শোধ – তসলিমা নাসরিন

›› উপন্যাসের অংশ বিশেষ  

………চব্বিশ বছর বয়সী অক্ষতযােনি প্রথম আমি স্বামীর সঙ্গে শুয়েছি। কিন্তু হারুনের মনে ঘন হয়ে একটি মেঘ উড়ছে—বিয়ের সেই রাত থেকেই, বিছানার চাদর সে খুব খুঁটিয়ে লক্ষ করেছিল। জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী দেখছ?

কপাল কুচকে বলেছিল, রক্ত পড়ল না কেন? রক্ত কেন পড়েনি আমাদের প্রথম মিলনে সে আমি নিজেও জানি না, তবে আমার যৌনাঙ্গে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছিল। যন্ত্রণায় আমি কুঁকড়ে ছিলাম, বারবার স্নানঘরে গিয়ে ঠাণ্ডা জল ঢেলে যন্ত্রণা কমাতে চেষ্টা করছিলাম।…….

………অন্ধকারে একা ভিজতে থাকি। অন্ধকারে একা আমি ছবির মেয়েটির মতাে ভিজি। এরপর জানি না কে আমাকে স্নানঘরে নেয়, আমাকে সত্যিকার নগ্ন করায়। জলের তলে স্থির দাঁড় করিয়ে দেয়। কে যেন আমার চোখ আমার শরীরে ফেরায়, আনাচ কানাচের রুপােলি জলে হীরকখণ্ডের দ্যুতি, স্তনবৃন্তে দুফোঁটা জল ফেলে দেখায়, ছবির ওই মেয়েটির চেয়ে সুন্দর দেখতে লাগে কিনা দেখায়। আমি নই, অন্য কেউ আমাকে দেখায়। আমি নই, অন্য কেউ আমার ভেতরে টুপ টুপ করে জল পতনের মতাে ঈর্যার পতন ঘটায়। নিষ্প্রাণ একটি মেয়ের শরীরের সঙ্গে আমার এই রক্ত মাংসের শরীর এক অদ্ভুত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেতে ওঠে। এই অনুভূতিগুলাের আমি কোনও অনুবাদ জানি না।….

……..আমার দুটো হাত আফজালকে ঠেলে সরাতে নেয়, আমার দুটো পা মাটি ছুঁতে চায়, শরীর আফজালের বেষ্টন হতে সজোরে মুক্ত হতে চায়। চুমুতে আমার অপ্রতিভ অবস্থা দেখার পরও আফজাল পাঁজাকোলা করে তুলে ওর নিজের ঘরে নিয়ে যায় আমাকে। দীপু ঠিক এরকম করে শিপ্রাকে তুলে আনন্দ করেছিল, যখন শিপ্রার বাচ্চা হবে খবর ও প্রথম শুনেছিলা আফজালের দু বাহুতে আমার শরীর শিথিল হতে থাকে। আমি না চাইলেও আমার দু হাত আফজালের গলা জড়িয়ে ধরে। ওকে ঠেলে দেবার, সরিয়ে দেবার কোনও শক্তি আমার আর তখন থাকে না। যেন এ আমি নই, আমি হারুনের বউ নই, আমি ঝুমুর নই, আমি শিপ্রা। আর আফজাল কোনও নীচতলার লােক নয়, সেবতির দের নয়, ও দীপু। আমাকে বিছানায় শুইয়ে দেয় আফজাল, আমার আঁচল খসে পড়েছে, চুলের বাঁধন খসেছে, আমি চোখ বুজে থাকি লজায়। বাসরঘরের শিপ্রা চোখ খােলে না শরমে। দীপুর কাছেই তার শরম। দুটো বােজা চোখের পাতায় আফজাল চুমু খায়, চোখ ধীরে ধীরে গােলাপের কুড়ি যেমন ধীরে ফোটে, তেমন করে ফোটে। ফোটা চোখ দেখে সামনে ঝুলছে নগ্ন নারী, সেই স্তনবৃন্তে জল নারী। আমার মুখের ওপর ঝুকে আছে আফজালের মুখ, যেন আমাকে এই প্রথম দেখছে, ও, আমার চুলে কপালে নাকে ঠোঁটে আঙুল-পালকের মতাে আঙুল ছোঁয়াচ্ছে ও।….

……..বিছানা থেকে তুড়িতে উঠে আমি ভাঙা স্বরে বলি, আমার ছবি আঁকবেন বলেছিলেন…, তাই।

—আমি তাে নগ্ন মেয়ের ছবি আঁকি। আফজালের চোখে ফোঁটা ফোঁটা মাদক। কণ্ঠেও। আমার মৌনতা আফজালকে সাহসী করে তােলে নাকি ও জন্ম থেকেই সাহসী আমার বােঝা হয় না। আমার কিছু বুঝতেও ইচ্ছে করে না। আফজাল আমার ঠোঁটে, চিবুকে, কণ্ঠদেশে, বুকে চুমু খেতে খেতে শাড়ির বাঁধন থেকে আমাকে মুক্ত করতে থাকে, আমার সংস্কারের বাঁধন থেকে। দ্রুত। আমার নির্জীব হাতদুটো ধীরে ধীরে উঠে আসে আফজালের পিঠে, খােলা পিঠে। পিঠ থেকে চুলে, আঙুলগুলাে চুলের ভেতর হাঁটে, চুল থেকে কপাল নাক না কামানাে গাল ঠোঁট চিবুক পেরিয়ে বুকের অরণ্যে হারিয়ে যায়। এ নির্ভুল প্রশ্রয়, এর অনুবাদ আফজাল চাইলে শুনতে পারে, তুমি যা করছ তা আমার ভাল লাগা উচিত নয়, কিন্তু ভাল লাগছে আমার। আরও ভাল লাগছে আফজাল একবারও ছবির ওই নগ্ন মেয়েটির দিকে তাকায়নি বলে। কি ঈর্ষাই না হয়েছিল, আর কি অকিঞ্চিৎকর পড়ে আছে ওই মেয়ে। আফজাল বিন্দু বিন্দু অমৃত ঝরাতে থাকে আমার গায়ে, গােপনে আমি ভিজে উঠতে থাকি।…….

…….বিছানায় এলে হারুন আমার কাপড় চোপড় পরা শরীরের ওপরই চড়ে বসে, পরনের শায়াটি ওপরে তুলে দ্রুত সঙ্গম সারে। সেরে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, একটি বাচ্চা আমার চাই, একটি ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চা।……

……….বােঝার পর এক দুপুরে ঠাণ্ডা জলে গায়ের ঘাম বীর্য দূর করতে করতে সিন্ধান্ত নিই যে আমি আফজালের বীর্য থেকে গর্ভবতী হব, হারুনের বীর্য থেকে নয়। ঋতুস্রাবের পর দশম থেকে ষােড়শ দিন গর্ভবতী হওয়ার দিন, সেবতি আমাকে বলেছে অনেক। সিদ্ধান্ত নিই দশম থেকে ষােড়শ—এই সাতটি দিন হারুন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকব, বাকি দিনগুলো সে আমার শরীরে বীজ বপন করবে তার সন্তানের। না, হারুনকে আমি আমার উর্বর। জমি দেব না। সে রাতভর উলুবনে তার মুক্তো ছড়াবে। তারপর বসে থাকবে আশায় আশায়, সন্তানের আশায়। সুভাষের নয়, আরজুর নয়, তার নিজের সন্তানের আশায়। এই সিদ্ধান্তের জন্য আমার ভেতর কোনও পাপবােধ জাগে না। বরং মনে হয় আমি হারুনকে ফিরিয়ে দিচ্ছি তার প্রাপ্য। এর নাম প্রতারণা নয়, ব্যভিচার নয়। স্বামীর প্রাপ্য বলতে সে যা বােঝে, সংসারে দিনের পর দিন আত্মীয়হীন বন্ধুহীন জীবন কাটানাে, স্বামী এবং স্বামীর আত্মীয়দের তুষ্ট রেখে নিজেকে অকিঞ্চিৎকর তুচ্ছ প্রাণীতে পরিণত করা—আমি করেছি । ……..

……….সেবতি বলে, আমার এই দেবরটাকে নিয়ে পারি না বুঝলে। সারাদিন ন্যাংটো মেয়ের ছবি আঁকে। বাড়িতে কোনও অতিথি এলে লজ্জায় পড়ি। ও দ্রুত আড়াল করতে থাকে বারান্দায় পড়ে থাকা আফজালের আঁকা ছবি। নতুন নগ্ন নারী, কে এ? পিঠে এলিয়ে পড়া কালাে দীঘল চুল, দিঘির জলের মতাে দুটো কালাে চোখ, সুগােল স্তন-লাজ রাঙা মুখটি কার? আমার নয় তাে! উৎকণ্ঠায় কণ্ঠ শুকোয়।……..

……..আফজালের সঙ্গে মাসের সাতদিন আমার সম্পর্ক হয়েছে। সে দিনগুলােয় হারুনকে বলেছি আমার শরীর ভাল লাগছে না, পেট ব্যথা হচ্ছে, মাথা বনবন করছে, ঘুম পাচ্ছে এসব। সাতদিন আমি হারুনকে আমার শরীর স্পর্শ করতে দিই না! সাতদিন পার হলে মরার মতাে শুয়ে থাকি, হারুন আমাকে এক রাতে যত ইচ্ছে গ্রহণ করে, একেবারে তুষ্ট না হলে দুবার, দুবারে না হলে তিন চার পাঁচ যতবার খুশি। হারুন প্রাণপণে আমার শস্যক্ষেত্রে বীজ বপন করতে থাকে। বীর্যের প্লাবন বয়ে যায়। আমাকে বিছানা থেকে উঠতে দেয় না সে, স্নানঘরে যেতেও দেয় না। ধুয়াে না কিছু, এভাবেই শুয়ে থাকে। তার ভয় আমি গা ধুলে কিছু না আবার জলের সঙ্গে চলে যায়। মনে মনে হাসি আমি।………..

Leave a Reply