সহস্র এক আরব্য রজনী – ১১ (আলীনূর ও আনিস-অল-জালিসের কিস্সা)

›› আরব্য রজনী  ›› ১৮+  

এক সময়ে বসরোহর সিংহাসনে সুলতান মহম্মদ ইবন সুলেমান অল অধিস্ঠিত ছিলেন। দীন দুঃখীদের প্রতি দরদ ছিলো তার অপরিসীম। তার মতো ধর্মপ্ৰাণ সুলতান সে সময়ে খুব কমই ছিলো।

সুলতানের দুই উজির। একজনের নাম সাবীরের পুত্র মইন আর একজন কা-কনের পুত্র অল-ফাদল। তিনি ছিলেন খুব দয়ালু, সৎ এবং জ্ঞানী। যে কেউ যে কোনও সমস্যা নিয়ে হাজির হলে তিনি তা ধৈর্য সহকারে শুনতেন এবং তার যথাযোগ্য সমাধান করে দিতেন। কিন্তু অন্য উজির মইন ছিলেন ঠিক তার উল্টো। কোনও লোককেই সহ্য করতে পারতেন না। বিনা কারণে চটে যেতেন। এবং লঘু অপরাধে গুরু দণ্ড বিধান করতেন।

প্রজারা মইনের প্রতি যেরূপ অপ্রসন্ন ছিলো, সেই রকমই ভালোবাসা ভক্তি ছিলো অল-ফাদলের প্রতি।

একদিন মহম্মদ ইবন সুলেমান শুনলো, বসরোহর বাজারে ভালো ভালো ক্রীতদাসী এসেছে। অল-ফাদলকে ডেকে সুলতান বললেন, তুমি নিজে যাও, দেখে শুনে একটা খুবসুরৎ ক্রীতদাসী কিনে নিয়ে এসো। দেখতে শুনতে এমন হওয়া চাই, যেন সবাই তারিফ করে। সবার সেরা হওয়া চাই। শুধু দেখতে সুন্দর হলেই চলবে না, স্বভাব চরিত্র খুব ভালো হওয়া দরকার।

এমন একটা কাজের ভার তার প্রতিদ্বন্দীকে দেওয়া হচ্ছে দেখে মইন ক্ষুব্ধ হয়। একটু রাগত স্বরেই বললেন, কিন্তু জাঁহাপনা, আপনার যেমন পছন্দ সেরকম একটা ক্রীতদাসী কিনতে গেলে দশ হাজার মোহরের কমে পাওয়া যাবে না।

সুলতান মইনের এই গায়ে পড়ে কথা বলায় বিরক্ত হন। খাজাঞ্চকে ডেকে বললেন, কোষাগার থেকে দশ হাজার মোহর অল-ফাদলকে দাও।

খাজাঞ্চী মোহর নিয়ে এসে দিলো। সুলতান বললেন যাও অল-ফাদল, বাজারে যাও। যা বললাম ঠিক সেইরকম হওয়া চাই।

সুলতানের হুকুম শিরোধার্য করে অল-ফাদল বাজারে চলে গেলেন। সব দালালদের ডেকে জানালেন তার চাহিদা। দালালরা শুনে বললো, কিন্তু হুজুর সেরকম ক্রীতদাসী তো এ বাজারে নাই। এখন যা আছে তার মধ্যে সবচেয়ে যেটা সেরা দাম হতে পারে বড়জোড় হাজারখানেক দিনার।

আল-ফাদল বললেন, ঠিক আছে, খুজে পেতে দেখো, যা ভালো পাও নিয়ে এসো।

সারাদিন খুঁজেও তেমন কোন মেয়ে পাওয়া গেলো না, যা হাজার দিনার দিয়ে কেনা যায়। দালালরা বললো, হুজুর এই মাসের শেধ্যে একটা চালান আসবে। সেই চালানে কিছু ভালো মেয়ে পাবেন। তার মধ্যে থেকে বাছাই করে নিলে হয়তো সুলতানের পছন্দ হতে পারে। অল-ফাদল ফিরে গেলেন। সুলতানের কাছে আরও কিছু সময় প্রার্থনা করে বললেন, আপনি আর কয়েকটা দিন সময় দিন আমাকে। এই মাসের শেষে ভালো ভালো মেয়েছেলে আসার কথা আছে!

সুলতান বললেন, ঠিক আছে অপেক্ষা করবো। কিন্তু তোমাকে যা বলেছি—দুনিয়ার সেরা মেয়ে হওয়া চাই!

কিছুদিন পরে এক দালাল এসে বললো, হুজুর, আপনি যা চাইছেন, সেইরকম একটা মেয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে।

আল-ফাদল বললেন, যত তাড়াতাডি পারো আমার প্রাসাদে নিয়ে এসো তাকে। আমি আগে দেখবো, তারপরে সুলতানকে দেখাবো।

ঘণ্টাখানেক বাদে একটি মেয়েকে সঙ্গে করে সেই দালাল হাজির হলো অল-ফাদলের প্রাসাদে। মেয়েটি বেশ লম্বা এবং তষী। প্রশস্ত নিতম্ব, সরু কোমর সুগঠিত স্তন, কাজল কালো টানাটানা চোখ। আপেলের মতো সিঁদুরে, মসৃণ চিবুক। মুখে তার হাসি লেগেই আছে। আর হাসলে পরে গালে এক অদ্ভুত সুন্দর টোল খায়। গায়ের রং দুধে আলতায়। মেয়েটা কারণে অকারণে খিলখিল করে হাসতে থাকে। দাঁতগুলো ওর ধবধবে সাদা মুক্তোর মতো। আঙ্গুরের মতো টসটসে ঠোট। গুণ গুণ স্বরে গানের কলি ভাজছিলো সে। আহা, কি মিষ্টি তার কণ্ঠ।

অল-ফাদল ভাবেন, এমন রূপের হাট, সুলতান দেখলে নিৰ্ঘাৎ পছন্দ করবেন। একেবারে ভরা যৌবন-ডাসা পেয়ারা।

অল-ফাদল জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী?

–আনিস-অল-জালিস।

নামের মানে—মধুমিতা। দেখে এবং তার কণ্ঠস্বর শুনে মুগ্ধ হলেন উজির। দালালকে জিজ্ঞেস করলেন, কী দাম?

দালাল বললো, ওর মালিক বলেছে দশ হাজার দিনার। আমার মনে হয় দামটা এমন কিছু বেশী বলেনি সে।

উজির বললেন, ঠিক আছে, তুমি এক কাজ করো। ওর মালিককে ডেকে নিয়ে এসো। টাকাটা আমি ওর হাতে দেবো।

দালাল নিয়ে এলো মেয়েটার মালিককে। উজির দেখলেন, লোকটি বয়সে বৃদ্ধ। কিন্তু বড় সৌখিন। জাতে পারসিক অল-ফাদল জিজ্ঞেস করলেন, কতো দাম নেবে মেয়েটার?

লোকটি বললে, সুলতান যদি ইচ্ছা করেন, বিনামূল্যেই দিতে পারি। তবে দাম যদি জিজ্ঞেস করেন, দশ হাজার মোহরই নেবো। তাকে আমি নবাব বাদশাহদের যোগ্য মানুষ করেছি। আরবী এবং পারসী সাহিত্যে তার ভালো দখল আছে। অঙ্ক, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন, আইন, সমাজবিদ্যায় তার তুল্য পারদশী খুব কমই পাবেন হুজুর। আমি তার লেখাপড়া বিষয়ে কোনও কার্পণ্য করেনি। তার চরিত্রে কোন খুঁত খুঁজে পাবেন না। আচার ব্যবহারে সে সকলের মনে জয় করতে পারবেন, এ বিশ্বাস আমি রাখি। সবচেয়ে বড়, তার রসবোধ। এমন সূক্ষ্ম রস-জ্ঞান অনেকেরই হিংসার বস্তু। এবং এই কারণেই তার নাম মধুমিতা।

উজির বললেন, তোমার কোন কথাই অবিশ্বাস করছি না। এই নাও, দশ হাজার মোহরই। দিলাম, গুণে দেখো।

পারসিক লোকটি টাকাগুলো গুণতে গুণতে বললো, আপনাকে একটা কথা বলি, মেহেরবানী করে আজই ওকে সুলতানের সামনে দাঁড় করাবেন না। পথশ্রমে ও ভীষণ ক্লান্ত। ওর রূপের জেল্লা কিছুটা স্নান হয়ে গেছে। দশটা দিন ওকে আপনার কাছে রাখুন। একটু বিশ্রাম করুক। স্নানটান সেরে নতুন সাজপোশাক পারুক। তারপর দেখবেন আজ যা দেখছেন তার চেয়ে অনেক বেশী সুন্দরী হয়ে উঠবে সে। তখন সুলতান তাকে দেখলে আপনার ওপর আরো খুশি হবেন।

বৃদ্ধের পরামর্শ গ্রহণযোগ্য মনে হলো উজিরের। নিজের প্রাসাদের একটা সুসজ্জিত কক্ষে তার বিশ্রামের ব্যবস্থা করলেন।

উজির অল-ফাদলের একটি পুত্র ছিলো। তার মতো রূপবান যুবক সচরাচর চোখে পড়ে না। ধবধবে ফর্সা গায়ের রং। সুঠাম দেহের গড়ন। টানাটানা চোখ উন্নত নাসিক প্রশস্ত ললাট। ঘন কালো কেঁকড়ানো চুল।

ছেলেটির নাম আলী নূর। মধুমিতা সম্বন্ধে সে কিছুই জানে না। কত টাকায় কেনা হয়েছে এবং কার জন্যে কেনা হয়েছে তার কোনও খবরই সে রাখে না।

উজির মেয়েটিকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বললেন, আজ থেকে দশ দিন তুমি এইখানেই থাকবে। পথের ক্লান্তি কাটিয়ে নাও। তারপর তোমাকে সুলতানের সামনে নিয়ে যাবো। কিন্তু একটা কথা, তোমাকে সাবধান করে দিয়ে যাচ্ছি। আমার একটি ছেলে আছে-পাজি বদমাইশ। কিন্তু দেখতে সুন্দর সুপুরুষ। তুমি কিন্তু নিজেকে খুব শক্ত করে রাখবে। তার মোহে নিজেকে বিলিয়ে দিও না। তাহলে সুলতানের কাছে আমি বে-ইজত হবো। সে এমনি যাদু জানে, মেয়েরা তাকে দেখলেই মজে যায়। আমার পুত্র এ মহল্লার একটি মেয়েকেও আস্ত রাখেনি। মেয়েগুলো আপনা থেকেই পতঙ্গের মতো উড়ে পড়ে তার রূপের আগুনে। আমার শ্ৰীমান তাদের প্রত্যেককে দগ্ধ করে মারে। এই তার কাজ। তুমি খুব সাবধানে থাকবে। ঘরের দরজা খুলে একা বাইরে যাবে না। খোজাকে বলে রেখেছি, তোমার পাশেই থাকবে সে। তোমার যা প্রয়োজন, তাকে বলো, সেই সব করে দেবে। তোমার গলার আওয়াজ যেন ঘরের বাইরে না যায়। একবার যদি সে জানতে পারে তুমি আছে। এখানে, তাহলে আর রক্ষে নাই। সে তোমার সামনে এসে দাঁড়ালে তাকে আর কোনও চেষ্টা চরিত্র করতে হবে না, তুমি নিজেই তোমার নিজেকে হারিয়ে ফেলবে।

মধুমিতা বিনীতভাবে ঘাড় নেড়ে বললো, আপনি যা বললেন তাই হবে।

কিন্তু বিধির লিখন কে করে খণ্ডন! পরদিন মধুমিতা গোসলের জন্যে বামন-খোজার সঙ্গে হামামে গেলো। আতর মেশানো জলের ফোয়ারার নিচে দাঁড়িয়ে স্নান করলো। সারা গায়ে সাবান মাখিয়ে দিলো খোজা। এমন বিলাসবহুল গোছালের কথা শোনেওনি কখনও। আজ প্রথম প্রত্যক্ষ করলো। নতুন সাজ-পোশাক পরে হাতে মেহেদী, নখে পালিশ পায়ে আলতা, কপালে টিপ, চোখে সুর্ম কাজল লাগিয়ে হামাম থেকে বেরিয়ে এলো সে। উজির সামনে থাকলে চিনতেই পারতেন না। তার এমন রূপের বাহার খুলেছে তখন। খোজারা তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলো উজিরের বিবির কাছে। এই তিনি প্রথম দেখলেন মেয়েটিকে। উজিরের বিবি মধুমিতাকে দেখামাত্র এগিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলেন। পালঙ্কে নিয়ে গিয়ে বসলেন, তোমার রূপের আলোয় দেখো কেমন ঘর ভরে গেছে। এত রূপ তুমি কোথায় পেলে মধুমিতা? এমন যার নিজের রূপ, কি দরকার তার এত সাজে?

মধুমিতা বিগলিত হয়। রূপের প্রশংসা করলে কে না মুগ্ধ হয়? বলে, আপনি মা। মা-এর চোখে মেয়ে চিরদিনই সুন্দর। আল্লাহ। আপনাকে সুখে রাখুন, মা।

আলী নুর-এর মা মধুমিতার জন্যে শরবৎ আর মিষ্টি আনতে বললেন। শরবৎ মিষ্টি এলো। মধুমিতা খুব তৃপ্তি করে খেলো। আলী নূরের মা বললেন, মা, তুমি একটু বিশ্রাম করো, আমি

হামামে যাচ্ছি গোছল সেরে আসি।

দুটি বামন খোজাকে পাহারায় বসিয়ে তিনি তার পরিচারিকদের সঙ্গে নিয়ে হামামে চলে গেলেন। খোজা দু’টোকে বলে গেলেন, ঘরে যেন কেউ না ঢোকে। নূরের মা চলে গেলে মধুমিতা সাজ-পোশাক ছেড়ে বিবস্ত্রা হয়ে পালঙ্কে শুয়ে পড়লো।

একটুক্ষণ পরে নূর এসে ঢুকলো প্রাসাদে। বাইরে থেকে ফিরে প্রথমে সে মা এর সঙ্গে দেখা করে। এটা তার চিরকালের অভ্যাস। মা-এর ঘরের দরজার সামনে আসতেই দেখে দুটি বামন-খোজা পাহারা দিচ্ছে। নূর জিজ্ঞেস করে, কিরে তোরা আজ এখানে?

–জী হুজুর মা-জী হামামে গেছেন, তাই—

–মা-জী হামামে গেছেন, তা তোরা এখানে বসে কি করছিস।

—আমাদের ছোেটা মালকিনকে পাহারা দিচ্ছি, হুজুর।

–ছোটা মালকিন? সে আবার কে?

—জী, মধুমিতা, নতুন এয়েছেন। কেন, হুজুর, আপনি জানেন না? উজির সাহেব-আপনার বাবা দশ হাজার মোহর দিয়ে কিনে এনেছেন আমাদের সুলতানের জন্য।

নূর ঘরের ভিতরে ঢুকতে যায়। খোজা দু’টো বাধা দেয়। বলে, আপনি ঢুকবেন না হুজুর। আমাদের গর্দান যাবে। মালকিন আমাদের বারণ করে গেছে, ঘরে যেন কাউকে ঢুকতে না দিই। যাবেন না হুজুর। যাবেন না–

কিন্তু নূর কি ওদের কথায় কৰ্ণপাত করার পাত্ব? দরজা ঠেলে সে ঢুকবেই। আর তাকে বাধা দেয় কার সাধ্য? বাইরে কার সঙ্গে খোজা দু’টো কথা বলছে—মধুমিত উৎকৰ্ণ হয়ে শুনতে থাকে। এ নিশ্চয়ই আলী নূর। উজির তাকে এই আলী নূর সম্পর্কে সাবধান করে দিলে গেছেন। ভীষণ বাজে ছেলে সে। তার সঙ্গে সে যেন কোনমতেই কথা না বলে। তার সামনে না যায়। সারা বাগদাদের একটা মেয়েও তার সতীত্ব বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি তার হাত থেকে। কী এমন চেহারা ঘু দেখে মেয়েরা পাগল হয়ে স্বেচ্ছায় নিজের দেহ বিলিয়ে দেয়? মধুমিতার দেখতে ইচ্ছে হয়। তবে এও ঠিক উজির সাহেব তাকে যা নির্দেশ দিয়ে গেছেন তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবে সে। আর তাছাড়া, এ পর্যন্ত কত সুপুরুষ ছেলেকেই তো দেখেছে। তারা সবাই তার রূপের আগুনে পুড়ে মরতে চেয়েছে। তারাও তো অনেকেই সুপুরুষ ছিলো। কিন্তু মধুমিতাকে কেউ টলাতে পারেনি। আর আলী নূর এমন কি কন্দৰ্পকান্তি যে তাকে দেখে সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে না। মধুমিত ভাবে, আচ্ছা দেখাই যাক না! সে যদি নিজে ঠিক থাকে। তবে একটা আলী নূর কেন, হাজারটা এলেও তার কিছু করতে পারবে না। পালঙ্ক থেকে এসে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে একটা পাল্লা একটু ফাঁক করে দেখে। মধুমিতার সারা শরীরে কেমন যেন শিহরণ খেলে যায়। একি! এমন রূপ কোনও পুরুষ মানুষের হয়? নূর এর চোখে চোখ পড়তেই তার সব তালগোল পাকিয়ে যায়। মাথাটা ঝিম ঝিম করতে থাকে। দেহ অবশ হয়ে আসে। কাম-বাণে জর্জরিত হয় সারা শরীর। মধুমিতা বুঝি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারবে না। দরজাটা বন্ধ করে পালিয়ে যেতে চায়। কিন্তু হাত ওঠে না।

নূরও অপলক চোখে দেখতে থাকে মধুমিতাকে। এমন নিখুঁত সুন্দরী সে তো সারা বসরাহতে একটাও দেখেনি। কত হাজার রূপসী নিজে থেকে এসে তার সামনে বিবস্ত্রা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজের যৌবন বিলিয়ে দিয়েছে তার পায়ে। তাদের মধ্যে, কাউকেই তো মনে করতে পারছে। না, এর পায়ের কাছে দাঁড়াতে পারে। এযে একেবারে ডানা কাটা হুরী। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়ে আলী নূর। ভীত শশকের মতো মধুমিতা ছিটকে সরে যায় ঘরের এক কোণে। দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁপতে থাকে। না না, সে কিছুতেই দেখবে না তাকে। উজিরের কাছে সে কথা দিয়েছে, নূর-এর সঙ্গে কথা বলবে না। তার হাতে ধরা দেবে না।

নূর এগিয়ে আসে।—কি গো সুন্দরী, মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে রইলে কেন? আহা, আমন চাঁদের মতো সুরৎ—একটু দেখাও। প্রাণভরে দেখে জীবন সার্থক করি।

মধুমিতা তখন কি করবে বুঝতে পারে না। হাতের আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে নূরকে দেখে। বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করতে থাকে। লোকটা কি জাদু জানে নাকি? তা না হলে সে কেন বলতে ‘পারছে না, তুমি ঘর থেকে বেরিয়ে যাও। কেন বলতে পারছে না, তোমার বাবাকে আমি কথা দিয়েছি, তোমার সঙ্গে কথা বলবো না, তোমার মুখ দেখবো না। মধুমিতা চেষ্টা করে কিন্তু মুখে কথা সরে না। আস্তে আস্তে পালঙ্কে গিয়ে বসে। নূর সামনে এসে দাঁড়ায়। থুতনিটা তুলে ধরে বলে, আমি দেখতে এতই খারাপ, মুখটা নিচু করে আছো কেন? দুটো কথা বলতেও আপত্তি? তাহলে আর কি উপায়। চলেই যাই।

নূর বেরিয়ে যাওয়ার ছল করে ফিরে তাকায়। মধুমিতা এবার খপ করে ওর হাত ধরে ফেলে। নূর ওর চোখের দিকে তাকায়। মধুমিতার চোখে করুণ মিনতি। মুখে কোনও কথা বলে না। চোখের ইশারায় বলে, পাশে বসে।

নূর হাসে। গা ঘেসে বসে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে। মধুমিতা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারে না, ছাড়িয়ে নিতে চায়ও না। সারা শরীরে এক অভূতপূর্ব পুলক জাগে। সেও দুহাত দিয়ে নূরকে আরও শক্ত করে চেপে ধরে বুকে। ঠোঁটটা কামড়ে ধরে। নূর এবার ওকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। মধুমিতা বলে, দাঁড়াও। আগে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসো।

আলী নূর উঠে এসে খোজা দু’টোর মুখের সামনে দাড়াম করে বন্ধ করে দেয় দরজাটা। খোজা দু’টো হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে, মালিক আপনি বেরিয়ে আসুন আপনার বাবা জানতে পারলে আমাদের গর্দান যাবে। মালিক, বেরিয়ে আসুন।

কিন্তু কে শোনে কার কথা। নূর আর মধুমিতা তখন অমৃত সায়রে সাঁতার কাটছে। খোজা দু’টো কাঁদতেকাঁদতে  বেগম সাহেবের হামামের দিকে ছুটে যায়। নূরের মা তখন হামাম-এ ঢুকেছেন। দাসী পরিচারিকা পরিবৃত হয়ে তিনি স্নান পর্ব সারছেন। খোজা দু’টো হামামের দরজায় করাঘাত করতে থাকে। ‘মা-জী শিগ্‌গির বেরিয়ে আসুন, সর্বনাশ হয়ে গেছে।’ কিন্তু বেগম সাহেব তখন বেরুবেন কি করে। তার গায়ে সাবান ঘসছে দাসীরা। এখনও সুস্থানের অনেক বাকী। একজন পরিচারিকা এসে দরজাটা একটু ফাঁক করে জিজ্ঞেস করে, এই মুখপোড়ারা, অতো চেন্নাছিস কেন? জানিস না, বেগম সাহেবা এখন বেআব্রু, গোছল করছেন?

একটা খোজা বলে, কিন্তু মেরে জানি, এদিকে সর্বনাশ হয়ে গেছে।

মেয়েটি এবারে মারমুখো হয়ে বেরিয়ে আসে, কে তোর ‘মেরে জান’ রে হতচ্ছাড়া?

—আহা অতো চটছো কেন সুন্দরী? না হয় মুখেই একটা কথা বললাম, তা বলে কি আর সত্যি সত্যিই তুমি আমার বিবিজন হতে পারো নাকি। আল্লাহ সাধ দিয়েছেন ষোলআনা—সাধ্য দেয়নি এক কণা।

—আহা! দুঃখু করিস নি, আমন করে দুঃখু করিস নি রে। আমি আল্লাহকে বলে দেবো, সে যেন পরের জন্মে তোকে একটা রাম পাঠা বানিয়ে পাঠায়। তা হলে তোর কি মজা হবে বল? সারা দিন রাত শুধু পাঠি পাল দিয়ে দিয়ে বেড়াতে পারবি। সাত জন্মের সাধ এক জন্মেই মেটাতে পারবি।

খোজাটা চটে যায়, এই-ভালো হবে না বলছি। গালাগাল করছে কেন?

—গালাগাল? ওমা, গালাগাল আবার কখন করলুম রে, বাঁদর?

—গালাগাল করলে না? এই তো এক্ষুণি রামপাঠা বললে!

-ওঃ এই কথা। রামপাঠা কি একটা গালাগাল হলো? আর এই বাঁদর বললাম, বোদরটা গালাগাল হলো না? ওটা বুঝি আদর হলো, নারে হাঁদা।

খোজাটা এবারে কেঁদে ফেলে। দাঁড়াও বেগম সাহেবকে বলে কেমন পিটানী খাওয়াই তোমাকে। আমাকে রামপীঠ বলেছে, আমাকে বাঁদর বলেছে।

মেয়েটা এবার খিলখিল করে হাসে।–আর কিছু বলিনি তোকে? ওরে মাথা মোটা তোকে যে আমি মুখপোড়া, হতচ্ছাড়া, হাঁদা বললাম সেগুলো তাকে বলবি নি?

খোজটা মাথা চুলকায়, একটু ফিক করে হেসে বলে, কি যে বলো, মেরে কলিজা, ওগুলো তো তুমি আমাকে আদর করে বলে।

মেয়েটা এবার মারতে হাত ওঠায়। মেরেই ফেলবো, তোকে আদর করতে যাবো কেন র‍্যাঁ-ছুঁছো? তার আগে জহর মুখে পুরতে পারবো না। তা যাক, কেন ডাকছিলি, বল।

খোজাটা দাঁতে জিভ কাটে। হেই বাবা, সব ভুলে মেরে দিয়েছি। ওদিকে তো কম্মো ফতে হয়ে গেলো।

মেয়েটা বুঝতে পারে না খোজাটার এই হেঁয়ালী। ভুরু কুঁচকে বলে, কিসের কম্মো ফতে হলো রে, কি বলছিস?

—মধুমিতা…

—মধুমিতা? মধুমিতা কী?

মধুমিতার কম্মো ফতে করে দিয়েছে এতক্ষণ

নিজের গাল নিজেই থাবড়াতে লাগলো খোজাটা। যে কথা বলার জন্যে সে ছুটে এসেছিলো, মেয়েটার সঙ্গে আশনাই করতে গিয়ে, সেই আসল কথাই সে ভুলে গেছে।

মেয়েটা এবারে অবাক হয়। সে কি রে? কে-?

খোজাটা বলে, ছোটা মালিক।

মেয়েটার মুখটা হা হয়ে যায়, আলী নূ-র-র…

এক মুহুর্ত। তার পরই চিৎকার করে ভিতরে ছুটে যায়, বেগম সাহেবা।–তাড়াহুড়া করে কোন রকমে সাজপোশাক করে ছুটে এলো বেগমসাহেবা। মধুমিতা তখন অসাড় অবসন্ন দেহে এলিয়ে পড়ে আছে পালঙ্ক শয্যায়। বেগম সাহেবা জিজ্ঞেস করলেন, নূর? সে কোথায়।

-চলে গেছে!

—তাকে তুমি ঘরে ঢুকতে দিলে কেন, মা? তোমাকে না তোতা পাখীর মতো পড়িয়ে গেলাম, যেই আসুক ঘরে ঢুকতে দেবে না?

-আমি দিইনি, মা। সে জোর করে ঢুকেছে।

–তারপর কী হলো?

মধুমিতা চুপ করে থাকে। বেগম সাহেবা গলা চড়িয়ে প্রশ্ন করেন। বলো, সেকি সর্বনাশ করে গেছে।

মধুমিতা বলে, সবই করে গেছে—আমার সবই নিয়ে গেছে সে।

তুমি কেন রাজি হলে, মা। এখন যদি উজির শোনেন, কী হবে?

—আমি কি করবো বলুন, আমি তাকে বারণ করেছিলাম। কিন্তু আমাকে সে অন্যভাবে বোঝালো।

—কী ভাবে? মধুমিতা বলে, আমি তাকে বললাম, তোমার বাবা আমাকে সুলতানের জন্যে দশ হাজার মোহর দিয়ে কিনে এনেছেন।

সে বললো, আগে সেই রকমই ঠিক ছিলো। কিন্তু সুলতান নাকি আমাকে গ্রহণ করবেন না। তাই উজির সাহেব ঠিক করেছেন। আপনার ছেলেকে উপহার দেবেন আমাকে।

—আর তুমি সেই কথা বিশ্বাস করলে? মধুমিতা কেঁদে ফেলে, আপনি বিশ্বাস করুন, মা। সে এমনভাবে বললো যাতে বিশ্বাস না। করে পারলাম না। তাছাড়া আমি তো বাদী। হুকুম তামিল করাই আমার কাজ।

বেগম সাহেব তখন রাগে ক্ষোভে দুঃখে নিজের গাল নিজে থাবড়াতে লাগলো।—এখন আমি কি করি। উজিরকে আমি কী বলবো? তার মতো শান্তশিষ্ট মানুষ হয় না। কিন্তু অন্যায় তিনি বরদাস্ত করতে পারেন না। তাছাড়া সুলতানের এই অসম্মান তিনি তো কিছুতেই সহ্য করবেন না। ছেলেকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলবেন।

এমন সময় উজির ফাদল ঘরে ঢুকলেন।–কী ব্যাপার তোমরা এমন কান্নাকাটি করছে। কেন? কী হয়েছে?

বেগম সাহেব কাঁদতেকাঁদতে  বললেন, আগে তুমি খোদার নামে হলফ করে কথা দাও আমি যা বলবো তার বাইরে কিছু করবে না। তা হলে কোনও কথা গোপন করবো না। সব খুলে বলবো। আর আমাকে কথা দিয়ে যদি তা না মানো তাহলে আমার মরা মুখ দেখবে।

উজির ফাদল খোদার নামে দিব্যি করে বললো, তুমি যা বলবে তার বাইরে আমি কিছু করবো না, বেগম। তুমি নিৰ্ভয়ে বল।

তখন বেগম সাহেবা আগাগোড়া সব ঘটনা খুলে বললেন তাকে। তার বদমাইশ ছেলে কিভাবে মধুমিতার ঘরে ঢুকে তাকে ধাপ্পা দিয়ে তার সর্বনাশ করে পালিয়েছে শুনে উজির মাথা! চাপড়াতে লাগলেন।–হায় হায় একি হলো আমার। এখন আমি কি মুখ নিয়ে সুলতানের কাছে দাঁড়াবো? রাগে দুঃখে নিজের জামার কাপড় ছিঁড়ে ফেড়ে কুটি কুটি করতে লাগলেন। বেগম সাহেবা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন।–নিজেকে শক্ত সংযত করো। এই বিপদের সময় ভেঙে পড়লে তো চলবে না। আমি তোমাকে দশ হাজার মোহর দিয়ে দেবো। নগদ যা আছে নাও, এবং বাদবাকী আমার গহনাপত্র বিক্রী করে দশ হাজার মোহর পূরণ করে সুলতানকে ফেরৎ দিয়ে দাও।

উজির বললেন, একি কথা বলছে নূর-এর মা। তুমি কি শুধু টাকার কথাই ভাবছো? টাকাটা আমার কাছে কিছুই না। আমি ভাবছি আমার ইজতের কথা। সুলতানের কাছে কি বে-ইজত। হবো, একবার ভাবো। হয়তো সুলতান ক্রুদ্ধ হয়ে আমার গর্দানও নিতে পারেন।

বেগম বললেন, কিন্তু সুলতানরা মধুমিতার কথা এখনও জানেন না। তাকে তো চোখে দেখেন নি। তিনি। সুতরাং মধুমিতাকে যে তার হাতে তুলে দিতে হবে তার কি কোন মানে আছে। আমি তোমাকে দশ হাজার মোহর দিচ্ছি। তুমি বরং অন্য একটা মেয়ে কিনে দাও তাকে। এতে তোমার জান প্রাণ ইজ্জত সবই ঠিক থাকবে। মধুমিতা যেমন এখানে আছে তেমনি থাক। ছেলেটাও বাউণ্ডুলে হয়ে যাচ্ছে। মধুমিতার রূপে তোমার ছেলে পাগল হয়ে গেছে। এবং ছেলেদের বশ করার মতে রূপ তার আছে।

উজির বাধা দিয়ে বললেন, কিন্তু নূরের মা, এটা তুমি বুঝছে না কেন চারদিকে শত্রুর অভাব নাই। সুলতানের আর এক উজির মাইন আমার খুঁত ধরার জন্যে ওৎ পেতে আছে। পাপ কখনো চাপা থাকে না। একদিন যখন তার কানে যাবে এই সব কথা সুলতানকে জানাতে কসুর করবে না। আমার কিভাবে সর্বনাশ হয় সেই পথই সে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

এই সময় রাত্রি অবসান হয়ে গ্র্যাসে। শাহরাজাদ তার গল্প থামায়।

 

পরদিন তেত্রিশতম রজনীর দ্বিতীয় প্রহরে আবার শুরু করে শাহরাজাদ।

তারপর শুনুন জাঁহাপনা, উজির ফাদল তার বেগমকে বললেন, তুমি বুঝতে পারছে না নূর-এর মা, উজির মাইন জানতে পারা মাত্র সুলতানকে ভাঙ্গানী দিতে আরম্ভ করবে। জাঁহাপনা আপনি যাকে আপনার একান্ত অনুগত এবং বিশ্বস্ত উজির বলে মনে করেন, সে কি চরম বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করেছে একবার শুনুন। আপনি যে দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা তাকে দিয়েছিলেন, সেই টাকায় সে দুনিয়ার সেরা একটি বাদী কিনেছিলো। কিন্তু তার পুত্র-এর খুব পছন্দ হওয়ায় তার ভোগের জন্য উজির ফাদল নিজের প্রাসাদেই তাকে রেখে দেয়। এবং বলে, সুলতানের তো হাজারটা বাঁদী রক্ষিতা আছে, তাদের দলে পড়ে মেয়েটার জীবনটাই বরবাদ হয়ে যাবে। আর বুড়ো সুলতান এই ষোড়শী যুবতীকে খুশিই বা রাখবে কি করে। এই বলে মেয়েটিকে ছেলে নূর-এর হাতে তুলে দিয়ে নিজের জেব থেকে টাকা দিয়ে আর একটা বাদী আপনার জন্যে যোগাড় করে এনে দিয়েছে। কিন্তু সে-মেয়ের নখের যোগ্য এ বাদী। এই হলো আপনার একান্ত বিশংবদ প্রিয়পাত্র উজির অল-ফাদলের কীর্তি-কাহিনী। মইন তোমার ছেলের গুণের কথাও বলতে ছাড়বে না। সে যে সারা বাগদাদের তামাম কুমারী মেয়ের সতীত্ব নষ্ট করেছে। এ কথা সে ফলাও করে বলবে। এবং মধুমিতা যে এখনও আমার প্রাসাদে নুর-এর অঙ্কশায়িনী রক্ষিতা হয়ে দিন কাটাচ্ছে তাও সে জানিয়ে দেবে। তখন? তখন কী হবে? সুলতান আমাকে গভীর বিশ্বাস করেন। তিনি হয়তো ভাববেন, মইন হিংসার জুলায় এসব মিথ্যে বানিয়ে বলছে। কিন্তু মইন-এর শয়তানী তো আমি জানি বেগম, সে তখন সুলতানকে বলবে, ‘ঠিক আছে আপনার যদি বিশ্বাস না হয় আমাকে হুকুম দিন তাকে ফাদল-এর প্রাসাদ থেকে এক্ষুণি তুলে এনে হাতেনাতে ভজিয়ে দিচ্ছি।’ সুলতান তখন কি বলবেন? তিনি অবিশ্বাসের হাসি হেসে বলবেন, ঠিক আছে যাও, নিয়ে এসো দেখি।’ মইন তখন লোক লস্কর নিয়ে এসে আমারবাড়ি তল্লাশী করে মধুমিতাকে তুলে নিয়ে যাবে সুলতানের কাছে। তখন তোমার এই মধুমিতা কি সুলতানের জেরার সামনে সত্যি কথা না বলে পোর পাবে। আর মধুমিতার মুখ থেকে যখন শুনবেন তিনি, আর কোন সন্দেহের অবকাশ থাকবে না। এই দাঁওটাই মইন খুঁজবে। সে তখন সুলতানকে বিষিয়ে দেবে, ‘জাঁহাপনা। আপনি যাকে একবিন্দু অবিশ্বাস করেন না, সে আপনার সঙ্গে কি সাংঘাতিক বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করেছে দেখুন। এবং আমি যে কতো অনুগত এবং হিতৈষী নোকর তাও আপনি প্রমাণ পেলেন।’ এরপর আমার ওপর সুলতানের আর কোন আস্থা থাকতে পারে না। এতকাল ধরে যে মান ইজ্জত আমার তৈরি হয়েছিলো তাসের ঘরের মতো এক ফুৎকারে তা ধসে। পড়ে যাবে। এবং সুলতান আমার প্রাণদণ্ডের বিধানও দিতে পারেন।

বেগম-সাহেব্বা তাকে বললেন, কবে কি ঘটবে না ঘটবে। আগে থেকেই তুমি অতোশতো ভাবছো কেন? আমি তুমি নূর আর মধুমিত এই ক’জন ছাড়া ঘটনাটা কেউ জানে না। জানবেও না। সুতরাং তোমার মইনই বা জানবে কি করে? আর সুলতানের কানেই বা বিষ সে ঢালিবে কি করে? তুমি কিছু ভেবো না, কেউ জানবে না। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো, তিনিই সব বিপদ কাটিয়ে দেবেন।

বেগমের কথায় উজির ফাদল কিছুটা শান্ত হন। কিন্তু পুত্র নূরের প্রতি ক্ৰোধ তার কমে না। একবিন্দু।

আলী নূর অনেক রাতে বাড়ি ফেরে। সে যখন মধুমিতাকে নিয়ে সুখের সায়রে ভাসছে সেই সময়ে, খোজা দু’টো চিৎকার করতে করতে হামামের দিকে ছুটে যায়। হামাম থেকে তার মা ফিরে আসার আগেই মধুমিতার মধু নিগড়ে খেয়ে ক্ষিপ্রবেগে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যায় সে। বুঝতে পারে ব্যাপারটা অনেক দূর গড়াবে। অনেক রাতে ফিরে সে নফর চাকরদের কাছেই সব শুনে নিলো। গা ঢাকা দিয়ে পা টিপে টিপে মেয়ে মহলে তার মা এর ঘরে গিয়ে ঢোকে। হাজার হলেও মায়ের মন, কোথায় গেলো, ফিরবে কি ফিরবে না। এই চিন্তায় ঘর বার করছিলো। ছেলেকে কাছে পেয়ে ধড়ে প্রাণ এলো। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলো। —এতরাত অবধি কোথা ছিলি, বাবা?

নূর বলে আব্বাজান খুব চটে আছেন, তাই না মা?

যে গুণধর ছেলে তুমি। বাপের মুখে চুনকালি দেবে। আর বাপ তোমাকে চুমু খাবে। যাও একবার তার সামনে, কেতিল করে ফেলবে।

নূর বললো, আমি এখান থেকে একেবারে চলে যাবো।

–সে কি, বাবা। না না, আমন কথাটি মুখে এনে না। তোমার কিছু ভয় নাই। হারেম ছেড়ে বাইরে যাবার দরকার নাই! তোর বাবার যতদিন না। রাগ পড়ছে আমার ঘরে আমার কাছেই থােক। তিনি তো খবর না দিয়ে এ মহলে কখনও আসেন না।

সেই রাত থেকে নূর তারি-মা-এর মহলেই রাত্রিবাস করতে লাগলো! মধুমিতা থাকে পাশের কামরায়। সারাটা রাত তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাটায়।

একদিন বেগম সাহেবা উজির ফাদলকে বললেন, আর কত দিন ক্ৰোধ নিয়ে থাকবে। ছেলে তো শুনবে কোনদিন দেশত্যাগী হয়েছে। তখন? তখন খুব সুখ হবে তোমার? আমি বেঁচে বর্তে থাকি তা কি তুমি চাও না।

উজির বাধা দিয়ে বলেন, আহা কী হলো? কী সব অলুক্ষণে কথাবার্তা বলো? তা কী করতে হবে বলে?

—ছেলে তোমার ভয়ে ভয়ে সারাদিন পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। অনেক রাতে এসে আমার ঘরে ঢোকে। ছেলে বড় হয়েছে। এখন কি আর সেই ছোটবেলার শাসন চলে? আজ রাতে তুমি আমার ঘরে থাকবে। ছেলে এলে তাকে ভালোভাবে বোঝাবে। এবার তাকে বদখেয়াল ছাড়তে হবে। বিয়ে শাদী করে সংসারী হতে হবে। মধুমিতা মেয়েটা বড় ভালো। অমন সুন্দরী মেয়ে তো তুমি সারা দুনিয়া ঢুড়েও যোগাড় করতে পারবে না। আর তোমার ছেলে তাকে ভালোওবাসে প্ৰাণ দিয়ে। ওর সঙ্গে শাদী দিলে ছেলে তোমার ঘরে থাকবে। তা হোক না পয়সা দিয়ে কেনা বাদী। অনেক খানদানী ঘরের ছুচোর কোত্তন তো আমার জানতে বাকী নাই। বাইরে সতীপনা দেখায়।

উজির বিরক্ত হয়। আঃ নূরের মা, তোমার মুখে কিছু আটকায় না!

বেগমের পরামর্শ মতো রাত্ৰিবেলা উজির তার ঘরে যায়। অনেক রাতে আলী-নূর ঢুকতেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি!–বদমাইশ বেত্তমিজ আজি তোকে খুনই করে ফেলবো।

বেগম সাহেবা হাঁ হাঁ করে ছুটে এসে চেপে ধরেন উজিরের হাত। তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে। ছেলেটাকে খুন করবে?

-হ্যাঁ আমি ওকে খুনই করবো। ও যদি নিজেকে না। শুধরায়, না ভালো হয়, আমন ছেলে থেকে আমার দরকার নাই।

বেগম বলেন, তুমি শান্ত হও। আমি ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ভালো পথে নিয়ে আসবো। ছেলেমানুষ ভুল না হয় করেইছে। তাকে তো বোঝাতে হবে কোনটা ভালো কোনটা মন্দ। তা না করে যদি আগেই এমন সাজা দাও কী ফয়দা হবে। ছেলেটা মরে গেলে আর ফেরৎ পাবে?

নূর বাবার পায়ের উপর পড়ে ছিলো। এবার মুখ তুলে ভয়ে ভয়ে বললো, আব্বাজান, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আমি আপনার পা ছুঁয়ে দিব্যি করছি আর কোনোও খারাপ কাজ করবো না। আপনার অবাধ্য হবে না।

উজির-এর মন নরম হয়। ছেলেকে টেনে তুলে পাশে বসান।–বাবা, এখন তুমি বড়ো হয়েছে, ভালো-মন্দ বুঝতে শেখে। লোকে তোমার নামে বদনাম দিলে বাবা হয়ে আমি সহ্য করি কি করে? এবার বিয়ে শাদী করে সংসারী হও। তুমি যে মধুমিতাকে ভালোবাসো তাতো কখনও বলেনি। মেয়েটি বড়ো ভালো। তার মতো রূপ ও গুণের মেয়ে আমি কোথাও দেখিনি। তুমি যদি আমাকে কথা দাও তাকে নিয়ে তুমি সুখে স্বচ্ছন্দে সংসার করবে তাহলে মধুমিতার সঙ্গে তোমার শাদী দিয়ে দেবো। কিন্তু একটা কথা, শাদীর পরে অন্য কোনও বদখেয়াল আমি বরদাস্ত করবো না। তাকে ঘরে ফেলে রেখে অন্য কোনও মেয়েকে নিয়ে বেলেল্লাপনা করতে পারবে না। তাকেই তোমার সারা জীবনের একমাত্র সঙ্গী করে রাখতে হবে। তাকে ঘরে রেখে আর কোনও মেয়েকে শাদী করে আনতে পারবে না।

আলী নূর বললো, না, আব্বাজান, তা হবে না। মধুমিতাকে ছাড়া অন্য কোনও মেয়েকে আমি ভালোবাসতে পারবো না; আমি ভালো হতে চাই। আপনি শাদীর ব্যবস্থা করুন।

সারা প্রাসাদে আনন্দের হিল্লোল উঠলো। আলী-নুর-এর সঙ্গে মধুমিতার শাদী হবে। উজির অল-ফাদল দশ হাজার মোহর দিয়ে অন্য একটা বাদী কিনে এনে সুলতানকে দিলেন। মহাজাঁকজমক করে নূর ও মধুমিতার শাদী হয়ে গেলো। এ খবর কিন্তু চাপা থাকলো না। দুষ্ট মইন সব খবরই জানতো। কিন্তু সুলতানের সামনে মুখ খুলতে সাহস করলো না। মইন ভাবলো, অল ফাদল সুলতানের সুনজরে আছে, এ সময় তার বিরুদ্ধে কোনও কথা বলতে গেলে কোন কাজ হবে না। বরং সুলতান তার উপর ক্ষিপ্ত হতে পারেন। ঝোপ বুঝে কোপ মারতে হবে। সুতরাং সুযোগের অপেক্ষায় থাকাই শ্রেয়।

সেই সুযোগ একদিন এসে গেলো। অল-ফাদল অসুখে পড়লেন। এবং সে অসুখ থেকে আর সেরে উঠতে পারলেন না। তিনি। মাত্র দুদিনের মধ্যেই দেহত্যাগ করলেন। মৃত্যুর আগে পুত্র নূর-কে ডেকে বললেন, বাবা আমার যাবার সময় হয়ে এসেছে। আমি চললাম। তোমার বয়স অল্প তাই ভয় হয়, দেখে শুনে ঠিক পথে চলতে পারবে কিনা। আল্লাহর উপর ভরসা রেখো। সৎভাবে জীবন যাপন করো। তারপর ন্যসীবে যা আছে তাই হবে। সবাইকে একদিন যেতেই হবে। চিরকাল এখানে কেউ থাকার জন্যে আসে না। আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে, এবার আমার যাবার পালা। তাই মনে কোনও শোক ক’রো না। যাবার আগে একটা কথা বলে যাই, মধুমিতা বড় ভালো মেয়ে। সে শুধু রূপসীই না, তার মতো বুদ্ধিমতী বিচক্ষণ মেয়ে আমি দেখিনি। সংকট কালে তার পরামর্শ নিও! সে তোমাকে সঠিক পথের সন্ধান করে দেবে। আল্লাহ একমাত্র সহায়। তিনি ছাড়া অন্য কোনও পথ নাই। তার প্রতি তোমার যেন ভক্তি থাকে, এই আমার একমাত্র ইচ্ছা।

বাসরাহ শহরে শোকের ছায়া নেমে এলো। উজির অল ফাদল দেহরক্ষা করেছেন। সারা শহর ভেঙে পড়লো।উজিরের প্রাসাদের সামনে! আবালবৃদ্ধ নারী চোখের জল ফেলতে লাগলো, তার মতো এমন একজন দীন দুঃখীর বন্ধুকে হারিয়ে আজ তারা শোকাহত।

যথাযোগ্য আড়ম্বরে পিতার শেষকৃত্য সম্পন্ন করলো নূর। আমির ওমরাহ এবং বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি শোক মিছিলে সামিল হলেন। নুর কোনও কার্পণ্য করলো না। প্রচুর অর্থব্যয়ে উপযুক্ত মর্যাদায় সমাহিত করা হলো তার পিতার মর-দেহ। সবাই বাহবা দিলো। যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান।

বাবার অবর্তমানে নুর শোকে ভেঙে পড়লো। আর সেই আগের মতো হৈ হান্না করে বেড়ায় না। নিজের প্রাসাদেই মন মরা হয়ে পড়ে থাকে। ভালো করে খায় না, কারো সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতে চায় না।

একদিন নূর তার ঘরে বসে বাবার স্মৃতিচারণ করছে এমন সময় কড়া নাড়ার শব্দে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। তারই সমবয়েসী একটি যুবক এসে ঘরে ঢুকলো। তার বাবার বন্ধুর ছেলে। নূর-এর সঙ্গে বেশ হৃদ্যতা আছে। ছেলেটি বললো, দোস্ত, এতো ভেঙে পড়ছে। কেন? মা-বাবা কারো চিরকাল বেঁচে থাকে না। কেউই এ সংসারে চিরদিনের জন্যে থাকতে আসেনি। সবাইকে একদিন ঐ পথে যেতে হবে। এর জন্যে শোক করো না বন্ধু। এই-ই দুনিয়ার নিয়ম। একে সহজভাবে মেনে নিয়ে নিজের দায়দায়িত্ব পালন করাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। আল্লাহর পয়গম্বর এই রকম নির্দেশই আমাদের দিয়ে গেছেন। এবার সব ঝেড়ে ফেলে, আবার হাসো গাও।

নূর কিন্তু বিষণ্ণতা কাটাতে পারে না। বন্ধুর কথার জবাবে কি বলবে তাও ঠিক করতে পারে না।

বন্ধু বলে, এক কাজ করো, একদিন সব ইয়ার-দোস্তদের নিমন্ত্রণ করো। খুব হৈ হাল্লা করে খানাপিনা করো। দেখবে সব শোক তাপ কেটে যাবে, আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবে।

আলী নূর ভাবলো, কথাটা মন্দ বলেনি সে। এই গুমোট ভাবটা কাটাবার জন্যে একটু হৈ হল্লা করা দরকার। নুর এর ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সংখ্যা জনা দশেক। একেবারে জীগরী দোস্ত যাকে বলে। এমন একদিন ছিলো, সারা দিনরাত তাদের সঙ্গে কাটিয়েছে সে। কথায় বলে না, এক গেলাসের ইয়ার। সেই রকম দশ জন বন্ধুকে খানাপিনার নিমন্ত্রণ করে একটু আনন্দ স্মৃর্তি করে মনের ভার লাঘব করবে। ঠিক করলো।

বন্ধু বললো তা হলে আর দেরি কেন, আজ সন্ধ্যা বেলাতেই বসা যাক একসঙ্গে?

আলী বলে, সেই ভালো। তাই ডাকো।

সেদিন বিকেল থেকে বৈঠকখানার বড় কামরাটা ভালো করে সাজানো হলো। খাবার টেবিলে পাতা হলো পাট ভাঙ্গা ধবধবে সাদা কাপড়। টেবিলের মাঝে মাঝে বাহারী ফুলদানী বসানো হলো। আতর তার গুলাব জল পিচকারী করে খুশবু ছড়ানো হলো সারা ঘরে সুগন্ধী আগর। আর বেলোয়াড়ী ঝাড়ে বাতি জ্বালানো হলো। যেন কোন উৎসব আসর।

এক এক করে বন্ধুরা এলো সবাই। দশজনই কেতা দূরস্ত সাজে সেজে গুজে এসে বসলো টেবিলে। দামী সরাবের পাত্ব পূৰ্ণ করে দিতে লাগলো বাবুর্চি, সাজিয়ে দিলো, কোপ্তা, কাবাব, চাপ তন্দুরী, মোরগ মসল্লাম এবং আরও অনেক বাদশাহী খানা। খুব মৌজ করে সরাব পান করলো সকলে। খুশির মেজাজে ঝলমল করে উঠলো সারা প্রাসাদ। অনেক দিন বাদে নূর যেন সাবার নূতন জীবন-আগের সেই মধুর জীবনের স্বাদ ফিরে পেলো। অনেক রাত অবধি চললো এই খানাপিনার উৎসব। যাবার সময় বন্ধুদের প্রত্যেককে দামী পোশাক উপহার দিলো আলী-নূর।

আবার হাসি গানে ভরে উঠলো আলী নূরের জীবন। প্রায় প্রতি দিন সন্ধ্যাবেলায় বাড়ির বৈঠকখানায় আসর বসে। কোনদিন আমীর। ওমরাহদের নিমন্ত্রণ করে আপ্যায়ন করে। আবার কোনদিন এসে জমায়েত হয় বসরোহরর বিখ্যাত সওদাগররা। সবাইকে সাদর অভ্যর্থনায় স্বাগত জানায় নূর। খানাপিনার আসর সরগরম হয়ে ওঠে। যারাই তার প্রাসাদে আসতে লাগলো, প্রত্যেককে। দামী দামী উপহার সামগ্ৰী বিতরণ করতে থাকলে সে। মধুমিতার কিন্তু গোড়া থেকেই খুব অমত ছিলো। সে বলতো, তোমার বাবা বিত্তবান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি এসব করতেন, তীর সাজতো। কিন্তু তুমি তার ছেলে, উজীর আমীর কিছুই হতে পারোনি, কিন্তু এইভাবে তার জমানো টাকা পয়সাগুলো উড়িয়ে দিচ্ছে, সেটা কি ঠিক হচ্ছে?

নূর আহত হয়। বলে দেখো, আমি উজিরের ছেলে, দীন ভিখিরির মতো আচার ব্যবহার তো আমার পোষায় না। এসব না করলে মান ইজত থাকে কি করে?

মধুমিতা বলে, তোমার যতদিন পয়সা আছে কিছুর অভাব হবে না। কিন্তু বসে খেলে কুবেরের ভাণ্ডারও একদিন শেষ হয়। তারপর কী করবে? তার চেয়ে বলি কি—এসব বন্ধ রেখে একটা কিছু ব্যবসা বাণিজ্য করো। এখনও যা আছে তা দিয়ে মোটামুটি একটা ভালো ব্যবসাই দাঁড় সরাতে পারবে। ব্যবসাতে লাভ হলে সেই টাকা দিয়ে তাদের আদর আপ্যায়ন করো না? তাতে তুমি বিপদে পড়বে না, কিন্তু এখন যা করছে, এতো আত্মহত্যার সামিল।

কিন্তু মধুমিতার এসব পরামর্শ তার ভালো লাগলো না। বললো তুমি বুঝতে পারছে না, মিতা, এইসব নামজাদা বড়লোকদের সঙ্গে দহরম-মহরম থাকলে তবেই ভালো মুনাফার ব্যবসা করতে পারবো। তা না হলে, ছোটোখাটো দোকানপাট করে কি এমন ফয়দা উঠানো যাবে? আর তাছাড়া ইয়ার বন্ধুদের হাতে রাখলে বিপদে আপদে তারা তো পাশে এসে দাঁড়াবে।

মধুমিতা ভাবে, নূর এক রঙিন স্বপ্নে বিভোর। এখন কোনও কথাই তার ভালো লাগবে না। খোয়াব যখন কেটে যাবে, তখন সে বুঝতে পারবে, দুনিয়া কি আজব জায়গা।

প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা আসর বসে, আলী-নূর-এর প্রসাদে। ইয়ার বন্ধুরা এসে হৈহল্লা করে খানাপিনা করে। ভালো ভালো উপহার সামগ্ৰী নিয়ে চলে যায়। এইভাবে একদিন জমানে টাকা সব শেষ হয়ে আসে। বাবুর্চি এসে বলে, মালিক, আজকের খানাপিনার ব্যবস্থা কি করে হবে? টাকা পয়সা যা ছিলো সবই ফুরিয়ে গেছে।

আলী নূর চিন্তান্বিত হয়। সন্ধ্যাবেলা বন্ধুরা এসে জড়ো হতে থাকে। কিন্তু খানাপিনা গান বাজনার কোন ব্যবস্থা না দেখে তারা অবাক হয়। নূর এগিয়ে আসে।–তোমরা আজ ভাবছো, কেন কোনও আয়োজন করা হয়নি। তবে শোনো, বন্ধুরা, আমার বাবার মৃত্যুর পর থেকে তার যা কিছু সঞ্চিত অর্থ ছিলো সবই আমি খরচ করে ফেলেছি। আজ আমি নিঃস্ব। হাতে একটা পয়সা নাই যে তোমাদের কোন আদর আপ্যায়ন করি। এখন ভাবছি, সবই তো শেষ হয়ে গেলো, এর পর কি করে চালাবো! তোমরা দশজন আমার জীগরী দোস্ত-প্ৰাণের বন্ধু! তোমরা আমাকে পরামর্শ দাও-কি করা যায়।

একজন বন্ধু বললো, কাল থেকে ভাই, আমার বিবির খুব জর। আমাকে এখুনি যেতে হবে। শুধু তোমাকে এই কথাটা জানাবার জন্যেই এসেছিলাম।

আর একজন বলে, আজ রাতে আমার বড়ভাই-এর ছেলের ছুন্নৎ। আমাকে সেখানে হাজির থাকতেই হবে। আর ভাই দেরি করতে পারছি না। আজকের মতো চলি। পরে আবার দেখা হবে, কেমন?

এইভাবে এক এক করে সব বন্ধুই তাদের ‘ভীষণ জরুরী।’ কাজের অছিলায় কেটে পড়লো। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই নূর দেখলো তার বৈঠকখানা ফাক-একা বসে আছে সে।

একটু পরে মধুমিতা এসে নুর-এর ঘাড়ে হাত রাখলো। গভীর চিন্তায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলো সে। মধুমিতার স্পর্শে সম্বিত ফিরে পায়।

-কী ভাবছো?

নূর বলে, আর কি ভাববো, মিতা, আমার কিছু নাই শুনে সবাই চলে গেলো।

–এমনটা যে ঘটবে, সেতো তোমাকে অনেক আগেই আমি বলেছিলাম। যতক্ষণ তোমার ট্যাক ভারি থাকবে ততক্ষণ তারা তোমাকে ঘিরে থাকবে। আর যখন বুঝতে পারবে, তুমি ফতুর হয়ে গেছে, তোমার একমাত্র বিশ্বস্ত কুকুর ছাড়া আর কেউ থাকবে না। তখন তোমার চোখে সোনালী রঙ। আমার কথা তোমার ভালো লাগেনি। কিন্তু সোনা, এখন বুঝতে পারছে, এই বঁদীর কথা বাসী হলে মিঠা লাগে।

আলী-নূর বলে, তুমি তো জানো মিতা, আমি আমার সর্বস্ব খরচ করে দিয়েছি আমার বন্ধুদের মনোরঞ্জনের জন্যে। তারা আমার কাছে যে যা চেয়েছে কখনও বিমুখ করিনি। দু’হাতে বিলিয়ে দিয়েছি বাবার যত সব মূল্যবান সংগ্রহ। আজ এই বিপদের দিনে তাদের কাছে গিয়ে যদি দাঁড়াই তারা কি আমাকে সাহায্য করবে না?

—না করবে না, মধুমিতা জোর দিয়ে বলে, কেউ করবে না। যারা এতোদিন ধরে মুঠো ভরে নিয়ে গেলো। আজ তাদের কাছ থেকে কানাকড়ি সাহায্য তুমি পাবে না। এই ভবিষ্যৎবাণী তোমাকে আমি অনেক আগেই করেছিলাম।

নূর মাথা নেড়ে বলে, না না, মিতা তুমি সবাইকে একই ছাঁচে ঢেলে দেখো না। আমার বন্ধুরা তেমন হবে না। আমি তো তাদের ছোটবেলা থেকে জানি। আমার দোস্তারা আমার জন্যে জানি কবুল করতেও কসুর করবে না।

—তোমার বন্ধুদের তুমি ছোটবেলা থেকে জানো, আর আমি তাদের চোখেও দেখিনি কখনও। কোনও আলাপ পরিচয় নাই। তবুও আমি তোমাকে যা বলে দিলাম, অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে নিও।

পরদিন সকালে আলী-নূর বন্ধুদের কাছে গেলো। উদ্দেশ্য, কিছু অর্থ সংগ্রহ করা। না হলে এমন অবস্থা–হাঁডি চড়বে না। প্রথমে এক বন্ধুর দরজায় কড়া নাড়তেই একটি নিগ্রো দাসী এসে খুলে দিলো, কাকে চান?

–তোমার মনিবকে বলে গিয়ে আলী-নূর এসেছে। মেয়েটি ভিতরে চলে গেলো। কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এসে বললো, মালিক বললেন, তিনিবাড়ি নাই।

সরল অবোধ মেয়েটির কথা শুনে হাসি পায়। আহা, বেচারী। ওকে যা বলতে বলে। দিয়েছে—তাই সে আওড়ে দিলো। নূর কিন্তু ওর বন্ধুর এমত ব্যবহারে আহত হয়। বাড়িতে থেকেও সে এইভাবে ছলনা করলো তার সঙ্গে। এই তার এতকালের প্রাণের বন্ধু, কি আর করবে, হাঁটতে হাঁটতে হাজির হলো আর এক বন্ধুর বাড়ি। নূরের আশা, তার এ বন্ধু নিশ্চয়ই ঐ অকৃতজ্ঞ বেজন্মাটার মতো হবে না। কিন্তু অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়। এক এক করে দশটি বন্ধুর দরজা থেকেই শূন্য হাতে ফিরে আসে সে।

মধুমিতা বলে, তোমাকে তো আগেই বলেছিলাম মালিক, কেউ হাত ওলটাবে না। ওরা হচ্ছে সু-সময়ের বন্ধু, অসময়ে কেউ কারো নয়। যাকগে, এখন তো বাঁচার পথ দেখতে হবে। প্রাসাদে ইত্য কিছু আসবাবপত্র আছে সব বেচে দাও। কি হবে এই সব দামী দামী আসবাব দিয়ে?

আলী নূর তাই করলো। কিন্তু বসে খেলে আর কতদিন চলে? কোনও দোকানপাট বা ব্যবসা বাণিজ্য কিছুই করতে পারলো না। ফলে, সে টাকাও একদিন ফুরিয়ে গেলো। আলী-নূর তার অদৃষ্টের কথা ভেবে চোখের জল আর রাখতে পারে না। মধুমিতা এসে ওকে জড়িয়ে ধরে।–তুমি কাঁদছো সোনা? কেঁদো না, তোমার চোখের জল আমি সইতে পারবো না। আমার কথা শোনো, তুমি তো জানো সারা আরব দুনিয়ার মধ্যে আমি সবচেয়ে সেরা সুন্দরী। সুলতানের ভোগের জন্য তোমার বাবা আমাকে দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে কিনে এনেছিলেন। আমাকে তুমি বাজারে নিয়ে চলো, বেচে দাও। আমার বিশ্বাস, এখনও তুমি সেই দামই পাবে। সেই টাকা দিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য করে নিজের পায়ে দাঁড়াও। সোনা, যেখানেই থাকি, আর যতদূরেই থাকি, তোমার আমার ভালোবাসায় চিড় খাবে না কোনোদিন। যদি আল্লাহর ইচ্ছা থাকে, আবার তবে আমরা দুজনে দু’জনকে ফিরে পাবো।

আলী-নূর বলে, না-না-না, সে কিছুতেই হয় না, হতে পারে না। আমি তোমাকে এক পলক না দেখলে বাঁচতে পারবো না।

মধুমিতা সান্ত্বনা দেয়, কষ্ট হবে জানি, কিন্তু পারতেই হবে তোমাকে। এছাড়া আমরা দুজনেই তো মরবো।

উজির অল-ফাদলের পুত্র আলী-নূর তখন জীবনধারণের উপায়ন্তর না দেখে মধুমিতাকে বাজারে নিয়ে গেলো। বসরাহর ওই ক্রীতদাসী বাজার তামাম আরবের মধ্যে সেরা। দেশ বিদেশ থেকে অনেক সুন্দরী রূপসী মেয়ের আমদানী হয় এখানে। বহু দূর দূরান্তর থেকে বাদশাহ, উজির আমীররা আসে মেয়ে কিনতে। একদিন মধুমিতাকেও আনা হয়েছিলো এই বসরাহর বাজারে। দশ হাজার মোহরে বিক্রি করে দিয়েছিলো তার মনিব। সুলতানের সেবাদাসী করার জন্যে উজির অল-ফাদল কিনেছিলেন এক দালালের কাছ থেকে। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, আজ আবার সে এসেছে এই বসরোহর বাজারে। বিক্রি হতে। আজকের বিক্রেতা তারই শাদী করা স্বামী আলী-নূর। আর দালাল সেই একই।

আলি-নূরকে দেখে এগিয়ে এসে কুর্নিশ জানালো লোকটা।–তা হুজুর, আপনি? কিরকম লেড়কী চাই বলুন, হুজুর।

আলী-নূর বলে, কিনতে চাই না, বিক্রি করতে এসেছি।

দালালটা অবাক হয়। আলী-নূর তাকে কাছেই একটা কাফেখানায় নিয়ে যায়। একটা কামরায় বোরখা ঢেকে বসেছিলো মধুমিতা। নূর বলে, নাকাবটা সরিয়ে সুরৎটা একটু দেখাও। দালাল এসেছে।

নাকাব সরাতেই চমকে ওঠে দালাল। একি! এ যে সেই মধুমিতা? আপনার বাবার কাছে দশ হাজার মোহরে বিক্রি করেছিলাম একদিন। কিন্তু এ বাঁদীকে আপনি পেলেন কী করে মালিক। এ তো সুলতানের খাস বাঁদী।

আলী-নূর মুখে তজনী চেপে চুপ করতে বলে দালালকে। কাফে-র বাইরে এনে বলে, ও যে মধুমিতা, ওকে যে সুলতানের বাঁদী করার জন্যে কেনা। হয়েছিলো, এসব কথা তুমি ফাঁস করবে না, এই আমার অনুরোধ। আসল ব্যাপার কী, সব তোমাকে খুলে বলছি আমি। কিন্তু চারদিকে আমার শত্রুর অভাব নাই। খুব গোপনে কাজ সমাধা করে দিতে হবে। আজ আমি বড় অভাবে তাকে বিক্রি করতে এনেছি। সে আমার প্রাণের বিবিজান। তার আদর্শনে আমি বাঁচবো না। কিন্তু তার কষ্টও আমি সহ্য করতে পারবো না। সে অন্য ঘরে যাক। সুখে সম্পদে থাক। সে কথা ভেবেও আমি খানিকটা সান্ত্বনা পাবো!

দালাল দুঃখ করে, সবই নাসীবের খেলা, হুজুর। আল্লাহ যখন যাকে যেভাবে রাখেন, সেইভাবেই থাকতে হবে। একদিন আপনার বাবার দয়ায় কতো মানুষের প্রাণ বেঁচেছে। আপনি তার ছেলে-দু’বেলা দুমুঠে খাবার-এর জন্যে আজ। আপনাকে কি করতে হচ্ছে। যাক, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, সবচেয়ে বেশী দামে যাতে বিক্ৰী হয় তার আমি কোসিস করবো।

বাজারের ঠিক মাঝখানে একটা শান বাঁধানো চবুতরা আছে। দালালরা এই চবুতরার উপরে দাঁড়িয়ে তাদের পণ্যের গুণ কীর্তন করতে থাকে। তখন ইতস্তত বিক্ষিপ্ত দেশ বিদেশের সওদাগররা-যারা নীলাম ডাকতে এসেছে, সবাই সেখানে জড়ো হয়। এক এক করে মেয়েদের নাকাব খুলে দেখানোর পালা চলে। তারপর ডাক শুরু হয়। একজনের দামের চেয়ে অন্যজন বেশী দাম হাঁকে। তার চেয়ে আরও কিছু বেশী দিতে চায় কেউ। তাকেও হটিয়ে দিয়ে আর কেউ হয়তো আরও বেশী দাম বলে। এইভাবে চলতে থাকে নীলামের ডাকাডাকি। সব শেষে যার দাম বেশী হয়, তাকেই দেওয়া হয়। সেই মেয়ে।

মধুমিতাকেও এনে দাঁড় করানো হলো সেই চবুতরার উপরে। তার পাশে দাঁড়িয়ে দালালটা তার গুণগান করতে থাকে।—এমন মেয়ে তামাম দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। একেবারে বেহেস্তের হুরী। আসমানের চাঁদ। আপনারা হয়তো এখানে আরও অনেক মেয়ে দেখেছেন, কিন্তু মুডি মিছরি এক করে গুলিয়ে ফেলবেন না। আমি যে মেয়েকে এখানে খাড়া করেছি, তার যেমন রূপ তেমনি তার গুণ। রূপে গুণে এমন লেড়কী আর একটাও নাই এই বসরোহর বাজারে। সারা বছরে তো অনেক মেয়েই আসে এ বাজারে-আপনারা দেখেছেন, কিন্তু আজ যাকে দেখলেন, তেমন মেয়ে কি আপনাদের চোখে পড়েছে কখনও? যাক, আমি আমার মালের গুণকীর্তন করতে চাই না। আপনারা সমঝদার আদমী-জহুরী, নিজেরাই চিনতে পারবেন। এখন আসুন মালিক, আপনারা নীলামের ডাক দিন।

এক সওদাগর এগিয়ে এসে ডাকলো, চার হাজার মোহর। আর একজনের ডাক শোনা গেলো, সাড়ে চার হাজার। দালালটা হো হো করে হেসে উঠলো, আসলী হীরা, সাড়ে চার হাজার-মাত্র সাড়ে চার হাজার? তা আপনারা খিদের, এক পয়সাও বলতে পারেন। কিন্তু এ দামে তো হীরে পাওয়া যায় না। সাহেব, হীরে ধোয়া পানি মিলতে পারে।

ঠিক এই সময়ে সুলতানের উজির মাইন যাচ্ছিলো বাজারের পথ দিয়ে। দূর থেকে মধুমিতা আর আলী-নূরকে লক্ষ্য করে কাছে এগিয়ে এলো। স্বগতভাবে গজগজ করতে থাকলো, বদমাইশটা সব উড়িয়ে দিয়ে এখন এসেছে শেষ সম্বলটা নীলামে তুলতে। এই মওকা। যেভাবেই হোক, মেয়েটাকে নিতেই হবে। তবেই সমুচিত শিক্ষা দেওয়া হবে, প্রতিশোধ নেওয়া হবে।–সেই অপমানের।

দালালের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে আভূমি আনত হয়ে কুর্নিশ জানালো মইনকে।-ফরমাশ করুন হুজুর।

মইন-এর মুখে ক্রুর হাসি। বললো, এই বঁদীটাকে আমি কিনতে চাই। কী দাম উঠেছে?

দালাল জানালো, এই সবে ডাক শুরু হয়েছে হুজুর। একজন চার হাজার আর একজন সাড়ে চার হাজার মোহর বলেছে। এই সময়ে আপনি এলেন।

মইন বলে, ঠিক আছে, আমি ঐ সাড়ে চার হাজারই দেবো। আর কারো কিছু বলার আছে।

মধুমিতা আজকের নীলামের সেরা বাদী। অনেক পয়সাওয়ালা সওদাগররা জড়ো হয়েছে, নীলাম ডাকবে বলে। কিন্তু সুলতানের এই বদমেজাজী শয়তান উজিরটাকে সবাই ভয় করে। তার ইচ্ছেয় বাদ সাধলে, ভিটেমাটি চাটী করে ছেড়ে দেবে সে। তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আর কেউ মুখ খুলতে সাহস করে না। দালাল বুঝতে পারলো, এত বড় সওদাটা আজ এখানেই ভেস্তে গেলো। শয়তান মইন যখন একবার হোত বাড়িয়েছে সে থাকা থেকে মধুমিতার আর রেহাই নাই। দালালকে নির্বক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মইনা ধমকে ওঠে।–কী হলো? ক্যাবলার মতো হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলে কেন? শুনতে পেয়েছে, বাদীটা আমি কিনলাম। চার হাজার দাম, আর তোমার দালালী পাঁচশো, এই মোট সাড়ে চার হাজার দিনার পাবে। দাও মেয়েটাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।

নূর দাঁড়িয়েছিলো দালালের পাশে। দালাল ফিসফিস করে বলে, মালিক, বরাত খারাপ। নেকড়েটা থাবা বাড়িয়েছে। বোধহয় জলের দরেই ছেড়ে দিতে হবে মধুমিতাকে। শয়তানটা আপনাকে ভালো করেই চিনতে পেরেছে। লোকটা আপনার বাবার সঙ্গে শত্রুতা করেছে। সারাজীবন। আপনার বাবার গুণের কদর করতো সুলতান, প্রজা, পরিষদ সবাই। এই অপদার্থ উজিরটা তা কোনোদিনই সহ্য করতে পারেনি। হিংসায় জ্বলেপুড়ে মরেছে। কোন কাজই সে জানতো না। জানতো শুধু কি করে নিরীহ মানুষ-এর উপর অত্যাচার চালাতে হয়। প্রজারা আল্লাহর কাছে অহরহ তার মৃত্যু কামনা করে। আজ শকুনটার চোখ পড়েছে মধুমিতার ওপর। আপনার বাবার ওপর আক্রোশ করেও তার একগাছি চুলও ছিঁড়তে পারেনি সে। কিন্তু আজ মওকা পেয়েছে। এতকালের বদলা সে আজ নেবে। শয়তানটা বুঝেছে মধুমিতা–আপনারই! কিন্তু মালিক, হুসিয়ার করে দিচ্ছি, যেভাবেই হোক, এই নীলামের ডাক খারিজ করে মধুমিতাকে নিয়ে আপনি ঘরে চলে যান। মইন যদি নিয়ে ও যায়। তাকে, সাড়ে চার হাজার কেন সাড়ে চার দিরহাম আপনি আদায় করতে পারবেন না তার কাছ থেকে। আজ তো সে আপনাকে একটা হুণ্ডি ধরিয়ে দিয়ে মধুমিতাকে নিয়ে চলে যাবে। তারপর বলবে, অমুক দিন এসো, টাকা দিয়ে দেবো। আপনি সেদিন গেলে ‘আর একদিন। এসো’ বলে একটা লম্বা তারিখ দিয়ে বিদেয় করে দেবে। সেদিন যখন যাবেন আপনার হাত থেকে হুণ্ডির কাগজটা কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে আপনাকে ভাগিয়ে দেবে। বেশী কিছু বলতে গেলে ডাণ্ডারবাড়ি খেয়ে ফিরে আসতে হবে। এ-সব আমি বানিয়ে বলছি না, হুজুর। এরকম ভুক্তভোগী লোক বসরাহতে অনেক আছে। তাদের কাউকে জিজ্ঞেস করলে আরও ভালো জানতে পারবেন। এখন মালিক, কিভাবে ঝামেলা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। তাই ভাবুন।

নূর বললো, আমার তো মাথায় কিছু আসছে না। কী করা যায়, বলে তো?

দালাল বললো, উজিরটা যখন জেদ ধরেছে, মধুমিতাকে সে নিয়ে যাবেই। আর আমিও গরীব সরীব মানুষ, উজির আমীরের হুকুম অমান্য করবো কি করে। তা হলে তো গর্দান নেবে। আপনি উজিরের ছেলে, মালিক। আমি মধুমিতাকে সঙ্গে করে যখন মইন-এর দিকে এগোতে থাকবো আপনি তখন ছুটতে ছুটতে এসে তার হাতটা খপ করে চেপে ধরে চেচামেচি শুরু করে দেবেন—এই নচ্ছার হারামজাদী, কোথায় যাস? তুই কি ভেবেছিলি, তোকে আমি সত্যি সত্যিই বেচে দিতে বাজারে এনেছিলাম। আর যাতে আমার সঙ্গে কখনও মুখে মুখে তর্ক না করিস, সেজন্যে তোকে একটু শিক্ষা দেবার জন্যে ভয় দেখাতে এসেছিলাম। চল,বাড়ি চল শিগ্‌গির। সোজা হয়ে মুখ বুজে থাকিবি। না হলে সত্যি সত্যি একদিন কিন্তু এই হাটে বেচে দিয়ে যাবো।চল, এখনবাড়ি চল। দরকার মনে করলে, এক আধটা চড়াচাপড়ও দিতে পারেন তাকে। এতে হয়তো পাজী উজিরটা বিশ্বাস করবে, না, আপনি ওকে ভয় দেখাবার জন্যেই বাজারে এনেছিলেন। সতি্যু সত্যি বেচার কোনও অভিপ্ৰায় ছিলো না।

নূর বললো, মতলবটো মন্দ ভাঁজোনি। দেখা যাক, কি হয়।

দালালটা যখন মধুমিতাকে নিয়ে মইন-এর দিকে এগোতে লাগলো, নূর ছুটতে ছুটতে এসে মধুমিতার গালে এক থাপ্নর বসিয়ে দিয়ে হাত ধরে হিডি হিডি করে টানতে টানতে বলে, এই বজাৎ মাগী, যাচ্ছিস কোথায়? ভাতারের বাড়ি? একেবারে মেরে হাড় গুড়ো করে দেবো। আর যদি কখনও বেয়াদপি করবি তো সত্যি সত্যি একদিন বেচে দিয়ে যাবো। এবারের মতো মাফ করে দিলাম। চল,বাড়ি চল। তোকে বেচে দেবো, এমন দীন ভিখারী আমি এখনও হইনি।

মইন হুঙ্কার ছাড়ে, কে রে আমরা খাজাঙ্খা? লম্বা লম্বা চাল বোল ঝাড়ছে? ঘরে তো হাঁড়িতে ছুঁচোয় ডন-বৈঠক মারছে, তার অতো আমীরি বুক্‌নি কিসের? আমার কি জানতে কিছু বাকী আছে, ভাবছো? তোমার ঘরে যে একটা কানাকড়ির মালও নাই তা আমার জানা আছে। এখন বাপের সুপুত্তুর হয়ে কেটে পড়ে। ওকে আমি নীলামে ডেকে নিয়েছি। ও আমার!

এই বলে মইন এগিয়ে এসে মধুমিতার হাত ধরতে যায়। আলী-নূর এতক্ষণ লোকটার কথাগুলো হজম করার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু মধুমিতার দিকে হাত বাড়াতেই মাথাটা কেমন বিগড়ে গেলো। মুহূর্তে স্থান-কাল-পাত্ব ভুলে গিয়ে মইনের উদ্যত হাতটা চেপে ধরে। একটু বাদে ছেড়ে দিয়ে বলে, যান,বাড়ি যান, এদিকে হাত বাড়বেন না।

তখন মইন রাগে থরথর করে কাঁপছে।–কী? এতো বড় আস্পর্দাঁ। আমাকে ধাক্কা দেওয়া? বাজারে আপনারা সবাই উপস্থিত আছেন, ভাই সব। আপনার সাক্ষী। কীভাবে সে আমাকে অপদস্থ অপমান করলো, আপনার স্বচক্ষে দেখলেন। এখন আমি যদি একটা ঘুষিতে ওর মুখটা তুবড়ে দিই, আপনারা কী বলবেন?

বাজারের উপস্থিত জনতার মধ্যে গুঞ্জন উঠলো। তারা বললো, আপনি হুজুর স্বয়ং উজির। আর উনিও কিছু কম না, উজির ফাদল-এর ছেলে। আপনাদের এই বাঘ সিংহের লড়াই-এর মধ্যে আমাদের সাক্ষী মানবেন না। আমরা ইত্যরজন, ওসব বড় ব্যাপারে মাথা গলাতে চাই না। আপনাদের যা অভিরুচি করুন। ওসব সাতে পাঁচে আমরা নাই।

আলী-নূর মনে ভরসা পায়। প্রচণ্ড এক ধাক্কা মেরে জীনসুদ্ধ মইনকে নিচে ফেলে দেয়। তার পর হাঁটুগেড়ে বসে এলোপাথাড়ি ঘুষি চালাতে থাকে ওর মুখে। তাগড়াই জোয়ান ছেলে নূর। মইন-এর বয়স হয়েছে—বুড়ো। সে কেন পারবে নূর-এর সঙ্গে। প্রচণ্ড ঘুষির ঘায়ে মইনের যে কটা দাঁত পড়তে বাকী ছিলো তাও খসে পড়ে গেলো। চোয়াল ফেটে, ঠোঁট কেটে রক্ত ঝরতে লাগলো! মইন প্রথমে ভেবেছিলো, একাই সে লড়তে পারবে নূর-এর সঙ্গে। কিন্তু নূর-এর এক-একটা আধমণি ঘুষির ঘা খেয়ে সে-ভ্বমানিমেষেই ভেঙে গেলো। তখন সে তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে।-কে আছো, বাঁচাও, আমাকে মেরে ফেলে দিলো।

নূর-এর তখন শরীরে অসুরের শক্তি ভর করেছে। দু’হাতে ঘুষি চালাতে থাকে সমানে। বুকে, পিঠে, পেটে তলপেটে-এবং সবশেষে অণ্ডকোষে। আর সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে যায় মইন। এতক্ষণ উজিরের প্রহরীরা দাঁড়িয়ে দেখছিলো, এবার তারা এগিয়ে যায় আলী-নূর-এর দিকে। কিন্তু বাজারের প্রতিটি লোক বাধা দেয়, ওসব উজির আমীর-এর লড়াই তোমরা কেন মাথা ঘামাচ্ছে, বাছা। কার সঙ্গে লড়াইটা হচ্ছে জানো? তোমাদের আগের উজির অল-ফাদলের ছেলে আলী নূর। সুতরাং বুঝতেই পারছে, ওদের বিবাদ একদিন মিটে যাবে, আবার গলায় গলায় ভাব হবে। কিন্তু তুমি আমি যেমন ছিলাম তেমনই চাকর নফর হয়েই থাকবো। উজিরের ছেলের গায়ে হাত তোলার জন্যে সুলতানের সাজা ছাড়াইনাম মিলবে না। এই বুঝে সুঝে আলী নূর-এর গায়ে হাত উঠাবে।

প্রহরীরা জানতো না। নূর-এর পরিচয়। যখন শুনলো, অল-ফাদলের ছেলে, দু’পা এগিয়েছিলো, এবার তিন-পা পিছিয়ে গেলো। আলী-নূর যখন দেখলো, লোকটা আর নড়ে না, শুন সুকৃষি মারা বন্ধ করেশান্ত হয়। মধুমিতাকে নিয়ে ভীড় ঠেলে হন হন করে বেরিয়ে যায় বাড়ির পথে।

একটু পরা মইন-এর জ্ঞান ফিরে আসে। পথের ধুলো আর দেহের রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে। সাজপোশাক ছিঁড়ে খুড়ে একশা। প্রাসাদে ফিরে এসে সুলতান মহম্মদ ইবন সুলেমান-এর পায়ের কাছে আছাড় খেয়ে পড়ে গেলো শয়তান উজিরটা।-শাহেন শাহ, আপনার সালতানিয়তে আজ আমাকে এইভাবে মার খেতে হলো? আমি আপনার উজির। আমার গায়ে হাত তোলা মানে সরকারকেই বেইজিত করা। আপনি ধর্মাবতার, আমি বিচার চাই।

সুলতান হতবাক। তার হুকুমতে বাস করে এমন দুঃসাহস কার হতে পারে? তার উজিরের গায়ে হাত তোলার স্পর্ধা কে রাখে? সুলতান ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন, কী হয়েছে উজির? খুলে বলে। তো। এখুনি আমি এর সমুচিত ব্যবস্থা করছি।

মইন তখন ইনিয়ে বিনিয়ে এক চমৎকার মিথ্যে গল্প খাড়া করলো সুলতানের সামনে।-হুজুর আমি বাজারের পথ দিয় যাচ্ছিলাম। দেখলাম, বাদীর নীলামের ডাক চলছে। একটা বঁদী আমার নজরে ধরলো। খুব রূপসী সুন্দরী। আমি ঠিক করলাম, ঐ বঁদীটা দিয়ে সুলতান সাহেবকে আমি নজরানা দেবো। আপনার হয়তো স্মরণ আছে, জাঁহাপনা, উজির অল-ফাদলকে আপনি দশ হাজার মোহর দিয়েছিলেন একটা সেরা সুন্দরী বাদী কেনার জন্য। এই মেয়েটা সেই সুন্দরী বঁদী। সারা আরবে এরকম আর একটা মেয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু আপনার বিশ্বস্ত উজির অল-ফাদল মেয়েটাকে কেনার পর আর আপনার হাতে তুলে দেয়নি। তার নিজের পুত্র আলী নূরের ভোগের জন্য তার প্রাসাদেই রেখে দিয়েছিলো। আপনাকে যে বঁদীটিা এনে দিয়েছিলো, সে-টা তার পরে কেনা। অল-ফাদল তার নিজের টাকা দিয়ে সেই মেয়েটি কিনে এনে দিয়েছিলো আপনাকে। আজ আলী নূর অভাবের দায়ে মেয়েটাকে বাজারে নিয়ে গিয়েছিলো নীলামে বেচে দিতে। দেখলাম, সাড়ে চার হাজার টাকা দাম উঠেছে। জাঁহাপনার জন্যে আমি ঐ টাকা দিয়ে কিনে নিলাম। কিন্তু আলী নূর আমার কাছে কিছুতেই বেচাবে না। আমার মা-বাপ তুলে গালিগালাজ করতে লাগলো। তার বক্তব্য, সে যে কোনও ইহুদী বা খ্ৰীষ্টান-এর কাছে কম টাকাতেও বেচে দেবে, তবু সুলতানের ভোগ্য পণ্য হতে দেবে না তাকে। তা সুলতান যদি তাকে পাল্লায় ওজন করেও সোনার মোহর দিতে চায়, তবু তাকে দেবে না। আমি তখন তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, সুলতান ন্যায্য দামে কিনতে চান, তাতে তোমার এত আপত্তি কেন? তার উত্তরে হুজুর, আলী নূর অশ্রাব্য ভাষায় আপনাকে গালিগালাজ করতে লাগলো। আপনি নাকি একটা বুড়ো হাবড়া শয়তান। আপনার হাতে পড়লে মেয়েটার জীবনই বরবাদ হয়ে যাবে। দোষের মধ্যে আমি এর প্রতিবাদ করেছিলাম, সুলতানের নামে এরকম গালিগালাজ করা তার উচিৎ না। সুলতানের কানে গেলে তিনি ক্রুদ্ধ হতে পারেন। তখন আলী-নূর ক্ষেপে গিয়ে আমাকে খচ্চরের পিঠ থেকে টেনে নামিয়ে ঘুষি লাথি মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেললো। আমি বুড়ো হয়েছি। অসহায়ের মতো তার হাতে একতরফা মার খেয়ে ফিরে এলাম। আমার লোকজন কিছু করতে সাহস করেনি, কারণ আলী-নূর আপনার প্রিয়পাত্র প্রাক্তন উজিরের পুত্র। জাঁহাপনা, আপনি স্বচক্ষেই দেখছেন, আমার শরীরের এই রক্তারক্তি কাণ্ড। এখন আপনার কাছে আমার নালিশ এর সুবিচার করুন।

সুলতান ক্ষণকাল চিন্তা করলেন। তারপর উজিরকে বললেন, জনা চল্লিশেক ফৌজ নিয়ে হানা দাও অল ফ্যদলের বাড়ি। যেভাবেই হোক নুর আর সেই মেয়েটাকে আমার সামনে হাজির করো। আর নূর-এর বাড়িঘর দোর বিষয় সম্পত্তি যা আছে–সব বাজেয়াপ্ত বলে ঘোষণা করে দাও।

মইন এইরকম আদেশই চেয়েছিলো। সুলতানকে কুর্নিশ করে বললো, জাঁহাপনার যেরূপ অভিরুচি। আমি এক্ষুণি তাকে গ্রেপ্তার করে আনছি। আর তার বাড়িঘর সব বাজেয়াপ্ত করে দিচ্ছি!

দরবারের এক তরুণ পারিষদ সুলতানের এই হুকুম শোনামাত্র দরবার থেকে সকলের অলক্ষ্যে বেরিয়ে পড়লো। এই ছেলেটি নূর-এর বাবা অল-ফাদলের বড় প্রিয়পাত্র ছিলো। তারই অনুগ্রহে এখানে এক উচ্চপদে বহাল হতে পেরেছে সে। আলী নূর-এর সঙ্গেও তার দারুণ ঘনিষ্ঠতা। রাস্তায় নেমে রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে লাগলো সে। একটানা দৌড়ে এসে নুর-এর প্রাসাদে কড়া নাড়লো। নূর তখন মধুমিতার সঙ্গে আলোচনা করছিলো। মধুমিতা বলছিলো, তুমি আজ যা করেছে, ভেবো না, ওখানেই ব্যাপারটা মিটে গেছে। উজির মাইন শুনেছি ভীষণ খারাপ লোক। এই মারের প্রতিশোধ সে নেবেই। এবং সে ক্ষমতাবান লোক। সত্যি মিথ্যে বলে সুলতানকে ভাঙ্গানী দিয়ে তার কাছ থেকে আমাদের নামে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা এনে ধরে নিয়ে যাবে। তারপর তোমরা নসীবে কি আছে সে আমি ভাবতে পারছি না, সোনা।

দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ দ্রুততর হয়। মধুমিতা বলে, ঐ শমন এসেছে।

নূর বলে দাঁড়াও, আমি দরজা খুলে দিচ্ছি, তুমি যেও না।

মধুমিতা বলে, না, তোমাকে যেতে দেবো না। তুমি খিড়কীর দরজা দিয়ে পালিয়ে যাও। নিয়ে যেতে চায়, আমাকে নিয়ে যাবে। তুমি পালাও।

নূর বলে, সে হয় না, মিতা, আমি তোমাকে ফেলে পালাতে পারবো না কিছুতেই।

মধুমিতা বলে, ঠিক আছে, আমাকে খুলতে দাও দরজা। তুমি পাশের ঘরে থাকে। আমার কথাবাতাঁর ধরন বুঝে যা ভালো বোঝা করো।

মধুমিতা দরজা খুলে দেখে, নুর-এর সমবয়সী একটি সুদৰ্শন ছেলে। —নুর কোথায়? আপনারা এখুনি পালিয়ে যান। শয়তান উজির মাইন আসছে গ্রেপ্তার করতে।

নূর এসে দাঁড়ালো। ছেলেটি বললো, আর দেরী করো না। নূর। যেখানে পারো এখুনি পালাও। সুলতানের হুকুমে চল্লিশজন ফৌজ নিয়ে মইন আসছে। এই নাও আমার কাছে চল্লিশটা দিনার আছে। এতে কতটা কি হবে জানি না। কিন্তু আর এক মুহূর্ত এখানে তোমাদের থাকা চলবে না। ওরা এক্ষুণি এসে পড়বে। তোমরা বেরিয়ে পড়ে।

মধুমিতা আর নূর সঙ্গে সঙ্গে খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে শহরের আলিগলি দিয়ে হন হন করে হেঁটে চলে। বড় রাস্তা দিয়ে যাওয়া যাবে না। লোকের চোখে পড়ে যাবে। এক সময় তারা বাসরাহর বন্দরে এসে হাজির হলো। সেই সময় একটা জাহাজ ছেড়ে যাচ্ছিলো বাগদাদে। খালাসীরা হাঁকিছে, কে যাবে বাগদাদে, চলে এসো, এখুনি জাহাজ ছাড়বে। নূর আর মধুমিত গিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই জাহাজটা ছেড়ে দিলো।

এদিকে মইন ফৌজ নিয়ে অল-ফাদলের প্রাসাদে এসে দেখে, পাখী পালিয়েছে। রাগে জ্বলে উঠলো। সে। হুকুম করলা, শহরের প্রান্তে প্রান্তে তল্লাসী চালাও। যেভাবেই হোক পাকড়াও করতেই হবে। উজিরের হুকুমে বসরোহর জনপথে ধূলি উড়তে লাগলো। সারা শহর তোলপাড় করে ফেললো ফৌজরা। যাকে সামনে পেলো, জেরা করলো। যাকে সন্দেহ হলো, গ্রেপ্তার করলো। কিন্তু কোথাও সন্ধান পাওয়া গেলো না তাদের। ওরা তখন বাগদাদের জাহাজের পাটাতনে বসে ভীরু কপোত-কপোতীর মতো বসরোহর বিলীয়মান বন্দরের দিকে তাকিয়েছিলো।

এই সময়ে রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

পরদিন চৌত্রিশতম রজনীর মধ্যরাতে আবার কাহিনী শুরু করলে সে।

জাহাজের পাটাতনে বসে দুই কপোত-কপোতী। তখন দূরে বিলীয়মান বন্দর বসরোহর দিকে তাকিয়েছিলো।

সারা শহর তোলপাড় করেও আলী নূর আর মধুমিতাকে না পেয়ে মইন ব্যর্থ মনোরথে সুলতানের কাছে গিয়ে কেঁদে পড়লো।—জাঁহাপনা, আমি যাওয়ার আগেই সে খবর পেয়ে গিয়েছিলো। কোথায় পালালো কিছুই বুঝতে পারছি না। সারা বসরাহ তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। কিন্তু না, কোথাও পেলাম না। কেউ বলতে পারলো না, কোন পথে তারা গেছে।

সুলতান গর্জে উঠলেন, অপদার্থ কোথাকার। এখুনি শহরের সব প্রবেশ মুখে ফৌজ মোতায়েন করো। প্রত্যেকটি মানুষকে ধরে ধরে তল্লাসী করো। পালাবে কোথায়? আমার সারা সলতানিয়তে হুলিয়া জারি করে দাও। যে ধরে দিতে পারবে তাকে মূল্যবান পোশাক আর নগদ এক হাজার সোনার মোহর ইনাম দেওয়া হবে। টাকার লোভে দেখবে ধরিয়ে দেবেই।

কিন্তু কে কাকে ধরিয়ে দেবে? যখন হুলিয়া জারি করে ফিরে এলো মইন, আলী নূর আর মধুমিতা তখন বাগদাদের বন্দরে পৌঁছে গেছে। কাপ্তেনকে অনেক সুক্ৰিয়া জানিয়ে ভাড়া বাবদ পাঁচটা মোহর গুজে দিলো তার হাতে।

সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে। বাগদাদে নেমে যে দিকে তাকায় চোখ জুড়িয়ে যায়। চারদিকে শুধু সবুজের সমারোহ। গাছে গাছে ফুল আর পাখীর মেলা। হাঁটতে হাঁটতে এক সময়ে একটা বিরাট বাগানের সামনে এসে দাঁড়ালো তারা। চারপাশ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা প্রকাণ্ড এক মনোরম বাগিচা। হাজারো রকম ফুলের গাছে। চেনা-অচেনা হাজারো রকম ফুলের বাহার! এমন মন ভোলানো দৃশ্য জীবনে দেখেনি নূর। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে জদুজনে। আহ কি অপূর্ব। বাইরে থেকে বোঝাই যায় না, ভেতরটা কত সুন্দর। চারপাশে দেয়াল দিয়ে সারা বাগিচাটা ঘেরা। আর দেওয়ালের মাঝে মাঝে টাঙানো ঝাড়বাতি। মৃদু মিষ্টি সবুজ আলে জুলছে। বাগিচার মাঝখানে একটা মস্ত বড় জলের ফোয়ারা। তার চারপাশ দিয়ে অনেকগুলো শান বাঁধানে চবুতরা।

নূর আর মধুমিতা ঠিক করলো রাতটা এখানেই কাটাবে। ঝরনার জলে হাত মুখ ধুয়ে একটা চবুতরার ওপর দুজনে চাঁদর চাপা দিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

ওরা জানতো না বাগিচাটা করে। বাগদাদের খলিফা হারুন-অল-রসিদ-এর অবসর বিনোদনের জায়গা এই বিনোদন-বাগিচা। খলিফা যখন শতকর্মে অবসাদগ্বস্ত হয়ে পড়েন, কিছুদিনের জন্য তখন তিনি এসে কাটান। এখানে। বাগানের এক পাশে একটি ছোট্ট হাবেলী। একেবারে নির্জন নিরিবিলি। এখানে দরবারের কোলাহল নাই, আছে শুধু ফুলের গন্ধ, ঝরনার কুলুকুলু পাখীর কাকলী আর প্রকৃতির অপোর সৌন্দর্য। হাবেলীর প্রধান কক্ষ মোট ৭২টি পয়তাল্লিশটি জানালা। আলো হাওয়ার প্রাচুর্যে ভরা। কক্ষের মাঝখানে একটা সোনার চিরাগদানী! হাজার মোমবাতি জ্বালানো যায়। প্রতিটি মোম সবুজ কাচের আচ্ছাদনে ঢাকা। বছরের বেশী দিনই এঘর অন্ধকারে ডুবে থাকে। আলোর বাহার-এ স্বপ্নপুরী হয়ে ওঠে মাত্র কয়েকটা দিন-যখন খলিফা আসেন। ঘরদের সাফ করা হয়। আলোর মালায় সাজানো হয় সারা বাগিচা; হাবেলী কক্ষ মনোরম হয়ে ওঠে। একটা শান্ত, মিষ্টি মধুর পরিবেশ গড়ে ওঠে সর্বত্র। খলিফা এসে বসেন পালঙ্কে। আর নিচে গোল হয়ে বসে সব গাইয়ে বাজিয়েরা, তানপুরাতে সুর বাজে। আর দেশ বিদেশের গুণী গাইয়েরা রাগ-রাগিণীর ইন্দ্রজাল রচনা করে। দুনিয়ার সেরা ওস্তাদ ইশাকও আসেন এই আসরে।

বাগানের মালীর নাম ইবরাহিম। সারাটা জীবন এই বাগানের দেখাশুনা করেই বুড়ো হয়ে গেছে সে। এইখানেই তার ঘর, এইখানেই তার সংসার। এই বাগিচার প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে আছে তার মমতা। প্রতিটি ফুলের গাছে জড়ানো রয়েছে তার আদর মাখা হাতের স্পৰ্শ। এ বাগিচার প্রতিটি লতাতিরুগুল্ম যেন তার এক-একটি সন্তান। বুকের কলিজা। বাইরের কাউকে ঢুকতে দেয় না সে। বাগিচার ফল ফুল ছিঁড়ে কেউ ছত্বখান করবে, তা সে কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারবে না। এই আশঙ্কায় বাইরের কারুরই প্রবেশ অধিকার নাই। ফটকের বাইরে বড় বড় হরফে সে-কথা লিখেও দিয়েছে সে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষ দু’টো এখানে এলো কেন? আর বলা নাই কওয়া নাই ঢুকেই সটান নাক ডাকিয়ে ঘুমুতে শুরু করলো। তাজ্জব ব্যাপার? ওরা কি জানে না, খলিফা তাকে কতখানি ক্ষমতা দিয়েছেন? তার অনুমতি ছাড়া যদি কেউ ঢোকে তাকে যে কোনও সাজা সে দিতে পারে? এ বাগিচায় শুধু খলিফার আত্মীয়স্বজন এবং অভ্যাগত অতিথি ছাড়া আর কারো প্রবেশ অধিকার নাই। আর ঐ যে চবুতরার ওপরে শুয়ে দিব্যি ঘুমুচ্ছে-ওখানে আসলে তো বাইরের কোন লোকের বসারই হুকুম নাই। ইবরাহিম রেগে আগুন হয়ে ওঠে। এত বড় আসপর্দা, দাঁড়াও মজা দেখাচ্ছি। বাছাধনদের। একটা পেঁপের ডাল কেটে চোঙ্গা বানালো।-’ওদের কানের কাছে ডালের নলটা ধরে ঘ্যাক করে এই–সা একটা আওয়াজ দেব-বাছাধনারা ভয়ে শিটিকে যাবে।’ কিন্তু কাছে যেতে ইবরাহিম কেমন মিইয়ে যায়। আহা, বোধ হয় অনেক পথ হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে বেচারিরা। আর তা ছাড়া মাথামুণ্ডু তো সব ঢাকা। না দেখে, না জেনেশুনে এরকম ব্যবহার কি করা ঠিক হবে? কে জানে, হয়তো ভিনদেশের কোনও মুসাফিরও হতে পারে। হতে পারে কোনও আমীর ওমরাহ। নলটা ওদের কানের কাছে ধরেও সরিয়ে নেয়। আগে ভালো করে দেখে নেওয়া দরকার। ইবরাহিম চাঁদরটা সরিয়ে দেয়। হায় আল্লাহ, এ কি! এতো কোনও সুলতান বাদশাহর ছেলে মেয়ে! এমন রূপ তো সাধারণ মানুষের হয় না! ঘুমে বিভোর হয়ে আছে যেন বাগিচার দুটি ফুল! ইবরাহিম ভাবে, এখন সে কি করবো? এমন সুন্দর চাঁদের মতো দুই নওজোয়ানকে সে চাবাঁকাতে চেয়েছিলো? ইবরাহিম যেন নিজের পিঠেই চাবুকের ঘা খায়।

চাদরটা দিয়ে আবার ওদের মুখ ঢেকে দেয়। ইবরাহিম। আলী-নূরের পায়ের কাছে বসে পায়ের ওপর হাত বুলাতে থাকে। আলী-নূর-এর ঘুম ভেঙে যায়। পায়ের কাছে এক বৃদ্ধ। সে তার পায়ে হাত বুলাচ্ছে। লজ্জা পেয়ে পা সরিয়ে উঠে বসে। ওর হাত দু’টো টেনে নিয়ে চুমু খেয়ে বলে, একি করছেন? আপনি বয়সে আমার বাবার চেয়েও বড়। এতে যে আমার পাপ হবে?

ইবরাহিম জিজ্ঞেস করে, কখন তোমরা এলে বাছা, কোথায় তোমাদের ঘর?

আলী নূর বলে, আমরা বিদেশী পথিক। চলতে চলতে রাত হয়ে গেলো। তাই এই বাগিচায় ঢুকেছি, রাত কাটাবো বলে। সকাল হলেই চলে যাবো।

ইবরাহিম বলে, তোমরা মুসাফির, আমার মেহমান। আমি আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থে পড়েছি, তিনি বহু জায়গায় নির্দেশ দিয়েছেন, ‘যারা পথশ্রমে ক্লান্ত, যারা পরদেশী তাদের মেহেমান জ্ঞান করে যথাযোগ্য আপ্যায়ন করবে।’ আল্লাহর এই বাণী আমি অবহেলা অবজ্ঞা করবো কি করে,  বাবা? তাহলে যে আমার দোজকেও জায়গা হবে না। ওঠ, চলো, আজ তোমরা আমার মেহমান! বাগিচাটা ঘুরিয়ে দেখাই তোমাদের।

আলী নূর বলে, কিন্তু এমন সুন্দর বাগিচাটা কার?

—ধরো, আমারই। আমরা তিন পুরুষ ধরে এই বাগিচা দেখাশুনা করে আসছি। আমার হুকুমেই এখানকার সব কিছু চলে। কেন, তোমাদের কি সন্দেহ হচ্ছে?

নূর বলে, না না, আমি সেকথা বলিনি।

বসরাহতে অনেক সুন্দর সুন্দর বাগিচা দেখেছে আলী নূর। কিন্তু এমন সুন্দর নয়নাভিরাম বাগান সে কল্পনাও করতে পারেনি কোনও দিন। সদর ফটকটা কি বিশাল। দু-পাশে নানা কারুকার্যকরা দু’খানা থাম্বা। তার মাথায় আঙুরের লতার ঘেরা-টোপ। থোকায় থোকায় ঝুলছে টুকটুকে লাল, মিশমিশে কালো জাতের আঙ্গুর। যে দিকে তাকাও, গাছ আর গাছ। দুনিয়ার সবরকম গাছ-এর এক মেলা। আর ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে ডালপালা। কোনটায় বা পাকা, কোনটায় বা ডাসা, আবার কোন গাছে সবে ধরেছে গুটি। ডালে ডালে পাখীদের বাসা। দিন শেষে কুলায় ফিরে এখন তারা প্রিয় পরিজনদের সঙ্গে কলামুখর। কেউ বা শিস দিচ্ছে, কেউ বা কুহু কুহু তানে গান ধরেছে। নানা জাতের পাখীর নানা বিচিত্র আওয়াজে মুখরিত সারা বাগিচা।

বাগিচার মাঝে মাঝে ফুলের কেয়াড়ী। অনেকটা জায়গা ঘিরে সারি বদ্ধভাবে লাগানো হয়েছে এক একটা জাতের ফুল-গাছ। কোন সারিতে গুলাব, কোনটাতে বেলী, আবার কোন সারিতে চাপা। যুঁই, চামেলী, রজনীগন্ধা, হামু হানা, সূর্যমুখী, ডালিয়া, ক্রিসেমথিমাম—কত দেশী বিদেশী ফুলের কি বিচিত্র সংগ্বহ। চোখ ফেরানো যায় না।

ইবরাহিম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে থাকে। কোন গাছটার কি নাম, কোন ফুলের গাছ কোন দেশ থেকে আনা হয়েছে—সব বুঝিয়ে বলতে থাকে তাদের। বাগিচা দেখা শেষ করে এবার তারা এসে দাঁড়ায় বাগানের ভিতরে সেই ছোট্ট হাবেলীর সামনে। শিল্পীর আঁকা একটা ছবির মতো। ইবরাহিম ওদের ভেতরে নিয়ে যায়। একটা প্রশস্ত কামরা শ’খানেক লোক বসতে পারে এমনটা জলসাঘর। কড়িকাঠ থেকে ঝুলছে অনেকগুলো হাজারবাতির ঝাড়। আর মাঝখানে একটা সোনার চিরাগ দানী। পারস্য গালিচায় সারা ঘরের মেজে মোড়া। সাটিনের আস্তর দেওয়া অসংখ্য তাকিয়া। আর মাঝে মাঝে বসানো আগরদানী। ধূপের সুমিষ্ট গন্ধে ঘরটা ভরপুর। ঘরটার চারপাশে নীল পর্দ ঢাকা অসংখ্য জানোলা। একটা জানালার পর্দা তুলে আলী নূর বাইরে তাকায়। কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতীয়া-প্রায়পূর্ণ চাঁদ তখন মাথার ওপরে। সারা বাগিচা নরম আলোর বন্যায় ডুবে গেছে। গাছের পাতার ওপর চাঁদের আলোর প্রতিসারণ প্রতি পলে এক অদ্ভূত অভূতপূর্ব ইন্দ্রজাল রচনা করে চলেছে। আলী নূর আর মধুমিতা প্ৰাণ ভরে দেখতে থাকে। দুনিয়াতে এত রূপ আছে, এত গন্ধ আছে আগে কখনও বুঝতে পারেনি আলী নূর। আবেশে মধুমিতাকে আরও কাছে টেনে নেয়। বলে, আচ্ছা মিতা বসরাহতে থাকতে প্রকৃতির এই মনোহারী রূপ তো কখনও ধরা পড়েনি চোখে।

মধুমিতা নূরের বুকে মুখ রেখে বলে, কি করে। ধরা পড়বে বলো? তখন তো তুমি ফালতু আড়ম্বরের নেশায় মেতেছিলো! এসব জিনিস দেখতে গেলে, মনটাকেও তো সেইভাবে তৈরি করতে হয়। প্রকৃতির রূপ উপভোগ করতে হলে তার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে দিতে হয়। কিন্তু তুমি তখন মিথ্যার জগতে বিচরণ করছে। কি করে এসব তোমার চোখে পড়বে। আজ তুমি অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের আগুনে পুড়ে পুড়ে শুদ্ধ সোনা হয়েছে। তোমার মনে এখন আর সেই অহঙ্কার, ফালতু আড়ম্বর নাই। তাই প্রকৃতির দিকে চোখ ফেরাতে পেরেছে। তাই তার অনিন্দ। অপার রূপ তোমার চোখে ধরা পড়েছে।

আলী নূর আরও নিবিড় করে চেপে ধরে মধুমিতাকে।–তোমার কতো জ্ঞান মধুমিতা! এসব তুমি শিখলে কোথায়?

মধুমিতা বলে, এ-তো কেউ কাউকে শেখাতে পারে না, সোনা। এ উপলব্ধি করার জিনিস। আর এই উপলব্ধি আসে-অনেক পড়াশুনো করলে।

নূর বলে, জীবনটাই তো হৈ হল্লা করে নষ্ট করে দিয়েছি। পড়াশুনার দিকে নজর দিইনি। ভেবেছিলাম, ঐভাবেই দিন কেটে যাবে। কথায় আছে না। মাছ মারবো খাবো ভাত, লেখাপড়া কী উৎপাৎ।’ আমার ছিলো সেই দশা। বড়লোকের ছেলে-কাজ কাম বা লেখাপড়া না করলেও তো বড়লোকী চালেই চলতে পারবো। সুতরাং মনে ধারণা ছিলো, লেখাপড়া এক উৎপাত বিশেষ। আজ সে-জন্যে সত্যিই দুঃখ হয়, মিতা। যদি একটু পড়াশুনা করতাম, বাবা মারা যাওয়ার পর সুলতানের দরবারে একটা ভালো চাকরী পেতাম আমি। চাই কি-কালে উজিরও হতে পারতাম।

মধুমিতা বলে, তা না পারার তো কারণ ছিলো না। উজিরের ছেলে তুমি। তুমিও উজির হবে, এই তো স্বাভাবিক। কিন্তু তার জন্যে তো শুধু মেয়ে-বাজী করে বেড়ালে হয় না। সেই সঙ্গে একটু আধটু বিদ্যে-চৰ্চাও করার দরকার ছিলো। একবার ভেবে দেখো তো, তোমার বাবা কত জ্ঞানবান ব্যক্তি ছিলেন। আর তার এই গুণের জন্যেই তো সুলতান তার কদর করতেন। দেশের লোক শ্রদ্ধা করতেন। তিনি যদি নিগুণ হতেন, তাহলে কি সুলতান তাকে অতো ভালোবাসতেন। আদৌ না। বিত্তবানকে লোকে মানে এই কারণে যে, প্রয়োজনে সে তাকে অনুগ্রহ করতে পারে। কিন্তু বিদ্বানকে সবাই শ্রদ্ধা করে, ভক্তি করে—কোনও কিছু টাকাকড়ি পাওয়ার লোভে নয়।

—কই গো বাছারা, খানা খাবে এসো।

ইবরাহিম টেবিলে কাপড় বিছিয়ে খানা সাজিয়েছে। মধুমিতা আর আলী গিয়ে খেতে বসে। খানাপিনার তেমন কোনও আড়ম্বর ছিলো না। রুটি, কিছু মাংস আর সব্জী। আর নানা জাতের ফল ছিলো অনেক। খিদে যথেষ্টই পেয়েছিলো। বেশ তৃপ্তি করেই খেলো দুজনে। হাত মুখ ধুয়ে আবার এসে বসে তারা জানলার পাশে। আলী নূর প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ। নিজেকে হারিয়ে দিতে চায়। ভুলে যেতে চায় দুনিয়ার কলকোলাহল। হিংসা, দ্বেষ, হানাহানি। কাম ক্ৰোধ লোভ মোহ সব মন থেকে সরিয়ে ফেলতে পেরেছে সে। আজ সে এক নতুন জাতের মানুষ। অতীতকে সে পিছনে ফেলে এসেছে। তাকে সে মন থেকেও মুছে ফেলতে চায়।

ইবরাহিম দুটি গেলাসে গুলাবী শরবৎ এনে রাখে। প্রতিদিন রাতে খাওয়ার পর মিষ্টি সরাব খাওয়ার অভ্যাস চিরকালের। নুর গ্লাসে চুমুক দিয়েই নামিয়ে রাখে। ইবরাহিম জিজ্ঞেস করে, শরবৎ ভালো হয়নি, মালিক?

–না না, খুব ভালো হয়েছে। কিন্তু রাতে শোবার আগে শরবৎ খাওয়ার তো কোনও অভ্যাস নাই, তাই ঠিক ভালো লাগছে না।

ইবরাহিম বলে, আমি বুঝতে পারিনি মালিক। এখানে সব ব্যবস্থাই আছে। অনেক দামী দামী সরাব তোমাদের খাওয়াতে পারি-যা কিনা শুধু নবাব বাদশাহদের খানার আসরেই পাওয়া যায়।

ইবরাহিম চলে গেলো। একটু পরে দু’টো গেলাস ভর্তি মদ এনে রাখলে ওদের পাশে। বললে, একশো বছরের পুরোনো, আসলী আলেপ্পোর আঙুর থেকে বানানো।

মদের গেলাসে চুমুক দিয়ে আলী নূর মাথা নাড়ে। হ্যাঁ, একেবারে খাটি আলেপ্পোর সরাব। লোকটা তো বেশ সমজদার! নূর বললো, আপনার খানা বেশ সাধারণ, কিন্তু পিনা তো বহুৎ মজাদার!

ইবরাহিম বললে, কিন্তু মালিক, আমি ওসব আর ছুই না। তেরো বছর হলো হজ করে এসেছি। তারপর থেকে সরাব আমার কাছে হারাম। আমি খাই না, কিন্তু তা বলে কারো ভালো লাগালে থাকে-তাতেও আমার কোনও আপত্তি নাই! আপ রুচি খানা, পর রুচি পরনা।

চো চো করে সরাক-এর গেলাস দু’টো সাবাড়ি করে দিলো দুজনে। কিন্তু নেশা থোড়াই হলো। মধুমিতা বলে, আর খেতে হবে না, এবার শুতে চলো।

নূর-এর এতোকালের অভ্যাস। হঠাৎ কি এক কথায় হুট করে ছাড়া যায়। কিন্তু ছাড়তে তাকে হবেই। পয়সার সংস্থান নাই। কোথায় মিলবে আশ্রয়, কিভাবে জোগাড় হবে, রুটি, সেই চিন্তাই এখন প্রধান। মদ সেখানে বিলাসিত।

নূর ভাবে, কাল যা হবে, হবে। আজকের এই সুন্দর রাতটা মদের নেশায় মধুর করতে পারলে হতো। ইবরাহিমকে বলে, আপনার এত দামী সরাব আর নষ্ট করতে চাই না। আপনি আমাদের জন্যে আর একটু কষ্ট করবেন?

—কষ্ট আর কী? হুকুম করো, মালিক, কি করতে হবে। নূর বলে, শুনেছি, বাগদাদে যে-সব দোকানে গুলাব জল বিক্ৰী হয়, মদও পাওয়া যায় সেখানে। গুলাব জলের বোতলের পিছনে লুকিয়ে রাখে মদের বোতল। একটু বেশী দাম দিলেই বের করে দেয়। তা আপনার যদি কোনও লোকজন থাকে, তাকে পাঠিয়ে একটা বোতল আনিয়ে দিতে পারেন? এই নিন, বোতলের দাম দু’দিনার, আর এই বাড়তি দু’দিরহাম।

ইবরাহিম হো হো করে হেসে ওঠে।–না, মালিক, তার দরকার হবে না। পয়সা তোমার রাখে। সরাব আমি তোমাদের প্রাণ ভরেই খাওয়াচ্ছি। যত পারো খাবে। তার জন্যে, অন্তত আজ রাতে, তোমাদের কানাকড়িও খরচ করতে হবে না। আজ তোমরা আমার মেহমান। আমার সঙ্গে এসো তোমরা।

নূর আর মধুমিতাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলো পাশের একটা ছোট্ট ঘরে। সেখানে আলমারীতে থরে থরে সাজানো সব নানা দেশের নানা জাতের মন্দ। ইবরাহিম বললো, এই নাও চাবি। যে-টা ইচ্ছা খুলে যত ইচ্ছা খাও। কেউ কিছু বলবে না। খলিফা হারুন-অল-রসিদ-এর জন্যে রাখা আছে এ সব। তার অতিথি অভ্যাগতদের আপ্যায়ন করার জন্যে তার হুকুমে জোগাড় করে রাখা হয়েছে।

নূর তাজ্জব হয়ে যায়। এতরকম মদ সে জীবনে কখনও দেখেনি। কোনটা সোনার, কোনটা রূপের ঝরিতে ভরা। আর কত বিচিত্র রকমের কারুকার্যকরা সব বোতল! আলী নূর দিশাহারা হয়ে পড়ে। কোনটা ছেড়ে কোনটা নেবে?

একটা দুষ্প্রাপ্য মদের বোতল নামিয়ে নিয়ে আসে আলী নূর। কাজ করা সোনার পেয়ালা এনে দেয়। ইবরাহিম। খুব মৌজ করে পান করতে থাকে নূর আর মধুমিতা। আস্তে আস্তে নেশা জমতে থাকে। মধুমিতার লাস্যময় ভঙ্গী বড় অপূর্ব। বিশেষ করে মদ পেটে পড়ার পর। তার হরিণীর মতো চঞ্চল আয়ত চোখ দু’টো যখন মদের নেশায় ঢুলু ঢুলু হয়ে আসে তখন যে-কোন সংযমী পুরুষের রক্তেও নাচন ধরে।

ইবরাহিম বেশ খানিকটা দূরে দরজার পাশে বসেছিলো। অচেনা পরপুরুষের উপস্থিতি স্বভাবতই মেয়েদের সন্ধুচিত করে ফেলে। যদিও নেশা বেশ জমে উঠেছে, মধুমিত তবু তেমন সহজ হতে পারে না। আলী নূরের কাছ থেকে একটু সরে সরে থাকতে চায়। কিন্তু নূর তখন নেশায় মত্ত। মধুমিতাকে কাছে টানতে চায়। বাধা দেয় মধুমিতা, আঃ, দেখছে না, ইবরাহিম রয়েছে।

ইবরাহিম অন্যত্র সরে যেতে পারতো। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়াই তার উচিৎ ছিলো; কিন্তু কেন জানি না, চেষ্টা করেও বেরিয়ে যেতে পারে না সে। মেয়েটা এমনিতেই দেখতে ভারি খুবসুরৎ। তার উপর মদের নেশায় মাতোয়ালা হয়ে আরও সুন্দর হয়ে উঠেছে সে। তার বলোল কটাক্ষ, তার জিব দিয়ে ঠোঁট চাটা, তার উঠতে গিয়ে টলে যাওয়া-বৃদ্ধ ইবরাহিমের যৌবনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তারও একদিন ঐ বয়স ছিলো। তার বিবির কাজলটানা চোখের বাণে সে-ও একদিন কামনার আগুনে জ্বলে উঠতো। নূর-এর মতো সে-ও তাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে কতোদিন বিবির কাছে ধাক্কা খেয়েছে, ‘আঃ ছাড়ো, এখুনি আম্মা এসে পড়বে।’

ভাবতে ভালো লাগে। ফেলে আসা যৌবনের মদির দিনের কথা সব বৃদ্ধেরই ভাবতে ভালো লাগে। মধুমিতাকে অপলক চোখে দেখতে থাকে ইবরাহিম। দেহ থেকে যৌবন বিদায় নিলে তাকে আর ফেরানো যায় না। আর এই না ফেরাতে পারার এক যন্ত্রণা আছে। সেই অক্ষম যন্ত্রণার মধ্যে জন্ম নেয় হিংসার। ইবরাহিম বুঝতেই পারে না, কখন থেকে সে নূর-কে হিংসা করতে শুরু করেছে।

ইবরাহিম বলে, আমাকে লজ্জা করার কি আছে? তোমরা আরও সহজ হও, বাছা। আমার কাছে কোন শরম করো না। তোমাদের আদর ভালোবাসা দেখে বড়ো ভালো লাগছে। বুড়ো হয়েছি আজ। কিন্তু একদিন আমিও তোমাদের মতো নওজোয়ান ছিলাম। আমার নাদান বিবিকে নিয়ে কতো না আনন্দ ফুর্তি করেছি। আজ আবার সেই সব পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ছে। বড় ভালো লাগছে। তোমরা অত দূরে দূরে থেকে না, কাছাকাছি হয়ে আদর সোহাগ করো। দেখে চোখ সার্থক করি। রোজ রোজ তো এমন মধুর-মিলন দেখার সৌভাগ্য হবে না।

আলী নূর-এর কথা জড়িয়ে আসে।–আরে বয়স ফয়স-এর কথা গুলি মারো। চুল পাকলেই কি মানুষ বুড়ো হয়? মনে যদি রং থাকে। তবে চুলে বা বয়সে কি করবে? আর কেন দোস্ত, দূরে দূরে বসে আছে। এসো, কাছে এসে বসে। আমাদের রসের ভাগীদার হও। এসো।

নূর এমন ভঙ্গী করে দু’হাত বাড়ালো যে, ইবরাহিম আর কাছে না এসে পারে না। নূর আর মধুমিতার অদূরে এসে বসলো। মধুমিতা গালিচার ওপর চিৎপাট হয়ে শুয়েছিলো। এবার উঠে বসে ইবরাহিমের দিকে চোখ মেলে তাকালো। নূর একটা পেয়ালায় মদ ঢেলে তুলে ধরে ইবরাহিমের দিকে। এক যাত্রায় পৃথক ফল আর কেন হবে? নাও দোস্ত, একটু খাও, মৌজ করো। তবে তো মজাটা জামবে!

ইবরাহিম বলে, না না, ওসব আমি তেরো বছর হলো ছেড়ে দিয়েছি। দু’বার মক্কা গিয়ে হজ করে এসেছি। ওসব আমার চলে না। তোমরা খাও, মৌজ করে, তাই দেখেই আমার আনন্দ।

নূর মদের পেয়ালা হাতে টলতে টলতে এগিয়ে আসে। আরে আজ রাতে একটু খেলে কোন দোষ হবে না। আর তা ছাড়া তুমি তো সাধ করে নিজে খাচ্ছে না, আমরা তোমার মেহমান। মেহমানকে খুশি করার জন্যে নিয়ম ভঙ্গ করলে কোনও দোষ হয় না।

নূর এতই নেশাগ্বস্ত হয়ে পড়েছে, পেয়ালাটা আর ধরে রাখতে পারলো না। গালিচার ওপর পড়ে গেলো।

—কুছ পরোয়া নাই, আবার দিচ্ছি ভরে।

কিন্তু পর পর তিনবারই কাপ ভর্তি মদের পেয়ালা পড়ে যায়। তার হাত থেকে। নিজেও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। গড়িয়ে শুয়ে পড়ে গালিচায়। এবার মধুমিতা এগিয়ে এসে, নুর-এর হাত থেকে পেয়ালাটা কেড়ে নিয়ে এক পেয়ালা মদ ভরে তুলে ধরলো ইবরাহিমের মুখের সামনে।—তুমিই দেখো, বন্ধু, এক সঙ্গে নেশা করতে করতে এইভাবে বেহেড হয়ে গেলে ভালো লাগে কারো। রোজ রোজ এই একই ব্যাপার! আমার আর সহ্য হয় না। সাহেব তো চোঁ চোঁ করে এক বোতল সাবাড়ি করে দিয়ে কগত হয়ে পড়ে গেলেন। এখন আমি-আমি কি এক এক বসে নেশা করবো? সে কি ভালো লাগে কারো? মদের নেশায় এখন গাইতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু তুমিই বলে ইবরাহিম, আমি কি কড়িকাঠকে গান শোনাবো? ওর এই অবস্থায় আমার কি আর নাচতে ইচ্ছে করবে? অথচ নেশা করে যদি একটু নাচ গানই না করলাম তা হলে অত কষ্ট করে ওসব শিখে কি ফয়দা?

তখন ইবরাহিমের সামনে সব কিছু তুচ্ছ হয়ে গেলো। একমাত্র মধুমিতার লাস্যময় আব্দরটাই বড় হয়ে উঠলো। হাত বাড়িয়ে মদের পেয়ালাটা নিয়ে বললো, শুধু তোমার মুখের দিকে চেয়েই আমি আজ খাবো, দাও।

–আঃ, বাঁচালে আমায়, কি বলে যে তোমাকে ধন্যবাদ জানাবো, ইবরাহিম।

একটার পর একটা পেয়ালা পূৰ্ণ করে দিলো মধুমিতা। আর ইবরাহিম চোঁ চোঁ করে টেনে নিলো। এক সময় সে বলে, আর না, থাক। অনেক খেয়েছি, আর বেশী খেলে আমার নেশা হয়ে যাবে।

কিন্তু কে শোনে কার কথা। মধুমিতার আব্দার এড়াতে পারে না সে–এই আর এক পেয়ালা। আর দেবো না।

ইবরাহিম হাত বাড়িয়ে নেয়। এই সময় আচমকা লাফিয়ে উঠে বসে নূর হো হো করে হাসতে থাকে।

এমন সময় রাত্রি ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

পঁয়ত্রিশতম রজনী।

আবার গল্প শুরু হয়।

তারপর শুনুন জাঁহাপনা, ইবরাহিম যখন মধুমিতার আব্দারে আরও এক পেয়ালা মদ হাতে নিলো, নেশার ভান করে পড়েছিলো, নূর তাড়াক করে উঠে বসে বললো, কি গো সাধু মহাপুরুষ, আমি তখন অমন করে সাধিলাম, খেলে না। বললে, হজ করে এসেছে। তেরো বছর ছেড়ে দিয়েছে। আর এখন দেখি চো চো করে টানছে। কী ব্যাপার? না, মেয়েছেলের নাকি সুরের আকদারে গলে গেলে!

ইবরাহিম লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে আসে।—না, মানে তুমি বেহেড হয়ে ঢলে পড়লে-মেয়েটা একা একা মদ খাবে।–তাই একটু… কিন্তু তোমার বিবি যে আমাকে একেবারে আস্ত একটা মাতাল করে ছাড়বে তা তো বুঝতে পারিনি।

আলী নূর আর মধুমিতা হেসে গড়িয়ে পড়ে। ইবরাহিম হাসতে পারে না। বোকার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মধুমিতা বলে, থাক, ঢের হয়েছে, ওকে আর লজ্জা দিওনা।

মধুমিতা দুটি পেয়ালায় মদ ঢালে। একটা নূরকে দেয়, আর একটা সে নিজে নেয়। বলে, ইবরাহিমকে আর দেবো না, ও ব্যাচারির খুব নেশা করিয়ে দিয়েছি আমি।

এরপর আর ওরা ইবরাহিমের দিকে ফিরেও তাকায় না। হাসি গল্পে মশগুল হয়ে একের পর এক পেয়ালা শেষ করতে থাকে। আর ইবরাহিম সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে তাদের মৌতাত। এক সময়ে আর থাকতে পারে না, বারে, শুধু তোমরাই খেয়ে যাবে, আর আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবো? আমাকে দেবে না?

এবার হাসির হুল্লোডি ওঠে। সে হাসিতে ইবরাহিমও সামিল হয়। মধুমিতা মদ ঢেলে এগিয়ে দেয়। ইবরাহিমের দিকে।

মধুমিতা বললো, দোস্ত ঘরের মাঝখানের চিরাগ দানীর একটা বাতি জ্বলিয়ে দেবে?

ইবরাহিম তখন নেশায় বুদ। বলে, মাত্র একটা? হুকুম করো তো সব আলো জ্বলে দিতে পারি।

মধুমিতা বলে, না একটা জ্বলিলেই যথেষ্ট।

ইবরাহিম একটা একটা করে শ’খানেক বাতি জ্বলিয়ে দিয়ে এলো; আলোয় আলোময় হয়ে উঠলো সারা কক্ষ।

এক এক করে সব জানলাগুলোই খুলে দিলো আলী নূর। আর প্রতিটি জানলার সামনে জ্বলিয়ে দিলো এক একটা মোমবাতি। সারা বাগানে ছড়িয়ে পড়লো সেই আলোর রোশনাই। ইবরাহিম ততক্ষণে নেশায় বুদ হয়ে চোখ বুজে পড়ে আছে। আলো জ্বালার পর জানিলা খোলায় যে কি বিপৰ্যয় ঘটে গেলো তা আর তখন কেউই জানতে পারলো না।

খলিফা হারুন-অল-রাসিদের প্রাসাদ থেকে তার এই বিনোদন-বাগিচা স্পষ্ট দেখা যায়। অনেক রাতে খলিফা প্রাসাদের গবাক্ষ থেকে দেখলেন, তার বাগিচার হাবেলী আলোয় আলোময়। সেই রাতেই, তখনই, উজির জাফর অল-বারম্যাকীকে ডেকে পাঠালেন। এই রাত দুপুরে খলিফার তলব! নিশ্চয়ই অভাবনীয় কিছু ঘটেছে। ভয়ে ভয়ে কোরবানীর খাসীর মতো এসে দাঁড়ালো। খলিফা বললেন, ওহে উজির, তোমরা কি সবাই মিলে বাগদাদ শহরটাকে উচ্ছন্নে দিতে বসেছে? নাকে তেল দিয়ে দিব্যি তো ঘুমাচ্ছে। এদিকে যে কি সব কাণ্ড-কারখানা চলছে, তার খবর রাখোঁ? আমার বিনোদন বিহার আলোয় ঝলমল করছে। নাচ-গান মদের ফোয়ারা ছুটছে। কী ব্যাপার, আমি কি মরে গেছি?

জাফর বিনীতভাবে বলে, জাঁহাপনা, আপনাকে এই সব আজগুবি খবর কে এনে দিয়েছে। এমন অবিশ্বাস্য কাণ্ড কি ঘটা সম্ভব??

–কে বলবে? আমি নিজে চোখে দেখেছি। বিশ্বাস না হয়, ওপরে যাও, দেখে এসো, এখনও আলো জুলছে। দরজা জানলা সব হাট করে খোলা রয়েছে।

জাফর দেখে ফিরে এসে বললো, এ হুজুর ঐ বুড়ো ইবরাহিমের বদমাইশি। লোকটা পয়সার লোভে ভাড়া খাটাচ্ছে। গত সপ্তাহে বুড়োটা আমার কাছে এসেছিলো। তার ছোট ছেলেটার সুন্নৎ। কিছু টাকা দরকার। তা আমি ভাগিয়ে দিয়েছি। হুট করে চাইলেই তো আর টাকা পাওয়া যায় না।

খলিফা বললো, খুব অন্যায় করেছে, জাফর। লোকটা আমার বহুকালের পুরনো চাকর। কিন্তু বড়ো গরীব। তার দরকারে কিছুটাকা তো দেওয়াই কর্তব্য। তা আমাকে না জানিয়ে তাকে শুধু হাতে ভাগিয়ে দিলে কেন?

জাফর মাথা হোঁট করে। —আমার দোষ স্বীকার করছি, হুজুর। আমি আপনাকে জানাবো ভেবেছিলাম, কিন্তু নানা কাজের ঝামেলায় একেবারে ভুলে গেছি।

খলিফা বললেন, ঠিক আছে, এ যাত্ৰা আমি তোমাকে মাফ করে দিলাম। কিন্তু ইবরাহিমের। এই কাজের সময় তাকে কিছু টাকা পয়সা দেওয়া আমার নৈতিক কর্তব্য। আর শুধু দু’টো পয়সা ষ্টুড়ে দিলেই কি সব হয়? সে আমার এতকালের পুরনো লোক। তার সুখে দুঃখে আমারও তো সামিল হওয়া দরকার। আমি ঠিক করেছি। তার কাছে একবার যাবো। তার এই উৎসবের দিনে আমাকে পেলে খুব খুশি হবে সে। তাছাড়া কতো রকম লোকের আনাগোনা হয়েছে সেখানে। হয়তো দু-একজন গুণী লোকের সঙ্গেও মোলাকাৎ হয়ে যেতে পারে।

জাফর বললো, আপনি কাল সন্ধ্যাবেলা যেতে চান, হুজুর? কিন্তু ততক্ষণে তার অতিথি অভ্যাগতরা কি আর কেউ থাকবে? আজ রাতে যদি কাজ-কাম হয়ে গিয়ে থাকে, তবে তো কাল দিন মানেই তারা যে যার ঘরে ফিরে যাবে।

খলিফা বললেন, তাহলে আর দেরি নয়, চলো, এখুনি বেরিয়ে পড়া যাক।

খলিফা, জাফর আর খলিফার দেহরক্ষী মসরুরকে সঙ্গে নিয়ে তিন ছদ্মবেশী সওদাগরের বেশ ধরে পথে বেরিয়ে পড়লো। হাঁটতে হাঁটতে বাগিচার সদর ফটকের সামনে এসে দেখে দরজা খোলা। অন্য সময়, রাতে কেন, দিনের বেলাতেও খোলা থাকে না। এ দরজা। আজ নিশ্চয়ই ইবরাহিমের ছেলের সুন্নৎ উৎসব। বাইরের নিমন্ত্রিতরা আসবে যাবে। সেই কারণে এই সদর ফাটক খুলে রেখেছে সে।

বাগিচার ভিতরে ঢুকে খলিফা বললেন, এ অবস্থায় ওদের উৎসবের আসরে যাওয়া ঠিক হবে না। তার আগে লুকিয়ে দেখতে হবে ওরা কি করছে।

একটা বাতাবী লেবুর গাছ দেখিয়ে তিনি বলেন, এই গাছটার ওপরে উঠে। উকি মেরে দেখতে হবে।

মসরুরের কাঁধে চেপে খলিফা আর জাফর গাছের উপরে উঠে গেলেন। ডালের ওপরে বসে উকি ঝুঁকি দিয়ে দেখতে চেষ্টা করেন। একটা জানলার মধ্যে দিয়ে দেখতে পেলেন, ঘরের মধ্যে তিনটি প্রাণী। তার একজন ইবরাহিম। আর দু’জন খুবসুরৎ যুবক-যুবতী। আহা, কি তাদের রূপ। এমন অপরূপ সুন্দর ছেলে মেয়ে সচরাচর চোখে পড়ে না। কিন্তু একি! ওরা সবাই সরাবের নেশায় বুদ। সবারই হাতে মদের পেয়ালা। ইবরাহিম তো মাথা গোঁজ করে বসে আছে। মেয়েটি গুণগুণ করে গান ধরেছে। আর ছেলেটি মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে তারিফ জানাচ্ছে। খলিফা বললেন, আমি ভেবে পাচ্ছি না, জাফর, এরা কারা। মনে হচ্ছে বিদেশী মুসাফির। কিন্তু এখানে এলো কি করে?

জাফর কোনও জবাব দিতে পারে না। খলিফা বললেন, এই অবস্থায় ওদের সামনে যাওয়া ঠিক হবে না। তাই না, জাফর?

জাফর বলে, কিন্তু না গেলে, এই গাছের ডালে বসে কি করে হদিস পাবেন, হুজুর?

এমন সময় ওঁরা দেখলেন, ইবরাহিম বলছে, এমন নেশা করে একটু গান বাজনা না হলে কি জমে? মালকিন, তুমি কি বাজাতে জানো?

মধুমিতা বললো, জানি, কিন্তু বাজাবার কি আছে এখানে?

ইবরাহিম বলে, আছে আছে, খুব ভালো যন্ত্র আছে। দাঁড়াও এনে দিচ্ছি।

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো ইবরাহিম। একটু বাদে একটু ফুট নিয়ে এলো হাতে করে। খলিফা জাফর-এর দিকে তাকান।–কী এতবড় স্পর্ধা? ওস্তাদ ইশাক যে ফুট বাজান সেই ফুট নিয়ে এসেছে বুড়োটা! আমি এসব কিছুতেই বরদাস্ত করবো না, জাফর। এ-ও আমি বলে রাখছি, বাজনা যদি বোসুরো হয়, তোমাদের সবাইকে কেতিল করবো আমি।

জাফর বললো, আর যদি সুর তাল ঠিক থাকে? তবে কি করবেন, জাঁহাপনা?

—তবে? তবে ওদের সবাইকে ছেড়ে দেবো। শুধু তোমাকে শূলে চড়াবো।

—হায় আল্লাহ, মেয়েটা যেন বেসুরেই বাজায়।

খলিফা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, কেন? এরকম প্রার্থনা করছো কেন?

জাফর বলে, মরতে হয়। সবাই মিলে এক সঙ্গে মরাই ভালো।

খলিফা তারিফ করলেন।

মধুমিতা ফ্লুটে অপূর্ব সুরের ইন্দ্রজাল রচনা করতে থাকে। খলিফা মুগ্ধ হন। বাঃ, রীতিমতো গুণী মেয়ে, হে। এমন মন-মাতানো মধুর সুর বহুকাল শুনিনি!

জাফর বলে, তা হলে আশা হচ্ছে, জাঁহাপনার ক্ৰোধ প্রশমিত হয়েছে।

খলিফা এবং জাফর দুজনেই গাছ-এর উপর থেকে নামলেন। খলিফা বললেন, না, জাফর, আর তো ধৈর্য রাখতে পারছি না। এবার তো দেখতে হয়, ওরা করা। এমন গুণীজনের সমাগম হয়েছে আমার হাবেলীতে। একটু আলাপ-সালাপ করা দরকার।

জাফর বাধা দিয়ে বলে, কিন্তু জাঁহাপনা, আপনার কি এ সময় ওদের সামনে যাওয়া ঠিক হবে? মদের নেশায় বুদ হয়ে আছেইবরাহিম। আপনাকে দেখা মাত্র ওর নেশা-ফেস কেটে পানী হয়ে যাবে। হয়তো বা ভয়ে অজ্ঞান হয়ে মরেই যাবে লোকটা। আর ঐ দুই যুবক-যুবতী ওরা তো বুঝতেই পারবে না, এই এতো রাতে কেনই বা আপনি ওখানে গেলেন, আর কেনই বাইবরাহিম ওভাবে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো?

খলিফা বললেন, তা যা বলেছে। ঠিক আছে, তোমরা এখানে দাঁড়াও। আমি ওদিকটা একটু ঘুরে দেখে আসি।

জাফর আর মসরুর দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। খলিফা এগিয়ে গেলেন।

বাগানের ওপ্রান্তে একটা বিরাট পুকুর। নালা কেটে টাইগ্ৰীস থেকে জল এনে ভরাট করা হয়। এই পুকুর। ফলে ছোট বড় নানা জাতের মাছে ভর্তি থাকে। সারা বছর। আর এই মাছের ওপর জেলেদের ভীষণ লোভ। দাও পেলেই বাগানে ঢুকে জাল ফেলে মাছ চুরি করে পালায়। সেই কারণে বাগানের সবগুলো দরজাই বন্ধ করে রাখে ইবরাহিম। কিন্তু আজ তার ছেলের সুন্নৎ, তাই সদর ফটকটা হাট করে খোলা। আর এই মওকায় করিম জেলে ঢুকে পড়ে বাগানে। চুরি করে মাছ ধরায় সারা বাগদাদে তার জুডি নাই। আরও মজার ব্যাপার, যার পুকুরের মাছ চুরি করে, তার কাছেই সে বিক্রি করে যায়। খলিফা দূর থেকে লক্ষ্য করেছিলেন, সদর দরজা দিয়ে ঢুকে জাল কাঁধে করে কে যেন পুকুরের দিকে চলে গেলো। তখন তিনি জাফর আর মসরুরকে সেখানে দাঁড় করিয়ে পুকুরের দিকে চলে এলেন। খলিফা দেখলেন, সেই করিম জেলে। জালটা দু’হাতে দোলাতে দোলাতে ছত্রাকারে ছড়িয়ে দিলো জলে। স্বগতভাবে বলে, আজ শালা, আচ্ছা মওকা মিলেছে। বুড়োটা সরাব গিলে বেহদ্দ মাতাল হয়ে পড়ে আছে। পুকুরের সব মাছ আজ সাবাড় করে দেবো।

নিস্তব্ধ রাত্রি। বিড় বিড় করে বললেও পরিষ্কার শুনতে পান খলিফা। পা টিপে টিপে আরও কাছে এগিয়ে আসেন। তিনি। একেবারে করিমের পিছনে। ফিসফিস করে ওর কানের কাছে মুখ রেখে বলেন, অতো মাছ কি করবি, করিম?

আঁৎকে ওঠে লোকটা। ফিরে তাকায়। ভরে থর থর করে কাঁপতে থাকে, জাঁহাপনা, আপ-নি–

-চুপ! একদম চেঁচাবিনা।

—হুজুর, আমাকে এবারের মতো মাফ করে দেন, আমি আপনার পা ছুঁয়ে কসম খাচ্ছি, আর ককখনো চুরি করতে আসবো না। কি করবো হুজুর, পেট চলে না, ঘরে অনেক লোক–

-ঠিক আছে বান্দর, এখন জালটা তোল, দেখি কি মাছ পড়েছে।

জালটা গুটিয়ে তুললো করিম। অনেকগুলো বেশ ভালো ভালো মাছ ধরা পড়েছে। খলিফা বললো, চমৎকার! খাসা হবে। নে, এবার তোর জামা পাতলুন খুলে ন্যাংটো হয়ে দাঁড়া।

করিম বেচারী মুখ কাচুমাচু করে। জী হুজুর—

—’জী হুজুর’ কি করে? তোকে না বললাম, ন্যাংটো হয়ে দাঁড়া? তা কথা শুনতে পাচ্ছিস না?

করিম এবার চটপট গায়ের চোগা চাপকন খুলতে থাকে। বাগদাদের সব লোকের কাছে করিমের এই পোশাকটা বহু পরিচিত। কবে যে সে প্রথম পরেছিলো, কেউ বলতে পারে না ইঞ্চি খানেক পুরু তেল চিটচিটে ময়লা জমেছে। ছিঁড়ে ঝুল্লি হয়ে গেছে। জামাটা খুলতেই গোটা কুড়ি বড় বড় ছারপোকার হুটোপুটি শুরু হয়ে গেলো।

খলিফার চোখ তো ছানাবড়া। সে কিরে করিম। এই সব সঙ্গী-সাথী নিয়ে দিব্যি তো আরামে থাকিস! কামড়ায় না?

—তা হুজুর পরথম পরথম কামড়াতো! এখন আমার সাথে ভাব হয়ে গেছে। আর কামড়ায় না। তা ছাড়া ও আমার গা-সওয়া হয়ে গেছে। কামড়ালেও টের পাই না, হুজুর।

করিম ভেবে পায় না, জাঁহাপনা কেন তাকে উলঙ্গ করলেন। হয়তো চুরি করার সাজা হিসাবে গায়ে এমন কোনও দাগ কেটে দেবেন যা তার চিরদিন মনে থাকবে। কিন্তু না, করিম দেখলো, খলিফা স্বয়ং নিজেও সব সাজ-পোশাক খুলে ফেলে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়ালেন, —

—এবার করিম, তুই আমার পোশাকগুলো পর। আর আমি তোরগুলো পরছি।

করিম হাঁদার মতো হাঁ করে চেয়ে চেয়ে দেখে। খলিফা হারুন-অল-রসিদ-দণ্ড মুণ্ডের বিধাতা, -দীন হতে দীন জেলে করিমের শতচ্ছিন্ন ময়লা নোংরা সেই পোশাক দেহে ধারণ করলেন। খলিফার নির্দেশে করিমও তার সাজ পোশাক পরে নিলো। খলিফা বললেন, বাঃ বেড়ে হয়েছে তো দেখতে। একেবারে সুলতান খলিফা হারুন-অল-রসিদ—উফা! ওরে করিম, একি হলো রে, ব্যাটারা যে কুট কুট করে কামড়াচ্ছে, আর তির তির করে ছুটে বেড়াচ্ছে!

জেলে বলে, ও কিছু না, জনাব। এখুনি সয়ে যাবে। নতুন মানুষ পেয়েছে, একটু তাজা রক্ত চুষে সেলাম জানাচ্ছে আপনাকে। পেট পুরে গেলে আর কামড়াবেনা।

খলিফা বলে, বলিস, কিরে? পেট পুরে গেলে—? আমি খলিফা হারুন-অল-রাসিদ। আর আমারই রক্ত চুষে খাচ্ছে? এত বড় স্পর্ধা?

হুজুর ক্ষান্ত হোন। এখন আপনি ওদের প্রজা। ওরা এখন শাহেন শাহ। ওটা ওদের জন্মগত অধিকার।

খলিফা খুশি হয়ে বলে, বাঃ তুই তো ব্যাটা রসিক আছিস। নে এই আংটিটা দিলাম তোকে। ঐ মাছগুলো রেখে তুই এখন পালা।

মাছগুলো করিমের একটা থলোয় ভরে নিয়ে জাফরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। জাফর খলিফাকে করিম বলে ভুল করলো, হ্যাঁরে করিম এই রাতে বাগানে ঢুকেছিস কী মতলবে? জানে বাঁচতে চাস তো শিগ্‌গির। পালা। খলিফা এসেছেন। এখানে।

জাফর-এর কথা শুনে খলিফা হো হো করে হেসে উঠলেন। জাফর তো অবাক!–জাঁহাপনা, আপনি?

খলিফা বললেন, তাহলে ছদ্মবেশটিা বেশ লাগসই হয়েছে, বলো? ইবরাহিম চিনতে পারবে না। তাহলে?

জাফর বলে, আমিই চিনতে পারিনি, তা ইবরাহিম চিনবে কি করে, হুজুর?

–ঠিক আছে। তোমরা এখানেই থাকে। আমি আসছি।

খলিফা সোজা ঢুকে পড়লেন হাবেলীর ঘরে। বাইরের মানুষের পায়ের শব্দে ইবরাহিম সজাগ হয়ে ওঠে, কে রে?

খলিফা সামনে এসে ইবরাহিমকে আদাব জানায়।

—ওঃ তুমি? এতো রাতে এ বাগানে ঢুকেছিস কেন রে চোর বদমাইস, নচ্ছার? খলিফা মুখ কচু মাচু করে মাছের থলেটা সামনে রাখে, আপনার জন্যে কাটা মাছ এনেছি, জনাব?

ইবরাহিম হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, মাছ? আমারই পুকুরের মাছ চুরি করে আমারই কাছে এনেছো

আজ্ঞে, বিক্রি করতে আনি নি, যদি মেহেরবানী করে গ্রহণ করেন—

মধুমিতা এগিয়ে আসে, দেখি দেখি, কি মাছ?

সদ্য ধরা জ্যান্ত মাছগুলো বের করে দেখান খলিফা। খলখল করে লাফাতে থাকে। নুর বলে, : জমিবে ভালো। ভাজা মাছ মদের সঙ্গে তোফা চাট।

ইবরাহিম খলিফাকে ধমকে ওঠে, তা হাঁদারাম, মাছগুলো ভেজে আনতে পারোনি? ওনারা কি তোমার এই কঁচা মাছগুলো কামড়ে কামড়ে খাবেন?

খলিফা শশব্যস্ত ভাবে বলে, আমি এক্ষুণি ভেজে এনে দিচ্ছি, জনাব।

ইবরাহিম বলে, যা, ওপাশে রসুই ঘরে তেল মশলা সব আছে। বেশ কড়া করে ভেজে আনবি।

খলিফা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। শুনতে পেলেন, ওরা তিনজনে চেঁচিয়ে বলছে, খুব জলদি, আচ্ছ–সে কড়া করে ভেজে নিয়ে আয়।

জাফরের কাছে ফিরে এসে খলিফা হাসতে হাসতে বললেন, জাফর, বিলকুল চিনতে পারেনি। ইবরাহিম। আমাকে দেখে রেখে আগুন। চোর বদমাইশ নচ্ছার বলে আব্দর অভ্যর্থনা করলো। তারপর নবাবী চালে হুকুম করলো, জলদী, মাছগুলো আচ্ছা-সে কড়া করে ভেজে নিয়ে আয়। কিন্তু জাফর, ছেলেটা আর মেয়েটাকে দেখে বনেদী খানদানী ঘরের নওজোয়ান মনে হলো। শুধু ভাবছি, ইবরাহিমের সঙ্গে ওদের কি সম্পর্ক?

জাফর বললো, মাছগুলো আমার হাতে দিন জাঁহাপনা, আমি ভেজে এনে দিচ্ছিা!

না না, সব মাটি হয়ে যাবে। ইবরাহিম যদি রসুই ঘরে এসে দেখতে চায়—আমি কি দিয়ে কি করে মাছগুলো ভাঁজছি তা হলেই সব ফাঁস হয়ে যাবে। তুমি এখানেই থাকে। আমি রসুইখানা থেকে ভেজে নিয়ে উপরে যাচ্ছি।

রসুইখানায় ঢুকে মাছগুলো কাটলেন, ধুলেন, নুন, হলুদ, মশলা, দিয়ে মাখলেন তিনি। উনুনে কাঠ দিলেন, কড়াই-এ তেল ঢেলে অপেক্ষা করতে লাগলেন। টগবগ করে যখন ফুটে উঠলো তেল, মাছগুলো কড়াই-এ ছেড়ে দিলেন।, একেবারে পাকা বাবুর্চির মতো নিখুঁতভাবে করে যেতে থাকলেন সব! এক পিঠ ভাজা ভাজা হয়ে এলে উল্টে দিলেন। এইভাবে মাছের টুকরোগুলো লালচে হয়ে এলে উনুন থেকে নামালেন। বাগান থেকে দু’টো পাতিলেবু আর একখানা কলা পাতা এনে ভাজা মাছগুলো ওপরে নিয়ে এলেন তিনি।

আলী নূর, মধুমিতা আর ইবরাহিম তিনজনে মিলে মাছগুলো সব সাবাড় করে দিলো। নূর বললো, বাঃ, বেড়ে ভেজেছো তো হে? তোফা হয়েছে। এই নাও, তোমার বকশিস।

তিনটি দিনার বের করে খলিফার হাতে দিলো সে। দু’হাত একত্র করে ইনাম নিলেন খলিফা। কপালে ছুঁইয়ে মুদ্রা তিনটি চেপে কপালের সঙ্গে সেঁটে দিলেন। অর্থাৎ ‘তোমাদের ইনাম মাথায় করে নিলাম’, খলিফা গদগদ হয়ে হাত জোড় করে বললেন, একটা কথা বলবো, হুজুর।

আলী নূর অবাক হয়। লোকটার কি তিন দিনারে মন ওঠেনি? কিন্তু সনজার তাকে মাত্র চল্লিশটা দিনার দিয়েছিলো আসার সময়। তাছাড়া তার নিজের কাছে একটা পয়সাও ছিলো না। তা থেকে জাহাজের কাপ্তেনকে পাঁচটা দিনার দিতে হয়েছে ভাড়া বাবদ। তিন দিনার ওকে দিয়েছে। এখন আর সাকুলো বত্ৰিশটা রইলো তার কাছে। বিদেশ বিভূঁই-এ সামান্য এই বত্রিশ দিনারে কদিন চলবে? আলী নূর বল, কি বলবে বলো।

খলিফা বলেন, জী হুজুর, যদি মালকিন একটা গান শোনান—ওঁর বাজনা শুনে বড়ড ভালো লেগেছে।

মধুমিতা বললো, কি গান শুনতে চাও, বলো, কি ধরনের গান তুমি ভালোবাসো?

— বেগম সাহেবা কি সব রকম গানই জানেন?

—সবই তো শিখেছিলাম এক কালে, খেয়াল, ঠুংরী, কালোয়াতী, কাওয়ালী—কি শুনবে বলো?

খলিফা অবাক হয়। মেয়েটা বলে কি? খেয়াল ঠুংরী! —তা যদি একখানা দরবারী কানাড়া শোনান তো খুব ভালো হয়। অনেক দিন শুনিনি।

মধুমিতা বলে, তুমি তো মাছ ধরে খাও। দরবারী বুঝতে পারবে?

খলিফা মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলেন, আমাদের জাত ব্যবসা মাছ ধরা ঠিকই কিন্তু আমার বাবা ছিলেন সাধক লোক। গানের সাধনায় তিনি অনাহারে জীবন পাত করেছেন। মাছ ধরা ফেলে রেখে তানপুরা নিয়েই মেতে থাকতেন। আমি মূর্খ্য সুখ্যু মানুষ, বাবার কোন গুণই পাইনি। তবে শুনতে ভালোবাসি, ভালোলাগে।

এতকাল পরে একজন সমজদার পেয়ে মধুমিতা খুশি হয়। দরদ দিয়ে দরবারী কানাড়া গাইতে শুরু করে। সত্যিকারের গুণী মেয়ে। সেই নিশুতিরাতে কানাড়ার নিখুঁত তাল মান লয় এর মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। খলিফা। ওস্তাদ ইশাকের পরে এত ভালো গান বহুদিন শোনেন নি। তিনি। গভীর আবেশে মাথাটা ঝুকে আসে।

ইবরাহিম ঠেলা মারে, এই চোটুঠা, ঘুমিয়ে পড়লি না কিরে।

খলিফা হকচকিয়ে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, না জনাব, শুনছিলাম।

–কচু শুনছিলে। এসব গানের তুই কি বুঝবি রে?

মধুমিতার গান শেষ হয়ে আসে। খলিফা দু’হাতে তালি বাজিয়ে বাহবা জানায়। বহুৎ আচ্ছা, বহুৎ আচ্ছ। আল্লাহ আপনাকে সুখে রাখবেন। এমন গান আপনি কোথায় পেলেন, মালকিন। শুনলে দিল-এ আর কোনই দুঃখ দর্দ থাকে না।

নূর বলে, বুঝলাম আমার বিবির গান তোমার খুব পছন্দ হয়েছে। তা এক কাজ করো, ওসব কালোয়াতী গান ফান তো আমি বুঝি না। আমি ওর কদরও করতে পারি না। তুমি ওকে সঙ্গে করে ঘরে নিয়ে যাও। প্ৰাণ ভরে গান শুনবে? কি বলে? না না, আর কোনও ওজর আপত্তি শুনবো না, জেলে, আমি তোমাকে বরাবরের জন্যে ওকে তোমায় দান করে দিলাম।

শেরওয়ানীটা কাঁধে ফেলে গভীরভাবে উঠে দাঁড়ায় আলী নূর। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়ায়। মধুমিতার কাতর কণ্ঠ শুনে থামে। মুখ ফেরায়। মধুমিতা বলে, প্ৰাণনাথ, তুমি আমাকে এইভাবে একা ফেলে চলে যাচ্ছে, একটুও তোমার মায়া হচ্ছে না। আর চিরকালের মতোই যখন যাচ্ছে দু’টো মিষ্টি কথাও কি বলে যাবে না, একটুখানি সবুর করো, প্ৰাণেশ্বর, একটি কথা শুনে যাও।

খলিফা কিছুই আন্দাজ করতে পারেন না। ছেলেটি দুম করে মেয়েটাকে ছেড়ে পালাতেই বা চাইছে কেন? তবে কি সে ওর শাদী করা বেগম নয়। কাউকে কি ভাগিয়ে নিয়ে এসেছে এখানে? নূরকে লক্ষ্য করে বললেন, শুনুন মালিক, আমি আপনার বাবার চেয়েও হয়তো বড় হবো। আমার কাছে গোপন করবেন না, খুলে বলুন, কি আপনাদের দুঃখ, কি আপনাদের অভাব অভিযোগ। আমি গরীব জেলে। দিন আনি দিন খাই। তবু যদি বুঝি, আমার সাধ্যমতো উপকার করতে কোসিস করবো। আপনি কি ভয় করছেন, এখানে কোতোয়ালের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে আপনাকে এই লেড়কীর জন্যে জবাবদিহি করতে হবে? ওসব আপনি বিলকুল ভাববেন না। কোতোয়াল তো কোন ছার, তার বাবার বাবার সঙ্গে আমার দাহরাম মহরম আছে। আমার এক ইশারাতে ছেড়ে দিতে পথ পাবে না বাছাধনরা। তা সত্যিই কি ভাগিয়ে এনেছেন, হুজুর?

নূর বলে, না না, ওসব নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নাই। আমি কোনও বে-আইনি কাজ-ফাজ করিনি। সমস্যা তা নয়। এককথায় তো তোমাকে সব বোঝানো যাবে না, জেলের পো। অনেকটা সময় লাগবে। আচ্ছা ঠিক আছে, শোনো, গোড়া থেকেই বলি, আমাদের দুঃখের কাহিনী–। তা একরকম ভালেই হবে। বলতে বলতে রাতটাও কাবার করে দিতে পারবো।

নূর যখন তাদের কাহিনী বলা শেষ করলো, রাত্রি তখন আর বেশি বাকী নাই। খলিফা বললেন, সবই তো শুনলাম। এখন কি করতে চান বলুন মালিক।

নূর বলে আল্লাহর পথ অবারিত, খোলা আছে। যে দিকে দু’ চোখ যায়, চলে যাবো।

খলিফা বলেন, শুনুন, জনাব, আমি যদিও এক দীন হীন সামান্য জেলে। তবু ছোটবেলায় বসরোহর সুলতানের সঙ্গে একই মাদ্রাসায় পড়াশুনা করার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার। এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বও গড়ে উঠেছিলো। সে সুবাদে তার কাছে আমি একখানা খৎ লিখে দিচ্ছি। আমার মনে হয়, আমার চিঠি দেখলে আপনাদের সমস্যার সমাধান করে দেবেন। তিনি।

এই সময়ে রাত্রি শেষ হয়ে এলো। গল্প থামিয়ে শাহরাজাদ চুপ করে বসে রইলো।

 

ছত্রিশতম রজনীর মধ্যভাগে আবার সে গল্প শুরু করে :

মহম্মদ ইবন সুলেমান অল-জিনির সহপাঠী ছিলাম। পড়াশুনায় আমার খুব মেধা ছিলো। সে তুলনায় সুলেমান বেশ কঁচা। কোরাণের পাঠ সে কিছুতেই মনে রাখতে পারতো না। মৌলভী ছিলেন ভীষণ কড়া। তার ভয়ে সবাই যুযু হয়ে থাকতো। আমি তাকে মুখে মুখে মুখস্থ করিয়ে দিতাম। ফলে আমাদের দোন্তী বেশ জমে উঠেছিলো। সুলতানের সন্তান সে, তাই কালে সুলতানই হলো। আর আমি, সামান্য জেলের ছেলে, আমার জাত-ব্যবসাতেই জীবনপাত করতে থাকলাম। তবু সেই ছোটবেলার বন্ধুত্বে কিন্তু এতটুকু ঘুন ধরেনি। এখনও দেখা হলে, সব ভুলে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। সে যে অত বড় সালতানিয়তের একজন সুলতান, ভুলে যায়। সে কথা। কোনও অহঙ্কার, দম্ভ আমি দেখিনি। আমি হয়তো খুবই কম জবাব দিই, কিন্তু সে নিয়মিত আমাকে চিঠি লেখে, খবর নেয়।

নূর বলে, যাই হোক, আল্লাহর নাম নিয়ে লিখে দাও একটা চিঠি। হয়তো কাজে দিতে পারে।

ইবরাহিম কাগজ দোয়াত কলম এনে দিলো। গালিচায় হাঁটু গেড়ে বসে একখানা চিঠি লিখলেন খলিফা।

।।এলাহি ভরসা।।

আমি–আব্বাস বংশের অন্যতম পুত্র মাহদি তস্য পুত্র হারুন-অল-রাসিদ। আমার অন্যতম সালতানিয়তে নিযুক্ত সুলতান মহম্মদ-ইবন সুলেমান জীনির প্রতি এই হুকুমনামা পাঠাইতেছি: এই পত্ববাহক আলী নূর, তোমার প্রাক্তন পরলোকগত উজির অল-ফাদলের পুত্র।

এই পত্র পাঠ করার সঙ্গে সঙ্গে তুমি সিংহাসন থেকে নেমে এসে আলী নূরকে সিংহাসনে অধিরূঢ় করিবে। এতকাল যে অধিকার তোমাকে দিয়াছিলাম অদ্য হইতে তাহা খারিজ করিলাম। এবং আলী নূরকে প্রদান করিলাম।

পত্র পাঠ আমার হুকুম তামিল করিবে। আল্লাহ তোমার সহায় থাকুন।

 

এর পরে খলিফা হারুন-অল-রাসিদ সহি ও টিপ সহি দিয়ে কাগজখানা ভাঁজ করে আঁঠা লাগিয়ে বন্ধ করে দিলেন। নূরের হাতে দিয়ে বললেন, আপনি আর দেরি করবেন না, জনাব। সকাল হয়ে এসেছে, এখুনি বেরিয়ে পড়ুন। বন্দরে জাহাজ ছাড়ার সময় হয়ে গেছে।

নূর ভাবলো ক্ষণকাল! লোকটা গুলতাগ্নি দিচ্ছে না তো? শেষে সুলতানের হাতে ধরা পড়ে বে-ঘোরে। প্ৰাণটা যাবে? ঠিক আছে, আল্লাহ নাম নিয়ে বেরিয়ে তো পড়া যাক। তারপর পথের মাঝে দেখে নেওয়া যাবে, কি লেখা আছে খতে। নূর বললো, তা হলে ওই কথাই রইলো, মধুমিতা এখানেই রইলো। আমি তোমাকে দিয়ে গেলাম। যাই বসরাহতে। যা ঘটে এসে বলবো।

আলী নূর বেরিয়ে যেতেই ইবরাহিম গর্জে ওঠে, শয়তান ঠগবাজ, দু’ পয়সার মাছ খাইয়ে তিন তিনটি মোহর নিলি জগ দিয়ে। তাতেও তোর আশ মিটলো না? আবার যাদু করে। ছেলেটাকে ভাগিয়ে দিয়ে মেয়েছেলেটাকেও ভোগ করতে চাস? সে আমি কিছুতেই হতে দেবো। না। সমান সমান ভাগ দিতে হবে আমাকে। না হলে ছাড়বো না। তিন মোহরের আদেক আর মেয়েটার আদেক আমার চাই। মেয়েটাকে আগে আমি ভোগ করবো, তারপর তোকে দেবো। তা না করে তোমার হাতে ছেড়ে দেবো, আর তুমি শালা নিয়ে হাওয়া হয়ে যাবে? ওটি হচ্ছে না।

ইবরাহিমের এই নোংরা কথা শুনে আপাদমস্তক জ্বলে যায় খলিফার। উঠে গিয়ে জানিলায় দাঁড়িয়ে তুডি বাজাতেই তীরবেগে ছুটে আসে মসরুর। কাঁপিয়ে পড়ে ইবরাহিমের উপর। জাফর-এর সঙ্গেই ছিলো খলিফার সাজ-পোশাক। ক্ষিপ্র হাতে জেলের পোশাকটা খুলে

ইবরাহিমের প্রথম মনে হয়েছিলো খোয়াব। কিন্তু মুহূর্তে তার ভুল ভাঙ্গলো। দারুণ দুঃখ লজ্জা ভয়ে মাথার চুল ছিঁড়তে লাগলো, নিজেই নিজের হাত কামড়াতে থাকলো।

খলিফা খুব শান্ত গলায় প্রশ্ন করলেন, এসব কী? আর কখনও এরকম বে-শরম বাত মুখে এনে না। বুড়ো হয়ে মরতে বসলে এখনও মেয়ে মানুষের লোভ গেলো না? যাও, এবারের মতো মাফ করে দিলাম।

তারপর মধুমিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, তা হলে সুন্দরী, এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছে, আমি কে? আর এখানে কেন? চলো, আমার প্রাসাদে যাই।

মধুমিতাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এসে তার থাকার জন্যে একটা বিলাসবহুল শয্যাকক্ষের বন্দোবস্ত করলেন খলিফা। খোজা, দাসী, পরিচারিকারা ব্যস্ত হয়ে উঠলো মধুমিতার পরিচর্যায় খলিফা নিজে এসে দেখলেন তার ঘর, পালঙ্ক, শয্যা প্রভৃতি। বললেন, আলী নূর শিগ্‌গিরই ফিরে আসবে। সে যে কদিন না আসে, তুমি আমার অঙ্কশায়িনী হয়ে থাকবে, কেমন রাজী?

মধুমিতা স্মিত হাসে। বড় মিষ্টি করে হাসতে জানে মেয়েটা। বলে, আলী নূর তো জাঁহাপনার হাতেই সমৰ্পণ করে গেছে আমাকে। এখন তার যা মর্জি হবে।

খলিফা বলেন, কিন্তু আলী নূর তো এক জেলের হাতে দিয়ে গিয়েছিলো। সে যদি এসে দেখে, হাতবদল হয়েছে, আমাকে কেতিল করবে না তো?

মধুমিত রসিকা মেয়ে। কোন জবাব দেয় না। একথার জবাব হয় না। শুধু হাসে। অনর্গল হাসতে থাকে। আর তার এই হাসির ঝরনায় মুক্তো কুড়াতে থাকেন। খলিফা হারুন-অল-রাসিদ।

এদিকে আলী নূর বাসরাহয় পৌঁছে ছুটে যায় সুলতানের প্রাসাদে। কিন্তু প্রহরী ঢুকতে দেবে না। আলী নূর চিৎকার করতে থাকে। সুলতান মহম্মদ সুলেমান শুনতে পায়। একজনকে বলে, কে চেৰ্চাচ্ছে, দেখো তো। লোকটাকে নিয়ে এসো।

আলী নূর দরবারে এসেই সোজা সুলতানের সামনে গিয়ে চিঠিখানা বাড়িয়ে দেয়। সুলতান বিরক্ত হয়। লোকটাতো ভীষণ বেয়াদপ। সুলতানকে কুর্নিশ না করেই সে দরবারে ঢুকে পড়লো। অবাক হয়েছিলো সবাই। এমন ঘটনা তো দেখা যায় না। কিন্তু চিঠি খানা পড়া মাত্র সুলতানের মুখের চেহারা পালটে গেলো। বারবার তিনবার চিঠিখানা মাথায় ঠেকিয়ে শ্রদ্ধা জানালো।

—খলিফার আদেশ আমার শিরোধার্য। আল্লাহর পয়গম্বর খলিফার হুকুম আমাকে মাথা পেতে নিতে হবে। কই কে আছে, এখুনি চারজন কাজীকেই ডাকে। আর ডাকো আমার সব আমীর ওমরাহন্দের। তাদের সামনে আমি এই সিংহাসন ছেড়ে দেবো খলিফার মনোনীত এই যুবককে।

তখুনি সবাই এসে হাজির হলো। সুলতান তার পদত্যাগ পত্র সই করতে যাবে এমন সময় উজির মইন এসে বাধা দিলো, এ আপনি কি করছেন হুজুর! ক্ষান্ত হোন।

সুলতান তাকে খলিফার হুকুমনামা খৎখানা দেখালো। চিঠিখানা পড়ে খলিফার টিপসই আর সই-এর অংশটুকু ছিঁড়ে ফেলে বললো, জাল। স্রেফ জাল, হুজুর। লোকটা একটা মস্ত।বড় জালিয়াৎ। খলিফার সই জাল করেছে। তা না হলে, আপনি ভাবুন, খলিফা কখনও একখানা সাদা কাগজে এইভাবে চিঠি লিখতে পারেন। তার সব চিঠিতেই তো প্রাসাদের ছবি আঁকা থাকে। আর তা ছাড়া চিঠি বয়ে নিয়ে আসবে তার দরবারের দূত। সঙ্গে থাকবে পাইক বীরকন্দাজ, সিপাই, সাস্ত্রী। এ চিঠি বিলকুল জাল, হুজুর। আপনি ওকে কয়েদ করুন। খলিফার কাছে খবর পাঠান। তারপরেই দেখবেন, আসল কথা জানা যাবে!

সুলতান মাথা নাড়ে, ঠিক। ঠিক বলেছে মইন। তোমার দেখছি একটু একটু বুদ্ধি হয়েছে। লোকটা একেবারে ফেরেববাজ! ওকে কয়েদখানায় আটকে রাখো। আমি খলিফার দরবারে লোক পাঠাচ্ছি।

মইন চিঠিখানা টুকরো টুকরো করে মুখে পুরে চিবিয়ে থুথু করে ফেলে দিলো।

সুলতান বললো, আহা, তুমি অতো উত্তেজিত হচ্ছে কেন মইন?

—হবোনা। লোকটা ঠগ, জোচ্চোর, পাজি, বদমাইশ? খলিফা তো দূরে থাক, ও কখনো তার উজির জাফর-এর কাছে পৌঁছতে পেরেছে? ও একটা শয়তান। ওকে শিক্ষা দেওয়া দরকার। আপনি হুকুম করুন, হুজুর, আমি ওরা দাওয়াই-এর ব্যবস্থা করছি। আর নাহলে আমার হাতে ছেড়ে দিন। আমি এমন শিক্ষা দেবো, যা সে জীবনে ভুলতে পারবে না। আচ্ছ এক কাজ করুন, হুজুর। লোকটাকে সঙ্গে নিয়ে দরবারের কোন পরিষদকে পাঠিয়ে দেন বাগদাদে। তাহলেই আসল ঘটনা টের পাওয়া যাবে। তারপর বাছাধনকে আমি চিঠি জাল করা বের করে দেবো।

মইন-এর যুক্তিতর্কে সুলতানের ক্রমশ স্থির বিশ্বাস জন্মে যে, লোকটা সত্যিই জালিয়াৎ। হুকুম দেয়, ওকে আচ্ছা করে বেত লাগাও। যতক্ষণ না কবুল করে, চালাও বেত।

আলী নূরকে পিছমোড়া করে বেঁধে, মাটিতে ফেলে বেতের ঘা মারা হতে লাগলো। বেচারী নূর কিছুক্ষণের মধ্যেই অচৈতন্য হয়ে পড়ে। সুলতান হুকুম দিলো, এবার কয়েদখানায় পুরে রাখে। পরে আবার দেখা যাবে।

মইন এসে কয়েদখানার সর্দারকে বলে গেলো। প্রতিদিন সকল সন্ধ্যায় বেত চালাবে, যতদিন–

সৌভাগ্যক্রমে কয়েদখানার সর্দার ছিলো| উজির-আল-ফাদলের বিশেষ প্রিয়পাত্র। নূরকে ফিসফিস করে বললে, মালিক, আপনার বাবার নোকর ছিলাম আমি। তার নূন খেয়েছি। আমি আপনাকে যতটা পারি বাঁচাবো। আপনি শুধু মরার মতো পড়ে থাকবেন।–যাতে উজিরটা সন্দেহ করতে না পারে। আমার ওপর হুকুম হয়েছে, সকাল বিকাল আপনার ওপর অত্যাচার চালাতে হবে। আপনাকে দিয়ে স্বীকার করাতেই হবে, আপনি একটা জালিয়াৎ। কিন্তু হুজুর, আমি তো জানি, আপনার দ্বারা আমন নোংরা কাজ করা সম্ভব নয়। আপনি একেবারে ওদিকে গিয়ে শুয়ে পড়ুন। মইন এলে কোন সাড়া দেবেন না।

চল্লিশ দিন কেটে গেলো। সর্দার প্রতিদিন সকাল-বিকাল উজিরের কাছে খবর পাঠায়। বেত মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলেছে তাকে। কিন্তু কিছুই সে কবুল করেনি।

একচল্লিশ দিনের দিন বাগদাদ থেকে নানা ধরনের মূল্যবান উপহার সামগ্ৰী এলো বসরোহর সুলতানের কাছে। সুলতান কিছু অনুমান করতে পারলো না, কি ব্যাপার! যারা বয়ে নিয়ে এসেছিলো বাগদাদ থেকে, তারাও কিছু বলতে পারলো না। খলিফার হুকুমে উজির তাদের পাঠিয়েছেন। এখানে। ব্যস। এর বেশী কিছু জানে না তারা। সুলতান চিন্তিত হলো। এতকালের মধ্যে বাগদাদ থেকে তো কোন উপহার সামগ্ৰী আসেনি। বরং বাগদাদেই ফিবছর ভেট পাঠাতে হয় তাকে। তবে? কিছুই ভেবে পায় না সে। আমীর ওমরাহদের কাছে পরামর্শ চাইলো-এই উপহারের কি অৰ্থ?

পারিষদরা বললো, খলিফা এ উপহার পাঠিয়েছে ঐ যুবক নতুন সুলতানের জন্যে। তাকে অভিনন্দন জানিয়ে এই শুভেচ্ছা উপহার পাঠানো হয়েছে।

মইন বললো, এখনও আপনি ওকে কেন জ্যান্ত রেখেছেন হুজুর? আপনি কি জানেন না, শত্রুর শেষ রাখতে নাই।

—তুমি ঠিক বলেছে, মইন। শত্রুর শেষ রাখতে নাই। এখুনি ওর গর্দান নাও।

মইন তখন সারা শহরে ট্যাড়া পিটিয়ে ঘোষণা করে দিলো; সুলতানের হুকুমে উজির অল-ফাদলের পুত্র জালিয়াৎ আলী নূর-এর গর্দােন নেওয়া হবে। যারা এই দৃশ্য স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে চায়, সকাল দশটার সময় দরবার প্রাঙ্গণে হাজির হতে পারে।

সকাল থেকে দলে দলে লোক এসে ভীড় জমাতে লাগলো দরবার প্রাঙ্গণে। হায় হায় করতে লাগলো সকলে। মইন এলো কয়েদখানার সামনে। সঙ্গে দশ জন প্রহরী। সর্দারকে বললো, আলী-নূরকে দাও। আজ ওর গর্দান নেওয়া হবে।

সর্দার বললো, আজ চল্লিশ দিন ধরে বেতের ঘায়ে সে তো এমনিতেই আধমরা হয়ে পড়েছে। আজ আবার তার গর্দান নেবার হুকুম হলো কেন?

মইন বললো, তা আমি কি করে বলবো? সুলতানের হুকুম, তামিল করতে হবে।

কয়েদখানার দরজা খুলে দেয় সর্দার। মইন চিৎকার করে ওঠে, এই জালিয়াতের বাচ্চা জালিয়াৎ, এদিকে বেরিয়ে আয়। আজ তোর মউৎ হাজির।

আলী নূর বেরিয়ে আসে। চলো, কোথায় যেতে হবে। তবে এও জেনে রাখো মইন, আল্লাহ উপরে আছে, তোমার শয়তানী তিনি সবই দেখছেন। আমার হাত থেকে রক্ষা পেলেও তার হাত থেকে রেহাই পাবে না তুমি।

—থামো, রাখো তোমার বুকনী। এবার চলো হাডিকাঠ তৈরি।

মইনের হুকুমে প্রহরীরা তাকে একটা খচ্চরের পিঠে বাঁধলো। কিন্তু এগোতে সাহস করলো না। উত্তাল জনস্রোত তখন ধেয়ে আসছে কয়েদখানার দিকে। সবারই কণ্ঠে একই ধ্বনি, আমাদের নতুন সুলতান আলী নূরের মুক্তি চাই-মুক্তি চাই। আলী নূর জিন্দাবাদ। উজির মাইন মুৰ্দাবাদ। আমাদের সুলতান-আলী নূর আলী নূর। আলী নূর হুকুম করো, মইনের মাথা গুডিয়ে দিই-গুডিয়ে দিই। এই রকম নানা ধ্বনি দিতে দিতে জনতা এগিয়ে আসতে থাকে।

আলী নুর চিৎকার করে বলে, ভাইসব ধৈর্য ধর, শান্ত হও। পাপীর শাস্তি আল্লাহ দেবেন।

একদল যুবক চিৎকার করে ওঠে, মইনের মুণ্ডু চাই। ব্যাটাকে কেটেটুকরো করে কুকুর দিয়ে খাওয়াবো।

আলী নুর শান্ত করার চেষ্টা করে, না না, অমন কাজ করো না তোমরা।

মইন হুঙ্কার ছাড়ে, তোমরা দাঁড়িয়ে রইলে কেন? বর্শা উচিয়ে ধরে। এগিয়ে চলো।

জনতার মধ্যে খচ্চরটাকে এগিয়ে নিয়ে যায় প্রহরীরা। আলী নূর সবাইকে স্বাগত জানাতে থাকে। এই ভাবে প্রাসাদ প্রঙ্গণে এনে হাজির করা হয় আলী-নূরকে। হাডিকাঠ তৈরি। জল্লাদও প্রস্তুত। হাতে হার শাণিত তারোয়াল।

এবার শয়তান মইন চিৎকার করে ওঠে, তোমরা সবাই দেখো, এবার জালিয়াৎ নূরকে কোতল করা হচ্ছে। জল্লাদকে উদ্দেশ্য করে বলে, আর দেরি করছে কেন? সুলতানের হুকুম তামিল করো।

জল্লাদ এগিয়ে আসে। নূরের কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, আমি আপনাদের আজ্ঞাবহ দাস মাত্র। যা হুকুম হবে আমাকে তাই করতে হবে। আপনার বাবা আমাকে স্নেহ করতেন। আহা, তার মতো মানুষ হয় না। আপনি শেষবারের মতো সুলতানের কাছে আজি পেশ করুন না, মালিক। দেখুন হয়তো তিনি মকুব করে দিতে পারেন।

আলী নূর চিৎকার করে বলতে থাকে, তোমরা কে আছে। কোথায়, শোনো, আমি কোন দোষ করিনি, তবু আমার প্রাণদণ্ডের বিধান হয়েছে। এত বড় অবিচার আল্লাহ সহ্য করবেন না। এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে একদিন।

প্রাসাদের ওপর থেকে মইন মুখ বাড়িয়ে বলে, জল্লাদ, এখনও তুমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে?

এই সময় কে একজন এক এক গেলাস জল এনে দিলো নূরের হাতে। জলের গেলাসটা মুখে তুলেছে, এমন সময় মইন নেমে এসে এক ঝটিকায় জল-সুদ্ধ গেলাসটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো। এবার জল্লাদকে ধমক দিয়ে বলে, কি হচ্ছে কি এসব, শুধু সময় নষ্ট করছে। কেন?

জল্লাদ এবার নূর-এর চোখ বেঁধে দিলো। জনতা সমস্বরে গর্জে উঠলো। উজির মইন মুৰ্দাবাদ।

হঠাৎ অশ্বখুরের শব্দে নিস্তব্ধ হয়ে গেলো সব কলকোলাহল। শুধু শোনা যেতে লাগলো, খটু-খটু-খটু-খটু আওয়াজ। বুঝতে বাকী রইলো না, এক বিশাল অশ্বারোহী বাহিনী প্রাসাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। ধূলি-বালিতে অন্ধকার হয়ে এলো চারদিক। সুলতান গবাক্ষপথে মুখ বাড়ালেন। দেখতে পেলেন, বিশাল এক ফৌজি বাহিনী টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে ধেয়ে আসছে। পুরভাগে খলিফার উজির জাফর অল বারম্যাকী। সুলতান বললেন, মইন, নিচে যাও দেখে এসে কে আসছেন? মনে হচ্ছে, খলিফার সৈন্যবাহিনী নিয়ে উজির জাফর নিজে এসেছেন।

মইন বললো, আপনি কি করছেন হুজুর। জল্লাদকে হুকুম দিন, সে যেন আর এক পলকও দেরি না করে। নূরের কাল্লা নামিয়ে দিন।

সুলতান বলে, থামো তুমি। তোমার বুদ্ধিতে অনেক লাভ হয়েছে। এবার যা বলছি শোনো। উজির জাফরকে অভ্যর্থনা করে নামাও, আমি যাচ্ছি।

মইন নিচে নেমে গেলো। সুলতানও নামলো একটু পরে।

উজির জাফর তার আগমনের উদ্দেশ্য সবিস্তারে বর্ণনা করলো সুলতানের কাছে :

আলী নূরকে খৎ লিখে খলিফাই পাঠিয়েছিলেন। তার পর তিনি যথারীতি নানা কাজের মধ্যে সে কথা আর মনে রাখেন নি। রাখার কোনও দরকারও বোধ করেন নি। খলিফার হুকুম কেউ অমান্য করতে পারে, সে তো কেউ স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে না। তার দৃঢ় বিশ্বাস, আলী নূর এখানকার সুলতান হয়ে দিব্যি সুখে প্রজাপালন করছে। আলী নূর তার বাঁদী মধুমিতাকে খলিফার হেফাজতে রেখে এসেছে। কথা ছিলো, বসরাহর সিংহাসনে বসে সে তাকে নিয়ে গিয়ে হারেমের প্রধান বেগম করে রাখবে। খলিফাকে বলে এসেছিলো, সে যতদিন না ফেরে। ততদিন মধুমিতাকে তিনিই যেন ভোগ দখলে রাখেন। মধুমিতার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে মাত্র একটি দিন কাটিয়েছেন খলিফা। তারপর তিনি অন্য দিকে মন ফিরিয়ে নিয়েছেন। এক মাস কাল কেটে গেছে। মধুমিতার কথা একেবারেই ভুলে গেছেন। খলিফার স্বভাবই ঐরকম। এই মুহূর্তে তিনি যা করলেন, পরের মুহূর্তে আর তা স্মরণ করেন। না। আবার নতুন কোনও সমস্যা নতুন কোনও কাজের মধ্যে নিজেকে 2 ته ডুবিয়ে দেন। এই ভাবে আলী নূর এবং মধুমিতা দুজনেই তীর মনের পর্দা থেকে সরে গিয়েছিলো। একদিন খলিফা প্রাসাদের ভিতরে ঢুকছেন, এক করুণ কান্না ভেসে এলো কোন এক কামরা থেকে। ক্ষণকালের জন্য দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি।—কে কঁদে?

একজন পার্শ্বচর বলে, হুজুর, মধুমিতা।

–মধুমিতা? খলিফা অবাক হন, সে কে? সে কেন আমার প্রাসাদে?

পার্শ্বচর বলে, আজ্ঞে আপনি মধুমিতাকে ভুলে গেছেন?

—ভুলে যাবো? আমি কি চিনতাম যে ভুলে যাবো? ও নামের কোন মেয়েকে তো আমি মনে করতে পারছিনে।

—আজ্ঞে সেই যে—আলী নূর? তার বাঁদী।

—তা আলী নূরের বাঁদী আমার প্রাসাদে কেন? আর আলী নূরই বা কে?

তখন তাকে সেদিন রাত্রের সব কাহিনী আবার মনে করিয়ে দেওয়া হয়। তখন তিনি লাফিয়ে ওঠেন। ওঃ হো হো, বিলকুল ভুলে গেছি। মেয়েটা আজ একমাস ধরে একা একা আছে। একবারও দেখাশুনা করিনি। অথচ আলী নূর বিশ্বাস করে আমার হাতে ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিলো। তোমরাও এমন হতভাগা একবার মনে করিয়ে দিতে পারোনি?

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন খলিফা। খলিফাকে দেখে মধুমিতার কান্নার রোল আরও উচ্চগ্রামে ওঠে। পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে মিনতি জানায়, একটি বার আলী নূরের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিন, জাঁহাপনা। আমি আর তাকে ছেড়ে থাকতে পারছি না। এতদিন হয়ে গেলো, সে ফিরে এলোনা। একটা খবর পাঠালো না। এ তো হতে পারে না; নিশ্চয়ই তার কোন বিপদ আপদ ঘটেছে। তার জীবনে আসার পর থেকে একটি দিনও সে আমাকে ছেড়ে থাকেনি। আমাকে না দেখলে যে মানুষটা এক মুহুর্ত থাকতে পারে না, আজ এক মাস হয়ে গেলো, সে কেমন করে আছে, আপনি আমাকে একটি মাত্র দিন সম্ভোগ করেছিলেন, তারপর আর কোন খোজ করেন নি। আমার।

খলিফা বললেন, আমি নানা কাজের মানুষ, ভুলে যেতে পারি। কিন্তু তুমি? তুমি তো আমাকে তলব করতে পারতে সুন্দরী।

—বাদীর কি সে অধিকার থাকে? আমি তো আর হারেমের বেগম নাই?

খলিফা বললেন, অধিকার কি কেউ হাতে তুলে দেয়? ওটা আদায় করে নিতে হয়। যাক ওসব কথা, এখন হুকুম করো সুন্দরী, বান্দা হাজির।

চোখে জল মুখে হাসি নিয়ে সে-এক অপূর্ব মোহিনী রূপে তাকালো মধুমিতা।

—একটা মাস আমার চোখে ঘুম নাই। আলী নূর-এর একটা খোঁজ পাওয়ার জন্যে মন আমার চঞ্চল হয়ে উঠেছে, জাঁহাপনা। আপনার পায়ে ধরে মিনতি করছি, একটিবার তার সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দিন।

সেইক্ষণেই জাফরকে তলব করলেন খলিফা। জাফর এসে দাঁড়ালে বললেন, দেখো, প্রায় একমাস আগে আমার খৎ নিয়ে বসরা হয় গেছে আলী নূর। তারপর থেকে তার আর কোনও খবর নাই। আমার মনে হচ্ছে, ওখানকার সুলতান বিদ্রোহী হয়েছে। আলী নূরকে সে হত্যা করেছে। আমার হুকুম সে অগ্রাহ্য করেছে। কিন্তু এও বলে রাখছি, জাফর, আলী নূরের যদি কেউ ক্ষতি করে তাকে রেহাই দেবো না। তা সে যেই-ই হোক। আমার প্রাণের বন্ধু হলেও নিস্তার পাবে না। আমার হাতে। আমার ইচ্ছা, তুমি আর এক মুহূর্ত এখানে বিলম্ব না করে, লোক-লস্কর যা প্রয়োজন নিয়ে, বসরোহর পথে রওনা হয়ে যাও। আমি জানতে চাই মহম্মদ সুলেমান কী ধরনের আচরণ করেছে আলী নূরের সঙ্গে।

উজির জাফর বললো, খলিফার নির্দেশে আমি এসেছি আপনার কাছে। এখন বলুন, আলী নূর কোথায়? এবং কীভাবে তাকে রাখা হয়েছে। আর এই বিশাল জন-সমুদ্র দেখছি, এরাই বা এমন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে কেন? খলিফার হুকুম আছে, আলী নূরের ওপর যদি কেউ অত্যাচার করে থাকে তাকে আমি হত্যা করবো।

আলী নূরকে বধ্যভূমি থেকে ফিরিয়ে আনার জন্যে হুকুম করলো সুলতান। জাফর কিন্তু আলী নূরের আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলো না। সুলতান আর তার উজির মাইনকে গ্রেপ্তার করলো। এবং ঘোষণা করে দিলো, এখন থেকে আলী নূর হবে বসরোহর সুলতান।

মহাসমারোহে আলী নূরকে বসরোহর সিংহাসনে বসালে জাফর। তিনদিন ব্যাপী চললো উৎসব আনন্দ। চতুৰ্থদিন সকালে আলী নূর জাফরকে বললো, ধর্মাবতারকে দেখার জন্যে মন আমার চঞ্চল হয়ে উঠেছে। জাফর বললো, ঠিক আছে, নামাজের পরই আমরা বাগদাদে রওনা হবো। মহম্মদ সুলেমান আর মাইনকে আমরা সঙ্গে নিয়ে যাবো বন্দী করে। খলিফা নিজেই ওদের বিচার করে যা সাজা দেবার দেবেন।

আলী নূরকে সঙ্গে নিয়ে বাগদাদে পৌঁছে, সর্বাগ্রে খলিফার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলো জাফর। খলিফা তাঁর তলোয়ারখানা আলী নূরের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, নাও ধরো, তুমি নিজে হাতে কেটে নামিয়ে দাও ওই শয়তান মইনের মাথাটা।

আলী নূর হাত পেতে নিলো তলোয়ারখানা। মইনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। মইন তখন দুহাত জোড় করে কাতরভাবে বলতে থাকে, আলী নূর, তুমি তো জানো, আমি জন্মগত ভাবেই দুষ্ট চরিত্রের লোক। সারা বসরা হতে আমার কোন সুনাম ছিলো না। প্রতিটি মানুষ আমাকে খারাপ বলেছে। প্রতিনিয়ত আমার মৃত্যু কামনা করেছে। আমি জানি, তারা কিছু অন্যায় বলেনি। সত্যিই আমি খারাপ। আর সেই জন্যেই তোমার ওপর অত অত্যাচার নির্যাতন করেছি। তোমাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবার ষড়যন্ত্রও করেছিলাম। সবই আমার মন্দ চরিত্রের ফল। কিন্তু আলী নূর, তুমি? তুমি তো সর্বজন পূজ্যপাদ উজির অল ফাদলের সুযোগ্য পুত্র। খানদানী বংশের রক্ত আছে তোমার শিরায়। জ্ঞানত তোমার দ্বারা কারো ক্ষতি কখনও হয়নি। এবং আমার বিশ্বাস, হতে পারে না। তোমার মতো উদার এবং মহৎপ্রাণ কি আমার তুল্য অধম আচরণ করতে পারে? আমি খারাপ, দুষ্ট, শয়তান–আমি তোমাকে বিনা দোষে হত্যা করতে পারি। কিন্তু তুমি তো। সৎবংশের ছেলে। তুমি কি আমাকে দোষী জেনেও হত্যা করতে পারো?

এই কথা শুনে আলী নূর খলিফার পায়ের কাছে তলোয়ার নামিয়ে রেখে বললো, আপনি মার্জনা করুন, জাঁহাপনা। মইন আমাকে কথার প্যাঁচে ঘায়েল করে ফেলেছে। আমি পারবো না।

খলিফা চিৎকার করে উঠলেন, মসরুর?

বান্দা হাজির, জাঁহাপনা।

–ওই শয়তানটার মাথা ধড় থেকে নামিয়ে দিবি-এক কোপে।

খলিফা এবার আলী নূরকে জিজ্ঞেস করলেন, এবার বলো, তুমি কি চাও?

আলী নূর কুর্নিশ জানিয়ে বললো, জাঁহাপনা, সলতানিয়তে আমার লোভ নাই। আমি সুলতান হতে চাই না। বসরোহর সুলতান হয়ে আমি কি করবো? তার চেয়ে আপনি অনুমতি করুন, যতদিন বঁচি, আপনার কাছে কাছেই যেন থাকতে পারি।

খলিফা বললেন, তাই হবে। তুমি খুশি হলেই আমি খুশি।

আলী নূর আর মধুমিতার জন্যে একখানা সুরম্য প্রাসাদ বানিয়ে দিলেন খলিফা। নানা প্রকার দামী দামী আসবাব পত্রে সাজিয়ে দিলেন প্রাসাদকক্ষ। প্রতি মাসে নিয়মিত এক হাজার দিনার মাসোহারার বন্দোবস্ত করে দিলেন। আলী নূরকে করে নিলেন তার দরবারের অন্যতম পরিষদ। আর মহম্মদ সুলেমানকে ক্ষমা করে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করলেন বসরোহর সিংহাসনে। বলে দিলেন, ভবিষ্যতে যেন আর সে ঐ রকম বদমাইশ উজির নিযুক্ত করে প্রজাদের সর্বনাশ না ঘটায়।

এরপর তারা সবাই যে যার মতো সুখে সচ্ছন্দে দিনকাটাতে লাগলো।

Leave a Reply