সকল গৃহ হারালো যার – তসলিমা নাসরিন

›› প্রবন্ধর অংশ বিশেষ  

…..দ্বিখণ্ডিত বইটি নিয়ে বিতর্কের একটি বড় কারণ, যৌন স্বাধীনতা। আমাদের এই সমাজের বেশির ভাগ মানুষ যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক সংস্কারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, তাই একজন নারীর যৌন স্বাধীনতার অকপট ঘোষণায় বিরক্ত, ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ। যে যৌন স্বাধীনতার কথা আমি বলি, তা কেবল আমার বিশ্বাসের কথাই নয়, নিজের জীবন দিয়ে সেই স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেছি, অথচ যে কোনও পুরুষ আমাকে কামনা করলেই পাবে না। এই সমাজ এখনও কোনও নারীর এমন স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত নয়। প্রস্তুত নয় এটা শিরোধার্য করতে, যে, কোনও নারী তার ইচ্ছে মত পুরুষকে সম্ভোগ করতে পারে এবং তা করেও কঠোরভাবে যৌন-সতীত্ব বজায় রাখতে পারে।….

….পৃথিবীর কত লেখকই তো লিখে গেছেন নিজেদের জীবনের কথা। জীবন থেকে কেবল পরিশুদ্ধ জিনিস ছেঁকে নিয়ে তাঁরা পরিবেশন করেননি। জীবনে ভ্রান্তি থাকে, ভুল থাকে, জীবনে কালি থাকে, কাঁটা থাকে, কিছু না কিছু থাকেই, সে যদি মানুষের জীবন হয়। যাঁদের মহামানব বলে শ্রদ্ধা করা হয়, তাঁদেরও থাকে। ক্রিশ্চান ধর্মগুরু অগুস্ত (৩৩৫-৪৩০) নিজেই লিখে গেছেন তাঁর জীবনকাহিনী, আলজেরিয়ায় তিনি যেভাবে জীবন কাটাতেন, যে রকম অসামাজিক অনৈতিক বাঁধনহীন জীবন কিছুই প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি। তাঁর যৌন স্বেচ্ছাচারিতা, উচ্ছৃঙ্খলতা, জারজ সন্তানের জন্ম দেওয়ার কোনও কাহিনীই গোপন করেননি। মহাত্মা গান্ধীও তো স্বীকার করেছেন কী করে তিনি তাঁর বিছানায় ন্যংটো মেয়েদের শুইয়ে নিজের ব্রহ্মচারিতার পরীক্ষা করতেন। ফরাসি লেখক জ্যঁ জ্যাক রুশোর (১৭১২-১৭৭৮) কথাই ধরি, তাঁর স্বীকারোক্তি গ্রন্থটিতে স্বীকার করে গেছেন জীবনে কি কি করেছেন তিনি। কোনও গোপন কৌটোয় কোনও মন্দ কথা নিজের জন্য তুলে রাখেননি। সেই আমলে রুশোর আদর্শ মেনে নেওয়ার মানসিকতা খুব কম মানুষেরই ছিল। তাতে কি! তিনি তার পরোয়া না করে অকাতরে বর্ণনা করেছেন নিজের ককীর্তির কাহিনী। মাদমাজোল গতোঁ তো আছেই. আরও অনেক রমণীকে দেখে, এমনকী মাদাম দ্য ওয়ারেন, যাঁকে মা বলে ডাকতেন, তাঁকে দেখেও, বলেছেন, যে, তাঁর যৌনাকাঙ্ক্ষা জাগত। বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন (১৭০৯-১৭৯০) তাঁর আত্মকথায় যৌবনের উতল উন্মাতাল সময়গুলোর বর্ণনা করেছেন, জারজ পুত্র উইলিয়ামকে নিজের সংসারে তুলে এনেছিলেন, তাও বলেছেন। বার্ট্রাণ্ড রাসেল তাঁর জীবনীগ্রন্থে লিখে গেছেন বিভিন্ন রমণীর সঙ্গে তাঁর অবৈধ সম্পর্কের কথা। টিএসএলিয়টের স্ত্রী ভিভিয়ানের সঙ্গে, লেডি অটোলিন মোমেলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা কে না জানে! লিও তলস্তয় লিখেছেন চৌদ্দ বছর বয়সেই তাঁর গণিকাগমনের কাহিনী, সমাজের নিচুতলার মেয়ে, এমনকী পরস্ত্রীদের সঙ্গে তাঁর যৌনসম্পর্ক, এমনকী তাঁর যৌনরোগে ভোগার কথাও গোপন করেননি। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন তাঁরা, সমাজ যা মেনে নিতে পারে না, এমন তথ্য পাঠককে শোনাতে গেলেন! শোনানোর নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে। নিজেদের আসল পরিচয়টি তাঁরা লুকোতে চাননি অথবা এই অভিজ্ঞতাগুলো তাঁদের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই শুনিয়েছেন। এতে কি তাঁদের জাত গিয়েছে নাকি তাঁদের আজ মন্দ বলে কেউ? কেউই তাঁদের মন্দ বলে না, যে অবস্থানে ছিলেন তাঁরা সে অবস্থানে তো আছেনই বরং সত্য প্রকাশ করে নিজেদের আরও মহিমান্বিত করেছেন। পশ্চিমি দেশগুলোয় নারী পুরুষ সম্পর্কটি বহুকাল হল আর আড়াল করার ব্যাপার নয়। হালের ফরাসি মেয়ে ক্যাথারিন মিলে তাঁর নিজের কথাই লিখেছেন La vie sexuelle de Catherine M বইটিতে। পুরো বই জুড়ে লিখেছেন ষাটের দশকে অবাধ যৌনতার যুগে তাঁর বহুপুরুষ-ভোগের রোমাঞ্চকর কাহিনী। পুরো বই জুড়ে মৈথুনের নিখুঁত বর্ণনা। এতে কী হয়েছে? বইটিকে কি সাহিত্যের বইয়ের তাকে রাখা হয়নি? হয়েছে। গার্বিয়েল গর্সিয়া মার্কেজও Vivir para contarla বইটিতে পরনারীদের সঙ্গে তাঁর লীলাখেলার কিছুই বলতে বাদ রাখেননি। মার্কেজকে কি কেউ মন্দ বলবে তাঁর জীবনটির জন্য নাকি কেউ আদালতে যাবে বইটি নিষিদ্ধ করতে?……