বাঙালি নারীর কাছে শাড়ি তার সারা শরীর জড়িয়ে রাখা এক কাপড়ের একটা দীর্ঘ স্বপ্নখচিত জড়োয়া গয়না। যুগে যুগে এই পোশাককে বিচিত্র শব্দে–বর্ণে মহিমান্বিত করেছেন লেখক–সাহিত্যিকেরা। তবে বর্তমানে নারীদের মধ্যে কমে গেছে শাড়ি পরার চল। শাড়ি নিয়ে বিশেষ এ আয়োজনে লিখেছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।
শাড়ি পৃথিবীর সবচেয়ে যৌনাবেদনপূর্ণ অথচ শালীন পোশাক। শুধু শালীন নয়, রুচিসম্পন্ন, সুস্মিত ও কারুকার্যময় পোশাক। নারী শরীরকে যতটুকু অনাবৃত রাখলে তা সবচেয়ে রহস্যচকিত হয়ে ওঠে, পোশাক হিসেবে শাড়ি তারই উপমা। শরীর আর পোশাকের ওই রমণীয় এলাকা বিভাজনের অনুপাত শারীর রচয়িতারা কি জেনে না না–জেনে খুঁজে পেয়েছিলেন, সে কথা বলা না গেলেও এর পেছনে যে গভীর সচেতন ও মুগ্ধ শিল্পবোধ কাজ করেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। আধুনিক শাড়ি পরায় নারীর উঁচু-নিচু ঢেউগুলো এমন অনবদ্যভাবে ফুটে ওঠে, যা নারীকে করে তোলে একই সঙ্গে রমণীয় ও অপরূপ। শাড়ি তার রূপের শরীরে বইয়ে দেয় এক অলৌকিক বিদ্যুৎ হিল্লোল।
না, সব দেশের মেয়েদের শাড়িতে এমন অপরূপ লাগবে না। পৃথিবীর কোনো কোনো এলাকার নারী শরীরেই কেবল শাড়িতে এ অলীক রূপ ফুটে ওঠে, বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রিয়দর্শিনী সুকুমারী তন্বীদের দেহবল্লরীতে—সে বাংলা, পাঞ্জাব বা উত্তর ভারতের—যেখানকারই হোক। বিশালদেহী আফ্রিকার নারীর জন্য এ পোশাক নয়, জার্মান বা ইংরেজ নারীর উদ্ধত সৌন্দর্যেও এ পোশাক হয়তো খাপ খাবে না। শাড়ি সুকুমার ও নমনীয় শরীরের জন্যই কেবল সত্যিকার অর্থে মধুর। হয়তো উপমহাদেশের বাইরে একধরনের মঙ্গোলীয় নারীকেও শাড়িতে ভালো লাগবে তাদের শারীরিক কমনীয়তার জন্য। কিন্তু পোশাকটি তাদের ভেতর প্রচলিত নয় বলে সে কথায় এখন যাব না। এটি ভালো লাগে বিপুলসংখ্যক উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয় মেয়েদের। যদি বাঙালি মেয়েদের প্রশ্ন ওঠে তবে বলব, এটি ভালো লাগে প্রায় প্রত্যেকটি বাঙালি মেয়েকে। সত্যি কথা বলতে কি, অধিকাংশ বাঙালি মেয়েকে শাড়ি ছাড়া আর হয়তো কিছুতেই মানায় না। এ জন্য তাদের প্রকৃতিগত পোশাক—তাদের সহজাত রূপের অংশ।
কেন, তা নিয়ে একটু ভাবা যাক।
কোনো এক কবিতায় কবি ওমর আলী লিখেছিলেন, ‘এ দেশের শ্যামল রং রমণীর সুনাম শুনেছি।’ কেন এই শ্যামল নারীদের রূপের এত সুনাম? এর কারণ তিনি ব্যাখ্যা করে বলেননি, কিন্তু তাই বলে গড়পড়তা বাঙালি নারী রূপের দিক থেকে পৃথিবীর সেরা সুন্দরীদের মধ্যে পড়ে এ বললেও যেন কিছুটা বেশি শোনাবে। বাঙালি পুরুষদের ব্যাপারেও হয়তো তা–ই। ইংল্যান্ডের কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: এখানে রাস্তায় বেরোনোর বড় সুবিধা যে থেকে থেকেই সুন্দর মুখ দেখতে পাওয়া যায়। বাঙালি জাতির বেলায় কথাটা হয়তো ওভাবে খাটবে না। তবে মাঝে মাঝে এ দেশেও যে এক–আধজন সুন্দর মুখের দেখা পাওয়া যায় না, তা–ও নয়। তবে একটিমাত্র কারণেই কেবল তা হতে পারে; যদি তারা তাদের কমনীয় শাড়িগুলোকে নান্দনিক বা সুরুচিসম্মতভাবে পরতে পারে। রবীন্দ্রসংগীতের সুরের সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীতের অনিন্দ্য কথা যোগ হলে যা হয় আমাদের প্রিয়দর্শিনী ললনারা তখন তা–ই হয়ে যায়।

বাঙালি সৌন্দর্যের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা: আমার ধারণা ‘উচ্চতা’। সবচেয়ে কম যে উচ্চতা থাকলে মানুষকে সহজে সুন্দর মনে হয়—যেমন পুরুষের ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি ও মেয়েদের ৫ ফুট ৫ বা ৬ ইঞ্চি—আমাদের গড় উচ্চতা তার চেয়ে অন্তত ২–৩ ইঞ্চি কম। দৈহিক সৌন্দর্য ছেলেদের বড় ব্যাপার নয় বলে এ নিয়েও তারা কোনোমতে পার পেয়ে যায়। কিন্তু আটকে যায় মেয়েরা। আমার ধারণা, একটা মেয়ের উচ্চতা অন্তত ৫ ফুট ৪–এর কম হলে তার শরীরে নারীজনিত গীতিময় ভঙ্গি পুরোপুরি ফুটে ওঠে না। এরপর তাদের দৈর্ঘ্য ৫ ফুট ৫, ৬ বা কিছু পরিমাণে ৭ ইঞ্চি পর্যন্ত উঠলে তা ক্রমাগত অলীকতর হয়ে উঠতে থাকে।
বাঙালি মেয়েরা বিপদে পড়ে এখানটাতেই। এদের গড় উচ্চতা ৫ ফুট ২ থেকে ৩ ইঞ্চির সামান্য এদিক–ওদিকে (অবশ্য ১০ শতাংশ মেয়েকে বাদ দিয়ে ধরলে)। এই উচ্চতা নিয়ে ললিত–মধুর ও দীর্ঘাঙ্গী নারীর কমনীয় শরীর নিয়ে ফুটে ওঠা কঠিন, যা দেখা যায় এই উপমহাদেশের উত্তর দিকের নারীর উন্নত দেহসৌষ্ঠবে। ওই অঞ্চলের মেয়েদের তুলনায় বাঙালি মেয়েদের আরও একটা জায়গায় ঘাটতি আছে। মনে রাখতে হবে, বাঙালিরা একটু বেশি রকমের মিশ্র জাতি। নানা জাতির দৈহিক বৈশিষ্ট্য এ জাতির মানুষের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গে অমিলভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। কিছুটা অবিন্যস্তভাবে, তাই বাঙালি মেয়েদের দেহ গঠন উপমহাদেশের উত্তরাংশের মেয়েদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অসম। যেকোনো অসমতাকে আড়ালে রেখে মানসম্মত দেহসৌষ্ঠব নিয়ে দাঁড়ানোর পথ একটাই—ইংরেজিতে যাকে বলে মেকআপ—যার গভীরতর মানে মেকআপ দ্য লস। শারীরিক অসমতার এত ঘাটতি থাকার পরও অন্যান্য মেকআপের মতো রূপকে নিটোলতা দেওয়ার মতো এক অনন্য সাধারণ মেকআপ রয়েছে বাঙালি মেয়েদের ভাঁড়ারে। আমার মতে, এর নাম ‘শাড়ি’। আগেই বলেছি, উচ্চতার কারণে উপমহাদেশের উত্তরাংশের গড়পড়তা মেয়েদের শাড়ি বা সালোয়ার–কামিজ দুটোতেই ভালো লাগে। কিন্তু ওই কাম্য উচ্চতার অভাবে বাঙালি মেয়েদের শাড়ি ছাড়া আর যেন কোনো গতিই নেই। আজ বাঙালি মেয়েরা সেই শাড়িকে প্রায় ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিচ্ছে। আজকাল শাড়ি ছাড়া অনেক রকম কাপড় পরছে তারা—সালোয়ার–কামিজ তো আছেই, পাশ্চাত্য ফ্যাশনের কাপড়ও কম পরছে না—এবং পরার পর ইউরোপ বা ভারতের ওই সব পোশাক পরা সুন্দরীদের সমকক্ষ ভেবে হয়তো কিছুটা হাস্যকর আত্মতৃপ্তিও পাচ্ছে।
আমরা যেন না ভুলি যে এসব পোশাক বাঙালি মেয়েদের দেহ গঠনের একেবারেই অনুকূল নয়। দেহভঙ্গিমারও না। বাঙালি মেয়েদের উচ্চতার অভাবকে আড়াল করে তাদের প্রীতিময় ও কিছুটা তন্বী করে তুলতে পারে একমাত্র শাড়ি। মেয়েরা শাড়ি পরে মাথা বা কাঁধ থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত। এভাবে শাড়িতে শরীর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যেকোনো মেয়ের রূপে কমবেশি দীর্ঘাঙ্গি বিভ্রম দেখা দেবেই, ঠিক যে কারণে দীর্ঘ পাঞ্জাবি বা শেরওয়ানি পুরুষদের শরীরে দীর্ঘদেহিতার বিভ্রম জাগায়। এতে সঠিক উচ্চতার তুলনায় তাদের কিছুটা বেশি দীর্ঘ লাগে। মেয়েদের ব্যাপারেও তা–ই। ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার মেয়েদের ভুল করে এভাবে মনে হতে পারে ৫ ফুট ৪ ইঞ্চির মেয়ে! আর সেই সঙ্গে তাদের চিরস্থায়ী হাইহিলের উচ্চায়ত রহস্য তো রয়েছেই।

শাড়ি একটা রহস্যময় পোশাক। নারী দেহকে কতটা প্রদর্শন করলে আর কতটা অপ্রকাশিত রাখলে তা শারীরিক মোহ বজায় রেখেও দর্শকের চোখে অনিন্দ্য হয়ে উঠবে, তা পোশাকটি যেন সহজাতভাবেই জানে।
শাড়ি ছাড়া এমন জাদুকরি রহস্য আর পরস্পরবিরোধী মাধুরী আছে কোন পোশাকে? শরীর নিয়ে এমন শিল্পিত খেলা আর কে খেলতে পারে? সালোয়ার-কামিজ, টাইট জিনস, মিনি স্কার্ট কি এর সমকক্ষ? শেষেরগুলো তো প্রায় পোশাক না থাকারই শামিল। জাপানি কিমোনোর রং ওদিকে আবার বেশি রকম উচ্চকণ্ঠ। শরীরের সহজাত মাধুর্যকে এ প্রায়শই ছাপিয়ে যায়। বাকি পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই পোশাক হয় শরীরটাকে রমণীয় গুদামঘর বানিয়ে রাখে, নয়তো প্রায় বিবসনা করে রগরগে যৌনতার মৌতাত উদ্যাপন করে।
শাড়ির মধ্যে আছে এই দুইয়ের মিলিত জাদু। এ সৌন্দর্যের লালসাকেও বাদ দেয় না আবার আলোয়–ছায়ায়, মেঘে-রৌদ্রে শরীরকে যেন স্বপ্নরাজ্য বানিয়ে দেয়।
আগেই বলেছি, নানা জাতির দৈহিক বৈশিষ্ট্য একত্র হওয়ায় বাঙালির শরীর অধিকাংশ সময় সুগঠিত নয়। এই ত্রুটিকেও শাড়ির রুচি স্নিগ্ধ–শৈল্পিক আব্রুর মধ্যে এনে যেন বাঙালি মেয়েকে প্রাণে বাঁচিয়ে দেয়।
তাদের শরীরের অসম অংশগুলোকে লুকিয়ে ও সুষম অংশগুলোকে বিবৃত করে শাড়ি এই দুর্লভ কাজটি করে।
শাড়ির আরেকটা দিক আছে, যা দীর্ঘ বা মধ্যম উচ্চতার সব মেয়েকেই প্রিয়দর্শিনী করে তোলে। সেটা হলো এর সহজ প্রীতিময়তা।
কোনো মেয়ে শাড়িতে সুন্দর হয়ে উঠতে চাইলে তার শরীরকে শাড়ির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য তাড়াহুড়ো করতে হয় না। বিনীত শাড়িই তার কোমলতা দিয়ে ওই শরীরকে সৌন্দর্যে ফুটিয়ে তোলার দায়িত্ব নিয়ে নেয়। শাড়ি সারা শরীর জড়িয়ে রাখা এক কাপড়ের একটা দীর্ঘ স্বপ্নখচিত জড়োয়া গয়না। বৈচিত্র্যে, সৌন্দর্যে কারুকার্যে প্রায় তুলনাহীন। আমাদের সোনালি ধানখেতগুলো যেন গোটা বাংলাদেশকে নানান বাঁকে জড়িয়ে দেশজুড়ে বয়ে যায়, শাড়িও তেমনি নারীর শরীরে সৌন্দর্যের প্রতিটি ঢেউ আর সরণিকে আঁকাবাঁকা, উঁচু-নিচু ভঙ্গিতে বিন্যস্ত করে আঁচলের কাছে এসে একঝাঁক সাদা পায়রার মতো নীল আকাশে উড়তে থাকে।
শাড়ি বা কিমোনোর মতো ঐতিহ্যময় পোশাককে হটিয়ে সালোয়ার-কামিজ, স্কার্ট, মিনি স্কার্ট, ট্রাউজার, শার্ট যে একালের মেয়েদের মন কাড়ল তার কারণ এই নয় যে শাড়ি বা কিমোনো পোশাক হিসেবে ভালো নয়, এর কারণেই কর্মব্যস্ত ঊর্ধ্বশ্বাস যুগের অকর্ষিত রুচি চাহিদা। জীবন প্রয়োজনের ক্লেদাক্ত চাপ শিল্পকে হটিয়ে দিয়েছে। এ যুগ সৌন্দর্যের পরিশীলনকে জানে না। সে বোঝে শুধু একটা জিনিস; লেস ইজ মোর। এই লেসের আক্রমণে মানুষের পোশাকরুচি তার শরীরের সমস্তরে নেমে গেছে।
আমার মনে হয়, এ রকম একটা অপরূপ পোশাককে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে বাঙালি মেয়েরা সুবুদ্ধির পরিচয় দেয়নি।
সমালোচনা
অধ্যাপক সায়ীদের শাড়ি ও সুশীলের নয়া কামসূত্র – শারমিন শামস্
২০১৯ সালে এই ভন্ডামী প্রতিষ্ঠিত মডারেট মুসলিম সুশীল সমাজের বুদ্ধিজীবীদের নেতায়ে পড়া বৃদ্ধ যৌনাঙ্গকে ফের দন্ডায়মান করতে ঠিক যে ফরমেটে একখানা কামসূত্র লিখে এক জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য পাতায় ছাপাইলে সেই নেতানো বস্তু দুই-তিন মিনিট কর্মক্ষম রাখা যাবে, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের শাড়ি নামের বস্তুটি ঠিক সেই ফরমেটেই লেখা! এই কামসূত্রটি পড়তে পড়তে মনে হইলো, এই একবিংশ শতাব্দীতে এতো পথ পাড়ি দেয়ার পরও মানুষ জাতির অন্তর্গত হইতে নারীর যে লড়াই, তা এখনো এই দেশে অতি দূর অস্ত। কারণ শুধুমাত্র অশিক্ষিত মূর্খ অসংস্কৃত লোকেদের ঘরে ঘরে গিয়া চক্ষু খুলবার যে লড়াই আমাদের করতে হবে বলে আমরা ভাবী, আসলে তা একটা ফাপা ভাবনা ও হুদাই প্রচেষ্টামাত্র। সুশীল ও সংস্কৃতবানের মুখোশ এঁটে যে পুরুষতান্ত্রিক পুরষেরা এই সমাজের ভেতরে বসে এখনো কলকাঠি নেড়ে চলেছে, আমরা এখনো তাদের আসল চেহারাটা বুঝেই উঠতে পারি নাই, প্রকাশ করবো কোন উপায়ে? লেখাটা পড়তে গিয়া আমার তীব্র মানসিক ও শারীরিক কষ্ট দুই-ই হইসে। লেখার শুরুর বাক্যই প্রতিষ্ঠা করে, এখনো আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মনের ভেতরের আরাধ্য সমাজের নারী তার গোলগাল স্তন, কোমরের বাঁক, পাছার খাদ, বাহুর কোমলতাসহ তাবৎ পুরুষের মনোরঞ্জন ও চাহিদা মেটানোর একমাত্র লক্ষ্য নিয়া ধরাধামে আবির্ভূত হইসেন। তাই নারীর পোশাক এখনো নারীর শরীর ঢাকা, তাপমাত্রা ও আবহাওয়া থেকে নারীকে রক্ষা করার কাজে যতোটা না দরকার, তা চেয়ে বেশি তার পোশাক পরতে হয়… পুরুষের চোখে তার নারী শরীরকে বাজারে তুইলা বেচার উপযোগী ও আবেদনময়ী করে তোলার প্রয়োজনে। তাই আমার গায়ের বা আমার আম্মার গায়ের শাড়ি এখন আমার বুক, পেট, পাছা ঢাকতে ও গ্রীষ্ম, বর্ষায়, শীতে আমাকে আরাম দিতে যতোটা না দরকার, তার চেয়ে বেশি জরুরি এইটা যে, এই শাড়ি পইরা আমি সায়ীদ স্যারসহ তাবৎ পুরুষকুলের শইলে কতোটা আগুন জ্বালাইতে পারলাম… সেইটা।
নারী জন্মের মুখ্য কর্ম যেহেতু পুরুষের শইলে আগুন জ্বালানো ও নিভানো এবং আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতে সেই কাজটা শাড়ির চায়া ভালো কোনো পোশাক করতে পারে না, তাই বাঙালির সমাজের নপুংসক পুরুষের ন্যাতানো অঙ্গের চিকিৎসার্থে শাড়ি অবশ্যই খুব ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থা, এই কথা সায়ীদ ভুল বলেন নাই। রবীন্দ্রনাথ বৈদেশ গিয়া মিনিটে দশটা কইরা সুন্দর নারী দেইখা চক্ষু জুড়াইতেন। সায়ীদের মনে তীব্র আফসোস, এই দেশে ঘণ্টায় মাত্র এক আধজন কইরা সুন্দরী রমণীর দেখা তিনি পান, যাদের দেইখা তার মনে ও শরীরে আগুন জ্বলে। সংখ্যাটি অত্যন্ত কম, এটি নিঃসন্দেহে আফসোসেরই ব্যাপার। নারীর একমাত্র কাজ যদি পুরুষের শরীর সেবা ও ক্ষুধা নিবারণই হয়া থাকে, তবে আমাদের দেশের খারাপ চেহারার নারীদের উচিত সেই কাজটা মন দিয়া করা। কী করলে শইলের ভাঁজ আরও গাঢ়মতো ফুইটা উঠবে, পাছার খাদ স্পষ্ট হবে, বুকের দুধের উচ্চা-নিচা টকটকায়া সকল আলোকিত পুরুষের ঢেউ তুলবে, এটি নিয়া আমাদের আরও আগে ভাবা উচিত ছিলো। আমরা বেহায়া বেশরম দেখতে খারাপ বুদ্ধিহীন নারীরা সেটি না করে, শাড়ি পরা কমায়ে দিসি। এর বদলে আমরা এমন পোশাক পরতেসি যেটি পইরা ঘরে বাইরে কাজ কাম চাকরি বাকরি পড়াশোনা করতে সুবিধা হয়, সময় নষ্ট কম হয়, দৌঁড়ঝাপ করা যায়! কতো বড় বুদ্ধিহীন আমরা দেখেন। অথচ ‘শাড়ি একখান সর্বশ্রেষ্ঠ যৌনাবেদনময় পোশাক।’ এটি পইরা কি সুন্দর শইল সামান্য বাইর সামান্য ভেতরে থাকে। রহস্য খেলা করে। সেই রহস্য পুরুষ শইলে দোলা দেয়। এই দোলাটা তাদের দরকার। কেননা তারা জগতে বিজ্ঞান প্রযুক্তি রাজনীতি সমাজনীতি সাহিত্যসহ বড় বড় কাম কইরা দুনিয়া চালান। এই দুনিয়া চালাইতে চালাইতে তাদের যখন সেক্সের দরকার হয় তখন তারা নারীর শইল দেখেন, চাটেন, সেক্স করেন এবং রিচার্জ হইয়া ফের কামে যান। তো এখন নারী যদি দেখতে খারাপ হয়, নারীর যদি উচ্চতা কম হয়, নারীর যদি বুক ছোট হয়, পাছা কম মোটা হয়, কোমর ভারি না হয়, যা কিনা বাঙালি নারীর জাতিগত বৈশিষ্ট্য, তো বাঙাল পুরুষের শইল তাইলে জাগবে কেমনে! কীভাবে তারা জগত সংসারের তাবৎ কাম করবে যদি তার দ- শীতল না হয়?
বাঙালি নারী এই তাবৎ পুরুষকুলের কথা চিন্তা করে না। তারা ইদানীং বড় বাড় বাড়ছে। তাদের শইলে আর শাড়ি দেখা যায় না। তাদের খুঁত ঢাকার কথা তাদের মনে থাকে না। পুরুষের চোখে আবেদনময় হয়ে ওঠার চিন্তা আর তারা ইদানীং করে না সেইভাবে। তারা এখন খালি নিজেদের কথা ভাবতেসে। পুরুষের শইল গরম করার কথা তাদের মাথায় নাই। শাড়ি পইরা নিজেদের উচ্চতা, পেটের চর্বি, বুকের অপুরুষ্ঠতা, পাছার ভারিত্ব ঢাইকা তারা দিব্যি নিজেদের কামময়ী দেবী হইয়া পুরুষের দরবারে মক্ষীর আসনে বইসা থাকতে পারতো। ডাক আসামাত্র পা জোড়া মেলাইয়া দিয়া দেহদানে প্রবৃত্ত হইতে পারতো। তা নয়। মেয়েগুলোর বড় বাড় বাড়ছে। এরা জিন্স পরে। টি পরে। মিনি পরে। পইরা ভাবে এইভাবে তারা নিজেদের যা ইচ্ছা তাই পরবে। যা ইচ্ছা তাই করবে। পোশাকের মধ্য দিয়া তাদের প্রতিবাদ শুরু হইসে। এখন তারা আস্তে আস্তে সকল দিকে নিজেদের ইচ্ছার বাস্তবায়ন করবে। এমনকি যৌনতার ব্যাপারেও তারা নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, রুচি, চাহিদা প্রকাশ করতে শুরু করছে। এখন এই ধ্বজভঙ্গের দেশে এ বড় আশঙ্কার কথা। চিন্তার ব্যাপার। যে যৌনতা একদিন পুরুষরে রাজাধিরাজ করে রাখছিলো আর নারীকে করে রাখছিলো আলমিরাতে সাজায়ে রাখা যৌন পুতুল, আজ সেই আলমিরা ভেঙে বের হয়ে আসা নারী কইতেসে, ‘আমাদের শইল ক্যামনে জাগবে তা আমরা জানি। আমাদের কী চাই, কারে চাই তাও আমরা জানি। অতএব আমাদের যৌনতাকে আমরাই পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করবো।’ নারীর পোশাকের উপর পুরুষের নিয়ন্ত্রণ পুরুষতন্ত্রের সবচেয়ে আদিম ও কুৎসিততম অস্ত্র। অশিক্ষিত বুদ্ধিহীন পুরুষতন্ত্র পোশাকের উপর নিয়ন্ত্রণ আনে সরাসরি। আর সায়ীদের মতো সংস্কৃতি বেচা মেধাবী বলে পরিচিত পুরুষের নিয়ন্ত্রণের কৌশল আলাদা। এরা জন্মের পর থেকে নারীকে পুরুষের চেয়ে কম, নিচু ও দলিত স্থানে জেনে মেনে ও প্রচার করে এসেছে। নিজেদের শক্তিময় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে নারীকে ব্যবহার করেছে। আজ নারীর জেগে ওঠা ও উত্থান তাদের মনে আতঙ্ক জাগায়। তাদের পায়ের নিচের মাটি কেঁপে ওঠে। তারা তাই সবলে ঐক্যবদ্ধ হতে চায় নারীর বিরুদ্ধে। পুরুষের যৌনতা ও ভোগের জন্য নারীর সেই আদিম একমাত্র জায়গাটিতে তারা নারীকে ফেরত পাঠাতে চায়। আজ তাই এ রকম একটি কুৎসিত আপত্তিকর সেক্সিষ্ট লেখা লিখে সেটা প্রকাশিত হয় জাতীয় দৈনিকে। সেটির ব্যাপক বিজ্ঞাপন হয়। লোকে সেই লেখা পড়ে, মাথা নাড়ে আর কয়, ‘ঠিক ঠিক। কই গেলো সেই স্বর্ণালী দিন যখন মাইয়া মানুষ ছিলো আসলেই মাইয়া মানুষ।’ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের লেখাটি শুধু মডারেট মুসলিম সুশীলের কামসূত্র নয়। এটা পইড়া মনে হইসে, জেগে ওঠা, এগিয়ে যাওয়া, পুরুষতন্ত্রকে নির্মূলের পথে হাঁটা তেজী নারী সমাজের প্রতি তীব্র দ্বেষ, ঘৃণা ও ঈর্ষা জমিয়ে রাখছেন তিনি। সেইসঙ্গে অবদমিত রিপুর অত্যাচারে তিনি ক্লান্ত ও ব্যথিত। যা এই সমাজের অধিকাংশ পুরুষের প্রকৃত অবস্থা। শরীরে মনে ও আত্মায়। আমি আবদুল্লাহ আবু আয়ীদসহ সব বাঙালি সুশীল পুরুষের আত্মার শান্তি কামনা করি। —ফেসবুক থেকে