতি নেই কারণ না থাকলে আমরা ক্লাব থেকে ভালাে পােশাক সরবরাহ করি। তারপর কবরখানার গিয়ে দেখবে কবরখানার গেটের উত্তরে বেড়ার ধারে বেশ উঁচু একটা কবর আছে। তুমি সেটার উপর বসে অপেক্ষা করবে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না। ষাঁড়ের মতাে সিংওয়ালা কালাে একটা
জীব এসে তুমি যে কবরের উপর বসে থাকবে তার পাশে দাঁড়াবে। মাড়টা কিন্তু ভূত। ভয় পেয়াে না।তুমি ওর পিঠে সােজা হয়ে বসবে কিন্তু এবার তার সিং তাে ধরবেই না এমনকি দেহ স্পর্শ করবে না। তোমার দুই হাত বুকে গুটিয়ে সােজা হয়ে বসে থাকবে। ষড় তােমাকে ঠিক জায়গায় নিয়ে যাবে। আরও একটা কথা। একদম ভয় পাবে না এবং কদাচ ভগবানের নাম করবে না, এমনকি তাকে স্মরণ করবে না তাহলেই বিপদ। কারণ প্রেতাত্মারা ভগবানের নাম একেবারেই সহ্য করতে পারেনা। স্মরণ করেছ কি মরেছ। ভগবান তাে দূরের কথা, কোনাে সাধুসন্তকে স্মরণ করলে জীবটা তােমাকে রাস্তায় ফেলে দেবে। অতএব সাবান।।
আরে তােমরা চিন্তা কোরাে না। আমি অনেক পাগলা ঘােড়ার পিঠেও চেপেছি।
ওরা সিমােনকে আরও একবার সাবধান করে দিয়ে চলে গেল।ওদিকে সন্ধ্যা হত না হতেই সিমেন তার স্ত্রীকে ছুতাে করে এক জায়গায় পাঠিয়ে দিল। তারপর ভেলভেট সিল্ক জরির পােশাক পরে মাথায় ঝলমলে টুপিটা পরে সন্ধ্যার পরেই কারখানার দিকে চললাে।
ওরা ঠিকই বলেছিল।কবরখানার গেটের উত্তর দিকে বেড়ার ধারে বেশউঁচু একটাক :: সিমোন তার ওপরে উঠে বসে ভৌতিক ষাঁড়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
বুফালমাচোর চেহারাটা দশাসই। সে সিংওয়ালা একটা মুখােশ পরল, তারপর সারা দেহ একটা লােমওয়ালা কম্বল দিয়ে ঢেকে হাতে পায়ে এমন ভাবে চলতে লাগল যে অন্ধকারে তাকে দেখলে ষাঁড় বলেই মনে হবে। তার ওপর মুখেও বাঁড়ের মতাে আওয়াজ করতে লাগল।
ব্রুনাে খবর দিল মলে কবরের ওপর সাজগােজ করে বসে আছে। বুফালমাচোও দূর থেকে আবছায়া দেখেছে কবরের ওপর সিমােন বসে আছে। কবরের কাছে আসতে আসতে বুফালমাচো প্রচণ্ড নর্তনকু আরম্ভ করলো। সিং ঘােরদত গল আর মুখে খ্যাপা ষাঁড়ের মতাে বিকট আওয়াজ। এই দেখেই তাে সিমােনের হয়ে গেছে। মার আর ঘাড়ের চুল খাড়া হয়ে গেল। থরথর করে কাঁপতে লাগল। এটা কিজ বাবা, ষাঁড় বলেই তাে মনে হচ্ছে, নাকি মহিষ? তবে জ্যান্ত কোনো জানােয়ার তাে নয়। যাই হােক এখন আর ভয় পেয়ে পালালে চলবে না।
কবরের পাশে এসে ষাঁড়’কিন্তু শান্ত হয়ে গেল। সিমােন নিশ্চিন্ত হয়ে পিঠের ওপর চড়ে বসলাে। ওদের নির্দেশ মনে আছে, সিং তাে ধরললাই না, গা স্পর্শ করলাে না, দুই হাত মুড়ে বুকে লাগিয়ে রাখল।
ধাঁড় কিন্তু কয়েক পা যেতে না যেতেই যেন ক্ষেপে গেল, সে নর্তনকুদন আরম্ভ করলে, পাগলের মতাে ডাকতে লাগল। সিমােন পড়ে যায় আর কি, তবুও যথাসাধ্য চেষ্টা করে ভারসাম্য রক্ষা করতে লাগল। কিন্তু মনে মনে ভাবছে না এলেই ভালাে করতাে,এ যে ভীষণ, এই বুঝি ফেলে দেয়! ভয় তাে পেলই এমনকি একবার বলে ফেলল হা ভগবান!
যেই না হা ভগবান বলা ষাড় অমনি পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল আর পাশে ছিল নােংরা জল আর দুর্গন্ধ পাক ও ময়লায় ভর্তি নর্দমা। সিমােন সেই নর্দমায় পড়ে গেল। ষাঁড়টা ছুটে পালাল। ব্রুনাে দূর থেকে ওদের অনুসরণ করছিল। সিমােনকে নর্দমায় পড়ে যেতে দেখে সে তাে হাসতে লাগল। একটা গাছের আড়াল থেকে দেখল সিমােন ওঠবার যত চেষ্টা করছে ততই সে যেন পাঁকে ডুবে যাচ্ছে। চেহারা যা হয়েছে যেন আসল দৃত।
একটু দূরে বুফালমাচো তার মুখােশ আর গা থেকে কম্বল খুলে নাের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। ব্রুনাে আসতে যে যার বাসায় ফিরে গেল।
সিমােন অতিকষ্টে পাক থেকে রাস্তায় উঠে দাঁড়াল। অমন দামী টুপিটা কোথায় হারিয়ে গেছে। মাথা হয়ে সেই নােংরা পাক গড়িয়ে তার চোখ বন্ধ করে দিয়েছে। নাকও বন্ধ, মুখেও কিছু ঢুকে গেছে। থু থু ৫ বিশ্রী! কোনাে রকমে চোখ মুখ থেকে পাক মুছল কিন্তু অসহ্য দুর্গন্ধ।
কোনােরকমে বাড়ি ফিরল। স্ত্রী দরজা খুলে দিয়েই নাক টিপে ধরলাে। তার স্বামীর অবস্থা দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। বলল, নিশ্চয় বেশ্যাবাড়ি গিয়েছিলে তারপর মাতাল হয়ে ফেরবার পথে ভয় পড়ে গেছ। উচিত সাজা হয়েছে। আমি তােমাকে পরিষ্কার করতে পারবাে না। উঃ কি দুর্গন্ধ রে বা।
সিমােন গা থেকে সেই নােংরা পােশাক ফেলে দিয়ে ভৃত্যের সহায়তায় স্নান করে পরিষ্কার হল বটে কিন্তু গা থেকে দুর্গন্ধ গেল না।
পরদিন সকালে ব্রুনাে আর বুফালমাচো নিজেদের মুখে, হাতে ও পিঠে এমন কায়দায় রং লাগাল যেন ওদের কেউ প্রহার করেছে। তারপর তারা সিমােনের বাড়ি গেল। সিমােন দরজা খুলে ওদের দেখে ভয় পেয়ে গেল। তখনও তার দেহ থেকে দুর্গন্ধ দূর হয়নি।
ওকে দেখেই দুই বন্ধু ঝাঝিয়ে উঠল, বিশ্বাসঘাতক, পাজী, বদমাশ কাল গেলে না কেন? তােমার জন্যে সব ঠিক করে রাখা হল, ডাচেস অফ সেসপুল এলাে, তুমি বদমাশ গেলে না উলটে আমরা চোরের মার খেলুম, এই দেখ আমাদের গায়ে দেব।
ওদের বসিয়ে কিছু খাইয়ে ও পান করিয়ে শান্ত করে গত রাত্রের নিজের দুর্দশার কথা বলল। ওরা বলল, প্রথমে তুমি ভয় পেয়েছিলে নইলে জন্তুটা লাফালাফি করতাে না। তারপর নিশ্চই ভগবানের বা কোনাে সাধুর নাম নিয়েছিলে নইলে জন্তুটা তােমাকে ফেলে দিত না। যাক তােমার ভাগ্য ভালাে যে ও তােমাকে সিং দিয়ে গুতােবার সুযােগ পায় নি।
সিমােন ওদের কাছে জোড় হাত করে ক্ষমা চেয়ে বলল, দোহাই ভাই কথাটা আমার স্ত্রীর কানে তুলাে না অন্য কাউকে বলে আমাকে অপদস্ত কোরাে না।
ব্রুনাে আর বুফালমাচো যাতে ব্যাপারটা ফাস না করে দেয় এজন্যে বােকা সিমােন ওদের প্রায়ই ভােজনে আপ্যায়ন করতে লাগল।
দশম গল্প
একজন সওদাগর তার সওদা নিয়ে পালেরমাে বন্দরে অবতরণ করে ছলনাময়ী এক ললনার পাল্লায় পড়ে সব হারালাে। পরে সে আবার আরও অনেক বেশি সামগ্রী নিয়ে ঐ হিলার কাছে সামগ্রীগুলি বন্ধক দিয়ে মােটা পরিমাণের স্বর্ণমুদ্রা ঋণ করলাে। সওদাগর চলে যাবার পর ঐ ললনা দেখল সওদাগর শুধু জল আর পচা দড়িদড়া রেখে গেছে।
সিমমানের দুর্দশার কথা শুনে হাসতে হাসতে মেয়েদের চোখ দিয়ে যে জল গড়িয়ে পড়বে এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। যাই হােক হাসি থামল, সকলে চোখ মুছল। ডায়ােনিও দেখল ন’জনের গল্প বলা হয়েছে, সে বাকি আছে। মেয়েরাও বলল, এবর ডায়ােনিও কি বলে শােনা যাক। কুইন তাকে ইশারা ব্রার সঙ্গে সঙ্গে সে আরম্ভ করলাে :
কোনাে অতিরিক্ত মানুষ দেখলে আমরা তাকে সন্দেহের চোখে দেখি নয়ত হিংসে করি। এইসব অতি চালাক মানুষরা যখন কাউকে ঠকায় তখন আমাদের রাগ হয় কিন্তু যদি কোনাে মানুষ সেই অতি চালাককে সমুচিত শিক্ষা দেয় তখন আমরা উল্লসিত হই, নয় কি ? তােমরা সকলে বেশ ভালাে ভালাে গল্প বলেছ আমিও একটা গল্প বলবাে। দেখি তােমাদের কেমন লাগে।
বন্দর শহরগুলিতে গুদাম ঘর ভাড়া পাওয়া যায়। এগুলি বন্দরের কাছেই অবস্থিত। কোনাে স্বীকৃত সংস্থা বা দেশের শাসক এগুলি তদারক করে। সওদাগররা জাহাজ থেকে মাল খালাস করে এখানে জমা রাখে। গুদামের রক্ষক মালের সমুদয় বিবরণী, মাপ, ওজন ও কর খাতায় লিখে রাখে। দালাল বা ব্যবসায়ীরা ঐ খাতায় মালের বিবরণী দেখে দেখে মাল বিক্রয়ের ব্যবস্থা করে বা আমদানীকারক নিজেই খরিদ্দার এনে মাল বেচে দেয়। অবশ্য গুদাম ভাড়া দিতে হয়। আমরা এইসব গুদামঘরকে ‘ডােগােনা বলি।
সিসিলি দ্বীপে পালেরমােতেও এমন কয়েকটি ডােগােনা আছে। থাকবেই তাে কারণ পালেরনের বেশ বড় বন্দর। পালেরমাের আর একটা খ্যাতি আছে। এই বন্দর শহরে বেশ কয়েকজন সুন্দরী শিকারী চটুল রমণী আছে যাদের কাজ হল কোনাে ব্যবসায়ীকে ছলাকলায় বশ করে তার সর্বস্ব বা যতটা পারা যায় লুট করে নেওয়া, তা সে নগদ অর্থই হােক বা মালপত্তর হােক।
সওদাগর দেশে তার স্ত্রী বা বা প্রিয়পাত্রীকে ছেড়ে এসেছে। তারপর একঘেয়ে জল দেখে দেখে তার শরীর মন যখন ক্লান্ত তখন বন্দরে পৌছে এইসব রসবতীদের কটাক্ষের সহজেই শিকার হয়।
শিকার সন্ধানে এইসব নারীরা স্বয়ং বেরিয়ে গড়ে অথবা দূতী পাঠায়। শিকার ফাঁদে পা দিলে তাকে ভুলিয়ে ঘায়েল করতে সময় লাগে না। এইভাবে অনেক সওদাগর হৃতসর্বস্ব হয়েছে।
ফ্লোরেন্সের একজন বড় ব্যবসায়ী তাদের কিছু মাল বেচবার জন্যে জাহাজ বােঝাই করে নিকলাে ডা ডিগনাননাকে পালেরমাে বন্দরে পাঠাল। নিকলাে ফ্লোরেন্সে স্যালবিত্তো নামে পরিচিত। সে নিজেও এই সুযােগে ব্যবসা করে। স্যালবিত্তো প্রচুর পশম বস্ত্র নিয়ে গিয়েছিল। পশম বস্ত্রগুলির মােট দাম পাঁচশ স্বর্ণ ফ্লোরিন।
জাহাজ থেকে মাল খালাস করে স্যালাবিত্তো সেগুলি একটি ডােগােনায় জমা দিয়ে রসিদ নিয়ে শহর দেখতে বেরিয়ে পড়ল। শহর দেখা অপেক্ষা শহরে ফুর্তি করার কী উপাদান আছে সেদিকেই তার নজর বেশি।
স্যালবিত্তোর চেহারাটি বেশ ভালাে। সুদর্শন, ধবধবে ফর্সা, মাথার চুল চকচকে বাদামী। খাড়া নাক, চওড়া কাঁধ, চওড়া কজি। সহজেই নারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অনেক নারী তাকে দেখেই লােলুপ হয়ে তার উরুর চাপ নিজ উরুতে সহ্য করবার জন্য লালায়িত হয়ে ওঠে। সু জ্যানকোফিয়াের নামে অটুট যৌবনা মদিরাক্ষি এক যুবতীও তখন শিকার সন্ধানে উত্তমরূপে সাজগােজ করে রাস্তায় বেরিয়েছিল। চার চোক্ষের মিলন হল। উভয়ে উভয়ের প্রতি আকৃষ্ট হল। সুন্দরী তার বাড়ির পথ ধরলাে, স্যালাবিত্তো তাকে অনুসরণ করতে লাগল। কোনাে ধনী মহিলা মনে করে স্যালাবিত্তো ভুল করেছিল কিন্তু পরে বুঝেছিল সুন্দরী স্বৈরিণী, বহুবল্লভা।
জ্যানকোফিয়াের তার নিজের বাড়িতে প্রবেশ করলাে। দরজায় প্রবেশ করবার আগে সে পশ্চাৎ দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে স্যালবিত্তোকে দেখতে পেয়েছিল কিন্তু তাকে ভেতরে আসবার জন্যে ইশারা করে নি।
সুন্দরীকে দেখে স্যালাবিত্তো এতই মুগ্ধ যে সে সেখানেই প্রস্তরমূর্তির মতাে দাঁড়িয়ে রইল। সুন্দরী ওপরে নিজের ঘরে গিয়ে দেখল যুবক একদৃষ্টে তার বাড়ির দিকে চেয়ে স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে রয়েছে। শুধু দেখতে সুন্দর হলেই তাে হবে না, ছেলেটার কাছ থেকে ঝাপিয়ে নেবার মতাে অর্থ থাকা চাই। তাও তাে সে ডােগােনাতে দেখে এসেছে।
জ্যানকোফিয়াের আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাে। যুবকের নড়বার নাম নেই, তখন সে তার দাসীকে পাঠাল। দাসী এ কাজে সিদ্ধহস্ত। এ কাজ সে অনেকবার করেছে। ছলছল নয়নে স্যালাবিত্তোর কাছে গিয়ে বলল, আমার কর্তী ঠাকুরাণী আপনাকে দেখে মুগ্ধ। ঘরে ফিরে খাটে শুয়ে পড়েছেন, ঘন ঘন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলছেন, তিনি আপনার প্রেমে পড়ে গেছেন।
স্যালাবিত্তো দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে দাসীকে বলল, হায় তােমার কী যদি জানতেন যে আমিও তার প্রেমে পড়ে গেছি বলতে কি তার চেয়ে অনেক বেশি তাে কম নয়।
দাসী বলল, এ অত্যন্ত সুখের কথা। কত্রী ঠাকুরাণী তাঁর প্রেমের নিদর্শনস্বরূপ এই আংটিটা আপনাকে দিয়েছেন। এটা আপনি সঙ্গে রাখুন। আংটিটা তিনি এখনি তার আঙ্গুল থেকে খুলে দিয়েছেন। কোনাে একটা অজানা জায়গায় তিনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।
স্যালবিত্তো আংটিটা চুম্বন করে নিজের আঙুলে পরে বলল, কোথায় দেখা করবাে বলাে।
অপেক্ষা করুন আমি জিজ্ঞাসা করে এসে বলছি। স্যালাবিত্তো অপেক্ষা করতে লাগল। একটু পরে এসে দাসী একটা অভিজাত স্নানাগারের নাম করে বলল সন্ধ্যার সময় আকাশে যখন শুকতারা উঠবে। তখন আপনি ঐ স্নানাগারের প্রবেশপথের সামনে অপেক্ষা করবেন। কত্রী চোখের ইশারায় আপনাকে ডেকে নেবেন কিন্তু সাবধান আপনি কাউকে একথা কিছুতেই বলবেন না। আজ নয় কাল সন্ধ্যায় যখন আকাশে শুকতারা উঠবে তখন।
তােমার কত্রীকে নিশ্চিত থাকতে বলল আমি ঠিক অপেক্ষা করবাে। স্নানাগারটা আমি চিনি।
পরদিন স্যালাবিত্তো যথাস্থানে গিয়ে শুকতারা উঠতে না উঠতে অপেক্ষা করতে লাগল। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। যুবতী এসে চোখের ইশারায় তাকে ভেতরে ডেকে নিল। স্নানাগারের একটা অংশ যুবতী আগেই সংরক্ষিত করে রেখেছে। শয্যাসমেত পৃথক একটি ঘর এখানে ভাড়া পাওয়া যায়। ধনী যুবক-যুবতীরা গােপনে মিলিত হবার জন্য এখানে ঘড় ভাড়া করে। এসব স্নানাগারে সর্বসাধারণ এক সঙ্গে স্নান করতে পারে না। তাদের জন্যে পৃথক স্নানাগার আছে, একদিকে পুরুষেরা অপরদিকে মেয়েরা স্নান করে।
স্যালাবিত্তো এবং জ্যানকোফিয়াের ভেতরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে দু’জন কিশােরী ক্রীতদাসীও প্রবেশ করলাে। একজনের মাথায় পালকের নরম গদি এবং অপরজনের মাথায় পালকের তুলতুলে বালিশ, চাদর ও আরও কিসব সরঞ্জাম ছিল। জ্যানকোফিয়ােরও একটি থলিতে করে কিছু সুগন্ধী। এনেছিল। কিশােরী দু’জন উত্তমরূপে শয্যা রচনা করে দিল। অতি সুগন্ধী ধূপ জ্বেলে দিল, যার সুবাসে মন মাতােয়ারা হয়ে যায়। স্যালাবিত্তোর মনে হল সে বুঝি পরীরাজ্যে এসেছে। এতে
জ্যানকোফিয়াের স্যালাবিত্তোকে সবলে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করে বলল, তােমার মতাে সুন্দর পুরুষ হাজারে একটা মেলে। তােমাকে দেখে পর্যন্ত আমার মন আনচান করছিল। অসুবিধা না থাকলে কালই তােমার সঙ্গে মিলিত হতুম। এখন এসাে আমরা স্নান সেরে নিই।
কিশােরীরা দু’জনেরই সমস্ত পােশাক খুলে নিল। জ্যানকোফিয়াের স্বয়ং সুবাসিত জলে স্যালাবিত্তোকে স্নান করিয়ে দিল। সাবান দিয়ে তার গাত্র মার্জনা করে দিল। স্যালাবিত্তো চেয়েছিল সুন্দরীকে নিজের হাতে স্নান করিয়ে দিতে কিন্তু সে রাজি হয়নি। স্নানের পর কিশােরী দু’জন দুধের মতাে সাদা ও নরম তােয়ালে দিয়ে দু’জনের গা মুছে দিয়ে দেহে সুগন্ধী পুস্পসারের প্রলেপ দিল। স্যালাবিন্তো ভাবছে সে বুঝি স্বর্গে এসেছে। বিলাসিতার কোনাে অভাব নেই। সুখের সপ্তম স্বর্গে দু’জনেই গা ভাসিয়ে দিল।
আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় দু’জনে বিছানায় অনেকক্ষণ শুয়ে রইল। তারপর সুন্দরী কিশােরী দুটিকে ডাকল। তারা এসে ওদের পােশাক পরিয়ে দিল। এরপর ওরা স্নানাগার থেকে বিদায় নিল কিন্তু বিদায় নেবার আগে স্যালাবিত্তোকে সুন্দরী বলল, আজ রাত্রে তুমি যদি আমার বাড়িতে এসে নৈশভােজ করাে ও রাত্রিটা আমার সঙ্গে অতিবাহিত করাে তাহলে আমি নিজেকে কৃতার্থ বােধ করবাে।
কৃতার্থ? কে কৃতার্থ বােধ করবে। স্যালাবিন্তো যেন হাতে স্বর্গ পেল। সে বলল, এ কি বলছাে সুন্দরী মনমােহিনী, আমি তাে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি।
স্যালাবিত্তো সুন্দরীর ছলাকলায় ভুলে গেল। সে মনে করলাে জ্যানকোফিয়াের তাকে সত্যিই ভাল বেসেছে, একেবারে নির্ভেজাল ভালবাসা কিন্তু নারীচরিত্র সম্বন্ধে সে এখনও অনভিজ্ঞ, বিশেষ করে ছলনাময়ী স্বৈরিণীকে চিনতে তার বাকি আছে।
সুন্দরী তাকে বলল, আমি যে শুধু একান্ত তােমার তা নয়, আমার যা কিছু আছে সবই তােমার।
তার সবকিছু তুমি নিজের মনে করে ব্যবহার করবে কিন্তু তােমরা সওদাগর তাে দু’দিনের অতিথি, মি চলে গেলে আমি কি করে বাচবাে? বলে জ্যাকোফিয়ার স্যালাবিত্তোর বুকের ওপর পড়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
সেদিন রাত্রে জ্যানকোফিয়াের তার প্রেমিকের জন্যে নানারকম সুখাদ্য, মিষ্টান্ন ও স্বাদু পানীয়ের বাবস্থা করেছিল। আহার শেষে বিশ্রাম তারপর শয়ন। প্রায় সারারাত্রি ও নব বিবাহিত দম্পতির মতাে জেগেই কাটাল।
পরদিন সকালে স্যালাবিত্তোকে কয়েকটা দামী উপহার দিল। জোর করেই দিল। তবে জানকোফিয়াের বেশ বুঝতে পারলাে যে এ ছােকরা তাকে এখন এতদূর বিশ্বাস করেছে যে তাকে তাড়িয়ে দিলেও সে যাবে না। তাকে সুন্দরী আবার আহার ও নিশিযাপনের জন্যে আমন্ত্রণ জানাল। তারও একরাত্রি পর আনন্দে সুখসাগরে কাটানাে গেল। স্যালাবিত্তো ভাবে পৃথিবীতে এত আনন্দও বিনামূল্যে পাওয়া যায়! নারীসঙ্গ এত সুখের? এমন তৃপ্তিদায়ক?
পরদিন সকালে স্যালবিত্তো যখন বিদায় নেবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে তখন তার পরিচারিকা ব্যস্ত হয়ে ঘরে ঢুকে তার কত্রীকে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে গেল।
একটু অপেক্ষা করাে প্রিয়তম, দাসী কি বলছে শুনে আসছি। কিছুক্ষণ পরে জ্যানকোফিয়াের যখন ফিরে এলাে তখন তার মুখ বিবর্ণ যেন কোনাে বিপদ ঘটেছে। স্যালাবিত্তোর কপালে রেখা ফুটে উঠলাে। ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাে, কি হয়েছে প্রিয়তমা?
প্রিয়তমার চোখে জল এসে গেল। কান্নাভেজা স্বরে বলল, আর কি হয়েছে? তুমি শুনে আর কি করবে? তােমাকে বলবােই বা কি করে?
কি হয়েছে বলােই না, আমি হয়ত কিছু করতে পারি। তুমি আর আমি কি পৃথক? দু’জনের হৃদয় কি এক নয়? | সাহস যখন দিলে তখন বলি প্রিয়তম, আমার ভাই মেসিনা থেকে এইমাত্র একখানা চিঠি দিয়েছে। তার ভীষণ বিপদ। তাকে সাত দিনের মধ্যে এক হাজার স্বর্ণ ফ্লোরিন না পাঠালে তার গলা কাটা যাবে। নে গলা কাটা যাবে বিস্তারিতভাবে তা লেখে নি। লিখেছে, এজন্যে আমার অলংকার ও সমস্ত আসবাব ও রুপপার বাসন যদি বিক্রি করতে হয় আমি তাও যেন করি। আমার তাে ঐ একটাই ভাই। কি যে করি? আর কিছুদিন সময় পেলে আমি আমার জমিদারির একটা অংশ বেচে দিয়ে ডবল টাকা তুলতে পারতুম কিন্তু তা তাে সাতদিনে হবে না। কি বিপদেই না পড়লুম বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উ? স্যালাবিত্তোর গলা জড়িয়ে ধরলাে।
স্যালবিত্তোর তার মাথায় হাত বুলিয়ে হাসতে হাসতে বলল, এ জন্যে চিন্তা করছাে কেন? আমি অবশ্য তােমাকে হাজার গােল্ড ফ্লোরিন দিতে পারবাে না। আমি কালই আমারশালগুলাে বেচে পাঁচশ পেয়েছি। সেই সবটা তােমাকে দিতে পারি তবে ওটা আমাকে পনেরাে দিনের মধ্যে ফিরিয়ে দিও কারণ টাকাটা তাে আমার নয়, আমার মহাজনের। আমার হলে তাে ফেরত দেবার প্রশ্নই উঠত না।
ছলনাময়ী বলল, না না মহাজনের টাকা তােমাকে দিতে হবে না। কিন্তু স্যালাবিন্তো কোনাে কথাই শুনল না। বলল, পনেরাে দিন সময় তাে পাবে তবে ভাবছ কেন? আগে ভায়ের প্রাণ তাে বাচাও।
ঠিক আছে যখন বলছ তখন দাও। আমার কাছে শ’ দুই আছে আর বাকিটার জন্যে আমার অলংকার বন্ধক দেব এখন।
সমস্যার সমাধান হয়ে গেল এই আনন্দে জ্যানকোফিয়াের যেন আনন্দে অভিভূত হয়ে গিয়ে স্যালাবিত্তোর গলা জড়িয়ে ধরে তাকে বুকে চেপে ধরে চুম্বনে চুম্বনে অস্থির করে তুলল, বলল একেই বলে আসল প্রেমিক, বিপদে যে সাহায্য করে, ভাগ্যে তুমি ছিলে, তােমার মতাে মানুষ আমি আর দেখি নি। এমন প্রশংসায় স্যালাবিত্তোও অভিভূত। টাকা যদি তার সঙ্গে থাকত তাহলে সে এখনি দিয়ে দিত তাতে সুন্দরীর কত না আনন্দ হতাে! স্যালাবিত্তো আফশােস করতে লাগল।
রাত্রিটা অন্য রাত্রি অপেক্ষা বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে ওরা যাপন করলাে এবং পরদিন ভাের না হতেই স্যালবিত্তো নিজের বাসায় ফিরে পাঁচশ স্বর্ণ ফ্লোরিন ভর্তি থলিটি এনে প্রেমিকার হাতে তুলে দিয়ে এতই তৃপ্তিলাভ করলাে যেন তার মনে হল সে ঋণমুক্ত হল। সুন্দরীও এত আনন্দিত হল যে, তার চোখে জল এসে গেল। স্যালাবিত্তো বলল, ফ্লোরিনগুলাে গুনে নিলে না? সুন্দরী কপট রাগ দেখিয়ে প্রেমিকের দিকে কটমট করে চেয়ে বলল, চোপ, দ্বিতীয় কথাটি নয়। তারপর সে মুদ্রাভর্তি থলিটি বাক্সয় তুলে রাখল।
জ্যানকোফিয়ােরের হাতে ফ্লারিনের থলি আসার সঙ্গে সঙ্গে তার অনুরাগ ক্রমশ শিথিল হতে লাগল। স্যালাবিত্তো তার বাড়িতে গেলে হেসে অভ্যর্থনা জানায় কিন্তু আর রাত্রি কাটাতে বলে না। অনেকদিন আবার বলে আজ একটু ব্যস্ত আমি তুমি কাল এসাে। ক্রমে দশটা অনুরােধ করলে একটা রক্ষা করতাে।
পনেরাে দিনের মাথায় যখন জ্যানকোফিয়াের ঋণ শােধ করলাে না, নানা ছলছুতােয় যখন দু’মাস কাটিয়ে দিল তখন স্যালাবিত্তো হতাশ হল, বুঝল টাকা সে ফেরত পাবে না। এখন সে নিজেকে বােকা মনে করলাে। নারী এত ছলনাও জানে। আর আফশােস করে কি হবে, ও অর্থ গেল। এদিকে তার মহাজন টাকার জন্যে তাকে কয়েকবার তাগাদা দিয়েছে কিন্তু সে কোনাে উত্তরই দেয় নি। এবার তার ভয় হল যে তার মহাজন হয়ত পালেরমােতে লােক পাঠিয়ে তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে সাজা দেবেন। অতএব পালেরমােতে আর থাকা নিরাপদ নয়, এখান থেকে পলায়ন করাই ভালাে। এই মনে করে সে। একটা ছােট জাহাজে চেপে নেপলস বন্দরে এলাে।
নেপলসে আমাদের ফ্লোরেন্সের একজন লােক বাস করতাে। লােকটি ছিল কনস্ট্যান্টিনােপলের রানীর খাজাঞ্চী, যেমন চতুর তেমনি বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান। তার নাম পিয়েত্রো ডেলো চানিজিয়ানাে। স্যালাবিত্তোর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। | নেপলসে স্যালবিন্তো বন্ধুর বাসাতেই উঠল। কয়েকদিন পরে তার দুঃখের কাহিনী বলল, একজন। নারী তাকে প্রবঞ্চনা করেছে। বন্ধু সব শুনে তাে স্যালবিত্তোকে খুব ভৎসনা করলাে, মুখ, নারীলােলুপ ইত্যাদি বলে তাকে যারপরনাই অপমানিত করলাে।
স্যালাবিত্তো বলল, বন্ধু যা ইচ্ছে বলাে, দু’চার ঘা মারতেও পারাে কিন্তু একটা উপায় বার করাে যাতে আমি বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে পারি। কতদিন পালিয়ে বেড়াব, মহাজন তাে আমাকে ছাড়বে না।
বন্ধু বলল,পাঁচশ ফ্লোরিন তাে আমি তােমাকে ধার দিতে পারি কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, তুমি হয়ত আবার কোনাে সুন্দরীর পাল্লায় পড়ে টাকা খােয়াবে। প্রতিশােধ নিতে হবে। ঐ নারীকে জব্দ করতে হবে। পারবে? নাকি ঐ মেয়ে যেই তােমাকে জড়িয়ে ধরে মুখে চুমু খাবে অমনি তুমি সব ভুলে ৫১৮
-না না বন্ধু আমি আর ভুলব না। বঞ্চনা আর অপমানের জ্বালা আমি আর সহ্য করতে পারছি না। তুমি একটা উপায় করাে।
চানিজিয়াননা জিজ্ঞাসা করলাে, তােমার কাছে কিছু অর্থ আছে?
আছে।
বেশ আমিও কিছু অর্থ ধার দিচ্ছি। তারপর স্যালবিত্তোকে কি করতে হবে বলে দিল। বন্ধুর পরামর্শক্রমে স্যালাবিত্তো বেশ বড় বড় কয়েকটা তেলের পিপে কিনলাে। পিপেগুলাে জলে ভর্তি করে বেশ করে মুখ বন্ধ করে দিল। তারপরে ছেড়া ন্যাকড়া ও পচা দড়িদড়া দিয়ে বেশ কয়েকটা পরিষ্কার গাঁট বাধল। তারপর সেগুলাে জাহাজে তুলে পালেরমােতে ফিরে এলাে। তারপরে সেই মালগুলাে ডােগানােতে জমা দিল। বলল পিপেতে আছে হিন্দুস্তানের চন্দন তেল আর গাটে আছে চীনদেশের রেশম বস্ত্র। এইসব পণ্যের মােট দাম দু’হাজার স্বর্ণ ফ্লোরিন। আরও তিন হাজার ফ্লোরিনের মাল আসছে। সেগুলাে এলে তখন সব মাল একসঙ্গে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে।
এই খবর জ্যানকোফিয়ােরের কানে পৌছে গেল। তার চোখ চকচক করে উঠল। এই দু’হাজার ফ্লোরিনও বাগাতে হবে।
এবার আরও ভালােরকম সাজগােজ করে স্যালাবিত্তো একদিন জ্যানকোফিয়ােরের বাড়িতে হাসিমুখে হাজির হল। জ্যানকোফিয়াের হাসিমুখে তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বলল, ঠিক সময়ে তােমার অর্থ ফেরত দেবার কথা দিয়েও আমি কথা রাখতে পারি নি। এজন্যে আমি মনে মনে কত কষ্ট পেয়েছি। তারপর যখন টাকার যােগাড় হল তখন তােমাকে শহরে কোথাও পেলুম না। জমিদারির খানিকটা বেচে দিয়েছি। ভায়ের বিপদ কেটে গেছে, এখন আমি নিশ্চিন্ত। আমি আগে তােমার ঋণ শােধ করি এই বলে জ্যানকোফিয়াের থলিভর্তি ফ্লোরিন এনে দিল। স্যালাবিত্তো লক্ষ্য করে দেখল এটা তার সেই থলিটাই এবং সেই ফ্লোরিনগুলিই। কিন্তু কিছু বলল না। থলি হাতে পেয়ে স্যালাবিত্তো তার পুরনাে মেজাজ ফিরে পেল।
কিছু পান ভােজন হল। তারপর বলল সে কি পরিমাণ ও কি মাল এনেছে, তার দামই বা কত এবং আরও তিন হাজার ফ্লোরিনের মাল আসছে। সে স্থির করেছে পালেরমােতেই বসবাস করবে কারণ জ্যানকোফিয়ােরকে ছেড়ে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব।
কয়েকটা দিন ও রাত্রি পরমানন্দে কাটাল। সেদিন রাত্রে প্রেমিকার বাড়ি প্রেমিকের নৈশভােজের নিমন্ত্রণ। স্যালাবিত্তো যথা সময়ে হাজির হল কিন্তু এ কোন স্যালাবিত্তো? বেশভূষা মলিন, চুল এলােমেলাে, কেমন যেন বিভ্রান্ত। স্যালাবিত্তোর চেহারা দেখে জ্যানকোফিয়াের ঘাবড়ে গেল। জিজ্ঞাসা করলাে কি হয়েছে? কোনাে শােক সংবাদ?
হতাশ স্যালাবিত্তা ধপ করে বসে পড়ে বলল, শােকসংবাদই বটে তবে কারও মৃত্যুসংবাদ হলে ভালাে হতাে। আমার সর্বনাশ হতে চলেছে।
অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে জ্যানকোফিয়াের জিজ্ঞাসা করলাে কি সর্বনাশ হতে চলেছে বলােই না। আমার মন আনচান করছে।
স্যালবিত্তো বলল, আজ সকালে খবর পেলুম আর একটা জাহাজে আমার তিন হাজার ফ্লোরিনের মাল আসবার কথা আছে সেই জাহাজ জলদস্যুরা আটক করে মুক্তিপণ দাবি করেছে। অন্য কয়েকজন সওদাগরেরও মাল আছে। দস্যুরা দাবি করেছে দশ হাজার সােনার ফ্লোরিন, আমার ভাগে পড়েছে হাজার ফ্লোরিন। এই শহরে আমাকে কেউ চেনে না। কেউ আমাকে টাকা দিতে রাজি হচ্ছে না অল্প ডােগােনাতে আমার দু’হাজার ফ্লোরিনের মাল রয়েছে তবে ঐ মাল বেচাকেনার এখন মরশুম নয়, মাস দুই পরে। এখন আমি এই এক হাজার সােনার ফ্লোরিন কোথায় পাব? অন্য সওদাগররা হয়ত টর দিয়ে আমার মালগুলাে নিয়ে নেবে, আমি এক কপর্দকপও পাবাে না।
সব শুনে জ্যানকোফিয়াের বলল, প্রিয়তম হতাশ হচ্ছ কেন? তােমার বিপদ আমারও বিপদ আমার হৃদয়ের সবটাই জুড়ে আছ। উপায় একটা হবেই। কবে মুক্তিপণ দিতে হবে? তিনদিনের মধ্যে।
বেশ, তাহলে শােনাে, আমার কাছে হাজার ফ্লোরিন নেই তবে আমার পরিচিত একজন হজ আছে। তার কাছে চাইলে ঋণ পাওয়া যাবে তবে তার সুদ চড়া। তুমি রাজি হলে আমি আজ ক নিয়ে আসবাে।
কি বলল? রাজি হবাে না? নিশ্চই রাজি। তবে আমার যে মাল এখানে মজুত আছে আর যে আসছে তার মােট দাম পাঁচ হাজার ফ্লোরিন। দু’তিন মাস পরে মরশুমের সময় মাল বেচে সুদ সমে: সব টাকা আমি মিটিয়ে দেব আর দু’হাজার ফ্লোরিনের যে মাল মজুত আছে সেটা আমি তােম এই শর্তে লিখে দিচ্ছি যে তিন মাসের মধ্যে আমি যদি তােমাকে হাজার ফ্লোরিন ফেরত দিতে না প তাহলে তুমি ঐ মাল বেচে তােমার প্রাপ্য কেটে নিয়ে বাকি অর্থ আমাকে দেবে।
জ্যানগেফিয়াের তাে খুব খুশি। এখন হাজার ফ্লোরিন দিয়ে দু’হাজার ফ্লোরিন হাতিয়ে নেওয়া যাবে। মহাজনের কাছে ধার করবে না কচু, ওর নিজেরই তাে আছে।
স্যালাবিত্তোকে বলল, এখন শান্ত হলে তাে? স্নান করে এসাে, তারপর খাওয়া দাওয়া করে ঘুম যাবে। কাল দুপুরে তুমি টাকা পেয়ে যাবে। কথা দিলুম। | ভ্যানকোফিয়ােরের আশ্বাস শুনে স্যালাবিত্তো নিশ্চিন্ত হল। তার মুখ উদ্ভাসিত হল। মনে ; বাল, সুন্দরী এবার তুমি জব্দ হবে। পাঁচশ ফ্লোরিন তাে উসুল হয়েছে। এবার এই বাড়তি হয় ফ্লোরিন। তােমাকে যে এতবার উপভােগ করলুম, বিনা পয়সায় ভালাে মন্দ খেলুম সেসব তাে ফাউ আমার মতাে ভাগ্যবান আর কে আছে।
পরদিন দুপুরে স্যালাবিত্তো তার প্রিয়তমার বাড়ি এসে দেখল একজন অপরিচিত বৃদ্ধ বসে রয়েহে স্যালাবিত্তো যেতে প্রিয়তমা বলল, ইনিই মহাজন। এর কাছ থেকেই আমি হাজার ফ্লোরিন ধার নিল স্যালাবিত্তোও ডােগানাতে তার যে মজুত মাল আছে জ্যানকোফিয়ােরের কাছে শর্তাধীনে বন্ধক রাখল : সেই মর্মে তমসুক লিখে দিল। জ্যানকোফিয়ার স্যালাবিত্তোকে হাজার ফ্লোরিন গুনে দিল। সেই বই মাের্টেই মহাজন নয়, জ্যানকোফিয়ােরের একজন পরিচিত ব্যক্তি। তার মায়ের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক ছিল,
প্রেয়সীকে চুম্বন করে সানন্দচিত্তে বিদায় নেবার সময় স্যালাবিত্তো বলল, মুক্তিপণ মিটিয়ে দেওয়া ও জাহাজ থেকে মাল খালাস ব্যাপারে সে দু’তিন দিন ব্যস্ত থাকবে। হয়ত আসতে পারবে না, জ্যানকোফিয়াের যেন চিন্তা না করে।
স্যালাবিত্তো সেই দিনই দেড় হাজার ফ্লোরিন কোমরে গুজে জাহাজে চেপে নেপলসে গিয়ে হাজির
বন্ধু চানিজিয়ানাের বাড়িতে উঠে তার মহাজনের কাছে পাঁচশ ফ্লোরিন পাঠিয়ে দিল এবং বন্ধুর ঋণও শােধ করে বন্ধুকে অজস্র ধন্যবাদ জানাল, কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করলাে। তারপর সে অন্যত্র চলে গেল।
ওদিকে স্যালাবিত্তো হাওয়া। জ্যানকোফিয়াের সারা পালেরমে তােলপাড় করে তার কোনাে পাত্তা পেল না। তখনও সে বুঝতে পারে নি যে, তার প্রেমিক তাকে ঠকিয়ে পালিয়েছে কারণ ডেগোনাতে। মজুত মাল বাবদ বন্ধকী তমসুক তার হাতে আছে। সেগুলাে বেচে তাে ডবল টাকা পাওয়া যাবে। তাই দু’মাস অপেক্ষা করে তমসুক বলে সে ডােগােনা থেকে মাল খালাস করে এনে খুলে দেখল, কোথায় চন্দন তেল আর রেশমী বস্ত্র! স্রেফ জলে ভর্তি পিপেগুলাে আর গাঁটবন্দী যত ছেড়া ন্যাকড়া আর পচা দড়ি।
জ্যানকোফিয়াের এবার সত্যিই কেঁদে ফেলল। শেষ পর্যন্ত উপলব্ধি করলাে যে সততাই শ্রেষ্ঠ পথ, কাউকে বঞ্চনা করতে গেলে নিজেও বঞ্চিত হতে হয়।
ডায়ােনিওর গল্প শেষ হল আর লরেতারও রানীত্ব শেষ হল। সে তার মুকুট এমিলিয়ার মাথায় পরিয়ে দিয়ে বলল, এমিলিয়া তুমি সুন্দরী, তুমি নিশ্চই আমাদেরও সুন্দরভাবে সন্তুষ্ট করবে।
এমিলিয়া গাল লাল হল। সে বলল সুন্দরী কিনা জানি না তবে তােমাদের খুশি করতে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবাে। তারপর সে স্টুয়ার্ড ও সকল পরিচালক ও পরিচারিকাকে ডেকে তাদের কাজ বুঝিয়ে দিল। গল্প শােনা ছাড়া সে নতুন কিছু খাদ্য পানীয় ও অনুষ্ঠানের আয়ােজন করলাে।
এমিলিয়া ঘােষণা করলাে যে রাজা বা রাণী কর্তৃক বিশেষ নির্দেশ অনুসারে আমরা অনেকগুলাে গল্প শুনলুম কিন্তু কাল তােমরা যার যা ইচ্ছে সেইরকম গল্প বলবে।
সেদিন সন্ধ্যা ও অনেক রাত্রি পর্যন্ত তারা নৃত্যগীতে ও আনন্দে অতিবাহিত করলাে। রাত্রের শেষ গানটি গাইল প্যানফিলাে।
|| ডােকমেরনের অষ্টম দিবস শেষ হল।।