সখী ঠাকরুন গাে! আপুনি শিগগিরি ঘর আসেন। নােক এয়েচেন।
ময়ুরাক্ষী নদীর একটি জনবিরল ঘাটে জলস্রোতের মধ্যে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে কতকটা যেন অঙ্গ এলিয়ে দিয়ে ভাসার মতাে ভেসে ছিল মধ্যবয়সী একটি মেয়ে। রঙটা গৌরবর্ণ, কাঁটা সােনার মতাে। চুলগুলাে কষকষে কালাে ও তৈলমসৃণ, চোখ দুটি ডাগর, মেয়েটি গলা ডুবিয়ে বসে নদীর জল মুখে টেনে নিয়ে কুলকুচি করে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছিল। ফেলছিল কতকটা যেন যৌবন-লীলাচ্ছলে। নদীর ঘাটে লােক নেই। ওপারেও যতদূর দেখা যাচ্ছে তাতে ওপারকেও নির্জন বলা চলে। এই নির্জনতার মধ্যে নদীর জলে গলা ডুবিয়ে বসে কিছু যেন সে ভাবছিল।
যে ডাকলে তাকে, সে একটি দশ-এগার বছরের মেয়ে। একটা ইজের আর একটা বড় গায়ের ঢলঢলে ব্লাউজ পরে এসে দাড়াল। সখী ঠাকরুন নাম্নী মেয়েটি আস্তে আস্তে পাড়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললে, মায়ের থানে লােক আসবে বলেই তাে মায়ের থান। লােক তাে রােজ আসছে। তার আবার তাগিদ কিসের? যে এসেছে তাকে বসতে বল্ গাে যা। আমি কারুর কেনা বাদি নই। সি বসবে না। আদালতের নােক! আদালতের? চমকে উঠল স্নানার্থিনী সখী ঠাকুরানী। ময়ূরাক্ষীর উত্তরে সাঁইথিয়া কাঁদী রাধারঘাট পর্যন্ত যে প্রাচীনকালের মেটে সড়কটা বর্তমানে পিচ দেওয়া পাকারাস্তাতে রূপান্তরিত হয়েছে, এর উত্তর-দক্ষিণে একটা সুপ্রাচীন অঞ্চল আছে। এই অঞ্চলের মধ্যে অনেক প্রাচীন গ্রামের অনেক প্রাচীন নিদর্শন আছে। তারই মধ্যে একটি বিলুগ্রাম। বিল্বগ্রামের দেবীর নাম বিল্ববাসিনী; তিনি নাকি অন্য কেউ নন; তিনি নাকি মদনভস্মে হতমানিনী উমা। এখানকার এই বিতলে এসে দুশ্চর তপস্যা শুরু করেছিলেন তাঁর তপস্যায় আকৃষ্ট শিব এসে দ্বারপ্রান্তে ভিক্ষুনাথরূপে দাঁড়িয়ে আছেন আর এই দেবস্থানে তপস্বিনী উমার আজ্ঞাবাহিনী এবং সকলকিছুর ভার নিয়ে রয়েছেন যিনি তিনি জয়া-বিজয়ার মতােই তাঁর সখী। তিনিই এখানে সর্বময়ী। তিনি কুমারী, তিনি ব্রহ্মচারিণী। তাঁরই নাম সখী ঠাকরুন। বিল্বগ্রাম গ্রামখানি বড় নয়; ছােট গ্রামই বটে। গােটাছয়েক পাকা ওপরপাড়া বা উত্তরপাড়া, নামােপাড়া দক্ষিণপাড়া-পশ্চিমপাড়াও আছে। এগুলাে অবিচ্ছিন্ন অর্থাৎ এপাড়ায় পাড়ায় ব্যবধান বিশেষ কিছু নেই। তবে এ তিন পাড়া ছাড়া ঘাঘরাপাড়া আছে, তাঁতিপাড়া আছে আর আছে দেবাংশীপাড়া। এই পাড়াগুলাে বেশ ছাড়া ছাড়া।
সব থেকে স্বতন্ত্র-মূলগ্রাম থেকে প্রায় রশিদুই দূরে দক্ষিণে ময়ুরাক্ষীর দিকে বিবাসিনীতলা, মায়ের স্থান। ঘনছায়ানিবিড় একটি আশ্রমের মতাে ঠাইটির চেহারা; ঘনসন্নিবিষ্ট গাছপালা ঝােপঝাড় বাঁশবন দিয়ে ঘেরা প্রায় পঁচিশ তিরিশ বিঘা জুড়ে একটি এলাকা। ময়ুরাক্ষী তীরের মাটি খুব উর্বর একটু লালচে; এই উর্বরতার জন্য গাছপালা আপনি জন্মায়। এখানে গাছের বেশিভাগই হলাে তেঁতুল, অর্জুন আর বনশিরীষ । তারই সঙ্গে কুঁচের লতা আর তেলাকুচার লতা যাকে বলে বিষফল। এরই মধ্যে দুটো পুকুর। একটা বড় একটা ছােট। এই পুকুর দুটোর মধ্যবর্তী স্থানটিতে দেবস্থল। একটি প্রশস্ত বাঁধানাে বিল্বমূল হলাে আসল দেবস্থল। এখন তার পাশেই একটি মন্দির-মন্দির নয়; একখানি একতলা ঘরে দেবীর প্রস্তরময়ী মূর্তি সিঁদুরে তেলে লােহিতাঙ্গিনী। তারই একটু দূরে একটি শিবস্থান। ভিক্ষুণাথের আসন। এছাড়া আছে সামনে একটি বাধানাে চত্বর; এখানে যাত্রীরা এসে বসে বিশ্রাম করে। মধ্যে মধ্যে পূজাপার্বণে উৎসব হয়। দেবতার আটন-মন্দির-শিবস্থান-সামনে বাঁধানাে স্থান ছাড়া আরও কতকগুলাে ঘরদোর নিয়ে আশ্রম। এটা মাটকোঠা। তার সঙ্গে রান্নাঘর, গরুবাছুরের জন্য গােয়াল ঘর, চালা। এছাড়া আছে দেবস্থলের এলাকা থেকে একটু সীমানা বাঁচিয়ে ঘর-চার-পাঁচ দেবাংশীদের ঘর। আরও কয়েক ঘর অন্য লােকের বাস আছে, তারা ঠাকুরতলার কাজকর্ম করে। দেবতা-সম্পর্কে জনপ্রবাদ বা উৎপত্তি বিবরণ যাই হােক না কেন, দেবতার মহিমা কিন্তু বিচিত্র। বিবাসিনীকে পূজা দিলে বা তাঁর কাছে মানত করলে পলুপােকা বা রেশমকীট প্রতিপালনে আশ্চর্য ফল পাওয়া যায়। আজকাল এই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার এ দেশের রেশমের খুব চাহিদা বেড়েছে-দেশান্তরে কদর হয়েছে; চাষিরা নতুন করে রেশমপােকা পালন করে গুটি তৈরি করছে, সঙ্গে সঙ্গে মা বিল্ববাসিনীর কদর হয়েছে। লােকজনে নানান মানত করে যায়। মায়ের যে নতুন মন্দিরটি তৈরি হয়েছে তার সামনে বাঁধানাে জায়গাটি তাে ছােট ছােট মার্বেল ট্যাবলেটে প্রায় ভরে গেছে। মধ্যে মধ্যে আজকাল নাটমন্দিরের কথা উঠছে। চিন্তা হয় এরপর ট্যাবলেট বসাবে কোথায়? টপটপ করে পর পর তিন/চারটে ডুব দিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল সখী ঠাকরুন । এলােখোঁপাটা জলের ভারে ভেঙে বুক মুখ এবং পিঠের উপর ছড়িয়ে পড়ল। সামনের দিকে ছড়িয়ে পড়া চুলগুলাে হাত দিয়ে পিছন দিকে ঠেলে দিয়ে সে নিজের সারা অঙ্গের দিকে তাকালে। দুর্দান্ত যৌবন বয়সের ভারে ভেঙে পড়েছে। গলার পদ্মবীজের মালাটা ঠিক করে নিলে। চোখের দৃষ্টি যথাসম্ভব নামিয়ে নিজের সর্বাঙ্গে বুলিয়ে নিয়ে কাপড়খানা নিংড়ে গায়ে জড়িয়ে তার উপর লাল গামছাখানাকে বেড় দিয়ে, কাকে পিতলের মাজা কলসি এবং ডান হাতে পিতলের বালতিতে জল ভরে নিয়ে ঘাট থেকে উঠে এসে বললে-চল আদালতের লােক কি বলে দেখি, চল ।
সে জানে-আদালতের লােক যে হুকুম জারি করতে এসেছে-সে তা জানে। তার উকিল তাকে বলেছেন। বলেছিল, সেই আদালতে জজসাহেবের কাছে বক্তৃতা শেষ করে এসে আদালতের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলেছিল-জিত তােমার হবেই বাপু। তুমি নিশ্চিন্ত থেকো। যেসব সাক্ষী-প্রমাণ তােমার পক্ষের, তাতে কার সাধ্যি তােমাকে নড়ায়। ওই যে তােমাদের আগের কালের জমিদার-বাবুর সাক্ষী খুব জবর সাক্ষী দিয়েছেন উনি! আমাকে কিন্তু খুব সরেস গরদের থান দিতে হবে, বুঝেছ। হ্যা, যতােদিন রায় না বের হয় ততদিন যেন ছেলেটাকে মেয়েটাকে তাড়িয়ে দিয়াে না। এখন যেমন আছে তেমনি থাক। ছেলেটা আর মেয়েটা। তারই বােনপাে আর, বােনঝি, রক্তের সম্বন্ধ অবশ্য নেই। কিন্তু তার থেকেও বেশি, সেই তাদের মানুষ করেছে। তারাই আজ তার উপর মােককণমা। করেছে। এই সখী ঠাকরুন পদ থেকে অপসারিত করবার জন্যে, তাড়িয়ে দেবার জন্যে তারা উঠে পড়ে লেগেছে। সে নালিশের আরজির কায়দা কত! শুনে সর্বাঙ্গে দুঃসহ জ্বালা ধরেছিল তার। ‘এই মামলার বিবাদিনী শ্রীমতী এলােকেশী দেবাংশিনী প্রথম হইতেই এই পবিত্র দেবস্থল বিল্ববাসিনীতলার অধিষ্ঠাত্রী দেবতার সখী ঠাকুরানী হইবার উপযুক্ত নহেন। এলােকেশীর পূর্ববর্তিনী সখী ঠাকুরানী মৃতা শ্যামাদাসী কোনদিনই তাঁহাকে বিধিমতে এই সখী ঠাকুরানীর পদে বহাল করেন নাই। তাহারা কোনাে অভিষেক্যজ্ঞ সম্পন্ন হইয়াছে বলিয়া কোনাে প্রমাণ নাই বা কেহ প্রমাণ দিবেন না। ১৯৩৮ সালে মৃতা শ্যামদাসী একটা অভিষেকক্রিয়া করাইবার ভান করিয়াছিলেন-শাস্ত্রসম্মত ক্রিয়া হয় নাই এবং এলােকেশীর বয়স তখন ষােল হইতে অনেক বেশি। এই ক্ষেত্রে সমস্ত তথ্য এবং তত্ত্ব মিলাইয়া লইয়া সূক্ষ্মবিচার করিলে তবে এই দেবস্থান দেবতত্ত্বের সঠিক অর্থ উপলব্ধি করা যাইতে পারে। এখানে প্রবাদ এই যে, এখানে উমা তপস্যা করিতেছেন-তাঁহার আকর্ষণে শিব আসিয়া দ্বারে দণ্ডায়মান। দ্বার রক্ষা করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন-জয়া বা বিজয়া-তিনিই সখী ঠাকুরানী। ইহা কথিত যে, এই সখী ঠাকুরানী চিরকুমারী ও চিরযুবতী। মােল বৎসর বয়সে বেশি বয়স্কা কেহ সখী ঠাকুরানী হিসেবে নিযুক্ত হইবেন না এবং যৌবন বিগথ হইলেই তাহার নিজের স্থলে তিনি নতুন সখী। ঠাকুরানী নিযুক্ত করেন। এই নিয়মানুযায়ীও বর্তমান সখী ঠাকুরানীর আর ওই পদে অধিষ্ঠিত থাকিবার উপযুক্ততা নেই। তাঁহার যৌবন বিগত হইয়াছে। তিনি বৃদ্ধার সামিলা।’ কি মিথ্যা কথা! কি মিথ্যা কথা! কি মিথ্যা কথা! সে তখন ১৩৪৫ সন ১৯৩৮ সাল। কাগজ আছে তার । পনের পার হয়ে যােলতে পড়বে সে। তখনও এক মাস বাকি ছিল। বিবাসিনীতলায় অনুষ্ঠান হয়েছিল। সে গেরুয়া রঙা লালপেড়ে শাড়ি পরেছিল। মালা পরেছিল। আকন্দফুলের মালা আর গাঁদাফুলের মালা। তার হাতে দিয়েছিল ত্রিশূল আর কাজললতা একখানা। বলেছিল-বিয়ের কথা ভেবাে না, পুরুষের দিকে চেয়াে না। হরগৌরীর মিলনের পর তােমার কথা। বিয়ে হয়ে গৌরী যাবেন কৈলাসে, তুমি যাবে সঙ্গে। তুমি সখী ঠাকরুন। গ্রামের মণ্ডলরা উপস্থিত ছিল। জমিদার ছিলেন। তখনও তাে দেশের রাজা ছিল ইংরাজরা। জমিদারেরা ছিল জমিদারির মালিক। তাদের গাঁয়ের জমিদার ছিলেন অল্পবয়সী তখন। তিরিশ-বত্রিশ বয়স। তাকে সখী ঠাকরুন বলে স্বীকার করার জন্যে জমিদার টাকা নিয়েছিলেন পুরনাে সখী ঠাকরুন শ্যামাদাসীর কাছে। শ্যামাদাসী জমিদারকে টাকা দিয়েছিল, সেই সঙ্গে তার বাবাকেও ছিলেছিল। তার শর্ত ছিল সখী ঠাকরুন এলােকেশীই হলাে; কথাটা ঠিক, -দেবকৃত্য যা করবার তা সেই সব করবে। তবে সবেতেই তার গার্জেন থাকবে শ্যামাদাসী। তার ওপরওয়ালা থাকবে সে। এই সময় থেকে সে থাকতে লেগেছিল শ্যামা মাসির কাছে। শ্যামা মাসিকে লােকে বলত বড় সখী ঠাকুরুন, শ্যামা মাসির তাকেই নিয়ে ছিল ওঠাবসা ঘােরাফেরা সব। রাত্রিবেলাটা কাছে নিয়ে শুয়ে নানান কথা বলত। মনে পড়ছে। বলেছিল-যে ভাগ্যি তােকে আমি দিলাম এলােকেশী, এ ভাগ্যি এ চাকলায় দশ/বিশখানা গাঁয়ের কারুর নেই। বুঝলি? ফুলশয্যের দিন তাের নেমন্তন্ন হবে। বর-কনে তােকে একটা সিধে দেবে আর আশীর্বাদ মাঙবে। তাদের যৌবন ঢলবে-পড়বে তুই সেই থাকবি। তাের যৌবন বাসী হতে না। অবাক হয়ে শুনত এবং তাকিয়ে থাকত এলােকেশী। শ্যামাদাসী একদিন বলেছিল-সেদিন তার ষােল বছর পূর্ণ হওয়ার দিন। সেদিন আবার কিছু কাজকর্ম ছিল সখী ঠাকরুন হিসেবে। সেই ক্রিয়াকর্মগুলাে শেষ হলে পর শ্যামাদাসী তাকে বলেছিল-এলুনি। তার নাম এলােকিশী থেকে সেটা এসে চলতিতে দাঁড়িয়েছিল-এলুনি! সে বলেছিল-বল । একটা ওষুধ আছে আমার কাছে। একটা কেন-ওষুধ আমার কাছে অনেক আছে। এই থানের দৈবওষুধ! সবই মেয়েদের অসুখের ওষুধ। তাের হলাে এই ঝাপিটা। এটা নে। তবে ওষুধ চিনতে হবে। কোন রােগে কি দিতে হয় জানতে হবে। এখন যে ওষুধটার কথা বলছি-সে ওষুধটা সখী ঠাকরুনকে খেতে হয় আজ। সে বলেছিল-কি ওষুধ, দাও। একটা শেকড়-বাটা, তার সঙ্গে আরও যেন কি কি-তার সামনে এগিয়ে দিয়েছিল। শ্যামাদাসী ।-খেয়ে নে। এক ঢােকেই শেষ করিস। বড় তেজী। কিন্তু খাব কেন দাসী? কিসের জন্যে খেতে হবে? এ খেলে আর কোক ফলবে না। একটু মৃদুস্বরে বললে শ্যামাদাসী। চমকে উঠে এলােকেশী, বলেছিল-মাসি!
হ্যা বাছা। এই নিয়ম রে । তবে সবাই খায় না। তাতে বিপদই ঘটে । বুঝলি না? সে বলেছিল-না। এলােকেশী তখন ষােল বছরের। কালটা সেকাল নয়, একাল। ১৯৩৬/৩৭ সাল । এলােকেশী পাঠশালায় পড়েছে; পৃথিবী গােলাকার সে খবর জানত; সায়া সেমিজ ব্লাউজ জানত, পরত, নতুন ফ্যাশনে চুল বাঁধতে জানত। এমনকি দেশ যে স্বাধীন হতে চলেছে, তখন-তাও সে জানত। এই অবস্থায় মাসি তাকে বসালে সখী ঠাকুরানীর আসনে। সুতরাং মাসি শ্যামাদাসীর কথার অর্থ সে ভালাে করেই বুঝেছিল এবং বুঝেই সে চমকে উঠেছিল এবং বুঝেসুঝেই সে বলেছিল-না। শ্যামাদাসী বলেছিল-বেশ, তাহলে এই ওষুধটা খা। ওষধ আরও একটা আছে।। ওটাতে কি হয়? এটা হলাে যৌবন-বন্ধনের ওষুধ। যৌবন-বন্ধনের? তার মানে কি? তুই তাে খুকি নস। এই যে আসনে বসলি-এ হলাে কুমারী মেয়ের আসন। সে চিরকাল কুমারী থাকবে, তার সন্তান তাে হবেই না-তার উপর তার দেহ যৌবন সব অটুট থাকবে। বুক ঢলে পড়বে না। চোখের কোলে কালি পড়বে না মা, যার জন্যে দুনিয়া জুড়াে রঙচঙ স্নাে পাউডার সাবান গন্ধ এত আয়ােজন বুয়েছিস না! হ্যা। যৌবন-বন্ধন ওষুধে এগুলাে তােমার ঠিক রাখবে। একটি বছরের জন্যে ভাবতে হবে না। তুমি নিশ্চিন্ত! সে চুপ করে একদৃষ্টে শ্যামাদাসী মাসির মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। ভাবছিল। কি ভেবেছিল। সেটা সেদিন থেকে আজও পর্যন্ত। যেন ঠিক স্পষ্ট হলাে না। সতীত্ব আতীত্বের প্রশ্ন তাে ঠিক ছিল না! ঘর সংসার স্বামী সন্তান এরও প্রশ্ন তাে ছিল না। এখানকার সেবায়েত সখী ঠাকরুন হয়ে এখানকার বিষয়সম্পত্তি পূজার আমদানির কথাটাই তাে সব ছিল না! শ্যামাদাসীর মুখের দিকে তাকিয়ে কি ভেবেছিল সে-তা সেদিন যেমন অস্পষ্ট ছিল-আজও তেমনি অস্পষ্ট। ওদিকে বাইরে মন্দিরের সামনে বাঁধানাে চত্বরে বা পাটাগনেতে ঘন ঘন উলু পড়ছিল। গ্রামের কুমারী এবং এয়ােতীরা মায়ের নতুন সখী ঠাকরুনের জন্য ঠারগুয়া দিতে এসেছে। তার কপালে সিঁদুরের টিপ পরিয়ে দেবে সকলে, পায়ে আলতা পরিয়ে দেবে; সে একখানা জলচৌকিতে বসে এই অভ্যর্থনা অভিনন্দন নেবে এবং তাদের কপালে এবং সিঁথিয়ে সিঁদুর ঠেকিয়ে দেবে। তার কপালে তারা দেবে সিঁদুরের টিপ। সে-সময় গ্রামে জমিদারবাবু ছিলেন-তিনিও আসবেন বিল্ববাসিনীতলায় এবং মায়ের সেবায়েতকে স্বীকৃতি দেবেন। সন্ধ্যা তখন হয়ে এসেছে, একটা উজ্জ্বল আলাে এসে বিবাসিনীতলায় ঢুকছিল, শূন্যমণ্ডলে সেই আলােটার আভাস দেখে শ্যামাদাসী তাকে তাড়া দিয়ে বলেছিল-একটু খেয়ে নাও এলােকেশী। এতে তােমার ভালােই হবে।
বাবুমশায় বােধ হয় এসে পড়লেন মা। মনে আছে সে সে-ওষুধটুকু খেয়েছিল। শ্যামাদাসী বলেছিল-দেখবি দেব-অঙ্গের মতাে লাবণ্যি হবে মা। রূপ ঝরে পড়বে। শিবচতুকণশীর এক মাস আগের অমাবস্যেতে এই তাের অভিষেক হলাে। আসছে বার আবার এই অমাবস্যেতে এই ওষুধ খেতে হবে তােকে! আমি থাকলে তােকে ঠিক দোব। না থাকলে তুই মনে করে খাবি। ওষুধটা ঝাঁঝাল ছিল। পেটের মধ্যে একটা জ্বালার সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই জুড়িয়ে যেন কেমন ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে জেগেছিল একটি বিচিত্র চিন্তা যে চিন্তা চিতার মতাে মানুষকে জ্বালায় দহন করে সে চিন্তা নয়; সুন্দর চিন্তা আনন্দভরা চিন্তা। চিন্তা ঠিক বলা চলে না। কল্পনা-একটি কল্পনায় সে মেতে উঠেছিল। ‘যৌবন-বন্ধন’ ওষুধ খেল সে। এরপর? মাসি বললে-এ রূপ-যৌবন অক্ষয় হবে। সে প্রদীপের আলাের স্বল্প-আলােকিত ঘরের মধ্যে যেন একখানা আয়নায় নিজের মুখ। নিজের রূপ দেখছিল। ‘দেব-অঙ্গের লাবণ্য। সে যে কি সে জানত না-আজও জানে না। তবে মনে মনে নানারকম করে নিজেকে সে সাজিয়ে গুছিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেছিল। জমিদারবাবু বয়সে খুব নবীন না হলেও নবীনই। সেদিন তিনি শ্যামা মাসির কাছে চার’শ টাকা নজর নিয়েছিলেন। এই টাকা নিয়ে তবে তিনি এলােকেশীকে বিশ্ববাসিনী মায়ের নতুন সখী ঠাকরুন বলে স্বীকার করেছিলেন। শ্যামা মাসি স্থবির হয়েছে-দাঁত ভেঙেছে-চুল পেকেছে আর সে সখী ঠাকরুন থাকবে না। এই নিয়ম। জমিদারই সেই নিয়মের চাপটা দিয়েছিলেন। গ্রামের লােকেরা শ্যামাদাসীর বিরুদ্ধে যায়নি। তাকে খারিজ করে দেওয়ার ব্যাপারে খুব একটা তাগিদ ছিল না তাদের। দেশে তখন নতুন কাল আসছে। শ্যামাদাসীকে চাপ দিলেন-সখী ঠাকরুন থাকা আর তার চলবে না। সেটা গ্রামের লােক সমর্থন করলে। কোন নবীনাটিকে দিয়ে অনেক কাজ করানাে যাবে? কিন্তু শ্যামাদাসী চারশ টাকা দিয়েছিলেন বলেই জমিদার সেদিন সন্ধ্যায় সখী ঠাকুরানীর আসনে অভিষেক-অনুষ্ঠানে নতুন সখী ঠাকরুনকে স্বীকৃতি দিতে এসেছিলেন। শ্যামা মাসি বলেছিল-রাজা, বয়সে বড়, জাতে বামুন, পেনাম কর মা। জমিদার বলেছিলেন- না। বলে একটা নমস্কার করে হেজাক বাতি একটা তার সামনে নামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন-কেমন সখী ঠাকুরুন হলাে দেখি, দাঁড়াও। জমিদার তরফের এই মালাটা নাও আর কি বলে-এই কাপড় শাড়ি তােমার জন্য। গেরুয়া রঙে আর রাঙিয়ে দেইনি। এই যুগে আবার গেরুয়া কেন? লালপাড় হলেই যথেষ্ট। কি বল? সে মুখ তুলে পরিপূর্ণ-দৃষ্টিতে জমিদারের দিকে তাকাতে পারেনি। লজ্জায় চোখের পাতা যেন নুয়ে নেমে এসেছিল। কানের পাশ-দুটো গরম হয়ে উঠেছিল। জমিদার সেই হেজাকের আলােয় তাকে দেখে বলেছিলেন-মায়ের সখী ঠাকরুন ভালো হয়েছে। শ্যামাদাসীর পছন্দ ভালাে। লেখাপড়া জানে শুনছি? আজ্ঞে হ্যা। জানে। প্রথম দ্বিতীয় ভাগ পড়ে আরাে কিছুটা পড়েছে। ভালাে ভালাে। দেখ-তুমি তাহলে এখানে মেয়েদের জন্যে একটা কিছু কর! আপনকার হুকুম হলেই হবে। আর তাে শুনছি বন্দেমাতরমে ভয় নেই। সায়ের মশায়রা সব চলে যাবেন। এখন আপনারা বললে হবে বইকি! তা হবে। তা করবে। এখন আমাদের কাজটা সারতে দাও দিকি! বলেছিল পশ্চিমপাড়ার গােপেশ্বর মণ্ডলের ছেলে-রমন্দ মণ্ডল। শুধু রমন্দ মণ্ডল নয়-ছয় পাড়ার ছয় মণ্ডল আর তাদের ছেলেরা ছিল। তারা এসেছিল একটি-একটি সিধা নিয়ে। পাঁচপাে চাল তদুপযুক্ত ডাল, তেল, নুন, তরকারি এবং সবার উপরে দুজোড়া বা চার জোড়া মণ্ডা। তার সঙ্গে কেউ দিয়েছে একটি সিকি বা একটি আধুলি। আলােচনাটা জলের স্রোতের মতাে এঁকে বেঁকে গড়িয়েই চলেছিল-ঢালের মুখটা ছিল গ্রামের উপকার দেশের উপকারমুখী। সে বসেছিল চুপ করে সমাজের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টিটা ঠেকেছিল গিয়ে সামনের বড় পুকুরটার ঘাটের মাথায় জমা-হওয়া পুঞ্জ পুঞ্জ অন্ধকারের মধ্যে। তারও মধ্যে সে দেখছিল নিজের ছবি। কথা বলছিল মােড়লদের ছেলেরাই বেশি। ছয় মােড়লের ছয় ছেলেদের মধ্যে কংগ্রেসীই বেশি। একজন আছে হিন্দু মহাসভা। একজন ছিল লাল ঝাণ্ডা কাস্তেহাতুড়ি। সকলের কাছেই যেন সে প্রসাদবণ্টনকারিনী মতাে প্রসাদী নৈবেদ্যের একটা প্রকাণ্ড পরাত হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ঐ প্রসাদ-বিতরণের সঙ্গে সে আরও কিছু বিতরণ করছিল। ওই প্রসাদ গ্রহণকারীদের সেইটুকুর জন্য কাঙালপনার আর শেষ ছিল না। সেটুকু হলাে তার অপূর্ব সুন্দর মুখের প্রসন্ন হাসির একটু একটু টুকরাে। পুরুষরা যতটুকু নিলে মেয়েরা তার থেকে অনেক কম নিলে কিন্তু অনেক বেশি যাচাই করে দেখে গেল। কুমারী সধবাদের মধ্যে অল্পবয়সী কিশােরী-কুমারী যারা তারা নিস্পলকনেত্রে হাঁ করে তাকে দেখলে-যেন তাকে গিললে দু-একজন যেন সভয়ে খুঁটে খুঁটে মুখ দিয়ে আস্বাদন করে দেখলে। বয়স্করা এক-একজনে তার চিবুক ধরে মুখখানা চোখের সামনে ধরে ধরে দেখলে। ওপাড়ার জগদ্ধাত্রীর মা বললে-বেশ সখী ঠাকরুন হয়েছে। তবে শ্যামাদিদির মতাে হবে না। বাবা! বয়সকালে ও যা ছিল না! সে একেবারে বাবা রে বাবা রে ব্যাপার। সে বুকদুখানা কি! এ্যা-ই। চুলে পাজা তােমার অ্যাই, পাছা পর্যন্ত। রংটা কালাে তাই, নইলে-কি বলে-শ্যামা মাসি বসেই ছিল, সে বললে-ম! জগার মা না কে? কি বলে বলে তােকে আর ফুট কাটতে হবে না বাপু, তুই থাম।
কে দিদি নাকিনি? হ্যা। তু তাম্। নামােপাড়ার রাখালের দিদি বললে-আমি ভাবছি মাথায় মাথায়। বুড়াে শিব এসে দরজায় দাঁড়াবে, মেয়েটাকে নাকে বলেছিল-যা বলেছ, শিবের আবার কেঁচুনী পাড়া যাওয়ার জন্যে বেজায় ঝোক! হাসিতে ফেটে পড়েছিল মেয়েদের আসর। আজও অত্যন্ত স্পষ্টভাবে সে দিনটা মনে রয়েছে। অত্যন্ত স্পষ্টভাবে। মনে পড়ছে এই সময় ময়ুবেশ্বর থানার দারােগাবাবু এসে হাজির হয়েছিলেন। শ্যামা মাসি দীর্ঘকাল এখানে সখী ঠাকরুন হয়ে রয়েছে; এই দেবতার স্থান ছাড়াও তার প্রতিপত্তি অনেক-সে হিসেব বােঝে এবং হিসেব করে চলে। সে দারােগাকে এই নিয়ােগের সাক্ষী রাখবার জন্যেই নিমন্ত্রণ করেছিল। দারােগা এসে মেয়েদের হাত থেকে তাকে বাঁচিয়েছিল। মেয়েদের মধ্যে বহুড়ীরা সরে গিছল। ঝিউড়িরা একটুমাত্র সরে বসেছিল। দারােগা তাকে দেখে বলেছিল, এ তাে হিতু দেবাংশীর মেয়ে! না? শ্যামা বলেছিল-আজ্ঞে হ্যা। দারােগা বলেছিল-বাহ! বেশ সখী ঠাকরুন হলাে। এইটেই ভালাে হলাে-মেয়েটা কিন্তু এত দেখতে ভালাে হবে-তা মনে হয়নি। খাসা মেয়ে। চোখ দুটো অতি উত্তম! প্রতিটি কথা যেন আকাশের বুকে জমা মেঘ জলধারার মতাে করে ঝরে পড়ছিল তার মাথার উপর। এই সময় সে এসে দাঁড়িয়েছিল। সে হলাে-ঘনশ্যাম। বিবাসিনীতলার গরু-বাছুরের মাহিন্দার। একটি পনের-ষােল বছরের কিশাের। কাঁধ থেকে বুক পর্যন্ত একখানা নিরেট এই বড় পাথর কেটে তৈরি করা মূর্তির মতাে গড়ন। এ কাঁধ থেকে ও কাঁধ পর্যন্ত চওড়া প্রায় এক হাতেরও বেশি, কোমরখানি এই সরু। দুখানা হাত নিটোল গােল, পেশীগুলাে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে শুরু করেছে। কালাে রঙ, চোখ দুটি আয়ত এবং নির্ভীক কিন্তু আশ্চর্য একটি মিষ্টতা আছে। মাথায় একমাথা কোঁকড়া চুল টোপরের মতাে একটি শােভার সৃষ্টি করেছে। ছেলেটা শ্যামা মাসির কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে। ঘনশ্যামের মা এ গ্রামে ভিক্ষে করতে এসে আশ্রয় নিয়েছিল মায়ের থানে। মায়ের তখন মরণদশা। কোলে একটা কচি-তার সঙ্গে হাত ধরে হাঁটত এই ছেলেটা। ঘনশ্যাম। ঘনা। তারপর কোলের ছেলেটা আর মা-টা মরল-ঘনশ্যাম রইল। সেই রয়েই গেছে। শ্যামাদাসী সখী ঠাকরুন ওকে গরু-বাছুরের বাগাল রেখেছিল। গরু-বাছুর চরাত, আপন মনে ঘুরত, ঠাকরুনতলার পুকুরপাড়ে অনেক তেঁতুল গাছ, সেই গাছগুলােতে হনুমানের উপদ্রব, বাঁটুলের ধনুক তৈরি করে বাটুল পাকিয়ে শুকিয়ে-সেই হনুমান তাড়া করে বেড়াত।
ইদানিং ঠাকরুন তলায় নিজের হাল করেছিল-শ্যামাদাসী সখী ঠাকরুন, তার জন্য দুটো মহিষ কিনেছে, ছেলেটা সেই মহিষের উপর চেপে বেড়ায় ময়ূরাক্ষীর পাড়ে পাড়ে অর্থাৎ তটভূমির তৃণক্ষেত্রে। সেদিন সেই অভিষেকের দিনে এই ঘনশ্যাম এসে দাঁড়াল দারােগাবাবুর পরেই। তার হাতে ছিল এক ঠোঙা পদ্মবীজ। তখন মাঘ মাস; পদ্মের ফোটা ঝরা শেষ হয়ে গেছে, পাতাগুলােও নেই, থাকবার মধ্যে উঁটির মাথায় পদ্মের টাটিগুলাে ধরে আছে, তাতে রয়েছে পদ্মের বীজ। এই বীজ জলের তলায় পাঁকের উপর পড়বে এবং নতুন গাছ হবে। পদ্মবীজে খুব ভালাে মালা হয়। কালাে মসৃণ বীজের মালা কালাে পাথরের মতাে দেখায়। সুন্দর রঙ যাদের তারে খুব ভালাে মানায়। শ্যামা মাসি পদ্মবীজের মালা পরে। পদ্মের বীজ এবার এলােকেশীও সংগ্রহ করছিল। নিজেই সংগ্রহ করছিল, লজ্জায় কাউকে বলতে পারেনি। ঘনশ্যাম সেটা লক্ষ্য করেছিল, সে আজ সারাদিন আখ মাড়াই কড়াই নিয়ে পাঁজার পুকুর থেকে পদ্মের বীজকোষ তুলে তার বীজগুলাে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছে। নতুন সখী ঠাকরুন মালা গেঁথে পরবে। একটি ঠোঙায় করে বীজগুলাে পায়ের। কাছে নামিয়ে দিয়ে-নতজানু হয়ে পায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বলেছিল-পায়ে ছুঁয়ে পেনাম করব আপনাকে? আশ্চর্য, সে বিমুগ্ধ-দৃষ্টি নিয়ে সে তার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। যত-মুগ্ধতা তত প্রসন্নতা ঘনশ্যামের চোখে, ঘনশ্যামের মুখে। সে একটু হেসে,-যে হাসি আপনি ঠোটে ফোটে মনের গহন থেকে বাতাসে উড়ে-আসা গন্ধের মতাে, যে হাসি ইচ্ছে করে কেউ হাসতে পারে না, সেই হাসি হেসে পা দুখানি একটু এগিয়ে দিয়েছিল। ঘনশ্যাম হাতও বাড়িয়েছিল কিন্তু শামাদাসী বলেছিল— উঁহু। পা ছোঁবে না। আজকে না। আজ অভিষেক। ঘনশ্যাম দূর থেকে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে উঠে গিয়ে দূরে সেই দাঁড়িয়েই ছিল। বৃহৎ অর্জুন গাছটা যেটা ঠিক বিল্ববাসিনীতলায় ঈশান কোণে আছে, সেই গাছটায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েই ছিল। সবশেষ হতে প্রহরের অধিক রাত্রি হয়েছিল; ক্রিয়াকরণ তাে কম ছিল না! মাসি সকলকে লুচি, কপির তরকারি, ছােলার ডাল খাইয়েছিল। খাবার পাতা পড়বার আগে পর্যন্ত সে বসেছিল পাট অঙ্গনে, ঘনশ্যামও ততক্ষণ উদাসীর মতাে তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল গাছটায় ঠেস দিয়ে। সেও বারবার তার দিকেই তাকিয়েছিল। চোখে চোখে মিলেছিল তাদের। কিন্তু কোন কথা হলাে বলে মনে হয়নি। বারবার মনে হয়েছিল ছেলেটা বড় ভালাে, বড় সরল! আর ঘনশ্যাম? ঘনশ্যাম কি ভেবেছিল? সে তা জানে। আজ সাতাশ/আটাশ বছর সে সখী ঠাকরুন হয়েছে। ষােল বছরে অভিষেক হয়েছিল, তারপর আটাশ বছর-চুয়াল্লিশ বছরের সে এখানকার সর্বময়ী মালিকানা ঠাকুরুন হয়েছে। গ্রামের পঞ্চায়েতের মধ্যে তার একটা আসন আছে। গ্রামে যারা আগন্তুক, তারাই তাকে মান্য করে। ঘনশ্যাম এখন তার একান্ত অনুগত একজন চাকর। এ গ্রামে ও গ্রামে যেতে হলে সঙ্গে চলে চাকরেরই মতাে। তার অন্তরটা সে জানে। সে জানে ঘনশ্যাম আজও সেই একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঘনশ্যামকে সে খুব ভালাে করে বােঝে। তাই সে বলতে পারে ঘনশ্যাম সেই অভিষেকের দিনে সেই অর্জুন গাছে ঠেস দিয়ে তাকিয়ে ক্রমান্বয়ে মনে মনে যে কথাটি বলে চলেছিল-সেটি হলাে কী সুন্দর, কী সুন্দর কী সুন্দর! এ অনুমান করতে এলােকেশীর এতটুকু দ্বিধাও হয় না সঙ্কোচও হয় না। ওই দিন অর্থাৎ এই অভিষেকের রাত্রে সেদিন প্রথম। সেই আরম্ভ; তারপর আজও পর্যন্ত ঘনশ্যাম তাকে ঠিক এমনি বিমুগ্ধ-দৃষ্টিতে দেখে। আজ আটাশ বৎসর দেখে আসছে। সকালবেলা উঠেই স্নান করে সখী ঠাকুরানী। সব সখী ঠাকুরানীকেই করতে হয়। স্নান করে ঠাকরুন মায়ের ঘর মার্জনা করে। ওদিক থেকে সকালবেলা পূজারীঠাকুর হাজির হন। ফুল বেলপাতা চন্দন সিঁদুর তেল আতপ চাল দিয়ে পূজার আয়ােজন করে দেয় সখী ঠাকরুন এবং সখী ঠাকরুনের লােকেরা। অভিষেকের পর থেকে শ্যামাদাসী দেখিয়ে দিত সে-করত। মাঘের শীত। তবুও সে বাংলা দেশের মেয়ে, তার উপর নতুন সখী ঠাকরুন। একটু রােকণুর উঠলেই সে সামনের বড়পুকুরটার ঘাটে গিয়ে নামত।
গােটা বিল্ববাসিনীতলাটা নিস্তব্ধ, শুধু পাখির ডাক উঠছে মধ্যে মধ্যে। বনকাক ডাকত কোন ঝােপের মধ্যে কুক কু কু কু। অন্য একদিক থেকে অন্য পাখিটা জবাব দিত। সে গলা পর্যন্ত জলে ডুবিয়ে শুনত। মধ্যে মধ্যে কু কু কু কু শব্দ করে পাখির ডাক নকল করতে তার মজা লাগত। ভারি মজা সে। এরই মধ্যে সােজা হয়ে দাঁড়াত। বুকের নিচে কোমর পর্যন্ত জল থেকে উপরে উঠত। ভিজে কাপড়ের নিচে তার সদ্য পরিপুষ্ট বুকখানি তার কাছেই ছিল পরম বিস্ময়। দিনের মধ্যে কতবার যে সে তার এই নতুন দেহমাধুরীর দিকে তাকাত এবং তাকে নেড়ে দেখত তার হিসাব নেই। স্নানের সময় ভিজা কাপড় লেপটানাে বুকখানির দিকে তাকানাে। বােধ করি সব মেয়েরই অনিবার্য, সে অন্তত দেখত। ভারি ভালাে লাগত। মনে হত কী সুন্দর! সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি একবার চারিটা দিক ঘুরে নিত। চারিদিক চোখ বুলিয়ে দেখে নিতে ইচ্ছে হত কেউ দেখছে কিনা লুকিয়ে। কোথাও কোন পাশে কোন একটা শব্দ হলে চমকে উঠত। উঠত কেন-ওঠে। সব মেয়েই ওঠে চমকে। তার অভিষেকের দিন দশেকের মধ্যেই একদিন সে ঘাটের ডানদিকে-একটু ঝুঁকেপড়া তেঁতুল গাছের গায়ে কতকগুলাে কাকের আক্রোশের ডাক শুনে এবং আক্রমণের উদ্যোগে ওড়া দেখে সেই দিকে তাকিয়েছিল। ভেবেছিল সাপ বা বনবেড়াল বা বেজিজাতীয় কিছু হবে। দেখতে সে কিছু পাবে না। কিন্তু সে সেখানে মানুষের আভাস পেয়েছিল। অনেকক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে সে ঘনশ্যামের সন্ধান পেয়েছিল। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে বাড়ি এসে ভেবেছিল ঘনশ্যাম বােধ করি কোন অন্য প্রয়ােজনে-সেখানে আগে উঠে আটকা পড়েছিল। কিন্তু না। ঘনশ্যাম তার এই স্নানের সময় তার অনাবৃত দেহের অপরূপ অম্নস্নান দেহশােভাকেই দেখতে চায়। কি দেখে? সে নিজে দেখেছে। সে নিজে নিয়মিতই দেখে। দিনান্তে কতবার দেখে তার হিসাব নেই। সব মেয়েতেই দেখে। তার সাক্ষী হলাে আয়না। শ্যাম মাসির একখানা আয়না ছিল। সে আমলের আয়না। সেই কাঠের ঢাকনা দেওয়া আয়না, প্রয়ােজন হলে কাঠের ঢাকনাটা খুলে গিয়ে মাটির উপর ঠেকা দিয়ে আয়নাটাকে সামনে খাড়া করে দেয়। তাকেও একখানা সেই আয়না কিনে দিয়েছিল শ্যামা মাসি। শ্যামা মাসির মৃত্যুর পর একজিবিশন মেলায় সে একখানা বড় আয়না কিনেছিল। চুল তাদের বেশি বিনিয়ে খোপায় ভেঙে বাঁধা বারণ । এলােখােপা বাঁধতে হয়। দিনান্তে দুবার। একবার স্নানের পর, একবার বিকেলবেলা দরজায় খিল দিয়ে, বড় আয়নাখানার সামনে বসত-গায়ে জামা থাকত না। সে চিরুনি চালাত চুলে আর তার সেই চুলে চিরুনি টানার আন্দোলনে দেহের চঞ্চলিত শােভা দেখে জীবনভরা খুশিতে খুশি হয়ে উঠত। ঘনশ্যাম আজও দেখে।
আজ যে সে কোথা থেকে দেখে-তা ঠিক জানে না এলােকেশী তবে সে যে দেখে তাতে তার ভুল নেই। ওর মধ্যে কলুষ কতটা, কামনা কতটা, সে হিসেব করে না এলােকেশী। ও সম্পর্কে এলােকেশীর নিজের একটা উলটো-হিসেব আছে। সে হিসেবটা কোথা থেকে বা কার কাছ থেকে সে শিকলে সে কথা তার জানা নেই। শ্যামা মাসিকে সে বলেছিল, শ্যামা মাসির তখন শেষ দশা। বােধ করি মৃত্যুর আর বাকি ছিল মাত্র তিন-চারদিন। শ্যামাদাসী বলেছিল-দেখ, আমি আর এ শয্যে থেকে উঠব না। তা তােকে বলে যাই কটা কথা। যা আমার আছে-মানে মাটিতে পোঁতা আছে-পনের শাে টাকা। আমার ভাইঝি ছিল না তাই, তুই বােনঝি, তােকে নিয়ে ছিলাম। এখন তুই-ই সবের মালিক। তুই ইচ্ছে করলে অভিষেকের পরদিনই আমাকে তাড়িয়ে দিতে পারতিস-তা দিসনি। আমাকেই মান্যি করে সর্বেসর্বা করে রেখেছিলি। আমার মনটা তাতেই বেঁচেছে। নইলে এঁটো পাতা মা; এঁটো পাতার মতাে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হত। এখন তুই টাকাটার অর্ধেক নিস, অর্ধেক আমার ভাইকে দিস, বুঝলি? সে তাে তােরও মামা। এলােকেশী বলেছিল-তাই হবে মাসি। আমি মামাকে অর্ধেক দেব। আর একটা কথা বলি। না করিস না। বল। তাের বয়স এই উনিশ পার হলাে। কুড়ি চলছে। নয়?
হা।
তুই সেই যৌবন-বন্ধন ওষুধটি খা। সখী ঠাকরুন যখন হয়েছিস-তখন মা হওয়া তাে আর হবে না! অথচ তাের এই কুড়ি মাত্র বয়স। মা-কিছু হলে-অগাধ জলে পড়বি।
বাড়ি ফিরে চুল আঁচড়াবে। সেই বড় আয়নাখানার সামনে দাঁড়িয়ে। নিজেকে দেখবে। সায়া-ব্লাউজ এ বেলা পরে না। লালপেড়ে তসরের শাড়ি পরে বিবাসিনীর বারান্দায় বসে। মেয়েরা আসে, প্রণাম করে। সে সিঁদুর ঠেকিয়ে দেয়। প্রণামী কুড়িয়ে জোড়াে করে। পূজারী পূজো করে। ঘনশ্যাম দাঁড়িয়ে থাকে। দাঁড়িয়ে থাকা নয়-হাজির থাকে। হাজির থাকে ওই ধানচালের ব্যবসায়ীর ওই দূতী পাঠানাের পর থেকে। মধ্যে মধ্যে চোখ তুলে তাকালেই সে দেখতে পায় ঘনশ্যাম হয় আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, নয় তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে হাসে। আপন মনে হাসে। হাসি পায় তাও। বিকেলবেলা তাকে সাজসজ্জা করে বের হতে হয়। আশপাশের গ্রামগুলাে ঘুরে আসে বিবাসিনীর আশীর্বাদী আর চরােদক নিয়ে। যাদের বাড়িতে পলুর চাষ তাদের বাড়ি যায়, যাদের বাড়িতে বিয়ে শাদী তাদের বাড়ি যায়; আবার এমনিও যায় । বিবাসিনী পলুর কল্যাণ করেন-আর যুবতী নতুন বিয়ােনাে বউবেটিদের কল্যাণ করেন। তারা স্বামীর আদর পায় আর রূপে-যৌবনে মেয়েরা ভরে ওঠে। এর দাবি বা দক্ষিণে বেশি নয়-চার পয়সা দু-আনা। মধ্যে মধ্যে টাকা দু-টাকাও মেলে। এই তাে রামনগরের গােপাল দত্তের ছেলের বিয়ে দিলে-বউ বাপের একমাত্র কন্যা-সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী। কিন্তু মেয়ে একখানি শুকনাে বাখারি। না লাবণ্য-না স্বাস্থ্য, রােগা, সারা মুখের মধ্যে খাড়ার মতাে নাক-আর ডাবড্যাবে দুটো চোখ। সেই মেয়েকে সে মাদুলি দিয়েছিল, এক বছরের মধ্যে সে মেয়ের দেহে যৌবন আর রূপের জোয়ার এসে গেছে। সেখানে বছরে এক টাকা করে বরাকণ হয়েছে আর এবার দিয়েছে পাঁচ টাকার কড়কড়ে নতুন নােট। গােপাল দত্তের ছেলের বয়স বাইশ-তেইশ হবে। তাকে খুব ঠাট্টাও করে এসেছে সে। বলেছে—আরও টাকা দাও না ভাই-আরও রূপ দেব তােমার বউকে। যৌবনও দোব। যৌবন যদি বাঁধতে চাও তারও ওষুধ জানি আমি।। সেইদিনই। হ্যা সেইদিনই সে ঘনশ্যামকে বলেছিল-রামনগর থেকে ফেরার পথে সে ঘনশ্যামকে বলেছিল-হঁারে ঘনা। হা-কি বলছ সখী ঠাকরুন। মুখপােড়া আমি কথা বলছিলাম, তুই তার দেখছিলি কি এমন করে রে? আঁআঁ কি রে? কি দেখছিলি তুই? বল নইলে তােরই একদিন কি আমারই একদিন। একটু চুপ করে থেকে ঘনা বলেছিল-তুমি হাসলে তােমাকে বড় ভালাে লাগে ঠাকরুনউ! আমাকে দেখতে ভালাে লাগে? হা ঠাকরুন। তােকে আমি তাড়িয়ে দোব ঘনা। না হলে এমন করে তুই তাকাবি নে। বুঝলি। খবরদার করে বলছি তােকে। তা ছাড়া কি বলবে খুঁজে পায়নি।
ঘনশ্যাম অপেক্ষা করে করে অবশেষে প্রশ্ন করেছিল-ঠাকরুন । কি বলছিলে-তাছাড়া-বলে? ওরে আমি দেবতা হয়ে গিয়েছি রে। দেখেছিলি তাে-শ্যামা মাসি আমাকে আসরে বসিয়ে অভিষেক করেছিল। ক্রিয়া করেছিল। হা ঠাকরুন। তাের অমঙ্গল হবে! কি অমঙ্গল হবে? রে হতভাগা ভয়ডর নেই তাের? আমি তাে মনে কোন কিছু মন্দ ভাবি নাই সখী ঠাকরুন! মন্দ তাে ভাবিস না কিন্তু ভালােটা কি ভাবিস শুনি? ভাবি না তাে। দেখি। ভালাে লাগেকানা হয়ে যাবি, অন্ধ হয়ে যাবি মুখপােড়া। কানা হয়ে যাব? কানা হােস বা না হােস-এরপর তােকে রাখব না আমি। এবার আমাক মাফ কর সখী ঠাকরুন। রূপাের তারে গাঁথা পদ্মবীজের মালাটা নাড়াচাড়া করতে করতে এলােকেশী বলেছিল-তা করলাম। কিন্তু খবরদার করে বলে দিলাম! মনে থাকে যেন! আশ্চর্য! বাতাসের বােধ হয় কান আছে। কদিন পর। জমিদারবাবু হঠাৎ একটু অসময়ে এসে বললেন-ঘনশ্যাম তােমার সঙ্গে নাকিচমকে উঠেছিল সে। মাঝখান থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলেছিল-না না না। কিছু হয়নি কিছু করেনি ও। কিচ্ছু না। আমি ওকে একটু সাবধান করে দিয়েছিলাম। জমিদারবাবু বলেছিলেন-না, ও সেরকম লােক ঠিক নয় কিন্তু করেছিল কি? হেসে ফেলে জমিদার বলেছিলেন-হা করে তােমার মতন সুন্দর মুখের দিকে আমিও তাকিয়ে থাকি। মুখ-চোখ লাল হয়ে উঠেছিল তার। মাথায় সচরাচর ঘােমটা সে দিত না-সেদিন এই কথার পরে সে ঘােমটা তুলে দিয়েছিল। একটু হেসে বলেছিল-আপনার গিরামে গিয়ে রাণীমার কাছে কথাটা বলে দিয়ে আসব। বলব-সাবধান হবেন আপনি। এ কথার তার রাগ হয়নি। হলেও যে চলবে না। সইয়ের বউয়ের বকুলফুলের বােনাে বউয়ের বােনঝি জামাইয়ের সঙ্গে হেসে কথা কইতে হয় সখী ঠাকরুনকে। জমিদার বলেছিলেন-তা হয় তাে পার। কিন্তু জান তাে-মানুষ পাগল হয়! নানান। কারণে হয়-রূপ দেখেও হয়।
ঠিক এই সময় লােক এসেছিল পূজারী। পূজারী আসতেই জমিদার চলে গেছিলেন। পূজারী প্রবীণ লােক। পূজারী বােধহয় অন্তরাল থেকে কথাবার্তার আঁচ পেয়েছিল। সে হেসে বলেছিল-সখী ঠাকরুন, শিব ক্ষেপলেও পার আছে-নন্দীভৃঙ্গী ক্ষেপলে আর পার নেই। ওরা তাে ভূত-প্রেত! কথাটা মিথ্যে বলেননি পূজারী। ঘনশ্যাম এবং জমিদারকে জড়িয়ে এলােকেশীর সঙ্গে বিননী পাকিয়ে পাকিয়ে নিত্য-নতুন বাহারের কবরী রচনা করতে শুরু করেছিল গ্রামের লােকেরা, বিশেষ করে ছােকরার দল-সেইদিন থেকে। তারপর আকস্মাৎ একদিন একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল । কারা যেন গভীর রাত্রে এলােকেশীর মাটকোঠার উপরতলায় দক্ষিণ দিকের শােবার ঘরের খােলা জানালায়-মই লাগিয়ে টর্চ ফেলে দেখেছে। ব্যাপারটা গায়ে মিটল না। থানায় গিয়েছিল এলােকেশী। দারােগা জানতেন তাকে। বলেছিলেন-সখী ঠাকরুন, তুমি মান্যের লােক। তবে গ্রামটাকে যেন পাগল খানিকটা করেছ তুমি। দশ-বিশ জনকে জড়িয়ে যার অপবাদ রটে-বুঝতে হবে দশ-বিশ জনার থেকে অনেক বেশি লােকে মনে মনে তার সঙ্গে কলঙ্কের ভাগী হতে চায়। আরও আছে-দশ-বিশ জনের সঙ্গে যার কলঙ্ক তাকে একজনও ছুঁতে পারেনি। কিন্তু ব্যাপার তাে এভাবে মিটবে না। আমার হাতেও ঠিক নয়। দেশ তাে স্বাধীন-দশ এখন সর্বেসর্বা। এখন দশজনই তােমাকে যদি রক্ষা করতে চায় তাহলে এক সাংঘাতিক ব্যাপার হবে। তার থেকে এক কাজ কর। এমন পাহারা রাখ যে ঘরের মধ্যে থেকে তােমাকে পাহারা দেবে। তুমি ঘরের মধ্যে একলা শােও এখন থেকে আরও লােক নিয়ে শােও। কোন মেয়েছেলেকে নাও শুতে। তােমরাও সাহস বাড়বে। দরকার হলে দুজনে চেঁচাবে। শেষ পর্যন্ত দারােগাই বলে দিয়েছিলেন-ছেলেমেয়েওলা কোন মেয়েছেলেকে, এই ধর তােমার বয়সী কি দু-পাঁচ বছরের বেশি বয়সী কাউকে তুমি রাখ। খেতে পরতে দেবে-তারা মানুষ হবে তােমার ওখানে-তােমারও কাজ হবে। অন্তত চোর-ছ্যাচড় এলে কুকুর যেমন চেঁচায় তেমনি চেঁচাতে তাে পারবে। খাওয়ার ভয়ে নেবে, পরার কাপড় যােগাবে, মাথা গুঁজবার ঠাই মিলবে-এর বিনিময়ে ছেলে বা মেয়েসুদ্ধ একটা মায়ের তাে অভাব হবার কথা নয়। পেয়ে গেল। সেবার জন্মাষ্টমীর পরদিন সকালবেলা একটি বছর চার-পাঁচ বয়সের ছেলেকে পরচুলাে পরিয়ে পীতধারী মােহনচূড়া পরিয়ে অলকাতিলকায় সাজিয়ে নিয়ে এসেছিল বিন্দুবাসিনীতলায়। এলােকেশী ভালাে লেগেছিল। জিজ্ঞেস করেছিল-কে? কার ছেলে? ছেলে তাদেরই স্বজাতের তবে ভিনগাঁয়ের। ছেলেটার বাপ মরে গেছে, মা-টা শক্তপােক্ত নয়-দুর্বল মানুষ। জমিজমা নেই, খেটে খাবার শক্তিও নেই; কোলে আবার একটা মেয়ে আছে। বিধবাটির নাম কল্যাণী । আজও বুড়াে বাপ আছে, মেয়েটার তাই আশ্রয় একটা মিলেছে। ছেলেটাকে জন্মাষ্টমীওয়ালারা সাজিয়ে এনেছে, দু-তিনখানা গা ঘুরে ফিরে যাবে; গৃহস্থদের দোরে যা পাবে তার কিছুটা অংশ দেবে। মনে পড়ছে এলােকেশীর-আজ বােধ হয় কুড়ি বছর হলাে।
হঁা, কুড়ি বছর। আজ সুধাংশুর বয়সই কুড়ি পার হয়ে গেছে। কুড়ির বেশি হবে। সুধাংশু সাওড়ার বড় ইস্কুল থেকে একটা পাস করলে। তারপর তিন বছর পড়েছে কলেজে। পাস করতে পারেনি-ফেল করে বাড়িতে বসে আছে। এলােকেশীই তাকে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করেছে, সাওড়ার ইস্কুলে পড়ার সব খরচ দিয়েছে। সেই সুধাংশু, গ্রামের লােক জুটিয়ে থাকে সখী ঠাকুরুন পদ থেকে তাড়াবার জন্য মামলা করেছে। তাকে বলেছে। থমকে দাড়াল এলােকেশী। ১৯৬৯ সালে ফাল্গুন মাস। এলােকেশী ময়ূরাক্ষ্মীর হাত ঘাট থেকে স্নান করে ফিরছে। তাকে ডাকতে এসেছিল যে মেয়েটা, সে পিছনে পিছনে আসছিল। এলােকেশী তার সঙ্গে কথা বলবার জন্যেই থমকে ঘুরে দাঁড়াল। হারে গুরী, আদালতের লােকের সঙ্গে গ্রামের লােক কতগুলাে জুটেছে? সে অ্যানেক গাে ঠাকরেন! জমিদারবাবু পাঁচপাড়ার মােড়লরাহুঁ। ছেলে-ছােকরারা? উয়ােরা বেশি আসে নাই। ওই দু-একজনা।। সুধাংশু। সি নাই। ওপরপাড়ায় কি সব মজলিস করছে। খুশি হলাে এলােকেশী। সে সব বুঝতে পেরেছে। সুধাংশুরা হেরেছে। জজসাহেব নিশ্চয় নাকচ করে দিয়েছেন ওদের আরজি। সে আবার ঘুরল। চলতে শুরু করল। বেশ গরবিনীর মতােই চলেছে, একটু যেন ইচ্ছে করে দোলন লাগিয়ে যে চলা সেই চলন। মুখে একটু হাসিও ফুটল তার, পিতলের কলসিটা থেকে জল ওথলাচ্ছে। ভিজে কাপড় এবং রাঙা টকটকে গামছাখানায় ঢাকা-তার বুকের যৌবন দোল খাচ্ছে। এ যৌবনকে বেঁধে দিয়ে গেছে শ্যামা মাসিযৌবন-বন্ধন-ওষুধটি মৃত্যুশয্যাতে শুয়ে খাইয়েছিল। বলেছিল দেখবি-পরে বুঝবি। সে নিত্য বুঝে আসছে মাসির কথার সত্যতা। জমিদারকে সাক্ষী মেনেছিল সে। তার উকিল জমিদারবাবুকে প্রশ্ন করেছিল-বিল্বগ্রামের সখী ঠাকরুনকে কি এখনও সখী ঠাকরুন থাকার যােগ্য বলে মনে করেন? জমিদার বলেছেন-করি । অতি সুন্দরভাবে কার্য পরিচালনা করেন। তা করেন। কিন্তু ওকে যুবতী বলবেন, না প্রৌঢ়া বলবেন? যুবতীই বলব। আমার তাে তাই মনে হয়। মাথার চুল একটিও পাকে নাই। বিপক্ষের উকিল বলেছিল-আপনি একজন অনুরাগী জন-এ আমরা জানি।
জমিদার বলেছিলেন-তা জানুন। সেই সঙ্গে এও জানেন যে ইনি সেজন্য কোন কলঙ্ক বহন করেন না। বিপক্ষের উকিল বলেছিল-একদা কলঙ্কের কর্দম ছােটানাে থেকে রক্ষা করবার জন্য সখী ঠাকরুনের শুনেছি-প্রহরার দরকার হয়েছিল। একটি দরিদ্র স্বাজাতীয় বিধবা এবং তার একটি ছেলে একটি মেয়েকে খুঁজে এনে রাখা হয়েছিল। বিধবাটির নাম কল্যাণী। ছেলেটার নাম সুধাংশু। মেয়েটার নাম ছিল রমা। কল্যাণী মরেছে। মরেছে এই সেদিন। বছর সাত-আট হবে। রমার বিয়ে এলােকেশীই দিয়েছিল। রমাও মরেছে ছেলে হতে গিয়ে। সুধাংশু বছর তিনেক আগে পর্যন্ত তার কাছে থেকেছে। সাওড়া ইস্কুলে পাস দিয়ে পড়তে গেল কলেজে রামপুরহাটে। পড়ার খরচ সে চেয়েছিল কিন্তু সে এলােকেশী দেয়নি। সেই আক্রোশে ওই সুধাংশু এই নালিশ করিয়েছে-গ্রামের পঞ্চজনকে নিয়ে। ‘বিল্ববাসিনীর সখী ঠাকুরানী-এলােকেশী দেবাংশিনী এই পবিত্র দেবস্থলের বিল্ববাসিনীর সখী ঠাকুরানী হইবার মতাে উপযুক্ত ব্যক্তি নহেন। ভূতপূর্ববর্তিনী সখী ঠাকুরানী বিধিমতে তাঁহাকে অভিষিক্তও করেন নাই। সর্বশেষ এতকাল অন্যায়পূর্বক এই পদ অধিকার করিয়া তিনি বৃদ্ধ হইয়াছেন-এই পদে যুবতী ব্যতীত বালিকা বা প্রৌঢ় বা বৃদ্ধার থাকিবার অধিকার নাই ইহা জানিয়াও তিনি গ্রামের পঞ্চজনের নির্বাচিত কোন নতুন সখী ঠাকুরানীকে অভিষেক করিয়া তাহাকে গ্রহণ করিতেছেন না। এলােকেশীর উকিল তাকে প্রশ্ন করেছিল-সুধাংশুও এ মামলায় দশজন বাদীর একজন-অন্যতম জন ছিল। এজাহারের সময় সে আদালতে স্বীকার করেছে যে ছেলেবেলা বর্তমান সখী ঠাকরুন এলােকেশী দেবাংশিনীর বাড়িতেই তারা থাকত। তখন খুব ছােট ছিল সে। তার মা বােন সে এলােকেশীর বাড়িতেই থাকত খেতাে, মাইনেটাইনে ছিল তা সে বলতে পারবে না। তবে জামা ইজের-পরে কাপড়-এলােকেশী দেবাংশিনীই দিতেন। আমার ইস্কুলের মাইনেও দিয়েছেন। ইস্কুলে হাফ-ফ্রি ছিলাম। ওই অর্ধেক মাইনে উনি দিতেন। মা মরে গেলে যে শ্রাদ্ধ করেছিলাম, খরচও উনিই দিয়েছেন। আমার বােনের বিয়ে হয়েছিল, মেয়েটা দেখতে ভালাে ছিল-খরচ কমই হয়েছে-তাও সব উনি দিয়েছেন। উকিল বলেছিল-তুমি তাই ওঁকে উচ্ছেদ করবার জন্যে নালিশ করেছ? না, কোন আক্রোশ আমার নেই। আমি ওর কাছে কৃতজ্ঞ খানিকটা বটে। খানিকটা? হা। অন্তত আপনারা যতটা ভাবছেন ততটা তাে নয়ই। কারণ খাওয়া পরা সেবা পাহারা দেওয়া-এ-সবের জন্য উপকার-সবটা উপকার হয়নি। দেনা-পাওনা হয়ে কাটছিট হয়েছে।
ভালাে । তুমি বলছ-শ্যামাদাসী ওকে অন্যায় করে সখী ঠাকরুন করেছিল- না।
ওসব বাজে কথা। শুনেছি শ্যামাদাসী অভিষেক ঠিকই করেছিলেন। এলােকেশী সখী ঠাকরুন কোন অন্যায় কাজ করেননি। কিন্তু উনি আজ অন্যায় করে জোর করে সখী ঠাকরুন পদ আগলে রেখেছেন। আমি ওকে বলেছিলাম-ঠাকরুন, তােমাদেরই সুলতা-গােপী দেবাংশীর মেয়ে খুব সুন্দর । ওর বাপ মা ভাই চায়, ও সখী ঠাকরুন হয় । তুমি ওকে সখী ঠাকরুন করে নাও আর যেমন শ্যামাদাসী ছিল তেমনি তুমি থাক । এলােকেশী ঠাকরুন আমাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। এলােকেশী ঠাকরুন আজও খুকি সেজে থাকতে চান, সেইটেই হলাে সব থেকে লজ্জার কথা আর অপরাধের কথা । তােমাদের এককালের জমিদার সাক্ষী দিয়েছেন-তাতে তিনি কি বলেছেন শুনেছ? শুনেছি। তিনি নিজে বৃদ্ধ। তাঁর দৃষ্টিতে যাকে যুবতী দেখেন-যে যুবতীর যৌবনের মধ্যে কতখানি কৃত্রিম উপকরণের প্রলেপ আছে, সজ্জা আছে, তার চোখে তা ধরা পড়বার কথা নয়। নিরঙ্কুশ কুড়ি-তিরিশ বছর চলে গেছে-এলােকেশী সেজেগুজে নিজের যৌবনকে বেঁধে রেখেছেন-অক্ষয় যৌবনের অধিকারিণী বলে ভেবে দুই হাত দিয়ে সখী ঠাকরুনের আসন আঁকড়ে ধরে আছেন। আমাদের নতুন কালের লােকের চোখে তা কুৎসিত ঠেকছে। আমার চোখের সামনে উনি তিল তিল করে বুড়াে হলেন-আমি দেখলাম। ঘরের মধ্যে আয়নার সামনে বসে সাজতেন। আমি দেখতাম। দরজার একটা ছিদ্র দিয়ে দেখতাম। ছেলেমানুষ ছিলাম, কৌতূহলাে-বশেই দেখেছি। তখন উনি যুবতী ছিলেন। সে রূপ আশ্চর্য রূপ, আজ আর সে রূপ নাই। আরও অনেক কথা বলেছে সুধাংশু। বলেছে-ছােট ছেলে থেকে আমি সতের-আঠার বছর পর্যন্ত দেখেছি-উনি আয়নার সামনে বসে নিজেকে দেখছেন। যত দিন যাচ্ছে-তত যেন বেশিক্ষণ করে দেখছেন। তত যেন ওঁর হাসি বেড়েছে, হেসে ঢলে পড়া বেড়েছে। শুনে এলােকেশী চমকে উঠেছিল। এক বছর মামলা চলেছে। তার উকিল আদালতে-বলেছে-আমার মক্কেল স্বীকর করেন না যে তাঁর সখী ঠাকুরানীর পদে অধিষ্ঠিত থাকবার যােগ্যতা নেই। সর্ববিধ যােগ্যতাই তার ষােলআনা বর্তমান। বিভিন্ন সাক্ষীর দ্বারা তাঁর এই উক্তি সমর্থিত হয়েছে। জীবন চলমান-সে শৈশব, বাল্য, কৈশাের, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব বার্ধক্যের বাঁকগুলােতে মােড় ফিরে স্রোত এবং তরঙ্গের গতি পালটে পালটে চলে। কতদূর থেকে কতদূর যে যৌবন সেটা নির্ণয় করা কঠিন। অন্তত বর্তমান সখী ঠাকুরানী সম্পর্কে একটি উক্তি আছে-এটা সকলেই জানে যে যৌবনবন্ধনের জন্য তিনি জপতপও করেছেন। তাছাড়া যে ট্র্যাডিশন বলবৎ রয়েছে তাতে যিনি সখী ঠাকুরানী হন মৃত্যুকাল পর্যন্ত তিনিই থাকেন সখী ঠাকরুন। পাওনাগণ্ডা ভাগেঅধিকারে তিনিই অধিষ্ঠিতা থাকেন। নতুন সখী ঠাকরুনটি নিতান্তই শিক্ষানবীশ নিরীহ মেয়ে-অনেক রাজা-রাজ্যে যুবরাজ বা যুবরাণীর মতাে ব্যাপার। সুতরাং এলােকেশীর মতের উপরেই সব নির্ভর করে, অন্য কোনাে কিছুর উপর কিছুই নির্ভর করছে না।
কোট-বম থেকে বেরিয়ে এসে উকিল বাবু বলেছিল-জিত তােমার হবেই, এই তাে আমার ধারণা। তবে এইবার দেখেশুনে একটি মেয়েকে নাও। যেমন নিয়ম আর কী! হ্যা! উকিল ব্রাহ্মণ, তাকে প্রণাম করে তার পাওনাকড়ি সব মিটিয়ে দিয়ে এসেছে এবং প্রত্যহ দিন গুনছি-কবে আসবে আদালতের রায়ের খবর। পূর্ণ কুম্ভ কাঁখে নিয়ে সে এসে মায়ের স্থানে দাঁড়াল। গ্রামের লােক অনেকে এসে জড়াে হয়েছে। প্রবীণেরাই বেশি এসেছেন। নবীনেরা গিয়ে জড়াে হয়েছে-পশ্চিমপাড়ায় মোড়লের বাড়িতে। সুধাংশু সেখানে রয়েছে। সুলতা মেয়েটি কিন্তু এখানে। সর্বাগ্রে তারই উপর পড়ল এলােকেশীর চোখ। মেয়েটিকে দেখে মনে পড়ে জবা ফুলে কুঁড়ি। লম্বা আকারে গাঢ় রক্তবর্ণ। আসছে-কালে ফুটন্ত জবা ফুলটির চেহারা জেনে ভেসে উঠে আপনা আপনি। মেয়েটা সত্যই আসছে-কালে পঞ্চমুখী রাঙা জবার মতাে জলমলে হয়ে উঠবে। লােক এসেছে-আদালতের রায় নিয়ে। আদালতের পিয়ন নয়। উকিলের লােক। উকিল রায়ে নকল দিয়ে লিখে পাঠিয়েছেন-নতুন পরামর্শ। এ আমাদেরই জিত, তুমিই সর্বেসর্বা তােমার জীবনকাল পর্যন্ত। তবে অবিলম্বে তুমি নতুন সখী ঠাকরুন অভিষেক করে নাও। যেমন তােমার হয়েছিল-শ্যামা ঠাকরুন করেছিল, এই আর কি। সুলতাকে আনিয়ে রখেছি তােমার পরামর্শ মতাে চলবে। রায়ে তা লিখেও দিয়েছে হাকিম। তার মানে? উভ্রান্ত হয়ে গেল এলােকেশী। চোখদুটো তার বিস্কুরিত হয়ে উঠল। পূজারী বললে-রায়ে হাকিম ভারি ভালাে লিখেছেন। বিবাদী পক্ষের উকিল ঠিকই বলিয়াছেন, শৈশব, বাল্য, কৈশর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব বার্ধক্য এ এক-একটি বাঁক। তার জীবনে কোনাে বাঁক কত দীর্ঘ তা নির্ণয় করা সুকঠিন তবুও ষােল বৎসর হইতে পঞ্চাশ বৎসরকাল জীবনের শ্রেষ্ঠ কাল। আমরা এই কালটাকেই জীবনে ধরিয়া রাখিতে চাই। চিকিৎসায় ওষুধে আহারে যােগে-এমনকি মন্ত্রতন্ত্র যাগ-যজ্ঞ করিয়াও ইহাকে ধরিয়া রাখিতে চাই, যতদিন বাঁচি ততদিন সুতরাং পঞ্চাশ বৎসরই যৌবনের সীমানা ধরিয়া নির্দেশ দেই যে-পঞ্চাশ বৎসরের পর সখী ঠাকুরানী নিজের যৌবন বিগত হইল বলিয়া মনে করিবেন এবং যথাবিহীত ক্রিয়াকলাপ নির্বাহ করিয়া নবীনা সখী ঠাকুরানী নিযুক্ত করিবেন। এলােকেশী স্থির-বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে সম্মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েই রইল। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে সমস্ত জনতাটি তার মুখের দিকে তাকিয়ে যেন কেমন হয়ে গেল। নির্বাক। বাক্যহারা। হ্যা, কথা যেন হারিয়ে গেল। এলােকেশীর চোখের দৃষ্টি যেন বলছিল তার সর্বনাশ হয়ে গেছে। সব হারিয়ে গেছে। তারপর সে চলে গেল নিজের ঘরে। ঘরের দরজা বন্ধ করে সে আয়নার সামনে অনাবৃত দেহে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল। চোখে সেই স্থিরদৃষ্টি। আয়নার মধ্যে অনাবৃত দেহের প্রতিবিম্ব।
পরতে পরতে কত রেখা। ও কি বার্ধকের রেখা? শরীরটা ভুল হয়েছে? এ মেদ কি বার্ধক্যের মেদ? চুল? চুল? সারা রুপালি রঙের চুল? কই? চুলগুলাে হাতে নিয়ে সে। দেখতে লাগল। কই নেই তাে? কই? না-নেই তাে? সে এবার উপুড় হয়ে লুটিয়ে পড়ল মেঝের উপর। সারাদিন সে বের হলাে না। সমস্ত পৃথিবীটা যেন শূন্য হয়ে গেছে বলে মনে হলাে। গাছে একটিও পাতা নেই। মাটির বুক ঢাকা সব ঘাস যেন শুকিয়ে গেছে। নদীর জল শুকিয়ে বালির স্তুপ জেগে উঠেছে। তার বহু যত্নের যৌবন আর নেই। সে আর সখী ঠাকরুন নয়। পরদিন সকালে তাকে পাওয়া গেল, ঠিক সেইখানে-সেই ঘরে তার আয়নার সামনে-সে সেই উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। ঘুমুচ্ছে। মাথার চুলগুলাে কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলেছে। চুলগুলাে তার এখনাে হাতে ধরা রয়েছে। কষকষে কালাে সুদীর্ঘ একরাশ চুণ। এলােকেশী বিচিত্র মেয়ে। যৌবনের সাঙ্গে সঙ্গে তার সখী ঠাকরুনত্ব গেছে। সেই সঙ্গে তার সব প্রয়ােজন মিটে গেছে। সে নিশ্চিত হয়েছে চুল কেটে। সে শ্যামাদাসীদের মতাে সখী ঠাকরুন হবে না। হতে চায় না। পাটাগনের বাইরে ঘনশ্যাম দাঁড়িয়ে আছে, সেই অর্জুন গাছটায় ঠেস দিয়ে। সারারাত দাঁড়িয়ে আছে। গভীর রাত্রে একটি সকরুণ কান্নার সুর শুনে সে উঠে এসে অবধি দাঁড়িয়ে আছে পাথরের মূর্তির মতাে। হাতে তার সখী ঠাকরুনের পদ্মবীজের মালাগাছটা। সখী ঠাকরুন বােধ হয় ফেলে দিয়েছিল। সেটা আবার সখী ঠাকরুন ফিরে নেবে কিনা কে জানে!