….শুধু রত্নরাজি নয়, সােমনাথ মন্দিরে দান করা হয় নারীদেরও। ভক্তদের বিশ্বাস, এই মন্দিরে কন্যারত্ব দান করলে অক্ষয় স্বর্গলাভ হয়। আর সেই স্বর্গলাভের পথ প্রশস্ত করতে ধণাঢ্য ব্যক্তিরা নারীরত্ব দান করেন সােমেশ্বর মহাদেবের চরণে। এই কুমারী নারীদের কখনও সংগ্রহ করে আনা হয় কোনও পরাজিত রাজ্য থেকে, খনও দাসীর হাট থেকে। এমনকী রাজা-মহারাজারা অনেকসময় তাদের নিজ পূর্ববারের কন্যাদেরও সমর্পণ করেন অধিক পুণ্যলাভের আশায়। এই সব কুমারী নারীরা সােমেশ্বর মহাদেবের কণ্ঠের নীলকণ্ঠ ফুলের মালা কণ্ঠে ধারণ করে তাকে গ্রহণ করে স্বামী রূপে। পূর্বের সব পরিচয় মুছে গিয়ে তখন তাদের একমাত্র পরিচয়, তারা-দেবদাসী। এজগতে তখন তাদের একমাত্র নাথ–সােমনাথ। তার সন্তোষপ্রদানই দেবদাসীদের প্রধান ও একমাত্র কর্তব্য। মন্দিরের জীবন্ত বিগ্রহের সামনে নৃত্যগীত প্রদর্শন করে তারা। প্রত্যহ সকালে নিদ্রাভঙ্গের পর দেবদাসীদের নৃত্য দেখে দিন শুরু করেন দেবতা, সন্ধ্যায় তাদেরই সঙ্গীত-মুছনা, নৃত্যে আমােদিত হয়ে শয়ন করতে যান। এমনকী দ্বিপ্রহরে ভােজন সমাপ্ত হবার পর বিশ্রামের পূর্বে তিনি তৃপ্ত হন সােমানথ সুন্দরীদের সেবায়। সুবিশাল সােমনাথ মন্দিরে বণ্টাধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে দেবদাসীদের নৃত্য-গীত-ঘুঙুরের শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে সােমেশ্বর মন্দির।….
…..প্রধান পুরােহিত প্রথমে তাকালেন দেবতার কাছে নিজেদের সমর্পণের উদ্দেশ্যে অপেক্ষারত কন্যাদের দিকে। দ্বাদশ থেকে অষ্টাদশ বর্ষীয়া কন্যা সব। বেশ কয়েক মাস যাবৎ এ মন্দিরের কানন সংলগ্ন এক সংরক্ষিত স্থানে এদের নৃত্যগীতের তালিম দিয়েছে দেবদাসী প্রধানা তিলােত্তমা। যদিও গর্ভগৃহর সামনে মন্দিরের প্রধান চত্বরে এই প্রথম পা রাখল তারা। আজকের পর থেকে অবশ্য তাদের নিয়মিত আসা-যাওয়া শুরু হবে এই চত্বরে। বারাে জন নারী।
প্রধান পুরােহিতের চোখ ঘুরতে লাগল এক এক করে তাদের মুখমণ্ডলের ওপর। অপরূপা সব। তাদের মুখমণ্ডলের সৌন্দর্য আর জৌলুশই জানিয়ে দিচ্ছে এই নারীরা সব সম্ভান্তবংশীয়া দুহিতা। প্রধান পুরােহিতের দৃষ্টি এক সময় এসে থমকে গেল এক নারীর মুখের ওপরে। দেবদাসী প্রধান তিলােত্তমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সে।
দেবদাসী তিলােত্তমা শুধু নর্তকী শ্রেষ্ঠাই নয়, এ মন্দিরের সুন্দরী শ্রেষ্ঠাও কাটে। কিন্তু এ কন্যার অঙ্গ সৌষ্ঠব আর রূপের কাছে তিলােত্তমার সৌন্দর্যও যেন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। প্রধান পুরােহিত ত্রিপুরারিদেব নারীসঙ্গ না করলেও সুন্দরী নারী তিনি কম দেখেননি। তিনি দীর্ঘকাল ধরে এ মন্দিরের সুন্দরী দেবদাসীদের তাে দেখেছেনই, দেখেছেন এ মন্দিরে পূজা দিতে আসা বহু বাজদহিতাকেও। কিন্তু, এমন সৌন্দর্য তিনি ইতিপূর্বে দেখেননি। ইন্দ্রসভার নর্তকীরাও হয়তাে ম্লান হয়ে যাবে এ নারীর সমুখে দাঁড়ালে।
সারবদ্ধ অন্য নারীরা বিস্মিতভাবে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কিন্তু এই কন্যা আনতভাবে চেয়ে আছে ভূমির দিকে। যেন স্বর্ণভূষণে সজ্জিত এক স্থির প্রস্তরমূর্তি। মেয়েটি প্রধান পুরােহিতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বুঝতে পেরে মল্লিকার্জুন প্রধান পুরােহিতের পাশে এসে দাঁড়ালেন। তারপর চাপাস্বরে বললেন, এই সেই চালুক্য কন্যা।…….
……নন্দিবাহনের ইশারাতে নর্তকীশ্রেষ্ঠা তিলােত্তমা এসে সামনে দাঁড়াতেই ত্রিপুরারিদেব তাকে প্রশ্ন কলেন, তুমি নিশ্চিত তাে যে এই কন্যারা সব
অক্ষত যােনি? , তিলত্তমা জবাব দিল, হ্যা, প্রভু। আমি নিশ্চিত।……
…..বুকের কাছে তার মৃণালবাহু দুটো প্রার্থনার ভঙ্গীতে জড়াে করে কয়েক মহর্ত পাথরের মূর্তির মতাে দাঁড়িয়ে রইল সেই কন্যা। তার পরনে জরির কাজ করা পট্টবস্ত্র, রক্তি ব বন্ধনী। মেঘ রাশির মতাে কুঞ্চিত কেশদাম, কাজল, কুমকুম চন্দন শােভিত মুখমণ্ডল, ক্ষীণ কটিদেশ, ভারী নিতম্ব শােভিত সেই নারীর দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সবাই। পুরােহিত নন্দিবাহনও তার ব্যতিক্রম নন।…..
……কয়েকটি দলের সমবেত নৃত্য প্রদর্শনের পর অবশেষে গর্ভগৃহর সামনে একক নৃত্য পরিবেশনের জন্য আবির্ভূত হল সমর্পিতা। অন্য দেবদাসীরা অর্ধবৃত্ত রচনা করে ঘিরে দাঁড়াল তাকে। শুরু হলাে তার নৃত্য প্রদর্শন। প্রথমে ধীর লয়ে, তারপর ক্রমশ দ্রুত হতে শুরু করল তার নৃত্য বিভঙ্গ। তার ক্ষিপ্র পদচারণা আর ঘুঙুরের শব্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠল গর্ভগৃহের অঙ্গণ। যেন এ কোনও মানবশরীর নয়, ঘূর্ণায়মান এক নীল তড়িৎশিখা আবর্তিত হচ্ছে অঙ্গিরার চোখের সামনে। | শুধু অঙ্গিরাই নয়, বিমােহিত অন্য দর্শকরাও। পুরােহিত নন্দিবাহন, রক্ষী প্রধান জয়দ্ৰথ, সেবায়েত-প্রধান বিষধারী সবাই নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সেই অপূর্ব নৃত্যশৈলীর দিকে। নানা বিভঙ্গে অনেক সময় প্রকট হয়ে উঠছে নর্তকীর শরীরের আহ্বান। চকিতের জন্য উঁকি দিয়ে যাচ্ছে সুডৌল ডিম্বাকৃতি স্তন যুগলের মধ্যে গাঢ় বক্ষ বিভাজিকা অথবা ঘূর্ণায়মান বস্ত্র খণ্ডের আড়াল থেকে গভীর নাভিকুপ। আর তা হয়তাে গােপনে কামের আগুন জাগিয়ে তুলছে কোনও কোনও পুরুষের মনে।
নারী শরীরের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তর জন্য হয়তাে বা চক্ করে উঠছে কোনও পুরুষের চোখ। অঙ্গিরার অবশ্য সে-সব কিছু নয়, মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল সমর্পিতার অপূর্ব, অসামান্য নৃত্য। কিন্তু এক সময় সমর্পিতার নৃত্য সমাপ্তির পর্যায়ে পৌছল।……
…..সমর্পিতার রক্ষাকর্তা ওই যুবক। সে-ও কিছুটা বিস্মিত ভাবে চেয়ে আছে ভূমিতে পতিত, সদ্য মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা ওই দেবদাসীর দিকে। সমর্পিতা তার দিকে তাকাতেই কয়েক মুহুর্তের জন্য দৃষ্টি বিনিময় হলাে তাদের দুজনের মধ্যে। আর এরপরই সমর্পিতার খেয়াল হল বর্তমানে | সে প্রায় অর্ধনগ্ন! অন্তর্বাস ছাড়া পরনে কিছু নেই! সমর্পিতার গাঢ় বক্ষ বিভাজিকা সম্পন্ন স্তন যুগলের স্পষ্ট অবয়ব, মুদ্রার আকৃতির গভীর নাভি কূপ, কদলী কাণ্ডের মতাে মসৃণ উরু যুগল, সবই উন্মুক্ত বা প্রকট ভাবে ধরা দিচ্ছে যুবকের চোখে!
ব্যাপারটা মাথায় আসতেই সমর্পিত লজ্জিত ভাবে দু-হাত বুকে চাপা দিল তার বক্ষ বিভাজিকা আড়াল করার জন্য। যুবকও যেন ব্যাপারটা বুঝতে পেরে দৃষ্টি সরিয়ে নিল সমর্পিতার ওপর থেকে। আর এরপরই চারপাশ থেকে ছুটে এল তিলােত্তমা-সহ অন্য দেবদাসীরা। এতক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকার পর হুঁশ ফিরেছে তাদের। কে যেন একটা বস্ত্রখণ্ড দিয়ে আবৃত করল সমর্পিতার শরীর। তারপর তাকে উঠিয়ে নিয়ে দেবদাসীরা গর্ভগৃহ চত্বর ত্যাগ করল।…..