লাউরা – ব্যারি মার্টিন

›› অনুবাদ  ›› সম্পুর্ণ গল্প  

বিশ্বের শ্রেষ্ঠ আদি-রসের গল্প

অনুবাদঃ তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়
উৎসঃ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ আদি-রসের গল্প
সম্পাদনাঃ সুকান্ত সেনগুপ্ত

দিনে রাতে, শয়নে-স্বপনে, শােকে আনন্দে লাউরাকে আমি ভালােবাসি —চিরদিন তাকে আমি ভালােবাসব। অভিশপ্ত রজনীর ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনার পর থেকে লাউরা সুস্থতা হারিয়েছে। আমি ভয় পেয়েছিলাম ভেবেছিলাম দুর্ঘটনার জন্য আমাকেই সে দায়ী করবে। কিন্তু কিছুই বলেনি সে। সে যে আমায় ভালােবাসে-ঠিক আমি যেমন তাকে ভালােবাসি।

আপনাদের কৌতুহল মেটানাের জন্য সেদিনের বিপর্যয়ের বিষয়ে আমি কিছু বলব। হপ্তা তিনেক আগের ঘটনা। রাত তখন সাড়ে এগারােটা। আমি আর লাউয়া জয়েসের জন্মদিনে পানাহার সেরে ববস-প্লেস থেকে গাড়ি ছুটিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য গাড়িকে আয়ত্তে রাখতে পারবনা সে পরিমাণে মদ আমি খাইনি।

বেশ মনে আছে তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। বাইরে হাড় কাঁপানাে ঠাণ্ডা। হিটারের দাক্ষিণ্যে গাড়ির ভেতরটা উষ্ণ ছিল। মনােরঞ্জনের জন্য গাড়ীতে রেডিও ছিল। মনমাতানাে গান হচ্ছিল রেডিওতে গীতির সঙ্গে সুর মিলিয়ে লাউরা গুন গুন করে গান করছিল, যৌবনােজ্জল পায়ের আঙ্গুল আর গােড়ালি ঠুকে তাল দিছিল। সহসা চেচিয়ে উঠেছিল সে, যীশুর দিব্যি, মন দিয়ে গাড়ি চালাও। ঠিক সেই সময়েই দুর্ঘটনা ঘটেছিল —চুরমার হলাে কাচ, পড়ে যাওয়ার শব্দ হয়েছিল, অতলান্তিক অন্ধকারের মাঝে মিলিয়ে গেল লাউরার কাতর আর্তনাদ।

সেদিন থেকে সে আর আমার সঙ্গে একটা কথাও বলেনি। সেদিন থেকে আমাদের আর তর্কাতর্কি বা কলহ হয়নি। আপনাদের, হয়তো মনে হতে পারে আমাদের দাম্পত্য জীবনে বােধ হয় সুখ শান্তি একেবারেই ছিল না—প্রায়ই আমরা ঝগড়া করতাম। কিন্তু বিশ্বাস করুন, বিবাহিত জীবনে একদিন মাত্র আমাদের রাগারাগি হয়েছিল। আর অকপটেই স্বীকার করি দোষটা সম্পুর্ণই আমার। ব্যাপারটা হয়েছিল কি, মনের ভুলে সিগারেটের জলন্ত টুকরােটি ফেলেছিলাম ডাইনিংরুমের কার্পেটে। পরিণতি কি হয়েছিল জানেন?  আগাগােড়া কার্পেটটি পড়ে গিয়েছিল। বিরােধ কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সাময়িক উত্তেজনা আর কথা কাটাকাটির পর আমাদের ভাব হয়ে গিয়েছিল। আমি যে তাকে ভালােবাসি, সে-ও তাে আমাকে ভালােবাসে।

এখনও কানে বাজছে লাউরার সেই তীক্ষ, চীৎকার—“যীশর দিব্যি, মন দিয়ে গাড়ি চালাও। ঠিক তারপরেই নির্জন নিশীথিনীর শান্তি ভঙ্গ করে গাড়িটি আছড়ে পড়েছিল। আঘাতে আর স্নায়বিক উত্তেজনায় সেদিন থেকে লাউরার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়েছিল। আজও সে নির্বাক মৌন। আমাদের দুর্ভাগ্য। দুর্ঘটনা কখন ঘটবে আগে থাকতে তো কেউ জানতে পারে না। আমার স্থির বিশ্বাস শীঘ্রই সে সুস্থ হয়ে উঠবে। আবার সে কথা বলবে, আমার বাহবন্ধনে ধরা দেবে, তাব আয়ত চোখে ফুটে উঠবে তার প্রেমের গভীরতা।

আগে কত উচ্ছল ছিল লাউরা, এখন সে শ্রান্ত। তাকে দেখি আর চোখ জলে ভরে ওঠে। প্রতিদিন সকালে তাকে শয্যা থেকে তুলে পােষাক পরিয়ে দিতে হয়। মাঝে মাঝে জানালার ধারে একটা চেয়ারে তাকে বসিয়ে দিই-ভয় পাই, দুর্বল শরীর তার আবার ঠাণ্ডা লেগে যাবে না তাে। দিনের শেষে নীল রাতের বিষয় অন্ধকারে তার মিষ্টি গালে আমি চুম্বন করি-বলি, লক্ষী মেয়ে, ঘুমিয়ে পড়ে শীঘ্রই তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে।

‘ডাক্তার ? না, ডাক্তার আমি ডাকি না। কারণ দুটেনার পর লাউরাকে তারা আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। তারা নির্মম, নির্বোধ। সে সময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে তদের গাল দিয়ে বলেছিলাম, জারজ সন্তানের দল, আমার কি করা উচিত কিংবা অনুচিত—তােরা নির্দেশ দেবার কে ?

লাউরাকে আমি ফিরিয়ে এনেছি। আমি দেখেছিলাম কোথায় তারা তাকে নিয়ে গিয়েছিল। আমি চাই সব সময়েই আমার পাশে থাকবে সে। আমি যেমন লাউরাকে ভালােবাসি আপনি যদি তেমন কারােকে ভালােবাসতেন তাহলে আপনিও কি আমার মতাে আপনার প্রেয়সীর তত সান্নিধ্য কামনা করতেন না।

এখানে আর কেউ লাউয়াকে দেখতে আসে না। প্রয়ােজনে-অপ্রয়ােজনে আমার কাছে অনেকেই আসে কিন্তু তারা ভুলেও কেউ লাউরার কথা জিজ্ঞেস করে না পাছে আমার মেজাজ বিগড়ে যায়। তাকে আমি সন্তপণে ওপরের ঘরে লুকিয়ে রেখেছি, কোনদিন নীচে আনিনা। অন্য কারাের সঙ্গ সে আদৌ পছন্দ করে না—সে যে শুধু আমাকেই চায়। সে চায় আমার প্রেম।

আমি জানি অচিরেই আরোগ্য লাভ করবে লাউরা। আবার আমরা ফিরে পাব সেইসব সােনালী দিন ফায়ার-প্লেসের সামনে আবার আমরা বাঁধ ভাঙা হাসি-গল্পের মাঝে রাতের খাবার খাব, হাত ধরে পার্কে ঘুরে বেড়াব, বেড রুমের নিঃসীম অন্ধকার আর নির্জনতায় চুম্বন মদির পান করব, ব্যাকুল বাসনার পরস্পর পরস্পরকে চাইব—একে অপরের মাঝে হারিয়ে যাব।

লাউয়ার প্রেমে আমার জীবনের মূল্য গেছে বেড়ে। তার ভালােবাসার উষ্ণতায় আমি স্নান করি। অঙ্গে অঙ্গে তার উচ্ছল তরঙ্গ-যৌবনের ঝাঁজালাে গন্ধ। বসন্তের স্পন্দন তার উদ্ভিন্ন যুগল স্তনে- উদ্ধত তার গােলাপী স্তনাগ্র চুড়া। হাতের মুঠোয় যখন সৌরভিত তার স্তন চেপে ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করি তখন স্তনবৃন্তকে মনে হয় গােলাপের তরতাজা কঠিন কুড়ি। কামনায় চঞ্চল হয়ে রঙীন নােখে আমার নগ্ন পিঠে আচর কাটে সে– তার কামনা কুসুমিত হয়ে বাইরে ফুটে উঠছে যেন।

তার চোখের মনিতে আমি তখন দেখি নরকের অন্ধকার, বিপর্যয়ের রাতের নিকষ কালাে আর ঠিক তার সাত দিন পরে যেদিন কবরের হিমশীতল প্রকোষ্ঠ থেকে তার নরম দেহটা উঠিয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম সেই গােপন রাত্রির মত মৌন আধারে মাখা তার চোখ দুটি।

লাউরাকে আমি ভালােবাসি। সে আমার চিতা, আমার স্বপ্ন। সে আমার চির দিনের। চির দিন তাকে আমি ভালবাসব।

3 thoughts on “লাউরা – ব্যারি মার্টিন

Leave a Reply