সহস্র এক আরব্য রজনী – ৪ (তিন রূপসী ও কুলির রোমাঞ্চকর কিসসা)

›› আরব্য রজনী  ›› ১৮+  

বেগম শাহরাজাদ এবার বলেন—বহিনজী, এর চেয়ে আরও অনেক ভাল ভাল কিসসা আমার ঝােলায় রয়েছে। এবার শােন, এক কুলি আর তিন লেড়কির কিসসা।

বাগদাদ নগর।

কোন এক সময়ে বাগদাদ নগরে এক সুদর্শন যুবক একাকী বাস করত। তার পেশা ছিল কুলিগিরি। সে ছিল একদমই একা। তিনকুলে তার ছিল না বলতে কেউ-ই ছিল না। শাদীও করেনি।

এক সকালে কুলি যুবকটা একটা খালি ঝুড়ি নিয়ে রাস্তায় বসেছিল। যদি কোন আমির মালপত্র বয়ে দেবার জন্য তাকে তলব করে, এ আশাতেই তার এখানে বসে থাকা।

এমন সময় নজর পড়লো। ক্ষীণ-কটি উদ্ধত উন্নতবক্ষা, অপসরা সদৃশ, পরমা সুন্দরী এক যুবতী তারই দিকে এগিয়ে আসছে। দুধে-আলতা গায়ের রঙ। চাঁপার কলির মতো তার হাতের আঙ্গুলগুলো। কাছে এসে মুখের নাকবি ঈষৎ সরিয়ে সে বললো, এই, যাবে?

হরিণীর মতো টানা টানা চোখ। সুরমা পরে আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। টিকালো নাক। গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁট মাথায় একরাশ ঘন কালো চুল। এমন রূপসী নারী সচরাচর চোখে পড়ে না! ও যখন ডাকলো, এই যাবে? যেন মধু ঢেলে দিলো তার কানে। কি মিষ্টি গলার স্বর।

খালি ঝুডিটা তুলে নিয়ে তার পিছে পিছে চলতে থাকে সে। এক সময় এক বাডির দরজার সামনে এসে কড়া নাড়লো মেয়েটি। একটি ট্যাশ মেয়েছেলে দরজা খুলে দিলো। তার হাতে কিছু দিনার দিতে একবোতল মদ এনে দেয় সে। সরাবের বোতল ঝুডিতে তুলে দিয়ে আবার চলতে থাকে। তার পিছে পিছে চলে কুলি। এক ফলের দোকানের সামনে এসে থামে। কিছুফল কেনে। নানা দেশের সেরা সব ফল। সিরিয়ার আপেল, ওসমানী বেদনা, উমানের আখরোট, আলেপ্লোর আলুবখরা, দােমস্কাসের আঙুর, নীল-এর শশা, মিশরের পাতিলেবু, সুলতানী চাটনী, লাল রঙের জাম। ফলগুলো ঝুডিতে তুলে নিলো এবার হেনা, গোলাপ, চামেলী, যুঁই, আরও সব নানা জাতের সুন্দর সুন্দর সুগন্ধী ফুল কিনলো মেয়েটি। তারপর এল কষাই-এর দোকানে। পাঁচ সের মাংস নিলো। এর পর সে আলমন্ড কিনলো। তারপর এলো মিষ্টির দোকানে; পেস্তার বরফি, গাজরের হালওয়া, মাখন চীজ, দুধ, মধু, চিনি দিয়ে তৈরি হরেক রকম জিভে-জাল-আসা ভালো ভালো মেঠাই কিনে ঝুডিতে তুলে দিলো। তার সওদা করার বহর দেখে কুলি তো অবাক। ঝুডিতে আর অ্যাটে না। কী পোল্লাই ভারি হয়ে গেলো ঝুডিটা। একটু বিরক্ত হয়ে অথচ হাসতে হাসতে বললো, আগে যদি জানাতে মালকিন, তা হলে তোমার জন্য একটা খচ্চর ভাড়া করে। দিতাম। এতো কি মানুষ বইতে পারে।

তার রসিকতায় হাসলো মেয়েটিা চোখে বান মারলো। মুখে কথা বললো না।

একটা আতরের দোকানে এসে গোলাপজল, আতর আর দশ বোতল নির্মল পানীয় জল নিলো। পিচকারীর যন্ত্রও কিনলো একটা। সব শেষে সে আলেকজান্দ্ৰিয়ার সুন্দর সুন্দর মোমবাতি কিনলো কিছু। সবগুলো ঝুডিতে তুলে দিয়ে বললো, নাও, চলো, সব হয়ে গেছে।

সুবোধ বালকের মতো ঝুডি মাথায় তার পিছু পিছু চলতে থাকে সে। এক সময় দেখে অবাক হতে হয়, এক মনোরম প্রাসাদ-প্রাঙ্গণে এসে হাজির হলো তারা। সামনে ফুলের বাগিচা। জলের ফোয়ারা। দরজায় টোকা দিতেই খুলে গেলো। কুলিটা দেখলো, দরজা খুলে দিয়েছে এক নবযৌবন-উদ্ভিন্না এক কিশোরী। যৌবনে হবে পরমা সুন্দরী রমণী। তার ছোট ছোট সুগঠিত স্তন, সরু কোমর আর কুসুম-পেলাব তনুতে এখনই যাদু লেগেছে। টানা টানা চোখ, উন্নত নাসিকা, গালে গোলাপের আভা। চোখের তারায় হরিণীর চঞ্চলতা। কুলিটা মাথা থেকে ঝুড়িটা নামাতে নামাতে আড়চোখে কিশােরীর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে নিল। তার কোমর স্বাভাবিকের চেয়ে সরু। সুগঠিত স্তন দুটো সবে একটু একটু করে উকি দিচ্ছে। ঘাসের ফাক দিয়ে ছােট ছােট ফুল যেমন উঁকি দেয় ঠিক তেমনি এ দুটোকে মনে হ’ল কুলি-যুবকটার চোখে। চোখ দুটো হরিণীর মতই টানা টানা। উন্নত নাসিকা। আপেলের মত লালচে আভা গাল দুটোতে সুস্পষ্ট। সব মিলিয়ে তার কুসুম – কোমল দেহ পল্লবটি পুরুষের দেহ-মনকে কাছে টানে। দেয় শান্তিসুখের প্রতিশ্রুতি।

আজকের দিনটা তার ভালোই যাবে মনে হচ্ছে। কুলিটা ভাবলো, সকাল বেলায় এমন সুন্দরী নারীর দর্শন, এ পরম সৌভাগ্যের কথা।

কুলিটা বিস্ময়ের ঘাের কাটিয়ে আপন মনে বলে উঠল –‘সাত সকালেই এমন অপরূপা যুবতী ও কিশােরীর মুখােমুখি দাঁড়ানাের সৌভাগ্য খােদাতাল্লার আশীর্বাদ ছাড়া কিছুতেই সম্ভব নয়। হায় খােদা! তােমার মেহেরবানীর হদিস মানুষের অজানা।

যুবতী এবার তুলতুলে কোমল সুদৃশ্য পা দুটো ধীর-মন্থর তালে ফেলে ফেলে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল। কুলিটা তাকে অনুসরণ করল। সুসজ্জিত এক বিশালায়তন ঘর। ঘরের একধারে মনলােভা কারুকার্যশােভিত পালঙ্কের ওপরে মখমলের চাদর বিছানাে। তারই ওপরে শুয়ে আর এক অপরূপা। ঘুমে অচৈতন্যা। তার কামিজটা পায়ের দিকে একটু বেশী রকমই উঠে গেছে। মেয়েটা পিছন ফিরে শুয়ে। তার ভারি ও চওড়া নিটোল নিতম্ব দুটো যেন ছাঁচে গড়া। কোন সুদক্ষ শিল্পী যেন নিপুণভাবে গড়ে তুলেছে। দুটো পাহাড়ের ঢেউ যেন বার বার বাধা পেয়ে নেমে এসেছে পাদদেশের দিকে। সরু কোমরটা ধীর – মন্থর গতিতে, সবদিকে সমতা বজায় রেখে ক্রমে চওড়া হতে হতে নিতম্ব দুটোর সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। আবার ওপরের দিকেও সৃষ্টিকর্তা একই নির্মাণ-কৌশল প্রয়ােগ করেছেন। কোমর থেকে ক্রমে চওড়া হতে হতে বুক আর পিঠটাকে মনলােভা করে তৈরী করা হয়েছে। নিতম্বের ও পরের অনাবৃত কোটিদেশ আর গ্রীবার অংশ বিশেষের অপলক চোখে তাকিয়ে থেকে যুবক কুলিটা যেন নিজেকে নিঃশেষে হারিয়ে ফেলল। এমন সময় তার বরাত আরও খুলে গেল এক ঝটকায়। মেয়েটা ঘুমের ঘােরেই অধিকতর স্বস্তির প্রত্যাশায় পাশ ফিরল। কুলিটার বুকের ভেতরে অদ্ভুত এক রােমাঞ্চের আবির্ভাব ঘটল।

মনে হ’ল কলিজাটা বুঝি উসখুসানি শুরু করে দিয়েছে। এক লহমায় তার কুসুম-কোমল মুখাবয়ব প্রত্যক্ষ করা মাত্রই তার বুকের ভেতরে এমন অভাবনীয় তােলপাড়ানি শুরু হয়ে গেছে, রােমাঞ্চে মন-প্রাণ আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। বিস্ময়াভিভূত কুলিটা আপন মনে বলে উঠল — মুখ নয় তাে যেন শিশিরে ভেজা আধ – ফোটা পদ্ম, মেঘমুক্ত প্রভাতের শুকতারা। আর না, আর ভাবতে পারল না সে। তার সর্বাঙ্গ যেন কেমন শিথিল হয়ে আসছে। রূপসী তন্বী যুবতীর ঘুম ভেঙ্গে গেল। চকিত চপল চোখ দুটো মেলে তাকাল। সুরেলা কণ্ঠে বল্ল – তােমরা এমন পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে যে!’ এবার তার বহিনজীর দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল –‘ওর মাথায় অতবড় একটা বােঝা, নামিয়ে দাও ?

কথা বলতে বলতে অপরূপা বিছানা ছেড়ে নেমে এল। দু’জনে ঝুড়িটা ধরাধরি করে কুলির মাথা থেকে নামাল। বড়জন দুটো দিনার কুলিটার দিকে এগিয়ে দিল। কিন্তু বিদায় জানিয়ে ঘর থেকে বেরনাে তাে দূরের কথা কোন কথাও বলতে পারল না। কেবল বিস্ময় মাখানাে দৃষ্টি মেলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল বহু বাঞ্ছিতা অপরূপাদ্বয়ের মুখের দিকে।

বড় লেড়কিটা বল্ল – “কিগাে, তােমার প্রাপ্য তাে বুঝেই পেয়েছ, তবে আবার দাঁড়িয়ে যে বড় ? মজুরি আরও কিছু চাচ্ছ কি ? ঠিক আছে, এই নাও আর এক দিনার।

কুলিটা যেন এবার সম্বিৎ খুঁজে পেল। সে ব্যস্ত হয়ে বল— “না, মজুরির ব্যাপার নয়। আমার মজুরি মাত্র এক দিনার। তােমরা -এমনিতেই দুদিনার দিয়েছ। আবার কেন দিতে যাবে?’

– তাই যদি হয় তবে যে এখনও দাঁড়িয়ে?

– “দেখ, যদি কিছু মনে না কর একটা কথা জিজ্ঞেস করি। তােমাদের কারাে দেহেই রূপ বা যৌবন কোনটারই অভাব নেই, যে কোন যুবকের মন জয় করার পক্ষে যথেষ্ট। তবু তােমরা একা থাক কেন, ভাবছি! কোন পুরুষ তােমাদের সঙ্গে নেই কেন? কোন কিছু যদি ভোগ করাই না যায় তবে তা থাকা আর না থাকা তাে সমান কথাই। তােমাদের দেহের এ অঢেল রূপ আর অফুরন্ত যৌবনের কি-ই বা মূল্য? আর রূপ থাক আর না-ই থাক যৌবন যখন আছে তার তাড়না তাে কম-বেশী থাকতে বাধ্য। মানুষ কামনা আর লালসার বশ, কথাটা তাে মিথ্যা নয়। কোন পুরুষকে যদি নারী তার দেহসুধা পান করাতে না পারে তবে তার জীবনই তাে বৃথা। নিজেকে পুরুষের কাছে মেলে ধরা, নিঃশেষে বিলিয়ে দেয়ার মাধ্যমেই তাে লেড়কিদের কামতৃষ্ণা নিবৃত্ত করার একমাত্র উপায়।

‘আমরা কুমারী, আজও কুমারীত্বকে সযত্নে পােষণ করছি। পর-পুরুষের সান্নিধ্য আমাদের বিপদ ঘটাতে পারে। মজা লুঠে পালিয়ে যাবে। আর তার কৃতকর্মের দায় ভার বইতে হবে আমাদের। এরকম আশঙ্কাতেই আমরা সতর্কতার সঙ্গে পুরুষদের এড়িয়ে চলেছি, আজও চলছি। বড় লেড়কিটা বল।

-তােমরা আমার ওপর আস্থা রাখতে পার। বিশ্বাসঘাতকতার লেশমাত্রও পাবে না। আরও এমন সব কথা বলতে লাগল যাতে করে স্পষ্টই বুঝা গেল, খােদাতাল্লার মর্জিতে কুলিগিরি করে বটে কিন্তু কালির অক্ষর কিছু পেটে আছে।

কুলি যুবকের কথা ও আচরণে লেড়কি তিনজনই খুব মুগ্ধ হল। মেজ লেড়কিটার মধ্যে একটু দুষ্টুমি বুদ্ধি ভর করল। সে বড়টার কানে কানে বল্ল  ‘একে নিয়ে একটু রঙ্গ তামাশা করলে কেমন হয়?’ বড় লেড়কিটা এবার কুলিটাকে বলল – কি গো, সঙ্গে মালকড়ি আছে কিছু? খালি হাতে তাে আর মজা লােটা যায় না।

– ‘সে আমি পাব কোথায়, বল তাে! কুলিগিরি করে দিন চালাই, দেখতেই তাে পাচ্ছ। আর যেটুকু আছে তা তােমাদের কাছে হাতের ময়লার সামিল। কি -ই বা তােমাদের কাজে লাগবে, বল ?

ঠিক আছে — কথা বলতে বলতে সে ঝুড়িটা হাতে তুলে নিয়ে এবার বেরােবার উদ্যোগ করল। ঠিক তখনই মেজো লেড়কিটা আচমকা তার একটা হাত ধরে ফেল। “ছিঃ! পুরুষ মানুষের এত গােসা করলে কি চলে! আর পয়সা ছাড়া মেয়েদের খুশি করা যায়, শুনেছ কোথাও? পাত্তি ফেল, মজা লুঠো।’ কথাটা বলেই সে মন মাতাল করা হাসিতে ফেটে পড়ার জোগাড় হল। বড় লেড়কিটাও তার সঙ্গে যােগ দিল।

বড় বহিনদের কাণ্ড দেখে ছােট লেড়কিটা বেশ রাগত স্বরেই বলল – তােমরা একে সােজা-সরল পেয়ে কী আরম্ভ করেছ বলতাে? সওদা করতে গিয়ে তাে নােটের বাণ্ডিল উড়িয়ে এলে।

তােমাদের কাছে যদি পয়সাটাই বড় হয় তবে এর হয়ে আমিই তােমাদের চাহিদা পূরণ করে দেব। কেমন পেশীবহুল এর শরীর আর কেমন চওড়া ছাতিটা! এ একাই আমাদের তিনজনের পিয়াস মেটাতে পারবে।

মেজো মেয়েটা বলল  “কি রে, তুই যে একেবারে মজে গেছিস দেখছি! যাক গে, চুলােয় যাক এর টাকাকড়ি। পাত্তির দরকার নেই। এবার সে কুলি যুবকটার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বলল – এসাে গাে মনের মানুষ, আমরা এবার একটু মন খােলসা করে গল্পটল্প করি।’

অন্য দু’বহিনও এবার তাকে সমর্থন করল। সুরার পাত্র আর পেয়ালা নিয়ে এল। পেয়ালার পর পেয়ালা সুরা উজাড় হতে লাগল। আর সে সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা-মস্করার জোয়ার বয়ে চল্ল।

কয়েক পেয়ালা সুরা গলায় ঢেলে কুলি যুবকটা খােশ মেজাজে গান ধরল। তার কিন্নর কণ্ঠের গানে তিন বােন তন্ময় হয়ে গেল।

আর এক পেয়ালা সুরা এনে ছােট লেড়কিটা তার ঠোটের কাছে ধরল। এক নিঃশ্বাসে পেয়ালাটা উজাড় করে দিয়ে সে এবার গানের তালে তালে নাচতে লেগে গেল। লেড়কি তিনটাও আর নিজেদের সামলে রাখতে পারল না।

তারা পালা করে যুবকটার কোমর ধরে নাচতে লাগল। তার কিন্তু বড় লেড়কিটার দিকেই আকর্ষণ বেশী। বার বার তাকে জড়িয়ে ধরেই নাচতে থাকে। ব্যাপারটা তার মনঃপূত হ’ল না। ঈর্ষা চেপে রাখতে পারল না। মুখ গােমড়া করে দাঁড়িয়ে রইল। দু’ চোখ দিয়ে ক্রোধানল ঠিকরে বেরিয়ে আসতে লাগল। ছােট লেড়কিটা অস্থির হয়ে পড়েছে। সে মাথা ঠিক রাখতে না পেরে কুলি-যুবকটাকে দমাদ্দম কিল-চড় মারতে আরম্ভ করল। আর রাগে ফুলতে লাগল।

কুলি যুবকটা বাধ্য হয়ে পালা করে তিন বহিনকেই জড়িয়ে ধরে নেচে আনন্দ দিতে লাগল। কিছুক্ষণ এভাবে সুখদান ও সুখলাভের মধ্য দিয়ে কাটিয়ে এক সময় সে মেজো লেড়কিটাকে আলতাে করে কাঁধের ওপর তুলে নিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেল। বারান্দা পেরিয়েই ফুল বাগিচা। হাজারাে রূপ আর গন্ধের বিচিত্র সমাবেশ ঘটেছে বাগিচার গাছে গাছে। যেন কোন্ দৈত্য সবার অলক্ষ্যে স্বর্গোদ্যানটাকে তুলে নিয়ে এসে এখানে বসিয়ে দিয়েছে।

কুলি যুবকের আচরণে ছােট লেড়কি রেগে একেবারে কাই হয়ে গেল। সে উন্মাদিনীর মত ছুটে গিয়ে তার চুল ধরে টানতে লাগল, দমাদ্দম কিল-চড়-ঘুষি মেরে আনন্দের ঘাটতিটুকু পূরণে প্রয়াসী হ’ল। তার নরম হাতের স্পর্শ কুলি যুবকটির মধ্যে ক্রোধের পরিবর্তে পুলকের সঞ্চারই করল।

এদিকে দীর্ঘ সময় ধরে কুলি যুবকের পৌরুষ দীপ্ত দেহের ছোঁয়া পেয়ে পেয়ে মেজো লেড়কিটার মধ্যে এক অনাস্বাদিত ভাবান্তর ঘটতে থাকে। সে নিজের দেহপল্লবটাকে তার কাধ থেকে নামিয়ে নিয়ে এসে প্রশস্ত বুকের সঙ্গে নিজেকে লেপ্টে দিল। গলাটা জড়িয়ে ধরে আবেগে উচ্ছ্বাসে অভিভূত হয়ে পড়ল। মাদকতায় পরিপূর্ণ চোখ দুটো মেলে অপলক দৃষ্টিতে তার ভরা যৌবনকে খেতে লাগল। তুলতুলে নরম ও রক্তাভ ওষ্ঠ দুটোকে এগিয়ে নিয়ে গে কুলি যুবকটার পৌরুভরা ওষ্ঠ দুটোর কাছে। কখন যে উভয়ের ওষ্ঠ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে তারা কেউ বুঝতেও পারেনি। কামােন্মাদনা বশত লেড়কিটা যুবকের নিচের ওটা কামড়ে ধরল। জোরে… আরও জোরে। দাঁত প্রেম বােঝে না, মায়াও নেই তার! দাঁতের কাজ দাঁতগুলাে করল। যুবকের নিচের ওষ্ঠটায় বসে গেল। তিরতির করে রক্ত বেরােতে লাগল। কিছুমাত্র হুশ কারো নেই। পুরুষের ওষ্ঠের রক্তের স্বাদ সে এই প্রথম পেল।

ও শক্তি প্রয়ােগ করে সাঁড়াশির মত আঁকড়ে ধরল যুবকটার নগ্ন ও প্রশস্ত বুকটাকে। একজন পুরুষ মানুষের শরীরে এত শান্তি-সুখ যে লুকিয়ে থাকতে পারে তা সে এর আগে কোনদিন বােঝে নি।

যুবকটার বুকের মধ্যে ইতিমধ্যে মহাসাগরের তুফান শুরু হয়ে গছে। সে তাকে আঁকড়ে থাকা মেজো লেড়কিটাকে নিয়ে মেঝেতে ধপাস করে বসে পড়ল। আর দেহটাকে নিচে শুইয়ে দিল। তার সদ্য উঁকি দেওয়া যৌবনের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে ইল। লেড়কিটার চোখের তারায় কাছে টানার ইঙ্গিত। ঠোটে দুষ্টুমি  হাসি। অসহ্য যন্ত্রণা। বুকের ভেতরে জ্বলন্ত আগুন। আর বাইরে পৃস্ট হবার দুরন্ত বাসনা। যুবকটা কখন কৃপা করবে সে প্রতীক্ষায় তার পক্ষে সাধ্যাতীত। অধৈর্য হাতটা দিয়ে তার পেশীবহুল হাতটাকে জড়িয়ে ধরল। অস্থিরভাবে নিজের বুকের ওপরে রাখল। দু’ হাতে জাপ্টে ধরে শরীরের সর্বশক্তি নিয়ােগ করে চাপ প্রয়ােগ করল। দলন-পেষণের জন্য সে একেবারে মাতােয়ারা।

উদ্যানের কেন্দ্রস্থলে এক মনােরম সরােবর। সাদা আর লাল পদ্মের বিচিত্র সমারােহ ঘটেছে সরােবরের পানিতে। ফুরফুরে হাওয়ার তালে তালে আনন্দে নেচে বেড়াচ্ছে তার স্বচ্ছ পানি। বড় লড়কিটা সরােবরের ধারে এসে দাঁড়াল। তার চোখের তারায় অবর্ণনীয় মাদকতা ভর করেছে। বাতাসে তিরতির করে দুলছে তার গায়ের ওড়নাটা। না, বৃথা কালক্ষয় করতে রাজি নয় সে। এক জটকায় গা থেকে ওড়নাটা খুলে নিয়ে ঘাসের ওপর ছুঁড়ে ফেলল। এবার খুব ব্যস্ত হাতে খুলে ফেলল কামিজের বােতাম ক’টা। শরীর থকে নামিয়ে ফেলল সেটাকে ভেতরের সরু একফালি অঙ্গবাস ঝাড়া আর কিছুই রইল না তার যৌবনভরা দেহপল্লবে। উন্মাদিনী প্রায় সে নেমে গেল জলে। অঞ্জলি ভরে জল নিল। যুবকটার গায়ে বার বার ছিটিয়ে দিতে লাগল। আর চোখের ভাষায় বলতে লাগল – ‘ ওগো, মনময়ুর, সরােবরের জল আমার কলিজার জ্বালা নিভাতে অক্ষম। এসাে, তুমি নেমে এসাে। একমাত্র তােমার উষ্ণবক্ষই আমার দেহ-মনের জ্বালা নেভাতে পারবে।

কিন্তু কে যাবে? কি করেই বা যাবে তার পিয়াস মেটাতে। যুবকটার দেহ-মন যে অসার হয়ে পড়েছে। ভেজা পােশাক পরিচ্ছদ পায়ে নিয়েই অলস-অবশ হয়ে সরােবরের তীরে সে পড়ে রয়েছে। মেহবুবার দিক থেকে কোন সাড়া না পেয়ে নগ্ন প্রায় বড় লড়কিটা জল থেকে উঠে এল। এক চিলতে কাপড় যা তার ভরা যৗবনকে কোনরকমে সামলে টামলে রেখেছিল, জলে ভিজে জাওয়ায় তা-ও যেন অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। তার উদ্ভিন্ন যৌবনচিহ্ন এখন স্পষ্টতর হয়ে চোখের সামনে ফুটে উঠেছে। সুন্দর বড় বড় স্তনদুটো বাধনমুক্ত হয়ে ফুটে উঠেছে।

জল থেকে উঠে এসেই বড় লেড়কিটা আছাড় খেয়ে পড়ে চৈতন্য প্রায় যুবকটার ওপর। মুহুর্তে যুবকটার মধ্যে সংজ্ঞতা ফিরে সে। সে তার সুদৃঢ় হাত দুটো বাড়িয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে কামােম্মাদিনী বড় লেড়কিটাকে। তার বক্ষের উষ্ণতা ভেজা নাপড়ের চিলতেটার শৈতাকে লােপ করে দিয়ে যুবকের প্রশস্ত বক্ষের আড়ালে ডুব দিল। যেন হারিয়ে যেতে, নিজেকে নিঃশেষে উজাড় করে দেওয়াতেই তার যত আনন্দ, যত সুখ। মেয়েটা যুবকের স্পশীবহুল হাতের পেষণে বার বার কুঁকিয়ে উঠতে থাকে। যুবকটিও তার স্তনদুটোকে দুহাতে চটকে, মুখ, নাভিস্থলর, বগল, ঘাড় সবজায়গায় চুমু চুষে একাকার করে দিতে লাগল। তবু তার বন্দন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে উৎসাহী নয় মােটেই। পুরুষের হাতের পেষণ, দলন তার নির্যাতনের মাধ্যমেই যৌবন – জ্বালা, বহের কামনা – বাসনা পরিতৃপ্তি লাভ করে। এক সময় বড় লেড়কিটার অবসন্ন দেহপল্লবটা যুবকের বুকের পর ঢলে পড়ে।

মেজো লেড়কি এবার নিজেকে বসনমুক্ত করে ঝাপিয়ে পড়ল সরােবরের জলে। কিছু সময় অস্থিরভাবে সাঁতার কাটল। তারপর ব্যস্ত-পায়ে উঠে এল জল থেকে। ঝাপিয়ে পড়ল কামােন্মাদনা লাঘবের উদ্দেশ্যে যুবকটার ওপর। যুবকের পুরুষাঙ্গটি নিয়ে কিছুক্ষন খেল করতেই সেটি আবার মাথা উচু করে তার অস্তিত্ত জানান দিল। আবার শুরু হ’ল দলন, পেষণ, চোষন, মাতন, সম্ভোগ।

এবার উঠে দাঁড়ালো ছোট ঝাঁপিয়ে পড়লো জলে। সাঁতারের নানা কায়দা জানে সে। কখনও ডুব দিয়ে হারিয়ে যায়। আবার কখনও চিৎ হয়ে জলের উপর ভাসতে থাকে। মনে হয় ওর শরীরের বুঝি বা কোন ওজন নাই। হালকা একটা শোলার, ভেলা। ফিকে নীল জলের ওপর ওর চাপার কলির মতো দেহটা আরও মনোহারিণী আরও রমণীয় মনে হয়। তার মরাল সদৃশ গ্ৰীবা, কুসুম পেলাব বাহু, আপেলের মতো স্তন, ক্ষীণ কটি ভারি নিতম্ব দিনে দিনে তাকে এক পূর্ণ নারী করে তুলেছে।

মেয়েটা উঠে আসে। লজাবনতা হয়ে ছেলেটার কাছে এসে দাঁড়ায়। শুয়ে শুয়ে সব দেখছিলো ছেলেটা। এবার দু-হাত বাড়িয়ে দেয়। সে ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারে না মেয়েটা।

এবার পুতুল খেলায় মেতে উঠে ছোট। ঘাসের ওপর এলিয়ে পড়ে থাকা যুবকটার ওপর ঝাপিয়ে পড়ল। শুরু হল পূর্বরীতি অনুসারে দাপাদাপি ঝাপাঝাপি। যদিও যুবকটি বড় দুই বোনকে সঙ্গসুখ দিয়ে ক্লান্ত কিন্তু ছোট বোনের সদ্য গজানো ডালিমের মত স্তনদুটো পেয়ে সে আবার জেগে উঠল। স্তনদুটোকে মুখে নিয়ে কিছুক্ষন চুষে, তার ঘাড়, কচি বগল, নাভী যোনি চুষে একাকার করে দিল। ছোট লেড়কিও সাড়া দিল আর যুবকের লিঙ্গটিকে মুখে নিয়ে চুষতে লাগল। এক সময় প্রবল একটা ঝাঁকানি দিয়ে কেঁপে ওঠে ছেলেটা। আর তৎক্ষণাৎ মেয়েটির সে কি অস্ফুট আর্তনাদ। আরও শক্ত করে জাপটে ধরলো ছেলেটাকে। উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে।

এভাবে দীর্ঘ সময় ধরে যুবকটার কাছ থেকে সঙ্গসুখ নিঙড়ে নিয়ে ঘাসের ওপর এলিয়ে পড়ল তার তাজা ফুলের মত দেহটা।

কুলি-যুবকটা কিছুক্ষণ পরিতৃপ্ত দেহ-মনে ঘাসের ওপর এলিয়ে পড়ে থাকার পর উঠে বসল। ধীর-পায়ে এগিয়ে গিয়ে নাম সরােবরে। দীর্ঘ সময় ধরে গােসল করে সাফসুতর হয়ে উঠে এল। বড় লেড়কির শিয়রে গিয়ে বসল। তার গায়ে, নরম তুলতুলে স্তনে হাত বুলাতে বুলাতে বলল – ‘সুন্দরী, তােমাকে ছেড়ে যাওয়া যে আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’

লেড়কিটা তার কোলের ওপর মাথা রেখে শুয়ে বল্ল “তুমি ছেড়ে যেতে চাইলে বা আমি ছাড়ব কেন? একবার যখন তােমাকে বুকে ঠাই দিয়েছি তখন আর তােমাকে ছাড়ব, ভাবছ কি করে মেহবুব আমার? বড়বোন বলে, অনেক রঙ্গ দেখালে বটে। কোন মায়ের দুধ খেয়েছিলে গো? এত তাগৎ পেলে কোথায়। বাব্বাঃ, শরীরটা আমার তুলোধোনা করে দিয়েছো।

ভাবাপুত মনে টুকরাে টুকরাে কথা বলতে বলতে তারা যে কখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল তা নিজেরাই জানে না। আর হবে -ই বা কেন? কয়েক ঘণ্টা ধরে দেহ ও মন উভয়ের ওপর দিয়ে যে কী ধকল গেছে তা আর কহতব্য নয়।

সন্ধ্যার কিছু পরে বড় লেড়কিটার ঘুম ভাঙল। অন্য সবাইকে ডাকাডাকি করে তুলল।

কুলি যুবকটা ঘুম থেকে উঠে বিদায় নেবার জন্য প্রস্তুতি নিল।

কিন্তু যেতে চাইলেই বা তাকে যেতে দেয় কে? তিন বােনই তার পথ আগলে দাঁড়াল। একটামাত্র রাত্রি তাদের সঙ্গদান করার জন্য বার বার মিনতি জানাল। তাদের অনুরােধ উপেক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব হ’ল না। বাধ্য হয়েই সেখানে তাকে রয়ে যেতে হল।

বড় লেড়কিটা কুলি যুবকটার হাত ধরে ভাবাপ্লুত কণ্ঠে বলল – নাগর আমার, চল তােমাকে একটা জিনিস দেখাব। দরজার পাল্লায় কি লেখা রয়েছে, দেখবে চল!

দরজার কাছাকাছি গিয়ে বড় লেড়কিটা দরজার পাল্লার গায়ের একটা লেখার দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করল। সেখানে লেখা রয়েছে।

– “তােমার কাছে সুখদায়ক কি বিষাদময় তা নিয়ে ভেবাে না। যা করার নির্দেশ দেবে তা-ই নির্বিবাদে পালন করনে। অন্যের ব্যাপার স্যাপার নিয়ে মােটেই মাথা ঘামাতে যেয়াে না।”

কুলি যুবকটা লেখাটা পড়ার পর বলল – ‘আমি এর আদেশ অমান্য করব না, কথা দিচ্ছি।

ইতিমধ্যেই প্রাসাদের বাইরের বাগানে পাখিদের কলরব শুরু হয়ে গেছে। বেগম শাহরাজাদ কিসসা বন্ধ করলেন।

দশম রাত্রি। বাদশাহ শরিয়ার-এর অনুরােধে বেগম শাহরাজাদ তার কিসসা শুরু করলেন – এদিকে রাত্রি গভীর হওয়ার আগেই মেয়ে তিনটা কুলি যুবকটাকে নিয়ে খানাপিনা করতে বসল। সবে তার খাবারের থালা কাছে টেনে নিয়েছে এমন সময় দরজার কড়া নড়ে উঠল।

বড় লেড়কিটা উঠে দরজা খুলে দিল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে হাসি হাসি মুখে ফিরে এসে বল্ল – আজ যে কার মুখ দেখে সকাল হয়েছিল তাই ভাবছি। তিনজন বিদেশী আমাদের বাড়িতে থাকতে চাইছে। কারাে মুখেই দাড়ি-গোঁফ দেখলাম না; আর সবারই বা চোখ কানা। আর তাতে কলুর বলদের মত তুলি বাঁধা। রোমদেশের অধিবাসী বলেই মনে হল। ভালই হল। তারা থাকলে সারা রাত্রি ধরে আনন্দে দেহ-সুখ মিটিয়ে নেওয়া যাবে।

তার মুখের কথা শেষ হবার আগেই ছােট লেড়কিটা এক দৌড়ে গিয়ে আগন্তুকদের ভেতরে নিয়ে এল।

আগন্তুকরা ভেতরে ঢুকে যুবকটার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে তাকে ভাল করে দেখে নিল। তারপর নিজেদের মধ্যে অনুস্ট কণ্ঠে বলাবলি করল—এ-যুবকটাও বােধ হয় আমাদের মতই কালান্দার ফকির। এখানে আশ্রয় নিয়েছে।

এবার প্রচুর খানা আর কয়েক বােতল মদ দিয়ে তিন বহিন কালান্দার ফকিরদের আপ্যায়ন করল।

খানাপিনা সারার পর তিন বাহিন কালান্দারদের গান শােনাবার জন্য বায়না ধরল। কালান্দারা গাইবার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগল। এমন সময় আবার দরায় কড়া নড়ে উঠল।

খলিফা হারুন-অল রসিদ নগর পরিক্রমায় বেরিয়েছেন। প্রতিরাত্রেই এরকম বেরােন। তবে এক একদিন এক এক অঞ্চলে যান। আজকে এদিকে পালা। খলিফা একা নন। তাকে সঙ্গদান করেন উজির, জাফর-অল-বারমাকি, আর যুবক তরবারি বাহক। মাসরুর। প্রজাদের সুখ-সুবিধা, অসুবিধা-সমস্যা প্রভৃতি সচক্ষে প্রত্যক্ষ করার জন্যই তার এরকম মহৎ প্রয়াস। এ-পথ দিয়ে যাবার সময় বাড়িটার ভেতর থেকে গান-বাজনার শব্দ শুনে ব্যাপার কি দেখার জন্য তার কৌতুহল হল। উজির জাফর-অল-বারমাকিকে বললেন—বাড়ির ভেতরে ঢােকার ব্যবস্থা কর। তবে আমার পরিচয় যেন বুঝতে না পারে।

উজির জাফর-অলবারমাকি এগিয়ে গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লেন। ছােট লেড়কি দরজা খুলে দিল। উজির বললেন-বাছা, আমরা তিবারিয়া দেশের সওদাগর। স্থানীয় এক সওদাগরের বাড়িতে উঠেছি। সামান্য লটবহর যা ছিল সব তার বাড়িতে গচ্ছিত রেখে নগরটা ঘুরে দেখার জন্য বেরিয়েছিলাম। এখন অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলেছি। বাড়িটা ঠিক চিনতে পারছিনা। আজকের রাত্রিটা তোমােদের এখানে আশ্রয় দিলে বড়ই উপকার হয়। খােদা তোমােদের ভালই করবেন।

তাদের দাঁড় করিয়ে রেখে ছােট লেড়কিটা ভেতরে গিয়ে বোনদের সঙ্গে পরামর্শ করে ফিরে এল। আশ্রয় প্রার্থীদের অভ্যর্থনা করে ভেতরে নিয়ে গেল।

তারা ভেতরে যেতেই বড় লেড়কিটা দরজায় লেখাটা তাদের পড়তে বল। পড়া শেষ হলে তারা বললেন—হ্যা, আমরা এ নির্দেশ মেনে নিতে রাজি আছি।

এবার তাদের নিয়ে গিয়ে কালান্দারদের পাশে বসতে দিল। খলিফা ও তার সঙ্গীদের জন্য খানা আর দামী সরাব নিয়ে এল। খফিফা বললেন—বাছা, আমি যে হজযাত্রী। এসব স্পর্শ করি না। এবার তারা তার জন্য গােলাপ পানির সরবৎ বানিয়ে অনল।

খলিফা দেখলেন কালান্দারদের প্রত্যেকেরই বাঁ-চোখ কানা। এবার বড় লেড়কিটা কুলি যুবকটাকে নিয়ে পাশের ঘরে গেল। টা নিকষ কালাে কুকুরকে শেকলে বেঁধে নিয়ে এল। দুটোই মাদি কুকুর। এবার কুলি যুবকটাকে একটা চাবুক ধরিয়ে দিয়ে বলল —‘চালাও চাবুক। এ মাদিটাকে কয়েক ঘা বেশী দেবে। শুরু হ’ল সপাং সপাং চাবুকের ঘা। মাদি কুকুরটা অসহ্য যন্ত্রণায় কেঁই সেই শুরু করে দিল। এবার তাকে কুলি যুবকটার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এসে দ্বিতীয় কুকুরটাকে চাবুক মারতে বলল। কুলি যুবকটা  নিষ্ঠুর ভাবে চাবুক চালাতে লাগল। তারপর তাকে ছিনিয়ে নিয়ে আবার প্রথম কুকরটাকে এগিয়ে দিল। এভাবে পালা করে চাবুকের ঘা মারার ব্যবস্থা করা হল।

খলিফা এবার সবিস্ময়ে প্রায় ফিসফিসিয়ে উজির জাফরকে বললেন- ‘লেড়কিটাকে জিজ্ঞেস করে দেখ তাে কুকুর দুটোর ব্যাপার কি?’

উজির বললেন—“জাহাপনা, এ ব্যাপারে কৌতূহল প্রকাশ না করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

মেজো বহিন এবার ছােট বহিনের হাত ধরে বলল—“চল, আমরা প্রতি রাত্রের মত প্রচলিত প্রথা অনুসারে যা-যা করা দরকার, সব করি।’

ছােট লেড়কিটা একটু বটুয়া নিয়ে এল। তার ভেতর থেকে একটা বাঁশি বের করল। সুর করে বাজাতে শুরু করল।

কিছুক্ষণ বাজাবার পর মেজো বহিনটা প্রায় আর্তনাদ করে উঠল– থামাে থামাে বহিন খােদাতালা তােমাকে কঠোর শাস্তি দিবেন।

এক সময় সে উম্মাদের মত নিজের পোশাক আশাক ছিড়ে টুকরাে টুকরাে করে ফেলল। সংজ্ঞা হারিয়ে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। এ লেড়কি তিনটার ব্যাপার দেখে খালিফা হারুণ-অল-রসিদ-এর মন কেঁদে উঠল।

এবার বড় লেড়কিটা তার চোখে-মুখে জলের ছিটা দিয়ে সংজ্ঞা ফিরিয়ে আনল। নতুন পােশাক পরিয়ে দিল। খালিফা হারুণ-অল-রসিদ আবার উজির জাফর-এর কানের কাছে মুখ নিয়ে আগের মতই ফিসফিসিয়ে বললেন–‘লেড়কির সারা গায়ে চাবুকের দাগ। কেমন কালসিটে পড়ে গেছে লক্ষ্য কয়েছ?’

উজির জাফর বললেন-“জাহাপনা, মুখ বুজে সবকিছু দেখে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

খালিফা হারুণ-অল-রসিদ এবার বললেন—“তা না হয় হ’ল। কিন্তু মাদি কুকুর দুটোকে চাবুক মারা আর তার পিঠের কালাে দাগগুলাে আমার মনে বিস্ময়ের উদ্রেক করছে। রহস্য! গভীর রহস্য! এর রহস্যভেদ আমাকে করতেই হবে।

– ‘জাহাপনা, দরজার ওই শপথ বাক্যের কথা ভুলে যাবেন না। কোন কিছু জিগ্গাসাবাদ করার অর্থ হচ্ছে শর্ত লঙ্ঘন করা।

এবার মেজো লেড়কিটা ওই বাঁশিটা বাজাতে আরম্ভ করল। সেই করুণ-মর্মান্তিক সুর। পূর্ব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। সে তার পােশাক আশাক ছিড়ে টুকরাে টুকরাে করে ফেল। ব্যস, সংজ্ঞা হারিয়ে ফেল্ল। সারা গায়ের চাবুকের দাগ খলিফা হারুণ-অল রসিদ-এর চোখের সামনে ভেসে উঠল। বড় মেয়েটা আবার পূর্ব কৌশলে তার চোখে-মুখে জলের ছিটা দিল। সে সংজ্ঞা ফিরে পেল।

একই পদ্ধতি অনুসরণ করে তিন তিনবার সে-ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটান হল।

খালিফা হারুণ-অল-রসিদ আর কৌতূহল দমন করতে পারলেন না। তিনি আগের মতই অনুচ্চ কণ্ঠে কালান্দারদের বললেন-মশাইরা, রহস্যটা কি বলতে পারেন?

-আমরা তাে আরও ভাবছিলাম, আপনাকে পুছতাহ করব।

-“তাই বলুন, আমাদের মত আপনারাও এখানে প্রথম এসেছেন?

—“আমার মনে হয়, ওই যুবকটা কিছু জানলেও জানতে পারে।

তাদের কথােপকথন কুলি যুবকটা শুনতে পেল। কিন্তু জিজ্ঞাস করার আগেই সেবলে উঠল–আমিও আপনাদেরই মত এখানে প্রথম এসেছি আপনারা এসেছেন রাত্রে আর আমি এসেছি দুপুরের কিছু পরে। ব্যস, এটুকুই যা তফাৎ। এর চেয়ে বরং পথের ধারে শুয়ে রাত্রি কাটনাে অনেক ভাল ছিল মশাই। তারা সাতজন একমত হলেন। ব্যাপারটা নিয়ে ভাবা দরকার জানা দরকার আসল রহস্যটা কি। তারা সংখ্যায় সাতজন পুরুষ মানুষ। আর তারা মাত্র তিনজন। তা-ও আবার মেয়েছেলে। এত ভয়ের কি আছে? তাদের কাছে কৈফিয়ৎ চাইতেই হবে। আর দরজার গায়ে লেখা শর্ত?

কালান্দারদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠল—আমরা শর্ত পালন না করলে লেড়কি তিনটাকে অপমান করা হবে না তো আবার? তার চেয়ে বরং অবশিষ্ট রাত্রিটুকু কোনরকমে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে সুবহ হতে না হতেই আমরা যে যার পথে চলে যাব।’

এবার উজির জাফর বলেন-“ঘণ্টা খানেক বাদে আমরা এখান থেকে কেটে পড়ব। আর আপনার কাছে অন্ততঃ ব্যাপারটা অজ্ঞাত থাকবে না। আজ না হয় কাল জানতে পারবেনই।

—“আমার পক্ষে এত সময় অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। সবাই উসখুস করছে ব্যাপারটা জানার জন্য সমস্যা দেখা দিল পুছতাছ করবে কে? অনেক কথার পর ঠিক হ’ল কুলি যুবকটাই তাদের কাছে এর কারণ জানতে চাইবে।

কুলি যুবকটা বার কয়েক ঢােক গিলে বল—“তােমাদের কুকুর দুটোর ব্যাপার কি, আমরা জানতে চাইছি। কেন তাদের এররকম নিমর্মভাবে চাবুক মারলে? কেনইবা আবার তাদের আদর করলে, তােমাদের শরীরে চাবুকের কালসিটে পড়া দাগ কি করে হ’ল ?

‘এটা কি তােমার একার, নাকি সবারই কৌতূহল?’

‘একমাত্র জাফর ছাড়া আমরা সবাই ব্যাপারটা নিয়ে বড় ভাবিত।

—তােমরা শর্ত ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত। আতিথ্য গ্রহণের আগে দরজার লেখা পড়ে শর্ত করেছিলে। তােমাদের শর্তভঙ্গের শাস্তি পেতেই হবে। কথা বলতে বলতে বড় লেড়কিটি হাতের চাবুকটা দিয়ে তিনবার মেঝেতে আঘাত করা মাত্র সাতজন গাট্টাগােট্টা দৈত্যের মত বিশালদেহী নিগ্রো ঘরে ঢুকল। ক্রোধে তর্জন গর্জন শুরু করে দিল। সবার হাতেই চকচকে তরবারি।

বড় লেড়কি হুকুম দিল—এদের একটার সঙ্গে আর একটা পিঠমােড়া করে বাঁধ। চোখের পলকে নিগ্রো দৈত্যগুলাে হুকুম তামিল করল।

কুলি যুবকটা কেঁদে কেটে বলল –“আমায় তােমরা কোতল করাে না। সর্বনাশের মূল এই চোখওয়লা কালান্দার ফকিরগুলাে। তারা এখানে না থাকলে এসব কিছুই ঘটত না।”

বড় লেড়কিটা হাে হাে করে হাসতে শুরু করল।

বেগম শাহরাজাদ জানলা দিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ। করতেই বুঝতে পারল ভোেরর আলাে ফুটতে আর দেরী নেই। সে কিসসা বন্ধ করল। বাদশাহ শারিয়ার বেগমের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন।

একাদশ রাত্রি বাদশাহ শারিয়ার যথাসময়ে বেগম শাহরাজাদ -এর ঘরে ছোটোবােনের আগ্রহে বেগম শাহরাজাদ কিসসা শুরু করলেন—“শুনুন জাহাপনা! বড় বােন সরবে হেসে উঠলে সবাই ভয়ে জড়ােসড়াে হয়ে উঠল। সবার মনেই এক ভাবনা, কি হয়—কি হয়। হাসি থামিয়ে সে বলল-“তােমাদের অসহায় অবস্থার কথা ভেবে রাত্রিবাসের জন্য আশ্রয় দিয়েছিলাম। যাকগে। এবার তােমরা সবাই এক এক করে আত্মপরিচয় দাও। তােমাদের কথায় যদি বুঝি তােমরা সত্যই বিপদে পড়ে আশ্রয় ভিক্ষা করনি তবে তােমাদের মৃত্যু অবধারিত।

বড় মেয়েটা এবার কালান্দার ফকির তিন জনকে লক্ষ্য করে বলল বল তাে, তােমরা কি সহােদর ভাই?

–না মালকিন। আমরা তিনজন তিন দেশের বাসিন্দা। আমরা সর্বত্যাগী। বিষয় সম্পত্তি বলতে কিছুই নেই। কোনরকমে জানটাকে টিকিয়ে রেখেছি।’

-“তােমরা কি জন্ম থেকে কানা? নাকি পরবর্তীকালে একটা করে চোখ—

তার মুখের কথা শেষ হবার আগেই একজন কালান্দার বলে উঠল—না। আমি কানা হয়ে জন্মাই নি। জন্মের পর এক অবিশ্বাস্য কাণ্ডের ফলে চোখটাকে হারাতে হয়েছে। বাকি দু’জনও একই কথা বলল। তাদের জীবনও বৈচিত্র্যময় ঘটনায় ভরপুর।

বড় লেড়কিটা এবার আগ্রহান্বিত হয়ে বলল—“তােমাদের জীবনের বিচিত্র ঘটনাগুলাে আমি শুনতে আগ্রহী, তােমরা এক এক করে তােমাদের জীবনকাহিনী আমাকে শােনাও। তােমাদের কথা শুনে আমি যদি বুঝি তােমরা সত্যই দয়া পাওয়ার যােগ্য তবে মুক্তি দিয় দেব। অন্যথায়—’

কুলি যুবকটা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠল—“আমি সত্যই গরিব, দীন দুঃখী কিনা তা-তাে তােমাদের অজানা নয়। আমার জীবনের অত্যাশ্চর্য ঘটনা বলতে যা কিছু সবই আজ দিনের বেলােতেই ঘটেছে। তা-তাে তােমরা ভালই জান। আর সে কথা শজনের সামনে, এরকম ভরাহাটে বলা সমীচীনও নয়। তাই বলছি কি, আমাকে ছেড়ে দাও।

‘ভাল কথা, তুমি এখনকার মত রেহাই পেলে, তােমার কথা পরেই না হয় শুনব। যাও, বিশ্রাম করগে।”

—না, আমি এ জায়গা ছেড়ে যাব না। অবশ্যই না, এদের কাহিনী শুনব।

Leave a Reply