নীলবর্ণা তরঙ্গিনীর জল গাঢ় হয়ে উঠল। তীর তরুদের কন্দরে কন্দরে ঘনিয়ে উঠল ছায়া। সেই ছায়া ধীরে ধীরে পর্বতের সােপান বেয়ে উঠে গেল কিন্নর কৈলাসের শিখরে।
ইন্দ্ররূপী আদিত্য তখন তার স্যন্দনখানিতে জ্যৈষ্ঠের আকাশ পরিক্রমা শেষ করে অস্তাচলে নামছিলেন। সহসা ছায়ার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হল আদিত্যের। অনুরাগের রক্তচ্ছটায় ভেসে গেল পশ্চিম দিগন্ত। আদিত্য বাহু প্রসারিত করে আলিঙ্গন করলেন ছায়াকে। নর্মলীলায় আলােড়িত হল অস্তাচলের আকাশ।
অপলক দৃষ্টিতে আলােছায়ার বিহার-লীলা দেখছিল যে কন্যা, সে দেখল সুরতলীলার সমাপ্তিতে ছায়া গ্রাস করে নিল আদিত্যকে।
এই অনুভূতিটুকু বুকের মধ্যে স্পন্দিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই কিশােরী কন্যাটি রূপান্তরিত হয়ে গেল উদ্ভিন্নযৌবনা তরুণীতে।
সে পরিচিত পাহাড়ি পথ বেয়ে ফিরে চলল তার আশ্রম নিবাসে। চন্দ্র উঠল ধৌলাধারের শিখরে। পৌর্ণমাসী রজনীর চাঁদ রজত থালিকা থেকে ঢালতে লাগল জ্যোৎস্নাধারা। | দক্ষিণ সমীর বয়ে আনল গিরিমল্লিকার সুবাস। চন্দ্রকিরণে স্নান করতে করতে তার মনে হল, সে আজ সন্ধ্যায় নতুন এক জন্ম লাভ করল। ফুলের গন্ধে, বায়ুর প্রবাহে, জ্যোৎস্নার ধারায় তাজানা কোন এক রহস্যের আভাস পেয়ে রােমাঞ্চিত হতে লাগল সে।
পিতা বৃদ্ধাশ্ব হিমবন্তে কঠিন তপস্যায় মগ্ন। মাতৃস্বসা ধূতি যমজ ভাইবােনকে আগলে রেখেছেন পক্ষিণীর স্নেহ সতর্কতায়। | জ্যোৎস্নাপ্লাবিত ভূর্জবৃক্ষের তলায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ধূতি। উদ্বিগ্ন ছিল তার অন্তর, অস্থির ছিল তার দৃষ্টি। বৃদ্ধাশের পুত্র গালভ কর্তব্যকর্মে সদা নিমগ্ন। বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ, বৈতানিক-বহ্নি (যজ্ঞীয় অগ্নি) প্রজ্বালন, আজাহুতি (ঘৃতাহুতি), সকল কর্মেই গালভ সময়নিষ্ঠ, নিয়মনিষ্ঠ। পিতার সুস্পষ্ট ছায়া গালভের প্রকৃতিতে। কন্যা অন্তর্মুখী। তার মানসসরােবর উত্তাল হয়ে উঠলেও বহিঃপ্রকাশ দুর্নিরীক্ষই থেকে যায়। | ধূতি এগিয়ে এলেন আশ্রম সীমায়। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, এত বিলম্ব অহল্যা?
নতুন অনুভূতির রােমাঞ্চে তখনও বিভাের ছিল সে। কেবল মাতৃস্বসার দিকে আয়ত চোখের আনন্দঘন দৃষ্টি মেলে তাকাল।
ধৃতি অহল্যার এই মঞ্জরিত মুখশ্রীর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। তিনি আশ্চর্য হয়ে অহল্যার নব ভাবরূপটি দেখতে লাগলেন।
কতক্ষণ পরে মুক কন্যাকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে বললেন, কী হয়েছে মা তােমার? আজ কেমন এক ভাবান্তর লক্ষ করছি তােমার ভেতর। অহল্যা বলল, আমি আজ আদিত্যরূপী ইন্দ্রকে ছায়ার সঙ্গে লীলারত দেখলাম। কোথায় ?
কৈলাসশিখরে। তগত হয়ে বলে চলল অহল্যা, বনের গভীরে কৃষ্ণবর্ণের বসনে দেহ আবৃত করে ছায়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। তখন ইন্দ্রের কিরীট থেকে স্বর্ণাভ মধু-বিন্দুর মতাে রশ্মিধারা ঝরে পড়ছিল কৈলাসের শিখরে। আমি দেখলাম, অতি সন্তর্পণে ছায়া পর্বতের খাঁজে খাঁজে পা রেখে উঠে গেল। কখনও বা সে পর্বত কন্দরে বিশ্রাম নিচ্ছিল। ও যত উপরে উঠছিল, ওর অঙ্গবাস একটি একটি করে খসে পড়ছিল নীচে। ও শিখর স্পর্শ করামাত্র ওকে বুকে টেনে নিল ইন্দ্র। আদরে আশ্লেষে ভরে দিল তাকে। লীলা শেষে ইন্দ্র প্রচ্ছন্ন হয়ে গেলে ছায়া একে একে তার স্বলিত বেশবাস তুলে নিল অঙ্গে। ত্রিভুবন ব্যাপ্ত হয়ে সে পড়ে রইল।
ধৃতি বুঝলেন, নারী-পুরুষ সংযােগের প্রথম পাঠ আজ প্রকৃতির পাঠভবন থেকে গ্রহণ করেছে অহল্যা।
মুখে বললেন, রাত্রিকালে ছায়ার প্রাধান্য, আবার দিনমানে ছায়া প্রচ্ছন্ন। এ লীলা প্রকৃতির একাও স্বাভাবিক ধর্ম মা। পশুপক্ষী, নরনারী, কীটপতঙ্গ সবাই এই লীলায় আবদ্ধ।
অহল্যা নিজের আবেগকে চেপে রাখতে পারল না। সে বলল, প্রতিদিন আমি এ দৃশ্য দেখি, কিন্তু আজই কেবল ওই দৃশ্য আমার মনে নতুন একটা অর্থ বয়ে আনল।
ধূতি বললেন, এবার থেকে নারী-পুরুষের সংযােগ তােমার দৃষ্টিতে স্বাভাবিক ধর্মরূপে ধরা দেবে।
ধূতি অহল্যাকে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বসালেন ভূর্জবৃক্ষের ছায়ায়। চন্দ্রালােকে সুস্পষ্ট ছায়া পড়েছে আশ্রম পাদপের।
প্রতি সন্ধ্যায় গালভ অগ্নিহােত্র গৃহে প্রবেশ করে অগ্নিসংরক্ষণের ব্যবস্থা করত। অগ্নি কোনও কারণে একবার নির্বাপিত হলে কাষ্ঠ ঘর্ষণে পুনরায় তাকে প্রজ্জ্বলিত করা সহজ কর্ম ছিল না। তাই অগ্নিসংরক্ষণের কাজে বিশেষভাবে নিযুক্ত থাকতে হত গৃহী অথবা যাজ্ঞিকদের।
গালভ প্রভাতে অধ্যয়ন বেদিকায় বসে বৈদিক স্তোত্র পাঠ করত। পাঠান্তে যজ্ঞক্রিয়া। পরে ব্রীহি ও গােধুমের ক্ষেত্র পরিদর্শন করে আশ্রম উদ্যানে ফল আহরণ করে বেড়াত। কখনও বা শুষ্ক কাষ্ঠভার বহন করে আনত উদ্যান থেকে।
এদিকে পুষ্পবৃক্ষগুলির পরিচর্যার ভার ছিল অহল্যার উপর। তরু আলবালে জলদান থেকে নিত্য দেবার্চনার পুষ্প সংগ্রহ তাকেই করতে হত। আশ্রমগৃহটিকে সম্মার্জিত করার সমস্ত দায়িত্ব সে গ্রহণ করেছিল। গৃহগুলি অঙ্গসজ্জায় অপরূপ হয়ে উঠেছিল তার করস্পর্শে। সে পার্শ্ববর্তী কুণ্ড থেকে পানীয় জল সংগ্রহ করে আনত। সখীদের সঙ্গে স্নান করত প্রবাহিনীর শীতল সলিলে।
খাদ্য প্রস্তুতের দায়িত্ব নিজের উপর তুলে নিয়েছিলেন ধূতি। জ্যেষ্ঠা ভগিনীর মৃত্যুর পরে দুটি যমজ ভাইবােনের দায়িত্বও নিজের স্কন্ধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। বালবিধবা ধূতির পতিকুলে কেউ ছিল না তাকে রক্ষণাবেক্ষণ করার। তাই বৃদ্ধাশই তাকে নিজের কাছে এনে রেখেছিলেন ভগিনীর স্নেহে।
সন্ধ্যায় অহল্যাকে নিয়ে যে-কোনও একটি নিভৃত স্থানে বসতেন ধূতি। নানা প্রাচীন কথা ও কাহিনী শােনাতেন তাকে। যে-কোনও কাহিনী শােনার অদম্য ব্যাকুলতা ছিল তার। আজ জ্যোৎস্নাপ্লাবিত ভূজবৃক্ষের তলায় বসে ধূতি ইন্দ্রের কাহিনী শুরু করলেন।
ইন্দ্র হলেন আদিদেব। ঈশ্বর নামেই তাকে অর্চনা করা হয়। দেবতাদের রাজা বা পরিচালক তিনি, তাই দেবরাজ নামেই ত্রিভুবনবিদিত। মেঘেদের চালিত করেন তিনি, তাই তিনি মেঘবাহন। আবার ওই মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝরিয়ে দেন, তাই তার অন্য নাম বৃষা। খেতকে প্লাবিত করা, কর্ষণের উপযুক্ত করা তার অন্যতম কাজ।
অমিত বীর্যবান পুরুষ এই ইন্দ্র। দ্বাদশ মাসে আদিত্য দ্বাদশটি নাম গ্রহণ করেন। এই জ্যৈষ্ঠ মাসে আদিত্যের অন্য নাম ইন্দ্র। সেই ইন্দ্রকে তুমি ছায়ার সঙ্গে লীলামত্ত দেখেছ।
অহল্যা বলল, লীলাবিলাসই কি তার স্বভাব?
তােমার অনুমান সঠিক। তবে তার শক্তির স্বাক্ষর সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। মেঘ বিদীর্ণ করে বারিবর্ষণ, অসুর নিধন, সবই তার অমিত শক্তির পরিচায়ক। যিনি যথার্থ শক্তিমান, তার শক্তির প্রকাশ বহুমুখী।
অহল্যা বলল, বীর্যবানের দিকে সকলেরই আকর্ষণ থাকে। ধূতি বললেন, খুবই স্বাভাবিক। শক্তির প্রকাশে আমরা চমকিত হই। সেই বিস্ময়ের সঙ্গে মিশে থাকে আমাদের শ্রদ্ধা, ভালবাসা। তাই বীর্যবান তার দিকে আমাদের আকর্ষণ করেন।
অহল্যা বলল, আজ আমি ইন্দ্রকে দেবরাজরূপে চিত্রিত দেখতে চাই না। তুমি এমন একটি কাহিনী বলাে যাতে তার ভালবাসার রূপটি আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। যেমন আজ দেখেছি ছায়ার সঙ্গে তার লীলা। ধৃতি বললেন, তা হলে শােনাে ইন্দ্ৰ-শ্রুবাবতীর কাহিনী। অহল্যা প্রশ্ন করল, শ্রুবাবতী কি কোনও রাজকন্যা অথবা দেবলােকবাসিনী কোনও অপ্সরা ?
অপ্সরা কিংবা রাজকন্যা নয়, শ্রুবাবতী এক তাপসকন্যা। ভরদ্বাজ ঋষির কন্যা ছিলেন তিনি। অহল্যা আবার প্রশ্ন তুলল, তার মাতৃ পরিচয়? অলরা ঘৃতাচী তার জননী।। শুনেছি ভরদ্বাজ মহর্ষি, তিনি কি অপ্সরাকে গ্রহণ করেছিলেন?
পত্নীরূপে গ্রহণ করেননি, কামনায় কাতর হয়ে ঘৃতাচীর সঙ্গ প্রার্থনা করেছিলেন। অহল্যা বলল, মহর্ষিরাও তা হলে কামনায় কাতর হন। শুনেছি তারা জিতেন্দ্রিয়। ধূতি বললেন, সৃষ্টির আদিতেই কামনা। কামনার হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া কঠিন মা। অগিকে যেমন আবৃত করে রাখা যায় না, তেমনই কামনাকেও মিথ্যা আচ্ছাদনে ঢেকে রাখা সম্ভব নয়। তবে সমাজ-স্থিতির কারণে অন্তরে বাহিরে সংযমের শাসন প্রয়ােজন।
অহল্যা এবার বলল, “বাবতীর কাহিনী শােনাও এখন। তােমার পিতার মতাে শ্রুবাবতীর পিতাও চলে গেলেন হিমালয়ে। গভীর তপস্যায় নিজেকে নিয়ােজিত করলেন তিনি। পিতার আশ্রম পরিচালনার সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ল শ্রুবাবতীর ওপর।
তপস্বীর কন্যা নিজেকে সজ্জিত করলেন তপস্বিনীর আবরণে। আহারে বিহারে, বসনে ভূষণে আচরণে শ্রুবাবতী তাপসীরূপে পরিচিত হলেন। কিন্তু অন্তরে তার জ্বলতে লাগল কামনার একটি দীপ।
জননী ঘৃতাচী এবং ঋষি ভরদ্বাজের জ্বলন্ত কামনার যজ্ঞকুণ্ড থেকে জেগে উঠেছে তিনি, সুতরাং তার রক্তপ্রবাহের মধ্যেই কামনার কল্লোল।
অহল্যা বলল, শুনেছি, ঘৃতাচী মেনকা রম্ভা উর্বশীরা স্বৰ্গনটী। ধৃতি বললেন, স্বর্গের কলাবতী ওরা এবং দেবভােগ্যা। এবার শােননা বাবতীর কামনার ক্রন্দন। তিনি কঠোর তপস্যার ভেতর দিয়ে পেতে চাইলেন ইন্দ্রকে। ইন্দ্রলােকে পেীছােতে পারলেই তিনি পাবেন তার মায়ের সন্ধান। যে-মা সন্তানের মায়ায় আবদ্ধ নয়, স্বর্গের লীলাচক্রে যার নিত্য আবর্তন, সেই মায়ের রূপটি তিনি দেখতে চান। আর দেখতে চান সেই স্বর্গ, সেই স্বর্গের অধীশ্বরকে—যাঁর আকর্ষণে মর্তবাসী মানুষের মন নিত্য উর্ধ্বমুখী হয়ে আছে।
একটি অহংকারকে শুবাবতী অন্তরে পােষণ করে রেখেছেন। তপস্যার আকর্ষণে এই মাটির পৃথিবীতে তিনি টেনে আনবেন স্বর্গের অধীশ্বরকে।
তপস্যায় পিঙ্গল হল তার কেশভার। প্রপাতের মতাে প্রলম্বিত কেশ আবদ্ধ হল জটাজালে। গৈরিক বসনের আবরণে প্রচ্ছন্ন রইল না তার যৌবন-মহিমা। ঋষিকন্যার পরিশুদ্ধ লাবণ্যের সঙ্গে যুক্ত হল তাপসীর ধ্যানলব্ধ জ্যোতিলেখা।
একদিন শ্রুবাবতীর কঠোর তপস্যার পথ বেয়ে এলেন এক ব্রাহ্মণ যুবক। যৌবনের স্বর্ণরাগে প্রদীপ্ত তার দেহকান্তি।
শ্রুবাবতী তরুণ তাপসকে জানালেন সংবর্ধনা। পরিতৃপ্ত ব্রাহ্মণকুমার বললেন, আমার একটি অভিলাষ আছে, যদি পূর্ণ করেন তা হলে বলি।
শ্রুবাবতী বললেন, নারীর পক্ষে একান্ত অসম্ভব না হলে আমি তা পূর্ণ করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।
একটু থেমে আবার বললেন শ্রুবাবতী, আমি কোনও এক পুরুষের তপস্যায় মগ্ন ছিলাম, তিনি আমার প্রার্থিত পুরুষ, এ কথাটিও আপনাকে সবিনয়ে জানাচ্ছি।
ব্রাহ্মণ যুবক সহাস্যে বললেন, আপনার ব্যক্তিগত কামনা বাসনার সঙ্গে আমার অভিলাষের কোনও সম্পর্ক নেই। আমি বহুদূর থেকে আসছি। কয়েকদিন এই আশ্রমের অতিথি নিবাসে বিশ্রামের সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরের আরাধনায় নিযুক্ত থাকতে চাই। অবশ্য আপনার আন্তরিক আহ্বান পেলে।
শ্রুবাবতী বললেন, এ আমার পরম সৌভাগ্য মহাত্মন। আশ্রমের এক প্রান্তসীমায় ভরদ্বাজ ঋষির অতিথি নিবাস। বনবেষ্টিত দুটি পর্ণগৃহ বিশিষ্ট অতিথিদের জন্য নির্দিষ্ট। সন্নিকটে পুষ্পিত লতা বেষ্টন করে আছে আশ্রম পাদপ। সন্নিকটে পুষ্করিণী। কাষ্ঠ নির্মিত সােপান শ্রেণি নেমে গেছে পুষ্করিণীর অভ্যন্তরে। ওই জলাশয়টির অন্য এক প্রান্ত ছুঁয়ে আছে আশ্রমের মূল গৃহপ্রাঙ্গণ।
এই অতিথি নিবাসে রাজা থেকে উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী, সকলেই কোনও না কোনও উপলক্ষে অতিবাহিত করে গেছেন। তা ছাড়া রাজগৃহ অথবা কোনও বিত্তবান বণিকাগৃহ থেকে ভাগুরার সামগ্রী আসে। সেই বস্তুগুলি যাঁরা নিয়ে আসেন তাদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা থাকে ওই অতিথিগৃহে। কান্তিমান ব্রাহ্মণ যুবক পরম আনন্দে সেই অতিথি নিবাস আলাে করে রইলেন। দেখা যায়, উষার উদয়ের আগেই শয্যা ত্যাগ করে আচমনাদি সমাপনান্তে শ্রুবাবতী তরু আলবালে জলসিঞ্চন করছেন। তারপর পুষ্করিণীতে স্নান সমাপন করে অগ্নিশৌচ অংশুক (অগ্নিতাপে পরিশুদ্ধ বস্ত্র) পরিধান করে বৈনিক বহ্নি (যজ্ঞের আগুন) প্রজ্জালনে ব্যাপৃত।
আশ্রমিক কার্য কিছু পরিমাণে সমাধা করে বাবতী আসেন অতিথি নিবাসে। বাম করে ফলপূর্ণ থালিকা, দক্ষিণ করে জলপূর্ণ কমণ্ডলু। কোনওদিন বা থালিকাতে থাকে পিষ্টক। নিজ হাতে অতিথির জন্য সযত্নে প্রস্তুত। ব্রাহ্মণকুমার প্রসন্ন হাস্যে গ্রহণ করেন বাবতীর দেওয়া অর্ঘ্য। কোনওদিন বলেন, আপনার আন্তরিক সেবার জন্য আমার অকৃত্রিম সাধুবাদ।
আবার কোনওদিন বলতে শােনা যায়, আপনার দেওয়া তিনটি রসালাে পনসের কোষ আমার ক্ষুধার নিবৃত্তি ঘটিয়েছে।
একদিন তাপসকুমার বললেন, আপনার উদ্যানবাটিকায় মনােরম রক্তিমাভ স্থলপদ্ম ফুটে উঠতে দেখলাম। ইন্দ্রের পারিজাতকেও লজ্জা দিতে পারে।
অতিথির এই কথায় ক্ষুব্ধ হলেন শ্রুবাবতী। তবু মনের ক্ষোভ প্রচ্ছন্ন রেখে বললেন, এ ধরনের তুলনা করবেন না তাপস। আমার লজ্জার পরিসীমা থাকবে না। আমি যথার্থই বলছি মনস্বিনী।
শ্রুবাবতী মনের ক্ষোভ আর দমন করে রাখতে পারলেন না। বললেন, আপনি কি কখনও সুরপতির নন্দনকাননে প্রস্ফুটিত পারিজাত দেখেছেন? | স্মিত হাসি হাসলেন ব্রাহ্মণকুমার। বললেন, সর্বত্র আমার গতায়াত আছে জানবেন। আমি যে উক্তি করি তা আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতারই ফল। আমি ইন্দ্রের কাননে স্বচক্ষে পারিজাত দেখেছি।
ব্রাহ্মণকুমারের কথা শুনে সহসা বাক্যহারা হয়ে গেলেন শ্রুবাবতী। সবিস্ময়ে বললেন, ধন্য আপনি! আর আজ আমিও ধন্য এই ভেবে যে স্বর্গলােকে বিচরণকারী এক তাপসকে সেবা করার সুযােগ আমি পেয়েছি। ব্রাহ্মণকুমার বললেন, আপনার সেবাযত্নে আমি তৃপ্ত কম হইনি তাপসী।
শ্রুবাবতী সবিনয়ে বললেন, যদি দ্যুলােকের আর কিছু কথা আপনার কাছে জানতে চাই তা হলে কি আপনি আমার প্রগলভতাকে অমার্জনীয় বলে ভাববেন? প্রশ্ন করুন। আমি খুশি মনে উত্তর দেবার চেষ্টা করব।
শ্রুবাবতী বললেন, আমাদের মর্ত জীবনের সঙ্গে স্বর্গের জীবনের কোনও পার্থক্য আপনার চোখে পড়েছে কি?
সর্ব বিষয়ে স্বর্গের অধিবাসী নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করে। তারা মর্তের মানুষদের কাছ থেকে। পূজা পেতে চায়। তারা মর্তবাসীকে করুণা করতে ভালবাসে।
কথাগুলাে একান্ত সত্য জেনেও শ্রুবাবতী ব্যথিত হলেন। বললেন, আমরা দেবতাদের পূজার অর্ঘ্য নিবেদন করে অহংকারী করে তুলেছি। আপনার অনুমান অসত্য নয়, তবু বলি, তাদের অহংকার করবার কিছু কারণও আছে। তারা নানা বিষয়ে মর্তের মানুষের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিমান। শ্রুবাবতী বললেন, কিন্তু মর্তের ঋষিকুল কঠোর তপস্যায় যে শক্তি সঞ্চয় করেন তা অনেক ক্ষেত্রে দেবতারও সাধ্যাতীত।
সত্য, একান্ত সত্য শ্রুবাবতী। তবু সাধারণ মর্তবাসী মানুষের সঙ্গে দেবতাদের ক্ষমতার তুলনা চলে না।
শ্রুবাবতী বললেন, মাটির পৃথিবীর মমতা, ভালবাসা স্বর্গে কি দেখেছেন আপনি? মর্তের মমতাময়ী মা সন্তানের মঙ্গলের জন্য জীবনটুকুও বিলিয়ে দিতে পারে অক্লেশে, এ ছবি কি স্বর্গে দেখা যায় ? ভালবাসার জনকে পাবার জন্য সেখানে কি দুশ্চর তপস্যা করে নারী? ব্রাহ্মণকুমার অধােমুখে দাঁড়িয়ে বললেন, এখানে মর্তের কাছে স্বর্গ হার মানবে তাপসী।
শ্রুবাবতী বললেন, না চাইতে সবই পেয়ে যায় স্বর্গ, তাই তার হৃদয়ের কোনও ক্ষুধা নেই। তাপস বললেন, নির্মম সত্য।
শ্রুবাবতী অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন, আপনি কি কোনও স্বৰ্গনটীর নৃত্যলীলা দেখেছেন? আমার সে সৌভাগ্য বৈজয়ন্তধামে বসেই হয়েছে। কেমন সে নৃত্য? ভাষায় প্রকাশ সম্ভব নয় শ্রুবাবতী। তবু সামান্য কিছু ধারণা যদি পাই। ব্রাহ্মণ যুবক বললেন, পার্বত্য তরঙ্গিণীর ছুটে চলা দেখেছেন? নৃত্যলীলায় ছুটে যেতে যেতে সে যখন শিলাপে বাধা পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে কিংবা ত্ৰত কোনও হরিণীর দল যখন উল্লম্ফনে প্রান্তর পার হয়ে যেতে যেতে হঠাৎ থেমে ভীত চোখে পেছনে তাকিয়ে দেখে?
ঝড়ের দোলায় শাখা বাহু মেলে যখন পুষ্পিত আশ্রম-তরু আন্দোলিত হয় তখন নিশ্চয়ই সে দৃশ্য দেখে অভিভূত হয়েছেন আপনি। এইসব প্রকৃতির কলানৈপুণ্য স্বৰ্গনটীদের নৃত্যলীলায় প্রতি মুহূর্তে প্রকাশ পায়। তাদের আকুতি ঝরে চোখের দৃষ্টিতে। তাদের আমন্ত্রণ দেহ হিল্লোলে!
শ্রুবাবতী বললেন, সবই সুন্দর তবু একটা অপূর্ণতা থেকে যায়। কী সে অপূর্ণতা তাপসী? ওরা দুঃখ জানে না, তাই বেদনা ওদের অভিব্যক্তিতে ধরা দেবে না, দিতে পারে না। বেদনাই তাে সৃষ্টির প্রথম পাঠ। আপনার উক্তি সত্যেরই উচ্চারণ তাপসী। তবু আনন্দ থেকেই এই পৃথিবী আর প্রাণীকুলের উৎপত্তি।
আমার মনে হয়, সব কিছুর মূলে প্রথমে বেদনা, তারপর আনন্দ। পৃথিবী সৃষ্টির আদিতে। আলােড়ন, তারপর সেই বেদনার মন থেকে বেরিয়ে এল হাস্যময়ী, রূপবতী ধরিত্রী। জননীর ব্যথা যখন সীমাহীন হয় তখনই ভূমিষ্ঠ হয় আনন্দ-সুন্দর। ব্রাহ্মণকুমার বললেন, আপনার অনুভূতির গভীরতা স্পর্শ করবে যে-কোনও মানুষের হৃদয়। তবু স্বর্গের আরও আরও কাজ আছে, যে কাজে ধন্য হয় ধরিত্রী। কী সে কাজ তাপস প্রবর? কখনও কি ভেবে দেখেছেন, তাপদা ধরিত্রীকে বর্ষার সুধারস ধারায় স্নান করায় স্বর্গ? চন্দ্র সূর্য নক্ষত্র দীপ জ্বেলে পথের সন্ধান দেয় বসুধার মানুষকে? মৃত্যুর অন্ধকার সরিয়ে নবজন্মের আলাে জ্বেলে দেয় ঘরে ঘরে?
শ্রুবাবতী বললেন, স্বর্গের স্বপক্ষে আপনার যুক্তি সত্যিই প্রশংসনীয় তাপস।
এইভাবে নিত্য আলােচনার আসর বসে অতিথি সদনে। আলােচনা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে। শুশ্রুবাবতীর তপস্যায় বিঘ্ন ঘটে। মাঝে মাঝে মনকে শাসন করেন তিনি। ইন্দ্রকে যে তার চাই। স্বর্গে মাতৃদর্শনে যেতে গেলে ইন্দ্ৰই হবেন তার সহায়। কিন্তু কী অলৌকিক ক্ষমতা এই ব্রাহ্মণ তনয়ের। ইন্দ্রের ধ্যানমন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে সামনে আবির্ভূত হন এই তাপসকুমার! শুশ্রুবাবতী আকুল হয়ে মনে মনে বলেন, তুমি এমন করে আমার চিত্তকে অস্থির করে তুলে
ব্রাহ্মণ। সুরপতি ইন্দ্রই আমার সাধনার ধন। আমি তাকে পেতে চাই, তারই সঙ্গে হবে আমার স্বর্গলােক বিহার।
দুর থেকে ব্রাহ্মণকুমারকে তপস্যারত দেখতে পান স্শ্রুবাবতী। যে বৃক্ষের তলায় ধ্যানস্থ হয়ে বসেন তিনি, সেই বৃক্ষ সহসা যেন পুষ্পিত হয়ে ওঠে। পূর্ব দিগন্তে সূর্যের সুবর্ণ আভার মতাে একপ্রকার দ্যুতি খেলা করে বেড়ায় তরুণ তাপসের চতুর্দিকে। শুশ্রুবাবতীর সমস্ত অন্তর ওই আলােকছটার দিকে পতঙ্গের মতাে ধাবিত হয়। চিত্তের এই বিহুলতার কোনও ব্যাখ্যাই খুঁজে পান না তিনি। এক সন্ধ্যায় পূর্ণিমার চাঁদ ধরা পড়েছে নাগকেশরের শাখায়। পুষ্পের পরাগদণ্ড থেকে ঝরে পড়ছে পেলব পরাগ কণিকা। সান্ধ্য সমীর চুপিসারে কথা কইছে বনপল্লবের সঙ্গে। শ্রুবাবতী এসে দাঁড়ালেন ব্রাহ্মণকুমারের সামনে। নাগকেশরের তলায় তখন আলাে-আঁধারের সুচারু আলপনা। শ্রুবাবতী নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন। ব্রাহ্মণকুমার প্রথমে নীরবতা ভেঙে বললেন, কাল প্রভাতেই এ আশ্রম ত্যাগ করে চলে যেতে হচ্ছে, কিন্তু আমার সমস্ত মন পড়ে রইল এই আশ্রমের পুণ্যভূমিতে। তার পথ, তরুলতা, পশুপক্ষী, কুমুদশােভিত সরােবরে। আর আমি সঙ্গে নিয়ে গেলাম নিবিড় উত্তাপ ভরা দুর্লভ এক আতিথ্য। শুশ্রুবাবতী বললেন, সহসা সেবার এ সৌভাগ্যে আমি ধন্য হয়েছি তাপস। ব্রাহ্মণকুমার বললেন, বিদায়ের লগ্নে প্রাণ চায় কিছু দিয়ে যেতে। হােক তা সামান্য তবু স্মৃতির সুধায় ভরা। কল্যাণী, কিছু কি চাওয়ার নেই। হে তাপস, আপনার চরণ-স্পর্শে ত্রিভুবন ধন্য হয়ে আছে। যদি কোনওদিন যান সুরলােকে, দেখা হয় দেবরাজ বাসবের সঙ্গে, তা হলে তাকে দেবেন এই ক্ষুদ্র সমাচার, মর্তের মানবী এক তারই পথ চেয়ে আছে দিবস রজনী।
সমাচারে কী কাজ কল্যাণী। সঙ্গে যদি যেতে চান, নিয়ে যাব বৈজয়ন্ত ধামে। শ্রুবাবতী অধীর আনন্দে বললেন, সত্যই কী সৌভাগ্য আমার। দেবলােকে যাব আমি। সেখানে কি স্বৰ্গনটীদের নৃত্যলীলা দেখা যাবে?
অবশ্যই। বাসবের সঙ্গে আমি বাঁধা আছি বন্ধুত্বের অন্তরঙ্গ সম্বন্ধ বন্ধনে। সব আশা পূর্ণ হবে আপনার। সশরীরে স্বর্গে গেলেন শ্রুবাবতী। ব্রাহ্মণকুমারের বরে অদৃশ্য রইলেন তিনি। নন্দনকাননে ভ্রমণ করে পারিজাত দেখলেন তিনি। উদ্ধত শাখার শিখরে ফুটে আছে পারিজাত। উগ্র গন্ধে আকুল সম কাননভূমি। স্বর্গের চতুর্দিক ঘিরে তুর পর্বত। সেই — •• •••••• তুষারসৃষ্ট স্রোতস্বিনীর ধারা নীলাম্বরী আচ্ছাদনে অঙ্গ ঢেকে নন্দনের পাশ দিয়ে বয়ে চলে গেছে। পর্বতশিখর থেকে মাঝে মাঝে নেমে আসছে কুয়াশার ঢেউ। তার ওপর সূর্যালােকের বিচ্ছুরণে তৈরি হচ্ছে সপ্তবর্ণের ইন্দ্রধনু।
মণিরত্নখচিত বৈজয়ন্ত ধামের পাশেই একটি প্রশস্ত অঙ্গন। সেই অঙ্গনে কারিগরেরা এক সুদৃশ্য গৃহনির্মাণে ব্যস্ত ছিল।
ব্রাহ্মণকুমার শ্রুবাবতীকে বললেন, এটি সুরপতির কলানিকেতন। মূল কাঠামাের ওপর প্রতিদিন বিশ্বকর্মার তত্ত্বাবধানে কারিগরেরা নতুন গৃহ নির্মাণ করে। সেই গৃহটি সম্পূর্ণরূপে পুষ্প দিয়ে গড়া। প্রতিদিন নব নব রূপ আর ভঙ্গিমায় গৃহটিকে শশাভিত দেখা যায়। সমস্ত ফুলই আসে ওই নন্দনকানন থেকে। প্রতি সন্ধ্যায় স্বর্গভূমিতে স্বপ্নময় জ্যোৎস্নালােক। পুষ্পগৃহের অভ্যন্তরে চন্দ্রদেব তার উজ্জ্বল উপস্থিতির জন্য মােহময় আলাে বিকীরণ করেন। সেই আলােকে চলে দীর্ঘ রজনী নৃত্যগীতােৎসব। আজ বিশেষ সন্ধ্যার উৎসবে শ্রুবাবতীর হাত ধরে সবার অলক্ষ্যে বিশেষ একটি স্থানে বসিয়ে দিলেন ব্রাহ্মণ তনয়। বললেন, নৃত্য শেষে আমি স্বয়ং এসে নিয়ে যাব।
শ্রুবাবতী সকৃতজ্ঞ হাসি হেসে বললেন, আপনার এই অযাচিত করুণার কথা কোনওদিন ভুলব না আমি। ব্রাহ্মণকুমার শ্রুবাবতীকে কলানিকেতনে বসিয়ে রেখে বহির্গত হলেন। একে একে দেবদেবীগণ নির্দিষ্ট আসনে এসে বসতে লাগলেন। উদ্ভাসিত দেহকাস্তি। পরিহাস রসিকতা চলতে লাগল পরস্পরের মধ্যে। সহসা সকলে গাত্রোত্থান করলেন। শ্রুবাবতী দেখল, জ্যোতির্ময় এক পুরুষ পরম রমণীয়া এক নারীর কর গ্রহণ করে সভাগৃহে প্রবেশ করলেন। তার মস্তকে সুবর্ণনির্মিত মণিমাণিক্যখচিত মুকুট।
তিনি নির্দিষ্ট একখানি পুষ্পশােভিত আসনে উপবেশন করলেন। পার্শ্বের আসনখানি গ্রহণ করলেন সেই রমণী। তারা উপবেশন করামাত্র দেবদেবীরা নিজ নিজ আসন গ্রহণ করলেন।
শ্রুবাবতী নিশ্চিত হলেন, ইনিই ত্রিলােকন্দিত বাসব। পার্শ্বে পতিসােহাগিনী শচীদেবী। কিন্তু দেবরাজকে দেখে বিস্মিত হলেন শ্রুবাবতী। প্রদীপ্ত যৌবনের ভাস্বর দীপ্তি তার ললাটে। পুঞ্জীভূত শক্তি আর লাবণ্যের আধার তার দেহ। দীপ্তি আর স্নিগ্ধতার সমন্বয়ে বিশাল দুটি নয়ন ভাবমধুর। শ্রুবাবতীর মনে হল, কোথায় যেন তিনি তার এই একান্ত সাধনার ধনকে দেখেছিলেন, কিন্তু সম্পূর্ণ স্মরণে এল না তার। তবে কি তিনি এঁকে পেয়েছিলেন তার ধ্যানে? অথবা তার স্বপ্নের পথ বেয়ে রাতের শয্যার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন ত্রিভুবনন্দিত এই পুরুষােত্তম।
অপূর্ব বাদ্যধ্বনি শােনা যেতে লাগল। দূর থেকে নিকটে এগিয়ে আসছিল সে ধ্বনি। কলামন্দিরে প্রবেশ করে থেমে গেল সে সুরঝংকার। যন্ত্রীরা সুরশ্রেষ্ঠ বাসবের উদ্দেশে নমস্কার নিবেদন করে আসন গ্রহণ করলেন।
একে একে প্রবেশ করতে লাগলেন অনন্ত যৌবনা, অনিন্দ্য দেহসৌষ্ঠব সম্পন্ন এক একজন রমণী। নৃত্যের সুচারু বেশবাসে পরিপাটি দেহশ্রী।
দেবরাজের কাছে এসে নত নমস্কারে প্রথমজন তার পরিচয় দিলেন, আমি উর্বশী। স্তব্ধ শ্রুবাবতী, এই সেই ত্রিলোেক বাঞ্ছিতা উর্বশী। যার নুপুর ঝংকারে ত্রিভুবন যৌবন চঞ্চল। ইন্দ্র তার পার্শ্বে রাখা স্বর্ণথালিকা থেকে একটি কুসুম তুলে উর্বশীর হাতে দিলেন। উর্বশী সেটি কেশপাশে আবদ্ধ করলেন। আমি, মেনকা। আমি, বিদ্যুৎপর্ণা। আমি, রম্ভা। আমি, ঘৃতাচী। তড়িৎ প্রবাহ খেলে গেল শ্রুবাবতীর চেতনায়। সে কাকে দেখছে। অপরূপা এক তরুণী ইন্দ্রের হাত থেকে উপহার-পুষ্পটি গ্রহণ করে লীলাভরে কবরীতে গেঁথে নিলেন।
হুহু করে শ্রাবণের ধারা নেমে এল শুশ্রুবাবতীর নয়নে। মা, আমার মা। স্বৰ্গনটী ঘৃতাচী আমার মা। পিতা ভরদ্বাজ, কী দুর্ভাগ্য তােমার, ধরে রাখতে পারলে না তােমার এমন রক্তপদ্মের মতাে প্রস্ফুটিতা স্ত্রীরত্নকে। কিন্তু কেন তুমি চলে এলে মাগাে? সন্তানের কথা কি এই স্বর্গসুখের মাঝে একবারও মনে পড়ে না তােমার?
নৃত্য শুরু হয়ে গেল। আজিকার আসরে এই পঞ্চনটাই নৃত্যকলা প্রদর্শন করে দেবতাদের প্রীতিসাধন করবেন। প্রথম একক নৃত্যে যন্ত্রীরা তুলল জলতরঙ্গের ধ্বনি। নটীর সারা দেহ তরঙ্গিত, হিল্লোলিত হয়ে চলল। যেন সারা সরােবর দক্ষিণ সমীরণের স্পর্শে শিহরিত হয়ে উঠছে। দ্বিতীয় নর্তকী উপবেশন মুদ্রা থেকে ধীরে ধীরে নৃত্যলীলায় উথিত হলেন। সারা দেহ অপরূপ সুষমায় আন্দোলিত হচ্ছে। মনে হল জলের বাধা অতিক্রম করে জেগে উঠল মৃণালদণ্ড! মাথায় ধারণ করে রেখেছে কমল কলিকা। কোথা থেকে নেমে এলেন আলাের রশ্মিধারায় তৃতীয় নর্তকী। বারে বারে আলাের দ্যুতি ছড়িয়ে প্রদক্ষিণ করছেন মঞ্চ। আবার স্পর্শ করছে কমল কলিকাটিকে। সােহাগে, প্রণয়ে পূর্ণ করে তুলছেন প্রাণের কোরকটি। যেন সবিতার প্রণয়মধুর স্বাদ পাচ্ছে বিকচোন্মুখ কমলিনী। চতুর্থ নর্তকী এলেন ভ্রমরীর বেশে চঞ্চল পক্ষ বিধুননে। তার গুঞ্জনধ্বনি শােনা যেতে লাগল কুশলী যন্ত্রীর বাদ্যযন্ত্রে দ্রুত অঙ্গুলি সঞ্চালনে। মঞ্চ প্রদক্ষিণ চলল কতক্ষণ ভ্রমরী লীলায়।
পঞ্চম প্রবেশ করলেন জাগরণী গান গাইতে গাইতে। কষ্ঠে জাগগা জাগাে ধ্বনি, করমুদ্রায় দল মেলে জেগে ওঠার আহ্বান।
এবার পঞ্চনর্তকী নৃত্য শুরু করল মণ্ডলাকারে। আশ্চর্য সে নৃত্য। একটি পদ্ম তার এক একটি দল মেলে বিকশিত হচ্ছে। শেষে নৃত্যলীলায় প্রস্ফুটিত হল শতদল। সে কী অপরূপ সৌন্দর্যের বিকশিত মহিমা। যন্ত্রীদের ঐকতান ধ্বনিতে, দেবদেবীর সাধুবাদে, ইন্দ্রাণীর ঘন ঘন চুর্ণ পুষ্পদল নিক্ষেপে নৃত্যবাসর বর্ণ গন্ধময় হয়ে উঠল।
সভার সমাপ্তি-লগ্নে ইন্দ্র প্রত্যেক কলাবতীর হাতে একটি করে পারিজাতের সঙ্গে এক স্বর্ণভৃঙ্গার যৌবন-মদিরা তুলে দিলেন।
দেবদেবী চলে গেলেন। পুষ্পমন্দির শূন্য হয়ে গেল। শ্রুবাবতী একাকী বসে রইলেন লােকচক্ষুর অতীত হয়ে। আনন্দময় পূর্ণতার মাঝে কী এক অকরুণ হাহাকার উদাস রিক্ত করে। তুলল তার অন্তর।
ব্রাহ্মণ যুবক এসে দাঁড়ালেন তার পাশে। শ্রুবাবতী চোখ তুলে তাকালেন। চোখে তার অশ্রুবিন্দু। এবার একান্ত অন্তরঙ্গ বাক্যালাপে ব্রাহ্মণকুমার বললেন, তােমার চোখে জল শ্রুবাবতী। স্বর্গে শিশির আর বর্ষাধারা ছাড়া কোনও জলবিন্দু ঝরে না কখনও। নয়নে অশু স্বর্গবাসীদের একান্ত অপরিচিত। আমি মর্তকন্যা, তাই আমার নয়ন অবর্ষণে শান্ত হয়। হৃদয়ের গভীর বেদনা অশ্রুতেই তার প্রকাশের পথ পায়। তুমি চলাে কন্যা, বৈজয়ন্ত ধাম তােমার শুভ পদার্পণের প্রতীক্ষায়।
স্বর্গ তার চির যৌবন, চির আনন্দ নিয়ে থাক বাসব, আমি আমার ধরিত্রী মায়ের কোলে ফিরে যেতে চাই। তুমি চিনেছ আমাকে?
যৌবন-অমৃত দিয়ে গড়া তােমার দেহ, তুমি বিতরণ করাে সে অমৃত স্বর্গবাসী নটীদের, তাই চিনতে ভুল হয়নি তােমাকে।
তুমিও পাবে সে যৌবন-অমৃত আমার পরম অনুরাগিণী। কৃতজ্ঞ তােমার ওই অযাচিত দানের অভিপ্রায়। তবু সবিনয়ে বলি, চির যৌবন আমার কাক্ষিত নয় বাসব। তবে, কী তােমার কামনার ধন?
আমি দুঃখ চাই, আনন্দ চাই, যৌবন চাই, আবার যৌবনের অবসানও চাই। যেখানে সন্তানের দিকে চেয়ে মায়ের চোখে অশ্রু ঝরে না, সে স্বর্গ আমার মতাে মাতৃস্নেহাতুরের জন্য নয় সুরপতি। তুমি যথার্থই মর্তকে ভালবাসােশ্রুবাবতী। আমাকে করুণা করে মর্তে নিয়ে চলাে বাসব। এত সুখের নিশ্বাস নিতে আমার বুক ভারী হয়ে উঠছে। একটি বার তােমার জননীর মুখােমুখি দাঁড়াবে না? ম্লান হাসি হেসে বললেন শ্রুবাবতী, কী হবে তার যৌবন-মহিমাকে পীড়িত করে। আমি যে জননীকে দেখার জন্য স্বর্গলােকে আসতে চেয়েছিলাম, সে জননীর দেখা স্বর্গে পাব না কখনও। কেবল মতই সে জননীকে প্রসব করতে পারে। সুরপতি বললেন, কল্যাণী, আর একটি মাত্র প্রশ্ন করতে চাই তােমাকে।
শ্রুবাবতী তাকিয়ে রইলেন বাসবের দিকে।
তুমি কি তােমার প্রার্থিত কোনও পুরুষের জন্য স্বর্গের আকাঙ্ক্ষা করাে না? সেই হৃদয়াসীন পুরুষকে আমি মর্তের মাটিতে পেতে চাই। আমি তারই জন্য ধরিত্রীর স্থলপদ্মে অর্ঘ্য রচনা করে প্রতীক্ষায় থাকব। ধৃতির কাহিনী শেষ হল।
— — — — — •• -” — করতলে আনন ন্যস্ত করে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল অহল্যা। একটা ভাবনার ঢেউ প্লাবিত করতে লাগল তার হৃদয়। ধৃতি বললেন, কী ভাবছ মা?
শ্রুবাবতীর প্রার্থনা কি পূর্ণ হয়েছিল? ধৃতি বললেন, “শ্রুবাবতী মর্তনারীর আকাঙ্ক্ষার কথাটুকুই নিবেদন করেছে, এখানেই তার কাহিনীর শেষ।
অহল্যা অন্তরের গভীর থেকে বলল, শ্রুবাবতীর আকাক্ষা কখনও ব্যর্থ হতে পারে না। আমি যদি শ্রুবাবতী হতাম তা হলে বাসবকে একদিন আমারই তপস্যার পথ বেয়ে নেমে আসতে হত।
হাসলেন ধূতি। তিনি জানতেন অহল্যা চিরদিনই স্বাধীনচেতা। তাই অহল্যার শিরে হাত রেখে বললেন, প্রার্থিতকে পেতে গেলে প্রার্থনার গভীরতা চাই মা।
মহারাজ অসিতদেবলের কন্যা প্রবাহিনীর আজ আনন্দের সীমা পরিসীমা নেই। সে আজ দিবাভাগে রাজপুরী থেকে রথারােহণে এসেছে বৃদ্ধাশ্বের আশ্রমে। বহুকাল পরে দুই সখী পরস্পরের দর্শনে আনন্দে আকুল। কেউ কাউকে এত স্বল্প সময়ে ছেড়ে দিতে চায় না। পুঞ্জীভূত কথার পাহাড় জমে উঠেছে, তাকে কি এত সহজে ক্ষয় করা যায় ?
মধ্যাহ্নভােজ সমাপ্ত হল আশ্রমে। দুই বান্ধবীতে পরামর্শের পর প্রবাহিনী গেল অহল্যাকে রাজগৃহে নিয়ে যাবার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করতে। ধূতির অনুমতি পেয়ে রথে উঠল দুই বান্ধবী। পরস্পর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে রইল কতক্ষণ। পথে রথ থামানাে হল। গালভ আসছিল বহুদূর থেকে যজ্ঞের ঘৃত আর রন্ধনের লবণ বহন করে। একেবারে একই অনিন্দ্যসুন্দর মূর্তি ভ্রাতা-ভগিনীর।
অহল্যাকে রাজার রথ থেকে অবতরণ করতে দেখে প্রথমে সে হতচকিত, পরে সব কিছু জেনে ভগ্নীকে উৎসাহিত করে বলল, মানুষের সকল বিষয়ে অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়ােজন অহল্যা। আমরা আশ্রমিক, তাই বলে সমাজের অন্য বৃত্তির মানুষ সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকব, এ তাে মুঢ় কুপমণ্ডুকতা। আমি সানন্দে তােমার এ যাত্রায় আমার শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। তােমার সখীকে বলল, আশ্রমে তার যথাযােগ্য সমাদর হয়নি বলে দুঃখিত। গালভ আশ্রমের পথ ধরল। রথ ছুটে চলল রাজপুরী লক্ষ্য করে।
পর্বতের কোল ঘেঁষে পথ, নিম্নে সংক্ষুব্ধ শতদ্র। রাজগৃহ থেকে আশ্রম পর্যন্ত প্রসারিত সংকীর্ণ পায়ে চলার পথটিকে রাজা অসিতদেবল প্রশস্ত করে তৈরি করেছিলেন। মহারানি প্রিয়মেধা ঋষি বৃদ্ধাশের পত্নী দিব্যার সখী ছিলেন। বিবাহের পূর্ব থেকেই উভয়ের সখিত্ব। একই অঞ্চলে ছিল উভয়ের পিতৃগৃহ।
মাঝে মাঝে রাজগৃহ থেকে প্রিয়মেধা আশ্রমে আসতেন সখী সন্দর্শনে। প্রথমে শিবিকায় আসতেন। যাতায়াতে বিলম্ব ঘটত। পথ ছিল প্ৰস্তরাকীর্ণ। অতি সাবধানে শিবিকা বাহকেরা পথ অতিক্রম করত। উর্ধ্বদেশ থেকে অতর্কিতে অসংলগ্ন শিলাখণ্ডের নিম্নে গড়িয়ে পড়ার ঘটনা প্রায়শই ঘটত। শিলার আঘাতে সংকীর্ণ পথ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যেত। এসব কারণে মহারাজ পথ সংস্কারে মনােনিবেশ করলেন। বহুকালের অসংলগ্ন
শিলাখণ্ডগুলিকে তিনি বহু শ্রমিক নিযুক্ত করে স্থানচ্যুত করলেন। পথ প্রশস্ত করে রথ চলাচলের যােগ্য করে তুললেন। পথিপার্শ্বে রােপন করা হল বৃক্ষ। মহারানি সেই পথে রথারােহণে আসতে লাগলেন সখীর আশ্রমে। দুই সখীই গত হয়েছেন, কিন্তু মহারাজ অসিতদেবল নির্মিত পথ তেমনই অটুট রয়ে গেছে। এই পথেই রথ নিয়ে আসে প্রবাহিনী, মহারাজের প্রিয়তম কন্যা। রথ নিজের গতিতেই চলছিল, হঠাৎ পার্বত্য ঝঞ্জা ধেয়ে এল। মেঘপ তার জলভার নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল শৈলশিখর থেকে। ভেসে গেল পথ। স্রোতবাহিত প্রস্তরখণ্ডে নিশ্চিহ্ন হল পথরেখা। রথ থেকে নেমে দুই বান্ধবীতে তখন আশ্রয় নিয়েছে একটি শৈল গুহায়। অদুরে একাখযােজিত রথ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রথচালক।
সহসা আকাশের বুক চিরে নীলাভ শুভ্র বিদ্যুৎ খেলে গেল। পর্বত বিদীর্ণ করে বাজ পড়ল। বিশাল এক শিলাপ গড়িয়ে এসে রথ ও গুহার মাঝে সুউচ্চ ব্যবধান সৃষ্টি করে পথের উপর দাঁড়িয়ে রইল।
শঙ্কায় মূৰ্ছাহতের মতাে গুহার ভিতর পড়েছিল প্রবাহিনী। পার্বত্য ঝঞ্জা মুহূর্তে সব কিছু তােলপাড় করে দিয়ে শান্ত হয়ে গেল। কেবল চতুর্দিকে প্রবাহিত জলের কল্লোলধ্বনি শােনা যেতে লাগল।
অহল্যা আবাল্য দুঃসাহসী। সে সখীকে গুহার মধ্যে রেখে চতুর্দিকের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য বাইরে বেরিয়ে এল।
সামনে বিশাল শিলাপ পথ অবরােধ করে আছে, তাকে অতিক্রম করা দুঃসাধ্য। ওপারে সারথী আর রথের কী দশা হয়েছে তা সে জানতে পারল না। কিন্নর কৈলাসের দিকে তাকিয়ে দেখল, বর্ষাঘােয়া আকাশের বুকে শেষ সূর্যের হিরন্ময় আলাে ছড়িয়ে পড়েছে। তার মনে হল, ইন্দ্রের কিরীট থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে সে দীপ্তি।
এখন কী তার কর্তব্য। আশ্রমের পথ ধরে চলতে গেলেও সন্ধ্যার পুর্বে তার পক্ষে পেীছােননা। সম্ভব হবে না। তা ছাড়া সঙ্গিনীটি একান্ত দুর্বল। পদব্রজে এতখানি পথ অতিক্রম করা প্রায় অসম্ভব।
ভগ্নপথের প্রান্তে গভীর খাদ। উপরের পর্বত থেকে প্রপাতের মতাে একটা জলধারা আছড়ে পড়ছে ওই খাদে। এ পথে এই প্রপাত আজিকার প্রাকৃতিক সংক্ষোভের ফলে সৃষ্টি হয়েছে। অবরুদ্ধ, বিপর্যস্ত পথের মুক্তি কবে ঘটবে কে জানে। অহল্যা মনে মনে নিশ্চিত হল, আজ অবশ্যই ওই গুহার অভান্তরে রাত্রিযাপন করতে হবে।
বর্ষার পর নেমে এল পাহাড়ি শীত। এই শীতে অগ্নি প্রজ্বলন ছাড়া আত্মরক্ষার অন্য কোনও উপায় নেই। কিন্তু সিক্ত সমিধ প্রজ্বলিত হবে কীরূপে। অহল্যা চিন্তামগ্ন অবস্থায় ইতস্তত পরিভ্রমণ করতে লাগল। সহসা তার দৃষ্টি পড়ল পাশাপাশি আরও দুটি ক্ষুদ্র গুহার উপর। সে উঁকি দিয়ে দেখল, একটি গুহায় কিছু অর্ধদগ্ধ কাঠের সঞ্চয় আছে। তার মনে হল, পার্বত্য অঞ্চলে যে সকল কাঠুরিয়া কাষ্ঠ সংগ্রহের জন্য আসে, তাদেরই রন্ধনের উদ্বৃত্ত এগুলি। অথবা কোনও পশুচারক দলের পরিত্যক্ত এসব অরণি।
অহল্যা অর্ধদগ্ধ কাষ্ঠ বহন করে নিয়ে যেতে লাগল নিজেদের গুহায়। সে কাষ্ঠ ঘর্ষণে অগ্নি উৎপাদনের কৌশল জানত। সুতরাং রাত্রিতে শৈত্যে জমে যাবার আশঙ্কা থেকে সে রক্ষা পেল।
শেষ কাষ্ঠভার নিয়ে সে যখন গুহার দিকে পা বাড়িয়েছে, অমনি দেখল সামনে এক দিব্য পুরুষ। আশ্চর্য কমনীয়তার ভিতর প্রচ্ছন্ন ছিল তার শৌর্য। তিনি আয়ত দৃষ্টি মেলে তাকিয়েছিলেন অহল্যার দিকে। তার সে চোখে ছিল মুগ্ধতার ভাষা। পুরুষ বললেন, এই দুর্যোগের ভেতর অবেলায় এখানে সুকল্যাণী? অহল্যা বলল, রাজগৃহে চলেছিলাম দুই সখী। মহাদুর্যোগের ভেতর পড়ে গেছি। আমি কি কিছু সাহায্য করতে পারি? অন্য সখীটি কোথায়? প্রকৃতির এই বিপর্যয়ে সম্মুখের গুহায় আশ্রয় নিয়েছে। তােমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি কোনও আশ্রমকন্যা। আমার এ অনুমান কি সত্য কল্যাণী? অনুমান যথার্থ মহাত্মন। ঋষি বৃদ্ধাশ্বের কন্যা আমি।
পুরুষ বললেন, কোনও প্রশ্নের আগেই তােমাকে চিনে নেওয়া আমার উচিত ছিল। ত্রিলােকবাঞ্ছিতা।
এ কথার অর্থ কী পুরুষােত্তম? ঋষি বৃদ্ধাশের কন্যা অহল্যা ভুবন বিদিত। তুমি যখন মাতৃগর্ভে তখন তােমার জননী সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার উপাসনা করতেন। তাই দেব চতুর্মুখ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সুন্দর বস্তুগুলির সমন্বয় তােমার মধ্যে ঘটিয়েছিলেন। তুমি তিল তিল সৌন্দর্যে তিলােত্তমা হয়ে উঠেছ। তাই বলছিলাম, তােমার দর্শনমাত্রেই তােমাকে আমার চিনে ফেলা উচিত ছিল।
অহল্যা নত নমস্কারে বলল, আপনি আমার অভিবাদন গ্রহণ করুন পুরুষােত্তম। আপনার পরিচয় পেলে কৃতার্থ হই।
ইন্দ্র নামেই আমি বিদিত। কিন্তু এই মুহূর্তে তুমি আমাকে মর্তের সামান্য একজন মানবরূপে কল্পনা করতে পারাে।
ইন্দ্র’ নাম শ্রবণে যাওয়ামাত্র অপার আনন্দে রুদ্ধবাক হয়ে দাড়িয়ে রইল অহল্যা। তার বারবার মনে পড়তে লাগল ধৃতির মুখে শােনা শ্রুবাবতীর কাহিনী। সেই সুরশ্রেষ্ঠ ইন্দ্র স্বয়ং তার সামনে। পুলকে রােমাঞ্চে শিহরিত হতে লাগল তার সর্বদেহ।
সেই মুহূর্তে সে আকাশের বুকে দেখল সূর্যাস্তের লীলা। ছায়াকে নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেছে আদিত্যরূপী ইন্দ্র। অহল্যার গভীর আনন্দ এতক্ষণে ভাষা পেল, অপূর্ব! আলােছায়ার কী অপূর্ব লীলা। তুমি যথার্থই ত্রিলােকনন্দিতা। সচেতন হল এবার অহল্যা, পুরুষশ্রেষ্ঠ, আমার সখী এখনও গুহার অভ্যন্তরে শয্যাশায়িনী। তার দেহ সন্ধ্যাসমাগমে শৈত্যে নিশ্চয়ই কাতর। এই মুহূর্তে তার উত্তাপের প্রয়ােজন। ইন্দ্র বললেন, তুমি গুহায় যাও, আমি অবিলম্বে আসছি। দেখি, তােমার সখীর শীত নিবারণের কোনও ব্যবস্থা করা যায় কিনা।
ইন্দ্র চলে গেলেন। তরুণী অহল্যা অলৌকিক এক আনন্দের ভার বুকে নিয়ে গুহার মধ্যে প্রবেশ করল।
অরণি ঘর্ষণে প্রজ্বলিত হল অগ্নি। ধীরে ধীরে গুহার মধ্যে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়তে লাগল। প্রবাহিনী তাপের ছোঁয়ায় কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠে বসল। এ আমি কোথায় রয়েছি? অহল্যা তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, কোনও ভয় নেই প্রবাহিনী। বজ্রপাতের শব্দে মুর্ভূিতা হয়ে পড়েছিলে তুমি। এখন আমরা গুহার মধ্যে রয়েছি।
প্রবাহিনীর সব কিছু স্পষ্ট মনে পড়ল। সে আতঙ্কিত হয়ে বলল, আমার রথ। পিতা গভীর চিন্তায় পড়বেন।
অহল্যা তাকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সমস্ত কাহিনী শােনাল। পরে বলল, ওপর থেকে নেমে আসা এক বৃহৎ শিলাপ রথের সঙ্গে আমাদের ব্যবধান সৃষ্টি করেছে। প্রায় কান্নার গলায় প্রবাহিনী বলল, তবে উপায়! ঠিক সেই মুহূর্তে গুহার মুখে এসে দাঁড়ালেন এক পুরুষ। প্রবাহিনী আতঙ্কে জড়িয়ে ধরল অহল্যাকে!
অহল্যা বলল, ভয় পেয়াে না প্রবাহিনী! ইনি আমাদের পরম শুভার্থী। বিপদের দিনে বন্ধুর মতাে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। প্রবাহিনীর কাছে ইন্দ্রের পরিচয় নিজমুখে প্রচার করল না অহল্যা। ইন্দ্র গুহামুখে নত হয়ে একটি পাত্র অহল্যার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, এতে এক ধরনের তরল পানীয় রয়েছে। তােমার সখী প্রয়ােজন মতাে এটি অল্প অল্প পান করলে শৈত্যের হাত থেকে রক্ষা পাবে।
প্রবাহিনী তরল পানীয় সামান্য পান করামাত্রই একেবারে সুস্থ ও স্বাভাবিক বােধ করতে লাগল।
এখন তার দ্বিতীয় সমস্যা প্রাসাদে ফেরা। ইন্দ্র বললেন, কিছুকাল পরেই চন্দ্রোদয় হবে। আমার সঙ্গীদের কেউ তােমাদের এই শিলাপ পার করে রথে তুলে দিয়ে আসবে। তােমাদের রথ অক্ষত রয়েছে। এই অঞ্চলটুকু ছাড়া কোথাও গিরিপথের কোনও ক্ষতি হয়নি। তােমরা নিশ্চিন্তে চন্দ্রালােকে রাজগৃহে পৌছে যাবে।
অহল্যা বলল, প্ৰবাহিনী, তুমি প্রাসাদে চলে যাও। আমি এই গুহায় রাত্রিবাস করে প্রাতে আশ্রমে ফিরে যাব। কেন সখী? তুমি তাে রাজগৃহে যাবার অনুমতি নিয়েই এসেছ। সবই ঠিক প্রবাহিনী। কিন্তু তােমার পিতার ন্যায় আমার মাতৃস্বসাও গভীর চিন্তায় পড়বেন। মধ্যপথে ঝড় না এলে কারুরই চিন্তার কোনও কারণ ছিল না।
তুমি নিশ্চিন্তে যাও, আমি নির্বিঘ্নে আশ্রমে পৌঁছােতে পারব। চাদ উঠল, এবং অল্প সময়ের মধ্যে উদ্ভাসিত হল চরাচর। ইন্দ্রের ইঙ্গিতে তার দু’জন পার্শ্বচর এগিয়ে এলেন। অহল্যা বলল, প্রবাহিনী, তুমি নির্ভাবনায় এদের সঙ্গে গিয়ে রথে আরােহণ করাে। প্রবাহিনী সখীকে আলিঙ্গন করে ইন্দ্রের অনুচরদের সঙ্গে প্রস্থান করল। ইন্দ্র আর অহল্যা দাঁড়িয়ে রইল গুহার বাইরে।
প্ৰবাহিণীকে বিদায় দেবার পর অহল্যা এই চন্দ্রালােকেই আশ্রমে ফিরে যাবার কথা ভাবছিল। ইন্দ্র তার মনের কথাটি যেন জেনে নিয়ে বললেন, আমি কি আশ্রমে প্রত্যাবর্তনের পথে তােমাকে সঙ্গ দিতে পারি কল্যাণী?
স্মিত হাসি হেসে অহল্যা বলল, পুরুষােত্তম, সে আমার পরম সৌভাগ্য। কিন্তু এ নিশীথে আপনাকে শ্রান্ত না করে আমি অনায়াসে এ গুহায় নিশিযাপন করতে পারি। প্রভাতে আশ্রমের পথে যাত্রা শুরু করা যাবে। ইন্দ্র বললেন, যদি একান্তই গুহার আশ্রয়ে নিশিযাপন করতে চাও তা হলে আমি তােমাকে তােমারই উপযুক্ত একটি গুহার সন্ধান দিতে পারি। সে গুহা তােমারই মতাে রমণীয়, শীত নিবারণের সমস্ত আয়ােজনই সেখানে রয়েছে।
অহল্যা বলল, আমি যদি আপনার নির্দিষ্ট গুহায় রাত্রিবাস করি, তা হলে অন্য কেউ আমার জন্য আশ্রয়চ্যুত হবেন না তাে? তুমি নিশ্চিন্তে থাকবে সেখানে। সে গুহা আজিকার রাত্রির মতাে একান্ত তােমার। অহল্যা বলল, চলুন পুরুষােত্তম, আপনার নির্দিষ্ট গুহায় যাত্রা করি। অহল্যার রূপে বিমুগ্ধ হয়েছিলেন ইন্দ্র। এখন তার অসংকোচ ব্যবহার ও সাহসিকতায় তাকে রমণীরত্ন বলে ভাবতে লাগলেন।
ইন্দ্র দুর্গম স্থান পারাপারের সময় অহল্যার কর ধারণ করলেন। একটি তীব্র বেগসম্পন্ন স্রোতস্বিনী অতিক্রমের সময় অহল্যাকে তুলে নিলেন দুই করে। পার্বত্য স্রোতধারার মতাে তখন প্রবাহিত হচ্ছিল অহল্যার রক্তধারা।
ইন্দ্র তার পরিচ্ছদের অভ্যন্তর থেকে কতকগুলি অর্ধ শুষ্ক পত্র বের করে বললেন, এখন তুষার পর্বতের অনেকখানি উর্ধ্বে আরােহণ করতে হবে। এইপত্রগুলি চর্বণ করে। শরীরে কোনও ক্লেশ বােধ হবে না।
অহল্যা ইন্দ্রের হাত থেকে পাতাগুলি নিয়ে নির্ধিধায় চর্বণ করতে লাগল। কোনও কটু স্বাদ ছিল না সেই পত্রগুলির। বরং সুখকর এক প্রকার সুবাস নির্গত হচ্ছিল চর্বণের সঙ্গে সঙ্গে।
আশ্চর্য কার্যকারিতা এই পত্রগুচ্ছের। অহল্যার মনে হল, সে উড়ন্ত পাখির মতাে দুটি ডানা লাভ করেছে।
পর্বতশিলায় পুঞ্জীভূত তুষারের স্তুপ। সেই তুষারের মাঝে মাঝে সারি সারি বৃক্ষ। বৃক্ষের শাখা পল্লব শুভ্র হয়ে উঠেছে হিমানী সম্পাতে। চন্দ্র তার রজত কলস থেকে ঢেলে যাচ্ছিল অফুরন্ত জ্যোৎস্নার ধারা। মায়াময়, স্বপ্নমদির হয়ে উঠছিল চরাচর।
এবার অনেকখানি পথ শুভ্র তুষারের আবরণে মসৃণ। তরুলতাশূন্য প্রসারিত সে পথ উঠে। গেছে পর্বতশিখরের দিকে। যেন স্বর্গারােহিণীর পথ।
ইন্দ্রের হাতে হাত রেখে উড়ে চলেছে অহল্যা। শীত আর শ্রমের অনুভূতি লুপ্ত হয়েগেছে দেহ থেকে। কেঁপে কেঁপে উঠছে অননুভূত এক রােমাঞ্চের স্পর্শে। এই স্বপ্নময় জগত পেরিয়ে তারা কি প্রবেশ করবে কোনও রহস্যময় জগতে। দু’জনেই বাক্যহীন। চলার আনন্দে শুভ্র স্রোতধারায় ভেসে চলেছে তারা। একস্থানে এসে ইন্দ্ৰ গতি সংবরণ করলেন। থামালেন অহল্যাকেও।
কর প্রসারিত করে বললেন, ওই দূরে আকাশের সুনীল চন্দ্রাতপের নীচে একটি শিখর দেখতে পাচ্ছ? চতুর্দিকে শুভ্র আচ্ছাদনের মাঝে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কিছু দৃষ্টিগােচর হচ্ছে?
অহল্যা বলল, “শিখরটি নীলাভ কৃষ্ণবর্ণের বলে মনে হচ্ছে। তবে আশ্চর্য হচ্ছি এই ভেবে যে এত উচ্চ শিখরশীর্ষেও একবিন্দু তুষারের আবরণ পড়েনি।
ওই হল কৈলাসপতির নিবাস। পার্বতী পরমেশ্বরীর সঙ্গে তিনি ওই আনন্দলােকে নিত্য বিহার করেন।
অহল্যা তুষারভূমির উপর নতজানু হয়ে নমস্কার করল। ডানদিকে কর প্রসারিত করে ইন্দ্র বললেন, ওই হল অপ্সরাদের গমনপথ। ওর নীচে সংখ্যাতীত পর্বতবেষ্টিত কিন্নরলােক। এখন আমরা অপ্সরাদের গমনপথ ধরে যাত্রা করব। ওরা এপথ ধরে কোথায় গমনাগমন করে? স্বর্গ থেকে ওরা এই পথে আসে অচ্ছেদ সরােবরে স্নান করতে। আবার ইন্দ্রের হাত ধরল অহল্যা। ডানদিকের পথ ধরে এবার উর্ধ্বলােকে উঠে চলল। দুই তুষার পর্বতের মাঝে গিরিসংকট পেরিয়ে অহল্যা শুনতে পেল সুমধুর সংগীতধ্বনি। অস্পষ্ট সে সুর। নারীকণ্ঠ নিঃসৃত ঐকতান।
কারা গাইছে পুরুষােত্তম? কিন্নরীদের সুধাকণ্ঠের শ্রবণ সুখকর সংগীত তুমি শুনতে পাচ্ছ। ওরা অনেক নিম্নের উপত্যকাভূমিতে বসে গাইছে। ওদের কণ্ঠের স্বর্গীয় সুর পবনদেবতা হরণ করে সুরলােক পর্যন্ত প্রেরণ করছে।
এবার কিছু উতরাই পথ অতিক্রম করেই ওরা এসে পৌছােল অনুচ্চ পর্বত বেষ্টিত এক সরােবরের তীরে।
অহল্যার পলক পড়ে না। অনুভূতি কখন তার চরম সীমা স্পর্শ করেছে। ইন্দ্রনীলমণির মতাে জলভার বুকে নিয়ে স্থির হয়ে শুয়ে আছে অচ্ছােদ। শুভ্র রাজহংসের মতাে অলস মধুর গতিভঙ্গিতে তার উপর ভেসে বেড়াচ্ছে তুষারখণ্ডগুলি। চাঁদের কিরণ দুই শুভ্র শিখরের মাঝ দিয়ে এসে পড়ছে জলতলে। সেই কিরণপথ ধরেই কি অপ্সরার দল নেমে আসে জলে? স্নানলীলা সমাপন করে প্রথম সূর্যের কিরণপাতে গড়া ইন্দ্রধনুর তােরণদ্বার দিয়ে ওরা কি প্রস্থান করে সুরলােকে?
অহল্যা সরসীর তীরে দাঁড়িয়ে এই সকল প্রশ্ন মনে মনে আলােচনা করছিল। ইন্দ্র সহসা তার হাত ধরে আকর্ষণ করতে ধ্যানভঙ্গ হল। এবার আমাদের যেতে হবে রাতের গুহা নিকেতনে। কিছু পরেই অপ্সরার দল আসবে জল বিহারে। তারা কোনও দর্শকের সন্ধান পেলেই ফিরে চলে যাবে।
অহল্যা ইন্দ্রের হাত ধরে চলল গুহা অভিমুখে। অধিক পথ অতিক্রম করতে হল না। একটি শীর্ণকায়া জলধারা বস্ত্র পরিধানে অনভ্যস্ত কিশােরীর মতাে তার নীলাম্বরী শাড়িখানা তুষার পথের উপর ললাটাতে লােটাতে এগিয়ে চলেছিল। মাঝে মাঝে লজ্জায় ঢুকে পড়ছিল তুষার আচ্ছাদনের আড়ালে। আবার বেরিয়ে আসছিল কিছু দূরে গিয়ে। সেই জলধারার একটি তীরে আশ্চর্য মনােরম এক গুহা নিকেতন।
তুষারে গড়া স্তম্ভের উপর বরফ ঢাকা ছাদ। গুহা নিকেতনটি বেশ প্রশস্ত। চারিদিকে তুষারে গড়া আশ্চর্য সব ঝালরের কাজ। দেওয়ালের গায়ে গায়ে প্রকৃতির নিজ হাতে গড়া অশ্বারােহীদের যুদ্ধযাত্রার ছাপ, হক্তিপৃষ্ঠে মহারাজের শােভাযাত্রা, নর্তকীদের নৃত্যলীলা।
ইন্দ্র প্রথমে গুহায় প্রবেশ করলেন। সহসা জ্বলে উঠল একটি মণিদীপ। স্নিগ্ধতিতে দৃশ্যমান হল গুহা।
অহল্যা দ্বার-মুখে নত হয়ে সেই অদৃষ্টপূর্ব রমণীয় গুহাটিকে দেখছিল, ইন্দ্র তাকে কর সঞ্চালনে ভিতরে আহ্বান করলেন।
অহল্যা গুহার মধ্যে প্রবেশ করল। বাইরের শীতল বায়ুপ্রবাহ না থাকায় গুহাটির অভ্যন্তরভাগ বেশ আরামপ্রদ মনে হল। তুমি ওই চর্মাসনে উপবেশন করাে কল্যাণী। ওটি কৃষ্ণসার মৃগ চর্ম।
অহল্যা ইন্দ্রের নির্দেশ মতাে আসনের উপর উপবেশন করল। সে তখন ওই স্বল্প আলােতেও গুহার অভ্যন্তরের সব কিছু দেখতে পাচ্ছিল। গুহা কোণে নাতিবৃহৎ একটি বেত্র-মঞ্জুষা। কতকগুলি রৌপ্য ও সুবর্ণনির্মিত পাত্র ইতস্তত রক্ষিত। কোনও কোনও পাত্র আচ্ছাদিত।
অহল্যাকে ইতস্তত দৃষ্টিপাত করতে দেখে ইন্দ্র বললেন, এটি শচীর সংসার। তিনি মাঝে মাঝে অচ্ছেদ সরসীতে স্নান করতে আসেন। তখন এসব তাঁর প্রয়ােজনে লাগে।
অহল্যা শুধু মন্তব্য করল, অপরূপ এই গুহা। ইন্দ্র মােহময় কণ্ঠে বললেন, আজ এই গুহা তােমার কল্যাণী।
অহল্যা ইন্দ্রের এ ধরনের উক্তির কী উত্তর দেবে ভেবে পেল না। সে এই গুহা প্রসঙ্গেই বলল, জ্যোৎস্না-বােয়া অনন্ত শুভ্রতার রাজ্যে, নীলকান্তমণির মতাে নীল জলে ভরা সরােবরের সংলগ্ন অঞ্চলে এই গুহাটি রাজপ্রাসাদের চেয়েও কাম্য।
ইন্দ্র বললেন, তােমার জন্য আমি এই পরিবেশে এমনই এক সুরম্য গুহা নির্মাণ করে দিতে পারি।
সহসা অহল্যার উচ্ছল হাসিতে গুহাটি শব্দিত হতে লাগল। হাসি থামলে অহল্যা বলল, আমি আশ্রমকন্যা। প্রধানত আশ্রম তরুর ফলেই আমাদের ক্ষুন্নিবৃত্তি হয়। এখানে কি সুরপতি আমার ভরণপােষণের জন্য একটি উদ্যান রচনা করে দেবেন?
ইন্দ্র বললেন, মায়াকানন তৈরি হতে পারে কল্যাণী, কিন্তু চিরস্থায়ী কোনও তরুলতার জন্ম এখানে সম্ভব নয়। অহল্যা বলল, কেবল স্নানলীলার জন্য আশ্রম থেকে এত দুরে আসা সম্ভব নয় সুরশ্রেষ্ঠ। তা ছাড়া আজিকার মতাে সুযোেগ ইচ্ছামাত্রেই পাওয়া যাবে না। ইন্দ্র বললেন, তুমি তােমার সুযােগ সময় আর বাসনা মতাে আসতে পারাে। আপনার অনুগ্রহই আজ আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। এ অনুগ্রহ প্রতি রজনীর নয় পুরুষােত্তম। আজিকার এ রজনী আমার মনের মঞ্জুষায় স্মৃতির উজ্জ্বল রত্ন হয়ে রইল জানবেন। কোনও নিভৃত অবসরে এই রত্ন দুঃখের সান্ত্বনা হয়ে দেখা দেবে।
ইন্দ্র সহসা উন্মােচন করলেন তার পেটিকা। একটি ইন্দ্রনীলমণি খচিত অঙ্গুরীয় পেটিকা থেকে তুলে এনে অহল্যার অঙ্গুলিতে পরিয়ে দিতে দিতে বললেন, এই অঙ্গুরীয়ের মণির দিকে তাকালে নামটি তােমার স্মরণে আসবে।
অহল্যার প্রদীপ্ত আঁখির কোণে জলবিন্দু দেখা দিল। মুক্তার মতাে টলটলে সেই ধারা গড়িয়ে পড়ল তার নিটোল লাবণ্যময় কপােলে। ইন্দ্র সবিস্ময়ে বললেন, তােমার আঁখিতে অশ্রু সুকল্যাণী! বৃষ্টি শেষের রােদুরের মতাে কোমল একটুকরাে হাসি ফুটে উঠল অহল্যার মুখে। বলল, এই ক্ষুদ্র হৃদয়ের পাত্রে অলৌকিক আনন্দের এত সুধা কী করেই বা ধরে রাখি। তাই উপচে পড়ল দুটি কণা। এ অশ্রু নয় পুরুষােত্তম, এ সুগভীর আনন্দসুধা।
ইন্দ্র সেই মুহুর্তে আবেগে অহল্যার হস্ত উত্তোলন করে অঙ্গুরীয়ের মণিতে চুম্বন চিহ্ন এঁকে দিলেন।
সহসা অহল্যার মুখমণ্ডলের দীপ্ত আলােকশিখা নিভে গেল। জলপূর্ণ মেঘের ছায়া ঘনাল সুহাসিনী দৃষ্টিতে।
আপনি কেন আমার দেহে কামনার এ স্পর্শ ছড়িয়ে দিলেন পুরন্দর। এর দাহিকা শক্তি অগ্নিরও অধিক। নিত্য হৃদয়কে পােড়াবে।
আমি প্রতিদিন তােমাকে স্মরণ করি কন্যা। আজ নয়, যেদিন তুমি তােমার কৈশােরের কলিকা উন্মােচন করে তারুণ্যের সুবাস ছড়িয়ে দিয়েছিলে, সেদিন সুরলােকে বসেও সে সৌগন্ধ। আমি পেয়েছি। আজ তােমার কাছে স্বীকার করতে কুণ্ঠা নেই, আমি সঙ্গোপনে আশ্রম তরুর আড়াল থেকে তােমাকে দেখে এসেছি। সেদিন থেকে আমার দিবসের কর্মে, নিশীথের স্বপ্নে তােমারই উপস্থিতি। দুটি পত্র যেন একটি চম্পক কুসুমকে ধরে রেখেছে, এমনই এক মুদ্রায় নিজের দুই করতলে মুখভার স্থাপন করে বসেছিল অহল্যা। সে স্বপ্নগুঞ্জনের মতাে শুধু শুনে যাচ্ছিল ইন্দ্রের মথিত ‘হৃদয়ের উচ্ছ্বসিত বাণী।
তার মনে হচ্ছিল অনুরাগ কী আশ্চর্য বস্তু! ত্রিভুবনের সর্বাপেক্ষা শক্তিমান ব্যক্তিও নতজানু হয়ে প্রেম প্রার্থনা করে। প্রেমের শক্তির কাছে ভুবনের সর্বোত্তম আয়ুধও একান্ত নিষ্ফল!
অহল্যাকে স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকতে দেখে ইন্দ্র আরও উচ্ছ্বসিত হয়ে বলতে লাগলেন, তােমার এই ভুকমনমােহিনী রূপের কল্পনা যিনি করেছিলেন, সেই সৃষ্টিকর্তা চতুর্মুখের কাছে আমি যাই। তার কাছে সাধারণ ভিক্ষুকের মতাে তােমার পাণি প্রার্থনা করি। অমনি ব্রহ্ম মৃদু হেসে আমাকে বিরত করে বলেন, শুদ্ধাচারী এক ঋষির সঙ্গে তােমার বিবাহ নাকি স্থির হয়ে আছে। জীবনে এতখানি নৈরাশ্য আর কখনও অনুভব করিনি সুকল্যাণী।
অহল্যা যথার্থই বিস্মিত হল। কারণ সে জানত না যে তার বিবাহ পূর্ব নির্ধারিত। সে বলল, সুরশ্রেষ্ঠকে পতিরূপে লাভ করা ত্রিলােকের যে-কোনও নারীর পক্ষেই পরম সৌভাগ্যের। কিন্তু কোনও ঋষির সঙ্গে বিবাহবন্ধনের কথা এতকাল আমার অপরিজ্ঞাতই ছিল। ইন্দ্র বললেন, আজ আমি পরম সৌভাগ্যবান। অন্তত একটি বিনিদ্র রজনী আমি আমার মানসপ্রিয়াকে কাছে পেতে পারব। অবশ্য যদি তার অন্তরের কোনও দ্বিধা না থাকে।
তােমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইন্দ্ৰ তােমাকে গ্রহণ করবে না কল্যাণী। ইন্দ্র অনার্য রাক্ষস কিংবা দৈত্য কুলােদ্ভব নয়।
ইন্দ্রের প্রতি সন্ত্ৰমে পূর্ণ হল অহল্যার অন্তর। সে বলল, প্রিয়তম, আমার গভীর শ্রদ্ধা আর ভালবাসা গ্রহণ করুন। যে মুহূর্তে আপনার অঙ্গুরীয় আমার অনামিকা স্পর্শ করেছে, আর আমি বিনা প্রতিবাদে তা গ্রহণ করেছি, সেই মুহূর্ত থেকে আপনি আমার জীবনের প্রার্থিত পুরুষ।
কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে নীরবে বসে রইল অহল্যা। পরে অনামিকা থেকে অঙ্গুরীয়টি উন্মােচন করে ইন্দ্রের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, প্রিয়তম, আমার এ রত্ন আপনার কাছেই গচ্ছিত থাক। অন্তরে যে নাম খােদিত হয়ে যায় তাকে স্মরণ করার জন্য অন্য কোনও অভিজ্ঞানের প্রয়ােজন হয় না। আমি এখন আশ্রমদুহিতা। আগেই বলেছি পিতার অধীন। বিধাতা আমার ভাগ্যকে কোন পথে পরিচালিত করেন, দেখা যাক। তবে আমার অন্তর থেকে উচ্চারিত একটি বাক্য আপনি সত্য বলে অবশ্যই গ্রহণ করতে পারেন। আমি জীবনের চক্র পরিক্রমায় যেখানেই থাকি
কেন, কোনওদিন একথা ভুলব না যে আপনিই আমার জীবনের প্রথম পুরুষ। তাই আমার ওপর আপনার অধিকার সবার চেয়ে বেশি। ইন্দ্র অঙ্গুরীয়টি নিজের অঙ্গুলিতে পরে নিয়ে বললেন, তােমার দেহের স্পর্শমাখা এই অঙ্গুরীয়টি প্রতি মুহুর্তে তােমাকে আমার কাছে রেখে দেবে। দূরে গেলেও তুমি থাকবে আমারই দেহের সীমার মধ্যে।
অহল্যা বলল, কেন জানি না এই মুহূর্তে অচ্ছেদ সরােবরের জল স্পর্শ করতে গভীর বাসনা জাগছে। ইন্দ্র বললেন, আমিও তােমার সঙ্গে যাব কল্যাণী। চলাে, দু’জনে আজ অচ্ছােদের জল স্পর্শ করে অচ্ছেদ্যবন্ধনের শপথ নিই।
ইন্দ্র আর অহল্যা অচ্ছােদের তীরে এসে শীতল জল স্পর্শ করল। অঞ্জলিতে দু’জনেই জল গ্রহণ করে শপথ নিল, তারা সামাজিক বিধানে যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন, অন্তরের বিধানে পরস্পরে অটুট বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে। ফিরে আসার পথে শিলাপের আড়ালে প্রস্ফুটিত কুসুম দেখে ইন্দ্র বললেন, আশ্চর্য! তােমার জন্য প্রকৃতি আজ তুষারের রাজ্যেও কুসুম ফুটিয়েছে।
বলতে বলতেই অহল্যার কবরীতে পরিয়ে দিলেন একটি ফুল। গভীর পুলকে, বসন্ত পবনে শিহরিত কিশলয়ের মতাে কেঁপে কেঁপে উঠল অহল্যার হৃদয়।
ইন্দ্র সহসা অহল্যার হাত ধরে বললেন, এসাে আমরা সম্মুখের ওই শিলাপের আড়ালে আত্মগােপন করি। কেন পুরুষােত্তম? এখানে আমরা দু’জন ভিন্ন আর কোনও সচেতন প্রাণীর অস্তিত্ব কি ধরা পড়েছে? কথা বলতে বলতেই ইন্দ্রের হাত ধরে শিলাপের আড়ালে চলে গেল অহল্যা। ইন্দ্র বলল, ওই তাকিয়ে দেখাে, স্বর্গলােক থেকে অপ্সরাপথ ধরে আমার নৃত্য বাসরের অলরার দল এগিয়ে আসছে।
অহল্যা মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখল, জ্যোৎস্নার শুভ্র ওড়না উড়িয়ে নন্দনবন বিহারিণী কন্যারা ছন্দের হিল্লোল তুলে অচ্ছেদ সরসীর দিকে ধেয়ে আসছে।
ইন্দ্র একে একে নর্তকীর পরিচয় দিচ্ছিলেন অহল্যাকে। সম্মুখে উর্বশী। সমস্ত দলটিকে সুরলােক থেকে পরিচালিত করে নিয়ে আসছে। হিমানীর তন্তুতে বােনা আশ্চর্য স্বচ্ছ আর কোমল পােশাক পরিধান করেছে সে। প্রতিটি নর্তকীর পরনে সেই একই পােশাক। অপরূপ দেহভঙ্গিমা তাদের। তুষারের রাজ্যে তারা যেন এক একটি তুষার প্রতিমা।
ঊর্বশীর পিছনে একে একে সুরলােক থেকে নেমে আসছে তিলােত্তমা, ঘৃতাচী, মেনকা, রম্ভা, রুচিরা, সুমধ্যা, সােমা, মিশ্রকেশী আর বিদ্যুৎপর্ণা!
ওরা এসে দাঁড়াল অচ্ছেদ সরসীর তীরে দিগন্ত প্রসারিত প্রাঙ্গণে। নক্ষত্রখচিত চন্দ্রাতপের মাঝে উজ্জ্বল রৌপ্য থালিকার মতাে চন্দ্র শশাভা পাচ্ছে। শুরু হল নৃত্য। মণ্ডলাকারে জ্যোৎস্নার ওড়না উড়িয়ে তুষারের বুকে পদচিহ্ন একে একে নৃত্য করছে ওরা। হিমানীর স্বচ্ছ পােশাকে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে দেহরেখাগুলি! আশ্চর্য! প্রতি জনের গঠন পারিপাট্য স্বতন্ত্র, কিন্তু প্রতিটি দেহভঙ্গি নিখুঁত সুষমামণ্ডিত।
দ্রুতলয়ে নাচছে ওরা। ক্ষিপ্র চরণ সঞ্চালনে তুষারপরাগ উখিত হচ্ছে। সংগীতের সুরধ্বনি নির্জন নিস্তব্ধ চরাচরে ছড়িয়ে পড়ছে।
ওরা সংগীতের বাণীতে বলছে, মর্তের মাধুরী আমরা অঙ্গে মেখে নিলাম। স্বর্গ-বিহারের সময়েও আমাদের মনে থাকবে এই সুখস্মৃতি। আমাদের নৃত্য ত্বরান্বিত করুক বসন্তের আবির্ভাব। লগ্ন। দিগন্তের অরণ্যলােক পুস্পিত হােক। পুষ্পগন্ধী পবন বয়ে আসুক আমাদের নৃত্যের আঙিনায়।
একসময় ওদের নৃত্যের দ্রুততম লয়ের সঙ্গে মিশে গেল জ্যোৎস্নার ধারা, হিমানীর তরঙ্গ আর তুষারের পরাগ। শুভ্রতার মেঘ সমস্ত অবলুপ্ত করে দিয়ে দিগন্ত পরিব্যাপ্ত করে উথিত হল গগনললাকে। সেই শুভ্র অন্তরালের মধ্য দিয়ে মুক্তবসনা অপ্সরার দল কলহংসীর ধ্বনি তুলে ঝাপিয়ে পড়ল অচ্ছেদ সরােবরে। ওদের দেহতাড়িত জলবিন্দু উর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত হয়ে অসংখ্য মুক্তা কণিকার শােভা ধারণ করল। ইন্দ্র বলল, চলাে কল্যাণী, এবার গুহায় ফিরে যাই।
অহল্যার যেন স্বপ্নভঙ্গ হল। সে এতক্ষণ বিহার করছিল ওই নর্তকীদের মণ্ডলের মধ্যে একটি রক্তপদ্মের মতাে। শ্বেতবসনা নর্তকীদের মনে হচ্ছিল শ্বেত মরাল। তারা প্রস্ফুটিত রক্তকমলটিকে বেষ্টন করে আনন্দে আশ্লেষে প্রমত্ত হয়ে উঠেছিল। ইন্দ্রের আহ্বানে সচেতন হয়ে উঠল অহল্যা। সে ইন্দ্রের হাত ধরে ফিরে গেল গুহায়।
তেমনই মণিদীপ জ্বলছিল। আধাে আলাে, আধাে অন্ধকারে গুহার অভ্যন্তর মায়াময়। ইন্দ্র বললেন, ওই কৃষ্ণাজিনের ওপর রচনা করাে তােমার রাতের শয্যা। গুহা কোণে রক্ষিত আছে পানীয়। ওই অমৃত সুধারস তােমার দেহে এনে দেবে উত্তপ্ত সুখনিদ্রা। শয্যা গ্রহণের পূর্বে তুমি অবশ্যই গ্রহণ করবে সুবর্ণপাত্রে রক্ষিত ভােজ্য সামগ্রী।
অহল্যা বলল, আসনে আপনি উপবেশন করুন, আমি প্রথমে আপনাকে ভােজ্য পরিবেশন করি।। ইন্দ্ৰ অহল্যার পরিশুদ্ধ হস্ত পরিবেশিত আহার্য গ্রহণ করলেন। পরিতৃপ্ত হলেন অন্তরে। অহল্যা বহু যত্নে আর আন্তরিকতায় সাজিয়ে দিয়েছিল ভােজ্য। পার্শে উপবেশন করে রমণীর
মমতায় তাকিয়েছিল ইন্দ্রর দিকে। আজ তার কেবলই মনে হচ্ছিল, এই ভােজনের অনুষ্ঠানটি কি আর কোনওদিন ফিরে আসবে তার জীবনে।
ইন্দ্র আচমন শেষে গুহার বহিৰ্বার থেকে বললেন, কল্যাণী, আহারাদি সমাপ্ত করে তুমি নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাও। অভ্যন্তর থেকে নিশাকালে একাকী বহির্গত হয়ে বিস্তীর্ণ তুষার প্রাঙ্গণে পরিভ্রমণের চেষ্টা করলে সহজেই পথভ্রষ্ট হবার সম্ভাবনা।
অহল্যা সসংকোচে বলল, কিন্তু পুরুষােত্তম, আপনি কীভাবে নিশিযাপন করবেন? আপনি কি আমার মতাে একজন আশ্রমকন্যাকে আশ্বস্ত করতে গিয়ে দীর্ঘ রজনী উন্মুক্ত প্রকৃতির বুকে কাটাবেন? তার চেয়ে আসুন জাগরণ আর আলাপনে এই অলৌকিক রজনী অতিবাহিত করি। ইন্দ্র বললেন, তােমার আহ্বানে আমার সকল দ্বিধা দুর হল কল্যাণী। এখন কুণ্ঠাহীন চিত্তে লাভ করব তােমার দুর্লভ সান্নিধ্য।
দু’জনের মাঝে জ্বলতে লাগল স্নিগ্ধ মণিদীপ। বিরহ-মিলন, অনুরাগ-অভিমানের ফুলে গাঁথা হল সুপ্তিহীন বিভাবরীর অনির্বচনীয় একখানি মালা।
প্রত্যুষের বর্ণরাগ ছড়িয়ে পড়ল উদয়দিগন্তে। ইন্দ্র অশ্রুভারাক্রান্ত অহল্যার হাত ধরে নিয়ে এলেন বাইরে। বললেন, অচ্ছােদের দিকে চেয়ে দেখাে একবার।
অহল্যা তাকিয়ে দেখল সত্যিই অপার বিস্ময়। দুই তুষার পর্বতের মাঝে ঝরে-পড়া জলকণিকায় সৃষ্টি হয়েছে ইন্দ্রধনু। সেই তােরণের ভিতর দিয়ে পার হয়ে গিয়ে অপ্সরার দল দাঁড়িয়েছে পর্বতের মধ্যদেশে। অপ্সরাদের পােশাক প্ৰভাত তপনের ছোঁয়া লেগে লােহিতাভ হয়ে উঠেছে।
সূর্যের সুবর্ণ রশ্মি তুষার পর্বতকে স্পর্শ করামাত্র মনে হল, একখানি স্বর্ণরথে আরােহণ করে অপ্সরার দল সুরলােকে যাত্রা করল।
ইন্দ্র তাকালেন অহল্যার দিকে। নিবিড় স্বরে বললেন, আমাদেরও যাত্রার লগ্ন উপস্থিত কল্যাণী।
অহল্যা বলল, মনে হচ্ছে সুখ দুঃখের এক আশ্চর্য স্বপ্ন দেখে এইমাত্র জেগে উঠলাম দেবরাজ। চলুন, যে জীবন অপেক্ষা করে আছে সেই জীবনে ফিরে যাই।
ইন্দ্র বললেন, মর্ত যে এত সুন্দর, মর্তকন্যা যে এত কাম্য, তা তােমাকে না দেখলে, তােমাকে কাছে না পেলে বােঝা যেত না অহল্যা।
আবার সেই স্বপ্নের পথ ধরে স্বর্গ-মর্তের মিলন মহােৎসব রচনা করতে করতে ইন্দ্র আর অহল্যা এসে দাঁড়ালেন পর্বত সানুদেশের অরণ্য প্রান্তে। এখান থেকেই আশ্রম অভিমুখে শুরু হবে যাত্রা।
ইন্দ্র কোনও কথা না বলে তার পরিচ্ছদের অভ্যন্তর থেকে একটি পুষ্প বের করে এনে অহল্যার কবরীতে পরিয়ে দিলেন।
অহল্যা বলল, কাল সমস্ত রাত্রি এই পুষ্পের আঘ্রাণে আমােদিত হয়েছিল আমাদের গুহা নিকেতন। আজ সারাপথ এর সুবাস আমাকে আকুল করেছে। এখন সেই কুসুমকে শিরােভূষণ করে আশ্রমে ফিরে যাচ্ছি। কী নাম এই পুষ্পের দেবরাজ।
অম্লান-কুসুম। এর বর্ণ, গন্ধ কিছুই ম্লান হবে না কোনওদিন। এ এক স্বর্গের অধিবাসী আর মর্তকন্যার অনিঃশেষ অকথিত প্রেমের প্রতীক হয়ে থাকবে।
অহল্যা বলল, প্রেমের বিহুল পরিবেশ, সম্পূর্ণ অধিকার আর আয়ত্তের মধ্যে পেয়েও যে ব্যাধ এক অনভিজ্ঞ হরিণীকে লক্ষ্য করে শর সন্ধান করেনি, সেই ব্যাধের কাছে হরিণীর। কৃতজ্ঞতার কোনও শেষ নেই, বাসব। ইন্দ্ৰ অহল্যার হাত নিজের করপুটে একটি কুসুমের মতাে তুলে নিয়ে বললেন, এই যে তােমার সম্মুখ দিয়ে একটি জলধারা প্রবাহিত হচ্ছে, এটি সম্পূর্ণ অস্পর্শিত। কালই হয়েছে এর বন্ধন মুক্তি। তােমরা যে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাঝে পড়েছিলে, সে বিপর্যয়ের স্রষ্টা স্বয়ং ইন্দ্র। বাসবের বজ্ৰই বিশাল এক শিলাপকে স্থানচ্যুত করেছে। এর কারণ, পর্বতের ঊর্ধ্বে এক বিশাল জলসম্ভারকে ওই সামান্য শিলাস্তুপ আবদ্ধ করে রেখেছিল। আমি আর আমার অনুচরেরা শিলা সরিয়ে ওই জলসম্ভারকে মর্তজনের কল্যাণের জন্য মুক্তি দিয়েছি। আজ থেকে ওই স্রোতধারার নাম হবে, অহল্যা। যে এখন অকর্ষিত, অম্পর্শিত, সে-ই অহল্যা। প্রিয় প্রভু, আপনি আমার কুমারীত্বকে সম্মান জানিয়েছেন, তাই আজ আমার নামে নামাঙ্কিত এই স্রোতস্বিনীর জলস্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা করছি, জীবনের কোনও অবস্থাতেই আপনাকে অদেয় আমার কিছু থাকবে না। আর কোনওদিন কোনও কারণেই আপনার ওপর থাকবে না আমার বিরূপতা।
ধুতি বললেন, শিশুকাল থেকেই তােমাকে নির্ভীক আর স্বাধীনচেতা দেখে আসছি মা। গালভ আর তুমি যমজ হলেও প্রকৃতিতে ভিন্ন। কাল যখন অস্বাভাবিক শব্দে বজ্রধ্বনি হয় তখন গালভ তােমার জন্য ভারী অস্থির হয়ে পড়েছিল। এখানে আকাশ নির্মল, তবু বজ্রধ্বনি, তাই শঙ্কিত হয়েছিল গালভ। আমি বলেছিলাম, অহল্যার জন্য চিন্তিত হয়াে না, সে আপনার প্রতিকুল অবস্থাকে জয় করবার ক্ষমতা রাখে।
অহল্যা বলল, আমার ওপর তােমার বিশ্বাস আর আশীর্বাদই আমার সকল কাজের প্রেরণা আর সাফল্যের মূল।
ধৃতি বললেন, তুমি সে শব্দ নিশ্চয়ই শুনতে পেয়েছিলে, কিন্তু কারণ কিছু অনুমান করতে পেরেছ কি? সেখানে বজ্রধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে মেঘভাঙা বৃষ্টি আর ঝড় হয়েছিল। একটি স্রোতস্বিনীও জন্ম নিয়েছে কাল। ওপরের পর্বতে সঞ্চিত জলরাশি তার উৎস। ঝড় থামলে প্রবাহিনীকে রথে প্রাসাদে পাঠিয়ে দিই। তােমরা চিন্তিত হবে বলে আমি আশ্রমে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিই। তবে কাল সন্ধ্যায় ফিরে আসা সম্ভব ছিল না বলে একটি গুহাতে রাত কাটাতে হয়েছে। যথার্থ কাজই করেছ মা।। অহল্যা বলল, কাল জ্যোৎস্নালােকে আমি অচ্ছেদ সরােবর দেখে এসেছি। অচ্ছেদ সরােবর! শুনেছি, সে নাকি অনেক উচ্চ তুষার গিরির কোলে অবস্থিত। তুমি সেখানে পৌঁছেলে কী করে মা? এক দিব্য পুরুষ আমাকে ওই সরসীর সন্ধান দেন এবং পথ প্রদর্শন করেন। এ তােমার যেমন এক নতুন অভিজ্ঞতা তেমনই দুঃসাহসের কাজও বটে। তােমার পিতা শুনলে হয়তাে শঙ্কিত হতেন।
অহল্যা ধূতির কণ্ঠলগ্না হয়ে বলল, আশৈশব তােমার প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠেছি, তাই দুঃসাহসই বলাে আর যাই বলাে, সে তােমারই দান। এখন বলল, কেমন দেখলে সে সরােবর?
অহল্যা সরােবর এবং পরিবেশের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে গেল। শেষে অপ্সরাদের নৃত্য আর স্নানলীলার কথা যখন বলতে লাগল তখন ধূতি বললেন, এমনই এক সরােবরে দেবনর্তকী উর্বশীর স্নানলীলা দেখে এক দৈত্য কামােন্মত্ত হয়ে গিয়েছিল।
অহল্যা বলল, সত্যিই উন্মত্ত হবার মতাে রূপ উর্বশীর। তার গমনের ছন্দ, নয়নের কটাক্ষ, মুখের হাসি, নৃত্যের লীলা চিনিয়ে দেয়, সে সবার থেকে স্বতন্ত্র। এখন তুমি ওই উর্বশী আর দৈত্য সম্বন্ধে যা জানাে, তাই শােনাও। ধূতি বললেন, এ শুধু উর্বশী আর দৈত্যের কাহিনী নয়, একজন রাজাও এই ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। আর শেষ পর্যন্ত ওই ঘটনা রাজা আর সুরনর্তকীকে নিয়েই আবর্তিত হয়েছিল।
আজ কিছু বিলম্বে চন্দ্রোদয় হয়েছে। যজ্ঞে নিবেদিত প্রসাদ, সন্ধ্যার কিছু পরে তিনজনে গ্রহণ করেছে। নৈশাহারের পর গালভ নিভৃত একটি স্থানে আত্মচিন্তায় নিমগ্ন থাকে। সে সময় অহল্যাকে কাছে বসিয়ে ধূতি নানা ধরনের গল্প করেন। আজ দু’জনে তেমনই বসে। ধুতি তার গল্পের জাল বুনে চললেন।
রাজা পুরুরবা বেরিয়েছেন মৃগ শিকারে। একাকী পার্বত্য অরণ্যে এই তাঁর প্রথম আসা। অনুচরদের সাহায্য ছাড়াই মৃগবধ করবেন, এর ভেতর আছে আলাদা এক রােমাঞ্চ।
অরণ্যের অভ্যন্তরে ভ্রমণ করতে করতে রাজা এক পরমাসুন্দরী কুরঙ্গীর সন্ধান পেলেন। তিনি মৃগীটিকে দেখামাত্র অশ্ব চালিয়ে দিলেন তার দিকে। মৃগীও পেছনে সাক্ষাৎ শমনকে দেখে প্রচণ্ড গতিতে ছুটে চলল।
এমন সময় অরণ্যের অন্তরাল থেকে বেরিয়ে এল একটি চিতা। সেও তার ভক্ষ্য বস্তুটিকে লক্ষ্য করে ছুটে চলল। রাজার সঙ্গে সঙ্গেই সে ছুটে চলেছিল, কিন্তু রাজা কিংবা অশের দিকে তার কোনও দৃষ্টিই ছিল না।
রাজা সমস্যায় পড়লেন। তার তুণীর বৃক্ষশাখায় সংলগ্ন ছিল। তিনি ধনুতে একটিমাত্র তির সংযােজন করে দ্রুত বেরিয়ে এসেছেন। এখন তিনি ভাবলেন, যদি আমি হরিণীকে তির-বিদ্ধ করি তা হলে ওই চিতার দৃষ্টি আমার ওপর নিপতিত হবে। তখন ওই হিংস্র জন্তুর হাত থেকে আর নিজেকে রক্ষা করতে পারব না।
এইরূপ বিবেচনা করে রাজা তার ওই একমাত্র শরে চিতাটিকেই বধ করলেন। কুরঙ্গী দ্রুত প্রস্থান করল। রাজা পুরুরবা ফিরে এলেন নির্দিষ্ট বৃক্ষতলে। তিনি এবার তার তুণীর পৃষ্ঠে বেঁধে নিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে নারীকণ্ঠের এক আর্ত চিৎকারে চরাচর বিদীর্ণ হতে লাগল। রাজা দ্রুতবেগে ধাবিত হলেন শব্দ অনুসরণ করে। তিনি নির্দিষ্ট স্থানে এসে দেখলেন, এক ভীষণাকার দৈত্য একটি সরােবরের জল তােলপাড় করছে। আর এক পরমাসুন্দরী নারী আত্মরক্ষার জন্য কখনও সন্তরণ করে পালাবার চেষ্টা করছে, কখনও বা জলে ডুব দিয়ে আত্মগােপনের চেষ্টা করছে।
রাজা প্রথমেই সুন্দরী কন্যাটিকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ভয় নেই। দুবৃত্তকে আমি শাসন করছি। তার উপযুক্ত শাস্তি সে এখুনি পাবে।
এবার দৈত্যকে উদ্দেশ করে বললেন, উঠে আয় হীন কাপুরুষ। একজন শক্তিহীন নারীর সম্ভ্রম নষ্ট করতে তাের বিবেকে একটুও বাধল না। তােকে আমি শরাঘাতে এখনই যমসদনে পাঠাতে পারতাম, কিন্তু তুই অস্ত্রহীন। জন্তু ছাড়া কোনও অস্ত্রহীনকে আমি অস্ত্রাঘাতে বধ করি । গর্জন করতে করতে সরােবর থেকে তীরে উঠে পুরুরবার দিকে ধেয়ে এল দৈত্য।
অস্ত্র ছেড়ে রাজা দৈত্যের সঙ্গে মল্লযুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন। তিন দিন দুই রাত্রি সেই সরােবর তীরে চলল রাজা পুরুরবা আর দৈত্যের সংগ্রাম। সে। অকল্পনীয় যুদ্ধ দেখতে লাগল মূক প্রকৃতি আর নির্বাক নীলাকাশ।
তৃতীয় দিনে সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে রক্ত ছড়ানাে আকাশের মতাে রক্তবমন শুরু করল দৈত্য। রাত্রির প্রথম যামে চন্দ্রোদয় হলে দেখা গেল, দৈত্য গতায়ু হয়েছে। রাজা পুরুরবা দৈত্যের সৎকার শেষে স্নান সমাপন করলেন। পুষ্করিণী থেকে উঠে এসে দেখলেন, সেই কান্তিময়ী কন্যা পুষ্পমাল্য হাতে দাঁড়িয়ে আছে। রাজা সেই মাল্য কণ্ঠে ধারণ করে বললেন, কী নাম তােমার সুভগে? মহাত্মন, আমি দেবরাজ ইন্দ্রের সভানটী উর্বশী। পুরুরবা বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে বললেন, তুমি উর্বশী! যার রূপ ও নৃত্যের মহিমা জিলােক বিদিত, সেই উর্বশী আমার সম্মুখে।
উর্বশী বলল, আপনার বিস্ময়ের কোনও হেতু নেই মহারাজ। যত কিছু বিস্ময় সবই আপনাকে কেন্দ্র করে। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা, বিশ্রাম ভুলে আপনি যেভাবে নিরস্তর এক অসহায় নারীর জন্য সংগ্রাম চালিয়ে গেছে তা ত্রিলােকের কোথাও আমি দেখিনি। এখন আর বাক্য নয় মহাত্মন, আসুন ওই তরুতলে। সামান্য কিছু ভােজ্যবস্তু দ্যুলােক থেকে নিয়ে এসেছি, তাই গ্রহণ করুন।
যত্ন করে উর্বশী পুরুরবাকে ভােজন করাল। পরে সঞ্জীবনী সুধা পান করতে দিল, যাতে রাজার দেহ থেকে সমস্ত আঘাত ও ক্লান্তির চিহ্ন নিঃশেষে মুছে যায়।
ঊর্বশী বলল, ভদ্র, এখন আপনার পরিচয়টুকু পেলে ধন্য হই। অবশ্য একটি মানুষের যথার্থ পরিচয় আমার আগেই জানা হয়ে গেছে। রাজা বললেন, আমাকে পুরুরবা নামেই জেনাে। আমি একটি রাজ্যের অধিপতি। মহারাজ, ত্রিলােকন্দিত আপনার নাম। আমার পরম সৌভাগ্য আপনাকে স্বচক্ষে দেখলাম। আপনার শৌর্ষ ও মহান হৃদয়ের পরিচয় পেলাম। আমাকে মর্তভূমির সামান্য একজন মানুষ বলে ভাবলে আমি খুশি হব নটী।
উর্বশী বলল, আমাকেও সুরনটী, অলরা না ভেবে সামান্য একজন নারী বলেই ভাববেন। যে নারী একমাত্র পুরুষের পৌরুষকেই মনে-প্রাণে পূজা করে।।
মহারাজ পুরুরবা বললেন, তােমাকে ঊর্বশী ভেবে আমি উদ্ধার করতে আসিনি। এসেছিলাম, বিপন্ন এক নারীর আর্ত চিৎকার শুনে।
আমি সেই নারী, আর তাতেই আমি চরিতার্থ মহারাজ। গত দুটি রাত্রি আমি স্বর্গের নৃত্যসভায় চলে গিয়েছিলাম, কিন্তু বারে বারে তালভঙ্গ হয়েছে আমার। দেবরাজ বিস্মিত হয়ে জানতে চেয়েছেন আমার শারীরিক কুশলবার্তা। আমি অসুস্থতার কথা উচ্চারণ করতে পারিনি। কারণ তখনই দেববৈদ্য আমাকে পরীক্ষা করে জানতে পারতেন, শারীরিক দিক থেকে আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। মহারাজ, উদ্বেগে আকুল হয়েছিলাম। আপনি আজ সন্ধ্যায় তার অবসান ঘটালেন।
পুরুরবা বললেন, কিন্তু আজ এই রাত্রিতে তুমি স্বর্গলােকে কেমন করেই বা ফিরবে? আর নৃত্যসভার অনুষ্ঠানে যােগ দেবেই বা কেমন করে? আজ নৃত্যের আসর বসবে না মহারাজ। আজ নাটক অভিনীত হবে। তােমার অনুপস্থিতি সবার দৃষ্টিগােচর হবে।
আমি মিশ্রকেশীকে বলে এসেছি, কেউ আমার অন্বেষণ করলে যেন বলে, আমি একান্ত নির্জনে নতুন একটি নৃত্যের পরিকল্পনায় মগ্ন হয়ে আছি।
পুরুরবা বললেন, আজ এই নিশীথিনী তা হলে একান্তই তােমার ? এই মুহূর্তে আমি উদ্বেগহীন। মুক্তপক্ষ বিহঙ্গের মতাে ভারহীন আমার দেহমন। তবে এসাে আমরা দু’জনে আজ এই প্রান্তরে পর্বতে বিহার করি। সুমধ্যমা, জগতের আনন্দ স্বরূপিণী তুমি। আজ তােমার আনন্দমদিরা পানের সুযােগ আমাকে দাও। তিন দিন দুটি রাত্রি আমি আপনার জয়ের প্রতীক্ষাতেই ছিলাম। আজ সে প্রতীক্ষার আনন্দময় অবসান ঘটেছে। আজ নিশীথে আপনাকে অদেয় আমার কিছুই নেই।
অগ্নি একবার প্রজ্বলিত হলে সে বুভুক্ষুর মতাে ইন্ধন চায় প্রিয়দর্শিনী। দেহের অগ্নি একবার জ্বলে উঠলে সে সহজে নির্বাপিত হবে না। উর্বশী আপনার দেহমনের প্রীতিসাধনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত বীরােত্তম। সেই মধুরাত্রি স্বৰ্গনটীর সঙ্গে আনন্দ-বিহার করে কাটালেন মহারাজ পুরুরবা।
নিশা যখন মিলিত হল উষার সঙ্গে, তখন সরােবর তীরে এসে দাঁড়াল স্বর্গের নট-নটী, নর্তকনর্তকীর দল। তারা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে স্বর্গের সর্বশ্রেষ্ঠা নর্তকীকে।
পুরুরবার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ উর্বশী নীবিবন্ধনী সংযত করে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। সঙ্গীদের সম্মুখে গিয়ে বলল, দানবের সঙ্গে তিন দিবস দুই রাত্রি নিরন্তর সংগ্রাম করে এই বীর্যবান পুরুষ আমার প্রাণরক্ষা করেছেন। তাই একে সমর্পণ করেছি আমার তনু মন প্রাণ। আমি আর স্বর্গে ফিরে যেতে চাই না। রম্ভা বলল, আমরা অনন্তযৌবনা। একমাত্র স্বর্গের কাছেই নিবেদিত। ঘৃতাচী বলল, মর্ত-বিহারে আমাদের বাধা নেই সত্য কিন্তু স্বৰ্গই আমাদের যথার্থ আশ্রয়। মিশ্রকেশী বলল, দেবতাদের আনন্দদানের জন্য আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ উর্বশী। দেবতারা আমাদের বিচরণের স্বাধীনতা দিয়েছেন বলেই আমরা স্বর্গের বন্ধনকে ছিড়তে পারি না।
নাগদত্তা বলল, আমরা অলরা। অপ বা জলে গমন করি, জলবিহার ভালবাসি, তাই আমাদের এই অভিধা। কিন্তু আমাদের হৃদয় কখনও জলের মতাে তরল নয়। বিদ্যুৎপর্ণা বলল, উরু বা মহৎ ব্যক্তিদের বশ করার জন্যই তুমি উর্বশী। কিন্তু তুমি তাে কারও বশ্য নও সখী।
রুচিরা এগিয়ে এসে একখানা হাত ধরল উর্বশীর। বলল, অপ্সরাদের প্রধানা তুমি। তুমিই আমাদের পরিচালিকা শক্তি। স্বয়ং দেবরাজ তােমাকে সেই সম্মানীয় আসনে বসিয়েছে। আমাদের দলভ্রষ্ট করে, সুরপতির সম্মানে আঘাত হেনে, তুমি কী এমন আনন্দ পেতে চাও উর্বশী?
দুটি হাতে মুখ ঢেকে দাঁড়াল উর্বশী। ঝড়ের মুখে সাগর তরঙ্গের মতাে আলােড়িত হচ্ছে তার অন্তর। সে কোনও কথা বলতে পারল না। সােমা বলল, যদি তুমি একান্তই ওই পুরুষবরকে সান্নিধ্য দানের জন্য মর্তে থাকতে চাও, তা হলে অবশ্যই স্বর্গাধিপতির অনুমতি প্রার্থনা করাে! উর্বশী চোখ মেলে বলল, বেশ তাই হবে। আমি তার কাছেই আমার মনের বাসনা জানাব। অপ্সরার দল দূরে অপেক্ষা করতে লাগল। উর্বশী বিদায় নিতে এল পুরুরবার কাছে। আমি এখন সুরলােকে যাচ্ছি প্রিয়তম। অচিরেই ফিরে আসব আপনার কাছে। আপনি মুহূর্তকালও আমার জন্য চিন্তা করে কষ্ট পাবেন না।
পুরুরবা অধীর হয়ে বললেন, তােমার কি সত্যিই মনে থাকবে আমার কথা। শুনেছি স্বর্গের প্রলােভন অন্য সব কিছু ভুলিয়ে দেয়।
সমস্ত রাত্রি যে আনন্দ-সম্ভোগে কেটেছে আপনার সঙ্গে সে স্মৃতি ভুলে যাবার নয় প্রিয়। আমি অবিলম্বেই আসব, আপনার সঙ্গে আবার মিলিত হব এই সরােবর তীরে।
পুরুরবাকে প্রবােধ দিয়ে ঊর্বশী ফিরে গেল স্বর্গলােকে। সে রাত্রিতে পুরুরবার দীর্ঘশ্বাসে ভরে উঠল বাতাস। সে দীর্ঘশ্বাস উখিত হল নভােলােকে। নভােলােক স্পর্শ করে তা প্রবাহিত হল সুরলােকে।
দেবসভা আজ পূর্ণ। উর্বশী কাল ছিল অনুপস্থিত। সে নাকি নৃত্যের নতুন একটি পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। তাই আজ দেবসভা উদগ্রীব উর্বশীর নতুন নৃত্য দেখবার জন্য।
মঞ্চে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত হয়েছে উর্বশী, এমন সময় বুকে এসে বাজল পুরুরবার দীর্ঘশ্বাস। মর্ত থেকে ভেসে এল একটা ক্ষীণ স্বর, তুমি কোথায় প্রিয়তমা।
মঞ্চে প্রবেশ করল উর্বশী। প্রােষিতভর্তৃকা নারীর কাতরতা তার সর্বাঙ্গে। বিরহ-বিধুরা নারীমূর্তি এই প্রথম দেখল স্বর্গলােকবাসীরা।
আবার মনে হল, কোনও নারী প্রিয়তমকে হারিয়ে উন্মাদিনীর মতাে তার সন্ধান করে ফিরছে। অরণ্য বৃক্ষের অন্তরালে সে খুঁজে ফিরছে তার হারানাে রতন। পুষ্পিত লতাকে জড়িয়ে ধরে বলছে, তুমি কি দেখেছ আমার প্রিয়তমকে? তুমি যে বৃক্ষকে আশ্রয় করেছ, আমার প্রিয়তমও অমনই এক বৃক্ষের মতাে বলিষ্ঠ। আমি তাকে আশ্রয় করেছিলাম। এমনই বিষাদিনীর অভিনয় করতে করতে ঝড় নেমে এল। মেঘের ঘনঘটায়, বিদ্যুতের চমকে, অঝাের বর্ষণে সমস্ত চরাচর স্তম্ভিত, মথিত, বিপর্যস্ত।
উর্বশী বিষাদিনী, উর্বশী উন্মাদিনী। সে প্রমত্ত ঝড়ের নৃত্যে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছে। নিতম্ব ছাড়িয়ে নেমেছে তার কৃষ্ণমেঘের মতাে কেশ। চোখে বারে বারে চমকে উঠছে বিদ্যুৎ। পায়ের নুপুরে বেজে উঠছে বর্ষার ধারাপতন ধ্বনি।
সারা মঞ্চ পরিক্রমা করে সভাগৃহে ঝঙ্কার তাণ্ডব তুলে বিষাদময়ী উর্বশী বিদায় নিল। সাধু, সাধু, ধ্বনিতে মুখরিত হল ইন্দ্রের নৃত্য-মণ্ডপ।
সেই রজনীতে নন্দনবনে পারিজাত বৃক্ষের তলায় ইন্দ্রের আহ্বানে এসে দাঁড়াল উর্বশী। তােমার আজ রাতের নৃত্য পরিকল্পনার জন্য গ্রহণ করাে এই মন্দার মালিকা। উর্বশী নত নমস্কার জানিয়ে গ্রহণ করল সে মালা। ইন্দ্ৰ সন্ধানী দৃষ্টি মেলে বললেন, এ কী উর্বশী! স্বর্গের আনন্দরূপিনীর চোখে অশ্রু! ঊর্বশীর অশ্রু উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। তুমি মর্ত-মানবের মতাে শশাকে আকুল হচ্ছ উর্বশী! এ যে আমার স্বপ্নেরও অতীত। প্রভু, প্রার্থনা আছে। তােমার প্রার্থনা কি কোনদিন অপূর্ণ থেকেছে উর্বশী। সত্যই প্রভু মর্তের স্পর্শ লেগেছে আমার দেহ মনে, তাই এ অশ্রুর প্রবাহ। আমি মর্তের এক মানুষকে ভালবেসেছি। তার সঙ্গে মিলিত হবার অনুমতি দিন, এই প্রার্থনা। ইন্দ্র কিছু সময় নীরব থেকে বললেন, কে সে সৌভাগ্যবান উর্বশী? মহারাজ পুরুরবা। পুরুরবা। অত্যন্ত বীর্যবান পুরুষ, দানব-দ্রোহী, দেবতাদের পরম মিত্র। তিনি আমাকে এক দানবের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। কয়েকদিন মল্লযুদ্ধের শেষে দানব তার হাতে নিহত হয়েছে। মহারাজ পুরুরবাও কি তােমার প্রণয়প্রার্থী? তার প্রশ্রয় এবং আনুকুল্য আমি লাভ করেছি। মর্তে অবস্থান করলে স্বর্গের বন্ধন তােমাকে ছিন্ন করে যেতে হবে উর্বশী। আমি কি আর কোনওদিন ফিরে আসতে পারব না প্রভু? পারবে। যেদিন প্রেমের উন্মাদনা কেটে যাবে। তােমরা প্রেমের প্রতিমা। প্রেমের রাজ্যে যদি হৃদয়ের অন্য কোনও ভাব প্রবেশ করে তা হলে দুর্বার প্রেমের স্রোতে লাগবে ভাটার টান। তখন ওই ভাটার টানেই ফিরে আসতে হবে মর্ত থেকে স্বর্গে। আমাকে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বলুন দেবরাজ। তুমি যদি পুরুরবার সঙ্গে তােমার প্রেম অক্ষয় সুত্রে বেঁধে রাখতে চাও তা হলে কোনওদিনই জননী হতে চেয়াে না। যেদিন জননীপদ লাভ করবে, সেদিন কেটে যাবে তােমার প্রেমের উন্মাদনা আর তখনই তােমাকে ফিরে আসতে হবে স্বর্গে। বিধি প্রেম দিয়েই গড়েছেন অপ্সরাদের নুমন। প্রেম ত্যাগ করে তারা দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকতে পারবে না।
প্রতীক্ষাকাতর পুরুরবার কাছে এসে দাঁড়াল উর্বশী। তুমি সত্যই ফিরে এলে স্বৰ্গনটী।। আপনার ভালবাসাই আমাকে ফিরিয়ে এনেছে প্রিয়তম। মহারাজ বললেন, রাজ্যের মানুষ নিশ্চয়ই কাতর হয়ে পড়েছে আমার অদর্শনে। তারা অবশ্যই অন্বেষণ করে ফিরছে আমাকে। তুমি চলাে আমার সঙ্গে। রাজ্যের কলালক্ষ্মীরূপে। সুরম্য কোনও প্রাসাদে করব তােমার প্রতিষ্ঠা। একটি অঙ্গীকারের প্রশ্ন আছে মহারাজ। কী সে অঙ্গীকার কলাবতী? যে-কোনও অঙ্গীকার পালনের জন্য আমি সত্যবদ্ধ হয়ে রইলাম।
আমাদের ভালবাসার বন্ধনকে যদি অটুট রাখতে হয় তা হলে আমার গর্ভে কোনও সন্তান উৎপাদন করতে পারবেন না। তােমার এ শর্ত মেনে নিলাম ভদ্রে। অন্তপুরচারিণী রমণীকুল, যাঁরা এতকাল রানির গৌরব মহিমায় অধিষ্ঠিত ছিলেন, তারা উর্বশীর আগমনে ম্লান হয়ে গেলেন। তারা আর রাজার কক্ষে প্রবেশ করতেন না কৌতুক কলহাস্যে। যদি কোনওদিন কোনও প্রয়ােজনে প্রবেশ করতেন, তা হলে প্রতিহারিণীর মুখে শুনতে পেতেন, মহারাজ দেবী উর্বশীর লীলা নিকেতনে।
পুরুরবা উর্বশীকে নিয়ে অরণ্যে যেতেন। অশ্বপৃষ্ঠে উর্বশীকে বসিয়ে নিজে পরিচালনা করতেন অশ। অরণ্যের অভ্যন্তরে লােকচক্ষুর অন্তরালে তারা আদিম অরণ্যচারী নরনারীর মতাে ঘুরে বেড়াতেন। শিকার-লব্ধ পশুপক্ষীর মাংস, কন্দ, মূল, ফল তারা আহার্যরূপে গ্রহণ করতেন। পান করতেন ঝরনার বা কোনও স্রোতস্বিনীর জল।
কখনও বা থাকতেন পর্ণকুটির নির্মাণ করে। পশুপক্ষী, জোনাকি, প্রজাপতি সেই পর্ণকুটির ঘিরে উর্বশীকে দেখাত মর্তের লীলা নৃত্য। শােনাত অশ্রুতপূর্ব সংগীত।
উর্বশী আনন্দে আত্মহারা হত। পুরুরবা বলতেন, এই অরণ্যভূমিতে, ক্ষুদ্র পর্ণকুটিরের মধ্যে যে সুখ, তা রাজসিংহাসনে কিংবা রাজপ্রাসাদে নেই।
উর্বশী বলত, আমি এখানে এসে স্বর্গের সুখের কথা ভুলে গেছি প্রিয়তম। এই অরণ্যের লতা, পুষ্প, পল্লবে নিত্য চলছে প্রেমের আনন্দ উৎসব। আমি চিত্রিত প্রজাপতি, আর আলাের দূত খদ্যোতের কাছ থেকে শিখেছি নৃত্যের অভিনব লীলা। মর্ত আমাকে মগ্ন করেছে তার রূপে, বর্ণে, গন্ধে, ছন্দে। বারবার একটি কথা অন্তর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে, আমি তৃপ্ত, আমি আনন্দিত।
অরণ্যে পুষ্প প্রস্ফুটিত হয়। মহারাজ দুরন্ত বালকের মতাে বৃক্ষে আরােহণ করে শাখা থেকে কুসুম চয়ন করেন। নিয়ে ফেলে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই বালিকার ক্ষিপ্রতায় ছুটে এসে সে কুসুম কুড়িয়ে নেয় উর্বশী। মহারাজ অবতরণ করে ফুলের অলংকারে সাজিয়ে তােলেন প্রেয়সীকে।
কখনও বা দুর্গম পর্বতে আরােহণ করে উভয়ে নিশিবাস করেন পর্বত করে। চন্দ্রালােকিত রাত্রিতে গন্ধর্বগীত ভেসে আসে সুরলােক থেকে। মর্তভূমি থেকে উথিত কিন্নরগীত মিশে যায়। তার সঙ্গে। সে এক অপার্থিব সুর-সঙ্গম।
পর্বত অথবা নদীতীরে পরিভ্রমণের কালে তাদের সামনে এসে উপস্থিত হয় মেষচারক অথবা গােচারকের দল। সাধারণ বস্ত্রে আবৃত থাকায় মহারাজ অথবা উর্বশীকে চিনতে পারে না কেউ। ওরা কখনও বা তাদের সঙ্গী হয়ে ঘুরে বেড়ায়। কখনও ওদের সঙ্গে একাসনে বসে আহার্য গ্রহণ করে, দুগ্ধ পানে পরিতৃপ্ত হয়। তুষারশৈলে পরিভ্রমণকালে হিমানী বিগলিত জলপূর্ণ সরােবরে ওরা স্নানলীলায় মাতে। উর্বশীর প্রস্তুত করা আহার্য পানীয় গ্রহণ করার ফলে ওদের দেহে থাকে না কোনও প্রকার শৈত্যবােধ।।
জলক্রীড়ায় মথিত হয় সরােবর। রাজহংস-রাজহংসীর মতাে কখনও জলের গভীরে আবার কখনও বা জলতলে ওরা বিচরণ করে। স্বাভাবিক মিলনে যে এত আনন্দ, এত সুখ, সেই উপলব্ধিতে পূর্ণ হয়ে উঠে ওদের অন্তর।
কোনও এক দ্বিপ্রহরে একটি বৃক্ষতলে বসে ওরা সামান্য ফলমূলে ক্ষুন্নিবৃত্তি করছিল। এমন সময় দেখা গেল দূরে দাঁড়িয়ে একটি লােক ওদের নিরীক্ষণ করছে।
সামান্য পােশাক পরিহিত দুটি নরনারীকে নিবিষ্ট হয়ে দেখছে একটি মানুষ, নিশ্চয়ই তার ভেতর কোনও কিছু উদ্দেশ্য আছে, এই ভেবে মহারাজ পুরুরবা গর্জন করে উঠলেন, কে তুমি? এই জনমানবশূন্য প্রদেশে কার অন্বেষণ করে ফিরছ? লােকটি এগিয়ে এসে আভূমি নত হয়ে নমস্কার করে বলল, মহারাজ, এতক্ষণে আপনাকে চিনতে পেরেছি। আপনার কণ্ঠস্বরই আপনাকে চিনিয়ে দিয়েছে। আমি আপনার প্রাসাদের অন্যতম কঞ্জুকী। পশ্চাৎ দ্বার রক্ষা করার দায়িত্ব আমার। এতকাল পরে প্রাসাদের একটি মানুষকে দেখে মহারাজ বড় প্রীত হলেন। কী সংবাদ ককী? রাজ্যের কুশল তাে? সভাসদেরা প্রতিদিন নিষ্ঠার সঙ্গে রাজকার্য পরিচালনা করছেন তাে? করুকী একটি ক্ষুদ্র বৃক্ষপত্র মাটিতে রেখে তার উপর উপবেশন করল। করজোড়ে বলল, মহারাজ, প্রভুহীন গৃহ চন্দ্রহারা রাত্রির মতাে। অমানিশায় তস্কর ও অন্যান্য নিশাচরদের উপদ্রব বাড়ে। ধূর্ত শৃগালেরা অন্ধকারের সুযােগে গৃহপালিত পশুপক্ষীদের হত্যা করে। সূর্য বর্তমানে প্রায় দৃষ্টিহীন পেচক রাতের অন্ধকারে পূর্ণদৃষ্টি ফিরে পায়। তখন সে ভয়ংকর মূর্তিতে বিচরণ করে।
শস্যভাণ্ডারের রক্ষকের দৃষ্টি উপরিভাগের শস্য অপসারণের কাজে নিযুক্ত, তাই ভাণ্ডারের নিম্নভাগে মুষিকের উপদ্রব অত্যধিক। মহারাজ শেষ সংবাদ, শবদেহের অধিকার নিয়ে ভাগাড়ে শকুনিদের বিবাদ শুরু হয়েছে।
হুংকার দিয়ে উঠলেন মহারাজ পুরুরবা, ওরা কি ভেবেছে পুরুরবা মুছে গেছে পৃথিবী থেকে? নিঃশব্দে, নিশ্চিন্তে চলে যাও কঞ্চুকী। আমি কোনও সংবাদ না দিয়ে ছদ্মবেশে অকস্মাৎ আবির্ভূত হব রাজধানীতে।
প্রণাম করে উঠে দাঁড়াল কক্ককী। বলল, প্রভুর কৃপাদৃষ্টির অপেক্ষায় সারা রাজ্য উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে। কঞ্চকী প্রস্থান করলে উর্বশী বলল, সকল অপরাধের মূলে যে তাকে দূর করুন মহারাজ। অবশ্যই তাকে বিতাড়িত করব। রাজ্যে পৌছােলেই তার সন্ধান পাওয়া যাবে। উর্বশী নিজের বুকের দিকে তার চম্পক অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলল, আপনার সম্মুখেই সে অপরাধী মহারাজ।
পুরুরবা বললেন, ভালবাসায় অপরাধ নেই প্রিয়তমা। কিন্তু মহারাজ, যে ভালবাসা মানুষের কর্তব্যকেও ভুলিয়ে রাখে সে ভালবাসা নিখাদ নয়?
পুরুরবা বললেন, হৃদয়ের সকল বৃত্তির ওপরে ভালবাসা। সে প্রচলিত পথ ধরে চলে না। সামাজিক অনুশাসন তাকে বাঁধতে পারে না। সব বৃত্তির ওপর শাসন চলে কিন্তু ভালবাসা কোনও শাসন মানে না। তুমি অকারণে তােমার ভালবাসাকে অপরাধী করছ প্রিয়ে।
উর্বশী বলল, এখনও আপনার মুকুট কেউ কেড়ে নেয়নি মহারাজ। তাই প্রজারা আপনার দিকেই চেয়ে আছে। আপনি তাদের অভিযােগের কারণ অনুসন্ধান করুন, তাদের অভাব দূর করার চেষ্টা করুন।
পুরুরবা বললেন, মাঝে মাঝে মনে হয়, এই রাজমুকুট আমি ভুল করে মাথায় তুলে নিয়েছি প্রিয়ে। এর গুরুভার বইবার মতাে ক্ষমতা আমার নেই। আর একে মাথায় ধারণ করার প্রবৃত্তিও আমার নেই। তুমি বিশ্বাস করাে প্রিয়তমা, আমার রাজ্যের একজন সাধারণ কৃষকও আমার ঈর্ষার পাত্র। সারাদিন মৃত্তিকা কর্ষণের পর সে যখন ক্লান্ত দেহে তার পর্ণকুটিরে ফিরে যায়, তখন দুটি প্রতীক্ষাকাতর হাত তার সেবায় নিযুক্ত হয়। সারারাত্রি দেহমনের বেদনা ভুলিয়ে দেয় একটি উত্তপ্ত ভালবাসার স্পর্শ। আমি যতই ওদের কথা ভাবি, রাজকার্য আমার কাছে তত গুরুভার হয়ে উঠে। তুমি সম্রাট নও প্রিয়তম, তুমি যথার্থ প্রেমিক।
রাজ্যে ফিরে রাজকার্যে মন দিলেন পুরুরবা। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন করে রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনলেন অচিরে।।
উর্বশী বলল, মহারাজ, অন্তঃপুরে আপনার অনুরাগিণী রমণীকুল আপনার প্রতীক্ষাকাতর। তারা প্রিয়তমের বিচ্ছেদে নিদ্রাহীন নিশি যাপন করেন। তাদের দীর্ঘশ্বাস আমাকে প্রায়ই পীড়িত করে। তাদের ঈর্ষা কিংবা ঘৃণার পাত্রী হয়ে আমি বেঁচে থাকতে চাই না মহারাজ। তুমি এত উদার উর্বশী! নারীর জন্য নারীর এতখানি ভাবনা সত্যই আমাকে বিস্মিত করেছে। আপনি আমাকে কথা দিয়েছেন মহারাজ।
সে বাক্য রক্ষিত হবে প্রিয়তমা। মহারাজ পূর্বের ন্যায় তার কক্ষে আমন্ত্রণ জানাতে লাগলেন অন্তঃপুরচারিণীদের। তারা ভাবতে লাগলেন, উর্বশীর সঙ্গে মহারাজের সুখ-সঙ্গমের ঘাের কেটে গেছে।
মধ্যরজনীতে মহারাজ আসেন উর্বশীর লীলা-নিকেতনে। স্বর্গের স্বভাব ধর্মে উর্বশী পুষ্পের তােরণ আর পুষ্পসজ্জা নির্মাণ করে রাখে প্রতিদিন।
মহারাজ পুরুরবা পুলকিত হয়ে বলেন, প্রতিদিন নব নব ফুলসজ্জা! পুষ্পের সৌরভই আপনার আগমনবার্তা বয়ে আনে। মহারাজ, প্রতিদিন আপনার ভালবাসা ওই বর্ণ গন্ধময় পুস্পের মতাে বিকশিত হােক, এই প্রার্থনা।
সম্প্রতি মহারাজ পুরুরবার অন্তরে একটি বাসনা জাগ্রত হয়েছে। তিনি ভালবাসার শেষ পরিণতি জানতে চান। শুরু হল ছদ্মবেশে নগর পরিক্রমা। একদিন তিনি এসে দাঁড়ালেন, একটি জরাজীর্ণ গৃহের সামনে। দ্বার উন্মুক্ত। অভ্যন্তর থেকে ভেসে আসছিল ক্ষীণ একটা কণ্ঠস্বর। ছদ্মবেশী মহারাজ ধারে দাঁড়িয়ে কান পেতে রইলেন।
বৃদ্ধ বলল, শেষ জীবনে অসহায় অবস্থায় পড়ব, কে জানত। যৌবনের জোয়ারে আনন্দের স্রোতে ভেসেছি, তখন কি ভাবতে পেরেছিলাম, এমন করে ভাটার টানে তলিয়ে যেতে হবে। বৃদ্ধার ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এল, একটি সন্তান যদি আমার কোলে আসত তা হলে আজ এমন করে ভাগ্যের হাতে নিজেদের সঁপে দিয়ে বসে থাকতে হত না। সে-ই আমাদের বৃদ্ধ বয়সে যষ্টির মতাে কাজ করত।
বৃদ্ধের কাশি শুরু হল। সহজে কি থামতে চায়। শেষে থামল, তখন প্রায় হত চেতন।
মহারাজ উকি দিয়ে দেখলেন, বৃদ্ধা ইতিমধ্যে নিজের কোলে তুলে নিয়েছে বৃদ্ধের মাথাটি। নিজের হাতে একটু একটু করে বুকের উপর ঘষে দিচ্ছে কোনও একটা প্রলেপ।
পুরুরবা পথে বেরিয়ে এলেন। সন্তানহীন বৃদ্ধ আর বৃদ্ধার পরিণতি দেখে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। সত্যই তাে, একটি সন্তান যদি থাকত ওদের তা হলে এমন সান্ত্বনাহীন জীবন হয়তাে কাটাতে হত না। কয়েকদিন পরে আবার মহারাজ বহির্গত হলেন ছদ্মবেশে।
জনপদ অতিক্রম করে এসে দাঁড়ালেন একটি বনের ধারে! পাহাড়ি বন। একটি ঝরনা দুরন্ত বালিকার মতাে পাথরের স্কুপের পাশ কাটিয়ে, গাছের ফাক দিয়ে লাফিয়ে ঝাপিয়ে নেমে এসে মহারাজ পুরুরবার পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল।
ক্লান্ত ছিলেন মহারাজ। প্রখর সূর্যতাপে দগ্ধ হচ্ছিল চরাচর। পিপাসার্ত পুরুরবা নত হয়ে অঞ্জলি ভরে জলপানের জন্য ঝরনার জলে হাত বাড়ালেন। সহসা বৃক্ষান্তরাল থেকে নারী কণ্ঠের তীক্ষ শব্দে তিনি জলপানে বিরত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। আবার সেই শব্দ ভেসে এল, পথিক, ওই জল পান করবেন না। মহারাজ এই নিষেধের কারণ জানতে না পেরে অবাক হয়ে অরণ্যের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
এবার সেই রমণীকণ্ঠেই উচ্চারিত হল, আরও উপরের পাহাড়ে আরােহণ করুন, সেখানে বিশুদ্ধ পানীয় জল পাবেন।
কৌতুহলী মহারাজ শব্দ লক্ষ করে উপরে উঠে গেলেন। সামান্য উপরে উঠেই তিনি রমণীকে দেখতে পেলেন। রমণী একা ছিল না। বিকৃত মনুষ্যরূপধারী আরও একজনকে দেখা যাচ্ছিল রমণীর পাশে। রমণী সেই মানুষটিকে ঝরনার জলে স্নান করাচ্ছিল।
মহারাজ তীক্ষদৃষ্টিতে মানুষটিকে লক্ষ করে বুঝতে পারলেন, গলিত কুষ্ঠে মানুষটির দেহ একেবারে বিকৃত হয়ে গেছে। মুখমণ্ডল কোনও মানুষের বলে মনে হচ্ছিল না। হস্তপদ প্রায় অঙ্গুলিবিহীন। কিন্তু কী আশ্চর্য। রমণী পরমাসুন্দরী, বয়ঃক্রমও অধিক নয়। অন্তরের সমস্ত যত্ন ঢেলে সেই নারী কুষ্ঠ রােগাক্রান্ত মানুষটির সেবায় নিযুক্ত ছিল। স্নান শেষে সন্তানের স্নেহে মানুষটিকে বুকের উপর তুলে নিয়ে রমণী ঢুকল পাশের কুটিরে। মহারাজ হতবাক হয়ে কুটিরের সামনে একটি বৃক্ষের নীচে দাঁড়িয়ে রইলেন। কতক্ষণ পরে, সম্ভবত মানুষটির পরিচর্যা শেষে রমণী কুটির থেকে বহির্গত হল। বিস্মিত হয়ে ছদ্মবেশী মহারাজকে জিজ্ঞেস করল, আপনি। মহারাজ বললেন, অপরাধ নিয়াে না, আমি কৌতুহল বশে এখানে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করে আছি। কী সে কৌতুহল মহাশয় ? এই নির্জন অরণ্যে একাকিনী এ ধরনের একটি মানুষকে নিয়ে দিনের পর দিন থাকা কী করে সম্ভব, তাই ভাবছিলাম।
নারী বলল, আমার ভাগ্যই আমাকে এ কাজে নিযুক্ত করেছে। ঈশ্বর আমার স্বামীসেবার পরীক্ষা নিচ্ছেন।
কতদিন এই কঠোর তপস্যায় নিযুক্ত রয়েছ তুমি? দীর্ঘ দশ বৎসরকাল। তােমার ভরণপােষণ? জনপদে দাসীবৃত্তি করে কিছু উপার্জন করি। তা ছাড়া অরণ্য থেকে কন্দ, মূল, ফল, কাষ্ঠ, সবই সংগ্রহ করি। তােমার কোনও সম্ভনাদি নেই? মেয়েটি মাথা নেড়ে জানাল, সে সন্তানহীনা। মনে হল, তার চোখ দুটি জলে ভরে উঠেছে। অঞ্চলে দুটি চোখ মার্জনা করে বলল, স্বামী বলুন, সন্তান বলুন, ইনিই এখন আমার একমাত্র অবলম্বন। একটু থেমে আবার শুরু করল, আমি একসময় একজন বলিষ্ঠ যুবককে ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম। সেই স্মৃতি আজও আমার বুকের ভেতর উজ্জ্বল হয়ে আছে। ওর দিকে আজও যখন চেয়ে থাকি ওর এই গলিত অঙ্গের উপরে সেদিনের সেই পরিপূর্ণ মানুষটি এসে দেখা দেয়?
মহারাজ পুরুরবা ফিরে আসতে আসতে ভাবলেন, প্রেমই যথার্থ স্পর্শমণি, যা সমস্ত জীবনটাকে ধন্য আর পূর্ণ করে দিয়ে যায়। তবু এই প্রেমের পূর্ণতার জন্য জীবন আর একটি অঙ্কুরের প্রত্যাশা করে। সে অন্ধুর সন্তান। যে একদিন পুষ্পিত হয়ে বৃক্ষটিকে পূর্ণতা দান করবে।
মহারাজ উর্বশীর লীলা নিকেতনে প্রবেশের পূর্বে উদ্যান অতিক্রম করতে গিয়ে দেখলেন, একটি চম্পক বৃক্ষে কয়েকটি পক্ষীশাবক ক্ষীণ কণ্ঠে শব্দ করছে। হঠাৎ মুখে খাদ্যবস্তু নিয়ে সেখানে আবির্ভূত হল পক্ষীজননী। পরম মমতায় ক্ষুধার নিবৃত্তি ঘটাল সন্তানদের।
কিছুদিন পূর্বে দুটি পক্ষীকে এই বৃক্ষশাখায় নীড় রচনা করতে দেখেছিলেন মহারাজ। তারপর ওই কুলায় বসে তারা যে সুমিষ্ট কুজন তুলত তাও শুনেছে পরম আগ্রহে। কিন্তু আজ নতুন মূর্তিতে দেখলেন সেই পক্ষিশীকে। মাতৃমমতায় পূর্ণ একটি হৃদয়ের ছবি। মহারাজ ভুলে গেলেন, উর্বশীর সঙ্গে তার মিলনের নির্দিষ্ট শর্তটি। অপুত্রক পুরুরবা পুত্র কামনায় অধীর হয়ে উঠলেন। কিছুকাল পরে উর্বশী হল সন্তানসম্ভবা। আনন্দে অধীর হয়ে উঠলেন পুরুরবা। কিন্তু নির্বাক উর্বশী। তার ভালবাসার নিভৃত নিকেতনে এতদিন পরে বয়ে এল নন্দনের বাতাস। সূর্যের সােনালী অক্ষরে লেখা পত্র তার হাতে এসে পৌঁছােতে লাগল। ধারা পন ধ্বনিতে সে শুনতে পেল সুরলােকের নৃত্যমণ্ডপে অপ্সরাদের মন্ত্রীর ঝংকার।
সন্তান ভূমিষ্ঠ হল। মহারাজ পুর আনন্দে অধীর হয়ে উঠলেন। রাজ্যে উৎসবের স্রোত বয়ে যেতে লাগল। কিন্তু সেই কান্তিমান শিশুটির মুখ দর্শন করল না একজন। সে তার গর্ভধারিণী, উর্বশী।
এক জ্যোৎস্নাময়ী নিশীথে সহসা মহারাজ পুরুরবার নিদ্রাভঙ্গ হল। একী! কোথা গেল প্রাণের প্রতিমা উর্বশী।
মহারাজ দেখলেন, দ্বার উন্মুক্ত। উন্মাদের মতাে ছুটে চললেন পুরুরবা। জনপদ, পথ, প্রান্তর পার হয়ে তিনি প্রবেশ করলেন অরণ্যে। সেই অরণ্যভূমিতে উচ্চারিত হতে লাগল স্মৃতির প্রেম-গাথা।
মহারাজ পুরুরবা শশাকে কাতর হয়ে বিলাপ করতে লাগলেন। তিনি চেতন-অচেতনের পার্থক্য ভুলে সবাইকে শােনাতে লাগলেন তার শােকবার্তা।
অবশেষে তিনি এসে পৌছােলেন সেই সরােবর তীরে যেখানে তিনি দেখেছিলেন স্বর্গের আনন্দস্বরূপিণী উর্বশীকে। উদ্ধার করেছিলেন দানবের সঙ্গে সংগ্রাম করে। উর্বশী তখন স্নান শেষে প্রস্তুত হচ্ছে সরসীর পরপারে পর্বতারােহণের জন্য।
পুরুরবা আর্তকণ্ঠে বললেন, যেয়াে না। একটি মুহূর্তও আমি তােমাকে ছাড়া বেঁচে থাকতে পারব না প্রিয়তমা।
উর্বশী ফিরে দাঁড়াল। বলল, প্রিয়তম, মর্তের ভালবাসা ছেড়ে যেতে আমারও বুক ভেঙে যাচ্ছে। তবু যেতে হবে, এ আমার নির্বন্ধ। শােকে উন্মাদ পুরুরবা বললেন, তােমাকে হারিয়ে আমি হিংস্র জন্তুর মুখে নিজেকে নিক্ষেপ করব। এমনি করে ধরা থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব আমি।
উতলা হওয়া বীর্যবান পুরুষের ধর্ম নয় প্রিয়তম। আমার হৃদয় দয়ামায়াহীন হিংস্র ব্যাঘ্রীর মতাে জানবেন। আপনি উত্তরাধিকারী পেয়েছেন, তাকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলুন। সেখানেই আমি বেঁচে থাকব। তোমার সন্তানকে তুমি ভুলে যাবে উর্বশী? স্বর্গের অপ্সরা কারও জায়া নয়, জননী নয়, সে শুধু প্রেমিকা। অনন্ত যৌবনের হাতে সে বাঁধা পড়ে আছে। যৌবনকে অতিক্রম করে যাবার কোনও ক্ষমতাই তার নেই প্রিয়তম।
ধীরে ধীরে আকাশ থেকে প্রসারিত হতে লাগল ঊষার পথ। সুর্যের সােনালি রথ এসে থামল পর্বতের তুষার চুড়ায়। উর্বশী নুপুরের ধ্বনি তুলে লীলায়িত দেহভঙ্গিমায় পর্বতারােহণ করতে লাগল সেই রথ লক্ষ করে।
পুরুরবা-উর্বশীর কাহিনী সমাপ্ত হওয়ামাত্র একটা তপ্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল অহল্যার বুক ঠেলে। সে বলল, জানি না, মিলনের গভীর লগ্নে কেন এমন করে বিচ্ছেদের হাহাকার বেজে ওঠে।
ধতি বললেন, স্বর্গ চিরদিনই মর্তকে আকর্ষণ করে, কিন্তু সে কখনও কোনও সুরলােকবাসীকে মর্তে ফেলে রেখে দিতে চায় না।
অহল্যা মনে মনে উচ্চারণ করল, যদি কোনওদিন সুযােগ আসে তা হলে স্বর্গের দেবশিশুকে বন্দি করে রাখব মর্ত-মায়ের স্নেহবন্ধনে।
প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় হল অহল্যার অধর। আলাে-অন্ধকারের তরল তরঙ্গে সে ছবি ধৃতির দৃষ্টির অলক্ষে মিলিয়ে গেল।
আজ আশ্রম উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে দিব্য আভায়। কিংশুক বেদিকায় বসে আছেন চতুর্মুখ। কিংশুকের শাখায় শাখায় সজ্জিত পুষ্পের প্রজ্বলিত প্রদীপ।
চতুর্মুখের পার্শে বসে রয়েছেন মহারাজ অসিতদেবল! কন্যা প্রবাহিনীকে সম্প্রদান করছেন তিনি। বৃদ্ধারে পুত্র গালভের হাতে কন্যা সম্প্রদানের পরামর্শ দিয়েছেন স্বয়ং চতুর্মুখ ব্ৰহ্মা।
প্রবাহিনীর অন্তর আজ আনন্দে পূর্ণ। সখী অহল্যার যমজভাই গালভ তার জীবনসঙ্গী হতে চলেছে। আবাল্য পরিচিত গালভ তার গােপন অন্তরে ভালবাসার স্থায়ী আসন অধিকার করে নিয়েছিল। এখন সে গােপন আসন ছেড়ে উঠে এসেছে প্রকাশ্য বেদিতে। গালভ সুন্দর, গালভ সংযতবাক। নিত্য দেবার্চনা আর জ্ঞানার্জনই গালভের একমাত্র আরাধনা।
ব্ৰহ্ম অসিতদেবলকে বলেছিলেন, তােমার কন্যা অতিশয় সুশীলা। এই স্নিগ্ধ স্বভাবের কন্যা কোনও রাজগৃহের বধু হয়ে গেলে সুখী হবে না। প্রতিটি রাজপ্রাসাদই অসিতদেবলের প্রাসাদ নয়! রাজগৃহ প্রায়ই ষড়যন্ত্র আর ব্যভিচারে পূর্ণ হয়। তােমার এ কন্যা সেইসব রাজগৃহকে অন্তর থেকে মানিয়ে নিতে পারবে না।
অসিতদেবল বলেছিলেন, প্রভু আপনার আশীর্বাদ শিরােধার্য করেই আমি রাজ্যশাসনে মনােনিবেশ করেছি। প্রজাদের সেবার ভেতর দিয়েই আমি পেয়েছি তাদের শ্রদ্ধা আর ভালবাসা। এ সকলই আপনার সুমঙ্গল উপদেশের ফল প্রভু। আজ আপনি আদেশ করুন কার করে আমি আমার একমাত্র মাতৃহীন কন্যাটিকে সমর্পণ করব। ব্রহ্মা বলেছিলেন, তােমার পরলােকগতা মহিষীর প্রিয় সহচরীর পুত্র গালভ থাকতে আমি অন্য কোন সৎপাত্রের কথা চিন্তা করব অসিতদেবল?
তাই এ বিবাহ অনুষ্ঠান। ব্রহ্মার ইচ্ছা অনুযায়ী কোনও প্রাসাদে সম্পন্ন না করে এই আশ্রমের মাঙ্গলিক পরিবেশে সমস্ত আয়ােজন করা হয়েছে।
এ আশ্রমটি মহারাজ অসিতদেবলই নির্মাণ করেছিলেন প্রিয় মহিষীর অনুরােধে। অহল্যার জননী যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন মাঝে মাঝে দুই সখীতে আসতেন এই আশ্রমে। কিছুকাল কাটিয়ে যেতেন। এরপর একসময় মর্তের মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন দুই সখী। তখন পবিত্র আশ্রমটি পরিণত হল ঋষি-নিবাসে। যে-কোনও তপস্বী ইচ্ছা করলেই কিছুদিন এই তপােকন পরিবেশে থেকে ঈশ্বর-চিন্তায় মগ্ন হতে পারতেন। আজ বিবাহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত আছেন ঋষি বৃদ্ধাশ্ব। তিনি সম্প্রতি হিমালয় থেকে মহারাজ অসিতদেবলের প্রেরিত রথারােহণে এসে পৌঁছেছেন আশ্রমে। এ বিবাহে তিনি সুখী। তবু পুর্ণ আনন্দ তিনি উপভােগ করতে পারছেন না। কন্যা অহল্যাকে এখনও তিনি পাত্রস্থ করতে পারেননি। যদিও ব্রহ্মা তাকে আশ্বস্ত করে রেখেছে তবু পিতার অন্তর থেকে অনুঢ়া কন্যার ভার একেবারে লাঘব হয়ে যেতে পারে না। ধূতি কল্যাণী জননীর সমস্ত দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে। আচার অনুষ্ঠানের যাতে কোনও ত্রুটি
হয়, যাজ্ঞিকরা চাইবামাত্র হাতের কাছে যাতে সব কিছুই পেয়ে যান, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে আছেন ধূতি।
অহল্যা আজ আনন্দে উদ্বেল। পিতা এসেছেন বহুদিন পরে। দীর্ঘ অদর্শনের পর মিলন হয়েছে পিতা-পুত্রীর। অহল্যা মােচন করেছে আনন্দ। এদিকে আবাল্যের প্রিয়সখী হচ্ছে ভ্রাতৃজায়া। কোনও কিছু হারাতে হবে না তাকে। বিচ্ছেদের বাঁশি ব্যথিত করবে না তার হৃদয়।
যতে হােতার আসনে বসেছেন ঋষি গৌতম। নিষ্ঠার সঙ্গে সমস্ত কার্য পরিদর্শন করছেন তিনি। উন্নত ললাট, প্রদীপ্ত চক্ষু, মধ্যবয়সি কান্তিমান তপস্বী। সবার মধ্যে থেকেও দৃষ্টি আকর্ষণের ক্ষমতা আছে তার। বর-বধু অন্সি প্রদক্ষিণ করল। মন্ত্র উচ্চারণ করলেন গৌতম। তার সুস্পষ্ট সুরেলা উচ্চারণ বহুদূর পর্যন্ত বহন করে নিয়ে গেল বাতাস।
সপ্রশংস দৃষ্টিতে সকলেই তাকাচ্ছিল গৌতমের দিকে। অহল্যা অদূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল ক্রিয়াকলাপ। তারও দৃষ্টি আকৃষ্ট হচ্ছিল ঋষি গৌতমের দিকে। বিবাহ কার্য শেষ হতেই বর-বধুকে নিয়ে ধূতি আর অহল্যা আশ্রম-অভ্যন্তরে চলে গেলেন। ব্ৰহ্ম বেদির উপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, হােমাগ্নি নির্বাপিত কোরাে না। এবার হােতর আসনে বসবে ঋষি মেধাতিথি।
গৌতম তাকালেন ব্রহ্মার মুখের দিকে। উপস্থিত সকলেই বিস্মিত। কারণ, গৌতম এখানে প্রধান পুরােহিতের কর্তব্য পালন করছিলেন। ঋষি গৌতম যােগ্যতম ব্যক্তি। চারজন প্রধান পুরােহিত ও দ্বাদশজন সহকারী ঋত্বিককে নিয়ে তিনি সমস্ত কর্ম পরিচালনা করছিলেন। সহসা ব্রহ্মার আদেশে বিচলিত হল গৌতমের অন্তর।
ব্রহ্মা বললেন, গৌতম, আমার প্রতি তােমার শ্রদ্ধা চিরদিনই অবিচল। আজ আমি তােমাকে একটি আদেশ করব, প্রতিপালন করার জন্য প্রস্তুত হও। গৌতম বিনীত মস্তকে বললেন, আদেশ করুন প্রজাপতি। ব্রহ্মা এবার অহল্যার পিতা বৃদ্ধাকে বললেন, তােমাকে আমি একসময় অহল্যার উপযুক্ত পাত্র স্থির করে রেখেছি বলেছিলাম। জিতেন্দ্রিয় গৌতমই আমার সেই নির্বাচিত পাত্র। তুমি এই বাসরেই কন্যা সম্প্রদান করাে। গৌতমের দিকে ফিরে বললেন, আমার বাসনা নিশ্চয়ই আর তােমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে না বৎস।
গৌতম সম্মতি জানালেন মস্তক নত করে। ব্রহ্মা বললেন, অন্তঃপুরে যাও বৃদ্ধাশ। কন্যাকে সম্প্রদানের জন্য প্রস্তুত করাে। আশ্রমের নারীনিবাসে পৌছে গেল সংবাদ। অহল্যা বিহুল, স্তম্ভিত। বয়সের পার্থক্য তার মনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। সে সারাক্ষণ সম্ভ্রমের চোখে দেখছিল গৌতমকে, কিন্তু জীবনসঙ্গীর আসনে বসিয়ে দেখার কথা তার সুদূর কল্পনাতেও আসেনি। বৃদ্ধাশ রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, প্রস্তুত হও মা। পিতৃগৃহ থেকে তােমার বিদায় আসন্ন। অহল্যা ঋষি পিতার কাছে কোনও আবেদন করল না। আকৈশাের সে শুনে এসেছিল, তার জীবনসঙ্গী নির্দিষ্ট হয়ে আছে, কিন্তু সে রহস্যের দ্বার এতদিন রুদ্ধ ছিল। আজ উন্মুক্ত হয়েছে সেই দ্বার। বেরিয়ে এসেছে প্রকাশ্য আলােকে সেই অজানা পাত্রটি। এখন তাকে সমাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে বরণ করে নিতে হবে। হৃদয়াসনে বসাতে পারবে কি না, সে চিন্তা এখন অবাস্ত। শুধু বিবাহমন্ত্র উচ্চারণের সময় একবার সে বিচলিত হয়েছিল। বর বলছিল বধুকে :
যদ ইদং হৃদয়ং তব তদ ইদং হৃদয়ং মম মম ব্রতে তে হৃদয়ং দধাতু…।
তােমার হৃদয় আমার আর আমার হৃদয় তােমার। আমার ব্রতে মিলুক তােমার হৃদয়।
অহল্যা ভাবছে ঈশ্বর রক্ষা করেছেন, এ বধূর প্রার্থনা নয়। কী করে দুটি হৃদয় মিলবে একসঙ্গে। কী করেই বা সে হবে গৌতমের ব্রতের অনুগামিনী। তার হৃদয় থেকে এখনও যায়নি আর একজনের স্মৃতি। তার মনের মুকুরে আজও এসে পড়ে সেই পুরুষােত্তমের প্রতিচ্ছবি।
নববধুকে নিয়ে গৌতম আশ্রমে প্রবেশের আগে যে প্রান্তর পেরিয়ে এলেন, সেটি বন্ধ্যা। কঠিন পার্বত্যভূমি, হলকর্ষণের অনুপযুক্ত।
গৌতম বললেন, আশ্রমের দক্ষিণে অনুর্বর এই অহল্যা-ভূমি। বামে শতদ্রর একটি শাখানদী আশ্রম স্পর্শ করে চলে গেছে। ওই স্রোতস্বিনীর কল্যাণেই আশ্রম ফল পুষ্প পড়বে পূর্ণ। অহল্যা অনুর্বর প্রান্তরের দিকে চেয়ে রইল। তার নামের সঙ্গে কী আশ্চর্য মিল এই প্রান্তরের। গৌতম দ্বিতীয় দিনে অহল্যাকে কাছে ডেকে বললেন, আমি আশ্রমবাসী তপস্বী। আমাদের বিবাহ, তপস্যাধর্মের বিঘ্ন না ঘটিয়ে তার সহায়ক হয়। তােমাকে আমার তপস্যা-সঙ্গিনী হতে হবে।
অহল্যা বলল, আমি সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ, অনুগ্রহ করে আমার কর্তব্য নির্দেশ করুন। গৌতম বললেন, পঞ্চবর্ষের জন্য আমি দুরূহ ব্রহ্মচর্য ব্রত নিয়েছি। তৃতীয়বর্ষ অতিক্রান্ত হয়েছে। এখনও ব্রত উদযাপনে দুই বৎসর বাকি।
গৌতম থামলেন। অহল্যা কোনও মন্তব্য করল না। গৌতম আবার বলতে লাগলেন, তুমি আমার এই ব্রতসাধনে প্রতিনিয়ত সাহায্য করবে, এই আমার ইচ্ছা। আশা করি আমার বক্তব্যের উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে তােমার কোনও অসুবিধা হয়নি।
অহল্যা নতমুখে নির্বাক বসে থেকে তার সম্মতি জানাল। গৌতম বললেন, এখন থেকে আশ্রমের প্রতিদিনের কাজ তােমার তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হােক, এই আমার অভিপ্রায়। অহল্যা বলল, তাই হবে। প্রথমে কিছু ত্রুটি ঘটবে, ক্ষমা করে নেবেন। অনভিক্সের ক্রটি অত্যন্ত স্বাভাবিক। পরে সব কিছুই সহজ হয়ে যাবে। অহল্যা পুষ্প চয়ন, গাভীর পরিচর্যা, সলিল সঞ্চয়, খাদ্যপ্রস্তুত, সর্ব কর্মেই নিজেকে নিযুক্ত রাখল। নিত্যকার হােম-যজ্ঞাদিতে স্বামীকে সাহায্য করতে লাগল নানাভাবে।
গৌতম নব বিবাহিতা পত্নীর আচার আচরণে বিশেষ পরিতৃপ্ত হলেন। নিশীথে পাশাপাশি প্রস্তুত থাকে দুটি শয্যা। গৌতমের অঙ্গ সংবাহন করে, স্বামী নিদ্রা গেলে তবেই অহল্যা নিজের শয্যা গ্রহণ করে।
জিতেন্দ্রিয় গৌতম নিজেকে পরীক্ষার আর একটি সুযােগ পেয়ে গেলেন। এই অপরূপা সুন্দরীর সাহচর্যে থেকেও তিনি প্রথম রিপুর রাশ টেনে ধরতে পেরেছেন। এতে তার আত্মশক্তি দিনে দিনে বেড়ে যাচ্ছে। অহল্যাকে এখন স্ত্রীরূপে না ভেবে সাধনসঙ্গিনীরূপেই ভাবছেন গৌতম।
অলরাদের বিমােহিনী শক্তিতে ধ্যানভঙ্গ হয় ঋষিদের। তারা চঞ্চল হন স্বৰ্গনটীদের কটাক্ষপাতে। গৌতম তাই অনুশীলন করে চলেছেন কঠোর ব্রহ্মচর্যের। ইন্দ্ৰত্ব হারাবার ভয়ে
যদি ইন্দ্র তার শ্রেষ্ঠ অরূপে ঊর্বশীকেও পাঠান তা হলেও তাকে ফিরে যেতে হবে প্রত্যাখ্যানের অপমান আর লাঞ্ছনা বহন করে।
অহল্যার আগমনে তাই খুশি হয়ে উঠলেন গৌতম। ব্রহ্মার আদেশে প্রথমে বিস্মিত, বিচলিত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এখন বিশেষভাবে উপলব্ধি করতে পারছেন, ব্রহ্ম তাকে আদেশের ছলে আশীর্বাদই করেছেন।
মাঝে মাঝে গৌতম তপস্যার জন্য বহির্গত হন হিমালয়ের বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে। সেখানে তপস্বীদের সঙ্গে চলে তার পারমার্থিক বিষয় নিয়ে আলােচনা। দুই বা তিনটি ঋতু কাটিয়ে তিনি ফিরে আসেন আশ্রমে। অহল্যার কর্মে বিরতি নেই। আলস্য তার স্বভাবধর্মও নয়। বৃহদায়তন আশ্রমের নানাবিধ কর্মে নিযুক্ত থাকতে হয় তাকে। সারাদিনের কর্মের শেষে সে যখন শ্রান্ত হয়ে শয্যা গ্রহণ করে তখন সমস্ত চৈতন্য আচ্ছন্ন করে নামে নিদ্রা।
কোনও কোনও সময় দক্ষিণের বাতাস সহসা প্রগলভ হয়ে ওঠে। কুলুকুলু ধ্বনিতে বন বনান্ত কার যেন আগমনের বার্তা শুনতে পায়। মঞ্জরিত হয় আতরু, অনুরাগের রঙে আরক্ত হয় অশােক, কৃষ্ণচূড়া, কিংশুক। সেই বিশেষ সময়গুলি অহল্যাকে সহসা বিহ্বল করে তােলে। সমস্ত কর্মের মধ্যেও সে উৎকর্ণ হয়ে থাকে কোনও অনিমন্ত্রিত অতিথির আগমন প্রত্যাশায়।
সে রাত্রিগুলি বােবা কান্নায় কুলপ্লাবী। আবার যখন বর্ষাগমে কদম্ব তরু পুষ্পিত হয়, তখন সেদিকে তাকিয়ে শিহরন জাগে অহল্যার। কোনও অন্তরঙ্গ জনের স্পর্শ কামনায় সে রােমাঞ্চিত হতে থাকে।
বর্ষার রাত্রিগুলি প্রতীক্ষাকাতর। মেঘধ্বনিতে, বিদ্যুতের ঘন ঘন চমকে, বৃষ্টিধারার পুষ্প বর্ষণে মনে হয় বহু দুর থেকে আসছে তার একান্ত প্রার্থিত জন। ঝলকে ঝলকে কেয়ার গন্ধ আশ্রম কুটিরে ভেসে এসে বলে, ওই আসে তােমার মন-বন বিহারী রাজ রাজেশ্বর। কিন্তু দিনের পর দিন শুধু প্রত্যাশায় বসে থাকা, যৌবনের পুষ্পিত নিকুঞ্জে কেউ আসে না।
এক দ্বিপ্রহরে আহারান্তে চম্পক তরুতলে বসে ছিল অহল্যা। এমন সময় আশ্রমের পথে রথের ঘর্ঘর ধ্বনি শােনা গেল।
সচকিত অহল্যা উঠে দাঁড়াল। রথ এসে থামল মাধবী বিতানের সামনে। এগিয়ে গেল অহল্যা। রথ থেকে নেমে এল প্রবাহিনী। দুই বান্ধবী বাঁধা পড়ল বাহুবন্ধনে। কতক্ষণ পরে প্রবাহিনী প্রথম কথা বলল, ঋষিবর কোথায়?
অহল্যা অশ্রুসিক্ত আঁখি মার্জনা করে বলল, তপস্যা ও ধর্মালােচনার কারণে তিনি মাসাধিককাল ঋষিকুলের সম্মিলনভূমিতে গমন করেছে। তুমি একাকিনী এই বিশাল উন্মুক্ত প্রান্তরের মাঝখানে কাটাচ্ছ। ম্লান হাসির রেখা ফুটে উঠল অহল্যার মুখে। বলল, আরও নির্জন, আরও সুবিশাল এক প্রান্তর আছে। সেই প্রান্তরই আমার শঙ্কার কারণ প্রবাহিনী।
বুদ্ধিমতী প্রবাহিনী সখীর মানসিক শূন্যতা এবং হাহাকার উপলব্ধি করল। সে এ বিষয় নিয়ে অধিক দূর অগ্রসর হল না।
এবার সকৌতুকে বলল, তােমার অন্তঃপুর লুণ্ঠনের ভয়েই কি তুমি আমাকে বাইরের অঙ্গনে দাঁড় করিয়ে রাখলে সখী?
অহল্যা প্রবাহিনীর হাত ধরে সাগ্রহে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল, তপস্যার ধনে পূর্ণ হয়ে আছে ঋষির ভাণ্ডার। ঋষি অনুপস্থিত। যত পারাে লুণ্ঠন করে নিয়ে যাও। প্রবাহিনী বলল, তুমি কি সত্যই একা সখী? নিঃসঙ্গতা বাইরে নয় প্রবাহিনী, অন্তরে। সে নিঃসঙ্গতার ভার দুর্বহ।
সহসা পরিস্থিতিকে লঘু করে নিয়ে অহল্যা বলল, একা নই প্রবাহিনী, ঋতুচক্র আমার দৃষ্টিকে নন্দিত করে আবর্তিত হয়। আশ্ৰমত প্রতিদিন আমাকে সুরভিত পুষ্প উপহার দেয়। প্রভাত থেকে সন্ধ্যা, পাখিদের কাকলি ধ্বনিতে পূর্ণ থাকে আশ্রম। ধেনুগুলি আমার আহ্বানের অপেক্ষায় গােশালায় হাম্বাধ্বনি করতে থাকে। আমার সঙ্গীর অভাব নেই সখী। প্রবাহিনীকে নিয়ে সে এবার প্রবেশ করল তার কুটিরে। পরিচ্ছন্ন পরিবেশে প্রবাহিনী খুশি হয়ে উঠল। অহল্যার গৃহিণীপনার ছবি তাকে তৃপ্ত করল। গালভ কেমন আছে প্রবাহিনী? সে তার হােম আরাধনার অবসরে তােমার দিকে দৃষ্টি দিতে পারছে তাে?
প্রবাহিনী বলল, আমি কিছুকাল পিত্রালয়ে এসে রয়েছি। সেখান থেকে চলে এলাম তােমাকে দেখতে। তােমার ভ্রাতার সম্বন্ধে আর প্রশ্ন কোরাে না। এখন হােমকর্ম গৌণ, পত্নীর মনােরঞ্জনই মুখ্য কর্ম হয়ে উঠেছে। আমি সংকোচ এড়াতে কিছুকাল চলে এসেছি পিত্রালয়ে।
একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের মধ্যে চেপে নিয়ে অহল্যা বলল, তােমার সৌভাগ্যকে যে-কোনও নারীই ঈর্ষা করবে। স্বামীর সঙ্গ তােমার দুর্বহ হয়ে উঠল প্রবাহিনী!
না, তুমি আমাকে ভুল বুঝাে না সখী। আর্যপুত্রের জন্য সর্বক্ষণ মন আমার ব্যাকুল। আমি চাই কিছুকাল অদর্শনে বিরহ বাড়ুক। পুনর্মিলন মধুময় হবে।
আর্যা ধূতিকে কী রকম দেখে এসেছ? তার মনের প্রসন্নতা অটুট আছে তাে? তিনি চির আনন্দময়ী। তবে তােমার অদর্শনে মাঝে মাঝে কাতরতা প্রকাশ করেন। তিনি তােমাকে নাগকেশরের তলায় নিয়ে গিয়ে জ্যোৎস্না রাতে গল্প শােনান তাের।
প্রবাহিনী বলল, কোনওদিনও না। সন্ধ্যায় তার মুখােমুখি হলেই বলেন, সারাদিন আশ্রমের কাজে গালভ বড়ই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, তুমি গিয়ে তার একটু পরিচর্যা করাে। পিতা এখন কি তার তপস্যার ক্ষেত্রে চলে গেছেন?
বহুকাল। যাবার সময় বলে গেছেন, এ আশ্রম তােমাদের। নিয়ত কল্যাণকর্ম করে যাবে। আমি তােমাকে সংসারী করে নিজে সংসার থেকে মুক্তি নিয়ে গেলাম। এখন থেকে পরিপূর্ণ পরমার্থ চিন্তায় কাটবে আমার দিন। পরমানন্দ লাভ করে ধন্য হব আমি।
অহল্যা মনে মনে বলল, ঋষির কন্যা হয়ে, মহাতপস্বীর পত্নী হয়ে আমিই কেবল নিজেকে ধন্য মনে করতে পারলাম না। অহল্যা এবার প্রবাহিনীর দুটি হাত ধরে বলল, তুমি কয়েকটা দিন আমার এখানে কাটিয়ে যাবে তাে সখী? সেই ভেবেই তাে এসেছিলাম এখানে, কিন্তু তােমাকে একা দেখে ভরসা পাচ্ছি না মনে। অহল্যা বলল, লুণ্ঠনের ভয় রাজগৃহে, যেখানে সম্পদ আছে। আমার এখানে কীসের আশায় দস্যু ধাওয়া করবে সখী?
তােমার মতাে রত্ন কোনও রাজার রাজপ্রাসাদেই মিলবে না। যে দস্যু রত্নের সন্ধান রাখে সে বৈজয়ন্ত ধাম ফেলেও এখানে আসবে রত্নের সন্ধানে।
প্রবাহিনীর কথা শুনে সহসা চমকে উঠল অহল্যা। সে কোন দস্যু, যে সুরলােকের সম্পদ ফেলে চলে আসবে অহল্যার আকর্ষণে। একটি মহান দস্যুর মুখচ্ছবি এই মুহূর্তে চোখের উপর ভেসে উঠতে দেখল অহল্যা।
রথের চালককে নির্দিষ্ট একটি দিনে পুনরায় আসতে বলে প্রবাহিনী থেকে গেল অহল্যার আশ্রমে। সেই রাতে একই শয্যায় বহুদিন পরে শয়ন করল দুই সখী। অহল্যা জানতে পারল প্রবাহিনী গর্ভে ধারণ করছে গালভের সন্তান। সে মনের আনন্দে জড়িয়ে ধরল প্রবাহিনীকে। পরদিন প্রভাতে কেমন এক উদাস দৃষ্টিতে অহল্যা তাকিয়ে ছিল আশ্রমের দক্ষিণে সেই আকর্ষিত ধু ধু প্রান্তরের দিকে। বড় রিক্ত, বড় শূন্য মনে হচ্ছিল নিজেকে। গতরাতে প্রবাহিণী তাকে জিজ্ঞেস করেছিল সন্তান-সম্ভাবনার কথা। সে নেতিবাচক উত্তর দিয়েছিল, কিন্তু একবারও মুখ ফুটে বলতে পারেনি, সে এখনও অহল্যা, ওই অনুর্বর প্রান্তরের মতােই অকর্ষিত।
কাছে এসে দাঁড়াল প্রবাহিনী। বলল, আশ্রমের স্থান নির্বাচনে ঋষিবরের প্রশংসা না করে। পারছি না। সামনেই খরস্রোতা নদীর সুনীল জলপ্রবাহ, অদূরে ধূমল পর্বতশ্রেণি। শুধু স্থান নির্বাচনই নয়, আশ্রমের অঙ্গসজ্জাতেও ঋষিবরের নিপুণ হস্ত ও কুশলী পরিকল্পনা কাজ করেছে!
অহল্যা তার সামনে প্রসারিত বন্ধ্যা ভূমির দিকে প্রবাহিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। আশ্চর্য! এমন বিশাল প্রান্তর, একেবারে অকর্ষিত! শস্যের বিরাট সম্ভাবনা এমনিভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে! রহস্যময় হাসি অহল্যার মুখে। বলল, করুণা পায়নি। ফলবতী হতে গেলে কর্যণ চাই, বলিষ্ঠ বীজ চাই আর সর্বোপরি চাই অফুরন্ত প্রেমবারির প্রবাহ।
স্বল্পকালের অবস্থিতির মধ্যেই প্রবাহিনী বুঝতে পারল, নিঃসঙ্গতা কীভাবে ধীরে ধীরে একটি নারীকে গ্রাস করে ফেলছে। তার প্রাণ প্রাচুর্যের মূল, জলশূন্য বিশুদ্ধতার মধ্যে শুধুমাত্র কঙ্করের পকে আঁকড়ে ধরে আছে। বিদায়ের আগের রাত্রি। দুই সখীর চোখে নিদ্রা নেই। সহসা একটি প্রশ্ন তুলল প্রবাহিনী, আচ্ছা সখী, আমাদের সেই রথযাত্রার বিপর্যয়ের কথা তােমার মনে আছে নিশ্চয়ই। সে দিনটি আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে আছে।
প্রবাহিনী বলল, আমি সেদিন হতচেতন হয়েছিলাম, তাই জিজ্ঞেস করার মতাে সামর্থ্য ছিল । আজ একটি কথা জানতে চাইব, সখীর কাছে অসংকোচে বলবে কি? অহল্যা প্রবাহিনীর হাতে চাপ দিয়ে বলল, তােমার কাছে আমার না বলার কিছু নেই। আমি যখন বিদায় নিয়ে চলে আসি তখন আমাদের উপকারী যে বন্ধুটি দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি কি তােমাকে সেই রাত্রেই আশ্রমে পৌছে দিয়েছিলেন, না তুমি গুহায় নিশিযাপন করেছিলে?
অহল্যা অসংকোচেই বলল, আশ্রমে ফিরে যাইনি সে রাতে। গুহায় নিশিযাপন করেছি, এ কথাও বলতে পারব না।
তবে কি তুমি মুক্ত আকাশের নীচে ঘুরে বেড়িয়েছিলে? ঠিক তাই। সেদিনের বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার কথা আমি বলে বােঝাতে পারব না। তবু তােমার কৌতুহল নিবৃত্তির জন্য কিছু বলছি শােননা।
আমি সে রাতে ওই উপকারী বন্ধুটির সঙ্গে নিশিভ্রমণে বেরিয়েছিলাম। তিনি আমাকে একটি উপযুক্ত গুহার সন্ধান দেবেন বলে নিয়ে গিয়েছিলেন। গুহার আশ্রয় কি পেয়েছিলে তুমি? পেয়েছিলাম। তবে নিশীথের বেশির ভাগ সময়ই আমাদের কেটেছিল অপূর্ব এক তুষার প্রান্তরে পরিভ্রমণ করে। আশ্চর্য! অহল্যা বলল, আশ্চর্যই বটে। জ্যোৎস্নাপ্লাবিত সে অলৌকিক তুষার প্রান্তরের বর্ণনা দেওয়া আমার সাধ্যাতীত। সেই সুরম্য ভূমিকে দেবলােকও বলা যায়। সেখানে এক সরােবরে অপ্সরার দল সুরলােক থেকে স্নান করতে নেমে আসে। তুমি কি সেখানে গুহার আশ্রয়ে নিশিযাপন করেছিলে? করেছিলাম। তুষারে তৈরি সে গুহার শিল্প সৌন্দর্য তােমাকে বলে বােঝাতে পারব না। আমি সেই বন্ধুর সঙ্গে কিছুক্ষণ সেই গুহাতে কাটিয়েছিলাম। সত্যি, তােমার সাহসের প্রশংসা না করে পারছি না। সাহস আমার নয় প্রবাহিনী। যিনি আমার কুমারীত্বকে অক্ষুন্ন রেখে সাহস জুগিয়েছিলেন, প্রশংসা তারই প্রাপ্য। প্রবাহিনী বলল, আমি তাে সেদিন বজ্বের ভয়ংকর গর্জন শুনে মুর্ভূিত হয়ে পড়েছিলাম। ওই মানুষটি সে সময় এলেন কোথা থেকে?
অহল্যা বলল, উনিই তাে ওঁর বজ্রের আঘাতে জলের দ্বার মুক্ত করে দিয়েছিলেন। তাই তুমি তােমার সামনে দেখেছিলে ওই গড়িয়ে পড়া শিলাপ। এখন দেখবে, ওপরের পর্বতের সেই সঞ্চিত জলরাশি স্রোতস্বিনীর আকারে মানুষের কল্যাণের জন্য মর্তে বয়ে চলেছে। প্রবাহিনীর কণ্ঠে বিস্ময়, সত্যই এক আশ্চর্য পুরুষ! অহল্যা অমনি বলে উঠল, এই পুরুষই চিরদিন নারীর প্রার্থনীয়, প্রবাহিনী। সম্মতিসূচক মস্তক আন্দোলন করে প্রবাহিনী নীরবে বসে রইল।
অহল্যার আশ্রম ছেড়ে পরদিন প্রবাহিনী চলে গেল পিত্রালয়ে। আবার সেই নিঃসঙ্গতা ঘিরে ধরল অহল্যাকে।
কিছুদিনের মধ্যেই আকাশের বুকে জমে উঠল আষাঢ়ের মেঘভার। প্রিমি প্রিমি বাজতে লাগল মেঘের মৃদঙ্গ। রােমাঞ্চিত হল কদম্ব তরু। মল্লিকা আর যুথীর সুবাসে আকুল হল অঙ্গন। বিরহকে উজ্জীবিত করল বর্ষা। এক ধারামুখর রাত্রিতে বজ্রধ্বনি হতে লাগল। ঘুম ভেঙে গেল অহল্যার। বাতায়ন পথে দেখল, আকাশের বিদ্যুৎ চরাচরকে আলােকিত করে রেখেছে। মাঝে মাঝে শােনা যাচ্ছে শুরুগুরু ধ্বনি।
সে শয্যার উপর উঠে বসল। বিপুল জলকল্লোল কানে ভেসে এল। তার মনে হল, নদী অনেক কাছে সরে এসেছে। সে যেন বয়ে চলেছে বাম থেকে দক্ষিণে।
ভােরের আলাে ফুটল। মেঘ-ভাঙা রােদুর ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। অহল্যা পূজার ফুল তুলতে নেমে এল অঙ্গনে।
একমনে ফুল তুলছিল সে, হঠাৎ চোখ তুলতেই দেখল সামনে দাঁড়িয়ে ঋষি গৌতম। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, জটাজুটধারী সন্ন্যাসী।
পলকমাত্র দৃষ্টি ফেলেই অহল্যা নত করল মুখ। সে পাদ্য-অর্ঘ্য সাজিয়ে আনার জন্য ত্বরায় প্রবেশ করল গৃহের অভ্যন্তরে।। বহিরঙ্গন থেকে ডাক দিয়ে বললেন গৌতম, অতিথিনিবাসে নিয়ে এসাে তােমার উপচার। ওখানে শ্রান্ত অতিথি তােমার সেবার প্রতীক্ষায় রইল।
ঋষি গৌতম চলে গেলেন অতিথিনিবাসে। অহল্যা পাদ্য-অর্ঘ্য হাতে নিয়ে ধীর পদক্ষেপে নত নেত্রপাতে অতিথি ভবনের দিকে অগ্রসর হল।
পথে যেতে যেতে ভাবতে লাগল, প্রথম দর্শনেই সে গৌতমের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠতে দেখেছে। গৌতমের মুখে মৃদু হাস্য কখনও তার দৃষ্টিগােচর হয়নি। তপস্বীর গাম্ভীর্যে পূর্ণ তার মুখ।।
তবে কি সে একইরকম জটাজালে আবৃত অন্য কাউকে দেখেছে। হয়তাে তাই, মুহূর্তমাত্র . সসংকোচ দৃষ্টিপাতে সে তার স্বামীকে চিনে নিতে পারেনি।
অতিথি ভবনের সামনে এসে সে দাঁড়াল দ্বিধাকন্দ্র পায়ে। তার সলজ্জ নত দৃষ্টি গিয়ে পড়ল অতিথির চরণে। না, চরণ দেখে চেনার কোনও উপায় নেই। সে কতটুকুই বা হৃদয়ের চোখ মেলে তাকিয়ে দেখেছে গৌতমকে। যে দৃষ্টিপাতে একজনকে চিরদিনের করে চেনা যায় সে দৃষ্টি তার কখনও ধেয়ে যায়নি গৌতমের দিকে।
অতিথির চরণ ধুইয়ে শুষ্ক বস্ত্রে মুছে নিয়ে অহল্যা আসন পেতে দিল। সামনে রাখল অর্ঘ্যসম্ভার। তারপর গলবস্ত্র হয়ে করজোড়ে প্রণামের উদ্দেশ্যে নত হল!
একী। কে তার প্রণামে বাধা দিল। তার চম্পকের মতাে দুটি হাত নিজের অঞ্জলিতে আবদ্ধ করে তাকে টেনে তুলে নিল দেহলি প্রান্তে।
অহল্যার বিস্ময়ভরা চোখের পাপড়ি ধীরে ধীরে উন্মােচিত হল। স্বামীর এতখানি সােহাগ যে তার কল্পনার অতীত।
এ কাকে দেখছে সে। স্থির সরসীতে পূর্ণ চন্দ্রমার প্রতিচ্ছবির মতাে অহল্যার স্থির দৃষ্টিতে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে এক পূর্ণ বীর্যবান পুরুষ। অহল্যার মুখ উজ্জ্বল হাসিতে এবার উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। পুরুষের মুখে কৌতুকের হাসি। অহল্যা বলল, কোথায় লুকোলেন আপনার ছদ্মবেশ। পুরুষ বললেন, তােমার উন্মুক্ত অতিথিশালার অভ্যন্তরে।। অহল্যা বলল, ছদ্মবেশ কি ওই আকৃতি প্রচ্ছন্ন রাখতে পারে। ওই মনােহরণসম্মিত মুখ। তুমি কি প্রথম দর্শনেই আমাকে চিনেছিলে প্রিয়দর্শিনী?
এক ঝলকে আমি শুধু আপনার ছদ্মবেশটুকুই দেখেছিলাম! তাতে স্বামীর আকৃতি ছিল কিন্তু প্রকৃতির ভিন্নতা আমাকে সংশয়ের দোলায় দুলিয়ে দিয়েছিল।
ইন্দ্র বললেন, আমি ঋষি গৌতমকে দূর থেকে দেখেছি, মানসের জলে অবগাহন করতে। ঋষিরা দাঁড়িয়ে আছেন তীরে। স্নান-সমাপনান্তে জিতেন্দ্রিয় উর্ধরেতা যােগীর অভিধা লাভ করবেন তিনি
অহল্যা প্রশ্ন করল, ওই অভিধা লাভ করলে কী হয়? ঋষিপত্নী হয়ে তাও জানাে না? ওই ঊর্ধরেতা যােগীর অসাধারণ ক্ষমতা জন্মে। ইন্দ্রের ইন্দ্ৰত্ব তার করতলগত।
অহল্যা মধুর পরিহাস উজাড় করে দিয়ে বলল, স্বর্গ হাতছাড়া হলে আপনি গৃহহীন হয়ে পড়বেন, তাই বুঝি এ আশ্রমে থাকার অগ্রিম আবেদন নিয়ে এসেছে? ঠিক তাই, তবে আর একটি প্রার্থনা আছে। কী সে প্রার্থনা? আশ্রম-লক্ষ্মীকে এখানেই অবিচল থাকতে হবে। অহল্যা বলল, সে ভেবে দেখা যাবে, আগে তাে স্বর্গ হস্তচ্যুত হােক। অতিথি সৎকারের সমস্ত আয়ােজন সম্পন্ন করল অহল্যা। আজ বহুদিন পরে প্রাণের মানুষটিকে কাছে পেয়ে নিজের সমস্ত সঞ্চিত সেবা উজাড় করে দিল অতিথির উদ্দেশে! বর্ষণ মুখরিত রাত্রি নিদ্রাহীন কাটল দু’জনার অতিথি নিবাসে।
ইন্দ্র বললেন, প্রিয়বাদিনী, তােমার জন্য পারিজাতের একটি স্ফুটনােম্মুখ কলিকা এনেছি, তুমি একে তােমার কেশে ধারণ করাে। দিনে দিনে ওই পুষ্প প্রস্ফুটিত হবে। দীর্ঘদিন ধরে চলবে। ওর প্রস্ফুটন ক্রিয়া। সেই স্মৃতির স্বপ্নে ভরা মায়াময় পরিবেশে একদিন যেমন করে আমার কেশে পরিয়ে দিয়েছিলেন কুসুম, তেমনই আজ পরিয়ে দিন নিজের হাতে এই পারিজাত। সেই নিরস্ত্র অন্ধকার ঘরে সহসা জ্বলে উঠল একটি দীপ। দীপ হতে অহল্যা দাঁড়াল লীলায়িত ভঙ্গিতে। তার কেশচুড়ায় ইন্দ্র পরিয়ে দিলেন ত্রিলােকের শ্রেষ্ঠ কুসুম, পারিজাত।
ইন্দ্রের চরণ প্রান্তে প্রদীপ রেখে নতজানু হয়ে বলল অহল্যা, পুরুষােত্তম, ধন্য হয়েছি আমি আপনার দানে। এর সৌরভ চিরদিন আমাদের স্মৃতিকে সুরভিত করুক, এই কামনা।
তৃতীয় রজনীতে স্বপ্নের স্বর্গলােক নেমে এল ধূলার ধরণীর বুকে। পূর্ব দিগন্তে মেঘের কোলে ফুটে উঠল চন্দ্রালােকের মহিমা। নিবিড় হল ইন্দ্রের কামনাকাতর বান্ধন। নিশিশেষে ওরা এসে দাঁড়াল সিক্ত চরণে কদম্ব বীথিকার তলায়। অতি কোমল সুরভিতে মন্থর বাতাস। অহল্যা ইন্দ্রের বুকে মাথা রেখে বলল, আমি স্বর্গের অফুরন্ত সুখ চাই না প্রিয়তম। মর্তের অনন্ত ব্যথার পারাবারও নিঃশব্দে মুখ বুজে পার হতে চাই না আমি। সুখ দুঃখ, ভােগ ভালবাসা, কর্ম ও ধ্যান আমাকে পরিপূর্ণ এক নারীর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করুক, এই আমার অভিলাষ।
ইন্দ্র বলল, কোনওদিন কি সতীত্বের তাড়নায় আমাদের এই ক্ষশ-মিলন তােমার কাছে গ্লানিময় মনে হবে না প্রিয়তমা?
স্থিরচিত্তে স্বেচ্ছায় আমি যা করেছি, তাকে কোনও অনুতাপ কোনওদিনই স্পর্শ করতে পারবে না। নারীত্বের অবমাননা যেখানে, অহল্যা সেখানে চির বিদ্রোহিনী। যােগ্য পুরুষের স্পর্শে বঞ্চিত নারীর বেদনাকে মুক্তি দিতে পেরে কৃতার্থ হয়েছি প্রিয়তম। এক মায়াময় সােনালি স্বপ্ন ছড়িয়ে মেঘের ফাকে সবিতার আবির্ভাব হল। ইন্দ্র অহল্যার হাত ধরে বললেন, এসাে আমার সঙ্গে।
অহল্যা প্রিয়তম পুরুষের হাতে হাত রেখে সামনে এগিয়ে চলল। আশ্রমের অতিথি ভবন পেরিয়ে, উদ্যান বীথিকার ভেতর দিয়ে তারা এসে পৌছােল মূল কুটিরের সামনে। ইন্দ্র বললেন, এই কুটিরের দক্ষিণে সেই অনুর্বর বন্ধ্যা ভূমি, তাই না কল্যাণী? সঠিক অনুমান প্রিয়তম। ইন্দ্র বললেন, চলাে সেখানে, প্রকৃতির অনন্ত লীলার আর এক মহিমা প্রত্যক্ষ করি। উভয়ে এসে দাঁড়ালেন সেই প্রান্তরের প্রান্তে। নির্বাক নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অহল্যা। উষর বন্ধ্যা ভূমির বুকের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে সৃষ্টির আনন্দে মত্ত অমৃতধারা। একসময় অহল্যার দৃষ্টি ফিরে এসে স্থির হল ইন্দ্রের মুখের ওপর। এ তােমারই করুণার দান প্রিয়তম।
পরিতৃপ্তির আনন্দে উদ্ভাসিত হল ইন্দ্রের মুখ। বললেন, একটি পাষাণের সুপ শতদ্রর জলগমনের পথ রুদ্ধ করে রেখেছিল। আমি সেই বাধাটিকে অপসারিত করেছি মাত্র। সৃষ্টির প্রাণপ্রবাহিনী তার স্বভাব ধর্মে নিম্নমুখী। আপন গতিতে প্রবাহিত হয়ে চলে গেছে।
অহল্যার পলকহীন দৃষ্টির মুগ্ধতা ইন্দ্রের মধ্যে জন্ম-জন্মান্তরের একটি পুরুষকে খুঁজতে লাগল। সাধনলােক থেকে আশ্রমে প্রত্যাবর্তন করলেন ঋষি গৌতম। তপস্যার তেজে প্রদীপ্ত তার তনু। সুকঠিন ব্রহ্মচর্য ব্রত অন্তে ফিরে এলেন তিনি। অহল্যা দেখল, সাধনার শক্তিতে আরও অহংকৃত হয়েছেন ঋষি। ব্রত উদযাপনের পর প্রথম সহবাস রজনীতে ঋষি গৌতম বললেন, নিরর্থক সহবাস, চিত্তবিক্ষেপমাত্র। সন্তান উৎপাদন ও সুচারুভাবে গৃহকর্ম সম্পাদনের জন্যই বিবাহ। সহবাস স্বামী-স্ত্রীর পুত্র উৎপাদনকে নিশ্চিত করে। তাই সহবাসকালে নিরন্তর সন্তান সৃষ্টির কথাই চিন্তা করতে হয়। সম্ভোগের চাঞ্চল্য শুধু অন্যায় নয়, অপরাধ।
অহল্যা বলল, কেবলমাত্র আপনার ন্যায় উর্দ্ধরেতা পুরুষই এই সত্য উপলব্ধি করতে পারেন। গৌতম অহল্যার এই প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপকে স্তুতি বলে ধরে নিয়ে তৃপ্ত হলেন।
অন্য এক রাতে সুরতলীলার পূর্বে ঘন ঘন শ্বাস গ্রহণ করে গৌতম বললেন, কোথা থেকে ভেসে আসে পুষ্প সুবাস?
অহল্যা বলল, আমার কেশপাশে গ্রথিত পুষ্প থেকে। বিস্মিত গৌতম বললেন, কোথা থেকে পেলে ও পুষ্প? এ তাে মর্ত্যের উদ্যানজাত কোনও পুষ্প নয়।
অহল্যা সুস্পষ্ট কণ্ঠে বলল, আপনার অনুমান যথার্থ ঋষিবর। এ পুষ্প, পারিজাত। স্বর্গের কানন থেকে চয়ন করে দেবরাজ আমাকে উপহার দিয়ে গেছেন।
ক্রোধে কম্পিত হল গৌতমের তনু। অন্ধকারেও অহল্যা উপলব্ধি করল, গৌতম প্রজ্বলিত এক অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে বসে রয়েছে।
কতক্ষণ পরে কক্ষ প্রকম্পিত করে গৌতম উচ্চারণ করলেন, ভ্রষ্টা, সৈরিণী, হীন চরিত্রা, কামজৰ্জর পুরুষের অঙ্কশায়িনী নারী! হ্যা মহাত্মন, একমাত্র সেই পুরুষই আমার নারীধর্মকে রক্ষা করেছেন। আমার প্রতি মুহুর্তের অবমাননার যন্ত্রণা থেকে তিনি আমাকে মুক্তি দিয়েছেন। গৌতম অন্ধকারেই উঠে দাঁড়ালেন। গৃহত্যাগের পূর্বে বললেন, যে সম্ভোগে সামাজিক অনুশাসন নেই, সংযম নেই, তা পশ্বাচার।
অহল্যা বলল, সবই সত্য ঋষি। যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনিই দিয়েছেন প্রবৃত্তি। দেহ মনের এই প্রবৃত্তি চায় তার সহজ স্বাভাবিক বিকাশের পথ। স্রোতস্বিনীর স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ হলেই সে দুকূল প্লাবিনী হয়ে ওঠে।
গৌতম সেই নিশীথেই পত্নী, আশ্রম উভয়কে পশ্চাতে ফেলে সত্যের সন্ধানে বহির্গত হলেন।
পঞ্চবর্ষ আত্মানুসন্ধানের পর একদিন ঋষি গৌতম আশ্রমের পথে ফিরলেন। তিনি দেখলেন, অনুর্বর ভূমি স্রোতবাহিত পলিমৃত্তিকার সঞ্চয়ে উর্বর হয়ে উঠেছে। স্থানে স্থানে জেগে উঠেছে সবুজ, শ্যামল, দৃষ্টিনন্দন লতাগুল্ম। পরিতৃপ্ত গৌতম স্রোতস্বিনীর সুশীতল বারিতে অবগাহন করলেন। আশ্রমে প্রবেশ করেই তিনি দেখলেন, কুটিরের সম্মুখে স্বৰ্গীয় এক চিত্র। জননী তার সন্তানকে নিয়ে মমতাময়ীর মূর্তিতে দাঁড়িয়ে আছেন। গৌতম অগ্রসর হলেন। জননীর পরিশুদ্ধ দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল অহল্যা। প্রথম বাক্য উচ্চারিত হল গৌতমের মুখে, এই অনিন্দ্যসুন্দর পুত্রটি কোন ভাগ্যবানের? অহল্যা উত্তর দিল, সৃষ্টিকর্তার। কী নাম রেখেছ কুমারের? শতানন্দ। গভীর আবেগে অহল্যা আর শতানন্দকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন মহাত্মা গৌতম।