এরপর শাহরাজাদ বলে, এবার আপনাকে আলী-ইবন বকর ও সুন্দরী সামস আল-নাহারের কাহিনী শোনাবো :
খলিফা হারুন-অল-রাসিদের সময়ে বাগদাদ শহরে আবু অল হাসান নামে এক সম্ভ্রান্ত সওদাগর বাস করতো। তার দোকানে সুলতান বাদশাহদের উপযোগী বাহারী বাহারী মহামূল্যবান সাজপোশাক পাওয়া যেত। আমির বাদশাহরাই তার খদ্দের। অতো দামের সাজ-পোশাক সাধারণ মানুষ ব্যবহার করবে কি করে?
হারেমের খোজারা তার দোকান ছাড়া অন্য কোথাও যেত না। আর শুধু সাজপোশাকই তো নয়, লক্ষ লক্ষ দিনারের হিরে জহরতের জড়োয়া গহনারও সেই একমাত্র বিক্রেতা। অন্য সব দোকান ছেড়ে খোজারা তার দোকানেই ভিড় করতো তার অন্য কারণও ছিলো। প্রথমত দোকানে এলেই খুব খাতির যত্ন পেত। শরবৎ মিঠাই পান তো মিলতোই তাছাড়া পেত। মোটা দালালী। যত সওদা প্রাসাদে যেত তার দামের ওপর হিসেব করে দালালী পেত তারা। এছাড়া তার নম্র ব্যবহারেও সবাই প্রীত ছিলো। স্বয়ং সুলতান হারুন-অল-রসিদও তার দোকানে পায়ের ধুলো দিতেন! আবুল হাসানের অমায়িক ব্যবহার এবং তার প্রিয়দর্শন চেহারা তাকে আকৃষ্ট করেছিলো। খলিফা কোন উৎসবে অনুষ্ঠানে আবুল হাসানকে বাদ দিতেন না। প্রাসাদে তার অবাধ গতিবিধি ছিলো। যখন খুশি সে খলিফার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতে পারতো। খলিফা নিজেই সে অধিকার তাকে দিয়েছিলো।
তরুণ আবুল হাসানের দোকানে বাগদাদের সম্ভ্রান্ত তরুণ-তরুণীদেরও খুব ভিড় জমতো। যত আমির ওমরাহ—তাদের বাড়ির ছেলে-মেয়ে-বিবিরা কেনাকাটা করতে আসতো। পারস্যের এক সুলতানের পুত্র ছিলো তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার নাম আলী ইবন বকর। সেও তার দোকানে প্রায়ই আসতো।
একদিন এই শাহজাদা তার দোকানে বসে আবুল হাসানের সঙ্গে গল্পগুজব করছে এমন সময় জনা দশেক সুবেশা সুন্দরী মেয়ে এসে দোকানের সামনে দীড়ালো। তাদের সঙ্গে আর একজন মেয়ে। সে ছিলো একটা দামী খচ্চরের পিঠে। তার বাহারী সাজ-পোশাকে চোখ ঝলসে যায়।
পড়ে। এমন পরমাসুন্দরী মেয়ে বড় একটা দেখা যায় না। টানাটানা চোখ, উন্নত নাক, আবির রাঙা গাল, পাকা আঙুরের মতো ঠোঁট-বেহেস্তের হুরীর কথা মনে করিয়ে দেয়। খচ্চরের পিঠ থেকে নেমে সে দোকানে ঢোকে। আবুল হাসান দু’হাত জোড় করে সাদর অভ্যর্থনা জানায়, আমার কি সৌভাগ্য আপনার পায়ের ধুলো পড়লো—
একটা মখমলের গদি দেখিয়ে বসতে অনুরোধ করে। আবুল হাসান গাদা গাদা সাজ-পোশাক বের করে দেখায়। কোনটা বা সে হাতে ধরে দেখে, কোনটা বা সে হাতেই ধরে না। কয়েকটা সোনার জরি দেওয়া কাপড় ও কিছু মূল্যবান জড়োয়া গহনা পছন্দ করে। পছন্দ করতে করতে কখন সে মুখের নাকাব সরিয়ে ফেলেছে নিজেই বুঝতে পারেনি। সওদাগর আবুল তার অনেকদিনের চেনা লোক—তার সামনে অতটা লজ্জা শরমের কিছু নাই। কিন্তু দোকানে তো বাইরের মানুষও বসেছিলো।
তার রূপের জেল্লা আলী-ইবন বকর-এর বুকে আগুন ধরিয়ে দেয়। এমন অপরূপ সুন্দরী মেয়ে সে জীবনে কখনও দেখেনি। আলী ইবন আর স্থির থাকতে পারে না। মাথাটা ঝিমাঝিম করে ওঠে, বুকের ভেতর মোচড় দিতে থাকে। ভাবে, এখান থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে পারলে ভালো হয়। এত রূপ আর সহ্য করা যায় না। আলী ইবনের এই অস্থিরতা মেয়েটির চোখ এড়ায় না। ইতিমধ্যেই আড় চোখে কয়েকবার সে তাকে দেখে নিয়েছে। ঠোঁটের কোণে একটু মুচকি হেসে বলে, আমার জন্যে আপনার দোকানের খদের চলে যাবে সে তো হয় না। বরং আমিই চলে যাচ্ছি। আমার অনুরোধ উনি থাকুন।
আলী ইবন বকর আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, খোদা কসম বলছি, সুন্দরী, আমি যে আপনার ভয়ে দোকান ছেড়ে চলে যেতে চাইছিলাম তা কিন্তু ঠিক না। আপনাকে দেখা অবধি আমি এক অসহ্য যন্ত্রণা পাচ্ছি।–জনি না, বলতে পারবো না, কিসের সে যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণার হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্যেই আমি চলে যেতে চেয়েছিলাম।
অদ্ভুত সুন্দর করে কথা বলে আলী ইবন। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে মেয়েটি। মনের সঙ্গোপনে কিসের যেন অনুরণন হতে থাকে। খাটো গলায় সওদাগরকে প্রশ্ন করে, কে এই মেহেমান?
আবুল হাসান বলে, ওর নাম আলী ইবন বকর। প্রাচীন পারস্য শাহদের বংশধর, যেমন দেখতে সুঠাম সুপুরুষ-ভেতরটাও তেমনি খাসা। মেয়েটি বলে, ভারি খুবসুরৎ দেখতে তো!
—হবে না? কত বড় খানদানী শাহ বংশের ছেলে। শরীরের শিরায় বইছে সাচ্চ নীল রক্ত।
মেয়েটি বলে, আমি যদি আমার একটি খোজাকে পাঠাই, আপনারা কি একবার তার সঙ্গে যেতে পারবেন? অবশ্য আপত্তি থাকলে-আমি শুধু আপনার দোস্তকে একবার দেখাতে চাই, বাগদাদ সুলতানের প্রাসাদে রূপে গুণে যে-সব রত্ন মেয়েছেলে আছে তা পারস্য-সুলতানের হারেমের চেয়ে কিছু খাটো নয়।
আবুল হাসান বুদ্ধিমান ছেলে। তার কথার নিগুঢ় অর্থ বুঝতে কিছু অসুবিধে হলো না। মাথা নত করে অভিবাদন জানিয়ে বললো, আপনার আদেশ শিরোধার্য করলাম। যথাসময়ে বান্দারা হাজির হবে।
মেয়েটি আর তিলমাত্র অপেক্ষা করলো না। নাকাবে মুখ ঢেকে দ্রুত বেরিয়ে গেলো।
আবুল হাসান এবার আলী ইবনের কাঁধে একটা চাপড় মেরে বললো, কি দোস্ত, আমন মন-মরা হয়ে বসে রয়েছ। কেন?
—চোখের সামনে দিয়ে আসমানের চাঁদ চলে গেলো, আমি কি খুশিতে ডগমগ হবো। আবুল হাসান বলে, চলে আর একেবারে গেলো কোথায়। সবে তো তোমার গগনে উদয় হবে বলে উকি ঝুকি দিচ্ছে।
–ঠাট্টা রাখো। আমার দিল পুড়ে যাচ্ছে। কেন যে মরতে তোমার দোকানে আজ এসেছিলাম।
আবুল ওর চিবুকটা নেড়ে দিয়ে চোখের মণি নাচিয়ে বলে, আহা, সোনার চাঁদ, না এলে এমন চাঁদমুখের দেখা পেতে?
—কিন্তু ‘ওতো জালিয়ে আগুন পালিয়ে গেলো, এ জালা তো সয়না প্ৰাণে।’
—ধৈৰ্য্য ধরো বন্ধু, ধৈৰ্য্য ধরো। আপসে সব ঠিক হয়ে যাবে। আলী ইবন রাগত ভাবে বলে, সব সময় রসিকতা ভালো লাগে না হাসান। বলো, মহিলাটি কে?
—উনি খলিফা হারুন-অল রসিদের প্রিয় প্রিয়তমা। খাস বেগমের চাইতেও কদরের বাদী সামস আল-নাহার। খলিফা এর জন্যে আলাদা প্রাসাদ বানিয়ে দিয়েছেন। এর দাস-দাসী নফর-চাকর সব আলাদা। খলিফা একমাত্র তাকেই ভীষণ বিশ্বাস করে। যে কারণে তার প্রহরায় কোনও খোজাকে রাখা হয়নি। সত্যি কথা বলতে কি হারেমের কড়া পাহারার মধ্যেও বেগমরা পরপুরুষের প্রেমে আসক্ত হয়। অন্যের ঔরসের সন্তান গর্ভে ধারণ করে। সেদিক থেকে সামস-আল-নাহার ভালো! এ পর্যন্ত তার নামে, যদিও তার মতো রূপসী সারা বাগদাদে দুটি নাই, তেমন কোনও কেচ্ছা রটেনি!
এইসব কথাবার্তা চলছে এমন সময় একটি ছোট্ট চাকর এসে আবুল হাসানের কানের কাছে ফিস ফিস করে বললো, আপনাদের দুজনকে, মালকিন যেতে বলেছেন।
আবুল দোকান বন্ধ করে বন্ধু আলীকে সঙ্গে নিয়ে সামস-আল-নাহার-এর প্রাসাদের দিকে রওনা হলো। আগে আগে পথ দেখিয়ে চলতে থাকলো সেই ছোট্ট চাকরিটা।
আলী ভেবেছিলো সে কিছু সুন্দর সুন্দর কবিতা শুনিয়ে সামস-আল-নাহারকে তাক লাগিয়ে দেবে। কিন্তু সে সুযোগ সে পেলো না। বসতে না বসতেই খানসামারা নানা রকম খানাপিনা এনে টেবিলে সাজিয়ে দিলো। খাবারের সুগন্ধে সারা ঘর আমোদিত হয়ে ওঠে। দুজনে তৃপ্তি করে খানাপিনা করলো। সামস-আল-নাহার নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সব তদারক করতে থাকলো। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে নিজে হাতে সে গোলাপ জল ঢেলে দিল ওদের দুজনের হাতে। দামী আদর ছড়িয়ে দিল ওদের সাজ পোশাকে।
এরপর সামস-আল-নাহার একটা দরজা খুলে ওদের ভিতরের আর একটা মহলে নিয়ে গেলো। বিরাট সেই কক্ষটার চারপাশে চব্বিশটি স্ফটিকের স্তম্ভ। তারা মাথায় ধরে আছে একটা বিশাল গম্বুজ। সেই গম্বুজের চারপাশ সোনার তৈরি পাখি দিয়ে সাজানো। আর গম্বুজের ভিতরটা সূক্ষ্ম শিল্পীর হাতে আঁকা নানাপ্রকার লতাপাতার নক্সা। দেখলে চোখ ফেরানো দায়। সারা মেজোটা পারস্য গালিচায় মোড়া।
এই সুদৃশ্য মহলে দাঁড়িয়ে বাইরে যেদিকে তাকাও ফুলের সমারোহ। চারপাশে ফুলের বাগিচা; শুধু ফুল আর ফুল। চেনা অচেনা হরেক রকম দেশ বিদেশের বাহারী ফুলে ফুলে ভরা।
আবুল আর আলী যখন এইসব অপরূপ সৌন্দৰ্য্যের সমুদ্রে নিজেদের হারিয়ে ফেলেছে সেই সময় দশটি সুদৰ্শন সুবেশ মেয়ে এসে বৃত্তাকারে ছড়িয়ে বসে পড়লো সেখানে। তাদের সবারই টানাটানা চোখ, টুকটুকে রাঙা গাল আর সুগঠিত বুক।
সেই দশটি মেয়ের প্রত্যেকের হাতে একটি করে তারের বাদ্যযন্ত্র। মেয়েরা বাজাতে শুরু করে আর নাহার গান ধরে। সে কি করুণ সুর। আলীর মনে হতে লাগলো। সে যেন কাঁদছে। অথচ সত্যিই সে কাঁদছে না। তার গানের করুণ সুর কান্না অশ্রু হয়ে গলে গলে পড়ছে। আলী বলে, আবুল, এ গান আমি আর সইতে পারছি না, দোস্ত। এমন ব্যথাও কি মানুষ মানুষকে দিতে পারে।
সামস-অল-নাহার গান থামালে মেয়েরা সমবেত কণ্ঠে গান ধরে। আজকের আসরের প্রধান অতিথি আলী ইবন বকর। তাই সবারই লক্ষ্য তার দিকে। তাকে ঘিরেই মেয়েরা নেচে নোচে গান করতে থাকে।
প্ৰায় গোটা দশ-বারো নিগ্রো ক্রীতদাসী কাঁধে করে বয়ে নিয়ে আসে একটা রূপের সিংহাসন। তার উপরে উপবিষ্ট বোরখা ঢাকা এক সুন্দরী। নিগ্রো মেয়েগুলোর বুক অনাবৃত। পরণে সংক্ষিপ্ত সাজ। সোনার সুতোয় বোনা জালি পায়জামা পরণের একমাত্র বাস। সিংহাসনটা ঘরের ঠিক মাঝখানে নামিয়ে দিয়ে তারা সকলে বাগিচায় গিয়ে দাঁড়ায়।
কাচের মতো প্রায়-স্বচ্ছ নাকাবের মধ্য দিয়ে সামস-আল-নাহারের রূপের জৌলুস পুরোপুরিই নজরে পড়ে। নাহার স্মিত হেসে আলীকে স্বাগত জানায়। আলীও মাথা আনত করে জবাব দেয়।
গানের সুরে মন ভরে ওঠে। প্রাসাদের প্রতিটি প্রান্ত। নেচে ওঠে ফুলের বনের নাম-না-জানা পাখি। নেচে ওঠে। আলী ইবন বকর-এর হৃদয়। একটা পর একটা গান চলতেই থাকে। অনেক অনেকক্ষণ ধরে চলে। তারপর একসময় গান থেমে যায়। কিন্তু সুর তখনও অনুরণন তুলে হৃদয়ে হৃদয়ে ফেরে। আলী মুগ্ধ হয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। অন্তরের অন্তস্থলে অনুভব করতে থাকে গানের মাধুরী।
আবুল হাসান ঠেলা মারে, এই—কি হলো?
—না কিছু হয়নি তো এমনিই।
–কী ভালো লাগছে না? আলী কি করে আবুলকে বোঝায়, এমন ভালো লাগা বহুকাল তার লাগেনি। —আমার সমস্ত মন প্ৰাণ ভরে গেছে আবুল।
—হুম তবে যে বলেছিলে তখন, আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলে। জীবনটা তোমার বরবাদ হয়ে গেলো।
—না ভাই সত্যি বুঝতে পারি ওই নাকাবের আড়ালে এক ভেন্ধী আছে? সত্যি যাদু জানে ও। আমার সমস্ত মন প্ৰাণ প্রথম দর্শনেই নিমেষে কেড়ে নিয়েছে সে। জানি না এরপর কি আছে আমার নসিবে।
আবার গান শুরু হলো। এবারের গায়িকা আবার সেই নাহার। সেই করুণ সুরের মুচ্ছনা। এত বিরহ ব্যথার গান সে কেন গায়? কেমন করে গায়।
সামস-আল-নাহারের দু’গাল বেয়ে নেমে আসে অশ্রুধারাণ। সে দৃশ্য দেখে আলী আর স্থির থাকতে পারে না। সে-ও কেঁদে আকুল হয়।
সামস-আল-নাহার উঠে দাঁড়ায়। ধীরপায়ে এগিয়ে যেতে থাকে সে দরজার দিকে। এবার সে বিদায় নেবে। আলী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। সে-ও উঠে দাঁড়ায়। ছুটে যায় দরজার দিকে। পর্দার ওপারে গিয়ে নাহারের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নাহার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। আলীর বুকে মাথা গুজে দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই সে আচমকা আলী ইবন এর বুকের ওপরে পড়ে গেল। হাত দুটো দিয়ে জড়িয়ে ধরল তার যৌবন ও পৌরুষভরা শরীরটিকে। ক্রমে তার হাত দুটো সুদৃঢ় হয়ে আসতে লাগল। দৃঢ়…. আরও….আরও দৃঢ়ভাবে জাপটে ধরল তাকে। নিটোল স্তন দুটোকে তার প্রশস্ত বুকের চাপে দলিত পিষ্ট করে ফেলতে চাইছে। তার দেহে যেন দৈত্যের শক্তি ভর করেছে। যৌবনজ্বালা তাে এমন করে আগে কোনদিন তাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দেয় নি। ইতিপূর্বে প্রৌঢ় খলিফাকে বহুবার দেহদান করেছে বটে কিন্তু আজকের মত দিল দরিয়া হয়ে নিজেকে পুরােপুরি বিলিয়ে দিতে পারে নি। কিন্তু আজ-এ নওজোয়ান আলী ইবনকে দি নিঃশেষে উজাড় করে দেওয়ার জন্য যেন সে উন্মাদিনীর প্রায় হয়ে উঠেছে।
আলী তাকে আদর করে। কিন্তু নাহারের দেহ অবশ্য অচৈতন্য হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে যায়। মেয়েরা ধরাধরি করে তাকে তুলে এনে একটা সোফায় শুইয়ে দেয়। একজন ঝারি করে গোলাপ জল এনে চোখে মুখে ঝাপটা মারতে থাকে। একটু পরে সামস-আল নাহার চোখ মেলে তাকায়। একজন একটা উগ্র আতরের নির্যাস। এনে ওর নাকের কাছে ধরে। ঝাঁঝালো গন্ধে তন্দ্রাভাব কেটে যায় তার।
সামস-আল-নাহার চোখ মেলে এদিক ওদিক তাকায়। কি যেন খুঁজতে থাকে। এক পাশে আলীকে দেখে স্মিত হাসে। সে হাসি বড় করুণ, বড় মধুর। আলী আরও কাছে সরে আসে। নাহার জিজ্ঞেস করে, আবুল হাসান কোথায়? তাকে দেখছি না কেন?
আবুল হাসান তখন ঘরের বাইরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার মনে এক অজানা আশঙ্কা। একটু আগে যা ঘটে গেছে এতক্ষণে সারা প্রাসাদের প্রতি মানুষ তা নিশ্চয়ই জেনেছে। আলী এসে বললো, তোমাকে খুঁজছে।
তােমাকে সামান্য মৌখিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আর শুকনো ধন্যবাদ জানিয়ে খাটোও করবো না তোমাকে। তবে একটি কথা জেনে রাখো, আজ তোমার জন্যেই আমার জীবনের মোড় ঘুরে গেলো। আমি আজ নতুন জীবনের সন্ধান পেয়েছি। যাইহোক, আমি অকৃতজ্ঞ নই, আবুল হাসান। তোমার কথা আমার মনে থাকবে।
আবুল হাসান নিজেকে ধন্য মনে করে। নাহারকে অন্তরের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলে, আপনি যে আমাকে মনে রাখবেন তা শুনেই আমি ধন্য হলাম।
সামস-অল-নাহার আলীর দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হাসে, তোমার ভালোবাসা নিখাদ, আমি আমার অন্তর দিয়ে বুঝেছি, আলী। যদিও আমার মতো নয়। আমি তোমাকে আমার হৃদয়ের সব চেয়ে উঁচু আসনে বসিয়েছি। মেয়েরা এখানে মাত্র একজনকেই বসাতে পারে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তুমি সেই জায়গায় স্থান পেয়েছে। অথচ আমার একটু করুণামিশ্রিত ভালোবাসা পাওয়ার জন্যে কত তরুণই না পাথরে নিস্ফল মাথা কুটে মরেছে। তাদের জন্য আমি দুঃখ পেয়েছি কিন্তু ভালোবাসা ঢেলে দিতে পারিনি। আজ তোমার কাছে আমার এই আত্মসমর্পণে আমি নিজেও কম। অবাক হইনি, আলী।
প্রিয়তমা, তোমার প্ৰেম আমার কাছে কোনও বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়—আমার আত্মারই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। মৃত্যুও তাকে আলাদা করতে পারবে না। কিন্তু কি আমাদের বিরহ বিধুর জীবন। একথা ভাবতে পারি না, পার্থিব জীবনে আমাদের কখনও মিলন হতে পারে না।
দুজনে আকুল নয়নে কাঁদতে থাকে। আবুল হাসান বলে, একমাত্র খোদাই ভরসা, আমি বুঝতে পারছি না, তোমরা কি করে বাঁচবে। এখন যদি তোমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে জীবন কাটাতে হয়, জানি না কি অঘটন ঘটবে। সে যাই ঘটুক পরের ব্যাপার পরে দেখা যাবে। এখন, এই মুহুর্তে যখন এক সঙ্গে রয়েছ, একটু প্ৰাণ খুলে হাসো। গাও। মৌজ করো।
আবুল হাসানের এই কথায় নাহার চোখের জল মুছে ফেলে। চাকরদের একজনকে ইশারা করতেই সে ভিতরে চলে যায়। একটু পরেই একদল খানসামা নিয়ে আসে খানাপিনী। বড় বড় রূপের রেকবী সাজানো হয় টেবিলে। নানা রকমের বাদশাহী খানা। মাংসের চাপ, সম্মিকাবাব, মোরগ মোসাল্লাম, শাহী কোর্মা কোপ্তা, কালিয়া, বিরিয়ানী, হালওয়া, তন্দুরী রুটি প্রভৃতি। টেবিলের মাঝখানে বসানো হয় একখানা বিরাট সোনার থালা। আপেল, আঙ্গুর, আনার, কলা, কালোজাম, গুলাব জাম ইত্যাদি নানা জাতের ফল। পারস্যের কাজকরা ঝারিতে দুষ্প্রাপ্য সরাব, গোলাপজল।
সামস-অল-নাহার আলীকে বলে, তুমি বসে ঠিক মাঝখানে। আমি বসবো তোমার মুখোমুখি। আবুলকে পাশে বাসায় নাহার। নিজে হাতে পরিবেশন করতে থাকে। একটা একটা করে তুলে দেয় আলী আর হাসানের রেকবীতে।
কুমারী নিগ্রো বাদীরা মদের পেয়ালা পূর্ণ করে দিতে থাকে। নাহার এগিয়ে দেয় আলী আর হাসানের দিকে। ধীরে ধীরে মৌজ করে খানাপিনা চলতে থাকে।
মেয়েরা গোলাপজলের ঝারি হাতে দাঁড়িয়েছিলো। খানাপিনা শেষ হলে আলী আর হাসানের হাতে জল ঢেলে দেয়। কেউ বা দাঁড়িয়েছিলো তোয়ালে হাতে।
এরপর সামস-আল-নাহার একমাত্র গাইয়ে মেয়েদের ছাড়া আর সবাইকে বিদায় করে দেয়। নাহার গান ধরে। এক এক করে মদের পেয়ালা পূর্ণ হয়। আলী হাসান আর নাহার ছোট ছোট চুমুকে শেষ করতে থাকে।
সুধা পাত্র মুখে তোলে। সুরের মুচ্ছনায় আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে।
ধীরে ধীরে মদের নেশা বেশ জমে ওঠে। জমে ওঠে গানের আসর। নাহার এবার বাঁশী তুলে নেয় হাতে। বাঁশীর করুণ সুরে সে এক অপূর্ব ইন্দ্রজালি রচনা করতে থাকে।
আলীর মনে হয়, সে কোনও এক বেহেস্তের বাসিন্দা। যেখানে বিত্ত বৈভবের কোনও চিন্তা ভাবনা নাই। শুধু আছে গান আর গান। হাসানেরও তাই মনে হতে থাকে। ভুলে যায়, সে এক নামজাদ সওদাগর। লক্ষ লক্ষ টাকার কারবার। তার দোকানে কত আমির উজিরের মেয়ে বিবিরা আসে। কত কেনা-বেচা। গানের অপরূপ মাদকতায় সমাজ সংসার, জীবনের এই কলরব-সব হারিয়ে তলিয়ে একাকার হয়ে যায়।
আলী কখনও বা হাসে কখনও কাঁদে! আবুল হাসানকে জড়িয়ে ধরে বলে, এ তুমি আমায় কোথায় নিয়ে এসেছে, দোস্ত। জীবনে এত গান আছে, এত সুর আছে এবং তার মধ্যে নিজেকে এমন করে নিঃশেষ করা যায়, তাতো জানতাম না। এ তুমি আমায় কোথায় নিয়ে এলে বন্ধু। আমার বড় ভয় করছে, আজকের এই মধুর রাত্রিকাল হয়তো ফুরিয়ে যাবে।
হাসান বলে, কাল কি হবে সে কথা আজ নাই ভাবলে দোস্ত। আজকের এই মুহুর্তে যা পে.ে কাল যদি তার কণা মাত্র অবশিষ্ট না-ই থাকে, তাতেই বা কী ক্ষতি? কিন্তু আজকে রাতের এই মধুর স্মৃতি সারা জীবন তো অক্ষয় হয়ে থাকবে। ওসব ভবিষ্যত ভাবনা ছাড়। এসো, পান করো, গাও, হাসো।
আবুল দু’খানা বাঁশী তুলে নিয়ে একখানা আলীর হাতে দেয়। বলে, এসো আমরাও নাহারের সঙ্গে সুর মিলাই।
কতক্ষণ। এইভাবে সুরের কল্পলোকে ওরা বিচরণ করেছিলো মনে নাই। হঠাৎ চৈতন্য হলো। খবর এলো, প্রাসাদ ফটকে এসে দাঁড়িয়েছে মসরুর। তার সঙ্গে আছে আফিফা এবং অন্য অনেকগুলো খোজা। সামস-আল-নাহার এগিয়ে এসে বললো, মালিক বাঁশী থামাও। শিয়রে শমন হাজিরা। মসরুর এসেছে। সে তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে চায়।
নাহারের এই কথা কানে আসা মাত্র আলী আর আবুল দিশাহীরা হয়ে পড়ে। বাজিয়ে মেয়েগুলো আতঙ্কে শিউড়ে ওঠে। কিন্তু সামস-আল-নাহার ধীর শান্ত। তার মুখে স্মিত হাসি তখনও লেগে রয়েছে। —ভয়ের কিছু নাই। তোমরা শান্ত হয়ে বসে।
নাহার তার এক বিশ্বস্ত অনুচরকে বলে, মসরুর আর আফিফকে একটু অপেক্ষা করতে বলো। আমি যাচ্ছি।
মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললো, আমার সিংহাসনট তোমরা ধরাধরি করে বাগানের মধ্যে নিয়ে গিয়ে রেখে দাও।
তারপর আলী আর আবুলকে উদ্দৌল্য করে সে বলে, তোমরা এই ঘরেই থাকবে। আমি বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে যাবো। না, কোনও ভয় করবে না। যা করার আমিই করবো।
চারিদিকের দরজা জানিলা বন্ধ করে দেওয়া হলো। নাহার তার দাসী বাদীদের সঙ্গে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দেওয়া হয়। শুধু রুদ্ধ ঘরের মধ্যে বসে থাকে আলী আর আবুল। তাদের মনে শঙ্কা, না জানি কি বা হয়। আলী বলে, দোস্ত আজ প্ৰাণটা বেঘোরে মারা গেলো। কেন যে তোমার কথায় নাচলাম।
আবুল সান্ত্বনা দেয়, নিজেকে শক্ত রাখো, আলী। আল্লাহ সব বিপদ কাটিয়ে দেবেন।
কিন্তু আল্লাহ কি বলেছিলেন অন্যের মেয়েমানুষ নিয়ে ফূর্তি করো?
হাসান বললো। ধৈর্য ধরে বন্ধু! প্রেমের পথ বড় বন্ধুর।
এদিকে ঘরের দরজায় কুলুপ এটি সামস-আল-নাহার বাগানে গিয়ে সিংহাসনে বসে। পরনে তার স্বল্পবাস। একটি বাদীকে বলে তেল নিয়ে এসে আমার দাবনায় মালিশ করতে থাক।
হামামে যাবার আগে এ তার নিত্য প্রসাধন।
একটি নিগ্রো বাঁদী মসরুর আর আফিফকে সঙ্গে নিয়ে বাগিচায় আসে। রণ সাজে সজ্জিত মসরুর। হাতে তার তালা খোলা বঁকা তরোয়াল। সামস-অল-নাহারকে ঐ রকম প্রায় বিবস্ত্ৰা অবস্থায় দেখে ওরা দুজনে সেলাম জানিয়ে মাথা। নত করে দাঁড়ায়।
নাহার স্বাগত জানায়, আল্লাহ তোমাদের মঙ্গল করুন, মসরুর। কি শুভ-সংবাদ নিয়ে এসেছো, বলো।
মসরুর আর সামনে তাকাতে পারে না। মালকিনকে এইভাবে দেখবে সে আশা করেনি। মাথা নত করেই বলে, মালকিন, খলিফা আপনাকে স্মরণ করেছেন। অনেক দিন। আপনার সঙ্গে মোলাকাৎ হয়নি, তিনি বললেন, ‘মসরুর মন আমার বড় চঞ্চল হয়ে উঠেছে। যা একবার তোর মালকিনের খবর নিয়ে আয়। তার তবিয়াৎ যদি ভালো থাকে। আমি তার সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই। তা সে যদি নিজে আসতে চায় সঙ্গে করে নিয়ে আসবি। আর যদি আমাকে যেতে হুকুম করে, আমিই যাবো।
খলিফার নাম কানে আসতেই সামস-অল-নাহার উঠে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানাবার জন্যে আভূমি আনত হয়ে তার উদ্দেশ্যে কুর্নিশ জানায়। এই-ই প্রচলিত বাদশাহী রীতি।
—তুমি তাঁকে গিয়ে বলো, তিনি যদি বাঁদীর প্রাসাদে পায়ের ধুলো দিতে চান আমি ধন্য হবো।
মাসরুর সেলাম জানিয়ে বিদায় নিলো। জলসাঘরের তালা খুলে ছুটে গিয়ে আলীকে বুকে জড়িয়ে ধরলো নাহার। আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, আলী, আমি কি করে বাঁচবো? কেন তুমি আমার কাছে এলে? কেন তুমি হাসানের দোকানে বসেছিলে? কেন—কেন? আমার দেহমান তোমার জন্যে আকুল হয়ে উঠেছে। অথচ ভাগ্যের এমনি পরিহাস তোমাকে আমি ধরে রাখতে পারবো না।
আলী নাহারকে বুকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে।–অমন করে কেঁদো না, নাহার। তোমার আমার প্রেম যুগ যুগান্তের। তুমি আমারই থাকবে আমিও তোমার হয়েই থাকবো। নাইবা হলো এ জীবনে আমাদের মিলন। দৈহিক মিলনটাই সব চেয়ে বড় কথা?
নাহার বলে, না না না, দেহের মিলনের কথা আমি বলিনি, সোনা। কিন্তু তোমাকে তো আর চোখের দেখাও দেখতে পাবো না। আমি অন্তঃপুরে বন্দী হয়ে থাকি। বাইরে বেরুবার স্বাধীনতা কতটুকু আমার? কিন্তু তোমরা পুরুষ মানুষ—বাইরে পাঁচটা জায়গায় ঘুরতে পারো। নানা রকম হৈ-হল্লার মধ্যে কাটাতে পারো। কত নতুন মেয়ে আসবে দোকানে। তাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হবে। তাদের রূপে ভুলে যাবে। আমি তখন তোমার মন থেকে মুছে যাবো।
এক অনুচর ছুটে এসে খবর দিল, খলিফা আসছেন।
সবাই সস্ত্বস্ত হয়ে ওঠে। সামস-আল-নাহার। আর একবার জড়িয়ে ধরে আলীকে। মেয়েদের লক্ষ্য করে বলে, প্রাসাদের ওদিককার ফটকটা খুলে দাও। খলিফাকে অভ্যর্থনা করে বসাও। আমি যাচ্ছি।
টাইগ্রীসের তীরে নাহারেরই নয়নাভিরাম প্রাসাদের আর এক মহল ওদিকটায়। সামনে নদীর মনোহর শোভা। খলিফা হারুন-আল-রাসিদ এলে এই মহলেই ওঠেন।
নাহার চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ায়। বেশবাস সংবৃত করে নেয়। আলীকে শেষ বিদায় জানিয়ে বলে, এবার তোমরা এসো। এখন আমাকে তাঁর মনোরঞ্জন করতে যেতে হবে।
নাহারের অনুচর। আলী আর আবুলকে সঙ্গে করে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অবশেষে এমন একটা ঘরে নিয়ে এসে দাঁড় করালো যেখান থেকে প্রাসাদের টাইগ্ৰীস মহলটা পুরো নজরে আসে। অথচ তাদের কেউ দেখতে পাবে না। মেয়েটি বলে, আপনার এখানে আরাম করে বসুন। ইচ্ছে হলে এই পালঙ্কে শুয়ে ঘুমাতে পারেন। খিদে পেলে খানা খেতে পারেন—টেবিলে সাজানো আছে। পান করার বাসনা হলে পান করতে পারেন। ঝারিতে সরাব আছে। আর তাছাড়া তো আমি হাজির আছি সামনে। যা দরকার বলবেন, এনে দেব। কিন্তু একটা কথা, জোরে কথাবার্তা বলবেন না। ওদিক থেকে এদিকে কিছু দেখা যায় না, কিন্তু কথাবার্তা শোনা যেতে পারে।
ঘরটা বড় অন্ধকার। কিন্তু একটু পরেই চোখে সয়ে গেলো। আলী আর হাসান এতক্ষণ জলসাঘরের চোখ ধাঁধানো আলো থেকে উঠে এসেছে। তাই প্রথম প্রথম বেশ আঁধার আঁধার লাগলেও পরে আর অতটা মনো হলো না। মেয়েটি খাটো গলায় বলে, হয়তা একটু অসুবিধে হবে আপনাদের। কিন্তু এ ঘরে আলো জ্বালানো যাবে না। ওমহল থেকে নজরে পড়লে বিপদ ঘটতে পারে।
আলী ফিসফিস করে বলে, আলোর কোনও দরকার নাই। ওদিকে যা আলোর রোশনাই।–তাতেই এ ঘর বেশ স্বচ্ছ পরিষ্কার।
জানলার জাফরীতে চোখ রেখে আলী আর হাসান খলিফার প্রমোদ বিহার দেখতে থাকে। প্রায় শ’খানেক অল্পবয়েসী খোজা-প্রত্যেকের হাতে একটা করে চিরাগ। সেই আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে থাকে। খোজাগুলো একটা বিরাট এক বৃত্ত রচনা করে ধীরে ধীরে টাইগ্রিসের ফটকের দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের মাঝখানে আরও শ’খানেক বয়স্ক খোজা-হাতে তলোয়ার আর ঢাল। আর এই খোজাদের মাঝে কুড়িটি সুবেশা সুদর্শনা বাঁদী এ ওর হাত ধরে খলিফাকে কেন্দ্র করে একটি পদ্ম রচনা করেছে। ধীর মন্থর গতিতে এগোতে থাকে তারা।
সামস-আল-নাহার জমকালো সাজে। সেজে ফটকেরী সামনে এসে দাঁড়ায়। তার পিছনে পিছনে এক দঙ্গল মেয়ে-সবারই হাতে নানারকম বাদ্যযন্ত্র।
বাজনার অপূর্ব সুরে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। খলিফা ফটকের কাছে এগিয়ে আসতেই নাহার আভূমি আনত হয়ে কুর্নিশ জানায়। খলিফা তার বাহু ধরে টেনে তোলে, তোমার স্থান ওখানে নয়। সুন্দরী, তুমি আমার বুকে এসো।
সামস-আল-নাহার কাঁটাষ হানে। পথে ঘাটে এ রসিকতা আমার ভালো লাগে না, জাঁহাপনা। রাস্তার লোকে হাঁ করে দাঁড়িয়ে পড়েছে। আর আপনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।
খলিফা হাসেন, কই জড়িয়ে ধরিনি তো! তবে ধরতে চেয়েছিলাম। তা তুমি তো দিলে না।
—আগে ভিতরে চলুন। তারপর যতখুশি ধরবেন।
খলিফা উপরে উঠে আসেন। বিশাল খোলা ছাদ। চারপাশ ঘেরা। নানা ফুলের গাছের সমারোহ। আর সামনে স্বচ্ছ সলিলা টাইগ্রিস। উপরে উন্মুক্ত নীল আকাশ। এক কথায় অপূর্ব মনোহর পরিবেশ।
মাঝখানে একটা রূপের সিংহাসন-খলিফা আসন গ্রহণ করলেন। পায়ের নিচে সূক্ষ্ম কাজ করা পারস্য-গালিচা পাতা। সামস-আল-নাহার খলিফার পায়ের কাছে বসলো।
খলিফা বলেন, অনেকদিন তোমার কাছে আসিনি। নানা কাজের ঝঞ্ঝাটে বড় ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু আর আর কিছুই ভালো লাগলো না। তাই তোমার কাছে খবর পাঠিয়েছিলাম।
নাহার মাথা নিচু করে বলে, খোদা মেহেরবান, তাই আজ। আপনাকে পেলাম।
ধরে রাখতে পারি? না ধরে রাখা উচিৎ?
—কেন—উচিৎ নয়, সুন্দরী!
-আমি তো আপনার এক না, আপনার আছে লক্ষ লক্ষ প্রজা-দরবার। কত দায়-দায়িত্ব আপনার। তার মধ্যেও মাঝে সাঝে এই বাদীকে যে আপনার মনে পড়ে-এতেই আমি ধন্য। আমার মতো সৌভাগ্য কটা মেয়ের হয়?
খলিফা প্রশ্ন করে, কিসে তুমি সৌভাগ্যবতী? আমি তোমাকে কি দিয়েছি—কি দিতে পেরেছি, নাহার? টাকা পয়সা ধন-দৌলত এইই কি সব-একটা নারীর জীবনে। আমি কি বুঝতে পারি না, কি নিঃসঙ্গ জীবন তুমি কাটাও।
সামস-আল-নাহার বাধা দিয়ে বলে, কোনও দুঃখ নাই আমার, জাঁহাপনা। আমি বেশ সুখী।
মেয়েরা সেতারে সুর তোলে। পূরবীর সুর। এই আসন্ন সন্ধ্যায় ঝির ঝির করে বসন্তের দখিনা বাতাস কানে কানে কি যেন গোপন কথা বলে যায়। খলিফা তন্ময় হয়ে শোনে।
—বড় ভালো বাজায় তোমার মেয়েরা। কোন ঘরানা?
নাহার বলে, সব আমার নিজে হাতে তালিম দেওয়া।
খলিফা মুগ্ধ হয়ে বলেন, বড় গুণী মেয়ে তুমি নাহার। তোমার আর্ক গুণের কদর করতে পারলাম না আমি। আমার মতো সুলতান বাদশাহরা পয়সা দিয়ে গুণী মানী লোকের মাথা হয়তো কেনে কিন্তু তাদের মগজের মর্যাদা দিতে পারে কতটুকু?
সামস-আল-নাহার তার অনুচরকে ইশারা করেত সে মেয়েগুলোকে কি যেন বলে আসে। একটু পরে তারা গান ধরে। ভালোবাসার গান। প্রেমিক গেছে পরবাসে। প্রেমিকা সে বিরহ জ্বালা সহ্য করতে পারছে না। কবে তাদের আবার মিলন হবে। কবে। আবার তার মুখে হাসি ফুটবে-এই যন্ত্রণাই ফুটে উঠতে থাকলো সেই গানে।
আলী আর আবুলকে মেয়েটি বলে, আমাদের মালকিনের এখন বিরহে ব্যাকুল প্ৰাণ। সে এ গান গাইতে বললো কেন জানেন?
আলী জিজ্ঞেস করে, কেন-কেন?
—আপনাকে শোনাবার জন্যে, সাহেব। আপনি তার মন প্ৰাণ কেড়ে নিয়ে বিবাগী হয়েছেন। সে এখন দিন কটায় কি করে?
আলী বুঝতে পারে, মেয়েটি মজা করছে। কিন্তু সত্যিই নাহারের হৃদয় তোলপাড় হয়ে হয়ে গেছে। একটা দিনের পরিচয় আপাতভাবে এমন কিছুই ব্যাপার নয়। কিন্তু তার মধ্যে হাজার বছরের বন্ধনের আকর্ষণ অনুভব করতে পেরেছে সে।
গান শুনতে শুনতে এক সময় নাহার তার পাশে একটি মেয়ের কোলে ঢলে পড়ে। আবু উৎকণ্ঠিত হয়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে, কী ব্যাপার কী হলো?
মেয়েটি মুচকি হাসে, ও কিছু নয়, মুচ্ছ গেছে, এখুনি ঠিক হয়ে যাবে।
আলী আর ভাবতে পারে না! আবুলকে জড়িয়ে ধরে তার কাধে মাথা রেখে বলে, কি হবে দোস্ত?
আবুল হাসান শান্ত করার চেষ্টা করে, তোমার বিরহে সে এখন কাতর। তার উপর এই বিরহ-সঙ্গীত ওকে বিচলিত করে ফেলেছে। কিছু চিন্তার নেই, সব ঠিক হয়ে যাবে।
আলী আর ভাবতে পারে না। আবুলকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মাথা রেখে বলে, কি হবে
আবুল হাসান শান্ত করার চেষ্টা করে, তোমার বিরহে সে এখন কাতর। তার উপর এই বিরহ-সঙ্গীত ওকে বিচলিত করে ফেলেছে। কিছু চিন্তার নেই, সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু এমন সময় কি যেন এক গুঞ্জন শোনা গেলো। মেয়েটি বলে দাঁড়ান। আমি দেখে আসি।
একটু বাদে ছুটে এসে ঘরে ঢুকে বলে, শিগগির বেরিয়ে আসুন, সর্বনাশ হয়ে গেছে।
আবুল আতঙ্কিত হয়ে বলে, এদিকে যে আরও বিপদ। আলী মুর্চ্ছা গেছে। একটু পানি ছিটিয়ে দাও ওর চোখে মুখে। মেয়েটি জলের ঝারিটা নিয়ে গিয়ে চোখে মুখে ঝাপটা দিতে থাকে। একটু পরে চোখ মেলে তাকায় আলী। মেয়েটি বলে, নিন। ধরুন।
আবুল আর মেয়েটির কাঁধে ভর দিয়ে আলী ইবন বকর কোনও রকমে হাঁটতে পারলো। খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে তারা এসে দাঁড়ালো প্রাসাদের অন্য প্রান্তের নদী উপকূলে। অন্ধকার রাত। দূরের মানুষ চোখে পড়ে না। শুধু অনেক দূরে সামস-আল-নাহারের দোতলার বিলাস উদ্যানের মৃদু আলোর আভা নজরে আসে।
ওরা তিন জনে নদীর ধারের একটা শান বাঁধানে চবুতরায় বসে পড়ে। অদূরে একটা ছোট্ট ডিঙি নৌকা যাচ্ছিল। মেয়েটি হাতে তুডি বাজিয়ে ডাকে। নৌকাটা কাছে আসে। ওরা মুখে কোনও কথা না বলে নৌকায় গিয়ে উঠে পড়ে। একটি মাঝ বয়েসী জেলে ডিঙিটা একাই চালিয়ে চলেছিলো। বলে, সাহেবরা সুলতানের লোক, যেখানে যেতে চায় নিয়ে যাবে।
আবুল হাসান বলে, আপনাকে প্রাসাদে পৌঁছে দিয়ে আসি।
মেয়েটি বললো, না না। তার দরকার হবে না। আমি দিব্যি যেতে পারবো। আপনারা এখন ভালোয় ভালোয় কেটে পড়ুন তো।
মেয়েটি আর দাঁড়ালো না, সেই আধো আলো, আধো আঁধার পথ দিয়ে আবার খিড়কির দরজার দিকে অদৃশ্য হয়ে গেলো।
নদীর ঠাণ্ডা হাওয়া মাথায় লাগতে আলী বেশ সুস্থ হয়ে ওঠে। একটু পরে নৌকাটা নদীর ওপারে গিয়ে পৌঁছয়। আবুল হাসানের কাঁধে ভর দিয়ে সে নেমে পড়ে। কিন্তু একটা শেওলা ধরা পাথরের ওপরে পা রাখতেই হড়কে পড়ে যায়। আলী বলে, দোস্ত, ধর ওঠাও, কাদায় পা পুতে গেছে।
টাইগ্ৰীসের এপারটা চোর-ডাকাতের বড় উপদ্রব। একটু রাত হলেই এদিক ওদিক ওৎ পেতে বসে থাকে তারা। শাঁসালো মক্কেল দেখলেই বাঁপিয়ে পড়ে সর্বস্ব লুণ্ঠ-পাঠ করে নিয়ে পালায়।
আলীর হাত ধরে টেনে তোলে আবুল হাসান। বলে, বেশি দূর হাঁটাহাঁটি করে দরকার নাই। কখন কোন চোর ছেনতাই-এর খপ্পরে পড়ে যাবো। তার চেয়ে চলো, কাছেই আমার এক বন্ধুরবাড়ি আছে—সেখানে রাতটা কাটিয়ে দিই।
আলী আর কি বলবে। এছাড়া এখন উপায় বা কি। রাতও বেশ হয়ে গেছে। এখন ফেরা ফেরিও পাওয়া যাবে না। গেলেও যাওয়া ঠিক হবে না। পথ-ঘাট ভালো না। নদীর বুকেও অনেক রাহাজানি ডাকাতি খুন খারাপি হামেশাই হয়, শোনা যায়।
কিছুদূর যেতেই আবুল হাসানের বন্ধুর বাড়ির দরজায় এসে পৌঁছনো গেলো। কড়া নাড়তেই দরজা খুলে দেয় তার বন্ধু। বিস্ময়ে আনন্দে উল্লাসে ফেটে পড়ে সে। কী ব্যাপার, এতকাল বাদে এই গভীর রাতে তোমার দেখা পাওয়া গেলো দোস্ত। এসো, ভিতরে এসো।
আবুল এক কল্পিত কাহিনী খাড়া করে কারণ দেখালো-কেন তাদের এত রাত হলো ফিরতে। আদি আপ্যায়ন মাত্রাতিরিক্ত। প্রায় অস্বস্তিকর বলা যায়। সেই মাঝ রাতে সারা বাড়িতে হৈ-চৈ পড়ে গেলো। খানাপিনার সে কি মহা ঘটা। কিন্তু কি করে বলবে, সারাদিনে অনেক ভালো ভালো খানাপিনা তারা করেছে। এখন এই মাঝ রাতে এসব না হলেই বরং ভালো লাগতো। খাবো না-খিদে নাই—অথবা শরীর ভালো লাগছে না—এসব ওজর অতিথির চলে না। কোনও আপত্তিই তারা কানে তুললো না। দম-ভর খাওয়ালো।
খানাপিনা সেরে দুই দোস্ত পাশাপাশি শুয়ে ছটফট করতে থাকে। কারো চোখেই ঘুম নাই। আলী ইবন বকর ভাবে, এই সে জীবনে প্রথম না বলে বাড়ির বাইরে রাত কাটাচ্ছে। তার মা নিশ্চয়ই এতক্ষণ ঘর-বার করে বেড়াচ্ছেন। আর বাবা রাশভারি মানুষ। মুখ দেখে বুকের ব্যথা বোঝে, কার সাধ্য! শ্যাওলায় হড়কে গিয়ে পা-টা বেশ চোট লেগেছে, মনে হয়। গা-হাত-পা বেশটিনটিন করছে।
আলী ভাবে, সামস-আল-নাহার এখন কেমন আছে কে জানে? তাকে মুছিত হয়ে ঢলে পড়তে দেখে এসেছে সে। হয়তো এতক্ষণে খলিফা সব জানতে পেরেছেন। ক্ৰোধে রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছে তার চোখ। জানিনা কি শাস্তি তিনি বিধান দেবেন। হয়তো এতক্ষণে মসরুরের খাড়ার এক কোপে নাহারের মাথাটা লুটিয়ে পড়েছে। নানা না, এসব কি আজগুবি উদ্ভট কল্পনা করছে সে। খলিফা তাকে সত্যিই খুব ভালোবাসে। যে যে-ভাবেই তার কান ভারি করুক হাতেনাতে প্রমাণ না পেলে নাহারকে তিনি সাজা দেবেন না। আর তাছাড়া সামস-আল-নাহার, নানারকম ছলাকলা জানে, বাক চাতুর্যে খলিফাকে কাৎ করে দিতে তার বেশি সময় লাগবে না।
পরদিন সকালে আবুল আর আলী বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শহরে ফিরে আসে। আলীর ব্যথা তখন বেশ বেড়েছে খুব কষ্ট করে হেঁটে কোনক্রমে আবুলেরবাড়ি পর্যন্ত যেতে পারে। শহরে ঢুকতে বলে, দোস্ত এখানে তুমি বিশ্রাম করো। বিছানাপত্ব খানাপিনা সবই আছে। আগে একটু সুস্থ হয়ে নাও। তারপর তোমারবাড়ি পৌঁছে দেব।
আলীর শরীর প্রায় নেতিয়ে পড়েছিলো। বিছানায় শোয়ামাত্র অসাড়ে ঘুমিয়ে পড়লো। যেন মনে হয়, দিনের পর দিন হেঁটে হেঁটে পথ-শ্ৰান্ত হয়ে এই প্রথম বিশ্রাম করছে সে।
একটানা একটা প্রহর ঘুমানোর পর আলী উঠে হাত মুখ ধুয়ে রুজু করে। তারপর নামাজ সেরে বেরুবার তোড়জোড় করতে থাকে। কিন্তু আবুল বাধা দেয়, শোনো বন্ধু, তোমার যা তবিয়ৎ, আজ সারা দিন সারা রাত বিশ্রাম দরকার। এ অবস্থায় রাস্তায় বেরুলে আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে। বরং আমি তোমার মনোরঞ্জনের কিছু ব্যবস্থা করছি।
আলী বলে, কী ব্যবস্থা করবে শুনি?
–কিছু গান বাজনার ব্যবস্থা করছি। সন্ধ্যাবেলায় নামকরা মুজরোদলকে ডেকে আনবো। ওরা তোমাকে পছন্দসই গান-বাজনা শুনিয়ে যাবে!
কিন্তু সে রাতটা আগের রাতের চেয়ে আরও খারাপ কাটলো। গানবাজনা কিছুই সে সহ্য করতে পারলো না।
আবুল বললো, কিন্তু মেয়েগুলো তো খারাপ গায়না দোস্ত।
—আরে, ওরা কেন খারাপ গাইবে-বাজাবে। আসলে আমার মেজাজটা ঠিক নাই–যতই ভালো হোক, কিছুই ভালো লাগতে পারে না।
পরদিন আলীর শরীর আরও খারাপ হয়ে পড়ে। আর এ অবস্থায় এখানে রাখা ঠিক হবে না। ভাবলো, ওর মা-এর আদর যত্ন পেলে সে তাড়াতাডি সুস্থ হয়ে উঠতে পারবে। কিন্তু পায়ে হেঁটে সে যেতে পারবে না। একটা খচ্চর ভাড়া করে পাঠিয়ে দিতে হবে। আলীকে বললো, তুমি একটু অপেক্ষ করো। আমি দোকানটা খুলে দিয়ে একটা খচ্চর নিয়ে আসছি।
দোকান খুলে বসতেই একজন খদের ঢুকলো। তার একটু পরেই এল সামস-আল-নাহারএর সেই অনুচর।
মেয়েটি তাকে আদাব জানায়। আবুল-এর হৃৎকম্প হতে থাকে। নিশ্চয়ই কোনও দুঃসংবাদ আছে। অবশ্য মেয়েটির মুখ দেখে তাই মনে হয়।
আবুল জিজ্ঞেস করে, কী গো, কী খবর? তোমার মালকিন কেমন আছেন?
মেয়েটি কিন্তু সে কথার জবাব দেয় না। উল্টো প্রশ্ন করে, আলী সাহেব কেমন আছেন?
আবুল বললো, শরীরটা তার এমনিতেই ভালো ছিল না সেদিন। তারপর আজ দুটো রাত ঘুম হয়নি। বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে।
মেয়েটির মুখ কালো হয়ে গেলো, আমার মালকিনের অবস্থা আরও খারাপ। নাওয়া খাওয়া বন্ধ করেছে। কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়েছে।
আবুল বলে, আমরা তো দেখে এলাম, গান শুনতে শুনতে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো। তারপর কী হলো?
মেয়েটি বলতে থাকে : আপনাদের দুজনকে নৌকায় তুলে দিয়ে আমি তাড়াতাডি প্রাসাদে ফিরে এলাম। তখনও দেখি সামস-আল-নাহার অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে। তার মুখ চোখে পাংশুবৰ্ণ হয়ে গেছে। খলিফা হারুন-অল-রাসিদ তার পাশে বসে রয়েছেন। আমরা তো ভয়ে জড়সড়। কি করা উচিৎ কি বলা উচিৎ কিছুই বুঝতে পারলাম না।
এইভাবে অনেক রাত অবধি তার অচৈতন্য ভাব ছিলো। মাঝ রাতে একবার চোখ মেলে। তাকালো। খলিফা খুব সোহাগ করে ডাকলেন, নাহার, মানিক সোনা কী হয়েছে তোমার? কিন্তু কোন কথা বলতে পারলো না সে। আবার চোখ বন্ধ করলো। শুয়ে শুয়েই খলিফার পায়ের উপরে ডান হাতখানা রাখলো। খলিফা আবার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি কষ্ট বলো, নাহার। আমি খুব দুশ্চিন্তায় আছি সোনা। তুমি না বললে তো আমি বুঝতে পারবো না-কষ্টটা তোমার কোথায়?
কিন্তু সামস-আল-নাহার কিছুই বলতে পারে না। সুলতান মাথায় হাত বুলাতে থাকে। নাহার আবার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি কষ্ট বলো, নাহার। আমি খুব দুশ্চিন্তায় আছি সোনা। তুমি না বললে তো আমি বুঝতে পারবো না-কষ্টটা তোমার কোথায়? কিন্তু সামস-আল-নাহার কিছুই বলতে পারে না। সুলতান মাথায় হাত বুলাতে থাকে। নাহার আবার চোখ মেলে তাকায় সুলতান আবার জিজ্ঞেস করে, বলো, তোমার কি কষ্ট। আমার কাছেও বলতে তোমার সঙ্কোচ। তাহলে কি আর তুমি আমাকে ভালোবাস না? নাহার এবার ভাঙা ভাঙা স্বরে বলে, বিশেষ কিছুই না, জাঁহাপনা, আজ এমন একটা নতুন ফল খেয়েছিলাম যা একদম হজম হয়নি। এই বদহজমের জন্যেই শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। আপনি কিছু ভাববেন না। একটু ঘুমোলেই ঠিক হয়ে যাবে।
সুলতান বলে, তার সঙ্গে কি কি খেয়েছিলে বলো দেখি।
নাহার বলে, দুটো পাতিলেবু, ছটা কাঁচা আপেল, এক বাটি দই, খানিকটা ভাজা বাদাম, আর এক মুঠো কাঁচা কড়াই শুটি।
—দূর, বোকা মেয়ে এ সব খেয়ে কারো বদহজম হয়? এ সবই তো খিদে বাড়ায়। তবে আমার মনে হয় খাওয়ার সময়েই ভেবেছিলে, বোধ হয়। হজম হবে না। যা-ই খাও তৃপ্তি করে না। খেলে হজম হওয়া শক্ত। সে যদি হজমিগুলিও হয়-দেখবে বদহজম হয়ে গেছে। যাই হোক, তোমার জীবনটা তো শুধু তোমার একার নয়। নাহার। তোমার কিছু হলে আমি যে সুস্থির থাকতে পারবো না। আমার কথা ভেবেও তোমার শরীরটা দিকে বিশেষ নজর রাখা দরকার। যাই হোক, এখন আর কোনও কথা নয়, একটু ঘুমাও। আমি তোমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ভালো লাগবে।
ভোর না হওয়া পর্যন্ত, বিশ্বাস করুন, সুলতান সেই একভাবে মালকিনের বিছানায় বসে রইলেন! চোখে তার একবার তন্দ্ৰাভাব এলো না। কি তাজ্জব ব্যাপার! সকাল হতেই তিনি প্রাসাদ এবং শহরের সব নামজাদা হেকিমকে এক সঙ্গে ডেকে পাঠালেন।
হেকিমরা এসে নানাভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে অনেক রকম দাওয়াই ব্যবস্থা করে গেলো। কিন্তু আসলে কোনও রোগ হলে তো দাওয়াই-এ সারবে। এ রোগ-এর গোড়া তো অন্য জায়গায়।
সুলতান এবং হেকিমরা বিদায় নেওয়ার পর সামস-আল-নাহার চোখ মেলে আমার দিকে তাকালো। আমি তাকে এক গেলাস সরবৎ এনে দিলাম। সরবৎটুকু খেয়ে নাহার। আমাকে বললো, আমি ওকে না দেখলে বাঁচবো না, তুই একবার আলীর খবর নিয়ে আয়।
আবুল বলে, যা বললাম। এর বেশী খবর এখন আর দিতে পারছিনা, মেয়ে। এখন তুমি যাও। কাল আবার এসো। তখন জানাবো কেমন থাকে।
মেয়েটি চলে যাওয়ার পর আবুল দোকান বন্ধ করে দ্রুত পায়েবাড়ি চলে আসে।
আলীর চারপাশে তখন বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন এবং হেকিম গিজ গির করছে। আবুল জিজ্ঞেস করলো, এখন কেমন আছো আলী?
আলী বলে, খুব একটা ভালো না। ওদিকের কিছু খবর পেয়েছ?
আবুল চোখের ইশারায় বললো, আছে।
আলী ঘর থেকে সবাইকে বাইরে যেতে বলে।
আবুল নাহার-এর দূতের কথা শোনায়। তার পর বলে, তোমার এত দুঃখের কারণ একমাত্র আমি। কেন যে মরতে তোমাকে নিয়ে গেলাম—। তুমি সুস্থ না হয়ে ওঠা পর্যন্ত আমি আর কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছি না। আল্লাহর দেয়া মাঙছি, তিনি যেন তোমায় তাড়াতাডি সুস্থ করে তোলেন।
পরদিন সকালে আবার সেই মেয়েটি এল আবুল-এর দোকান।–আমার মালকিন আপনাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। শাহজাদা আলীর শরীর কেমন আছে আজ?
আবুল বললো, ও কথা আর জিজ্ঞেস করো না, মেয়ে। আজকের খবর আরও খারাপ। সারারাত সে ঘুমায় না। খা না। শুধু হা হুতাশ করছে সামস-আল-নাহার-এর সঙ্গে আর বুঝি তার দেখা হবে না।
মেয়েটি বলে, আমার মালকিনের অবস্থাও ভালো না। একখানা চিঠি দিয়েছে সে। আপনি শাহজাদা আলীকে চিঠিখানা দিয়ে দেবেন। মেহেরবানী করে। মালকিন জবাব নিয়ে যেতে বলে দিয়েছে।
আবুল দোকান বন্ধ করে মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে আলীর বাড়িতে আসে। দরজায় অপেক্ষা করতে বলে, আবুল ঢুকে যায়। আলীর ঘরে এসে ইশারায় জানায়, যারা ঘরের ভিতরে আছে তাদের বাইরে যেতে বলে।
আলী উপস্থিত সকলকে বলে আমার পেটে বিষম ব্যথা হচ্ছে, তোমরা একটু বাইরে যাও। আমি ঘুমাবার চেষ্টা করি।
ঘর ফাঁকা হয়ে গেলে আবুল চিঠিখানা আলীর হাতে দেয়। নাহারের প্ৰেম-পত্রে পড়ে আলী আরও বেশি অসুস্থ বোধ করতে থাকে। আবুলকে বলে, আমি নিজে হাতে এর জবাব লিখতে পারবো না বন্ধু শরীর বড় দুর্বল, তুমি দেখো, আমি বলে যাই।
আলীর জবানীতে আবুল হাসান চিঠিখানা লিখে পড়ে শোনায়। আলী বলে, ঠিক আছে, কলম দাও, আমি সই করে দিই।
আলীকে সেলাম জানিয়ে জবাব দিয়ে মেয়েটি চলে যায়।
আবুল হাসান দোকানে এসে বসে ভাবতে থাকে, ব্যাপারটা ক্রমশই জটিল হয়ে উঠছে। মেয়েটি এখন রোজই চিঠি নিয়ে যাওয়া আসা করবে। প্রাসাদের খোজাদের চোখে ধুলো দিয়ে কতদিন এভাবে চলতে পারবে। শেষে খলিফার কানে যাবেই। তারপর-ওরে সর্বনাশ-তারপরের দৃশ্য সে কল্পনাও করতে পারছে না। সুলতান সবাইকে কোতল করবে। কিন্তু আবুল ছা-পোষা মানুষ, সে মারা গেলে তার সংসারের কী দশা হবে। না না না। এ কিছুতেই চলতে দেওয়া যেতে পারে না। আলীকে সাফ সে বলে দেবে, এসব ফালতু ঝামেলায় সে আর নাই।
পরদিন সকালে আলীর বাড়িতে যায় হাসান।—তোমার মতো প্রেমকাতর মানুষ তো আমি আর দুটি দেখিনি, ভাই। নিজের শরীরটা ক্ষয় করছে আর এদিকে নিজের মরণ ফাঁদ নিজেই পাতিছে? ছাড়ে-ছাড়ো ভায়া, জীবনে বেঁচে থাকলে অনেক পরমাসুন্দরীর সাক্ষাৎ পাবে। এই অলীক মায়ার পিছনে ছুটে কোনও লাভ আছে? তুমি কি ভাবছো, সামস-অলু-নাহার তোমার অঙ্কশায়িনী হবে, আর সুলতান তা চেয়ে চেয়ে দেখবে! খলিফা যেদিন জানতে পারবেন সে-দিন নাহারও বাঁচবে না। আর আমার অবস্থা বুঝতেই পারছে—ভিটে মাটি চাটি করে দেবে। তাই এখনও বলছি, বন্ধু কথা শোনো, নিজেকে সংযত করো। দেখো, সময়ে সব সয়ে যাবে।
আলী ইবন বকর বললো, বহুৎ সুক্ৰিয়া দোস্ত, কিন্তু সামস-আল-নাহার বিহীন এ জীবনে আমার কোনও প্রয়োজন নাই। তার জন্যেই সপেছি-এজীবন! যায় যাবে, থাকে থাকবে।
বাহবা বাহবা দিয়ে উঠলা আলীর অন্য বন্ধুরা। কেউ বললো, তোমার এই প্ৰেমগাথা অমর। হয়ে থাকবে দোস্ত। আবার আর একজন বলে, প্রেম করতে বসে আত ভয় করেল চলে আবুল বলে, তাহলে কিন্তু আমাকে অন্য চিন্তা করতে হবে। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, সুলতান একদিন জানবেই। তখন আমাদের কারুরই রক্ষা থাকবে না। আমি ভাই এ-সবের মধ্যে থাকতে পারবো না।
আবুল হাসান বিদায় নিলো। শুধু সে-দিনের জন্যে নয় চিরকালের মতো। পরদিন আলীর বন্ধু অন্যতম আমিন এসে জানালো, আবুল ভীষণ ভীতু। খলিফা ওকে কোতল করবে। ভয়ে ও আজ সকালেই সপরিবারে বসরাহ পালিয়েছে। সেখানে দোকান পাট খুলে ব্যবসা বাণিজ্য করবে। পরে এসে এখানকার দোকান বিক্রি করে দিয়ে যাবে।
আলী শুনে আহত হয়।-আমাকে এই অবস্থায় ফেলে আবুল চলে যেতে পারলো। সে যে আমার প্রাণের দোস্ত, আমিন।
আমিন ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে, ওরকম ওপর ওপর প্রাণের বন্ধু সবাই হতে পারে, দোস্ত। বন্ধুর পরীক্ষা বিপদে, দুঃসময়ে দুঃখের দিনে। সুসময়ে সুখের খবর সবাই নিতে আসে। কিন্তু প্রকৃত বন্ধুই শুধু দুঃখের দিনে পাশে থাকে। সে তোমার প্রাণের বন্ধু-অথচ আজ এই চরম সময়ে সে কেটে পড়লো। তা পড়ুক, তোমার কোনও অসুবিধে হবে না। আমি আছি তোমার পাশে। যা করতে হয় আমাকে বলো, আমি করে দেব। নিজের বলতে আমার কেউ নাই। সংসারে আমি একা। এক বুড়ি নিগ্রোঝি আছে সেই রোধে বেড়ে দেয়। সুতরাং সুলতানের রোষে যদি আমার এ তুচ্ছ প্ৰাণ যায় তাতেও আমি বিচলিত নই। তবুও বন্ধুর জন্যে যদি কিছু করতে পারি সে-ই আমার বড় সাত্ত্বিনা।
আলী বলে, কিন্তু তুমি কি করে আমার উপকারে আসতে পারবে বন্ধু! আবুল ছিল খলিফার পিয়ারের লোক। প্রাসাদের যত্রতত্র ওর ছিল অবাধ গতিবিধি। হুই করে নোহারের প্রাসাদে ঢুকে গেলেও কোনও নাফর চাকর সন্দেহ করতো না। কিন্তু তোমাকে তারা ঢুকতে দেবে কেন?
আমিন বলে, ও বাবা, তাও জানি না বুঝি, আমি, আবুলের মতো না হলেও, ছোট খাটো জহরৎ-এর ব্যবসা করি। আমার কাছ থেকেও হারেমের বেগমরা অনেক কিছুই কেনে। অনেক সময় খোজাদের দিয়ে ডেকে পাঠায়। আবার আমার হাতে নতুন কোনও জহরৎ এসে গেলে নিজেও গিয়ে দেখিয়ে আসি। সুতরাং প্রাসাদে যে আমারও গতিবিধি একেবারে নাই তা নয়।
আলী আশ্বস্ত হয়। তা হলে হয়তো কোনও অসুবিধে হবে না।
এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে আমিন উঠে যায়। একটু পরে ফিরে এসে বলে, সামস-অল-নাহারের কাছ থেকে একটি মেয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।
আলী অধৈৰ্য হয়ে ওঠে, নিয়ে এসো তাকে এক্ষুণি।
মেয়েটি এসে সেলাম জানিয়ে দাঁড়ায়।
আলী জিজ্ঞেস করে, তোমার মালকিন কেমন আছে?
–আপনার বিরহে সে প্রায় পাগল। একবার চোখের দেখা দেখতে চায়। কিন্তু তা কি করে হতে পারে?
আমিন বলে, যদি কিছু মনে না করো, আলী একটা কথা বলি। আমার বাড়ির সামনেই আর একখানা আমার খালিবাড়ি আছে। সেখানে কেউ থাকে না। তালা বন্ধ করে রেখেছি। যদি চাও সেখানে তোমাদের নিভৃত মিলন করিয়ে দিতে পারি।
দুর্বল অসুস্থ আলী যেন মুহূর্ডে চাঙ্গ হয়ে ওঠে। —তোমাকে কবলে যে কৃতজ্ঞতা জানাবো, ভাই—
আমিন বলে, কৃতজ্ঞতার কি আছে। আমি যদি তোমাদের কোনও উপকারে আসতে পারি, নিজেকে ধন্য মনে করবো।
মেয়েটি বললো, আমি আমার মালকিনকে গিয়ে বলি। সে যা বলে কাল এসে আপনাদের জানাবো।
পরদিন সকালে আবার সে এলো। আমিনকে বললো, মালকিনকে সব বললাম। সে আমাকে বললো, আপনাকে তার প্রাসাদে নিয়ে যেতে।
মেয়েটির এই কথায় আমিনের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আসে। একটা অজানা ভয় যেন তাকে গ্রাস করে ফেলবে। ঠোঁট দিয়ে জিভ চেটে বলতে থাকে, আমি-মানে আমার কি সেখানে যাওয়া ঠিক হবে? যদি খোজারা সন্দেহ করে? তার চেয়ে তাকেই আমার বাড়িতে আসতে বলে। মন খুলে কথাবার্তা বলা যাবে।
মেয়েটি বুঝলো, আমিন যাবে না। বললো, ঠিক আছে তাই গিয়ে বলি—
সামস-আল-নাহার এতই দুর্বল যে উঠে বসতে পারে না। কিন্তু মেয়েটি যখন গিয়ে বললো, তারা কেউ আসবে না, আপনাকেই যেতে বলেছে, তখন ঐ অবস্থাতেই সে উঠে দাঁড়ালো। কোনও রকমে সাজ পোশাক পরে একটা সাধারণ বোরখায় শরীর ঢেকে সবারই অলক্ষ্যে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে পড়লো। মেয়েটি তাকে সঙ্গে করে নিয়ে চলে এল আমিনের বাড়ি।
আমিন বাড়িতেই অপেক্ষা করছিল। মেয়েটি নাহারকে বাইরে দাঁড় করিয়ে আমিনের সঙ্গে কথা বলতে থাকে।—এ বাড়িতে আর কে কে থাকে?
-আমি আর এক বুড়ি নিগ্রো ঝি। কিন্তু এ বাড়িতে আর কে কে থাকে? আঃ একটাবাড়ি আছে আমার। সে বাড়িতে কেউ বাস করে না। সেখানেই আমি দেখা সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছি।
মেয়েটি বলে, কিন্তু এ নিগ্রো বুড়িটাও যেন সে বাড়িতে না ঢোকে।
আমিন বলে, তুমি নিশ্চিত থাকে, কেউ টের পাবে না। চল ঐ বাড়িতেই যাই। এবার সামস-আল-নাহার মুখের নাকাব সরিয়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো, এই সেই সাহেব? এর কথাই তুই আমাকে বলেছিলি?
আমিন দেখলো, তার রূপের আলোয় ঘরটা ভরে গেলো। আলীর পছন্দ আছে বটে। এ রুদাপের জন্যে কোেনা পাগল হতে পারে?
নাহার এবার আমিনের দিকে তাকায়, আপনার নাম-ই আমিন?
—জী হাঁ।
–আপনি বিবাহিত?
–জী না। তাছাড়া মা বাবা কেউই আমার নাই। ছোটবেলা থেকেই আমি অনাথ।
একটা সুসজ্জিত কক্ষ খুলে দিয়ে আমিন বললো, আপনি এখানে বিশ্রাম করুন, আমি আলীকে নিয়ে এখুনি আসছি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সে আলীকে নিয়ে ফিরে এলো।
অনেক কয়দিন বাদে দুজনেই দুজনকে দেখে আনন্দে আত্মহারা। আলীর বুকে কাঁপিয়ে পড়লো নাহার।
অনেক রাত অবধি খানাপিনা হৈ-হল্লা আনন্দের মধ্যে কাটলো। এক সময় আমিন আর নাহারের অনুচর মেয়েটি বিদায় নিয়ে চলে গেলো। ওরা দরজা বন্ধ করে দিলো।
পরদিন সকলে সারা পাড়ার লোক জমে গেছে বাড়িটার সামনে। দরজার কপাট ভাঙ্গা। কাল রাতে ডাকাতি হয়ে গেছে আমিনের এই খালি কুঠিতে। পাড়ার প্রত্যক্ষদশীদের একজন এগিয়ে এসে বললো, গতকাল মাঝ রাতে অনেকগুলো ডাকাত এসে দরজা ভেঙে বাড়ির সামান-পত্র আর আমিন সাহেবের দুজন মেহেমানকে চুরি করে নিয়ে গেছে। তাদের হাতে ইয়া বড় বড় ছোরা বল্লম দেখে আমি ভয়ে চিৎকার করতে পারিনি।
প্রতিবেশীরা অনেকেই উপদেশ দিল, কোতোয়ালকে গিয়ে নালিশ করো। ডাকাতকে তারা পাকড়াবার ব্যবস্থা করবে। কি করবে কি করা উচিৎ কিছুই ভাবতে পারে না। আমিন। এমন সময় একজন অচেনা লোক তার সামনে এসে বললো, শোনও, তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে।
একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে বললো, ডাকাতদের আস্তানা আমি জানি, যাবে আমার সঙ্গে… এসো।
আমিন যেন হাতে স্বৰ্গ পায়, বলে, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই যাবো চলুন।
হাঁটতে হাঁটতে তারা ট্রাইগ্রীসের ধারে এসে পড়ে। লোকটি বল, ওপারে যেতে হবে। একটা নৌকায় চেপে ওপরে গিয়ে নামে। তারপর আলিগলি একে বেঁকে এমন এক গোলক ধাঁধার মধ্যে আমিনকে নিয়ে গিয়ে হাজির করে, যেখান থেকে ছেড়ে দিলেও সে বেরিয়ে আসতে পারবে না।
একটা পোড়ো বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। লোকটা ট্যাক থেকে চাবি করে করে তালা খোলে। আমিনকে সঙ্গে নিয়ে ভিতরে ঢোকে। আমিন দেখলো, দশজন সাণ্ডা-গুণ্ডা মার্ক লোক বসে বসে খানা পিনা করছে। আমিনকে বসতে বলে লোকটিও মুখ হাত ধুয়ে এসে ওদের সঙ্গে বসে পড়ে। বলে, খাবে নাকি? এসো।
আমিনের বেশ খিদে পেয়েছিলো। কিন্তু বসতে ভরসা হলো না। কি জানি, বিষ টিস যদি খাইয়ে দেয়। বলে, না খিদে নাই।
লোকটা হাসে, বিশ্বাস করতে পারছে না।–তাই না? আরে, আমরা ডাকাত হলেও লোক ভালো। স্বাচ্ছন্দে বসে খেতে পারে।
আমিনের হৃদকম্প শুরু হয়। লোকগুলো ডাকাত! এদিক ওদিক চেয়ে দেখে, নানা রকম মারাত্মক অস্ত্ব শস্ত্র রাখা আছে এক পাশে।
লোকটা বলে, কাল রাতে তোমার বাড়িতে আমরাই ডাকাতি করে এসেছি।
আমিন শিউরে ওঠে, তাহলে আমার মেহেমানদের কি—
–না মেরে ফেলিনি। তারা নিরাপদ আশ্রয়ে আছে। রাজপ্রাসাদেও তেমন সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের বন্দোবস্ত নাই—তেমনি ভাবেই তাদের রাখা হয়েছে। দেখতে চাও? একটু সবুর করো খানা শেষ হলে তাদের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেব। কিন্তু তার আগে একটা সত্যি কথা বলবে? ওরা কারা? কি ওদের পরিচয়? কিন্তু সাবধান, যা বলবে, সত্যি বলবে। মিথ্যে কোনও কথা বললে আমরা ধরে ফেলবো? এবং তার পরিণাম বড় খারাপ হবে।
আমিন আর কোনও কথা গোপন করলো না। সামস-আল-নাহার এবং আলীর সমস্ত বৃত্তান্ত খুলে বললো।
আর একবার ঝালাই করে নেয় লোকটা, তোমার সব কথা বিশ্বাস করতে পারি?
–একশোবার। এর এক বৰ্ণও বানিয়ে বলিনি।
এমন সময় পাশের একটা দরজা খুলে ঘরে এসে ঢুকলো সুলতানের কোতোয়াল। পরণের বেশবাসেই চেনা গেলো।
–তোমার সব কথা আমি পাশের ঘর থেকে শুনেছি। সব সত্যি বলেছো?
আমিনের তখন কাপড়-চোপড়ে অবস্থা। কাঁপতে কাঁপতে বলে, জী হুজুর, সব সত্যি।
কোতোয়াল বলে, ঠিক আছে, তুমি যেতে পারো।
লোকটিকে ইশারা করতেই দরজা খুলে আমিনকে নিয়ে বেরিয়ে আসে সে।
—এখন বুঝতে পারলে আমরা ডাকাত কিনা?
আমিন বলে বুঝেছি, আপনারা সবাই সুলতানের লোক।
লোকটি বলে, একথা তোমরা ভুলে গেলে কি করে? হয়তো বা কখনও আল্লাহর চোখেও ধুলো দিতে পারো, কিন্তু খলিফা হারুন-অল রসিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা চলে না।
এর পরের ঘটনা অতি সংক্ষিপ্ত। সামস-আল-নাহারকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো তার প্রাসাদে। আর বেচারী আলী-ইবন-বকর-এর গর্দান গেলো সুলতানের হুকুমে।
এইখানেই এ কাহিনীর পরিসমাপ্তি ঘটতে পারতো। কিন্তু আরও একটু বাকি ছিলো।
সামস-আল-নাহার কে আদর-সোহাগ করে খলিফা বললেন, আমি তোমার সব গোস্তাকি মাফ করে দিলাম, নাহার। ভুল মানুষ মাত্রেরই হয়। তাই বলে তার কি সংশোধন নাই? আমার ভালোবাসা তুমি ঠিক বুঝতে পারেনি, সোনা। তাই অন্য দিকে হাত বাড়িয়েছিলে? কিন্তু বিশ্বাস করো, জীবনে আমি কখনও মিথ্যা বলি না, তোমার আমি প্ৰাণ দিয়ে ভালোবাসি। তুমি আমার প্রাণাধিক প্রিয়া।
তাঁর কথা শেষ হতে না হতেই সামস-আল-নাহারের দেহটা খলিফার কোলে ঢলে পড়ে জহরে নীল হয়ে যেতে থাকে। ওর স্বর চাপার মতো দেহখানা।